দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।
হেম একসময় আট বছরে পড়ল। কথাটা অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। যেখানে এক বছরও কাটবার কথা নয় সেখানে এক কাল কি ক’রে কাটল ভেবেই পায় না শ্যামা।
চুরি ক’রে করে সংগ্রহ করে শ্যামা। শুধু শ্যামাই বা কেন
―
‘
সরকারদের প্রকান্ড বাগানের পাকা তাল, নোনা, আতা, নারকেল, পেঁপে, কলা
হেম, মহা সবাই।এটা আর গোপনও নেই সরকাররা সবাই জানে। এখন শুধু চলে লুকোচুরি খেলা পিঁটকীর ছেলেটা সব চেয়ে বড় শত্রু, সে আজকাল প্রায় সারাদিনই বাগানে বসে থাকে, আর ওদের কারও টিকি দেখলেই নাকে কাঁদে, ‘ও মা দ্যাখো, আবার ওঁই বামুনগুলো এঁসেছে চুরি করতে ও মা –‘
আর মহা, ওদেরই কাছে শুনে শুনে গালাগাল শিখেছে, সে আধো-আধো কণ্ঠেই আঙুল মটকে শাপ দ্যায়, ‘হতচ্ছাড়া ছেলে মরেও না– মর্ মর্
এইভাবে চলে টানাটানি যখন ধরা পড়ে তখন চোরের মার খায় একদিন, বামুনের ছেলে ব’লে রেয়াৎ করে না কেউ। শ্যামা দিনের আলোয় ও চেষ্টা করে না রাত্রির অন্ধকারে গা ঢেকে ঘুরে বেড়ায় নিশাচরী প্রেতিনীর মত। আগে আগে সরকারেরা ভয় পেত, সত্যি-সত্যিই ‘অন্যি দেবতা’ মনে ক’রে চিৎকার ক’রে রামনাম করতে করতে দৌড়ত, অন্ধকারের মধ্যে সাদা কাপড় পরা ওকে দেখে কিন্তু ক্রমে কথাটা জানাজানি হয়ে পড়ায় তারাও নির্ভয়ে বেরোয় বাগানে। তাল কি নারকেল পড়ার শব্দ হ’লেই দু দলে চলে প্রতিযোগিতা কে আগে আসতে পারে! সরকারদের ছেলেমেয়েরাও নির্ভয়ে বেরিয়ে আসে–বামনী ত আছেই বাগানে, ভয় কিসের?
যেদিন শ্যামা আগে পৌঁছয়, ফল সংগ্রহ ক’রে নিয়ে নিঃশব্দে ফিরে চলে আসে। ওরা সারা বাগান তোলপাড় ক’রেও কিছু খুঁজে পায় না। তখন ফিরে যাবার সময় হেমদের জানালার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গালাগাল দিয়ে যায়, ‘বামুন না ঘোড়ার ডিম! চোর, চোর সব! চোর আবার বামুন হয়? মর্ মর্
. ওলাউঠো হোক্!’ কিন্তু শুধু ত সংগ্রহ করাই নয় . তা থেকে কিছু অর্থ সমাগমও প্রয়োজন। সেটা আরও কঠিন। পাড়াগাঁয়ে সবাই কিছু কিছু জমি নিয়ে বাস করে ফল- ফুলুরী সব্জী প্রত্যেকের বাড়িতেই হয়, সুতরাং পাড়াঘরে এসব কেনবার লোক নেই। বিক্রি হয় সুদূর শিবপুরের বাজারে পাঠালে
কিংবা আর’ দূরে
শালিমারে।
একসঙ্গে সব কিছু সংগ্রহ হয় না। রোজ রোজ অত দূরে যায় কে? কাজেই অধিকাংশ দিনই ঐ সব পাকা ফল খেয়ে ফেলতে হয়, ঐ খেয়েই জীবনধারণ করতে হয়। যেদিন দু’রকম জিনিস জমে সেদিন শ্যামা বেরোয় খদ্দেরের খোঁজে। তাও পাহারার শেষ নেই। অনেকক্ষণ একটা একটা ক’রে জিনিস সরিয়ে কোন গোপন স্থানে রেখে আসে, তারপরে মা ছেলে দু’ পথে গিয়ে সেখানে মিলিত হয়। মহা একা বাড়ি থাকে। শ্যামা মাল বয়ে নিয়ে গিয়ে বাজারের কোথাও গাছের আড়ালে অপেক্ষা করে, হেম ভেতরে গিয়ে বিক্রি করে। দর একেই কম ছেলেমানুষ দেখে আরও কম দেয়
অর্থাৎ এত
কান্ড ক’রে, এত পথ হেঁটে পয়সা মেলে কোনদিন দু আনা, কোনদিন দশ পয়সা, কোনদিন বা আরও কম। ফেরবার পথে যেদিন হেম রৌদ্রের তাপে আউতে-ওটা দোলনচাঁপার পাপড়ির মত নেতিয়ে পড়ে সেদিন বড়জোর এক পয়সার বাতাসা কিনে মায়ে-বেটায় কোন পুকুরপাড়ে বসে একটু জল খেয়ে নেয়। তার চেয়ে বেশি খরচ করতে ভরসা হয় না, কারণ ঐ সামান্য পয়সাতেই চাল কিনতে হবে আজকাল এই ভাত খাবার দিনগুলো ওদের কাছে মহোৎসবের দিন।
হয়
—–
আর এত কষ্টের পর যেদিন চালান করার মুখে ছেলেমেয়েরা ধরা প’ড়ে নির্যাতিত মালও হয় বাজেয়াপ্ত, সেদিন শ্যামা অন্তরালে থেকে অসহায় ভাবে মাথা খুঁড়ে কপাল ফুলিয়ে ফেলে শুধু কোন প্রতিকারই করতে পারে না। আর সে নির্যাতনেরও নব নব রূপ দস্তুরমত যেন গবেষণা ক’রে বার করা হয়। একদিন-বা হাতে বেঁধে গায়ে আলকুশী ঘষে দেওয়া হ’ল আর একদিন হয়ত বিছুটি ঘষে জল ঢেলে দিলে গায়ে। এমনি নানারকম কৌশল। সব চেয়ে কষ্ট হয়েছিল শ্যামার যেদিন সত্যিই অপরের বাগান থেকে চেয়ে আনা একটা নোনার জন্য মহাশ্বেতাকে শীতের বিকেলে পুকুরের জলে ডুবিয়ে ওর মাথায় পা দিয়ে চেপে রইলেন অক্ষয়বাবু স্বয়ং, চোর বলেই ধ’রে নিলেন,কোন কথাই বিশ্বাস করলেন না। দু’তিন মিনিট ঐভাবে থেকে হাঁপিয়ে মেয়ে যখন নীল হয়ে উঠেছে তখন হেমের মুখে সব কথা শুনে শ্যামা আর থাকতে পারলে না, ছুটে এসে জোর ক’রে মেয়েকে টেনে জল থেকে কোলে তুলে নিয়ে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললে, ‘এই ত পাশেই চট্খন্ডীদের বাড়ি, ওরা দিয়েছে কি না জেনেই না হয় মেয়েটাকে খুন করতেন! এই দুধের বাছাকে এমনভাবে মেরে ফেলতে লজ্জা হয় না আপনার?’
অক্ষয়বাবুও ভেংচি কেটে জবাব দিলেন, ‘লজ্জা হয় না তোমাদের বাগান-সুদ্ধ ফল চুরি করতে?’
শ্যামা এর আগে কোনদিন কথা কয় নি ওঁর সঙ্গে, বলে ফেলে লজ্জিতই হয়েছে তবু এখন আর ফেরা যায় না– সেও সদম্ভে জবাব দিলে, ‘ফল ত কত পাখি- পাখালি কাকে বাদুড়ে-ভামে খেয়ে যাচ্ছে, না হয় খেলই বামুনের ছেলেমেয়েরা দুটো।
তাই বলে বামুনের কুমারী মেয়ের মাথায় পা! মা সতীরাণী এর বিচার করবেন।’
এতক্ষণে আরও ভাল ক’রে মেয়ের নীল মুখের পানে চেয়ে দেখবার ফুরসুত হয়েছে শ্যামার। কেমন যেন হয়ে গেছে মহাশ্বেতা, ঠোঁট দুটো কাঁপছে শুধু কাঁদতেও
পাড়ছে না। সেই দেখে আরও জোরে কেঁদে উঠে পাগলের মত একটা আমগাছে সে মাথা খুঁড়তে লাগল।
এইসব গোলমালে ততক্ষণে মঙ্গলা ছুটে এসেছেন। মঙ্গলা স্বামীকে তিরস্কার করলেন। জোর ক’রে শ্যামার চোখের জল মুছিয়ে মেয়েটাকে নিজের শুকনো আঁচল দিয়ে গা মুছিয়ে বুকের মধ্যে ক’রে নিয়ে ঘরে পৌঁছে দিলেন, ‘ষাট্ ষাট্, কিছু মনে করিস্ নে মা, ও মিসে অমনি। রাগলে আর ওর জ্ঞান থাকে না!
শ্যামা কিছু বললে না। কিন্তু দৈবক্রমে সেই দিনই পিঁটকীর এক মেয়ের প্রবল জ্বর হ’ল–দিন দুই পরে ডাক্তার ডাকতে শোনা গেল, নিমোনিয়া। ওরা যত ভয় পেলে শ্যামাও তত, সত্যি-সত্যিই কিছু ভাল-মন্দ হবে না তো মেয়েটার? হে মা দুগ্গা, হে মা কালী, রক্ষে করো মা। দিনরাত জপ করে শ্যামা।বড় দুর্দিনে আশ্রয় দিয়েছে, উপকারও যে কিছু করে নি তা নয়!
মঙ্গলা এসে জোর ক’রে একদিন ওকে ধরে নিয়ে গিয়ে ওর পায়ের ধুলো মেয়েটার মাথায় গায়ে মাখিয়ে দিলেন। ওর হাত দুটো ধরে বার বার বলতে লাগলেন, ‘তুই ওকে মাপ কর্ বামনি, মাপ কর্, নইলে দুধের বাছা আমার বাঁচবে না।’ পিঁটকী এসে দুটো পা ধরে পড়ে রইল। ‘কি শাপ দিলি বামুন-দি, মেয়েটা আমার শুকিয়ে মরে গেল!’
কেমন ক’রে বোঝাবে শ্যামা ওদের যে, শাপ সে সত্যিই দেয় নি। এত ছোট মন
নয় তার।
সে কিছুই বলতে পারলে না, শুধু হাউ হাউ ক’রে নিজেও খানিক কাঁদলে। তারপর অচৈতন্য মেয়েটার মাথার কাছে বসে প’ড়ে ওর সর্বাঙ্গে হাত বুলোতে বুলোতে বলতে লাগল, ‘ওর সব বালাই নিয়ে আমি যেন মরি মা ওর যেন কোন অনিষ্ট না হয়। ছি ছি –কী বলছেন আপনারা, এ আমি স্বপ্নেও কোন দিন ভাবি নি!’
যাই হোক্
শ্যামা কাঠ হয়ে রইল কদিন। সে যেন কন্টকশয্যা। অক্ষয়বাবু
নিজে একদিন উঠোনে দাঁড়িয়ে মাপ চেয়ে গেলেন। এক ধামা চালও পাঠিয়ে দিলেন
এর ভেতর। তেরোদিন পরে ডাক্তার যেদিন বললে আর ভয় নেই . সেদিন প্রকান্ড প্রকান্ড দুটি ঝুড়ি বোঝাই ক’রে এল সিধে চাল ডাল তেল ঘি আটা ময়দা একটা শাড়ি পর্যন্ত।
J
মায়
সেই থেকে এঁরা আর বিশেষ ঘাঁটান নি শ্যামাদের। বরং বলা চলে, মঙ্গলা একটা রফাই ক’রে নিলেন। স্থির হ’ল যে বাগানে যা নারকেল পাতা পড়বে–মায় গাছ ঝাড়িয়ে যা কেটে ফেলা হবে, সব শ্যামা পাবে, তা থেকে ঝাঁটার কাঠি করিয়ে শ্যামা শহরে বিক্রি করতে পাঠাবে, শুধু সরকারদের দরকার মত কিছু কিছু দেবে ওঁদের।… আর জ্বালানী পাতা অর্ধেক ওদের অর্ধেক শ্যামার।
সেই শুরু হ’ল পাতা-জমানো।
খ্যাংরা এক-একবারে
এ বন্দোবস্তে শ্যামা খুশী হল। নারকেল গাছ কম নয় পাঁচ সের আন্দাজ জমলে বয়ে বয়ে নিয়ে যায় সে শিবপুরের বাজারে। পাঁচ আনা ছ আনা পয়সা হয়। তার সঙ্গে ফল-ফুলুরি কিছু কিছু বেচেও দু’চার পয়সা হয়।
128
অর্থাৎ কোনমতে উপবাসে শুকিয়ে মরাটা বাঁচে।
কমলা মধ্যে মধ্যে দু’পাঁচ টাকা অবশ্য পাঠায় ছেলেমেয়েদের নাম ক’রে। সে টাকা এলে তেলমশলা কাপড় ইত্যাদি কেনে শ্যামা একেবারে কিনে ফেলে। নইলেত শুধু
নগ্নতার জন্যই বাইরে বেরোনো বন্ধ হয়ে উপবাস ক’রে মরতে হ’ত ওদের।
নরেন আজকাল আসে ছ মাস আট মাস অন্তর। কিছু কিছু হয়ত হাতে ক’রেই আসে কিন্তু সেগুলি নিজেই খেয়ে নিঃশেষ ক’রে যায়। এদের কথা চিন্তা করার অভ্যাস তার নেই।
―
কোথায় যায় সে, কোথায় কোথায় ঘোরে কী খায় কী করে এ সব প্রশ্ন আজকাল আর শ্যামা করে না। সে সহজ ভাবেই মেনে নিয়েছে তার স্বামীভাগ্যকে শুধু ওর কথাবার্তার মধ্যে থেকে প্রকাশ হয়ে পড়ে যে সে এক-রকমের ভ্রাম্যমাণ পুরোহিতের পেশা থেকেই সাধারণত পেট চালায় প্রয়োজন হলে চুরি-জুচ্চুরিতেও আপত্তি নেই। জুয়া খেলার কৌশল খুব ভাল রকম আয়ত্ত করেছে, এমন কি পথে- ঘাটে অপরিচিত লোকের সঙ্গেও খেলতে বসে যায়, জিতলে সে পয়সা ট্যাকে গুঁজে সোজা কোন পতিতালয়ে বা মদের দোকানে গিয়ে ওঠে আর হারলে অম্লান বদনে জানায় যে তার সঙ্গে কিছু নেই; সত্যি-সত্যিই থাকে না কিছু, সুতরাং বিজয়ী পক্ষ কিছুই করতে পারে না, কেউ শুধু গালাগাল দিয়ে ছেড়ে দেয়, কেউ দু’চার ঘা দেয় উত্তম-মধ্যম।
‘ট্যাক থেকে যখন পয়সা খসছে না তখন আর কি, কোনটাতেই আমার আপত্তি নেই। যত মারই দিক, একপো ধেনো কিনে মালিশ করলেই গায়ের ব্যথা মরে যায়। হুঁ হুঁ বাবা, নগদ টাকা বার করবে এ শম্মার কাছ থেকে, এমন লোক এখনও জন্মায় নি।’
বিজয়গর্বে কথাগুলো প্রচার ক’রে নিজের বুকে ঘুষি মারে।
দুই
বুদ্ধিটা মঙ্গলাই দেন। তাঁরও প্রয়োজন ছিল অবশ্য। বেচা ঠাকুর কিছুদিন ধরেই নানাখানা রোগে ভুগছে আজকাল পুজো করানো হয়েছে এক সমস্যা।
একদিন দুপুরবেলা এসে ওদের ঘরে জেঁকে বসে বললেন, ‘এক কাজ কর বামুন মেয়ে, ছেলেটা ত আট বছরে পড়ল, ওর একটা পৈতে দিয়ে দে।’
পৈতে! এরই মধ্যে?’
ক’রে দেব?
হচকিয়ে যায় শ্যামা, ‘আমি কোথায় কি পাবো, কেমন
‘যেমন ক’রে হোক দে। এই ত ঠিক পৈতের বয়স। পৈতেটা হয়ে গেলে পূজোটা ও-ই হাতে নিতে পারবে। নিতনেই নিত্যি নেই, নিত্যি উপোস সেটা ত ঘুচবে। চালটা হাতে পাবি, দুধ-বাতাসা থাকবে এক রকম ক’রে চলে যাবে। চাই কি, গাঁয়ের দু- একটা মনসা পুজো লক্ষ্মী কিছুদিন ধরেই না। থানা রোগে করানো মাসে তেরো পর্ব।।
আজকাল পূজো
– ১২৫
শ্যামা কথাটা ইদানীং ভাবে নি কোনদিন। এককালে সে-ই বলেছিল এই কথাই। কিন্তু এই নিঃস্বতার মধ্যে আর কিছু মনে ছিল না,সব ভুলে বসে ছিল। সে যেন আঁধারে কুল দেখতে পেলে। ছেলেটা এত বড় হয়ে গেল, লেখাপড়া শেখানোরও কোন ব্যবস্থা করতে পারে নি। যেটুকু নিজে জানত সেটুকু অবশ্য শিখিয়েছে কিন্তু আজকাল একটু ইংরেজী না জানলে কি চলে! কমলা লিখেছিল ওকে তার কাছে পাঠাতে শ্যামা তা পারে নি।
1 সে থাকবে কাকে নিয়ে, কেমন ক’রে? শুধু ভালবাসার প্রশ্নও নয় হাত- নুড়কুৎ ঐ ত একটি, রোজগার করতে . পুরুষমানুষ বলতেও ত ঐ এক।
না, হেমকে ছেড়ে দিতে পারবে না সে।
–
কিন্তু এ কথা হ’ল স্বতন্ত্র। হেমের যদি নিজস্ব উপার্জন কিছু হয়, তাহ’লে হেড মাস্টারের হাতেপায়ে ধরে মিডিল ইস্কুলে ভর্তি ক’রে দিতে পারে সে। সরকাররা বললে কিছু আর ‘না’ বলতে পারবে না। ওদেরই ইস্কুল
এক নিমেষে বহুদূর পর্যন্ত ভেবে নিলে সে। কল্পনা চলে গেল অনেক-খানি, অনেক বাস্তব বাধা ডিঙিয়ে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পানে। বিহ্বল ভাবে মঙ্গলার দিকে তাকিয়ে বসে রইল সে একদৃষ্টিতে।
খানিকটা ওর উত্তরের জন্য অপেক্ষা ক’রে ক’রে হাতে ক’রে বয়ে আনা পিকদানীতে পিচ্ করে খানিকটা পিক্ ফেলে মঙ্গলা বললেন, ‘কী হ’ল, অমন হাঁ করে চেয়ে আছিস কি? কী ঠিক করলি?’
‘ঠিক? যেন চমকে জেগে ওঠে শ্যামা, ‘ঠিক আর আমি কি করব বলুন, আমার অবস্থা ত সবই জানেন?’
মঙ্গলা বিশেষ একরকম কণ্ঠস্বর বার ক’রে বললেন, ‘নেকু! তা আর জানি নি? হ্যাঁ আমরাও কিছু সাহায্য করলুম না হয়, পিঁকীকে না হয় ভিক্ষেমা ক’রে দিলুম ওর এ সব কাজ ত খারাপ নয়, পুণ্যি আছে ওতে . কিন্তু তোর মা মাগীকেও এক কলম লেখ না। ঠিক কিছু পাঠাবে এখন ধার-দেনা ক’রে। তোদের আর কি, তোদের ত কলমের জোর আছে, কারুর খোশামোদ করতে হবে না, এক কলম নিজেই লিখবি, ডাকে দিবি, আর টাকা! তবে তাও বলি,মেয়েমানুষের লেখাপড়া শিখতে নেই। তোর মা তোদের লেখাপড়া শিখিয়েছে ব’লেই তোদের এত দুদ্দশা। আমার বাবা আমাকে ঐজন্যেই লেখাপড়া শিখতে দেন নি। বলতেন, মেয়েরা হ’ল লক্ষ্মী, ঘরের লক্ষ্মী পর হয়ে যাবে সরস্বসতীর সঙ্গে যে ওদের চিরকালের ঝগড়া। আসলে সরস্ততী ত লক্ষ্মীর সতীন! সতীন-কাঁটাকে কে দেখতে পারে বল্ মা?’
শ্যামা মাথা হেঁট ক’রে বসে রইল। আশা কি জিনিস তাই যখন সে ভুলতে বসেছে তখন এ কি এক নতুন শিহরণ নিয়ে এল নতুন আশা! তাহ’লে সেও কোনদিন দাঁড়াতে পারবে, মানুষের মত মানুষ হয়ে উঠবে।
‘কি করবি তাহলে!’
‘চিঠি লিখব মা। আপনারাও একটু দেখবেন।’
—
‘হ্যাঁ তাই লিখিস। কত্তাকে আবার বলি। কত্তার হাতে এখন সব গিয়ে প’ড়েছে কিনা। যা চারদিকে চুরি ডাকাতি হচ্ছিল ভয় ধ’রে গিয়ে আমার সব পুঁজি-পাটা বার ক’রে ওর হাতে দিয়েছি, ও কি ব্যাং ম্যাং কোথায় রেখে ছে সায়েবদের কাছে। এখন কতকটা ওর হাতে আমি। ওর হাততোলায় থাকা। দেখি, আদায় করব’খন।
টাকা রাসমণিও পাঠালেন। কমলাও। শ্যামা তা থেকে অনেকখানি সরিয়ে রেখে দিলে দুর্দিনের জন্যে। সে যতটা পারলে সরকারদের ওপরই চাপালে। রাসমণি লিখেছিলেন কলকাতায় নিয়ে যেতে– তাহলে তাঁরাই পৈতেটা দিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু এজন্যেই শ্যামা যায় নি। কি দরকার মায়ের গোনা পুঁজি খসাবার। পরের ঘাড় দিয়ে যদি হয়ে যায় ত যাক না!
পৈতে হয়ে যাবার দিন সাত-আট পরেই নরেন কোথা থেকে এসে হাজির। সেটা বিকেলের দিক, আবছা হয়ে এসেছে দিনের আলো। তবু উঠোনে পা দিয়েই হেমকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ কি, মাথা নাড়া কেন? গলায় ওটা কি? য়্যা, আমাকে না জানিয়ে আমার ছেলের পৈতে দেওয়া হয়েছে! কার এত সাহস শুনি? এত বড় আস্পদ্দা? আমি কেউ নই, না? আমি হলুম ওর জন্মদাতা পিতে– আমাকে না জানিয়ে এত বড় কাজটা ক’রে বসল দুম করে! মেয়েমানুষের এত সাহস! আজ যদি গো’র বেটার জাতকে এক কোপে সাবাড় না করি–’
যেন তুড়িলাফ খেয়ে নেচে-কুঁদে পাগলের মত কান্ড বাধিয়ে তুললে নরেন। শ্যামা গিয়েছিল পুকুরে
আসতে আসতে সব শুনে সেও জ্বলে গেল, ছুটে এসে রান্নাঘরে ঢুকে একেবারে উনুন থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ তুলে এনে বললে, চুপ করবে, না জ্যান্ত এই নুড়ো জ্বেলে দেব! চুপ। আর একটা কথা না শুনি! পিতে! জন্মদাতা পিতে! লজ্জার মাথা ত খেয়েছ হায়া-পিত্তি বলেও কি কিছু থাকতে নেই?’
ওর সেই রণচণ্ডী মূর্তির সামনে আস্তে আস্তে যেন কুঁকড়ে গেল নরেন।
‘থাম্ থাম্, খুব হয়েছে। চুপ কর্। একটু আগুন দে দেখি কলকেটায়!’ তারপর বসে বসে একটু চুপ করে থেকে বললে, ‘ঐ পুঁটলির মধ্যে এক কোণে একটু চা বাঁধা আছে। চা কর্ দিকি –খাই একটু।
তারপর চা-তামাক খেয়ে একথা সেকথার পর সহসা যেন কথাপ্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল, ‘ঐ দ্যাখ, আসল কথাটা বলা হয় নি। যে জন্যে হঠাৎ চলে এলুম! আমর বড় ভয়রা যে ফর্সা!
‘য়্যা!’ আর্তনাদ করে উঠল শ্যামা। ‘কি, কী বললে?’
‘অক্কা! সাবাড়!’ হি-হি ক’রে হেসে বললে নরেন, ‘কলকাতায় গিয়েছিলুম, ওদের বাড়িওলার সঙ্গে দ্যাখা। তিন দিন হ’ল কি একটা যাগযজ্ঞি করতে গিয়ে নাকি বুকে
ব্যথা ধরে
ব্যাস, তাইতেই শেষ!’
সেই প্রথম আর্তনাদের পর শ্যামার কন্ঠ থেকে কোন স্বরই বেরোই নি। নরেনই একটু চুপ ক’রে থেকে আবার বললে, ‘মানে কথা, এবার তোমার দিদি বিধবা হ’ল।
Fire ১২৭
পয়সার দ্যামাক এবার একটু কমবে। বেশি পয়সা যে কত্তা রেখে যেতে পেরেছেন তা নয়। হেঁ-হেঁ! পুরোনো জামা দিয়ে গরীব বোনকে সাহায্য করা
সাহায্য করে তাই দ্যাখো!’
উল্লাসের সুর ফোটে ওর গলায়।
তিন
এবার ওকে কে
–
শ্যামার হয়ত তখনই কলকাতায় চলে যাওয়া উচিত ছিল খবরটা শুনে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়া ওর হয়ে ওঠে না। কারণ বিস্তর। প্রথমত কমলার এই অবস্থায় সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারে না কিছুতেই। সে নিজে মেয়েছেলে মেয়েছেলের এত বড় সর্বনাশ যে আর নেই তা বোঝে, বিশেষত হিন্দু বাঙালীর ঘরে। ওর সেই রাজেন্দ্রাণীর মত দিদি চওড়া লাল পাড় শাড়ি ও গয়নায় ঝলমল করত তার ‘নিরাভরণ শুভ্র বেশ দেখতে হবে, তার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল। উঃ, দিদি না জানি কি করছে! ওকে দেখলেই হয়ত চিৎকার ক’রে উঠবে হয়ত আছড়ে পড়বে
। না, না, এখন সেখানে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।
দ্বিতীয়ত, হেমকে সবে ইস্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। ইস্কুলের কর্তারা দয়া ক’রে বিনা মাইনেয় ভর্তি ক’রে নিয়েছেন কিন্তু ব’লেই দিয়েছেন কামাই করা চলবে না একদিনও। কামাই করলেই এ সব সুবিধা বন্ধ ক’রে দেওয়া হবে। বেচু চক্কোতি শয্যাগত–হেমই নিত্যসেবা করছে। নরেন ত পরের দিনই আবার উধাও হয়েছে। হেমকে কার কাছে কোন্ ভরসায় রেখে যাবে? কে তাকে খেতে দেবে?
এখন
তাছাড়া তাছাড়া সে আবার অন্তঃসত্ত্বা। এ অবস্থায় হেঁটে যাওয়া! গিয়ে কিছু আর মার কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নেওয়াও চলবে না আবার হেঁটেই ফেরা। বড় কষ্টকর!
–
সুতরাং চোখের জল চোখে চেপে শ্যামা দৈনন্দিন অভ্যস্ত জীবনযাত্রাতেই ফিরে আসে ধীরে ধীরে।
অবশ্য উমার চিঠিতে খবর সবই পাওয়া যায়।
কথায় বলে, ‘অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর।’ রাসমণির সেই অবস্থা। আঘাত খেয়ে খেয়ে তাঁর সমস্ত অন্তরই যেন পাষাণ হয়ে গেছে। নতুন কোন আঘাতের প্রতিক্রিয়া জাগা শক্ত, তবে বজ্রাহত-বনস্পতির মত খাড়া থাকলেও ভেতরটা বোধ করি আমূলই শুকিয়ে গেছে।
কমলা বাপের বাড়ি এসে ওঠে নি। ওর ভাশুর এবং দেওর আছেন অনেকগুলি, কিন্তু তার স্বামী ইদানীং তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্কই রাখতে দেন নি। সুতরাং আজ এতদিন পরে তাদের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে কি অভ্যর্থনা মিলবে তা কমলা অনুমান করতে পারে সহজেই। সাংসারিক জ্ঞান খুব বেশি না থাকলেও মানুষকে এটুকু সে চেনে। হয়ত তারা প্রথমেই তাড়িয়ে দে না কিন্তু শীগগিরই এমন অবস্থা ক’রে
তুলবেন যে আর টেকা যাবে না।
১২৮-
ওর স্বামী চাকরি করতেন কোন এক সওদাগরী ফার্মে, মাইনে মোটা ছিল না। কিন্তু শতকরা চার আনা কমিশণ একটা পেতেন, তাতেই ওদের সচ্ছলে সংসার চলত। ঝি রাঁধুনী চাকর
এলাহি ব্যাপার ছিল। দু’-একবার কমলা সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার যে চেষ্টা করে নি তা নয় কিন্তু তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন বার বার। বলেছেন,
‘ভয়
কি, আর কিছুদিন চাকরি ক’রে নিজের ফার্ম খুলব। মূলধন? এদের সঙ্গেই অর্ডার সাপ্লাই-এর কাজ করব মূলধন কি হবে? আমাদের এই ছোট্ট সংসার, কিই বা ভাবনা? তার জন্যে এখন থেকে দুশ্চিন্তা ক’রে লাভ নেই। চলেই যাবে একরকম ক’রে।
JU
—
চলেই হয়ত যেত–এমনিতেই। কিন্তু মরবার কিছুদিন আগে এক তান্ত্রিক এসে জুটেছিল। ঠিক দীক্ষাগুরু নয় দীক্ষা নিয়েছিলেন কুলগুরুর কাছে
এমনি শিক্ষাগুরু বলা যেতে পারে। তারই প্রয়োচনায় এক কালী স্থাপনা ক’রে জমি-জমা যেখানে যা কিছু ছিল সমস্তই দেবোত্তর ক’রে দিয়েছিলেন নগদ টাকা সব খরচ হয়ে গিয়েছিল বাড়ি ও মন্দিরে। সেই তান্ত্রিক তার আইনসম্মত সেবাইত এখন। সে অবশ্য বিধবাকে আশ্রয় দিতে আপত্তি করে নি কিন্তু কমলা সংক্ষেপে বলেছিল, ‘ঐ ত আমার স্বামীকে খুন করেছে। ওর আশ্রয়ে ছেলে মানুষ করার আগে ছেলের মুখে বিষ তুলে দেব।’
এই নতুন মন্দিরেই কি একটা তান্ত্রিক-ক্রিয়া করতে গিয়ে হঠাৎ বুকে ব্যথা ওঠে তাঁর অজ্ঞান হয়ে যান। সেই অবস্থাতেই একদিন পরে হয় মৃত্যু, কমলাকে কিছু বলেও যেতে পারেন নি।
কমলার নিজের হাতে যৎসামান্য নগদ-টাকা যা ছিল তা এই ক’দিনেই শেষ হয়ে গেছে শ্রাদ্ধশান্তি করতে। অফিস থেকে প্রাপ্য কিছু ছিল কমিশন আর মাইনে বাবদ, তার সঙ্গে সামান্য যোগ ক’রে দিয়ে পঁচিশ টাকা দিয়ে গেছে তারা। আর আছে গায়ের গহনাগুলো। কমলা এই বিপদে একটু ও মাথা গুলিয়ে ফেলে নি, সে শুধু বালা জোড়াটা গোবিন্দর বৌয়ের জন্য এবং গোবিন্দর অন্নপ্রাশনের গহনাগুলো তার ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে তুলে রেখে বাকী সব গহনাগুলো বেচে দিলে। সবসুদ্ধ দাঁড়াল বাইশশ টাকা। এই টাকাটা একেবারে সে তুলে দিলে ওর স্বামীর বন্ধু এক সুবর্ণবণিক ব্যবসায়ীর গদীতে। তিনি পাকা রসিদ দিয়ে টাকাটা নিলেন কথা রইল টাকাটা যথেচ্ছ খাটাবেন তিনি . লাভলোকসান তাঁর
ক’রে দেবেন কমলাকে।
তিনি শুধু এর সুদ বাবদ মাসে আঠার টাকা
কমলা অতঃপর ফার্নিচার পর্যন্ত বেচে দিয়ে মাসিক চার টাকা ভাড়ায় একখানি ঘর নিয়েছে এবং ছেলেকে নিয়ে সেইখানেই এসে উঠেছে। ভদ্র ব্রাহ্মণবাড়ির মধ্যে ঘর, সব দিক দিয়েই নিরাপদ আশ্রয়। অতঃপর সে ঐ আয়েই দিন গুজরান ক’রে ছেলেকে মানুষ ক’রে তুলবে, এই তার প্রতিজ্ঞা। মা তাঁর দুটি যমজ মেয়েকে নিয়েই বিব্রত, আবার তার ওপর বোঝা চাপাবে না কমলা এই এক কথা, দ্বিতীয় কথা, যা অনেক পরে প্রকাশ পেয়েছে, মেয়েদের বিধবা হবার পর বাপের বাড়ি গিয়ে ওঠা তার স্বামী একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি নাকি অনেকদিন আগে একবার বলেও ছিলেন,
১২৯
‘যদি তেমন কোন দুর্দিন আসে ত চেষ্টা ক’রো ছেলেকে নিজেই মানুষ ক’রে তুলতে। তার জন্যে যদি গতর খাটাতে হয় ত লজ্জা নেই, কিন্তু বিধবা মায়ের কাছে গিয়ে উঠো না। সে বড় অশান্তি। দুই বিধবা বোন বাপের বাড়ি থাকলে আগুন জ্বলে। ওতে মন ছোট হয়ে যায়, ছেলেও মানুষ হয় না। তোমার উমা ত বিধবারই সামিল! ‘
খবরটায় কমলার জন্য দুঃখ বোধ একটু করে বৈকি শ্যামা। আহা, সেই দিদি তার কখনও কিছু করা অভ্যাস নেই, কখনও এক গ্লাস জল পর্যন্ত গাড়িয়ে খায় নি! সে কি পারবে এত সব কাজ গুছিয়ে করতে? ঐ ত আয়! খুব কষ্ট না করলে দুটো পেট চালিয়ে ছেলেকে লেখাপড়া শেখাতে পারবে না। আবার মনে মনে কোথায় যেন একটু আশ্বস্তও হয়। তার মনের গোপন কোণে একটা বিশ্বাস বাসা বেঁধে আছে বহুদিন থেকেই যে, এখনও তার মায়ের হাতে কিছু সোনা আছে। এবং সেটা তিনি মরবার পর উমা ও শ্যামার মধ্যেই ভাগ হবে। কিন্তু কমলা এসে উঠলে সেও ত ভাগ পেত।
কমলা এসে ঐ বাড়িতে না থাকলেও যে তার এক ভাগ পাওনা হয় ন্যায়ত ধর্মত এবং এখন তার যা অবস্থা তা’তে পাওয়াই উচিত এ কথাটা কে জানে কেন শ্যামা একবারও ভাবে না। তার আত্মকেন্দ্রিক মন নিজের দাবীটাকেই সর্বদা বড় ক’রে দেখে
চার
এবারেও মঙ্গলা ঠাকরুণই কথাটা পাড়েন, ‘হ্যালা, মেয়ের বিয়ে দিবি? দ্যাখ দিস্ ত দে।
আকাশ থেকে পড়ে শ্যামা। মেয়ের বিয়ে! তার মেয়ে যে সবে সাত পেরিয়েছে!
‘আহা, তা হোক না সাত বছর। এই ত বিয়ের বয়স। অষ্টম বর্ষে গৌরীদান। তারও ত একটা পূণ্য আছে। তোর ভালর জন্যেই বলছি। নইলে ব্যাটাছেলের আবার বিয়ের ভাবনা! কত মেয়ের বাপ তাদের দোরের মাটি রাখছে না। আমার কথাটা মনে পড়ল তাই। বলি ফুটফুটে মেয়ে তোর, হয়ত ওদের নজরে পড়ে গেলেও যেতে পারে। এই ফাঁকে পার হয়ে যায় ত যাক।’
লোভে কম্পমান হয় শ্যামার মন, যেদিন থেকে মেয়ে হয়েছে সে দিন থেকেই তা বলতে গেলে দিন গুনছে। বরং বলা চলে যে, মেয়ে হবার আগে থেকেই দিন গুনছে– কবে মেয়ে হবে! মেয়ে হ’লে শীগগির কুটুম হয়, নাত নাতনী– ছেলের বিয়ের জন্যে অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়।
‘কিন্তু মা, আসল কথাটা যে ভাবছেন না! আমার হাতে কিছুই নেই। কোথায় কি পাবো বলুন ত? আবার এই একটা মেয়ে হ’ল। এরই দেনা এখনও শোধ হয় নি।
‘বলি, গায়ে গুমাখলে তা আর যমে ছাড়বে না! আমাদের হিন্দুর ঘরে মেয়ে যখন বিইয়েছিস্ তখন বিয়ে দিতেই হবে– খেতে পাস্ না পাস্। মেয়ে দেখা না– দেখাতে দোষ কি? দেখাতে
না। পছন্দ হলে চাই কি টাকা-কড়ি
নাও নিতে পারে।
আমার
কথা শ্যামার মনে লাগল। হেম আর একটা নিত্যসেবার কাজ পেয়েছে। এ গ্রামের বাইরে সেটা–প্রায় মাইল খানেক হেঁটে যেতে হয়। তা হোক–রাত চারটেয় উঠে হেম আগে সেখানে চলে যায়, তারপর এখানের পূজো শেষ ক’রে পড়তে বসে। খুব জোরে যায় আর জোরে আসে–ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগে না। সেখানে ব্যবস্থা ভাল, চাল ঐ আধসেরই বটে, কিন্তু তেমনি মাসে তিন টাকা মাইনে। রাত্রে শেতলে দু’খানা বড় বাতাস–একপো দুধ। সেটা ঠিক বামুন-কায়েতের বাড়ি নয়–কিন্তু যাঁর আপত্তি হতে পারত সেই মঙ্গলা ঠাকরুণই অভয় দিয়েছেন, ‘কে বা আজকাল অত সব মানছে, তুমিও যেমন! ঐ বেছাই নুকিয়ে লুকিয়ে করত! নিয়ে নে―নিয়ে নে, ভাতের দুঃখ ত ঘুচবে।’
বেচু অসুস্থ হয়ে পড়ছে বলে এমনি মনসাপূজো, লক্ষ্মীপূজোও দু’একটা পায় হেম–অর্থাৎ ঠিক উপবাস করার অবস্থাটা ঘুচেছে। আর একটি শিশু এসেছে কোলে বটে–চাঁদের মত রং, পদ্মফুলের মত সুন্দর মেয়ে। কমলা চিঠিতে নাম পাঠিয়েছে ঐন্দ্রিলা। সে যাক–তার আর কতই খরচা! যদি মা কিছু দেয়, এবং মঙ্গলা যদি কিছু ধার বলেও দেন তা কোনমতে কাজ সারা যেতে পারে হয়ত। দেনা সে রাখবে না- যেমন ক’রেই হোক কষ্ট ক’রে কাজ সারবে।
আয়ের ইদানীং আর একটা পথও বেড়েছে। মৌড়ীর কুন্ডুবাবুরা সাতখানা গাঁয়ে ক্রিয়াকর্মে সামাজিক বিলোন, পূজাপার্বণে ছাঁদা দেন। এ গ্রামও সেই তালিকায় পড়ে; ব্রাহ্মণমাত্রেই পায়–এতদিনে এরা পায় নি স্থায়ী বাসিন্দা হয় বলে। বহুদিনের চেষ্টায় ওদের খাতায় নাম উঠেছে। সামাজিক মানে নিমন্ত্রণের সঙ্গে একটা পেতলের হাঁড়ি কিংবা ঘড়া ক’রে তেল নয়ত কাঁসার থালায় সন্দেশ–দিয়ে যায় বাড়ি বাড়ি। তেলটা ঘরে থাকে, বাসনটা বিক্রি করা যায়।…আর পূজায় রাসে ছাঁদার ব্যবস্থা আছে– মাথাপিছু ষোলখানা লুচি ও বারোটা সন্দেশ। তিন-চার দিন ধরে সপরিবারে খাওয়া চলে। সদ্যোজাতা ঐন্দ্রিলাও এ ছাঁদার অধিকারী।
খানিকটা চুপ ক’রে থেকে শ্যামা মনে মনে কত কি স্বপ্নজাল বোনে, কল্পনায় বহুদূর এগিয়ে যায়। তারপর বলে, ‘বেশ ত দেখুন না মা। ত ছেলে কি করে, বয়স কত?’
ছেলে নাকি ঐ মৌড়ীগ্রামেই থাকে—-মঙ্গলার কাছে যা খবর পাওয়া গেল। কোন্ এক বিলিতি কারখানায় কাজ করে, উনিশ টাকা আন্দাজ মাইনে পায়; রোজ হিসেবে মাইনে, ঐ রকমই দাঁড়ায়। মা আর দু’টি ভাই আছে সংসারে। দুটো বোনও বুঝি আছে। পৈতৃক বাড়ির ভাগ খানদুই ভাঙাঘর আছে, তবে জমি আছে অনেকখানি প্ৰায় তিন-চার বিঘের বাগান।
মঙ্গলা বললেন, ‘ব্যাটাছেলে, রোজগার করছে, বাড়ি করতে কতক্ষণ! জমি আছে, বাড়ি তুলে নেবে দেখিস্ দেখতে দেখতে। তারপর তোর মেয়ের বরাত। যদি তেমন পয় ফলাতে পারে ত ওর আয়ও বেড়ে যাবে না কি চড়চড় ক’রে?’
‘বয়স?’ একটুখানি চুপ ক’রে থেকে বোধ করি হিসেবে করারই চেষ্টা করেন মঙ্গলা, ‘বয়স আর কত, তেইশ-চব্বিশ হবে বড়জোর।’
১৩১
‘চব্বিশ বছর! আমার মেয়ে যে মোটে সাত বছরের মা।’
‘ওমা, বলিস্ নি ওসব কথা! সাত বছর কি সোজা বয়স মেয়েছেলের? আগে ত এই বয়সে বিয়ে না কলে লোকে নিন্দেই করত। আর বরের কথা যদি বলিস্– বেটাছেলের আবার বয়স কি লা? দোজবরে ত নয়। আগে ত শুনেছি তোদের কুলীন বামুনের ঘরে পাঁচ বছরের মেয়ের সঙ্গে ষাট বছরের ঘাটের মড়ার বিয়ে হ’ত।
তবু শ্যামা চুপ ক’রেই আছে দেখে মঙ্গলা ঠাকরুণ আবার বললেন, ‘আর বামুনের ঘরের কথাই বা কোন–আমারই ত বড় জা-রয়েছে, তুই ত দেখেছিস তাঁকে, ঐ যে পিঁকীর কোলের ছেলেটার অন্নপেরাশনে এসে ছিল! এয়োরাণী ভাগ্যিমানী পাকা চুলে সিঁদুর পরছে—কিন্তু ওদের কি বিয়ে হয়েছিল শুনবি? আমার জায়ের যখন পাঁচ বছর, তখন বঠাকুর আটাশ পেরিয়ে উনত্রিশে পড়েছেন। বাইরে বাইরে পশ্চিমে ঘুরে কাজ- কর্ম করতেন, বিয়ে করবার ফুরসত পান নি। তারপর হঠাৎ ঠাকুরের কানে গেল যে ছেলের স্বভাব-চরিত্রির বিগড়েছে, যেখানে থাকতেন সেখানে নাকি ইহুদী ম্যাম্ রেখেছেন বাঁধা। যেমন কানে যাওয়া অমনি তার পাঠিয়ে দিলেন, মা মরো-মরো, ঝট্ ক’রে চলে এসো। ছেলে যেদিন এসে পৌঁছল সেইদিনই দিলেন পিঁড়িতে বসিয়ে তিন-চার দিন মোটে সময়, মেয়ে ত আর দেখবার সময় পেলেন না, হাতের কাছে ছিল ঐ পাঁচ বছরের মেয়ে, তাই তাই সই!… তা সে যা মজা মা বুঝলি, লজ্জার কথা এসব কাউকে বলিস নি, বলতে গেলেও হাসি পায় আমার। জা ফুলশয্যের রাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে কাপড়খানা গুটিয়ে বগলে চেপে ভাশুরকে ডাকছে
ও বল্ বল্, শুনছ, আমার যে পেচ্ছাব পেয়েছে, দাঁড়াবে চলো। বল্ দিকি কি কান্ড!’
মঙ্গলা হা-হা ক’রে হেসে ওঠেন।
শ্যামা কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে বললে, ‘তা দেখুন মা, যা ভাল বোঝেন। আপনাদের দয়া হ’লে মেয়ে পার হয়েই যাবে।
হ্যাঁ
যাই আবার দেখি
পিকী হয়ত দোর-তাড়া খোলা রেখেই ঘুমিয়ে
পড়ল! ওর যা কাণ্ড! মেয়েটা বড্ড বাউন্ডুলে!’
১৩২