১৪. আটদিনের দিন জোড়ে এসে

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

কথা ছিল মহাশ্বেতা আটদিনের দিন জোড়ে এসে এক বছর থাকবে। এ-ই নিয়ম। এই এক বছরে জামাই আসতে পারে কিন্তু মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে না। এ অঞ্চলের এই প্রথা, তাছাড়া মহাশ্বেতা একেবারেই ছেলে-মানুষ এক বছরের বেশি থাকলেও ক্ষতি নেই। কিন্তু মহাশ্বেতার শাশুড়ী ক্ষীরোদা এক অদ্ভুত প্রস্তাব ক’রে পাঠালেন। তিনি নাকি কোন্ টোলে মত নিয়েছেন, বিয়ের আটদিনের মধ্যে মেয়ে-জামাই যদি বাপের বাড়ি আসে আর সদ্য ফিরে যায়– তাকে নাকি বলে ‘ধূলো পায়ে দিন’– তাহ’লে আর এক বছর বাপের বাড়ি থাকার দরকার নেই; ক্ষীরোদার ইচ্ছা মহাশ্বেতাকে তিনি মধ্যে মধ্যে নিয়ে যাবেন। দু-এক মাস ক’রে অবশ্যই বাপের বাড়ি থাকবে– কিন্তু তাঁরও ত একটি হাতনুড়কুৎ দরকার– একেবারে টানা এক বছর বাপের বাড়ি ফেলে রাখতে পারবেন না।

শ্যামার মুখ শুকিয়ে উঠল। তার দুধের মেয়ে, আর ঐ সাজোয়ান জামাই এখন থেকে শ্বশুরবাড়ি থাকবে কি! শ্বশুরবাড়ির ত ঐ ছিরি। হেমকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে শ্যামা মেয়ের শ্বশুরবাড়ির যে চিত্র পেয়েছে তাতে তার ঐ সাত বছরের মেয়ে শ্বশুরবাড়ি আছে ভাবলেই বুকের মধ্যে কেমন করে যেন।

কিন্তু বিয়ে হ’লেই মেয়ে পর। তার ওপর আর জোর কি?

অগত্যা শ্যামা মঙ্গলার শরণাপন্ন হয়।

‘কী হবে মা! ওরা যে এখন থেকেই মেয়ে আটকাতে চায়!’

মঙ্গলা একটুখানি চুপ ক’রে থেকে বলেন, ‘শুনেছি আজকাল এরকম হচ্ছে। ধূলো পায়ে দিন ক’রে নিচ্ছে কেউ কেউ। তার আর কি করবি বল্! জোর ত আর নেই, বরং এর পর টেনেটুনে দু মাসের জায়গায় তিন মাস ক’রে আটকে রাখা যাবে। ওখানে নিয়ে গেলে আবার দু’ মাস পরেই ফিরিয়ে আনবি ‘খন।

কিন্তু এটুকু মেয়ে এখন থেকে শ্বশুরবাড়ি থাকলে শুকিয়ে উঠবে যে। তারপর যা ভারিক্কি জামাই, মেয়ে হয়ত ভয়ে দবববকে দব্‌কে সারা হয়ে যাবে।

‘ঐটুকু মেয়ে ঢের অমন শ্বশুরঘর করছে– তার জন্যে কিছু নয়। আর জামাইয়ের কথা যদি বললি এক বছর তোর কাছে থাকলেই কিছু তোর মেয়ে একেবারে লায়েক হয়ে উঠবে না। তারপর ত ঐখানে পাঠাতে হবে, তখন কি করবি? তাছাড়া তোর একটা পেট ত বাঁচল!’

অগত্যা শ্যামাকে চুপ ক’রে যেতে হয়।

জামাই অভয়পদ কিন্তু খুব ভদ্র। বিয়ের দিন অত বুঝতে পারে নি শ্যামা। কিন্তু যেদিন ওরা ধূলো পায়ে দিন করতে এল আর যেদিন জোড়ে এল, দু’দিনই ভাল ক’রে ওকে লক্ষ্য করে দেখে শ্যামা আশ্বস্ত হ’ল। বলতে গেলে জামাই আর সে একবয়সী কাজেই খোলাখুলি কথা কইতে তার লজ্জা করে কোন মতে মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে সে সামনে আসে, নেহাত খাবার সময় দু একটা অনুরোধ করতে হয় করে কতকটা নৈর্ব্যক্তিক ভাবে, চাপা গলায় ফিস ফিস ক’রে, কিন্তু হেম এবং মঙ্গলার সঙ্গে যখন কথা বলে অভয় তখন উৎকর্ণ হয়ে শোনে সে। না, কথাবার্তা বেশ ভাল। শুধু মিষ্টি নয়, বেশ জ্ঞানবান বা বুদ্ধিমানের মতই কথা। এই বয়সে বরং এতটা জ্ঞান ও জগৎ সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা কেমন ক’রে হ’ল তাই ভেবেই শ্যামার একটু অবাক লাগল। অবশ্য কারণটা সে অনুমান করতে পারে–নিতান্ত বালক বয়সে সংসারের ভার মাথায় এসে পড়েছে, সংসারের বিদ্যালয়ে সর্বাপেক্ষা কঠিন এবং নির্মম গুরুমশায় বাস্তবের কাছেই পাঠ নিতে হয়েছে তাকে; তাই বোধ হয় বয়সের অনুপাতে ঢের বেশি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে সে। বয়স্ক লোকের বোঝা বইতে বইতে কিশোর দেহের মধ্যেকার মানুষটা কখন বয়স্ক ও প্রবীণ হয়েছে তা বোধ হয় বেচারী নিজেও টের পায় নি। শ্যামার মায়া হয় এই অকালপক্ক তরুণটির উপর। আহা, এই ত ওর আমোদ-আহ্লাদের বয়স, এখনই কি আর এমন বুড়িয়ে পেকে যাবার কথা ওর!

অভয়পদর আচরণও একটু অদ্ভুত!

জলখাবার, ভাত, যা তাকে সাজিয়ে দেওয়া যাক না কেন, শ্যামা লক্ষ্য ক’রে দেখে, ঠিক অর্ধেকটা খেয়ে অর্ধেকটা রেখে দেয়া পাতে। জলখাবারের একটা রসগোল্লা দিলে ভেঙে আধখানা খায়। ভাত থেকে শুরু ক’রে মাছ পর্যন্ত সবই যেন মেপে আধাআধি খেয়ে ওঠে। প্রথমটা অত বুঝতে পারে নি শ্যামা কিন্তু পরে বুঝেছিল যে এটা সে ইচ্ছা ক’রেই রাখে মহাশ্বেতার জন্য। শ্বশুরবাড়ির পুরো পরিচয় না পেলেও বহুদর্শী অভয়পদ এক নজরে আন্দাজ ক’রে নিয়েছিল, সে জানত এতগুলি লোকের জন্য সমান আয়োজন করা এখানে সম্ভব নয় যা তাকে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে তা শুধু তার জন্যই সংগৃহীত। ওর খাওয়া হ’লে মহাশ্বেতাই সে পাতে বসবে নিশ্চয় সুতরাং বালিকা বধুর প্রতি মমত্ববশত সে সব জিনিসেরই চুলচেরা ভাগ রেখে যেত।

এ আচরণ অভয়পদ চিরকাল বজায় রেখেছিল। কোন অনুরোধ বা অনুযোগেই তাকে টলানো যায় নি কখনও। শেষে হাল ছেড়ে দিয়েছিল শ্যামা। বরং সম্ভব হ’লে বেশি ক’রেই ওর পাতে সাজিয়ে দিত- যাতে অর্ধেক রাখলেও একজনের মত যথেষ্ট হয়।

মহাশ্বেতা প্রথম প্রথম অবশ্যই পুলকিত হত। শ্যামা কিন্তু সবটাই তাকে ভোগ করতে দিত না হেমকেও ভাগ ক’রে দিত ভাল ভাল খাবারগুলো। তাতে মহাশ্বেতার খুব বিশেষ আপত্তি ছিল না। একটা দাদা ত! তাকে দিয়েও যা পেত তা যে তার কল্পনারও অগোচর!

2

প্রথম দিন, ধূলো পায়ে দিন করতে যেদিন আসে ওরা, আকণ্ঠ খেয়ে উঠে মহাশ্বেতা বলেই ফেলেছিল, ‘যাই বলো বাপু, মানুষটা কিন্তু মন্দ নয়!

কলকাতার কাছেই-১০

১৪৫

সত্যিই প্রথমটা বুঝতে পারে নি শ্যামা, প্রশ্ন করেছিল, ‘কে রে, কার কথা বলছিস?’

‘আবার কে! ঐ বরটার কথা বলছি!’

মহাশ্বেতার মুখ লাল হয়নি। কিন্তু শ্যামার কপালে ও গালে কে সিঁদুর ঢেলে দিয়েছিল

সে কি শুধু লজ্জায়? না

―co

সুখেও। নিজের নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ ক’রে

এ কঁটা দিন সে আশঙ্কায় কণ্টকিত হয়ে ছিল। আজ অভয়পদকে ভাল ক’রে দেখে এবং মেয়ের কথা শুনে সুখেই তার চোখে জল এসে গেল।

নিশ্চিন্ত হ’ল সে। মানুষের হাতে পড়েছে, জন্তুর হাতে নয়। এখন মেয়ে যত দুঃখই পাক ওর তাতে কোন ক্ষোভ নেই।

প্রথম দিকে ওরা চলে যাবার সময় হেম গিয়েছিল এগিয়ে দিতে। মল্লিকদের বাগান ছাড়িয়ে চখন্ডীদের বাড়ি পর্যন্ত গিয়ে পাকা রাস্তায় তুলে দিয়ে হেম যখন ফিরে এল তখন তার হাতে চক্‌চক্‌ করছে একটা রূপোর টাকা।

‘এ কি রে, কোথায় পেলি!’ শ্যামা সচকিত হয়ে প্রশ্ন করে।

হেম উজ্জ্বলমুখে টাকাটা মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বললে, ‘জামাই দিলে মা। আমি কিছুতেই নেবো না, সেও ছাড়বে না। বলে, সন্দেশ কিনে খেও। আর মহাটা কি পাজী জানো মা, আমাকে কানে কানে বলে কিনা দিচ্ছে, নে না! আবার যেদিন জোড়ে আসবে, সেদিন খরচা নেই? এমন লজ্জা করছিল আমার শুনে!’

লজ্জার কথাই বটে, তবে কথাটা সত্যিই। শ্যামার দুর্ভাবনার শেষ ছিল না সেদিনের কথা মনে ক’রে। বিয়ে দিতেই তার হাত নিঃশেষ হয়ে গেছে। কোথাও থেকে যে কিছু পাওয়া যাবে সে সম্ভাবনাও নেই। নরেন সবে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি ফিরলেও দু মাস। এক ভরসা ওর নারকেল পাতা তাও এই গোলমালে কদিন হাত দেওয়া যায় নি, খুব খাটলেও চার-পাঁচ আনা পয়সা আসবে। তারপর?

এই তারপরের প্রশ্নটাতেই যখন বুকের রক্ত হিম হয়ে আসছিল তখন যেন দেবতার আশীর্বাদের মত টাকাটা এসে পড়ল।

জামাই দীর্ঘজীবী হোক। মহাশ্বেতা সুখী হোক। হে মা মঙ্গলচন্ডী, এতদিনে কি একটু মুখ তুলে চাইলে মা?

মঙ্গলচন্ডীকে প্রণাম করতে গিয়ে মঙ্গলার কথাও মনে পড়ল। ভাগ্যিস্ তখন বয়সের কথা শুনে ইতস্তত করে নি! মঙ্গলার কাছে তার ঋণ শোধ হবার নয়।

দুই

শ্বশুরবাড়ির দারিদ্র্যের চেহারাটা বিয়ের আটদিন ভাল নজরে পড়ে নি মহাশ্বেতার। বাঙালী মধ্যবিত্ত ঘরে ধারদেনা ক’রেই হোক আর ভিক্ষে চেয়েই হোক– বিবাহ প্রভৃতি সামাজিক ব্যাপারে এক রকমের কৃত্রিম প্রাচুর্য সৃষ্টি করা হয়, তাতে ক’রে গৃহস্থের ঠিক অবস্থাটা টাওর করা শক্ত হয়ে ওঠে। বরং অবস্থাপন্ন ঘরে কৃপণতা দেখা যায় কোথাও

১৪৬

অভয়পদর মত ভাত হয় ছোট ভিজেলে ক’রে পাতার জ্বালে। তারপরই ক্ষীরোদা বেরিয়ে পড়েন পাড়ায়। কার পাদাড়ে ডুমুর হয়েছে, কোথায় দুটো ডাঁটা, কারও বাড়ি গিয়ে গোটাকতক আমড়া, কোথাও বাঁ একফালি থোড় এই সংগ্রহ ক’রে ফেরেন একেবারে আটটা নাগাদ। তারপর হাঁড়ি ক’রে ডাল চাপে।মহাশ্বেতা এসে পর্যন্ত দেখেছে একই ডাল অড়র। একদিন শাশুড়ীকে সে বলেই ফেলেছিল, ‘হ্যাঁ মা, রোজ অড়র ডাল রাঁধেন কেন?’ তাতে শাশুড়ী উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ও মা, তা জানো না, অড়র ডাল যে পোষ্টাই খুব! সায়েবরা পর্যন্ত খায়!’

কিন্তু পরে মহাশ্বেতা শুনেছিল কথাটা তা নয়। ওর সমবয়সী ননদ বুড়ী একদিন খুব অন্তরঙ্গতার অবসরে ব’লে ফেলেছিল, ‘হ্যাঁ, পোষ্টাই না ছাই! আসলে সস্তা। দাদা কোথা থেকে অড়র ডাল আনে –পোস্তা না কোথা থেকে চার পয়সা সের। ঐ ক্ষুদি ক্ষুদি ডাল– ও আবার পোষ্টাই! কুণ্ডুবাড়ি অড়র ডাল আসে এই এত বড় বড় দানা! তা ওদের ওখানে ও ডাল খায় শুধু খোট্টা দারোয়ানেরা!’

ঐ ডাল আর একটা চচ্চড়ি, সকাল বিকেল একই অবস্থা। কোনদিন আমড়া কি কাঁচা তেঁতুল কোথাও থেকে পাওয়া গেলে বড়জোর একটু অম্বল কিংবা টক দিয়ে ডাল। তাও অম্বলে মিষ্টি পড়ত না– তাতে নাকি অসুখ করে।

শুধু ডাল চস্তড়ি দিয়ে খেতে মহাশ্বেতার আপত্তি হবার কথা নয়। যদি সেটাও ভালভাবে পেত সে। প্রতিদিনই দেখত যে পুই ডাঁটা বা কুমড়ো ডাঁটার (এই দুটো শাক ওদের উঠোনেই হয়েছিল অপর্যাপ্ত) সঙ্গে গাঁ থেকে ডুমুর থোর বা কাঁচকলা যেদিন যা যোগাড় হ’ত, চচ্চড়ির –চেঁচে নিয়ে পুরুষদের এবং ছোট ননদের পাতে দেওয়া হ’ত, ওদের শাশুড়ী-বৌয়ের জন্য অবশিষ্ট থাকত শুধু ডাঁটার অংশটুকু। যেদিন সাজনে ডাঁটা পাওয়া যেত সেদিনটা মহাশ্বেতার কাছে উৎসবের দিন, কিন্তু সে কদাচিৎ কখনও। জলের মত ডাল মেখে শুধু পুইডাঁটা দিয়ে ভাত খেতে এক-একদিন মহাশ্বেতার চোখে জল এসে যেত। শাশুড়ীও অবশ্য তাই খেতেন, কিন্তু তাতে সান্ত্বনা

পেত না সে।

একদিন সে প্রশ্ন করেছিল, ‘হ্যাঁ মা, আমাদের বাজার হয় না কেন?’

চকিতে ক্ষীরোদার মুখ রাঙা হয়ে উঠেছিল, ‘হয় বৈ কি মা। তবে কি জানো, চলে যায়, পাঁচজনে ভালবাসে, এটা ওটা দেয়– তাই আর আমার অভয়পদ গা করে না তেমন!’

সব চেয়ে মুশকিল, স্বামীকে কাছে পায় না মহাশ্বেতা। এবার শ্বশুরবাড়ি আসার পর দেখছে শোবার ব্যবস্থা অন্য রকম হয়েছে, বড় ঘরে সে, তার ছোট দেওর, ননদ এবং শাশুড়ী শোয় ভাঙা ঘরে বাকী দু ভাই। সে একটু ক্ষুণ্নই হয়েছিল এতে, শ্বশুরবাড়ির মধ্যে তার বর লোকটিই যে সব চেয়ে ভাল, আর যা কিছু তার মনের কথা একমাত্র ঐ লোকটিকেই নির্বিচারে বলা চলে এ কথাটা কেমন ক’রে মহাশ্বেতা যেন নিজে নিজেই বুঝেছিল। কিন্তু উপায় কি? এ কথা ত মুখ ফুটে বলা যায় না যে সে বরের কাছেই শুতে চায়। বিশেষত শাশুড়ী বলেই দিয়েছিলেন যে, ‘এখন তুমি বড্ড ছেলেমানুষ বৌমা, তুমি দিনকতক আমার কাছে শোও। নইলে হয় ত ভয়-টয় পাবে

38b

বোধ হয় সম্পন্ন অবস্থা বলেই সেটা দেখাতে সাহস করেন তাঁরা– দরিদ্রের সংসারে, যেখানে যত অভাব, সেখানে তত সচ্ছলতা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগেন কর্মকর্তারা।

অভয়পদর বাড়িতেও তার অন্যথা হয় নি। পণের একান্ন টাকা ছাড়াও অভয়পদ তার বহু কষ্টের সঞ্চিত ষাটটি টাকা তুলে এনে দিয়েছিল তা ছাড়াও কিছু ধার করতে হয়েছে। সংসার চালাতে হবে এবং দেনা শোধ করতে হবে, সবই ঐ উনিশ টাকা ছ’ আনা মাইনের মধ্যে। সুতরাং বধূর সামনেও কোন ছদ্ম-সম্ভ্রম রাখা সম্ভব নয়। মহাশ্বেতা যখন দু’মাস পরে আবার ঘর করতে এল তখন বাইরের কৃত্রিম আবরণ শুধু নয় যেন মাংস আর চামড়াও খসে পড়েছে! বেরিয়ে এসেছে কঙ্কালটা!

অভয়পদর অফিস নাকি হাওড়ার পোলের কাছে কোথায়। কারখানার চাকরি আটটায় হাজ্বরে। সুতরাং সে ছটার মধ্যেই ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। পাকা আড়াই ক্রোশ পথ হেঁটে বড় রাস্তায় পৌঁছলে, সেটা যদি সওয়া সাতটার মধ্যে পৌঁছনো যায় ত, বাকী দেড় ক্রোশের প্রায়ই একটা সুব্যবস্থা হয়– অর্থাৎ অফিসের সাহেবদের গাড়ি যায় অনেকগুলো সেই দিক দিয়ে– কেউ কেউ দয়াপরবশ হয়ে কোচম্যানের পাশে তুলে নেন ওকে, নইলে সেটাও পায়ে হেঁটে সারতে হয়। ফেরবার সময়ও অবশ্যই একই ব্যবস্থা।

যাই হোক––আগের রাত্রের বাসি ডাল তরকারির সঙ্গে গরম ভাত দিয়ে আহারপর্ব সারতে হয় অভয়পদকে। যেদিন তা থাকে না, সেদিন বড়জোড় একটু ডালভাতে দিয়ে আগাগোড়া ভাত খেয়ে ওঠে। এর বেশি ক্ষীরোদা পেরে ওঠেন না। ওঠেন তিনি রোজই রাত চারটেয় কিন্তু বাসি পাট সেরে চান ক’রে ভাত চড়াতে চড়াতে কোথা দিয়ে পাঁচটা বেজে যায় বুঝে উঠতে পারেন না। শুধু যেদিন বাসি ডাল তরকারি কোন কারণে থাকে না সেদিন একটু হা-হতাশ করেন ‘আহা রে নির্লখ্যে একটু ডালভাতে দিয়ে কি ক’রেই বা খাবি, তাই ত! ঘরেও কিছু নেই, ঐ জন্যে বলি একটা দুটো আলু অন্তত এনে রাখিস্– এই সময় একটা আলু থাকলে কত সুবিধে হ’ত!’

বলা বাহুল্য, অভয়পদ কোনদিনই এসব কথার কোন উত্তর দেয় না। খাওয়া নিয়ে সে কোন আলোচনাই করে না কারও সঙ্গে। এমন কি ডালে নুন না হলেও বলে না, বা চেয়ে নেয় না, ভুলে ডবল নুন পড়লেও কোন অনুযোগ ক’রে না। রাত্রে সে-ই সর্বাগ্রে খায় কিন্তু তাকে খাইয়ে কোন ভরসা পান না ক্ষীরোদা। আগে আগে তিনি অভিযোগ করতেন, ‘তুই কি রে, তখন বললে ত আবার নুন দিয়ে ফুটিয়ে নিতে পারতুম!’ কিন্তু তাতে অভয়পদর মুখের প্রশান্তি বা নীরবতা নষ্ট হ’ত না, খুব বাড়াবাড়ি হ’লে জবাব দিত, ‘কি দরকার! যে রেঁধেছে সেও ত খাবে। তখনই বুঝবে।’

‘তা তোর মুখে কি সাড় লাগে না? তুই খাস কি ক’রে?’

‘খাই যখন, তখন অসুবিধে হয় না বুঝতে হবে এর বেশি কথা সে বলে না কোনদিনই।

প্রাণীর বহু

Fire ১৪৭

অড়র ডাল ঘন খেলে এমন কি লজ্জার কথা আছে তা ভেবে পায় না মহাশ্বেতা। খেতে ত সেইটেই ভাল লাগে। তবু মনে মনে আরও একবার প্রতিজ্ঞা করে যে, খাওয়ার কথা আর কখনও তুলবে না। বাপের বাড়িতে দুবেলা ভাত জোটাই ত তার স্বপ্নের অগোচর ছিল বলতে গেলে। দুটো ভাত যে খেতে পাচ্ছে পেট পুরে, এই ঢের।

বয়স অল্প হ’লেও অভাব ও দারিদ্র্য অনেক বেশি পাকিয়ে দিয়েছে মহাশ্বেতাকে, সে বেশ ভারিক্কী লোকের মতই নিজেকে বোঝাতে বসে মধ্যে মধ্যে।

কিন্তু তার কান্না পায় একটা ব্যাপারে। ওর দেওর ননদরা রোজই আগে খায়- যার পাতে যা কিছু পড়ে থাকবে শাশুড়ী একটা বাটি করে জড়ো ক’রে তুলে রাখবেন আর তাকে দেবেন সেইগুলো খেতে। ডাল তরকারি মাখা ভাত ছড়িয়ে বিছড়ে খায় ওরা, বিশেষত ছোট দেওর দুর্গাপদর ত সর্বদাই সর্দি লেগে আছে, তার খাওয়ার দৃশ্য মনে হ’লেই বমি আসে মহাশ্বেতার- আর সে-ই ঠিক রোজ এতগুলো ক’রে ভাত চেয়ে নিয়ে খানিকটা পাতে ফেলে রেখে উঠবে। তাই কি তরকারি একটু রেখে যাবে? কোনদিনও না, তার বেলা সেয়ানা ছেলে, ঠিক চেটেপুটে খেয়ে যায়! শুধু শুধু ডালমাখা ভাতগুলো– মাগো, সাত পাতের ঐ কুড়োনো ঠান্ডা ভাত–! এক-একদিন আড়ালে মাথা কুটত মহাশ্বেতা, আর কাঁদত ডাক ছেড়ে। কোন কোন দিন রেগে আঙুল মটকে গালাগালও দিত, ‘মর্, মর্ আঁটকুড়ো, চোখখেগো! মর্! এত লোকের ওলাউঠো হয়,

তোর হয় না?

সরকার বাড়ির পুকুরে চান করতে এসে পোদেদের গিন্নী ঠিক এই ভাষাতেই গালাগাল দিতেন তার দেওরদের। হুবহু সেইটেই মনে আছে মহাশ্বেতার।

এক-একদিন কাজের সময় বায়না ধরে কাঁদত যখন দুর্গাপদ তখন ক্ষীরোদা বলতেন, ‘একটু ভোলাও ত বৌমা–থাক থাক, কোলে করতে যেও না, এমনি হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ভোলাও একটু।’

সেই ছিল মহাশ্বেতার সুযোগ। প্রাণ ভরে অন্তর-টিপুনী দিত এক একদিন। তার ফলে ডাক ছেড়ে যখন কেঁদে উঠত সে, তখন আপনমনে দাঁতে দাঁত চেপে বলত, ‘রাক্কোস ছেলে! মর্ মর্ তুই, মরিস্ ত আমার হাড় জুড়োয়!’ আর প্রকাশ্যে চেঁচিয়ে শাশুড়ীকে ডাকত, ‘ও মা, আসুন না একবার’ কিছুতেই থামছে না যে।’

তিন

মহার শ্বশুরবাড়িতে বিগ্রহ আছেন রাধা-দামোদর –সে কথাটা বিয়ের সময় অত ভাল ক’রে বুঝতে পারে নি সে। একটা ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে প্রণাম করানো হয়েছিল এই মাত্র ছোট্ট অন্ধকার ঘরে নিচু বেদীর ওপর ন্যাড়াবঁচো দুটি মূর্তি, কেষ্টটি পাথরের, রাধিকা পেতলের (বা অষ্টধাতুর সামনে একটি সিংহাসনে একটা শালগ্রাম আর একটি ছোট্ট পাথরের শিব। স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে অসংখ্য আরশোলা বেড়াচ্ছে, কেমন একটা ড্যাপস্যা গন্ধ মোট কথা মহাশ্বেতার আদৌ

~ 380

হাসি পেয়েছিল মহাশ্বেতার কথাগুলো শুনে। প্রথম আটদিন ভয় পেলো না

এখন পুরোনো শ্বশুরবাড়ি ভয় করবে?

ওরই মধ্যে একদিন এক ফাঁকে

সেটা বোধ হয় রবিবার

বলে ফেলেছিল সে

অভয়পদকে নির্জনে পেয়ে, ‘একদিন পটল এনো না। বড্ড পটল খেতে ইচ্ছে করে। বেশি করে এনো কিন্তু, নইলে আমার আর মার অদৃষ্টে জুটবে না।’

অভয়পদ বলেছিল, ‘তা আনবো। কিন্তু তুমি আর মাকে বাজারের কথা বলো না। আমাদের অভাবের সংসার বাজার-হাট ক’রে আনতে গেলে কি চলে? চেয়ে-চিত্তে সংসারটা চলে গেলেই হ’ল। মিছিমিছি মা লজ্জা পান।’

অপ্রতিভ হয়ে গিয়েছিল মহাশ্বেতা সেই বয়সেই। ‘আর কখনও বলব না’ বলে প্রায় ছুটে পালিয়েছিল।

পরের দিনই সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ঢুকল অভয়পদ গামছায় পুঁটুলি ক’রে একরাশ পটল নিয়ে। মার সামনে নামিয়ে দিয়ে বললে, ‘পোস্তার দিকে একটু দরকার ছিল আজ– পেয়ে গেলুম এক পয়সায় এতগুলো পটল তাই নিয়ে এলুম।

কিন্তু সে পটলের চেহারা দেখে হাসবে কি কাঁদবে মহাশ্বেতা ভেবে পায় না। যত রাজ্যের হলদে পাকা পটল– কতক কতক হাজাও আছে। কোন কোনটা ভাঙা দুখানা করা।

সেদিন রাত্রে সেই সব পটলের মধ্যে বেছে যেগুলো আর এক রাতও থাকবে না সেইগুলো পোড়ানো হ’ল। সেই পোড়া পটলই রাত্রের একমাত্র ভরসা। শাশুড়ী রাতে ভাত খান না, মুড়ি খান– তিনিও পটল পোড়া দিয়ে মুড়ি খেলেন। ভারি খুশী, বললেন, ‘পাকা পটল কেমন মিষ্টি লাগে দেখেছ বৌমা? আমি খুব ভালবাসি পাকাপ টল পোড়া খেতে!’

মহাশ্বেতার আদৌ ভাল লাগল না এসব। পটল সে দিদিমার বাড়ি খেয়েছে, ভাজা কিংবা ঝোল কি আলু-পটলের ডালনা! এ কী ছাই!… বার বার নিজের মনে মনে বলতে লাগল, এই শেষ! ঐ ছিষ্টিছাড়া মানুষটাকে যদি সে আর কোনদিন কিছু বলে! তার খুব শিক্ষা হয়েছে!

মহাশ্বেতা একদিন শাশুড়ীকে খেতে খেতে বলে ফেলেছিল, ‘আচ্ছা মা, আপনি এত পাতলা ডাল রাঁধেন কেন? আমার দিদিমা অড়র ডাল কি ছোলার ডাল রাঁধে এই চাপ-চাপ! ঠান্ডা হয়ে গেল তাতে সর পড়ে ফেটে যায়। সেই ত বেশ!’

তাতে এমন হেসেছিল ক্ষীরোদা যে মহাশ্বেতার লজ্জার শেষ ছিল না। এই দ্যাখো কান্ড, সে আবার কী বলতে কী বলে ফেলেছে বোধ হয়! বর আবার না তাকে আড়ালে পেয়ে গম্ভীর মুখে শাসন করে!

ক্ষীরোদা বলেছিলেন, ‘ও মা! অড়র ডাল আবার চাপ চাপ? শুনলে লোকে হাসবে

যে! যা বলেছ বলেছ আমার কাছে বলেছ

না অমন কথা।

যার কারুর সাক্ষাতে যেন ব’লে ফেলো

བ་གནས་ས་ཁ་གས་པ་ ། །

189

‘হুঁ’, গম্ভীর হয়ে বলে অভয়পদ, ‘ফরমাশ ত বেশ লম্বা-চওড়া দেখতে পাচ্ছি। মাসে একটা টাকাও বাড়তি থাকে না। আজ দু’মাস ওভারটাইম বন্ধ। কিনব কোথা থেকে? জানো এখনও বিয়ের দেনা শোধ হয় নি?’

মুখ ম্লান হয়ে যায় মহাশ্বেতার। কেন যে মরতে এসব ফরমাশ করতে যায় সে বরকে! প্রতিবারেই এমনি কথা শুনতে হয়, এমনি অপমান! ছিঃ ছিঃ আবারও সে প্রতিজ্ঞা করলে

আর কোনদিন কিছু বলবে না।

কিন্তু সেই রবিবারই দেখা গেল অভয়পদ বাগানের এক কোণে জড়ো ক’রে রাখা কতকগুলো কাঠা নিয়ে বসে গেছে সকাল থেকে। যন্ত্রপাতি সব ওর কাছেই থাকে বোধ হয় অন্তত মহাশ্বেতার তাই মনে হ’ল, কৈ, কোথাও থেকে চেয়ে নিয়ে এল ব’লে ত মনে হ’ল না সে যাই হোক সন্ধ্যা-নাগাদ দেখলে বেশ উঁচু গোছের একটা সিংহাসন তৈরি হয়ে গেল। বা রে! মনে ভাবে মহাশ্বেতা, লোকটা ত কারিগর মন্দ না!

প্রথমটা ওর খুব আনন্দ হয়েছিল। ওর একটা সামান্য শখও সে ম’নে করে রেখেছে আর সেটা মেটাবার জন্যে এত মেহনত করছে! কিন্তু তারপরই ভয়ে বুক দুরদুর করতে লাগল। যদি বলে দেয় লোকটা? মাকে যদি বলে, ‘তোমার বৌ ফরমাশ করেছিল তাই করলুম!’ ও মা, সে কি ঘেন্নার কথা হবে! মা-ই বা কি মনে করলেন, ভাববেন হয়ত বৌ তাঁর ছেলের সঙ্গে অমনিই রোজ রোজ লুকিয়ে কথা কয়, আবার এরই মধ্যে ফরমাশ করতে শুরু করেছে। হে মা কালী, বলে না ফেলে কথাটা!

লোকটা কিন্তু খুবই ভাল। ক্ষীরোদা যখন প্রশ্ন করলেন, ‘হ্যাঁ রে, কী করছিস্ রে সারাদিন ধরে?’ তখন বেশ সহজ ভাবেই বলে, ‘পূর্ণিমে থেকে ত ঠাকুর আসছেন ঘরে তাই ভাবছি একটা বেশ উঁচু দেখে ভাল সিংহাসন তৈরি করি। দেখি –কতদূর কি হয়।

সন্ধ্যাবেলা কাজ শেষ হয়ে গেলে অভয়পদ মাকে ডেকেই দেখাল, ‘দ্যাখো দিকি মা কেমন হয়েছে?’

মা একটু খুঁতখুঁত করে বললেন, ‘হয়েছে ত ভালই। তবে ঠাকুরের সিংহাসন, পুরোনো কাঠে করলি, ওতে দোষ হবে না ত?’

‘হ্যাঁ—- তুমিও যেমন! চেঁচে-ছুলে দিয়েছি, তাছাড়া জিনিসটা ত নতুন তৈরি হ’ল। কাঠে দোষ কি?

কিন্তু ঠাকুর যখন সত্যি-সত্যিই ওদের দিকের দরজা খুললেন তখন মহাশ্বেতা বুঝলে যে ঠাকুরসেবাটা আর যাই হোক, পুতুলখেলা নয়। হাজারো রকমের কাজ আর ঝঞ্ঝাট। পূজোর কোন আয়োজন নেই কিন্তু অনুষ্ঠান আছে। মাটির বাসী হাঁড়ির ভাত চলবে না। প্রতিদিন মাজা পেতলের হাঁড়িতে ভাত রান্না হয়– ভাতের উপকরণ যাই থাকে, বামুনবাড়ির ঠাকুর, অন্নভোগ দিতেই হবে। তাছাড়া ভোগ দেওয়াই বা কি হবে? সকালে দুখানা বাতাসা ছাড়া কিছুই থাকে না– পাড়ার লোক কেউ শশাটা পেয়ারাটা দিয়ে গেলে কিংবা কোন মানসিকের পূজো দিতে এলে তবে ঠাকুর নৈবেদ্যের মুখ দেখতেন। পর্বদিনে পাড়া থেকে পূজো আসত বিস্তর– তেমনি তা বিলোতেও হ’ত লাভের মধ্যে খাটুনির সীমা থাকত না। ভোগও ত ডাল ভাত আর চচ্চড়ি, কোনদিন

ভক্তি হয় নি সে ঠাকুর দেখে। দিদিমার সঙ্গে গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে আনন্দময়ীতলায় ঠাকুর দেখেছে, বাগবাজারের মদনমোহন দেখেছে দক্ষিণেশ্বরে একবার গিয়েছিল, সে সব কেমন ঠাকুর! কি জাঁকজমক, কত গয়নাগাঁটি, ফুলচন্দনের গন্ধ! এমন কি, ওদের সরকারবাড়ির ঠাকুরঘরও কেমন আলাদা মন্দিরের মত, কত উঁচু! আর এ কি বিশ্রী!

কিন্তু সে যাই হোক

এ ঠাকুর যে ওদেরই তা তখন বুঝতে পারে নি। একেবারে

বুঝতে পারলে মাস আষ্টেক পরে যখন শুনল যে আসছে মাস থেকে ঠাকুরের পালা পড়বে তাদের।

‘তার মানে কি মা?’ প্রশ্ন করেছিল মহাশ্বেতা।

ক্ষীরোদা বুঝিয়ে দিয়েছিন, ‘তোমার শ্বশুররা খুড়তুতো জেঠতুতো ধরে তিন ভাই ঠাকুর হ’ল গে আমার দাদাশ্বশুরের তা এ বংশের সকলকারই ত সেবা করার কথা। মরে হেজে গিয়ে এখন এই তিন ঘরে ঠেকেছে –তাই পালা ক’রে ক’রে এক এক বছর সেবা করা হয়। এ বছরটা ছিল আমার ভাশুরের, এবার আমার পড়বে। আবার আমরা এক বছর সেবা করলে আমার দেওর আছেন একজন, তাঁদের ওপর ভারটা পড়বে। বুঝলে মা?’

‘তা সবাই মিলে একসঙ্গে করেন না কেন?

‘সে হয় না মা। তাহলে কেউ করত না–সবাই সরে থাকত, ফাঁকি দেবার চেষ্টা করত।

মহা ঠিক বোঝে না। ঠাকুরসেবা করা এ ত ভাগ্যের কথা,

এ আবার কি কথা

মাসিমার মুখে কতদিন শুনেছে

তাতে ফাঁকি দেয় নাকি কেউ!

তবু কথাটা শুনে ওর খুব আনন্দই হ’ল। ছেলেমানুষের মন

ঠাকুর-সেবার মধ্যে

পুতুলখেলার স্বাদটা পায়। সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করে, ‘কবে আসবেন মা ঠাকুর?’

‘আসবেন না ত ঐ ঘরেই থাকবেন। আমরা ঐখানে গিয়ে সেবা করব। ওদের দিকের দোরটা বন্ধ ক’রে রেখে আমাদের দিকের দোরটা খোলা হবে। ওই শুধু। দ্যাখো নি ও ঘরে তিনটে দরজা?

সে কিন্তু দিন গোণে। ঠাকুরের পালা তার হাতে এলে সে ঐ ঘর ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করবে। আরশুলাগুলোকে মারবে ধরে ধরে দু’বেলা ধুনো দিয়ে ভ্যাসা

গন্ধ নষ্ট করবে। আরও কত কি!

একদিন অভয়পদর অফিস যাবার সময় বুঝে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে বাগানে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একটা বুড়ো আমগাছের আড়ালে। অভয়পদ অত লক্ষ্য করে নি, হনহন ক’রে এগিয়ে যাচ্ছিল

মহাশ্বেতা ডাকলে, ‘শোন।’

অভয় ত অবাক! কাছে এসে একটু মুচকি হেসে বললে, ‘কি খবর গো, বলো বলো বেলা হয়ে গেছে, কিছু ফরমাশ আছে বুঝি? কী চাই এবার?’

বুঝলে? ঠাকুর অত

মহাশ্বেতা প্রায় মরিয়া হয়ে বলে উঠল, ‘আসছে মাস থেকে ত আমাদের ঠাকুরের পালা পড়বে একটা উঁচু দেখে কাঠের সিংহাসন কিনে এনো- নিচু হয়ে দেখতে হয় আমার বড্ড খারাপ লাগে।’

303

একটু পায়সও জুটত না। আধ-পো দুধ নেওয়া হ’ত রাত্রের শেতলের জন্যে– সেটুকু শাশুড়ী খেতেন। মহাশ্বেতা বলেছিল একদিন, ‘ঠাকুরের ভোগে যে পায়েস দিতে হয় শুনেছি মা?’ তাতে শাশুড়ী উত্তর দিয়েছিলেন, ‘ও মা, সে আমাদের নয়– আমাদের যে আত্মবৎ সেবা। নিজেরা যা খাবো তা-ই ঠাকুরকে দেব।’ মহাশ্বেতার একবার মনে হয়েছিল রাত্রের শেতলের কথা– ওরা ত আর রোজ দুধ খেত না, ভাতই খেত, তবে ঠাকুরকে তা দেওয়া হয় কেন? কিন্তু শেষ অবধি সাহসে কুলোয় না।

ঠাকুর আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর একটা উপসর্গ জুটল–গোরু। অভয়পদ কোথা থেকে একটা বড়-সড় বাছুর নিয়ে এল, এ নাকি বড় হয়ে বছর দেড়েকের মধ্যেই দুধ দেবে। দুধ দেবে কিনা মহাশ্বেতা জানে না, কিন্তু কাজ যা বাড়ল তাতে ওর চক্ষুস্থির! খড় কাটা, জাব দেওয়া, জল দেওয়া, গোয়ালকাড়া সবই করতে হয় তাকে। শাশুড়ী ঠাকুরঘর নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাঁর নিশ্বাস ফেলার সময় থাকে না তা মহাশ্বেতা নিজের চোখেই দেখে, সুতরাং তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না– রাগ ধরে ওর ননদের ওপর। ওরই বয়সী ননদ অন্তত শাশুড়ী তাই বলেন (মহার মনে হয় আরও বেশি বয়স) তবু সে কুটি ভেঙে দু’খানি করে না। শাশুড়ীও কিছু বলেন না ওকে—- সারাদিন পুতুল খেলে ঘুরে বেড়ায়। তার ওপর বৌদির নামে নালিশ করতে পারলে আর কিছু চায় না। একটু কিছু হ’লেই সুর তোলে, ‘ও-মা-দ্যা-খো-না-বৌ-দি–ইত্যাদি! হাড় জ্বলে যায় মহাশ্বেতার ওকে দেখলে। শাশুড়ীকে বললে বলেন, ‘তা বৌমা, ওর অত্যেচার একটু সইতে হবে বৈ কি! ননদ ত– তাছাড়া ওর কিই বা জ্ঞান- বুদ্ধি হয়েছে বলো!… র’সো না, পরের বাড়ি গেলেই জব্দ হয়ে যাবে।

অঘ্রাণ মাসে আর এক খাটুনি বাড়ল। কোথায় নাকি ওদের জমি আছে সরিকানা জমি, প্রতি বছর এই সময় তার দরুন ভাগের ধান এসে পড়ে। কমই আসে অন্য বছর, একই সঙ্গে চাল করিয়ে তোলা হয়। মাস-তিনেকের মত চাল হয়। এবার অন্য সরিকের ধানও সস্তায় কিনেছে অভয়পদ, তাছাড়া ধান হয়েছেও বেশি। সুতরাং বস্তা ক’রে ধানই ঘরে তোলা হ’ল। মাঝে মাঝে বার ক’রে সে ধান সেদ্ধ করতে হয়, নেড়ে-চেড়ে শুকোতে হয়, তারপর নিয়ে যেতে হয় ওদের জেঠশ্বশুরের ঢেঁকিশালে ভাঙাতে। তারপর আছে ঝেড়ে-বেছে তুষ-কুড়ো আলাদা করা। অসম্ভব খাটুনি।

এত খাটুনি অভ্যাস নেই, শরীরেও কুলোয় না। মাঝে মাঝে মহাশ্বেতার চোখে জল এসে যায়। ভাত খেয়ে উঠেই গোরুর কাজ সেরে ধান শুকিয়ে তুলে রেখে হয়ত আবার এসে শাশুড়ীর সঙ্গে ঘাটে বাসন মাজতে বসতে হয়। সে সময় আর চোখের জল বাধা মানে না, সকলের অজ্ঞাতেই আপনিই টপ্ টপ্ করে ঝরে পড়ে জলের ওপর। শাশুড়ীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে সে সে-সময়। কোন প্রতিকার ত হবেই না, মিছিমিছি নানা রকমের জবাবদিহি করা। হয়ত ছেলের কাছেই লাগাবেন। দুঃখ সে চেপেই থাকে প্ৰাণপণে।

এমন কি, মাকেও কখনও বলে না। তবে মধ্যে মধ্যে গিয়ে যখন পনরো কুড়িদিন বাপের বাড়ি থাকে তখন যেন মনে হয় জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়েছে সে। মা সঙ্কোচ

১৫৩

করে মেয়েকে আনতে মেয়ে এলেই জামাইকেও আনতে হয়, সে খরচ আছে, তাছাড়া আছে,তাছাড়া মেয়েকেও ভাল ক’রে খেতে দিতে পারে না। আর যাই হোক শ্বশুরবাড়ি পেট পুরে ত ভাত খেতে পায় দুবেলা। কিন্তু মহা অত বোঝে না, গলা জড়িয়ে ধরে মাকে বলে, ‘আমাকে একটু তাড়াতাড়ি এনো মা, তোমার কাছে না খেয়ে থাকলেও শান্তি।’

আগে আগে শ্যামা ভাবত যে এটা নিছক তার ওপর প্রীতি। কিন্তু তারপর খুঁটে খুঁটে কথার ছলে বোকা মেয়ের কাছ থেকে সব কথাই বার করে নেয় সে। কষ্ট হয় খুবই, তবু মনকে সান্ত্বনা দেয, গরীবের ঘরে জন্মেছে যখন তখন ত খাটতেই হবে। জামাই ভাল হয়েছে, এইটুকুই লাভ।

এক বছর পরে মহাশ্বেতার ভাগ্য একটু ফিরল। শোবার ব্যবস্থা পালটালো। কোথা থেকে কি বাড়তি টাকা পেয়ে ছোট ঘরটা সারিয়ে-সুরিয়ে নিলে অভয়পদ –তারপর থেকে স্বামীর ঘরেই মহাশ্বেতার শোয়ার হুকুম হ’ল।

সে যেন বাঁচল। দুটো কথা কওয়া যায় প্রাণভরে, তা অভয়পদ উত্তর দিক বা না দিক (অধিকাংশ কথারই উত্তর দেয় না)–মধ্যরাত্রে শেয়ালের ডাকে ঘুম ভেঙে হঠাৎ ভয় পেয়ে গেলে তাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকোনো যায়– এটাই কি কম লাভ? মানুষটা সত্যিই ভাল যত দিন যাচ্ছে, ততই বুঝছে মহাশ্বেতা কোথাও শবযাত্রার ‘বল হরি, হরিবোল’আওয়াজ পেলে নিজেই বুকের মধ্যে টেনে নেয় বৌকে, পিঠে হাত বুলিয়ে প্রশ্ন করে, ‘ভয় পাও নি ত?’

দূরে

১৫৪

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *