কালো নেকড়ে – কর্নেল সমগ্র ১০ – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
০১.
ভদ্রলোক কর্নেলের সঙ্গে মৃদুস্বরে কথা বলেছিলেন। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে চুপ করলেন এবং পাইপ ধরাতে মন দিলেন।
জানালার কাছে ডিভানে বসে তাকে লক্ষ্য করতে থাকলুন। মাথার আঁকড়া চুল ঝকমকে সাদা। খাড়া তীক্ষ্ণ নাকের নিচে কাঁচাপাকা ঝাপালো গোঁফে সামরিক অফিসারদের মতো কেতা। পরনে ছাইরঙা টি-শার্ট এবং জিনস। এই বয়সে এ পোশাক দেখে অবশ্য আজকাল অবাক হওয়ার কিছু নেই তবে ইনি ইউরোপীয় নন তা বোঝা যায়। দেহের গড়ন বলিষ্ঠ। সম্ভবত এখনও নিয়মিত শরীরচর্চা করেন। আর গায়ের রঙ ফর্সা হলেও পোড়-খাওয়া ছাপ আছে। ভাবলুম, কর্নেলের পরিচিত কোনো সামরিক অফিসার।
তিনি পাইপের ধোঁয়া ছেড়ে আমার দিকে তাকালে আমার বৃদ্ধ বন্ধু বলে উঠলেন, আলাপ করিয়ে দিই। জয়ন্ত! ইনি সেহরাগড়ের নবাব মির্জা হায়দার আলি বেগ।
ভদ্রলোক আমাকে অবাক করে সহাস্যে বাংলায় বললেন, আর যা-ই বলুন, আমাকে নবাব বলে আলাপ করিয়ে দেবেন না কর্নেল সরকার! হ্যাঁ–একথা ঠিক যে, আমার পূর্বপুরুষ নবাবি করেছেন। কিন্তু আমি এখন নিছক মির্জাসাহেব।
কর্নেল বললেন, কিন্তু সেহরাগড়ের লোকেরা এখনও আপনাকে ছোট নবাব বলে। যা-ই হোক, আমার এই তরুণ বন্ধুর নাম জয়ন্ত চৌধুরী। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার বিখ্যাত সাংবাদিক।
মির্জাসাহেব আমাকে করজোড়ে নবস্কার করে বললেন, আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভাল লাগল।
আমিও নমস্কার করে বললুম, আপনি চমৎকার বাংলা বলতে পারেন। দেখছি!
পারি। মির্জাসাহেব উজ্জ্বল মুখে বললেন। কারণ আমার ছেলেবেলা থেকে তরুণ বয়স পর্যন্ত কলকাতায় কেটেছে। আমার বয়স যখন মোটে ছবছর, তখন আমার বাবা মির্জা হাসান আলি বেগ মারা যান। তারপর পারিবারিক ঝামেলায় বিপন্ন আমার মা জাহানারা বেগম আমাকে মেটিয়াবুরুজে তাঁর দাদা কাশিম খানের কাছে রেখে যান। মামা ছিলেন নামকরা অ্যাডভোকেট। কংগ্রেস দলে রাজনীতি করতেন। তো আমার পড়াশোনা কলকাতাতেই শুরু হয়। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলুম। পরে সেহরাগড়ে মায়ের কাছে ফিরে যাই। তারপর অবশ্য অ্যামেরিকা–তো সে যা-ই হোক। মনে-মনে আমি সেই যে বাঙালি হয়ে গিয়েছিলুম, এখনও তা-ই আছি। এখনও সেহরাগড়ে আমার বন্ধুরা আমাকে বাঙাল বলে তামাশা করেন।
কর্নেল বললেন, বেগ পদবি শুনে জয়ন্তের মাথায় কোনো প্রশ্ন জাগা উচিত। কারণ সাংবাদিকদের সবজান্তা না হলে চলে না।
বললুম, আমি সাংবাদিক হিসেবে এখনও আনাড়ি। এটা আপনারই কথা কিন্তু!
মির্জাসাহেব হেসে উঠলেন। এই তুর্কি শব্দটা আমাদের বংশের একটুকরো লেজ। আমি প্রাচীন ইতিহাস আর পুরাতত্ত্বের ছাত্র ছিলুম। কিন্তু আমার পক্ষে বলা কঠিন, সত্যিই আমরা পূর্বপুরুষ মধ্য এশিয়ার তুর্কি ছিলেন কি না। তবে হ্যাঁ–বাংলায় তুরুকসোয়ার বলে একটা কথা আছে। কথাটা আসলে সওয়ার। তার মানে, তুর্কিদের ঘোড়ায় চড়ার বাতিক ছিল। সেই বাতিক কিন্তু আমারও আছে।
ষষ্ঠীচরণ কফি আনল। কর্নেল বললেন, আরেক দফা কফিতে আশা করি মির্জা সাহেবের আপত্তি নেই।
মির্জাসাহেব চুপচাপ কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। এবার তাকে একটু অন্যমনস্ক মনে হলো। পেয়ালায় চুমুক দিয়ে আস্তে বললেন, কফির স্বাদ বছর তিনেক আগেকার সেই জ্যোৎস্নারাতের স্মৃতি জাগিয়ে তোলে। সেহরাগড় ফরেস্ট বাংলোর বারান্দায় বসে এমনি মার্চ মাসে আপনি, আমি আর এমিলি কফি খাচ্ছিলুম। আপনি এমিলিকে জিজ্ঞেস করছিলেন, ভারতীয় জ্যোৎস্নার সঙ্গে অ্যামেকিান জ্যোৎস্নার কোনো তফাত সে অনুভব করছে কি না।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ, সেই রাতটার কথা আমার মনে আছে। এখন আপনার সব কথা শোনার পর মনে হচ্ছে, আপনার স্ত্রী এমিলি যেন এ দেশের জ্যোৎস্নার নেশায় পড়েছিলেন।
ঠিক তা-ই। মির্জাসাহেব সহসা যেন উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। ওকে প্রায়ই নিষেধ করতুম। এভাবে রাতবিরেতে তুমি ঘোড়ায় চেপে কোথাও ঘোরাঘুরি কোরো না। সে নিষেধ মানত না।
কর্নেল বললেন, অ্যাকসিডেন্টটা আপাতদৃষ্টে স্বাভাবিক মনে হওয়ার কথা। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, শিক্ষিত ঘোড়ার পক্ষে এ ধরনের অ্যাকসিডেন্ট বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় ছোটাছুটি করার অভ্যাস যার ছিল–
মির্জাসাহেব কর্নেলের কথার ওপর বললেন, ঠিক এই কথাটাই আপনাকে বলতে চাইছিলুম। রাস্তাটা পাথুরে হলেও মোটামুটি সমতল। বাঁদিকে হঠাৎ তার সরে আসার কারণ কী? বাঁদিকে তিনশো ফুট গভীর খাদ। ডাইনে যথেষ্ট জায়গা ছিল। অথচ সে বাঁদিকে সরে এসে গতির মুখে টাল সামলাতে না পেরে খাদে পড়ে গেল। হতভাগিনী এমিলির লাশের ফুট বিশেক ওপরে পড়ে ছিল ঘোড়াটা। তাকে মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়ে আমি গুলি করেছিলুম।
কর্নেল বললেন, আপনি তো রাস্তাটা পরীক্ষা করেছিলেন?
হ্যাঁ। কিন্তু ঘোড়াটা সোজা ছুটতে ছুটতে কেন বাঁদিকে সরে এসেছিল বুঝতে পারিনি।
সেহরাগড় অঞ্চলে তখন একটা মানুষখেকো নেকড়ের উৎপাত চলছিল। তাই না?
মির্জাসাহেব একটু চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু নেকড়েটা বয়স্ক মানুষ বা তার চেয়ে আকারে বড় কোনো জন্তুকে আক্রমণ করেনি। রাতদুপুরে চুপিচুপি হানা দিয়ে ঘুমন্ত শিশুকে তুলে নিয়ে গেছে। অনেক শিকারি তাকে মারবার চেষ্টা করেছেন। আমিও করেছিলুম। কিন্তু তার পাত্তা মেলেনি।
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, এমন কি হতে পারে না যে, সেই নেকড়েটাকে হঠাৎ দেখে আপনার স্ত্রীর ঘোড়া ভয় পেয়েছিল?
মির্জাসাহেব আস্তে বললেন, সেদিন বিকেলে কিছুক্ষণ ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল। রাতে আকাশ পরিষ্কার ছিল। জ্যোৎস্না ছিল। তাছাড়া অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটা ছিল খোলামেলা। নেকড়ের মতো একটা খুদে জানোয়ার দেখে টনির ভয় পাওয়ার কথা নয়। সকালে আমি তন্নতন্ন খুঁজে ওখানে কোনো জানোয়ারের পায়ের চিহ্ন পাইনি।
কর্নেল বললেন, এবার বলুন পোস্টম্যান লছমনের কথা। সে নাকি নেকড়েটা দেখেছিল?
লছমন সিং সম্পর্কে আপনাকে বলেছি। সে সাহসী লোক। সাইকেলে চেপে দেহাতে চিঠি বিলি করে বেড়ায়। গত মাসে একদিন সে হরিপুরা থেকে বাড়ি ফিরছিল। পাহাড়ি শীত কী সাংঘাতিক তা আপনি জানেন। সন্ধ্যার আগেই সে বাড়ি ফেরার জন্য শর্টকাট করেছিল। হঠাৎ নাকি সে নেকড়টাকে দেখতে পায়। তার দিকে পাথর ছুঁড়তে ছুঁড়তে হইহল্লা শুরু করে। তাই শুনে আদিবাসীরা দৌড়ে আসে। তবে তারা নেকড়টাকে দেখতে পায়নি। এখন লছমন আমাকে বলেছে, নেকড়েটার গায়ের রঙ নাকি কালো।
কালো নেকড়ে?
মির্জাসাহেব হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আমি ওকে বললুম, তুমি আসলে ভালুক দেখেছ। কিন্তু সে জোর গলায় বলল, ভালুক নয়। সে বনজঙ্গল এলাকার লোক। ভালুক সে চেনে। কিন্তু সেই জন্তুটা অবিকল প্রকাণ্ড একটা কুকুরের মতো। প্রথমে সে ভেবেছিল, জন্তুটা একটা অ্যালসেশিয়ান কুকুর। সেহরাগড়ে অনেকের বাড়িতে এই কুকুর আছে। হয়তো একটা কুকুর বাড়ি থেকে এতদূরে চলে এসেছে। কিন্তু সে পাথর ছুঁড়লে কালো জন্তুটা দাঁত বের করে গর্জন করছিল। তার পায়ের বড়বড় নখও দেখতে পেয়েছিল লছমন। আমার মতে, ওটা তার মনগড়া ধারণা।
কর্নেল আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সাংবাদিকদের নিশ্চয় জানা কথা। প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ যেসব নেকড়েকে গৃহপালিত জীবে পরিণত করেছিল, তাদেরই বংশধরকে আমরা কুকুর বলি।
ওঁর কৌতুকে কান না করে বললুম, আপনিই বলেন, প্রকৃতিতে রহস্যের কোনো সীমা নেই। কাজেই কালো নেকড়েও থাকতে পারে। সেই কালো নেকড়েকে হঠাৎ দেখে মির্জাসাহেবের স্ত্রীর ঘোড়া ভয় পেতেও পারে।
মির্জাসাহেব চমকে উঠে আমার দিকে ঘুরে বসলেন। মিঃ চৌধুরিকে ধন্যবাদ। এই পয়েন্টটা আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু তাহলে তার পায়ের ছাপ খুঁজে পাইনি কেন কে জানে!
কর্নেল বললেন, আচ্ছা মির্জাসাহেব, অ্যাকসিডেন্টের জায়গা থেকে আপনার খুড়তুতো দাদার ফার্মহাউস কতদূরে?
বেশি দূরে নয়। হাফ কিলোমিটারের মধ্যেই।
আপনি কি কখনও সেই ফার্মহাউসে গেছেন?
মির্জাসাহেব জোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমার সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আপনাকে বলেছি, আমার চাচা মির্জা আব্বাস আলি বেগের ফ্যামিলির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়। চাচা আমার মাকে প্রচণ্ড অপমান করেছিলেন। চাচা মারা গেছেন প্রায় দশ বছর আগে। তার দুই ছেলে সালিম এবং কলিম। সালিমের এগ্রিকালচারে একটা ডিগ্রি আছে। সে তার বাবার মতোই উদ্ধত স্বভাবের লোক। তার ফার্মহাউসের আনাচে-কানাচে কেউ যেতে সাহস পায় না। কলিম অবশ্য ভদ্র। তার ভদ্রতার সুযোগ নিয়ে সালিম কিন্তু তাকেও প্রপার্টির ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করেছে।
কলিমসাহেব কী করেন?
সে সেহরাগড়ের নামকরা ডাক্তার। আমাকে দেখলে কথা বলার চেষ্টা করে। সে। কিন্তু আমি এড়িয়ে থাকি।
বাই এনি চান্স, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ওঁদের দু ভাইয়ের কি কখনও আলাপ হয়েছিল?
মির্জাসাহেব একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, এমিলি কলিমের খুব প্রশংসা করত। আর–এমিলি একদিন রাত্রে বলেছিল, সালিম তার সঙ্গে যেচে পড়ে আলাপ করেছে এবং তার ফার্মহাউসে যেতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমি এমিলিকে ওদের সঙ্গে আমাদের শত্রুতার সব ঘটনা খুলে বলেছিলুম। তাই এমিলি সালিমকে এড়িয়ে চলত।
কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট অ্যাশট্রেতে রেখে বললেন, ফার্মহাউসের জমি কতখানি?
শুনেছি প্রায় পঞ্চাশ একর। ওই জমিতে আমারও কিছু অংশ আছে। মানে রেকর্ড অনুসারে আছে। কিন্তু আমি মামলা-মোকদ্দমা একেবারে পছন্দ করি না। বলে মির্জাসাহেব একটু নড়ে বসলেন। হ্যাঁ–আপনাকে বলা উচিত কথাটা। আমার শ্যালক গ্যারি কোহেন বছর দুই আগে বোনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। গ্যারির হবি বুনো জানোয়ারের ছবি তোলা। আমার এবং এমিলির অজ্ঞাতসারে সে সালিমের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলেছিল। ফার্মহাউসেও গিয়েছিল। কথাটা জানতে পেরে এমিলি তাকে বকাবকি করেছিল। কিন্তু গ্যারি বোনকে গ্রাহ্যই করেনি।
জিজ্ঞেস করলুম, আপনার স্ত্রীকে কি আপনি ধর্মান্তরিত করেননি?
মির্জাসাহেব পাইপের ছাই ঝেড়ে ফেলতে ফেলতে বললেন, করিনি। আসলে ইসলাম ধর্মের বিধানে আছে, কোনো মুসলিম যদি ইহুদি বা খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করেন, তাহলে স্ত্রীকে ধর্মান্তরিত না করলেও চলে। কারণ এই দুই ধর্মের প্রফেটরা মুসলিমদেরও শ্রদ্ধেয় প্রফেট।
এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল। কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিয়ে বললেন, ইয়া! জাস্ট এ মিনিট। প্লিজ হোল্ড অন।
তিনি মাউথপিসে হাত চাপা দিয়ে বললেন, এক মহিলা জানতে চাইছেন মির্জাসাহেব এখানে আছেন কি না!
মির্জাসাহেব রিসিভার নিয়ে সাড়া দিলেন। রোজি?….হোয়াট?….ওকে। আই অ্যাম গোয়িং। ডোন্ট বি ওয়ারিড!
টেলিফোন রেখে তিনি বললেন, আমার মামাতো বোন রোজি মেটিয়াবুরুজ থেকে ফোন করে জানাল, সেহরাগড় থেকে জরুরি খবর এসেছে। আমাদের একজন ওল্ড সারভ্যান্ট কাদের বখশকে গতকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। না। আমি উঠছি কর্নেল সরকার! আপনাকে যা বলার সবই বলেছি। আমি আপনার প্রতীক্ষায় থাকব। মিঃ চৌধুরিকেও সঙ্গে নিয়ে গেলে খুশি হব। আচ্ছা, চলি!
করজোড়ে নমস্কার করে মির্জাসাহেব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল স্বগতোক্তি করলেন, মির্জাসাহেব আমার কাছে আসার সময় তাঁর মামাতো বোনকে আমার ফোন নাম্বার দিয়ে এসেছিলেন। তার মানে, উনি সেহরাগড়ে ওঁর বাড়ি বা লোকজন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। এমন কি, সম্ভবত নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারটাও তার মাথায় ছিল।
বললুম, মির্জাসাহেবের কেসটা কী?
কর্নেল অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমার কাছে সবটা স্পষ্ট হয়নি। শুধু এটুকু বুঝেছি, সেহরাগড়ে ওঁকে কেন্দ্র করে রহস্যময় কিছু ঘটনা ঘটছে।
অতএব আপনি যাচ্ছেন!
তুমিও যাচ্ছ। মির্জাসাহেব তোমাকেও আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন।
আমি–
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, এই বসন্তকালে সেহরাগড় বিশেষ করে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে সংরক্ষিত অরণ্য এলকা মর্তে স্বর্গ হয়ে উঠেছে। এই সুযোগে দ্বিতীয়বার সেহরাগড় দর্শনের লোভ সম্বরণ করা আমার পক্ষে কঠিন।
কিন্তু আপনার কেসটা তো নবাববাড়ির।
তা ঠিক। বছর তিনেক আগে ওই জঙ্গলে গিয়ে মির্জাসাহেব এবং তার মার্কিন স্ত্রী এমিলির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমার কেন যেন ধারণা হয়েছিল, ওঁদের দাম্পত্যজীবনে স্বাভাবিকতার লেশমাত্র নেই। ব্যাপারটা আমি ঠিক বোঝাতে পারব না। এটুকু বলতে পারি, আমার মধ্যে একটা প্রশ্ন জেগেছিল। ওঁরা কি কোনো গোপন ব্যাপারের চুড়ান্ত বোঝাপড়া করতেই নির্জন জঙ্গলে এসেছেন? সম্ভবত আমি হঠাৎ গিয়ে পড়ায় সেটা ওঁদের পক্ষে আর হয়ে ওঠেনি।
তা হলে বলুন দুজনের মধ্যে সম্পর্কে ভাঙন ধরেছিল?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, নাহ্। অতটা নয়।
আচ্ছা কর্নেল, মির্জাসাহেবের সঙ্গে আপনার কি তার আগে থেকে পরিচয় ছিল?
হ্যাঁ। মির্জা হায়দার আলি বেগ প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের এক উদ্যোক্তা। নৈনিতালের প্রকৃতি-পরিবেশ সংক্রান্ত একটা কনফারেন্সে ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। তখন অবশ্য এমিলি ওঁর সঙ্গে ছিলেন না।
আপনি সেহরাগড়ে ওঁর বাড়িতে কি গিয়েছিলেন?
না। আমন্ত্রণ পেয়েও যাওয়া হয়নি। তবে এটুকু জানি, নবাব পরিবারের বাড়িটা আসল একটা কেল্লাবাড়ি। ইংরেজিতে যাকে ক্যা বলা হয়। আর বাড়িটার নাম কালামহল।
অদ্ভুত নাম তো!
আসলে কালা পাথরের পাঁচিল ঘেরা বাড়ি। মোগল আমলে ওঁদের প্রাসাদটাও ছিল কালো পাথরে তৈরি। শুনেছিলুম, সেই প্রাসাদটা এখন ধ্বংসস্তূপ।
এই সময় ডোরবেল বেজে উঠল। একটু পরে প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার–আমাদের প্রিয় হালদারমশাই ঘরে ঢুকে ধপাস করে সোফায় বসে পড়লেন। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে নস্যির কৌটো বের করে এক টিপ নস্যি নিলেন। তাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছিল।
কর্নেল তার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, শরীর খারাপ নাকি হালদারমশাই?
প্রাক্তন পুলিশ অফিসার যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু হাসলেন। না কর্নেলস্যার! শরীর ঠিক আছে। মনের অবস্থা ঠিক না। যদি জিগান, ক্যান? আমি কইব, ক্লায়েন্ট যদি তঞ্চকতা করে, তাহলে আমার প্রফেশন চলবে ক্যামনে?
ব্যাপারটা খুলে বলুন। শোনা যাক। বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ আমার দিকে ঘুরে বললেন, জয়ন্তবাবুও শোনেন। মশাই! আপনারা–মানে কাগজের লোকেরা মাঝে মাঝে কী সব ঝামেলা বাধান!
বললুম, কী ঝামেলা বলুন তো?
হালদারমশাই তার লম্বা তর্জনী আমার দিকে তাক করে কর্নেলের উদ্দেশে বললেন, আচ্ছা! কন তো কর্নেলস্যার! উলফ কি কখনও ব্ল্যাক হয়? জয়ন্তবাবুরা কাগজে লিখছেলেন, কোথায় একটা ব্ল্যাক উল উৎপাত বাধাইছে।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। এরকম একটা খবর কমাস আগে সব কাগজে বেরিয়েছিল বটে!
বললুম, সে কী! আমার তো চোখে পড়েনি!
বলেই অবাক হয়ে গেলুম। আশ্চর্য! এই তো কিছুক্ষণ আগে সেহরাগড়ের মির্জাসাহেব কালো নেকড়ের কথা বলে গেলেন। তা হলে কর্নেল আগে থেকেই ওই খবরটা জানতেন! তা ছাড়া আমি আসার আগে মির্জাসাহেবের সঙ্গে নিশ্চয় তা নিয়ে কিছু আলোচনা হয়েছে।
উত্তেজিত হালদারমশাই বললেন, কিন্তু আমার ঝামেলাটা শোনেন। গত সপ্তাহে একটা ইংরেজি কাগজে আমার ডিটেকটিভ এজেন্সির বিজ্ঞাপন দিছিলাম। দুদিন পরে আমার অফিসে এক মহিলা টেলিফোন করলেন। বাঙালি না। বাঙালি মহিলাদের ইংলিশ প্রনানশিয়েশন আমি আইডেন্টিফাই করতে পারি। তা শোনেন।
এরপর প্রাইভেট ডিটেকটিভ যে ঘটনা শোনালেন, তা এই :
এক অবাঙালি মহিলা হালদারমশাইকে টেলিফোনে বলেন, খবরের কাগজে বিহারের সেহরাগড় জঙ্গল এলাকায় যে কালো নেকড়ের উৎপাতের খবর বেরিয়েছে তা নিশ্চয় ডিটেকটিভদ্রলোক দেখেছেন। না দেখে থাকলে লোক মারফত সেই খবরের কাটিং তিনি পাঠিয়ে দেবেন। মিঃ হালদার যার কালো নেকড়েটাকে ধরে দিতে পারেন, তা হলে তাকে দশ হাজার টাকা বখশিস দেওয়া হবে! হালদারমশাই খুব অবাক হয়ে যান। তিনি বলেন, এ কাজটা শিকারিদের। তিনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তখন সেই মহিলা বলেন, না! কালো নেকড়ের মধ্যে একটা রহস্য আছে। ওটা সম্ভবত নেকড়ে নয়। যাই হোক, সেদিন বিকেলে পাঁচটা নাগাদ হালদারমশাই যেন মেট্রো সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভদ্রমহিলা তাঁকে এক হাজার টাকা অগ্রিম দেবেন। ইতিমধ্যে তার লোক খবরের কাগজের কাটিং তাকে অফিসে পৌঁছে দেবেন। আশ্চর্য ব্যাপার, লোকটা সেদিন এল না। কিন্তু ডিটেকটিভ এসেন্সির অফিসের লেটারবক্সে হালদারমশাই কাটিংটা পেয়ে গেলেন। তারপর বিকেল পাঁচটায় যথারীতি তিনি মেট্রো সিনেমার সামনে দাঁড়িয়ে তার মক্কেলের অপেক্ষা করেন। অধৈর্য হয়ে ঘণ্টাটাক প্রতীক্ষার পর একটা বেঁটে গাঁট্টাগোট্টা লোক এসে তাকে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করে, তিনি মিঃ হালদার কি না। হালদারমশাই সেই মহিলাকে নিজের চেহারা এবং বিশেষ করে ঘন ঘন নস্যি নেওয়ার ব্যাপারটা জানিয়ে রেখেছিলেন। হালদারমশাই লোকটাকে বলেন, ম্যাডাম কোথায়? লোকটা বলে, ম্যাডাম আসতে পারেননি। মিঃ হালদারকে কষ্ট করে তার সঙ্গে ওঁর বাড়িতে যেতে হবে। ম্যাডাম কাছেই থাকেন। সদর স্ট্রিট এলাকায় একটা গলির ভেতর পুরনো একটা বাড়ির সামনে হালদারমশাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে লোকটা ভেতরে যায়। তারপর আর সে ফিরে আসেনি। আরও একঘণ্টা প্রতীক্ষার পর তিনি পাশের একটা পান-সিগারেটের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, বাড়িটাতে যারা বাস করে, তারা খারাপ মেয়ে। অর্থাৎ আসলে ওটা একটা হোরহাউস। দোকানদার মুচকি হেসে অবশ্য বলেছিল, এই খানকিমহলে ঢোকার ইচ্ছে থাকলে বাবুসাহেব তাকে কুড়ি টাকা দিন। কথাটা শুলে হালদারমশাই সেখান থেকে কেটে পড়েন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, আবার গতকাল দুপুরে সেই মহিলা টেলিফোন করেছিলেন। রাগ করে হালদারমশাই তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার হুমকি দিয়ে ফোন রেখে দেন। তারপর আর ফোন আসেনি।
সবটা শোনার পর কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, আমরা সেহরাগড়ে বেড়াতে যাচ্ছি। হালদারমশাই ইচ্ছে করলে আমাদের সঙ্গী হতে পারেন। কালো নেকড়ের ব্যাপারটা সত্যি রহস্যময়।
হালদারমশাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ নড়ে উঠলেন। বললেন, দেন আই মাস্ট গো দেয়ার।…
.
০২.
ষষ্ঠীচরণ হালদারমশাইয়ের জন্য কফি এনেছিল। কর্নেল যথারীতি আওড়ালেন, কফি খান হালদারমশাই। কফি নার্ভ চাঙ্গা করে।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ ফুঁ দিয়ে বেশি দুধ মেশানো গরম কফির পেয়ালায় বারকতক চুমুক দেবার পর একটু হেসে বললেন, আইজ নার্ভ চাঙ্গা হবে না।
কর্নেল হাসলেন, কেন বলুন তো?
আপনার কথায় নার্ভ ব্যাবাক তালগোল পাকাইয়া গেল। হালদারমশাই ভুরু নাচিয়ে চাপা স্বরে ফের বললেন, সেই মহিলা কি আপনার লগেও যোগাযোগ করছিল?
নাহ্।
তাহলে হঠাৎ আপনি ব্ল্যাক উলফের পিছনে দৌড়াইতে চান ক্যান?
কর্নেল হাসলেন। সেহরাগড়ে যাওয়ার প্ল্যান আমি আগেই করেছিলুম। ওই এলাকায় একটি রিজার্ভ ফরেস্ট আছে। তাছাড়া ওখানে আমার একজন বন্ধুও আছেন। তিনি সেহরাগড়ে নবাবদের বংশদর। তার কাছেই একটা মানুষখেকো কালো নেকড়ের খবর আমি পেয়েছি।
হালদারমশাই গুলিগুলি চোখে তাকিয়ে বললেন, তা হলে হেভি মিট্রি!
অবশ্যই। বিশেষ করে আপনার মুখে যা শুনলুম, তাতে আমার নার্ভও তালগোল পাকিয়ে গেছে। বলে কর্নেল অ্যাশট্রে থেকে আধপোড়া চুরুটটি তুলে নিলেন। লাইটার জ্বেলে চুরুট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে ফের বললেন, সেহেরাগড় যাওয়ার দিনক্ষণ এখনও ঠিক করিনি। ইতিমধ্যে আপনি আজ একটা। কাজ সেরে ফেলুন। তারপর দিনক্ষণ ঠিক করা যাবে।
হালদারমশাই কফি শেষ করে নস্যি নিলেন। তারপর বললেন, কেন কর্নেলস্যার!
কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, আপনি তো ছদ্মবেশে ধরতে ওস্তাদ। ইচ্ছেমতো ছদ্মবেশ ধরে সেই বাড়িটার কাছে গিয়ে ওত পেতে থাকুন। আমি লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে বলে রাখব। তাদের লোকও মেতায়েন থাকবে। সেই বেঁটে লোকটাকে দেখতে পেলেই জাপটে ধরে চোর-চোর বলে চ্যাঁচামেচি শুরু করবেন। কী? পারবেন তো?
আলবাত্ পারব। এ তো সামান্য কাজ। কন! কখন যাব?
বিকেল চারটেতে আপনি পৌঁছুবেন।
হালদারমশাইয়ের গোঁফ তিরতির করে কাঁপতে থাকল। জিজ্ঞেস করলুম, কী ছদ্মবেশে ধরবেন হালদারমশাই?
গোয়েন্দাপ্রবর ফিক করে হেসে বললেন, কসমোপোলিটন এরিয়া। তবে মুসলিমরাই বেশি। লুঙ্গি-পাঞ্জাবি পরব। মাথায় টুপি পরব। চোখে সানগ্লাস। আর–হঃ! দাড়ি তো লাগাবই।
কর্নেল বললেন, বাহ্।
অমনি হালদারমশাই তড়াক করে উঠে দাঁড়ালেন। আমার দিকে ঘুরে বললেন, জয়ন্তবাবু! চৌতিরিশ বৎসর পুলিশে চাকরি করছি। মাঝে মাঝে কর্নেলস্যারের লগে কনসাল্ট করতে আসি বটে, তবে আমারে ফুলিশ ভাববেন না। পুলিশ রিটায়ার করলে নাকি ফুলিশ হয়। আমার এক কলিগ কইত। কথাটা কত ভূল, তা প্ৰভ করার জন্যই তো প্রাইভেট ডিকেটটিভ এজেন্সি খুলছি। কর্নেলস্যার! শুধু একটা অনুরোধ।
কর্নেল বললেন, বলুন।
লালবাজারের ঘুঘুগুলি আমারে লইয়া মস্করা করে। প্লিজ, তাদের যেন আগেই জানাইয়া দিবেন না আমি কে। পরে, জানলে ক্ষতি নাই।
কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, আপনার এই প্রব্লেমটা আছে অবশ্য। তবে চিন্তা করবেন না। আমি আশেপাশে থাকব।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ চিন্তিতভাবে বললেন, কিন্তু গলিটার নাম তো লক্ষ্য করি নাই। বাড়িটা পুরানো। গেট আছে। কী যেন নামটা…
কর্নেল বললেন, আমার এলাকা থেকে দূরে নয়। আমি বাড়িটা চিনি। ওটার নাম খুশবুমহল। ওই গলির নাম দিলজান লেন।
হালদারমশাই আবার ফিক করে হেসে বললেন, আপনি গিছলেন কখনও? কর্নেল গম্ভীরমুখে বললেন, বছর পাঁচেক আগে ওই বাড়িতে একজন বাইজি খুন হয়েছিল। বাড়ির মালিকই তাকে খুন করেছিল। সে এখন জেলে। বাড়িটা বেহাত হয়ে গেছে। যাই হোক, প্লিজ টেক ইট সিরিয়াসলি!
অব কোর্স! বলে কে কে হালদার সবেগে বেরিয়ে গেলেন।
বললুম, হালদারমশাই এখন থেকেই ড্রেসরিহার্সাল শুরু করবেন বাজি রেখে বলতে পারি।
কর্নেল আমার কথায় কান দিলেন না। তেমনি তুম্বো মুখে টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করতে ব্যস্ত হলেন।
প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম চলি! আজ আমার ইভনিং ডিউটি।
কর্নেল চাপা স্বরে কার সঙ্গে কথা বলছিলেন। মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন শুধু। আমি বেরিয়ে এলুম।…
সেদিন সন্ধ্যায় দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার অফিসে বসে পুলিশসূত্রে পাওয়া গয়নার দোকানে ডাকাতির একটা খবর লিখছি। নিউজ ডিপার্টমেন্টের ব্যুরোচিফ সত্যদা ডাকলেন, জয়ন্ত! তোমার ফোন!
বিরক্ত হয়ে বললুম, আমার টেবিলে দিতে বলুন অপারেটরকে।
সত্যদা সহাস্যে বললেন, তোমার বসের ফোন। আশা করি কিছু একটা বেধেছে।
কে বস?
সত্যদা, অমনি রেগে গিয়ে হালদারমশাইয়ের মতো পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় বলে উঠলেন বুড়ারে কইয়া দিতাছি, জয়ন্ত ফোন ধরবে না। আর কনসিকোয়েন্টলি কী হইব জানো? তোমার একটা ইনক্রিমেন্ট স্টপ কইরা দিমু! ক্যান? না– সত্যসেক পত্রিকা একটা ইমপরট্যান্ট স্টোরি মিস করবে।
বেগতিক দেখে দ্রুত উঠে গিয়ে ওঁর টেবিলে টেলিফোন ধরলুম। আসলে আজ বিকেলে সেই বাইজিমহলের ব্যাপারটা তখন মাথায় ছিল না। আজ গয়নার দোকানে ডাকাতির ঘটনা সাংঘাতিক।
সাড়া দিতেই কর্নেলের কণ্ঠস্বর ভেসে এল। তখন এমন করে আমার ঘর থেকে তোমার চলে যাওয়া উচিত হয়নি জয়ন্ত! ষষ্ঠী তোমার জন্য রান্না করেছিল। যাই হোক, শোনো। সত্যবাবুকে আভাস দিয়েছি। তুমি এখনই চলে এস। ছাড়ছি।…
সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় সব রাস্তায় জ্যাম। অলিগলি ঘুরে ইলিয়ট রোডে কর্নেলের বাড়ির লনে যখন গাড়ি ঢোকালুম, তখন সওয়া সাতটা বেজে গেছে।
তিনতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় কলিং বেলের সুইচ টেপার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ষষ্ঠীচরণ দরজা খুলে দিল। সে চাপাস্বরে বলল, বাবামশাই নিচে লক্ষ্য রাখতে বলেছিলেন। এদিকে এক কাণ্ড! হালদার মশাইকে দেখলেই বুঝতে পারবেন! রক্তারক্তি কাণ্ড!
ষষ্ঠীচরণ হাসি সামলাতে না পেরে অন্য দরজা দিয়ে তার ঘরে ঢুকল। কর্নেলের ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি, হালদারমশাইয়ের কানের নিচে ব্যান্ডেজ। পরনে চেককাটা লুঙ্গি আর নোংরা ফর্দাফাই রক্তমাখা পাঞ্জাবি। মাথায় অবশ্য টুপি নেই। মুখেও নকল দাড়ি নেই।
আমাকে দেখে তিনি একটিপ নস্যি নিলেন। কর্নেল বললেন, বসো জয়ন্ত! আগে কফি খাও।
বললুম, কফির আগেই ঘটনাটা শুনতে চাই বস্! হালদারমশাইয়ের কানের নিচে ব্যান্ডেজ। মনে হচ্ছে, প্রচণ্ড কিছু ঘটেছিল।
হালদারমশাই বললেন, নাহ্। তেমন কিছু না। আমি ভাবি নাই হালা আমারে ক্ষুর মারবে। জাপটাইয়া ধরা মাত্র–ওঃ! হালারে পুলিশ লইয়া গেল। আমি পেটাবার সুযোগ পাইলাম না।
কর্নেল বললেন, হালদারমশাই খুব বেঁচে গেছেন। ওঁর গলার দিকে ক্ষুর চালাতে চেয়েছিল বজ্জাতটা। হা–আমিও এতটা ভাবিনি। ভাবা উচিত ছিল। আমার বুদ্ধির ভুলেই ওঁর প্রাণ যেতে বসেছিল।
যষ্ঠী কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে ঘটনাটা কর্নেলের মুখে শুনলুম।
খুশবুমহলের ভেতর থেকে বেঁটে ষণ্ডামার্কা লোকটা বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে হালদারমশাই তাকে জাপটে ধরে চোর-চোর বলে চিৎকার করছিলেন। হঠাৎ লোকটা ক্ষুর বের করে তাঁর গলায় চালানোর চেষ্টা করে। হালদারমশাইয়ের পুলিশজীবনের এধরনের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি খপ করে তার হাত চেপে ধরেন। তারপর সাদা পোশাকের চারজন পুলিশ লোকটাকে পাকড়াও করে। লোকটার নাম সেকেন্দার আলি। তবে সে বিট্টু পাহলোয়ান নামে পরিচিত। কর্নেল ঘটনাস্থলে ছিলেন। হালদারমশাইয়ের কানের নিচে ইঞ্চিটাক ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছিল। তাকে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে এক ডিসপেনসারিতে নিয়ে গিয়ে কর্নেল ফার্স্ট এডের ব্যবস্থা করেন এবং সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফেরেন।
লালবাজার ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট সন্ধ্যা ছটা নাগাদ কর্নেলকে টেলিফোনে লোকটার পরিচয় জানায়। ঘুঘু লোক। পুলিশ রেকর্ডে সে একজন মার্কামারা অপরাধী। কিন্তু প্রমাণের অভাবে সে বহুবার আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেয়েছে। এ সব লোকের মুখ থেকে গোপন কথা বের করা সহজ নয়। শুধু এটুকু জানা গেছে, নাসিমা নামে একজন মধ্যবয়সী শিক্ষিতা বারবনিতা তাকে মেট্রো সিনেমার সামনে হালদারমশাইয়ের কাছে পাঠিয়েছিল। বিট্টু পাহলোয়ান বলেছে, তার কোনো কসুর নেই। হালদারমশাইকে নিয়ে এসে অপেক্ষা করতে বলে সে নাসিমার ঘরে গিয়েছিল। কিন্তু নাসিমাকে দেখতে পায়নি। তাই তার খোঁজে ব্যস্ত ছিল সে। কোনা ঘরেই নাসিমাকে পাওয়া যায়নি। ঘরে তালা আঁটা ছিল। সন্ধ্যার পর বারবনিতাদের জিম্মাদারনী মুন্নিবাই ঘরের তালা ভাঙার হুকুম দেয়। তারপর দেখা যায়, নাসিমা কখন তার জিনিসপত্র নিয়ে কেটে পড়েছে। বাড়িটার মালিক সুরেশ সিং প্রভাবশালী লোক। তার কাছে খবর যায়। কিন্তু সে ব্যাপারটা গ্রাহ্য করেনি। তার কথা, খাঁচার চিড়িয়া উড়ে গেল আরেক চিড়িয়া এসে ঢুকবে।
এখন পুলিশ সুরেশের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে। নাসিমা সম্পর্কে পুরনো তথ্য জানা থাকলে একমাত্র সে-ই দিতে পারে। বিট্টু পাহলোয়ান অবশ্য বলেছে, নাসিমা এখানে এসে জুটেছিল মাস দেড়েক আগে। তাকে ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হতো। তাই বাড়ির সবাই তাকে সমীহ করে চলত। তা ছাড়া নাসিমা ছিল মেজাজী মেয়ে। তার ঘরে একজন বাঁধা খদ্দের ছিল। লোকটা পয়সাওয়ালা। বিট্টু এবং আরও অনেককে সে প্রচুর বখশিস দিত। তাকে ওরা। চাঁদ মিয়া নামে জানত। চাঁদ মিয়া আসত মারুতি গাড়ি নিয়ে। মাঝে মাঝে জিম্মাদারনীকে বখশিস দিয়ে নাসিমাকে সে বাইরে নিয়ে যেত।
কিন্তু নাসিমা জিনিসপত্র নিয়ে সদর গেট দিয়ে পালায়নি। তাহলে বাড়ির লোকদের চোখে পড়ত। পেছনে একটা দরজা আছে। দরজার বাইরে হাত তিনেক চওড়া একটা গলি। নাসিমা ওই পথেই পালিয়েছে। বিট্টু পাহলোয়ানের দৃঢ় বিশ্বাস, নাসিমা চাঁদ মিয়ার সঙ্গেই পালিয়ে গেছে।…
কর্নেলের মুখে সব কথা শোনার পর বললুম, বড় গোলমেলে ব্যাপার। তো হালদারমশাইয়ের পাঞ্জাবি ছিঁড়ল কী করে?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ গোমড়ামুখে বললেন, জানি না। লক্ষ্য করি নাই। হয়তো ওই হালাই ছিঁড়ছে।
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, আশা করি হালদারমশাইয়ের রাগ এতক্ষণে পড়ে গেছে। বিট্টু পাহলোয়ানকে আপাতত ক্ষমা করে দিন। পরে সুযোগ পেলে ওকে নিজের হাতে শায়েস্তা করবেন।
হালদারমশাই বললেন, আই প্রমিজ!
ঠিক আছে। এবার পোশাক বদলে বাড়ি ফিরে বিশ্রাম নিন। আপনাকে আমার একপ্রস্থ পোশাক দিচ্ছি।
না কর্নেল স্যার! শুধু একখানা পাঞ্জাবি থাকলে দিন। ওই যথেষ্ট।
কর্নেল উঠে গিয়ে পাশের ঘর থেকে একটা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি এনে। দিলেন। তারপর বললেন, বাথরুমে গিয়ে এটা পরে নিন। ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা আপনাকে যত্ন করে রাখতে হবে। ওটা আদালতে একজিবিট হবে। বিট্টু পাহলোয়ানের বিরুদ্ধে পুলিশ কেস দিয়েছে। ভুলে যাবেন না। আপনাকে খুনের চেষ্টা নিয়ে মামালাটা খুব গুরুত্বপূর্ণই হবে। ছেঁড়া পাঞ্জাবিটা কাগজে মুড়ে নিয়ে যান। পুলিশ আপনার কাছ থেকে কাল ওটা নিয়ে আসবে।
হালদারমশাই বাথরুম থেকে পাঞ্জাবি বদলে এসে কর্নেলের কথামতো ছেঁড়া রক্তাক্ত পাঞ্জাবিটা কাগজে মুড়ে বগলদাবা করলেন। বললেন, তা হলে যাই গিয়া।
কর্নেল বললেন, ডিটেকটিভ সাব-ইন্সপেক্টর নরেশ ভদ্র সকাল নটা নাগাদ আপনার বাড়িতে যাবেন। আর একটা কথা। আপনি ওঁকে যেন বলে ফেলবেন না যে আমরা সেহরাগড় যাচ্ছি। শুধু আপনি যা জানেন, সেই অংশটা ডিটেলস বলবেন।
প্রাইভেট ডিটেকটিভ পা বাড়িয়ে হঠাৎ ঘুরে বলবেন, আচ্ছা কর্নেলস্যার! ওই মহিলা যদি আবার আমার অফিসে ফোন করে?
তাকে নির্ভয়ে আপনার অফিসে যেতে বললেন। যদি সে যায়, সব কথা শুনে নোট করবেন। তারপর তাকে কোনো ছলে বসিয়ে রেখে আমাকে রিং করবেন।
তার জন্য আমার ব্রাতে আইজ যা ঘটছে, তারে বলব না?
কক্ষনো না। শুধু বলবেন, লোকটা আপনাকে দাঁড় করিয়ে রেখে আর আসেনি। ব্যস!
হালদারমশাই বেরিয়ে গেলেন।
আমি বললুম, রহস্য এত শিগগির জটিল হয়ে যাবে কল্পনাও করিনি।
কর্নেল টেলিফোনের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, যত জটিল হোক, এর চাবি আছে নাসিমা নামে একটি মধ্যবয়সী মেয়ের কাছে। তার পরিচয় পেলে আমার পা ফেলতে সুবিধে হবে। কারণ মির্জাসাহেব আমাকে শুধু আভাস দিয়েছেন, তাকে কেন্দ্র করে কিছু রহস্যময় ব্যাপার ঘটছে। কিন্তু সেগুলো যে কী, তা তিনি খুলে বলেননি। ওঁর বাড়ি গেলে নাকি আমি নিজেই টের পায়। এদিকে এই নাসিমা সেহরাগড় জঙ্গলের কালো নেকড়ের রহস্যটা ফাস করতে চায়। কিন্তু তার পক্ষে সেটা সম্ভব নয় বলেই প্রাইভেট ডিটেকটিভের সাহায্য দরকার। অথচ সে অমন করে হঠাৎ পালিয়ে গেল খুশবুমহল থেকে। এটাই ভারি অদ্ভুত!
বার বার ডায়াল করে কিছুক্ষণ পরে সাড়া পেলেন কর্নেল। বললেন, আমি কর্নেল সরকার বলছি!…না, না! ডিসি ডিডি সায়েবকে নয়! আপনি এস. আই নরেশবাবুকে দিন।….নরেশবাবু! শুনুন। আপনি তো কাল সকালে মিঃ হালদারের বাড়ি যাবেন। যাবার পথে আমার এখানে হয়ে যেতে অসুবিধে হবে?… ঠিক, আছে। একটা জরুরি কথা বলতে চাই আপনাকে।…বলেন কী! বিট্টু পাহলোয়ান। তা-ই বলেছে? …ও কে। রাখছি। মর্নিংয়ে কফি খেতে খেতে কথা হবে। ছাড়ছি।
টেলিফোন রেখে কর্নেল একটু হেসে বললেন, বিট্টু পাহলোয়ান বলেছে, তার বাড়ি ছিল বিহারের সেহরাগড়ে। তার বাবা হোসেন আলি ছিল বড় নবাব সাহেবের সহিস। বিচিত্র যোগাযোগ!
অবাক হয়ে বললুম, নাসিমার বাড়িও যে সেহরাগড়, তা নিশ্চিত। তাই না?
কর্নেল চোখ বুজলেন, হুঁ।
অথচ বিট্টু ব্যাটাচ্ছেলে তাকে চেনে না এ কি বিশ্বাসযোগ্য?
তুমি ঠিক বলেছ জয়ন্ত।
বিট্টু তার চেনাজানা বলেই হালদারমশাইকে সে ডাকতে পাঠিয়েছিল। নিজে। কোনো কারণ যেতে পারেনি।
ঠিক, ঠিক।
কর্নেল চোখ বুজে সায় দিচ্ছিলেন। হঠাৎ চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন এবং শার্টের বুকপকেট থেকে একটা চিরকুট বের করে দেখে নিয়ে আবার টেলিফোন ডায়াল করতে থাকলেন।
একটু করে টেলিফোন রেখে দিয়ে বললেন, রিং হয়ে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। এই নিয়ে তিনবার চেষ্টা করলুম। নাম্বারটা পুলিশ ঠিক দিয়েছে তো?
জিজ্ঞেস করলুম, কার নাম্বার?
খুশবুমহলের মালিক সুরেশ সিংহের। বলে কর্নেল টেলিফোন গাইডের দিকে হাত বাড়ালেন।
বললুম, সুরেশ সিংহের বাড়ির ঠিকানা পেয়েছেন কি?
হ্যাঁ।
কিন্তু টেলিফোন গাইডের খুদে হরফ পড়তে পারবেন না। আমাকে দিন।
কর্নেল হাসলেন। এ বয়সে আমার সত্যি অত দৃষ্টিশক্তি নেই। তবে তুমি আমার শক্তিমান আতস কাঁচটির কথা ভুলে গেছ।
আতস কাচের সাহায্যে সুরেশ সিংহকে টেলেফোন গাইডের পাতা থেকে খুঁজে বের করতে দেরি হলো না কর্নেলের। বললেন, হ্যাঁ। ফোন নাম্বার আর ক্যামাক স্ট্রিটের ঠিকানা ঠিক আছে। তবে আর ফোনে নয়। বরং কাল দিনের বেলায় সুরেশ সিংহের বাড়ি যাব। রাতবিরেতে এ সব লোকের মেজাজ ঠিক থাকে না।
বলে কর্নেল হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী! আবার কফি খাব। আর তোর দাদাবাবুর জন্য কিছু স্ন্যাক্স নিয়ে আয়।….
পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছি, সেই সময় কর্নেলের টেলিফোন এল। জয়ন্ত! এইমাত্র সেহরাগড় থেকে মির্জাসাহেবের ট্রাঙ্ককল পেলুম। ওঁর ওলড সারভ্যান্ট কাদের বখশের লাশ পাওয়া গেছে। ক্ষতবিক্ষত লাশ। সরকারি ডাক্তারের মতে, আপাতদৃষ্টে কোনো হিংস্র জন্তুর আক্রমণে মৃত্যু হয়েছে লোকটার। যাই হোক, আমরা আজই দুটো পঁয়ত্রিশের ট্রেনে ভায়া আসানসোল সেহরাগড় যাচ্ছি। ট্যাক্সি করে চলে এস। একটা কথা। তোমার লাইসেন্স ফায়ার আর্মস সঙ্গে রেখো।
উত্তেজিতভাবে বললুম, হালদারমশাই যাচ্ছেন তো?
ওঁর যাওয়ার ব্যাপারটা একটু ভেবে দেখছি।
হঠাৎ মত বদলালেন কেন?
সেই মেয়েটি যদি আবার ওঁর অফিসে যোগাযোগ করে? এ কারণে আমার মনে হচ্ছে ওঁর কলকাতায় থাকা দরকার। প্রয়োজন হলে বরং উনি পরে যাবেন। ছাড়ছি।
এক মিনিট! কাদের বখশের লাশ কোথায় পাওয়া গেছে?
নবাববদের পারিবারিক কবরখানায়।
টেলিফোন রেখে ব্রেকফাস্টে মন দিলুম। কিন্তু খাওয়া জমল না। বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল একটা ভয়ঙ্কর হিংস্র কালো রঙের নেকড়ে আর তার লকলকে রক্তাক্ত জিভ।….
.
০৩.
সেহরাগড় রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে যখন পা দিলুম, তখন রাত প্রায় দশটা বাজে। মাঝারি ধরনের স্টেশন। কিন্তু প্লাটফর্ম জনশূন্য বললেই চলে। কয়েকজন যাত্রী নেমেছিল। তারা দ্রুত যেন মিলিয়ে গেল কাথায়। পরে বুঝলুম, ট্যাক্সি বা অটোরিকশায় চেপে তারা চলে গেছে। স্টেশনের নিচের চত্বরে ছোট বাজার। সব দোকানপাটই বন্ধ। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন স্বয়ং ছোটনবাব মির্জা হায়দার আলি বেগ। তার পিঠে বন্দুক দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলুম। তিনি নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। গম্ভীরমুখে প্রথমে কর্নেল, তারপর আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, আসুন।
হালদারমশাই কর্নেলের পরামর্শ মতো আমাদের সঙ্গে আসেননি। তিনি ট্রাঙ্ককল করে কর্নেলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন। মির্জা সাহেবে নেমকার্ড তাঁকে দিয়ে এসেছেন কর্নেল।
গাড়িটা অ্যাম্বাসাডার। কর্নেল মির্জা সাহেবের পাশে বসলেন। আমি বসলুম পেছনে। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মির্জা সাহেব বললেন, গাড়ি আমি কদাচিৎ ব্যবহার করি। ঘোড়াই আমার পছন্দ। তবে এই গাড়িটা পুরনো মডেলের আর মজবুত। কিছু পার্ট বদলে গাড়িটাকে পাহাড়ি এলাকায় চলার উপযুক্ত করে নিয়েছি।
কর্নেল বললেন, রাস্তাঘাট একেবারে খাঁ-খাঁ করছে দেখছি। সম্ভবত কালো নেকড়ের ভয়ে।
মির্জা সাহেব বললেন, হ্যাঁ। তবে এদিকটায় ভয়ের কারণ নেই। সেহরা নদীর ব্রিজ পর্যন্ত ঘনবসতি এলাকা। বনজঙ্গল সবই ওপারে। এই মোড় পেরিয়ে হাইওয়ে দিয়ে আপনি রিজার্ভ ফরেস্টে গিয়েছিলেন।
হ্যাঁ। চিনতে পেরেছি।
নদীর ব্রিজ পেরিয়ে হাইওয়ে ডাইনে চলে গেল। এবার আমরা সংকীর্ণ একটা পাহাড়ি রাস্তায় পৌঁছলাম। রাস্তাটার দুধারে গাছ, ঝোপঝাড় আর প্রকাণ্ড সব পাথর হেডলাইটের আলোয় ঝলসে যাচ্ছিল। মির্জা সাহেব বললেন, আমাদের কেল্লাবাড়িটা একটা টিলার মাথা কেটে তৈরি করা হয়েছিল। কাছাকাছি স্থানীয় এবং বাইরের কিছু বড়লোকের রেস্টহাউস আছে।
কালামহল তো নদীর ধারেই?
হ্যাঁ। নদী ওখানে বাঁক নিয়েছে। কালামহল কোন যুগে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমার ঠাকুর্দার আমলে তৈরি বাড়িটাও ভেঙেচুরে গেছে। পাঁচ একর জায়গার মাঝামাঝি জেলখানার মতো উঁচু পাঁচিল তুলে আমার চাচা একদিকে আর আমার মা একদিকে থাকতেন। চাচার বাড়িটা বিশাল। আমাদেরটা ছোট এবং দোতলা। মায়ের মৃত্যুর পর আমেরিকা থেকে ফিরে আমি সেই বাড়িটা ওয়েস্টার্ন মডেলে নতুন করে তৈরি করেছিলুম। ওপরে টালির চাল। জিওমেট্রিক প্যাটার্ন।
আমার আবাক লাগছিল, ওঁরা কাদের বখশের মৃত্যু সম্পর্কে কোনো কথাই বলছেন না। আবার চড়াইয়ের পর উত্রাইয়ে নেমে গাড়ি বাঁদিকে ঘুরল। তখন একটা অর্ধবৃত্তাকার কালো পাঁচিল এবং গেট দেখতে পেলুম। গেটের মাথায় এবং ভেতর দিকে আলো জ্বলছে। এতক্ষণ ভুতুড়ে ধরনের জ্যোৎস্নার পর আলো দেখে ভালো লাগল।
গেটের কাছে দুজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের দুজরেনই হাতে লম্বা টর্চ। একজনের পিঠে বন্দুক। অন্যজনের হাতে বল্লম। তারা গেট খুলে দিয়ে একটু ঝুঁকে কপালে হাত ঠেকাল। মির্জা সাহেব বললেন, খুদা বখশ! কুমারসাব কুছ খবর ভেজা?
শক্তসমর্থ গড়নের বন্দুকধারী লোকটি বলল, জি নেহি! লেকিন ডাগরদারসাব টেলিফোন কিয়া। রহিমসাবকো টেলিফোনমে কুছ বোলা, মালুম হ্যায়! রহিমসাব তুরন্ত মোটরবাইক লেকে চলা গেয়া। আভি লোটা নেহি।
ঠিক হ্যায়। রহমত! তুম যাও। খুদা বখশ! তুম ডিউটি করো।
ভেতরে একটা ঝোপঝাড়ে ভরা ধ্বংসাবশেষের পাশে সারবন্দি একতলা কয়েকটা ঘর। কানে এল, কোনো মেয়ে চাপা গলায় সুর ধরে কাঁদছে। মনে হলো ইতিহাসের অভ্যন্তর থেকে শোকাচ্ছন্ন কোনো আত্মার দীর্ণ বিলাপ।
ধ্বংসাবশেষের ডানদিক দিয়ে মুড়িবিছানো রাস্তায় খড় খড় শব্দ করতে করতে গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিল। মির্জাসাহেব বললেন, এটা একসময় মসজিদ ছিল। এখন জঙ্গল গজিয়ে গেছে।
এবার ফুলবাগান, কেয়ারি করা পায়ে চলা রাস্তা এবং খোলামেলা জায়গা পেরিয়ে বিলিতি কান্ট্রি হাউসের মতো একটা বাড়ির পোর্টিকোর তলায় গাড়ি থামল।
চাওড়া বারান্দায় এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি আমাদের অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে একটু ঝুঁকে আদাব দিলেন। মির্জাসাহেব বললেন, শাকিল মিয়াঁ! আপ মেহমান লোগোঁকো দেখিয়ে। হাম আভি আতা হ্যায়।
কর্নেল বারান্দায় বেতের টেবিল-চেয়ার দেখিয়ে বললেন, শাকিল মিয়াঁ। হামলোগ ইহা পর আভি বইঠেগা। ইহা আচ্ছা জাগাহ্ হ্যায়।
শাকিল মিয়াঁ আবার কুর্নিশ করে বললেন, আপলোগোঁকা মর্জি! তো স্যার! আপলোগোঁনে কালকাত্তাসে আয়া। হামি থোড়া থোড়া বাংলা ভি জানি। হামি ছোটা নবাবসাবকা প্রাইভেট সেক্রেটারি আছি। কোনো অসুবিধা হোবে না।
ভদ্রলোক ভেতরে গিয়ে চাপা গলায় ডাকলেন, মুন্নিজান! মুন্নিজান!
বাড়িটার মাথায় উজ্জ্বল আলো। সেই আলোয় দেখলুম, ডানদিকের একটা গ্যারাজে মিজাসাহেব গাড়ি ঢোকাচ্ছেন। তার ওপাশে আর একটা গ্যারাজ। মৃদু আলোয় সেই ঘরে একটা প্রকাণ্ড চেহারার লাল রঙের ঘোড়া দেখা গেল। ওটা তাহলে ঘোড়াশালা। লোহার গরাদ ঘেরা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা।
মির্জা সাহেব গাড়ির গ্যারাজে তালা এঁটে আমাদের কাছে এলেন। পিঠের বন্দুকটা এতক্ষণে স্পষ্ট দেখতে পেলুম। ওটা একটা রাইফেল।
রাইফেলটা একটা চেয়ারের পাশে কাত করে রেখে তিনি বললেন, কর্নেল সরকার যে এখানেই বসবেন, আমি জানতুম। জ্যোৎস্নাও চমৎকার ছিল আজ। কিন্তু বাড়ির লোকেরা ভয় পেয়েছে। তাই আলো জ্বেলে রাখা হয়েছে।
শাকিল মিয়াঁ এবং তার সঙ্গে একজন সালোয়ার-কামিজ পরা কিশোরী ট্রে নিয়ে এল। টেবিলে ট্রে রেখে কুর্নিশ করে মেয়েটি চলে গেল। বুঝলুম, এর নামই মুন্নিজান।
শাকিল মিয়াঁ মৃদুস্বরে বললেন, কফি স্যার। থোড়াসা স্ন্যাক্স। আধাঘণ্টা বাদ ডিনারকি বন্দোবস্ত কিয়া যায়েগা।
মির্জাসাহেব একটু হেসে বললেন, আরে মিয়াঁ! আপ তো কলকাত্তামে থে। বাংলা বোলিয়ে!
জি হাঁ সাব! থোড়াসা জানতা। জরুর ম্যায় কোশিস করেঙ্গে।
ঠিক হ্যায়! ডিনারকি ইন্তেজাম কিজিয়ে।
প্রাইভেট সেক্রেটারি আবার কুর্নিশ করে চলে গেলেন। মির্জাসাহেব বললেন, কফি খেয়ে ক্লান্তি দূর করুন। তারপর গেস্টরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে নেবেন। পোশাক বদলে ফেলবেন।
কফিতে চুমুক দিয়ে কর্নেল এতক্ষণে বললেন, মর্গের রিপোর্টে কী বলা হয়েছে?
মির্জাসাহেব পোর্টিকোর দিকে তাকিয়ে বললেন, রহমত! তুম অন্দর যাও। মুন্নিবেটিকি সাথ হাত লাগাও।
লোকটার চেহারায় কেমন যেন হিংস্রতা আছে। সে বল্লমটা বারান্দার একপাশে শুইয়ে রেখে ভেতরে চলে গেল।
মির্জাসাহেব চাপা স্বরে বললেন, কাদের বখশ জানোয়ারের হামলায় মারা পড়েছে বলা হয়েছে। জানোয়ারটার দাঁতের দাগ আছে গলায়। যাই হোক, ডাক্তারবাবু টেলিফোন করেছিলেন শুনলুম। আমার দূরসম্পর্কের ভাগ্নে রহিম খান তার কাছে গেছে। ছেলেটা বড় ডানপিটে। এত রাতে না গেলেই চলত না?
কর্নেল বললেন, আপনাদের পারিবারিক কবরখানা কোথায়?
মির্জাসাহেব বললেন, কাছেই। ঘটনা হলো, কাদের বখশ রোজ সন্ধ্যায় কবরখানার লাগোয়া পীরের মাজারে সাঁঝবাতি জ্বেলে দিয়ে আসে। আমার ধর্মে মত নেই। সীরবুজুর্গ লোকেদের প্রতি ভক্তি নেই। শুনেছি, আমার পূর্বপুরুষেরা পীরভক্ত ছিলেন। ওই মাজার–মানে পীরের সমাধি ভবন নাকি পাঁচশো বছর আগে তৈরি হয়েছিল। তো আমি কলকাতা যাওয়ার পরদিন সন্ধ্যায়—গত পরশু রোজকার মতো কাদের বখশ সাঁঝবাতি জ্বালতে গিয়েছিল। অনেক রাতেও সে ফিরছে না দেখে তার জামাই রহমত–যাকে আপনারা দেখলেন, সে শ্বশুরের খোঁজে যায়। কিন্তু খুঁজে পায়নি। কাল সকালেও যখন কাদের বখশ বাড়ি ফিরল, তখন এ বাড়ির সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। সেই সময় একটি আদিবাসী মেয়ে এসে খবর দেয়, কবরখানায় একটা লাশ পড়ে আছে। মেয়েটি পাশের জঙ্গলে মহুয়া গাছে উঠে মহুয়া ফল পাড়ছিল। হঠাৎ লাশটা তার চোখে পড়ে।
কাদের বখশের লাশ কি মর্গ থেকে আনা হয়েছে?
মির্জাসাহেব শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ। আজ বিকেলে লাশ এলে ওই কবরখানায় কবর দেওয়া হয়েছে। কবরখানার একপাশে আমাদের পরিবারের কর্মচারীদের কবর দেওয়ার রীতি আছে। তবে তাদের কবর পাকা নয়। স্রেফ মাটির কবর।
কর্নেল এবার চুরুট ধরালেন। একটু পরে বললেন, বাই এনি চান্স আপনি নাসিমা নামে কোনো মহিলাকে চেনেন?
মির্জাসাহেব যেন একটু অবাক হলেন। নাসিমা? না তো! কে সে?
পরে বলব। আপনি চাঁদ মিয়া নামে কাউকে চেনেন?
চাঁদ মিয়া? মির্জাসাহেব মাথা নাড়লেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, বিট্টু পাহলোয়ান? ওরফে সেকেন্দার আলি?
মির্জাসাহেব ভুরু কুঁচকে তাকালেন। তারপর হেসে ফেললেন। ফরেস্ট কনজারভেটর মাধব পাণ্ডে আপনার সম্পর্কে যা সব বলেছিলেন, কাঁটায়-কাঁটায় মিলে যাচ্ছে দেখছি! তবে আশা করি, যাদের কথা বললেন, তারা আমার বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত নয়? নাকি তারাই
কর্নেল দ্রুত বললেন, এখনও জানি না। তো আর একজনের কথা জিজ্ঞেস করি। হোসেন আলি নামটা কি আপনার চেনা মনে হচ্ছে?
হোসেন আলি–মির্জাসাহেব একটু ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ। এ নামটা যেন শুনেছি।
হোসেন আলি আপনার চাচা মির্জা আব্বাস আলি বেগের ঘোড়ার সহিস ছিল।
মির্জাসাহেব নড়ে বসলেন। হ্যাঁ। মনে পড়েছে। আমার চাচা শত্রুতা করলেও এই লোকটা মায়ের অনুগত ছিল। এমন কি কলকাতায় গিয়ে গোপনে আমার চাচার ক্রিয়াকলাপের খবর দিয়ে আসত।
বিট্টু পাহলোয়ান তারই ছেলে যার আসল নাম সেকেন্দার আলি।
ঘরের দরজায় শাকিল মিয়াঁকে দেখতে পেয়ে মির্জাসাহেব বললেন, ওসব কথা পরে হবে। আপনারা শাকিল মিয়াঁর সঙ্গে গেস্টরুমে যান। প্রায় এগারোটা বাজতে চলল।
মির্জাসাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারি আমাদের বারান্দা দিয়ে নিয়ে গেলেন। পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একতলায় একটা বড় ঘর। সুন্দর বিলিতি কেতায় সাজানো। দুধারে দুটো খাট। সোফা, ডিভান, কয়েকটা চেয়ার আর একটা টেবিলও আছে। শাকিল মিয়াঁ আমাদের ডিনারের জন্য তৈরি হতে বলে চলে গেলেন।
পেছনে দক্ষিণ দিকের দরজা খুলে কর্নেল বললেন, এদিকেও ফুলবাগান আছে। তবে ওই উঁচু পাঁচিলটা সব সৌন্দর্য নষ্ট করেছে। তা ছাড়া এত উজ্জ্বল আলো! চাঁদটাকে কোতল করেছে যেন।
উঁকি মেরে দেখে বললুম, নেকড়েটা অত উঁচু পাঁচিল ডিঙোতে পারবে না।
কর্নেল দরজা বন্ধ করে বাথরুমে ঢুকলেন …
নবীন ঐতিহ্যের সঙ্গে বিলিতি রীতিমেশানো ডিনার খেয়ে আমার ভয় করছিল, পেটে গণ্ডগোল বাধবে না তো? খাবার ঘর দোতলায়। সিঁড়িতে নামবার সময় বলেছিলুম, মির্জাসাহেব! সঙ্গে হজমি ট্যাবলেট আনিনি কিন্তু!
মির্জাসাহেব শুধু হেসেছিলেন। তার প্রাইভেট সেক্রেটারি শাকিল মিয়াঁ বলেছিলেন, কুছ হবে না স্যার। মাত্ ঘাবড়াইয়ে। ওহি যো শরবত পিয়েছেন, উয়ো হজমি আরক আছে।
মির্জাসাহেব গেস্টরুমে এসে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন। শাকিল মিয়াঁ পরামর্শ দিয়েছিলেন, অ্যাটাচড় বাথরুম আছে স্যার! জেরা হোশিয়ারিসে রহৃনা পড়ে। কভি বাহার মাত্ যাইয়ে। দরকার হেনেসে উয়ো কলিং বেলকি সুইচ হ্যায়।
বরাবর আমার অভ্যাস, অচেনা জায়গায় প্রথম রাত্রিটা ভালো ঘুম হয় না এবং ঘুম খুব দেরিতে আসে। আবহাওয়া ঠাণ্ডা। তাই ফ্যান আস্তে ঘুরছিল। মশারির ভেতর শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলুম। কর্নেলের যথারীতি নাকডাকা শুরু হয়েছিল।
তারপর কখন সবে ঘুমের টান এসেছে, হঠাৎ বাইরে দুরে কোথাও একটা অদ্ভুত জান্তব চিৎকার কানে এল। কতকটা এইরকম : অ-উ-উ-উ-উ! অ-উ উ-উ-উ! অ-উ-উ-উ-উ!
ঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। ও কিসের চিৎকার? চিৎকার না অর্তনাদ? সারা শরীর অজ্ঞান আশঙ্কায় শিউরে উঠল। ডাকলুম, কর্নেল! কর্নেল!
কর্নেলের নাকডাকা থেমে গেল।
বললুম, একটা সাংঘাতিক চিৎকার শুনলুম।
হু। বলেই কর্নেল ঘুমে তলিয়ে গেলেন। নাকডাকা শুরু হলো আবার।
অদ্ভুত মানুষ। কিন্তু ওঁকে জাগাতে হলে আবার একটা হুঁ শুনব। বরাবর দেখে আসছি, ওঁর এই অদ্ভুত অভ্যাস। আমার ঘুমটা পণ্ড হলো। কান খাড়া করে থাকলুম। বাইরে জোরে বাতাস বইছে। গাছপালার পাতায় সর সর শো শোঁ শব্দ। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ মনে হলো, আমি কি সেই কালো নেকড়ের চিৎকার শুনলুম? কিন্তু চিৎকারটা যেন আর্তনাদের মতো।
তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। ঘুম ভাঙল কারও ডাকে–স্যার! স্যার! চায় লায়া।
মশারি থেকে বেরিয়ে দেখি, রহমত বেড-টি এনেছে। সে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে যত্ন করে মশারি গুটিয়ে দিল। কর্নেলের মশারি কখন গুটানো হয়েছে। তার বিছানা খালি। জানালা দিয়ে বসন্তকালের ঝলমলে রোজ দেখা যাচ্ছে।
রহমত বলল, কর্নিলসাব ছোটে নবাবসাবকা সাথ বাহার ঘুমনে গেয়া।
ঠিক আছে। বলে বিছানায় বসে অভ্যাসমতো বাসিমুখে চায়ে চুমুক দিলুম। রহমত সেলাম ঠুকে চলে গেল। কাল রাতে এই লোকটাকে কেন যেন হিংস্র দেখাচ্ছিল। আজ সকালে তার মুখে বেশ নরম আর ভদ্র ভাব।
পরে মনে হলো গোঁফ আর গালপাট্টার জন্য ওর চেহারায় আমি হিংস্রতা আরোপ করেছিলুম। এ বাড়িতে গত রাতে যে তিনজনকে দেখেছি, তাদের মধ্যে শুধু শাকিল মিয়াঁর মুখেই দাড়ি আছে। তবে দাড়িটা ফ্রেঞ্চকাট। লোকটাকেও শিক্ষিত মনে হচ্ছিল।
হ্যাঁ। শিক্ষিত না হলে সে মির্জাসাহেবের প্রাইভেটে সেক্রেটারি হবে কেমন করে?
চা খেয়ে বাথরুম সেরে ধোপদুরস্ত পোশাক পরে বারান্দায় সেই বেতের চেয়ারে বসলুম। দিনের আলোয় বাড়িটাকে বেশ সাজানো-গোছানো মনে হলো। বাঁদিকে পশ্চিমে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। ডানদিকে গ্যারেজের ওপাশে টেনিস লন। উত্তরে টানা কালো পাথরের পাঁচিলে আগাছা গজিয়ে আছে। উত্তর-পূর্ব কোণে কালো পাথরের বিশাল ধ্বংসপ চোখে পড়ল। ওটাই কি সেই কালামহল?
টেনিস লনটা দেখে মনে হলো, ওখানে মির্জাসাহেব আর তার মার্কিন স্ত্রী এমিলি একমসয় টেনিস খেলতেন। জায়গাটা এখন শূন্য দেখাচ্ছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ওদিকে উঠে যাবার জন্য দাঁড়িয়েছি, শাকিল মিয়াঁ এসে আদাব দিলেন। বললেন, রহমত আছে। চায়-কফি কুছুর দরকার হলে তাকে ডাকবেন স্যর! হামি এমন বাহার যাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলুম, ছোট নবাব সাহেবের ভাগ্নে রহিম খান ফিরেছেন?
শাকিল মিয়াঁ একটি হেসে বললেন, জি হাঁ। রাত এক বাজনেকা বাদ উনহি এলেন। মোটরবাইক বিগড়ে গিছলো। বহত ডেয়ারডেভিল ইয়ং ম্যান–উয়ো। লড়কা। ছোটেনবাবসাব বহত্ রাগ করলেন।
রহিমসাব কি উঠেছেন?
আভি সাড়ে আট বাজা। উনহি উঠবে, দশ-সাড়ে দশ বাজবে তখন। বলে শাকিল মিয়াঁ কণ্ঠস্বর চাপা করলেন। ছোটানবাবসাবের কৈ লড়কা-লড়কি না আছে? ইস লিয়ে রহিমবাবা আপনা খেয়ালসে কাম করে।
রহিমবাবা মানে?
সব উনহিকো খাতিরসে বাবা বোলতা। উর্দুমে বাবা বহত্ অনারেবল ওয়ার্ড স্যার।
শাকিল মিয়াঁ বারান্দার অন্যপ্রান্তে দাঁড় করানো একটা সাইকেল আর কেরিয়ারে ব্যাগ এঁটে চলে গেলেন। সম্ভবত বাজারে যাচ্ছেন।
একটু পরে দেখি, একটা চৌদ্দ-পনের বছরের ছেলে মসজিদের ধ্বংসস্তূপের ওদিক থেকে একটা লাল রঙের ঘোড়ার রাশ টানতে টানতে সামনের প্রাঙ্গণ দিয়ে ঘোড়াশালায় গেল। যাবার সময় সে আমাকে দেখতে দেখতেই গেল। সে ঘোড়াটা বেঁধে একটা জাবনায় তার খাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত হলো।
রহমত এসে আদাব নিয়ে জানতে চাইল আর চা বা কফি খাব কি না। আমি মাথা নাড়লে সে ঘোড়াশালের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ছেলেটিকে বলল, আ বে ডিব্ব! তু আস্তাবলমে কেয়া করতা? তু ঘোড়া হো যাবে, ঘোড়া বন যা! হাম তেরা সওয়ার হোগা।
ছেলেটি রাগ করে বলল, দিললাগি মাত্ করো রমহতভাই!
মির্জাসাহেবের বাড়ির চালচিত্র এমনি করে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। ভাবছিলুম, ওঁর আয়ের উৎস কী। এতগুলো লোক পুষছেন। তাদের মাইনেও দিতে হয়।
একটু পরে কর্নেল এবং মির্জাসাহেবকে দেখতে পেলুম। কর্নেলের পিঠে কিটব্যাগে প্রজাপতিধরা জালের স্টিক উঁচু হয়ে আছে। বুকের ওপর ঝুলছে বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা। মাথায় টুপি। আর মির্জাসাহেবের কাঁধে সেই রাইফেল।
কাছে এসে মির্জাসাহেব আমাকে মর্নিং সম্ভাষণ করে ভেতরে ঢুকে গেলেন। কর্নেল এসে চেয়ারে বসেই বললেন, কাল রাত্রে তুমি কী যেন বলছিলে?
বললুম, আপনি গ্রাহ্য করলেন না। একটা অদ্ভুত চিৎকার শুনছিলুম। জানোয়ারের ডাক কিংবা কারও আর্তনাদ!
কর্নেল একটু হেসে কিটব্যাগটা পাশে রাখলেন। তারপর আস্তে বললেন, কাদের বখশ কবরখানায় মারা পড়েনি। তাকে পীরের কবরের কাছে মেরে টানতে টানতে নবাবী কবরখানায় আনা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য জয়ন্ত! পীরের কবরের কাছে এক জায়গায় টাটকা গর্ত খোঁড়া হয়েছে। লাশটা পুঁতে ফেলার জন্য ওভাবে গর্ত খোঁড়ার মানে হয় না। তাছাড়া গর্ত খোঁড়া হয়েছে শাবল দিয়ে। ওখানে কি কিছু লুকানো ছিল? মির্জাসাহেবের ব্যাখ্যা আমার মনঃপূত হয়নি।…
.
০৪.
একটু পরেই মির্জাসাহেব এলেন। পরনে সাদা চু-পাঞ্জাবি। রহমত কফি স্ন্যাক্সের ট্রে নিয়ে এল। কফি খেতে খেতে মির্জাসাহেব বললেন, কাদের বখশের মতো ওজনদার মানুষের লাশ কোনো জানোয়ারের পক্ষে অত দূর বয়ে আনা সম্ভব নয়। আপনার এই পয়েন্টটা আমি মানতে পারছি না।
কর্নেল বললেন, ঝোপজঙ্গলের পাতায় রক্তের ছাপ আর মাটিতে বা ঘাসে ভারী কিছু টেনে আনার চিহ্ন তো স্পষ্ট। জানোয়ারটা কালো নেকড়ে হোক বা যা-ই হোক, শক্তিশালী। আপনি তো জানেন, একটা চিতাবাঘ মোষের মতো জন্তুকে টেনে গাছে তুলতে পারে।
মির্জাসাহেব একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু বাই দা দাই, পীরের মাজারে বছর দুই আগে একবার ওইরকম করে কেউ গর্ত খুঁড়েছিল। আপনাকে সে-কথা বলেছি। এলাকায় পুরনো গুজব আছে, ওখানে নাকি সোনার মোহরভরা কলসি পোঁতা আছে। কাজেই গর্ত খোঁড়া নিয়ে আমি মাথা ঘামাতে রাজি নই।
বলে মির্জাসাহেব হেসে উঠলেন। কর্নেল বললেন, গুপ্তধনের নেশা কোনো কোনো মানুষকে পাগল করে।
আমি বললুম, গতরাতে আমি একটা অদ্ভুত চিৎকার শুনেছি।
মির্জাসাহেব বললেন, হ্যাঁ। আমিও শুনেছি। কর্নেলকে বলেছি সে-কথা। আমার ধারণা, ওটা কোনো জন্তুর ডাক নয়। ইংরেজিতে নেকড়ের ডাককে হাউল বলা হয়। ডকুমেন্টারি ফিল্মে হাউল শুনেছি। জ্যোৎস্নারাতে নেকড়েরা নাকি ডাকে। কিন্তু আমার কানে ডাকটা মানুষের বলে মনে হয়েছে। কর্নেলকে বলেছি, এই এলাকায় কোথা থেকে একজন পাগলা এসে জুটেছে। সে রাতবিরেতে গান গেয়ে ঘুরে বেড়ায়। সম্ভবত তারই বদমাইশি। নেকড়ের উৎপাতের কথা শুনে পাগলাটা হয়তো তামাশা করেছে! রহমতকে বলব, তাকে। দেখতে পেলে যেভাবে হোক, আমার কাছে যেন নিয়ে আসে! রহমত! ইধার আও।
রহমত বারান্দায় একটা থামের ওধার থেকে বেরিয়ে এসে কুর্নিশ ঠুকে বলল, জি ছোটেনবাবসাব!
সেই পাগলটাকে যেভাবে হোক তার কাছে ধরে নিয়ে আসার হুকুম দিলেন মির্জাসাহেব। রহমত কথাটা শুনে কাঁচুমাচু মুখে বলল, লেকিন হুজুর, উনহি এক। বুজুর্গ আউলিয়া! হাম আপনা আঁখসে দেখা, উনহি ভুখ লাগনেসে পাত্থরকা টুকরা খা লেতা!
মির্জাসাহেব রেগে গেলেন। ছোড়ো! উজবুককা তারাহ্ বাত করতা তুম। তুম উসকা শাগরিদ বন্ গেয়া মালুম!
জি হুজুর–উনহি কিসিকো বাত নেহি সমঝতা!
ঠিক হ্যায়। হাম রহিমবাবাকো বোলেগা। তুম আপনা কাম করো। ব্রেকফাস্ট ভেজ দো ইহাপর। ইয়ে ট্রে উঠাকে লে যাও।
বেজারমুখে রহমত ট্রে গুছিয়ে নিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হলো।
মির্জাসাহেব বললেন, রহমতের চেয়ে ওর বল্লমটার লাহস বেশি।
বললুম, আচ্ছা মির্জাসাহেব! কালো নেকড়ে হোক বা যে জানোয়ারই হোক, কাদের বখশকে মেরে ফেলেছি। কিন্তু এক পাগলা একা রাতবিরেতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে জানোয়ারটা আক্রমণ করছে না কেন?
মির্জাসাহেব গম্ভীরমুখে বললেন, সেটাই বুঝতে পারছি না।
কর্নেল বললেন, আমি এগুলো রেখে পোশাক বদলে আসি।
বলে তিনি কিটব্যাগটা নিয়ে গেস্টরুমের দিকে চলে গেলেন। আমি বললুম, আচ্ছা মির্জাসাহেব! আপনার বাবুর্চির সঙ্গে তো আলাপ হলো না। তাকে ধন্যবাদ দিতুম। কী অপূর্ব রান্না!
মির্জাসাহেব একটু হেসে বললেন, তিনি পর্দানসিনা।
কে তিনি?
আমার দূরসম্পর্কের বোন। রহিমের মা দিলোয়ারা বেগম। রহিমের বাবা হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান। লখনউতে সরকারি অফিসার ছিলেন। এদিকে আমার স্ত্রী এমিলিও মারা গেল। এই সংসারের দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ ছিল না। তাই দিলোয়ারা আর ওঁর ছেলেকে নিয়ে এলুম। রহিম বি. এ. পর্যন্ত পড়েছে। ওকে আর পড়ানো গেল না। ডানপিটে ছেলে। স্পোর্টসের নেশা আছে।
কাল রহিম নাকি অনেক রাতে ফিরেছেন! পথে মোটরমাইক বিগড়ে গিয়েছিল। শাকিল মিয়াঁ বলছিলেন।
হ্যাঁ। ওকে বাগে আনা আমার পক্ষে কঠিন। দিদির পক্ষে তো সম্ভবই নয়। মির্জাসাহেব হাসতে হাসতে বললেন, কাল রাত্রে ডাক্তার জগদীশ রায়ের সঙ্গে দেখা করে রহিম গিয়েছিল স্পোর্টিং ক্লাবের একটা ফাংশনে। গান শুনছিল। বুঝুন!
রহমত আর তার মেয়ে মুন্নিজান ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখে গেল। ইতিমধ্যে কর্নেল এসে গেলেন। একটু পরে মুন্নিজান জলের জগ আর তিনটে গ্লাস আনল। মির্জাসাহেব তাকে বললেন, মুন্নি! তেরি আব্বা এক পাগলকো বুজুর্গ। আউলিয়া বানা দিয়া। জানতি হ্যায় তু?
রহমতকে কেটে পড়তে দেখলুম। মুন্নি ওড়নায় হাসি চাপা হিয়ে বলল, আব্বা উয়োরাজ এক কুত্তা দেকার ভাগা!
মির্জাসাহেব হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক হ্যায়! যা! আপনা কাম কর!
মুন্নিজান নাচের ভঙ্গিতে চলে গেল। কর্নেল বললেন, কুকুরকে আমি ভয় পাই। ভাগ্যিস আপনার বাড়িতে কুকুর নেই!
মির্জাসাহেব বললেন, একটা ল্যাব্রাডার রিট্রিভার ছিল। সেটা এমিলির। অসুখে ভুগে সেটা মারা যায়। তারপর একটা অ্যালসেশিয়ান এনেছিলুম। কিন্তু দিদি–মানে রহিমের মা বড্ড ধর্মভীরু। মুসলিম বাড়িতে কুকুর থাকলে নাকি ফেরেশতা অর্থাৎ দেবদূতরা ঢোকেন না। তাছাড়া কুকুর নাকি ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ প্রাণী। কে জানে কী ব্যাপার! দিদির জন্য বাধ্য হয়ে কুকুরটা আমার বন্ধু নরেশ সিংকে উপহার দিলুম।
কর্নেল বললেন, কলকাতায় আমার চেনা একজন সুরেশ সিং আছেন। আপনার বন্ধুর সঙ্গে তার কি কোনো সম্পর্ক আছে? নামের মিল দেখেই বলছি।
মির্জাসাহেব হাসতে গিয়ে হাসলেন না। হঠাৎ একটু চমকে উঠলেন যেন। বললেন, নরেশের এক ভাই ছিল মনে পড়েছে। হা সুরেশ। মনে পড়েছে। নরেশের কাছে শুনেছিলুম, সে নাকি হংকংয়ে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। দাদার সঙ্গে বনিবনা ছিল না তার। জানি না আপনি কোন সুরেশের কথা বলছেন!
হ্যাঁ। আমার জানা সুরেশ সিং একসময় হংকংয়ে ছিল। এখন কলকাতায় থাকে।
তাহলে নরেশকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
ছেড়ে দিন। এটা তেমন কোনো ইমপর্ট্যান্ট ব্যাপার নয়।
ব্রেকফাস্টের পর পাইপ ধরিয়ে মির্জাসাহেব বললেন, রহিমবাবার ওঠার সময় হয়েছে। শোনা যাক বাবাকে ডাক্তার রায় কী কথা বলেছেন। আপনারা বিশ্রাম করবেন, নাকি বেরোবেন?
কর্নেল বললেন, জয়ন্তকে একবার এরিয়াটা দেখিয়ে নিয়ে আসব।
গাড়িটা নিতে পারেন। খুদা বখশ ড্রাইভিং করবে।
থাক। আমরা পায়ে হেঁটে ঘুরব। পীরের সমাধির ওদিকে কয়েক রকমের অর্কিড দেখে এলুম।…
কর্নেলের সঙ্গে যখন বেরোলুম, তখন আমার প্যান্টের পকেটে লাইসেন্স করা পয়েন্টে ২২ ক্যালিবারের রিভলবার। কর্নেলের নির্দেশে অস্ত্রটা সঙ্গে নিতে হয়েছিল। কিন্তু এই সতর্কতা কেন, তা বুঝতে পারছিলুম না।
দক্ষিণে সংকীর্ণ-এবড়ো-খেবড়ো পিচ-রাস্তায় কিছুটা এগিয়ে বড়নবাবদের বাড়ির গেট চোখে পড়ল। এদিকটায় বনেদি ঐশ্বর্যের ছাপ আছে। পুরনো আমলের কালো পাথরের পাঁচিল মেরামত করা হয়েছে কালো পাথর দিয়েই এবং গেটটাও পরিচ্ছন্ন। যথারীতি বন্দুকধারী দারোয়ানও আছে। তার পরনে খাকি উর্দি। ভেতরে বিস্তৃত সবুজ ঘাসে ঢাকা, লন আর ফুলবাগিচার মধ্যে দোতলা বিশাল একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। আমরা ওই গেটের সামনে দিয়ে কিছুটা এগিয়েছি, গেটের দিক থেকে একটা জিপগাড়ি বেরিয়ে এল। গাড়িটা চলে যাওয়ার জন্য রাস্তা দিতে আমরা একপাশে সরে দাঁড়ালুম। কিন্তু জিপগাড়িটা এসে আমাদের কাছে থেমে গেল। গাড়ির ডানদিকে একজন রুক্ষ চেহারার লোক বন্দুক হাতে বসে ছিল। গাড়ির চালক বাঁদিকে এবং তার চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ আছে। পরনে বুশশার্ট আর ছাইরঙা প্যান্ট। তিনি ইংরেজিতে কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারাই কি ছোট মির্জাসাহেবের অতিথি?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ। আমার ধারণা, আপনি তার চাচার ছেলে মির্জা সালিম বেগ?
ভদ্রলোক বললেন, আপনার ধারণা ঠিক। যাই হোক, আপনারা একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন।
আপনি কি কালো নেকড়ের ব্যাপারে আমাদের সাধন করে দিচ্ছেন?
সালিম বেগ গম্ভীর মুখে বললেন, ও ছাড়া আপনাদের সাবধান করার কী কারণ থাকতে পারে? হায়দারভাইও সম্ভবত আপনাদের সাবধান করে দিয়েছেন?
নাহ, উনি এখনও কালো নেকড়ে সম্বন্ধে নিশ্চিত নন।
তাই বুঝি? সালিম বেগ আস্তে বললেন, হায়দারভাইয়ের সঙ্গে আমার বা আমার সঙ্গে ওঁর কথা বলা বন্ধ। তবু যেহেতু আপনারা আমাদের নবাবি খানদানের অতিথি, তাই আমার কর্তব্য আপনাদের সাবধান করা। আচ্ছা, চলি।
আপনি কি আপনার ফার্মহাউসে চললেন?
হ্যাঁ। আপনারা যেতে চাইলে সঙ্গে আসতে পারেন। তবে হায়দারভাই মেজাজি লোক। জানতে পারলে রাগ করবেন।
বরং আমাদের হোেস্টকে বলে আগামীকাল যদি যাই?
আপনাদের হোস্ট নিষেধ করবেন।
যদি না করেন?
সালিম বেগ হাসলেন। তা হলে যাবেন। আমি ওখানে সবসময়ই থাকি। নেহাত দরকারে বাড়ি এসেছিলুম। আচ্ছা, চলি।
এক মিনিট। আপনি কি আমাদের পরিচয় জেনেছেন?
জেনেছি। দুই বাড়ির কর্তাদের মধ্যে যত বিবাদ থাক, ভৃত্যদের মধ্যে কোনো বিবাদ নেই। কাজেই আমাদের বাড়ির কথাও হায়দারভাইয়ের বাড়িতে সহজে পৌঁছে যায়। সালিম বেগ হঠাৎ চাপা গলায় বললেন, হায়দারভাই কলকাতা যাওয়ার পরই আমার কানে এসেছিল, উনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ আনতে যাচ্ছেন।
কর্নেলের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। পকেট থেকে একটা নেমকার্ড বের করে বললেন, কেউ আমাকে ডিটেকটিভ বললে আমি অপমানিত বোধ করি। এই নিন আমার নেমকার্ড। বছর তিনেক আগে রিজার্ভ ফরেস্টের বাংলোতে মির্জা হায়দারের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তাছাড়া আমরা দুজনেই প্রকৃতি পরিবেশ সংক্রান্ত আন্দোলনে যুক্ত আছি। আর–জয়ন্ত! তোমার নেমকার্ড দাও এঁকে!
দুটো নেমকার্ডে চোখ বুলিয়ে সালিম বেগ হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক আছে। কাল সকালে যদি আমার ফার্মহাউসে যান, আমি আপনাকে হায়দারভাইয়ের কোথায় ভুল হয়েছে, সেটা বুঝিয়ে বলব। আচ্ছা, চলি।
জিপটা চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, লোকটা ধড়িবাজ। মেজাজ নষ্ট করে দিয়ে গেল!
বললুম, কর্নেল! এখনও কিন্তু আমি জানি না, মির্জা হায়দার আলি বেগ কেন আপনার সাহায্য চাইতে গিয়েছিলেন। আপনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। অথচ এখন মনে হচ্ছে, এই সালিমসাহেব ঠিক জানেন–
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, এখন ও কথা থাক।
বাঁদিকে শালবন, ডানদিকে উঁচু মাটির ওপর মাঝে মাঝে একটা করে সুন্দর বাংলা ধাঁচের বাড়ি। কিছুদূর চলার পর দুধারেই শালবন চোখে পড়ল। কর্নেল বললেন, শালবনের ভেতরে দিয়ে শর্টকার্ট করা যেত। কিন্তু বড্ড বেশি পাতা পড়ে আছে। নিঃশব্দে পা ফেলা যাবে না।
জিজ্ঞেস করলুম, আমরা যাচ্ছি কোথায়?
পীরের সমাধিতে।
আর কোনো প্রশ্ন করলুম না। শালবনের পর বাঁদিকে পাথরে বাঁধানো একফালি রাস্তা। বোঝা যাচ্ছিল রাস্তাটা খুবই পুরনো আমলে তৈরি। সেই রাস্তার দুধারে ঝোপঝাড়, বড় বড় পাথর আর উঁচু-নিচু কঁকড়া গাছ। বসন্তকালে। সবুজ চিকন পাতা আর ফুলে-ফুলে উজ্জ্বল হয়ে আছে। একটু পরে মুখ থুবড়ে পড়া পাথরের ফটক এবং একটা বিশাল বটগাছ দেখা গেল। কর্নেল বললেন, বটগাছের নিচে যে উঁচু পাথরের চত্বর দেখতে পাচ্ছ, ওটাই পীরের সমাধি।
আমার সমাধির কাছে যেতেই চোখে পড়ল, একটা আধোলঙ্গ লোক ঝুঁকে বসে কিছু করছিল। তার মাথায় লম্বা বিশৃংখল চুল, মুখে তেমনি এলোমেলো গোঁফদাড়ি। সে ঘুরে আমাদের জ্বলজ্বলে চোখে দেখতে থাকল। এতক্ষণে দেখলুম, তার হাতে একটা শাবল।
কর্নেল সকৌতুকে বললেন, পাগলাবাবা! খাজানা (গুপ্তধন) জরুর মিল যায়েগা।
অমনি সে শাবলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর একলাফে ওদিকের ঝোপঝাড়ের ভেতর ঢুকে উধাও হয়ে গেল।
কর্নেল বাইনোকুলারে তাকে দেখতে দেখতে বললেন, সেয়ানা পাগল!
বললুম, মির্জাসাহেব বলছিলেন, গুপ্তধনের লোভে লোকে এখানে খুঁড়তে আসে। অথচ আপনার ধারণা নাকি অন্যরকম।
আমার ধারণা ঠিক কি না এবার যাচাই করার সুযোগ এসেছে। বলে কর্নেল এগিয়ে গেলেন। পাগল লোকটা যেখানে গর্ত খুঁড়ছিল, সেখানে গিয়ে তিনি পিঠে-আঁটা কিটব্যাগ থেকে একটা লোহার গোঁজ, আর হাতুড়ি বের করলেন। আমি জানি, ওঁর কিটব্যাগে এ ধরনের অজস্র জিনিস থাকে। বিশেষ করে পাহাড়ি জঙ্গলে যাবার সময় এই সব জিনিস তিনি নিয়ে যান। গোঁজে চাপা শব্দে হাতুড়ির আঘাত করতে করতে কর্নেল বললেন, তুমি চারদিকে একটু লক্ষ্য রাখা জয়ন্ত!
এখানে মাটিটা নরম। কিছুটা খোঁড়ার পর কর্নেল থেমে গেলেন। উঠে দাঁড়িয়ে নাকে রুমাল চাপা দিলেন।
বললুম, কী পোঁতা আছে ওখানে?
খানিকটা মাংস। হাড়সুদ্ধ মাংস। ম্যাট থিকথিক করছে।
ভীষণ অবাক হয়ে বললুম, কী আশ্চর্য!
মাংসটা পচাতে দেওয়া হয়েছে। থিকথিকে পোকায় ভরা পচা মাংস যে জন্তুটার খাদ্য, খাওয়ার সময় কোনো মানুষ এখানে এসে পড়লে সে তাকে আক্রমণ করবে। বলে কর্নেল সরে এলেন একটু তফাতে। আপনমনে ফের বললেন, তাহলে আজ কার পালা? যারই হোক, সে সম্ভবত দুপুরেই এখানে আসবে।
কর্নেল! আমি উত্তেজিতভাবে বললুম, ব্যাপারটা খুলে বলুন।
কর্নেল আবার স্বগতোক্তি করলেন। আমি হয়তো ভুল করছি! বলে তিনি ঝুঁকে এক টুকরো মাটি তুলে আঙুলের চাপে গুঁড়ো করে গুড়োগুলো ওপর থেকে নিচে ফেলতে থাকলেন। বললেন, বাতাসের গতি পশ্চিম থেকে পূর্বে। জয়ন্ত! তুমি পূর্বদিকটা লক্ষ্য করো। ফায়ার আর্মস বের করে তৈরি হও। কোনো জন্তুকে আসতে দেখলে গুলি করবে। গুলি করার সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখবে কিন্তু। কুইক! প্রতি সেকেন্ড সময় খুব মূল্যবান।
যন্ত্রের মতো তার নির্দেশ পালন করলুম এবং আড়চোখে দেখলুম, কর্নেল কিটব্যাগ থেকে একটা টেস্টটিউব বের করলেন। তারপর লোহার গোঁজের ডগা দিয়ে পোকা সরিয়ে এক টুকরো পচা মাংস টেস্টটিউবে ভরে ছিপি এঁটে দিলেন। বললেন, হঠাৎ আমার বুদ্ধিশুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল।
তারপর তিনি সেই গর্তটা ভালভাবে বুজিয়ে জুতোর চাপে সমতল করে দিলেন। একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত! জন্তুটার আর আসার চান্স নেই। তবে সত্যি সত্যি এলে আমাকেই সামলাতে হতো। কারণ লক্ষ্য করছিলুম, তোমার দৃষ্টি একাগ্র নয়।
আমি আপনার অদ্ভুত ক্রিয়াকলাপও দেখছিলুম। অবশ্য জন্তুটা এলে আমার চোখ এড়িয়ে যেত না। জন্তুটা নিশ্চয় কালো নেকড়ে?
কালো কি না জানি না। আর জন্তুটা নেকড়ে কি না তা-ও বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকুই বুঝতে পেরেছি, এই পচা মাংসের গন্ধ সে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে। এতে এমন কী আছে কে জানে!
কর্নেল বাইনোকুলারে ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া ঝোপ ও পাথরে ঢাকা পুবদিকটা কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে নিলেন। জিজ্ঞেস করলুম, সকালে যে গর্তটা দেখেছিলেন, সেটা কোথায়?
কর্নেল আঙুল তুলে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, ওটা পরীক্ষা করার পর বুজিয়ে দিয়েছিলুম। তলায় মাটিতে পচা মাংসের একটুখানি চিহ্ন ছিল। দুএকটা পোকাও ছিল। মির্জাসাহেবের সঙ্গে তা নিয়ে ইচ্ছে করেই আলোচনা করিনি। তাছাড়া তখনও আমার মাথায় এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু কে দুটো গর্তে মাংস পুঁতে রেখেছে?
জানতে পারলে তো সব রহস্যের সমাধান হয়ে যেত। বলে কর্নেল সমাধিচত্বরের চারদিকে ছায়াঢাকা মাটির ওপর তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকাতে তাকাতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলেন। মাটির ওপর কোথাও ঘন ঘাস-গুল্ম গজিয়ে আছে। কোথাও মাটি নগ্ন হয়ে আছে। দুটো গর্তই নগ্ন মাটিতে খোঁড়া হয়েছিল।
বললুম এখানে ওই পাগলাটাকে দিয়েই গর্ত খুঁড়ে মাংস পচাতে দিয়েছিল কেউ। তারই নির্দেশে পাগলটা দ্বিতীয় গর্তটা খুঁড়ে পচা মাংস বের করে রাখতে এসেছিল। আপনি বলেছিলেন, এবার কার পালা? আপনার মতে, এখানে কারও আসার কথা ছিল।
কর্নেল মাথা নেড়ে বললেন, নাহ। আমার থিয়োরি বদলে গেছে। ওই পাগল সম্ভবত আড়াল থেকে কাকেও এখানে গর্ত খুঁড়তে দেখেছিল। গর্তে কী পোঁতা হচ্ছে তা দেখার জন্যই সে একটা শাবল যোগাড় করে চুপি চুপি এখানে এসেছিল। সেয়ানা পাগল বলাটা অবশ্য ভুল হয়নি। কিন্তু
ওঁর কথার ওপর বললুম, কিসে বুঝলেন?
এখনও পর্যন্ত পীরের এই কবরের জায়গায় কোনো মানুষ এল না কেন? আমরা এখানে প্রায় আধঘণ্টা আছি। এতক্ষণে জন্তুটার শিকার এসে পড়া উচিত ছিল।
আমরা আছি বলে হয়তো সে আসছে না।
নাহ্। এই রাস্তাটা সোজা এবং ফঁকা। আমার একটা চোখ রাস্তার দিকে ছিল। কেউ এলে আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যেত না। বলে কর্নেল পা বাড়ালেন।
তাকে জিজ্ঞেস করলুম, ফায়ার আর্মস কি এখনও হাতে রাখব?
দরকার নেই। চলো, মির্জাসাহেবের বাড়িতে ফিরে যাই। একটা জরুরি কাজ সামনে এসে গেছে….
.
০৫.
মির্জাসাহেব বারান্দায় বসে পাইপ টানছিলেন। আমাদের দেখে বললেন, এরই মধ্যে বেড়ানো হয়ে গেল? আমি ভেবেছিলুম, জয়ন্তবাবুকে ফেলে কর্নেল সাহেব কোনো পাখির পেছনে উধাও হয়ে যাবেন। মার্চে সেহরাগড়ের সবখানে পাখির মেলা।
কর্নেল বললেন, পীরের সমাধিতে গিয়েছিলুম।
অর্কিডটা নিয়ে এলেন বুঝি?
নাহ, তবে যে জিনিস এনেছি, তা আরও দামী। বলছি। আগে—
কফি! বলে মির্জাসাহেব হেসে উঠলেন। তারপর হাঁক দিলেন, রহমত!
জি হুজুর!
কফি লাও। জলদি!
রহমত চলে গেল মির্জাসাহেব চাপা স্বরে বললেন, রহিমবাবাকে ডাক্তার জগদীশ রায় একটা ব্যক্তিগত রিপোর্ট দিয়েছেন। ওটা আমার দেখার জন্য। ব্যক্তিগত রিপোর্ট বলার কারণ ওটা বেসরকারি। পুলিশকে দিলে অকারণ ঝামেলা বাড়বে। আপনি পড়ে দেখুন।
দেখলুম, ওটা একটা সাধারণ কাগজে টাইপ করা চিঠি। কর্নেল চোখ : বুলিয়ে বললেন, কাদের বখশের রক্তে টক্সিক সাবস্ট্যান্স পাওয়া গেছে। এটা এমন সাংঘাতিক জিনিস যে, রক্তে মিশলে দ্রুত শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। হাইঞ্জেক্ট করার কোনো চিহ্ন ছিল না বডিতে। তাই ডাঃ রায়ের ধারণা, হিংস্র জন্তুটার দাঁতের কামড়ের ফলে ভিকটিমের রক্তে টক্সিক এলিমেন্ট ঢুকে গিয়েছিল। তা হলে দেখছি, আমি যা ভেবেছি, তা-ই ঠিক।
মির্জাসাহেব জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললেন, আপনি কী ভেবেছেন?
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, বলছি। কফি খেয়ে নিই। ইতিমধ্যে আপনি ডাক্তার রায়কে টেলিফোনে জানিয়ে রাখুন, আমরা ওঁর কাছে যাচ্ছি। আপনি আমার পরিচয় দেবেন।
মির্জাসাহেব তখনই উঠে গেলেন। একটু পরে রহমত কফি নিয়ে এল। কর্নেল তাকে বললেন, রহমত! উয়ো বুজুর্গ আউলিয়াকা সাথ হামারা মুলাকাত হুয়া। উনহি এক শাবল লেকে পীরবাবাকা জাগাহ পর এক গাঢ়াহ করনে লাগা। হামলোগোকো দেখুকার উনহি ভাগ গেয়া। কুছ নেহি মালুম আতা। কাহে উনহি ভাগ গেয়া।
রহমত হাঁ করে শুনছিল। বলল, তাজ্জব!
রহমত! উনহিকো সমঝানে পড়েগা, উয়ো কাম বহত খতরনাক্ হ্যায়। আর ওহি জগাহ ভি আভি বহত খতরনাক হ্যায়। উহা যানা-আনা ঠিক নেহি।
জি হাঁ। হাম উনকো হোশিয়ারি দেগা। ইয়ে ঠিক কাম নেহি।
মির্জাসাহেবকে দেখে রহমত সরে গেল। এক হাতে রাইফেল নিয়ে উনি এসে বললেন, ডাক্তার রায় একটার মধ্যে যেতে বললেন। একটায় উনি লাঞ্চ খেতে বাড়ি যান।
কফি শেষ করে আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি এবং মির্জাসাহেব গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করতে গেছেন, শাকিল মিয়াঁ বারান্দার পশ্চিমপ্রান্তে থেকে হন্তদন্ত এসে বললেন, কর্নিলসাবকা টেলিফোন আয়া কালকাত্তাসে। মেরা অফিসমে চলিয়ে।
কর্নেল তার সঙ্গে চলে গেলেন। মির্জাসাহেব অ্যাম্বাসাডার গাড়িটা পোর্টিকোর সামনে এনে জিজ্ঞেস করলেন, কর্নেল সাহেব কোথায় গেলেন?
বললুম, শাকিল মিয়াঁ ডেকে নিয়ে গেলেন ওঁকে। কলকাতা থেকে টেলিফোন এসেছে।
মির্জাসাহেব বললেন, তাহলে আমার ঘরের নাম্বারে না পেয়ে অফিসের নাম্বারে দিয়েছে। তাতে কোনো অসুবিধে হবে না। আসুন মিঃ চৌধুরি।
গাড়িতে উঠে জিজ্ঞেস করলুম, আপনার অফিস মানে কি আপনার কোনো বিজনেস কনসার্ন আছে?
আছে। তবে সামান্য। স্থাবর সম্পত্তি কোনাবেচায় আমি মিডলম্যান–সোজা কথায় দালালি করি। বাইরে অফিস করিনি। মির্জাসাহেব হাসতে হাসতে বললেন, বাইরে অফিস করতে গেলে এই বাড়ির নবাবি ট্রাডিশন আর ইজ্জত নাকি নষ্ট হবে। আমার মায়ের হুকুম এটা। আমি মেনে চলেছি। যাদের দরকার, তারা ফোনে যোগাযোগ করে এবং বাড়িতে আসে।
ওর খুড়তুতো ভাই সালিম সাহেবের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা বলতে গিয়ে বললুম না। বরং কর্নেল বলবেন। আমার মুখ বুজে থাকা উচিত।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল ফিরে এসে গাড়ির সামনের সিটে বসলেন। মির্জাসাহেব গাড়ি ফের স্টার্ট দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, জরুরি ফোন নাকি?
মিঃ হালদার নামে আমার এক বন্ধুর ফোন। আমাকে শিগগির কলকাতা ফিরতে বলছেন। ওঁর একটা নার্শারি আছে। কয়েকটা ক্যাক্টাসের অর্ডার দিয়েছিলুম। সেগুলো এসে গেছে।
মির্জাসাহেব বললেন, ক্যাক্টাসের চেয়ে আমার ব্যাপারটা জরুরি কর্নেল সাহেব! প্লিজ
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, না। আমি শিগগির চলে যাচ্ছি না। ওঁকে বললুম, ক্যাক্টিগুলো আমার নামে মেমো কেটে জমা রাখুন।
রাস্তায় পৌঁছে মির্জাসাহেব বললেন, ব্যাপারটা শুধু তথাকথিত কালো নেকড়ে হলে ওই জানোয়ারটাকে আমি নিজেই মেরে ফেলার দায়িত্ব নিতুম।
কর্নেল আস্তে বললেন, আপনি ভাববেন না। কাজটা শেষ না করে আমি ফিরছি না।
আমরা এবার উত্তরে বসতি এলাকার দিকে যাচ্ছিলুম। দুধারে টিলাপাহাড় আর জঙ্গল। একটা ছোট্ট বস্তিও চোখে পড়ল। চড়াই-উৎরাই রাস্তার পর চওড়া হাইওয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে। হাইওয়ে পেরিয়ে নদীর ব্রিজ। কিছুদূর চলার পর সুন্দর পরিচ্ছন্ন ঘরবাড়ি চোখে পড়ল। বাঁকি নিতে নিতে অবশেষে একটা হাসপাতালের গেটে গাড়ি ঢুকল। হাসপাতালটা আপাতদৃষ্টে পরিচ্ছন্ন এবং নতুন মনে হলো।
এখনও রোগীর ভিড় আছে। পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে মির্জাসাহেব বললেন, একটু কষ্ট করে দোতলায় উঠতে হবে।
মির্জাসাহেবকে দেখে দোতলার করিডরে অনেকেই ঝুঁকে সেলাম দিচ্ছিল। শেষপ্রান্তে একটা ঘরের পর্দা তুলে মির্জাসাহেব একজন সিস্টারকে বললেন, ডাক্তার রায়কে বলুন মির্জাসাহেব এসেছেন।
শিগগির ভেতরে যাওয়ার ডাক এল। একটা বড় ঘর এবং ল্যাবের সরঞ্জামে ভরা। টেবিলের সামনে একজন প্রৌঢ় শীর্ণকায় ডাক্তার বসে ছিলেন। হাত বাড়িয়ে আমাদের প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করে বসতে বললেন।
কর্নেল তার নেমকার্ড দিলেন। ডাক্তার রায় একটু হেসে ইংরেজিতে বললেন, আপনি প্রকৃতিবিদ। অতএব ছোটনবাবসাহেবের সঙ্গে আপনার সৌহার্দ্য স্বাভাবিক। এবার বলুন কী করতে পারি।
কর্নেল কিটব্যাগ থেকে সেই টেস্টটিউবটা বের করে বললেন, আমি প্রকৃতিবিদ। তবে মাঝে মাঝে রহস্যজনক ঘটনা কোথাও ঘটলে নাক না গলিয়ে থাকতে পারি না। পীরের সমাধির জায়গায় যেখানে কাদের বখশকে কোনো জন্তু আক্রমণ করেছিল, আজ সেখানে একটা গর্তের মধ্যে আমি এই জিনিসটা পেয়েছি। আমার প্রচণ্ড কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে ডাঃ রায়! এই জিনিসটা আপনি ল্যাবে পরীক্ষা করে আমাকে যদি জানান, খুব বাধিত হব। হা–এ কথাটা আগেই আপনাকে বলা উচিত। সেই গর্তে পচা মাংসের সঙ্গে অজস্র পোকা ছিল। এটা পচা মাংসের একটু অংশ। কিন্তু আমার সন্দেহ হয়েছে, এর মধ্যে কোনো সাংঘাতিক টক্সিক জিনিস আছে।
টেস্টটিউবটা নিয়ে একটা উজ্জ্বল আলো জ্বেলে দেখার পর ডাক্তার রায় বললেন, আগে কোন মন্তব্য করা উচিত নয়। তবে আমি ছোটনবাবসায়েরকে যে। ব্যক্তিগত রিপোর্ট দিয়েছি, তা সম্ভবত সত্য প্রমাণিত হবে। কর্নেল সরকার! আজ রাত দশটার মধ্যে আমি ফোনে আপনাকে জানাব। আমার বাড়িতে নিজস্ব একটা ল্যাব আছে। সেখানে কাজ করাটাই ভালো। বিশেষ করে কালো নেকড়ে নিয়ে সারা এলাকায় যা গুজব রটেছে, তাতে এখানে বসে কাজ করাটা ঠিক হবে না। এখানে নানা ধরনের লোক আনাগোনা করে।
ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ। বলে কর্নেল উঠলেন।
ডাঃ রায় বললেন, অসময়। তবু অনুরোধ করছি চা ঠাণ্ডা পানীয় একটা কিছু খেয়ে যান। বিশেষ করে ছোটনবাবসাহেব নিজে এসেছেন।
মির্জাসাহেব বললেন, ধন্যবাদ ডাঃ রায়। এইমাত্র আমরা কফি খেয়ে বেরিয়েছি। আচ্ছা, চলি।
কর্নেল বললেন, এটা কিন্তু অত্যন্ত গোপনীয়। আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন।
অবশ্যই।….
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মির্জাসাহেব বললেন, আমি কিন্তু অবাক হইনি কর্নেল সরকার! সকালে আপনি যখন গর্তটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন, তখনই ধরে নিয়েছিলুম আপনি কোনো ক্লু পেয়ে গেছেন।
কর্নেল বললেন, আপনার বাড়িতে বিশেষ করে বাইরে বারান্দায় বসে সব কথা আলোচনা করা সঙ্গত ছিল না। কথায় বলে, দেয়ালের কান আছে। বলবেন, আপনার কর্মচারীরা খুব বিশ্বস্ত। তবু এখন আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
হ্যাঁ। আপনি ঠিক বলেছেন। মির্জাসাহেব হাসলেন। দুই নবাব-ফ্যামিলির কর্তাদের মধ্যে বিবাদ থাকলেও কর্মচারীদের মধ্যে তো কোনো বিবাদ নেই।
কর্নেলও হাসলেন। তখন বড় নবাববাড়ির গেটের কাছে আপনার খুড়তুতো ভাই সালিমসাহেবের সঙ্গে আলাপ হলো। তিনিও ঠিক একই কথা বলছিলেন।
মির্জাসাহেব যেন একটু চমকে উঠলেন। বলেন কী! সালিমের সঙ্গে কীভাবে আলাপ হলো?
কর্নেল পুরো ঘটনাটা খুলে বললেন।
শোনার পর মির্জাসাহেব গম্ভীর মুখে বললেন, আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ এনেছি একথা কীভাবে ওর কানে গেল? এটা তো ভারি অদ্ভুত! তাছাড়া আপনাকে ডিটেকটিভ বলে সালিম অপমান করেছে।
চেপে যান। এবার শুনুন কীভাবে পীরের সমাধির কাছে পচা মাংস আবিষ্কার করলুম।…..
কর্নেলের কথা শেষ হলে মির্জাসাহেব উত্তেজিতভাবে বললেন, ওই পাগলাটা সম্পর্কে আমার সন্দেহ ছিল।
কর্নেল বললেন, আপাতত আমি পাগল লোকটা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। ওকে খুঁজে বের করে আটকে রাখা দরকার।
মির্জাসাহেব রুষ্ট মুখে বললেন, অবশ্যই দরকার। ওকে জেরা করলে অনেককিছু ফঁস হতে পারে। আমি রহিমকে গিয়ে বলছি। এ কাজটা রহিম পারবে। ওর ক্লাবের বন্ধুদের সাহায্য নেবে বরং।
এ কাজটা রহমত পারবে না? রহমত কোনো ছলে ওকে ভুলিয়ে, যদি মির্জাসাহেব কর্নেলের কথায় বাধা দিয়ে বললেন, রহমত বড্ড ভীতু। ওর চেহারা দেখে কিছু বোঝা যায় না। তাছাড়া পাগলাটাকে ও বুজুর্গ ফকির বলে বিশ্বাস করে। রহত বলছিল না? ও তাকে পাথর খেতে দেখেছে!
কথায়-কথায় আমরা নদীর ব্রিজ এবং হাইওয়ে পেরিয়ে এলুম। একসময় হঠাৎ কর্নেল বললেন, কাল রাত্রে আপনি খুদা বশকে কুমারসাবের কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। কে তিনি?
মির্জাসাহেব বললেন, এস কুমার নামে এক ভদ্রলোক এই এলাকায় বাগানবাড়ি করার জন্য খুঁজছেন। পাটনার লোক। এক সময় পার্লামেন্টের মেম্বার ছিলেন। এখন আর রাজনীতি করেন না। কুমারসাব নরেশ সিংয়ের বন্ধু। দুদিন হলো এখানে এসেছেন। নরেশের বাড়িতেই আছেন। আপনি তো জানেন, আজকাল আমি রিয়েল এস্টেটের কারবার করি। ভদ্রভাবে এই কাজটা করা যায় বলেই করি।
গাড়ি গেটে ঢোকার সময় কর্নেল আবার ওঁকে মনে করিয়ে দিলেন, ওই পাগলকে খুঁজে বের করা জরুরি।
কিছুক্ষণ পরে গেস্টরুমে গিয়ে কর্নেল বললেন, তুমি স্নান করে নাও। আজ আমার স্নানের দিন নয়।
কর্নেল শীতকালে সপ্তাহে একদিন এবং বাকি সময় সপ্তাহে দু থেকে তিন দিন পর স্নান করেন। এটা নাকি ওঁর সামরিক জীবনের অভ্যাস। ব্যতিক্রম। ঘটলেই ঠাণ্ডা লেগে যায়।
বাথরুমে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করলুম, হালদারমশাইয়ের খবর কী? ফোনে কী বললেন?
কর্নেল আস্তে বললেন, আজ রাতের ট্রেনে উনি আসছেন।
সেই মহিলার ব্যাপারটা বললেন না?
তার সঙ্গেই আসছেন। বলে কর্নেল তাড়া দিলেন। দুটোয় নবাবি লাঞ্চ। দেরি কোরো না।….
মির্জাসাহেবের প্রিয় রহিমবাবার সঙ্গে আলাপ হলো দোতলায় ডাইনিং রুমে। বয়স একুশ-বাইশের বেশি নয়। সুশ্রী চেহারা। তেমনি স্মার্ট। দেখেই বোঝা যায় ছেলেটি চঞ্চল প্রকৃতির এবং খেয়ালি। সে ইংরেজিতে কথা বলছিল। গত রাতে তার মোটরবাইক বিগড়ে যাওয়ার জন্য দায়ী নাকি সেই পাগল। অত রাতে লোকটা ভূতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল রাস্তায় মাঝখানে। মোটরবাইকে চেপে তাকে তাড়া করতে গিয়ে বাহনটা গর্তে পড়ে বিগড়ে গিয়েছিল। রহিম বলছিল, লোকটা সত্যি পাথরের টুকরো চোষে। যখনই তাকে দেখতে পায়, রহিম খান তার সঙ্গে দুষ্টুমি না করে ছাড়ে না। তবে আঙ্কল মির্জাসাহেব যখন তাকে ধরে আনার হুকুম দিয়েছেন, সে তাকে ধরে আনবে! এজন্য সে ল্যাসো বা দড়ির ফাঁস তৈরি করে নেবে। কারও সাহায্য তার দরকার হবে না। তবে আঙ্কলের ঘোড়াটা তার চাই। পাহাড়ি বনবাদাড়ে মোটরবাইক অচল। ঘোড়াটা এসব জায়গায় ছুটোছুটি করতে পটু।
মিজাসাহেব বললেন, রহিমবাবা! তুমি আমার ঘোড়াকে মোটরবাইকের মতো বিগড়ে দেবে না তো?
কক্ষণো না। আঙ্কল! আপনি আমাকে কতদিন ধরে ঘোড়ায় চড়ায় ট্রেনিং দিয়েছেন। এবার আমার পরীক্ষা হয়ে যাক।
মির্জাসাহেব কিন্তু কিন্তু করে শেষে বললেন, ঠিক আছে। তবে তুমি সূর্যাস্তের আগে কিন্তু অক্ষত শরীরে আমার ঘোড়া ফেরত দেবে।
ও কে আঙ্কল! বলে রহিম খান আহারে মন দিল।
খাওয়ার পর গেস্টরুমে ফিরে কর্নেলকে বললুম, যদি পাগল লোকটা আমরা চলে আসার পর আবার সেই গর্তটা খোড়ে, তাহলে সে বিপদের মুখে পড়বে। পচা মাংসের গন্ধ পেয়ে জন্তুটা ছুটে এসে ওকে আক্রমণ করবে। কাজটা ঠিক হয়নি কর্নেল!
কর্নেল একটা ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরাচ্ছিলেন। বললেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। সে আর ওখানে যাবে না। কেন জানো? এটা সহজ অঙ্ক। সে একটা গর্ত খুঁড়ছিল এবং আমরা তা দেখে ফেলেছি। যদি সে ওখানে আবার আসে, গর্তটা আগের মতো বুজিয়ে ফেলা হয়েছে দেখে সে ধরে নেবে, গর্তে যা পোঁতা ছিল তা আমরা হাতিয়ে নিয়েছি।
একটু ভেবে নিয়ে বললুম, আচ্ছা কর্নেল! জন্তুটাকে মেরে ফেলার জন্য টোপ হিসেবে তো ওই পচা মাংসটা ব্যবহার করা যায়! ধরুন, গর্তটা আবার খুঁড়ে পচা মাংস বের করে রাখলেন। তারপর আড়াল ওত পেতে বসে থাকলেন। মির্জাসাহেবের রাইফেল আছে। আপনার আর আমার রিভলভার আছে।
কর্নেল হাসলেন। তুমি কি ভেবেছ আমার বাহাত্ত্বরে ধরেছে? জয়ন্ত! ওটা টোপ হিসেবে ব্যবহার করব ভেবেই গর্তটা বুজিয়ে রেখে এসেছি।
তাহলে দেরি করা কি ঠিক হচ্ছে?
কর্নেল চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুরুট টানার পর বললেন, আজ তোমার ভাতঘুম আসছে না কেন?
বিরক্তি চেপে বললুম, আসছে। কিন্তু
কিন্তু উত্তেজনা বাধা দিচ্ছে! বলে কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। উত্তেজিত না হয়ে রবং ঘণ্টা দেড় ঘুমিয়ে নিতে পারো। মির্জাসাহেবের সঙ্গে ততক্ষণ একটু শলাপরামর্শ করতে হবে। আমরা যে পথে পীরের সমাধিতে গিয়েছিলুম, ওই পথে যাওয়া ঠিক হবে না। অন্য কোনো গোপন পথে যেতে হবে।
কেন?
কর্নেল আবার চুপচাপ চুরুট টানতে থাকলেন। তারপর আধপোড়া চুরুটটা অ্যাশট্রেতে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর চাপা স্বরে বললেন, শিকারী যখন শিকারে যায়, তখন গোপন পথে নিজেকে আড়ালে রেখেই টোপের জায়গায় যায়। যাই হোক, তুমি স্বচ্ছন্দে ঘুমিয়ে নিতে পারো।
কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। চোখ বুজে শুধু পাগলটার কথা ভাবছিলুম। কর্নেল বললেন বটে সে আর ওখানে যাবে না বা আবার গর্তটা খোঁড়ার চেষ্টা করবে না, কিন্তু আমি নিশ্চিন্ত হবে পারছিলুম না। আরও একটা কথা বারবার মনে ভেসে উঠছিল। দুটো গর্তে পচা মাংস রাখা হয়েছিল কেন? একটা গর্তের পচা মাংসের গন্ধে ছুটে আসার পর জন্তুটা কাদের বখশকে সামনে পেয়েছিল। অর্থাৎ ব্যাপারটা একটা নিশ্চিত চক্রান্ত এবং কারও উদ্দেশ্য ছিল কাদের বখশকে জন্তুটার সাহায্যে হত্যা করা হয়। তার সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় গর্তে আবার একই টোপ রাখার কারণ কী? এবার কার পালা? কর্নেলের এই কথাটা মাথার ভেতর মাছির মতো ভনভন করছিল। কর্নেল তাঁর থিয়োরি বদলালেও আমি বদলাতে পারছিলুম না।
কতক্ষণ পরে কর্নেল এসে ডাকলেন, জয়ন্ত! উঠে পড়া। এখন চারটে বাজে। সাড়ে চারটেতে আমরা বেরুব। তার আগে অবশ্য বারান্দায় বসে কফি খেয়ে নেব। তুমি তৈরি হয়েই বেরোও।
বারান্দায় গিয়ে দেখি, মির্জাসাহেব শিকারির বেশে তৈরি হয়ে আছেন। পাশে রাইফেলটা দাঁড় করানো আছে। কফি এসে গেল। আমরা কফি খাচ্ছি, সেই সময় মসজিদের ধ্বংসাবশেষের পাশ দিয়ে ঘোড়ায় চেপে রহিম খান ফিরে এল। সে ঘাড়া থেকে নেমে হাসতে হাসতে বলল পাগলাটা নদী পেরিয়ে পালিয়ে গেল। নদীতে প্রচণ্ড স্রোত আর এত পাথর। আমি অবাক! তার হাতে একটি শাবল ছিল। সেটাও সে ফেলেনি।
মির্জাসাহেব বললেন, ঠিক আছে। কাল আবার চেষ্টা করবে। তিনি হাঁক দিলেন ডিব্বু! ডিব্ব!
সেই কিশোর সহিস দৌড়ে এসে ঘোড়াটাকে টহল খাওয়াতে নিয়ে গেল। রহিম বলল, আঙ্কল! আমি ক্লাবে যাচ্ছি। পায়ে হেঁটে যাচ্ছি। ভাববেন না। আমার এক বন্ধু গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
সে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। পূর্বদিকে কালামহলের ধ্বংসাবশেষের পাশে একটা খিড়কির দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখি, নিচে খরস্রোতা নদী। রহমত দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল।
ঝোপঝাড় আর পাথরের আড়াল দিয়ে সাবধানে হেঁটে পীরের সমাধিস্থলে পৌঁছুলুম। তারপর চোখ গেল সেই গর্তটার দিকে আবার কেউ গর্ত খুঁড়েছে। কর্নেল হন্তদন্ত গিয়ে গর্ত দেখে বললেন, টোপ নেই। কেউ তুলে নিয়ে গেছে জন্তুটা যে খায়নি, তা স্পষ্ট। গুঁড়ো মাটিতে জুতোর ছাপ দেখতে পাচ্ছি।
মির্জাসাহেব আবাক হয়ে বললেন, আশ্চর্য তো!..
.
০৬.
এবার আমরা প্রকাশ্য রাস্তা দিয়ে ফিরে আসছিলুম। কর্নেল বললেন, একটা পয়েন্ট এতক্ষণে স্পষ্ট হলো। কালো নেকড়ে হোক কিংবা যা-ই হোক, ওটা কোনো লোকের পোষা জন্তু।
মির্জাসাহেব বললেন, আরও একটা পয়েন্ট আমার মাথায় এসেছে। সেই লোকটা জানত, আজ কেউ পীরের মাজারে যাবে। তখন জন্তুটাকে সে ছেড়ে দেবে এবং জন্তুটা তাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু আজ পীরের মাজারে প্রথমে আমি আর আপনি গিয়েছিলুম। তারপর আপনি আর মিঃ চৌধুরি গিয়েছিলেন। তাছাড়া পাগলটা ওই এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শেষে রহিম ঘোড়ায় চড়ে ছোটাছুটি করে গেল। তাই জন্তুটার মালিক সাবধান হয়ে গেছে। কারণ ওখানে সে কারও না কারও চোখে পড়ে যাবে। বিশেষ করে আপনার বাইনোকুলার আছে।
আমি বললুম, যে লোকটা এবার ভিকটিম হতো, সে-ও সম্ভবত যায়নি।
কর্নেল বললেন, ধরে নেওয়া যায়, তার যখন ওখানে যাওয়ার কথা, তখন তুমি আর আমি ওখানে ছিলুম। তার মানে, প্রায় সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে তার যাওয়ার কথা ছিল। আমরা থাকায় সে যেতে পারেনি।
মির্জাসাহেব বললেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। কাদের বখশের মতো একটা নিরীহ ভালমানুষকে মেরে ফেলে কার কী লাভ হলো? তা ছাড়া আরো একজন লোককে একই জায়গায় মেরে ফেলার চক্রান্ত করা হয়েছিল। একই জায়গায় দুদুটো মৃত্যু ঘটিয়ে কার কী লাভ হতে পারে?
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কর্নেল মাঝে মাঝে অভ্যাসমতো বাইনোকুলারে চারদিক দেখে নিচ্ছিলেন। মির্জাসাহেবের কথার উত্তরে তিনি একটু হেসে বললেন, আপনি বলছিলেন ওখানে নাকি গুপ্তধনের গুজব আছে?
মির্জাসাহেব ক্ষুব্ধভাবে বললেন, আছে। কিন্তু কাদের বখশ গুপ্তধনের খোঁজে এখানে আসত না। এসব ব্যাপারে তার বিশ্বাস ছিল না। তার বিশ্বাস ছিল শুধু পীরের ওপর। কতবার সে আমাকে বলেছে, পীরের মাজারে যদি খাজানা লুকোনো সত্যিই থাকে, তাহলে তাতে হাত দিলে পীরবাবার অভিশাপ লাগবে। কর্নেল সরকার! আমি জোর দিয়ে বলছি, কাদের বখশ ছিল পীরভক্ত মানুষ। তাই আজীবন সে মাজারে সাঁঝবাতি দিতে আসত।
কর্নেল বললেন, এ সব কথা থাক। আপনার বন্ধু নরেশ সিং কোথায় থাকেন? তার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই।
নরেশ কাছাকাছি একটা বাগানবাড়ি করেছে। আমিই ওকে জমিটা পাইয়ে দিয়েছিলুম। ওর পৈতৃক বাড়ি সেহরাগড় বাজার এলাকায়। বিকেলে সে এই বাড়িতে চলে আসে। মির্জাসাহেব একটু হেসে ফের বললেন, রাতে মদের আসর বসে ওর বাড়িতে। বিশেষ করে প্রতি রবিবার এই এলাকার সব বড়লোক এবং বড়-বড় অফিসাররা আসেন। পার্টি দেয় নরেশ।
আজ রবিবার নয়। কর্নেল বললেন। কাজেই আজ পার্টির ধুমধাম নেই।
হ্যাঁ। তা ছাড়া এখনও তার মদ্যপানের সময় হয়নি। চলুন। ওই যে লালরঙের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, ওটাই নরেশের বাড়ি।
কয়েকটা বাড়ির পর বাঁদিকে উঁচু জমিতে একটা বাংলো ধাঁচের বাড়ি দেখা যাচ্ছিল। গেটে ঝলমলে লাল বুগেনভিলিয়া। ভেতরে সুদৃশ্য লন। গেটের সামনে যেতেই কুকুরের গর্জন ভেসে এল। বন্দুকধারী দারোয়ান চুলে বসে খৈনি ডলছিল। মির্জাসাহেবকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল।
বললুম, সব বাড়িতেই কি বন্দুকধারী দারোয়ান আছে?
মির্জাসাহেব বললেন, হ্যাঁ। বিহার মুলুকে এটাই ট্রাডিশন। পথেঘাটে যানবাহনে সবখানে বন্দুকধারী লোক দেখতে পাবেন। তা ছাড়া এলাকায় মানুষখেকো নেকড়ের উৎপাত শুরু হবার পর থেকে সবাই সতর্ক।
গাব্দাগোব্দা চেহারা এক ভদ্রলোক ছড়ি হাতে বারান্দা থেকে নেমে আসছিলেন। পরেনে প্যান্ট, গায়ে স্পোর্টিং গেঞ্জি। মির্জাসাহেবের চেয়ে ঝাপালো গোঁফ আছে মুখে। মাথায় টাক। সহাস্যে একটু ঝুঁকে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললেন, আদাবারজ ছোটনবাবসাব। আইয়ে। অন্দর আইয়ে!
লনে কয়েকটা চেয়ার পাতা ছিল। বারান্দায় চেনে বাঁধা একটা প্রকাণ্ড কুকুর প্রচণ্ড হাঁকডাক করছিল। নরেশ সিং ধমক দিয়ে তাকে চুপ করালেন। মির্জাসাহেব আমাদের সঙ্গে নরেশ সিংয়ের আলাপ করিয়ে দিয়ে বারান্দায় কুকুরটাকে আদর করতে গেলেন। বুঝলুম, নরেশ সিংকে তিনি ওই অ্যালসেশিয়ানটাই উপহার দিয়েছিলেন।
নরেশ সিং বললেন, বৈঠিয়ে। বৈঠিয়ে।
আমরা বসলুম। মির্জাসাহেব ফিরে এলেন। তারপর ইংরেজিতে আলাপ শুরু হলো। কর্নেল বললেন, মির্জাসাহেব বলছিলেন, আপনার ছোটভাইয়ের নাম সুরেশ সিং। তিনি কি এখন কলকাতার ক্যামাক স্ট্রিট থাকেন?
নরেশ সিং বললেন, তা জানি না। দশ বছর আগে সুরেশ আমার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে গেছে। আজ সকালে হঠাৎ তার ট্রাঙ্ককল পেয়ে আমি যত অবাক, তত উদ্বিগ্ন। সে আজ রাতের ট্রেনে আসছে। স্টেশনে যেন গাড়ি পাঠাই।
মির্জাসাহেব বললেন, সঙ্গত অনুরোধ। আপনি তার দাদা। সে আপনার সহোদর ভাই।
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তো জানেন সুরেশ আমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছিল।
ভুলে যান ওসব কথা। মির্জাসাহেব বললেন। আমার মাননীয় অতিথিরা আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।
আমি দুঃখিত। বলে নরেশ সিং কর্নেলের দিকে ঘুরে বসলেন। আপনি একজা অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। আগ্নেয়াস্ত্র ধরার অভ্যাস আছে। একটা মানুষখেকো কালো নেকড়েকে গুলি করে মারতে পারবেন না?
কর্নেল হাসলেন। এ বয়সে আমার আর তত দক্ষতা নেই। কেন? সরকারি বেসরকারি শিকারীরা তো চেষ্টা করছেন?
নাহ্। এক বছর ধরে চেষ্টা করে সব শিকারী হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মির্জাসাহেব নিশ্চয় আপনাকে বলেছেন, কালো নেকড়ে হোক বা স্বাভাবিক ধূসর রঙের নেকড়ে হোক, জন্তুটা খুবই ধূর্ত। দিনে দিনে তার সাহস এত বেড়েছে যে এখন বয়স্ক মানুষের ওপর হামলা করছে। হতভাগ্য কাদের বখশের প্রাণ গেল। জানেন? কাদের বখশকে কদিন আগেই জঙ্গলের ভেতর পীরের সমাধিতে ওভাবে একা যেতে নিষেধ করেছিলুম। কাদের বখশ বলেছিল, পীরবাবা আমাকে বাঁচাবেন!
এই সময় একটি লোক কফি আর স্ন্যাক্স নিয়ে এল। মির্জাসাহেব বললেন, গরম পানীয় খেয়ে চাঙ্গা হওয়া যাক।
নরেশ সিং লোকটিকে বললেন, যাও! অভি সব বাত্তি জ্বালা দো।
সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি এসে গিয়েছিল। আলো জ্বলে উঠল। কফি খেতে খেতে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ সিং কি ব্যবসাবাণিজ্য করেন?
করি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানাধরনের জিনিসের অর্ডার সংগ্রহ করে সেগুলো সরবরাহ করি। অর্ডার সাপ্লায়ারিং এজেন্সি। নরেশ সিং একমুঠো বাদাম চিবুতে চিবুতে ফের বললেন, বাবার আমলের কারবার। সুনামের জোরে ভালই চলে।
আরও কিছুক্ষণ নানা বিষয়ে কথাবার্তার পর মির্জাসাহেব বললেন, এবার ওঠা যাক্।
নরেশ সিং চোখ নাচিয়ে বললেন, আপনার অতিথিরা আমারও অতিথি। তা ছাড়া আপনিও অনেকদিন পরে এলেন। একটু ভাল রকমের আপ্যায়নের লোভ হচ্ছে।
মির্জাসাহেব হাসলেন। আজ নরেশজির আসরে আর কোন অতিথি নেই বুঝি?
নাহ্। আজ আমি একেবারে নিঃসঙ্গ। তেমন কাকেও আজ খুঁজে পাইনি।
কর্নেলসাহেব এবং জয়ন্তবাবু, দুজনকেই বলছি, আপনারা ইচ্ছা করলে নরেশজির সঙ্গ দিতে পারেন। নরেশজির খাঁটি স্কচ ছাড়া চালে না।
কর্নেল হাসলেন, ধন্যবাদ নরেশজি! কড়া পানীয় আর আমার শরীর নেয় না। আর জয়ন্ত তো এক পেগেই মাতাল হয়ে যায়। তখন ওকে সামলানোর সমস্যা হয়। কাজেই ক্ষমা করবেন।
ঠিক আছে। নরেশ সিং করুণ মুখভঙ্গি করে বললেন, এসব ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করাটা অভদ্রতা…
অন্ধকার রাস্তায় জোরালো টর্চের আলো ফেলে হাঁটতে হাঁটতে মির্জাসাহেব বললেন, আমার মনমেজাজ আর আগের মতো নয়। আগে নরেশজির বাড়িতে আমিও রাতদুপুর অব্দি কাটিয়েছি। লোকটা আর যা-ই হোক, প্যাঁচালো ধরনের মানুষ নয়।
কর্নেল বললেন, সুরেশ সিং ওঁর মুখে চুনকালি মাখিয়েছিলেন–সেটা কী ব্যাপার?
সুরেশ নিষিদ্ধ মাদকের কারবার করত। মির্জাসাহেব সাবধানে আলো ফেলে চারদিক দেখে নিলেন। তারপর চাপাস্বরে বললেন, তখন আমি অ্যামেরিকায় ছিলাম। ফিরে এসে ঘটনাটা শুনেছিলুম। নরেশজি ভাইকে শাসনে রাখতে পারেননি। কোনো গোপনসূত্রে খবর পেয়ে আবগারি দফতরের লোকেরা পুলিশ নিয়ে একরাতে নরেশজির গুদামে হানা দিয়েছিল। শুনেছি প্রায় দশ লাখ টাকার গাঁজা আর আফিম লুকোনো ছিল গুদামে। সুরেশ পালিয়ে যায়। নরেশজি অনেক হয়রানির পরে বেঁচে যান। ওঁর সঙ্গে অনেক বড় বড় অফিসার আর রাজনীতিকদের চেনাজানা আছে। তো আপনার চেনা সুরেশ সিংয়ের চেহারার সঙ্গে কি নরেশজির চেহারা মিল লক্ষ্য করলেন?
কর্নেল বললেন, চেনা-মানে, নিছক নামেই চেনা। কলকাতার সদর স্ট্রিট এলাকায় একটা গলির মধ্যে খুশবুমহল নামে একটা বাড়ির মালিকের নাম সুরেশ সিং। বাড়িটা আসলে একটা পতিতালয়। ওই বাড়িতে একটি মেয়ে খুন হয়েছিল। বাড়ির মালিকের জেল হয়। তারপর কীভাবে জনৈক সুরেশ সিং বাড়িটা হাতিয়ে নেয়।
মির্জাসাহেব বললেন, আজ রাতের ট্রেনে সুরেশ আসছে। আপনি ইচ্ছা করলে আমি তার সঙ্গে আপনার আলাপের সুযোগ করে দিতে পারি।
কর্নেল বললেন, নাহ্। সুরেশ সিং সম্পর্কে আমার তত আগ্রহ নেই।
মির্জাসাহেব হাসলেন। আমার আগ্রহ আপনিই জাগিয়ে দিলেন। কাজেই কোনো কৌশলে জেনে নেব সে কলকাতার খুশবুমহল নামে একটা বাড়ির মালিক কি না। তবে এটা সত্যি হতেও পারে। কারণ সুরেশ সম্পর্কে অনেক খারাপ কথা এখানে অনেকের কাছে শোনা যায়।
কর্নেল তার ছোট্ট কিন্তু জোরালো টর্চের আলো পায়ের কাছে ফেলে হাঁটছিলেন। একটু দূরে নবাববাড়ির আলো গাছপালার ফাঁকে ঝিলমিল করছিল। আমাদের ডানদিকে রাস্তার কিনারায় বিশাল একটা পাথর দেখা যাচ্ছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, পাথরটার আড়ালে কেউ বা কিছু আছে।
অমনি মির্জাসাহেব টর্চের আলো ফেললেন পাথরটার দিকে। আমিও টর্চ জ্বেলে সেদিকে আলো ফেললুম। কর্নেলকে এগিয়ে যেতে দেখলুম। তিনটি টর্চের আলোয় পাথরটা যেন ঝলসে উঠল। তারপর দেখতে পেলুম সেই পাগলটাকে।
হঠাৎ আলোর মধ্যে পড়ে সে প্রথমে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। হাতের শাবলটা কিন্তু সে ছাড়েনি। তাকে ধরে ফেলার আগেই সে শাবলটা কর্নেলের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারল। অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় কর্নেল পাশ কাটিয়ে গিয়ে তার চুল ধরে ফেললেন। শাবলটা রাস্তায় গিয়ে পড়েছিল। আমি তখনই সেটা কুড়িয়ে নিলুম। কর্নেল তার লম্বা চুল ধরে তাকে জব্দ করে ফেলেছিলেন। তার গলা দিয়ে শুধু আঁ-আঁ শব্দ বেরুচ্ছিল। মির্জাসাহেব গিয়ে তার বুকে রাইফেলের নল ঠেকিয়ে বললেন, চুপসে আও মেরা সাথ। নেহি তো গোলি মার দেগা।
তার এক হাতে রাইফেল, অন্য হাতে টর্চ। কর্নেল বললেন, জয়ন্ত! হাঁ করে কী দেখছ? আমার পিঠে আঁটা কিটব্যাগের ভেতর দড়ি আছে। সেটা বের করে দাও। কুইক!
দড়িটা খুঁজে বের করার পর কর্নেল বললেন, মির্জাসাহেব! এর হাত দুটো পেছনে টেনে বেঁধে ফেলুন।
পাগলাটার গায়ে বেজায় দুর্গন্ধ। তাকে মির্জাসাহেব ও কর্নেল আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেললেন। তারপর দুজনে ঠেলতে ঠেলতে রাস্তায় নিয়ে এলেন। কিন্তু এবার সে শরীর এলিয়ে শুয়ে পড়ল। মুখে শুধু অদ্ভুত আঁ-আঁ শব্দ!
কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর তাকে দাঁড় করানো গেল না। তখন কর্নেল বললেন, মির্জাসাহেব! আপনি বরং বাড়ি চলে যান। রহমত আর ডিব্বুকে নিয়ে আসুন। ওরা একে বয়ে নিয়ে যাবে।
মির্জাসাহেব হন্তদন্ত চলে গেলেন।
এবার ব্যাপারটা আমার খারাপ লাগচ্ছিল। এই পাগল লোকটার ওপর বড় বেশি অত্যাচার করা হচ্ছে। বললুম, কর্নেল! বেচারাকে এত টানাটানি করে কোনো লাভ হবে না মনে হচ্ছে। এ তো দেখছি কথা বলতে পারে না। বোবা!
কর্নেল আমার কথায় কান না করে বললেন, শাবলটা হাতছাড়া কোরো না।
শাবলটা ছোট্ট এবং ওজনে কম। সেটা পাথরটার কাছে রেখে কর্নেলের কিটব্যাগ থেকে দড়ি বের করতে গিয়েছিলুম। টর্চের আলো ফেলে শাবলটা কুড়িয়ে আনলুম। এবার দেখলুম, কর্নেল পাগলটার মুখে চকোলেট গুঁজে দিচ্ছেন। একটু পরেই আমাকে অবাক করে বন্দী পাগল শিশুর মতো হাসতে শুরু করল।
কর্নেল তার পাশে বসে চাপাস্বরে বললেন, আজ রাতমে তুম ছোটে নবাবসাবকা মেহমান বন যায়েগা। আচ্ছা-আচ্ছা খানা মিলেগা! কাপড়াভি মিলেগা। সমঝা?
বলে তিনি আর একটা চকোলেট তার মুখে গুঁজে দিলেন। পাগলটা চকোলেট চুষতে থাকল। মুখে নিষ্পাপ হাসি। যখনই কর্নেল টর্চের আলো জ্বালছেন, তখনই দেখতে পাচ্ছি পাগল নিঃশব্দে হাসছে। তার চোখে একবার যেন জলও চিকচিক করতে দেখলুম। কে এই পাগল?
কিছুক্ষণের মধ্যেই মির্জাসাহেবের টর্চের আলো দেখা গেল। রহমত আর ডিব্বু এসে পড়ল তার আসার আগেই। রহমত কপাল চাপড়ে বলল, ইয়া আল্লা! ইয়ে বুজুর্গ আউলিয়াকো আপলোগ কাহে জুলুম-জবরদস্তি কর রহা স্যার? ইয়ে ঠিক কাম নেহি।
পিছন থেকে মির্জাসাহেব চাপাস্বরে ধমক দিলেন, কাঁধপর উঠাকে লে চলো! জলদি!
ধমক খেয়ে কাচুমাচু মুখে রহমত আর ডিব্বু পাগলকে মড়ার মতো বয়ে নিয়ে চলল।
মির্জাসাহেবের বাড়ি পৌঁছে পাগলাকে পোর্টিকোর সামনে বারান্দায় শুইয়ে রেখে রহমত তার পা ধরে বলল, হাম মাফি মাঙ্গতা হুজুর!
মির্জাসাহেব রমহতকে কড়া ধমক দিয়ে পাগলের পাহারায় থাকতে হুকুম দিলেন। তারপর আমাদের উদ্দেশে বললেন, লোকটা বেজায় নোংরা। আমি হাত ধুয়ে পোশাক বদলে আসি। আপনারাও হাত ধুয়ে পোশাক বদলে আসুন। এখানে বসে আরেক দফা কফি খেয়ে পাগল সম্পর্কে আলোচনা করা যাবে।
গেস্টরুমে গিয়ে কর্নেল বললেন, সমস্যা হচ্ছে লোকটা বোবা।
বললুম, ওর কাঁধের নিচে পিঠের একটু অংশ দেখে মনে হলো, লোকটা ফর্সা। মুখের চেহারাও মোটামুটি সুশ্রী।
হ্যাঁ। আজ সকালেই তা লক্ষ্য করেছিলুম। এই পাগল কে, সেটা জানা গেলে আমার পা বাড়াতে সুবিধে হয়। বলে কর্নেল কিটব্যাগ, বাইনোকুলার আর ক্যামেরা রেখে বাথরুমে ঢুকলেন।…
কয়েক মিনিটের মধ্যে পোশাক বদলে আমরা বারান্দায় পোর্টিকোর কাছে গেলুম। মির্জাসাহেব তখনও আসেননি। রহমত তখনও পাগলের পায়ের কাছে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে। ডিব্বু কাছাকাছি থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাগল চোখ বুজে পা নাচাচ্ছে। শাবলটা আমি চেয়ারের পাশে নিরাপদ দূরত্বে রেখে গিয়েছিলুম। কর্নেল বসে শাবলটা পরীক্ষা করে দেখে বললেন, রহমত! এই শাবলটা তোমার কি চেনা মনে হচ্ছে?
ডিব্বু ঝটপট বলে উঠল, ইয়ে তো ওহি শাবল হ্যায়!
রহমত তার দিকে তাকাল।
এক মাহিনা আগে খুদা বখশ চাচাকো ঘরসে খোয় গেয়া! চাচা তুমকো সাথ ইস লিয়ে বহত্ ঝামেলা কিয়া না? ভুল গেয়া তুম?
রহমত বেজার মুখে আস্তে বলল হামকো কুছ মালুম নেহি থা! হাম কেয়া করেগা?
মির্জাসাহেব এলে ডিব্রু শাবলের ঘটনাটা জানিয়ে দিল। তিনি রহমতের দিকে একবার ক্রুদ্ধদৃষ্টে তাকালেন শুধু। কিছু বললেন না।
মুন্নি কফির ট্রে এনে টেবিলে রেখে পাগলকে দেখতে দেখতে ঘরে ঢুকল। কর্নেল বললেন, শাকিল মিয়াঁকে দেখছি না তো?
মির্জাসাহেব বললনে, ডিব্বু! মিয়াঁসাব কঁহা?
ডিব্বু বলল, বাহার গেয়া সাইকিল লেকে। বোলকে গেয়া, সাত বাজকে লোটেঙ্গে।
মির্জাসাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, সাতটা বাজতে চলল। মিয়াকে বলেছি, যেখানেই যান, সন্ধ্যার আগেই যেন বাড়ি ফেরেন। এই এক অদ্ভুত মানুষ!
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, এই পাগল বোবা। এটাই একটা সমস্যা। ও পীরের সমাধির ওখানে যা কিছু ঘটেছে, সম্ভবত সব দেখেছে। ওর। কাছে সব কথা জানা যেত। কিন্তু–বলে কর্নেল হঠাৎ থেমে গেলেন।
মির্জাসাহেব বললনে, কিন্তু কী?
সেহরাগড়ে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার নিশ্চয় আছেন?
হ্যাঁ। একটা মেন্টাল হসপিটালও আছে। মনোরোগীদের জন্য একটা নার্সিংহোমও আছে।
এখনই ওকে কোনো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেন?
পারি ডাক্তার রবীন্দ্র ভার্মার সঙ্গে আগে কথা বলে নিই।
এতক্ষণে উজ্জ্বল আলোয় শাকিল মিয়াঁকে সাইকেলে চেপে আসতে দেখা গেল। তিনি সাইকেল থেকে নেমে সেলাম দিলেন। তারপর পাগলের দিকে চোখ পড়লে হন্তদন্ত বারান্দায় উঠে এলেন। সাইকেল বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে রইল। পাগলের দিকে ঝুঁকে কিছুক্ষণ তাকে খুঁটিয়ে দেখার পর শাকিল মিয়াঁ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, ইয়া আল্লা কেয়া বদনসিব! ছোটেনবাবসাব! ইয়ে আমি তো তাহির খান! মির তাহির খান। বহত্ আফসোসকি বাত।…
.
০৭.
মির্জাসাহেব তার প্রাইভেট সেক্রেটারির কথা শুনে যেন একটু অবাক হয়েছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপ ইয়ে আদমিকো পহচানতা?
জরুর। আপ্ ইকো কভি দেখা নেহি ছোটেনবাবসাব! শাকিল মিয়াঁ ধরা গলায় বললেন। লেকিন মুঝে মালুম হ্যায়, ইনকা নাম আপ শুনা থা! আভি ভূল গেয়া। তো মেহেরবানি করকে ইধার আইয়ে। বাত কনফিডেন্সিয়াল হ্যায়। ম্যায় আপকো সমঝা দুঙ্গা।
শাকিল মিয়াঁ মির্জাসাহেবকে বারান্দার অন্যপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ কী সব বললেন। তারপর দেখলুম, মির্জাসাহেব প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ফিরে আসছেন। পাগলের কাছে এসে তিনি বললেন, রহমত! ডিব্ব! ইনকো উঠাকে লে যাও।
পাগল তেমনি চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে। শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। তবু ওর যেন কোনো কষ্ট হচ্ছে না। কিংবা কষ্টের বোধও তার নেই। ওর অবস্থা দেখে আমার খারাপ লাগছিল। বেচারার ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে।
শাকিল মিয়াঁ, রহমত ও ডিব্বু পাগলকে ধরাধরি করে মড়ার মতো শূন্যে তুলে নিয়ে বারান্দা দিয়ে চলে যাওয়ার পর মির্জাসাহেব জোরে শ্বাস ছেড়ে বসলেন। তারপর বললেন, মানুষের জীবনে কী মর্মান্তিক ঘটনা না ঘটে।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কে এই তাহির খান?
মির্জাসাহেব আস্তে বললেন, এটা একটা পারিবারিক কেলেঙ্কারির ঘটনা। আপনাকে বলা উচিত ছিল। কিন্তু বলতে পারিনি। সেজন্য ক্ষমা করবেন।
না, না। ক্ষমার কথা কেন আসছে? আমি আপনাকে পীড়াপীড়ি করছি না। তবে এ কথা ঠিক, ঘটনাটা জানতে পারলে আমার সুবিধা হয়।
মির্জাসাহেব পাইপে তামাক ভরলেন। তারপর লাইটার জ্বেলে পাইপ ধরিয়ে বললেন, না। আপনাদের কাছে গোপন করব না। বিশেষ করে আপনার জানা দরকার। আমার দিদির সন্তান একটি নয়। দুটি। প্রথম সন্তান মেয়ে। রহিমের দিদি ছিল সে। তার নাম ছিল নাজমা কোম। নাজমা গ্রাজুয়েট হওয়ার পর। আমার জামাইবাবু জোর করে তার বিয়ে দিয়েছিলেন। জামাইবাবুর অবশ্য তত দোষ ছিল না। কারণ নাজমা ছিল উদ্ধৃত প্রকৃতির মেয়ে। লখনউয়ের মতো শহরে মোটামুটি একটা রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ের পক্ষে স্বাধীনতার একটা নির্দিষ্ট সীমা থাকে। নাজমা সেই সীমা গ্রাহ্য করত না। অনেক পুরুষবন্ধু জুটিয়েছিল সে। যাই হোক, জামাইবাবু আজিমাবাদের এক ভদ্র পরিবারে তার বিয়ে দিয়েছিলেন। পাত্র আলিগড়ের এম. এ। স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। আমি এসব ঘটনার সময় আমেরিকায় ছিলুম। কাজেই প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছিল, জানি না। দিদি তা আমাকে আজ পর্যন্ত খুলে বলেননি। যে কারণেই হোক, নাজমা একদিন স্বামীর বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তার স্বামী নাকি দ্বিতীয় বিয়ে করে পাকিস্তানে চলে যান। অথচ আজ শাকিল মিয়াঁ বলছেন–আবার জোরে শ্বাস ছেড়ে মির্জাসাহেব আবেগরুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বললেন, শাকিল মিয়াঁও আজিমাবাদের লোক। এই মির তাহির খান তার বন্ধু ছিলেন। কাজেই দেখামাত্র তাকে চিনতে পেরেছেন।
কর্নেল আস্তে বললেন, এই পাগল মির তাহির খান আপনার ভাগনি নাজমা বেগমের স্বামী?
হ্যাঁ। এখন সমস্যা হলো, ব্যাপারটা দিদি কী ভাবে নেবেন। দিদি অবশ্য খুব কঠোর প্রকৃতির মহিলা।
তাহির খান নিশ্চয় বোবা ছিলেন না?
না। যেভাবেই হোক, শুধু বোবা নন, পাগলও হয়ে গেছেন। মানসিক আঘাতও এর কারণ হতে পারে। তাই না?
পারে। আপনি আজ রাতেই ওঁকে সেই সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তারের নার্সিং হোমে রেখে আসুন।
মির্জাসাহেব বললেন, হ্যাঁ। সেইজন্য ওঁকে স্নান করিয়ে জামাকাপড় পরিয়ে একটু ভদ্রস্থ করে তোলার নির্দেশ দিলুম। আপনারা বসুন। আমি ডঃ রবীন্দ্র ভার্মাকে ফোন করে গাড়ি বের করব।
কিছুক্ষণ পরে মির্জাসাহেব ফিরে এলেন। তারপর গ্যারেজের দিকে গেলেন। গাড়ি পার্টিকোর সামনে এনে তিনি বললেন, মিঃ চৌধুরি! যদি কিছু মনে না করেন, আমার রাইফেলটা দিন।
রাইফেলটা চেয়ারের পাশে দাঁড় করানো ছিল। সাবধানে তুলে ওঁর হাত দিয়ে এলুম। উনি ধন্যবাদ বলে গাড়ি মসজিদের ধ্বংসাবশেষের কাছে নিয়ে গেলেন।
বললুম, নাটকীয় ব্যাপার! এরপর হয়তো জানা যাবে খুশবুমহলের নাসিমাই সেই নাজমা!
কর্নেল হাসলেন। আরও নাটকীয় ব্যাপার ঘটতে চলেছে জয়ন্ত! আজ রাতে হালদারমশাই তার ক্লায়েন্টসহ সেহরাগড় পৌঁছুচ্ছেন। আমার সঙ্গে শিগগির ওঁর যোগাযোগ হওয়া দরকার।
কাল কি সালিম বেগের ফার্মে যাবেন না তাহলে?
দেখা যাক। কালকের কথা কাল ভাবা যাবে। বলে কর্নেল উঠলেন। চলো! ঘরে গিয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে দিই। কেন যেন বড্ড টায়ার্ড লাগছে। আসলে সব তালগোল পাকিয়ে গেল।
বাথরুম থেকে ফিরে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। আমিও বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ রগড়ে ধুয়ে ফেললুম। তারপর বিছানায় হেলান দিয়ে বসলুম। আমার মাথাও ভোঁ-ভোঁ করছিল …।
মির্জাসাহেব যখন ফিরলেন, তখন রাত প্রায় পৌনে দশটা বাজে। গেস্টরুমে ঢুকে তিনি চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর ক্লান্তভাবে বললেন, ডাঃ ভার্মার মেন্টাল হোমে তাহির খানকে রেখে ডাক্তার জগদীশ রায়ের বাড়ি গিয়েছিলুম। উনি ওঁর ল্যাবে ছিলেন। ভেতরে ডেকে পাঠালেন। তারপ বললেন, এই পচা মাংস যে কেমিক্যাল সাবস্ট্যান্স পেয়েছেন, তা সাংঘাতিক উত্তেজক। কোনো মানুষের মুখের লালার সঙ্গে মিশে গেলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্রেনের নার্ভে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের জন্য সেই মানুষ প্রচণ্ড হিংস্র হয়ে ওঠে। সে কী করছে, বুঝতে পারে না। তারপর অবশ্য সে মারা পড়ে। বিশেষ করে কুকুর জাতীয় জন্তুর লালায় মিশলে প্রতিক্রিয়া একই রকমের হয়। কিন্তু জন্তুটা মারা পড়ে না। কারণ কুকুর জাতীয় জন্তুর রক্তে ন্যাচারাল রেসিস্ট্যান্স পাওয়ার আছে মানুষের চেয়ে বহুগুণ বেশি। উনি আমাকে বসিয়ে রেখে টাইম করে এই রিপোর্টটা আপনার জন্য দিয়েছেন।
মির্জাসাহেব বুশশার্টের পকেট থেকে একটা মুখ-আঁট খাম দিলেন। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমি দিদির কাছে যাই। ওঁর কানে কথাটা গেছে কি না জানি না। আপনারা কি চা বা কফি খাবেন?
কর্নেল খামের মুখ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বললেন, থাক। অসুবিধে না হলে দশটায় ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়ব।
ঠিক আছে। বলে মির্জাসাহেব চলে গেলেন।
কর্নেল টাইপকরা রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, আমি যা ভেবেছি, ডাক্তার রায় তা-ই বলেছেন। নেকড়ে হোক বা কুকুর হোক, পোষা প্রাণী। কারণ দীর্ঘদিন ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে লোকটাকে। তারপর সে প্রাণীটাকে কাজে লাগিয়েছে।
কে সেই লোক?
কর্নেল হাসলেন। তাকেই তো খুঁজছি। ডাক্তার রায়ের মতে, প্রাণিবিজ্ঞান এবং রসায়নবিজ্ঞানে দখল না থাকলে এ ধরনের চিন্তা মাথায় আসে না। তার মানে, দুটো বিষয়ে লোকটা পারদর্শী।
আচ্ছা কর্নেল, ডাক্তার রায় খামের মুখ এঁটে দিয়েছিলেন কেন?
তোমার কী ধারণা শুনি?
ডাক্তার মির্জাসাহেবকে বলেননি, এমন আরও কিছু কথা ওতে আছে।
হ্যাঁ, আছে। তবে ইচ্ছে করলে মির্জাসাহেব পড়ে নিতে পারতেন বা পারবেন। আমার কাছেও জানতে অসুবিধা নেই।
আমরা চাপাস্বরে কথা বলছিলুম। বললুম, ওঁর এই মানসিক অবস্থায় সে উৎসাহ নেই।
কর্নেল ঘড়ি দেখে নিয়ে বললেন, পৌনে দশটা। দশটায় ডিনার খাব। তারপর আবার রিপোর্টটা খুঁটিয়ে পড়া যাবে। যাকে বলে বিটুইন দ্য লাইনস, সেই রকম কিছু এতে আছে কি না দেখতে হবে। যাই হোক, তুমি ঠিক বলেছ। আপাতত মির্জাসাহেব তাহির খান সম্পর্কে বেশি মনোযোগী।
কিছুক্ষণ পরে শাকিল মিয়াঁ এসে বিনীতভাবে বললেন, ছোটেনবাবসাব আমাকে খবর দিতে বললেন, ডিনার ইহাপর সার্ভ কিয়া যায়েগা। উনহির বহিনসাহেবকি তবিয়ত আচ্ছা নেহি। আপনারা কুছু মনে করবেন না।
কর্নেল বললেন, না, না। মনে করব কেন? আপনি এখানেই আমাদের খাবার পাঠিয়ে দিন। বেগমসাহেবার মনের অবস্থা আমরা বুঝতে পারছি।
শাকিল মিয়াঁর পেছনেই বিশাল ট্রে হাতে নিয়ে রহমত দাঁড়িয়ে ছিল। উনি পর্দা তুলে ধরলে সে টেবিলে ট্রে রাখল। তারপর সেলাম ঠুকে চলে গেল।
কর্নেল বললেন, শাকিল মিয়াঁ! আপনাকে তদারক করতে হবে না। আমরা নিজেরাই খেয়ে নেব।
জি নেহি কর্নিলসাব! ইয়ে বাব খানদানের ট্রাডিশন আছে। মেহমান–আই মিন, গেস্ট যতক্ষণ খানাপিনা করবেন, এক আদমি হাজির থাকবে। ছোটে নবাবসাব হামাকো উয়ো কাম দিলেন।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, তাহলে আপনি বসুন।
শাকিল মিয়াঁ একটা চেয়ারে বসলেন। আমরা খেতে বসলুম। প্রকাণ্ড পরোটা, ডিমের হালুয়া, পনির মাখানো এবং সেদ্ধ কী একটা সবজি, রোস্টেড চিকেন, কয়েকরকমের মিঠাই সাজানো ছিল। কর্নেল বললেন, শাকিল মিয়াঁ। আপনিও আসুন। এত বেশি আমরা দুজনে খেতে পারব না।
ভদ্রলোককে রাজি করানো গেল না। তিনি নাকি পেটের রোগী। রাত্রে শুধু দুটো শুকনো রুটি আর একটু ডাল খান।
কর্নেল নিজেই বলেন, খেতে বসে কথা বলতে নেই। কিন্তু আজ নিয়ম ভঙ্গ করে শাকিল মিয়াঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন। একটু পরে বুঝলুম, কর্নেল আসলে ওঁকে জেরা করছেন। দুজনের মধ্যে এই সব কথাবার্তা হলো–
কর্নেল ॥ পীরের সমাধি দেখতে গিয়েছিলুম। দুই নবাব পরিবারের লোকেরা থাকতে সমাধির অবস্থা জরাজীর্ণ কেন?
শাকিল মিয়াঁ ॥ পীরের মাজারের তিন একর জমি নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে এখনও বিবাদ চলছে। সালিমসাহেব কোর্টে একটা দলিল সাবমিট করেছেন। আনরেজিস্টার্ড দলিল। ওতে ছোটে নবাবসাহেবের মায়ের সই আছে। উনি ভাসুরসাহেবকে ওই জমি দিয়ে গেছেন।
কর্নেল ॥ আপনি কি পীরের সমাধিদর্শনে যান?
শাকিল মিয়াঁ ॥ আগে কোনো কোনো দিন যেতুম। কালো নেকড়ের উপদ্রবের পর আর যাই না। কাদের বখশকেও যেতে নিষেধ করেছিলুম। কিন্তু নিষেধ শোনেনি।
কর্নেল ॥ আজ কি আপনার ওখানে যাওয়ার কথা ছিল?
কর্নেলের এই প্রশ্নটা শুনে শাকিল মিয়াঁ খুবই চমকে উঠলেন। আস্তে বললেন, জি হাঁ। বড়ানবাবসাবের ফ্যামিলির এক খিদমতগার (পরিচারক)
মোমিন খান হামকো বোলা, কাদের বখশ মর গেয়া। লেকিন কাদের বখশ হ্যাড ডিসকভারড় দা প্লেস অব হিন্ ট্রেজার। তো হুয়া একেলা মোমিন খান নেহি যানে শক্ত। উসকা বহত্ ডর লাকতা। তো ইফ আই এগ্রি টু অ্যাকম্পেন হিম, হি উইল গো দেয়ার। কর্নিলসাব! খাজনাকে লিয়ে মেরা কৈ লালচ নেহি হ্যায়। লেকিন আই ওয়াজ ভেরি মাচ ইনকুইজিটিভ, হোয়েদার মোমিন খান সাচ বোলতা কি ঝুট বোলতা! অব কোর্স, মোমিন খান ইজ এ ফেথফুল পার্সন।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, কখন যেতে বলেছিল সে?
মগরিবকি আগে। পাঁচ-সওয়া পাজ বাজকে। লেকিন আপলোগোনে উস ওয়াখত্ উধার থে। ইস লিয়ে হাম নেহি যা শ্যকে।
আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল মোমিন খানের?
আজ সেহরাগড় টাউনকি বাজরমে মুলাকাত হুয়া। মোমিন খান খারাব আদমি নেহি হ্যায়। আজ এ গুড মুসলিম হি প্রেজ ফাইভ টাইমস এ ডে। সো আই বিলিভ হিম। ঔর হাম ইয়ে ভি শোচা, দো আদমি একসাথ রহনেসে উও জানোয়ার–আই মিন, দা ব্ল্যাক উলফ উইল নট ডেয়ার টু অ্যাটাক আস।
কর্নেল খাওয়া শেষ করে বললেন, শাকিল মিয়াঁ! আপনি খুব বেঁচে গেছেন আজ।
শাকিল মিয়াঁ হকচকিয়ে গেলেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন কর্নেলের দিকে।
কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, মোমিন খান সাচ্চা মুসলমান হতে পারেন, কিন্তু তিনি নিশ্চয় কারও কথায় একা কোথাও যাবেন না।
শাকিল মিয়াঁ কাকুতি-মিনতি করে বললেন, হামার ভুল হইয়ে গেছে। কর্নিলসাব! চৌধুরিসাব! মাই রিকোয়েস্ট! প্লিজ ডোন্ট টেল দিস টু ছোটে নবাবসাব। মেরা নোকরি নেহি রহেগা।
কর্নেল তাকে আশ্বস্ত করে বাথরুমে ঢুকলেন।….
এ-রাত্রে আমি শিগগির ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। কর্নেল ভোরবেলা অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। সকাল আটটায় আমি যখন বিছানায় বসে বেড-ট পান করছি, তখন কর্নেল ফিরে এলেন। তাকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। আশা করেছিলুম, তার ব্যক্তিগত প্রথা অনুসারে তিনি সম্ভাষণ করবেন, গুড মর্নিং জয়ন্ত! আশা করি সুনিদ্রা হয়েছে।
কিন্তু উনি চুপচাপ কিটব্যাগ, বাইনোকুলার এবং ক্যামেরা টেবিলে রেখে ক্লান্তভাবে বসে পড়লেন। বললুম, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে বস্।
কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, আজ একা বেরিয়েছিলুম। মির্জাসাহেব এখনও শয্যাত্যাগ করেননি শুনলুম।
বললুম, কিন্তু আপনার মেজাজ খারাপ করে দিল কে?
সুরেশ সিং। বলে কর্নেল টুপি খুলে রেখে টাকে হাত বুলিয়ে নিলেন। তারপর অভ্যাসমতো সাদা দাড়ি ঝেড়ে ফেললেন। আপনমনে ফের বললেন, আগে কফি খেয়ে নার্ভ চাঙ্গা করে নিই।
আমি এই সুযোগে বাথরুমে গেলুম। শেভ করে এবং দাঁত ব্রাশ করে বেরুতে মিনিট পাঁচ-সাত লাগল। দেখলুম, রহমত কফি আর স্ন্যাকের ট্রে রেখে সদ্য বেরিয়ে গেল। মুখোমুখি বসে বললুম, সুরেশ সিংয়ের সঙ্গে আপনার দেখা হলো কোথায়?
কর্নেল কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললেন, বলছি।
ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতেই হলো। কফি শেষ করে চুরুট করিয়ে কর্নেল আস্তে বললেন-নরেশজির বাড়ির সামনে দিয়ে আসার সময় দেখি, একটা যণ্ডামার্কা লোক বেরিয়ে আসছে। পোশাক আর লোকটার মধ্যে কোনো মিল নেই। সে হনহন করে। এগিয়ে আসছে দেখে আমি দাঁড়ালুম। লোকটা সরাসরি আমাকে চার্জ করল, আপনি কি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার? আমিও একই সুরে বললুম, আপনি কি সুরেশ সিং? সে বলল, হ্যাঁ। আমিই সেই সুরেশ সিং। তারপর
এক মিনিট। বাংলা কথা বলছিল সে?
হ্যাঁ। তো হঠাৎ ব্যাটাচ্ছেলে আমাকে হুমকি দিয়ে বলল, এটা আপনার কলকাতা নয়। সেহরাগড়ের জঙ্গল। এখানে একটা নয়, শয়ে শয়ে কালো নেকড়ে চরে বেড়াচ্ছে। প্রাণে বাঁচতে হলে আজই কেটে পড়ুন। পারেন তো কলকাতায় আমার সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন।
কর্নেল চুপ করলে জিজ্ঞেস করলুম, তারপর?
কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, আমি মাথা ঠাণ্ডা রেখে ওকে বললুম, আপনার দাদার কাছে শুনেছি দশ বছর আগে আপনি এখান থেকে পুলিশের ভয়ে গাঢাকা দিয়েছিলেন। গত দশ বছরে এখানে অবস্থা বদলে যাওয়ারই কথা। ব্যাটাচ্ছেলে বলে কী, বাজে কথা ছাড়ুন। আমি এখানে দশ বছর ছিলুম না। কিন্তু আমার ছায়া এখানে ছিল। ইশারায় বললুম, বুঝে নিন কর্নেলসায়েব! কাল যদি এখানে আপনি থাকলে, কালো নেকড়ে আপনাকে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। কথাগুলো বলেই লোকটা গিয়ে নরেশজির বাড়িতে ঢুকল।
হতবাক হয়ে শুনেছিলুম। বললুম, মির্জাসাহেবকে কথাটা জানানো দরকার।
এইসময় শাকিল মিয়াঁ এসে বললেন, কর্নিলসাব! আপকা টেলিফোন আয়া।
কর্নেল তাঁর সঙ্গে চলে গেলেন। ভাবলুম, সুরেশ সিংয়ের ওইভাবে হুমকি দেওয়ার কী কারণ থাকতে পারে? তাছাড়া কালো নেকড়ের কথা বলে ভয় দেখানোতে রহস্যটা আরও জট পাকিয়ে গেল। কলকাতার খুশবুমহলের সেই নাসিমা প্রাইভেট ডিটেকটিভ হালদারমশাইয়ের শরণাপন্ন হয়েছে। সে ওই বাড়ি থেকে কি তাহলে সুরেশের ভয়েই পালিয়েছিল?
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল একা ফিরে এলেন। ইজিচেয়ারে বসে বললেন, হালদারমশাই তার ক্লায়েন্টসহ সূর্য হোটেলে উঠেছেন।
নদীর ওধারে একটা পশ এরিয়ায় সূর্য হোটেল। হালদারমশাই দশটা নাগাদ আমাকে যেতে বললেন। তার মক্কেল আমার সঙ্গে কথা বলতে চায়।
কথাটা শুনে হাসি পেল। বললুম, একজন বারবধূর সঙ্গে একই ঘরে ওঠেননি তো?
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, তোমার মাথায় এই কথাটা এল কী করে?
জিভ কেটে বললুম, নাহ। আপনার মুড খারাপ। তাই একটু জোক করলুম।
ব্যাড জোক। বলে কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। কিছুক্ষণ চোখ বুজে থাকার পর আপনমনে বলে উঠলেন, যামার্কা লোকটা কি সত্যি সুরেশ সিং? আমার সন্দেহ বেড়ে যাচ্ছে।
জিজ্ঞেস করলুম, কেন?
কর্নেল বললেন, যে সুরেশ সিং কলকাতায় থাকে এবং নানা মহলে প্রভাব আছে, সে আমার ব্যাকগ্রাউন্ড জেনেও এভাবে মুখোমুখি হুমকি দেবে কি? শুনেছি সে ধূর্ত লোক। জয়ন্ত! এই লোকটা তার ডামি।…
.
০৮.
কালকের মতো আজও বারান্দায় ব্রেকফাস্টের আয়োজন করা হয়েছিল। মির্জাসাহেব তার ভাগনে রহিমবাবা-কে সঙ্গে নিয়ে ব্রেকফাস্টে যোগ দিলেন। রহিমের চেহারায় কালকের সেই চাপল্য ছিল না। তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল।
খাওয়ার পর মির্জাসাহেব পাইপ ধরিয়ে বললেন, জামাইবাবু তাহির খান সম্পর্কে রহিমের কোনো স্মৃতি নেই। কারণ বিয়ের সময় ও ছিল নেহাত শিশু। কিন্তু কাল যে ও না জেনে তার পাগল জামাইবাবুকে তাড়া করে বেড়িয়েছে, ও জন্য ওর দুঃখ হয়েছে। তো ওকে বললুম, আমার সঙ্গে ডাক্তার ভার্মার। মেন্টাল হোমে চলো। ও রাজি হচ্ছে না। বাবা রহিম! মানুষের জীবনে এ ধরনের অনেক শোচনীয় ঘটনা ঘটে।
রহিম কিছু বলল না। কর্নেল বললেন, আমার মতে, রহিমের যাওয়া উচিত। কারণ ওকে দেখামাত্র তাহির খান প্রচণ্ডভাবে রিঅ্যাক্ট করবেন। তাকে রহিম যদি বুঝিয়ে দিতে পারে, সে তাকে জামাইবাবু বলে চিনতে পেরেছে, তাহলে তার পুরনো স্মৃতি ফিরে আসতে পারে। তারপর একসময় রহিমের মাকে নিয়ে গেলে ভাল হয়।
মির্জাসাহেব বললেন, দিদি তো এখনই যেতে চাইছেন। তবে আগে তার জামাইয়ের অবস্থা না দেখে এবং ডাঃ ভার্মার কথা না শুনে দিদিকে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। রহিম! আমি গাড়ি বের করছি। তুমি শিগগির তৈরি হয়ে এস।
রহিম চুপচাপ উঠে ভেতরে গেল। কর্নেল বললেন, রহিম তার দিদি নাজমা বেগমের ঘটনা নিশ্চয় জানে?
জানে। কিন্তু নাজমা সম্পর্কেও ওর কিছু মনে পড়ে না। তবে থাক ওকথা। গাড়ি বের করি। পৌনে দশটা বাজে। বলে মির্জাসাহেব উঠে দাঁড়ালেন।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত আর আমাকে তাহলে নদীর ব্রিজ অব্দি আপনার গাড়িতে লিফট দিন।
মির্জাসাহেব একটু অবাক হলেন যেন। ওদিকে কোথায় যাবেন?
কর্নেল হাসলেন। বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নেই। নদীর ধারে-ধারে ঘুরব। তারপর নরেশজির সাপ্লাই এজেন্সির অফিসে যাব। তার ভাই সুরেশ সিংয়ের সঙ্গে আলাপ করারও ইচ্ছা আছে।
সুরেশ যদি এসে থাকে, তাহলে নরেশজি তাকে এখানকার বাগানবাড়িতেই রাখবেন বলে আমার ধারণা। কারণ সুরেশের নাম এখনও পুলিশের বেকর্ডে থেকে গেছে। সে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াতে সাহস পাবে না। বলে মির্জাসাহেব গ্যারাজে গেলেন। তারপর গাড়ি বের করে এনে পোর্টিকোর সামনে দাঁড় করালেন।
রহিম এলে মির্জাসাহেব তাকে সামনের সিটে বসতে বললেন। কর্নেল ও আমি বসলুম।
নদীর ব্রিজ পেরিয়ে কর্নেল বললেন, এখানেই নামিয়ে দিন।
আমরা নামলে মির্জাসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা ফিরবেন কী ভাবে? আজকাল কালামহল এলাকায় দিনের বেলাতেও কেউ যেতে রাজি হয় না।
কর্নেল বললেন, কিছু ভাববেন না। যানবাহন না পেলে পায়ে হেঁটে ফিরব।
মির্জাসাহেব উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, ঠিক আছে। উইশ ইউ গুড লাক।
ব্রিজ পেরিয়ে এসে হাইওয়ে পূর্বে বাঁক নিয়ে চলে গেছে। তাই এখানে। ট্যাক্সি, সাইকেল রিকশ, এক্কাগাড়ি, বাস ইত্যাদির ভিড়। মানুষজনেরও ভিড় আছে। হাইওয়ের ধারে ঘিঞ্জি বাজারও দেখতে পেলুম। কর্নেল একটা সাইকেল রিকশ ডেকে বললেন, সূর্য হোটেল। জলদি যানা ভাই।
বিশ রুপৈয়া ভাড়া হাঁকল রিকশওয়ালা।
কর্নেল বললেন, ঠিক হ্যায়।
নদীর সমান্তরালে একটা পরিচ্ছন্ন নতুন রাস্তায় এগিয়ে যেতে যেতে ঘরবাড়ি নতুন দেখে বুঝলুম, এলাকাটা নতুন গড়ে উঠেছে এবং এখানে পয়সাওয়ালা লোকেরা থাকে। নদীর ধারে একটা করে হোটেল চোখে পড়ছিল। সুদৃশ্য সব হোটেল। রাস্তার বাঁকের মুখে বাঁদিকে আঙুল তুলে রিকশওয়ালা বলল, আ গেয়া সাব!
সূর্য হোটেলও নদীর ধারে। কিন্তু বিশাল লন, ফুলবাগান, এবং একটা কৃত্রিম ফোয়ারা এই হোটেলটার সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে। পিছনদিকে সুইমিং পুলের একটু অংশ চোখে পড়ছিল।
বললুম, এটুকু পথ পায়ে হেঁটেই আসা যেত।
কর্নেল বললেন, তা যেত। কিন্তু লোকেদের জিজ্ঞেস করতে হতো। তাই পৌঁছুতেও দেরি হতো।
কাচের প্রকাণ্ড দরজা ঠেলে লাউঞ্জে ঢুকে দেখলুম, রিসেপশন কাউন্টারে দুই সুন্দরী স্মার্ট হয়ে বসে আছে। লাউঞ্জে কোনো লোকজন নেই। কর্নেল এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন, হালদারমশাই লাউঞ্জে অপেক্ষা করবেন বলেছেন। কোথায় তিনি?
হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, একটা থামের আড়ালে চিত্রবিচিত্র ভেলভেটমোড়া একটা সোফায় শরীর এলিয়ে কেউ ঘুমোচ্ছে। কর্নেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে একটু হেসে বললেন, মনে হচ্ছে উনিই তিনি। টাই-স্যুট পরেছেন দেখছি। হ্যাঁ–এই পোশাকে ওঁকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে।
সামনে গিয়ে দেখি, প্রাইভেট ডিটেকটিভ হাঁ করে ঘুমোচ্ছেন। নাক ডাকছে। কর্নেল তাঁর কাছে বসে যেই আস্তে ডেকেছেন, হালদারমশাই! অমনি উনি সটান সোজা হয়ে লাল চোখে বলে উঠলেন, কে ডাকল?
তারপর আমাদের দেখতে পেয়ে কাঁচুমাচু হেসে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। কর্নেল বললেন, রাত্রে ঘুম হয়নি নাকি হালদারমশাই?
হালদারমশাই করুণ মুখে বললেন, কেন্দ্রীয় সরকারের হোমরা-চোমরা লোকেরা সেমিনারে আইছেন। সব হোটেল ভর্তি। শুধু এই থ্রি স্টার্স হোটেলে একখানা স্যুইট খালি ছিল। কী করব? ক্লায়েন্ট কইলেন, ডোন্ট হেজিটেট! দুইজনে দুই খাটে থাকব। আপনি আমার দাদা। কিন্তু যা-ই কন আপনারা, এই অবস্থায় ঘুম আসব ক্যামনে? আমি বিছানায় শুই নাই। সোফায় শুইয়া রাত্রি কাটাইছি।
আমি বললুম, কর্নেল! তা হলে দেখনু আমি ব্যাড জোক করিনি!
কর্নেল গম্ভীর হয়ে বললেন, হালদারমশাই! দেরি করা যাবে না। চলুন। আপনার ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করি!
ছ’তলা হোটেল। তাই লিফটে আছে। ছতলায় উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা স্যুইটের সামনে গিয়ে দরজায় নক করলেন হালদারমশাই। কিন্তু কোনো সাড়া এল না। হালদারমশাই বললেন, বাথরুমে আছে মনে হয়। একটু ওয়েট করা যাক।
করিডর নির্জন। হালদারমশাই আবার নক করলেন। কিন্তু সাড়া নেই।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কতক্ষণ আগে লাউঞ্জে গিয়েছিলেন?
হালদারমশাই বললেন, নটায় ব্রেকফাস্ট করতে নিচের ডাইনিং হলে গেছি। ক্লায়েন্টের ব্রেকফাস্ট তার এই ঘরে সার্ভ করতে বলেছি। তারপর আপনার জন্য লাউঞ্জে ওয়েট করছিলাম।
বলে তিনি আবার জোরে নক করলেন। কোনো সাড়া এল না। হালদারমশাই বিরক্ত হয়ে বললেন, কী যে করে!
কর্নেল দরজার হাতল ঘোরানোর চেষ্টা করে বললেন, ইন্টার লকিং সিস্টেম। ভেতর থেকে খোলা যায়। বাইরে থেকে খুলতে হবে চাবির দরকার।
হালদারমশাই বললেন, চাবি তো ক্লায়েন্টের কাছে আছে। আমি চাবি লই নাই।
কর্নেলকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। বললেন চলুন! নিচে রিসেপশনে গিয়ে ওদের বলুন। ওদের কাছে ডুপ্লিকেট চাবি আছে।
লিফটে ঢুকে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, হোটেল রেজিস্টারে কার নামে সুইট বুক করা আছে।
হালদারমশাই চিন্তিত মুখে বললেন, আমার ক্লায়েন্টের।
রেজিস্টারে আপনি সই করেছিলেন কি?
না। আমি একপাশে খাড়াইয়া ছিলাম।
কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন, এ ধরনের বড় হোটেলে অনেকসময় যে বুক করে, তার নাম-ঠিকানা লিখিয়ে নিয়ে অ্যান্ড পার্টি জুড়ে দেওয়া হয়। নাসিমা তা করেছে কি না কে জানে! আসলে অভিজাত বিত্তবান পরিবারের কোনো মহিলা তার পুরুষবন্ধুকে নিয়ে নিরুপদ্রবে এ সব হোটেলে বাস করতে পারেন।
হালদারমশাইয়ের মুখ করুণ হয়ে উঠল। বললেন, কী কাণ্ড!
যাই হোক। আপনি রিসেপশনে গিয়ে জানান, সুইট নাম্বার সিক্স টু ও-তে আপনি এক মহিলার সঙ্গে উঠেছেন। ব্রেকফাস্ট খেতে একা নিজের ডাইনিংয়ে এসেছিলেন। এখন ফিরে গিয়ে বহুক্ষণ নক করে তার কোনো সাড়া পাচ্ছেন না।
হালদারমশাই নিচে নেমে মরিয়া হয়ে গেলেন যেন। সোজা রিসেপশনে গিয়ে একটি মেয়েকে ইংরেজিতে কথাগুলো বললেন। মেয়েটি ইন্টারকমে কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও সাড়া পেল না। সে বলল, কেউ ধরছে না।
কর্নেল বললেন, উনি বাইরে যাননি তো?
মেয়েটি চাবিঝোলানো বোর্ড দেখে নিয়ে বলল, না। বাইরে গেলে বোর্ডাররা চাবি রেখে যান। সিক্স টু ও-র চাবি দেখতে পাচ্ছি না।
প্লিজ ম্যানেজারকে কথাটা বলুন। এটা জরুরি ব্যাপার।
মেয়েটি সংলগ্ন একটি কেবিন দেখিয়ে দিয়ে বলল, আপনারা ওখানে গিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলুন।
কর্নেল আমাদের দাঁড়াতে বলে ম্যানেজারের কেবিনে ঢুকলেন। মিনিট দু তিন পরে তাঁর সঙ্গে একজন রোগা ফর্সা টাই-স্যুট পরা ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে হালদারমশাইকে দেখে বললেন, আপনি কাল রাত্রে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে ৬২০ নম্বর সুইটে উঠেছেন! আমি তখন রিসেপশনে ছিলুম।
হালদারমশাই বললেন, হাঁ। আজ সকালে নিচের ডাইনিংয়ে ব্রেকফাস্ট করার পর এঁদের জন্য অপেক্ষা করছিলুম। তারপর স্যুইটে গিয়ে কতক্ষণ নক করে সাড়া পেলুম না। এই মহিলা ইন্টারকমে রিং করলেন। কেউ ধরছে না।
ম্যানেজার রিসেপশনে ঢুকে তালাবন্ধ একটা দেয়াল আলমারি খুলে ডুপ্লিকেট চাবি বের করলেন। তারপর বললেন, চলুন, দেখি কী ব্যাপার।
লিফটে ঢুকে তিনি হালদারমশাইকে জিজ্ঞেস করলেন, যদি কিছু মনে না করেন–ভদ্রমহিলার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক আছে নিশ্চয়? স্বামী-স্ত্রী অথবা নিকটত্মীয়া?
হালদারমশাই একটু ভড়কে গেলেন যেন। ঝটপট পকেট থেকে তার আইডেন্টিটি কার্ড বের করে দেখালেন।
ম্যানেজার একটু অবাক হয়ে বললেন, আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ? আপনার সঙ্গিনী ভদ্রমহিলা কে?
আমার ক্লায়েন্ট। উনি অবশ্য মুসলিম। এখানে একটা জরুরি কাজে এসেছি ওঁর সঙ্গে। উনি আমাকে দাদা বলেন।
ম্যানেজার উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, ঈশ্বর না করুন–অবাঞ্ছিত কিছু ঘটলে হোটেলের সুনামহানি হবে।
হালদারমশাইয়ের মুখেও উদ্বেগ ফুটে উঠল। বললেন, আমার ক্লায়েন্ট নাসিমা বেগম আমাকে তেমন কোনো আভাস দেননি। দিলে পুলিশকে জানিয়ে রাখতুম।
ছতলার সেই স্যুইটের লকে চাবি ঢুকিয়ে ম্যানেজার দরজা খুলেন। সামনে একটা ফুট সাতেক উঁটু কারুকার্যখচিত কাঠের পার্টিশন। সোফাসেট এবং সেন্টার টেবিল। সেই টেবিলে ব্রেকফাস্ট খাওয়ার চিহ্ন চোখে পড়ল। প্লেট, চা বা কফির পট ইত্যাদি একটা ট্রেতে রাখা আছে।
আমরা পার্টিশনের পাশ দিয়ে বেডরুমে ঢুকলুম। তারপরই চোখে পড়ল একটা বীভৎস দৃশ্য। মেঝের কার্পেটে চিত হয়ে পড়ে আছেন এক মহিলা। তার শ্বাসনালী কাটা। রক্ত জমাট বেঁধে আছে। পরনের নাইটি রক্তে মাখা। এক পায়ে একপাটি স্লিপার আটকে আছে। অন্য পায়ের স্লিপার ছিটকে একটু তফাতে পড়েছে।
দেখামাত্র আমার মনে হলো, নাসিমা আত্মরক্ষার সুযোগ পাননি। সেইসঙ্গে এ-ও বোঝা যাচ্ছিল, আততায়ী তার পরিচিত। তা নাহলে পার্টিশনের ওধারে দরজার কাছেই তিনি আক্রান্ত হতেন।
ম্যানেজার এই সাংঘাতিক দৃশ্য দেখামাত্র ও মাই গড! বলে আর্তনাদ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন। কর্নেল বললেন, মিঃ লাল! এখন কোনো হইচই করা ঠিক হবে না। মাথা ঠাণ্ডা রেখে আপনি নিচে গিয়ে পুলিশকে খবর দিন। শিগগির চলুন! আপনার কোনো কর্মচারীও যেন জানতে না পারে কী ঘটেছে। আপনি আপনার ঘর থেকে পুলিশকে টেলিফোন করবেন।
ম্যানেজার মিঃ লাল বিভ্রান্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই সুযোগে হালদারমশাই তাঁর ব্রিফকেস তুলে নিলেন। আমরা বাইরে গেলে কর্নেল দরজা টেনে বন্ধ করলেন। আবার দরজা লকড় হয়ে গেল।
লিফট নিচে নামলে ম্যানেজার কর্নেলের কথামতো তার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। কর্নেলের ইঙ্গিতে আমার কাছেই একটা সোফায় বসে পড়লুম। কর্নেল ম্যানেজারের ঘরে চলে গেলেন।
রিসেপশনের মেয়ে দুটি পরস্পর তাকাতাকি করে চাপা স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলতে থাকল। জিনস-টিশার্ট পরা একজন যুবক কম্পিউটারের সামনে বসে আপন মনে কাজ করছিল। সে মুখ তুলে একটি মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করল। মেয়েটি দুই কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে দুটো হাত নাড়ল। অর্থাৎ সে কিছু জানে না।
কিছুক্ষণ পরে কর্নেল বেরিয়ে এসে হালদারমশাইয়ের পাশে বসে তার ব্রিফকেসটা তুলে নিজের পাশে রাখলেন। তারপর চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, আর কিছু আছে?
হালদারমশাই বললেন, নাহ্! সকালে শেভ করি নাই। দাঁত মাজি নাই! এক ঘরে ওই মহিলার সঙ্গে থাকা যায়? এক্কেরে মেমসায়েব! আচ্ছা কর্নেলস্যার, পুলিশ তো আমারে হ্যারাশ করবে। তাই না?
কর্নেল বললেন, চুপ। কোনো কথা নয়।
পুলিশ এল প্রায় পনের মিনিট পরে। দুজন অফিসার এবং চারজন কনস্টেবল। ম্যানেজার মিঃ লাল নমস্কার করে বললেন, সূর্য হোটেলে এই প্রথম এমন ঘটনা স্যার! হোটেলের সব রুমে ভি আই পিরা ছিলেন। তাই আপনাদের সিকিউরিটি তো ছিলই আমাদেরও যথারীতি সিকিউরিটি গার্ড মোতায়েন ছিল।
তাঁর কথায় ওপর একজন পুলিশ অফিসার বললেন, স্যুইট নাম্বার সিক্স টু ও?
হ্যাঁ স্যার।
দ্বিতীয় পুলিশ অফিসার আমাদের দিকে ঘুরে বললেন, মর্নিং কর্নেল সরকার। আপনার সঙ্গে মুখোমুখি আলাপের সৌভাগ্য হলো। পুলিশ সুপার পরশু রাতে আমাকে আপনার সম্পর্কে খবর পাঠিয়েছিলেন। আমার নাম অর্জুন পাণ্ডে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর। প্রয়োজনে আপনাকে সাহায্য করার জন্য আমি কাল সকালেই এখানে চলে এসছি। মিঃ ত্রিবেদী! ইনিই সেই প্রখ্যাত ব্যক্তি নীলাদ্রি সরকার।
প্রথম অফিসার একটু হেসে বললেন, আমি রত্নেশ ত্রিবেদী। এখানকার থানার অফিসার-ইন-চার্জ। মিঃ পাণ্ডের কথা সত্যি হলো।
কথার মধ্যে কর্নেলের সঙ্গে ওঁরা করমর্দনপর্ব শেষ করেছিলেন। কর্নেল আমার এবং হালদারমশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, জয়ন্ত এবং মিঃ হালদার এখানে অপেক্ষা করুন। ভিড় বাড়িয়ে লাভ নেই। চলুন, আমরা ঘটনাস্থলে যাই।
ত্রিবেদী বললেন, মিঃ লাল! ফোটোগ্রাফার আসবেন একজন। ডাক্তার রায় আসতে পারছেন না। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট আসবেন। রিসেপশনে বলে রাখুন। এঁরা এলে যেন কেউ ওই স্যুইটে নিয়ে যায়।
কর্নেল ব্রিফকেসটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, তোমরা অপেক্ষা করো জয়ন্ত
ইতিমধ্যে হোটেলের কর্মচারীদের মধ্যে চাপা হিড়িক পড়ে গেছে। এদিক ওদিক থেকে তারা উঁকি দিচ্ছে। সেই সময় লক্ষ্য করলুম, হালদারমশাই নস্যি নিলেন এবং তার গোঁফ উত্তেজনায় তিরতির করে কেঁপে উঠল। চাপা স্বরে বললুম, আপনি কর্নেলকে সম্ভবত সব বলেছেন। আমাকে সংক্ষেপে একটু বলুন।
হালদারমশাই আস্তে বললেন, কী আর কমু জয়ন্তবাবু? আমারই ভুল। আমার অফিসে গিয়ে ক্লায়েন্ট কইছিল, সুরেশ সিং ট্যার পাইছে সব। তাই সে মেট্রোর সামনে যায় নাই। আর সেই চান্দ মিয়াঁ হইল গিয়া আমার ক্লায়েন্টের লাভার। কিন্তু এই মিয়াই তারে সর্বনাশের পথে পাঠাইয়া দিছিল। মিয়া। যে সুরেশের চ্যালা, আমার ক্লায়েন্ট তা জানত না। হংকংয়ে লইয়া গিয়া মহিলারে খারাপ করছিল। বড়-বড় হোটেলে তারা রাখত আর বড়লোকদের সঙ্গ দিতে বাধ্য করত। পরে সুরেশ সিং হংকংয়ে পুলিশের তাড়া খাইয়া কলকাতা ফিরল। সেই মিয়া আর আমার ক্লায়েন্টেরও সঙ্গে আনল সুরেশ।
জিজ্ঞেস করলুম, চাঁদ মিয়াঁর আসল নাম কী?
পকেট থেকে খুদে নোটবই বের করে হালদারমশাই দেখে নিলেন। বললেন, সাজ্জাদ খান। বাড়ি আজিমাবাদ। সেখানেই আমার ক্লায়েন্টের হাজব্যান্ডের বাড়ি ছিল। এ লং স্টোরি জয়ন্তবাবু! পরে শুনবেন! এমন মুড নাই।
বললুম, শুধু এটুকু বলুন অন্তত। আপনার ক্লায়েন্ট কেন কালো নেকড়ের রহস্য ফাঁস করতে চেয়েছিল।
হালদারমশাই ফিসফিস করে বললেন, খুশবুমহলে সুরেশ সিং আর চাঁদ মিয়া কালো নেকড়ে সম্পর্কে চুপিচুপি কথাবার্তা বলত। কাগজে খবর ছাপছিলেন না আপনারা? একদিন আমার ক্লায়েন্ট বাথরুমে ছিল। ওরা দুজনে কনসাল্ট করছিল, একটা লোক নাকি সব ট্যার পাইছে। তারে কালো নেকড়ে ফিনিশ না করলে বিপদ বাধবে। কোটি টাকার বিজনেস!
গোয়েন্দাপ্রবর হঠাৎ থেমে গেলেন। কর্নেল এবং ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর মিঃ পাণ্ডে লিফট থেকে নেমে এগিয়ে এলেন। কর্নেল বললেন, চলুন, মিঃ হালদার! পুলিশের কাজ পুলিশ করবে। ততক্ষণ আমরা মিঃ পাণ্ডের সঙ্গে থানায় যাই।
বাইরে দুটো পুলিশ-জিপ দাঁড়িয়েছিল। একটা পুলিশভ্যান এবং অ্যাম্বুলেন্সও সবে লনে ঢুকছিল। আমরা একটা জিপে উঠে বসলুম। মিঃ পাণ্ডের পাশে বসলেন কর্নেল। মিঃ পাণ্ডে জিপে স্টার্ট দিয়ে বললেন, বরং থানা থেকে নবাববাড়িতে টেলিফোন করা যাবে। ছোটে নবাবসাহেবের দিদি তার মেয়ের লাশ শনাক্ত করতে পারবেন।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, এতক্ষণ আশা করি উনি বাড়ি পৌঁছে গেছেন।
বললুম, কর্নেল! আমার ধারণা তাহলে সত্যি হলো। নাসিমাই সেই নাজমা বেগম।…
.
০৯.
সেহরাগড় থানার দোতলায় একটা ঘরে বসে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অর্জুন পাণ্ডে হালদারমশাইয়ের বিস্তারিত স্টেটমেন্ট নিলেন। তারপর বললেন, মিঃ হালদারের সতর্ক থাকা উচিত ছিল।
হালদারমশাই বিষণ্ণ মুখে বললন, আমি জানতুম না যে সুরেশ সিং আর তার সঙ্গী চাঁদ মিয়া আমাদের অনুসরণ করে এখানে এসেছে। আমি তো ওদের। দুজনকে কখনও দেখিনি।
কর্নেল বললেন, একে বলা যায় কমিউনিকেশন গ্যাপ। আমি জানি সুরেশ এসেছে। কিন্তু টেলিফোনে মিঃ হালদারের কাছে ডিটেলস কিছু শোনার সুযোগ। ছিল না। আমার পক্ষে কিছু খুলে বলারও সুযোগ ছিল না। রিস্ক নিতে চাইনি।
হালদারমশাই বললেন, ফোনে এত কথা তো বলা যায় না।
মিঃ পাণ্ডে বললেন, যাই হোক, ভদ্রমহিলা নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছেন। এটা স্পষ্ট যে খুনী তার চেনা। সুরেশ সিং অথবা চাঁদ মিয়া তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছে চিরদিনের মতো। ভদ্রমহিলা নিশ্চয় আরও কিছু গোপন তথ্য জানতেন। সে-কথা বলার জন্যই কর্নেল সাহেবকে ডেকেছিলেন।
কর্নেল সায় দিলেন। ঠিক বলেছেন। আমিও সেটাই অনুমান করেছিলুম।
জিজ্ঞেস করলুম, উনি যে নাজমা বেগম, তা কীভাবে জানা গেল?
মিঃ পাণ্ডে বললেন, ওর স্যুটকেস সার্চ করে কতকগুলো পুরনো চিঠি পাওয়া গেছে। লখনউ থেকে লেখা ওঁর বাবা-মায়ের চিঠি! আজিমাবাদের ঠিকানায় সেগুলো পাঠানো হয়েছিল। সবই উর্দুতে লেখা। আমি উর্দু জানি। আমাকে উর্দু শিখতে হয়েছিল এই পেশার কারণে। বিহার-উত্তরপ্রদেশে ক্রাইম ব্রাঞ্চে বা ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে অফিসারদের মোটামুটিভাবে উর্দু জানাটা খুব দরকার।
কর্নেল বললেন, মিঃ পাণ্ডে! নাজমা বেগম বাথরুম থেকে আড়ি পেতে শুনেছিলেন, কোটি টাকার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে–মিঃ হালদারের স্টেটমেন্টে তা আছে–তো সেই ব্যবসা সম্ভবত নিষিদ্ধ মাদকের।
সম্ভবত। আমারও সেই সন্দেহ জেগেছে।
নাজমা বেগম শুনেছিলেন, একজন তা টের পেয়েছে। তাকে কালো নেকড়ে তাই খতম করবে। এখন বুঝতে পারছি, কে টের পেয়েছিল। কারণ কালো নেকড়ের আক্রমণে সে মারা পড়েছে।
মিঃ পাণ্ডে চমকে উঠলেন। কে সে?
মির্জা হায়দার আলি বেগের প্রবীণ ভৃত্য কাদের বখশ।
আমি এই খবরটা জানি না। ওসি মিঃ ত্রিবেদী নিশ্চয় জানেন তাহলে। আসলে গত বছর এই এলাকার গ্রামাঞ্চলে নেকড়ের উপদ্রবের খবর শুনেছিলুম। কয়েকটা বাচ্চাকে নাকি নেকড়টা তুলে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নকড়েটা যে কালো, তা আমার জানা ছিল না। নেকড়ে কি কালো হয়?
লছমন নামে একজন পোস্টম্যান নাকি দেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নেকড়েটার গায়ের রঙ কালো। মিঃ ত্রিবেদীর এসব কথা সম্ভবত জানা আছে। কারণ কাদের বখশের বডির পোস্টমর্টেম হয়েছিল।
অর্জুন পাণ্ডে একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, সেই কালো নেকড়ে একজন বয়স্ক লোককে মেরে ফেলেছে। এদিকে নাজমা বেগমের কাছে মিঃ হালদার সেই রহস্যময় কালো নেকড়ের কথা শুনেছেন। নাজমা তার রহস্য ফাঁস করতে চেয়েছিলেন, কর্নেলসাহেব! আপনিও যে এই রহস্য ফাঁসের উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছেন, তা বুঝতে পারছি। ব্যাপারটা ভারি অদ্ভুত।
হালদারমশাই বললেন, সবচেয়ে বড় কথা, এই কালো নেকড়ের সঙ্গে কোটি টাকার ব্যবসা জড়িত।
মিঃ পাণ্ডে গম্ভীর মুখে বললেন, আগে নাজমা বেগমের খুনীকে পাকড়াও করতে হবে। পুলিশ জানে গোপন তথ্য কিভাবে আদায় করতে হয়।
কথা হচ্ছিল ইংরেজিতে। মাঝে মাঝে টেলিফোন বেজে উঠেছিল। মিঃ পাণ্ডে চাপাস্বরে হিন্দিতে কথা বলছিলেন। কখনও তিনি নিজেও টেলিফোন করে কাকেও কিছু নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এবার টেলিফোন বেজে উঠলে তিনি বললেন, কর্নেলসাহেব। আপনার ফোন।
কর্নেল রিসিভার তুলে সাড়া দিলেন। …হ্যাঁ। বলুন মির্জাসাহেব! …ঠিক আছে। আপনি দিদিকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান। ..না, না। আমাদের জন্য গাড়ি। পাঠানোর দরকার নেই। আমরা থানায় আছি। …না, না। এ বেলা এখানেই লাঞ্চ খেয়ে নেব। তবে রাত্রে আর একজন গেস্ট আমাদের সঙ্গে যাবেন। প্রাইভেট ডিটেকটিভ মিঃ কে. কে. হালদার। …হ্যাঁ। আর একটা কথা। নরেশজিকে রিং করে জেনে নিতে পারবেন কি যে তাঁর ভাই সুরেশ কোথায় আছে? …শুনুন। এটা খুব গোপনীয়। ট্যাক্টফুলি আপনাকে জেনে নিতে হবে। ..হ্যাঁ, ছাড়ছি। বিকেলের মধ্যে দেখা হবে।
টেলিফোন রেখে কর্নেল বললেন, ছোটে নবাবসাহেবের দিদি দিলোয়ারা বেগম প্রথমে আসতে রাজি হননি। মেয়ের প্রতি তাঁর নাকি কোনো মায়ামমতা নেই। যাই হোক, পুলিশকে সাহায্য করার জন্য তিনি মর্গে আসতে রাজি হন। বডি শনাক্ত করেছেন। মর্গে মিঃ ত্রিবেদী এখনও আছেন। তার ফিরে আসা পর্যন্ত কি আমরা অপেক্ষা করব?
মিঃ পাণ্ডে ঘড়ি দেখে বললেন, দেড়টা বাজে। ওসি দুটোর আগে ফিরছেন না। তাছাড়া আপাতত আপনাদের থাকার কী দরকার? বরং চলুন। আমারও খিদে পেয়েছে। পুলিশ ক্যান্টিনে খেয়ে আমার অরুচি ধরে গেছে। সকালে মিঃ ত্রিবেদীর বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট এসেছিল। সমস্যা হলো, মিঃ ত্রিবেদী একেবারে সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণ। আমিও ব্রাহ্মণ। কিন্তু আমিষভোজী।
অর্জুন পাণ্ডের সঙ্গে আমরা বেরিয়ে এলুম। কাছাকাছি একটা ওড়িয়া হোটেলে গিয়ে তৃপ্তি সহকারে ডাল-ভাত-মাছ খাওয়া হলো। নবাববাড়ির খাদ্য খেয়ে আমারও অরুচি ধরেছিল।
মিঃ পাণ্ডে বিল মিটিয়ে দিলেন। বললেন, প্রত্যেকদিন তো আপনাদের খাওয়াতে পারব না। এ বেলা আপনারা আমার অতিথি। কর্নেল সাহেব কি এখন নবাববাড়ি ফিরতে চান?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। একটু ধাতস্ত হওয়া দরকার। সময়মতো আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করব। মির্জাসাহেবের ফোন নাম্বার আপনি মিঃ ত্রিবেদীর কাছে পেয়ে যাবেন।
কিন্তু আপনারা যাবেন কিসে? শুনেছি ওই এলাকায় ভাড়া নিয়ে কেউ যেতে চায় না। পুলিশের জিপে যাওয়া ঠিক হবে না। যা বুঝেছি, তাতে অন্য পক্ষ সতর্ক হয়ে যাবে। এক মিনিট। বলে মিঃ পাণ্ডে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে থানার দিকে এগিয়ে গেলেন।
একটু পরে একটা প্রাইভেট কারে চেপে তিনি ফিরে এলেন। গাড়ি থেকে নেমে বললেন, এটাও পুলিশের গাড়ি। তবে পুলিশের ছাপ নেই। স্পেশাল ব্রাঞ্চের এস আই রাকেশ শর্মা এটা ব্যবহার করেন। রঘুবীর! মিঃ পাণ্ডে ড্রাইভারের কাঁধ চাপড়ে সহাস্যে ফের বললেন, তুমি পুলিশের গাড়ির ড্রাইভার। তোমার গায়ের গন্ধে নেকড়েটা লেজ তুলে পালিয়ে যাবে।
রঘুবীর ব্রিজ পেরিয়ে সোজা চড়াইয়ে ওঠার সময় হিন্দিতে বলল, পাণ্ডেসাব জানেন না। আমার বাড়ি ক্যায়লাসপুর। ওইগ্রামেই গত বছর নেকড়েটা প্রথম। হামলা করেছিল। তখন গরমের মাস। বাইরে খোলা উঠোনে রসুলালের বউ ঘুমোচ্ছিল। বুকের কাছে তিনমাসের বাচ্চা! মেয়েটা ঘুমোয়নি তখনও। বাচ্চাটা কাঁদছিল। আচমকা নেকড়েটা এসে বাচ্চাটাকে কামড়ে ধরে নিয়ে পালিয়েছিল। সে শুরু। তো দিনে দিনে জানোয়ারটার সাহস বেড়ে গেছে। আশ্চর্য স্যার! কত শিকারী চেষ্টা করেছেন। তাকে মারতে পারেননি।
সে সারাপথ নেকড়েটার মুখে কতগুলো বাচ্ছা মারা পড়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিচ্ছিল। একসময় কর্নেল বললেন, নেকড়ের গায়ের রঙ নাকি কালো?
হ্যাঁ স্যার। তবে শোনা কথা।
তুমি জানো নবাববাড়ির একজন বুড়ো চাকরকে নেকড়েটা মেরে ফেলেছে?
জানব না কেন? তার লাশের পোস্টমর্টেম হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করেছে। তবে দেখুন স্যার। একটা ব্যাপারে আমার একটু খটকা লেগেছে।
কী ব্যাপার?
জানোয়ারটা শুধু এই রাস্তার দুধারে যত গ্রাম আর ছোট বসতি আছে, সেখানে হামলা করে বেড়াচ্ছে। রাস্তা শেষ হয়েছে ওই উঁচু পাহাড় দেখছেন, তার কাছে।
এই রাস্তার দুধারে কতগুলো গ্রাম আছে?
দুটো গ্রাম আর তিনটে আদিবাসী বসতি। খুব ছোট বসতি। গ্রাম দুটোও অবশ্য বড় নয়। জঙ্গল আছে। টিলা আছে। মানুষজন খুব গরিব।
রাস্তাটা পাহাড়ের কাছে শেষ হয়েছে কেন? ওধারে গ্রাম নেই?
পাহাড়ের ওধারে আছে। কিন্তু রাস্তাটা আগে কালামহল–মানে, নবাববাড়ি পর্যন্ত ছিল। বড়নবাবের ছেলের চাষের ফার্ম আছে ওদিক। ফার্মের ফসল আনার জন্য রাস্তাটা বাড়ানো হয়েছে। ইলেকট্রিক লাইনের এই যে সব খুঁটি দেখছেন, এগুলো গেছে ফার্ম পর্যন্ত! বড়নবাবের ছেলে দয়া করে শুধু আমাদের ক্যায়লাসপুরকে লাইন দিয়েছেন। তাও মাত্র চার-পাঁচটা বাড়ি পেয়েছে। কথাগুলো বলে শ্বাস ছেড়ে রঘুবীর স্বগতোক্তি করল, ইয়ে হ্যায় দেশকি হাল। গরিবোঁকে লিয়ে কৈ নেহি শোচতা হ্যায়!…..
গেটের সামনে আমরা গাড়ি থেকে নামলাম। রঘুবীর সেলাম ঠুকে কর্নেলের কাছে কিছু বখশিস নিয়ে চলে গেল। খুদা বখশ গাড়ির শব্দ শুনে গেটের কাছে এসেছিল। সেও সেলাম ঠুকে বলল, ছোটেনবাবসাব আধাঘণ্টা আগে এসেছেন।
আমরা মসজিদের ধ্বংস্তূপের পাশ দিয়ে এগিয়ে দেখি, বারান্দায় শাকিল মিয়াঁ দাঁড়িয়ে আছেন এবং মির্জাসাহেব বেতের চেয়ারে বসে আছেন। দুজনে কথা বলছিলেন। আমাদের দেখে শাকিল মিয়াঁ আদাব দিলেন। মির্জাসাহেব বললেন, আপনাদের খাওয়া হয়েছে? আমি কিন্তু আপনাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করে গিয়েছিলুম।
কর্নেল বললেন, ওড়িয়া হোটেল খেলুম। একটু মুখ বদলানো হলো। যাই হোক, আপনার দিদি কেমন আছেন?
দিদি ঠিক আছেন। শুধু রহিমবাবাকে নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছিল। এখন সে একটু শান্ত হয়েছে।
কর্নেল হালদারমশাইয়ের সঙ্গে মির্জাসাহেবের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, তাহির খানের খবর কী?
মির্জাসাহেব গম্ভীরমুখে বললেন, ডাক্তার ভার্মা ওঁকে পরীক্ষা করে বুঝেছেন, তাহির খান কোনো সময়ে বিষাক্ত কিছু খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। ওঁর জিভ থেকে কণ্ঠমূল পর্যন্ত পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ডাক্তার ভার্মা অবাক হয়ে বললেন, এতদিন কী করে বেঁচে আছেন, সেটাই আশ্চর্য!
নরেশ সিংকে ফোন করেছিলেন কি?
হ্যাঁ। একটু আগে করেছিলুম। নরেশজি বললেন, সুরেশ আর তার এক বন্ধু। গত রাতে এসেছে। তারা রাতে এখানকার বাগানবাড়িতে ছিল। সকালে দুজনে বেরিয়েছিল নরেশজির একটা গাড়ি নিয়ে। এখন পর্যন্ত আর তাদের খবর পাননি উনি। খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
কর্নেল বললেন, মিঃ হালদার এখানে থাকার কোনো অসুবিধা হবে না তো?
মির্জাসাহেব বললেন, কেন একথা ভাবলেন? কর্নেল হাসলেন। ভাবলুম। কারণ মিঃ হালদার অপরাধবোধে কুণ্ঠিত। তাঁর ধারণা, এত বড় মিসহ্যাপের জন্য তিনিই দায়ী। কাজেই মির্জাসাহেব তার প্রতি ক্রুদ্ধ। তিনি আমাদের সঙ্গে আসতে রাজি হচ্ছিলেন। তাই তাকে শুনিয়ে আপনাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলুম। কী হালদারমশাই?
হালদারমশাই বিষণ্ণমুখে বললেন, আমার ক্লায়েন্টকে আমি বাঁচাতে পারলুম না। এ দুঃখ এ জীবনে ঘুচবে না।
মির্জাসাহেব আস্তে বললেন, হতভাগিনী নাজমা তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। আপনি চেষ্টা করলেও তাকে বাঁচাতে পারতেন না। নিয়তিতে আমি বিশ্বাসী। যাই হোক আপনারা গেস্টরুমে গিয়ে বিশ্রাম করে নিন। শাকিল মিয়াঁ। এঁদের নিয়ে যান। কর্নেল সরকার! সাড়ে চারটেতে আপনার সঙ্গে একটু প্রাইভেট আলোচনায় বসতে চাই।
কর্নেল বললেন, আমারও কথা আছে। যাই হোক, আমি দিনে জয়ন্তের মতো ঘুমোই না। তবে মিঃ হালদার রাত্রে ঘুমুতে পারেননি। ওঁকে ঘুমুনোর সুযোগ দেব।
গেস্টরুমে গিয়ে দেখলুম, হালদারমশাইয়ের জন্য একটা ক্যাম্পখাট ঢোকানো হয়েছে। তাতে বিছানাও পাতা হয়েছে। কর্নেল বললেন, হালদারমশাই! আপনি পোশাক বদলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে নিতে পারেন। জয়ন্ত! তুমিও ভাতঘুম সেরে নিতে পারো।
হালদারমশাই পোশাক বদলাতে বাথরুমে ঢুকলেন। শাকিল মিয়াঁ তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বললেন, কর্নির্লসাহেব! হামি একঠো বাত্ করব। কনফিডেন্সিয়াল বাত্। মেহেরবানি করে ভিতরের বারান্দায় চলেন।
ভেতরের বারান্দায় যাওয়ার দরজা বন্ধ ছিল। সেটা খুলে শাকিল মিয়াঁর সঙ্গে কর্নেল বারান্দায় গেলেন।
ক্লান্তিবশত আমি আর পোশাক না বদলে শুধু জুতো ঘুলে বিছানায় গড়িয়ে পড়লুম। হালদারমশাই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে এলেন। আস্তে বললেন, সঙ্গে নকল গোঁফ-দাড়ি আর একখান টুপিও আনছি। যদি মুসলিম সাজবার দরকার হয়। তো কিছুই কাজে লাগল না।
বললুম, আগে আপনি শুয়ে পড়ুন হালদারমশাই। বলা যায় না, মুসলিম ছদ্মবেশে ধরতে হবে হয়তো।
হালদারমশাই করুণ হেসে ক্যাম্পখাটে বসে একটিপ নস্যি নিলেন। তারপর শুয়ে পড়লেন। একটু পরে শুনি ওঁর নাক ডাকছে।
কর্নেল একা ফিরে এলেন। বললুম, মির্জাসাহেব কোথায়?
কর্নেল বললেন, উনি ভেতরের বারান্দা দিয়ে চলে গেলেন। তারপর কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে চুরুট ধরালেন এবং চোখ বুজে স্বগতোক্তি করার ভঙ্গিতে বললেন, শাকিল মিয়াঁ সকালে কথাটা আমাকে বললে ঘটনা এমন ট্র্যাজিক হতো না।
কী কথা?
তবে বুঝলে জয়ন্ত? আমি ঠিকই ধরেছিলুম ষণ্ডামার্কা লোকটা সুরেশ হতে পারে না।
আহা! কথাটা কী বলুন। তবে তো বুঝব!
কর্নেল চোখ খুলে চাপাস্বরে বললেন, শাকিল মিয়াঁ আজ ভোরে তার ঘরের জানালা দিয়ে দেখেছিলেন, একটা লোক বড় নবাববাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কার সঙ্গে কথা বলছে। যার সঙ্গে লোকটা কথা বলছে, তাকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু লোকটাকে তার চেনা মনে হচ্ছিল। একটু পরে তার মনে পড়ে যায় আজিমাবাদের সাজ্জাদ খানের কথা। তখন তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের ধ্বংসতূপের ওধারে খিড়কির দরজায় চলে যান। ওই দরজা দিয়ে জরুরি প্রয়োজনে এ বাড়ির লোকেরা বাইরে যায়। দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে। আটকানো থাকে। চাবি থাকে শাকিল মিয়াঁর কাছে। তো তালা খুলতে একটু দেরি হয়েছিল। বেরিয়ে গিয়ে লোকটাকে হনহন করে চলে যেতে দেখেন। লোকটা নরেশ সিংহের বাড়িতে গিয়ে ঢুকেছিল। যাইহোক, শাকিল মিয়াঁর বিশ্বাস তিনি তার জন্মস্থান আজিমাবাদের সেই সাজ্জাদকেই দেখেছেন। সাজ্জাদ ছিল বড়লোক বখাটে ছেলে। এখন চেহারা যণ্ডামার্কা হয়েছে। কিন্তু তবু তাকে চিনতে ভুল হয়নি তার।
বুঝলুম। কিন্তু সেই লোকটাই যে সকালে আপনাকে হুমকি দিয়েছিল তার প্রমাণ কী?
পোশাক। শাকিল মিয়াঁ বললেন, গায়ে জংলা ছাপের শার্ট আর পরনে আঁটো নীলচে প্যান্ট ছিল। কাজেই আমি বুঝতে পারলুম একই লোক। ইশ! শাকিল মিয়াঁ সকালে যদি বলতেন।
কর্নেল আবার চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন।
ক্লান্তিতে অবেলায় আমার চোখের পাতা বুজে আসছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। হালদারমশাইয়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। রহমত কফি আর স্ন্যাক্স এনেছিল। সে সেলাম ঠুকে চলে গেল। হালদারমশাই বললেন, পাঁচটা বাজে। তিন ঘণ্টা সাউন্ড স্লিপ। নাও আই অ্যাম অলরাইট।
জিজ্ঞেস করলুম, কর্নেল কি বেরিয়েছেন?
না। নবাব সাহেবের সঙ্গে পোর্টিকোর সামনে বারান্দায় কী সব ডিসকাস করতাছেন।
দুজনে চুপচাপ বসে কফি খেলুম। কিছুক্ষণ পরে শাকিল মিয়াঁ এসে আদাব দিয়ে বললেন, কর্নিলসাব ঔর ছোটে নবাবসাব বাহার গেলেন। হামাকে কর্নিলসাব বললেন, আপলোগোকো মর্জি হোনেসে আপলোগোভি ঘুমনে শ্যকে। লেকিন বহত্ হোশিয়ার রহনা পড়ে।
বললুম, আমরা বরং নদীর ধারে একটু বেড়িয়ে আসি। রহমতকে বলে আপনি কালামহলের দিকের দরজাটা খুলে দিন হালদারমশাই! প্যান্টশার্ট পরে নিন। টর্চ নিন।
শাকিল মিয়াঁ চলে গেলেন। একটু পরে আমি আর হালদারমশাই বেরোলুম। ওঁকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিলুম সঙ্গে ওঁর ফায়ার আর্মস নিয়েছেন কি না। হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, হ্যাঁ। এই ডেঞ্জারাস এরিয়ায় আর্মস ছাড়া ঘোরা যায়?
রহমত টেনিস কোর্টের পূর্বদিকে কালামহলের ধ্বংসাবশেষের পাশে ছোট দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। দরজা খুলে দিয়ে সে বলল, হাম হঁহাপর খাড়া হ্যায় স্যার! দরওয়াজামে ধাক্কা দেনেসে খুল দেগা।
পাথরের বড়-বড় চাঁইয়ের ওপর দিয়ে নেমে আমরা নদীর ধারে পৌঁছুলুম। হালদারমশাই নদী দেখে বললেন, নদীও দেখি ডেঞ্জারাস! কী ফোর্সফুল কারেন্ট জয়ন্তবাবু!
ততক্ষণে সন্ধ্যার ধূসরতা ঘনিয়েছে। নদীর ওপারে খাড়া পাহাড়। আমাদের ডানদিকে কালামহলের ধ্বংসস্তূপ সোজা দক্ষিণে নদীর সমান্তরাল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অজস্র ঝোপঝাড় গজিয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপে। হালদারমশাই দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি একটা পাথরে বসে পড়লুম।
একটু পরে হালদারমশাই হঠাৎ গুঁড়ি মেরে বসে চাপাস্বরে উত্তেজিতভাবে ডাকলেন, জয়ন্তবাবু! জয়ন্তবাবু! কাণ্ড দ্যাখছেন?
ঘুরে ওঁর দিকে তাকালুম। উনি যেদিকে লম্বাটে তর্জনী তুলেছিলেন, সেদিকে কিছু চোখে পড়ল না। তখন গুঁড়ি মেরে ওঁর কাছে গেলুম। তেমনি চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলুম, কী ব্যাপার?
প্রাইভেট ডিটেকটিভ বললেন, এইমাত্র কেউ কালোকুত্তা লইয়া জঙ্গলে ঢুকল। আর আমি ফলো করুম!
বলেই উনি গুঁড়ি মেরে পাথরের আড়ালে এগিয়ে চললেন। বরাবর দেখে আসছি, প্রাক্তন পুলিশ অফিসার হালদারমশাই কোনো ব্যাপারে গোঁ ধরলে তাকে বাধা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। এমন একটা জায়গায় সন্ধ্যার প্রাক্কালে তাঁর সঙ্গী হওয়ার সাহস আমার ছিল না। তাছাড়া উনি তো কর্নেল নীলাদ্রি সরকার নন।…
.
১০.
প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর আমি সাবধানে টর্চ জ্বেলে সেই খিড়কির দরজায় উঠে এলুম। কপাটে ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। রহমত সেলাম ঠুকে বলল, উয়ো লম্বে সাব কাঁহা গেয়া স্যর?
লম্বা সাহেবের কথাটা খুলে বললুম। শুনেই রহমত কপালে মৃদু থাপ্পড় মেরে বহত্ খতরনাক্ বলে হন্তদন্ত দৌড়ে গেল গেটের দিকে। ততক্ষণে বাড়ির বিশাল লনে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আমি দরজাটা হুড়কো দিয়ে এঁটে দিলুম। টেনিস লন পেরিয়ে গিয়ে দেখি, বন্দুক কাঁধে নিয়ে খুদা বখ্শ আসছে। আমার কাছে ঘটনাটা শুনে নিয়ে সে হেসে ফেলল। তার পিছনে রহমত এসে গিয়েছিল। খুদা বস্ হাসতে হাসতে বলল, ইয়ে বুড়বক সবকুছমে খতরনাক দেখতা। আবে! তু জানতা নেহি ইস ওয়াখত কলিম ডাগদারসাব কুত্তা লেকে নদীকি কিনারমে ঘুমতে রহে? স্যার! কলিমসাব আচ্ছা শরিফ আদমি হ্যায়। উনহিকি এক কালা বিলায়তি কুত্তা হ্যায়। উনহি মরহুম (প্রয়াত) বড়েনবাবকা ছোটো বেটা মির্জা কলিম আলি বেগ।
খুদা বখশ আমাকে আশ্বস্ত করে চলে গেল। তার বক্তব্য, ডাগদারসাব এ বাড়ির একজন অতিথিকে চা-নাস্তা খাইয়ে তবে পৌঁছে দেবেন। চিন্তার কারণ নেই।
বারান্দায় গিয়ে বেতের চেয়ারে বসলুম। খুদা বখশের কথা শুনেও মনে অস্বস্তি থেকে গেল। একটু পরে শাকিল মিয়াঁ এলেন। ঘটনাটা ইতিমধ্যে তার কানে গিয়েছিল। তিনি বললেন, খুদা বখশ ঠিক বোলা স্যার! কলিমসাব আচ্ছা আমি! মিঃ হালদারকে লিয়ে মাত শোচিয়ে। কলিমসাব ছোটেনবাবসাবকো সাথ কভি-কভি বাতচিত করতো। হি ইজ নট লাইক হিজ এল্ডার ব্রাদার সালিমসাব।
কর্নেল এবং মির্জাসাহেব গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ওঁরা যখন ফিরে এলেন, তখন সাতটা বেজে গেছে। হালদারমশাইয়ের কীর্তি শুনে কর্নেল গম্ভীর হয়ে গেলেন। মির্জাসাহেব বললেন, ডিব্বু একদিন বলেছিল, আমার ঘোড়ার জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে সে কলিমকে আমাদের কবরখানার নিচের জঙ্গলে কুকুর নিয়ে বেড়াতে দেখেছে। কলিমের একটা টেরিয়ার কুকুর আছে শুনেছি। সেটা কালো কি না জানি না। কুকুর সম্পর্কে আমার তত কিছু জ্ঞান নেই।
রহমত কফি আনল। কফি খেতে খেতে কর্নেল বললেন, মিঃ হালদারকে নিয়ে এই এক সমস্যা। উনি সবসময় বিপজ্জনক ঝুঁকি নেন। আচ্ছা মির্জাসাহেব, আপনার খুড়তুতো ভাইদের বাড়িতে কাউকে দিয়ে মিঃ হালদারের খবর নেওয়া যায় না?
তা যায়। কিন্তু এখন তো কলিমের নার্সিংহোমে থাকার কথা। ওর নার্সিংহোম সেহরাগড় টাউনের রোশনিবাগে। এখান থেকে অন্তত দশ কিলোমিটার দূরত্ব।
উনি গাড়িতে যাতায়াত করেন তাহলে?
হ্যাঁ। রহমত! খুদা বখশকে পুছকে আও। কলিকা গাড়ি উয়ো পছানতা।
রহমত তখনই গিয়ে খবর নিয়ে এল। খুদা বখশ এইমাত্র ডাগদারসাবের গাড়ি যেতে দেখেছে। কর্নেল চিন্তিত মুখে বললেন, তাহলে মিঃ হালদারের ফিরে আসা উচিত ছিল। মির্জাসাহেব! কফি খেয়ে নিন! ওঁর খোঁজে বেরুনো দরকার। বড্ড হঠকারী মানুষ।
এই সময় রহমতের মেয়ে মুন্নি এসে খবর দিল, ছোটনবাবসাহেবের টেলিফোন এসেচে। মির্জাসাহেব দ্রুত উঠে গেলেন। কর্নেল বললেন, তুমি ওঁর সঙ্গে গেলে না কেন? তোমার কাছে তো ফায়ার আর্মস আছে!
বললুম, আপনি হলে কথা ছিল। আপনি তো জানেন হালদারমশাই কেমন মানুষ! তাছাড়া কে কুকুর নিয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তা নিয়ে অহেতুক মাথাব্যথার মানে হয় না। আমি ভাবলুম, শিগগির ফিরে আসবেন।
কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে গলার ভেতর বললেন, হোপলেস! তোমার আর্মস লাইসেন্স বাতিল হওয়া উচিত। তোমার বোঝা উচিত ছিল তোমাকে কেন ফায়ার আর্মস সঙ্গে নিতে বলেছিলুম।
চুপচাপ কর্নেলের ভর্ৎসনা হজম করলুম। সত্যি আমি ভুল করেছি। কেন যে তখন অত ভয় পেলুম!
মির্জাসাহেব ফিরে এসে হাসিমুখে বললেন, সুখবর আছে কর্নেল! সুরেশ আর সাজ্জাদ ওরফে চাঁদ মিয়া হাইওয়েতে বমাল ধরা পড়েছে। চণ্ডীপুর স্টেশনের কাছে রেলওয়ে ক্রশিংয়ে অ্যান্টি-নার্কোটিক সেলের অফিসাররা এবং স্থানীয় পুলিশ নরেশজির গাড়ির বর্ণনা অনুসারে একটা গাড়িতে হানা দেন। নাম্বারপ্লেট বদলানো ছিল। গাড়ি সার্চ করে পেছনের সিটের তলায় দশ কিলোগ্রাম আফিম আর পনের কিলোগ্রাম গাঁজা পাওয়া গেছে। ওদের সেহরাগড়ে আনা হচ্ছে। ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর অর্জুন পাণ্ডে বললেন, এই সব কাঁচামাল প্রসে হয়ে নানাধরনের মাদক তৈরি হয়। সত্যিই কোটি টাকার ব্যবসা!
কর্নেল বললেন, তাহলে বলুন আমার ম্যাথমেটিকসে ভুল ছিল না!
না। আসলে গাড়িটা তো নরেশজির। তাই ভেবেছিলুম ওরা সেহরাগড়েই ট্রেনে চাপবে।
আর আমার বক্তব্য ছিল, ওরা হাইওয়ে দিয়ে গিয়ে কোথাও গাড়িটা ফেলে রেখে অন্য কোনো স্টেশনে ট্রেনে চাপবে। কারণ ওদের পক্ষে এটুকু বোঝা সহজ যে, সেহরাগড় স্টেশনে পুলিশ ওত পেতে থাকবে।
মির্জাসাহেব রাইফেলটা কাঁধে তুলে অন্য হাতে টর্চ নিয়ে বললেন, চলুন। বেরুনো যাক।
কর্নেল কিটব্যাগটা সবসময় সঙ্গে রাখেন। সেটা পিঠে এঁটে বাইনোকুলার আর ক্যামেরা গেস্টরুমে রেখে এলেন। একটু হেসে বললেন, জয়ন্ত আশাকরি এবার ভয় পাবে না। মির্জাসাহেবের রাইফেল দেখে ওর ভরসা পাওয়া উচিত।
চুপচাপ ওঁদের অনুসরণ করলাম।
গেটের বাইরে গিয়ে মির্জাসাহেব বললেন, পীরের মাজার হয়েই যাওয়া যাক।
আমরা পীরের সমাধিতে যাওয়ার রাস্তার কাছে সব পৌঁছেছি, হঠাৎ কর্নেল থমকে দাঁড়িয়ে বললেন কী আশ্চর্য! ওই তো মিঃ হালদার আসছেন।
ডানদিকে বাংলোধাঁচের বাড়িগুলো থেকে রাস্তায় আলো পড়েছে। দেখলুম, প্রাইভেট ডিটেকটিভ সবেগে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছেন। মির্জাসাহেব টর্চের আলো ফেলতেই গোয়েন্দাপ্রবর ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বরে বললেন, কেডা আলো জ্বালে? হাত গুঁড়াইয়া দিমু।
তিনি রিভলবার তাক করতেই কর্নেল সাড়া দিলেন, হালদারমশাই! অস্ত্র সম্বরণ করুন।
হালদারমশাইয়ের দাঁত ঝকমক করল। আরে কী কাণ্ড! কর্নেল স্যার নাকি?
মির্জাসাহেব ততক্ষণে টর্চের আলো নিভিয়ে বললেন, আপনি ওদিকে কোথায় গিয়েছিলেন?
রাস্তায় কথা নয় চলুন।…
মির্জাসাহেবের বাড়ি পৌঁছে বারান্দায় আবার আমরা বসলুম। হালদারমশাইয়ের জন্য এক পেয়ালা কফির ব্যবস্থা করে মির্জাসাহেব বললেন, আপনার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে খুঁজতে বেরিয়েছিলুম। ওই এরিয়া এখনও বিপজ্জনক। কারণ কালো নেকড়েটা–
বাধা দিয়ে হালদারমশাই বললেন, কুত্তা। কালো রঙের একটা লম্বাটে কুত্তা।
কর্নেল বললেন, আগে কফি খেয়ে চাঙ্গা হোন হালদারমশাই!
রহমত কাছাকাছি ছিল না। মুন্নি মাথার ওড়না চাপা দিয়ে এক পেয়ালা কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে হালদারমশাই যা বললেন তা এই
রোগাটে গড়নের এক ভদ্রলোক কালো লম্বা গড়নের একটা কুকুরের চেন ধরে একটা ফাঁকা জায়গায় কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ঝোপজঙ্গল আর পাথরের মধ্যে দিয়ে যেখানে গেলেন, সেটা একটা কবরখানা। হালদারমশাই অবাক হয়ে দেখলেন, সেখানে একটা লোক অপেক্ষা করছিল। তার পায়ের কাছে একটা মাটির কবর এবং তার হাতে একটা শাবল। ভদ্রলোক টর্চের আলো ফেললেন কবরটার ওপর। অমনি কুকুরটা কবরের খোঁড়া জায়গায় মুখ ঢুকিয়ে দিল। হালদারমশাই একটা পাথরের আড়ালে ছিলেন। প্রচণ্ড দুর্গন্ধ ভেসে আসছিল। তাই বুঝলেন, কুকুরটাকে মরা মানুষের মাংস খাওয়ানো হচ্ছে। একটু পরে কুকুরের চেন সেই লোকটার হাতে দিয়ে ভদ্রলোক জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেলেন। এবার কুকুরটা খাওয়া শেষ করে জিভ দিয়ে মুখের দুপাশে চাটতে থাকল। লোকটা কবরের মাটি ঠিকঠাক করে শাবলটা একটা ঝোপে ঢুকিয়ে রাখল। তারপর কুকুরটাকে নিয়ে সোজা নাকবরাবর দক্ষিণে হাঁটতে থাকল। তারপর অন্ধকার ঘন হলে হালদারমশাই তাদের হারিয়ে ফেললেন। দৃশ্যটা বীভৎস। হালদারমশাই এবার ডানদিকে দূরে আলো লক্ষ করে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তাটা পেয়ে যান।
কর্নেল বললেন, মির্জাসাহেব! ওদিকে কি কোনো গ্রাম আছে?
মির্জাসাহেব বললেন, আছে। কৈলাসপুর। কিন্তু এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! কলিম তার কুকুরকে মরা মানুষের মাংস খাওয়ায়? তাছাড়া একবছরের মধ্যে ওই কবরখানায় সদ্য কবর দেওয়া হয়েছে কাদের বখশকে। এর একটা ফয়সালা করা দরকার।
কর্নেল বললেন, এ মুহূর্তে ওকথা চেপে যান মির্জাসাহেব! আমাকে যা করার করতে দিন।
আশ্চর্য! মির্জাসাহেব উত্তেজিতভাবে বললেন। কলিমকে ভদ্র নিরীহ বলে জানতাম!
তার চেয়েও আশ্চর্য– হালদারমশাই চাপাস্বরে বললেন, কুত্তাটা একেবারে নেকড়ের মতো দেখতে। কর্নেল স্যার! দ্য মিস্ট্রি অব দ্য ব্ল্যা উল ইজ সলভড। কী কন?
কর্নেল হাসলেন। কনগ্রাচুলেশন হালদারমশাই! তবে আপাতত এসব কথা আর নয়।…
সে-রাতে খাওয়াদাওয়ার পর গেস্টরুমে ঢুকে কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা হালদারমশাই, কুকুরটা যখন কবর থেকে পচা মাংস খাচ্ছিল, তখন কি আপনি কুকুরটার কোনো বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছিলেন?
হালদারমশাই বললেন, তখন তো দিনের আলো আর ছিল না। তবে মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালছিল ওরা। সেই আলোয় যেটুকু দেখলাম, কুত্তাটার দাঁতগুলি বড় আর ধারালো। নখগুলিও দেখছি। সাধারণ কুত্তার নখ এত বড় হয় না। কইলাম না? কুত্তাটা য্যান কুত্তা না, নেকড়ে। গলায় বকলেস আর চেন না থাকলে ওটা কুত্তা বলিয়া মনে হইব না।
বললাম, কিন্তু একটা কুকুরকে নেকড়েতে পরিণত করার কারণ কী?
সন্ত্রাস সৃষ্টি। যাতে নির্বিবাদে কারবার চালানো যায়। বলে কর্নেল চুরুটের একরাশ ধোঁয়া ছাড়লেন। একটু পরে ফের বললেন, গত একবছর ধরে এই সন্ত্রাস চলছে। এবার মনে করে দেখ, মির্জাসাহেবের স্ত্রী এমিলি আর তার ঘোড়াটার শোচনীয় মৃত্যুর কারণ কী হতে পারে? তুমি বলেছিলে, হয়তো কালো নেকড়েটা দেখেই ঘোড়াটা ভয় গোয়ে খাদে পড়ে গিয়েছিল। কথাটা খানিকটা ঠিক। আসলে তখন ইচ্ছাকৃতভাবে ওই জন্তুটাকে টক্সিক আরক মেশানো পচা মাংস খাইয়ে পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে কেউ অপেক্ষা করছিল। তারপর এমিলি সেখানে পৌঁছুনোর সময় জন্তুটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। মির্জাসাহেবকে নিয়ে জায়গাটা দেখতে গিয়েছিলুম। এবার ঘটনাটা আমার কাছে স্পষ্ট। কুকুর-নেকড়ে বলো বা নেকড়ে-কুকুর বলো, তার আক্রমণেই ঘোড়াটা খাদে পড়ে যায়।
বললুম, তার মানে এমিলিকে হত্যার দরকার হয়েছিল।
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। যেমন কাদের বখশকে হত্যার দরকার হয়েছিল।
কিন্তু কেন?
এমিলি স্বামীর নিষেধ না মেনে সালিম বেগের ফার্মে যেতেন। এদিকে ডিব্দুর কাছে জেনেছি, সালিমের লোক মোমিন খান কাদের বখশকে মাঝে মাঝে টাকাকড়ি দিত। ডিব্বু আড়াল থেকে দেখেছিল। তার মানে, কাদের বখশের মুখ বন্ধ করতে সালিম টাকাকড়ি দিতেন। আজ শাকিল মিয়াঁ আমার জেরার চোটে কবুল করেছেন, সালিম সাহেবের ফার্মে কিছু বেআইনি কাজকারবার হয় এবং সেকথা তিনি তার দূরসম্পর্কের আত্মীয় আবিদের কথায় আঁচ করেছিলেন। আবিদ ফার্মে কাজ করে। সরল এবং ধার্মিক মানুষ শাকিল মিয়াঁ একদিন কথায় কথায় মোমিন খানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ফার্মে নাকি গোপন কাজকর্ম হয়? মোমিন খান ধূর্ত লোক। কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর শাকিল মিয়াঁকে পীরের সমাধিতে হত্যার চক্রান্ত করা হয়েছিল। কালো নেকড়ের কামড়ে তাঁর মৃত্যু হতো। এখন বুঝতে পেরেছি, পাগল তাহির খান কাউকে ওখানে গর্ত করতে দেখেছিলেন। তারপর কৌতূহলবশে তিনি গর্তটা খুঁড়ছিলেন। সেই সময় আমরা গিয়ে পড়েছিলুম। এবার বুঝতেই পারছ, শাকিল মিয়াঁ ওখানে পৌঁছানোর আগেই গর্ত খুঁড়ে পচা মাংসটা বের করা হতো। সেই গন্ধে কলিম ডাক্তারের সাংঘাতিক প্রাণীটা ছুটে আসত।
বললুম, সব বুঝতে পারছি। কিন্তু সালিম বেগের ফার্মে কী এমন গোপন কারবার হতো?
হালদারমশাই ঝিমুচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় বললেন, নার্কোটি। নিষিদ্ধ মাদক। আমার ক্লায়েন্ট কইছিল।
কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, প্রায় এগারোটা বাজে। শুয়ে পড়া যাক। জয়ন্ত হালদারমশাই! ভোর চারটেতে আমাদের উঠতে হবে।
জিজ্ঞেস করলুম, কেন?
এই রহস্যের শেষ পর্দা তোলা হবে আগামী প্রত্যূষে। গম্ভীর মুখে কথাটা বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন।….
ভোর চারটে নাগাদ কর্নেলের তাড়ায় আমাকে উঠে পড়তে হয়েছিল। মির্জাসাহেব রাইফেল কাঁধে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তখনও অন্ধকার মুছে যায়নি। হালদারমশাই উৎসাহে পা বাড়িয়ে বললেন, কুকুরটা আপনিই মারবেন। তবে তাকে খুঁজে পাবেন কি না জানি না।
আমরা খিড়কির দরজা খুলে নদীর ধারে নেমে গেলুম। শাকিল মিয়াঁ দরজাটা ভেতর থেকে আটকে দিলেন। মির্জাসাহেব আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। ঝোপজঙ্গল আর বড় বড় পাথরের মাঝখানে সাবধানে পা ফেলে আমরা হাঁটছিলুম। একবার কর্নেলকে জিজ্ঞেস করলুম, আমরা কোথায় যাচ্ছি?
কিন্তু কোনো উত্তর পেলুম না।
কিছুদূর চলার পর অন্ধকার বেশ কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে গেল। মির্জাসাহেব বললেন, ডানদিকে কৈলাসপুর। আমরা কৈলাসপুর পেরিয়ে গেলে পাহাড়ি রাস্তা পাব।
প্রায় মিনিট কুড়ি পরে পাহাড়ের কাঁধে একটা পায়ে চলা রাস্তা পাওয়া গেল। ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটেছে। চারদিকে পাখিরা ঘুমঘুম স্বরে ডাকাডাকি করছিল। ক্রমশ রাস্তাটা চড়াইয়ে এগিয়ে গেছে বলে হালদারমশাই বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। আন্দাজ শতিনেক ফুট ওঠার পর রাস্তাটা উত্রাইয়ে নেমে গেছে। এবার রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ের চূড়ার দিকে আমরা উঠছিলুম। পাহাড়ের মাথার দিকটা নগ্ন। একখানে চূড়াটা দুভাগ হয়ে গেছে। সেখানে পৌঁছে মির্জাসাহেব বললেন, কর্নেল সরকার! ওই দেখুন নিচে সালিমের ফার্মের জমি।
দিনের আলো এখন রক্তিম। কর্নেল বাইনোকুলারে ফার্মের জমি দেখতে দেখতে বললেন, যা ভেবেছিলুম। এখন হোয়াইট পপির মরশুম। ওদিকের জমিতে হেম্প বা ক্যানাবিস জাতীয় উদ্ভিদ। মির্জাসাহেব! আমার অনুমান, প্রায় নএকর জমিতে–বেশিও হতে পারে, হোয়াইট পপির চাষ করা হয়েছে। ক্যানাবিস প্রায় তিন একর জমিতে।
মির্জাসাহেব বললেন, হোয়াইট পপি? তার মানে–
আফিং। কর্নেল বাইনোকুলারে দেখতে দেখতে বললেন। আর ক্যানাবিস বলছি যাকে, তা সিদ্ধি আর গাঁজা। পুরুষ গাছগুলো থেকে সিদ্ধি পাওয়া যায়। স্ত্রী গাছগুলো থেকে গাঁজা। হালদারমশাই একটিপ নস্যি নিয়ে নিয়ে বললেন, কিন্তু কুত্তাটা গেল কই?
কর্নেল বললেন, কুকুরটা এখানে থাকে কি না বলা কঠিন। মির্জাসাহেব! আপনার খুড়তুতো ভাইদের বুদ্ধি আছে। চারদিকে আখের চাষ করে মাদকচাষের জমি ঘিরে রেখেছেন। তাছাড়া জমিগুলো ঢালু।
মির্জাসাহেব ঘড়ি দেখে বললেন, পুলিশ এখনও এসে পৌঁছুল না?
কর্নেল হাসলেন। পৌঁছে গেছে। ফার্মের গোডাউন আর অফিস গাছপালার আড়ালে পড়েছে বলে দেখতে পাচ্ছেন না। বাইনোকুলারে দেখুন। পশ্চিমদিকের পাহাড় থেকে নেমে একদল পুলিশ আখের খেতের ভেতর দিয়ে এগোচ্ছে।
মির্জাসাহেব বাইনোকুলারে দেখতে দেখতে বললেন, হ্যাঁ। ফার্মের অফিসেও–
তার কথা থেমে গেল আগ্নেয়াস্ত্রের গুলির শব্দে। হালদারমশাই নড়ে বসলেন। কুত্তাটারে গুলি করল নাকি?
তারপরেই অভাবিত ঘটনা ঘটল। ফার্মের দুজন গার্ড ছুটে এসে এই পাহাড়ের একটা খাঁজে সম্ভবত লুকোতে এসে মুখ তুলে আমাদের দেখতে পেয়েই গুলি ছুড়ল। আমাদের মাথার ওপরকার পাথরে লাগল গুলি দুটো। পাথরের টুকরো ছিটকে পড়ল। আমরা সহজাত আত্মরক্ষার প্রবৃত্তিবশে মাথা নিচু করেছিলুম। মির্জাসাহেব তার রাইফেল তুলে তাক করতেই কর্নেল বললেন, আর এখানে নয়। বাড়ি ফেরা যাক। পুলিশ অ্যাকশানে নেমেছে। আমরা যেটুকু দেখলুম, তাই যথেষ্ট। তবে এক মিনিট। ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে রেখেছি। আফিং আর সিদ্ধি-গাঁজার জমিতে এবার রোদের ছটা পড়েছে। কয়েকটা ছবি তুলে নিই।
কর্নেল উপুড় হয়ে শুয়ে কয়েকবার ক্যামেরার শাটার টিপলেন। তারপর পিছিয়ে গিয়ে সোজা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, চলুন। আর দেরি করা ঠিক নয়।
হালদারমশাই ক্ষুব্ধভাবে বললেন, হালার কুত্তাটা।…
ফেরার পথে মির্জাসাহেব বললেন, কর্নেল সরকার! চলুন! আমাদের পারিবারিক কবরখানাটা একবার দেখে যাই। কাদের বখশের কবরটা কী অবস্থায় আছে, দেখা যাক। বরং ওটা ইট দিয়ে বাঁধিয়ে দেব।
কালামহলের ধ্বংসস্তূপের কিছুটা আগে বাঁদিকে ঘুরে ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে উঁচু মাটিতে নবাবি কবরখানায় পৌঁছুলুম। সেই সময় কর্নেল চাপাস্বরে বলে উঠলেন, বেগতিক দেখে ওরা কুকুরটা ছেড়ে দিয়েছে দেখছি! গলায় শুধু বকলেস পরানো আছে।
হালদারমশাই বললেন, কৈ? কৈ?
তারপরই দেখতে পেলুম, লম্বাটে একটা কালো কুকুরের মতো জন্তুকে। জন্তুটা একলাফে নিচের ঝোপ থেকে কবরখানায় উঠল এবং দৌড়ে গিয়ে একটা মাটির কবরকে পালাক্রমে সামনেকার এবং পেছনকার পায়ে আঁচড়াতে শুরু করল। মির্জাসাহেব রাইফেল তাক করার আগেই প্রাইভেট ডিটেকটিভ তাঁর রিভলবার দুহাতে ধরে পর পর দুরাউন্ড গুলি ছুড়লেন। হিংস্র চেহারার জন্তুটা গর্জন করে শূন্যে ছিটকে গেল। সেই অবস্থায় মির্জাসাহেবের রাইফেল গুলি মুহূর্তে আরো কিছুটা তফাতে সরিয়ে দিল নিস্পন্দ জন্তুটাকে।
কর্নেল বললেন, ওটাকে ডাক্তার রায়ের কাছে পাঠাতে হবে। পুলিশকেও জানাতে হবে।
হালদারমশাই দৌড়ে গেলেন। মির্জাসাহেব তাঁকে বললেন, মিঃ হালদার! কবরখানায় জুতো খুলে রেখে ঢুকতে হয়।
সরি! বলে জুতো খুলে রেখে হালদারমশাই লেজ ধরে রক্তাক্ত জন্তুটাকে টেনে নিচে ফেলে দিলেন। তারপর জুতো পরে আবার তার লেজ ধরে টানতে টানতে নিয়ে চললেন। এবার মির্জাসাহেবের নির্দেশে আমরা পীরের সমাধির পাশ দিয়ে সদর রাস্তায় পৌঁছলুম। গুলির শব্দ শুনে বড় নবাববাড়ি থেকে কয়েকজন লোক বেরিয়ে এসেছিল। তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। হালদারমশাই জন্তুটার লেজ ধরে সবিক্রমে টানতে টানতে শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্যে আবার চাপা গর্জন করলেন, হালার কুত্তা!….
Leave a Reply