০৬. খালি বাড়িটা

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

খালি বাড়িটা আরও ফাঁকা লাগে। হা-হা করে বিরাট শূন্যতা। শুধু ত শ্যামা যায়নি, তার সঙ্গে হেমও গেছে; দু’বছরের শিশু তার হাসির কলরবে বাড়িতে যে প্রাণস্পন্দন জাগিয়ে রেখেছিল, তা নিঃশেষে মরে গিয়েছে যেন।

রাসমণি আরও বেশী সময় দেন পূজোতে। কিন্তু উমার কিছুই করবার নেই। এক এক সময় ভয়াবহ শূন্যতা ও নিষ্ক্রিয়তায় মনে হয় যেন সে পাগল হয়ে যাবে। নির্জন একান্তে টিক্ টিক্ ক’রে মাথা খোঁড়ে সে মধ্যে মধ্যে।

সাদিক মিয়া বা সাদিক মুসলমান (এই নামেই তিনি পাড়ায় বিখ্যাত ছিলেন) উপদেশ দেন, ‘নিচের তলাটা ভাড়া দাও মেয়ে তাতে বাড়িতে লোকজনও থাকবে,

তোমার ভাড়ারও অনেকটা সুসার হবে।’

কিন্তু রাসমণি রাজী হন না। ভাড়াটের সঙ্গে একত্র থাকা যে কী, সে সম্বন্ধে তাঁর কিছু অভিজ্ঞতা আছে বৈকি! আশপাশের বাড়িতে নিত্য কলহ শুনে শুনে তিনি ক্লান্ত। কে কার সিঁড়ি ধোওয়ার পালায় ফাঁকি দিয়েছে, কোন্ ভাড়াটে পাইখানা পরিষ্কার করানোর শর্ত মানছে না, কে কতটা জল বেশি খরচ করছে– এমনি হাজারো ঝঞ্ঝাট। তাছাড়া গুচ্ছের ছেলেমেয়ে হয়ত থাকবে চ্যাঁ ভ্যাঁ নোংরামি। না, সে তিনি

পারবেন না।

‘বরং বুড়ো গোছের একটা দারোয়ান যদি পাওয়া যায়– দোকানে কি অফিসে কাজ করে, এখানে রাত্রে থাকবে, সামান্য ফাই-ফরমাশ খাটবে– সেই চেষ্টা বরং দেখুন বাবা!’

মাস দুই পরে সাদিক তার চেয়ে ভাল প্রস্তাব আনেন, ‘এক ভদ্রলোক ছোটখাটো একটা ছাপাখানা চালাবে –নিচের তলাটা ভাড়া দেবে? নটায় প্রেস খোলে, বড়জোর সন্ধ্যে পর্যন্ত থাকবে। অরপর চাবি দিয়ে বাড়ি চলে যাবে। ভাড়াও দিতে চাইছে কুড়ি টাকা। এটা পেলে তোমার আর বিশেষ ভাড়াই লাগবে না। ত্রিশ টাকার মধ্যে কুড়ি টাকাই ত আদায় হয়ে যাচ্ছে।’

প্রস্তাবটা রাসমণির মন্দ লাগে না। মেয়েছেলে থাকলেই ছেলেমেয়ে থাকবে গন্ডগোল চেঁচামেচি হাজার রকমের ঝঞ্ঝাট। অথচ বাসাড়ে বেটাছেলে থাকার যে অসুবিধা ও বিপদ, এক্ষেত্রে সে সব সম্ভাবনাও নেই। সারাদিন কাজ করবে সন্ধ্যাবেলা চলে যাবে। সে সময়টা নিচে যাবার দরকার কি?

তবু একটু চিন্তিত মুখে বলেন, ‘কিন্তু কল-পাইখানা? সে ত নিচের তলায়!’ সাদিক বললেন, ‘সেটা একটা পার্টিশানের মত দিয়ে দিলেই হবে। ওদের ব’লে দেব যে কল-পাইখানা সারতে পারবে না। বাইরেই ত সরকারী কল আছে। এধারের সিঁড়ির সঙ্গে কলতলা সুদ্ধ ঘিরে আমি করগেটের বেড়া দিয়ে দিচ্ছি। ওদের সঙ্গে সম্পর্কই থাকবে না–কেমন?’

রাসমণি রাজী হলেন। টাকার কথাটাও একেবারে উড়িয়ে দেবার মত নয়। কলসীর জল গড়াতে গড়াতে একবারে তলায় এসে ঠেকেছে –আর কতদিন চলবে তা ভাবতে গেলেও ভয় হয় তাঁর।

সাদিক মিয়া লোক পাঠিয়ে করগেট দিয়ে বেশ ক’রে উঠোনের মধ্যে বেড়া টেনে দিলেন। তার একটা দোরও হ’ল। সেটা খুললে তবে বাইরের দিকে পড়ে বাড়ি থেকে বার হওয়া যায়। ভেতরের দিকের ছোট একটা ঘরও তাঁদের রইল, শুধু ওদিকের দুখানা ঘর ছেড়ে দেওয়া হ’ল ভাড়াটেদের। কথা হ’ল ভেতরের দিকের দোরও তারা বন্ধ রাখবে। রাস্তার দিকেই তাদের যখন কাজকারবার, অন্তঃপুরে আসবার দরকার কি?

মাসের পয়লা থেকে ভাড়াটে এল। দুদিন আগে থেকেই তাদের লটবহর আসতে শুরু হয়েছে টাইপ রাখার খোপ-ওলা কাঠের কেস্, গ্যালি রাখার র‍্যাক, টুল, চেয়ার, টেবিল। জন-দুই মিস্ত্রী এসে একটা ছোট ট্রিড্‌ল্‌ প্রেসও লাগিয়ে চালিয়ে দিয়ে গেল। এ ছাড়া আরও এল কিছু রবার স্ট্যাম্প করার সাজ-সরঞ্জাম।

উমার কাছে এসব জাদুঘরের সাজিয়ে রাখা জিনিসের মতই দ্রষ্টব্য। সে ইতিমধ্যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখারও একটা ব্যবস্থা ক’রে ফেলেছে। সিঁড়ির একটা বাঁকে বসলে রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে ওদের বড় ঘরটার জানালার মধ্য দিয়ে দৃষ্টি পাঠানো যায় বহুদূর। উমা সেইখানে বসে দেখে অবাক্ হয়ে। ওর ডাগর দুটি চোখ বিস্ময় বিস্ফারিত হয়েই থাকে, রেলিং-এ চেপে রাখার ফলে শুভ্র গৌর ললাটে ছাপ ফুটে ওঠে সেখান থেকে না পারে নড়তে আর না পারে চোখ ফেরাতে।

বিস্ময়!

তবুও

ওর আগাগোড়াই বিস্ময় লাগে। টুলে বসে কেমন দ্রুত হস্তে কম্পোজিটাররা বিভিন্ন খোপ থেকে টাইপগুলো নিয়ে পর পর সাজায়। কী নিচ্ছে সেদিকে নজর নেই, নজর ওদের লেখা কাগজখানার দিকে শুধু। সকলেরই খাটো কাপড় পরনে গায়ে ছেঁড়া জামা আর খালি পা। টুলে বসে বসে ওদের ঘাড় ব্যথা করে না? নটায় এসে বসে, ওঠে কেউ সন্ধ্যা ছটায় কেউ আরও পরে। দুপুরে শুধু একবার উঠে মুড়ি খায়। আধ পয়সার মুড়ি আর আধ পয়সার বেগুনি কি ফুলুরি।

আবার কল চালিয়ে ছাপা — সেও কম বিস্ময় নয়। পা দিয়ে কি একা ঠেলে আর চাকা ঘোরে। কেমন লুচি বেলা বেলুনের মত দুটো বেলুন একটা লোহার চাকি থেকে কালি নিয়ে সীসের অক্ষরের ওপর বুলিয়ে দিয়ে যায় তারপর তাতে পিনে আটকানো কাগজখানা গিয়ে পড়ে আর আপনি ছাপা হয়ে যায়। কোনটা দেখবে উমা যেন ভেবেই পায় না।

ওদের মনিবটিও দেখবার মত বৈকি! বেঁটে খাটো কালো-পানা মানুষটি দোহারা

টও দেখবার মত বৈরি বলিষ্ঠ গড়ন। ছোট ছোট দুটি চোখে কেমন এক প্রকারের ধূর্ত দৃষ্টি। ধুতির ওপর

৬৭

মেরজাই পরে ঘুরে বেড়ায়, একটা জামা আছে, সেটা পেরেকে টাঙানোই থাকে। প্রেসের চাবি থাকে তার ট্যাঁকে গোঁজা ফলে খাটো কাপড়খানা হাটুর ওপরে উঠে পড়ে। লোকটি এক দণ্ড স্থির হয়ে থাকে না। যখন খদ্দের আসে তখন চেয়ারে এসে বসে, পাশে টুলের ওপর ক্যাশ বাক্সটিতে একটা হাত দিয়ে নইলে হয় কর্মচারীদের খিঁচোর, নয়ত রবার স্ট্যাম্প তৈরি করতে বসে। কর্মচারী অবশ্য খুবই কম, দুটি কম্পোজিটার আর একটি মেসিন চালাবার লোক, সে-ই অবসর সময়ে ফাই-ফরমাশ খাটে। মনিব নিজেই রবার স্ট্যাম্প তৈরি, করেন –খদ্দেরের কাছে খালি বলেন, (কেউ কিছু পালটে দিতে বললে) ‘এখন ত আবার আমার কর্মচারী নেই কিনা, ওটা থাক কাল সে এসে সেরে রাখবে’খন।’ অর্থাৎ জানতে দেন না কাউকে যে কাজটা তিনি নিজেই ক’রে থাকেন।

লোকটির ভাবভঙ্গী দেখলে উমা কিছুতেই হাসি চাপতে পারে না। বয়স কত সে সম্বন্ধে ওর কোন ধারণা নেই ত্রিশও হতে পারে, চল্লিশ হওয়াও বিচিত্র নয়। কিন্তু শুধুই হাসি পায় না, কেমন যেন ভয়-ভয়ও করে। কী একটা আছে লোকটার মধ্যে আতঙ্ককর কিছু যাতে তার দিক বেশিক্ষণ চেয়ে থাকলে গায়ের মধ্যে একটা শিশির্ করে ওঠে

অথচ যত মনে করে সে ওদিকে চাইবে না চোখ ফিরিয়ে নেয়, ততই দৃষ্টি যেন ঘুরেফিরে ওর উপর নিবদ্ধ হয়। চোখ ফেরাতে পারে না।

গোপনচারিণীর এই চুরি ক’রে দেখাটুকু, বলা বাহুল্য প্রেসের মালিক ফটিকেরও

চোখ এড়ায় নি। সে নিজে জানতে দেয় নি যে সে জানে বাইরে এমনি নিস্পৃহ উদাসীন ভাব বজায় রেখেছিল কিন্তু তার চোরা চাহনি সদাজাগ্রত দৃষ্টি মেলে থাকত এই রূপসী ও কিশোরী মেয়েটির দিকে। তার কাছে কিছুই চাপা ছিল না।

একদিন অপরাহ্নে অবসর-মত উমা এসে বসেছে তার খাঁজটিতে, হঠাৎ ফটিক মুখ তুলে তাকালে। সেদিন কী কারণে সকাল ক’রে কর্মচারীদের ছুটি হয়ে গিয়েছিল। ফটিক একাই বসে বোধ হয় হিসেব-নিকেশ দেখছিল। পেছন ফিরে বসে থাকা সত্ত্বেও উমার নিঃশব্দ প্রবেশ কেমন ক’রে টের পেয়ে আকস্মিক ভাবে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘খুকী শোন মা, আছেন ওপরে?

উমা একেবারে অবাক্। এক্ষেত্রে কি করা উচিত ছুটে পালানোই উচিত কি না কিছুই ভেবে পেলে না সে। অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে কথা বলা নিশ্চয়ই ঠিক নয় এ কথা সে জানে ভাল ক’রেই কিন্তু ওর চুরি ক’রে দেখাটা ধরা পড়ে গেছে, এবং সামনা-সামনি লোকটি যখন প্রশ্ন ক’রে বসেছে তখন উত্তর না দেওয়াটাও বোধ হয় অভদ্রতা হবে! এখন কি করলে সব দিক বজায় থাকে প্রাণপণে ভাবে সে।

ঠিক কি করবে এখন কিছুই ভেবে না পেয়ে উমা তাকিয়েই আছে ওর দিকে বিমূঢ় নির্বাক ভাবে, এমন সময়ে ফটিকই আবার কথা কইলে। সে এক নজরেই উমার লজ্জারক্ত মুখ ও বিব্রত দৃষ্টি দেখে ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছিল ললে, ‘মা ঠাকুরুনকে বলো ত, আমি একবার প্রণাম করতে যাব।

এবার উমা অব্যাহতি পেল। সে ছুটে ওপরে গি ঐ ছাপাখানার লোকটা আপনার সঙ্গে কথা কইতে চায়

৬৮

পাতে হাঁপাতে বললে, ‘মা,

বামি করতে যাবো–’

রাসমণি মেয়ের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘ও তোকে পেলে কোথায় যে তোকে ডেকে বললে?’

আবারও উমার সুগৌর মুখখানি রক্তরাঙা হয়ে উঠল। সে ঘাড় হেঁট ক’রে দাঁড়িয়ে রইল অপরাধীর মত।

সিঁড়ি দিয়ে ওদের ঘরের দিকে উঁকি মারছিলি বুঝি? আর কখনও অমন ক’রো না। বুঝলে? ওতে নিন্দে হয়। ভেতরে যাও এখন।’

তারপর তিনি নিজেই বাইরে বেরিয়ে এসে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, ‘কী বলছিলে বাবা, ওপরে এসো।’

সেই দিন মাসকাবার, সংক্রান্তি। তবু ফটিক ট্যাক্ থেকে ভাড়ার কুড়িটা টাকা বার ক’রে ওঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম ক’রে পায়ের ধূলো নিয়ে মাথায় ও জিভে ঠেকালে I

রাসমণি যেন একটু অপ্রতিভ হলেন, ‘এত তাড়া কি ছিল বাবা, এখনও তো মাস শেষই হয় নি বলতে গেলে!’

‘তা হোক্ মা। যা দিতে হবে তা দিয়ে ফেলতে না পারলে আমার রাত্রে ঘুম হয় না। কিন্তু ঠিক সেই জন্যেই আপনাকে ডাকি নি মা একটা কথা বলব, ক’দিন থেকেই মনে করেছি, আজ সাহস ক’রে তাই–

থেমে গেল সে মাঝপথেই, রাসমণি উত্সুক হয়ে চেয়ে থাকেন, আশা করেন বাকী কথাটার।

‘মা, আমি আপনার সন্তানের মত’, বিনয়পূর্বক শুরু করে ফটিক, ‘যদি অপরাধ না নেন ত বলি।’

‘বল না বাবা। অপরাধ কিসের।’

‘মা, আপনার এই মেয়েটির কথা সব শুনেছি। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথ ত বন্ধ, আপনিই বা কদিন থাকবেন। তারপর কি হবে ওর?’

ধৃষ্টতা সন্দেহ নেই। তবু লোকটার বলার ভঙ্গীতে এমন একটা আন্তরিকতা ছিল যে রাসমণির দৃষ্টি প্রখর হয়ে উঠলেও কণ্ঠস্বর কঠিন হয় না, কতকটা কোমল কণ্ঠেই বলেন, ‘সে ওর অদৃষ্টে যা আছে হবে বাবা। তবে এ সব কথা বাইরের লোকের সঙ্গে আলোচনা না করাই ভাল।

‘ঐ জন্যেই ত অভয় চেয়ে নিয়েছি মা আগে থাকতে। একটা প্রস্তাব আছে বলেই কথাটা পেড়েছি। ওকে হাতের কাজ শেখাবেন কিছু? যাতে ও রোজগার ক’রে খেতে পারে?’

‘কি কাজ?’ সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠেন যেন রাসমণি।

ধরুন রবার স্ট্যাম্প করার কাজ। নতুন কাজটা উঠেছে, এখনও বেশী লোক জানে না তৈরি করতে। অর্ডার আসে খুব। ও যদি ঘরে বসে তৈরি ক’রে দিতে পারে আমি দাম আর কাজ বুঝে নিতে পারি। ওতে বেশ আয় হবে।’

সে এখন ওকে কে শেখাবে বাবা বলো!’

‘যদি অনুমতি করেন ত আমি শেখাতে পারি —

৬৯

‘সে কি হয় বাবা!’ দৃঢ়কণ্ঠে বাধা দিয়ে ওঠেন রাসমণি, ‘বাজে কথা ব’লে লাভ কি!

‘কেন হয় না মা। আপনি বসে থাকবেন, আপনার সামনে বসে আমি শিখিয়ে দেব। তারপর মাল-মশলা সব ওর ঘরেই থাকবে আমি শুধু কাজটা আপনার হাতে এনে দেবো, আপনার কাছ থেকে বুঝে নেবো।… ও ভেতরে বসে কাজ করবে। বেশ আয় হবে আপনি দেখবেন।’

‘সে ত আজ তুমি আছ বাবা

পরে কে ওকে কাজ দেবে, কেই বা বুঝে নেবে? এ হ’ল কারবারের কথা! মেয়েছেলে কি কারবার করতে পারে? তুমি আজ আছ কাল নেই।’

স্পষ্ট কথাই বলেন রাসমণি। ওর এই অপ্রাসঙ্গিক কথায় একটু বিরক্তও হন। ফটিক কিন্তু নাছোড়বান্দা। বলে, ‘আমি না-ই বা রইলুম মা, সন্ধানসুলুক দিয়ে যাবো এরপর ত চাকর দিয়েও করাতে পারবেন। তাতেও কিছু থাকবে। তাছাড়া কাজটা শিখে রাখতে দোষ কি?’

তবু সংশয় কাটে কৈ? রাসমণি বলেন, ‘এসব কাজ মেয়েছেলে শিখছে শুনলে লোকে কি বলবে?

‘লোকে শুনবে কেন মা? আপনি আর আপনার এই ছেলে এ ছাড়া কারুর শোনবার দরকার কি?’

‘আচ্ছা ভেবে দেখি।’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলতে হয় রাসমণিকে, কতকটা ওকে এড়াবার জন্যই।

কিন্তু উমা আড়াল থেকে সবই শুনেছিল। সে জেদ করতে লাগল, শিখতে দিন না মা, আপত্তি কি? আপনার সামনেই ত শিখব লোকে কে জানতেই বা পারছে! এরপর যা হয় হোক্‌ এখনও ত দু’পয়সা আয় হতে পারে।’ ইত্যাদি।

+

ক’দিন ধরে অনবরত একই কথা শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে রাসমণি বলেন, ‘না। ভেবে দেখলুম ওসব ঝামেলার কাজ নেই।’

দুই

উমার পিপাসার্তা অন্তরবাসিনী ফটিকের এই প্রস্তাবটিকে যেন প্রাণপণে আকড়ে ধরেছিল, এখন মার নিষেধাজ্ঞায় সে অবলম্বন একেবারে ভেঙে পড়ল। এটা ওর কাছে রীতিমত অবিচার ব’লেই বোধ হ’ল। কি করবে ও? এখন ত মা আছেন তারপর? ভিক্ষে ক’রে খেতে হবে, নয়ত দিদির বাড়ি বিনা মাইনের দাসীবৃত্তি করতে হবে। কেন? কেন? কেন ও স্বাধীন একটা বৃত্তি অবলম্বন করবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে?

প্রবল একটা ক্ষোভ আর বিদ্রোহ ওর মনের মধ্যে দুর্বার হয়ে ওঠে। কিন্তু রাসমণির মুখের চেহারা দেখে সে বিদ্রোহ প্রকাশ সম্ভব হয় না। মাকে ভয় করাটা ওদের অভ্যাস হ’তে হ’তে স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে –এখন আর তাকে বদলাতে পারে না।

দিন দুই ও ভাল ক’রে খেলে না, মার সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কথা বললে না। তাতে অবশ্য রাসমণির বিশেষ কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। তিনি নিশ্চিন্ত মনেই নিজের কাজ ক’রে যেতে লাগলেন। তিনি যে ওর এই পরিবর্তন লক্ষ্য করেন নি তা

নয়, প্রশ্রয় দিতে চান নি। তিনি জানতেন এ নিয়ে কচকচি করলে ব্যাপারটা তেতো হয়ে উঠবে। তিনি উমার অজ্ঞাতসারেই একটু কড়া নজর রাখলেন শুধু।

উমাও ভয়ে ভয়ে কিছুদিন সিঁড়ির ধার দিয়েই গেল না। কিন্তু কর্ম ও মানুষের সঙ্গের অভাব ওর কৌতূহলকে ক্রমশঃ অসহ করে তুলতে লাগল। ফটিক আজকাল রাত অবধি একা অফিস ঘরে থাকে! কি কাজ করে তা ওপর থেকে বোঝা যায় না শুধু দেখা যায় ঘরে ডবল ফিতের জোরে টেবিল ল্যাম্পটার আলো জ্বলে এবং মধ্যে মধ্যে খুট্ খুট্ ক’রে কি আওয়াজ হয়। সেটা রাসমণিও লক্ষ্য করেন। একদিন সাদিক মিয়াকে ডেকে বললেন, ‘বাবা, আপনি বলেছিলেন যে সন্ধ্যার আগেই ওরা চলে যাবে, এখন ত দেখি রাত নটা-দশটা পর্যন্ত কি করে ঘরের মধ্যে!’

সাদিক বিস্মিত হলেন। বললেন, ‘তাই নাকি?…আচ্ছা দেখছি আমি।’

খবর নিয়ে এসে বললেন, ‘সবাই চলে যায়, শুধু ফটিকবাবু থাকেন। ওঁর রবার স্ট্যাম্পের কাজ খুব বেড়েছে, তাই রাত অবধি নিজে বসে কাজ করেন। তাছাড়া প্রেসের অবস্থা খুব ভাল যাচ্ছে না ত– তাই নিজেই কিছু কিছু কম্পোজ করে রাখেন, আর একটা লোক বাড়াতে চান না।’

‘প্রেসের অবস্থা ভাল নয়? কিন্তু কাজ ত আসছে! যে লোক ছিল তাদের ত আর তাড়ায় নি, আবার নিজেও এত করছে অবস্থা ত ভাল হবার কথা।’

তিনি চুপ ক’রে গেলেন। ভাড়াটে বসিয়ে আর এত তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বাদানুবাদ করা যায় না। সাদিক মিয়ারই বা এমন কি গরজ তিনি ভাড়াটের সন্ধান দিয়ে ত আর অপকার করেন নি –মিছিমিছি তাঁকে উত্ত্যক্ত করা ঠিক নয়।

কিন্তু, ক্রমশঃ ফটিকের অবস্থানকাল দীর্ঘতর হয়। দশটাও বেজে যায় এক এক দিন।

রাসমণির সন্ধ্যাবেলাই জপ-আহ্নিক সেরে শুয়ে পড়া অভ্যাস। রাত নটার পর উঠে মেয়েকে খেতে দেন, নিজেও কোন কোন দিন একটু কিছু মুখে দেন, তারপর পাকাপাকি ভাবে বিছানা পেতে শুতে যান। এই সময় আর ঘুম হয় না তাঁর

তা উমা জানে, সারারাত ছটফট করেন আর মধ্যে মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, কখনও বিছানায় উঠে বসে জপ করতে থাকেন। কিন্তু বোধ হয় সেই জন্যেই সন্ধ্যার ঘুমটা গাঢ় হয়। উমার পক্ষে এমন সুযোগ-সুবিধার লোভ সম্বরণ করা কঠিন হয়ে ওঠে। আজকাল সন্ধ্যার সময় ঝিও থাকে না। কাজ কম হয়ে গেছে বলে রাসমণি নূতন বন্দোবস্ত করেছেন, এখানে শুধু পেটভাতে থাকে সে, সকাল সন্ধ্যায় অন্য বাড়ি ঠিকে কাজ করে। এখানকার কাজ সেরে চলে যায় পাঁচটায়, ফেরে কোনদিন রাত নটায়, কোনদিন সাড়ে নটায়। মার পুরোনো বইগুলো এক-একখানা পঞ্চাশ-ষাটবার ক’রে পড়া হয়ে গেছে। সেগুলোও আর ভালে লাগে না। নিজে মধ্যে মধ্যে কবিতা লেখার চেষ্টা করে সময়টা শুধু ঘুরে বেড়ায়, খালি বাড়িতে একা একা।

হ’ল।

সুতরাং প্রকৃতির দুর্লভ্য

বাকী

রি আবার এসে বসতে

জানালার সেই বিশেষ খাঁজ দিয়ে দৃষ্টি প্রসারিত ক’রে যা দেখে তাতে ও রীতিমত বিস্মিতই হয়। ফটিক তার টুলটির ওপর অভ্যস্ত ভঙ্গীতে ক্যাশবাক্সে হাত দিয়ে চুপ ক’রে বসে আছে। এত রাত অবধি কাজ করা ছাড়া থাকার কোন কারণ নেই– কিন্তু কাজ ত কিছুই করছে না, চুপ ক’রে বসে আছে যেন কার জন্য অপেক্ষা করছে। ওধারে দোরও বন্ধ, ঘরেও দ্বিতীয় প্রাণী নেই, তবে এ কিসের প্রতীক্ষা?

অনেকক্ষণ, বোধ হয় কুড়ি-পঁচিশ মিনিট এই ভাবে কাটল। অবশেষে কৌতূহল অপূর্ণ রেখেই উমা উঠবে মনে করছে এমন সময় সাপের মত হিসহিসিয়ে কে বলে উঠল, ‘খুকী শোন!’

শিউরে চমকে উঠল উমা।

কে, কে বললে এ কথা? ফটিক ত তেমনি ওদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে আছে, একবারও ফেরে নি। তবে ও জানবে কি ক’রে উমার অস্তিত্ব? কিন্তু ওরই গলা যেন–

এ কি ভৌতিক ব্যাপার নাকি!

নিমেষে ঘেমে উঠল সে। জিভটা শুকনো ঠোঁটের ওপর একবার বুলিয়ে নিয়ে ওঠবার চেষ্টা করলে কিন্তু পা যেন অসাড়, নড়বারও শক্তি নেই; কি একটা আতঙ্কে ওর সব স্মায়ূ যেন অবশ হয়ে গেছে

এবার ফটিক মুখ ফেরালে, টুল থেকে উঠেও দাঁড়াল।

‘ভয় কি, শোন না।’

উমার এতক্ষণে যেন হাত-পায়ে সাড় ফিরে এল। সে প্রাণপণ চেষ্টায় উঠে দ্রুত ছুটে পালাল দোতলায়। একেবারে সর্বশেষ ধাপে পা দিয়ে প্রথম থামল সে দম ফেলবার জন্য, নিজেকে একটু নিরাপদ মনে করে। কিন্তু দেখা গেল যে ফটিকের পূর্ণ পরিচয় সে পায় নি সেই কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সরীসৃপের মতই নিঃশব্দ দ্রুতগতিতে সে একেবারে উমার সামনে পৌঁছে গেল এবং সেই রকম ফিসফিস করে বললে, ‘ভয় কি? আমি যে তোমার জন্যেই বসেছিলুম। শিখবে তুমি রবার ইস্ট্যাম্পের কাজ?’

‘মা বারণ করেছেন যে!’ থতিয়ে থতিয়ে অনেক কষ্টে উত্তর দেয় উমা। ওর গলা শুকিয়ে কাঠ, সর্বাঙ্গ কাঁপছে ভয়ে।

‘ওঁরা সেকেলে লোক, সব তাতেই খারাপ দেখেন। তুমি ত আর সত্যিই কিছু অন্যায় করতে যাচ্ছ না, ভয় কিসের? উনি ত এই সময়টা রোজ ঘুমোন।

এই সময় তুমি একটু ক’রে শিখে রাখলে পারো। এটা একটা বিদ্যে –বিদ্যে শিখে রাখতে দোষ

কি?’

তবু উমা ইতস্তত ক’রে!

তোমার অবস্থা দেখে মনে দুঃখ হয়েছে তাই। নইলে আমার আর এত মাথাব্যথা কি? রোজ এই এত রাত অবধি বসে অপেক্ষা করি জানি দু-চার দিন গেলেই আবার তুমি সিঁড়িতে এসে বসবে

–তু… আপনি টের পান কি ক’রে?’ কৌতূহলটাই বড় হয়ে ওঠে।’

আশার

বই

মা টের

ফটিক হাসে একটু। অন্ধকারেও ওর দাঁতগুলো দেখা যায়। শক্ত, মজবুত দাঁত। ‘এসো। এসো। আচ্ছা, ব্যাপারটা একটু দেখেই যাও না। ক-মিনিট বা পাবেন না।

নিজের অনিচ্ছাতেই যেন নেমে আসে। কোন অন্যায় সে করে নি এটা ঠিক, অন্যায় বা পাপের ধারণাও ওর ছিল না, তবু পা-দুটো যেন কাঁপে থরথর করে, সর্বাঙ্গ ঘেমে ওঠে।

ফটিক কিন্তু খুব সহজ। সে নিতান্ত স্বাভাবিক ভাবেই কথাবার্তা কয়। ওকে দেখায় রবার স্ট্যাম্প তৈরি করার কৌশল ও কলকব্জা। একটা লাইন তৈরি ক’রেও দেখায়। ক্রমে ক্রমে উমার আতঙ্কও কমে। যদিচ কান পাতা থাকে ওপরের দিকে। খানিকটা পরে ফটিকই বলে, ‘এইবার ওপরে যাও খুকী

মা উঠে পড়বেন হয়ত, তোমাদের ঝি আসারও সময় হ’ল।’ উমাও যেন পালিয়ে বাঁচে। তাড়াতাড়ি যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ওপরে উঠে আসে।

পরের দিন উমা আর সিঁড়ির ধারে গেল না। যদিও ওপরের বারান্দা থেকে ফটিকের ঘরের আলোর রেখা লক্ষ্য ক’রে সে বোঝে যে ফটিক সেদিনও ওর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আর নয় মনকে শাসন করে সে, মা যখন নিষেধ করেছেন তখন দরকার নেই ওসব ঝামেলায় গিয়ে।

>

কিন্তু তার পরের দিন আবার কে যেন ওকে আকর্ষণ করে মা ঘুমোবার পরেই এসে বসে সিঁড়িতে, ফটিকও যেন প্রস্তুত ডেকে ঘরে নিয়ে যায়। বলে, ‘আজ একটা অর্ডার আছে। দ্যাখো যদি তৈরি করতে পারো ত এর লাভটা তোমাকেই দেবো।’ আগের দিন কেন আসে নি উমা, সে প্রশ্ন ত দুরের কথা তার ইঙ্গিত মাত্রও করে

না।

ব্যাপারটা কঠিন, নয়, অল্প আয়াসেই উমা আয়ত্ত ক’রে নেয়। অর্ডারী স্ট্যাম্পটাও তৈরি ক’রে ফেলে সে এক সময়, কাগজের ওপর ছাপ উঠিয়ে সগর্বে তাকিয়ে থাকে নিজের কীর্তির দিকে

ফটিক বাহবা দেয়, ‘তোমার খুব মাথা কিন্তু। আমিও এত তাড়াতাড়ি শিখতে পারি নি।’

পরের দিন তিন আনা পয়সা ওর হাতে গুঁজে দেয় ফটিক একরকম জোর ক’রেই, ‘বা রে! তোমার জিনিস বেচে এই লাভ হয়েছে, এটা না নিলে চলবে কেন?’

লজ্জায় সঙ্কোচে যেন মাটির সঙ্গে মিশে গিয়ে উমা বলে, ‘আমি আমি এ পয়সা নিয়ে কি করব! মা বকবেন —

‘জমিয়ে রাখো। মাকে এখন বলবার দরকার কি? এরপর খানিকটা জমিয়ে হাতে দিও একেবারে চমকে উঠবেন।’

সেদিনও একটা স্ট্যাম্প নিজে হাতে তৈরি করে উমা। টেবিল ল্যাম্পের আলোতে ঝুঁকে পড়ে সে তৈরি করে, ফটিক পাশে দাঁড়িয়ে থেকে উপদেশ নির্দেশ দেয়। ওর নিঃশ্বাস উমার গালে এসে লাগে, উমার ললাটের স্বেদবিন্দুগুলি আলোতে চিকচিক করে, ফটিক তাকিয়ে দেখে।

এসে লাগে, উমার ললাটে

৭৩

সেদিন সাজ-সরঞ্জাম গুছিয়ে রেখে উমা ‘তবে আসি’ বলে উঠে দাঁড়িয়েছে, ফটিক

ওর একটা হাত চেপে ধরলে হঠাৎ। উমা ভয় পেয়ে চমকে উঠল

কেমন একটা

ভীতত্রস্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিন্তু ফটিকের চোখের দিকে চোখ পড়ে যেন আর জোর করতে পারলে না। বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়েই রইল।

সাপের মত স্থির দৃষ্টি ফটিকের, জাদুকরের মত অমোঘ আকর্ষণ।

উমার হাতে টান দিয়ে আরও কাছে আনে ফটিক, ‘শোন! আর একটু থেকে যাও–’ হিসহিস ক’রে ওঠে যেন কোন ক্লেদাক্ত সরীসৃপ।

তিন

অকস্মাৎ ওপর থেকে রাসমণির তীক্ষ্ণ আহ্বান কানে এসে বাজল,

‘উমি!’

সাপের ফণা নেম গেল নিমেষে, উমাও যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। প্রাণপণে বিহ্বলতা কাটিয়ে ছড়িয়ে-পড়া চেতনাকে কুড়িয়ে নিয়ে সে দৌড়ে ওপরে চলে গেল।

রাসমণি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে ওর দিকে চেয়ে থেকে প্রশ্ন করলেন, ‘কী করছিলি নিচে?’ সর্বাঙ্গ কাঁপছে উমার, গলা দিয়েও স্বর বার হ’তে চায় না। সে শুধু নিরুপায়ের মত দীন ভঙ্গীতে চেয়ে রইল মার দিকে।

‘তুই ঐ ওদের ছাপাখানায় গিয়েছিলি? একা, এত রাত্রে?’ চাপা গলায় গর্জন ক’রে ওঠেন রাসমণি।

‘ও– ও ডাকলে যেন। কাজ শিখিয়ে দেব বলে–’ থতিয়ে খতিয়ে ঢোক গিলে গিলে বলে উমা।

‘আর তুমি তাই যাবে! কচি খুকী! আমি না বলে দিয়েছি ওসব চলবে না! এত বড় সোমখ মেয়ে এই গভীর রাতে একটা ষন্ডামার্কা পুরুষের সঙ্গে নির্জন ঘরে কথা কইছে –পাড়ার কেউ যদি জানতে পারে? আমি কাল সকালে মানুষের সামনে মুখ দেখাব কি ক’রে?’

তারপর একটু দম নিয়ে বললেন, ‘যার বরাত মন্দ হয় তার বুদ্ধিও কি তেমনি বিপরীত! তুমি এত খুকী নও যে কিসে কি হয় তা জানো না –। আমার চেয়ে ঐ একটা মুখ্‌খু ছাপাখানাওয়ালা ঐ হ’ল তোমার বেশি আপন, না? তাই আমি বারণ করবার পরও ওর কাছে যেতে হ’ল তোমায়! বিয়ের পর স্বামী যাকে নিলে না লজ্জায় তার মাটির সঙ্গে মিশিয়ে থাকবার কথা। তুই তাই লোকের সঙ্গে মুখ দেখাস, অন্য মেয়ে হলে গলায় দড়ি দিত! নির্লজ্জ বেহায়া কমেনকার!’

রাগ যেন কমে না রাসমণির। উন্মাদের মত বলে যান, শুধু এই জ্ঞানটা আছে যে গলার স্বর বাড়ানো চলবে না, পাড়ার কারও কানে না যায়। কিন্তু সেই চাপা গলার তর্জনের মধ্যে যে ভাষা বেরোতে থাকে তা যেন তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের মত কেটে কেটে বসতে থাকে ওর গায়ে। কাটার ওপরও নুন ছিটিয়ে দেয় সেই সব কথা।

উমারও কিছু বলবার ছিল বৈকি। এই রকম ঘরে যে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল সে দোষ তার নয় নিজে সে ইচ্ছে ক’রে বা জেনে এ বিয়ে করে নি কিংবা তার

98

কোন দোষে সে বিতাড়িত হয় নি, তবে তাকে সে কথা নিয়ে গঞ্জনা দেওয়ার কি যুক্তি থাকতে পারে? কিন্তু মার সেই রুদ্র মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে কোন কথাই বলতে পারে না, মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে ঘামে শুধু।

আরও খানিকক্ষণ ধরে ওকে তিরস্কার করার পর রাসমণি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলেন তরতর্ করে

উমার সেই বসে থাকবার খাঁজটিতে এসে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন,

‘ফটিক?’

ফটিক বহু পূর্বেই চলে যেতে পারত, কিন্তু ওপরের ব্যাপারটা কতদূর কি হয় তা জানবার কৌতূহল দমন করতে পারে নি ব’লে জানালার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল শুধু তাই, নয়, ঘরের আলোটাও নেভানো হয় নি, সুতরাং উপস্থিতিটা অস্বীকার করতে পারলে না, ওপাশের দরজা দিয়ে ঘুরে বেরিয়ে এসে নিরীহ ভাল মানুষের মতই দাঁড়াল, ‘মা, ডাকছেন!’

মুখে তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ভঙ্গী। অর্থাৎ তাকে তিরস্কার করতে গেলে সেও সহজে ছাড়বে না, সর্বপ্রকার যুদ্ধের জন্যই সে প্রস্তুত।

কিন্তু রাসমণি সে ধার দিয়েও গেলেন না। শুধু বললেন, ‘আমি আটচল্লিশ ঘন্টা সময় দিলুম, এর ভিতর তুমি ছাপাখানা উঠিয়ে নিয়ে যাবে। ভাড়াটে রাখার আর সুবিধে হবে না আমার।

ফটিক হয়ত এতটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। মিনিট খানেক সময় লাগল তার উত্তর দিতে, এবং যখন কথা কইলে তখন তার গলাতেও সে দৃঢ়তা যেন আর ফুটল না। বললে, ‘আজ্ঞে, ভাড়াটে তোলার ত একটা আইন আছে উভয় পক্ষেই পনরো দিন নোটিশ দিতে হয়।’

রাসমণি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আইন আদালত আমি বুঝিও না, করবও না। আটচল্লিশ ঘণ্টা দেখব, তারপর আমি নিজে হাতে তোমার ছাপাখানার জিনিসপত্র তুলে রাস্তায় ফেলে দেব। ক্ষমতা থাকে তুমি আটকিও। আর থানা-পুলিস করতে হয়, আইন-আদালত করতে হয় তুমি ক’রো বাবা!

এই বলে বাদানুবাদের বিন্দুমাত্র অবসর না দিয়ে তিনি ওপরে উঠে গেলেন।

উমা সে রাত্রে কিছু খেলে না, ঘুমোতেও পারলে না। তার নিজের যে কোথায় কি অপরাধ ঘটল তা সে অনেক চেষ্টা ক’রেও বুঝতে পারলে না। ফটিকের কাছে কাজ শিখতে নিষেধ করাটাও যেমন সে অবিচার ভেবেছিল, আজকের এ ভর্ৎসনাও তার তেমনি অবিচার বলে বোধ হ’ল। অবশ্য হ্যাঁ মনের অবচেতনে ফটিকের এই কিছুপূর্বের আচরণটা মিলিয়ে কোথায় যেন সে মার নিষেধাজ্ঞার এবং আশঙ্কার একটা যথার্থ স্বীকার করতেও বাধ্য হ’ল। তবু আঘাতের ব্যথাও ত কম নয়। কথা যে তীক্ষ্ণ তীরের মত বাজতে পারে, তা আজ প্রথম বুঝল উমা। শাশুড়ীর তিরস্কারের কারণগুলো সবই মিথ্যা বলে দুঃখিত হ’লেও সে আহত হয় নি বোধহয় খানি। আজ অনুভব করল বাক্যবাণ শব্দটির অর্থ।

रे

মর্মান্তিক দুঃখের প্রথম তীব্রতার বিহ্বলা উমা বার করে স

গলায় দড়িই দেবে। মা তাতে

কথাই শুনবে

90

করলে যে সে মায়ের ন দেখে নেবে সে।

অকারণে তাকে এতটা আঘাত করার শোধ তুলবে সে মার ওপর। কেন, কিসের জন্য এত ক’রে বললেন তিনি! তিনি কি এটা কখনও ভেবে দেখেন যে উমার মত মেয়ের এই একক নিঃসঙ্গ জীবন কি ক’রে কাটবে? সে যদি প্রলুদ্ধ হয়েই থাকে ফটিকের ঐ অর্থ উপার্জনের প্রস্তাবে ত এমন কিছু অন্যায় করে নি। অবশ্য ফটিক লোক ভাল নয় এটা উমাও বুঝতে পেরেছে, কিন্তু তবু তার দিকটাও কি ভেবে দেখা উচিত ছিল না ওঁর। উমা ত নিজেই অনুতপ্ত।

তাই বলে

রাসমণির একটা কথা ওকে সব চেয়ে আঘাত করেছে, ‘এখন বুঝতে পারছি তোকে শ্বশুরবাড়িতেই পাঠানো উচিত ছিল। ঐ দজ্জাল শাশুড়ীর হাতে মার খেয়ে গতর চূর্ণ হওয়াই দরকার ছিল তোর। তবে টিট্ থাকতিস। লাথির ঢেঁকি কি চড়ে ওঠে!….’

সে কি এমনই মন্দ, এমনই অসৎ যে তার জন্য ঐ শাস্তি ঈশ্বরনির্দিষ্ট! ঐ তার যথার্থ স্থান! তার চেয়ে তার মরাই ভাল।

জ্বালা থেমে এক সময় চোখে বর্ষা নামে। ভাগ্যের এই উপায়হীন প্রতিকারহীন অবিচারের বিরুদ্ধে মনটা মাথা কুটে কুটে এক সময় যেন শান্তিতেই ভেঙে পড়ে। মনের সব বেদনা অশ্রুর আকারে ধারায় ধারায় ঝড়ে পড়ে উপাধান সিক্ত করে। তবু উমার মরা হয় না। জীবনকে সে ত্যাগ করতে পারে না।

তার হেমের কথা মনে পড়ে যায়। শ্যামা যদি খোকাটাকেও রেখে যেত! কি নিয়ে সে বাঁচবে? কি নিয়ে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *