১৫. শ্যামার যেন এক যুগ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

মেয়ের বিয়ের পর একটা বছর কাটল, শ্যামার যেন এক যুগ। বারো বছরেও মানুষকে বোধ হয় এত দুঃখ, এত কৃচ্ছসাধন করতে হয় না এত দুর্ভাবনা দুশ্চিন্তা ভোগ করতে হয় না। এক-একটা দিন এমন আসে, মনে হয় বুঝি কাটবে না। সামান্য কিছু উপার্জনের পথ হয়েছে এটাও ঠিক, তেমনি হেম ইস্কুলে পড়ছে, ‘ফ্রি’ হ’লেও কিছু খরচ ত আছেই। যখন-তখন যজমানি করতে যেতেও পারে না। তার ওপর আছে মেয়েজামাই আনা, জামাইবাড়ি তত্ত্ব করা।

সে যেন এক সাধনা।

একদিন তখন সবে মাস-কতক বিয়ে হয়েছে

লোকমুখে হেমের খুব জ্বর হয়েছে খবর পেয়ে এক শনিবার জামাই এসে হাজির। ঘরে কিছুই নেই হেমের জ্বর। সরকারদের বাড়ির প্রায় সকলেই মঙ্গলার বাপের বাড়ি কি একটা ক্রিয়াকর্ম উপলক্ষে গেছেন। টাকাপয়সা হাতে নেই কখনোই থাকে না থাকলেই বা আনাত কাকে দিয়ে? এরকম লজ্জায় বোধ হয় জীবনে কোন দিন পড়ে নি শ্যামা। ঐন্দ্রিলা বাগান থেকে কোনমতে বুকে ক’রে নারকেলটা আসটা কুড়িয়ে আনতে পারে বটে কিন্তু তাকে বাজারে পাঠানো চলবে না। বাক্স-প্যাঁটরা ঘেঁটে দশটা পয়সা বেরোল কিন্তু যায় কে? যেতে গেলে ওকেই যেতে হয়। জামাইয়ের সামনে দিয়ে বাজারে যাওয়া? ছি! জামাই যদি দেখতে পায়?

আকশ-পাতাল ভাবল শ্যামা। শরীরটাও ভাল নেই। সদ্য একটি মেয়ে হয়েছে ওর এখনও তিন মাস হয় নি। প্রসবের পর থেকে নানা রোগে ওকে যেন জেরবার ক’রে দিয়েছে ভূতের মত খাটবার শক্তি ত গেছেই, মাথাতেও যেন সব সময় সব কথা

আসে না।

দশটা পয়সা হাতে ক’রে অভিভূতের মত রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে থাকে শ্যামা। শোবার ঘরে হেমকে অসুখের খবর জিজ্ঞাসা করছে জমাই, ঐন্দ্রিলা কি সব বকে যাচ্ছে আপন মনে কোথায় কোন্ আম গাছের ডালে বসে বসন্ত বৌরি পাখিটা কটর কটর

এই সব শব্দের দিকে যেন কান পেতে থাকে সে।

করছে

অনেকক্ষণ পরে–একটা দমকা গরম বাতাসে ওর যেন চমক ভাঙে। ধড়মড় ক’রে উঠে দাঁড়ায়। পথও দেখতে পায় চোখের নিমেষে। ঠিক ত, ডাল ত আছে! আর আছে

সদ্য সিধে-পাওয়া একটু গাওয়া ঘি ও ময়দা। হেমেরই উপার্জন–কি একটা ব্রত করিয়ে পেয়েছে সে।

ডাল ভিজিয়ে দেয় দু-তিন রকম। কাঠ জ্বেলে ছোলার ডাল চাপায়। একটা বার্লির

একটু হালুয়া ক’রে দেওয়া চলবে যেন উৎসাহের জোয়ার লাগে ওর এই ওর সংকল্প। তিন ঘণ্টা পরে

কৌটোর এক কোণে দুটি সুজি পড়ে আছে জামাইকে এখন জলখাবারের মত। হঠাৎ দেহেমনে। বিত্তের দৈন্য বুদ্ধি দিয়ে ঢেকে নেবে যখন জামাইকে খাবার সাজিয়ে দেয় তখন নিজেই অবাক হয়ে যায়। ধোঁকার ডালনা, ছোলার ডাল, পরোটা, রসবড়া, পায়স! পায়সটা নিয়েই বিপদে পড়েছিল প্রথমে, কারণ চিনি বাতাসা মিশ্রি যা কিছু ঘরে ছিল কুড়িয়ে কুড়িয়ে এর আগে হালুয়া আর রসে খরচ হয়ে গেছে। অথচ মিষ্টি আনানো যায় নি, সে অভাবটা শুধু রসবড়া দিয়ে সারতেও যেন কেমন লাগে, তাও তেলেভাজা রসবড়া মায়ের মত ঘিয়েভাজা রসবড়া করবে, সে ঘি কোথায়? এই ত তাই –লুচি ক’রে দেওয়া যায় নি– পরোটা ক’রেই দিতে হয়েছে! অথচ শেতলের দুধটাও ত আছে। অনেক ভেবে শেষে আঁধারে কূল পায়। কিছুদিন আগেই কুন্ডুবাড়ি থেকে ছাঁদা পাওয়া গিয়েছিল, তার দরুন সন্দেশ ক’টা আজও পড়ে আছে হাঁড়িতে। একে চিনির ডেলা সন্দেশ, তায় এতদিনের বাসি সামান্য গন্ধও হয়ে গেছে সে সন্দেশ জামাইকে দেওয়া যায় না ব’লে ও কথা আর মনেই রাখে নি! এখন মনে হ’ল চিনির ডেলা ত চিনির কাজে লাগানো যেতে পারে! মিছিমিছি নষ্ট ক’রে লাভ কি? গন্ধ? বর্ষাকালে ঘরে থাকলে চিনিতেও ত একটু ম’দো গন্ধ হয়। তাছাড়া খুঁজেপেতে যদি একটা ছোট এলাচ বেরোয় বাড়ি থেকে তাহলে গুঁড়িয়ে দিলেই ত গন্ধটুকু ঢেকে যাবে।

বেশ তৃপ্তি ক’রেই খেলে অভয়। কোনদিনই কিছু বলে না কিন্তু আজ ব’লেই ফেললে উচ্ছ্বাসভরে, ‘অনেকদিন এত ভাল খাই নি। রান্না সব হয়েছে যেন অমৃত।’ অভয় এখনও ঠিক ‘মা’ বলে নিঃসঙ্কোচে সম্বোধন করতে পারে না। প্রায় সমবয়সী শাশুড়ীকে মা বলে ডাকতে বোধকরি ওর একটু লজ্জাই হয়।

সেদিনের কৃতিত্ব নিয়ে বেশ একটু গৌরববোধই হয়েছিল শ্যামার। অনেকদিন পর্যন্ত সে-কথা মনে হ’লে আনন্দে গর্বে বুকটা ফুলে উঠত। মঙ্গলাও বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এসে যখন সব শুনলেন, কিছুক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসেছিলেন, কথা কইতে পারেন নি। অনেকক্ষণ পরে বলেছিলেন, ‘তোর ত খুব মাথাখানা খেলে বামনি, আমি ত বাপু সাত রাত ভাবলেও এত কথা মাথা থেকে বার করতে পারতুম না। তা এ ত বেশ ভাল খাওয়াই হ’ল আর কি!’

কিন্তু শুধু কি গর্ব –একটু লজ্জার কথা ও ছিল বৈকি। যত তৃপ্তি ক’রেই খাক বুদ্ধিমান জামাইয়ের চোখে আসল ব্যাপারটা ঢাকা থাকে নি। ঐন্দ্রিলার হাতে একটা টাকা ত দিয়ে গিয়েইছিল, পরের দিন বিকেলে পাড়ারই কে একটি ছেলেকে দিয়ে একরাশ বাজার পাঠিয়ে দিয়েছিল ডুমুর, থোড়, কাঁচকলা –বিনামূল্যের আনাজ, আর তার সঙ্গে কিছু সাগু, মিশ্রি হেমের জন্যে।

লজ্জা বোধ হয়েছিল খুবই, মাথা কাটা গিয়েছিল জামাইয়ের কাছ থেকে এই সাহায্যটুকু– সাহায্য ছাড়া আর কি! নিতে, কিন্তু আনন্দেও চোখে জল এসে গিয়েছিল। এত বিবেচনা যার তার হাতে মেয়ে সুখী হবে, তার মত দুঃখ কিছুতেই

পাবে না।

ভাল

অভয় এলে তার ছেলেমেয়েদের মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে এটাও শ্যামা লক্ষ্য করেছিল। শুধু যে এলেই ওদের হাতে টাকা বা আধুলি দিয়ে যায় তাই নয় খাবার যা কিছু ওর জন্য তৈরি হয় তারও ভাগ পায় তারা। শুধু তারা কেন হেম অসুস্থ সেদিন জামাইয়ের পাতে যা ছিল তা ঐন্দ্রিলার পক্ষে সব খাওয়া সম্ভব নয় এই অজুহাতে কি সেও খায় নি সে সব খাবার? অনেক ইতস্তত করেছিল অবশ্য জামাইয়ের পাতের উচ্ছিষ্ট খাবার আগে– কিন্তু শেষ পর্যন্ত লোভের আর প্রয়োজনেরই জয় হয়েছিল। ঘরে কিছুই নেই, শরীর দুর্বল, সদ্য-প্রসূতির অসহ্য ক্ষুধা সামলানো শক্ত। খেয়েছিল এবং খেয়ে খুশীই হয়েছিল। সে কথা মনে পড়লে এতকাল পরেও লজ্জা হয় কিন্তু সেদিন উপায় ছিল না।

দুই

লোভ

শ্যামা অনেকদিন ধরেই ভাবছে যে কলকাতায় যাবে কিন্তু আগেকার মত যাওয়াটা আর তার সহজ নেই বলেই হয়ে ওঠে নি। অথচ যাওয়াটা তার প্রয়োজন এবারের প্রসবের পর থেকে শরীরটা যেন কিছুতেই সারছে না। কিছুদিন শুধু বসে খেতে পারলেও বোধ হয় একটু বল পেত সে। কিন্তু এদিকে হেমের ইস্কুল। তার বাঁধা বন্দোবস্তের নিয়ম-পূজা রয়েছে দু-দুটো। অথচ হেমকে ফেলেই বা যায় কি করে? কে তাকে খেতে দেবে কে দেখবে? এই সাতপাঁচ ভেবেই তার যাওয়া হয় না দেহটাকে যেন চাবুক মেরে চালায়।

ক্লান্ত

মার শরীর একেবারে ভেঙে পড়েছে–

এরই মধ্যে চিঠিটা এল। লিখেছে উমা

| ডাক্তার বলেছে চেঞ্জে নিয়ে যাওয়া দরকার। মাকেও রাজী করানো গেছে, এখন যাবার আগে মা তাঁর তিন মেয়েকেই একবার একসঙ্গে দেখতে চান আর ফেরেন কি না ফেরেন তার ঠিক কি! শ্যামা কি দু-চার দিনের জন্য আসতে পারবে?

শ্যামা ব্যাকুল হয়ে উঠল চিঠি পড়ে, হওয়াই স্বাভাবিক। মা শুধু মা-ই ত নন এখনও তার ভরসা, আশ্রয়। চরম কোন অবস্থায় পড়লে মার কাছে গিয়ে দাঁড়ানো যাবে, তা সে জানে। মার কি আছে –কতকুটু আছে, সে খবর সে রাখে না। তবে মা চালাবেনই যেমন ক’রে হোক। এই বিশ্বাসটা মনের গোচরে কিছু বা অগোচরে আছে বলেই এমন ক’রে জীবনযুদ্ধ চালাতে পেরেছে শ্যামা। পেছনে কোথাও আছে ভরসা, আছে শেষ নিরাপদ অবলম্বন, এই জ্ঞান বা অনুভূতিই দিয়েছে তাকে শক্তি। সেই অবলম্বন কি শেষে ভেঙে পড়বে? এত তাড়াতাড়ি, এমন অসময়ে? এখনও যে হেম মানুষ হয়ে উঠল না! এখনও যে

ওও এইটেই বোধ হয় স্বাভাবিক

স্বার্থপরের মত শোনালেও এইটেই বোধ হয় স্বাভাবিক। কোন দুঃসংবাদ শুনলে মানুষের প্রথম প্রতিক্রিয়া হয় তার স্বার্থের স্থানটিতেই। শ্যামাকে তাই দোষ দেওয়া যায় না।

109

যাওয়া প্রয়োজন—-আর এখনই।

শুধু যে মাকে শেষ-দেখা তাই নয়, কোথায় আর তাঁর কি আছে, কতটুকু তার হেমের পাওনা সেটাও জানা দরকার।

কিন্তু যাওয়া কি সম্ভব!

এমন সময়

চিঠি হাতে নিয়ে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে শ্যামা, অশ্রুসজল দৃষ্টি, একমুঠো পানের খিলি মুখে পুরে চিবোবার চেষ্টা করতে করতে দেখা দিলেন মঙ্গলা। ‘কী হয়েছে রে বামুন মেয়ে? অমন কাঁদো কাঁদো হয়ে বসে আছিস কেন? ওমা হাতে ঠিঠি যে কোন খারাপ খবর নাকি? মা মাগী ভাল আছে ত?’ রুদ্ধ কণ্ঠ ভেদ ক’রে কথাগুলো বেরিয়ে আসে।

কেঁদেই ফেললে শ্যামা উত্তর দিতে গিয়ে।

সব শুনে মঙ্গলা বললেন, ‘এখনই চলে যা। এখনই। হেম থাক না, আমরা দেখব এখন। আমি না হয় এসে রাত্রে থাকব’খন। ভয় কি?’

‘কিন্তু ওর খাওয়া-দাওয়া?’

তাই ত!’ একটুখানি চুপ ক’রে গেলেন মঙ্গলাও

তারপরই আবার তাঁর মুখ

উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘তা সে-ও একরকম ক’রে হয়ে যাবে এখন। আমি কি পিঁটকী যদি ভাতটা চাপিয়ে দিই, তাহলে কোন রকম ক’রেও নামিয়ে নিতে পারবে না?’

হেম কাছেই বসেছিল, সে বললে, ‘তা বোধ হয় পারব- দেখিয়ে দিলেই পারব।’ উৎসাহিত হয়ে ওঠেন মঙ্গলা, ‘তোদের ত আতপ চালের ভাত

ফ্যানেভাতে খাওয়াও অভ্যাস আছে। এমন ভাবে জল দেব যে ফ্যানও গালতে হবে না। আর আমার ওদিকে আ-সকড়িতে যা ডাল তরকারি হয় দিয়ে যাবো’খন। রাত্রে দুখান রুটি গড়ে ও দিতে পারবে। তুই নির্ভরসায় চলে যা বানি, আমি তোর ছেলেকে দেখব।

আর উনি ত রাঁধুনী রাখবেন বলে আবার চেষ্টা করছেন। আমারও শরীর খারাপ, পিঁকীও গুছিয়ে রাঁধতে পারে না। রাঁধুনী পেলে আর ভাবনা কি, আমাদের ওখানেই খাবে। পাওয়া যায় ঢের, তবে কি জানিস, সোমথ মেয়েছেলে আমি রাখব না। সে আমার এক কথা খেতে পাই আর না পাই! ওদের দোষ ওই, এসেই কত্তাটিকে গিলে খাবার চেষ্টা করে। হুঁকো ব্যাটাছেলেও চলবে না। সোমথ সোমখ মেয়ে আমার ঘরে। তাই ত মুশকিল! যেটা ছিল তাকে ত আমিই তাড়ালুম বলতে গেলে। আমার যে হয়েছে শতেক জ্বালা চোরছ্যাঁচোড় না হয় তাও দেখতে হবে ত!’

তারপর একটু থেমে পানের পিচ ফেলে আবার বললেন, ‘তুই কাল সকালেই চলে যা।’

রাসমণির শরীর কিছুদিন ধরেই ভাঙছিল। কমলা ও উমার চিঠিতেও ওঁর অসুখের খবর পেয়েছে সে কিন্তু সত্যিই যে এত খারাপ হয়েছে তা শ্যামা কল্পনা করে নি। অমন রাজেন্দ্রাণী মূর্তি যেন শুকিয়ে ঝলসে কুকড়ে গেছে। উজ্জ্বল গৌরবর্ণে কালি মেখে দিয়েছে কে। দাঁতগুলো পড়ে গেছে সব কটাই। নিত্য জ্বর হচ্ছে খুব সম্ভব ম্যালেরিয়া, কিন্তু ডাক্তার ডাকতে দেন নি এতকাল। পাড়ার এক বৃদ্ধ কবিরাজ চিকিৎসা

করছেন

কিছুতেই যখন কিছু হয় নি তখন কমলা একদিন জোর ক’রে ডাক্তার নিয়ে

এসেছে। তিনি দেখে ওষুধ দিতে জ্বর ওঠাটা বন্ধ হয়েছে কিন্তু একেবারে ছাড়ে নি। বিকেলের দিকে গা-গরম হয় প্রত্যহ। ডাক্তারবাবু বলেছেন হাওয়া বদল করতে হবে নইলে এ পুরোনো জ্বর ছাড়বে না কিছুতেই। আর হাওয়া বদল করতে গেলে পশ্চিমে যাওয়াই দরকার। দেওঘর গেলেই ভাল হয়

চান রাসমণি ত বর্ধমান কিংবা নলহাটি যেতে পারেন

তবে অতদূর যদি না যেতে জল-হাওয়া ভাল, উপকার

নিয়ে যেতে

হবে। নলহাটি ত আবার তীর্থস্থান, ললাটেশ্বরী আছেন, বাহান্নপীঠের এক পীঠ।

রাসমণি অনেক ভেবেছেন। উমাকে একা ফেলে যাওয়া চলবে না হবে। এ বাড়িতে কে থাকবে? কমলা হয়ত রাজী হ’তে পারে। কিন্তু তিনিই বা একা যান কার ভরসায়? এই দুর্বল দেহ, তাছাড়া কখনও একা কোথাও যান নি, কলকাতার বাইরে কোথাও যাওয়া অভ্যাস নেই। কে সঙ্গে যাবে?

কিন্তু সে ব্যবস্থাও কমলা ক’রে দিলে। ওদের বৃদ্ধ পুরোহিত– রাঘব ঘোষাল বহু তীর্থ ঘুরে এসেছেন, বিদেশ যাওয়া তাঁর অভ্যাস আছে, তিনি সঙ্গে যেতে রাজী হলেন। খরচ আর খোরাক দিলেই তিনি যাবেন, তাঁর কোন অসুবিধা নেই। তাঁর ছেলে বড় হয়েছে, যজমানী সে-ই বজায় রাখতে পারবে মাঝখান থেকে তাঁর শরীরটাও সারিয়ে নিতে পারবেন।

এবার আর রাসমণি ‘না’ করতে পারলেন না। তাছাড়া তিনি চিরদিনই একরোখা মানুষ, তেজের সঙ্গে থাকতে ভালবাসেন। এমন অকর্মণ্য জবুথবু হয়ে, মেয়েদের সেবার ওপর ভরসা ক’রে থাকা তাঁর পক্ষে মৃত্যুর সমান। এতকালের গঙ্গাস্নান তাঁর– কোনদিন কোন কারণে যা বন্ধ করেন নি তা বন্ধ হয়েছে, সেটা যেন আরও কষ্টকর। মনে আছে প্লেগের বছরে যখন সারা কলকাতা শ্মশান হয়ে গিয়েছিল, তখনও তিনি প্রত্যহ ভোরে উঠে স্নান করতে গেছেন। রাস্তার দুধারে বড় বড় খালি বাড়িগুলো হাঁ-হাঁ করছে, নিস্তব্ধ পথ যেন গিলতে আসছে, তবু রাসমণি ভয় পান নি। তিনি পালানও নি মৃত্যুকে ত্বরিত মৃত্যুকে তাঁর ভয় নেই। শহর উজাড় ক’রে পালিয়েছে সব, স্ক্যাভেঞ্জার গাড়িগুলো ধুয়ে তাতে বসে পালিয়েছে সপরিবারে—- গাড়ির অভাবে। ঐ গাড়িগুলোই নিয়েছে পনরো-বিশ টাকা– এখান থেকে চন্দননগর কি চুচঁড়ো যেতে। দেখেছেন আর হেসেছেন। প্রাণ কি এমন ক’রেই এরা ধরে রাখতে পারবে চিরকাল! এমন কি পুলিস থেকে যখন ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে নিমতলায় গঙ্গাস্নান যাওয়া বন্ধ করলে- তখনও রাসমণি বিচলিত হন নি– শুধু সময়টা একটু এগিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র। রাত চারটেয় যেতেন– তিনটেয় যাওয়া শুরু করলেন। অত ভোরে পুলিশ থাকবে না তা তিনি জানতেন।

না ভয় পাবার মেয়ে রাসমণি নন। তখন মৃতদেহের সংখ্যা বেশি বলে হুকুম হয়েছিল দু-ঘন্টার বেশি কেউ চিতা জ্বালাতে পারবে না। ঐ দু-ঘণ্টায় যা পুড়ল –বাকী যা থাকবে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে হবে। সেইজন্যই গঙ্গাস্নান আরও নিষিদ্ধ হয়েছিল। এই রকমই একটা কন্ধ-কাটা শব ভেসে এসে স্নানের ঘাটে সিঁড়ির নিচে আটকে ছিল রাসমণি ঘাটে নামতে গিয়ে পা দিয়ে ফেলেছিলেন তার গায়ে কিন্তু চেঁচিয়ে ওঠেন নি, সেখান থেকে ছুটে পালান নি– কোন রকমেই বিচলিত হন নি। বরং হেঁট হয়ে আছা

১৫৯-

আলোয় ব্যাপারটা ভাল ক’রে দেখে বুঝে ‘নমঃ শিবায়’ বলে এক গন্ডুষ জল ছিটিয়ে দিয়েছিলেন তার গায়ে, তারপর তাকে প্রদক্ষিণ ক’রে গঙ্গায় নেমে গিয়েছিলেন। সঙ্গে যে শুকনো তসরের কাপড়খানা ছিল সেটাও অপবিত্র হ’ল মনে করেন নি।

বাড়িতে এসে কথাটা বলতে উমা চেঁচামেচি ক’রে উঠেছিল ভয়ে। রাসমণি হেসে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘ওমা, ভয় কি? অগ্নিদগ্ধ হয়ে গঙ্গায় পড়েছে, ও কি ভূত হয়ে আমাকে তাড়া করবে? ও শবও যা শিবও তাই।’

‘কিন্তু অসুখটার ভয়ও ত আছে। ঐ ছোঁয়াচে রোগ যদি লাগে? দুদিন গঙ্গা নাওয়া বন্ধ করলে কি হয়?’

‘হ্যাঁ কি না কি, আমি গঙ্গা নাওয়া বন্ধ করব! আমার ও রোগ লাগবেই বা কেন? ও সব যারা মরছে তারা কি জানিস মা, বছুরকে মড়া ওরা বছর বছরই মরে। একটা ক’রে হুজুগ ওঠে আর গন্ডায় গন্ডায় মরে। আমি মরব কেন?

সেই গঙ্গা-নাওয়া আজ তাঁকে বন্ধ করতে হয়েছে! এইটেই চরম ব্যথা।

জীবনের যত বেদনা, যত ব্যথা পুঞ্জীভূত যত গ্লানি, সব ভুলিয়েছে মা জাহ্নবীর ঐ সর্বদুঃখহরা শীতল জল। চোখের গরম জল দিনের পর দিন মার ঠাণ্ডা জলে ঝ’রে পড়ে বুকের তাপ ঠাণ্ডা করেছে। ওঁর উষ্ণ দীর্ঘনিঃশ্বাস মিশেছে মার বুক থেকে ভেসে- আসা তাপনাশা বাতাসে করেছে তাঁকে শান্ত, সমাহিত। সহ্য করার শক্তি খুঁজে পেয়েছেন, পেয়েছেন আবারও যুদ্ধ করার শক্তি দুঃখের সঙ্গে, দুর্ভাগ্যের সঙ্গে।

গঙ্গা ত শুধু তাঁর নেশা নয় নিবেদন করেছেন দিনের পর দিন নিজের জীবন দিয়ে অনুভব করেছেন ঊর্মিমুখর স্রোতে! কি দয়া মা গঙ্গার

তাঁর আশ্রয় যে! সব সব দুঃখ তিনি ঐখানে

নইলে বোধ হয় তিনি পাগল হয়ে যেতেন।

কি শান্তি, কি অভয় লুকিয়ে আছে মার ঐ তা রাসমণি ছাড়া বুঝি আর কেউ জানে না। সেই গঙ্গাস্নান তাঁর বন্ধ হল বেঁচে থাকতেই —-! কতকটা সেই জন্যেই বোধ হয় রাজী হয়েছেন রাসমণি বিদেশে যেতে।

কিন্তু যদি যেতেই হয় ত বর্ধমান নলহাটি কেন– দেওঘরই বা কেন যাবেন কাশীতেই। একটু সুস্থ হয়ে যদি বাবার মাথায় এক ঘটি জল ঢালতে পারেন কোন দিন ত সেটাও হবে একটা লাভ। এ জীবনে কোন তীর্থেই প্রায় কখনও যাওয়া হয়নি। মরবার আগে কাশীতে একবার গেলেও সান্ত্বনা পেতে পারেন।

কাশীই যাবেন তিনি। রাঘব ঘোষালকে বলে দিয়েছেন, পান্ডাকে চিঠি লিখে ঘর ঠিক করতে।

তিন

শ্যামা এসে দাঁড়াতে যেমন শ্যামার দু’চোখ দিয়েও জল ঝরে পড়ল, তেমনি রাসমণির চোখও শুষ্ক রইল না। এ কি চেহারা হয়েছে তাঁর শতদলের মত রূপসী মেয়ের? এ যে কঙ্কাল! এর আগেও অনাহার-শীর্ণ দেহে অনেকবার এসে দাঁড়িয়েছে সে

–কিন্তু এত দুর্বল তাকে কখনও দেখেন নি।

১৬০

নিজের রোগশীর্ণ কম্পিত হাতখানি ওর গায়ে-মাথায় বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘তুই যাবি মা আমার সঙ্গে? চল্! তোর শরীরও সারবে।

‘আমি? কাশী যাবো?’

‘হ্যাঁ– চল না। তাহলে উমাকে আর নিয়ে যাই না। ওরা দুজনে এখানে থাক। উমারও মেয়ে পড়ানোর ক্ষতি হয়

‘কী পড়ানো!’

উমা পাশে এসে বসেছিল, মাথা হেঁট ক’রেই বসেছিল, এবার চোখ তুলে শ্যামার চোখের দিকে চেয়ে বললে, ‘তুমি জানো না তোমাকে বলাও ত হয় নি! আমি এই পাড়াতেই মেয়ে পড়াচ্ছি। এখন অনেকেই মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চায়, কিন্তু লোক পায় না। ছোট-বড় অনেকগুলি মেয়েকে আমি পড়াচ্ছি। কোন কোন বাড়িতে বৌ এমন কি গিন্নীরা সুদ্ধ পড়ছে-’

‘তুই –তুই বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়িয়ে আসছিস?’

‘কী করব বলো? তারাই বা আমার বাড়ি আসবে কেন? কেউ কেউ হয়ত আসতে পারে, কিন্তু সবাই আসতে চাইবে না!’

শ্যামার তবু যে বিশ্বাস হয় না, ‘আমাদের বাড়ির মেয়ে, বাড়ি বাড়ি ছেলেমেয়ে পড়িয়ে বেড়াচ্ছিস্!’

উমার মুখ আগুন-বর্ণ হয়ে উঠল। সে একটু কঠিন কণ্ঠেই বললে, ‘তোমার ওখানে বুঝি আয়না নেই ছোড়দি? এই বাড়ির মেয়ে নারকোল আর ঝাঁটার কাঠি নিয়ে বাজারে গিয়ে বেচে আসছে সেটা দ্যাখো নি?’

তা বটে। শ্যামা এবার মাথা হেঁট করে। রাসমণির দেহেরই শুধু পরিবর্তন হয়নি

মনেরও হয়েছে। নইলে তিনি কৈফিয়ত দেবার মানুষ নন। আজ যেন কতকটা সেই সুরেই কথা বললেন, ‘কি করব বল্‌― ও যখন বললে, আর না বলতে পারলুম না! সত্যিই ত, কি খাবে? আর ত কিছুই নেই। আমিই যদি দুটো দিন বেশি বাঁচি, আমাকে কে খেতে দেবে সেই ত এক ভাবনা। কম্‌লির ত ঐ ষোল টাকা ভরসা! বড় জামাই থাকলে তিনিই দেখতেন। তবু ত ওর পেটটা চলবে!

শ্যামার বিষয়বুদ্ধি এবার উগ্র হয়ে ওঠে, ‘কত ক’রে পায়?’

‘মেয়ে পিছু দু টাকা কোথাও কোথাও এক টাকাও আছে। তিনটে মেয়ে এক জায়গায় পড়ে, তারা দেয় চার টাকা। মোটমাট মন্দ হয় না, কোন কোন মাসে ষোল- সতেরো টাকাও পায়।

‘কখন যাস্ রে?’শ্যামা এবার সোজাসুজি উমাকেই প্রশ্ন করে।

‘এই খেয়েই বেরুই। এগারোটা নাগাদ। সন্ধ্যের সময় ফিরে আসি। সবই এই পাড়াতে।’

রাসমণি নিজের প্রশ্নের জের টানেন, ‘কি বলিস, যাবি?’

‘আমার এই ছানাপোনা নিয়ে?’

উমা বললে, ‘ঐন্দ্রিলা না হয় থাকৰে

কলকাতার ক

দর কাছে।

দিকে নিয়ে যাও।’

১৬১

‘কিন্তু হেম? হেমকে একা ফেলে এসেছি যে। কি করছে ছেলে-মানুষ ভাত রেঁধে খেতে হচ্ছে, হাত-টাত যদি পুড়িয়ে ফেলে?’

এবার সকলেই চুপ ক’রে যান।

নিজেকে

শ্যামার মন কিন্তু দুলতেই থাকে লোভে। কাশী সমস্ত বাঙালীর মেয়েরই স্বপ্ন সুদূর স্বপ্ন। আজকের মত তখন অত বেড়াতে যাওয়ার চল হয় নি। কাশীতে আর শ্রীক্ষেত্রে জীবনে একবারই যেতে পারত মানুষ, তাও অনেক চেষ্টাচরিত্র করলে।

সারাদিন ভেবে ভেবে শ্যামা একখানা চিঠি লিখলে হেমকে, জোড়া পোস্টকার্ড দিয়ে।

দুদিন পরে উত্তর এল– অভাবনীয় সুসংবাদ। মঙ্গলা এক বুড়ী রাঁধুনী পেয়েছেন। হেম ওঁদের ওখানেই খেতে পারবে মঙ্গলা অনুমতি দিয়েছেন

যতদিন খুশি মার সেবা ক’রে যেন আসে বামুনমেয়ে। পিঁকীর যে ছেলেটা প্রায় হেমের সময়বয়সী সে-ই হেমের সঙ্গে শুচ্ছে, ওরা অনবরত খবর নিচ্ছেন। কোন ভয় নেই।

শ্যামা বাঁচল। স্থির হ’ল কমলা এখানে এসে উমার কাছে থাকবে, ঐন্দ্রিলাকে ওরাই দেখাশুনা করবে। শ্যামা যাবে ওঁদের সঙ্গে।

পাঁজিপুথি দেখে মোটঘাট বেঁধে একদিন রওনা হ’লেন। সঙ্গে গেলেন রাঘব ঘোষাল এবং তাঁর ছোট ছেলে সত্যহরি বছর ষোল বয়স, রাঘবও বুড়ো হয়েছেন, রাসমণির এই অবস্থায় একা তিনি সামলে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা সন্দেহ হ’ল শেষ পর্যন্ত, তাই এই ব্যবস্থা। সত্যহরি আর কিছু না করুক ছুটোছুটি ত করতে পারবে। অনেক ভেবে তার খরচও বহন করাই শ্রেয় বোধ হ’ল। যাওয়া-আসা গাড়িভাড়া গোটা আষ্টেক টাকা আর এক মাস খেতে কাশীতে আর কতই বা

লাগবে বড় জোর চার টাকা।

শ্যামার মনে হ’ল এই পয়সায় হেমকে আনা চলত। আহা, যদি নিত্য-সেবার কাজগুলো না থাকত!

রাসমণি এর মধ্যে তিন-চারবার বলেছেন যে তাঁর আর কিছুই নেই। একজোড়া যশম বিক্রি ক’রে এই একশ টাকার ব্যবস্থা করেছেন। আর যা রইল, যদি বছর তিনেকের বেশি বাঁচেন ত কুলোবে না, উমার উপার্জনের ওপর নির্ভর করতে হবে। একটা বাড়িতে আলাদা থাকার যে বিলাস, তাও আর চলবে না।

কিন্তু শ্যামার কথাটা বিশ্বাস হয় নি। সে আরও সেইজন্যেই সঙ্গে যাচ্ছে। ঠিক আর কতটা আছে কী কী আছে সেটা ভাল ক’রে জানতে চায় সে। ঐন্দ্রিলার বিয়েটাও যদি ওঁর ওপর দিয়ে সেরে ফেলা যেত। ঐন্দ্রিলাটা যে বড়ই ছোট।

কমলা আর গোবিন্দ গিয়েছিল তুলে দিতে। সঙ্গে পাড়ারই একটি ছেলে নিয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসে পালকি থেকে নামতেই প্রথম যার সঙ্গে চোখোচোখি হল সে নরেন। একমুখ খোঁচা-খোঁচা গোঁফদাড়ি, হাঁটু পর্যন্ত ধুলো, খালি পা, একটা ছেঁড়া মেরজাই গায়ে বাইরের রকে উবু হে সে আছে। পাশে একটা গামছায় কী পুঁটুলি বাঁধা।

কমলাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বিনা ভূমিকাতেই বললে, ‘দ্যাখো দিকি দিদি, উমির কি আস্পদ্দা! আমাকে দেখে দোর খুললে না, বলে কি না দিদি আসুক। কেন আমি কি বাঘ না ভালুক?’

‘তার চেয়ে বেশি যে ভাই, চোর-ছ্যাঁচোড় বাঘ-ভালুকেরও বাড়া। ‘

‘তুমিও এই কথা বললে দিদি?’ আহত কণ্ঠে বলে নরেন।

‘তুমিই ত বলাও। আমি কি আর বলি। চলো চলো, ভেতরে চলো।’

ভেতরে এসে চৌবাচ্চা থেকে জল নিয়ে পা ধুতে ধুতে বললে, ‘বাড়ি ফিরে খোকার মুখে শুনেই আমি ছুটতে ছুটতে এলুম। তা হেঁটে আসা ত–তোমাদের মত গাড়ি পালকি চড়ার ক্ষ্যামতা ত আমার নেই ঠিক তোমরা বেরিয়েছ আর আমি এসেছি।

তা আমার পরিবার কি সত্যিই চলে গেল?’

‘গেল বৈকি। গাড়িতে তুলে দিয়ে এলুম।’

‘কিন্তু এটা কি শাশুড়ী ঠাকরুণের নেয্য কাজ হয়েছে? তুমিই বলো দিদি। উনি ত এত সভ্য-ভব্য মানুষ –আমার পরিবারকে আমার বিনা-হুঁকুমে তিনি কোন্ আইনে নিয়ে যান?’

‘তোমার পরিবার তোমার হুকুমে চলবে সে অবস্থা কি তুমি রেখেছ? পরিবারকে খেতে দাও তুমি?’

‘দিই নে ত কি? বলি হেম যে নিত্যি-সেবার কাজ করছে আমি যদি এসে কেড়ে নিই?’

‘তাহলে ত বাঁচে ও। তুমি খেটে ওদের খাওয়াবে

করছে সে তোমার ভাগ্যি।’

সেটা কার কাজ?

সেইটেই ত নিয়ম। হেম

‘ইস্, ভারি নিয়ম! আমি খাটব আর ঐ গোরবেটার জাত বসে খাবে!’

কমলা চুপ ক’রে যায়। ইতরটার সঙ্গে মিছিমিছি বকে মুখ ব্যথা করা।

পুঁটুলি খুলে হুঁকো কলকে চকমকি বার করে নরেন। তামাক ধরাতে ধরাতে বলে, হুঁ। তা কে কে গেল সঙ্গে?’

‘মা,শ্যামা, রাঘব ঘোষাল আর তার ছোট ছেলে সত্যহরি।’

‘কে, কে গেল?’ তীক্ষ্ম হয়ে ওঠে নরেনের কণ্ঠ, ‘রাঘব ঘোষাল, সে আবার কে? কত বয়স?’

‘ওরে বাবা, আমাদের সেই বুড়ো পুরুত! তোমার বিয়েও সে-ই দিয়েছে। তার প্রায় ষাট বছর বয়স

‘হলোই বা ষাট। এমন কিছু বড়ো নয় দিদি। আমার এক যজমান সাতষট্টি বছর বয়সে চতুর্থ পক্ষে বিয়ে করেছে তারপরও তার তিনটে ছেলেমেয়ে!’

কমলা ক্লান্তভাবে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল। সেইভাবেই চুপ ক’রে বসে রইল। মনটা ভাল নেই। মা ঐ অবস্থায় গেলেন, সুস্থ হয়ে ফিরেন কি না কে জানে! তারও ত মাথার ওপর মা ছাড়া আর কেউ নেই।

হঠাৎ কানে আবার সেই তীক্ষ্ণ কণ্ঠের প্রশ্ন পৌঁছয়, ‘আর

সত্যহরি না ফত্যহরি তার বয়স কত?’

১৬৩

ছেলে কি যেন বললে

‘পনরো-ষোল হবে।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় কমলা।

‘ওমা, তবে ত যুবো ছেলে! তা গাড়িতে কে কোথায় বসল?

‘সবাই এক গাড়িতে উঠেছে। মার শরীর খারাপ, মেয়ে-গাড়িতে তুলতে ভরসা হ’ল না।

‘তবেই ত বললে ভাল। তা আমার পরিবারের পাশে কে বসল?

‘মা।’

‘সে ত গেল এক পাশে। আর এক পাশে?’

‘আর একদিকে পুরুত ঠাকুর আছেন, ভয় নেই। ‘

‘হুঁ। তাহলে আমার পরিবার বসেছে রাঘব ঘোষাল আর শাশুড়ী মাগীর মাঝখানে? আর সেই ছোঁড়াটা? সে আবার মাঝরাস্তায় গিয়ে আমার পরিবারের পাশে এসে বসবে না ত?’

কমলা উঠে দাঁড়ায় এবার, রাগ ক’রে বলে, ‘অত আমি জানি না, ইচ্ছে হয় উড়ে গিয়ে দেখে এসো গে।’

‘বা রে, বেশ মজা ত! আমার পরিবার কার পাশে বসে যাচ্ছে আমি খবর নেব না?’ ততক্ষণে কমলা ওপরে উঠে গেছে। সেদিকে চেয়ে বসে খানিকটা তামাক টানবার পর একসময় কতকটা আপন মনেই ব’লে উঠল, ফিরে আসুক একবার। গোরবেটার জাতকে এক কোপে যদি সাবাড় না করি ত আমার নাম নেই।’

ওপর থেকে মুখ বাড়িয়ে উমা প্রশ্ন করলে, ‘রাত্রে খাবে নাকি এখানে?’

*ও হরি, শউর বাড়ি এসেছি

খাবো না? একটু ভালো ক’রে মৌরী বাটা দিয়ে

ঘন ঘন বিউলির ডাল রাঁধ দিকি উমি, অনেকদিন খাই নি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *