০৮. উমাদের খালি বাড়িটা

অষ্টম পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

উমাদের খালি বাড়িটা যেন উমাকে ভ্যাংচায়। এক এক সময় সে ভাবে তার মুখের দিকে চেয়ে হা-হা ক’রে হাসছে নোনাধরা দেওয়ালগুলো। সত্যি সত্যিই যেন হাসির আওয়াজ পায় সে– অবাক হয়ে চেয়ে থাকে উমা। আজকাল এই চিন্তাটা তার বড় বেশী হয়েছে

সে পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি!

কখন মনের

মাঝে মাঝে নাকি সে আপন মনে বকেও। অন্তত মা তাকে একাধিক দিন তাই বলেছেন। তিনিই চমক ভেঙে দিয়েছেন। কিন্তু তার ত মনে পড়ে না কথাগুলো ঠোঁটের ওপর নাচে অমন ক’রে!

মতই রূপবান

মাঝে মাঝে তার মনে হয় স্বামীর কথা। অমন সুপুরুষ স্বামী তার! কার্তিকের এক-একবার তার মনে হয়, না-ই বা স্বামী তাকে নিয়ে ঘর করলেন শ্বশুরবাড়ি না-ই বা যেতে পেলে সে এক আধবারও যদি তিনি আসতেন এখানে ত সে ধন্য হয়ে যেত। দুটি একটি রাত্রির সঙ্গলাভও যদি সে করতে পারত। আত্মসম্মান নয়– অভিমান নয়, কোনপ্রকার অনুযোগেও সে বিব্রত করত না স্বামীকে, কোন কৈফিয়ত চাইত না। কোন দায় চাপাত না বোঝার মত ঘাড়ে চাপত না।

সন্তান?

সন্তান হ’লে সে পরের বাড়ি রাঁধুনীগিরি ক’রে কিংবা দাসীবৃত্তি করে মানুষ করত। স্বামীকে কিছু বলত না। একবার আসুক না, শরৎ এসেই দেখুক না। এই ত ঝি বলছিল, ‘কত পুরুষ ত বাইরের মেয়েমানুষ রেখেছে, তাই বলে কি ঘরের বৌ নিয়ে ঘর করে না তারা? এ আবার কেমনধারা অনাচ্ছিষ্টি কান্ড বাপু! কোন্ পুরুষের আজকাল বারদোষ নেই? এ ত শহর-বাজার জায়গা — আমাদের পাড়াগাঁয়েও দেখ গে যাও ঘর- ঘর এই সব কীর্তি! কিন্তু মেয়েমানুষের বাড়ি পড়ে থাকা– এমন সৌন্দর বৌ তা দেখা নেই ছোঁওয়া নেই এমন কখনও শুনিনি!’

তারই অদৃষ্টে এমন অনাসৃষ্টি কান্ড।

একবার কাছে পেলে সে স্বামীর পায়ে ধরেও রাজী করাত।

কিন্তু কোথায় সে? কোন খবর পর্যন্ত পায় না। শুনেছে যে আজকাল নাকি সে

বাড়িতেও আসে না বাড়ি খোঁজ করতে যাওয়া কিংবা ছাপাখানায় যাওয়া? ছিঃ, সে তা পারবে না!

মাকে একটা পয়সা পর্যন্ত দেয় না। তার সেই মেয়েমানুষের

তাছাড়া সে সম্ভব নয়। প্রথমত সে তার ঠিকানাও জানে না। দ্বিতীয়ত মার কাছে এ কথা পাড়লে—-? দুখানা ক’রে কেটে ফেলবেন তিনি

মনে মনে এই সব কথা আলোচনা করে যখন, তখন বোধহয় মুখ কখনও কখনও নড়ে ওঠে– সে টের পায় না। লজ্জিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করে আর কখনও এমন অন্যমনস্ক হবে না।

মাস কতক পরে উমার তবু একটা কাজ জুটল। মানে, সময় কাটাবার কাজ।পাড়ায় একটা বস্তি ছিল, হঠাৎ সেটা ভেঙে ফেলতে শুরু করলে। শোনা গেল ওখানে নাকি একটা নতুন থিয়েটার-বাড়ি তৈরি হবে।

থিয়েটার? সেটা আবার কি?

ঐ যে ঝি হাত-পা নেড়ে বললে, ‘লাটক হয় গো, লাটক! পেলে হয়! সব রং- চং মেখে বেরোয়, নাচগান কথা-বাত্তারা হয়, তারপর আবার যে যার বাড়ি চলে যায়। যেমনকে নিঝঝুম তেমনি। জানো না!’

উমা দেখে নি কখনও থিয়েটার তবে নাটক সে পড়েছে দু-একখানা। ব্যাপারটা ঝাপসা ঝাপসা আন্দাজ করবার চেষ্টা করে।কিন্তু তাতে অন্য দিকে দিয়ে কৌতূহল কমবার কোন কারণ ঘটে না। বাড়িটা হচ্ছে ওদের গলিটা যেখানে বড় রাস্তায় গিয়ে পড়েছে তারই কাছাকাছি– উল্টো দিকটায়। ওদের ছাদ থেকে খানিকটা স্পষ্ট দেখা যায়। উমা আজকাল অবসর পেলেই ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। হাঁ ক’রে তাকিয়ে থাকে। কী দেখা তা সে জানে না। মিস্ত্রী খাটে, মজুররা যোগাড় দেয়। একটি বাবু দিনরাত দেখাশোনা করেন আর মিস্ত্রীদের গাল দেন, তার ভাষা এখানে এসে পৌঁছয় না অঙ্গভঙ্গীটা লক্ষ্য করা যায়। আর আসে সবটা মিলিয়ে একটা কোলাহল। অদ্ভুত, অপূর্ব লাগে উমার। তবু একটা বৈচিত্র্য, তবু একটা প্রাণচঞ্চলতা। ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকাটা যেন নেশায় দাঁড়িয়ে যায় ওর।

রাসমণি বকেন, কিন্তু খুব জোরে নয়। বড়জোর বলেন, ‘আ মরণ! একটা বাড়ি উঠছে, মিস্ত্রী খাটছে, তার মধ্যে এমন কি মজা আছে তা ত বুঝি নে। দিনরাত রোদে দাঁড়িয়ে অসুখ করবে যে। রং ত পুড়ে যাচ্ছে একেবারে।’

বেশি কিছু বলেন না। ও যে কত দুঃখে এইটে নিয়ে ভুলে থাকতে চায় তা তিনি মায়ের প্রাণে ভালই বোঝেন।

কিন্তু এরা বাড়িই তৈরি করাচ্ছে। থিয়েটারের লোক এরা নয়, তা উমা বোঝে।

মধ্যে মধ্যে একটা গাড়ি চেপে একটি বাবু আসেন তদ্বির করতে, হয়ত তিনিই মালিক। থিয়েটারের লোক কেমন? এমন কি সাধারণ মানুষের মতই? কে জানে! ওর কৌতূহলী মন কল্পনায় তাদের বিচিত্র মুর্তি আঁকে।

অবশেষে –থিয়েটারের বাড়ি শেষ হয়ে আসার মুখে অপ্রত্যাশিত ভাবে সত্যিকার থিয়েটারের লোক এসে হাজির হয় ওদের বাড়ি।

া গোছের

একদিন ঝি এসে রাসমণিকে বললেন, ‘একটি বুড়ো গোছের বাবু এসেছেন, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। রাসমণি বিস্মিত হয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নেমে এলেন, উমাকে বার বার সতর্ক ক’রে দিলেন নীচে না উঁকি মারে সে।

,

৯০-

কিন্তু উমার কৌতূহল অদম্য। সে সিঁড়ির ওপরদিককার একটা ধাপে প্রায় শুয়ে পড়ে একটি খাঁজ দিয়ে চেয়ে থাকে। সে দেখতে পায় ঠিকই কিন্তু তাকে দেখা যায় না। যে লোকটি এসেছিলেন তিনি ভেতরে এসে দাঁড়ালেন। বুড়ো নয় মোটেই বেশ শক্তসমর্থ জোয়ান লোক। হয়ত বড়জোর চল্লিশ বয়স। কিন্তু মাথার চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেছে অল্প বয়সেই। লম্বা দোহারা গঠন, সাদা থান-ধূতির কোঁচা সামনে পাট-করা গোঁজা সাদা চীনে কোট গায়ে, তাতে বোতামের ঘরের দুদিকে চমৎকার সুতোর কাজ করা, পায়ে শুড়-তোলা চটি। সম্ভ্রান্ত ভদ্রলোক।

ভদ্রলোক ভেতরে এসে দাঁড়ালেন হাত জোড় ক’রে, ‘মা, আমি আপনার কাছে একটি ভিক্ষা নিয়ে এসেছি।’

রাসমণি বললেন, ‘বলুন!’

‘জানেন বোধহয় যে এইখানে, এই মোড়ে একটা থিয়েটার-বাড়ি হচ্ছে। ওটা এখনও শেষ হয় নি অথচ এদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে আমরা রিহার্সাল মানে মহড়া শুরু করেছি। কিন্তু এখানে এখনও পাইখানাকল কিছুই তৈরি হয় নি। এতগুলো লোক আসবে একটু খাবার জলও দরকার আমাদের চাকরকে রোজ দু-তিন

ঘড়া খাবার জল নেবার অনুমতি দেন ত এতগুলি প্রাণীর জীবনটা বাঁচে।’

রাসমণি বিপন্ন মুখে খানিকটা চুপ ক’রে থেকে বললেন, ‘জল চাইলে না বলতে নেই –কিন্তু বাবা, একা মেয়েছেলে একটা সোমত্ত মেয়ে নিয়ে ঘর করি– থিয়েটারের লোক বাড়ি এলে কে কী বলবে

– বড় ভয় পাই।’

সে ভদ্রলোক বললেন, ‘মা, পাড়ার এখানে আর কারো বাড়ি কল নেই আমি খবর নিয়ে জেনেছি। তা থাকলে কিছুতেই আপনাকে বিরক্ত করতুম না। তাছাড়া, থিয়েটারের লোক সবাই ত খারাপ নয় মা –আমি বামুনের ছেলে, ভদ্রলোকের ছেলে, লেখাপড়াও করেছি। পাথুরেঘাটা ঠাকুরবাড়ির দৌউত্তুর আমি। চাকর এসে জল নিয়ে যাবে এক-আধ কলসী বৈ ত নয়। হিন্দুস্থানী বেয়ারা, তারাও সৎ জাত।’

রাসমণি একটুখানি চুপ ক’রে থেকে বললেন, ‘আচ্ছা, তাই হবে। এতে যদি পাড়ায় কোন কথা ওঠে কি আর কোন উপদ্রব হয় ত শেষ পর্যন্ত আমায় এ ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে, তা আপনাকে জানিয়ে রাখছি।’

ভদ্রলোক হেঁট হয়ে নমস্কার ক’রে বেরিয়ে গেলেন। মা এদিকে ফেরবার আগেই উমা নিঃশব্দে তার খাঁজ থেকে উঠে পালিয়ে গেল। তার বুকটা ধড়াস ধড়াস্ করছে ধরা পড়বার ভয়ে নয়, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে বিশেষত নিতান্ত যা কল্পলোকের বস্তু সেই থিয়েটারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবার সম্ভাবনায়।

দুই

রাসমণির একটা সুবিধা ছিল এই যে পাড়ার লোকে কি বলছে না বলছে সেটা তাঁর জানবার বিশেষ সম্ভাবনাই ছিল না। তিনি কারও বাড়ি যেতেন না, তাঁর বাড়িতেও লোকে আসত কদাচিৎ। সাদিকরা আসতেন, তা তাঁরাও কারও কথায় থাকতেন না। ঝি

করা আসতেন, ত

পাড়ার কেচ্ছা বহন ক’রে বেড়াবে এ আশঙ্কাও কম।

তাঁর প্রায় দিনরাতের

সুতরাং থিয়েটারের জল নেওয়ার ব্যবস্থাটা অব্যাহতই রইল। শুধু তাই নয় রাসমণির অনিচ্ছাতেও ওদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাটা একটু বাড়ল। হঠাৎ একদিন একটি স্ত্রীলোক একেবারে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে এসে বললে, ‘মা জননী, রাগ ক’রো না মা–বড় বিপদে পড়েছি, আপনার ঐ দিকটা একটু ব্যবহার করব।’ এই বলে সে কল-পাইখানার দিকটা দেখিয়ে দিলে।

ইচ্ছা থাকলেও বাধা দেবার উপায় ছিল না। চক্ষুলজ্জায় বাধে। তাছাড়া সে অনুমতি চাইলেও তার জন্যে অপেক্ষা করে নি। দামী শান্তিপুরী শাড়ির ওপরই কাঁধে একখানি গামছা ফেলে সেদিকে চলে গিয়েছিল।

তারপর সেখান থেকে ফিরে ‘আঃ বাঁচলুম’ বলে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রাসমণির রান্নাঘরের সামনের রকে বসে পড়ে বলেছিল, ‘একটা পান দেবে মা জননী? পান ফেলে এসেছি বাড়িতে।’

অগত্যা তাঁকে বলতে হল,

মেঝেতে বসলে মা! একটা আসন এনে দিক ঝি!’

জিভ কেটে মেয়েছেলেটি উত্তর দিলে, ‘বাপ রে, আপনাদের আসনে বসতে পারি! আমরা নরকের কীট। অনেক জন্মের পাপ ছিল মা, এ জন্মে তাই এই সব ঘরে জন্মেছি, আবার কি বামুনের আসনে বসে পাপ বাড়াবো!’

নরম হয়ে আসে রাসমণির মন।

‘তোমার নাম কি বাছা?’

‘আমার নাম এককড়ি, মা। ছেলেবেলায় মা একটা কড়ি দিয়ে বেচেছিল। আমি ওদের থিয়েটারে য়্যাক্টো করি। বড় বড় পার্ট সব আমার মা–তোমাদের আশীব্বাদে।’

হাত জোড় ক’রে নমস্কার করে সে।

বেশ দেখতেও। শ্যামবর্ণের মধ্যে দিব্যি ছিরি, মনে মনে ভাবে উমা।

‘এইটি বুঝি তোমার মেয়ে, মা? কী নাম ভাই তোমার? উমা? আহা, উমাই বটে! কী রূপ!’

অমনি দু-একটা কথার পর সেদিনের মত সে উঠল। কিন্তু অতঃপর আর ওদের দলকে বাধা দেওয়া গেল না। আরও দু-একজন অমনি প্রাকৃতিক প্রয়োজনে আসতে শুরু করল। রাসমণি যদিও সেই প্রথম দিনের পর উমাকে বারণ ক’রে দিয়েছেন ‘খবদ্দার, ওদের সামনে থাকিস্ নি। ওরা নাকি সব বেশ্যে, বেশ্যে ছাড়া এ কাজ করতে আসেই বা কে! আমি বুড়োমানুষ সে একরকম, তুই ওদের সঙ্গে কথা কইলে ভারি নিন্দে হবে পাড়ায়। উমা তবু ভেবে পায় না যে সাধারণ মেয়েদের থেকে ওদের তফাত কোথায়। ভারি মিষ্টি কথাবার্তা, যেমন ভদ্র, তেমনি বিনয়ী। সবাই ওর মাকে মা ব’লে দূর থেকে প্রণাম করে, ছোঁয়া যাবার ভয়ে পায়ে হাত দেয় না। অনেকখানি ব্যবধান রেখে বসে সবাই, মেঝেতেই বসে, জল খেয়ে আসে কল থেকে, ওদের ঘটি পর্যন্ত চায় না। ওদের সঙ্গে মেশায় দোষ কি তা কিছুতেই বুঝতে পারে না সে। বেশ্যা বলতে কি বোঝায় তা সে ভাল জানত না, কিন্তু ইতিমধ্যে ঝি পুঁটির মার কৃপায় মোটামুটি বুঝে নিয়েছে। শুনে তারও দাম হয় বটে তবে মানুষগুলোকে দেখে সে-ঘৃণা আর সে রাখতে

পারে না।

৯২

এককড়ি আজকাল ঘন ঘন আসে। প্রথম দিন যে ভদ্রলোকটি এসেছিলেন তাঁর পরিচয় ওর মুখেই পেয়েছে উমারা। চন্দ্রশেখর মুস্তাফী নাম, খুব নাকি ভাল অভিনেতা শিক্ষকও ভাল। এককড়ি বলে, ‘ভারি কড়া ম্যাস্টার। বেত হাতে ক’রে বসে থাকে রিয়েশ্যালে। পান থেকে চুন খসলেই অমনি বেত পড়ে ছুঁড়িদের পিঠে। আমাকে অবিশ্যি কিছু বলতে সাহস করে না আমি আবার ওর যে গুরু তাঁর কাছে শিখি

কিনা।

তিনি হ’ল আবার এখন আমার শখের পতি। তবে আমিও মুস্তাফীমশাইকে খুব ভয় করি।’

আবার কোনদিন হয়ত বলে, ‘ঠিয়েটার খুলুক দেখাতে নিয়ে যাবো। এই ত দু মাস পরেই খুলবে।

আমি মা তোমাকে একদিন

রাসমণি প্রবল বেগে ঘাড় নাড়েন, ‘ওমা ছি, থিয়েটার দেখতে যাবো কি!’

‘তাতে কি হয়েছে মা, ঠাকুর-দেবতার পালাই ত বেশির ভাগ। এই ধরো না সীতের বনবাস। আমি সীতে সাজব। আমার যে গুরু তিনি সাজবে রাম। দেখবে

কেমন হয়!’

এমনি আরও বহু কথা অনর্গল বকে যায় সে। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কথাও অনেক বলে। সে যেন এক নতুন রাজ্য মানুষগুলোও আর এক রকমের প্রাণী। সে সব কথা বলবার সময় এককড়ির গলা নেমে এলেও উমা তা শুনতে পায়। শোনে আর শিউরে ওঠে। অথচ একটা যেন অদ্ভুত আকর্ষণও অনুভব করে না শুনেও পারে না।

একদিন এককড়ি একটু অসময়েই এসে গেল।

তখন বেলা দেড়টা হবে, রাসমণি ওপরে বিশ্রাম করছেন আর পুঁটির মা ঝির একান্ত অনুরোধ উমা তার মেয়ে পুঁটিকে প্রথম ভাগ পড়াবার চেষ্টা করছে। নিচের দোর কি কারণে খোলাই ছিল, ঝি হয়ত সামনের বাড়ির ঝির সঙ্গে গল্প করতে গেছে দোর খুলে রেখে, তাই এককড়ি কখন নিঃশব্দে একেবারে সামনে এসে পড়েছে ত কেউ টের পায় নি।

উমা চমকে উঠল, কিন্তু তার চেয়েও বিস্ময় এককড়ির।

সে গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে বললে, ‘ওমা, তুমি লেখাপড়া জানো বুঝি! ঐটুকু মেয়ে দিব্যি গড়গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে গা! ওমা কি হবে, কোথায় যাবো!’

ঈষৎ একটু গর্ব বোধ হয় বৈকি। আর তার সঙ্গে করুণাও।

–তু আপনি বুঝি জানেন না?’ উমা সসঙ্কোচে প্রশ্ন করে।

‘মোটেই না। আমাদের কে-ই বা জানে! একজন দুজন। বাকী সবই গো-মুখ্যু। মেয়েছেলে কে বা লেখাপড়া শিখছে তা আবার আমাদের ঘরের কথা

!

আড়াল থেকে শুনে শুনে এদের অনেক কথাই উমার জানা হয়ে গেছে তাই সে প্রশ্ন ক’রে বসল, ‘তা পার্ট মুখস্থ করেন কি করে?

আমাকে আপনি-আজ্ঞে কেন করছ? তুমি বামুলে

মাথায় পা রাখলেও আমাদের জন্ম সাথক হবে।

য় সধবা, আমাদের

বলছিলুম, পাট? পাট

১৩

মুখস্ত করি শুনে। ঐ একজন পড়ে যায়, আমরা শুনে শুনে মুখস্ত করি। মুখস্ত কি হতে চায়? হয় না।’

তারপর একটু দম নিয়ে খানিকটা পানদোক্তা মুখে পুরে বলে, ‘মা কোথায়?’

‘ওপরে শুয়ে আছেন

‘ঘুমোচ্ছেন?’

‘না–ভাল ঘুম কখনও হয় না ওঁর। বই-টই পড়েন। নয়ত এমনি শুয়ে থাকেন। আজ এমন অসময়ে যে?’

তুমি বা আপনি বলার দায়টা কৌশলে এড়িয়ে যায় উমা।

‘ওমা–মাও লেখাপড়া জানেন বুঝি? ও, তাই তোমরা লেখাপাড়া শিখেছ!’

‘না তা কেন? আমরা যে পাঠশালায় পড়েছি।’

এককড়ি ওপরে উঠে গিয়ে চৌকাঠে বসে পড়ে।

‘মা জননী কৈ গো?’

বই পড়তে পড়তেই বোধকরি রাসমণির একটু তন্দ্রা এসেছিল, ওর ডাকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলেন, ‘ওমা, এসো এসো। ভেতরে এসে বসো না। ছি, চৌকাঠে বসতে নেই! তা এমন দুপুরে যে মেয়ে?’

‘আজ একটা বাগানে যাবার বায়না আছে মা সন্ধ্যেবেলা, তাই দুপুরে রিয়েশ্যাল বসেছিল। আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে কিনা এখন গান গটানো হচ্ছে, আবার একটু পরে আমার ডাক পড়বে, তাই মা তোমার কাছে পালিয়ে এনু। বড্ড তেষ্টাটাও পেয়েছে।

‘আহা তা পাবে না, এই দুপুরবেলা ছুটোছুটি!’

রাসমণি উঠে দুটো নারকেল নাড়ু আর এক ঘটি জল দেন।

‘জলটা আমার হাতে ঢেলে দিন মা।’

অপ্রতিভ হয়ে রাসমণি বলেন, ‘না না–তুমি অমনি খাও। তাতে দোষ কি? তুমিও

ত মানুষ!

তবু সন্তর্পণে আলগোছে জল খেয়ে ঘটিটা এক পাশে নামিয়ে রাখে। তারপর একথা সেকথার পর বলে, ‘মা, একটা কথা বলব, বলো, রাগ করবে না?’

‘না না রাগ করব কেন? বলো না —

‘না মা। অপরাধ নিও না কিন্তু, সব দিক ভেবেই বলছি। তোমার মেয়ে উমা ত লেখাপড়া শিখেছে —

‘খুব আর কৈ বাছা ছাত্রবৃত্তি পাস করেছে।’

‘ওমা

পাসও করেছে! তবে দিব্যি লেখাপড়া জানে!

‘ইংরিজি ত জানে না। আজকালকার মেয়েরা নাকি ইংরেজিও শিখছে কেউ কেউ।’

‘তা ইঞ্জিরি চুলোয় যাক্– বলছিলুম কি, তোমার মেয়ে আমাদের লেখাপড়া শেখাবে? আমরা আট-দশটা মেয়ে শিখতে পারি। এক টাকা 5 টাকা ক’রে যার যা

দু

ক্ষ্যামতা দেব, মাস গেলে পনরোটা টাকা আসবে হেসে খেলে। একসঙ্গেই শিখব, তাতে বেশি মেহনতও হবে না। বড়জোর এক ঘণ্টা।’

৯৪

འཤ། (༣༡ )

+

দৃঢ়তার সঙ্গ ঘাড় নাড়ে রাসমণি, ‘না, সে হয় না। তাতে বড় নিন্দে হবে!’

‘নিন্দে কিসের মা? লেখাপড়া শেখানোয় নিন্দে কিসের? তাছাড়া গলাটা একটু কেশে সাফ্ ক’রে নিয়ে এককড়ি বলে, ‘তুমি ত দয়া ক’রে সবই বলেছ মা, আমার ত জানতে কিছুই বাকী নেই এখন ত সারাজীবন পড়ে রইল মেয়েটার, তুমি চোখ বুজলে ও কি করবে তা ভেবে দেখেছ? হয় রাঁধুনীগিরি, নয় ঝি-গিরি বড়জোর বড় বোনের বাড়ি বিনে-মাইনের দাসীবৃত্তি!’

নইরে

‘সে

রাসমণি বোধ করি একটু বিরক্তই হন এতটা অন্তরঙ্গতায়। ভ্রু কুঁচকে বলেন, যা হয় হবে মা, কিন্তু এখন এই সোমত্ত মেয়েকে দিযে আমি টাকা রোজগার করাতে পারব না। তা ছাড়া তোমরা দশ-বারোজন দল বেঁধে রোজ সন্ধ্যেবেলা এখানে এলে কিছু মনে ক’রো না পাড়ার লোকে কি ভাববে?’

‘বেশ ত, সন্ধ্যের পর না হয় গাড়ি পাঠিয়ে ওকে নিয়েই যাবো?’

এবার আর রাসমণির বিরক্তি চাপা থাকে না, তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে যাবে থিয়েটারে তোমার আস্পদ্দাও ত কম নয় মা! এসব কথা আর কোন দিন যেন না

শুনি।

অপ্রতিভ ভাবে এককড়ি বলে, ‘সে-ভাবে ঠিয়েটারে যাবার কথা ত বলি নি মা, তুমি মিথ্যে রাগ করছ। তাছাড়া আগেই ত বলিয়ে-নিয়েছি যে রাগ করতে পারবে না!’

রাসমণি শান্ত হন কিন্তু কথার আর উত্তরও দেন না। অপমানবোধের চাপা ক্রোধ নিঃশব্দ-দহনে জ্বলতে থাকে তাঁর ভেতরে ভেতরে।

এককড়ি আরও কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে একসময় উঠে পড়ে।

,

কথাটা উমার কানেও গিয়েছিল, কারণ সে তখন সিঁড়ির মুখটায় দাঁড়িয়ে। এর তিন-চার দিন পরে সে সমস্ত সংকোচ এবং শঙ্কা বিসর্জন দিয়ে প্রকাশ্যেই বিদ্রোহ ঘোষণা করলে, ‘আপনি ত সব কথাতেই না বলেন, কিন্তু সত্যিই আমার কি ব্যবস্থা করবেন তাই শুনি? আপনার যা পুঁজি, বড়জোর আর পাঁচ-সাত বছর এমন ক’রে বসে খেতে পারেন। তারপর আপনিই বা খাবেন কি আর আমিই বা দাঁড়াবো কোথায়?’

রাসমণি স্থির–দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ‘বেশ, তোমাকে তোমার শ্বশুরবাড়িতে রেখে আসছি। তারপর তুমি যা খুশি তাই ক’রো।’

‘কেন সেখানে যাব আমি? খুন হ’তে? আপনারাই ত দেখে-শুনে বিয়ে দিয়েছেন। তার দায় বুঝি আমার?’

‘সে তোমার অদৃষ্ট আমরা ত চেষ্টার ত্রুটি করি নি।’

তার বেলায় অদৃষ্ট!… এর বেলা অদৃষ্ট মানছেন না কেন? আমি না হয় খেটে খাবারই চেষ্টা দেখি।’

‘তাই ব’লে তুমি ঐ থিয়েটারের বেশ্যে মাগীদের যাবে লেখাপড়া শেখাতে? তোমার দশ-পনের টাকায় আমার কী-ই বা সুসার হবে?’

‘দশ-পনরো টাকা বিশ-পঁচিশ হ’তে কতক্ষণ! কা অভ্যেস হতো। আর দশ- পনরো টাকায় একটা পেট বেশ চলে যায় মা।’

যায় মা।

৯৫

উমা যেন নিজের সাহসে নিজেই আবাক হয়ে যায়।

*কিন্তু সে বয়স এখনও আসে নি মা। রূপ-যৌবন বড় শত্রু। এত বড় শত্রু সঙ্গে ক’রে কি কাজই বা করতে যাবে? আর, কে বলতে পারে যে পাঁচ-সাত বছরে জামাইয়েরই মতিগতি ফিরবে না?’

সে আশা কি উমার মন থেকেই একেবারে গেছে!

কন্দর্পকান্তি! সেই রূপের স্মৃতি যেন

সে চুপ ক’রে যায়। রূপবান তরুণ স্বামী কামনার বাতাসে হতাশার ভস্মস্তপের মধ্যে থেকে আশাকে সঞ্জীবিত ক’রে তোলে অনেক দিনের পর। মনের জমাট-বাঁধা স্তব্ধতা কোন্ এক অজানা দক্ষিণা-বাতাসে দূর হয়ে গিয়ে ওর দেহলতা কাঁপতে থাকে থরথর্ করে।

তিন

দিন-দুই পরে অকস্মাৎ চন্দ্রশেখর মুস্তফী স্বয়ং এসে উপস্থিত হলেন। হাত জোড় ক’রে বললেন, ‘মা, আমার একটি নিবেদন আছে।

কারণটা ঠিক অনুমান করতে না পারলেও কেমন একটা আক্রমণ আশঙ্কায় কঠিন হয়ে ওঠেন রাসমণি, ‘বলুন!’

কখনও ঢুকবে না

যাবে, ঘোমটা দিয়ে

‘আমি ব্রাহ্মণ, আপনার সন্তান। একটা কথা যদি বলি ত অপরাধ নেবেন না। এককড়ির কাছে সব শুনলুম। যদি আপনার কন্যা আমার ভগ্নী এ কাজটি করতে পারে ত মহৎ দায় উদ্ধার করা হয়। আমি একটি আলাদা ঘর দেব। সে ঘরে পুরুষ এ কথা দিচ্ছি। আমার ঝি এসে প্রতিদিন রাত সাতটা নাগাৎ নিয়ে টুপ ক’রে চলে যাবে, কেউ অত লক্ষ্যও করবে না। আমি দোরের

–কেউ ওর দিকে মুখ তুলে চাইতে পর্যন্ত সাহস করবে না। ওরা ন’জন পড়বে –দু টাকা ক’রে দেবে, এ ছাড়া আমরা থিয়েটার থেকে বারো টাকা ক’রে দিয়ে ঐ পুরো ত্রিশ টাকাই করে দেব। আর মা, লোকে যদি জানতে পারে নিন্দে করবে? আমি ত সবই শুনেছি, কি ক্ষতি হবে তাতে মা আপনার ত আর মেয়ে নেই যে বিয়ে দিতে হরে। সমাজের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কি?’

কাছে দাঁড়িয়ে থাক্‌

রাসমণি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘কিন্তু আমার অন্য মেয়েজামাইরা আছেন –তাঁদের ত সমাজ আছে!’

‘এটা কলকাতা শহর মা। এখানে সমাজের শাসনই বা কি আর কে-ই বা এখানে কার কথা জানতে পারছে!’

‘না বাবা এসব কথা আর তুলবেন না। সে আমি পারব না।’

রাসমণি যেন অসহ্য একটা ক্রোধে জ্বলে ওঠেন। এ উষ্মা ওঁর ভাগ্যের ওপর– এত করেও কি অদৃষ্ট-দেবতার সাধ মেটে নি? আরও নিচে তাঁকে নামাবার জন্য এমন চক্রান্ত তাঁর?

প্রলোভনের জাল ক্রমেই রমণীয় ক’রে তুলছেন, ঘিরে ধরেছেন রাসমণি পিছন ফিরে ওপরে চলে গেলেন, ইচ্ছা ক’রে মুস্তফীকে অপমাণিত করার জন্য।

চারিদিক দিয়ে।

-།—— ET—

৯৬

কিন্তু আক্রমণ এখানেই থামল না।

আবার এককড়ি এল। নানা রকম যুক্তি, নানা প্রলোভন।

অবশেষে কমলা একদিন এসে সব শুনে বললে, ‘পাঠিয়ে দিন মা, আর দু-মত

করবেন না।

‘তুইও বলছিস্? জামাই কি ভাববেন যদি শোনেন?’

,

‘সে আমি তাঁকে নিজে বলতে পারব, সে সাহস আছে আমার। এতে দোষ কি?

অকারণ সমাজকে এত ভয় করেন কেন মা সমাজ আপনাকে খেতে পরতে দেবে? পরের দয়ায় বেঁচে থাকার চেয়ে যে-কোন রকমে খেটে খাওয়া ভাল।’

কিন্তু ঐ রূপের খাপ্পা মেয়েকে কোথায় পাঠাই বল ত?’

‘ওখানে ত মুস্তফী মশাই ভাল প্রস্তাব করেছেন মা রূপের খাপ্পা মেয়ে যদি খারাপ হয় ত আপনি পাহারা দিয়েই সামলাতে পারবেন? কত চোখে চোখে রাখবেন! তাছাড়া

আমার বোনেরা তেমন নয় মা।’

আরও দু-চারদিন ভেবে

আরও অনুরোধ-উপরোধের পর রাসমণি দুর্বল হয়ে আসেন একসময় সম্মতি দেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও। কিন্তু তারপর পূজোয় বসে তাঁর দু’চোখ জলে ভেসে যায়। ঠাকুর, এ কী করলে তুমি!

?

উমার বুক কাঁপে সারাদিন। অজ্ঞাত কি একটা আশঙ্কা, নাম-না-জানা কি একটা আশা। কিছুতেই স্থির হয়ে কোথাও বসতে পারে না, কিছু একটা ভাবতে পারে না মাথা ঠিক রেখে।

সন্ধ্যার কিছু আগে মনে হ’ল মাকে গিয়ে বলে, ‘ও আমি পারব না মা আপনি বারণ ক’রে দিন।

কাজে ব্যস্ত থাকার আশা, অর্থ উপার্জনের আশা

>

কিন্তু নূতন আশা

এমনি নানা আশা এসে বাধা দেয়। সেই আশাই একসময় তাকে থিয়েটারের পদ্মঝির পিছু পিছু অমোঘ, অপ্রতিহতবলে টেনে নিয়ে যায়। মাথায় ঘোমটা টেনে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে অন্ধকারে কোনমতে যেন ছুটে পার হয়ে যায় রাস্তাটুকু তবু মনে হয় পাড়ার হাজার জোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি তাকে লক্ষ্য করছে ও বিদ্রুপের হাসি হাসছে।

থিয়েটারে পৌঁছে অবস্থা আরও খারাপ হয়। মেয়েরা দু-চারজন চেনা কিন্তু বাকী সবাই এমন ভাবে তাকিয়ে থাকে যে উমার মনে হয় তাদের সে দৃষ্টির আড়ালে একটা কৌতুকের হাসি আছে। যেন ওদের মনের ভাব নিঃশব্দে বলছে আর কত দিন, শীগগিরই ত আমাদের দলে এসে দাঁড়াবে– দেরি নেই! ও ভদ্রতার ঔদ্ধত্য আর বেশি দিন রাখতে হবে না ঢের দেখেছি আমরা!

তাছাড়া, মুস্তফী মশায়ের কড়া শাসন সত্ত্বেও দু-একটি পুরুষ উঁকি মারে এদিক ওদিক থেকে। তাদের দিকে তাকিয়েও উমা বুঝতে পারে সেটা।

ঘেমে নেয়ে ওঠে উমা, বুকের মধ্যে কেমন করে ওর, হাত পা ঝিমিয়ে আসে। মিনিট-কতক কোনমতে কাটিয়েই হঠাৎ কেঁদে এককড়িকে বলে, ‘আজ, আজ

འགས་ཅི་ག་ ག

আমার বড্ড ভয় করছে দিদি, আমায় বাড়ি পাঠিয়ে দাও।’

৯৭

কলকাকान কাছেই-এ

এককড়ির চোখ করুণার্দ্র হয়ে ওঠে, ‘বুঝেছি ভাই– অমন হয় প্রথম দিন। এতগুলো অচেনা লোক ত। তা আজ আর পড়াতে হবে না। একটু বসে গল্প করো বরং

‘না না

আমার বড্ড গা গুলোচ্ছে। আমাকে এখনি বাড়ি পাঠিয়ে দিন।

এই বলে সে নিজেই বেরিয়ে পড়ে। উল্টো দিকে বেরোতে গিয়ে স্টেজে ঢুকে দড় দড়ির গহন অরণ্যে আরো দিশাহারা হয়ে ওঠে

‘অ পদ্ম, দ্যাখ কান্ডখানা! যা যা তুই শীগিরি। এই যে বোন, এই দিকে এসো। আমি নিজে তোমাকে পৌঁছে দিচ্ছি না হয়।’ এককড়ি চেঁচাতে থাকে।

পদ্ম-ঝি ছুটে এসে একরকম উমার হাত ধরেই বাইরে নিয়ে আসে।

একটি মেয়ে এককড়িকে বললে, ‘তোমার যেমন কান্ড দিদি, ও যে একেবারে খুকী ওকে এখানে আনে কখনও?’

আর একজন চিমটি কেটে বললে, ‘ওলো থাম! অমন অনেক খুকী দেখেছি আমরা। এরপর এস্টেজে নেমে ধিতিং ধিতিং ক’রে নাচতেও ভয় পাবে না।’

এককড়ি তাকে ধমক দিয়ে ওঠে।

থিয়েটারের বাইরে এসেও উমা প্রথমটা যেন হচকচিয়ে গিয়েছিল। তারপর পদ্ম- ঝি যখন তার হাত ধরে আকর্ষণ ক’রে বললে, ‘এই যে ইদিকে, অমন বোকার মত চারিদিকে চাইছ কি?’ তখন যেন ওর সম্বিৎ ফিরে এল। নিজেদের গলিটা চিনতে পেরে সে হাতটা মুঠো থেকে টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে একরকম ছুটেই বড় রাস্তা পার হয়ে গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।

কিন্তু ঠিক নিজেদের বাড়িতে ঢুকতে যাবে এমন সময় কে যেন পরিচিত কণ্ঠে পেছন থেকে বললে, ‘শুনছ, উমা, একটু শুনে যাও!’

চমকে কেঁপে উঠল উমা, হয়ত পড়েই যেত দেয়ালটা না ধরে ফেললে খুবই সামান্য পরিচয় এ কণ্ঠস্বরের সঙ্গে, তবু সমস্ত অন্তরে যেন এর প্রত্যেকটি সুর সদাজাগ্রত– হৃদয়ের তন্ত্রী এই সুরেই বাঁধা হয়ে গেছে চিরকালের মত।

এ যে তার স্বামী

শরৎ!

উমা চোখ খুলে না তাকিয়েও তাকে চিনতে’ পারলে, উপস্থিতিটা অনুভব করতে পারলে– সারা দেহের প্রতিটি অনু-পরমাণু দিয়ে।

তোমাকে এইমাত্র ঐ থিয়েটারটা থেকে বেরোতে দেখলুম যেন, এ কি সত্যি?’

এই সহজ প্রশ্নের অন্তরালে যে প্রচ্ছন্ন একটু অনুযোগ ছিল তাতেই উমার মন কঠিন হয়ে উঠল, এতক্ষণ তার গলা যেন বুজে আসছিল, এবারে পরিষ্কার কণ্ঠে জবাব দিলে, ‘হ্যাঁ, কি হয়েছে তাতে?’

‘শেষে তোমার এই দুৰ্গতি, ছিঃ!’

জ্বলে ওঠে উমা, ‘তুমি ত আমাকে ত্যাগ করেছে, আমার চলবে কিসে তা কোনদিন ভেবে দেখেছ কি? বিধবা মা ক

মা গেলেই বা দাঁড়াব কোথায়?’

থেকে পুষবে আমাকে চিরকাল? তারপর

৯৮

‘তোমার কাছে আমার অপরাধ ঢের-তা সত্যি, বলবারও কোন হক হয়ত আমার

নেই, তবু তুমি থিয়েটারে নামছ

কাজ ক’রো না। ছিঃ!’

না, না, উমা এ আমি ভাবতেই পারি না। এ

এই বলে শরৎ যেন একরকম ছুটেই অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ও যে এখানেই আসে নি, এটা যে আকস্মিক পথের দেখা তা উমা কল্পনা করে নি। তাই ভেতরে যাবার কোন আমন্ত্রণও জানায় নি। ‘ভেতরে চলো আজকের রাতটা থেকে যাও’ এ যে ওর সারা অন্তরের আর্ত কাকুতি, এ কি উনি জানেন না? অনাবশ্যক-বোধেই মুখে তা বলে নি উমা, বলবার অবকাশও পায় নি। তাই ব’লে উনি

চলে গেলেন!

কত কথা যে ওঁকে বলবার আছে, কত ভিক্ষা ওঁর কাছে চাইবার! বাঞ্ছিত আরাধিত দেবতা, হাতের কাছে এসে আবার কোন্ অনির্দিষ্ট কাল ও সীমাহীন স্থানের মধ্যে হারিয়ে গেল! আর কি কখনও বলা হবে সেসব কথা!

ওর অনুযোগটাও যে কত মিথ্যা, তাও ত জানানো হল না!

এ কী হ’ল ওর, এ কী হ’ল!

>

আড়ষ্ট পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে উমা দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই, তেমনি একটা পা চৌকাঠে দিয়ে, এক হাতে দরজার কাঠটা ধরে, বহু নড়বারও আর শক্তি নেই ওর।

বহুক্ষণ ধ’রে। একটু খানি

৯৯

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *