০৪. নরেন যখন কলকাতায়

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

দিন তিনেক ওখানে কাটিয়ে নরেন যখন কলকাতায় ফেরবার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, তখন স্বাভাবিক ভাবে শাশুড়ী এবং বধূ দুজনেরই মুখে এক প্রশ্ন ফুটে উঠল, ‘তারপর?’

নরেন বোকার মত হাসতে হাসতে মাথা চুলকোতে লাগল, উত্তর দিতে পারলে না। ক্ষমা একটু কঠিন কণ্ঠেই বললেন, ‘দয়া ক’রে তোমার মাগ-ছেলে তুমি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করো বাবা তাহ’লেই আমি বাঁচি। মা গঙ্গায় গা ঢেলে নিশ্চিত হই।’

নরেন হি-হি ক’রে হেসে বললে, ‘এ ত মজা মন্দ নয়। ও কাল রাত্তিরে ঠিক এই কথাই বলছিল যে তোমার মার একটা যা হোক ব্যবস্থা করো তাহ’লে মরে রেহাই পাই। হি হি! দুজনে পরামর্শ ক’রে বলছো বুঝি?’

‘এ ত পরামর্শ করবার দরকার নেই বাবা, তোমার মত মানুষের সঙ্গে যাদের ঘর করতে হয়, এ ছাড়া আর তাদের গতি কি বলো।’

‘বা-রে, সব দোষ বুঝি আমার! সাত-তাড়াতাড়ি একটা বিয়ে দিয়ে ন্যাঞ্জারি করে দিলে, এখন আমাকে সব সামলাতে হবে!’

‘বিয়ে যখন দিয়েছিলুম তখন সম্পত্তিও ছিল। যা ছিল চিরকাল বসে খেলেও খেতে পারতিস। সব খোয়ালি, তার জন্যে দায়ী কি আমি?’

‘বা! তা ব’লে পুরুষমানুষ –আমোদ-আহ্লাদ করব না!’

এ লোকের সঙ্গে কথা কইতে যাওয়া বৃথা জেনেই ক্ষমা চুপ ক’রে গেলেন। খানিকটা ভেবে নিয়ে নরেন বললে, ‘দেখা যাক্ দিন-কতক ত ঘুরে আসি।’

‘তারপর? আমাদের এই দিন-কতক চলবে কিসে?’

‘রাজা বিনে কি আর রাজ্য আটকায়? এতদিন চলল কি ক’রে? হেঁ হেঁ তাছাড়া তোমার হাতেও কিছু ছিল নিশ্চয়ই। কম চাপা মেয়েমানুষ তুমি!’

ঘৃণায় এত বড় কথাটারও জবাব দিলেন না ক্ষমা। শুধু ছেলে চলে যাবার পরে তুলসীতলায় এসে ঢিপ্ টিপ্‌ করে মাথা খুঁড়তে লাগলেন, ‘ঠাঁকুর, আমাকে নাও! আজও প্রায়শ্চিত্ত হল না, এত কি পাপ করেছিলুম ঠাকুর?’

এর পর আবার সেই সুদীর্ঘ প্রতীক্ষা। দিন এবং রাত যেন প্রতিদিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। প্রতিটি দিন কিসে কাটাৰে সেই এক সমস্যা। তার ওপর শ্যামার আরও বিপদ তার শাশুড়ীকে নিয়ে। এবার নরেন যাবার পর থেকে তিনি যেন খাওয়া-

দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। যা সামান্য ধানচালের যোগাড় হয় তাও তিনি সঞ্চয় ক’রে রাখেন পৌত্র আর পুত্রবধূর জন্য। একেবারে না বসলে শ্যামাও খাবে না ব’লে মাত্র একবার বসেন। শুধুমাত্র মুখে দেওয়া একটা ছোট পাখীর চেয়েও কম খান তিনি। প্রথম প্রথম অনুযোগ করার চেষ্টা করেছে শ্যামা, ‘মা, এমন খেলে বাঁচবেন কী করে?’

‘বাঁচবার কি আর দরকার আছে আমার? আরও আমাকে বাঁচতে বলো? আত্মহত্যা মহাপাপ ব’লেই করি না। নইলে মরবার ভয় আর আমার এক তিল নেই মা

‘কিন্তু আমরা কোথায় দাঁড়াবো মা? আমাদের কি উপায় হবে?’ শ্যামা হয়ত বলে। ‘উপায় আমি ত কিছু করতে পারছি না মা, সেইটেই ত দুঃখ। এখন যে ভাবে দিন কাটছে তোমার, তার চেয়ে খারাপ আর কি কাটবে মা? এখনও তোমার মা বেঁচে আছেন এক মুঠো ভাত তোমার মিলবেই সে আমি জানি।’

বধূ আর দেবার মত উত্তর খুঁজে পায় না।

নরেনের কোন খবরই পাওয়া যায় না। দেবেনেরও তথৈবচ। রাধারাণী সামান্য কিছু লেখাপড়া জানে কিন্তু চিঠি লেখার অভ্যাস নেই। একখানা মাত্র চিঠি দেবেন দিয়েছিল, তাতে শুধু নরেনের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালাগালি –কিন্তু এই দুটি আশ্রয়হীনা মেয়েছেলের এখানে দিন কি ক’রে কাটবে সে কথার উল্লেখমাত্ৰ নেই।

মধ্যে খুব অসহ্য হওয়ায় মা একখানি চিঠি লিখিয়েছিলেন শ্যামাকে দিয়ে পুত্রবধূর নামে। ছেলেটা কি না খেতে পেয়ে মরে যাবে? অন্তত দেবেন যদি পাঁচটা টাকা পাঠায়! দেবেন পাঠিয়েছিল দুটি টাকা। সেই কুপনে লিখেছিল যে, ‘এখানে এক বেটা ইংরেজী- জানা লোক আসিয়া বসিয়াছে যদিও সে আমার চেয়ে বেশি ডাক্তারী জানে না, তথাপি ইংরেজীর ভুচুং দিয়া আমার পসার মাটি করিতে বসিয়াছে। এক্ষণে আমার সংসার চলাই দায়। নচেৎ শ্রীমানকে দেখা ত আমার কর্তব্যের মধ্যেই’ ইত্যাদি—-

লেখা চলত তার মাকে, সে ইঙ্গিতও যে ক্ষমা দেন নি তা নয় কিন্তু সেখানে শ্যামা অটল। কোন কারণেই সে মার কাছে এই অবস্থায় হাত পাতবে না। মাকে অন্তত সে জানতে দেবে না তার অবস্থাটা। শাশুড়ীও বধূর মন বুঝে স্পষ্ট ক’রে বলতে সাহসে করেন নি কথাটা।

কিন্তু মাস ছয়েকের মধ্যেই ক্ষমার শরীর অসম্ভব ভেঙ্গে পড়ল। রক্তাল্পতার সমস্ত লক্ষণ দেখা দিল, হাত পা ফুলতে শুরু হ’ল। এইবার যথার্থ প্রমাদ গুনলে শ্যামা। এই বিদেশ-বিভূঁয়ে একা এই অবস্থায় কি করবে সে? বিশেষ তার অল্প বয়স এবং সে সুশ্রী দেখতে– এটার যে কী বিপদ তা পদে পদেই বুঝতে পারে আজকাল। পাশের তাঁতিগিন্নী খুব দেখাশুনো করেন, তেলিপাড়ার দুটি-তিনটি পরিবারও নিয়মিত সাহায্য করে, সেজন্য বিপদ খুব কাছে আসে না কিন্তু আশেপাশেই যে ঘোরে, সে আভাস শ্যামা পায়।

অল্পবয়সী ছেলেদের অভাব নেই পাড়ায় তারা দুপুর ও অন্ধকার সন্ধ্যায় পাঁচিলের পাশে পাশে শিস্ দিয়ে, ঘোরে, গাছের ডালে উঠে দ্বিতলের বাতায়নবর্তনীয় দৃষ্টি আকর্ষণ করবার চেষ্টা করে এবং অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন যারা, তারা নাপিতিনীকে দিয়ে অলঙ্কারের প্রলোভন দেখায়। শুধু তাঁতিগিন্নীর পাঁচটি জোয়ান ছেলে আছে ঘরে এবং তিনি প্রায়ই বেশ চেঁচিয়ে বলে যান ‘কেউ যদি একটু ওপর-নজরে

৫১

চায় বৌমা, কি কিছু ইশেরা-ইঙ্গিত করে, তখুনি আমাকে বলে দেবে মা দিনে- দুপুরে তা মুণ্ডুটা ধড় থেকে ছিঁড়ে নিয়ে তোমার পায়ের কাছে ফেলে দেবে আমার ব্যাটারা। হ্যাঁ,– ওরা পাঁচ ভাইয়ে লাঠি ধরলে কোম্পানীর ফৌজে কিছু করতে পারবে

সেইজন্য বাড়াবাড়ি করতে কেউ সাহস করে না।

না!’

মাসখানেক ধরে চিন্তা ক’রে শ্যামা ওর মাকেই একখানা চিঠি লিখলে। সব খুলেই লিখতে হ’ল। মিছিমিছি আর গোপন ক’রে লাভ নেই।

কিন্তু সেই চিঠির যা জবাব এল তা শ্যামাকে আবারও পাথর ক’রে দিলে। স্বামীর কোন ব্যবহারেই আজ ও বিস্মিত বোধ করবে না এমন একটা ধারণা ওর হয়েছিল কিন্তু মার চিঠি পেয়ে বুঝলে যে এখনও ওর সেই লোকটিকে চিনতেই বহু বিলম্ব আছে।

মা যা লিখেছিলেন তার তারিখ মিলিয়ে শ্যামা দেখলে যে এখান থেকে ফিরে দিনকতক পরেই নরেন রাসমণির সঙ্গে দেখা করে এবং শ্যামা ও খোকার এক কল্পিত রোগের বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে কিছু অর্থ সাহায্য চায়। নরেনকে চিনলেও সে বিবরণ শুনে তিনি স্থির থাকতে পারেন নি ঋণ ক’রেও কিছু টাকা দিয়েছিলেন। তারপর আরও বার-দুই কিছু কিছু দেবার পর তাঁর সন্দেহ হয়, তিনি সোজা বলেন যে মেয়ের নিজের হাতের লেখা চিঠি না পেলে তিনি আর এক পয়সাও দেবেন না। নরেন সেখান থেকে ফিরে বড় শালী কমলার কাছে যায় এবং সেখান থেকেও চোখের জল ফেলে দু- দফায় মোটা টাকা আদায় করে। দৈবাৎ কমলা বাপের বাড়ি আসায় কথায় কথায় কথাটা বেরিয়ে পড়ে এবং কমলাও সতর্ক হয়। শেষ কমলার কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার পর নরেন আর আসে নি।

এ ছাড়াও চিঠিতে দুঃসংবাদ ছিল। উমার স্বামী রাত্রে কোনদিনই বাড়ি আসে না। বিবাহের আগে থেকেই সে বেশ্যাসক্ত সে কথা নাকি ফুলশয্যার রাত্রে উমার কাছে অকপটে স্বীকার করেছে। তার ওপর তার শাশুড়ীর যে অমানুষিক নির্যাতনের সংবাদ লোকমুখে রাসমণির কাছে আসছে তা চিঠিতে লেখা যায় না। উমা কিছুই বলে না কিন্তু বহু লোকের মুখে একই কথা শুনছেন তিনি, কাজেই অবিশ্বাসের কোন কারণ নেই। রাসমণির বহুদিন ধরেই ঘুম হ’ত না রাত্রে এখন ফিটের অসুখ দেখা দেয়েছে। একা থাকতে হয় কোন্ দিন মরে পড়ে থাকবেন এই ভয়ে বড়মাসিমাকে আনিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু তিনি দিনকতক থেকে ঝগড়া ক’রে চলে গেছেন। এ অবস্থায় যদি শ্যামা তার শাশুড়িকে বুঝিয়ে কোনমতে ওর কাছে নিয়ে যেতে পারে ত প্রকারান্তরে রাসমণির উপকার করাই হবে।

চিঠি পড়তে পড়তে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে চোখ দিয়ে ঝরঝর ক’রে জল পড়তে থাকে শ্যমার। ক্ষমা তা লক্ষ্য ক’রে ব্যাকুল হয়ে বলেন, ‘কী লিখেছেন বেয়ান, বৌমা? খারাপ খবর কি কিছু? · আমাকে পড়ে শোনাও না মা

চোখ মুছে চিঠি পড়বার চেষ্টা করে শ্যামা কিন্তু প্রথম প্রথম কিছুক্ষণ ঠোঁট দুটোই নড়ে শুধু তা দিয়ে স্বর বেরোয় না। অনেকক্ষণ পরে অতিকষ্টে সে একটু একটু ক’রে পড়ল। ক্ষমা প্রথম অংশটা শুনে আর্ত চিৎকার করে উঠেছিলেন একবার, ‘ঠাকুর, আর কত শোনাবে ছেলের কীর্তি! এবার নাও দয়া করো।’ কিন্তু শেষাংশ শুনে কে

জানে কেন যেন কতকটা শান্ত হয়ে উঠলেন। উমার সুখ-সৌভাগ্যের সংবাদ এলে যেন সেজন্য অপরের, দুর্ভাগ্যের বিবরণ তাঁর কাছে মনের

তাঁর আরও লজ্জার কারণ হ’ত

অজ্ঞাতেই সান্ত্বনার কারণ হয়ে উঠল।

তিনি বললেন, ‘তোমার মার উঁচু মন বৌমা, অমনকরে লিখেছেন। ভিক্ষে কি ক’রে দিতে হয় তা তিনি জানেন। তোমার মাদেবী।’

শ্যামা নিমেষে আশ্বস্ত হয়ে উঠে বললে, ‘তাহ’লে মাকে লিখে দিই যে আমরা যাচ্ছি?’

ক্ষমা একটু চুপ ক’রে থেকে বললেন, ‘বৌমা, দীর্ঘ জীবনটা কেটে গেল, আর কটা দিন বা বাঁচব, বেশ বুঝতে পারছি যে ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে এসেছে। আর কেন মা পারো ত অন্তত এ অপমানটা থেকে বাঁচাও আমাকে।’

এরপর আর অনুরোধ করতে পারে না শ্যামা কিন্তু ভয়ে ওর ঘুম হয় না রাত্রে। দিন দিন ক্ষমা শয্যাগত হয়ে পড়ছেন, এর পর আর নিয়ে যাওয়াও যাবে না।

কিন্তু দিন-দুই পরে ক্ষমাই কথাটা পাড়লেন। শ্যামাকে ডেকে বললেন, ‘বৌমা, এখানে আর থাকা উচিত নয়। বেশ বুঝতে পারছি এই যে শয্যা পেতেছি এই শেষ। এঁরা অবশ্য আছেন, দেখাশুনোও করবেন জানি, তবু যতটা সম্ভব তোমার মার কাছেই থাকা উচিত এখন। এক কাজ করো মা, ঐ পাড়ায় আমার শ্বশুরের এক শিষ্য আছেন উকিল

তাঁকে চিঠি দাও, যেন কোনমতে একটা ঘর দেখে দেন তাঁর বাড়ির কাছে। বাসন-কোসনগুলো ত আছে, তাঁতি-বৌয়ের ছেলেদের দিয়ে কতক কতক যদি বিক্রি করাতে পারি ওরা ত নবদ্দীপে যায়, সেখানেও বেচে দিতে পারে তাহ’লে দুটো-একটা মাসের খরচ চলে যাবে। তারপর ওখানে তোমার মা রইলেন, তিনি তোমাকে দেখতে পারবেন।’

শ্যামা এ ব্যবস্থার সহস্র অসুবিধার কথা ব’লে আর একবার বোঝাতে চেষ্টা করলে, কিন্তু তিনি কেঁদে ওর হাত দুটো চেপে ধরলেন, ‘মা, তার চেয়ে গঙ্গায় গা ঢালাও আমার কাছে ঢের সহজ।

অগত্যা কলকাতার সেই শিষ্যবাড়ি চিঠি লেখা হ’ল। উকিলবাবুটি পত্রপাঠ উত্তর দিয়ে জানালেন যে তাঁরই একখানা ঘর খালি পড়ে আছে। একেবারে পৃথক মত, স্বচ্ছন্দে তাঁরা গিয়ে থাকতে পারেন। তারপর, যদি সেখানে ওঁদের সুবিধা না হয়, নিজেরা আশেপাশে ঘর দেখে নিতে পারবেন।

উনি।

ক্ষমা চিঠিটা শুনে বললেন, ‘যদিও ছেলেদের বিদ্যের বহর দেখে ওরা গুরুবংশ ত্যাগ করেছে, তাহ’লেও আমি জানতুম যে আমাকে একেবারে ত্যাগ করতে পারবে না। ওঁর ছেলেকে দীক্ষা দেবার আগে আমার কাছ থেকেই অনুমতি নিয়ে তবে অন্য গুরু করেন তাই চল মা, স্বামী-শ্বশুরের শিষ্য বংশ, সেখানে তবু জোর আছে কিছু!’ তাঁতিগিন্নীকে বলতে ওর ছেলেরা নবদ্বীপ থেকে কাঁসারি ডেকে আনলে ব্রাহ্মণের বাসন কোন গৃহস্থ ওখানে কিনতে রাজী হ’ল না। যা টাকা পাওয়া গেল তাতে খুচরো দেনা শোধ ক’রে হাতে ত্রিশ-চল্লিশ টাকার বেশি রইল না। সেই ক’টি টাকা

করে যাতে

না। সেইল না। ভরসা করেই দুটি স্ত্রীলোক বহু দিনের আশ্রয় গুপ্তিপাড়া একদিন ত্যাগ করলেন।

তবু

দুই

কলকাতায় এসেই ক্ষমার শরীর একেবারে ভেঙে পড়ল। রাসমণি অনেক দেখেছেন– তিনি দিন সাতেক দেখেই মেয়েকে বললেন, ‘ভাল বুঝছি না মা ভাশুরকে লেখা দরকার!’

তোর

নরেনের ঠিকানা কারও জানা নেই। এ অবস্থায় দেবেনকে লেখা ছাড়া উপায় কি? শ্যামা বড় জাকে বিস্তৃত চিঠি লিখে দিলে, তবু দেবেনের আসতে দিন চারেক দেরি হ’ল। শেষ পর্যন্ত যখন সে এসে পৌঁছল তখন ক্ষমার প্রায় কথা বন্ধ হয়ে এসেছে। দেবেন পাশে গিয়ে বসে কাঁদতে লাগল। ক্ষমা অতি কষ্টে কম্পিত হাতখানি তুলে ওর চোখ মুছিয়ে দিয়ে মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন।

বাবা?

‘মা, কিছু খেতে ইচ্ছা হয় তোমার?’

দেবেন প্রশ্ন করে।

ক্ষমা হাসলেন একটু। তারপর অতিকষ্টে বললেন, ‘নরেন

‘তার কথা আবার মুখে আনছ মা তুমি? তোমার লজ্জা করে না?

সে নাম আমার কাছে ব’লো না

সাফ ব’লে দিলুম!’

রাসমণি ঘোমটা দিয়ে একপাশে বসেছিলেন, বাধ্য হয়ে এবার মুখ খুললেন। বললেন, ‘বাবা, যতই যা হোক তাকে উনি পেটে ধরেছেন। নাড়ীর টান কোথায় যাবে তুমিও ত কম অপরাধ করো নি বাবা, তবু তোমাকেও উনি আশীর্বাদ করেছেন!’ দেবেন জ্বলে উঠে বললে, ‘সে হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা দেখুনগে যান খাকী- বাড়ি পড়ে আছে, আমি সেইখানে যাবো নাকি

তাকে ডাকতে?’

রাসমণি আর কথা কইলেন না। কিন্তু দেবেন নিজেই খানিকটা ইতস্তত ক’রে সন্ধ্যার পর বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা থেকে রাত্রি গম্ভীর হয়ে এল ক্ষমার শ্বাসকষ্ট শুরু হ’ল তবু কারও দেখা নেই। না দেবেনের না নরেনের। রাসমণি প্রমাদ গুনলেন। শেষে শেষরাত্রে বললেন, তোমরাই একটু একটু গঙ্গাজল দাও আর নাম শোনাও পাষন্ড ছেলেদের হাতে জল নেওয়ার অপমানটা বোধ হয় অদৃষ্টে নেই।’ তিনি নিজেও বেয়ানের বুকে হাত বুলিয়ে নাম শোনাতে লাগলেন।

দেবেন এল একেবারে সকাল বেলা। তখন ক্ষমার শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেছে। খানিকটা থমকে দাঁড়িয়ে থেকে বললে, ‘তা আমি কী করব! মা মাগীর জন্যেই ত এইটি হল ও শালাকে খুঁজতে গিয়ে খুঁজে ত পেলুমই না লাভে হ’তে পুরোনো জায়গায় গিয়েছি, সেই সব পাল্লায় পড়ে কি আর বেরিয়ে আসা যায়! মাঝখান থেকে মার শেষ সময়টায় মুখে একটু জল পড়ল না! ছো!’

তিন

নরেন যে সংবাদটা পায় নি তা নয়– কিন্তু শ্রাদ্ধের খরচের প্রশ্নটা উঠবে বলেই বোধ হয় এল ঘাটের আগের দিন। যেন সংবাদটা এইমাত্র পেলে এই ভাবে ছুটতে ছুটতে এসে ঢুকে, ‘য়্যা– মা নেই। মা, মাগো!’ বলে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল।

৫৪

দেবেন খানিকটা চুপ ক’রে ছিল কিন্তু তারপরই দিলে এক ধমক, ‘মেলা য়্যাক্টো করিস্ নি নরো– চুপ ক’রে থাক্ তোকে চিনতে কারুর বাকী নেই। খবর কি তুই আজ পেলি?’

‘মাইরি দাদা, তোমার দিব্যি বলছি।’ এই বলে নরেন ওর দিকে দু পা এগিয়ে এল হয়ত বা গায়ে হাত দিয়ে দিব্যি গালতেই।

‘খবরদার ছুঁস নি। মিথ্যাবাদী কম্‌নেকার

দাড়িগোঁফ কেন? খালি পায়ে এলি কেন?’

জানিস না যদি ত মুখে একগাল

নরেনের- মাথায় অত কথা যায় নি। খানিকটা থতমত খেয়ে চুপ ক’রে থেকে নাকীসুরে বিনিয়ে বিনিয়ে বলতে শুরু করলে, ‘বলে আমি মরতে বসেছিলুম, আজ এক মাস রোগে ভুগছি।’

‘হ্যাঁ –এক মাস ভোগারই চেহারা বটে। তোর মিছে কথা শুনলে ঘেন্না করে।’

‘দ্যাখো দাদা, বেশি সতীপনা করো না। তুমি সে রাত্তিরে কোথায় কাটিয়েছিলে তা জানি নে?’

‘দেখলে দেখলে

নচ্ছার হারামজাদার মিছে কথা ধরা পড়ে গেল। দেখলে!’

প্রায় চুলোচুলি বেধে ওঠে দেখে রাসমণি এগিয়ে এলেন। তিনি শ্রাদ্ধের যোগাড় ইত্যাদির ব্যাপারে কদিন এখানেই থাকছেন সারাদিন। খরচও তাঁরই দেবেন খবর পেয়ে এক কাপড়ে চলে এসেছে এই অজুহাত দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে। রাসমণি ডাকলেন, ‘দেবেন! এই কটা দিনও যদি ভাল থেকে মার কাজটা করতে না পারো বাবা, তাহ’লে আর এ সবে কাজ নেই –জিনিসগুলো গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হও!’

সে কণ্ঠস্বরে শুধু দেবেন নয়, নরেনও নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

কিন্তু কোনমতে শ্রাদ্ধটা কাটিয়েই নরেন আবার ডুব মারলে। নিয়মভঙ্গের দিনও রইল না। তিনি চার দিন পরে মাথা চুলকে দেবেন বললে, সেখানে বিস্তর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে আমি ত আর অপেক্ষা করতে পারি না মা!’

‘আর কেন অপেক্ষা করবে বাবা, তুমি যাও। আমি যখন ওকে পেটে জায়গা দিয়েছি—- হাঁড়িতেও জায়গা দিতে পারব।’

রাধারাণী অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল শ্যামাকে জড়িয়ে ধরে। তার চেহারা হয়ে গেছে কঙ্কালসার। সর্বাঙ্গে ঘা চোখ দিয়ে নাকি আজকাল পুঁজ পড়ে। বললে, ‘আমি আর

বেশি দিন বাঁচব না, ভাই, এই হয়ত শেষ দেখা –‘

‘ছি! কী যে বলো দিদি!’

‘না ভাই, খারাপ ব্যামো ধরিয়েছিল বস্তিতে গিয়ে

সেই রোগ আমাতেও ছড়িয়ে

গেছে। আর বাঁচবার সাধও নেই। ভয় শুধু ছেলেটার জন্যেই—-দেখছিস ত ওরও কি অবস্থা। ছেলেটাও বেশি দিন বাঁচবে না তাও বুঝছি। তবে আমি আগে যেতে পারি যাতে, সেই কথা বল্ তোরা।’

শ্যামা শোনে আর শিউরে ওঠে।

খারাপ ব্যামো সম্বন্ধে পরিষ্কার কোন ধারণা নেই তার –কিন্তু ওর সন্দেহ হয় নরেনেরও তেমনি একটা কিছু আছে। এর আগের বারে সে তাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিল। নরেন সদম্ভে উত্তর দিয়েছিল, ‘হবে না কেন, হয়েছে। ও সব ডাকসাইটে

৫৫

পাড়ায় গেলেই হয়ে –তাই ব’লে আমি কি দাদার মত? আমি দস্তরমত চিকিচ্ছে করিয়েছি। কবিরাজী চিকিচ্ছে!

কিন্তু সে কথায় শ্যামার আস্থা কম। অথচ তার দেহের মধ্যে আর একটি সন্তানের আগমন-সম্ভাবনা প্রায় আসন্ন হয়ে এসেছে। কী হবে তাই ভেবে এখন থেকেই ওর ঘুম হয় না।

মা বললেন, ‘তাহ’লে তুই নে তৈরি হয়ে।’

শ্যামা ঘাড় নেড়ে বললে, ‘আমি যাবো না মা।’

‘সে কি রে, এখানে কে তোকে দেখবে? আমিই বা রোজ আসি কি ক’রে?’

‘কিন্তু মা–ওখানে গেলে ও আর কোন দিনই আমাকে নিয়ে যাবে না, দিব্যি তোমার ঘাড়ে সব চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হবে, নিজেও দিব্যি হয়ত চেপে বসবে।’

‘সে ওষুধ আমার আছে মা। তুমি ভেবো না। তোমাকে রাখব ব’লে ওকে বাড়ি ঢুকতে দেব তা ভেব না।’

শ্যামা কী করবে ভেবে পায় না। অথচ এখানে একা থাকা, আসন্ন সন্তান-সম্ভাবনা- সে যে অসম্ভব। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চোখের জল মুছতে মুছতে উঠে পড়ে। বহুদিন পরে বাপের বাড়ি যাবে, মার কাছে যাবে কিন্তু কিছুমাত্র আনন্দ হচ্ছে না তার। এমন নিরানন্দে বাপের বাড়ি যাওয়ার কথা কোন মেয়ে কখনও বোধ হয় কল্পনা করতে পারবে না।

স্বামীকে মা বাড়ি ঢুকতে দেবেন না। সে যদি কোনদিন বাড়িতে না-ই ঢোকে? চিরকাল বাপের বাড়ি থাকা? মার কাছে? মা-ই বা কদিন? দুশ্চিন্তায় হাত পা যেন পাথরের মত হয়ে ওঠে –তাড়াতাড়ি নাড়তেও পারে না।

চার

শ্যামাকে বেশিদিন একা থাকতে হ’ল না। উমা এসে জুটল মাসখানেকের মধ্যেই। একদিন সন্ধ্যায় বসে শ্যামা মাকে মহাভারত পড়ে শোনাচ্ছে

উঠল কট কট কট কট্ ক’রে।

দরজার কড়া নড়ে

‘এমন ভাবে কে কড়া নাড়ে রে!’ রাসমণি বিস্মিত হয়ে ঝিয়ের সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে এলেন। দরজা খুলে দেখা গেল একটি মোটাসোটা বর্ষীয়সী মহিলা-এক গা গহনা, চওড়া-পেড়ে দামী শাড়ি পরনে তার পিছনে উমা। উমা মাথা হেঁট ক’রে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ও কাঁপছে থরথর ক’রে।

এ কী ব্যাপার!’ রাসমণি অতি কষ্টে বলেন।

‘বলি বাছা, তুমি এর মা?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘মাগী, পেটে ঠাঁই দিয়েছিস্ হাঁড়িতে দিতে পারিস্ নি? মেয়েকে কি করতে রেখে দিয়েছিস্ সেখানে? এর চেয়ে দাসীবৃত্তি করলে যে খোরপোশ ছাড়া মাইনে পেত কিছু। সে তাড়কা রাক্কুসীর কাছে কিনে দিলেও ত হ’ত–

পালার ত

রখে একগাছা দড়ি আর একটা কলসী

19

রাসমণি ততক্ষণে একটু সামলে নিয়েছেন। বললেন, ‘আপনি কে জানি না

একথা কেন বলছেন তাও জানি না, কিন্তু মা

মেয়েকে শ্বশুর-বাড়ি থেকে বাপের

বাড়ি এনে রাখাটা কি খুব সম্মানের কথা? শ্বশুরবাড়িতে দাসীবৃত্তি করাও ভাল এই শিক্ষাই পেয়েছি আমরা!’

‘তা কি আমরা জানি নে বাছা’, একটু নরম হয়ে তখন তিনি বললেন, ‘আমরাও হিদুর ঘরের মেয়ে। শ’বাজার রাজবাড়ির মেয়ে আমি উচিত-অনুচিত সবই বুঝি। কিন্তু মা সম্ভব-অসম্ভব আছে ত। আমার বাড়ি বাছা ঐ পাড়াতেই, তোমার বেয়ানবাড়ির উঠোন আমার জানালা দিয়ে দেখা যায় সবই দেখি। আজ তিন দিন এই মেয়েটাকে খেতে দেয় নি, তার ওপর সমানে খাটাচ্ছে। আজ ঘড়া ক’রে রাস্তার কল থেকে জল আনতে গিয়ে উঠোনে আছাড় খেলে, শাশুড়ী মাগী ছুটে এসে আগে ঘড়া দেখছে, আমি আর অচৈরণ সইতে না পেরে বলনু যে আগে ঐ কচি মেয়েটাকে দ্যাখো বাছা। তা বললে কি, বউ গেলে আবার বউ হবে ঘড়া গেলে কিনতে হবে নগদ টাকা দিয়ে। তাও গেল আজও সারাদিন ঐ ছুতো ক’রে খেতে দেয় নি। কি ভাগ্যি সন্ধ্যেবেলা মাগী বেরিয়েছে ছেলের অফিসে না কোথায় সেই ফাঁকে আমি ওকে বার ক’রে নিয়ে এসেছি। এখন পুষতে পারো পোষো নয়ত একটা কলসী কিনে গঙ্গায় দিয়ে এসো নিজে হাতে –‘

এক নিঃশ্বাসে এতগুলো কথা বলে তিনি যেন হাঁপাতে লাগলেন। রাসমণি হেঁট হয়ে প্রণাম করতে গেলে, এতখানি জিভ্ কেটে বললেন, ‘হাঁ হাঁ বাছা করো কি! তোমরা ব্রাহ্মণ। পাপে ডুবিও না।’

‘মা পৈতে থাকলেই ব্রাহ্মণ হয় না আপনি অনেক ব্রাহ্মণের চেয়ে উঁচু!’

‘তা হোক বাছা। বাপরে– হাজার হোক তোমরা বামুনের মেয়ে– গোখরো সাপ!’

তিনি আর বসলেন না

ওখান থেকেই বিদায় নিলেন। গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে,

সেই গাড়িতেই ফিরে যাবেন এই অজুহাতে থাকতে রাজী হলেন না।

সে রাত এই তিনটি প্রাণীর যে ভাবে কাটল, তা অবর্ণনীয়। দুই বোনের চোখের জল একবারও শুকোল না শুধু রাসমণি স্তম্ভিত স্থির ভাবে বসে রইলেন। ভোরের দিকে বার-দুই পর পর ফিট্ হবার পর প্রথম তাঁর চোখের জল এল।

পরের দিন সকালেই দয়াময়ী এসে হাজির হলেন। ভেতরে ঢুকে উঠোনে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন, কৈ, কে কোথায় সব! আমার আর দাঁড়াবার সময় নেই।’

উমা সে কণ্ঠস্বর শুনেই সভয়ে জড়িয়ে ধরল শ্যামাকে। রাসমণি বেরিয়ে এলেন। ‘শোন বাপু। যে শিক্ষা দিয়েছ তোমার মেয়েকে, তার উপযুক্ত কাজই সে করেছে কাল কুলত্যাগ ক’রে বেরিয়ে গেছে সে। কর্তব্য বুঝে জানালুম, এর পর আমার কোন দায়-দোষ নেই। ‘

‘শ্বশুরবাড়ির শিক্ষা বেশি দিন পেলে হয়ত তাই করত বেয়ান’, রাসমণি কঠিন কণ্ঠে বলেন, ‘কিন্তু আমার শিক্ষা এখনও ভোলে নি বলেই তা করে নি। তাকে আমি এখানে এনে রেখেছি।

ཁ་བ། ང་། ངས་ད་འ་དང་

‘অ! তাই ত বলি

মা-মাগীর যোগ-সাজস! দ্যাখো, ভাল চাও ত আমার বৌ

এখনি বার করো, নইলে আমি থানা-পুলিশ করব!’

‘ক্ষমতা থাকে তাই করো। আমার মেয়ে ও বাড়ির চৌকাঠ আর মাড়াবে না! কণ্ঠস্বর শান্ত কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে আগুন জ্বলে ওঠে ওঁর।

‘তাই বা কেন! আমি থানা-পুলিসের তোয়াক্কা রাখি না, আমি নিজেই নিয়ে যাবো। দেখি কে আটকায়!’ দয়াময়ী দু পা এগিয়ে এলেন।

দয়াময়ী ছিলেন উঠোনে, রাসমণি রকের ওপরে। অকস্মাৎ তাঁর শরীরের সমস্ত রক্ত যেন ফুটে উঠল টগবগ ক’রে তিনি পাশ থেকে বড় বঁটিখানা তুলে নিলেন।

‘নরহত্যা মহাপাপ কিন্তু জানি মা জগজ্জননী এতে অপরাধ নেবেন না। তুমি যা করেছ তারপর তোমার সামনে দাঁড়িয়ে পাগল না হওয়া অসম্ভব! আর যদি এক মিনিট এখানে থাকো ত বঁটি দিয়ে দুখানা ক’রে ফেলব। এই গুরুর দিব্যি বলছি।’

সে সময় রাসমণির যে রুদ্র মূর্তি ফুটে উঠেছিল তা দেখে দয়াময়ীও ভয় পেয়ে কোনোমতে পা পা ক’রে পিছিয়ে এসে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। আর একটি

গেলেন

কথাও বলতে সাহসে কুলোলো না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *