০৯. আসর-সাজানো বরাসনে

আসর-সাজানো বরাসনে বসবার সময় আর ছিল না, হুড়মুড়িয়ে একেবারে কলতলায় খেউরী করিয়ে স্নান করিয়ে নিয়ে সোজা নিয়ে যেতে হবে সম্প্রদানের পিঁড়িতে। সেই পিঁড়িতেই ধান দুর্বে আর আংটি দিয়ে পাকা দেখা অনুষ্ঠানের প্রথাটা পালন করে নিতে হবে।

অবিশ্যি সারাদিনে অন্তত বার পাঁচ-ছয় চর্বচোষ্য করে খেয়েছে রাসু, কিন্তু কি আর করা যাবে! এরকম আকস্মিক ব্যাপারে ওসব মানার উপায় কোথায়? বলে কত মেয়েরই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ওঠ ছুড়ি তোর বিয়ে করে। এই তো লক্ষ্মীকান্তরই এক জ্ঞাতি ভাইপোর মেয়ের বিয়ে হল সেবার ঘুমন্ত মেয়েটাকে মাঝরাতে টেনে তুলে। গ্রামের আর কার বাড়িতে বর এসেছিল বিয়ে করতে, তার পর যা হয়। কোথা থেকে যেন উঠে পড়ল কন্যেপক্ষের কুলের খোঁটা, তা থেকে বাচসা অপমান, পাত্ৰ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া।

যাক সে কথা, মূল কথা হচ্ছে, আকস্মিকের ক্ষেত্রে চর্বচোষ্য খেয়েও বিয়ের পিঁড়িতে বসা যায়।

কথা হচ্ছে—এখন রাসুকে নিয়ে।

রাসুর অবস্থাটা কি?

সে কি এখন খুব একটা অন্তর্দ্বন্দ্বে পীড়িত হচ্ছে?

তীব্র একটা যন্ত্রণা, ভয়ঙ্কর একটা অনুতাপ, প্রবল একটা মানসিক বিদ্রোহের আলোড়ন রাসুকে ছিন্নভিন্ন করছিল? বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ এই চিলের মত ছোঁ মেরে উড়িয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে এনে আরও একটা সাতপাকের বন্ধনে বন্দী করে ফেলবার চক্রান্তে কাকার ওপর কি রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিল রাসু?

না, রাসুর মুখ দেখে তা মনে হচ্ছে না।

বলির পাঁঠার অবস্থা ঘটলেও ভয়ে বলির পাঁঠার মত কাঁপছিলও না রাসু, শুধু কেমন একটা ভাবশূন্য ফ্যালফেলে মুখে নিজের নির্দেশিত ভূমিকা পালন করে চলছিল সে।

হ্যাঁ, এই আকস্মিকতার আঘাতে বেচারা রাসুর শুধু মুখটাই নয়, মনটাও কেমন ভাবশূন্য ফ্যালফেলে হয়ে গিয়েছে। সেখানে সুখ-দুঃখ ভাল-মন্দ দ্বিধা-দ্বন্দু কোন কিছুরই সাড়া নেই।

সে-মনে ধাক্কা লাগল স্ত্রী-আচারের সময়। সে ধাক্কায় খানিকটা সাড় ফিরল।

সে সাড়ে মনের মধ্যে একটা ভয়ানক কষ্ট বোধ করতে থাকল রাসু।

সাত এয়োতে মিলে যখন মাথায় করে শ্ৰী, কুলো, বরণডালা, আইহাঁড়ি, চিতের কাঠি, ধুতরো ফলের প্রদীপ সাজানো থালা ইত্যাদি নিয়ে বরকনেকে প্ৰদক্ষিণ করছিল, ধাক্কাটা লাগল। ঠিক তখন।

এয়োদের অবশ্য একগলা করে ঘোমটা, কিন্তু তার মধ্যেও আদল বলে একটা কথা আছে। যে বৌটির মাথায় বরণডালা, আর আদলটা ঠিক সারদার মতন, যদিও দিনের বেলা হঠাৎ সারদার মুখটা দেখলে রাসু ঠিক চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ, তবুও আদালটা চেনে। ওই রকম বেগনী রঙের জমকালো একখানা চেলিও যেন সারদাকে মাঝে মাঝে পরতে দেখেছে রাসু। পাড়ার কারুর বিয়েটিয়েতে কি সিংহবাহিনীর অঞ্জলি দেবার সময়।

দেখেছে অবিশ্যি নিতান্ত দূর থেকে, আর ভাল করে তাকাবার সাহসও হয় নি। কারণ রাতদুপুরের আগে, সমস্ত বাড়ি নিযুতি না হওয়া পর্যন্ত কাছাকাছি আসবার উপায় কোথা? আর তখন তো। সারদা সাজসজ্জা গহনাৰ্গাটির ভারমুক্ত। তা ছাড়া সারদা ঘরে ঢুকেই কোণের প্রদীপটা দেয় নিভিয়ে। বলে, কে কমনে থেকে দেখে ফেলে যদি!

অবিশ্যি দেখবার পথ বলতে কিছুই নেই। রামকালী চাটুয্যের বাড়ির দরজা-কপট তো আর পাড়ার পাঁচজনের মত আমাকাঠের নয় যে ফাটা-ফুটো থাকবে, মজবুত কাঁঠালকাঠের লোহার পাতমোরা দরজা। দরজার কড়া-ছেকলগুলোই বোধ করি ওজনে দুপাঁচ সের। আর জানলা? সে তো জানিলা নয়, গবাক্ষ। মানুষের মাথা ছাড়ানো উঁচু তে ছোট্ট ছোট্ট খুপরি জানলা, সেখানে আর কে চোখ ফেলবে? তবু সাবধানের মার নেই।

গ্ৰীষ্মকালে অবশ্য পুরুষরা এ রকম চাপা ঘরে শুতে পারেন না, তাদের জন্যে চণ্ডীমণ্ডপে কিংবা ছাতে শেতলপাটি বিছিয়ে রাখা হয় ভিজে গামছা দিয়ে মুছে মুছে। সেখানে তাকিয়া যায়, হাতপাখা যায়, গাড় গামছা যায়, বয়ে নিয়ে যায় রাখাল ছেলেটা কি মুনিযটা। কর্তাদের অসুবিধে নেই।

প্ৰাণ যায় বাড়ির মহিলাদের, আর নববিবাহিত যুবকদের। তারা প্ৰাণ ধরে বারবাড়িতে শুতে যেতে পারে না, অথচ ভেতরবাড়ির ঘরের ভিতরের গুমোটিও প্রাণান্তকর।

তবে সারদার মত বৌ হলে আলাদা। সারদা এই গ্রীষ্মকালে সারারাত্তির পাখা ভিজিয়ে বাতাস করে রাসুকে।

প্ৰাণের ভেতরটা হঠাৎ কেমন মোচড় দিয়ে উঠল রাসুর। গতকাল রাত্ৰেও সারদা সেই পতিসেবার ব্যতিক্রম করে নি। রাসু মায়া করে বার বার বারণ করছিল বলে কচি ছেলেটার গরমের ছুতো করে নেড়েছে। সারদা। আর সব চেয়ে মারাত্মক কথা, যেটা মনে করে হঠাৎ বুকটা এমন মুচড়ে মুচড়ে উঠছে রাসুর, মাত্ৰ কাল রাত্তিরেই সারদা তাকে ভয়ানক একটা সত্যবদ্ধ করিয়ে নিয়েছিল।

বাতাস দিতে বারণ করার কথায় চুপি চুপি হেসে বলেছিল। সারদা, এত তো মায়া, এ মায়ার

রাসু ঠিক বুঝতে পারে নি, একটু অবাক হাসি হেসে বলেছিল, চিরকাল কি গরম থাকবে?

আহা তা বলছি নে। বলছি-, রাসুর বুকের একবারে কাছে সরে এসে সারদা বলেছিল, সতীনজ্বালার কথা বলছি। তখন কি আর মায়া করবে? বলবে কি আহা ওর সতীনে বড় ভয়!

রাসু যতটা নিঃশব্দে সম্ভব হেসে উঠেছিল, হেসে বলেছিল, হঠাৎ দিবাস্বপ্ন দেখছি নাকি! সতীনাওলা আবার কে দিলে তোমায়!

দেয় নি, দিতে কতক্ষণ?

অনেকক্ষণ! আমার আমন দু-চারটে বৌ ভাল লাগে না। দরকারও নেই।

সারদা। তবু জেরা ছাড়ে নি, আর আমি বুড়ো হয়ে গেলে? তখন তো দরকার হবে!

রাসু ভারি কৌতুক অনুভব করেছিল, আবার হেসে ফেলে বলেছিল, এ যে দেখি হাওয়ার সঙ্গে মনান্তর! তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, আর আমি বুঝি জোয়ান থাকব?

আহা, পুরুষ ছেলে কি আর অত সহজে বুড়ো হয়? তা ছাড়া ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ছেলে, দেখতে সোন্দর। এত পয়সাওলা মানুষ তোমরা, কত ভাল ভাল সম্বন্ধ আসবে তোমার, তখন কি আর আমার কথা–

হঠাৎ আবেগে কেঁদে ফেলেছিল সারদা।

অগত্যাই নিবিড় করে কাছে টেনে নিয়ে বৌকে আদর সোহাগ করে ভোলাতে হয়েছে রাসুকে। বলতে হয়েছে, সাধে কি আর বলেছি হাওয়ার সঙ্গে মনান্তর।! কোথায় সতীন তার ঠিক নেই, কাঁদতে বসলো! ওসব ভয় করো না।

আরও অনেক বাক্য বিনিময়ের পর পতিব্ৰতা সারদা স্বামীকে আশ্বাস দিয়েছিল, তা বলে তোমাকে আমি এমন সত্যবন্দী করে রাখছি নে যে আমি মরে গেলেও ফের বে করতে পারবে না। আমি মলে তুমি একটা কেন একশটা বে করো, কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে নয়।

নয়, নয়, নয়! হল তো? তিন সত্যি করেছিল রাসু।

মাত্র গতরাত্রে।

আর আজ সেই রাসু, এই টোপর চেলি পরে কলাতলায় দাঁড়িয়ে আছে, এই মাত্তর যে গিন্নীমানুষটা বরণ করছিল সে বলে উঠেছে, কড়ি দিয়ে কিনলাম, দড়ি দিয়ে বাঁধলাম, হাতে দিলাম মাকু, একবার ভ্যা কর তো বাপু!

একটা মানুষকে কতবার কেনা যায়?

বাঁধা জিনিসটাকে আবার কি ভাবে বাঁধা যায়?

হায় ভগবান, রাসুকে এমন বিড়ম্বনায় ফেলে কি সুখ হল তোমার?

আহা, রাসু যদি ঠিক আজকেই গায়ে না থাকত! রুগী দিদিমাকে দেখতে এমন তো মাঝে মাঝে গা ছেড়ে ভিনগায়ে যায় রাসু। আজই যদি তাই হত! যদি দিদিমা বুড়ী টেসে গিয়ে ওখানেই আজ আটকে ফেলত রাসুকে!

যদি ঠিক এই সময় জ্ঞাতিগোত্তর কেউ মরে গিয়ে অশৌচ ঘটিয়ে রাখত রাসুদের! যদি রাসুরও এদের সেই বরটার মতন আচমকা একটা শক্ত অসুখ করে বসত!

তেমন কোন কিছু ঘটলে তো আর বিয়ে হতে পারত না!

কন্যাদায়গ্ৰস্ত বিপন্ন ভদ্রলোকের বিপদের কথা মনের কোণেও আসে না রাসুর, মরুক চুলোয় যাক ওরা, রাসুর এ কী বিপদ হল!

এ যদি কাকা রামকালী না হয়ে বাবা কুঞ্জবেহারী হত! বাবা যদি বলত, ভদ্রলোকের বিপদ উপস্থিত রাসু, দ্বিধা-দ্বন্দূের সময় আর নেই, চল ওঠ। তা হলেও হয়ত বা রাসু খানিক মাথা চুলকোতে বসত!

কিন্তু এ হচ্ছে যার নাম মেজকাকা, যার হুকুমের ওপর আর কথা চলে না।

অনেক যদির শেষে অবশেষে হতাশচিত্ত রাসু এ কথাও ভাবল, আর কিছুও না হোক, যদি গতরাত্রে রাসুগ্ৰীষ্মের কারণে বারবাড়িতে শুতে যেত! তা হলে তো ওই সত্যবন্দীর দায়ে পড়তে হত না তাকে!

এর পর কি আর জন্মে কোন দিন কোন ব্যাপারে রাসুকে বিশ্বাস করতে পারবে সারদা? বিশ্বাস করতে পারবে, এক্ষেত্রে রাসু বেচারাও সারদার মতই নিরূপায়? কোন হাত ছিল না তার! নাঃ, বিশ্বাস করবে না। সারদা, বলবে, বোঝা গেছে বোঝা গেছে! বেটা ছেলেদের আবার মন-মায়া! বেটা ছেলের আবার তিন-সত্যি!

কিন্তু কথাই কি আর কখনো কইবে সারদা? হয়তো জীবনে আর কথা কইবে না। রাসুর সঙ্গে, নয়তো দুঃখে অভিমানে মনের ঘেন্নায়— হঠাৎ রাসুর মনশ্চক্ষে বিশালকায় চাটুয্যেপুকুরের কাকচক্ষু জলটার দৃশ্য ভেসে ওঠে।

মনের ঘেন্নায় আজ রাত্তিরেই সারদা কিছু একটা করে বসবে না তো!

বুকের ভেতরটা কে যেন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চিরে চিরে নুন দিচ্ছে। রাসু বুঝি আর চুপ করে থাকতে পারবে না, বুঝি হাউমাউ করে চেঁচিয়ে উঠবে।

না, চেঁচিয়ে ওঠে নি। রাসু, তবে মুখের চেহারা দেখে কন্যাপক্ষের কে একজন বলে উঠল, বাবাজীর কি শরীর অসুস্থ বোধ হচ্ছে?

আবার বিয়ের বরের শরীর অসুস্থ!

লক্ষ্মীকান্ত একবার এই হিতৈষী-সাজা দুর্মুখটার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকালেন, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে আদেশ দিলেন, ওরে কে আছিস, আর একখানা হাতপাখা নিয়ে আয় দিকি, নতুন নাতজামাইয়ের মাথার দিকে বাতাসটা একটু জোরে জোরে দে।

জোর জোর বাতাসে মুখের চেহারাটা রাসুর সত্যি একটু ভাল দেখাল। আর না দেখালেই বা কি, ততক্ষণে তো বিয়ে সাঙ্গ হয়ে গেছে, বরকনেকে লক্ষ্মীর ঘরে প্ৰণাম করিয়ে বাসরে বসাতে নিয়ে যাচ্ছে সবাই ধরে ধরে, পায়ের গোড়ায় ঘটি ঘটি জল ঢালতে ঢালতে।

সেখানে আবারও তো সেই সেবারের মতন উপদ্রব হবে! সারদার বাপের বাড়ির সেই সব মেয়েমানুষদের বাক্যি আর বাঁচালতা মনে করলে রাসুর এখনো হৃৎকম্প হয়।

আবার তেমনি ভয়ঙ্কর একটা অবস্থার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে এখন রাসুকে!

সম্পূর্ণ অসহায়, সম্পূর্ণ নিরস্ত্র।

হঠাৎ রাসু দার্শনিকের মত নিজের ব্যক্তিগত দুঃখজ্বালা ভুলে একটা বিরাট দর্শনের সত্য আবিষ্কার করে বসে!

মানুষ কি অদ্ভুত নির্বোধ জীব!

এই কুশ্রী কদৰ্যতাকে ইচ্ছে করে জীবনে বার বার সোধে নিয়ে আসে, বার বার নিজেকে কানাকড়িতে বিকেয়!

পরদিন সকালে এখানে বৌছত্ৰ আঁকা হচ্ছিল।

ইচ্ছে-শখের বিয়ের মত নিখুঁত করে বাহার করে না হোক নিয়মপালাটা তো বজায় রাখতে হবে?

আর এত বড় উঠোনটায় যেমন-তেমন করে একটু আলপনা ঠেকাতেও এক সেরা পাঁচ পো চাল না ভিজোলে চলবে না।

তা সেই পাঁচপো চালই ভিজিয়ে দিয়েছিলেন রামকালীর খুড়ী নন্দরাণী। রামকালীর নিজের খুড়ী নয়, জেঠতুতো খুড়ী। সংসারের যত কিছু নিয়মলক্ষণ নিতাকিতের কাজের ভার নন্দরাণীর আর কুঞ্জর বৌয়ের উপর। কারণ ওরাই দুজন হচ্ছে একেবারে অখণ্ডপোয়াতি। কুঞ্জর বৌয়ের তো সাতটি ছেলেমেয়েই ষোটের কোলে খোসমেজাজে বাহাল তবিয়াতে টিকে আছে।

নন্দরাণীর অবশ্য মাত্র দু-তিনটিই।

সে যাক, বিয়ের ব্যাপারে নিয়মপালার কাজের সব কিছুই যখন নন্দরাণীর দখলে–তখন এক্ষেত্রেই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন? কাজেই রাসুর এই বিয়েটাকে মনে মনে যতই অসমর্থন করুন নন্দরাণী, পুরো পাঁচপো আতপ চালই ভিজিয়ে দিয়েছিলেন তিনি উঠোনে বৌছত্তর আঁকতে। দুধে আলতার প্রকাণ্ড পাথর বসিয়ে তাকে কেন্দ্র করে আর ঘিরে ঘিরে দ্রুতহস্তে ফুল লতা শাঁখ পদ্ম একে চলেছিলেন নন্দরাণী; সাঙ্গ হতে কিছুকিঞ্চিৎ দেরি আছে এখনও, সহসা রাখাল ছোঁড়া ঘর্মািক্ত কলেবরে ছুটতে ছুটতে এসে উঠোনের দরজায় দাঁড়িয়ে আকর্ণবিস্তৃত হাস্যে জানান দিল, বরকনে এয়েলো গো! আমি উই-ই দীঘির পাড় থেকে দেখতে পেয়েই ছুটে ছুটে বলতে এনু।

তা তো এলো- নন্দরাণী বিপন্নমুখে এদিক ওদিক তাকিয়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠেন, দিদি, বরকনে এসে পড়ল শুনছি—

বরকনে! এসে পড়ল!

দীনতারিণী কুটনো ফেলে ছুটে এলেন, এখুনি এসে পড়ল? রামকালীর কি এতেও তাড়াহুড়ো?

বারবেলা পড়বার আগেই বোধ করি নিয়ে এসেছেন রামকালী।

যদিচ ভাসুরপো, তথাপি ধনে-মানে এবং সর্বোপরি বয়সে বড়। কাজেই নন্দরাণী রামকালী সম্পর্কে ছেন দিয়েই বাক্যবিন্যাস করেন। এখনো করলেন।

দীনতারিণী বারবেলা শব্দটায় মনকে স্থির করে নিয়ে বললেন, তা হবে। তা তোমাদের নেমকন্মর সব প্ৰস্তুত?

নন্দরাণী আরও ব্যস্ত হাতে হাতের কোজ সারতে সারতে বলেন, প্রস্তুত তো একরকম সবই, কিন্তু দুধটা যে ওথলাতে হবে! সেটা আবার এখন কে করবে?

দুধা! তাই তো!

ওথলানোর দরকার বটে!

বৌ এসে সদ্য উথলে পড়া দুধ দেখলে, সংসার নাকি ধন-ধান্যে উথলে ওঠে।

দীনতারিণী উদ্বিগ্ন মুখে প্রশ্ন করলেন, বড় বৌমা কোথায় গেলেন?

বড় বৌমা? সে তো রান্নাশালে! তাড়াহুড়ো করে একঘর বেঁধে রাখতে হবে তো! বৌ এসে দৃষ্টি দেবে।

বড় বৌমা অর্থ রাসুর মা। তাকে তাই বলে তো নন্দরাণী।

কারণ নন্দরাণী বয়সে রাসুর মার সমবয়সী হলেও মান্যে বড়, সম্পর্কে খুড়-শাশুড়ী, কাজেই বৌমা।

যাই হোক, কুঞ্জর বৌ রান্নাশালে।

অতএব দুধ ওথলাতে আর কাউকে দরকার। ওদিকে বর-কনে আগতপ্ৰায়।

দীনতারিণী মনশ্চক্ষে চারিদিক তাকিয়ে নেন, আর কে আছে? অখণ্ডপোয়াতি সোয়ামীর প্রথম পক্ষী!

দ্বিতীয় তৃতীয় পক্ষ দিয়ে তো আর পুণ্যকর্ম হবে না?

কে আছে?

ওমা, ভাবার কি আছে?

সারদাই তো আছে!

তাকেই ডাক দেওয়া হোক তবে। একা ঘরের কোণে বসে রয়েছে মনমরা হয়ে, কাজকর্মে ডাকলে তবু মনটা অন্যমনস্ক হবে–তা ছাড়া নতুন লোক নির্বাচনের সময়ই বা কোথা?

সত্য উঠোন পার হচ্ছিল তীরবেগে, দীনতারিণী তাকেই ডাক দিলেন, এই সত্য, ধিঙ্গী অবতার! যা দিকিনী, বড় না।তবৌমাকে ডেকে আন দিকিন শীগগির, বরকনে এসে পড়ল পেরায়, দুধ ওথলাতে হবে।

বৌকে? বড়দার বৌকে ডেকে দেব? সত্য দুই হাত উলটে বলে, বৌ কি আর বৌতে আছে? ভোর থেকে মাটিতে পড়ে কেন্দে কেন্দে মরছে!

কেঁদে কেঁদে মরছে? দীনতারিণী বিরক্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, একেবারে মরছেন। কেন, এতে মরবার কি হল? ওমা, শুভদিনে ইকি অলক্ষণে কাণ্ড! যা, শীগগির ডেকে আন।

সত্য এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে, কে বাবা ডাকতে যায়! তুমি তো বললে কাঁদবার কি হয়েছে? বলি নিজের যদি হত? সতীন আছে কাঁদবে না, আহ্লাদে উর্ধবাহু হয়ে নাচবে মানুষ! হেঁ! কই, কোথায় কি আছে তোমাদের? আমিই দিচ্ছি। দুধ জ্বাল দিয়ে!

তুই? তুই দিবি দুধ জ্বল?

কেন, দিলেই বা! সত্য সোৎসাহে বলে, পিসঠাকুমা যে সেবার খুন্তির দিদির বিয়েতে বলল, সত্যর বছর ঘুরে গেছে, এখন এয়োডালায় হাত দিতে পারে!

বছর ঘুরে অর্থাৎ বিয়ের বছর ঘুরে।

সেটা আর স্পষ্টাম্পষ্টি উচ্চারণ করল না। সত্য।

দীনতারিণী সন্দিগ্ধ সুরে বলেন, বছর ঘুরলেই বুঝি হল? ঘরবসতি না হলে—

জানি নে বাবা। রাখো তোমাদের সন্দ। আমি এই হাত দিলাম।

বলেই সত্য দাওয়ার পাশে দুখানা ইট পাতা উনুনের উপর জ্বলে বসানো ছোট্ট সরা চাপা মাটির হাঁড়িটার নিচে ফুঁ দিতে শুরু করে।

ঘুঁটের আগুন জ্বলছে ধিকি ধিকি, ফুঁ পেড়ে দু-চারখানা নারকেলপাতা ঠেলে দিলেই জ্বলে উঠবে। দাউ দাউ করে। তা গোছালো মেয়ে নন্দরাণী নারকেল পাতার গোছাও এনে রেখেছেন পাশে।

সত্যর সকল কাজই উদ্দাম।

তার ফুঁয়ের দাপটে বরকনে আসার আগেই দুধ ওথলাতে শুরু করল। উথরে ধোঁয়া ছড়িয়ে ভেসে গেল। গড়িয়ে পড়ে।

দীনতারিণী হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ওরে একটু রয়ে-বসে, নতুন বৌ ঢোকা মাত্তর যেন দেখতে পায়।

কথা শেষ হবার আগে বাইরের উঠোনে শাঁখ বেজে উঠল।

অর্থাৎ শুভাগমন ঘটেছে নতুন বৌয়ের।

মোক্ষদা শাঁখ হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাইরে। আজ পূর্ণিমা, বিধবাদের ঘরে রান্নার ঝামেলা নেই, কোন এক সময় আমকাঁঠাল ফল মিষ্টি খেলেই হবে। কাজেই আজ ছুটি মোক্ষাদাদের।

ছুটিই যদি, তবে ছোটাছুটি না করবেন কেন মোক্ষদা? স্নান তো করতেই হবে জল খাবার আগে।

তাই মোক্ষদাই অগ্রণী হয়ে বারবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন। আছেন শাঁখ হাতে নিয়ে।

শুভকর্মে বিধবারা সমস্ত কর্মে অনধিকারী হলেও, এই একটি কর্মে তাদের অধিকার আছে, সমাজ অথবা সমাজপতিরা বোধ করি এটুকু আর কেড়ে নেন নি, ক্ষ্যামা-ঘেন্না করে ছেড়ে দিয়েছেন। শাক আর উলু।

অতএব সেই অধিকারটুকুর সম্যক সদ্ব্যবহার করতে থাকেন মোক্ষদা রাসুর দ্বিতীয় অভিযানান্তে। ৩।বর্তন উপলক্ষ্যে।

দীনতারিণী উদ্‌গ্ৰীব হয়ে এগিয়ে যেতে যেতে চমকে উঠে বলেন, আমন করে ফুঁ দিচ্ছিস যে সত্য? পোড়ালি বুঝি?

সত্য তাড়াতাড়ি সত্য গোপন করে ফেলে বলে, পোড়াবো কেন, হুঁ!

তবে হাতে ফুঁ পাড়ছিস কেন?

এমনি।

যাক এবার উনুনে ফুঁ পাড়, ঢোকার সময় যেন আর একবার দুধটা ফেপে ওঠে, তা উঠেছে, বৌ পয়মন্ত হবে। সেবার বরং-

কথা শেষ হবার আগেই রামকালীর গভীর কণ্ঠনিনাদ ধ্বনিত হল, তোমাদের ওই সব বরণ-টরণ তাড়াতাড়ি সেরে ফেলো ছোটপিসী, পিছনে পিছনে পাড়া ঝেটিয়ে অবগুণ্ঠনবতীর দল।

.

বিয়েটা যেভাবে আর যে অবস্থাতেই ঘটে থাকুক, বৌভাতের যজ্ঞি। একটা করতেই হবে। আমোদ-আহ্লাদের প্রয়োজনে নয়, সমাজ-জানিত করবার প্রয়োজনে। খামকা একদিন হূঁট করে লক্ষ্মীকান্ত বাঁড়ুয্যের পৌত্রী এসে চাটুয্যেবাড়ির অন্দরে সামিল হল, কাকে-পক্ষীতে টের পেল না, এটা তো আর কাজের কথা নয়। তার প্রবেশটা যে বৈধ, এ খবরটুকুর একটা পাকা দলিল তো থাকা চাই।

দলিল আর কি! লিখিত্ব পড়িত্ তো কিছু নয় সই-সবুদও নয়, মানুষের স্মরণ-সাক্ষ্যই দলিল তা সেই স্মরণ-সাক্ষ্য আদায় করতে হলে গ্রাম-সমাজকে একদিন গলবস্ত্ৰে ডেকে এনে উত্তম ফলার খাইয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় কি?

তা ছাড়া বাঁড়ুয্যেদের মেয়ে যে চাটুয্যে পরিবারভুক্ত হল, তার স্বীকৃতিটাও তো দিতে হবে? বৌভাতের যজ্ঞিতে নতুন বৌয়ের হাত দিয়ে ভাত পরিবেশন করিয়ে জ্ঞাতিকুটুম্বের কাছ থেকে সেই স্বীকৃতি নেওয়া।

অতএব বিয়েতে যজ্ঞির আয়োজন না করলেই নয়। আগে থেকে বিলিবন্দেজ নেই, হুট্‌ক্কারি করে বিয়ে, তাই ভোজের আয়োজনেও হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। অনুগত জনের অভাব নেই রামকালীর, দিকে দিকে লোক ছড়িয়ে দিয়েছেন। জনাইতে মনোহরার বায়না গেছে, বর্ধমানে মিহিদানার। তুষ্ট গয়লাকে ভার দেওয়া হয়েছে দৈ-এর, আর ভীমে জেলেকে ডেকে পাঠিয়েছেন মাছের ব্যবস্থা করতে। কোন পুকুরে জাল ফেলবে ক-মণ তোলা হবে, এই সব নির্দেশ দিচ্ছিলেন রামকালী, সহসা সেই আসরে এসে উপস্থিত হলেন মোক্ষদা।

এ তল্লাটে রামকালীকে ভয় করে না এমন কেউ নেই, বাদে মোক্ষদা। রামকালীর মুখের উপর হক কথা শুনিয়ে দেবার ক্ষমতা একা মোক্ষদা রাখেন। নইলে দীনতারিণী পর্যন্ত তো ছেলেকে সমীহ করে চলেন।

অবিশ্যি ভাবা যেতে পারে রামকালীকে হক কথা শুনিয়ে দেবার সুযোগটা আসে কখন? যে মানুষটা কর্তব্যপালনে প্রায় ত্রুটিহীন, তাকে দুকথা শুনিয়ে দেবার কথা উঠছে কি করে?

কিন্তু ওঠে।

মোক্ষদা ওঠান। কারণ মোক্ষদার বিচার নিজের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে। রামকালীর মতে যেটা নিশ্চিত কর্তব্য, প্রায়শই মোক্ষদার মতে সেটা অনর্থক বাড়াবাড়ি।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হক কথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সত্যবতী। হবে না-ই বা কেন? রামকালী যদি এমন মেয়ে গড়ে তোলেন যেমন মেয়ে ভূ-ভারতে নেই, তাহলে আর কথা শোনানোয় মোক্ষদার দোষ কি? সৃষ্টিছাড়া ওই মেয়েটাকে তাই যখন-তখন তার বাপের সামনে হাজির করে ন ভূতো ন ভবিষ্যতি করতেই হয় মোক্ষদাকে।

আজও তাই রামকালীর দরবারে একা আসেন নি মোক্ষদা, এনেছেন সত্যবতীকে সঙ্গে করে। সত্যবতীও এসেছে বিনা প্ৰতিবাদে। অবশ্য প্ৰতিবাদে লাভ নেই বলেই হয়তো এই অপ্ৰতিবাদ। অথবা হয়তো এটা তার নির্ভীকতা।

ভীমে জেলের উপস্থিতির কালটুকু অবশ্য নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিলেন মোক্ষদা। কথার শেষে ভীম রামকালীকে দণ্ডবৎ হয়ে প্ৰেণাম করে চলে যাবার পরীক্ষণেই মোক্ষদা যেন ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

এই নাও রামকালী, তোমার গুণের অবতার কন্যের হাতের চিকিচ্ছে করো এবার। আর চেরটাকালই করতে হবে তোমাকে, এ মেয়েকে তো আর শ্বশুরঘর থেকে নেবে না। একটু দম নিলেন মোক্ষদা।

মোক্ষদা দম নেবার অবকাশে রামকালী মৃদু হেসে বলেন, কি? কি হল আবার?

হয়েই তো আছে সমস্তক্ষণ, মোক্ষদা দুই হাত নেড়ে বলেন, উঠতে বসতেই তো হচ্ছে। কাটছে ছিঁড়ছে ছড়ছে। এই আজ দেখা মেয়ের হাতের অবস্থা। পুড়িয়ে-ঝুড়িয়ে এতখানি এক ফোস্কা! আবার বলে কি বলতে হবে না বাবাকে, এমনি সেরে যাবে! দেখো তুমি নিজের চক্ষে।

ইত্যবসরে রামকালী মেয়ের হাতখানা তুলে ধরে শিহরিত হয়েছেন।

কী ব্যাপার? এ কি করে হল?

কি করে হয়েছে শুধোও-ওকেই শুধোও। মেয়ের গুণের কথা এত বলি, কথা কানে করো না তো! তবে তোমাকে এই বলে রাখছি রামকালী, এই মেয়ে হতেই তোমার ললাটে দুঃখু আছে।

কথাটা নতুন নয়, কাঁহ ব্যবহৃত। কাজেই রামকালী যে বিশেষ বিচলিত হন এমন নয়। তবে বাইরে গুরুজনকে সমীহ করবার শিক্ষা রামকালীর আছে, তাই বিচলিত ভাবটা দেখান।

নাঃ, মেয়েটাকে নিয়ে—! আবার কি করলি? এত বড় ফোস্কা পড়ল কিসে?

দুধ ওথলানো হচ্ছিল গো। কালকে যখন রেসো বৌ নিয়ে এসে ঢুকল, উনি গেলেন পাতা জ্বেলে দুধ ওথলাতে! আর এও বলি, এত বড় বুড়ো ধিঙ্গী মেয়ে, এটুকু করতে হাতই বা পোড়ালি কি दळल?

রামকালী মেয়ের হাতের অবস্থাটা নিরীক্ষণ করে ঈষৎ গম্ভীর হয়ে মেয়ের উদ্দেশেই বলেন, আগুনের কাজ তুমি করতে গেলে কেন? বাড়িতে আর লোক ছিল না?

সত্য ঘাড় নিচু করে বলে, বেশী জ্বালা করছে না। বাবা।

জ্বালা করার কথা হচ্ছে না, করলেও সে জ্বালা নিবারণের ওষুধ অনেক আছে। জিজ্ঞেস করছি, তুমি আগুনে হাত দিতে গেলে কেন?

সত্য এবার ঘাড় তোলে। তুলে সহসা নিজস্ব ভঙ্গীতে তড়বড় করে বলে ওঠে, আমি কি আর সাধে আগুনে হাত দিয়েছি বাবা, বড়বৌয়ের মুখ চেয়েই দিয়েছি। আহা বেচারী, একেই তো সতীনকাঁটার জ্বালা তার ওপর আবার দুধ ওথলাবার হুকুম। মানুষের প্রাণ তো!

সত্যর এই পরিষ্কার উত্তরপ্রদানে এক রামকালীই নয়, মোক্ষদাও তাজ্জব বনে যান। এ কী সর্বনেশে মেয়ে গো! ওই হোমরাচোমরা বাপের মুখের ওপর এই চোটপাট উত্তর! গালে হাত দিয়ে নির্বাক হয়ে যান মোক্ষদা। কথা বলেন রামকালীই। দুই ভ্রূ কুঁচকে ঝাঁঝালো গলায় বলেন,

কি জিনিস সে কথা তুমি তোমার মেয়ের কাছেই এবার শেখে। রামকালী! মোক্ষদা সত্যবতীর আগেই তীক্ষ্ণ বিদ্রুপের স্বরে বলেন, আমরা এতখানি বয়সে যা কথা না শিখেছি, এই পুঁটকে ছুঁড়ী তা শিখেছে! কথার ধুকড়ি!

সত্য এই সব উলটোপালটো কথাগুলো দুচক্ষের বিষ দেখে। কেন রে বাপু, যখন যা সুবিধে তখন তাই বলবে কেন? এই এক্ষুণি সত্যকে বলা হলো বুড়ো ধিঙ্গী, আবার এখন বলা হচ্ছে পুঁটকে ছুঁড়ী! সবই যেন ইচ্ছে-খুশী!

রামকালী পিসীর দিকে একনজর তাকিয়ে নিয়ে জলদগম্ভীর স্বরে কন্যাকে পুনঃপ্রশ্ন করেন, কই, আমার কথার জবাব দিলে না? বললে না। সতীনকাটা কি জিনিস আর তার জ্বলাটাই বা কী বস্তু?

কী বস্তু সে কথা কি ছাই সত্য জানে? তবে বস্তুটা যে খুব একটা মর্মবিদারি দুঃখজনক, সেটা বোধ করি জন্মাবার আগে থেকেই জানে। তাই মুখটা যথাসম্ভব করুণ করে তুলে বলে, সতীন মানেই তো কাটা বাবা! আর কাটা থাকলেই তার জ্বালা আছে! বড়বৌ-এর প্রাণে তো এখন তুমি সেই জ্বালা ধরিয়ে দিলে–

থামো! হঠাৎ ধমকে উঠলেন রামকালী। বিচলিত হয়েছেন তিনি, বাস্তবিকই বিচলিত হয়েছেন এতক্ষণে। বিচলিত হয়েছেন মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে নয়, সহসা মেয়ের অন্তরের মলিনতার পরিচয় পেয়ে।

এ কী?

এ রকম তো ধারণা ছিল না তার ছিল না হিসাবের মধ্যে। এটা হল কোন্ ফাঁকে? সত্যবতীর বহুবিধ নিন্দাবাদ তার কানে এসে ঢোকে, সে-সব তিনি কখনোই বড় একটা গ্রাহ্য করেন না। করেন শুধু মেয়ের স্বভাব-প্রকৃতিতে একটা নির্মল তেজের প্রকাশ লক্ষ্য করে। সত্যর হৃদয়ে হিংসাদ্বেষের ছায়ামাত্র নেই, এইটাই জমা ছিল হিসাবের খাতায়, এহেন নীচ হিংসুটে কথাবার্তা শিখে ফেললো সে কখন? কিন্তু বাড়তে দেওয়া ঠিক নয়, শাসনের দরকার।

তাই আরও বাঘ-গর্জনে বলে ওঠেন, কেন, সতীন কিসে এত ভয়ঙ্করী হল? সে এসে ধরে মারছে তোমাদের বড়বৌকে?

বার বার বাঘা-হুমকিতে সত্যবতীর চোখে জল উপচে এসে পড়ছিল, কিন্তু সহজে হার মানে না সে। আর কাঁদার দৈন্যটা প্রকাশ হয়ে পড়বার ভয়ে কষ্টে ঘাড় নিচু করে ধরা গলায় বলে, হাতে না মারুক, ভাতে মারছে তো? বড়বৌ একলা একেশ্বরী ছিল, নতুন বৌ হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসল–

আ, ছি ছি ছি!

রামকালী শিউরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মুখ দেখে মনে হল, সত্যবতী যেন সহসা তাঁর যত্নে আঁকা একখানি ছবিকে মুচড়ে দুমড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে।

এই ফাঁকে মোক্ষদা আবার একহাত নেন, ওই শোনো! শোনো মেয়ের কথার ভঙ্গিমে! সাধে বলি কথার ভশ্চায্যি! বুড়ো মাগীদের মতন কথা, আর ছেলেপেলের মতন দস্যিচাল্লি! হরঘড়ি অবাক করে দিচ্ছে কথার জ্বালায়!

রামকালী পিসীর আক্ষেপে কান না দিয়ে তিক্তবিরক্ত স্বরে বললেন, এমন ইতর কথাবার্তা কোথা থেকে শিখেছ? ছি ছি ছি! লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে আমার। উড়ে এসে জুড়ে বসা মানে কি? এক বাড়িতে দুটি বোন থাকে না? সতীনকে কাঁটা না ভেবে বোন বলে ভাবা যায় না?

.

বাবা এত ঘেন্না দেওয়ার পর অবশ্য সত্যবতীর সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। একসঙ্গে অগুনতি ফোঁটা ঝর ঝর করে ঝরে পড়ে চোখ থেকে গালে, গাল থেকে মাটিতে। পড়তেই থাকে, হাত তুলে মোছে না সত্য।

রামকালী চাটুয্যে আর একবার বিচলিত হন। সত্যবতীর চোখে জল! এটা যেন একটা অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য মনে হচ্ছে। মনে হল ঘেন্নাটা বোধ করি একটু বেশী দেওয়া হয়ে গেছে।

ঔষধে মাত্রাধিক্য, রামকালীর পক্ষে শোচনীয় অপরাধ। মনে পড়ল, মেয়েটার হাতের ফোস্কাটাও কম জ্বালাদায়ক নয়। এখুনি প্রতিকার করা দরকার। তাই ঈষৎ নরম গলায় বলেন, এরকম নীচ কথা আর বলো না, বুঝলে? মনেও এনো না। সংসারে যেমন ভাই বোন ননদ দেওর জা ভাসুর সব থাকে, তেমনি সতীনও থাকে, বুঝলে? কই দেখি হাতটা!

হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে সত্যবতী নিজের উদ্বেল হৃদয়ভারকে সামলাতে চেষ্টা করে দাঁতে ঠোঁট চেপে।

মোক্ষদা বোঝেন মেঘ উড়ে গেল। হয়ে গেল রামকালীর মেয়ে শাসন করা। ছি ছি ছি! আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হল না, বললেন, যাক গে, শাস্তি শাসন হয়ে গেছে তো? এবার মেয়েকে সোহাগ করো বসে বসে। তুমিই দেখালে বটে বাবা!

রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নেন মোক্ষদা।

রামকালী আশু প্রতিকার হিসাবে একটা প্রলেপ মেয়ের ফোস্কা ঘায়ে লাগাতে লাগাতে সহসা আবার বলেন, আজকের কথা মনে থাকবে তো? আর কোন দিন এ রকম কথা বলো না, বুঝলে? মানুষ তো বনের জানোয়ার নয় যে খালি হিংসেহিংসি কামড়াকামড়ি করবে! সকলের সঙ্গে মিলেমিশে সবাইকে ভালবেসে পৃথিবীতে থাকতে হয়।

বাবার গলায় আপসের সুর।

অতএব ফের একটু সাহস সঞ্চয় হয় সত্যবতীর। তা ছাড়া প্রাণটা তো ফেটে যাচ্ছে বাবার ধিক্কারে। কিন্তু তারই বা দোষ কোথায় বুঝে উঠতে পারে না সত্যবতী। সবাইকে ভালবেসে থাকাই যদি এত ধম্মে হয়, তা হলে সেঁজুতি বত্তটি করতে হয় কেন?

মনের চিন্তা মুখে প্রকাশ হয়ে পড়ে সত্যর, তাই যদি, তা হলে সেঁজুতি বত্ত করতে হয় কেন বাবা? পিসঠাকুরমা তো এ বছর থেকে আমাকে ফেন্তুকে আর পুণ্যিকে ধরিয়েছে!

রামকালী এবার বিরক্তির বদলে বিস্মিত হন। সেঁজুতি বত্ত সম্পর্কে অবশ্য তিনি সম্যক অবহিত নন, কিন্তু যাই হোক, কোনও একটি ব্রত যে মানবতাবোধ-বিরোধী হওয়া সম্ভব, সেটা ঠিক ধারণা করতে পারেন না। তাই প্রলেপের হাতটা ঘরের কোণে রক্ষিত মাটির জালার জলে ধুতে ধুতে বলেন, ব্রতের সঙ্গে কি?

কি নয় তাই বলো না কেন বাবা? চোখের জল শুকোবার আগেই সত্যর গলার সুর শুকনো খটখটে হয়ে ওঠে, সেঁজুতি বত্তর যত মন্তর সব সতীনকাটা উদ্ধারের জন্যে নয়?

রামকালী একটুক্ষণ চুপ করে থাকেন।

কোথায় যেন একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। হু, এই রকমই একটা কিছু গোলমেলে ব্যাপার ঢুকে গিয়েছে মেয়ের মাথায়। নচেৎ সত্যর মুখে অমন কথা!

হাতে অনেক কাজ।

তবু রামকালী বিবেচনা করলেন, সদুপদেশের দ্বারা কন্যার হৃদয়-কানন হতে সতীন-কণ্টকের মূলোৎপাটন করা কর্তব্য; তাই ভুরু কুঁচকেই বললেন তাই নাকি? সে মন্তরটা কি?

মন্তর কি একটা বাবা? সত্যবতী মহোৎসাহে বলে, গাদা গাদা মন্তর। সব কি ছাই মনেই আছে! ভেবে ভেবে বলছি রোসো। প্রথমে তো আলপনা আঁকা। ফুল-লতার নকশা কেটে তার ধারে কোণে হাতা-বেড়ি হড়িকুড়ি এস্তক ঘর-সংসারের প্রত্যেকটি জিনিস এঁকে নেওয়া। তা’পর একোটা একোটা ধরে ধরে মন্তর পড়তে হয়। হাতায় হাত দিলাম, বললাম–

হাতা, হাতা, হাতা,
        খা সতীনের মাথা।
খোরায় হাত দিয়ে
        খোরা গোরা পোরা,
        সতীনের মাকে ধরে নিয়ে যাক
         তিন মিনসে গোরা।

তা’পর

বেড়ি বেড়ি বেড়ি
         সতীন মাগী চেড়ী।
         বঁটি বঁটি বঁটি
         সতীনের ছেরাদ্দর কুটনো কুটি।
         হাঁড়ি হাঁড়ি হাঁড়ি,
         আমি যেন হই জন্ম-এয়োস্ত্রী,
         সতীন কড়ে রাঁড়ী।

চুপ চুপ।

রামকালী জলদগম্ভীর স্বরে বলেন, এই সব তোমাদের মন্তর?

এই সব যে ব্রতের মন্তর হওয়ার উপযুক্ত নয়, সেই সত্যটা যেন সত্যর বোধের জগতে সহসা এই মুহূর্তে একটা চকিত আলোক ফেলে যায়। সে উৎসাহের বদলে মৃদুস্বরে বলে, আরও তো কত আছে–

আরও আছে? বটে! আচ্ছা বলো তো শুনি আরও কি কি আছে! দেখি কি ভাবে তোমাদের মাথাগুলো চিবানো হচ্ছে! জানো আরও?

হ্যাঁ। সত্য বড় করে ঘাড় কাত করে বলে, আর হচ্ছে–

ঢেঁকি ঢেঁকি ঢেঁকি,
        সতীন মরে নিচেয় আমি উপুর থেকে দেখি!

তা’পর গে

অশ্বথ কেটে বসত করি,
        সতীন কেটে আলতা পরি।
        ময়না ময়না ময়না,
        সতীন যেন হয় না।

তা’পর একমুঠো দুব্বো ঘাস নিয়ে বলতে হয়, ‘ঘাস মুঠি ঘাস মুঠি, সতীন হোক কানা কুষ্ঠি’। গয়না এঁকেও ছুঁয়ে ছুঁয়ে মন্তর আছে–

বাজু বন্দ পৈছে খাড়ু,
        সতীনের মুখে সাত ঝাড়।

পান এঁকে বলতে হয়–

ছচি পান এলাচি গুয়ো–
        আমি সোহাগী, সতীন দুয়ো—

আচ্ছা থাক হয়েছে। আর বলতে হবে না।

রামকালী হাত নেড়ে নিবৃত্ত করেন, এসব গালমন্দকে তোমরা পূজোর মন্তর বল?

আমরা বলি কি গো বাবা? সত্যবতী তার পণ্ডিত বাপের এহেন অজ্ঞতায় আকাশ থেকে পড়ে চোখ গোল গোল করে বলে, জগৎ সুদ্ধ সবাই বলে যে। সতীন যদি বোনের মত হবে, তবে এত মন্তরের স্রেজন হবে কেন? বোনের খোয়ারের জন্যে কি কেউ বত্ত করে? আসল কথা বেটাছেলেরা তো আর সতীনের মর্ম বোঝে না, তাই একটা ঢোক গিলে নেয় সত্য, কারণ বেটাছেলে সম্পর্কে পরবর্তী যে বাক্যটি জিভের আগায় এসে যাচ্ছিল, সেটা বাবার প্রতি প্রয়োগ করা সমীচীন কিনা বুঝতে না পেরে দ্বিধা এল।

রামকালী গম্ভীর মুখে বলেন, তা হোক, এ ব্রত তোমরা আর করো না।

করো না!

ব্রত করো না!

মাথায় বজ্রপাত হল সত্যর।

এ কী আদেশ! এখন উপায়?

একদিকে পিতৃআজ্ঞে, অপরদিকে ‘ব্রেতোপতিত’। বেতোপতিত হলে তো জলজ্যান্ত নরক; পিতৃআজ্ঞে পালন না করার পাতকটা ঠিক কতদূর গর্হিত না জানা থাকলেও, সেই পাতকের পাতকীকেও যে নরকের কাছাকাছি পৌঁছতে হবে এ বিষয়ে সত্য নিঃসন্দেহ।

অনেকক্ষণ দুজনেই স্তব্ধ।

তার পর আস্তে আস্তে কথাটা তোলে সত্য, ধরা বত্ত উজ্জাপন না করে ছেড়ে দিলে যে নরকগামিন হতে হবে বাবা!

না, হবে না। এসব ব্রত করলেই নরকগামী হতে হয়।

পিসঠাকুরমাকে তা হলে তাই বলব?

কি বলবে?

এই ইয়ে– সেঁজুতি করতে তুমি মানা করেছ?

আচ্ছা থাক, এখুনি তাড়াতাড়ি তোমার কিছু বলবার দরকার নেই। যা বলবার আমিই বলব এখন। তুমি যাও এখন। হাতটা সাবধান। কোথাও ঘষটে ফেলো না।

সত্যবতীর অবস্থাটা দাঁড়ায় অনেকটা ন যযৌ, না তস্থৌ।

বাবার হুকুম চলে যাওয়ার, অথচ মনের মধ্যে প্রশ্নের সমুদ্র। সে সমুদ্রের ঢেউ আর কার পায়ের কাছে আছড়ে পড়লে সুরাহা হবে– বাবা ছাড়া?

বাবা!

কি আবার?

বত্তটা যদি অন্যায়, সতীন যদি ভাল বস্তু, তা হলে বড় বৌয়ের অত কষ্ট হচ্ছে কেন?

বড়বৌ? রাসুর বৌ? কষ্ট হচ্ছে? সে তোমাকে বলেছে তার কষ্ট হচ্ছে?

রামকালীর কণ্ঠে ফের ধমকের সুর ছায়া ফেলে।

কিন্তু সত্যবতী দমে না।

ধিক্কারে দমে বটে সত্য কিন্তু ধমকে নয়। তাই বাকভঙ্গীতে সতেজতা এনে মোক্ষদার ভাষায় ‘কথার ভশ্চায্যি’র মতই তড়বড় করে বলে, বলতে যাবে কেন বাবা? সবই কি আর মুখ ফুটে বলতে হয়? চেহারা দেখে বোঝা যায় না? কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখ বসে গেছে, অমন যে সোনার বণ্ন, যেন কালি মেড়ে দিয়েছে। পরশু থেকে মুখে একবিন্দু জল দেয় নি। নোকনজ্জায় বলছে বটে পেটব্যথা করছে তাতেই খিদে নেই, তাতেই কাঁদছি, কিন্তু বুঝতে সবাই পারছে। কে আর ঘাসের ভাত খায় বল? মড়ার ওপর খাড়ার ঘা, তার ওপর আবার আজ নতুন বো’র হাতের সুতো খোলা! কেউ বলছে বড়বৌকে অন্য ঘরে দিয়ে ওই ঘরেই নেমকর্ম হবে, কেউ বলছে আহা থাক। বড়বৌ নাকি ও বাড়ির সাবি পিসীকে বলেছে, অত ধন্দয় কাজ নেই, চাটুয্যে-পুকুরে অনেক জায়গা আছে, তাতেই আমার ঠাই হবে।

সর্বনাশ!

প্রমাদ গণেন রামালী।

মেয়েমানুষের অসাধ্য কাজ নেই।

কে বলতে পারে মেয়েটা সত্যিই ওরকম কোন দুর্মতি করে বসবে কি না। এও তো মহাজ্বালা। কোথায় ভদ্রলোকের জাত-মান উদ্ধারের কথা ভেবে আনন্দ করবি, তা নয় এই সব প্যাঁচ!…. কেন, ত্রিভুবনে আর কারো সতীন হয় না?

হয়েছে আর কি, ওইসব অখদ্যে ব্রতপার্বণ করিয়ে শিশুকাল থেকে মেয়েগুলোর পরকাল ঝরঝরে করে রাখা হয়েছে কিনা!

মেয়েমানুষ জাতই কুয়ের গোড়া।

ঘরের লক্ষ্মী বলে সৌজন্য দেখালে কি হবে, এক-একটি মহা অলক্ষ্মী!

নইলে রেসোর এই বৌমা, কি বা বয়স, তার কিনা এত বড় কথা! জলে ডুবে মরবার সংকল্প। ছি ছি!

এই কথা বলেছেন বড় বৌমা?

অন্ধকার-মুখে বলেন রামকালী।

সাবি পিসী তো বলছিল।

বাবার মুখ দেখে এবার একটু ভয়-ভয় করে সত্যর। কিন্তু ভয় করলে তো চলবে না। তারও যে কর্তব্য রয়েছে– বাবাকে চৈতন্য করাবার।

এত বোধবুদ্ধি বাবার, অথচ সোয়ামী আর একটা বিয়ে করে আনলে মেয়েমানুষের প্রাণ ফেটে যায় কিনা সে জ্ঞান নেই! আর যদি না ফাটবে, তা হলে কৈকেয়ী কেন তিন যুগে হেয় হয়েও রামকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন? কথক ঠাকুরের কথাতেই তো শুনেছে সত্য।

রাজার রাণী তিনি, তার মনে এত বিষ!

আর বড়বৌ বেচারী নিরীহ ভালমানুষ, শুধু মনের ঘেন্নায় নিজে মরতে চেয়েছে।

সত্যর প্রাণে এত দাগা লাগার আরও একটা কারণ, বড়বৌকে দুটো সান্ত্বনার কথা বলবার মুখ তার নেই। নেই তার কারণ, এই মর্মান্তিক হৃদয়বিদারক নাটকের নায়ক হচ্ছেন স্বয়ং সত্যবতীরই বাবা। ইশারায় ইঙ্গিতে ঘরে-পরে সকলেই তো রামকালীকেই দুষছে।

দুষবার কথাও। ছেলের মায়ের যে গৌরব আলাদা। বড়বৌ যদি ছেলের মা না হত তা হলে কথা ছিল। কেঁদে কেঁদে যদি ওর বুকের দুধ শুকিয়ে যায়, ছেলে বাঁচবে কিসে?

.

এদিকে রামকালী ভাবছেন বৌটাকে শায়েস্তা করার উপায় কি? গ্রামসুদ্ধ লোক নেমন্তন্ন করেছেন, রাত পোহালেই যজ্ঞি, ও যদি সত্যিই কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে বসে! অনেক ভেবে গলাটা ছেড়ে বললেন, ওসব হচ্ছে ছেলেবুদ্ধির কথা! তুমি আমার হয়ে বৌমাকে গিয়ে বলো গে, ওসব ছেলেমানুষী বুদ্ধি ছেড়ে দিতে। বলো গে, বাবা বললেন, মন ভাল করব ভাবলেই মন ভাল করা যায়। বলো গে, উঠুন, কাজকর্ম করুন, ভাল করে খান-দান, মনের গলদ কেটে যাবে।

সত্য আর একবার বাবার অজ্ঞতায় কাতর হয়। তবে শুধু কাতর হয়ে চুপ করেও থাকে না। একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, তা যদি কেটে যেত, তা হলে তো মাটির প্রিথিবীটা সগগো হত বাবা! রুগীর চেহারা দেখে তুমি ওপর থেকে বলে দিতে পারো তার শরীরের মধ্যে কোথায় কি হচ্ছে, আর মানুষের মুখ দেখে বুঝতে পারো না তার প্রাণের ভেতরটায় কি হচ্ছে? নিজের চোক্ষে প্রেত্যক্ষ একবার দেখবে চল তা হলে!

সহসা কেন কে জানে রামকালীর গায়ে কি রকম কাটা দিয়ে উঠল। চুপ করে গেলেন তিনি। তার অনেকক্ষণ পর হাত নেড়ে মেয়েকে ইশারা করলেন চলে যেতে।

এর পর আর চলে না যাওয়া ছাড়া উপায় কি? সত্য মাথা হেঁট করে আস্তে আস্তে ঘর থেকে চলে যায়।

কিন্তু এবারের ডাকের পালা রামকালীরই, আচ্ছা শোনো।

সত্যবতী ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।

শোনো, বৌমাকে তোমার কিছু বলবার দরকার নেই, তুমি শুধু, মানে ইয়ে, তোমাকে খালি একটা কাজ দিচ্ছি

রামকালী ইতস্তত করছেন।

সত্যবতী অবাক হয়ে যায়।

নাঃ, আর যাই হোক বাবাকে কখনো এমন ইতস্তত করতে দেখে নি সত্য!

কিন্তু এ হেন পরিস্থিতিতেই বা কবে পড়েছেন রামকালী?

সত্যিই কি সত্যবতী তার চৈতন্য করিয়ে দিল নাকি? তাই রামকালী অমন বিব্রত বিচলিত?

বাবা কি করতে বলছিলেন?

ও হ্যাঁ, বলছিলাম যে তুমি তোমাদের বড়বৌ-এর একটু কাছে কাছে থাকো গে, যাতে তিনি ওই পুকুরের দিকেটিকে যেতে না পারেন।

সত্যবতী মুহূর্তকাল স্তব্ধ থাকে। বোধ করি বাপের আদেশের তাৎপর্যটা অনুধাবন করতে চেষ্টা করে। তার পর খুব সম্ভব অনুধাবন করেই নম্র গলায় বলে, বুঝেছি, বৌকে চোখে চোখে রেখে পাহারা দিতে বলছ।

পাহারা!

রামকালী যেন মরমে মরে যান।

তার আদেশের ব্যাখ্যা এই!

বিরক্তি দেখিয়ে বলেন রামকালী, পাহারা মানে কি? কাছে থাকবে, খেলাধুলো করবে, যাতে তার মনটা ভাল থাকে।

সত্যবতী সনিঃশ্বাসে বলে, ওই হল, একই কথা। কথায় বলে, যার নাম ভাজা চাল তার নাম মুড়ি, যার মাথায় পাকা চুল তারেই বলে বুড়ী। কিন্তু বাবা, পাহারা নয় দিলাম, ক’দিন ক’রাত দেব বলো? কেউ যদি আত্মঘাতী হব বলে প্রিতিজ্ঞে করে, কারুর সাধ্যি আছে আটকাতে? শুধুই তো চাটুয্যে-পুকুরের জল নয়, ধুতরো ফল আছে, কুঁচ ফল আছে, কলকে ফুলের বীচি আছে

চুপ চুপ!

রামকালী আতপ্ত নিঃশ্বাসে দাহ ছড়িয়ে বলে ওঠেন, চুপ করো। তোমার সেজ ঠাকুমা দেখছি ঠিকই বলেন। এত কথা শিখলে কোথা থেকে তুমি? যাও তোমাকে কিছু করতে হবে না, যাও!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *