জে ডি স্যালিনজারের দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই (১৯৫১) প্রকাশের পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং বিতর্কের জন্ম দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক স্কুলে নিষিদ্ধ (১৯৬১-১৯৮২) থাকলেও বহু স্কুলে বইটি ছিল পাঠ্য। উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল প্রাপ্তবয়স্ক পাঠকের জন্য। কিন্তু কিশোর দ্রোহ, একাকিত্ব ও মনস্তত্ত্বের অকপট দলিল হিসেবে কিশোরকিশোরীদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। অশালীন ভাষা, যৌনতা এবং মাদকবিষয়ক বিবরণের জন্য এই বই আদালতের কাঠগড়ায় ওঠে। বিশ্বব্যাপী এখনও বিভিন্ন ভাষায় প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কপি বিক্রি হয় । ২০০৫ সালে দ্য টাইমস-এর করা ইংরেজি ভাষার শ্রেষ্ঠ একশ উপন্যাসের তালিকায় ছিল বইটির নাম । এ উপন্যাসের পাঠ যেকোনো পাঠকের জন্য চমৎকার অভিজ্ঞতা ।
দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – জে ডি সালিঞ্জার
অনুবাদ – রাফায়েত রহমান রাতুল

অধ্যায় ১
আমার ব্যাপারে যদি শুনতে চান, তাহলে হয়তো প্রথমেই জানতে চাইবেন আমি কোথায় জন্মেছিলাম, আমার বিদঘুটে শৈশব কেমন ছিল এবং আমার জন্মের আগে আমার বাবা-মা অন্য কিছু নিয়ে কতটা ব্যস্ত ছিল এবং হাবিজাবি জাতীয় আরো নানাকিছু। তবে যদি সত্যটা জানতে চান, তাহলে আমার এসবের কিছুই বলার ইচ্ছা নেই। প্রথমত, ঐ ব্যাপারগুলোকে আমার প্রচণ্ড বিরক্তিকর মনে হয়, আর দ্বিতীয়ত আমার বাবা-মা যদি তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কিছু বলতে শুনে তাহলে প্রচণ্ড ক্ষেপে যাবে। ওসব বিষয় নিয়ে তারা খুবই স্পর্শকাতর, অভিমানী। আমার বাবা একটু বেশিই অভিমানী। এটা বলবো না যে তারা মানুষ হিসেবে ভালো না, তবে তারা প্রচণ্ড অভিমানী। আর তাছাড়া আমিও আপনাদেরকে আমার অটোবায়োগ্রাফি বা এমন কিছু শোনাতে যাচ্ছি না। আমি শুধু গত ক্রিসমাসে আমার সাথে ঘটা কিছু গোলমেলে ব্যাপার নিয়ে—যেটার কারণেই আমাকে শান্ত হওয়ার জন্য এখানে আসা লেগেছে। ডি.বি.কে আমি সবসময়ই এটার ব্যাপারে বলি, হাজার হোক সে আমার ভাই। ডি.বি. হলিউডে কাজ করে। আমার এই বাজে জায়গাটা থেকে হলিউড খুব একটা দূরে না । প্রতি সপ্তাহেই ডি.বি. আমাকে দেখতে আসে। সম্ভবত আগামী মাসে বাসায় যাওয়ার সময় সে-ই আমাকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে। মাত্রই একটা জাগুয়ার কিনেছে ও। হলিউডের কাজ করেই সে ঘণ্টায় দুইশো মাইল গতিতে চলতে পারা গাড়িটা কিনেছে । এটা কিনতে তার খরচ হয়ে চার হাজার ডলার। তার এখন অনেক টাকা হয়েছে। আগে কিন্তু এতো পয়সা-কড়ি ছিল না। বাসায় থাকার সময় সে ছিল সাধারণ এক লেখক মাত্র। সাধারণ না, বেশ ভালো লেখকই বলা যায়। কিছু ছোটো গল্প নিয়ে খুব সুন্দর একটা বই লিখেছিল। দ্য সিক্রেট গোল্ডফিশ, বইটার নাম হয়তো শুনে থাকতে পারেন। ‘দ্য সিক্রেট গোল্ডফিশ’ই ছিল বইটির সেরা গল্প। গল্পটি ছিল এক বাচ্চাকে নিয়ে, যে কখনো তার গোল্ডফিশ কাউকে দেখতে দিতো না, কারণ সে ওটা তার নিজের টাকা দিয়ে কিনেছিল । গল্পটি আমার খুবই ভালো লেগেছিল । আর এখন সে কাজ করে হলিউডের ‘পতিতা’ লেখক হিসেবে। আমি যদি কোনো কিছু একদম ঘৃণা করে থাকি, তাহলে সেটা হলো সিনেমা। আমার সামনে কখনো ওটার নামও নেবেন না কেউ ।
যাই হোক, আমি যেদিন পেন্সি প্রেপ ছাড়লাম সেদিন থেকে বলা শুরু করছি। পেন্সি প্রেপ হচ্ছে অ্যাগারস্টাউন, পেনসিলভেনিয়ার একটি স্কুল। অনেকে হয়তো নাম শুনেছেন স্কুলটার। নয়তো অ্যাডে দেখেছেন। প্রায় হাজারটা ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন দেয় এই স্কুল। প্রতিটা বিজ্ঞাপনেই দেখা যায়, সুঠাম দেহের এক লোক ফেন্সের ওপর দিয়ে ঘোড়া নিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে । অর্থটা এমন যেন পেন্সিতে পুরোটা সময়ই পোলো খেলা যায়। আর বিজ্ঞাপনগুলোতে ঘোড়াওয়ালা লোকটার নিচে লেখা থাকে, ‘১৮৮৮ সাল থেকেই আমরা বাচ্চা ছেলেদেরকে চিত্তাকর্ষক ও পরিষ্কার-মস্তিষ্ক বিশিষ্ট যুবকে রূপান্তরিত করে আসছি।’ তবে আমি কখনো ঐ এলাকার কোনো জায়গায় একটা ঘোড়াও দেখিনি, পোলো খেলা তো পরের কথা। আর তারা অন্যান্য আরো বিভিন্ন স্কুল থেকে খুব একটা বেশি পরিমাণ রূপান্তরিতও করে না। সত্যি বলতে আমি পেন্সিতে চিত্তাকর্ষক এবং পরিষ্কার-মনের কাউকে দেখিনি। হয়তো দুইজন আছে, বেশি হলে। তবে তারাও এখানে এসে হয়নি বলেই আমার ধারণা, সম্ভবত তারা এভাবেই এসেছিল এখানে।
যাই হোক, ঐদিন ছিল শনিবার। স্যাক্সন হলের সাথে ফুটবল খেলা ছিল পেন্সির। পেন্সিতে সবসময় স্যাক্সন হলের সাথে খেলাটাকে খুব বড়ো কিছু বলে ধরা হয়। ঐ খেলাটা ছিল বছরের শেষ খেলা। যদি পেন্সি ঐ ম্যাচ না জিতে তাহলে হয়তো অনেকে আত্মহত্যাও করে বসতে পারে। আমার মনে আছে ঐদিন বিকাল তিনটার দিকে আমি থমসেন হিলের চূড়ায় থাকা বিপ্লবী যুদ্ধের এক বিদঘুটে ক্যাননের পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। ওখান থেকে পুরোটা মাঠই দেখা যায়। দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠে দুই দলের খেলোয়াড়েরা একে-অন্যের সাথে বুনো লড়াইয়ে মেতে আছে। তবে গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে চোখে পড়ার মতো কিছু ছিল না, কিন্তু ওখান থেকে পেন্সির পক্ষে প্রচুর চিয়ার আর স্যাক্সন হলকে দেওয়া প্রচুর দুয়োর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এটাই স্বাভাবিক, কারণ আমি ছাড়া স্কুলের সবাই ঐদিন গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে ছিল আর সফরকারী দল কখনো সাথে করে খুব বেশি সমর্থক নিয়ে আসে না ।
ফুটবল খেলাগুলোতে কখনোই খুব বেশি মেয়ের উপস্থিতি দেখা যায় না। শুধুমাত্র সিনিয়ররাই সাথে করে মেয়ে নিয়ে আসতে পারতো। যে দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা হোক না কেন, পেন্সি ছিল খুবই বাজে একটা স্কুল। খেলার ফাঁকে ফাঁকে আমি অন্তত অল্প কয়েকজন হলেও মেয়ের উপস্থিতি দেখতে পছন্দ করি। খেলার ওপর তাদের মনোযোগ থাকুক বা না থাকুক, অন্তত উপস্থিত থাকলেই হয়। তারা খেলা দেখতে এসে অযথাই হাত নাড়ুক বা নাক ঝাড়ুক বা বোকার মতো ফিকফিক করে হাসুক না কেন, তাতে আমার আপত্তি নেই। স্কুলের হেডমাস্টারের মেয়ে সেলমা থার্মার মাঝেমধ্যেই কিছু খেলা দেখতে আসে। যদিও সেলমা যথেষ্ট সুন্দরী, তবে আকাঙ্খায় পাগল করে দেওয়ার মতো মেয়ে না ও। অ্যাগারস্টাউন থেকে আসার সময় একবার বাসে তার পাশে বসেছিলাম আমি। কথাও বলেছিলাম। ওকে আমার ভালো লাগে। তার নাকটা বেশ বড়ো, সবসময় দাঁত দিয়ে নখ কামড়ানোর ফলে নখগুলো রক্তাক্ত হয়ে থাকে আর কৃত্রিম স্তনজোড়ায় বুক সবসময়ই উঁচু হয়ে থাকে। তবে তাকে দেখলে একটু দুঃখই লাগে আমার। তার ব্যাপারে আমার যেটা সবচেয়ে বেশি লাগে সেটা হলো—সে কখনোই তার বাবা কত মহৎ মানুষ সেটা বুঝানোর চেষ্টা করে না। সম্ভবত সে জানে তার বাবা একজন জালিয়াত ।
আমি ঐদিন গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডে সবার সাথে থাকার বদলে থমসেন হিলে দাঁড়িয়েছিলাম, কারণ মাত্রই পেন্সিং দলের সাথে নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসেছি। পেন্সিং দলের ম্যানেজার ছিলাম আমি। খুবই বড়ো ব্যাপার এটা। আমরা নিউইয়র্কে গিয়েছিলাম ম্যাকবার্নি স্কুলের সাথে পেন্সিং ম্যাচ খেলার জন্য। তবে খেলতে পারিনি। কারণ যাওয়ার সময় সাবওয়েতে আমি পেন্সিং’র সব সরঞ্জাম ফেলে গিয়েছিলাম। অবশ্য পুরো দোষটা আমার না। আমরা গিয়ে কোথায় নামবো সেটার জন্য আমাকে বারবারই ম্যাপ দেখতে হচ্ছিল, তাই সরঞ্জামের প্রতি কোনো খেয়াল ছিল না। সেজন্যই ডিনারের সময়ের বদলে পেন্সিতে আমাদেরকে আড়াইটায় ফিরে আসতে হয়েছে। ফিরে আসার পথে ট্রেনে পুরোটা সময়ই আমাকে একঘরে রেখেছিল। অবশ্য একদিক থেকে ভাবলে ব্যাপারটা বেশ মজার ছিল।
তবে মাঠে না নামার আরেকটা কারণও ছিল । ঐসময় আমি আমার ইতিহাস শিক্ষক মি. স্পেন্সারকে বিদায় জানাতে যাচ্ছিলাম । লোকটার ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল, আর আমারও মনে হচ্ছিল ক্রিসমাস ভ্যাকেশন শুরু হওয়ার আগে হয়তো তাঁর সাথে আমার আর দেখা হবে না। তিনি আমাকে নোট লিখে জানিয়েছিলেন যে আমি যেন বাড়ি যাওয়ার আগে তাঁর সাথে একবার দেখা করে যাই । তিনি জানতেন আমি আর পেন্সিতে ফিরে আসবো না ।
ওহ, বলতে ভুলেই গিয়েছিলাম। স্কুল থেকে আমাকে বের করে দিয়েছে তারা। ক্রিসমাসের ছুটির পর আমাকে আর এখানে ফিরে না আসতে বলে দেওয়া হয়েছে। কারণ আমি চারটা সাবজেক্টে পাশ করার কোনো শর্তই পূরণ করতে পারিনি এবং কোনো ক্লাসেই অ্যাপ্লাই করিনি। তারা আমাকে অনেকবারই সতর্কতা দিয়েছে ক্লাসে অ্যাপ্লাই করার জন্য, বিশেষ করে মিডটার্মের দিকে তো আরো বেশি করে দিয়েছে। এমনকি হেডমাস্টার থার্মারের সাথে কথা বলার জন্য আমার বাবা-মাকেও ডেকে আনা হয়েছিল তখন। কিন্তু আমি অ্যাপ্লাই করিনি। তাই তারা আমাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করে দিয়েছে। পেন্সিতে প্রায়ই ছাত্রদেরকে বহিষ্কার করা হয়। পেন্সির শিক্ষাগত নিয়মকানুন খুব কড়া এবং রেটিংও বেশ ভালো তাদের।
যাই হোক, তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। দিনটাও ছিল প্রচুর ঠান্ডা। বিশেষ করে বিদঘুটে হিলটার ওপরে ঠান্ডা ছিল আরোও অনেক বেশি। আমার পরনেও তেমন ভারী পোশাক ছিল না, হাতে গ্লাভসও না। ঐদিনের এক সপ্তাহ আগেই কে যেন আমার রুম থেকে উটের পশমে তৈরি কোট চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল, পশমের গ্লাভসগুলোও ছিল কোটের পকেটে। পেন্সিতে প্রচুর হারামি রয়েছে। পেন্সিতে আসা অনেকেই বেশ ধনী-বনেদি পরিবারের, কিন্তু হারামির কোনো অভাব নেই ওখানে। স্কুল যত ব্যয়বহুল হয়, সেখানে হারামির সংখ্যাও বেশি হয়—মজা করছি না, কথাটা আসলেই সত্য । যাই হোক, কনকনে ঠান্ডায় বিদঘুটে ক্যাননের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের মাঠের খেলা দেখছিলাম আমি । তবে খেলার প্রতি কোনো মনোযোগ ছিল না । আমি আসলে ওখানে দাঁড়িয়েছিলাম বিদায়ের কোনো একটা সুখস্মৃতি পাওয়ার জন্য। মানে আমি আগেও অনেক স্কুল-জায়গা ছেড়েছি, তবে কোনোবারই জানতাম না যে আমি এগুলো ছেড়ে যাচ্ছি। আসলে স্মৃতিটা দুঃখময় হোক বা খারাপ হোক, যেটাই হোক না কেন—তা নিয়েও আমার কোনো মাথাব্যথা নেই । একটা জায়গা ছেড়ে যাওয়ার সময় আমি শুধু এটাই জানতে চাই যে আমি জায়গাটা ছেড়ে যাচ্ছি। যদি এটা জানা না থাকে, তাহলে খারাপটাও অনেক বেশি লাগে ।
অধ্যায় ২
তাদের দুইজনেরই আলাদা আলাদা রুম আছে । দুইজনের বয়সই সত্তরের মতো, আরো বেশিও হতে পারে। অনেক কিছুই উপভোগ করেছেন তাদের জীবনে, যদিও অবশ্যই খুব একটা ভালো করে তা করতে পারেননি। কথাটা শুনতে খারাপ মনে হলেও আমি আসলে খারাপ কিছু বুঝাইনি । শুধু বলছি যে আমি এই বৃদ্ধ স্পেন্সারকে অনেকটা সময় ভেবেছি, আর লোকটাকে নিয়ে যদি কেউ অতিরিক্ত ভেবে থাকে—তাহলে মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে, লোকটা এখনো বেঁচে আছে কিসের জন্য । মানে বলতে চাচ্ছি, লোকটা কুঁজো হয়ে গেছে, শিরদাঁড়ার অবস্থা খুবই খারাপ। ক্লাসে বোর্ডে লেখার সময় হাত থেকে চক পড়ে গেলেও সেটা তুলতে পারেন না তিনি। সবসময়ই সামনের সারিতে থাকা কারো উঠে চকটা তাঁর হাতে তুলে দিতে হয়। আমার মতে এরকম জীবন তো খুবই জঘন্য জীবন। তবে লোকটাকে নিয়ে যদি কেউ অতিরিক্ত না ভেবে যথেষ্ট পরিমাণ ভাবে, তাহলে বুঝতে পারবে লোকটার জীবন আসলে খুব একটা খারাপ নয়। উদাহরণস্বরূপ, এক রবিবার আমি আর স্কুলের কয়েকজন মিলে উনার বাসায় হট চকলেট খেতে গিয়েছিলাম। ঐদিন মি. স্পেন্সার আমাদেরকে একটা পুরোনো ছেঁড়া নাভাজো কম্বল দেখিয়ে বলেছিলেন, কম্বলটা নাকি তিনি আর মিসেস স্পেন্সার মিলে ইয়েলোস্টোন পার্কের এক ইন্ডিয়ানের থেকে কিনেছেন । কথাগুলো বলার সময় তাঁর চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে তিনি এই কম্বলটা কিনে খুবই তৃপ্ত হয়েছেন। হ্যাঁ, আমি এটাই বুঝাতে চাচ্ছি। কাউকে দেখে হয়তো মি. স্পেন্সারের মতো অনেক বয়স্ক মনে হতে পারে কিংবা মনে হতে পারে লোকটা এখনো বেঁচে আছে কিসের আশায়, সেই মানুষগুলোর আশাও কিন্তু আসলে খুব অল্পই থাকে, একটা ছেঁড়াফাঁটা কম্বল পাওয়াতেই সে পরিতৃপ্ত হয়ে যেতে পারে ।
মি. স্পেন্সারের দরজাটা খোলাই ছিল, তারপরও ভদ্রতার খাতিরে দরজায় টোকা দিলাম। দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম যে তিনি একটা বড়ো চামড়ার চেয়ারে বসে আছেন। শরীর মুড়িয়ে রেখেছেন একটু আগেই বলা ঐ কম্বলটা দিয়ে। টোকার শব্দ শুনে বসা অবস্থাতেই চোখ তুলে তাকালেন দরজার দিকে । ‘কে ওখানে?’ চেঁচিয়ে বললেন। ‘ওহ, কলফিল্ড? আসো, আসো, ভেতরে আসো।’ তিনি আসলে সবসময়ই চেঁচিয়ে কথা বলেন । ক্লাসেও, ক্লাসের বাইরেও। চেঁচানোটা অনেকটা ভড়কেও দেয় তাঁর শ্রোতাদেরকে।
রুমের ভেতরে ঢুকেই মনে হলো আমার ওখানে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। ঢুকতেই প্রচণ্ড খারাপ লাগা শুরু করল আমার। অসুস্থ মানুষের প্রতি আমার কোনো সমস্যা ছিল না। তবে রুমের অবস্থাটা ছিল খুবই খারাপ। মি. স্পেন্সার চেয়ারে বসে আঁলান্টিক মান্থলির একটা কপি পড়ছিলেন। ওষুধ-বড়ি ছড়িয়ে ছিল পুরো রুমে জুড়ে, বাতাসে ভাসছিল শুধু নাকের ড্রপের গন্ধ । খুবই বিষণ্নকর এক অবস্থা। মি. স্পেন্সারের পরনে ছিল খুবই পুরোনো, মলিন একটা বাথরোব । কে জানে জন্মের পর তাঁকে ঐ বাথরোবেই মোড়ানো হয়েছিল কী না। বয়স্ক লোকদেরকে রোবে দেখতে আমার অতটা ভালো লাগে না। রোবে তাদের জীর্ণশীর্ণ বুক আর পা সবসময়ই উন্মুক্ত হয়ে থাকে। বিচে এবং অন্যান্য কিছু জায়গায় দেখেছি, বৃদ্ধ লোকদের পা খুব বেশি ফ্যাঁকাশে আর অ-লোমশ হয়। দেখতে খুবই বিশ্রি লাগে ।
‘হ্যালো, স্যার,’ বললাম। ‘আপনার নোটটা পেয়েছি। ধন্যবাদ, স্যার।’ তিনি আমাকে একটা নোটে লিখে জানিয়েছিলেন আমি যেন ছুটি শুরুর আগে উনার সাথে একবার দেখা করে যাই। ‘আপনার নোট পাঠানোর দরকার ছিল না। আমি নিজেই এসে আপনার সাথে দেখা করে যেতাম।’
‘বসো ওখানে,’ বললেন মি. স্পেন্সার। ওখানে বলতে তিনি বিছানাকে বুঝিয়েছেন ।
বিছানায় বসলাম। পাথরের মতো শক্ত। ‘আপনার অসুখের কী অবস্থা, স্যার?”
‘মাইবয়, আমার যদি আরেকটু বেশি ভালো লাগে, তাহলে হয়তো আমি ডাক্তারের জন্য ডাক পাঠাবো,’ বলে পাগলের মতো খুক খুক কর হাসতে শুরু করলেন বৃদ্ধ স্পেন্সার। অসুখে আসলে তাঁর মানসিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ হাসার পর নিজেকে আবার স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন, ‘তুমি খেলার মাঠে নেই কেন? আমি তো জানতাম আজকে বড়ো খেলাটা হওয়ার কথা।’
‘হ্যাঁ, স্যার খেলাটা আজই হচ্ছে। আমিও ওখানেই ছিলাম। মাত্রই পেন্সিং টিম সাথে করে নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসেছি,’ বললাম।
‘তো, তুমি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো, না?’ সিরিয়াস কণ্ঠে বললেন মি. স্পেন্সার। আমি জানতাম যে তিনি সিরিয়াস হবেনই একসময়।
‘হ্যাঁ, স্যার। তাই তো মনে হয়।’
শুনে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলেন তিনি। আমি আমার জীবনে কাউকে কখনো এতো বেশি মাথা ঝাঁকাতে দেখিনি। দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিনি কি মাথা ঝাঁকিয়ে কোনো কিছু ভাবছেন, নাকি তিনি মাথা ঝাঁকানো থামাতে ভুলে গেছেন ।
‘ড. থার্মার তোমাকে কী বলেছে? যতদূর জানি তোমার সাথে তাঁর কথে পিকথন হয়েছে।’
‘হ্যাঁ, স্যার। আসলেই আমাদের কথা হয়েছে । প্রায় দুই ঘণ্টার মতো উনার অফিসে ছিলাম আমি।’
‘কী বলেছে তোমাকে লোকটা?’
‘তেমন কিছু না… বলেছে জীবন আসলে একটা খেলার মতো। আর এই খেলাটা খেলতে হয় সব নিয়মকানুন অনুসরণ করে। খুব ভালোভাবেই কথা বলেছেন তিনি। মানে তিনি আসলে উত্তেজিত হয়ে বা রাগান্বিত গলায় কিছু বলেননি । তিনি শুধু ‘জীবন একটা খেলা’ এটা নিয়েই বলে গেছেন।’
‘জীবন আসলেই একটা খেলার মতো, বাছা। আর এই খেলাটা খেলতে হয় সব নিয়ম মেনেই।’
‘হ্যাঁ, স্যার। আমি জানি এটা, আমি জানি।’
ধুর, খেলা না ছাই। তামাশার খেলা আমার। যদি গুরুত্বপূর্ণ-নামিদামী মানুষদের দলে কেউ থাকে, তাহলে এটা আসলেই একটা খেলা—আমি মানি সেটা । তবে কেউ যদি অন্য দলটাতে থাকে, যেটাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ-নামিদামী মানুষরা না থাকে, তাহলে এখানে খেলার আছেটাই বা কী? কিছুই না । কোনো খেলাও না ।
দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – জে ডি স্যালিনজার
অনুবাদ – নুসরৎ নওরিন

জে ডি স্যালিনজার : পুরো নাম জেরোম ডেভিড স্যালিনজার। জন্ম ১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে। বাবা লিথুনিয়ান বংশোদ্ভূত সল স্যালিনজার ছিলেন পনির ও মাংস আমদানিকারক। মা মিরিয়াম স্যালিনজার। বাবা ইহুদি এবং মা ক্রিশ্চিয়ান ৷ ক্যাচার ইন দ্য রাই প্রকাশের আগে স্যালিনজারের লেখা ছোটগল্প, নভেলাগুলো সংকলিত হয়েছে নাইন স্টোরিজ, ফ্র্যানি অ্যান্ড জোয়ি, রেইজ হাই দ্য রুফ বিম, কার্পেন্টার্স অ্যান্ড সিমোর : অ্যান ইন্ট্রোডাকশন ইত্যাদি গ্রন্থে । একমাত্র উপন্যাস দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই স্যালিনজারকে এনে দেয় প্রবাদপ্রতিম জনপ্রিয়তা, যা তাঁর কাছে ছিল চরম অস্বস্তির। ফলে নিউ ইয়র্ক থেকে বহু দূরে নিউ হ্যাম্পশায়ারের কর্নিশে অরণ্যময় এক পাহাড়ের কোলে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান তিনি। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় সেখানেই কাটান ।
নুসরৎ নওরিন : গল্প লেখেন, অনুবাদ করেন। পড়ালেখা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে । বর্তমানে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ঢাকার আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে। অনুবাদ করেছেন ওরিয়ানা ফাল্লাচির উপন্যাস লেটার টু এ চাইল্ড নেভার বর্ন (বাতিঘর ২০২১)।
ভূমিকা
জে ডি স্যালিনজারের দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলের ৩১৯ নম্বর রুমে বসে একদিন বইটা পড়তে শুরু করি। লেখকের নাম আগে শুনিনি। পড়া শুরু করার পর ছোটবেলার মতো একটা জাদুকরি ঘটনা ঘটে । অনেক দিন পর ক্লাস, খাওয়া, গোসল বাদ দিয়ে বইটা পড়তে থাকি। এর আগে হোল্ডেন কলফিল্ডের মতো কোনো চরিত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। অনেকেই হয়তো হোল্ডেনের মতো ভাবে, কিন্তু স্যালিনজার যেভাবে তা লেখায় তুলে এনেছেন সেটা অসাধারণ। ঘোরের মধ্যে পড়া শেষ করে স্যালিনজারের আরও উপন্যাস খুঁজতে গিয়ে জানতে পারি তাঁর আর কোনো উপন্যাস নেই ।
এটা প্রায় এক যুগ আগের কথা। এত দিন পর সেই মুগ্ধতার কাছে আবার কীভাবে ফিরে গেলাম, তা বলার আগে বইটি সম্পর্কে কিছু বিষয় জেনে নেওয়া যাক ।
১৯৫১ সালের ১৬ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের লিটল, ব্রাউন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই প্রকাশিত হয়। প্রকাশের পরপর বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, জন্ম দেয় বিতর্কের একটি কিশোর চরিত্রের ভাবনা, ক্ষোভ ও বিচ্ছিন্নতাবোধকে এমন বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রকাশের মুনশিয়ানা দিয়ে স্যালিনজার।
অধ্যায় ১
তুমি কি সত্যিই আমার গল্পটা শুনতে চাও? তাহলে হয়তো শুরুতেই জানতে চাইবে আমি কোথায় জন্মেছি, আমার ফালতু শৈশবটা কেমন কেটেছে, আমার বাবা-মা কী করত—এই সব। এসব ডেভিড কপারফিল্ড মার্কা আবর্জনায় আমার কোনো আগ্রহ নেই। আর তা ছাড়া, আমার বাবা-মা খুবই অভিমানী টাইপের । আমি বলছি না যে তারা খুব অসাধারণ মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে তাদের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বললে দুজনেরই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে। আর আমিও তো আত্মজীবনী বলতে বসিনি। ওসব ফালতু গল্পে আমার মোটেও আগ্রহ নেই ।
আমি শুধু গত ক্রিসমাসের কিছু ঘটনা বলব। উদ্ভট কিছু কাণ্ডকারখানা হয়েছিল আমার সঙ্গে। একদম মাথা নষ্ট করা। ওই সময়ই আমি এই বিশ্রী জায়গায় এলাম। আসতে হলো সবকিছুকে সহজভাবে নেওয়ার জন্য।
এখন যা বলব তার সবই আমি ডিবিকে বলেছি। ডিবি আমার ভাই । হলিউডে আছে। এখান থেকে বেশি দূরে না জায়গাটা। সে প্রতি সপ্তাহে গাড়ি চালিয়ে আমাকে দেখতে আসে। একদম নিয়ম মেনে। আগামী মাসে হয়তো আমাকে নিয়ে যাবে। কিছুদিন আগে সে একটা জাগুয়ার কিনেছে। চার হাজার ডলার দাম। জিনিসটা ঘণ্টায় দুশ মাইল চলে । ডিবির এখন অনেক টাকাপয়সা। আগে অন্য লেখকদের মতোই তার তেমন টাকাপয়সা ছিল না।
ডিবিকে চিনতে পারছ? এখনো না চিনলে বলি, ও একটা মারাত্মক বই লিখেছে। দ্য সিক্রেট গোল্ডফিশ। এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর গল্পটা এক বাচ্চা আর তার গোল্ডফিশ নিয়ে। বাচ্চাটা কাউকে ওই মাছ দেখতে দেয় না। কারণ, ওটা তার নিজের টাকায় কেনা। মারাত্মক গল্প । ডিবি অবশ্য এখন নিজেকে বেচে দিয়েছে। সিনেমা আমার একেবারে অসহ্য লাগে । আমার সামনে কখনো সিনেমার কথা মুখেও আনবে না।
আমার কাহিনির শুরু যেদিন পেন্সি প্রেপারেটরি ছেড়ে এলাম সেদিন । আমার সর্বশেষ স্কুল। পেনসিলভানিয়ার এগারসটাউনে। হয়তো নাম শুনেছ। কারণ ওরা হাজার হাজার বিজ্ঞাপন দেয়। ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠায় চকচকে একজন লোককে দেখা যায়। লোকটা ঘোড়ায় চড়ে পোলো খেলছে। ছবির নিচে লেখা, ‘সেই ১৮৮৮ সাল থেকে আমরা ছাত্রদের অসাধারণ, বিশুদ্ধ চিন্তার তরুণ হিসেবে গড়ে তুলছি।’ দেখলে তোমার মনে হবে পেন্সির ছাত্ররা সারা জীবন শুধু পোলো খেলে। কিন্তু আমি পেন্সির ত্রিসীমানায় কখনো কোনো ঘোড়া দেখিনি। ওই কথাটা একদম ধাপ্পাবাজি। অন্য কোনো স্কুল থেকে পেন্সি মোটেও আলাদা কিছু না । অসাধারণ, বিশুদ্ধ চিন্তার তরুণ ওখানে কোথায়? বড়জোর দুজন পাওয়া যাবে। দুজনই ওদের কাছে অনেক। খুঁজলে দেখা যাবে ওই দুজনও পেন্সিতে এসে অসাধারণ হয়নি, আগে থেকেই ও রকম ছিল ।
যা বলছিলাম। দিনটা ছিল শনিবার। আমাদের সঙ্গে স্যাক্সন হলের ফুটবল খেলা। আমাদের স্কুলে এটা একটা বিরাট ঘটনা। একেবারে জীবন-মরণ ব্যাপার। তার ওপর বছরের শেষ খেলা। অবস্থা এমন যে পেন্সি হেরে গেলে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা টাইপের কিছু করে ফেলা উচিত। তো, তখন বেলা তিনটা। আমি টমসেন হিলের ওপর দাঁড়িয়ে আছি । যুদ্ধকামানটার পাশে। ওখান থেকে পুরো মাঠ দেখা যায় । এক দল আরেক দলকে কীভাবে তুলোধুনো করছে সব। গ্যালারির ছাউনির জন্য দর্শকদের ভালোমতো দেখতে না পেলেও পেন্সি সমর্থকদের জোরালো চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম। অন্যদিকে স্যাক্সন সমর্থকদের চিৎকারে মনে হচ্ছিল কেউ মিনমিন করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। তারা ভিজিটিং টিম। তেমন কোনো সমর্থক সঙ্গে আনেনি ।
এসব খেলায় মেয়েদের তেমন দেখা যায় না। কারণ শুধু সিনিয়ররাই
অধ্যায় ২
মি. এবং মিসেস স্পেন্সারের সব আলাদা, ঘরটর সব। দুজনের বয়সই সত্তরের কাছাকাছি। বেশিও হতে পারে। জীবনটাকে যথেষ্ট উপভোগ করেছেন তারা। তবে সেটা খুব সূক্ষ্মদাগে নয়। মোটা দাগে। কথাটা শুনলে মনে হতে পারে আমি ছোটলোকদের মতো চিন্তাভাবনা করি । তবে আমি সে অর্থে বলিনি। আসলে আমি মি. স্পেন্সারকে নিয়ে বেশ চিন্তা করতাম। আর তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে হতো লোকটা এখনো বেঁচে আছে কী জন্য! বয়সের ভারে কুঁজো, শরীর বেঁকে গেছে। ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে গেলেই হাত থেকে চক পড়ে যায়। সামনে থেকে কোনো ছাত্র গিয়ে চকটা তুলে দেয়। ভয়ংকর ব্যাপার । তবু ওনার বিষয়টা ভাবলে বুঝতে পারতে উনি খুব একটা খারাপ জীবন কাটাচ্ছিলেন না ।
এক রোববারের কথা বলি । আমরা কয়েকজন তার বাসায় হট চকলেট খেতে গিয়েছি। তিনি আমাদের একটা ন্যাভাহো কম্বল দেখালেন। কম্বলটা পুরোনো, জরাজীর্ণ। ইয়েলোস্টোন পার্কে এক ইন্ডিয়ানের কাছ থেকে কিনেছেন। মি. স্পেন্সারকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তিনি অসম্ভব খুশি। এটাই বলতে চেয়েছি। স্পেন্সারের মতো এ রকম যেকোনো থুথুড়ে বুড়োর কথা ধরো । দেখবে তুচ্ছ একটা কম্বল কিনেই তার আনন্দের সীমা নেই ।
স্পেন্সারের রুমের দরজা খোলা। তার পরও ভদ্রতা করে কড়া নাড়লাম। চামড়া মোড়ানো একটা বড় চেয়ারে তিনি বসে ছিলেন। গায়ে ন্যাভাহো কম্বলটা জড়ানো। আমার দিকে তাকিয়ে তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘কে? ও, কলফিল্ড? এসো, এসো।’
সব জায়গায় চিৎকার করা তার অভ্যাস। সেটা ক্লাসরুম কিংবা যেখানেই হোক । মাঝেমধ্যে মেজাজ খুব খারাপ হয় ।
তার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটা ব্যাপার হলো। ওখানে যাওয়ার জন্য হঠাৎ আমার খুব আফসোস হলো। মি. স্পেন্সারের হাতে মাসিক আটলান্টিক ম্যাগাজিন। সারা ঘরে পিল আর ওষুধ ছড়ানো-ছিটানো 1 সবকিছুতে ভিক্স নোজ ড্রপের গন্ধ। মন খারাপের জন্য এই পরিবেশ যথেষ্ট। তা ছাড়া অসুস্থ মানুষের প্রতি আমার যে খুব দরদ আছে তা না। মি. স্পেন্সারের গায়ে একটা পুরোনো বাথরোব। সেটার অবস্থা শোচনীয়। পুরো পরিবেশকে মিইয়ে দিতে বাথরোবটাই যথেষ্ট। দেখে মনে হয় মি. স্পেন্সারের জন্মই হয়েছে ওটার মধ্যে। তা ছাড়া বাথরোব, পায়জামা পরা বৃদ্ধদের দেখা খুব একটা সুখকর না। তাদের শুকনা, হাড় জিরজিরে বুক বাইরে বেরিয়ে থাকে। সমুদ্রসৈকত থেকে শুরু করে সব জায়গায় এদের দেখা যায় ছিলা মুরগির মতো লোমহীন, ফর্সা পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বললাম, ‘হ্যালো, স্যার। আপনার চিরকুট পেয়েছি। থ্যাংকস আ লট, স্যার। চিরকুট না দিলেও হতো। আমি এমনিতেই দেখা করতে আসতাম।’
‘বসো।’
বসার জন্য বিছানা ছাড়া আর কিছু নেই । সেখানেই বসলাম । বললাম, ‘আপনার জ্বরের অবস্থা কেমন? ভালো, স্যার?’
‘আমি আছি সেই রকম। শোনো বাবা, ডাক্তারও কিচ্ছু করতে পারবে না,’ এ কথা বলে স্পেন্সার নিজের কথায় নিজেই মজা পেয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলেন। একসময় সেই পাগলের মতো হাসি বন্ধ হলো। বললেন, ‘খেলা দেখতে যাওনি কেন? আমি তো জানতাম বড় খেলাটা আজই ৷
‘হ্যাঁ, আজই । দেখতে গিয়েছিলাম। আসলে ফেন্সিং টিমের সঙ্গে নিউ ইয়র্ক থেকে ফিরলাম তো।’
আমি পাথরের মতো শক্ত বিছানাটায় বসে আছি। দেখি মি. স্পেন্সার বেশ গম্ভীর হয়ে যেতে শুরু করেছেন। আমি জানতাম এ রকম হবে।
অধ্যায় ৩
আমি ভয়ংকর মিথ্যাবাদী। এত বড় মিথ্যাবাদী তুমি জীবনেও দেখোনি । ধরো, আমি ম্যাগাজিন কিনতে দোকানে যাব। তখন যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় যাচ্ছ?’ আমি অবশ্যই বলব, ‘অপেরা শুনতে যাচ্ছি।’ খুবই বাজে অভ্যাস । মি. স্পেন্সারকে যখন বললাম, ‘জিমে যাচ্ছি’, তখন আসলে ডাহা মিথ্যে বলেছিলাম । আমি জিমে কখনোই কিছু রাখতাম না ।
আমি থাকতাম পেন্সির নতুন ডরমিটরি, অসেনবার্গার মেমোরিয়াল উইংয়ে। ওখানে সিনিয়র আর জুনিয়ররা একসঙ্গে থাকে। আমি জুনিয়র আর আমার রুমমেট সিনিয়র। আমাদের এই উইংয়ের নাম দেওয়া হয়েছিল এখানকার প্রাক্তন ছাত্র অসেনবার্গারের নামে। কারণ সে স্কুলের পেছনে অনেক টাকা ঢেলেছিল। পেন্সি থেকে বের হওয়ার পর সে ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা কামায়। ব্যবসাটা হলো মরা মানুষকে সাজিয়ে-গুছিয়ে কফিন এবং কবরের ব্যবস্থা করা, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান এই সব। তার ব্যবসার খুব প্রসার, সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। জনপ্রতি পাঁচ ডলার দিলে সে তোমার বাড়ির সবার কবরের ব্যবস্থা করে দেবে। তোমাকে কিছুই করতে হবে না, শুধু কষ্ট করে মরতে হবে। আর অসেনবার্গারকে দেখলে বুঝবে তার কবর দেওয়ার ব্যবস্থাটা কেমন। আমার ধারণা, ব্যবস্থা একটাই। লাশগুলো বস্তায় ভরে নদীতে ফেলে দেওয়া। যা-ই হোক, অসেনবার্গারের টাকা ঢালার কারণে উইংটা তার নামে করা হয় ।
বছরের প্রথম ফুটবল গেমে অসেনবার্গার ক্যাডিলাকে চড়ে এল । গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে আমাদের তাকে অভিবাদন জানাতে হলো। ট্রেনের স্টিম ইঞ্জিন যেমন আস্তে আস্তে চালু হয়ে গতি বাড়াতে থাকে সেই রকম মৌখিক অভিবাদন। প্রথমে ধীরে ধীরে, তারপর দ্রুত। যা-ই হোক, পরদিন সকালে অসেনবার্গার আমাদের চ্যাপেলে একটা বক্তব্য রাখল। বক্তব্যটা দিতে সে মাত্র ঘণ্টা দশেক সময় নিল। শুরুতেই মান্ধাতার আমলের গোটা পঞ্চাশ কৌতুক বলল। সে বোঝাতে চাচ্ছিল, ‘দেখো, কী স্বতঃস্ফূর্ত, সাবলীল আমি!’ তারপর বলল সে সব রকম বিপদে- আপদে হাঁটু গেড়ে নির্দ্বিধায় ঈশ্বরের সাহায্য চায়। আমাদেরও সব সময় যে অবস্থায় থাকি না কেন ঈশ্বরের সাহায্য চাওয়া উচিত, যিশুকে বন্ধু ভাবা উচিত ইত্যাদি ইত্যাদি। সে নাকি গাড়ি চালাতে চালাতেও যিশুর সঙ্গে কথা বলে । মনে মনে দেখতে পাচ্ছিলাম দুই নম্বর ভণ্ডটা গাড়ি ফার্স্ট গিয়ারে নিতে নিতে বলছে, ‘যিশু, আমাকে লাশ দাও। আরও কয়েকটা লাশ দাও।’
অসেনবার্গার যখন নিজের বিষয়ে বড় বড় কথা বলছে—সে কত দক্ষ, অসাধারণ ইত্যাদি ইত্যাদি—ঠিক তখন একটা দারুণ ঘটনা ঘটল । সামনের সারিতে বসা এডগার মাসালা বিকট শব্দে একটা পাদ দিল। আরেকটু হলে ছাদটা উড়ে যেত। চ্যাপেলের মতো পবিত্র জায়গায় নিঃসন্দেহে নিষ্ঠুর কাজ। তবে ঘটনাটা খুব মজার । কেউ অবশ্য শব্দ করে হাসল না। আর অসেনবার্গার এমন একটা ভাব ধরল যেন কিছুই শুনতে পায়নি। কিন্তু মঞ্চে হেডমাস্টার থার্মারসহ সবাই শুনেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই। থার্মার খুব আহত হলেন। পরদিন আমাদের একাডেমিক বিল্ডিংয়ে আসতে বলা হলো। সেখানে থার্মার যে বক্তব্য দিলেন তার সারমর্ম হলো, যে ছেলে চ্যাপেলের মতো জায়গায় এই ধরনের কাজ করতে পারে সে পেন্সিতে পড়ার অযোগ্য। বক্তব্যের মাঝখানে আমরা মার্সালাকে দিয়ে আরেকটা পাদ দেওয়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু মার্সালার সেদিন ঠিক মুড ছিল না। কিছু জিনিসের জন্য মুড লাগে । এই হলো অসেনবার্গার কাহিনি ।
মি. স্পেন্সারের ওখান থেকে সোজা ডর্মে ফিরে গেলাম । সবাই খেলা দেখতে গিয়েছে। রুম হিটার চালানো। চারদিকে আরামদায়ক উষ্ণতা। কোট, টাই, কলারের বোতাম খুলে আমার নতুন হান্টিং হ্যাট মাথায়
Leave a Reply