১০. যাও বলে মানুষকে তাড়ানো যায়

যাও বলে মানুষকে তাড়ানো যায়, চিন্তাকে তাড়ানো যায় না। তাড়ানো যায় না মানসিক দ্বন্দ্বকে। সত্যবতীকে যাও’ বলে ঘর থেকে সরিয়ে দিলেন রামকালী, কিন্তু মন থেকে সরাতে পারছেন না সহসা উদ্বেলিত হয়ে-ওঠা এই চিন্তাটাকে, তাড়াতে পারছেন না এই দ্বন্দ্বটাকে।

তা হলে কি ঠিক করি নি?

তবে কি ভুল করলাম?

চিন্তার এই দ্বন্দ্ব রামকালীকেই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, ঘর থেকে চণ্ডীমণ্ডপে, চণ্ডীমণ্ডপ থেকে বারবাড়ির উঠোনে, সেখান থেকে বাগান বরাবর। কি জানি কেন, একেবারে চাটুয্যেপুকুরের ধারে ধারে পায়চারি করতে থাকেন রামকালী।

দীর্ঘায়ত শরীর সামনের দিকে ঈষৎ ঝোকা, দুই হাত পিঠের দিকে জোড় করা, চলনে মন্থরতা। রমিকালীর এ ভঙ্গীটা লোকের প্রায় অপরিচিত। দৈবাৎ কখনো কোনো জটিল রোগের রোগীর মরণ বাচন অবস্থায় চিন্তিত রামকালী এইভাবে পায়চারি করেন। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের পুঁথি নেড়ে ঔষধ নির্বাচন করেন না রামকালী, এইভাবে বেড়িয়ে বেড়িয়েই মনে করেন। হয়তো বা পুঁথির পৃষ্ঠাগুলো মুখস্থ বলেই সেগুলো আর না নাড়লেও চলে। শুধু ভেবে দেখলেই চলে।

কিন্তু সে তো দৈবাৎ।

ঔষধ নির্বাচনের জন্য চিন্তার বেশী সময় নিতে হয় না কবরেজ চাটুয্যেকে, রোগীর চেহারা দেখলেই মুহূর্তে রোগ এবং তার নিরাকরণ ব্যবস্থা দুইই তার অনুভূতির বাতায়নে এসে দাঁড়ায়। তাই চিন্তিত মূতিটা তার কদাচিৎ দেখতে পাওয়া যায়। ঋজু দীর্ঘ দেহ– শালগাছের মত সতেজ, দুই হাত বুকের উপর আড়াআড়ি করে রাখা, প্রশস্ত কপাল, খড়গনাসা, আর দৃঢ়নিবদ্ধ ওষ্ঠাধরের ঈষৎ বঙ্কিম রেখায় আত্মপ্রত্যয়ের সুস্পষ্ট ছাপ। এই চেহারাই রামকালীর পরিচিত চেহারা। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম ঘটেছে, আজ রামকালীর মুখের রেখায় আত্মজিজ্ঞাসার তীক্ষ্ণতা।

তবে কি ভুল করলাম?

তবে কি ঠিক করি নি? তবে কি আরও বিবেচনা করা উচিত ছিল? কিন্তু সময় ছিল কোথা?

বার বার ভাবতে চেষ্টা করছেন রামকালী, তবে কি বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছেন? তাই একটা অবোধ শিশুর এলোমেলো কথার উপর এতটা মূল্য আরোপ করে এতখানি বিচলিত হচ্ছেন? কি আছে এত বিচলিত হবার? সত্যিই তো, ত্রিভুবনে সতীন কি কারো হয় না? অসংখ্যই তো হচ্ছে। বরং নিঃসপত্নী স্বামীসুখ কটা মেয়ের ভাগ্যে জোটে, সেটাই আঙুল গুনে বলতে হয়। কিন্তু এ চিন্তা দাড়াছে না। চেষ্টা করে আনা যুক্তি ভেসে যাচ্ছে হৃদয়-তরঙ্গের ওঠাপড়ায়। কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছেন না একফোঁটা একটা মেয়ের কথাগুলোকে।

বহুবিধ গুণের সমাবেশে উজ্জ্বল বর্ণাঢ্য চরিত্র রামকালীর, পুরুষের আদর্শস্থল, তবু সে চরিত্রের গাঁথনিতে একটু বুঝি খুঁত আছে। মানুষকে মানুষের মর্যাদা দেবার শিক্ষা আছে তার, শিক্ষা আছে বয়োজ্যেষ্ঠকে সম্মান সমীহ করবার, কিন্তু সমগ্র ‘মেয়েমানুষ’ জাতটার প্রতি নেই তেমন সমবোধ, নেই সম্যক মূল্যবোধ।

যে জাতটার ভূমিকা হচ্ছে শুধু ভাত-সেদ্ধ কর! ছেলে ঠেঙাবার, পাড়া বেড়াবার, পরচর্চা করবার, কোন্দল করে অকথ্য অশ্রাব্য গালিগালাজ করবার, দুঃখে কেঁদে মাটি ভেজাবার আর শোকে উন্মাদ হয়ে বুক চাপড়াবার, তাদের প্রতি প্রচ্ছন্ন এক অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছু আসে না রামকালীর। অবশ্য আচার-আচরণে ধরা পড়ে না, ধরা পড়ে না হয়তো নিজের কাছে– তবু অবজ্ঞাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু সম্প্রতি ক্ষুদে একটা মেয়ে যেন মাঝে মাঝে তাকে ভাবিয়ে তুলছে, চমকে দিচ্ছে, বিচলিত করছে, মেয়েমানুষ’ সম্পর্কে আর একটু বিবেচনাশীল হওয়া উচিত কিনা এ প্রশ্নের সৃষ্টি করছে।

আকাশে সন্ধ্যা নামে নি, কিন্তু তাল নারকেলের সারি-ঘেরা পুকুরের কোলে কোলে সন্ধ্যার ছায়া। এই প্রায়ান্ধকার পথটুকুতে পায়চারি করতে করতে সহসা রামকালীর চোখের দৃষ্টি ঈগলের মত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। কে? ঘাটের পৈঠের একেবারে শেষ ধাপে অমন করে বসে ও কে? কই এতক্ষণ তো ছিল না, কখন এল? কোন পথ দিয়েই বা এল? আর কেনই বা এল এমন ভরা-ভরা সন্ধ্যায় একা? এ সময় ঘাটের পথে এমন একা মেয়েরা কদাচিৎ আসে, অবশ্য মোক্ষদা বাদে। কিন্তু দূর থেকে কে তা ঠিক বুঝতে না পারলেও মোক্ষদা যে নয়, সেটা বুঝতে পারলেন রামকালী।

তবে কে?

অভূতপূর্ব একটা ভয়ের অনুভূতিতে বুকের ভেতরটা কেমন সিরসির করে উঠল। রামকালীর পক্ষে এ অনুভূতি নিতান্তই নতুন।

অন্ধকার দ্রুত গাঢ় হয়ে আসছে, দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণতর করেও ফল হচ্ছে না, অথচ এর চেয়ে কাছাকাছি গিয়ে ভাল করে নিরীক্ষণ করবার মত অসঙ্গত কাজও রামকালীর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একেবারে অগ্রাহ্য করাই বা চলে কি করে? সন্দেহ যে ঘনীভূত হচ্ছে। এ আর কেউ নয়, নির্ঘাত রাসুর বৌ!

কিন্তু সত্য কি করল? সত্যবতী? পাহারা দেওয়ার নির্দেশটা পালন করল কই?

দিব্যি বড়সড় একটা কলসী ওর সঙ্গে রয়েছে মনে হচ্ছে।

যারা সাঁতার জানে, তাদের পক্ষে জলে ডুবে মরতে কলসীটা নাকি সহায়-সহায়ক। আর ছেলেমানুষ একটা মেয়ে যদি ওই কলসীটা গলায় বেঁধে

চিন্তাধারা ওই একটা দুশ্চিন্তার শিলা পাথরকে ঘিরেই পাক খেতে থাকে। কিছুতেই মনে আসে, অসময়ে জলের প্রয়োজনেও কলসী নিয়ে পুকুরে আসতে পারে লোক।

তবে এটা ঠিক, জল ভরবার তাগিদ কিছু দেখা যাচ্ছে না ও ভঙ্গীতে। কলসীর কানাটা ধরে চুপচাপ বসে থাকাকে কি তাগিদ বলে?

নাঃ, জলের জন্যে অন্য কেউ নয়, এ নির্ঘাত রাসুর বৌ। মরবার সংকল্প নিয়ে ভরসন্ধ্যায় একা পুকুরে এসেছে, তবু চট করে বুঝি সব শেষ করে দিতে পারছে না, শেষবারের মত পৃথিবীর রূপ রস শব্দ স্পর্শের দিকে তাকিয়ে নিতে চাইছে।

শুধুই কি তাই?

তাকিয়ে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে ভাবছে না কি, কার জন্যে তাকে এই শোভা সম্পদ, এই সুখভোগ থেকে বঞ্চিত হতে হল?

হঠাৎ চোখ দুটো জ্বালা করে এল রামকালীর।

এই জ্বালা করাকে রামকালী চেনেন না। এ অনুভূতি সম্পূর্ণ নতুন, সম্পূর্ণ আকস্মিক।

কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে তো চলবে না, এখুনি একটা বিহিত করতে হবে। নিবৃত্ত করতে হবে মেয়েটাকে। অথচ উপায় বা কি? রামকালী তো আর মেয়ে-ঘাটে নেমে হাত ধরে তুলে আনতে পারেন না! পারেন না ওকে সদুপদেশ দিয়ে এই সর্বনাশা সংকল্প থেকে ফেরাতে! ডাকবেনই বা কি বলে? কোন্ নামে? রামকালী যে শ্বশুর।

অথচ এখান থেকে সরে গিয়ে কোনও মেয়েমানুষকে ডেকে নিয়ে আসবার চিন্তাটাও মনে সায় দিচ্ছে না। যদি ইত্যবসরে

আরে, আরে, স্থিরচিত্রটা চঞ্চল হয়ে উঠল যে!

কলসীটা জলে ডুবিয়ে জল কাটছে যে মেয়েটা! ঈগল-দৃষ্টি ছুরির ফলার মত তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, নিজের অজ্ঞাতসারেই মেয়ে-ঘাটের দিকে এগিয়ে যান রামকালী, এমন সংকট মুহূর্তে ন্যায় অন্যায় উচিত অনুচিত নিয়ম অনিয়ম মানা চলে না। আর একটু ইতস্তত করলেই বুঝি ঘটে যাবে সেই সাংঘাতিক কাণ্ডটা!

দ্রুতপদে একেবারে ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন রামকালী, প্রায় আর্তনাদের মত চিৎকার করে উঠলেন, কে ওখানে? সন্ধ্যেবেলা জলের ধারে কে?

রামকালী আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছিলেন, তাঁর চীৎকারের ফলটা কি দাঁড়াল! ওই যে সাদা কাপড়ের অংশটুকু দেখা যাচ্ছিল এতক্ষণ, সেটা কি এই আকস্মিক ডাকের আঘাতে সহসা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? যেটুকু দ্বিধা ছিল সেটুকু আর রইল না? ওই তো বসে রয়েছে জলের মধ্যে পায়ের পাতা ডুবিয়ে, জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান শুধু একটি লহমার, একটি ডুবের। তার পরই তো ওর সব দুঃখের অবসান, সব জ্বালার শান্তি। ওইখানেই তো ওর হাতে রয়েছে সব ভয় জয় করবার শক্তি, তবে আর রামকালীর শাসনকে ভয় করতে যাবে কোন্ দুঃখে?

সাদা কাপড়টা দেখা যাচ্ছে এখনও, একটু যেন নড়ছে। রুদ্ধশ্বাস-বক্ষে অপেক্ষা করতে থাকেন রামকালী। অথচ এই বিমূঢ়ের ভূমিকা অভিনয় করা ছাড়া ঠিক এই মুহূর্তে আর কি করার আছে রামকালীর? যতক্ষণ না সত্যি মরণের প্রশ্ন আসছে, ততক্ষণ বাঁচানোর ভূমিকা আসবে কি করে? জলে পড়ার আগে জল থেকে তুলতে যাওয়ার উপায় কোথা?

যতই ভয় পেয়ে থাকুন রামকালী, এমন কাণ্ডজ্ঞান হারান নি যে শুধু ঘাটের ধারে বসে থাকা মেয়েটাকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসবেন, মেয়েটা মরতে যাচ্ছে ভেবে।

কি করবেন তবে? সাদা রংটা এখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি, এখনও কিছু করা যাবে।

সহসা আত্মস্থ হয়ে উঠলেন রামকালী, সহসাই যেন ফিরে পেলেন নিজেকে। কী আশ্চর্য! কেন বৃথা আতঙ্কিত হচ্ছেন তিনি? এখুনি তেমন হাঁক পাড়লেই তো অঞ্চলের দশ-বিশটা লোক ছুটে আসবে। তখন আর চিন্তাটা কি? নিজের ওপর আস্থা হারাচ্ছিলেন কেন?

অতএব হাঁক পাড়লেন।

তেমনি ধারাই হক বটে। মৃত্যুপথবর্তিনীও যাতে ভয়ে গুরগুরিয়ে ওঠে। জলদগম্ভীর স্বরে অভ্যস্ত আদেশের ভঙ্গীতেই হাঁক পাড়লেন রামকালী, যে হও জল থেকে উঠে এসো। আমি বলছি উঠে এসো। ভরসন্ধ্যায় জলের ধারে থাকবার দরকার নেই। আমি’টার ওপর বিশেষ একটু জোর দিলেন।

না, হিসাবের ভুল হয়নি রামকালীর।

কাজ হল। এই ভরাট ভারী আদেশের সুরে কাজ হল। কলসীটা ভরে নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে এল মেয়েটা একগলা ঘোমটা টেনে। সাদা রংটার গতিবিধি লক্ষ্য করে বুঝতে পারলেন রামকালী, ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে ও।

আর একবার চিন্তা করলেন রামকালী, পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন? নাকি নির্বুদ্ধি মেয়েটাকে একটু সদুপদেশ দিয়ে দেবেন?

সাধারণত শ্বশুর-বৌ সম্পর্কে কথা কওয়ার কথা ভাবাই যায় না, কিন্তু চিকিৎসক হিসাবে রামকালীর কিছুটা ছাড়পত্র আছে। বাড়ির বৌ-ঝির অসুখ-বিসুখ করলে মোক্ষদা কি দীনতারিণী রামকালীকে খবর দিয়ে ডেকে নিয়ে যান এবং তাদের মাধ্যমে হলেও পরোক্ষে অনেক সময় রোণিীকে উদ্দেশ করে কথা বলতে হয় রামকালীকে। যথা ঠাণ্ডা না লাগানো বা কুপথ্য না করার নির্দেশ। তেমন বাড়াবাড়ি না হলে অবশ্য রোগী দেখার প্রশ্ন ওঠে না, লক্ষণ শুনেই ঔষধ নির্বাচন করে দেন। কিন্তু বাড়াবাড়ির ক্ষেত্রে বলতে হয় বৈকি। অবশ্য যথাসাধ্য দূরত্ব সম্ভ্রম বজায় রেখেই বলেন। পুত্রবধূ অথবা ভ্রাতৃবধূ সম্পর্কীয়দের আপনি ভিন্ন তুমি বলেন না কখনও রামকালী।

নিধি একেবারে লঙ্ঘন করলেন না রামকালী, তবু কিছুটা করলেন। পাশ কাটিয়ে চলে না গিয়ে একটা গলাখাকারি দিয়ে বলে উঠলেন, এ সময় এরকম একা ঘাটে কেন? আর এ রকম আসবেন না। আমি নিষেধ করছি। আর একবার ‘আমি’টার উপর জোর দিলেন রামকালী।

সমুখবর্তিনী অবশ্য কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ রামকালীর সামনে দিয়ে হেঁটে চলে যাবে, এমন ক্ষমতা অবশ্য থাকবার কথাও নয়।

রামকাণী কথা শেষ করলেন, বাড়িতে শুভ কাজ হচ্ছে, মন ভাল করতে হয়। এমন তো হয়েই থাকে।

দ্রুত পদক্ষেপে এবার চলে গেলেন রামকালী।

রামকালী চলে গেলেও কাঠের পুতুলখানা আরও কিছুক্ষণ কাঠপাথরের মত দাঁড়িয়ে থাকে, কী ঘটনা ঘটে গেল যেন বুঝতেই পারে না। কি হল? এটা কি করে সম্ভব হল?

এমন তো হয়েই থাকে, মানে কি?

উনি কি তা হলে সব জেনেছেন? জেনেও ক্ষমা করে গেলেন? মাথা ঠাণ্ডা রেখে সদুপদেশ দিয়ে গেলেন মন ভাল করতে? সত্যিই কি তবে উনি দেবতা? দেবতা ভেবেও বুকের কাপুনি আর কমতে চায় না শঙ্করীর।

হ্যাঁ, শঙ্করী!

রাসুর বৌ সারদা নয়, কাশীশ্বরীর বিধবা নাতবৌ শঙ্করী। চিরদিন পিত্রালয়বাসিনী কাশীশ্বরীর একটা মেয়েসন্তান, তাও মরেছিল অকালে। মা-মরা দৌত্তুরটাকে বুকে করে এক বছরেরটি থেকে আঠারো বছরের করে তুলে সাধ করে সুন্দরী মেয়ে দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন কাশীশ্বরী, কিন্তু এমন রাক্ষসী বৌ যে বছর ঘুরল না, দ্বিরাগমন হল না। তা বাপের বাড়িতেই ছিল এ যাবৎ, কিন্তু এমনি মন্দকপাল শঙ্করীর যে, মা-বাপকেও খেয়ে বসল। ছিল কাকা, সে এই সেদিন ভাইঝিকে ঘাড়ে করে বয়ে দিয়ে গেছে চাটুয্যেদের এই সদাব্রতর সংসারে। না দিয়েই বা করবে কি? শুধুই তো ভাতকাপড় যোগানো নয়, নজর রাখে কে? শ্বশুরকুলে থাকলে তবু সহজেই দাবে থাকবে। আর কপাল যার মন্দ, তার পক্ষে শ্বশুরবাড়ির উঠোন ঝাট দিয়েও একবেলা একমুঠো ভাত খেয়ে পড়ে থাকা মান্যের। বাপ কাকার ভাত হল অপমান্যির ভাত।

এইসব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কাকা সেই যে ছেড়ে দিয়ে গেছে, ব্যস! বছর কাবার হতে চলল, উদ্দিশ নেই। অথচ এখানে শঙ্করীর উঠতে বসতে খোঁচা খেতে হচ্ছে ‘চালচলনের’ অভব্যতায়। উনিশ বছরের আগুনের খাপরা এতখানি বয়স অবধি বাপের ঘরে কাটিয়েছে, তাকে বিশ্বাসই বা কি? বিধবার আচার-আচরণই তো শেখে নি ভাল করে। নইলে বামুনের বিধবা এটুকু জানে না যে রাতে চালভাজার সঙ্গে শশা খেতে হলে আলাদা পাত্রে নিতে হয়, এক পাত্রে রাখলে ফলার হয়! এমন কি কামড়ে কামড়েও তো খেতে নেই, আলগোছা টুকরো করে মুখের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে তবে চালভাজার সঙ্গে খাওয়া চলে। তা নয়, সুন্দরী দিব্যি করে একদিন শশা কেটে চালভাজার পাশে নিয়ে খেতে বসেছেন। যা-ই ভাগ্যিস মোক্ষদার চোখে পড়ে গেল, তাই না জাত-ধর্ম রক্ষে।

কিন্তু সেই একটাই নয়, পদে পদে অনাচার ধরা পড়ে শঙ্করীর, আর প্রতিপদে উপর-মহলে সন্দেহ ঘনীভূত হয়– এ মেয়ের রীত-চরিত্তির ভাল কি না।

তা রামকালীর এত তথ্য জানবার কথা নয়। কবে কোন্ দিন কোন্ অনাথা অবীরা চাটুয্যেদের সংসারে ভর্তি হচ্ছে, সে কথা মনে রাখার অবকাশ কোথায় তাঁর? কাজে-কাজেই রাসুর বৌয়ের প্রশ্ন নিয়েই চিন্তাকে প্রবাহিত করেছেন। তাছাড়া পুকুরের উঁচু পাড় থেকে ঠিক ঠাহরও হয় নি, সাদা ওই বস্ত্রখণ্ডটুকুর কিনারায় একটু রঙের রেখা আছে কি নেই।

কিন্তু না, সারদা মরতে আসে নি। সত্যবতী পিতৃ-আদেশের সঙ্গে-সঙ্গেই তাকে কড়া পাহারায় রাখতে শুরু করেছে। আর পাহারা না দিলেও মরা এত সোজা নয়। মরব বলেছে বলেই যে সত্যিই সদ্য আগত সতীনের হাতে স্বামী-পুত্র দুই তুলে দিয়ে পুকুরের তলায় আশ্রয় খুঁজতে যাবে সে তা নয়। জ্বালা নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে তাকে অন্যকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাবার ব্রত নিয়ে।

মরতে এসেছিল শঙ্করী।

মরতে এসেছিল, তবু মরতে পারছিল না।

বসে বসে ভাবছিল মরণের দশা যখন ঘটেছে তার, তখন মৃত্যু ছাড়া পথ নেই। কিন্তু কোন্ মৃত্যুটা শ্রেয়? এই রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-সুধাময় পৃথিবী থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, না সমাজ সংস্কার সম্ভ্রম সভ্যতা মানমর্যাদার রাজ্য থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া!

শেষের মৃত্যুটা যেন প্রতিনিয়ত কী এক দুর্নিবার আকর্ষণে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে শঙ্করীকে। কিন্তু শঙ্করী তো জানে সেখানে অনন্ত নরক। তাই না যে পৃথিবীর সকরুণ মিনতির দৃষ্টি তাকিয়ে আছে ভোরের সূর্য আর সন্ধ্যার মাধুরীর মধ্যে, তার কাছ থেকেই বিদায় নিতে এসেছিল শঙ্করী?

কিন্তু পারল কই?

শুধুই কি মামাঠাকুরের দুর্লজ্জ আদেশ! ঘাটের পৈঠাগুলোই কি তাকে দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধনে বেঁধে রাখে নি?

তবে কি শঙ্করীর মৃত্যু বিধাতার অভিপ্রেত নয়? তাই দেবতার মূর্তিতে উনি এসে দাঁড়ালেন মৃত্যুর পথ রোধ করে?

হঠাৎ এমনও মনে হল শঙ্করীর, সত্যিই মামাঠাকুর তো? নাকি কোন দেবতার ছল? ঠাকুর দেবতারা মানুষের ছদ্মবেশে এসে মানুষকে ভুল-ঠিক বুঝিয়ে দিয়ে যান, অভয় দিয়ে যান, এমন তো কত শোনা যায়!

বাড়ি ফিরে শঙ্করী যদি কোনপ্রকারে টের পায় রামকালী এখন কোথায় রয়েছেন, তা হলেই সন্দেহ ভঞ্জন হয়। ভাবতে ভাবতে ক্রমশ শঙ্করীর এমন ধারণাই গড়ে উঠতে থাকে, নিশ্চয় খোঁজ নিলে দেখা যাবে মামাঠাকুর এখন এ গ্রামেই নেই, রোগী দেখতে দূরান্তরে গেছেন। নিশ্চয় এ কোন দেবতার ছল। নইলে সত্যিই তো মামাঠাকুর এমন ঘুলঘুলি সন্ধ্যেয় মেয়েঘাটের কিনারায় ঘুরবেনই বা কেন?

আর সেই হাঁকপাড়াটা?

সেটাই কি ঠিক মামাশ্বশুরের কণ্ঠস্বর? মাঝে মাঝে তো ভেতরবাড়িতে আসেন মামাঠাকুর, কথাবার্তাও কন মা’র সঙ্গে, খুড়ীর সঙ্গে, কই গলার শব্দে এতটা চড়া সুর শোনা যায় না তো? মৃদুগম্ভীর ভারী ভরাট গলা, আর কথাগুলি দৃঢ়গম্ভীর।

এ মামাঠাকুরকে দেখলে পুণ্যি হয়।

বড় মামাঠাকুরের মতন নন ইনি। বড় মামাঠাকুরকে দেখলে ভক্তি-ছো ছুটে পালায়। কিন্তু কথা হচ্ছে ছদ্মবেশ সম্বন্ধে একেবারে নিঃসংশয় হবার উপায়টা কি? কোথায় মেয়েমহল আর কোথায় পুরুষমহল! চাটুয্যেদের এই শতখানেক সদস্য সম্বলিত সংসারে স্ত্রীরাই সহজে স্বামীদের তত্ত্ব পান, তা আর কেউ! অবশ্যি পুরুষের তত্ত্ববার্তা নেবার প্রয়োজনটাই বা কি মেয়েদের? দুজনের জীবনযাত্রার ধারা তো বিপরীতমুখী। পুরুষের কর্মধারার চেহারা যেমন মেয়েদের অজানা, সেদিকে উঁকি মারবার সাহস মেয়েদের নেই, তেমনি পুরুষের নেই অবকাশ মেয়েদের কর্মকাণ্ডের দিকে অবহেলার দৃষ্টিটুকুও নিক্ষেপ করবার।

একই ভিটেয় বাস করলেও উভয়ে ভিন্ন আকাশের তারা।

তবু মনে হতে লাগল শঙ্করীর, কোন উপায়ে একবার খোঁজ করা যায় না! মামাঠাকুর বাড়িতে আছেন কিনা, থাকলে কি অবস্থায় আছেন? এইমাত্র ফিরলেন, না অনেকক্ষণ থেকে বসে আছেন?

আহা, মামাঠাকুরের সঙ্গে যদি কথা কইতে পারা যেত! তাহলে বোধ করি ভগবানকে দেখতে পাওয়ার আশাটা মিটত শঙ্করীর। তা ওঁকে ভগবানের সঙ্গে তুলনা করবে না তো করবে কি শঙ্করী? এত ক্ষমা আর কোন মানুষের মধ্যে সম্ভব? এত করুণা আর কার প্রাণে আছে? শঙ্করীর মর্মকথা জানতে পারলে ত্রিজগতের কেউ কি অমন দয়া অমন সহানুভূতি দিয়ে কথা বলতে পারত? নাঃ, তারা মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গাঁয়ের বার করে দিত শঙ্করীকে। আর পিছনে ঘৃণার হাততালি দিতে দিতে বলত, ছি ছি ছি, গলায় দড়ি! তুই না হিন্দুর মেয়ে! তুই না বামুনের ঘরের বিধবা!

আচ্ছা কিন্তু, হঠাৎ যেন সর্বশরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে শঙ্করীর, মামাঠাকুর টের পেলেন কি করে? কে বলবে, কে জানে? তাও যদি বা কোন প্রকারে সন্ধান পেয়ে থাকেন, যদি সেই পরম শত্রুটাই এসে কোন ছলে ভয়ে-ভয়ে ফাঁস করে দিয়ে গিয়ে থাকে– শঙ্করী যে আজ এই সন্ধ্যায় ডুবে মরবার সংকল্প নিয়ে ঘাটে এসেছিল, এ কথা জানতে পারলেন কি করে তিনি?

মাত্র আজই তো দণ্ডকয়েক আগে সংকল্পটা স্থির করেছে শঙ্করী, অনেক ভেবে, অনেক নিঃশ্বাস ফেলে, অনেক চোখের জলে মাটি ভিজিয়ে। বিয়েবাড়ি, শাশুড়ী দিদিশাশুড়ীর দল বাড়তি কাজে ব্যস্ত, কে কোথায় কি করছে না-করছে কেউ লক্ষ্য করবে না, আজই ঠিক উপযুক্ত সময়। তা ছাড়া আসছে কাল বাড়িতে যজ্ঞি, আত্মীয়-কুটুষের ভিড় লাগবে বাড়িতে। কে জানে কোন ছুতোয় কে শঙ্করীর রীতিনীতির ব্যাখ্যান করবে, শঙ্করীর চালচালনের নিন্দে করবে, চি-টি পড়ে যাবে বাড়িতে।

না না, মরতেই যদি হয়, আজকেই হচ্ছে তার শ্রেষ্ঠ সময়। এইসব সাত-সতেরো ভাবনার বোঝা মাথায় করে ঘাটে এসেছিল শঙ্করী, জীবনে সমস্ত বোঝা নামিয়ে দেবার জন্যে। কিন্তু, আবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল শঙ্করীর, কিন্তু বিধাতা নিষেধ করলেন।

মরণের দরজা থেকে জীবনের রাজ্যে ফিরিয়ে আনলেন শঙ্করীকে।

তবে আর দ্বিধা কেন?

.

শঙ্করী বিধবা হলেও ওর আনা জল নিরামিষ ঘরে চলে না। ও ‘অনাচারে’, ওর অদীক্ষিত শরীর। জলের কলসীটাকেই তাই মাঝের দালানে এনে বসাল শঙ্করী, ছেলেপুলেদের খাওয়ার দরকারে লাগবে।

কলসী নামানোর শব্দে কোথা থেকে যেন এসে হাজির হল সত্যবতী। এসেই এদিক ওদিক তাকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, সব্বনাশ করেচ কাটোয়ার বৌ, তোমার নামে টি-টিক্কার পড়ে গেছে! বাড়িতে অনেক বৌ, কাজেই আশপাশের বৌদের তাদের বাপের বাড়ির দেশের নাম ধরে অমুক বৌ, তমুক বৌ বলতে হয়। তা ছাড়া শঙ্করী নবাগতা, ওর আর পর্যায়ক্রমে মেজ-সেজ দিয়ে নামকরণ হয় নি।

বুকটা ধড়াস করে উঠল শঙ্করীর।

কিসের সব্বনাশ!

তবে কি সব ধরা পড়ে গেছে?

ঘরের কোণে রাখা মাটির প্রদীপের আলোয় মুখের রং-গড়ন দেখা গেল না, শুধু গলার স্বরটা শোনা গেল, কাঁপা কাঁপা ঝাঁপসা।

কিসের সব্বনাশ, রাঙা ঠাকুরঝি?

আজ না তোমার লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যে দেবার পালা ছিল? সত্যর কণ্ঠস্বরে বিস্ময় আর সহানুভূতি।

লক্ষ্মীর ঘরে সন্ধ্যে দেখানোর পালা।

ওঃ, শুধু এই!

বুকের পাথরটা নেমে গেল শঙ্করীর, হালকা হল বুক। হোক এটা ভয়ানক মারাত্মক একটা অপরাধ, আর তার জন্যে যত কঠিন শাস্তিই হোক মাথা পেতে নেবে শঙ্করী।

অবশ্য এই দরদের ধিক্কারে চখে জলে এসে গিয়েছিল তার।

সত্য গলাটা আর একটু খাটো করে বলে, আর তাও বলি কাটোয়ার বৌ, এই ভরসন্ধ্যে পর্যন্ত ঘাটে থাকার তোমার দরকারটাই বা কি ছিল? সাপখোপ আছে, আনাচেকানাচে কু-লোক আছে–

শঙ্করী সাহসে বুক বেঁধে বলে, দিদিমা খুব রাগ করছিলেন বুঝি?

রাগ? রাগ হলে তো কিছুই না। হচ্ছিল গিয়ে তোমার ব্যাখ্যানা!

সত্যবতী হাত-মুখ নেড়ে বলে, আর সত্যিও বলি কাটোয়ার বৌ, তোমারই বা এত বুকের পাটা কেন? ভর-সন্ধ্যেবেলা একা ঘাটে গিয়ে যুগযুগান্তর কাটিয়ে আসা কেন? আবার আজই সন্ধ্যে দেখানোর পালা। ঠাম্মারা তো তোমায় পাশ-পেড়ে কাটতে চাইছিল।

তাই কাটো না ভাই তোমরা আমায়– শঙ্করী ব্যগ্রকণ্ঠে বলে, তা হলে তোমরাও বাঁচো, আমার মনস্কামনা সিদ্ধি হয়।

সত্য ভ্রূভঙ্গী করে গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা! তোমার আবার কিসের মনস্কামনা? তুমি আবার বড়বৌয়ের মত বোল ধরেছ কেন? বড়বৌও যে এতক্ষণ আমায় বলছিল, আমায় একটু বিষ এনে দাও ঠাকুরঝি, খাই। তোমার দাদার হাতের সুতো খোলার আগেই যেন আমার মরণ হয়, সে দৃশ্য দেখতে না হয়।

সত্যি বলতে কি, সারদার সঙ্গে শঙ্করীর এখনও তেমন ভাব হয় নি। প্রথম তো বয়সের ব্যবধান, তাছাড়া সারদা ছিল স্বামী-সোহাগিনী নবপুত্রবতী, আর শঙ্করী ছাইফেলার ভাঙাকুলো। আরও একটা কথা– দুজনের এলাকা আলাদা। শঙ্করীকে থাকতে হয় বিধবামহলে, তাদের হাতে হাতে মুখে মুখে ফাঁইফরমাশ খাটতে– সারদা সধবা মহলের জীব। খাওয়া শোওয়া বসা সব কিছুর মধ্যেই আকাশ-মাটির পার্থক্য।

কিন্তু আপাতত সারদা অনেকটা নেমে পড়েছে, এখন শঙ্করীও তাকে করুণা করতে পারে। তাই করে শঙ্করী। দরদের সুরে বলে, তা বলতে পারে বটে আবাগী।

বলি সে নয় বলতে পারল, তোমার কি হল? তোমার অকস্মাৎ কিসের জ্বালা উথলে উঠল?

আমার পোড়াকপালে তো সব্বদাই জ্বালা ঠাকুরঝি। শঙ্করী নিঃশ্বাস ফেলে।

সত্য হাত নেড়ে বলে,আহা, কপাল তো আর তোমার আজ পোড়ে নি গো! ঠামারা তো সেই কথাই বলছিল, সোয়ামীকে তো কোন্ জন্মে ভুলে মেরে দিয়েছ, তবে আবার তোমার সদাই মন উচাটন কিসের? কিসের চিন্তে কবরা রাতদিন?

মরণের! শঙ্করী দালানের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ে বলে, ও ছাড়া আমার আর চিন্তা নেই।

তা ভাল। সত্য আবার দুই হাত নেড়ে কথার সমাপ্তি টেনে মল বাজিয়ে চলে যায়, সব মেয়েমানুষের মুখে দেখি এক রা, মরব মরছি মরণ হয় তো বাঁচি! এ তো আচ্ছা ফ্যাসাদ!

শঙ্করী আর এ কথার উত্তর দেয় না, বসে বসে হাঁপাতে থাকে। আসুক ঝড়, আসুক বজ্রাঘাত, এখানে বসে বসেই মাথা পেতে নেবে সে, উঠে গিয়ে পায়ে হেঁটে ঝড়ের মুখে পড়বার শক্তি নেই।

তা একটু বসে থাকতে থাকতেই ঝড় এল।

কিংবা শুধু ঝড় নয়, বৃষ্টি-বজ্রাঘাতও তার সঙ্গী হয়েছে।

শঙ্করী ফিরেছে শুনে খোঁজ করতে এসেছেন কাশীশ্বরী আর মোক্ষদা।

পিছনে দর্শকের ভূমিকা নিয়ে ভুবনেশ্বরী, রামকালীর স্ত্রী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *