দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ১৬

অধ্যায় ষোলো

নাস্তা করে বেরিয়ে দেখি তখন প্রায় দুপুর হওয়া শুরু করেছে। স্যালির সাথে দেখা করতে তখনো বেশ লম্বা সময় বাকি ছিল। তাই হাঁটতে শুরু করলাম। কোনোভাবেই ঐ দুই নানের কথা মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। শুধু ভাবছিলাম পুরোনো রুক্ষ খড়ের ঝুড়িতে করে তাদের টাকা সংগ্ৰহ করার ব্যাপারটা। কল্পনা করছিলাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সামনে এরকম পুরোনো খড়ের ঝুড়ি হাতে তাদের জায়গায় টাকা সংগ্রহ করছে আমার মা বা আমার আন্টি বা স্যালি হায়েসের মা। দৃশ্যটা কল্পনা করা বেশ কঠিন ছিল। আমার মায়ের ক্ষেত্রে দৃশ্যটা কঠিন ছিল না, তবে অন্য দুজনের ক্ষেত্রে খুবই কঠিন ছিল। আমার আন্টি অবশ্য যথেষ্ট দানশীল মহিলা। প্রায়ই রেডক্রসসহ নানান দাতব্য প্রতিষ্ঠানেই সাহায্য করে আন্টি। তবে দান করার সময় আন্টি সবসময়ই খুব দামি পোশাক, কড়া লিপস্টিকসহ প্রচুর মেক-আপ করে যায়। সেজন্যই লিপস্টিক ছাড়া কালো একটা পোশাকে আন্টিকে ঝুড়ি হাতে টাকা সংগ্রহের চিন্তা করাটা বেশ কঠিনই। আর স্যালি হায়েসের মায়ের কথা কী বলবো! খোদা! ঐ মহিলা ঝুড়ি হাতে টাকা সংগ্রহের জন্য একমাত্র তখনই দাঁড়াবে, যখন টাকা ঝুড়িতে দেওয়ার সময় সবাই তার হাতে চুমু খেয়ে যাবে। যদি শুধু ঝুড়িতে টাকা রেখে মহিলাকে এড়িয়ে চলে যায়, তাহলে ঐ মহিলা ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই ঐ কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। বিরক্ত হয়ে ঝুড়ি ফেলে চলে যাবে কোনো বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করার জন্য। ঐ নানদের এই ব্যাপারটাই বেশি ভালো লেগেছিল। তাদের দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে তারা কখনোই বিলাসবহুল লাঞ্চ করেনি। এটা ভেবে আমার আবার প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল যে তারা কখনোই ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে উচ্চদামী লাঞ্চ করতে পারবে না। আমি জানি এটা তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, তারপরও খুব খারাপ লাগছিল আমার।

ব্রডওয়ের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। অনেক বছর ধরে ওদিকে যাওয়া হয়নি আমার। তাছাড়া রবিবার খোলা থাকে এমন একটা রেকর্ডের দোকানও খুঁজছিলাম। ফিবিকে ‘লিটল শার্লি বিনস’ নামের রেকর্ড দেওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার। এই রেকর্ডটা পাওয়া খুবই কঠিন ব্যাপার। রেকর্ডটা ছিল একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে যে বাসা থেকে বেরুতে চাইতো না, কারণ তার সামনের পাটির দুটো দাঁত ছিল না এবং এটার জন্য বাচ্চাটা খুব লজ্জিত ছিল। পেন্সিতে থাকতে এটা শুনেছিলাম। আমার পাশের ফ্লোরেই থাকা একটা ছেলের কাছে এই রেকর্ডটা ছিল। ঐ ছেলেটার কাছ থেকে ঐ রেকর্ডটা কিনতেও চেয়েছিলাম ফিবির জন্য। আমি জানতাম যে এই রেকর্ডটা ফিবিকে প্রচণ্ড খুশি করবে। কিন্তু ছেলেটা রেকর্ডটা বিক্রি করেনি। রেকর্ডটা প্রায় বিশ বছর আগের। এস্টেল ফ্লেচার নামের অশ্বেতাঙ্গ শিল্পী গেয়েছিল গানটা। গানটা সে গেয়েছে ডিক্সিল্যান্ড মানে হট জ্যাজ মিউজিকের ধাঁচে এবং এটাতে আবেগপ্রবণতারও অতটা প্রভাব ছিল না। যদি এই গানটা কোনো শ্বেতাঙ্গ মেয়ে গাইতো, তাহলে সেটা শুনতে খুব কিউট শোনাতো। কিন্তু এস্টেল ফ্লেচার জানতো সে কী করছে, এবং এটা আমার শোনা সেরা রেকর্ডগুলোর একটি। আমি ভাবছিলাম রবিবার যদি কোনো খোলা দোকানে এই রেকর্ডটা পাই, তাহলে ওটা কিনে নিয়ে পার্কে চলে যাবো। প্রায় রবিবারেই ফিবি পার্কে রোলারস্কেট করতে আসে। সে কোন কোন জায়গায় বেশি সময় কাটায় সেটাও জানি আমি।

দিনটা আগের দিনের মতো অতটা ঠান্ডা ছিল না, তবে তখনো সূর্য ভালো করে উঠেনি। আর দিনটা হাঁটার জন্য খুব একটা ভালোও ছিল না। তবে রাস্তায় মন ভালো করার মতো একটা উপাদান ছিল। আমার ঠিক সামনে দিয়েই বাবা, মা এবং ছয় বছর বয়সী বাচ্চা ছেলের একটা পরিবার হেঁটে যাচ্ছিল। তাদেরকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে তারা কোনো চার্চ থেকে বেরিয়ে এসেছে। যদিও তাদেরকে দেখে দরিদ্র পরিবার মনে হচ্ছিল। ছেলেটার বাবা মাথায় একটা ধূসর টুপি পরে রেখেছিল। গরীব লোকরা নিজেদের কেতাদুরস্ত ধনী দেখানোর জন্য সাধারণত এসব টুপিই পরে। লোকটা তার স্ত্রীর সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে যাচ্ছিল। ছেলেটার ওপর তাদের কারোরই কোনো নজর ছিল না। বাচ্চাটা অবশ্য খুব ভালো ছিল। সাইডওয়াকের বদলে রাস্তা ধরে হাঁটছিল ছেলেটা। তবে সাইডওয়াক থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। সাইডওয়াকের পাশে থাকা বর্ডার লাইনটা ধরে হাঁটছিল ও। বাচ্চারা যেমনভাবে হাঁটে আর কী। আর হেঁটে যাওয়ার সময় পুরোটা রাস্তা জুড়েই গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে যাচ্ছিল ছেলেটা। ‘ইফ অ্যা বডি ক্যাচ অ্যা বডি কামিং থ্রু দ্য রাই,’ এই গানটা গাচ্ছিল। ছেলেটার কণ্ঠটাও বেশ মিষ্টি ছিল। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল সে খুব আনন্দ নিয়ে গানটা গাচ্ছিল। গাড়ি পাশ কেঁটে যাচ্ছিল, রাস্তায় অনবরত ব্রেকের ক্যাচক্যাচ শব্দ ছিল—তারপরও ছেলেটার দিকে তার বাবা-মায়ের কোনো নজর ছিল না। তবে ছেলেটার তা নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে। সে তার মতো করেই সোৎসাহে ‘ইফ অ্যা বডি ক্যাচ অ্যা বডি কামিং থ্রু দ্য রাই’ গাইতে গাইতে যাচ্ছিল। ব্যাপারটা বেশ ভালো লেগেছিল আমার। এক উষ্ণতায় মন ভরে উঠেছিল। ঐ গানটা শোনার পর থেকে হতাশাও অনেকটা কেঁটে গিয়েছিল আমার।

ব্রডওয়েতে ঐদিন প্রচুর ভীড় ছিল। দিনটা ছিল রবিবার, ঘড়িতে তখন বাজে মাত্র দুপুর বারোটার মতো কিন্তু ভীড়ের কোনো কমতি ছিল না তাতে। সবাইই ওখানে এসেছিল দেখতে। প্যারামাউন্ট, অ্যাস্টর, স্ট্র্যান্ড, ক্যাপিটাল সবগুলোই ছিল লোকে লোকারণ্য। রবিবার বলে প্রত্যেকেই আবার ভালো পোশাকও পরে এসেছিল। খুবই একটা বাজে ব্যাপার। তবে ওটার থেকেও বাজে ব্যাপারটা হলো ওরা প্রত্যেকেই প্রস্তুতি নিয়ে মুভি দেখতে এসেছে। যখন সময় কাটানোর কিছু থাকে না, তখন মুভি দেখতে আসাটা মানা যায়। তবে কেউ যখন নিজ ইচ্ছায় প্রস্তুতি নিয়ে মুভি দেখতে আসে তখন সেটা সহ্য করা খুবই কঠিন। বিশেষ করে মিলিয়নখানেক মানুষের লম্বা লাইনে ব্লক আটকে ধৈর্য্য ধরে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটার দৃশ্যটা সহ্য করা প্রায় অসম্ভব। ব্রডওয়েতে যাওয়ার জন্য আর তর সইছিল না আমার। অবশ্য আমার কপাল বেশ ভালোই ছিল। প্রথম দোকানটাতেই ‘লিটল শার্লি বিনস’-এর রেকর্ড পেয়ে গিয়েছিলাম। যদিও দুষ্প্রাপ্য রেকর্ড হওয়ায় দোকানি ওটার জন্য দাম চেয়েছিল পাঁচ ডলার। তবে তাতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। রেকর্ডটা কিনে হটাৎই খুব আনন্দ লাগা শুরু করল আমার। পার্কে গিয়ে ফিবিকে রেকর্ডটা দেওয়ার জন্য আর তর সইছিল না।

রেকর্ডের দোকান থেকে বেরিয়েই দেখি সামনে একটা ড্রাগস্টোর। ভাবলাম ওখানে জেনকে একটা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করবো ছুটিতে সে বাসায় এসেছে কি না। স্টোরের ভেতরে ফোন দিলাম জেনের বাসায়। তবে ফোন ধরেছিল জেনের মা, তাই কোনো কথা না বলেই কেঁটে দিলাম ফোনটা। ঐ মহিলার সাথে লম্বা আলাপে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা ছিল না আমার। তাছাড়া আমার মেয়েদের মায়ের সাথে কথা বলতে খুব একটা ভালোও লাগতো না। তবে অন্ততপক্ষে জেন বাসায় এসেছে কি না সেটা জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল। এটা জিজ্ঞেস করলে কোনো ক্ষতি হতো না। তবে কেন যেন জিজ্ঞেস করতেও ইচ্ছা করছিল না। আসলে মুড না থাকলে ওসব কিছুর আগ্রহ পাওয়া যায় না।

আমার তখনও টিকিট কেনা বাকি ছিল, তাই একটা পত্রিকা কিনে দেখে নিলাম কী কী শো চলছে। রবিবার ছিল বলে ঐদিন তিনটা শো চলছিল মাত্র। তাই আমি ‘আই নো মাই লাভ’র অর্কেস্ট্রাল সিটের দুটো টিকিট কিনে নিলাম। যদিও আমার ওটা দেখায় খুব একটা আগ্রহ ছিল না, তবে জানতাম যে কৃত্রিমতার রাণী স্যালি ঠিকই ওগুলো পছন্দ করবে কারণ ওটাতে লান্টসরা রয়েছে। হয়তো টিকিট দেখানোর পর তার মুখ থেকে লালাও ঝরা শুরু করতে পারে। যাই হোক, সত্যি বলতে আমার আসলে কোনো শো-ই তেমন একটা ভালো লাগে না। শোগুলো মুভির মতো অতটা খারাপ না, তবে খুব একটা ভালো লাগার মতোও কিছু না। প্রথমত, অভিনেতাদের ঘৃণা করি। তারা কখনোই মানুষের মতো আচরণ করে না। তারা শুধু ভাবে যে তারা মানুষের মতো আচরণ করতে পারে। অবশ্য বেশ কিছু ভালো অভিনেতারা মাঝেমধ্যে বাস্তবতা ফুটিয়ে তুলতে পারে, তবে সেটা দেখতেও খুব একটা বেশি ভালো আগে না। আর যদি কোনো অভিনেতা ভালোও হয়ে থাকে, তাহলে তাকে দেখেই বুঝা যায় যে সে জানে সে ভালো অভিনেতা, আর এটাই অভিনয়টাকে নষ্ট করে দেয়। স্যার লরেন্স অলিভিয়েরের কথাই ধরা যাক। গত বছর হ্যামলেট-এ লোকটার অভিনয় দেখেছিলাম। আমার ভাই ডি.বি. আমাকে আর ফিবিকে হ্যামলেট দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। এর আগে সে আমাদের লাঞ্চ করিয়েছিল, তারপর নিয়ে গিয়েছিল শোতে। সে আগেও দেখেছিল শোটা। আর লাঞ্চের সময় সে যেভাবে ওটার বর্ণনা করছিল তাতে শো’টা দেখার জন্য আমার আগ্রহ প্রচুর বেড়ে গিয়েছিল। তবে শো’টা আমি খুব একটা উপভোগ করতে পারিনি। আমি আসলে বুঝতেই পারছিলাম না যে স্যার লরেন্স অলিভিয়ের কেনো অতটা বিখ্যাত! হ্যাঁ, লোকটার কণ্ঠস্বর খুবই ভালো এবং দেখতেও খুব সুদর্শন ছিল, এমনকি তাকে হাঁটতে বা লড়াই করতে দেখতেও খুব ভালো লাগতো। তবে ডি.বি. যেরকম বর্ণনা করেছিল, হ্যামলেট হিসেবে লোকটা আসলে খুব একটা ভালো ছিল না। তাকে দেখতে দুঃখী, ভাঙাচোড়া একজনের বদলে অনেকটা জেনারেলের মতো লাগে। পুরো ছবিতে একমাত্র ভালো লাগার জায়গা হলো যখন ওফেলিয়ার ভাইকে—যার সাথে শেষ অংশ হ্যামলেট লড়াই করে—বিদায়ের সময় যখন তার বাবা অনেকগুলো উপদেশ দেয়। যখন তার বাবা ভাইকে উপদেশ দিচ্ছিল, তখন ওফেলিয়া তার ভাইয়ের সাথে খেলায় ব্যস্ত ছিল। হোলস্টার থেকে ড্যাগার বের করে আনছিল, তার ভাইকে ক্ষেপাচ্ছিল—কিন্তু তার বাবা কী বলছে তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহও ছিল ওর। দৃশ্যটা বেশ ভালো ছিল। প্রচুর হাসি পেয়েছিল আমার দৃশ্যটা দেখে। তবে এমন দৃশ্য তো আর খুব একটা বেশি দেখা যায় না। ফিবির শুধু হ্যামলেটের কুকুরের মাথায় হাত বুলানোর দৃশ্যটাই বেশি ভালো লেগেছিল। তার কাছে ঐ দৃশ্যটা বেশি সুন্দর ও মজার মনে হয়েছিল। যাই হোক, শো-তে বসে আমাকে ঐ নাটকটা পড়তে হবে আর কী। সমস্যাটা হলো কোনো নাটকে গেলে সবসময়ই আমার নিজেকে ওটা পড়া লাগে। যদি অভিনেতারা অভিনয় করে দেখানোর চেষ্টাও করে, তারপরও আমি সেটায় মনোযোগ রাখতে পারি না। সবসময়ই একটা দুঃশ্চিন্তা থাকে যে তারা হয়তো যেকোনো সময় কোনো ধাপ্পাবাজি করে বসতে পারে।

লান্টস’র শো’র টিকিট কেনার পর ক্যাবে করে পার্কে গেলাম। আমার আসলে সাবওয়েতে উঠা উচিৎ ছিল, কারণ পকেটের টাকার পরিমাণ কমে আসছিল। তবে আমার তখন শুধু ইচ্ছা করছিল যত দ্রুত সম্ভব ব্রডওয়ে থেকে দূরে সরে যেতে।

পার্কটা খুবই ফালতু ছিল। দিনটা অতটা ঠান্ডা ছিল না, সূর্য তখনো উঠেনি পার্কটাতে কুকুরের বর্জ্য, বুড়োদের সিগারেটের উচ্ছিষ্টাংশ, এখানে সেখানে থুতু ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বেঞ্চগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যে ওগুলোতে বসলে শরীর ভিজে যাবে। খুবই হতাশাজনক দৃশ্য, আর অবস্থা আরো খারাপ করার জন্য হাঁটার সময় কিছুক্ষণ পরপরই কাঁটা দিয়ে উঠছিল শরীরে। পার্কটা দেখে বুঝার উপায়ই ছিল না যে কয়েকদিন পরই ক্রিসমাস। এমনকি সামনে কোনো ছোটোখাটো উৎসব আছে বলেও মনে হচ্ছিল না। যাই হোক, তারপরও পার্ক ধরে হেঁটে মলের দিকে যাওয়া শুরু করলাম। ফিবি পার্কে এলে সাধারণত ওখানেই যায় বেশির ভাগ সময়। ব্যান্ডস্ট্যান্ডের কাছে স্কেট পছন্দ করে ও। ব্যাপারটা বেশ মজার। ছোটোবেলায় আমিও ওখানে স্কেট করতে যেতাম।

যদিও ওখানে গিয়ে কোথাও ফিবির দেখা পাওয়া গেল না। বেশ কিছু বাচ্চা স্কেট করছিল, দুটো ছেলে সফট বল দিয়ে খেলছিল, তবে ফিবি ছিল না কোথাও। তার বয়সী একটা মেয়েকে দেখলাম বেঞ্চে বসে তার স্কেটগুলো শক্ত করে বাঁধার চেষ্টা করছে। ভাবলাম সে হয়তো ফিবির পরিচিত হতে পারে, সে হয়তো বলতে পারবে ফিবি কোথায় আছে। তাই বেঞ্চে তার পাশে গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কি ফিবি কলফিল্ডকে চেনো?’

‘কে?’ সে বলল। মেয়েটার পরনে একটা জিন্স আর বিশটার মতো সোয়েটার ছিল। সোয়েটারটা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে ওটা তার মা তাকে বানিয়ে দিয়েছে। পোশাকটা প্রচুর ঢোলা তার জন্য।

‘ফিবি কলফিল্ড। সেভেন্টি-ফার্স্ট স্ট্রিটে থাকে। পড়ে ফোর্থ গ্রেডে—’

‘তুমি ফিবিকে চেনো?

‘হ্যাঁ, আমি তার ভাই। তুমি কি জানো সে কোথায় আছে?’

‘সে তো মিস ক্যালোনের ক্লাসের, তাই না?’ মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।

‘জানি না ঠিক। মনে হয়।’

‘তাহলে হয়তো মিউজিয়ামে আছে। গত শনিবার মিউজিয়ামে গিয়েছিলাম আমারা,’ জবাব দিলো বাচ্চা মেয়েটা।

‘কোন মিউজিয়ামে?’ জিজ্ঞেস করলাম।

অনিশ্চিত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো মেয়েটা। ‘আমি জানি না,’ বলল ও। ‘মিউজিয়াম তো মিউজিয়ামই।’

‘আমি জানি, তবে সে কোনটায় গেছে? যেটাতে ছবি আছে সেটায়, নাকি যেটাতে ইন্ডিয়ানরা আছে ওটায়?’

‘যেটাতে ইন্ডিয়ানরা আছে ওটায়।’

‘অনেক ধন্যবাদ,’ বলে পা বাড়ানো শুরু করেছিলাম তখনই হঠাৎই মনে পড়লো যে ঐদিন তো রবিবার। ‘আজকে তো রবিবার,’ বললাম বাচ্চাটাকে।

শুনে মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। বলল, ‘ওহ, তাহলে সে ওখানে নেই।’

স্কেটটা বাঁধতে প্রচুর সময় লাগছিল। মেয়েটার হাতে কোনো গ্লাভসও ছিল না। ঠান্ডায় হাতগুলো একদম লাল হয়ে গিয়েছিল। এটা দেখে আমিই তার স্কেটটা বেঁধে দিলাম। অনেক বছর স্কেটে হাত লাগাইনি। তারপরও ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল না। স্কেটে আমার এতোই ঝোঁক ছিল যে পঞ্চাশ বছর পরও স্কেটে হাত দিলে বলতে পারবো যে স্কেটটা কীভাবে বাঁধা লাগবে। এমনকি ঘুটঘুটে অন্ধকারেও কোনো সমস্যা হবে না আমার। যাই হোক, স্কেট বেঁধে দেওয়ায় আমাকে ধন্যবাদ জানালো মেয়েটা। মেয়েটা খুবই শান্ত ও ভদ্র ছিল। শান্ত ও ভদ্র বাচ্চাদের খুবই ভালো লাগে আমার। বেশির ভাগ বাচ্চারাই এমন হয়। আসলেই। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে আমার সাথে বসে হট চকলেট বা এমন কিছু খাবে কি না। মেয়েটা মানা করেছিল। বলেছিল এক বন্ধুর সাথে ওখানে দেখা করবে ও। বাচ্চারা সবসময়ই তাদের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে পছন্দ করে। ব্যাপারটা খুবই ভালো লাগে আমার।

যদিও রবিবারে ফিবির কোনো মিউজিয়ামের ক্লাসে থাকার কথা ছিল না আর বাইরের পরিবেশটাও ছিল প্রচুর স্যাঁতস্যাঁতে, তারপরও পার্ক ধরে মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রির দিকে পা বাড়ালাম। স্কেটের ঐ মেয়েটা এই মিউজিয়ামের কথাই বুঝিয়েছিল। ঐ মিউজিয়ামটা আমি হাতের উল্টো পিঠের মতো চিনি। ফিবি যে স্কুলে পড়তো, আমিও ছোটোবেলায় ঐ স্কুলেই পড়তাম। ওখান থেকে প্রায়ই ন্যাচারাল হিস্ট্রির মিউজিয়ামটায় যেতাম। আমাদের শিক্ষিকা মিস অ্যাইগেল্টিঙ্গার প্রায় প্রতি শনিবারেই ওখানে নিয়ে যেত আমাদের। মাঝেমধ্যে আমরা বুনো প্রাণী দেখতে যেতাম, মাঝেমধ্যে যেতাম প্রাচীন সময় ইন্ডিয়ানদের বানানো বিভিন্ন সামগ্রী যেমন মাটির বাসন, খড়ের ঝুড়ি দেখতে। ওসবের কথা ভাবলে সবসময়ই মন খুশি হয়ে যেত আমার। এমনকি এখনো। আমার মনে আছে ইন্ডিয়ানদের সামগ্রী দেখার পর আমার বেশির ভাগ সময়ই বিশাল অডিটোরিয়ামে মুভি দেখতাম। কলাম্বাসের মুভি। ওটাতে সবসময়ই কলাম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার, জাহাজ কেনার জন্য ফার্ডিনান্দ ও ইসাবেলার কলাম্বাসকে টাকা দেওয়া এবং তার সাথে নাবিকদের বিশ্বাসঘাতকতার দৃশ্যগুলো দেখানো হতো। যদিও কেউই কলাম্বাসের দিকে অতটা মনোযোগ দিতো না, তবে অডিটোরিয়ামে গেলে সবসময়ই হাত ভর্তি ক্যান্ডি, গাম, চকলেট পাওয়া যেত। আর অডিটোরিয়ামের ভেতরের ঘ্রাণটাও ছিল খুব সুন্দর। ঘ্রাণটা শুঁকে মনে হতো বাইরে হয়তো বৃষ্টি পড়ছে, এমনকি বৃষ্টি না পড়লেও ঘ্রাণটা একই রকম থাকত। মিউজিয়ামটা প্রচুর পছন্দ করতাম। আমার মনে আছে অডিটোরিয়ামে যেতে হলে ইন্ডিয়ান রুমটা পেরিয়ে যাওয়া লাগতো। রুমটা ছিল অনেক লম্বা। রুমটা পেরিয়ে যাওয়ার সময় কথাও বলা লাগতো ফিসফিস করে। শিক্ষকরা থাকত সবার সামনে, আর পিছনে থাকত ক্লাসের ছাত্ররা। ছাত্রদের যাওয়া লাগতো দুই সারি বেঁধে, আর সবার সাথে একজন করে পার্টনার থাকত। বেশির ভাগ সময়ই আমার পার্টনার হতো গারট্রুড লিভাইন নামের একটা মেয়ে। মেয়েটা সবসময়ই হাতে হাত ধরে রাখতে চাইতো, আর তার হাতগুলো সবসময়ই ঘেমে আঠালো হয়ে থাকত। মিউজিয়ামের মেঝেটা পুরো নিরেট পাথরের। কেউ ঐ মেঝেতে মার্বেল ছুড়ে মারলে মার্বেলটা এতো জোরে বাউন্স করত আর এতো কটকটে শব্দ করে উঠতো যে শিক্ষকরা পুরো ক্লাসকে থামিয়ে দেখতে আসতো কী হয়েছে। এরপর পেরিয়ে যাওয়া লাগতো ইন্ডিয়ানদের বিশাল বিশাল লম্বা এক রণতরী। সারিবদ্ধভাবে রাখা তিনটা ক্যাডিলাক গাড়ির সমান লম্বা ঐ রণতরীটা। ওটাতে প্রায় বিশজনের মতো ইন্ডিয়ান ছিল। কেউ কেউ বৈঠা বাইছিল, কেউ দাঁড়িয়েছিল মুখে রুক্ষ ভাব ফুঁটিয়ে আর বাকিরা দাঁড়িয়ে শুধু তাকিয়ে চারপাশ দেখছিল। তাদের প্রত্যেকের রং মাখানো ছিল, যুদ্ধের রং। বজরার পিছনের মুখোশ পরা বিশাল ভয়ঙ্কর একটা লোকও ছিল। ইন্ডিয়ানদের ওঝা ছিল লোকটা। লোকটাকে দেখলেই ভয় লাগতো আমার, তারপরও লোকটাকে অনেক পছন্দ করতাম। আরেকটা বিষয় হলো, হেঁটে যাওয়ার সময় কেউ যদি নৌকার বৈঠা বা কোনো কিছু স্পর্শ করত, তখন গার্ডদের একজন বলে উঠতো, ‘বাচ্চারা, এখানের কিছুতে হাত দিয়ো না।’ তবে লোকটা কথাটা বলত খুবই মৃদুভাবে, পুলিশের মতো কড়া গলায় কিছু বলত না। রণতরীর পরে ছিল বিশাল একটা কাচের বাক্স। বাক্সটার ভেতরে থাকা ইন্ডিয়ানদের কয়েকজন কাঠিতে কাঠি ঘষছিল আগুন জ্বালানোর জন্য, সেই সাথে কম্বল বুনন করা এক ইন্ডিয়ান মহিলাও ছিল। কম্বল বুনন করা ঐ মহিলাটা কিছুটা কুঁজো হয়ে থাকায় মহিলার বুকের অনেকটাই উন্মুক্ত হয়েছিল। আমরা সবাই ঐ বুক দেখার জন্য উঁকিঝুঁকি করতাম। এমনকি মেয়েরাও করত। ঐসময়টায় আমরা সবাইই বাচ্চা ছিলাম, আর তখন মেয়েদের বুকও আমাদের মতোই ছিল। যাই হোক, অডিটোরিয়ামে ঢোকার দরজার পাশেই ছিল তুষারাবৃত হ্রদের ধারে বসে মাছ ধরতে থাকা একটা এস্কিমো। ওই এস্কিমোর পাশে তার আগে ধরে রাখা দুটো মাছও ছিল। মিউজিয়ামের পুরোটা জুড়েই প্রচুর কাঁচের বাক্স ছিল। ওপরতলায় কাঁচের বাক্সের সংখ্যা আরো বেশি ছিল। ওপরতলায় ছিল পানির ফোয়ারা থেকে পানি খেতে থাকা একটা হরিণ আর শীতের সময় দক্ষিণে উড়ে যাওয়া অনেক পাখি। নিকটবর্তী তারে ঝুলানো পাখিগুলো ছিল স্টাফ করা আর পিছনের দিকের পাখিগুলো ছিল দেওয়ালে আঁকা। তবে তারা সবাইই উড়ে যাচ্ছিল দক্ষিণের দিকে। যদি কেউ মাথা কাৎ করে পাখিগুলোর দিকে তাকায় তাহলে সে দেখবে যে পাখিগুলো খুব তাড়াহুড়ো করে দক্ষিণের দিকে উড়ে যাচ্ছে। মিউজিয়ামের সবচেয়ে ভালো দিকটা ছিল, ওখানের সবকিছু সবসময় একটা জায়গাতেই থাকত। কেউই ওগুলোর স্থান পরিবর্তন করত না। হাজারবার ঐ মিউজিয়ামে গেলেও একই দৃশ্য দেখা যেত। এস্কিমো তার দুই মাছ নিয়ে বসে আছে, পাখিগুলো উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণের দিকেই, হরিণরা তখনো পানি খাচ্ছে ফোয়ারা থেকে, এমনকি ঐ ইন্ডিয়ান মহিলা তখনো তার ঐ কম্বলটাই বুনছে। কোনো কিছুই বদলাতো না। শুধু বদলে যেতাম আমি। এমন না যে বয়সের ব্যবধান খুব বেশি বেড়ে যেত, এমন কিছু হতো না। আমিই বদলে যেতাম। কোনোসময় যেতাম ওভারকোট পরে, অথবা কোনোবার হয়তো সাথে আগেরবার সাথে থাকা পার্টনার সর্দিজ্বরের কারণে আমার সাথে থাকত না—পার্টনার করা লাগতো অন্য কাউকে, অথবা কোনোবার হয়তো মিস অ্যাইগেল্টিঙ্গারের বদলে কোনো শিক্ষক থাকত সাথে, অথবা কোনোবার হয়তো শোনা যেত বাথরুমে বাবা-মায়ের ঝগড়া করার শব্দ। মানে প্রতিবারই কোনো না কোনো উপায়ে আমিই বদলে যেতাম। আসলে ব্যাপারটা আমি ঠিক ব্যাখ্যা করে বলতে পারবো না। ব্যাখ্যা করে বললেও ঐ অনুভূতিটা ঠিকমতো বুঝাতে পারবো না।

হেঁটে যাওয়ার সময় পকেট থেকে হান্টিং টুপিটা বের করে আবার মাথায় পরে নিলাম। জানতাম না যে ওখানে আমার পরিচিত কারো সাথে দেখা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, আর পার্কের পরিবেশটা খুবই স্যাতস্যাতে ছিল। হেঁটে যেতে যেতে ভাবছিলাম ফিবিও কি প্রতি শনিবার আমার মতো করেই মিউজিয়ামটা দেখে কি না। ভাবছিলাম সেও কি আমার মতো প্রতিবার নিজের বদলে যাওয়াটা বুঝতে পারে কি না। ওটা ভাবতে আমার খুব একটা খারাপ লাগছিল না, তবে খুব একটা ভালোও লাগছিল না। কিছু কিছু জিনিসকে একভাবেই রেখে দেওয়া উচিৎ। মাঝেমধ্যে ইচ্ছা করে নিজেকে ঐ বড়ো কাঁচের বাক্সে আঁটকে রেখে দেই, যাতে আমাকে আর বদলানো না লাগে। জানি এটা অসম্ভব, তবে ব্যাপারটা কিন্তু খুব একটা খারাপও না। যাইহোক, এসব ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে যাচ্ছিলাম।

তখনই অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটলো। মিউজিয়ামের ভেতর ঢুকতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই আর ঢুকতে ইচ্ছা করল না আমার। এমনকি লক্ষ টাকার বিনিময়েও মিউজিয়ামে ঢুকতে ইচ্ছা করছিল না। কেন যেন মিউজিয়ামটা আর আকর্ষণ করছিল না আমাকে। আর আমিই পুরো পার্ক ধরে কিন্তু হেঁটে গিয়েছিলাম ঐ মিউজিয়ামের জন্যই। ফিবি ভেতরে থাকলে হয়তো ভেতরে ঠিকই ঢুকতাম, কিন্তু সে তো ছিল না। তাই মিউজিয়ামের সামনে থেকেই ক্যাব নিয়ে রওনা করলাম বাল্টিমোরের দিকে। সেখানেও যেতে ইচ্ছা করছিল না, যদিও স্যালির সাথে আগেই ডেটটা ফিক্সড করে রেখেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *