১৮. বয়সের তুলনায় বেশি পাকা

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

ঐটুকু মেয়ে– কিন্তু বয়সের তুলনায় যেন ঢের বেশি পাকা। এরই মধ্যে ওর মতামত স্পষ্ট ও তীক্ষ্ম। বালিকার দেহ থেকে কচি গলাতে যখন পাকা পাকা ভারী কথাগুলো বেরিয়ে আসে তখন রাসমণি সুদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন। ওদের ঝি গিয়ে বলে, ‘মাগো, ওর ওপর বোধ হয় কোন গিন্নীবান্নীর ভয় হয়! কথা বলে দেখেছো- যেন তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে! ওর যেন কোথাও গন্ডা গন্ডা ছেলেপিলে, নাতি- নাতনী আছে, এমনিধারা কথাবাত্রা!’

প্রথম প্রথম ভাল লাগত সকলকারই– সেই যখন চার-পাঁচ বছরেরটি ছিল। এখন একটু বেশি এঁচোড়ে পাকা মনে হয় ঐন্দ্রিলাকে।

কালো রংটা দুচক্ষে দেখতে পারে না সে। যে গয়লা দুধ দেয় তার রং কালো ব’লে দুধ খেতে চাইত না আগে।

‘মাগো, কি বিচ্ছিরি কালো! ঘামলে মনে হয় অলকাতরা গড়িয়ে পড়ছে!

বলেছিল তার সামনেই। উমা ত অপ্রস্তুত।

1

রাসমণি খুব বকে দিয়েছিলেন সেদিন, তার পর থেকে একটু সতর্ক হয়েছে এইমাত্র—কিন্তু রংটার ওপর থেকে বিদ্বেষ যায় নি। কালো মাছ খাবে না মেয়ে– কই, শোল, মাগুর, সিঙ্গি– কিচ্ছু না। যে তিজেলটাতে ওদের মাছ রান্না হয়, সেটা কাঠের জ্বালে কালো হয়ে যায় বলে প্রায় খুঁত-খুঁত করে কিন্তু বেশি আপত্তি করতে সাহস করে না–শুধু রাসমণি যখন না থাকেন তখন উমাকে শোনায়, ‘মাসিমা, তোমরা এখনও তিজেলে রাঁধো কেন? সে ত ঐ পাড়াগাঁয়ের লোকেরা রাঁধে, কয়লা পাওয়া যায় না বলে। তোমাদের তা কয়লার এলঢেল– তবু কাঠ পোড়াও কেন?’

কমলা যখন এখানে আসে– তখন মধ্যে মধ্যে মুখ টিপে হেসে বলে (অবশ্য অনুচ্চ কণ্ঠেই –রাসমণির সামনে বলা সম্ভব নয়), ‘মুখপুড়ী, দেখিস্ ঠিক তোর একটা কালো বর হবে!’

ঐন্দ্রিলা তার পাতলা পাতলা দুটি রক্তিম ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে, ‘ইস্! আমি তার সঙ্গে ঘর করলে ত! সেই দিনই তার কপালে মুড়ি খ্যাংরা মেরে চলে আসব না!’

‘ওলো, তোর কপালেও খ্যাংরা পড়বে তাহ’লে!’

‘কেন?’

খেতে পরতে দেবে কে?’

‘কেন–’ তীক্ষ্মকণ্ঠেই উত্তর দেয় ঐন্দ্রিলা, মাসিমার মত মেয়ে পড়িয়ে খাবো। মাসিমাকেও ত তার বর নেয় না– সে কি উপোস ক’রে আছে? খাচ্ছে পরছে না?’

‘চুপ চুপ!’ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কমলা। এঁচোড়ে-পাকা মেয়েকে ঘটানোই ভুল হয়েছে ওর। উমা যদি শুনতে পায়, ছি ছি!

গলা নামিয়ে বলে, ‘ওসব কথা তোমাকে বলতে নেই মা, ছি! ছোট মুখে বড় কথা শুনলে দিদিমা বড় রাগ করবেন।’

মুখ ঘুরিয়ে উত্তর দেয় ঐন্দ্রিলা, ‘দিদিমার কথা ছেড়ে দাও, সব তাইতেই রাগ!’

কমলা যে কথাটা বলতে পারত সেটা হচ্ছে এই যে, মাসিমার মত মেয়ে পড়িয়ে খেতে গেলে নিজের কিছু লেখাপড়া শেখা দরকার। অথচ ওটাতে কিছুতেই ঐন্দ্রিলা কোন উৎসাহ বোধ করে না। উমা হার মেনে গেছে–দু’বছর ধরে দ্বিতীয় ভাগের গন্ডী আর পার হতে পারছে না মেয়ে কোন মতেই। অথচ সংসারের কাজে-কর্মে দ্বিগুণ উৎসাহ। প্রায়ই ভোর চারটেয় উঠে দিদিমার সঙ্গে গঙ্গায় স্নান করতে যায়। তা যেদিন হয়ে ওঠে না, সেদিন ফেরবার আগেই স্নান সেরে পুজোর আয়োজন ক’রে রাখে নইলে তাঁর সঙ্গে ফিরেই তাড়াতাড়ি চন্দন ঘষে ফুল বেলপাতা সাজিয়ে ঠিক করে দেয়। রাসমণি প্রত্যহ শিবপূজা করেন– তারই যোগাড়। তারপর উমার সঙ্গে রান্নার কাজে লেগে যায়। কুটনো কোটা, দুধ জ্বাল দেওয়া ত বটেই– এখন রান্নাও করতে বসে এক-একদিন। উমা ওকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে কিসে কি হয়ে যাবে, পুড়ে-ঝুড়ে যাবে হয়ত

পরের মেয়ে তায় আইবুড়ো, তখন সারা জীবন তাকেই কথা শুনতে

হবে। কি দরকার বাপু! কিন্তু ঐন্দ্রিলা শোনে না কোনমতেই। রাগ করে, ঝগড়া করে, অভিমান করে। রাসমণিও বলেন, ‘দে দে–রাঁধতে চায় ত রাঁধতে দে। কোন্ দুঃখীর সংসারে গিয়ে পড়বে, সেখানে শুধু ত হাঁড়ি ঠেলা নয়– জুতো সেলাই থেকে চন্ডীপাঠ সবই করতে হবে হয়ত। যেমন মহাটার হচ্ছে। একটু অভ্যাস থাকা ভাল।’

ঘর-সংসারের সব কাজেই ওর সমান মন। ‘সেজ’-এর আলো জ্বলে সারারাত– সে সব সাজানো, আজকাল কেরোসিনের আলো হয়েছে, তা ঝাড়ামোছা করা— বিছানা পাতা– উমা যখন থাকে না তখন সব করে সাজিয়ে রেখে দেয়। এসবগুলো যে ক্লান্ত উমাকে ফিরে এসে করতে হয় না, সেজন্য উমা বরং কৃতজ্ঞ। এমন কি বিকেলের খাবারের আয়োজনও সে ঠিক ক’রে রেখে দেয়– কুটনো কুটে উনুন সাজিয়ে ময়দা মেখে– উমা এসে কাপড় কেচে আহ্নিক করতে গেলে উনুনে আঁচও সে দিয়ে দেয়। তারপর যাহোক তরকারি আর রুটি, ওদের দুজনের মত একটু রান্না– কতক্ষণই বা লাগে!

রাসমণি রাত্রে একটু দুধ ছাড়া কিছু খান না। আজকাল দিন-রাতের ঝি রাখা হয় না– প্রধানত ক্ষমতার অভাব গিরিবালা এসে কাজকর্ম সার দিয়ে চলে যায়। মাসিক দুটাকা মাইনে তার– খাওয়াপরার কোন দাঁ

শীতকাল হলে এক-

১৯৬

একদিন উমা দুপুরেই রান্না ক’রে রেখে দেয়, বিকেলে কাঠের জ্বালে ঐন্দ্রিলা শুধু দুধ জ্বাল দেয় আর সকালের তরকারিটা গরম ক’রে রাখে।

শ্যামা মধ্যে মধ্যে চিঠি লেখে মাকে, ‘ঐন্দ্রিলার জন্য শহরের দিকে একটা পাত্র দেখুন মা। ও আমার গর্ভের সব চেয়ে সুন্দর ফল, এই সব বনগাঁয়ে ধান সিদ্ধ করা আর গোয়াল সাফ করবার জন্যে বিয়ে দিতে মন চায় না।

উমার চিঠিতে যা পড়ি তাতে মনে হয় ওর লেখাপড়া আর হবে না। তাহ’লে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভাল।’

রাসমণি চিঠি পড়ে কঠিনভাবে হাসেন। চিঠি নিয়ে আসে হেম। ওর অফিসে নানা ধরনের শিশি আসে, বিলিতী শিশি–হেম সেইগুলো রোজই দুটো-একটা করে সরায় আজকাল। কতকগুলো জমলে এক এক রবিবার পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে সটান হেঁটে কলকাতায় চলে আসে এখানে নাকি শিশি-বোতলের খুব দর, বেচলে ভাল দাম পাওয়া যায়। সেই টাকা নিয়ে দিদিমার বাড়ি আসে, খাওয়াদাওয়া ক’রে আবার সন্ধ্যের পর হাটা দেয় বাড়ির দিকে।

রাসমণি অবশ্য এ খবর জানেন না। হেমের বয়স অল্প হলেও এটুকু সে চিনে নিয়েছিল দিদিমাকে, চোরাই মালের কারবার করা কখনও তিনি বরদাস্ত করবেন না। তিনি ভাবেন হেম বুঝি এমনি ওর বোনের খবর নিতে আসে। তিনি খুশীই হন মনে মনে। ভাই-বোনে টান থাকা ভাল।

1

কিন্তু সে অন্য কথা। শ্যামার চিঠি পড়ে হেমকেই উত্তর দেন, ‘তোর মায়ের দেখছি দুঃখে-কষ্টে মাথাটা একেবারেই খারাপ হয়ে গেছে। আমি এখান থেকে পাত্র দেখব কি ক’রে? আমার কি কোন পুরুষ অভিভাবক আছে, না আমি নিজে কারও বাড়ি যাওয়া-আসা করি! আমাকে পাত্র দেখতে গেলে ঘটক-ঘটকী ডাকা ছাড়া উপায় নেই— কিন্তু ঘটকের সাধ নিজেকে দিয়ে, উমাকে দিয়েও কি তার মেটে নি? বরং বলগে যা জানা-শোনার মধ্যে পাড়া-ঘরে ভাল ছেলে দেখতে। মেয়ে কি তার রঙের রাধা যে গোয়াল কাড়তে গিয়ে মরে যাবে!’

হেম মাথা হেঁট করে সব শোনে। উত্তর বয়ে নিয়ে যায় মায়ের কাছে। শ্যামা রাগ করে, ‘মায়ের যত সব অনাছিষ্টি কথা। ঘটক-ঘটকী কি আর কোথাও ভাল বে দিচ্ছে না! আমাদের বরাতে যা ছিল তাই হয়েছে। ওদের কি দোষ?’

হেম মুচকি হেসে উত্তর দেয়, ‘তোমার মেয়ের বরাতেও যা আছে তাই হবে। এখানেই বিয়ের পাত্তর দ্যাখো না।

‘তুই থাম।’ শ্যামা ধমক দেয়।

‘হ্যাঁ– দিদিমা আরও একটা কথা বলে দিয়েছেন, বলেছেন ঘটক-ঘটকী যে সম্বন্ধ আনবে তাতে শুধু ভাত মুখে উঠবে না

খরচ করতে পারবে তাই শুনি!’

পাওনা-থোওনা চাই। কত টাকা তোর মা

মুখ গোঁজ ক’রে শ্যামা বলে ‘টাকা যদি আমিই খরচ করব ত ঝিয়ের মত খাটতে মেয়েকে আমার সেখানে ফেলে রেখেছি কেন?’

১৯৭

মায়ের অকৃতজ্ঞতায় হেম সুদ্ধ যেন চমকে ওঠে, একটু থেমে বলে, ‘তাহলে ওকে আনিয়েই নাও না মা? কি দরকার ফেলে রাখবার?’

‘দেখি একটু বেয়ে-ছেয়ে। মা কালী কি মুখ তুলে চাইবেন না!

দুই

সেদিন দুপুরবেলাই কালো ক’রে মেঘ ঘনিয়ে এল। উমা সব কাজ ফেলে ছুটল ছাদে। ওর এই অসময়ের কালো মেঘ দেখতে খুব ভাল লাগে। কেমন চারদিক অন্ধকার করে আসে, মিষ্টি মিষ্টি ঠান্ডা হাওয়া দেয়, আর অন্ধকারের মধ্যেও সেই দিকচক্র-রেখার দিকে কেমন একটা অদ্ভুত আলো দেখা যায়। মেঘগুলোও যেন ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মত গড়িয়ে এসে একসময় আকাশ ছেয়ে ফেলে, মধ্যে মধ্যে গুম্ গুম্ শব্দ হ’তে থাকে। উমার মনে হয় মহাপ্রলয় বুঝি ঘনিয়ে আসছে আর দেরি নেই। ঐ রাশি রাশি কালো পাথরের মত মেঘগুলো বুঝি এখনই ঝাঁপিয়ে পড়বে পৃথিবীর বুকে, সব ভেঙে-চুরে গুঁড়িয়ে চাপা দিয়ে দেবে।

‘ছোট মাসিমা!’ ঐন্দ্রিলা উমাকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে আসে। ‘ঐ! শুরু হয়েছে! কি যে বাপু তোমার এক মেঘ দেখা তা বুঝি না। মেঘ হল ত কাজ-কর্ম ফেলে ছুটলে ছাদে! কী আছে মেঘে? কালো কালো বিচ্ছিরি মেঘগুলো দেখলেই ত ভয় করে।

উমা কিন্তু চোখ নামায় না। ওর তৃষ্ণার্ত হৃদয় বুঝি সজল মেঘের মধ্যেই শান্তি খোঁজে। দুই চোখ ভরে পান করে সেই শ্যামল শোভা।

অসহিষ্ণু ঐন্দ্রিলা আবারও ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে, ‘এখন আমার কথাটা শুনবে, না কি? মেঘ ত আর পালাচ্ছে না। ও ত রোজই আছে।

চোখ না ফিরিয়েই উমা হেসে বলে, ‘তোর ও-কথাও ত রোজ আছে। দিনরাত আছে। মেঘই বরং পালাবে। দ্যাখ না, ঐ বৃষ্টি নেমে গেছে–ঐ যে নতুন বাজারের ওধারে ঐ পশ্চিম দিকের আকাশের কাছটা ঝাপসা হয়ে এসেছে– তার মানে গঙ্গার ওপর জল নেমেছে। এখানে এসে গেল বলে—-’

তোমার বাপু সব তাইতে বাড়াবাড়ি!’

চুপ চুপ। ঐ শোন্, রাজেন মল্লিকের চিড়িয়াখানায় ময়ূর ডাকছে। কান পেতে শোন দিকি!’

অর্ধস্বগতোক্তি করে ঐন্দ্রিলা, ‘ভারি শোনবার জিনিস কি না! ক্যাঁ ক্যাঁ কি আমার মিষ্টি ডাক গো!

বেশিক্ষণ অবশ্য তাকে অপেক্ষা করতে হয় না। চটপট শব্দ ক’রে বড় বড় ফোঁটায় জল নেমে পড়ে। ‘ও মা গো’ বলে তিন লাফে রান্নাঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ায় ঐন্দ্রিলা। উমা কিন্তু তবুও যেন কিসের আশায় দাঁড়িয়ে থাকে। দেখতে দেখতে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে যায় উমার গা-মাথার কাপড়–দৌড়ে আসতে আসতেও ভিজে

ཝ་ ་ ་ཝང་ ཀ་ལ་གར་བ་

লেপটে যায় গায়ের সঙ্গে।

‘হ’ল ত!’ ঐন্দ্রিলা রাগ করে, ‘কি যে আদিখ্যেতা তোমার তা বুঝি না। সেই থেকে বলছি! কাপড়টি ত বেশ ক’রে ভেজালে, এখন কি করবে? কাপড় আনতে যাবে কে নিচে? যে যাবে সেই ত ভিজবে।’

গায়ের কাপড় খুলে নেংড়াতে নেংড়াতে উমা উত্তর দেয়, ‘কাপড় আর আনতে হবে না এ এখনই শুকিয়ে যাবে আগুন-তাতো

‘হ্যাঁ, তা যাবে বৈকি। ভিজে কাপড়ে সারাবেলা থেকে তারপর জ্বরে পড়ো। দেখি, আমারই আবার পোড়ার ভোগ আছে আর কি!’

বলতে বলতে, উমা বাধা দেবার আগেই, বড় একখানা গামছা গায়ে-মাথায় জড়িয়ে ছুটে চলে যায় সিঁড়ির দিকে, তারপর তেমনি ভাবেই বুকের মধ্যে ক’রে একখানা শুকনো শাড়ি নিয়ে ছুটে আসে আবার।

‘নাও ধরো। আমার হয়েছে এক জ্বালা!’

বকতে গিয়েও ওর কথা বলার ধরনে হেসে ফেলে উমা। ‘তারপর, তুইও ত ঐ ক’রে ভেজালি কাপড় এখন আবার আমি আনতে যাই?’

না না এ আমার কিছু ভেজে নি, দু-পুরু গামছা ছিল।’

‘কি বলছিলি তখন? কি এমন জরুরী কথা?’ কাপড় ছাড়তে ছাড়তে উমা প্রশ্ন

করে।

‘শোন নি? গিরি মাসি নুন কিনতে গিয়েছিল– নুন পায় নি!’

‘নুন পায় নি? সে আবার কি কথা?’

‘দোকানী বলেছে

বিলিতী নুন নাকি আর সে বেচবে না। পাড়ার ছোকরা বাবুরা সব স্বদেশী হয়েছে, বিলিতী নুন আর কাউকে পাড়ায় বেচতে দেবে না। সন্ধব নুন কিনতে হবে, তা বেশি পয়সা চাই। তাও নাকি লাল লাল বিচ্ছিরি নুন মাটির

ডেলা!’

তা অন্য দোকানে দেখলে না কেন? গিরিকে বললি না? নগদ পয়সা দেবে যখন ‘সে সব দোকান ঘুরে দেখেছে। ছাতুবাবুর বাজারে কেউ বিলিতী নুন বেচবে না। আছে সবার কাছেই কিন্তু সাহস নেই কারও। বিলিতী নুন বিলিতী কাপড় কিচ্ছু

বেচা চলবে না।’

কথাটা আজ নয়– ক’দিন আগেই শুনেছে উমা। ছাত্রীদের বাড়িতে প্রবল আলোচনা হয়– কানে না এসে উপায় নেই। বড়লাট সাহেব নাকি বাংলাকে দুখানা ক’রে দিয়েছেন– তাতে বাঙালীর সর্বনাশ হয়ে যাবে। বাঙালীকে জব্দ করার জন্যেই নাকি এই সব ব্যবস্থা। তাই সবাই ক্ষেপে উঠেছে। বিলিতী জিনিস কেনা বন্ধ করেছে সবাই- তাতেই নাকি ইংরেজ ঠান্ডা হবে সব চেয়ে। ওতে ওদের ভাতে হাত পড়বে।… বিলিতী কাপড়ের কথাটাই শুনেছে সে বেশি ক’রে শোনে নি!

ওর মনের কথারই প্রতিধ্বনি করে দেবে না! তবেই ত চিত্তির!’

নুনের কথা ত কৈ

ন্দ্রিলা ব’লে উঠল, ‘কাপড়ও ত কিনতে

১৯৯

‘তাতে আর আমাদের কি? আমরা ত তাঁতের কাপড় পরি!’

একরত্তি ঐন্দ্রিলা হাত-পা নেড়ে বলে, ‘সবাইয়েরই ত আর তোমার মত ফরাসডাঙার কাপড় পরার ক্ষ্যামতা নেই! আমাদের মতি গরীবগুর্বোর কি হবে?’

একটু অপ্রতিভ হয়ে উমা বলে, ‘সেও ত শুনছি বোম্বাইয়ের ওধারে কোথায় কাপড়ের কল বসেছে। সে ব্যবস্থা হচ্ছে।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ– রেখে বসো! ঐ ত গিরি মাসি শুনে এসেছে– সে যা কাপড় আসবে– থলের মত বিচ্ছিরি মোটা- তাও ডাবল দাম! এমন চোদ্দ আনায় বারো আনায় এত ভাল কাপড় পাবে না!’

উমা কথাটা উড়েয়ে দেয়, ‘ভেবে কি হবে বল্! যা সবার অদৃষ্টে আছে আমাদেরও তাই হলে–বেশি ত আর নয়।’

‘মার কানে যদি কথাটা যায়— মা লাফাবে একেবারে!’

আরও খানিক গজ-গজ করে ঐন্দ্রিলা আপন মনেই কিন্তু উমার কাছ থেকে কোন উৎসাহ না পেয়ে খানিকটা পরে আপনিই থেমে যায়।

সত্যিই শ্যামা লাফাতে থাকে একেবারে।

মঙ্গলা ঠাকরুণ হাত-পা নেড়ে এসে গল্প করেন, ‘শুনেছিস্ বানি– স্বদেশীওলাদের হুজুগ?’

‘কৈ না ত মা! কী–ওলা বললেন?’

ঐ যে বাপু স্বদেশী না কি এক ফ্যাচাঙ উঠেচে! দেশের ছোকরা বাবুরা উঠে-

-পড়ে লেগেছেন ইংরেজ নাকি এদেশে আর রাখবেন না, তাড়িয়ে তবে জলগেন করবেন। যত সব বাউন্ডুলে উনপাঁজুরে বরাখুরে ছোঁড়ারা জুটেছে– একটা-না-একটা হুজুগ লেগে আছেই!’

‘তা তারা কি চায়?’ শ্যামা তখনও সংবাদটার সমস্ত অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থ বুঝতে পারে না। ‘ওলো, কেউ নাকি বিলিতী কাপড় পরবে না, বিলিতী নুন চিনি কিচ্ছু খাবে না সব নাকি বয়কট করবে। ওকে নাকি বয়কট করা বলে!’

নিশ্চিন্ত অবিশ্বাসের হাসি হেসে শ্যামা বলে, ‘না কিনে করবে কী? আপনিও যেমন

ক্ষেপেছেন!

‘ওলো না

আমাদের কত্তা কাল চিনি কিনে আনছিলেন, হাত থেকে কেড়ে

নিতে গেছল। অনেক ধমক-ধামক্ করে তবে পার পেয়েছেন। ‘

‘তবে? চিনি না হ’লে চা খাবেন কি করে? ওঁর ত আবার চা খাবার অভ্যেস!

‘তাই ত বলছি। বলে কিনা গুড় দিয়ে চা খেতে হবে।’

খানিকটা চুপ ক’রে থাকে শ্যামা, বলে, ‘ও দুদিনের হুজুগ মা–দুদিনেই থেমে যাবে। আপনিও যেমন!’

‘হ্যাঁ –আমিও তাই বলছিলুম ওঁকে। বিলিতী কাপড় না কিনলে পরবে কি? কটা লোকের ফরসাডাঙা শান্তিপুর পরার ক্ষ্যামতা আছে তাই শুনি? কিন্তু–’ গলাটা নামিয়ে

|

এবার একটু চিন্তিতভাবে বলেন মঙ্গলা, ‘উনি যেন কেমন ভরসা পাচ্ছেন না। বলছেন তোমরা যা ভাবছ তা নয়–এ নিয়ে রীতিমত গোলমাল বেধে উঠবে। দেখো তখন

চাকরি নিয়ে না টানাটানি পড়ে!’

কথাটা শুনে শিউরে ওঠে শ্যামা। অক্ষয়বাবুর চাকরির জন্যে তার ভাবনা নয়– চাকরি গেলেও তাঁর চলবে, তার ভাবনা হেমের চাকরির জন্যে। গত মাস থেকে বারো টাকা হয়েছে মাইনে। আরও বাড়বে– সাহেবের সুনজরেও চাই কি পড়ে যেতে পারে কোন রকমে। (কেমন করে সেটা পড়া যায় শ্যামা জানে না- তবে ঝাপসা রকম একটা ধারণা আছে যে এ রকম অঘটন ঘটলে আর কোন ভাবনা নেই।) এই সময় এসব আবার কি বিঘা

সে গজরাতে আর গাল পাড়তে থাকে।

স্বদেশী কী তা সে জানে না, কেন এদের এ বিক্ষোভ তাও জানতে চায় না, কোথা দিয়ে কী ক্ষতি হ’তে পারে, ওর এবং জাতির– জাতির সুবিধার জন্যে যে কোন কোন মানুষের সামান্য ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করতে হয় মধ্যে মধ্যে–এ সব কোন কথাই শ্যামার জানা নেই। শুধু হেমের চাকরি এই আন্দোলনের ফলে কোন্ দিন যেতে পারে

এই সম্ভাবনাতেই সে যেন ক্ষেপে ওঠে একেবারে।

‘মুখে আগুন মড়াদের! মরুক, মরুক সব। ওলাউঠো হোক। এক-ধার থেকে নির্ব্বংশ হোক। স-পুরী এক গাড়ে যাক, হুজুগ করবার আর সময় পেলেন না সব! গরীবকে কেবল জব্দ করা বই আর কিছু নয়!

হেম বরং মধ্যে মধ্যে সান্ত্বনা দেয়– ‘যাক না মা, ভারি তো বারো টাকা মাইনের চাকরি, যজমানী ক’রে ওর চেয়ে ঢের বেমি এনে দেবো।’

‘তুই থাম্। ভারি ত বুঝিস্ তুই!’ ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয় শ্যামা।

কিন্তু ওর গালাগাল সে বিপুল জনসমুদ্রের কোলাহল ভেদ করতে পারে না। তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে আন্দোলন। অবশেষে শোনা গেল একদিন অক্ষয়বাবুর হাত থেকে বিলিতী কাপড় কেড়ে নিয়ে ছেলেরা পুড়িয়ে দিয়েছে।

উড়ো উড়ো নানা খবর আসে। কলকাতাতে নাকি ভীষণ গোলমাল চলেছে, কবে যে আগুন জ্বলে উঠবে তার ঠিক নেই। অক্ষয়বাবুর অফিসে চার-পাঁজন ছোকরার চাকরি নাকি এরই মধ্যে চ’লে গেছে–এই সব হুজুগ করার জন্যে।

অবশেষে একদিন অফিস থেকে হেম শুনে এল-সাহেব সবাইকে সাবধান ক’রে দিয়েছেন, এসব হাঙ্গামে তাঁর কলের কেউ যেন জড়িয়ে না পড়ে– তাহ’লে কিন্তু কোনক্রমেই চাকরি থাকবে না।

শিউরে উঠে শ্যামা তাকে সাবধান করে, ‘দেখিস, ঐ সব হাড়হাবাতে বজ্জাত ছোঁড়াদের ত্রিসীমানায় থাকিস নি কোনদিন। খবরদার– এই পই পই ক’রে বারণ ক’রে দিচ্ছি! দুর্গা দুর্গা– রক্ষে করো মা বাছাকে।

অনেকদিন পরে একদিন নরেন এসে হাজির হল মছ

བཞིན་

পুঁটুলিতে অনেকখানি

দামী বিলিতী চিনি।

গজগজ করতে করতেই বাড়ি ঢুকল, ‘ঢাল নেই তরোয়াল নেই নিধিরাম সদ্দার! ওঁরা তাড়াবেন ইংরেজ! শুধু যদি বক্তিমে ক’রে ইংরেজ তাড়ানো যেত তাহলে আর ভাবনা ছিল না। কাজের মধ্যে ত কেবল কথা কথার ধুক্‌ড়ি এক-একটি!’

শ্যামা অবাক হয়ে বলে, কিন্তু এত চিনি পেলে কোত্থেকে, তবে যে শুনেছিলূম বিলিতী চিনি কাউকে কিনতে দিচ্ছে না?’

‘হুঁ হুঁ, তাই ত! সেই ত সুবিধে হ’ল, বুঝলি না? কি জানিস গিন্নী, বুদ্ধি চাই! বুদ্ধি থাকলে কি আর কেউ মাগের শ্বশুরবাড়ি খেটে খায়?… উঁ উঁহু– ওতে হাত দেওয়া চলবে না! এ আমি অকা সরকারকে বিক্কিরি করব। চা খাওয়ার নেশা বাবুর, চিনি ত পাচ্ছেন না, চড়া দাম নেব!’

‘কিন্তু পেলে কি ক’রে তাই শুনি না?’

জিনিসটা ত নষ্ট হবেই

‘ঐ এক সাহেবের চাপরাসী কিনে নিয়ে যাচ্ছিল। ছোঁড়ারা রে-রে ক’রে গিয়ে পড়ল। আমি দেখলুম

সাহেবের ভোগে আর হচ্ছে না। আমিও ঐ দলে মিশে গিয়ে সব্বার আগে ছিনিয়ে নিলুম। তারপর হৈ-চৈ চেঁচামেচির মধ্যে এক ফাঁকে সরে পড়তে কতক্ষণ, বুঝলি না!– তা মাল আছে ঢের, পাঁচ সেরের কম নয়। হেঁ-হেঁ!’

আত্মতৃপ্তির হাসিতে ওর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

তারপর পা ছড়িয়ে বসে শ্যামাকে তামাক সাজবার হুকুম ক’রে আবারও একচোট গালাগালি দিতে বসে আহাম্মক ছোঁড়াদের।

‘তুমিও যেমন। স্বদেশী হচ্ছে না গুষ্টির পিন্ডি হচ্ছে! ছাই হবে। লাভে হ’তে এই অপ্‌চ।… বোকা বোকা! ঝাড়ে-বংশে সব বোকা!’

বহুদিন পরে স্বামীর সঙ্গে একমন হতে পেরে শ্যামাও খুশী হয়ে ওঠে। দুজনে মিলে মনের সাধ মিটিয়ে গাল দেয় এই অস্পষ্ট, অপরিচিত –স্বদেশীওলাদের!

তিন

কেবল কোন উত্তেজনা দেখা যায় না রাসমণিরই। তিনি সবই শোনেন, কোন কথা বলেনে না। উমা বুঝতে পারে না মায়ের ভাবটা।

এমন ত ছিলেন না মা। যেন কোন নিস্পৃহ উদাসীন হয়ে গেছেন তিনি।

কিছুতেই আর কোন কৌতূহল নেই, আসক্তি নেই, কেমন যেন ভয়-ভয় করে ওর রাসমণির এই ধরনের ভাব দেখে। উমা কমলাকেও তার আশঙ্কার কথাটা জানিয়েছিল একবার কিন্তু কমলা সেটা গায়ে মাখে নি। উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘ও কিছু নয়– বুড়ো বয়সে শরীর খারাপ হ’লে অমনিই হয়। ‘

অবশ্য শরীরটা খারাপই যাচ্ছে ওর– সেটাও ঠিক। কাশী থেকে এসে বছরখানেক বেশ ভাল ছিলেন, তারপরই আবার খারাপ হ’তে শুরু করেছে। বিশেষত ইদানীং যেন একটু বেশি রকম কাবু হয়ে পড়েছেন। জ্বর হয় প্রায়ই, ম্যালেরিয়া। কুইনাইন দিতে চান– রাসমণি তা খাবেন না

চার বলেন পুরোনো

ক’রে বলেন,

‘হ্যাঁ,

কুইনাইনে শুনেছি মাতা ঘোরে, কানে কালা হয়ে যায়! বুড়ো বয়সে ঐ খেয়ে মরি আর কি!… দূর! দূর!

কবিরাজীও করতে চান না। কেবল অনুপান আর পাঁচন– করে কে ওসব? ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘অত হাঙ্গামা আর পোষাবে না। তাছাড়া দর-কারই বা কি? রোগে ধরলে ওষুধে ছাড়ে– যমে ধরলে কি আর ছাড়ে! এবার আমায় যমে ধরেছে বুঝছিস্ না? সময়ও ত হ’ল, আর কতকাল বাঁচব! কিছুদিন ধরে জ্বর হলেই তোদের গুষ্টিকে স্বপ্ন দেখছি। এতদিনে বোধ হয় মনে পড়েছে!’

স্বামীর প্রসঙ্গ রাসমণির মুখে কেউ কখনও শোনে নি। এ-ও এক ব্যতিক্রম। ‘তোদের বাবা’ এ তিনি বলেন না। স্বামীর প্রসঙ্গে ‘বাবা’ শব্দ, হোক না কেন অপরের বাবা এ তাঁদের আমলে উল্লেখ করা নিষেধ ছিল। ওটা অসভ্যতা ব’লে গণ্য হ’ত, ঠাট্টা- তামাশা করত সবাই। সুতরাং তিনি বলেন, ‘তোদের গুষ্টি!’

নতুন কি এক চিকিৎসা বেরিয়েছে হোমিওপ্যাথি বলে, পাড়ায় তারই এক ডাক্তার আছেন– কালীপদ বরাট। জ্বর যখন খুব চেপে আসে, এক-একদিন কাঁপতে কাঁপতে দাঁতি লেগে অজ্ঞান হয়ে যান রাসমণি, তখন উমা ভয় পেয়ে বরাটকেই ডাকে। ছোট একটা ছেলের মাথায় কাঠের বাক্স চাপিয়ে নিয়ে তিনি চলে আসেন। বেশ জাঁকিয়ে বসেন রোগিনীর পাশে, নানা প্রশ্ন করেন ওদের (সম্ভব হলে রোগিণীকেও), এবং প্রত্যেকটি উত্তর শুনেই একবার ক’রে বিজ্ঞভাবে টেনে টেনে বলেন ‘হুঁ–।’ তারপরই আবার একটি নতুন প্রশ্ন নিক্ষেপ করেন। এইভাবেই চলে প্রায় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট।

অনেকক্ষণ পরে শেষ একটি ‘হুঁ’ ছেড়ে কাঠের বাক্স খোলেন। ঐন্দ্রিলাকে হুকুম করেন, ‘একটা পরিষ্কার পাথরের বাটিতে ক’রে একটু জল এনে দাও ত খুকী-মা!’

পাথরের বাটিতে জল এসে পৌঁছলে সাবধানে বেছে একটি শিশি বার করেন, তারপর তা থেকে পরিষ্কার জলবৎ কি একটা ওষুধ খুব সন্তর্পণে শিশির মুখে ছিপি লাগিয়ে একটি ফোঁটা মাত্র ঢেলে দেন।

‘শ্রীবিষ্ণু! নাও, এবার খাইয়ে দাও ত মা-ঠাকরুনকে চটপট!’

প্রথম প্রথম রাসমণি খেতে চাইতেন না।

‘এ যে কেমন কেমন গন্ধ ডাক্তারবাবু!’

‘মদের মত গন্ধ– এই ত!’ ডক্তার বরাট মুখের কথা টেনে নিয়ে বলতেন, ‘তা তা হবেই মা। যে জিনিসের যা। এ যে সুরাসার দিয়ে তৈরি। কিন্তু তাতে ত দোষ নেই– জানেন ত শাস্ত্রের বচন,

ঔষধার্থে সুরাপান। তাও চলে!’

করেন

ইদানীং আর আপত্তি করেন না। কিছুতেই যেন আপত্তি নেই তাঁর। ক্লান্তভাবে হাঁ

কে কি ওষুধ ঢেলে দিচ্ছে চেয়েও দেখেন না।

কিন্তু তাতেও রোগ ভাল হয় না।

তিন দিন চার দিন ভাল থাকেন আবার পালটে পালটে জ্বরে পড়েন। এই সময় আর একবার হয়ত পশ্চিমে নিয়ে গেলে হ’ত কিন্তু কে নিয়ে যাবে? রাঘব ঘোষাল বাতে পঙ্গু– তার ছেলেই সব যজমানী দেখছে। উমার যাওয়ার উপায় নেই, তাছাড়া সব চেয়ে বড় কথা হ’ল খরচা। অত খরচ দেবে কে? এখন যা অবস্থা সংসার চলাই ভার।

২০৩

সুতরাং কিছুই হয় না। রাসমণি রোগে ভোগেন– আর যখন ভাল থাকেন ক্লান্ত অবসন্নভাবে দূরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বসে মালা জপেন।

আজকাল সব দিন আর গঙ্গাস্নানেও যেতে পারেন না। দু’তিন দিন উপরি উপরি ভাত খেয়েও যদি জ্বর না আসে ত চুপিচুপি ঐন্দ্রিলাকে সঙ্গে ক’রে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু হেঁটে যদি যান আসার সময় প্রাই আর আসতে পারেন না– পালকি ক’রে ফেরেন। যেদিন হেঁটে আসেন– সেদিনও টানা আসতে পারেন না, পথে অনেক জায়গায় বসে পড়তে হয়। খানিকটা বসে জিরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করেন।

>

যেদিন স্নান করতে যান সেদিন গঙ্গার ঘাটেও শোনেন স্বদেশী হাঙ্গামার কথা। সুরেন বাঁড় য্যে বিপিন পাল আর রবি ঠাকুর নাকি ছেলেদের খেপিয়ে তুলছেন। কোন বিলিতী জিনিস কেনা হবে না– সাহেবদের ভাতে মারতে হবে, এই হয়েছে হুজুগ। নুন চিনি বিলিতী কাপড় কিছু কেনা যাবে না। কেনা সম্ভব নয়। কেউ কেউ নাকি লুকিয়ে কেনার চেষ্টা করছে কিন্তু ধরা পড়ে তেমনি লাঞ্ছনাও হচ্ছে তাদের। স্বদেশী ছেলেরা নাস্তানাবুদ ক’রে ছাড়ছে।

শোনেন কানে যায় এই পর্যন্ত। কথাটা তাঁকে কোনরকমে বিচলিত করতে পারে না। মন তাঁর এতটুকুও জাগে না। অথচ এককালে তিনি খবরের কাগজ পড়তে ভালবাসতেন। বরাবর সাপ্তাহিক কাগজ একখানা ক’রে নেওয়া হ’ত। পড়ার অভ্যাস ছিল তাঁর। তিলোত্তমাম্ভব কাব্য গোলেবকাগুলি, চাহার দরবেশ, গোল-সনুবর, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনী– এসব বই এখনও তাঁর বাক্স খুঁজলে পাওয়া যাবে। পয়ারে অনূদিত বেতাল পঞ্চবিংশতি এককালে তাঁর মুখস্থ ছিল। কিন্তু কিছুদিন ধরে যেন সবই ভূলে যেতে বসেছেন। বই পড়তেও আর ভাল লাগে না। এক-একদিন উমা নিজে থেকেই প্রস্তাব করে–’কিছু পড়ে শোনাব মা?’ রাসমণি তাতেও ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানান, ‘থাক গে, ভাল লাগছে না।’

কী যে ভাল লাগবে তাঁর, উমা তা বুঝতে পারে না। দিনরাতই কি যেন ভাবছেন। বসে থাকলে জানালা দিয়ে বোসেদের বাড়ির কানিসটার দিকে, নয়ত ছাদের দিকেই তাকিয়ে থাকেন। কী এত ভাবেন মা– উমা হাজার চেষ্টা ক’রেও আন্দাজ করতে পারে না। তবে কি তিনি তাঁর ফেলে আসা দীর্ঘ জীবনের কথাই ভাবেন দিনরাত? অথবা তিনি যেদিন থাকবেন না, তাঁর এই তিনটি মেয়ের কি হবে সেই কথা কল্পনা করার চেষ্টা করেন!

কিছুই বোঝা যায় না তাঁর এই স্তম্ভিত অথচ উদাসীন ভাব দেখে। প্রশ্ন করতেও সাহসে কুলোয় না। চিরদিন মাকে ভয় করা অভ্যাস তার

দাঁড়িয়ে গেছে। ভয় কাটে নি।

সে অভ্যাস স্বভাবেই

ঐন্দ্রিলা মাঝে মাঝে প্রশ্ন ক’রে বসে, ‘আচ্ছা দিদিমা, কি ভাবেন অত?’

‘য়্যা,– যেন ঘুম থেকে জেগে উঠে ওর মুখে কে কাবার চেষ্টা করেন

রাসমণি, ‘কি বললি? ভাবছি? না– ভাবছি আর কৈ!’

আবার তেমনি নৈঃশব্দে ডুবে যান।

কেবল একটি দিন ওঁর ভাবান্তর দেখেছিল উমা। সেটা তিরিশে আশ্বিনের দিন কথা ছিল সেদিন রাখীবন্ধনে সব বাঙালীকে বাঁধবে ‘ভাই’ বলে। নাড়ীর টান আরও নিবিড় ক’রে তুলবে।

তা আগে প্রায় তিন-চার দিন জ্বর হয় নি রাসমণির। স্নান করতে যাওয়ার পথে কথাটা শুনলেন। আজ কোন বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে না, এবেলা রান্না হবে না কোথাও। গঙ্গাস্নান করবে সবাই। স্নান ক’রে খালি পায়ে এক এক দল এক এক দিকে যাত্রা করবে, রাখী পরাতে পরাতে যাবে পথের দুধারে। এই পথেই বুঝি যাবে সবাই।

বাড়ি এসেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন উমাকে। তার আগে নিষেধ করলেন উনুনে আঁচ দিতে।

উমা প্রশ্ন করলে, ‘কিন্তু আপনি কী খাবেন মা তাহলে? অন্তত দুখানা কাঠ জ্বেলে আপনাকে একটু দুধ গরম ক’রে দিই?’

‘না না, তার দরকার নেই’– প্রবল বেগে ঘাড় নেড়ে বললেন রাসমণি, ‘তুই কি পাগল হয়েছিস? আমার এই বয়সে দু-তিন দিন না খেলেও কিছু ক্ষেতি হবে না। বরং ঘরে যদি মিষ্টিটিষ্টি থাকে ত ঐ মেয়েটাকে একটু কিছু খাইয়ে দে। ছেলেমানুষ নেতিয়ে পড়বে শেষে।’

স্বদেশী ব্যাপারে ঐন্দ্রিলার কোন সহানুভূতি ছিল না, থাকবার কথাও নয়। সে কিছু বুঝত না এসব। কিন্তু হুজুগে মেতে ওঠারই বয়স তার। দিদিমা কিছু খাবেন না– সে খাবে কচি খুকী বলে? কক্ষনো না।

সে বললে, ‘আমার কিছু হবে না দিদিমা, আমি বেশ থাকব।… একটা রেলা বৈ ত নয়! এই ত গতবার আমি শিবরাত্তির করলুম।’

রাসমণির প্রশ্নের উত্তরে উমা যতটা জানত সবটাই বলে। কে নাকি বড়লাট– কার্জন বলে– বাঙালীকে জব্দ করবার জন্যে বাংলাটাকে দু ভাগ ক’রে দিয়েছ। বাঙালীরা নাকি এর বেশী লেখাপড়া শিখে ফেলেছে যে ইংরেজদের রাজত্ব করা দায় হবে এদেশে– তাই দেশটাকে দু’আধখানা ক’রে বাঙালীকে চিরদিনের মত দমিয়ে রাখতে চায়। সেই জন্যেই সব দেশ ক্ষেপে উঠেছে। ইংরেজদের ধনপ্রাণও নাকি নিরাপদ নয়– মুখ শুকিয়ে গেছে সকলকার।

দেশ যে ক্ষেপে উঠেছে তা রাসমণিও লক্ষ্য করেছেন। আজকাল গঙ্গাস্নান করতে গেলে পথেঘাটে নজরে পড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য। দুজন ছোকরার যদি দেখা হয়ে গেল তবে আর রক্ষা নেই। তা কে জানে চেনা আর কে জানে অচেনা! একজন বলবে ‘বন্দে–’, বলে সে থামবে। আর একজন পাদপূরণ করে দেবে ‘মাতরম্’। এই নাকি এ যুগের সম্ভাষণ। প্রণাম নমস্কার আর কেউ করবে না। ‘বন্দে মাতরু বললেই নাকি সব

সারা হয়ে গেল।

এ নাকি এক মন্ত্র উঠেছে– সকলেরই মুখে এক

মাতরম্’!

রাসমণি বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ বই পড়েছিলেন, ‘বন্দে মাতরম্’ গানও পড়ে গেছেন, কিন্তু সেই গানই যে দেশসুদ্ধ লোকের মন্ত্র হয়ে উঠেছে তা অত বুঝতে পারেন নি। সে কথাটাও আজ শুনলেন। থিয়েটারে নাকি ‘আনন্দমঠ’ নাটক হয়ে অভিনীত হয়েছে, তাতে সুর বসিয়ে ঐ গানটাও গাওয়া হয়েছে। আর সেই গান গেয়েই ক্ষেপে উঠেছে সারা দেশ। সাহেবরা তাই আজকাল ‘বন্দে মাতরম্’ শুনলেই আঁতকে ওঠে–বন্দুকের গুলির চেয়েও ‘বন্দ মাতরম্’ শব্দ দুটি হয়ে উঠেছে ভয়াবহ। দু-এক জায়গায় নাকি সাহেব-মারাও চলেছে।

মন দিয়ে শোনেন রাসমণি। মুখে তাঁর একটু সংশয়ের ছায়াও ফুটে ওঠে। মুখে বলেন, ‘শুনেছি মহারাণীর রাজত্বে সূর্য অস্ত যায় না– সারা পৃথিবীতে তাঁর রাজত্ব। সেই মহারাণীর লোকের সঙ্গে কি আর শুধুহাতে লড়তে পারবে এরা? কে জানে!’

মহারাণী যে মারা গেছেন এটা কিছুতেই মনে থাকে না রাসমণির। আগে আগে উমা ভুল সংশোধনের চেষ্টা করত, ইদানীং হাল ছেড়ে দিয়েছে।

তবু আজ যেন কি একটা উৎসাহ বোধ করেন রাসমণি। এতকাল পরে কি এক নূতন উদ্দীপনা। মন আবার যেন কোথায় একটা কৌতূহলের কেন্দ্র খুঁজে পেয়েছে। জীবন পেয়েছে নব প্রাণরস। উত্তেজনায় চোখে মুখে নতুন আলো জেগেছে তাঁর।

F

তিনি নটার সময় গিয়ে সদরে বসেন। দলে দলে লোক গিয়েছে স্নান করতে, এইবার ফিরবে তারা। এই পথেই ফিরবে। রাখী পরব। ঐন্দ্রিলা গিয়ে তাঁর পাশটিতে চুপ ক’রে বসে।

কিন্তু বড় রাস্তা দূরে। একটা বাড়ি পেরোলে তবে বড় রাস্তা। গঙ্গার ঘাটে যাবার পথ। সেই পথেই আজ চরম উত্তেজনা। এখান থেকে নজরে পড়ছে, সেখানকার অভিনব দৃশ্য। দলে দলে ছেলেরা চলেছে সব– খালি পা, রুক্ষ চুল। আজ পথে গাড়ি নেই। যারা জীবনে কখনও হাঁটে নি, তারাও আজ রাস্তায় পা দিয়েছে।

ঐন্দ্রিলা থেকে থেকে বলে, ‘দিদিমা, চলুন না ঐ বোসেদের রোয়াকে গিয়ে বসি।’

‘ক্ষেপেছিস তুই!’ রাসমণি থামিয়ে দেন ওকে, ‘গিগিস্ করছে লোক ওদের রকে, তার ভেতর আমি কোথায় গিয়ে বসব! এইখান থেকেই বেশ দেখা যাবে।’

মধ্যে মধ্যে হুঙ্কার উঠছে, ‘বন্দে

মাতরম্!’

মাতরম্’

বলো ভাই আবার বলো, ‘বন্দে

রাস্তায় যাবার ভিড় কমেছে। এইবার ফিরবে ওরা! ক্লান্ত দেহ অবসন্ন হয়ে আসে রাসমণির– তবু উনি ওঠেন না। জীবনের আবার নতুন ক’রে অর্থ খুঁজে পেয়েছেন তিনি। ঘরে শুয়ে থাকা অসম্ভব।

‘বন্দে—-

দূরে যেন মেঘের গর্জনের মত কি শোনা যাচ্ছে। কান পেতে শুনলেন, মাতরম্!’ কান পেতে শুনলেন গানের সুর। ঐ বুঝি সে দল এদিকেই আসছে! রাসমণি চৌকাঠ ধরে দাঁড়ালেন।

আহা হা! কি সব রূপ! সোনার চাঁদ সব ছেলে

চাঁদ সব ছেলেরা ধনী পা ফেলতে পারছে না, তবু সবাই চলেছে খালি পো

লাল– গরম রাস্তায় মধ্যে একটি লোককে

দেখে রাসমণি চোখ ফেরাতে পারলেন না। কন্দর্পের মত রূপ। মুখখানি যেন কে পাথর কুঁদে বার করেছে। গৌর তনু, কুঞ্চিত কেশ, ঘনকৃষ্ণ শ্মশ্রু। অল্প বয়স, তবু একটি সুমধুর গাম্ভীর্য বিরাজ করছে তাঁর সর্বাঙ্গ ঘিরে

লোকটিও যেতে যেতে এদিক ফিরে তাকালেন। এক বৃদ্ধা ও এক বালিকা। বৃদ্ধাটি যে রুগ্‌ণা তা মুখের দিকে চাইলেই নজরে পড়ে। রোগশয্যা থেকে উঠে এসেছেন, হয়ত বা মৃত্যুশয্যা থেকেই– দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে। দেশব্যাপী এই প্রাণ- মহোৎসব থেকে দূরে রাখতে পারেন নি নিজেকে সরিয়ে।

পাশের লোকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে কি যেন তিনি বললেন আস্তে আস্তে। বোধ করি এই সব কথাই। তারপর থমকে একটু থেমে নিজেই এগিয়ে এলেন গলির দিকে। নিজের হাতে রাখী পরিয়ে দিতে এলেন রাসমণি ও ঐন্দ্রিলার হাতে। পরানো শেষ হলে নিজেই হাত তুলে নমস্কার করলেন। বড় রাস্তার বিরাট দলটি চারিদিকের আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে গর্জন ক’রে উঠল, ‘বল ভাই বন্দে মাতরম্!’

তারই মধ্যে রাসমণি প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নামটি কি বাবা?’

‘আমার নাম?’ একটু ইতস্তত করলেন তিনি, তারপর সস্মিতমুখে মাথাটি নত ক’রে উত্তর দিলেন, ‘আমার নাম শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!

‘ও, তুমিই সেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ছেলে? দ্বারিক ঠাকুরের নাতি তুমি? তোমার নাম রবি ঠাকুর? বেচে থাকো বাবা, দীর্ঘজীবী হও। তোমার মার জন্ম সার্থক!’

প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করেন রাসমণি।

রবীন্দ্রনাথ স্তদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, মুখে তাঁর তেমনি সবিনয় মধুর হাসি। তারপর আর একবার হাত তুলে সমস্কার ক’রে আবার রাস্তায় গিয়ে দলে যোগ দিলেন। বাকী ছেলেরা অন্য বাড়ির লোকদের রাখী পরাচ্ছিল, তারাও কাজ সেরে ফেলেছে ততক্ষণে। আবার সেই বজ্র নির্ঘোষ ‘বন্দে মাতরম্!’

রাসমণি চোখে জল এসেছিল। ঐ সুন্দর ছেলেটি নিজে এসে তাঁর হাতে রাখী পরিয়ে দিয়েছে। হেসে কথা কয়েছে, নমস্কার করেছে। তিনি যেন কৃতার্থ হয়ে গিয়েছেন। তাঁর যদি অমনি একটি ছেলে থাকত আজ! মেয়েরা শুধুই বোঝা। আজ পরপারে যাবার পথেও পায়ে বেড়ির মত এঁটে ধরেছে তাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে। মরেও শান্তি নেই তাঁর।

উদ্‌গত দীর্ঘনিঃশ্বাস দমন ক’রে আবারও সদরের চৌকাঠে বসে পড়েন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *