১১. বছর কাটে

একাদশ পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

একটি একটি ক’রে বছর কাটে।

মহাকাল তাঁর হিসেবের খাতায় একটি ক’রে পাতা ওল্টান। সেই পাতার মধ্যে বহু সুখদুঃখের বিবরণ চিরকালের মত চাপা পড়ে যায়। কত মর্মান্তিক ইতিহাস বুকভাঙা বেদনা!

কত

আজ যা মনে হয় অসহ্য কাল তাই একটা অস্পষ্ট বেদনাদায়ক অনুভূতিতে পরিণত হয়ে স্মৃতির কোন্ সুদূর দিগন্তে মিলিয়ে যায়!

শ্যামারও বছর কাটে। এক-এক সময় মনে হয় বুঝি কাটল না কিছুতে– মনে হয় এতকাল পরে সংসারের তরণী বুঝি এই ঘূর্ণিতে ডুবল, বুঝিবা এই তুফানে বানচাল হ’ল। আবারও তা কোনমতে হেলে-বেঁকে একসময় সোজা হয়ে দাঁড়ায়। স্তব্ধ নিঃশ্বাস আবার সহজে বেরিয়ে আসে উঁচু পর্দায় বাঁধা স্নায়ুতন্ত্রী আবার নিশ্চিত আলস্যে শিথিল হয়ে যায়। এই ত প্রায় প্রতি দরিদ্র সংসারের ইতিহাস। শ্যামার জীবনেই বা

তার অন্যথা হবে কেন?

নরেনের ডুব মারাটা আজকাল সয়ে গেছে শ্যামার। বরং যখন সে আসে তখনই যেন বেশি অসহ্য। চালটা পায় বটে স্বামীকেও কাছে পায় এই পর্যন্ত, কিন্তু তার ঝঞ্ঝাট-ঝামেলাও বড় কম সইতে হয় না। শ্যামার এক-এক সময় মনে হয় আর বুঝি

সে পারে না।

মঙ্গলা ঠাকরুণ অবশ্য এদের তাড়াবার চেষ্টা কম করেন নি। আগের পূজারীকে দিয়েই যখন পূজা করাতে হবে অর্ধেক দিন, তখন মিছিমিছি এরা ঘর-জোড়া ক’রে থাকে কেন? তাছাড়া সে পূজারীও বড় গোলমাল করে নরেন মধ্যে মধ্যে এসে দেড়মাস দু’মাস থাকে যখন, তখন তার বরাদ্দ মারা যায়। প্রথম প্রথম ঝগড়া ক’রে নরেনকে দমিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দু’ একবার মাত্র সে চেষ্টার পরই হাল ছেড়ে দিয়েছে। নরেন একেবারে কাটারী কি বঁটি ধরে। সে সময় তার যা প্রচন্ড মূর্তি হয়, তাতে সামনে দাঁড়ানো শক্ত। অগত্যা চুপ ক’রে সহ্য করা ছাড়া পূজারীর সহ্যই করে, আর মধ্যে মধ্যে অনুযোগ করে মঙ্গলা ঠাকরুণের

উপায় থাকে না

কাছে।

ཨཝ)འི གངས, ༤༑མ པདངས།

অথচ মঙ্গলাই বা কি করবেন ভেবে পান না! এ হয়েছে তাঁর স্বখাত সলিল। নরেনের দ্বারা ভাল পূজা হবে সে আশা-ভরসা আর তাঁর নেই। ও যেন গেলেই তিনি বাঁচেন। বিশেষত নরেনের প্রস্তুতির যে পরিচয় তিনি পাচ্ছেন দিন দিন, তাতে এ বিশ্বাসও বদ্ধমূল হয়েছে যে, নতুন বামুনঠাকুর এবোরে পাগল। একদিন ত হাতেনাতেই ধরলেন। পাইখানার কাপড়ে এসে, না স্নান না কিছু, পূজো করতে বসে গেল। হাঁ-হাঁ ক’রে এলেন মঙ্গলা ঠাকরুণ, ‘ও কি ঠাকুর, ও কী করলে গো! সর্বনাশ করলে! এখুনি তুমি বেরোও বেরোও বলছি!’

প্রথমটা নরেনও একটু হচকিয়ে গিয়েছিল, ‘কেন গো, কী হ’ল আবার?’

‘কী হ’ল আবার জিজ্ঞেস করছ! সদ্য পাইখানার কাপড়ে এসে ঠাকুর ছুঁলে। আবার বলা, কি হ’ল!’

কে বললে পাইখানার কাপড়

না ত!’

‘আবার মিছে কথা বলছ ঠাকুর? আমি স্বচক্ষে দেখলুম তুমি মাঠ থেকে পুকুরে গেলে আর সোজা উঠে এসে গাছ থেকে ফুল পেড়ে নিয়ে মন্দিরে ঢুকলে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলুম আক্কেলখানা। তা এত সাহস যে হবে তা স্বপ্নেও ভাবি নি। ধন্যি বুকের পাটা বাবা। যাক্ যা হয়েছে তা হয়েছে। খুব আক্কেল হয়েছে আমার। এখন বেরোও, আমি বেচা ঠাকুরকে ডেকে অভিষেক করাই। আজই তুমি বিদেয় হয়ে যাবে আমার

ভিটে থেকে–বলে রাখলুম।’

মিছে কথা বলে পার পাবার আর উপায় নেই দেখে নরেনও নিজমূর্তি ধরলে, ‘থাম্ মাগী মেলা ভ্যানর ভ্যানর করিস নি। ঠাকুরের সেবা কি হবে না হবে সে কথা বামুন বুঝবে আর ঠাকুর বুঝবে। এ হ’ল গে আমাদের কাজ, যার যা। বলে যার কর্ম তারে সাজে অন্যের মাথায় লাঠি বাজে!’

তবু মঙ্গলা হাল ছাড়েন না। বলেন, ‘তাই বলে তুমি যা-তা কাপড়ে ঠাকুর ছোঁবে? হেগো-হাতে পূজো করবে?’

নরেন খিঁচিয়ে ওঠে, ‘আলবত করব। মাগী, এত শান্তর জানিস আর এটা জানিস না যে বামুন এক পা গেলেই শুদ্ধু? হাওয়া লাগলেই বামুন শুচি হয় তা জানিস না? না জানিস ত জিজ্ঞেস ক’রে দেখগে যা কোন টুলো পন্ডিতকে শুনেছি ত মন্তর হয়েছে, সেই গুরুকেই জিজ্ঞেস করিস।’

এই বলে সে ঠাকুরকে স্নান করাতে শুরু করে দিলে।

‘এ ত কম অত্যাচার নয় গা! বামুন বলে যা খুশি তাই করবে?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। করব। বামুনের পায়ের ধূলো ভগবান বুক পেতে নেন। তোরা শুদ্দুর, কি বুঝবি এর মর্ম! আমরা হলুম গে গুরুবংশ। আমরা সব জানি।’

সম্প্রতি কালনায় গিয়ে কথকতা শুনে এসেছে নরেন। এখনও মনে আছে ঘটনাটা। শুধু ভৃগুর নামটা মনে পড়ল না ব’লে আফসোস হ’তে লাগল।নইলে জমত আরও।

মঙ্গলা তবু একবার শেষ চেষ্টা করলেন, ‘আমি ঠাকুর তোমাকে রাখব না, আমার খুশি, তুমি আজই পথ দেখবে। সিধে বাত!’

১১৬

তড়াক করে লাফিয়ে উঠে যেন ছিটকে বেরিয়ে আসে নরেন, ‘যেতে পারি আমি, কিন্তু পৈতে ছিঁড়ে ঐ নারায়নের সামনে মাথা খুঁড়ে ব্রহ্মরক্তপাত ক’রে চলে যাবো তা বলে দিলুম। ছেলেপুলে নিয়ে ঘর করো তোমার তাতে ভাল হবে ত;’

এর পর আর একটি কথাও বলতে সাহসে কুলোয় নি মঙ্গলার। তখনকার দিনে কুলোনো সম্ভবও ছিল না। তিনি এক পা এক পা ক’রে পিছিয়ে চলে গেলেন বিড়বিড় ক’রে বকতে বকতে, ষাট্ ‘ষাট্! এ কি সাংঘাতিক সর্বনেশে লোক রে বাবা! আজই বাছাদের কপালে পাঁচ পয়সা ক’রে ঠেকিয়ে তুলে রাখতে হবে। মার ওখানে যেদিন যাবো পূজো দেব। হে হরি, হে নারায়ণ, রক্ষে করো বাবা!’

নরেন একা দাঁড়িয়ে হি হি ক’রে হাসতে লাগল সেখানেই।

সব শুনে শ্যামা বলেছিল, ‘তারপর? তোমার ত হুট্ বলতেই যাওয়া। একা পেয়ে আমাকে যদি একদিন তাড়িয়ে দেয়?’

‘ইস্, দিলেই হ’ল! আমার বৌ হয়ে এই কথা তুই মুখে আনলি! ওরে হাজার হোক আমরা হলুম বামুন, গোর্খরো সাপের জাত। আমাদের ঘাঁটাতে সাহস করবে না সহজে। তেমন হয় বলবি এই আমি তিনদিন উপোস ক’রে পড়ে রইলুম। তে- রাত্তির করে তাঁবে বেরোব।’

তখন সে কথায় অতটা আমল দেয় নি শ্যামা। কিন্তু একসময় কথাটা খুব কাজে লেগে গেল। মঙ্গলা একদিন স-পুত্রকন্যা একেবারে রণচন্ডী মূর্তিতে এসে দাঁড়ালেন, ‘বাম্‌নি, তুই যাবি কিনা, বল্। না বেরোস্ ত জোর করে বার ক’রে দেব। ভাল চাস্ ত মালপত্তর যা নিয়ে যেতে হয় নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যা আমি গাড়িভাড়া দিচ্ছি।

মরিয়া হয়ে মানুষ যা করতে পারে, আগে থেকে তা কল্পনা করা শক্ত। নরেনের মুখে কথাটা শোনবার সময়ে শ্যামা কল্পনাও করে নি যে ঐ কথা- গুলো সত্যিই তার মুখ দিয়ে বেরোবে। কিন্তু এখন, যখন একান্ত অসহায় অবস্থায় পড়ে মনে হ’তে লাগল ওর পায়ের নিচে থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, তখন অনায়াসেই সে বলে ফেললে, ‘আমার স্বামী বাড়ি নেই বলে দল বেঁধে গায়ের জোর দেখিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিতে এসেছেন মা-বেশ, গায়ে হাত দিয়ে বার করতে হবে না আমি নিজেই ছেলেমেয়ের হাত ধরে রাস্তায় গিয়ে বসছি। তবে অমনি যাবো না মা

রাস্তায় ওপর

ত আর আপনার জোর নেই আপনার বাড়ির সামনে বসে তে-রাত্তির ক’রে যদি যেতে হয় ত তখন যাবো। জিনিসপত্তরে কি দরকার ও আপনারা ফেলে দিন। আয় রে খোকা’

মঙ্গলা অবাক্ হয়ে গালে হাত দিয়ে থাকেন কিছুকাল।

‘শুনলি,তোরা শুনলি একবার!

যেমন দ্যাবা তেমনি দেবী। বেইমানের ঝাড়

একেবারে। এতকাল ঘরে রেখে পুষলুম, তার এই শোধ, আমারই সর্বনাশ করার চেষ্টা! বেশ, তাই তুমি থাকো মা, বলে তাই করো’

আমার ঘর-জোড়া ক’রে

। তাই যদি তোমার ধম্মে

ཝའི་ གས་ ་ ་ ་ ་ ་ ་ ་

সদলবলে গজ্‌জ্ করতে করতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শ্যামাও সেদিন পাগলই হোক বদমাইশই হোক কিন্তু লোকটার যে বুদ্ধি

হেসেছিল আপন মনে

আছে তা মানতেই হবে।

দুই

সেদিন থেকে সোজাসুজি তাড়াবার চেষ্টা আর মঙ্গলা করেন নি। কিন্তু তাছাড়া যত রকমে করা যায় তার কোন পথটাই বাদ দেন নি। হেম আর মহাশ্বেতার ওপর ত অত্যাচারের অন্তই ছিল না শ্যামার পক্ষেও সে সব সহ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠছিল

শুধু আর কোথাও কোন পথ

নেই বলে চুপ্ ক’রে সইতে হ’ত।

এমনিই ত দিন চলে না। নরেন যখন থাকে না তখন বরাদ্দ চাল বন্ধ হয়ে যায় গহনা যা সামান্য থাকে তাতে কয়েক দিনও চলে না ভাল ক’রে। তারপর উপবাস। খুব অসহ্য হয় যখন; ছেলেমেয়েগুলোকে ঘরে চাবি দিয়ে রেখে শ্যামা চলে যায় হেঁটে কলকাতায় মার কাছে একবেলা খেয়ে কিছু চাল ডাল টাকা নিয়ে আবার হেঁটেই ফিরে আসে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেতে ভরসা হয় না পায় ফিরে এসে!

ঘরে যদি আর ঢুকতে না

থাকে তখন সে নিজেই

নরেন থাকলে এক-আধবার যখন মেজাজ ভাল ওদের পাঠিয়ে দেয়, বলে, ‘তুই নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যায় ছোট বৌ– আমি এই মাটি কামড়ে পড়ে রইলুম, তুই না ফিরলে নড়ছি নি।’ সে রকম ক্ষেত্রেও সাত-আট দিনের বেশি থাকতে ভরসা হয় না। তবু তাতেই ঢের উপায় হয়। রাসমণি নামই দিয়েছেন, দুর্ভিক্ষ অবতার। আসে যখন কঙ্কালসার চেহারা, একমাথা উকুন, গায়ে ময়লা ছেঁড়া কাপড়। এখানে এসে মাথা ঘষে, তেল সবান মেখে চক্‌চকে হয় আবার–নতুন কাপড় পায়, ছেলেমেয়েদের অঙ্গেও জামাকাপড় ওঠে। যাবার সময় পাঁচ-দশটা টাকাও আচলে বেঁধে ফেরে।

এর বেশি রাসমণি দেন না। প্রথমত তাঁরই সংসার চলা শক্ত। আরও কতদিন বাঁচতে হবে তাঁকে কে জানে, উমারও ত এই অবস্থা বিশেষ ক’রে উমার চিন্তাই যেন তাঁকে আরও বেশি বিব্রত ক’রে তুলেছে। সেক্ষেত্রে কত টাকা ওদের দেওয়া সম্ভব? তাছাড়া নরেনকে বিশ্বাস করেন না তিনি একটুও, বেশি টাকা নিয়ে মেয়ে ফিরলে সে টাকা তার ভোগে হবে কিনা সন্দেহ!

শ্যামা কিন্তু এতে একটু ক্ষুণ্নই হ’ত। দীর্ঘকাল ধরে অহরহ দারিদ্র্য ও উপবাসের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে ওর মনটাও যেন পাল্টে গেছে অনেকটা। মা বেশি করে টাকা দেন না, সেটা যেন মায়ের অন্যায়। মা কোথায় পাবেন সে কথা একবারও ভাবে না। শুধু এইটেই মনে হয়, নিজেরা ত বেশ ভোগেসুখে আছেন–আমার বেলাই যত নেই নেই! ওর মানসিক পরিবর্তন ও নিজেও যেন অনুভব ক তবু তার প্রভাব এড়াতে পারে না।

কিন্তু মার আশঙ্কা যে কতটা সত্য তা একদিন প্রমাণিত হয়ে গেল। ইতিমধ্যে আবার অন্তসত্ত্বা হয়েছিল শ্যামা। প্রসবের সময় হিসেব ক’রে রাসমণি চিঠি লিখলেন

১১৮-

তাঁর কাছে যাবার জন্যে। শ্যামার তা সাহসে কুলোল না। একমাস দেড়মাস সেখানে থাকতে হবে হয়ত, কিংবা আরও বেশি। তাহ’লে এ বাসা ঘুচবে চিরকালের মত। মার ওখানে তার আশ্রয় মিললেও মিলতে পারে • নরেনের যে স্থান হবে না এটা ত ঠিক। কাজেই অনেক ভেবেচিন্তে সে মাকে লিখলে, ‘কিছু টাকা যদি সম্ভব হয় ত পাঠান মা

যাওয়া আমার হবে না।

হাজার হোক সন্তান। রাসমণি অনেক কষ্টে পঞ্চাশটি টাকাই যোগাড় করে পাঠালেন। টাকা যেদিন এল সেদিন নরেন সেখানে উপস্থিত। লোলুপ দৃষ্টিতে টাকাটার দিকে চেয়ে রইল সে, কিন্তু শ্যামার ভয়ে তখন কিছু বলতে পারলে না। ইদানীং শ্যামাও শক্ত হয়ে উঠেছে। তাকে ভয় দেখিয়ে কিছু করা যায় না।

সন্ধ্যার সময় শ্যামা রান্না চাপিয়েছে, নরেন কাছে এসে বসল।

‘কি খবর বলো দিকি? এত ন্যাওটোপনা করছ কেন?’ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়

শ্যামা।

‘না –এমনি। অনেকদিন যেন তোকে ভাল ক’রে দেখি নি। মাইরি বলছি ছোটবৌ, এত দুঃখ-কষ্টে এখনও তোর রুপটা কিন্তু নষ্ট হয় নি। এখনও আর একবার বিয়ে দিয়ে আনা যায়।’

এ স্তুতির আড়ালে আর কিছু আছে জেনেও পুলকিত হয় শ্যামা। আগুনের তাতে তার শুভ্র ললাটে স্বেদবিন্দুর মধ্যে যে রক্তিমাভা ফুটে উঠেছিল তা নিবিড়তর হয়ে ওঠে 1

‘আর হবে না-ই বা কেন? আমার শাশুড়ী ঠাকরুণের রূপটাই কি কম! অন্ধকারে

যেন জ্বলে! কত বড় বংশের মেয়ে। রাজা-রাজড়ার ঘরে মানাত তোকে নেহাত আমার হাতে এসে পড়েছিস, তাই।’

শ্যামা বাঁকা কঠাক্ষে ওর মনের কথাটা বোঝবার চেষ্টা করে কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। গলাটা হঠাৎ একটু নামিয়ে বলে, মাইরি, ছোটবৌ,তোর দু’টি পায়ে পড়ি–তিনটে টাকা দিবি?’

‘টাকা? টাকা কি হবে? টাকা কোথায় পাবোই বা!

‘অনেকদিন নেশাভাঙ্ করি নি, তোর দিব্যি বলছি। আজকে শরীরটাও বড় ম্যাজম্যাজ করছে যাবো আর আসবো। একটু বিলিতি খাবার ইচ্ছে হয়েছে আজ।’

‘আচ্ছা তোমার একটু লজ্জা করছে না! আমার আঁতুড়ের খরচা বলে মা পাঠিয়েছেন একমাস আঁতুড় ঠেলতে হবে। দাই আছে, খাওয়া-দাওয়া আছে, তোমার ত পাত্তাই থাকবে না। এ সময় উপোস ক’রে থাকলে চলবে? তোমারই দেওয়ার কথা মা পাঠিয়েছেন, বিধবা মানুষ, তাঁকে দেনে-আলা ত কেউ নেই। তাইতেই ত তোমার লজ্জায় মরে যাওয়া উচিত। আর উটে কি না ছি ছি! তোমার কাছে থেকে ঘেন্না-লজ্জা আর আশা করি না, তবু মানুষের কোন পদাত্ত কি আর নেই!’

‘মাইরি বলছি, এই তোর দুটি পায়ে পড়ছি এইবারটি দে, তারপর যদি লক্ষ্মীছেলে হয়ে ঘরে বসে না থাকি ত কি বলেছি। দু’মাস কোথাও নড়ব না এই পৈতে ছুঁয়ে বলছি। তোকে, ছেলেমেয়েদের রেঁদে দিতে হবে না?’

১১৯

কোমল হয়ে আসে শ্যামার মন। সে আস্তে আস্তে গোপন ভাণ্ডার থেকে তিনটি টাকা বার করে দেয়।

তিন

সেই দিনই রাত্রে শ্যামার ব্যথা উঠল। তখন আর উপায় নেই— পাড়ার যে দুলে- বৌ দাইয়ের কাজ করে তাকেই ডেকে পাঠাতে হ’ল। ছ’বছরের ছেলে হেম সেই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে অন্ধকার রাত্রে তাকে ডাকতে গেল– আর দ্বিতীয় লোক কৈ! মঙ্গলা ঠাকরুণ অবশ্য পরে এলেন কিন্তু তাঁর ছেলে মেয়েদের ঘুম থেকে তুলে যে দাই ডাকতে পাঠাতে দেবেন না তিনি –এটা শ্যামা বেশ জানত। হেম ভয়ে চোখ বুঝে হোঁচট খেতে খেতে কোনমতে গেল দুলে-বৌ সঙ্গে এল এই যা ভরসা। কিন্তু ততক্ষণে আপনা থেকেই একটি মৃত সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে শ্যামার। দুলে-বৌ-এর মুখে খবরটা শুনে শ্যামার দু চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল, এত কষ্টের সন্তান যদি বা হ’ল বাঁচল না!

আসবার সময়

মঙ্গলা এসে হেঁট হয়ে দেখে বললেন, এ বাছা তোমার সোয়ামীর দোষ। নিশ্চয়ই ওর খারাপ ব্যামো আছে। নইলে এমন হ’ত না। আমি ভাবছিলুম যে রাত-বিরেত অন্ধকারে যাও আমার ফলগাছগুলোর সর্বনাশ করতে পেটের জ্বালায় কিছুই ত মানো না তাই বুঝি কি নজর-টজর লেগেছে! কিন্তু এ ত… দেখছিস বসনের মা?’

বসনের মা দাই ঘাড় নাড়ল, ‘আমারও তাই মনে হচ্ছে মা।’ ওর জা রাধারাণীর কথা মনে পড়ে যায় শ্যামার

তা হ’লে কি তার কোন

ছেলেই আর বাঁচবে না? এর কি কোন প্রতিকার কি চিকিৎসা নেই?

কিন্তু ক্লান্ত চোখ দুটি অবসন্ন হয়ে বুজে আসে। এ সব কথা এখন আলোচনা করতে ইচ্ছাও করে না।

মঙ্গলা আবশ্যকীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তবে তুই সব ধুইয়ে মুছিয়ে দিয়ে যা বসনের মা। আমার আবার ঘরদোর পড়ে রয়েছে, কর্তাকে দোর দিতে বলেছি, দিয়েছে কি না জানি না হয়ত ঘুমিয়েই পড়ল। মনটা আমার সেইখানেই পড়ে রয়েছে। আমি এখন যাই

বসনের মাও শেষরাত্রে চলে গেল। ছেলেটা ছেঁড়া কাপড়ে জড়ানো পড়ে রইল নরেন এসে না হয় একটা ব্যবস্থা করবে।

বসনের মা যাবার সময় প্রশ্ন করলো, ‘দোর?’

‘ভেজানো থাক। রাত ত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। উনিও এসে পড়বেন এখন।

ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ। শ্যামার চোখও তন্দ্রায় অবশ হয়ে আসে। তাই সে টেরও পায় না কখন নরেন এসে ঘরে ঢোকে। নেশায় তার চোখ লাল কিন্তু দৃষ্টিতে ঘুমের আমেজ নেই, তাতে ফুলে উঠেছে অপরিসীম ধূর্ততা। নিঃশব্দে ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটলির মধ্যে থেকে ন্যাকড়ায় বাঁধা টাকাগুলো বার করে। সবগুলোই

কন্যাক

নিয়ে চলে যাচ্ছিল, কি ভেবে ঘুরে এসে দশটা টাকা রেখে যেমন এসেছিল তেমনিই নিঃশব্দে চলে গেল।

পরের দিন বসনের মা সকালে এসে ঘুম ভাঙাতে শ্যামা হেমকে বললে টাকা বার ক’রে দিতে। কিন্তু পুঁটলি খুলতেই শ্যামা সব বুঝতে পারলে। লজ্জায় অপমানে ঘৃণায় আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল অনেকক্ষণ। নরেন চামার কিন্তু এ যেন তার পক্ষে ও

বিস্ময়কর আচরণ।

ব্যাপার গতিক দেখে বসনের মা চারটি টাকা নিয়েই চলে গেল। ক্লান্ত শ্যামা মরা ছেলেটাকে দেখিয়ে বললে, ‘ওটার একটা গতি তুমিই করো বসনের মা, যা হোক

মঙ্গলা এসেও শুনলেন।

‘চামার মা, আস্ত চামার! তুমি যাই সতী-সাধ্বী বউ তাই ওর সঙ্গে ঘর করো। ঘেন্না করে অমন ভাতারের নামে। যাক্ গে, তুমি আজ আর উঠো না, আমিই সাবু ক’রে পাঠিয়ে দিচ্ছি, ছেলেমেয়েদেরও খানকতক রুটি গড়ে দিক পিঁটকী। বামুনের ছেলেমেয়ে, ভাত ত দিতে পারব না। বামুন ঠাকরুণ আবার এই সময় দেশে গেলেন

কিনা।

তারপর একটু থেমে দম নিয়ে বললেন, ‘ঐ জন্যেই ত কেবল টিক্‌টিক্ করি দোরটা যদি উঠে দিয়ে রাখতে সোয়ামীই হোক যেই হোক এমন নিঃশব্দে কিছু আর নিয়ে যেতে পারতো না!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *