সপ্তম পরিচ্ছেদ
ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।
বড় বাড়িটার একেবারে এক প্রান্তে ঠাকুরঘর, কতকটা বাইরেই
অর্থাৎ মূল বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন। তারই পিছনে একটি মাত্র কুঠুরি, সেইখানেই নরেন শ্যামাকে নিয়ে গিয়ে তুললে, ‘দিব্যি ঘর, না? আগাগোড়া পাকা।
ঘর পাকা বটে কিন্তু এ কী ঘর?
দক্ষিণে মন্দির ঠাকুরঘর সুতরাং দক্ষিণটা চাপা। পূর্বেও কোন জানালা নেই আছে পশ্চিমে একটি জানালা আর উত্তরে দরজা ও আর একটা জানালা। মোটা মোটা নিরেট ইটের গাঁথুনি, ভেতরটা দীর্ঘদিনের অবহেলায় আগাগোড়া নোনা-ধরা অন্ধকার, স্যাৎসেঁতে আর তেমনি গরম। কিছুকাল দাঁড়াবার পরই মনে হ’ল দম আটকে আসছে। শ্যামা কোনমতে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করলে। আর্তনাদের মত তার গলা দিয়ে স্বর বেরোলো, ‘এখানে আমার ছেলেমেয়ে থাকবে কি ক’রে গো?
‘তা থাকবে কেন? নবাব-নন্দিনীর পুত্তুর-কন্যের জন্যে রাজপ্রাসাদ অট্টালিকা চাই। অতশত লম্বা লম্বা কথা যেন না শুনি আর এই সাফ্ বলে দিলুম।’
হেমও ঘরের মধ্যে এসে কেমন একরকম ভ্যাবচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, নরেনের দৃষ্টি পড়ল তার ওপর, গালে প্রচন্ড এক চড় মেরে বললে, ‘দেখছিস কি হারামজাদা! এইখানে এনেছি, এইখানেই থাকতে হবে। বাপের যেমন অবস্থা তেমনি থাকবি। অত নওয়াবি চলবে না।’
দুবছরের ছেলে এসব কথার একটিও বুঝলে না, ডুকরে কেঁদে উঠল শুধু যন্ত্রণায়। ওর গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসে গিয়েছিল। শ্যামা তাড়াতাড়ি গিয়ে ওকে কোলের মধ্যে টেনে নিলে।
‘নাও
—
ঢের হয়েছে। পোঁটলাপুঁটলি খোল দেখি। দ্যাখো ঐ ওদিকে কোথায় রান্নাঘর উনুন-ফুনুন আছে কি না দ্যাখো, না হয় কাঠ-কুটো দিয়ে চাটি চালে- ডালে চাপিয়ে দাও। সন্ধ্যের আর বেশি দেরি নেই—– কোথায় আলো কি বিত্তেন্ত, আমি এখানে সে সব খুঁজে বেড়াতে পারব না
অর্থাৎ এই বিজন বনে রাত্রিবেলা অন্ধকারে থাকতে হবে
প্রকান্ড বাগান এই মন্দিরের চারদিকে। ওদিকে কোথায় একটা পুকুর আছে কিন্তু এখানটায় বড় বড় গাছপালার ঠাস্-বুনুনি। কাঁঠাল আম জামরুল চালতা সজনের সূর্যকে এই অপরাহ্নেই আড়াল ক’রে এনেছে, সন্ধ্যাবেলা কি হবে?
শ্যামার মনে হ’ল ছুটে পালিয়ে যায় কোথাও ছেলেমেয়েদের হাত ধরে, এই রাক্ষসের হাত থেকে অন্য যে কোনও জায়গায় হোক্। কিন্তু কোথায় যাবে? অদৃষ্টের হাত থেকে ত পালাতে পারবে না!
সে কাঠ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে দেখে নরেন বোধকরি আরও একটা প্রচণ্ড ধমক দিতে যাচ্ছিল, এমন সময় ওধারের বাগানের মধ্যে দিয়ে একটি মোটা গোছের মহিলা এসে পড়ায় তার ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর বাধা পেয়ে থেমে গেল।
‘আমাদের নতুন বামুন মা কেমন এল দেখি একবার! ও মা, এ যে একেবারে ছেলেমানুষ, আমার পিটকীর চেয়েও ছোট। তবে বাছা আর পেন্নাম করব না অকল্যাণ হবে। এই এইখানে থেকেই হাত তুলে অমনি
তিনি বেশ হেঁট হয়েই নমস্কার করলেন।
শ্যামা যেন আঁধারে কুল পেলে। সে বরাবরই একটু মুখচোরা কিন্তু হঠাৎ একেবারে এমন অকূলে পড়ে তারও মুখ খুলে গেল। সে-ও কাছে এসে হেঁট হয়ে নমস্কার করে বললে, ‘মা আমিও আপনার এক মেয়ে।’
‘বাঃ, বেশ বেশ। বেশ মিষ্টি কথা ত তোমার।হবে না কেন, হাজার হোক শহরের মেয়ে আর এই পাড়াগাঁয়ের সব কথা, ঝ্যাঁটা মারো! আমিও কলকাতার মেয়ে বাছা যদিও এই ছাব্বিশ বছর হ’তে চলল বে হয়েছে তবু এখনও এখানকার কথাবার্তা অব্যেস হল না। যেন খটাশ ক’রে গায়ে বাজে।’
এইবার তিনি প্রায় শ্যামাকে ঠেলেই ভেতরে এসে দাঁড়ালেন, ‘ও মা, এখনও যে পোঁটলাপুঁটলি কিছুই খোলা হয় নি। চলো বাছা, তুমিও একটু হাত দাও আমি তোমার ঘরকন্না গুছিয়ে দিয়ে যাই —
সরকার-গিন্নী নিজেই সব গুছিয়ে
শ্যামাকে অবশ্য আর হাত দিতে হ’ল না দিলেন। জিনিসত্র তাকে কুলুঙ্গিতে সাজাতে সাজাতে বললেন, ‘তোমার মা ত সংসার
তোমার মা-মাগীর এমন অবস্থা,
গুছিয়েই দিয়েছে দেখছি। তা বেশ আক্কেল আছে বাপু
মানতেই হবে।
তবে
একটা কথা বলছি বাছা, কিছু মনে ক’রো না, আর মনে করলেই বা কি কাঁচা মাথাটা ত কচ্ ক’রে কেটে নিতে পারবে না তোমরা ত শুনেছি বিবিদের মত লেখাপড়াও শিখেছ এমন জানোয়ারের হাতে দিলে কেন?
আমার
এত বুদ্ধি তার তা জেনেশুনে
এক কোণে হুঁকো-কলকের পুঁটুলি খুলে নরেন তামাক সাজছিল, তার হাত থেমে গেল,দাঁত কড়মড়ও করলে একবার কিন্তু মনিবপত্নীকে কিছু বলতে সাহসে কুলোল না শুধু কানটা খাড়া ক’রে রইল শ্যামা কি উত্তর দেয় তা শোনবার জন্য।
শ্যামার পক্ষে সে কথার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, সে বরং কথাটা চাপা দিয়েই বললে, ‘মা, আলোর ত কোন ব্যবস্থাই নেই সঙ্গে
. কী হবে?
…এখন চলো
‘তার আর কি হয়েছে বাছা, আজকের মত একটা পিদিম তেলসতে দিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি। কাল বাজার থেকে খানিকটা রেড়ির তেল আনিয়ে নিও। রান্নাঘরে উনুন-টুনুন কাটিয়ে রেখেছি, কাঠকুটোও তৈরি। কাপড় কেচে এসে চাটি চাপিয়ে দাও। আমাদের এই বাগানের মধ্যেই পুকুর খাসা জল, ঐ জলই আমরা সকলে খাই।’
>
ওদের ঘরের কাছেই বেশ একটা বড় চালাঘর, মাটির দেওয়াল মাটিরই মেঝে, তার দাওয়ায় একটা উনুন কাটা, ঘরেও আর একটা উনুন। সত্যিই ভদ্রমহিলা সব তৈরি ক’রে রেখেছেন। ঘরের মধ্যে একটা মাচাও তৈরি আছে, ভাঁড়ারের জিনিসপত্র রাখবার
জন্য।
সরকার-গিন্নী নিজে সঙ্গে ক’রে পুকুরে নিয়ে গেলেন। বেশ বড় পুকুর কিন্তু চারপাশে বড় বড় গাছ থাকায় বড় নির্জন আর জলটা বড় কালো দেখায়। বাঁধা ঘাট আছে, তবে ইটের সিঁড়িতে শ্যাওলা জমে বড় বেশী, পিছলও।
‘ভয় করছে নামতে? এই নাও, আমার হাত ধরো।
সাঁতার জানো না বুঝি? আমার পিটকী আসুক, তোমাকে একদিনে সাঁতার শিখিয়ে দেবে।’
‘তিনি কোথাও গেছেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ
ছেলেমেয়েরা আমার কেউ ত নেই। সব মামার বাড়ি গেছে। আমার ভাইপোর বে। মায় আমার দেওরের ছেলেমেয়েবা সুদ্ধু।’
‘তা আপনি যান নি?’
বেশ বলছ তা বাছা তুমি!’ ওর নির্বুদ্ধিতায় যেন একটু বিরক্তই হন তিনি, আমার ঘরকন্না দেখবে কে! এই দিন-কাল, আমাদের এতবড় বনেদী সংসার, পাঁচটা জিনিস- পত্তর নিয়ে ঘর করি-যথাসর্বস্ব যাক্ আর কি! এই তাই কর্তা থাকেন তবু রাত্তিরে ঘুম হয় না, খুট্ ক’রে শব্দ হলেই জেগে উঠি। দায়িত্ব কি কম?’
তারপর নিজেই অন্য প্রসঙ্গে আসেন, ফুটফুটে। তা কোটার কি নাম রেখেছ বাছা?’
I
ছেলেমেয়েগুলি তোমার দিব্যি বাপু, বেশ
শ্যামা ওঁর উষ্ণ স্বরে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, এখন হাঁপ ছেড়ে বললে, খোকার নাম হেমচন্দ্র। আর মেয়ের নাম মহাশ্বেতা।’
‘ও বাবা, ও যে বড্ড বড় বড় নাম! ডাকো কি বলে?’
‘ওকে হেম বলে ডাকি আর একে ডাকি মহা ব’লে।
―
‘তবু ওসব পোশাকী নামই হয়ে রইল। আমার আবার ছেলেমেয়েদের একটা ক’রে আটপৌরে নাম না হলে ডেকে সুখ হয় না। দ্যাখো না, ছেলের নাম রেখেছি গুয়ে, হেগো, বাব্লা মেয়েদের নাম পুঁটি, বুচি। উনি আবার তার বাড়া। আমি নাম রাখলুম পুঁটি, উনি তাকে করলেন পিঁকী! আবার আদরের বাহার শুনবে? রোজ আপিস থেকে এসে জামাকাপড় না ছেড়েই ত বাবুর সব আগে মেয়েকে আদর করা চাই, তা আদরের বুলি কি, না পিট্কিরাণী ঘটঘটানি, মরবে তুমি দেখব আমি! আমি আগে আগে গালমন্দ করতুম, আমাকে একদিন বুঝিয়ে দিলে যে বাপ-মা মর বললে পরমায়ূ বাড়ে, সেই থেকে আর কিছু বলি না
-~-
পানদোক্তা-খাওয়া কালো এবং বড় বড় দাঁতগুলি মেলে সরকার-গিন্নী নিজেই হা হা ক’রে হেসে উঠলেন
ততক্ষণে শ্যামার কাপড়চোপড় কাঁচা হয়ে গেছে। ঘরের দিকে রওনা হয়ে যেতে যেতে গিন্নী প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার নামটা ত শোনা হ’ল না বামুন মেয়ে।
‘আমার নাম শ্যামা।’
‘ও ত আবার ঐ পোশাকী নামই হ’ল। আটপৌরে কিছু নেই?’
সে মা ত রাখেন নি। এ মার যা খুশি রেখে নেবেন।’
‘বা, বা! বেশ! বেশ কথাবার্তা তোমার বাপু, তা মানতেই হবে। হবে না কেন, নেকাপড়া-জানা মেয়ে যে। আমিও দত্তদের বাড়ির মেয়ে তবে তখন একেবারেই মেয়েদের লেখাপড়ার চল ছিল না ত। এখন শুনছি ভূদের মাস্টারের দল খুব উঠে পড়ে লেগেছে মেয়েদের লেখাপড়া শেখাবে বলে। কালে কালে কতই হ’ল। আমার নাম মঙ্গলা তা বলে রাখি। আমাদের সব সেকেলে নাম ঐ রকমই রাখা হ’ত তখন। দ্যাখো না, দত্তদের বাড়ির মেয়ে পড়লুম সরকারদের ঘরে। এরা হ’ল গে আমাদের চাকর বংশ, তা কী হবে বলো, পয়সারই জয়জয়কার। এদের ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা যেখানে পয়সা সেখানেই ইজ্জত। এর এক ঠাকুদ্দা আমাদের বাপের বাড়ি পাঁচ টাকা মাইনের চাকরি করত। আমাদের দৌলতেই পয়সার মুখ দেখলে। তা কি হবে বলো!’
হত-শ্রী বংশগৌরবের কথা স্মরণ ক’রেই বোধ হয় সরকার-গিন্নী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
দুই
রাসমণি যা চালডাল সঙ্গে দিয়েছিলেন তাতে দিনকতক চলল। কিন্তু তবু শ্যামা ওর স্বামীর নিশ্চিন্ত ভাবভঙ্গী দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আধ সের মাত্র চাল পাওয়া যায় নিত্য-সেবার নৈবেদ্য থেকে বাঁধা মাপকরা ব্যবস্থা। তাতে ওদের দুবেলা কোনমতেই চলে না। নরেন বরাবরই ভাত খায় বেশী, ঠিক মেপে দেখে নি যদিও কোনদিন, তবু শ্যামার বিশ্বাস এক-একবার সে-ই একপোয়ার ঢের বেশী চাল খায়। এক্ষেত্রে এমন নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকার পরিণাম যে নিশ্চিন্ত উপবাস।
শ্যামা ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়েই বুকে সাহস আনে, স্বামীকে বলে, হ্যাঁগা, কী করছ? মা যা দিয়েছিলেন তা ত ফুরিয়ে এল তারপর?’
খিঁচিয়ে ওঠে নরেন, ‘আরে রেখে দে তোর মার দেওয়া! সে মাগীর ভিক্ষের ভরসাতে আমি এখানে পরিবার নিয়ে এসেছি?’
তা ত আনো নি . কিন্তু চলবে কিসে?’
——-
‘কেন, এই কদিনে নৈবিদ্যির চাল জমছে না?
‘তা জমলেও, সে আর কদিন! আর তা-ই বা জমছে কৈ? ভিজে আতপ চাল বলে রোজই ত রাত্তিরে সেই চাল রান্না হয়, খেয়ে টের পাও না?’
bo
কেন, কেন তা রান্না হয় শুনি? শুকিয়ে রেখে দিতে পারো না?’
‘সে ত একই কথা হল। ওগুলো শুকিয়ে তুলে রাখলে এগুলো ফুরিয়ে যেত তাড়াতাড়ি। তাছাড়া অভ্যাস নেই, দুবেলা আলোচাল খেলে আমাশা ধরত যে!’
啼
‘হুঁ।’ খানিকটা গুম খেয়ে থেকে বলে নরেন, তা নেবিদ্যির সব চালই শোর পেটে
গিলে বসে থাকছ!
শ্যামার চোখে জল এসে যায় এই দুর্নামে। তবু এই লোকটার সামনে চোখের জল ফেলতে লজ্জা করে বলেই প্রাণপণে চেপে থেকে বলে, ‘আমিই খাই, না? যা ভাত রান্না হয় তার চার ভাগের তিন ভাগেরও বেশি ত তুমি খাও। ছেলের আর আমার জন্যে কত কটা পড়ে থাকে। আমি না খেয়েও থাকতে পারি কিন্তু দুধ কমে যাবে তাহ’লে একেবারে, মেয়েটা খাবে কি? দুধ কিনে খাওয়াতে পারবে?’
‘হ্যাঁ, –দুধ কিনে খাওয়াবে! হারামজাদী আমার স্বগ’গে বাতি দেবে কিনা!’
তারপর খানিকটা নিঃশব্দে বসে তামাক টানবার পর গলাটা একটু নামিয়ে বলে, ‘এই ব্যাটারা কি কম! আমিও নরেন ভট্টচার্জ, আমার কাছে যে কথা লুকোবে সে এখনও মায়ের গর্তে। সব আমি টেনে বার ক’রে নিয়েছি এই যে সম্পত্তিটা দেখছ এর সবটাই দেবোত্তর। ঠাকুরের ঐ আধ সের চাল আর আটখানা বাতাসা ঠেকিয়ে দিয়ে নিজেরা দিব্যি নবাবী মারছেন! সম্পত্তিটার আয় একটুখানির? কেন, পারে না আর আধ সের চাল বাড়িয়ে দিতে? দেবো একদিন হাটে হাঁড়ি ভেঙে– সব ওস্তাদি বেরিয়ে যাবে।’
শ্যামার তার এই নির্বুদ্ধিতা সহ্য হয় না। সে বলে ফেলে, ‘তাতে তোমার কি সুবিধে হবে? পারবে মামলা-মকদ্দমা করতে? না, করতে পারলেও তোমার চাকরি থাকবে? তুমি কি খাবে তাই ভাবো।’
+
‘তুই থাম মাগী। মেলা ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করিস নে। আমার মাগ ছেলে কি খাবে না খাবে সে আমি বুঝব। খেতে দিই খাবি, না হয় শুকিয়ে থাকবি। যা করব– চুপ ক’রে থাকবি। একটা কথা কইবি নি, তোর কথার ধার ধারি না আমি।’
অগত্যা চুপ ক’রেই থাকতে হয়। যদিচ ওদের ঘর এক প্রান্তে তবু বাবুদের ছেলেমেয়েরা সর্বদা আসছে যাচ্ছে, তাদের সামনে মারধোর সে বড় অপমান।
―
তবু রাসমণির চাল যেদিন নিঃশেষে ফুরিয়ে গেল, সেদিন কথাটা আর একবার পাড়তেই হল। সব শুনে মুখটা বিকৃত ক’রে নরেন আর একবার তামাক সাজতে বসল! এটাও আগে আগে শ্যামাকে ফরমাশ করত কিন্তু পছন্দ হয় না বলে আজকাল নিজেই সেজে নেয়। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ তামাক খেয়ে উঠে আলনা থেকে গামছা আর উড়নিটা কাঁধে ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল।
এখানে আসার পর এই প্রথম নড়ল নরেন। শ্যামা ভাবলে নিশ্চিত উপবাসের সামনে দাঁড়িয়ে বোধহয় খানিকটা চৈতন্য হয়েছে ওর সে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচল।
কলকাতার কাছেই-৬
কিন্তু প্রভাত ক্রমশঃ দ্বিপ্রহরে, দ্বিপ্রহর অপরাহ্নে, –অপরাহ্ন সন্ধ্যায় শেষ হ’ল তবু নরেনের দেখা নেই। রাত্রিতে শীতল দেওয়ার সময় হয়ে এল। শীতলের দুধ জ্বাল দিয়ে দিতে হয় ব’লে ও কাছেই আসে শ্যামা বহু রাত্রি পর্যন্ত দেখে নিজেই দুধ বাতাসা নিয়ে গিয়ে ঠাকুরঘরে নিবেদন করে দিয়ে এল। মন্ত্র জানে না চোখের জলে সে ত্রুটি পূরণ ক’রে নিয়ে মনে মনে জানালে, ‘অপরাধ নিও না ঠাকুর, সবই ত বুঝছ নিজগুণে এই গ্রহণ করো।’
―
এত
তখন আর উপায়ও ছিল না। মনিবদের কথাটা জানাতে ভরসা হ’ল না
শেষ পর্যন্ত ঠাকুর হয়ত উপবাসী থাকবেন, আর
রাত্রে কোথায় কাকে পাবেন তাঁরা
সেই অপরাধে এই আশ্রয়টুকু ও হয়ত যাবে। বাধ্য হয়েই ঠাকুর দেবতাকে নিয়ে এই মিথ্যাচরণ করতে হ’ল– সেজন্য বার বার শিউরে উঠতে লাগল ওর অন্তরাত্মা।
―
কিন্তু রাত যখন আরও গম্ভীর হয়ে এল (কত রাত তা জানবার উপায় নেই, ঘড়ি এখানে নেই, কারুর ঘড়ির শব্দ কানেও যায় না। দূরে কোন্ একটা কলে ভোঁ বাজে একবার রাত চারটেয়, একবার সকাল আটটায় আর একবার বেলা চারটেয়। এই ওর একমাত্র সময় জানবার উপায়) তখন আর থাকতে পারলে না। সমস্ত বাগানটা অন্ধকারে ভয়াবহ হয়ে ওঠে প্রতি রাত্রেই, সেই নিরন্ধ্র নিঃসীম অন্ধকারে যখন জোনাকি জ্বলে আর ঝিঁঝি পোকা ডাকে তখন প্রত্যহই ওর বুকের মধ্যে ভয়ে গুরুগুর্ করে। গুপ্তিপাড়ায় থাকতে জোনাকি আর ঝিঁঝি পোকা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এখানের ঝিঁঝি পোকা যেন বড় বেশি ডাকে, তেমনি ব্যাগুলো ঘ্যাঙর ঘোঁ করে সারারাত। তবু অন্যদিন নরেন থাকে আজ একা এই ঘরে, বিজন বনের মধ্যে শুধু এই দুটি শিশু পুত্রকন্যা নিয়ে থাকতে যেন কিছুতেই সাহসে কুলোল না। সে মরিয়া হয়ে ঘরে তালা লাগিয়ে ভেতরে গিয়ে মঙ্গলার শরণাপন্ন হ’ল। মিছে কথাই বললে, ‘মা, উনি শেতল দিয়েই যে কোথায় বেরোলেন এখনও ত ফিরলেন না, একা কি
,
করে থাকব?’
–
‘তাই ত! বেরোল আবার কোথায়, এত রাত্রে! ছোঁড়ার আক্কেল ব’লে যদি কিছু আছে! ভর-যুবতী বৌ ঘরে এই এত রাত্রে, বাগানের একটেরে তাই-ত! দেখি যদি হরির মা তোমার ঘরে শুতে রাজী হয়। তোমাদের যা বিছানা বাপু, আমার ছেলে- মেয়েরা শুতে রাজী হবে না।
চকিতে ওদের কলকাতার বাড়ির শিমূলতুলোর পুরু গদি আর ধপধপে চাদরের কথাটা মনে পড়ে যায়। রাসমণি দরিদ্র হ’লেও জমিদারীর অভ্যাস কতকগুলি ছাড়তে পারেন নি এখনও, তার মধ্যে বিছানার বিলাস একটি।… ওর শ্বশুরবাড়িতেও খাট- পালঙ্কের ছড়াছড়ি ছিল –নিজের চোখেই দেখেছে শ্যামা।
সে একটা উদগত নিঃশ্বাস দমন ক’রে বললে, ‘না মা, শুতে কাউকে হবে না। একটু কান রাখবেন। একা রইলুম যদি ভয়-টয় পাই– একটু সাড়া দেবেন।’
‘অ!’ অপ্রসন্ন কণ্ঠে মঙ্গলা বলেন, হরির মা ঝি বলে বুঝি তাকে বিছানায় নিয়ে শুতে মানে বাধল। তা ঝি হোক ওর গায়ে জল আছে বাপু তা মানতেই হবে। আর
কৈবত্তর মেয়ে, সৎ জাত, এমন কিছু ময়লা কাপড়ও পরে থাকে না তোমার খুশি। তা ব’লে আমি ছেলেমেয়ে ও ঘরে পাঠাতে পারব না।’
সে দ্যাখো, যা
অপরাধিনীর মত মাথা হেঁট করে বেরিয়ে এল শ্যামা। ফল কিছুই হ’ল না মাঝখান থেকে কথাটাই জানাজানি হয়ে গেল।
সেদিন রাত্রে খাওয়া হ’ল না কিছু। সকালেও ভাত খায় নি, নরেনের জন্য অপেক্ষা ক’রে বসে ছিল সেই জল দেওয়া ভাতই হেমকে এক গাল খাইয়ে, মেয়েকে দুধ খাইয়ে নিজে শুধু বাতাসা মুখে দিয়ে এক ঘটি জল খেয়ে শুয়ে পড়ল।
পরের দিন সকালেও নরেনের দেখা নেই। বেলা আটটা নাগাদ পুঁটুরাণী দেখা দিলেন, ‘কি গো বামুন-দি, ভট্ট্চাজ মশাই ফিরেছে?’
পুঁটু বা পিটকী সত্যিই শ্যামার চেয়ে বয়সে বড় কিন্তু তার বিশ্বাস অন্য রকম। তাই সে দিদি বলেই ডাকে, শ্যামাও প্রতিবাদ করে না। ওর বিয়ে হয়েছে, ছেলেমেয়েও হয়েছে। কিন্তু কথাবার্তায় মঙ্গলার মুখেই শুনেছে শ্যামা তাদের অবস্থা খুব ভাল নয় ব’লে বছরের দশ মাসই এখানে থাকে; মঙ্গলা আদরের মেয়েকে পাঠান না।
‘মাগো, শুনলে অবাক্ হয়ে যাবে, বাসনমাজার একটা ঝি পর্যন্ত নেই কায়েতবাড়ির এমন দন্যিদশা হয় শুনি নি কখনও। সে বাড়িতে মেয়ে পাঠাই কি ক’রে বলো? আমার আদরের বড় মেয়ে, সে কি বাসন মাজতে যাবে সে বাড়ি! ঘকী মাগীই ত সর্বনাশ করলে
মিথ্যে ভুচুং দিয়ে বিয়ে দেওয়ালে। কী বলব এদিক আর মাড়ায় না ভয়ে, নইলে আমি সদ্য আঁশবটি দিয়ে নাকটা কেটে নিতুম, তবে অন্য কথা! না হয় জেল হত আমার এর বেশি ত নয়? তবে তাও বলি, দত্তবাড়ির মেয়েকে জেল দেয় এমন জজ ম্যাজেস্টার এখনও জন্মায় নি।’
–
আপন মনেই এমনি বকে যান উনি
―
হয়ত বাসন মাজতে মাজতেই শোনে শ্যামা আদরের মেয়ে সেও ছিল, এখনও তার বাপের বাড়িতে দিনরাতের ঝি আছে। কিন্তু সে কথা তোলা এখানে নিরর্থক
পুঁটির প্রশ্নের উত্তরে ভয়ে ভয়ে ঘাড় হেঁট করে শ্যামা জানায় যে নরেন ফেরে নি
এখনও।
‘তবেই ত চিত্তির! পূজোর কি হবে?’ পুঁটি যেন একটা উল্লাসই বোধ করে শ্যামার এই বিপদে। কোথায় যে একটা কি কারণ ঘটেছে তা শ্যামা জানে না কিন্তু পুঁটির একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষ সে অনুভব করতে পেরেছে এই ক-দিনেই
‘দাঁড়িয়ে আতান্তর বলো!’ পুঁটি আরও খানিকটা অপেক্ষা ক’রে (বোধ হয় শ্যামার কাছ থেকে উত্তর পাবার আশা ক’রে) মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল, ‘তখনই বলেছিলাম মাকে যে ঐ নেশাখোর মিসেকে ঢুকিও না –ঠাকুরের সাত হাল হবে।’
আরও খানিক পরে এলেন মঙ্গলা নিজেই, ‘হ্যাঁগা তা হ’লে কি হবে বলো, ঠাকুর ত চচ্চড়ি হচ্ছেন এত বেলা অবৃদি –সারাদিন ত আর টাঙিয়ে রাখতে পারি না।’
শ্যামা নিঃশব্দে মাথা হেঁট ক’রে দাঁড়িয়ে পায়ের নখ দিয়ে উঠোনের মাটি খোঁড়ে। কি জবাব দেবে সে? কি জবাব দেবার আছে? পৃথিবী যেন টলতে থাকে ওর পায়ের নিচে।
মঙ্গলা মুহূর্তকয়েক চুপ ক’রে থেকে বলেন, ‘আছে এখানে আর একজন পুরুত বামুন, সে-ই পুজো করত, গাঁজাখোর বলে তাড়িয়ে দিয়েছি। বলো ত তাকেই ডাকি, যে—কদিন নরেন না আসে ঐ করুক। তবে তাকে নৈবিদ্যির চালটা পুরো ধরে দিতে হবে বাপু, তা আগেই ব’লে রাখছি। নইলে সে ব্যাগার দিতে আসবে কেন? আমার বরাতই এমনি। ছোঁড়াকে কত ক’রে বুঝিয়ে বললুম যে, এখানে ত আরও ক-ঘর বামুন কায়েত আছে, ষষ্ঠী মাকাল পুজোও লেগে আছে সব ঘরেই বলে বারো মাসে তেরো পাব্বন। ঘুরে ঘুরে যদি সব ক-ঘর না হোক্, আদ্দেকও ধরতে পারিস্ ত ভাবনা কি!
ঐ গাঁজাখোর ভরসা, ওকে কেউই রাখতে চায় না। তা শুনলে আমার কথা?’
কাল থেকে খাওয়া হয় নি। আজকের চালগুলোও যাবে। শ্যামা একবার ব্যাকুল হয়ে ওঁর মুখের দিকে চেয়ে যেন কী বলতে গেল শেষ পর্যন্ত বলতে পারলে না। কীই বা বলবে, যে পূজো করবে সে কেন চাল ছেড়ে দেবে? ওঁরা যে এই বন্দোবস্তেই রাজী হয়েছেন এই ঢের। এখনই যে তাড়িয়ে দেন নি, এই জন্যেই মনে মনে কৃতজ্ঞতা বোধ করল সে।
সেই ব্যবস্থাই হ’ল। পুরাতন ব্রাহ্মণ এসে বার বার সবাইকে শুনিয়ে গেলেন, ‘নেশাই করি আর যাই করি, বামুন ত বটে। জাত সাপ। তাড়িয়ে দিলেই হ’ল! আবার ত শেষে সেই ডাকতে হ’ল। তা বাবু আমার এমন একটিনি করা পোষাবে না। ও যদি না করে ত পূজোটা আমাকেই দেওয়া হোক্।’
হেম কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকালে কতকগুলো কালোজাম তাকে খেতে দিয়েছিল শ্যামা। দুপুরে সকলে ঘুমোলে বাগান থেকে কতকগুলো ডুমুর পেড়ে এনে সেদ্ধ ক’রে নুন দিয়ে খাওয়ালে। নিজেও খানিকটা খেলে তাই। উপবাস করতে তার আপত্তি নেই কিন্তু মেয়েটার মুখ চেয়ে প্রাণপণে চোখের জল চেপেও সেই ডুমুরসেদ্ধ খেতে হ’ল।
পরের দিন আর সহ্য একগাল চাল যদি দেন মা
করতে না পেরে মঙ্গলাকে গিয়ে বললে, ছেলেটার মত
নেতিয়ে পড়েছে একেবারে!’
‘ওমা, ঘরের বুঝি এমনি অবস্থা! একেবারে ভাঁড়ে মা ভবানী? তোমারও মুখচোখ বসে গেছে যে, মুখে আগুন অমন সোয়ামীর। আমি হলে অমন সোয়ামীর মুখে জ্যান্ত নুড়ো জ্বেলে দিয়ে চলে যেতুম। খাকী-খাতায় নাম লেখাতে হ’ত তাও ভাল। হাত্তোর বামুনের ঘর রে!’
এক রেক চাল বার ক’রে দিয়ে বললেন, ‘এইতেই টিপে টিপে চালাও গে, সে ছোঁড়া কতদিনে আসে তার ঠিক কি!’
টিপে টিপে চালালেও এক রেক চাল এক রেকই। আরও দিন কতক উপবাসের পর একদিন নরেন্দ্রনাথ দেখা দিলে। কাঁধে একটা বচ্চা, খালি পা– উডুনিখানাও নেই; পরণের কাপড়খানা যেমন ময়লা তেমনি শতছিন্ন গামছাটা গায়ে জড়ানো।
b8
ধপাস্ ক’রে বস্তাটা নামিয়ে রেখে প্রশান্ত কণ্ঠেই বললে, কৈ গো কোথায় গেলে, একটু তামাক সাজো দিকি!’
তিন
ঘৃণা যখন আকণ্ঠ পূর্ণ হয়ে উপচে পড়ে তখন তিরস্কারের ভাষাও মুখ দিয়ে বেরোয় না। শ্যামারও উপবাস-শীর্ণ ঠোঁট দুটি বারকতক থরথর করে কাঁপল বটে কিন্তু একটি কথাও সে কইতে পারলে না, কিছুক্ষণ বৃথা চেষ্টা ক’রে ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ল। ক্লান্তিতে, অবসাদে, দুঃখে ওর চৈতন্যও যেন এলিয়ে পড়েছিল।
হাঁক-ডাকে মঙ্গলা নিজেই এলেন ছুটে। তাঁর সমস্ত লাঞ্ছনা চুপ ক’রে সহ্য ক’রে নরেন একটু হাসবারও চেষ্ট করলে। বললে, ‘ও যে এত বোকা, সব ভাড়ার খালি ক’রে আমাকে বলেছিল তা কি করে জানব! আমি ভাবলুম যে ঘরে মার দরুন চাটটি চাল রেখেই বলেছে হাঁড়ি খালি। আর রোজগার করা কি মা এতই সোজা! কত ত ঘুরলুম, নিজেই কি সব দিন খেতে পেয়েছি ভাবছেন? তাহ’লে এমন ছিরি হয়? জুয়া খেলে কিছু রোজগার করেছিলুম, আবার জুয়া খেলেই তা দিয়ে আসতে হল। শেষে এই পনেরো দিন এক গোলদারী দোকানে খাতা লিখে নানান্ ভাঁওতা দিয়ে এই আধমণ ময়দা নিয়ে সরে পড়েছি। তা গেল কোথায়, রুটিই গড়ুক না খানকতক!
‘তোমার লজ্জা নেই, বেহায়ার একশেষ তা জানি বাছা, তোমাকে কথা বলাই মিথ্যে। কিন্তু এমন ক’রে ত আমার চলবে না তা ব’লে দিলুম। এরকম যদি করতে হয় ত পথ দ্যাখো। আমার ঘর খালি ক’রে দাও, আমি দোসরা লোক দেখি। বলে মরেও না. ছাড়েও না আড়া আগলে পড়ে থাকে, এমন ধারা আমার চলবে না।
মাইরি মা, এই আপনার দিব্যি বলছি আর হয়ত দু-একবার এমনি হবে। তারপর আমি একেবারে ভাল ছেলে হয়ে বসব এখানে এসে। আপনি দেখে নেবেন।’
বকতে বকতে মঙ্গলা চলে গেলেন। নরেন উঠে এসে শ্যামার হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে তুলে দাঁড় করিয়ে দিলে, ‘নে নে, ওঠ, আর অত ন্যাকামোয় কাজ নেই!’ খানকতক রুটি গড়ু দেখি ভালমানুষের মত!’
শ্যামা আঘাত পেলে কিন। বোঝা গেল না। খানিকটা কেঁদে সে বোধ হয় প্রকৃতিস্থ হয়েছিল, আঁচলে চোখ মুছে শান্ত কণ্ঠেই বললে, ‘রুটি খাবে কি দিয়ে? ঘরে ডাল মশলা ত চুলোয় যাক-নুন তেল পর্যন্ত নেই!’
রাগে দাঁত কিড়মিড় করে উঠল নরেন, ‘উ! সব ঐ শোর পেটে গিলে আর গিলিয়ে বসে আছ! আ-ত্তোর নিকুচি করেছে!…’
+
তারপর ওর মুখের কাছে হাত-পা নেড়ে দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললে, বেশ করেছ, এখন শুধু খাও! আমি তার কি করব!’
2
শ্যামা মার কাছ থেকে যা নিয়ে এসেছিল তারপর যে নরেন আর এক ছটাকও
ডাল মশলা নুন তেল কেনে নি
অনাবশ্যক বোধেই সে কথাটা আর স্মরণ করালে না অনাবশ্য
be
―
সে। স্বামীর মুখের দিকে চাইলেও না একটা গামলাতে খানিকটা ময়দা বার ক’রে নিয়ে মাখতে বসল।
কে জানে কেন–ওর এই নীরব উপেক্ষা আজ নরেনের চোখে পড়ল, সে খানিকটা চুপ ক’রে ওর গতিপথের দিকে চেয়ে থেকে নিজেই তামাক সাজতে বসল, তারপর বেশ একটু উচ্চকণ্ঠেই মন্তব্য করলে, ‘হুঁ–তেজ হয়েছে, তেজ! তেজ ভাঙব যেদিন, বুঝবি!’
দিন দুই-তিন ঘরে বিশ্রাম করলে নরেন। আগেকার পুরোহিতকে নিজেই ডেকে বললে, ‘মাইরি দাদা, যে কটা দিন না আসি তুমি চালিয়ে নিও। দেখছ ত, আমি কাজের তালেই ঘুরছি। কোথাও একটা আট-দশ টাকার কাজও যদি পাই ত চলে যাবো এখানে কি থাকব ভেবেছ? তা- হ’লেই ত ষোল আনা তোমার হয়ে গেল, বুঝলে
কাজেই গোল ক’রো না কিছু –আমি কাজটা তোমাকেই দেওয়াতে চাই।’ এর ভেতর সে কোথা থেকে কিছু ডাল নুন তেলও যোগাড় করে এনেছিল। চারদিনের দিন বৌকে ডেকে বললে, ভাঁড়ার সব গুছিয়ে দিয়ে গেলুম নাকে কাঁদবি না, খবরদার! আমি আবার এখন দিনকতক ঘুরব। দেখি যদি কাজটাজ পাই।’
না?
―
এখনই যে সে যেতে চাইবে শ্যামা তা ভাবে নি। সে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অতি কষ্টে যখন কণ্ঠস্বর ফিরে এল তখন বললে, ‘তুমি আবার চলে যাবে? কে দেখবে?’
‘দেখবে আবার কে? তুই কচি খুকী নাকি? দোরে খিল দিয়ে শুবি এই দিন চার-পাঁচের মধ্যেই ফিরব।’
আমাদের
আমি, আমি
এরপর ফিরল নরেন একেবারে দেড় মাস কাটিয়ে। অলঙ্কার বিশেষ কিছুই ছিল না। এবার মা আসবার আগে নতুন ক’রে কানের দুটো মাকড়ী, নাকের নথ এবং দুগাছা বালা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। উপবাস সহ্য করতে না পেরে শ্যামা মাকড়ী দুটো মঙ্গলা ঠাকরুনের কাছে বাঁধা রাখতে বাধ্য হয়েছিল। তবু ও তার ছেলের এবং নিজের দেহের যে অবস্থা হয়েছে তাতে চিনতে পারবার কথা নয়। নরেনও কিছুক্ষণ অবাক্ হয়ে তাকিয়ে থেকে একটু যেন অনুতাপের সুরেই বললে ‘ইস্ কি চেহারা হয়েছে রে তোর ছোট বৌ? খেতে-টেতে পাস্ নি বুঝি! এত বড় লোকের আশ্রয়ে রেখে গেছি– বামুনের মেয়ে, তোরা ত হলি গিয়ে শুদ্দর, কায়েত। তোদের বাড়ি আমার ঠাকুর্দা থাকলে পা ধুতেও আসতুম না।
তোরা চাটটি চাল দিতে পারিস নি? চামার! চামার!
চোখের পর্দা নেই এতটুকুও।’
খানিকটা গজগজ ক’রে বাঁ হাতের পুঁটুলিটা নামিয়ে রাখলে। ডান হাতে ছিল গালা-মাখানো একটা মাটির ভাঁড় তাতে খানিকটা ঘি। সেটা শ্যামার হাতে দিয়ে বললে, ‘পরশু একটা ছেরাদ্দর কাজ জুটেছিল– তারই দি। খাসা গাওয়া ঘি, আধসেরের কম নয়। আর ঐ নে, ওতে ভুজ্যির চাল ডাল আনার পাতি মশলা দুখানা কাপড়– সব আছে। মায় আজ নেমভঙ্গের একটা মাস
ভাল করে রান্নাবান্না
কর্।’
by
এবারেও শ্যামা কোন কথা কইলে না। শুধু যে ঘৃণা করে ওর তাই নয়– এতদিনে সে সম্পূর্ণ বুঝেছে যে এ পশুর সঙ্গে চেঁচামেচি করা সম্পূর্ণ অনর্থক। জীবনের স্বাদ তার ঘুচে গেছে আনন্দ দুঃখ এই বয়সেই যেন আর দাগ কাটে না। শুধু হেম আর মহাশ্বেতার মুখ চেয়ে কোনমতে প্রাণধারণের উপায় খুঁজে বেড়ায় সে এখন দিনরাত।
মঙ্গলা কিন্তু শ্যামার সহজ নিস্তব্ধতা পুষিয়ে নিলেন। বললেন, ‘এবার এসেছ মাগ ছেলের হাত ধরে যে পথ দিয়ে ঢুকেছিলে সেই পথ দিয়ে বেরিয়ে যাও। এমন ক’রে আমি পারব না– সাফ কথা। আর সহজে না যাও ত পুলিস্ ডাকব বলে দিলুম।’
প্রথম সমস্ত বকুনিটা নরেন শুনেছিল চুপ ক’রেই, কিন্তু এই কথায় সে যেন ছিটকে তিড়িং ক’রে লাফিয়ে উঠল, ‘ডাকুন না পুলিস। ঠাকুরের সম্পত্তি নিজেরা সব দুধে-মাছে খাচ্ছেন আর ঠাকুরের জন্যে ঠেকিয়ে রেখেছেন আধ সের করে চাল! লজ্জা করে না আপনার! আপনার কি, আমি ত একটিন দিয়ে গেছি। কাজ পেলেই হ’ল। পুলিস ডাকবেন! এখনও চন্দর-সূয্যি উঠছে বুঝলেন, হাজার হোক আপনারা শুদ্দুর আর আমরা বামুন! যদি বেরোতে হয় পৈতে ছিঁড়ে বেরিয়ে চলে যাবো। ছেলেপিলে নিয়ে ঘর করেন সবাই, মুখে রক্ত উঠে মরে যাবে এই বলে দিলুম!’
মঙ্গলা অভিযোগে ততটা ভয় পান নি যতটা পেলেন এই অভিশাপের সম্ভাবনায়। মুখ শুকিয়ে উঠল তাঁর। গলাটাও অনেকটা নামিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেলেন নিজের বাড়ির দিকে। তিনি অদৃশ্য হয়ে যেতেই নরেন যেন মনের খুশিতে একপাক নেচে নিয়ে হি হি ক’রে হেসে বললে, ‘দেখলি কেমন জোঁকের মুখে নুন পড়ল! তুই ত ভেবেই খুন। যখন যাবো নিজের খুশিতে যাবো। তা ব’লে ওরা তাড়াবার কথা বলবে! ইস, বলুক দিকি! এক তুড়িতে উড়িয়ে দেবো না!’
সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা খানিকটা ঘুম দিয়ে উঠে বসে প্রথমেই নরেন ফরমাশ করলে, ‘অনেকদিন ভালমন্দ খাই নি। আজ খানকতক লুচি ভাজ্ দিকি আমার মত। লুচি আর আলুর দম। তোরাও না হয় দুখানা ক’রে খাস।’
শ্যামা একটু অবাক্ হয়ে তাকিয়ে থেকে বললে, ‘কিন্তু ময়দা পাবো কোথায়? তোমার ও পুঁটুলিতে ত ময়দা ছিল না।’
‘সে কি! কেন, সেই যে ময়দা ছিল আধ বস্তা!’
শ্যামার বাকরোধ হয়ে এল বিস্ময়ে, ‘সেই ময়দা আজও থাকবে? তুমি কদিন বাড়িছাড়া হিসেব করেছ? আর কী রেখে গিয়েছিলে? ছেলেমেয়েদের বাঁচাই কী দিয়ে! মাকড়ী-জোড়া রেখে সরকার-গিন্নী চার টাকা দিয়েছিলেন, তাও ত সব চলে গেছে। এই তিন দিন কুমড়ো আর ডুমুরসেদ্ধ খেয়ে আছি আমরা। ওদের বাগান থেকে চুরি ক’রে আনতে হয়েছে কুমড়ো। আমাদের দিন কী ক’রে চলে তার কোনদিন হিসেব রেখছ? আমি মরি তাতে দুঃখ নেই একটুও ছেলেমেয়েগুলোকে ত তুমি এনেছ
সংসারে! তাদের কথাও ভাবো কোনদিন?’
বলতে বলতে এতদিনের জমাট-বাঁধা দুঃখ যেন অন্তরের শাসন ভেঙে দুই চোখের কুল ছাপিয়ে বেরিয়ে এল। কান্নায় গলা বুজে এল শ্যামার।
bq
কিন্তু সে অশ্রুর প্রতিক্রিয়া হ’ল নরেনের ওপর ঠিক বিপরীত। সে যেন জ্বলে উঠল, ‘তাই ব’লে তুমি সেই আধ বস্তা ময়দা নুন-তেল দিয়ে সবাইকে গিলিয়ে বসে আছ! ছেলেমেয়ে, ছেলেমেয়ে আমার স্বগে বাতি দেবে! হারামজাদা, শুয়োরের
বাচ্ছা সব!’
শ্যামারও ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল এবার। সেও কণ্ঠস্বর বেশ একটু চড়িয়েই বললে, ‘তুমি ত চারদিন খেয়ে তবে এ বাড়ি থেকে গেছ। দু’বেলা তিনটে লোক ময়দা খেলে আধ মণ ময়দার কত বাকী থাকে?’
‘দেখাচ্ছি কত বাকী থাকে! ঐ গোরবেটার জাতকে আগে এক এক কোপে সাবাড় করি, তারপর তোকে কেটে যদি ফাঁসি না যাই ত আমি বামুনের ছেলে নই!’
এই বলে মুহূর্ত-খানেক এদিকে ওদিকে চেয়েই ঘরের কোণ থেকে কাটারিখানা তুলে নিয়ে উঠোনে বেরিয়ে এল, কৈ, কোথায় গেল সে বেটাবেটিরা? আজ তাদের শেষ ক’রে তবে অন্য কাজ।
+
চরম বিপদের সময় একরকম মরিয়া হয়ে ওঠে মানুষ, সাহস ও বুদ্ধি দেখা দেয় অপ্রত্যাশিত ভাবে। রান্নার জন্য বাগান থেকে কুড়িয়ে আনা কয়েকটা গাছের ডাল ছিল ঘরের কোণে, অকস্মাৎ তাই একটা তুলে নিয়ে শ্যামাও বাইরে বেরিয়ে এল প্রায় ছুটে, তারপর অপ্রত্যাশিত দৃঢ় কণ্ঠে বললে, ‘নামাও বলছি কাটারি, নইলে আমি ঠিক মাথা ফাটিয়ে দেব। নামাও!’
কী ছিল সে কণ্ঠে তা নরেন না বুঝতেও একটু কেমন ক’রে অনুভব করলে যে, আজ এই মুহূর্তে শ্যামার পক্ষে সবই সম্ভব। হয়ত সে নিজের মনে মনেই বুঝেছিল যে স্ত্রীর ধৈর্যের ওপর চরম আঘাত সে হেনেছে। আস্তে আস্তে উদ্যত হাত নামিয়ে কাটারিখানা উঠোনেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললে, ‘আচ্ছা আজ থাক। কিন্তু তোদের মৃত্যুর আর বেশি দেরি নেই তা বলে দিলুম।’