১৭. মহাশ্বেতা স্বামীকে তাগাদা দেয়

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

মহাশ্বেতা স্বামীকে প্রায়ই তাগাদা দেয়, ‘মেজঠাকুরপোর বিয়ের কি করছ, হ্যাঁ গা?’

অভয়পদ নিদ্রালু অন্যমনস্কতার সঙ্গে উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ এই যে, এবার হবে। ‘রোজই ত বলো এবার হবে। কবে হবে? এই ত প্রায় বছর দেড়েক চাকরি করছে, আর কি? আমি যে আর পারি না। খেটে খেটে কি দশা হচ্ছে দ্যাখো দিকি!’

ও পক্ষ থেকে উত্তর আসে না। অভয়পদ ততক্ষণে গাঢ় ঘুমে আচেতন। প্রত্যহই এই রকম চলে। মহাশ্বেতার বিরক্তির অন্ত থাকে না, অথচ উপায় বা কি? দিনের বেলা টিকি দেখবার উপায় নেই লোকটার। অফিসে বেরোয় ত বলতে গেলে রাত থাকতে। শীতকালে সত্যিই রাত থাকে। একই অফিসে ত কাজ করে দু ভাই, কিন্তু হ’লে কি হবে

অম্বিকাপদ নাকি বাবু’ তাই তার ন’টায় হারে আর অভয়পদ মিস্ত্রী তাই তার আটটায়। আবার অম্বিকাপদর আস্পদ্দা কত! বলে কি না, ‘নেহাত কানে খারাপ শোনায় ব’লে বলি মিস্ত্রী, সাহেবরা ত কুলীই বলে! খাতায়-পত্তরে কুলীই লেখা আছে। বাবু! আঠারো টাকা মাইনের বাবু! গা জ্বালা করে মহাশ্বেতার ওর বাবু-বাবু ভাব দেখলে। বাবুর ফরসা কামিজ চাই রোজ– আবার বলে চাদর নেব। যত জুলুম মহাশ্বেতার ওপরই ত–ক্ষার কেচে কেচে পাল্কা ককন করে, হাত তুলতে পারে না এক একদিন। ‘তাও ঐ এক বেয়াড়া মানুষ দ্যাখো না! উনসুনি ইস্টিশান থেকে গাড়ি হয়েছে আজকাল–এই পোন্ কোশ (পৌনে এক ক্রোশ) রাস্তা হেঁটে গিয়ে রেলগাড়ি চেপে গেলেই হয়– যেমন মেজ্ ঠাকুরপো যায়– তা যাবে না। ঐ এক জেদ! হেঁটে যাবেন। এই কটা পয়সা না বাঁচালে আর চলে না। তাও যেদিন সাহেবরা দয়া ক’রে গাড়ি থামিয়ে তুলে নেয় সেদিন বাঁচোয়া– নইলে পুরো চারটি কোশ পথ হেঁটে যাওয়া আর ফেরা!’

গজগজ করে মহাশ্বেতা আপন মনেই

কিন্তু অভয়পদর কানে তা পৌঁছয় না। রাত থাকতে যায় আর রাত্রে ফেরে। ছুটি বলতে এক রবিবার, কিন্তু সেদিনও কি মানুষটাকে হাতের কাছে পাবার জো আছে ছাই! কোথা থেকে যে যত রাজ্যের বাজে বাজে কাজ খুঁজে বার করে! কোথায় হয়ত

বনবাদাড় সাফ করছে, নয়ত দেখ গে কাঠকুটো পাতালতা কুড়িয়ে পাহাড় করছে ত মাটি কাটা বাগান করা ত আছেই। আজকাল আবার মাথায় ঢুকেছে রাজমিস্ত্রীর কাজ

শিখে নিজের বাড়ি নিজেই করবে, সেইজন্যে ছুটি পেলেই কোথায় নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে খুঁজে খুঁজে সেখানে গিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবে।… তাহলে মহাশ্বেতা তার কথাগুলো শোনায় কখন?

এমনি দিনের বেলায় স্বামীর সঙ্গে কথা কওয়ার হুকুম নেই যে কাছে গিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলবে। আড়ালে-আবডালে পেলেও না হয় চট্ ক’রে দু-একটা কথা কয়ে নিতে পারে। ‘তা ও পোড়ার মানুষ কি সেই পাত্তর?’

এক সময় রাত্রিতে! কিন্তু যত তাড়াতাড়িই করুক না কেন, অভয়পদর শুতে আসবার অন্তত দেড়টি ঘণ্টা পরে না হ’লে মহাশ্বেতার ছুটি মেলে না। ওরা দু ভাই একসঙ্গেই প্রায় খেতে বসে, সে ত পাঁচ মিনিট তারপর সেই পাতে বসবে কুঁচোরা– ছোট দেওর আর ননদ। তারা ফেলে-ছড়িয়ে ঝগড়া ক’রে খাবে প্রায় আধঘণ্টা ধরে। তারপর খাবে মহাশ্বেতা। যত রাজ্যের পাতে পড়ে থাকা ভাত কুড়িয়ে জড়ো ক’রে খেতে হয় ওকে। ভাত ফেলবার হুকুম নেই। এর ওপর পান্তাভাত খাওয়া আছে। শাশুড়ীর হুকুম ‘গেরস্তবাড়িতে মাপ মতো ভাত নিতে নেই মা। কে কখন আসে ভিখিরী অতিথ, তা কি বলা যায়? দুপুর বেলা এসে দুটো ভাত পাবে না, ভারি লজ্জার কথা। একেবারে পেট মেপে চাল নেয় যারা তাদের হ’ল গে ডেয়ো-ডোকলার ঘরকন্না। ওতে গেরস্তর ইজ্জত থাকে না

লক্ষ্মীও থাকে না।… নাও না দু মুঠো ভাত বেশি, ফেলা ত যাবে না। না হয় জল দেওয়া থাকবে

– তুমি আমি ত আছিই।’

অবশ্য ভিখিরী আসে প্রায়ই। আর এ বাড়ির এক অদ্ভুত নিয়ম, মুঠো ক’রে চাল দেওয়ার রেওয়াজ নেই– একেবারে পাত পেতে ভাত ঢেলে দিতে হবে তাদের সামনে। তারাও জেনে গেছে, যার যেদিন ভাত খাবার দরকার ঠিক দুপুরবেলা এসে হাজির হয়। যেদিন আসে কেউ সেদিনটাই বাঁচোয়া–নইলে সেই বাড়তি ভাতে জল দেওয়া থাকে, সেইগুলি খেতে হয় মহাশ্বেতাকে। অবশ্য বাড়তি থাকলে শাশুড়ীও খান, কিন্তু তিনি ত খান একবেলা, দুপুরবেলা মাত্র– তাতে আর কত ভাত খাবেন তিনি? তবে আউতি-যাউতিও আছে। পাড়াগায়ে ভাত রাঁধার সময় হিসেব ক’রে কেউ কুটুমবাড়ি যায় না। উঠোনে ঢুকেই হাঁক দেয়, ‘দাও গো–কাঠের উনুনটায় চারটি ভাতেভাত চড়িয়ে।’ পাতা-লতা সব বাড়িতেই আছে, উনুনেরও অভাব নেই। কাউকে বিব্রত করা হবে একথা ভাবে না কেউ। আর সেইটেই রক্ষা–মহাশ্বেতার কাছে।

সে যাই হোক– পাত-কুড়োনো পান্তা যাই জুটুক, মহাশ্বেতার আজকাল গা সওয়া হয়ে গেছে– শুধু যদি একটু আগে ছুটি পেত! সবাইকার খাওয়া যখন শেষ হবে তখন শাশুড়ী হুকুম করবেন, আমাকে অমনি মুঠো খানেক মুড়ি দিও গো বৌমা।’

কিছুতেই আগে বলবেন না। কতদিন মহাশ্বেতা সেধে বলছে–

বসবার আগেই, ‘ও মা, আপনাকে খেতে দিই কিছু?’

নিজে খেতে

দাঁড়াও বাছা, খাবো কি না তাই এখনও বুঝতে পাচ্ছি না। পাড়ার পেটে কিছু না দিলেও নয় তাই। মুখে কি কিছু যেতে চায়?’

১৮৬

অথচ প্রত্যহই খান তিনি। সন্ধ্যা-আহ্নিক শেষ ক’রে সেই যে থুম্ হয়ে রান্নাঘরের দাওয়ায় বসেন– একবারও নড়েন না। হাতে একটা জপের মালা থাকে ঠিকই কিন্তু ইষ্টনামের চেয়ে রসনায় সুখাদ্যের তালিকাই বেশি উচ্চারিত হ’তে থাকে। তাঁর বাপের বাড়ির অবস্থা ভাল ছিল, প্রথম বয়সে তিনি অনেক ভাল ভাল খাবার খেয়েছেন– সেই সব গল্প প্রত্যহই তাঁর করা চাই। এর ভেতর ছেলেরা এসে শেতল দেয়, একে একে খেতে বসে। তাদের সঙ্গে চলে গল্প, তারা করে তাদের অফিসের গল্প, উনি কিছু বোঝেন কিনা বোঝা না গেলেও শোনেন খুব মন দিয়ে। কিন্তু তখনও উনি বুঝতে পারেন না, তাঁর রাত্রে কিছু খাবার দরকার হবে কি না।

একেবারে মহাশ্বেতার খাওয়া হয়ে গেলে তবে ফরমাশ হবে। তখন মুড়ি মেখে দিতে হবে তেল-নুন দিয়ে, তার সঙ্গে উঠোনের শসা থাকতে তা কুঁচিয়ে দিতে হবে– নইলে বসতে হবে নারকেল কুরতে। মুড়ি থাকে কম দিনই– যত রাজ্যের ক্ষুদ ভেজে রাখেন, ওরই মধ্যে বড় গোছের ক্ষুদ ভাজা তেল-নুন মেখে খাওয়া চলে, ছোটগুলো আবার গুঁড়িযে গুড় দিয়ে মেখে দিতে হয়। তা হোক তাতে মহাশ্বেতার আপত্তি নেই। কিন্তু সে শুধু ভাবে– একটু আগে বললে কি হয়? এঁটো বাসন বড়ঘরের তক্তাপোশের নিচে জড়ো করা থাকে, সেখানে রেখে এসে রান্নাঘর ধুয়ে মুছে, পরের দিনের ভাত চড়াবার সব যোগাড় ক’রে রেখে মায় চাল পর্যন্ত ধুয়ে সব কাজ শেষ ক’রে সে এসে বসে শাশুড়ীর সামনে। তখনও পর্যন্ত চলে তাঁর মুড়ি খাওয়া কুডুর কুডুর ক’রে। তাও শুধু খেতে আর কত সময় লাগত? গল্পই বেশি। সেই তাঁর শৈশব ও কৈশোরের কাহিনী তাঁর জগৎ যেখানে থেমে আছে চিরকালের মত।

‘কলকাতা বৌমা, শুনতেই শহর! বলি ঐ ত শ্যামপুকুরের– ওখানে এখনও বাঘ বেরোয়!’

কৈ, তেমন ত কখনও শুনি নি মা।’

‘কে জানে বাছা কেন শোন নি, আমার আইবুড়ো বেলায় দু-দুটো বাঘ মারা হয়েছিল।’

‘সে ত অনেক দিনের কথা মা।’

‘এমন কি আর অনেকদিন বাছা, আমি কি আর আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ী! বিরক্ত কণ্ঠেই উত্তর দেন শাশুড়ী।

ভয়ে ভয়ে চুপ ক’রে যায় মহাশ্বেতা। হয়ত কোনদিন বলেন, ‘ডাক বৌমা ঘোড়ার গাড়িতে যায়। ছ’ কোশ সাত কোশ দূর দূর আস্তাবল আছে, তাকেই বলে ডাকখানা, সেইখানে ঘোড়া বদল হয়, নতুন ঘোড়া জুড়ে আবার গাড়ি চলে।’ ওকে বলে ডাক বদল করা। ঐ ডাকখানাতেই চিঠি-পত্তর ওঠে নামে। বড় বড় লোক রাজা মহারাজারাও অমনি ঘোড়ার ডাক বদল করে দেশ-বিদেশে ঘোরে।’

তন্দ্রালু চোখ দুটি যতদূর সম্ভব বিস্ফারিত করে তাকিয়ে কোনদিন প্রতিবাদ ক’রে বলে, ‘কিন্তু আমি ত শুনেছি মা ডাক এ

2

ক মহাশ্বেতা। হয়ত রেলগাড়িতে যায়।’

দৃঢ়কণ্ঠে প্রতিবাদ করেন শাশুড়ী, ‘আমি বাবার মুখে কত দিন এ গল্প শুনেছি! তিনি কি মিছে কথা বলতেন?’

‘ওমা, সে অনেক দিন আগে বোধ হয়– তাই যেতো।’

‘অ বৌমা-কি তোমার বুদ্ধি বাছা! সরকারী নিয়ম বুঝি ক্ষ্যাণে ক্ষ্যাণে বদলায়! তখন এক রকম যেতো আর এখন এক রকম যায়- তাই কি হয় মা? অমন কথা আর কাউকে বলো না, শুনলে লোকে হাসবে।’

এই চলে বহু রাত্রি পর্যন্ত, কত রাত্রি তা জানে না মহাশ্বেতা–শুধু এইটুকু জানে যে শাশুড়ীর খাওয়া যখন শেষ হয়– তখন নিষুতি রাত থমথম করে। পাড়াঘরে জনপ্রাণীর সাড়া নেই, হয়ত কেউ জেগে থাকে কিন্তু তাদের অস্তিত্ব বোঝবার কোন উপায় নেই– না সাড়ায়, না আলোয়। কেবল যেদিন টগরের বাবা মদ খেয়ে এসে চেঁচামেচি করে আর ওর মা কাঁদে– সেদিনই যা পাড়া সরগরম থাকে। কিন্তু মাতাল শব্দটা শুনলেই চিরদিন মহাশ্বেতার হাত-পা পাথর হয়ে আসে ভয়ে– এখানে এই এত কাছে মাতলামির শব্দে বুকের মধ্যে গুরগুর করতে থাকে। তার চেয়ে মনে হয় ওর, অন্ধকার ঝিঁঝি-ডাকা জোনাকি-জ্বলা নিস্তব্ধ রাত ঢের ভাল।

শাশুড়ীর খাওয়া হ’লে তাকে সব পেড়ে ঝেড়ে রান্নাঘরে তালা দিয়ে গিয়ে নিয়মমত শাশুড়ীর শয়নকক্ষে বসতে হয়। শাশুড়ী পিদিমের আলোয় হাতড়ে হাতড়ে পান সাজেন, ছেলেমেয়েরা কে কি ভাবে শুয়েছে দেখে তাদের সরিয়ে শোয়ান, তারপর বধূর দিকে ফিরে সস্নেহে বলেন, ‘যাও বৌমা, তুমি শুয়ে পড় গে– আর রাত করছ কেন মা? ছেলেমানুষ ঢুলে ঢুলে পড়ছ। যাও– আমার এখানে আর ত কিছু দরকার নেই।’

তবে ছুটি পায় মহাশ্বেতা। কিন্তু ততক্ষণে অভয়পদ অন্য এক রাজ্যে চলে যায়। তাকে বিশেষ দোষ দেওয়াও যায় না। ভোরে যে বিছানা ছাড়ে সে, একেবারে রাতে শুতে যায়, এর ভেতর বিশ্রাম ব’লে কোন শব্দ ওর জানা নেই। শোওয়া ত দূরের কথা, বসতেই পায় না।

মহাশ্বেতার কিন্তু প্রতিদিনই এই সময়টায় রাগ ধরে। এক-একদিন দুঃখে কান্না আসে ওর। শাশুড়ীর মুণ্ডপাত করে সে মনে মনে, ‘রাক্ষুসী ডাইনি! পিন্ডি গিলবে ঠিক জানে, তবু সেটা আগে গিলবে না!’

দড়াম করে কপাট বন্ধ করে সে। ও ঘর থেকে শাশুড়ী প্রত্যহই বলেন, ‘আস্তে বৌমা, আস্তে। ভয় পেলে নাকি?…. অমন করলে কাঠের দোর আর ক’দিন টিকবে বাছা?’ কিন্তু সে ও ঘর থেকেই পরের দিন সকালে আর তাঁর মনে কিছু থাকে না। মহাশ্বেতাও তাই ভয় করে না। দুম্ দুম্ করে চলে সে, অকারণে বাক্স-পেটরার আওয়াজ তোলে, তাতেও যখন অভয়ের ঘুম ভাঙে না তখন বিছানায় শুয়ে পা টিপতে

বসে।

37 3

বড় বৌ!

এইবার একটু হয়ত চৈতন্য হয়। জড়িত কণ্ঠে বলে, এসো এসো, শুয়ে পড়ো। আমার পা টিপতে হবে না– রাত পার হয়েছে।’

3bb

এইটুকু চেতনার অবকাশ নিয়েই মহাশ্বেতা দুটো একটা কথা বলতে যায়– নিতান্ত থাকতে পারে না তাই, কিন্তু একটু পরেই নিজের নির্বুদ্ধিতা নিজের কাছে ধরা পড়ে,তখন চুপ ক’রে যায়। যেদিন খুব রাগ হয় সেদিন অভয়ের কাঁধে এক ধাক্কা দেয়, ‘আচ্ছা মানুষ বটে, শুলো ত আর সাড় নেই! এর চেয়ে পাথরের সঙ্গে ঘর করাও ভাল!’

তখন হয়ত অভয় চোখ মেলে চায়। দুটো-একটা কথাও বলে, একটু বা আদরও করে। সেইদিন হয়ত নিজের বক্তব্য শোনানোও যায়, সংক্ষেপে তার উত্তরও মেলে। তবে সে দৈবাৎ। বেশির ভাগ দিনই নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আপনমনে আসায় সে। তারও পরিশ্রম কম হয় না সারাদিন, তবু যেন ঘুম আসতে চায় না সহজে। অন্তরের ক্ষোভরোষ-অভিমান আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি ব্যর্থ রাত্রির বেদনায় তাকে উত্তেজিত ও উদ্‌ভ্রান্ত ক’রে তোলে। কেবল যখন নিশীথ রাত্রের স্তব্ধতার মধ্যে বিনা বাতাসেই বাঁশঝাড়ের মধ্যে পাকা বাঁশের গা নাড়বার শব্দ ওঠে কট্‌ট্ করে, তখন ভয় পেয়ে শিউরে উঠে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে তার দেহের খাঁজে মুখটা চেপে ধরে। দেখতে দেখতে দু’চোখে তন্দ্রাও নেমে আসতে তখন দেরি হয় না। স্বামীর দেহের সংস্পর্শে ও গন্ধে– সমস্ত বেদনা-অভিমান ধুয়ে-মুছে গিয়ে আশা ও আশ্বাসে ওর নবীন বয়সের কোরক-প্রাণ যেন নতুন করে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে।

দুই

এমনিই একদিন দুর্লভ মুহূর্তে, অভয়পদর পূর্ণ চেতনার অবকাশে উত্তর মিলল মহাশ্বেতার প্রশ্নের, ‘দাঁড়াও আর একটা ঘর করি- নইলে খোকা শোবে কোথায়?’

ভাইকে এখনও অভয় মধ্যে মধ্যে খোকা বলে ডাকে।

উৎসাহের দীপশিখা যেন এক ফুঁয়ে নিভে যায় মহাশ্বেতার, ‘ওমা ঘর করবে তবে বিয়ে দেবে মেঠাকুরপোর! সে ত ঢের দেরি! তাহ’লেই বিয়ে হয়েছে।’

‘না, দেরি আর নেই। দ্যাখো না, শীগগিরই আরম্ভ করছি। খোকার টাকায় ত আমি হাত দিই না, ওটা ওর কাছেই জমছে। ঐতেই ঘরটা ক’রে নেব।’

মহাশ্বেতার অগাধ বিশ্বাস ওর স্বামীর ওপর, তবু সে একটু হতাশ হয়, আপন মনেই বলে, ‘দুর! সে ঢের দেরি!’

সত্যিই কিন্তু লোকটা মাস-কতকের মধ্যেই আরম্ভ করলে। আর সবই কি অদ্ভুত মানুষটার! লোকে মিস্ত্রী ডাকে, যোগাড়ে ডাকে, বাড়ি করায়। অভয়পদ সে ধার দিয়ে ও গেল না। ‘জন’ বা মজুর লাগল ওর দিন-কতক মাত্র, ভিত্‌ খোঁড়া এবং ভিতে খোঁয়া- পেটার জন্যে– তাও রবিবার দেখেই করাতো, যাতে নিজেও তাদের সঙ্গে লাগতে পারে– তারপরের যে কাজ, করত ম্পূর্ণ একা। অফিস থেকে ফিরেই পাঁচি-দুতি একখানা পরে লাগত দেওয়াল গাঁথতে। মশলার তাগাড় ক’রে রাখত নিজেই, ইটও আগে থাকতে বয়ে এনে সাজিয়ে রাখত হাতের কাছে, তারপর লেগে যেত গাঁথুনির কাজে। শুধু মশলা ফুরোলে অম্বিকা খালি কড়াটা নিয়ে গিয়ে তাগাড় থেকে খানিকটা তুলে এনে দিত।

১৮৯

প্রথমটা মহাশ্বেতার হাসি পেয়েছিল, লোকটা কি পাগল! অবশ্য অনেক কিছু জানে মানুষটা, কিন্তু তাই বলে ঘর গাঁথবে মিস্ত্রিদের মত!

–হি-হি, তুমি যেন কি! মিছিমিছি পয়সা অপ্‌চ!

খুব হেসেছিল সে।

কিন্তু তারপরই বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে দেখলে দেওয়াল ত বেশ উঠছে একটু একটু ক’রে! যেমন অন্যদের বাড়িতে ওঠে প্রায় তেমনই!

একদিন কাজের ফাঁকেই স্বামীর কাছে গিয়ে ফিসফিস ক’রে বললে, ‘হ্যাঁগো– এ ত ঠিক দ্যালের মতই দেখতে লাগছে!’

কর্ণিকটা একটু থামিয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে অভয়পদ মুচকি হেসে বলেছিল, ‘তবে তুমি কি ভেবেছিলে ইটের গাঁথুনিটা বাঁশের বেড়ার মত হবে?’

অপ্রতিভ ভাবে মহাশ্বেতা উত্তর দিয়েছিল, ‘না, তাই বলচি।’

>

অফিস থেকে ‘না ব’লে-আনা’ ভারি ভারি কর্ণিক,সাবল, কোদাল– কেমন অনায়াসেই না চলে ওর হাতে! অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে মহাশ্বেতা। পিছন থেকে ঘোমটার আড়াল দিয়ে লক্ষ্য করে, সেই সব ভারী ভারী জিনিস চালানোর সময় ওর প্রশান্ত সুগৌর পিঠের পরিপুষ্ট পেশী-গুলো কেমন ফুলে ফুলে উঠছে, আঁবার পরক্ষণেই মিলিয়ে যাচ্ছে। সুন্দর কপালে ও গলায় ঘামগুলোও যেন কেমন ভাল দেখায়!

নাঃ লোকটা সুন্দর দেখতে তাতে কোন সন্দেহই নেই! আপন মনেই স্বীকার করে মহাশ্বেতা। মাঝে মাঝে ভাবে দাড়িটা না থাকলে হয়ত আরও ভাল হত– আবার এক এক সময় মনে হয় অত ফরসা রঙের সঙ্গে কালো কুচকুচে দাড়ি ভালই মানিয়েছে!

ঘুমন্ত স্বামীকে পিঠে হাত দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘হ্যাঁ গা, গা-হাত-পা একটু টিপে দেব? যা খাটুনি– গা-গতরে ব্যথা হচ্ছে ত খুব?’

জড়িত কণ্ঠে অভয়পদ বলে, ‘না না, তোমাকে আর এই এত রাত্তিরে গা টিপতে বসতে হবে না। তুমি শুয়ে পড়ো।’

কতকটা লজ্জায়, কতকটা ভয়ে ভয়ে পিছন থেকে খুব সন্তপণে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে মহাশ্বেতা।

‘ওর কাছে আমি কতটুকু! মাগো!’

শেষের দিকে দিন-কয়েকের জন্যে একটা মিস্ত্রীও ডাকতে হ’ল। জনও লাগল গোটা-দুই। কিন্তু ঘর সত্যিই এক সময় শেষ হয়ে গেল। পাড়ার লোকে বলাবলি করতে লাগল, ‘এদের আবার বরাত ফিরল! যাই বলো বাপু, রৌটারও পয় আছে।’

কথাটা শুনে মহাশ্বেতার বুক ফুলে ওঠে গর্বে।

ঘরে যেদিন কলি ফেরানো পর্যন্ত শেষ হয়ে গেল

দেখে ঢিপ্‌ করে এক প্রণাম করলে স্বামীকে।

১৯০

শ্বেতা এদিক ওদিক

‘ও আবার কি?’

‘না বাপু, তোমার ক্ষ্যামতা আছে।’

কিন্তু রাগও কম হয় না। শাশুড়ী নিজেই বললেন, ‘এত ক’রে খেটেখুটে ঘরটা করলি, ওটাতে তুই থাক। অম্বিকে বরং এই ছোট ঘরটায় শুক এখন–’

P

উনি বাবু উদারভাবে বললেন, ‘না না আমি বেশ আছি, অম্বিকেই শুক ও ঘরে। আমার কিছু দরকার নেই।

‘কেন রে বাপু, এত আদিখ্যেতার দরকার কি? বলি সন্ন্যোসী ত নই। আমিই ত বড়, আমারই ত আগে পাওনা। যার বিচ্ছিরি হয়, তার সব বিচ্ছিরি!’

পুকুরঘাটে বাসন মাজতে গিয়ে বোধ হয় নির্জন পুকুরের মাছগুলোকেই শোনায় সে। আবার, এতদিন মাইনের টাকা এনে শাশুড়ীর হাতেই দিত, ক-মাস থেকে আদর করে ভাইয়ের হাতে এনে দেওয়া হচ্ছে– ‘তুইই সংসার চালা। ওসব ঝঞ্ঝাটে আমি থাকতে চাই না। তোর ত শেখা দরকার। মা আর কদিন এসব ঝামেলা পোয়াবে?’

‘কেন? মার পরে ত আমিই বাড়ির গিন্নী, আমাকে দাও না?’

বলেওছিল একদিনমুখ ফুটে। তার জবাব এল, ‘তবেই হয়েছে! একে ছেলেমানুষ, তার লেখাপড়া জানো না, তুমি কি হিসেব রাখবে?’

সর্বাঙ্গ জ্বালা করে না কথাগুলো শুনলে? ওঁর মা-ই বড় লেখাপড়া জানেন! তিনি কি ক’রে এতকাল সংসার চালিয়ে এলেন?

কিন্তু রাগ করাও বৃথা। যাকে দরকারী কথাই শোনানো যায় না, তার সঙ্গে ঝগড়া করার ফুরসত কোথা? তারপর এই ধরনের কথা বলতে গেলেই যে কুলুপ এঁটে মুখ বন্ধ করে, আর মাথা খুঁড়লেও মুখ খোলানো যায় না! যেন পাথরের মানুষ।

মনের জ্বালা ক্রমশ জুড়িয়ে যায় মহাশ্বেতার। কেবল সে ঐ নতুন ঘরখানার দিকে কিছুতেই ভাল ক’রে তাকাতে পারে না।

তিন

অম্বিকার বিয়ে ঠিক হল ওদেরই এক বহু দূর-সম্পর্কের ভাগ্নীর সঙ্গে। সম্পর্ক থাকলেও এত দূর যে তাতে বিয়ে আটকায় না। এখন ত নয়ই- তখনও আটকাত না।

এগারো-বারো বছরের ফুটফুটে মেয়ে– নাম প্রমীলা। একশ এক টাকা নগদ, দানের বাসন আর চেলির জোড় এই পাওনা হ’ল ছেলের। উলুবেড়ে থেকে নেমে দেড় ক্রোশ গেলে তবে ওদের বাড়ি। অম্বিকা একটু গজগজ করলে আড়ালে, ‘খুব বে হচ্ছে বাবা, শ্বশুরবাড়ি যেতে গেলে চালচিঁড়ে বেঁধে যেতে হবে! ঠ্যাঙের ওপর কাপড় তুলে আল ধরে আগে তিন কোশ হাঁটো– তবে শ্বশুরবাড়ি পৌঁছবে। দাদাটা যেন কি একটু যদি বুদ্ধি বিবেচনা আছে?’

প্রায় মহাশ্বেতারই বয়সী কিন্তু তার চেয়ে ঢের বেশী সাহস প্রমীলার। অত ছেলেবেলা থেকে আসার জন্যই হোক আর বরাবরই একটু ভীরু-প্রকৃতির বলেই হোক,

১৯১

এখনও মহাশ্বেতা শাশুড়ীর সামনে ভরসা করে যেসব কথা বলতে পারে না, প্রমীলা তা বলে দেয় অনায়াসে। একটু ডানপিটেও আছে। বিয়ের কনে এসেই একদিন গাছে চড়েছিল। সাঁতার কাটতেও ওস্তাদ। জায়ের অকর্মণ্যতায় সে ভেবেই খুন, ‘ওমা দিদি, তুমি সাঁতার জানো না! এসো তোমাকে শিখিয়ে দিই। না না– ভয় কি, আচ্ছা এই ঘড়াটা উপুড় করো– এই দ্যাখো, ভাসছে ত, এবার ওর ওপর বুক দিয়ে হাত-পা ছেড়ে দাও। ভয় কি, আমি ত আছি!’

কিন্তু মহাশ্বেতা ভয়ে কাঁদো-কাঁদো, না ভাই, ও আমি পারব না। না না, তোমার পায়ে পড়ি– আমার বড্ড ভয় করছে।’

হেসে চপল লঘু হাতে এক ঝলক জল ওর চোখে ছুঁড়ে মেরে প্রমীলা বলেছিল, ‘আলগোছ-লতা একেবারে! আচ্ছা থাক– আজ প্রথম দিনটা। তোমায় কিন্তু আমি সাঁতার শিখিয়ে তবে ছাড়বো। দেখে নিও। ‘

উৎসব-বাড়ির সমারোহ শেষ হয়ে আসতেই এ বাড়ির স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা যখন একটু একটু প্রকাশিত হল, তখন প্রমীলা গেল অবাক হয়ে!

‘ও দিদি, এই পুঁইয়ের খাড়া দিয়ে ভাত ঠেলতে হবে দুবেলা? ওমা, এরা কি তরকারি-পাতি খায় না? মাছ কৈ?’

‘তবেই হয়েছে! মাছ? একটু আনাজ পেলে বেঁচে যেতুম! এ বাড়ির ধারা ঐ আনাজ যা, তা পুরুষের পাতে পড়ে, আমাদের বেলা টু-ফুঁ। দ্যাখো দ্যাখো– এই ত সবে শুরু, দিনকতক যাক– বুঝতে পারবে!

বিজ্ঞের মত ঘাড় দুলিয়ে বলে মহাশ্বেতা।

‘বয়ে গেছে! আমি এই দিয়ে খাচ্ছি! আমাকে তুমি তাই পেয়েছ কিনা! এ সব আমি ঢিট ক’রে দিচ্ছি দ্যাখো না!’

পরের দিনই পুকুরে নাইতে নেমে প্রমীলা প্রস্তাব করলে, ‘ও দিদি, গামছার ঐ খুঁটটা ধরো ত ভাল ক’রে!’

‘কি হবে মেজ-বৌ?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মহাশ্বেতা।

মাছ ধরবো। দেখছ না কত মৌরলা মাছ ঝাঁক বেঁধে বেড়াচ্ছে?’

‘ওমা, গামছা দিয়ে মাছ ধরবি! দূর, তাই কখনও হয়?’

‘তুমি দ্যাখো না ধরতে পারি কি না। দুটো-চারটে ঠিক ধরব। ওদের ত গেলা শেষ হয়ে গেছে। বাকী তুমি আর আমি! দুটো-চারটে মাছ ধরতে পারলেই তুলে নিয়ে গিয়ে বাটি-চচ্চড়ি বসিয়ে দেব। নইলে কিনে খেয়ে মরব নাকি? তোমার মত ভাই আঙ্গুল ঠেলে ভাত খেতে আমি পারব না!’

সত্যি-সত্যিই বার-কতক চেষ্টা করতে করতে মুঠোখানেক মাছ ধরলে প্রমীলা মাছগুলো কচুপাতায় মুড়ে পুকুরপাড়ে একটা ইঁট চাপা দিয়ে রেখে প্রমীলা নিশ্চিন্ত হয়ে স্নান করতে নামে। তার স্নান করাও কম নয় অন্ততপক্ষে বার-চারেক এপার ওপার। দুঃসাহসিনীর অসমসাহসিকতার দিকে নিঃশব্দে তাকি

ভেতরে ভয়ে শুকিয়ে ওঠে।

নিঃশব্দে কে

শ্বেতা আর ভেতরে

‘বাটি ক’রে মাছ চাপাবে মেজ-বৌ, মা যদি কিছু বলেন!’

‘ওমা– কী বলবেন? আচ্ছা, সে আমি দেখছি

বাড়িতে ঢুকে প্রমীলা নিজেই গিয়ে শাশুড়ীকে বললে, ‘আজ গোটাকতক মাছ পেয়েছি.মা গামছা-ছাঁকায়–সামান্যই। আর রান্নার হাঙ্গাম না ক’রে একটু বাটিচচ্চড়ি মত চাপিয়ে দিই!’

‘দাও না মা।’ শাশুড়ী বলতে বাধ্য হন, ‘কি মাছ? মৌরলা? কটা মাছ? পারো ত দু-একটা বুড়ী দুগ্‌গার জন্যে রেখো বিকেলে ভাতের সঙ্গে খাবে–’

মাছ বেছে বাটিচস্তড়ি চড়াতে চড়াতে প্রমীলা বলে, ‘এবার যখন ঘর করতে আসব একটা বঁড়শি আর হাত-কতক সুতো আনব, তাহ’লে আর মাছের দুঃখ থাকবে না।’

‘ওমা, মেয়েছেলে হয়ে বঁড়শিতে মাছ ধরবি! লোকে কিছু বলবে না!’

‘কী বলবে লোকে? বলার কি ধার ধারি? তাছাড়া দুপুরে দুপুরে ধরব– লোকে জানতে পারবে না। ছিপ হলে লোকে বুঝতে পারে। ক’হাত মাত্তর মুগা সুতো দেখতে পেলে ত!’

মাস-কতক পরে যখন ঘর-বসত করতে এল প্রমীলা, তখন সত্যিই তার প্যাটরার তলায় দেখা গেল গোটা-কতক বঁড়শি আর খানিকটা সুতো।

মহাশ্বেতা বাঁচল। অবশ্য সব দিনমাছ ধরবার সময় হয় না। কিন্তু আরও অনেক কিছু জানে মেজ-বৌ। ঝিনুক গুলি তোলে এক-একদিন, মাথার কাঁটা দিয়ে ভেতর থেকে মাংসটা বার ক’রে কচুপাতায় সংগ্রহ করে, তারপর চুপিচুপি একটা পিয়াঁজ কুচিয়ে নিয়ে চাপিয়ে দেয় উনুনে। প্রথম প্রথম মহাশ্বেতার ঘেন্না করত এসব খেতে– কিন্তু প্রমীলার পীড়াপীড়িতে খেতে হ’ল– সয়েও গেল ক্রমশ। পিয়াজ আগে আসত না এ বাড়িতে, সেটাও প্রমীলা তার স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া ক’রে ব্যবস্থা করেছে। তাছাড়া এখন ডাঁটার গায়ে একটু আনাজও লেগে থাকে– নইলে প্রমীলা কটকট ক’রে শাশুড়ীকে শুনিয়ে দেয়, ‘ও ডাঁটা ক’গাছাই বা রাখেন কেন মা, আমরা বৌ বই ত নয়– আমরা শুধু-ভাতই বেশ খেতে পারব!

শাশুড়ী অপ্রস্তুত হয়ে বলে, ‘ওমা তা কেন–কাল থেকে আর একটু ক’রে আনাজপত্তর কুটে দিও বড় বৌমা, তোমার বাপু বড্ড দিষ্টিকিপ্পনতা!’

প্রমীলার কাছে আর একটি শিক্ষাও পেলে মহাশ্বেতা, এ সম্বন্ধে ওর কোন জ্ঞানই ছিল না এতদিন।

,

হঠাৎ একদিন পুকুরঘাটে গিয়ে ওর গলা জড়িয়ে প্রমীলা প্রশ্ন করলে, তোর কাছে দুটো টাকা হবে দিদি? তাহলে এই রাসের মেলায় একটা জিনিস কিনব!’

আকাশ থেকে পড়ে মহাশ্বেতা, ‘টাকা! টাকা কোথায় পাবো ভাই?’

‘আহা ঢং! বলে, ‘ন্যাকা ঢং হলসে’ কানা, জল বলে যায় চিনির পানা!’ মেয়েমানুষের টাকা কেনা থেকে আসে?’

কলকাতার কাছে-

আমার বহু

১৯৩

এবার বুঝতে পারে মহাশ্বেতা, ‘হ্যাঁ, সেই মানুষই তোর ভাশুর কিনা! মাইনের পাই-পয়সাটি ত ফি-মাসে তোর বরের হাতেই তুলে দেয়, তুই জানিস না?’

‘ওমা, সে ত গেল সংসার-খরচের টাকা! তা বলে দু’চার পয়সা তোর হাতে দেয় না?’

এক পয়সাও না।

‘মিছে কথা।’

‘এই তোকে ছুঁয়ে বলছি মেজ-বৌ। যা ব’লে দিব্যি করতে বলবি করব।’ খিলখিল করে হেসে ওঠে প্রমীলা। হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে যায়। ‘তুই ভাই একটা আকাট বোকা। সত্যি তোকে দেখলে মায়া হয়। ‘ ‘ওমা, তা আমি কি করব না দিলে–’

‘ওরে হাঁদারাম, এমনি কি কেউ দেয়? আদায়করতে হয়। ঝগড়াঝাঁটি করবি, রাগারাগি করবি, তবে ত দেবে! দু-এক পয়সা মধ্যে মধ্যে না রাখলে তোর হাতে কি থাকবে? মানুষের জন্ম নিয়েছি, হ’লেই বা মেয়েমানুষ, আমাদের কি সাধ-আহ্লাদ কিছু নেই? সংসার-খরচের টাকা থেকে জমিয়ে ওরা কবে সাধ-আহ্লাদ মেটাবে সেই ভরসাতে থাকবি তুই? তবেই হয়েছে!’

আবারও হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে প্রমীলা।

মহাশ্বেতা কাঠ হয়ে বসে থাকে। এ যেন এক নতুন জগৎ নতুন এক চেহারা নিয়ে ওর চোখের সামনে খুলে যাচ্ছে একটু একটু করে। একে দেখে ভয় করে!

১৯৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *