০৩. বিরাট খালি বাড়িটা

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বিরাট খালি বাড়িটা হা হা করে। সব ঘরগুলোই বন্ধ করে রাখা হয়েছে, একটা ছাড়া। তবু যেন শ্যামার গা ছমছম করে। সেটাই যেন একটা বিভীষিকা। দেবেনরা চলে যাওযার পর থেকে ক্ষমাও কথাবার্তা বিশেষ বলেন না, শুধু নিঃশব্দে চোখের জল মোছেন আর মধ্যে মধ্যে প্রচন্ড শব্দ ক’রে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। শ্যামাই বা নিজে থেকে তাঁর সঙ্গে কী কথা কইবে, কী ব’লে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায় না। সে-ও চুপ ক’রে থাকে। সেই প্রচণ্ড এবং দুঃসহ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ হয় একমাত্র যখন ওর খোকা কেঁদে ওঠে তখনই। কিন্তু তার কান্নার শব্দ খালি বাড়িতে প্রতিধ্বনিত হয়ে এমন একটা বিচিত্র ধ্বনি সৃষ্টি করে যে শ্যামা কতকটা ভয় পেয়েই তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে চুপ করাতে চেষ্টা করে।

ক্ষমা অবশ্য একাধিক দিন বলেছেন শ্যামাকে, ‘ছেলেই যখন মায়ের মুখ চাইলে না তখন তুমি পরের মেয়ে কেন মিছে কষ্ট করছ মা, তোমার কিসের দায়িত্ব, তুমি কলকাতা চলে যাও, আমার দিন একরকম ক’রে কাটবে।’

শ্যামা কিছুতেই রাজী হয় নি, সেও উল্টো প্রস্তাব করেছে, ‘তা হ’লে আপনিও চলুন কলকাতায়। আমার মা আপনাকে মাথায় ক’রে রাখবেন।’

ক্ষমা জিভ কেটে বলতেন, ‘সে আমি জানি মা। কিন্তু বুড়ো বয়সে ছেলের শ্বশুরবাড়ি গিয়ে উঠব এক মুঠো ভাতের জন্য, সে বড় লজ্জার কথা। সে পারব না।’

পাড়ার সবাই ছি ছি করে। তাদের সেই সরব সহানুভূতি যেন তীরের মত বেঁধে শ্যামাকে, অথচ কী-বা তার বলবার আছে? তার স্বামী বা ভাশুর যা তা-ই তারা বলে মাত্র। তারা ওদের প্রাণ-ধারণের উপায় ক’রে দিয়ে ধিক্কার দিচ্ছে তাদের, যাদের সে উপায় করবার কথা। রাগ করার কথা নয়, বিবাদ করার কথাও নয় কৃতজ্ঞ থাকারই কথা। শ্যামাও তাই থাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু তখনও যেটুকু আত্মসম্মানজ্ঞান তার ছিল তা যেন নিঃশব্দ দহনে তাকে দগ্ধ করে।

স্বামীর কথা ওর মনে হয় যেন ছবির মত। এরই মধ্যে যেন তার চেহারাটা মনের মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। যারা বহুদিন পর্যন্ত স্বামীর চেহারা ধ্যানের মধ্যে উজ্জ্বল ক’রে রাখে তাদের কথা শ্যামা জানে না তবে তার এখনই স্পষ্ট ক’রে মনে করতে যেন অসুবিধা হয়। শুধু মনে আছে স্বামী তার সুন্দর; তার সঙ্গের, তার সাহচর্যের আনন্দানুভূতিটা শুধু আজও মনে আছে।

মাঝে মাঝে প্রচন্ডভাবে, উন্মত্তভাবেই সেটা মনে পড়ে। সমস্ত মন আকুলি-বিকুল ক’রে ওঠে তাকে পাবার জন্য, তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য। ক্ষোভে দুঃখে সে সময় ওর মাথা খুঁড়তে ইচ্ছা করে, মনে হয় নিজের কোন দৈহিক যন্ত্রণার কারণ ঘটলে যেন সে কতকটা সুস্থ হ’তে পারে। এই সময়গুলোতে স্বামীর কোন অপরাধের কথাই মনে থাকে না, শুধু মনে হয় সে ফিরে আসুক। কিছু বলবে না তাকে।

এমনি ক’রে আরও কয়েক মাস কাটবার পর হঠাৎ কলকাতা থেকে চিঠি এল, উমার বিয়ে। শ্যামাকে কি পাঠানো সম্ভব হবে? তাহ’লে রাসমণি লোক পাঠাতে পারেন তাকে নিয়ে যাবার জন্য।

ক্ষমা চিঠি পড়া শেষ ক’রে বধূর মুখের দিকে চাইলেন!

‘কি করবে বৌমা?’

উমা তার যমজ বোন। শৈশব ও বাল্যের ক্রীড়াসঙ্গিনী। একই বোঁটায় দুটি ফুল একসঙ্গে ফুটে উঠেছিল।

উমা, এক মুহূর্তও যাকে দেখতে না পেলে শ্যামা ঠিক থাকতে পারত না। রাত্রে মায়ের দু’পাশে দুজন শুয়ে মায়ের বুকের ওপর দিয়ে পরসম্পরের হাত ধরে থাকত। উমা যেন তার নিজের অস্তিত্বেরই একটা স্বতন্ত্র প্রকাশ ছিল।

সেই উমার বিয়ে! সমস্ত মন দেহ, ওর সমস্ত সত্তা সেই মুহূর্তে চাইল পাখা মেলে উড়ে যেতে ওদের কলকাতার সেই ছোট্ট দোতলা বাড়িটাতে। যার ছাদ ও চিলেকোঠায় ওদের দুই বোনের বাল্যের শত সহস্র স্মৃতি জড়িত আছে।

কিন্তু সেই উমার বিয়ে ব’লেই যাওয়া সম্ভব নয়।

বন্ধুকে নিরুত্তর দেখে ক্ষমা সম্মতির লক্ষণ ধরে নিলেন। ম্লান হেসে বললেন, ‘ভাবছি, কী যৌতুক করবে তোমার বোনকে। একটা কিছু না দিলে ত মান থাকে না। অন্তত আইবুড়ো ভাতের একটা শাড়িও নিয়ে যেতে হবে!

‘আমি যাবো না মা।’

‘যাবে না বৌমা? কেন মা?’ প্রশ্ন করলেন বটে কিন্তু ক্ষমার কণ্ঠে যে উদ্বেগ প্রকাশ পেল সে যেন, যদি বৌমা মত বদল করে এই আশঙ্কায়।

শ্যামা নতমুখেই জবাব দিলে, ‘কী প’রে গিয়ে দাঁড়াব মা? গহনা ত সবই সেখানে রইল। আছে কিনা তাও জানি না। বেনারসী শাড়িটা পর্যন্ত এখানে নেই। ভাল কাপড়ও ত নেই একখানা। এ অবস্থায় সেখানে গেলে নানা লোকে নানা কথা বলবে মা কটার উত্তর আমি দেব? আপনার ছেলের কথাই বা কি বলব। আর যৌতুকের কথা ত আছেই। তাছাড়া একেবারে একা আপনাকেই বা কার কাছে রেখে যাব?’

‘সে না হয় দুলে-বৌকে দুদিন রাত্তিরে থাকতে বললুম। কিন্তু বাকী কথাগুলোই –এই পর্যন্ত ব’লে কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোমার কপাল মা! নইলে নিজের বোনের বিয়ে আর এই তোমার মায়ের শেষ কাজ, যেতে পারলে না। আমারও কপাল যে জোর ক’রে তোমাকে যাও বলতে পারলুম না। সত্যিই ত, কীই বা প’রে যাবে, দেওয়ার কথা বাদই। তোমার মাকেই বা কী বলবে, তিনি ত আর কিছু কম দেন নি!’

তারপর একটু মেথে ওর পিঠে হাত দিয়ে সস্নেহে বললেন, ‘তবে একটা কথা ব’লে রাখি, স্বামীর সম্বন্ধে উল্লেখ করতে গেলে কারুর ছেলে কি কারুর বাবা এমন বলে উল্লেখ করতে নেই মা–ওতে নিন্দে হয়।’

কটা দিন যেন ভূতে পাওয়ার মত কী এক ঘোরে ঘুরে বেড়াল শ্যামা। ওর দেহটা আছে এখানে কিন্তু সমস্ত আত্মা যেন সেখানকার সেই বাড়িতে। কখন কি হচ্ছে সেখানে–এ ওকে ব’লে দেবার দরকার নেই। অবসর বা কাজকর্মের মধ্যেও সবটা যেন ওর চোখের সামনে ঘটছে। চোখ বোঁজবারও দরকার নেই, এমন কি চোখ অপর কোন বস্তুর বা ব্যক্তির দিকে মেলা থাকলেও দৃষ্টিতে ফুটে উঠছে অন্য জিনিস। দিদি এসেছে। দাদাবাবু। খোকা। বড় মাসিমা তাঁর বিখ্যাত হেঁসেলের ঘটি নিয়ে রান্নাঘরের চৌকাঠে এসে বসেছেন। তিনি বালবিধবা, হুতাশনের মত প্রচন্ড জ্বালা বুকে নিয়ে আজ এর বাড়ি কাল ওর বাড়ি ক’রে বেড়ান। ইহজগতের সম্বল বলতে তাঁর আছে মাত্র ঐ ঘটিটি। কোথাও কোন আশ্রয় নেই, আর কোন সম্পত্তি নেই। খান-দুই-তিন থান কাপড় ও ঐ ঘটি তাঁর সংসার। যখন যেখানে থাকেন গৃহস্থের কোন কাজে আাসেন না, তাদের খান অথচ অহরহ গালাগালি দেন। কুলীনের ঘরে বাপ-মা দেখেশুনে এক অর্থব বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। বিধবা হবার পর বলতেন, ‘ভবিতব্য, নইলে কত বুড়ো ত বেঁচে আছে!’ সেইজন্য বাপ-মাকেও গালাগালি না দিয়ে বড় মাসিমা জলগ্রহণ করেন না। তাঁদের উল্লেখ করতে গেলেই বলতেন –উঁ, বলে কিনা ভবিতব্য! দিলি জেনে-শুনে ঘাটের মড়াকে, তার আবার ভবিতব্য কি? তোরাই ত ভবিতব্য। ইনি ভবি আর আর উনি তব্যি। দুজনে মিলে আমার কপালটাকে কড়মড় করে চিবিয়ে খেয়েছেন!’

তবু বড় মাসিমাকে বাদ দেবেন না মা নিশ্চয়ই। তিনি রান্নাঘরের চৌকাঠ জুড়ে বসে পাহারা দিচ্ছেন তাঁর নিরামিষ রান্না কেউ আঁশ করে না ফেলে কিংবা অপর কেউ না ছোঁয়। আর এসেছেন মেজমামা। মেজমামা আর মেজমামার ছেলে এঁরা কখনও মাকে ত্যাগ করেন নি। কাকারা কেউ আসবেন না এটা ঠিক, তবে এক খুড়তুতো দাদা কলকাতাতেই থাকে মেসে, সে মাঝে মাঝে এসে মার কাছে খেযে যায়– সে আসবে। আরও এদিক ওদিক থেকে পাড়ার সব কাকীমা মাসিমা বৌদির দল।

কোথায় বাজারগুলো এনে ঢালা আছে তা শ্যামা জানে। পান সাজার সরঞ্জাম সিন্দুকের নিচেই রয়েছে নিশ্চয়। দিদি উমার বেনারসী কাপড়খানা দেখাচ্ছে সবাইকে। দাদাবাবু রসিকতা করছেন আর ভিয়ানের আয়োজনে ব্যস্ত। এ কাজটা তিনি জানেন ভাল।

উমার বর কেমন দেখতে হ’ল কে জানে! উমা শ্যামারই যমজ, ঐ রকমই সুন্দর দেখতে, তবে রঙটা ওর মত অত গোলাপী নয় একটু হলদেটে। মা বলেন, হরতেলের মত রং। তা হোক, তাতেই যেন আরও সুন্দর দেখায়– উমা, নামেও উমা দেখতেও তাই, সাক্ষাৎ দুর্গা যেন। নিশ্চয় ওর বরও দেখতে ভাল হয়েছে। মা জামাই না দেখে করেন না। দিদিকে দোজবরে দিয়েছেন বটে কিন্তু দাদাবাবুর কী চেহারা, যেন মহাদেব। তারও ত–

থাক্ তার স্বামীর কথা নির্জনে মনে হ’লেও চোখে জল ভরে আসে।

আহা উমা যেন সুখী হয় তার স্বামীকে নিয়ে। যেমনই দেখতে হোক সে। সুন্দর আর কাজ নেই।

বিয়ের তারিখ যত এগিয়ে আসে শ্যামার মন তত হুহু করে। ক্ষমা বধুর দিকে চেয়ে দেখেন আর নিজেও চোখের জল মোছেন আড়ালে। বিয়ের তারিখ যেটা, সেদিন ভোরে আর শ্যামা কিছুতেই স্থির থাকতে পারলে না। ভোরবেলা ওর কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে উঠে ক্ষমা দেখেন ঘর থেকে বেরিয়ে দালানে মেঝেতে পড়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে শ্যামা। আজ আর তার কোনও বাঁধ নেই, আজ আর ধৈর্যের অভিনয় করা সম্ভব নয়।

ক্ষমা একটি সান্ত্বনার কথাও মুখে উচ্চারণ করতে পারলেন না। শুধু পাশে গিয়ে বসে ওর মাথাটা জোর ক’রে নিজের কোলে তুলে নিলেন।

সারারাত ঘুমোয় নি শ্যামা। ওদের রাত জেগে কুটনো কোটার সময় সে অদৃশ্য থেকেই সারারাত যেন সেখানে ছিল। শুধু জল সইতে যাবার সময়টা মনে পড়ে আর কিছুতেই নিজেকে বেঁধে রাখতে পারে নি।

সত্যিই সে উমার বিয়েতে রইল না।

দুই

কিন্তু তার পরের দিনের পরের দিন, আইনত যেদিন উমার ফুলশয্যা হবার কথা, সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবেই এসে হাজির হ’ল নরেন।

শ্যামা যেন চোখকে বিশ্বাসই করতে পারে না, সে বিহ্বল হয়ে চেয়ে রইল শুধু। নরেন রসিকতা করার চেষ্টা ক’রে বললে, ‘কি গো, ভূত দেখলে নাকি? মাইরি, এত রকম ন্যাকামোও জানো!’

শ্যামা আরও অবাক হয়ে গিয়েছিল ওর চেহারা দেখে। শেষ ওকে দেখেছিল, সিল্কের পাঞ্জাবি দেশী ধূতি পরনে; সোনার ঘড়ি চেন। আজ সেখানে ছেঁড়া আধ-ময়লা কাপড়, একটা সুতো-সরা ছিটের কোট। কাপড় হাঁটু অবধি তোলা, এক পা ধুলো, খালি পা। একটা পুঁটুলি হাতে। আর তেমনি চেহারা, চুলগুলো রুক্ষ, সর্বাঙ্গে কে কালি মেখে দিয়েছে যেন-–এত কালো ওর স্বামী কখনই নয়! রোগা, ঘাড়টা সরু হয়ে গিয়েছে। অমন পুরন্ত গাল কে যেন চড়িয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে ভেতরে। অত বড় বড় চোখ তাও কোটরগত। সবচেয়ে ওর সন্দেহ হ’ল– বোধ হয় চুলেও কিছু কিছু পাক ধরেছে এই বয়সেই। হাতের কব্জিতে ও পায়ের গোছে পাঁচড়ার মত ঘা। সর্বাঙ্গে খড়ি উঠছে–মনে হয় যেন কত মাস স্নান করে নি।

সে অবাক হয়ে দেখেই চলেছে, এমন সময় ক্ষমাও ‘কে এল গা বৌমা’ ব’লে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে যেন পাথর হয়ে গেলেন ছেলেকে দেখে। কী যেন বলবার চেষ্টা করলেন, কিছুক্ষণ পরে ঠোঁট দুটো নড়লও বার কয়েক, কিন্তু কোন স্বরই বেরোল না তা থেকে– এবং নরেন যখন এগিয়ে এল ওর দিকে, বোধ হয় প্রণাম করবারই ইচ্ছে ছিল,–তিনি একটি কথাও না বলে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকে সশব্দে দোর বন্ধ ক’রে দিলেন।

‘বা রে! বেশ ত। মজা মন্দ নয়! মাও চং শিখেছে কত!’

অপ্রতিভ না হবার চেষ্টা করতে করতে নরেন আবার পিছিয়ে এল। তারপর পুঁটুলিটা শ্যামার কাছাকাছি মেঝেতে নামিয়ে রেখে বলল, ‘উমির যে বিয়ে হয়ে গেল। কৈ, তোমরা যাও নি ত কেউ?’

এ প্রশ্ন নরেনের পক্ষেই করা সম্ভব, শ্যামা এতদিনে স্বামীকে এটুকু বুঝেছিল। তাই সে কোন অনুযোগের চেষ্টাই করলে না। কিন্তু বিস্মিত সে হ’ল রীতিমতই। সব ভুলে গিয়ে প্রশ্ন করলে, ‘তুমি কি ক’রে জানলে?’

‘আরে, আমি কি জানি যে তুমি এখনও এখানে আছ। আমি ভেবেছি তোমাকে শাশুড়ী ঠাকরুন নিশ্চয় কলকাতাতে নিয়ে গিয়ে রেখেছেন যা আদুরে মেয়ে তুমি!’

‘অনুযোগ করব না’ মনে করলেও এক এক সময় অসহ্য হয় বৈ কি! শ্যামা ব’লে ফেললে, ‘আর বুড়ো মা তোমার, তাঁকে কোথায় রেখে যাবো?’

‘আমি ত ভেবেছিলুম মা-টা এতদিনে মরেই গেছে। নইলে দাদা হয়ত এসে নিয়ে- টিয়ে গেছে কোথাও। তাই আগেই খোঁজ করতে গিয়েছিলুম কলকাতাতে।’

‘তুমি, তুমি এই ভাবে সেখানে গিয়েছিলে নাকি?’ শিউরে ওঠে শ্যামা, প্ৰায় আর্তনাদ ক’রে ওঠে সে।

এবার নরেনও একটু অপ্রতিভ হয়, ‘আরে, আমি কি আর বিয়েবাড়ি জেনে গিয়েছিলুম! তারপর শাশুড়ী ছাড়লেন না, তা কি করি বলো। তিনি এত কথা জানতেনও না দেখলুম। আামার মুখেই সব শুনলেন। তুমি ত আচ্ছা চাপা মেয়ে! ধড়িবাজ বটে বাবা!’

তারপর নিজের রসিকতায় নিজেই খানিক হেসে নিয়ে বললে, ‘তাই ব’লে বলতে পারবে না যে একা একা খেয়ে এসেছি সাথপরের মত। তোমার জন্যে দিব্যি করে চেয়ে-চিনতে ছাঁদা বেঁধে এনেছি। লুচি মিষ্টি সব রকম। মাছটা খারাপ হয়ে যাবে তাই–’

আর শ্যামার পক্ষে স্থির থাকা সম্ভব হ’ল না।

‘তোমার গলায় দড়ি জুটল না, তাই আবার তুমি ঐ খাবার বয়ে নিয়ে এলে! গলায় পৈত্যেগাছটা ত ছিল। না, তাও বেচে খেয়েছে? ছি ছি, আমারই যে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে ইচ্ছে করছে।’

শ্যামাও তার শয়নঘরে ঢুকে সশব্দে কপাটটা বন্ধ ক’রে দিলে।

‘ইস্, ভারি যে লম্বা লম্বা কথা শেখা হয়েছে! দ্যাখো সবাই মিলে অমন ক’রে আমাকে ঘাঁটিও না বলে দিচ্ছি। গলায় দড়ি! দড়ি দেওয়া বার ক’রে দেব একবারে। বজ্জাতের ঝাড় কমনেকার!’

পূর্ব-অভ্যাসমত খানিকটা দাপাদাপি করলেও আগের মত জোর আর পাওয়া গেল না নরেণের কণ্ঠস্বরে। বরং কিছুক্ষণ পরে ক্ষমার দোরের কাছে গিয়ে অনভ্যস্ত কণ্ঠে একটু মাপ চাইবারও চেষ্টা করলে।

ক্ষমাকেও বেরিয়ে আসতে হ’ল। যে অমানুষ তাকে ক্ষমতা থাকলে শাসন করা যায় কিন্তু তার ওপর অভিমান করার মত নির্বুদ্ধিতা আর কিছু নেই। তিরস্কারও করলেন খানিকটা–বৃথা জেনেও।

নরেন কিন্তু বেশ সপ্রভিত ভাবেই আত্মসমর্থন করলে। বললে, ‘বা রে, সব দোষ বুঝি আমার? একে কলকাতা শহর, তায় আমি ছেলেমানুষ, হাতে অতগুলো কাঁচা পয়সা–মাথার ঠিক থাকে কখনও? আর আমি না হয় ঠিক রাখলুম, পাঁচজনে রাখতে দেবে কেন? দেখতে দেখতে চারিদিক থেকে ইয়ারব এসে জুটল। ব্যস মদ মেয়েমানুষ, ও কটা পয়সা আর কদিন?’

‘য়্যা!’ প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন ক্ষমা, ‘তুই বাড়ি করার টাকা এমনি ক’রে মদে- মেয়েমানুষে উড়িয়ে দিয়ে এলি? আর তাই আবার বড় গলা ক’রে আমার সামনে বলছিস্? হ্যাঁ রে, ঘেন্না পিত্তি কি তোদের কিছু নেই কোথাও? সেও একজন কি পেঁসের কারবার করার নাম ক’রে সব উড়িয়ে দিলেন আর ইনি—’

বিশ্রী একটা ভঙ্গি ক’রে নরেন বলে ‘ইল্ লো! কে কারবার ক’রে পয়সা উড়িয়েছে তাই শুনি? দাদা-–?’

ক্ষমার মনে প্রথম একটা সংশয় দেখা দেয়। তিনি খতিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ তাই ত বললে সে।’

হো হো ক’রে অনেকক্ষণ ধরে হাসে নরেন, ‘মাইরি, দাদা বেশ বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারে ত! নবেল লিখলে ওর দু পয়সা হ’ত। ঐ আমিও যে পথে গিয়েছি, দাদাও সেই পথের যাত্রী। এক পাড়াতেই দুজনে গিয়ে পড়েছিলুম। দাদা কার ঘরে যেত আর আমি জানি নি! দুজনেরই খারাপ রোগ ধরল, আমি সামলে নিলুম, দাদা এখনও ভুগছে। কারবার! কারবারই বটে!’

সম্পূর্ণ নির্লজ্জ ভাবে কথাগুলো ব’লে সগর্বে চেয়ে রইল নরেন। দাদার জুচ্চুরিটা ধরে দিতে পেরে সে এইবার সত্যি-সত্যিই খুশি হয়েছে।

ক্ষমা স্তম্ভিত ভাবে বসে রইলেন। নরেন অমানুষ এ তিনি চিরকালই জানেন, কিন্তু দেবেন? সেও এতগুলো মিছে কথা ব’লে গেল?

নরেন বললে, ‘দাদা আর কি বানিয়ে ব’লে গেছে তাই শুনি।’

‘সে বানিয়ে বানিয়ে বলেছে না তুই বলছিস্ কেমন ক’রে বুঝব? নিজে ল্যাজকাটা শিয়াল, অপরের ল্যাজও কাটতে চাইচিস্ কিনা কে জানে!’

‘মাইরি মা, তোমার দিব্যি বলছি-–’

.

নরেন মায়ের গায়ে হাত দিতে যাচ্ছিল, ক্ষমা যেন সভয়ে সরে গিয়ে বললেন, ‘হুঁস নি ছুঁস নি–তোদের পেটে ধরেছি এই পাপেই আমাকে নরকে যেতে হবে–আর ছুঁয়ে এখন পাপ বাড়াব না। কত জন্মের পাপ ছিল তাই এ জন্মে এমন ছেলে পেটে ধরেছি!’

নরেন ঠিক এতটা আশা করে নি। কারণ তার নিজের অপরাধ সম্বন্ধে সে নিজে মোটেই সচেতন নয়। মাকে সে ধরতে যাচ্ছিল, হঠাৎ তিনি সরে যাওয়ায় পড়ে যাবার উপক্ৰম হ’ল। সেটা সামলে নিতে বেশ একটু বেগ পেলে। একটু অপ্রতিভও হ’লে–ও নিজে বুঝতে পারলে না কেন– তারপর সেটা সামলাবার জন্যে আপনমনেই সেই শূন্য দালানে দাঁড়িয়ে খানিক আস্ফালন করতে লাগল, ‘ও, না ছুঁলে ত বড় বয়েই গেল। ভারি ত! আমার ত বড় ক্ষেতি! দাদা এসে মিছে ক’রে বানিয়ে ব’লে বেশ সতী হয়ে গেল। আমার বেলা যত বাচ-বিচার। বেশ আমি আসব না না হয়, অত কি!’

রাত্রে আহারাদির পর শ্যামা অন্য দিনের মত যখন ক্ষমার বিছানাতে এসেই বসল তখন তিনি একটু বিস্মিত হলেন। বোধ হয় একটু উদ্বিগ্নও। বললেন, ‘আর এত রাত্রে এখানে কেন মা, একেবারে ও ঘরে শুয়ে পড়োগে। খোকা বরং থাক্ এখানে–যদি রাত্রে খুব কান্নাকাটি করে ত ডেকে দিয়ে আসব এখন।’

শ্যামা অভ্যাসমত শাশুড়ীর পায়ে হাত বুলোতে বুলোতে খানিক পরে বললে, ‘আমি এখানেই থাকি না মা। আমার আর ভাল লাগছে না। ‘

ক্ষমা উঠে বসলেন। বধূকে প্রায় কোলের মধ্যে টেনে-নিয়ে বললেন, ‘তা জানি মা। আমিও ত মেয়েছেলে, ওসব কথা শোনবার পর সে স্বামীর কাছে যেতে যে কী ঘেন্না হয় মা তা আমি বুঝতে পারি। আমরা বরং সতীন সয়েছি অনায়াসে। তাতে অত ঘেন্না হয় না–এর ভেতরে যে নীচতা আছে তাতে তা নেই। কিন্তু কী করবে মা। এ হিন্দুর বিয়ে, মুছে ফেলবার নয়, তালাক দেবারও নিয়ম নেই। যখন ঐ ঘরই করতে হবে তখন সহ্য করা ছাড়া উপায় কি বলো! শুধু শুধু, ওকে তা জানো মা–একটা চেঁচামেচি গন্ডগোল, মারপিট করাও বিচিত্র নয়। এই নিষুতি রাত, একটু চেঁচালেই শোনা যায়। পাড়াসুদ্ধ ঢিটিক্কার পড়ে যাবে মা!’

শ্যামা ওর শাশুড়ীর কোলের মধ্যেই মুখ গুঁজে পড়ে ছিল। এইবার উঠে বসল। আচলে চোখ মুছে মাথার কাপড়টা টেনে দিয়ে নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল।

‘আপনি দোর দিয়ে শুয়ে পড়ুন মা।’

বাইরে থেকে সহজ অথচ শুষ্ক স্বরে কথাগুলো বললে সে, কতকটা যন্ত্রচালিতের মত।

ঘর থেকে বেরিয়ে সে যেখানে পড়ল সেটা ঘেরা দরদালান। ক্ষমার ঘরের পাশেই সিঁড়ি, তার পাশের ঘরে আজ নরেনের বিছানা করা হয়েছে তাদের বিছানা।

কলের পুতুলের মতই শ্যামা সেদিকে দু পা এগিয়ে গেল কিন্তু সিঁড়ির কাছাকাছি যেতেই যেন ওর চমক ভাঙল। আছে, এখনও উপায় আছে। পালিয়েই যাবে নাকি শেষ পর্যন্ত!

ঐ সিঁড়ি সিঁড়ি দিয়ে নামলেই নিচের দালান–দোর খুলে বেরিয়ে পড়লে কেউ জানতেও পারবে না।

তারপর?

পাশেই কুন্ডুদের পুকুর। আর একটু এগিয়ে গেলেই গঙ্গা।

চিরদিনের মত শান্তি। এ যন্ত্রণা আর সইতে হবে না।

শ্যামা স্থির হয়ে দাঁড়াল। লোভ! হয়ত লোভেই হবে। মৃত্যুর ওপর যে লোভ হয় তা কে জানত! এই ত ওর মোটে পনেরো-ষোল বছর বয়স, ভরা যৌবন। এতদিন কি প্রচন্ড ভাবেই না কামনা করেছিল ও স্বামীকে। নিষ্ঠুর নির্বোধ, পশু–তবুও তাকে চেয়েছিল, ওর প্রথম যৌবনের সমস্ত উগ্র কামনা দিয়ে স্বামীর কথাই চিন্তা করেছিল শুধু। আজ সেই স্বামীই উপস্থিত, প্রায় এক বৎসরের অনুপস্থিতির পর।

তবে?

কিন্তু এ বুঝি পশুরও বেশি। ঘরে যার নববিকশিত পদ্মের মত রুপসী বধূ সমস্ত অন্তরের বাসনার দীপটি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছে, স্বপ্নের মত প্রণয়রজনীগুলি আবেগ- থরথর বাসনায় যেখানে উন্মুখ হয়ে রয়েছে–সেখানে না এসে, সে বধূর দিকে না চেয়ে যে গেল একটা ঘৃণ্যা রূপোপজীবিনীর ঘরে, কুৎসিত ব্যধিতে নিজের স্বাস্থ্য ও যৌবনলাবণ্য বোধ হয় চিরকালের মতই নষ্ট ক’রে এল, সে পশুর চেয়েও অধম। পশু চায় দেহের প্রয়োজন মেটাতে, সেখানে সে পাত্রাপাত্র বিচার করে না–কিন্তু যেখানে সে প্রয়োজন ছিল না? যেখানে শুধু জঘন্য জীবন, শুধু পাঁক, শুধু মালিন্য, শুধু ক্লেদের প্রতি আকর্ষণ, মোহ– সেখানে কোন্ স্তরে ফেলবে সে মানুষকে?

সেই পুরুষের আলিঙ্গনের মধ্যে নিজের দেহকে এলিয়ে দিতে হবে?

ভাবতেও যেন শিউরে ওঠে সে। অথচ–

খোকা? শিউলি ফুলের মত নরম, পদ্মের মত পবিত্র যে ফুলটি তার এই দেহলতায় মঞ্জুরিত হয়ে উঠেছে, যা তার ঈশ্বরের দেওয়া দান, তাকে ছেড়ে যেতে হবে?

মা, দিদি, উমি। জননীর মত স্নেহশীলা তার শাশুড়ী।

শ্যামা সিঁড়ির কাছ থেকে সরে এল। দক্ষিণের একটা জানালার ধারে এসে ঠাণ্ডা গরাদেতে ওর উত্তপ্ত ললাট চেপে দাঁড়াল। আঃ! কী ঠাণ্ডা! কী শান্তি!

বাইরে রাত্রি যেমন অন্ধকার তেমনি নিস্তব্ধ! দূরে কোথায় একটা সরীসৃপ চলে গেল বোধ হয় শুকনো পাতার ওপর দিয়ে। তার শব্দ এখানে এসে যেন ওর আচ্ছন্ন চৈতন্যে আঘাত করল। ঐ সরীসৃপের স্পর্শ ও বোধ হয় এতটা ক্লেদাক্ত নয়।

এবার সঙ্গে ক’রে হুঁকো-কলকে এনেছিল নরেন। তামাকের অভ্যাস হয়েছে এই ক’দিনে। এখনও বসে বসে তামাক টানছে সে। সে শব্দ এবং গন্ধ এখান থেকে স্পষ্ট পাওয়া যাচ্ছে। তার মানে এখনও জেগে আছে। মনে মনে একটা অত্যন্ত দুরাশা পোষণ করেছিল শ্যামা যে, হয়ত ঘুমিয়েই পড়বে নরেন শীগির।

হঠাৎ একসময় সে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অন্ধকার দালানে শ্যামাকে অমন নিস্তব্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সে যেন একটু ভয় পেয়েই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ওকে চিনতে পেরে কাছে এসে তিক্ত চাপা গলায় বললে, ‘এই যে, এত রাত্তিরে আবার ন্যাকামি ক’রে এখানে দাঁড়িয়ে থাকা হয়েছে কেন? আমি কি সারারাত জেগে শুয়ে থাকব নাকি?’

সেই ক্রুর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর! এর পরে প্রহার–তা শ্যামা জানে।

তবু, কোথা থেকে যেন একটা অসম সাহস ওর এসে গেল।

সে শান্ত সহজকণ্ঠে বললে, ‘তুমি যাও শোওগে–আমি একটু পরে যাচ্ছি।’

নরেন ওর একটা হাত ধরে টানবার চেষ্টা ক’রে বললে, ‘ওসব ন্যাকামি ছেড়ে দাও দিকি চাঁদু, ভাল চাও ত শোবে চলো ভালমানুষের মত। নইলে—’

‘নইলে কি?’ শ্যামার কঠিন ও মৃদু কণ্ঠস্বর যেন চমকে দেয় নরেনকে, ‘নইলে অদৃষ্টে দুঃখ আছে, এই ত? কী করবে তুমি, মারবে? বেশি ক’রে মারতে পারবে? বঁটি এনে দিলে গলায় বসিয়ে দিতে পারবে? দ্যাখ্যো, একটা কথাও বলব না আমি, কাঁদব না পর্যন্ত, কেউ টের পাবে না।’

ওর এ চেহারার সঙ্গে নরেন মোটেই পরিচিত নয়। সে বেশ একটু ঘাবড়ে গেল।

‘ও সব কি ইয়ার্কি হচ্ছে? চলো শোবে চলো–’ থতিয়ে খতিয়ে বললে নরেন। কিন্তু বেশ বোঝা গেল, আগের জোর আর ওর গলায় নেই।

শ্যামা এবার সহজেই হাতখানা নরেনের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললে, ‘তুমি শোওগে, আমি ঠিক শুতে যাবো। আমার খুশিমত যাবো। কিন্তু যদি জুলুম করো ত এখনই ওপরের ছাদ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ব। এ কথার আর নড়চড় হবে না।’

নরেন রীতিমত ভীত কণ্ঠেই বললে, ‘তুমি আমার ঘর করবে না নাকি?’

‘করতে ত হবেই! কিন্তু আজ রাতটা আমায় অব্যাহতি দাও, দোহাই তোমার!’

নরেন আস্তে আস্তে, যেন পিছিয়ে পিছিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। সেখানে পৌঁছে কিন্তু ওর পূর্ব অভ্যাস ফিরে পেলে সে। আস্ফালন করতে লাগল, ‘উ, বেশ্যাবাড়ি যেন কেউ যায় না। কত তাবড় তাবড় লোক যাচ্ছে দেখগে যা। বেশ করেছি গেছি পুরুষমানুষ গিয়েই থাকে। এসে পর্যন্ত শাশুরী-বৌয়ে কি করছে দেখ না! সতীর বেটি সতী? ও সব সতীপনা ঢের দেখেছি। ও নাটুকেপনা টিট্ করতে আমার বেশি সময় লাগবে না ব’লে দিলুম। আচ্ছা, আজ রাত্তিরে আর বেশি হ্যাঁঙ্গামা করলুম না। কাল সকালে তোমার একদিন কি আমার একদিন!’

আস্ফালনও ক্রমে ক্রমে থেমে আসে তারপর এক সময় নিয়মিত নাকডাকার শব্দ কানে যায় অর্থাৎ নরেন ঘুমিয়ে পড়েছে।

শ্যামা সেইখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তেমনি এক হাতে জানালার গরাদেটা ধরে, স্বব্ধ হয়ে। বসল না পর্যন্ত। এমনি ভাবেই কেটে গেল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

আজ উমার ফুলশয্যা। তার আবার কি ফুলশয্যা হ’ল তা কে জানে!

ভগবান তাকে বাঁচাও! তাকে যেন এ অপমান কোনদিন না সইতে হয়।

এতক্ষণ যেন পাথর হয়ে দাঁড়িয়েছিল শ্যামা। উমার কথা মনে হয়ে মার কথা মনে পড়ল– মার কত স্নেহের মেয়ে ছিল সে। তার সেই ছেলেবেলাকার মধু-মাখা দিনগুলি–সে ছেলেবেলা খুব সুদূরও নয়।

এবার যেন সহসা পাষাণ বিদীর্ণ হয়ে নির্ঝরিণী নামল। শ্যামা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

তিন

রাসমণি গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ– ভারি রাশভারি। সেজন্য বাইরে থেকে তাঁর অন্তরের কোন আঘাতেরই পরিমাণ বোঝা যেত না। কিন্তু শ্যামার ব্যাপারে সত্যিই তিনি অত্যন্ত আঘাত পেয়েছিলেন। তাঁর অমন রূপসী মেয়ে, বুদ্ধিমতী কর্মনিপুণা মেয়ে, যে সংসারে যাবে সে সংসারকে সুখী করতে পারবে, ভবিষ্যতে একদিন তার হাল ধরতে পারবে– একথা তিনি প্রায়ই গর্ব ক’রে বলতেন। সেই শ্যামার এমন বিয়ে হবে কে জানত!

রাসমণি অনেক আঘাত পেয়েছেন জীবনে। সতীনের ওপর বৃদ্ধ স্বামীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল। নৌকা ক’রে যেতে যেতে আটান্ন বছরের বৃদ্ধ তেরো বছরের মেয়েকে গঙ্গাস্নান করতে দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠেন। ঘটক পাঠান বিয়ের প্রস্তাব ক’রে, জমিদার তিনি–পয়সা দেখে বাপ-মাও দিয়েছিলেন। অবশ্য স্বামীকে নিয়ে যে খুব অসুখী হয়েছিলেন রাসমণি, তা বলা যায় না। কিন্তু প্রথম যৌবনেই তিনটি শিশুকন্যা নিয়ে বিধবা হন। শেষ সময়ে স্বামীর কাছে তিনি থাকতে পর্যন্ত পারেন নি। দেবররা সতীনপুত্রের সঙ্গে ব্যবস্থা ক’রে এক সুচতুর চক্রান্তে তাঁকে সরিয়ে দেয়, মরবার সময় অচৈতন্য নিরক্ষর স্বামীর টিপসই নিয়ে এক মিথ্যা উইল খাড়া করে। তার ফলে তিনি সমস্ত বিষয়ে বঞ্চিত, তাঁর মিথ্যা দুর্নামে শ্বশুরবাড়ির দেশের আকাশ-বাতাস কলঙ্কিত এই অবস্থায় নিজের গহনা বিক্রি ক’রে এবং সামান্য যা কিছু টাকা হাতে ছিল তাই দিয়ে মেয়েদের মানুষ করতে হচ্ছে তাঁর। মোকদ্দমা করলে হয়ত জ্ঞাতিদের জব্দ করা যেত, কিন্তু সে চেষ্টা করবে কে? তাছাড়া তখন ঐ ক’টা টাকাই শেষ অবলম্বন–সেটাও উকীল-মোক্তারের হাতে তুলে দিতে ভরসা হয়নি।

এত দুঃখের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দেওয়া–তারও এই অবস্থা! রাসমণি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। মেয়ে চাপা, সে প্রায় কিছুই বলে না কিন্তু নরেনের মুখে যেটুকু প্রকাশ পায় তাই যথেষ্ট। বাকীটা অনুমান ক’রে নিতে পারেন অনায়াসেই। তার ফলে ইদানীং তিনি রাত্রে ঘুমোতে পারতেন না। বহু রাত্রি পর্যন্ত একা জেগে বসে থাকতেন। কত কী আকাশ-পাতাল ভাবতেন। এক এক সময় মনে হ’ত তিনি পাগল হয়ে যাবেন। আবার এক এক সময় যেন ভাবতে ভাবতে বুকটা ভেঙে যেতে চাইত, ‘বাপরে!’ ব’লে প্রচন্ড একটা নিশ্বাস ফেলতেন। সে নিশ্বাসের শব্দে উমার ঘুম ভেঙে যেত।

এমনি বসে থাকতে থাকতে এক একদিন রাত ভোর হয়ে আসত, চারটে বাজলেই উঠে বাড়িতে তালা লাগিয়ে গঙ্গাস্নান করতে যেতেন।

অবশ্য এ লক্ষণগুলোর সঙ্গে বাইরের লোকের পরিচয় ছিল না।

একটি মাত্র লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল, উমার বিয়ে দিতে তাঁর অনিচ্ছা।

মেয়ে ক্রমশ গাছের মত হয়ে যাচ্ছে–আর কবে বিয়ে দেবে উমার মা? মুখে অন্নজল যাচ্ছে কি ক’রে? তোরো পেরিয়ে গেল–মেয়ে অবিবাহিত অবস্থায় যৌবনপ্রাপ্তা হ’লে পূর্বপুরুষ যে নরকগামী হবেন! এমনি নানা অনুযোগ, যুক্তি ও শাস্ত্রের কথা বর্ষিত হ’ত তাঁর ওপর। কিন্তু তবু রাসমণি অটল থাকতেন।

‘মেয়ে আমার কাছে যে ক’টা দিন হেসে কাটাতে পারে কাটাক। ওর বিয়ে আমি কিছুতেই তাড়াতাড়ি দেব না।’

তবু তাঁকে সমর্থন করতেন তাঁর বড়দি, ‘দিস নি। কি হবে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে? কথায় কথায় ত ভবিতব্য দেখানো হয় সব এর বেলা ভবিতব্য নেই? কেউ বলবে বলবি যে ভবিতব্য থাকে ত বিয়ে হবে। আমি কি জানি?’

বাঁ হাত দিয়ে ঘটিটি ধরে রান্নাঘরের চৌকাঠে বসে বেশ একটু উত্তেজিত ভাবেই বলতেন কথাগুলো।

উমা কিন্তু ক্রমে যখন চোদ্দও পার হ’ল তখন আর রাসমণি স্থির থাকতে পারলেন না। চতুর্দিকে খোঁজ-খবর করতে শুরু করলেন। আরও মাস কতক পরে এই সম্বন্ধটা হাতে এল।

কুলীনের ছেলে, পরম রূপবান–এমন রূপ বাঙালীর ঘরে দুর্লভ। দুধে-আলতায় রং, কোঁকড়ানো চুল চেরা-সিঁথির দু দিকে স্তবকে স্তবকে সাজানো, পাতলা গোঁফ–যেন প্রতিমার কার্তিক। বয়সও কম–বাইশ-তেইশের বেশি হবে না। তবে অবস্থা খুব ভাল নয়, ঘর-বাড়ি জমি জায়গা নেই। ছেলে এক প্রেসে কাজ করে। মাইনে ভালই, এরই মধ্যে কুড়ি টাকা পায়, এ ছাড়া ‘ওভার টাইম’ খাটলে আলাদা পাওনা। মা আর এক ভাই, সে ভাইও কোন জমিদারী সেরেস্তায় য়্যাপ্রেন্টিস ঢুকেছে –শীগগিরই মাইনে হবে।

ঘট্‌কীর মুখে সব কথা শুনে রাসমণি বললেন, ‘ঘরবাড়ি নেই, কোথায় দেব মেয়ে?’

‘তা দিদিমণি, সে কথাও ছেলের মা বলেছে। বলেছে ওদের সেই মানিকতলায় কোথায় জমি নেওয়া আছে খাজনা-করা–সেইখানে দুখানা খোলার ঘর তুলে দিক–পাইখানাটা না সবসুদ্ধ ছ’শ টাকা হলেই হয়ে যাবে। তিনি আর নগদ টাকা এক পয়সাও নেবে না বলেছে। ভালই তো হবে দিদি, মেয়ে নিজের বাড়িতে গিয়ে উঠবে।’

রাসমণি বললেন, ‘ছ’শ টাকা নগদ! ঐ ছেলেকে ছ’শ টাকা নগদ দেব– গহনা আছে, সেও কোন্ না পঁচিশ-ত্রিশ ভরি যাবে, ধরো ছ’শ টাকা আরও, দানসামগ্রী–অন্য খরচা–ঘর-খরচা আছে কোথায় পাবো বাছা! এ সম্বন্ধ আমার চলবে না। গরীব বিধবা রেওয়া মানুষ।’

ঘটকী জেদ করতে লাগল ‘বাড়ি ত তোমার মেয়েরই রইল দিদি। তোমারই মেয়ে থাকবে। মেয়ে আর জামাই। ও মাগী আর কদ্দিন? বরং গহনা না হয় কিছু কম দিও।’

রাসমণি বললেন, ‘জমি তাহলে মেয়ের নাম ক’রে দিক। বাড়ি আমি ক’রে দেব ছোটভাইও ত থাকবে! তাছাড়া মায়ের নামে জমি–যদি শাশুড়ী-বোয়ে বনিবনা না হয়?’

‘তা দিদি হবার জো নেই। খাজনা-করা জমি হস্তান্তরের হুকুম নেই। এক ও জমি ছেড়ে দিতে হয়–আবার মেয়ের নামে পাট্টা করাতে হয় কিন্তু তাতে ত নতুন করে সেলামী লাগবে!’

রাসমণি বললেন, ‘তাহ’লে তুমি ও সম্বন্ধ ছেড়ে দাও, অন্য পাত্তর দ্যাখো।’

ঘটকী পাকা লোক। বড় মেজ মেয়ের সম্বন্ধ যে করেছিল তাকে আর রাসমণি ডাকেন নি শ্যামার এই ব্যাপারের পর। নতুন লোক– কিন্তু এরই মধ্যে হাড়হদ্দ সব জেনে নিয়েছে। সে একটু চোখ টিপে বললে, ‘আত তাড়াতাড়ি ঝেড়ে জবাব দিও না দিদি, ভেবে দ্যাখো।

নতুন সম্বন্ধ করব কি, ভাল সম্বন্ধ ত করবারই কথা, অমন সোন্দর মেয়ে তোমার। কিন্তু জানো ত–এমন দেশ, যেখানে যাই তোমার শ্বশুরবাড়ির খবরটি আগে গিয়ে বসে থাকে– ভাল ভাল জায়গায় কেউ এ কথা শুনতেই চায় না। তার ওপর গাছের মত মেয়ে ক’রে রেখেছ সে আবার আর এক বদনাম। বলে, এতকাল বিয়ে হয় নি কেন?

রাসমণির মুখ অপমানে রাঙা হয়ে উঠল। দৃষ্টি হয়ে উঠল কঠোর। তিনি বললেন, ‘না হয় মেয়ের বিয়ে দেব না। তুমি যাও–পারো অন্য সম্বন্ধ দ্যাখো’–

কিন্তু ঘটকীর তাতে চলবে না। ও পক্ষে মোটা টাকার লোভ ছিল। সে ওঁর বড় মেয়ে কমলাকে ধরলে। কমলা নিজে সৎপাত্রে পড়েছে –পৃথিবীতে যে অসৎপাত্র এত আছে সে কথাটা যেন তার বিশ্বাসই হয় না। শ্যামার বিয়েটা দৈব-দুর্ঘটনা, তা কি আর বার বার ঘটে? কমলা এসে মাকে ধরলে, ‘অমন কার্তিকের মত ছেলে মা হাতছাড়া করো না। আমি ওঁকে বলেছি–উনি বলেছেন যে মা যদি অপরাধ না নেন আমি কিছু টাকা দিতে পারি।

ম্লান হাসলেন রাসমণি, অপরাধ নেওয়ার কথাই আর ওঠে না। বহুদিনই জামাইয়ের সাহায্য নিতে হয়েছে। নগদ টাকা হাত পেতে তিনি কখনও নেন নি বটে কিন্তু জামাই অবস্থাপন্ন লোক–তার দেশে জমি, শহর তলীতে বাগান-বাগিচা আছে। চাষের চাল ডাল বাগানের ফসল ইদানীং প্রায়ই পাঠায়–সবগুলো ঠিক বাগানের কিনা সন্দেহ থাকলেও রাসমণি বেশি জেরা করেন না। কারণ সে অবস্থা আর তার নেই; মুদীর দোকানের ফর্দ কমেছে, বাজারের খরচা বিশেষ লাগছে না–এটা তাঁর কাছে যে কত তা অন্তর্যামীই জানেন। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার‍্যা বলে গহনা তিনি জমিদার স্বামীর কাছ থেকে কিছু বেশিই পেয়েছিলেন কিন্তু সে তো আর কুবেরের ঐশ্বর্য নয়। কলকাতায় বাড়িভাড়া ক’রে থাকা–পাঁচটা ভাড়াটের সঙ্গে এক বাড়িতে থাকার মেজাজ তাঁর নয়, জমিদারী অভ্যাসের ঐটুকু এখনও ছাড়তে পারেন নি –তাতেই কত টাকা বেরিয়ে যায়! একটা লোকও রাখতে হয়েছে, নইলে দেখাশুনা বাজার-হাট করে কে? কলসীর জল ক্রমাগত ঢাললে একদিন ফুরোবেই।

রাসমণি একটু চুপ ক’রে থেকে বললেন, ‘তার জন্যে নয় রে। জামাইয়ের কাছ থেকে তা নিচ্ছিই, একদিন হয়ত জামাইবাড়ি গিয়েই দাঁড়াতে হবে একটু আশ্রয়ের জন্যে। কিন্তু ছেলেও ত এমন কিছু নয়। ছাপাখানার চাকরি–’

‘ঘট্‌কী বলছিল যে ও নিজেই ছাপাখানা করবে শীগির। ওর এক বন্ধুর সঙ্গে ভাগে।’

‘ঘটকীরা কত কথা বলে মা, সব বিশ্বাস করতে নেই। এখন যেটা দেখছি তা ত ঐ। মেয়েকে গিয়ে বাসন মাজতে হবে, হয়ত রাস্তার কল থেকে জল তুলতে হবে।’

‘ঘাড়ে সংসার পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু এমন সুন্দর ছেলে–উমির সঙ্গে কেমন মানাবে বলো দেখি!’

‘আবার রাঙামূলো দেখে ভুলছিস! একবারে তোদের চৈতন্য হ’ল না?’

‘বারবারই কি আর অমন হয়! তাছাড়া ডকে ওদের বাড়ি পড়ল তাই– নইলে কি আর এমন থানছাড়া মানছাড়া হয়ে পড়ত! উনি বলছিলেন ছেলেটির সঙ্গে কথাবার্তা বলে ওঁর খুব ভাল লেগেছে, মুখ ছাপাখানার লোক যেমন হয় তেমন নাকি নয়–। সেরকম যদি বোঝেন উনিই কি ওকে একটা ভাল চাকরি ক’রে দিতে পারবেন না?’

রাসমণি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দ্যাখো যা ভাল বোঝ। আমি আর যেন ভাল ক’রে কিছু ভাবতেও পারি না। জামাই যদি ভাল বোঝেন ত ঠিক করো ওখানেই –। জামাই ত একটা ভাল পাত্তরও দেখে দিতে পারলেন না।’

কমলা নতমুখে বসে মেঝের একটা গর্তে আঙুল ঢুকিয়ে বিলিতি মাটির চাপড়া তুলতে তুলতে বললে, ‘জানই ত মা। উনি এসব জানতেন না মাথার ওপর আর কোন অভিভাবক ছিল না তাই খোঁজখবর করেন নি। যেখানে সম্বন্ধ করতে যাবেন তারাই ত খোঁজখবর করবে। তখন? ওঁর সুদ্ধ যে মাথা হেঁট হবে। সবাই বলবে উনিও ত এইখানে বিয়ে করেছেন

.

নিজের মেয়ের মুখে পর্যন্ত এই সব ইঙ্গিত শুনলে বুকটা যেন ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে যায় রাসমণির। অথচ ঈশ্বর জানেন– ওঁর অপরাধ কি?

সে দুর্যোগের দিনগুলো আজো চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে আছে। বৃদ্ধ স্বামী চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এলেন। দিন সাতেক পরে ছেলে গিয়ে বললে, ‘ছোট মা, বাবার বোধ করি শেষ অবস্থা আপনাকে আর মেয়েদের দেখতে চান।’ তখনই এক কাপড়ে রাসমণি আসছিলেন বেরিয়ে, পুরোনো বুড়ী ঝি বলল, ‘ছোট মা, জমিদার বাড়ির ব্যাপার, গহনার বাক্স আর টাকাকড়ি যা আছে ফেলে যেও না। ফিরে এসে আর পাবে কিনা সন্দেহ!’ তবু রাসমণি নিতে চান নি, সেই বুড়ীই জোর ক’রে একটা কাঁঠাল কাঠের সিন্ধুকে সব পুরে নৌকোয় তুলে দিয়েছিল। কলকাতা এসে শুনলেন স্বামী দেশে ফিরে গেছেন। ছেলে বললে, ‘তাই ত, কি রকম হ’ল আপনারা ততক্ষণ একটু বসুন–দেখি একটু খবর নিয়ে।’

সে সরে পড়ল।

এক মাসের জন্য বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। বিরাট বাড়ি। তখনও সামান্য কিছু বাসন-কোসন ছড়ানো পড়ে রয়েছে। ওষুধের শিশু ময়লা কাপড়-চোপড়– দ্রুত স্থানত্যাগের চিহ্ন সর্বত্র। তারই মধ্যে সারাদিন উপবাসী রাসমণি বসে বৃথা অপেক্ষা করলেন; তারপর পাশের বাড়ির একটি মহিলার জিম্মায় মেয়েদের রেখে একাই যাত্রা করলেন আবার দেশে। সঙ্গে পুরোনো চাকর ঝি ছিল, ঝিকে রেখে গেলেন মেয়েদের কাছে, চাকরকে সঙ্গে নিলেন। দেশে পৌঁছে শুনলেন যে স্বামীকে হাওয়া বদলের নাম করে দেশে নিয়ে গিয়ে দেখানো হয়েছে তিনি নেই, তিনি নাকি (সে ঘেন্নার কথা শুনলে আজও তাঁর গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা হয়) চাকরের সঙ্গে কুলত্যাগ করেছেন। গহনাপত্র টাকাকড়ি সব নিয়েই গেছেন–অকাট্য প্রমাণ। সেই আঘাতেই বৃদ্ধ একেবারে অচৈতন্য হয়ে পড়লেন, কোন্ উইলে সই করেছেন তা তিনি জানেনও না! অজ্ঞান অবস্থায় টিপ নিয়ে মজুত-রাখা সাক্ষীদের দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধ জানতেন যে তিনি আরো ঢের দিন বাঁচবেন। কলকাতায় গিয়ে একটু সুস্থও হয়েছিলেন। পশ্চিমে চেঞ্জে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি নাকি বলেছিলেন, ‘তার আগে দেশে চল, ছোট বৌকে সঙ্গে নেব, সে না হলে সেবা করতে পারে না কেউ।’ যার ওপর এতটা আশা ভরসা ক’রে এসেছিলেন তার সম্বন্ধে এই সব শুনে ভেঙে পড়বেন না ত কি!

রাসমণি বাড়িতে ঢোকবারও অনুমতি পান নি। শুনলেন তিনি নাকি কুলত্যাগিনী। সেইজন্য স্বামী তাঁর বা কন্যাদের ভরণ-পোষণেরও কোন ব্যবস্থা করে যান নি, উইলে সে কথার উল্লেখ ক’রে অধিকাংশ বিষয় ছেলেকে এবং ভাইদের কিছু কিছু দিয়ে গেছেন। ওদের আশঙ্কা ছিল যে অন্তিম সময় আসন্ন জানলে রাসমণি নিজের নামেই সব বিষয় লিখিয়ে নেবেন। তাই এত আয়োজন। আরো শুনলেন যে তিনি নাকি স্বামীর বিবাহিতা স্ত্রী নন–রক্ষিতা, এমন প্রমাণ করবার ব্যবস্থাও দেবরদের হাতে আছে। সেই চলে এসেছিলেন শ্বশুরবাড়ি থেকে, আর সেখানে ফিরে যেতে পারেন নি।

রাসমণি আবারও একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘যা ভাল বোঝ তোমরা করো মা, জামাইয়ের মত নাও, আমি আর ভাবতে পারব না কিছু।’

কমলা ছেলেকে দেখে নি, শুধু তার রূপের বর্ণনা শুনেই আর কোন তাকালে না, একরকম জোর করেই এখানে সম্বন্ধ ঠিক করলে।

চার

উমার বিয়ে ঢুকে গেল নির্বিঘ্নে। বাড়ি আগেই তৈরি ক’রে দেওয়া হল–যাতে নববধূ নতুন বাড়িতেই গিয়ে উঠতে পারে। মাটির গাঁথুনি, ইটের দেওয়াল, চুনের টেপা মেঝে আর খোলার চাল। ছ’শ টাকাতে কুলোল না, কিছু বেশিই পড়ল। কত তা রাসমণি জানেন না, শেষ অবধি তিনি বেঁকে দাঁড়িয়েছিলেন ব’লে কমলা নিজের টাকা থেকে গোপনে দিয়েছে বাকিটা।

বিবাহসভায় বর দেখে সবাই একবাক্যে উমার ভাগ্যের প্রশংসা করলে। শুভদৃষ্টির সময় ভাল ক’রে দেখা যায় নি কিন্তু পরে উমাও ভাল করে দেখে নিলে। শ্যামার অনুপস্থিতি তাকে আঘাত করেছিল খুব, প্রথমটা সে খুবই অস্থির হয়ে পড়েছিল কিন্তু বর দেখে সে দুঃখও তার রইল না। বরং নরেন্দ্রনাথের সহসা আবির্ভাবে চারিদিকে যখন একটা চাপা ধিক্কারের স্রোত বয়ে গেল, ওর মা শিউরে উঠে ওর হাতটা চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘জানি নে মা, তোর আবার কী বিয়ে দিলুম!’ তখন কিন্তু উমার মনে মনে ছোড়দির ওপর করুণাই হয়েছিল, আর সেই সঙ্গে মনে হয়েছিল ‘আমার এমন হবে না কখনও। এত যার রূপ তার গুণও আছে নিশ্চয়!’ সে একটু গর্বই অনুভব করেছিল তার স্বামী-সৌভাগ্যে।

প্রথমে সে সম্বন্ধে ওর মনে সংশয় দেখা দিল শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে। নিচু একতলা খোলার বাড়ি, জন্মে পর্যন্ত কখনও এমন বাড়িতে থাকার কল্পনা করে নি। কুয়া হয় নি, পাশের বাড়ির কুয়া থেকে জল আনতে হয়। বাড়িতে লোকজনও তেমন নেই, আত্মীয়- স্বজনদের দয়াময়ী বিশেষ জানান নি, বলেছিলেন, ‘নগদ পয়সা ত একটা পেলুম না। খরচ করব কোথা থেকে, ধার করব নাকি ছেলের বিয়েতে?’

দয়াময়ী নাম কে রেখেছিল কে জানে, উমা তাঁর মূর্তির মধ্যে দয়ার লেশ কোথাও খুঁজে পেলে না। ঢ্যাঙা মদ্দাটে গঠন, চওড়া চওড়া হাড়– বেশ জোয়ান পুরুষের মত। গলার আওয়াজও মোটা আর ভাঙা ভাঙা। বৌ তখনও পাল্কি থেকে নামে নি তিনি মন্তব্য করলেন, ‘এই বউ এত সুন্দরী, ত্যাত সুন্দরী! ঘী বেটি গেল কোথায়, আসুক না! আমার ছেলের কাছে কি!’

তারপরই ওর হাতে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে বলেছিলেন, ‘নামো বাছা ভালমানুষের মেয়ে। বুড়ো হাতী বৌ, কোলে করতে পারব না।’

কোনমতে বরণ ক’রে বউ ঘরে তোলা হ’ল। তিনটি না চারটি এয়ো। ভাল ক’রে শাঁখাও বাজল না বোধ হয়। কড়ি খেলা প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠান– তাও নামমাত্র। ভাগ্যে কুশণ্ডিকা ওখান থেকে সেরে আসা হয়েছিল, উমা মনে মনে ভাবলে, নইলে তাও হ’ত না বোধ হয়। তারপরই শাশুড়ী একখানা বিলিতি কোরা শাড়ি ওর গায়ের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, ‘নাও, বেনারসীখানা ছেড়ে ফ্যালো চট্‌পট্― ঐ ওদিকে জল আছে, মুখ হাত ধুয়ে এসো গে। দেখো, সাবধানে খরচ করো, এ তোমার বাপের বাড়ির মত আময়দা জল নয়, অনেক কষ্ট ক’রে তুলে আনতে হয়েছে নিজেকে– পঞ্চাশটা চাকর ত নেই।’

উমা ত কাঠ। ওর বর শরৎ আড়ে একবার ওর মুখের দিকে চেয়ে নিয়ে উঠে পড়ল, আড়ালে গিয়ে উমার বাপের বাড়ি থেকে যে ঝি এসেছিল তাকে ডেকে বললে ‘তুমি ওকে কাপড় ছাড়িয়ে নিয়ে যাও না কলতলায়।’

ঝি ফিসফিস ক’রে বললে, ‘আমি ত আগেই যেতুম জামাইবাবু, আপনার মাকে দেখে আমার ডর লাগছে–’

‘না না যাও। মার অমনি ধরন, ওঁর কথা ধরো না।’

শরৎ ত সরে পড়ল। ঝি কাছে গিয়ে ওকে কাপড় ছাড়াতে ছাড়াতে চুপি চুপি বললে, ‘তোমার বর বেশ লোক দিদিমণি, এরই মধ্যে কত টান, তোমার অসুবিধে হচ্ছে দেখে নিজে গিয়ে আমায় পাঠিয়ে দিলে। কিন্তুক্ তোমার শাশুড়ী যেন কেমনতরো—’

ইতিমধ্যে দয়াময়ীর প্রবেশ।

‘তুমি বাছা না বলা-কওয়া এ ঘরে ঢুকেছ কেন? আমাদের দাসী চাকরের পাট নেই। ঝি ছাড়া যদি নবাব-নন্দিনীর চলবে না ত মা-মাগী খোলার ঘরে মেয়ের বিয়ে দিয়েছে কেন? এখানে জল তুলতে হবে, বাসন মাজতে হবে সব কাজ করতে হবে। অত ঝিয়ের র‍্যালা এখানে চলবে না।

‘সে ত দুদিন পরে হবেই মা। আজ বিয়ের কনে– আর সেই জন্যেই ত —আমার সঙ্গে আসা—’

‘চোপরাও হারামজাদী! মুখের ওপর কথা! আস্পদ্দা! এ আমার বাড়ি, আমি যা বলব তাই হবে।

ঝি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দয়াময়ীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর উমার যে বেনারসী কাপড়খানা পাট করছিল, সেখানা ওর পায়ের কাছে আছড়ে ফেলে বললে, ‘ঘর তুমি করো দিদিমণি সোয়ামীর। আমি চলনু। আমরা গতর খাঁটিয়ে খাই, যেখানে খাটব সেখানে পয়সা। গাল খেতে যাব কিসের জন্যে? হাত্তোর ভদ্দর লোকের ঘর রে!’

দয়াময়ী আগুন হয়ে বললেন, ‘নেকালো হারামজাদী, আবি নেকালো আবার লম্ব লম্বা বাত!’

‘কেন বলব না বাছা। আমি কি তোমার ব্যাটার বউ? বিনি দোষে তোমার গাল শুনব কিসের জন্যে?’

ঝি বেরিয়ে চলে গেল। উমার তখন স্তম্ভিত অবস্থা, চোখের বাঁধ ভেঙে কখন জল নেমেছে তো সে টেরও পায় নি। দয়াময়ী ধমক দিয়ে উঠলেন, ‘নাও নাও আর প্যান- প্যানাতে হবে না। চট্‌পট্ কাজ সেরে নাও। এই ত বৌ, রূপের ধুচুনী কত নশো পঞ্চাশ টাকা তোমার মা দিয়েছে তাই শুনি যে আবার ঢং ক’রে ঝি দিয়েছে সঙ্গে? আর দিয়েছে দিয়েছে এমন ছোটলোক ঝি দেয়! সহবত শেখে নি। ভদ্দর লোকের ঘরে কখনও কাজ করে নি তা কি হবে! কুটুম যা হ’ল তা ঝি দেখেই টের পাচ্ছি। যেমন ছোটলোকের ঘর, তেমনি তার ঝি। তাও বলে দিচ্ছি বাছা, চোখ রাঙিয়ে বেরিয়ে গেল ঐ ঝি, সে অপমানের শোধ আমি তোমার উপর দিয়ে তুলব। মাকে বলে দিও। এ ক-টা দিন যাক না।’

আশা ও আশ্বাসের কথাই বটে। ভয়ে উমা এ কথাটাও বলতে পারলে না যে ও ঝি তাদের বারোমেসে ঝি নয়। নিজের সংসারের ঝি কেউ কনের সঙ্গে পাঠায় না। কে জানে, কথা কইতে গেলে যদি আরও গালাগাল শুনতে হয়! চোখের জলের ওপরই নামে মাত্র মুখে হাতে জর দিয়ে ফিরে এসে বসল। দেরি করতে আর সাহস হ’ল না।

কে যেন একজন বললে, ‘বৌকে জলখাবার দিলে না নতুন-বৌ?’

উত্তর এল, ‘এই ত বাপের বাড়ি থেকে গিলে এসেছে। কোন পেটে খাবে? মিছিমিছি লোক-দেখানো নৌকতা আমি করতে পারি নে।’

সেদিন এবং তার পরের সারাটা দিন উমার চোখের জল শুকোল না। তাও প্রকাশ্যে ফেলবার উপায় নেই –দেখতে পেলে আর রক্ষা থাকবে না। এর ভেতরে শুধু একমাত্র অভয়রাণীকে সে মন্ত্রের মত জপ করেছে সে ওর ঝিয়ের কথা, ‘তোমার বর বেশ লোক দিদিমণি!’ ঐ একমাত্র ওর আশ্বাস। ঐ একটি আশার শিখাকে চারদিকের নিষ্ঠুর ঝড়ের মধ্যে ও বাঁচিয়ে রাখল অসুরের সমস্ত তাগিদ দিয়ে কামনা দিয়ে ঘিরে।

বৌভাতের আয়োজনও সামান্য। মোট জন পঞ্চাশেক লোক খেলে। দয়াময়ী ও অন্য দুটি স্ত্রীলোক নিজেরাই রান্না করলেন। ভিয়ান হ’ল না হালুইকর এল না এ যেন খেলাঘরের বিয়ে! উমা দুই বোনের বিয়ের গল্প শুনেছে, পাড়ায় আরও দেখেছে কিন্তু এমন বিয়ে যে হয় তা সে কখনও শোনে নি।

তবু ও সে ভেবেছে, স্বামী যদি ভাল হয়, মনের মতন হয়–এ সব বাইরের তুচ্ছ ব্যাপার নাই বা হ’ল ঠিক ঠিক! সে দিতে ত ঈশ্বর তার প্রতি কার্পণ্য করেন নি! স্বামীর ভালবাসার অমৃত-প্রলেপে ওর এই সব আঘাতের ক্ষত শুকিয়ে উঠবে।

তখনও সে জানে না ভাগ্যদেবতা তাঁর সবচেয়ে বড় পরিহাসটাই ওর জন্য তুলে রেখেছেন।

ফুলশয্যার আচার-অনুষ্ঠান শেষ হয়ে সকলে চলে গেলে দুরু দুরু বক্ষে উমা যখন প্রতীক্ষা করছে সেই পরম শুভক্ষণের–স্বামীর কাছ থেকে প্রেমের প্রথম নিদর্শন যখন আসবে তখন ওর দিকে এগিয়ে, স্বামী হয়ত কাছে ডাকবেন কি হাত ধরে টানবেন বুকের মধ্যে কিংবা আরও অচিন্তিত- পূর্ব কিছু, যা সে এখনও শোনে নি কারও মুখে,–চাপা গলায় শোনা গেল, ‘শোন, এদিকে এসে বোস।’

হৃৎপিন্ডটা ধ্বক করে উঠে থেমে যাওয়ার উপক্রম হ’ল। কেমন যেন শুষ্ক শোনাচ্ছে কণ্ঠস্বর। এ কি!

উমা বসে বসে ঘামছে। শরৎ আবারও ডাকলে, ‘খুব জরুরী কথা আছে, এদিকে কান দাও। আমি প্রেমালাপ করার জন্য ডাকি নি। এসো এসো–সরে এসো।

শেজের মৃদু আলোয় ভাল ক’রে কিছু দেখতে পায় না উমা, চুপ করে বসেই থাকে। চোখের দৃষ্টিটা শুধু আরও ঝাপসা হয়ে ওঠে। সারা বাড়িটা নিস্তদ্ধ– কেউ আড়ি পাতবে না তা উমাও জানে। সে রকম লোকই নেই এ বাড়িতে।

শরৎ অস্ফুট একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে নিজেই এগিয়ে আসে, মুখের অনেকটা কাছে মুখ এনে বলে, ‘দ্যাখো একটা কথা আজ থেকেই পরিষ্কার ক’রে রাখতে চাই। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না; আমার কাছে কিছু প্রত্যাশাও করো না। মানে স্বামীর কাছে স্ত্রী যা আশা করে সে ভালবাসা তোমাকে আমি দিতে পারব না। বিয়ে করেছি মার জুলুমে, তা ব’লে তোমার সঙ্গে ঘর করা হবে না আমার দ্বারা

উমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেল? সে কি ভুল শুনছে? না ভুল বুঝছে? ওর বুকের রক্ত-চলাচল বোধ হয় বন্ধ হয়ে যাবে–

ঠিক কি ভাবছিল, কি শুনছিল কিছুই, জানে না উমা ভাল ক’রে। সে রাত্রের কথাগুলো অনেকদিন সে ভাববার চেষ্টা করেছে, মনে করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু–

লক্ষ যোজন দুর থেকে কে যেন কথা কইছে না?

শরৎ বলছে, ‘তুমি রক্ষিতা কাকে বলে জানো? জানো না? তাই ত! মানে আমি আর একটি মেয়েকে ভালোবাসি, তার সঙ্গেই ঘর করি। তাকে ছাড়া আর কারুর সঙ্গে আমি ঘর করতে পারব না। আজ তিন বছরের পুরানো অভ্যেস, সে আর বদল হবে না। ছেলের চরিত্র খারাপ হচ্ছে ব’লে মা বিয়ে দিতে চাইলে, বড় জ্বালাতন করে তাই বিয়ে করতে হ’ল। নইলে আমার ইচ্ছা ছিল না। কী করব, মা সেখানে পর্যন্ত গিয়ে চেঁচামেচি করে। তাই গোলাপীও বললে, কাজ কি বাপু অত হ্যাঁঙ্গামে, একটা বিয়ে করে ফেলে রেখে দাও। তাও আমি ভেবেছিলুম যে, যে মেয়ে দেবে সে ত খোঁজখবর করবে, আমার মা-টি যে কি চীজ্ তা জানলে আর বিয়ে দিতে চাইবে না কেউ। তা তোমার মা যে এমন ফট ক’রে রাজী হয়ে যাবেন তা কেউ জানত! তুমি ত বেশ সুন্দর, মা পয়সা খরচও করলেন–এমন পাত্রে দিলেন কেন?’

উমার মুখ দিয়ে একটিমাত্র প্রশ্ন বের হ’ল, ‘আপনি তাকে বিয়ে করেন নি কেন?’

প্রশান্ত মুখে বললে শরৎ, ‘হরি হরি! সে যে বেশ্যা, কিন্তু সেও বেশ সুন্দরী। ছোট জাতের মেয়ে–তাহ’লেও চেহারায় বেশ লাজ্জত আছে। তাছাড়া সে খুব ভালবাসে। আমি ত বেশি পয়সা কড়ি দিই না, মাইনের টাকা মা মাইনের তারিখে ছাপাখানায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আদায় করে নেয়। শুধু ওভার-টাইমের টাকাটা, তা সে আর কত। ও-ই আমাকে খাওয়ায়। ওর মায়ের কিছু ছিল, তাছাড়া এদিক ওদিক কিছু কামায়, তাইতেই চলে। নইলে দুটো প্রাণীর চলে কিসে বলো,–এই দিনকাল।’

উমা আজকালকার মেয়ে নয়। সেদিন এ প্রশ্ন তার মাথাতেও আসে নি যে, এক্ষেত্রে কোন্ অধিকারে বিয়ে করেছে শরৎ ওর নারী-জীবনকে ব্যর্থ করে দেবার কি অধিকার ছিল ওর? তখনকার দিনে স্বামী না নিলে মেয়েরা নিজেদের অদৃষ্টকেই ধিক্কার দিত। উমাও তাই দেবে নিশ্চয়। তখন সেই মুহূর্তে কিন্তু কোন কথাই মনে ছিল না ওর–স্তম্ভিত, জড় হয়ে বসে রইল।

আর শরৎও– শুদ্ধ মাত্র মার জ্বালাতনে উত্ত্যক্ত হয়ে একটি মেয়ের সারা জীবন নষ্ট ক’রে দিতে বসেছে–এটা অম্লান বদনে বলতে পারলে, একটুও বাধল না কোথাও। তবে আশ্বাসও দিলে বৈকি সে, বললে, ‘তা ব’লে আমি কোন জুলুমও করব না। তোমার ওপর কোন আক্রোশ নেই ত। তুমি সংসার নিয়ে থেকো, আমি আমার কাজ নিয়ে থাকব। মার সঙ্গে ঐ শর্তই হয়েছিল, বৌ এনে দেব ওর সংসারের কাজের জন্যে। তারপর আর আমাকে কোন কথা বলতে পারবে না। বোধ হয় ভেবেছিল সুন্দরী বৌ এলে আমি নিজেই সেদিকে ঢলব, আর কিছু বলতে হবে না। ছেলেকে ত চেনে নি এখনও।’

একটু হেসে ওঠে শরৎ। বোধ হয় রসিকতাটা অনুভব করতেই থামে একটু তারপর বলে, ‘এই পাঁচ-ছ’টা দিন। তারপর কি আর বাড়ি আসব ভেবেছ? এই কটা দিন মাঝে বালিশ রেখে শোও। কী আর করবে। দ্যাখো সব পরিষ্কার ক’রে দিলুম–এর পর যেন কোনরকম দুষো না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *