দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ৪

অধ্যায় চার

আমার তেমন কিছু করার ছিল না, তাই আমিও টয়েলেটে গেলাম শরীরে পানি দিতে, আর স্ট্র্যাডলেটার তখন শেভ করছিল। টয়েলেটে তখন আমরা দুইজনই ছিলাম, কারণ বাকিদের সবাই তখনো খেলার মাঠে। টয়েলেটের ভেতরে প্রচণ্ড গরম ছিল, জানালাগুলোও বাষ্পায়িত হয়েছিল। ওখানে প্রায় দশটার মতো ওয়াশবোল, প্রতিটাই লাগানো ছিল দেওয়ালের সাথে। স্ট্র্যাডলেটার দাঁড়িয়ে ছিল মাঝেরটায়। আমি তার পাশের ওয়াশবোলটাতে গিয়ে বসলাম এবং ঠান্ডা পানির নব ঘুরাতে শুরু করলাম। একবার নব ঘুরিয়ে পানি ছাড়ছি, আরেকবার বন্ধ করছি। নার্ভাসে থাকলে আমি এই কাজটাই করি। আর স্ট্র্যাডলেটার ওদিকে ‘সং অব ইন্ডিয়া’ গানটার শিস কাটতে কাটতে শেভ করছিল। স্ট্র্যাডলেটারের শিসের ধ্বনিটা একটু বেশিই তীক্ষ্ণ ছিল, আর শিসটা কখনোই সুরের সাথে মিলতো না। শিস দেওয়ার জন্য সে সবসময়ই এমন কিছু গান বাছাই করত যেগুলো ভালো শিসদাতাদের জন্যও শিস দিয়ে সুর তোলা কষ্টকর। যেমন ‘সং অব ইন্ডিয়া’ বা ‘স্লটার অন টেনথ অ্যাভিনিউ’। গানের প্রায় বারোটা বাজিয়ে দিতো ও।

মনে আছে, অ্যাকলির ব্যাপারে বলেছিলাম সে কিছুটা নোংরা প্রকৃতির? আসলে স্ট্র্যাডলেটারও কিছুটা নোংরা স্বভাবের। তবে সেটা একটু অন্যধরনের ছিল। স্ট্র্যাডলেটারের অভ্যাসটা আসলে তেমন কেউ জানতো না। তাকে দেখতে সবসময়ই ভালো দেখাতো, তবে যদি কেউ কখনো তার দাড়ি কামানোর রেজারটা হাতে নিতো, তাহলে দেখতো পেতো যে ওটা মরিচা পরা, অনেক ময়লা আর লোম লেগে আছে ওটাতে। সে কখনোই রেজার বা কিছু পরিষ্কার করত না। তবে দাড়ি কামানোর পর তাকে দেখতে সবসময়ই ভালো দেখাতো। তবে আড়ালে আবডালে কিন্তু সেও নোংরা স্বভাবেরই। অন্তত কাছ থেকে দেখায় আমি সেটা খুব ভালো করেই জানি। স্ট্র্যাডলেটার আসলে নিজেই নিজের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল। মানে নার্সিসিস্টিক স্বভাবের অনেকটা। এই কারণেই সে তার বাহ্যিক আবরণকে সবসময় খুব ফিটফাট করে রাখতো। সে ভাবতো পশ্চিম গোলার্ধ্বে সে-ই সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে। সত্যি বলতে, সে আসলেই অনেক সুদর্শন ছিল। তবে সে ছিল এমন প্রকারের সুদর্শন, যার ইয়ার বুকের ছবি দেখে যে কারো বাবা-মা-ই প্রথমে জিজ্ঞেস করবে, ‘এই ছেলেটা কে?’ মানে সে আসলে ইয়ার বুকের ছবির জন্য সুদর্শন ছিল। পেন্সিতেই আমি আরো অনেককে জানতাম যারা স্ট্র্যাডলেটারের থেকেও বেশি সুদর্শন ছিল, কিন্তু ইয়ার বুকের ছবিতে তাদেরকে এতটা সুদর্শন দেখাতো না। ছবিতে হয় তাদের নাক বড়ো দেখাতো, নয়তো কানগুলোকে হাতির কানের মতো লাগতো। প্রায়ই এটা খেয়াল করে দেখেছি আমি।

যাই হোক, আমি ওয়াশবোলে বসেছিলাম, আর স্ট্র্যাডলেটার আমার পাশেরটায় দাঁড়িয়ে শেভ করছিল। ওয়াশবোলে বসে পানি ছাড়ছিলাম-বন্ধ করছিলাম আর হ্যাটের ঝুঁটিটা নাড়ছিলাম। টুপিটা তখনো আমার মাথাতেই ছিল, ঝুঁটিটা বেঁকেছিল পিছনের দিকে। ওটা নিয়ে খেলতে বেশ ভালোই লাগছিল। আসলেই ঐ টুপিটা কিনে অনেক তৃপ্তি পেয়েছিলাম।

‘হেই,’ স্ট্র্যাডলেটার বলল। ‘আমার একটা বড়ো উপকার করতে পারবে?’

‘কী?’ জানতে চাইলাম। খুব একটা আগ্রহ দেখাইনি আমি। সে সবসময়ই বড়ো কোনো উপকার করার অনুরোধ করত। আসলে সুদর্শন লোকরা বা যেসব মানুষ নিজেদেরকে অনেক হোমড়া-চোমড়া ভাবে—তারা সবসময়ই তাদেরকে বড়ো কোনো উপকার করে দেওয়ার অনুরোধ করে। কারণ তাদের আগ্রহ থাকে শুধু নিজেদের নিয়েই, আর তারা ভাবে অন্য মানুষের আগ্রহও বোধহয় তাদের নিয়েই এবং অন্যরা তাদের কোনো উপকার করে দেওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। একদিক দিয়ে ভাবলে, ব্যাপারটা কিন্তু বেশ মজার।

‘তুমি কি রাতে বেরুবে-টেরুবে নাকি?’ সে বলল।

‘বেরুতেও পারি। আবার নাও পারি। ঠিক জানি না। কেন?’

‘সোমবারের জন্য আমাকে প্রায় ১০০ পাতার মতো ইতিহাস পড়তে হবে, ‘ সে বলল। ‘তুমি কি আমাকে ইংরেজির জন্য একটা কম্পোজিশন লিখতে দিতে পারবে? সোমবারের মধ্যে ওটা জমা না দিতে পারলে বিরাট বিপদে পড়ে যাবো। সেজন্যই তোমাকে অনুরোধ করছি। পারবে?’

ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর ছিল। আসলেই অনেক হাস্যকর।

‘পড়ালেখায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য আমাকেই কিন্তু এখান থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, আর তুমি কি না আমাকেই কম্পোজিশন লিখে দিতে বলছো?’ আমি বললাম।

‘হ্যাঁ, আমি জানি সেটা। তবে ব্যাপারটা হলো আমার জন্য লেখাটা বেশ কঠিন হয়ে যাবে। আর ঐ লেখাটা না দিতে পারলে আমাকে বড়ো বিপদে পড়া লাগবে। বন্ধু হিসেবে অনুরোধ করছি। লিখে দিতে পারবে?’

সাথে সাথেই কোনো উত্তর দিলাম না। স্ট্র্যাডলেটারের মতো মানুষদেরকে মাঝেমধ্যে অপেক্ষায় রাখাটাই বেশি শ্ৰেয়।

‘কিসের ওপর লিখতে হবে?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘যেকোনো একটা হলেই হবে। বর্ণনামূলক যেকোনো কিছু। একটা রুম বা বাড়ি বা তুমি থেকেছো এমন কোনো জায়গা—একটা হলেই হবে। শুধু লেখাটা বর্ণনামূলক হলেই হবে।’ বলে বড়ো একটা হাই দিয়ে উঠলো। বড়ো কোনো উপকার করে দিতে বলার সময় কেউ হাই দিয়ে উঠলে আমার প্রচণ্ড বিরক্তি লাগতো। ‘তবে খুব বেশি ভালো লিখে ফেলো না আবার,’ আবার বলল স্ট্র্যাডলেটার। ‘ঐ হারামি হার্টফেল ভাবে তুমি ইংরেজিতে অনেক দক্ষ আর সে জানে তুমি আমার রুমমেট। তাই সব দাড়ি-কমাই ঠিক জায়গায় বসিয়ো না, কিছু ভুল থাকলেই বরং ভালো।’

এই ব্যাপারটাও আমাকে প্রচণ্ড বিরক্ত করত। মানে আমি কম্পোজিশন লেখায় ভালো। কিন্তু কেউ এটা নিয়ে কথা বলে না, বলে দাড়ি-কমা কোন জায়গায় বসাচ্ছি তা নিয়ে। স্ট্র্যাডলেটার সবসময়ই এই কাজটা করত। সে ভাবতো, দাড়ি-কমা ঠিক জায়গামতো বসাতে না পারার কারণে তার কম্পোজিশনগুলো ভালো হয় না। এই দিক দিয়ে সে অনেকটা অ্যাকলির মতোই। অ্যাকলির পাশে বসে আমি একবার বাস্কেটবল ম্যাচ দেখেছিলাম। আমাদের টিমে হাওয়ি কোয়েল নামে খুবই ভালো একজন খেলোয়াড় ছিল। ফ্লোর থেকে দাঁড়িয়েই বাস্কেটে বল ছুড়ে মারতো সে। এমনকি তার ব্যাকবোর্ডে ধরা বা লাফানোও লাগতো না। আর অ্যাকলি ঐ ম্যাচের পুরোটা সময়ই আমার কানের কাছে প্যানপ্যান করেছে বাস্কেটবলের জন্য কোয়েলের শরীর কতটা নিখুঁত তা নিয়ে। সে জানতো আমি ওসব নিয়ে কথা বলা অপছন্দ করি, তারপরও সে ঐটা নিয়ে বকবক করে গেছে।

অনেকক্ষণ ওয়াশবোলে বসে থাকায় বিরক্তি ধরে গিয়েছিল আমার। তাই কয়েক পা পিছিয়ে ট্যাপ-ড্যান্স করতে শুরু করলাম। কোনো কারণে না, এমনিতেই নিজের বিরক্তি কাটানোর জন্য নাচ শুরু করেছিলাম। আমি কিন্তু আসলে ট্যাপ-ড্যান্স করতেই পারতাম না। তবে টয়লেটের পাথুরে মেঝেটা ট্যাপ-ড্যান্সের জন্য পারফেক্ট ছিল। নাচতে নাচতে মুভি অ্যাক্টরদের একজনের অনুকরণ করতে শুরু করলাম। মিউজিক্যাল টাইপ মুভির এক অ্যাক্টরের মতো। যদিও মুভি জিনিসটা আমি দুই চোখে সহ্য করতে পারি না, তবে ওগুলোর অনুকরণ করতে অনেক মজা লাগে আমার।

শেভ করার সময় স্ট্র্যাডলেটারের চোখেও আমার নাচটা ধরা পড়লো। আমি আসলে তার চোখেই পড়তে চাচ্ছিলাম, সত্যি বলতে একজন দর্শক চাচ্ছিলাম। আমি অনেকটা এক্সিবিশনিস্ট টাইপের। ‘আমি গভর্নরের ছেলে,’ বলে উঠলাম বলতে বলতে পা ঠুকছিলাম মেঝেতে। পুরো মেঝে জুড়েই লাফাচ্ছিলাম বলা যায়। ‘তবে আমার বাবা আমাকে ট্যাপ-ড্যান্সার হতে দিতে চায় না। বাবা চায় আমি যেন অক্সফোর্ডে যাই। কিন্তু এই ট্যাপ-ড্যান্সিং আমার রক্তের সাথে মিশে আছে।’ শুনে হাসতে শুরু করল স্ট্র্যাডলেটার। তার সেন্স-অব-হিউমার খুব একটা খারাপ ছিল না। ‘আজ রাতে জিগফিল্ড ফলিজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।’ বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠলাম। শরীরে দম বলতে কিছুই আর বাকি ছিল না আমার। ‘কিন্তু অনুষ্ঠানের লিডিং ম্যান যেতে পারবে না সেখানে। মদ খেয়ে পাড় মাতাল হয়ে আছে লোকটা। ঐ লোকের জায়গায় তারা কাকে ডেকে পাঠিয়েছে জানো? আমাকে। গভর্নরের ছেলেকে।’

‘ঐ টুপিটা কোথায় পেয়েছো?’ স্ট্র্যাডলেটার জিজ্ঞেস করল। শিকারি টুপিটার কথা বলছিল ও। সে ওটা আগে কখনো দেখেনি।

এমনিতেই আমার শ্বাস ধরে গিয়েছিল, তাই ইচ্ছামতো পাগলামি করছিলাম। সে জিজ্ঞেস করার পর নবমবারের মতো টুপিটা হাতে নিয়ে দেখলাম। ‘আজ সকালে নিউইয়র্ক থেকে কিনেছি। এক ডলার দিয়ে। তোমার ভালো লেগেছে এটা?’

মাথা ঝাঁকালো স্ট্র্যাডলেটার। ‘জিনিসটা খুব চমৎকার,’ সে বলল। অবশ্য সে কথাটা বলেছিল শুধু তেল মারার জন্যই, কারণ এরপরই তার কথাটা ছিল, ‘শুনো, তুমি কি আমাকে কম্পোজিশনটা লিখে দিতে পারবে? ভালোভাবে বলে দাও।’

‘যদি সময় পাই, তাহলে করে দেবো। সময় না পেলে করতে পারবো না,’ বললাম। বলে আবার গিয়ে বসলাম তার পাশের ওয়াশবোলটায়। ‘তোমার ডেট কে?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘ফিটজেরাল্ড?’

‘আরে নাহ! আমি তো বলেছিই তোমাকে, ঐ শয়তানির সাথে আমার সম্পর্ক শেষ।’

‘হ্যাঁ? তাহলে আমাকে দিয়ে দাও। মজা করছি না। ও কিন্তু আমার টাইপেরই।’

‘নিয়ে নাও… তবে সে কিন্তু তোমার থেকে অনেক বড়ো।’

হঠাৎ করেই আমার মনে হলো ওয়াশবোল থেকে তেড়ে গিয়ে স্ট্র্যাডলেটারকে হাফ নেলসনে চেপে ধরি। যদিও আমি আসলে মজা করার মুডেই ছিলাম। হাফ নেলসন আসলে একটা রেসলিং মুভ, মানে রেসলিংয়ের মার। অনেকেরই অজানা থাকতে পারে এটা। এই মুভটাতে আক্রমণকারী শিকারের পিছ থেকে হাত পেঁচিয়ে গলা চেঁপে ধরে। তাই করলাম আমি। প্রায় প্যান্থারের মতো ক্ষীপ্রগতিতে লাফিয়ে উঠে স্ট্র্যাডলেটারের ওপর চেপে বসলাম।

‘ছাড়ো আমাকে, হোল্ডেন। ওহ খোদা!’ স্ট্র্যাডলেটার বলল। তার আসলে খেলা করার কোনো মুড ছিল না। হাজার হোক, ও তো শেভ করছিল তখন। ‘তুমি আসলে কী করতে চাচ্ছো—মাথা ছিঁড়ে ফেলবে নাকি আমার?

যদিও আমি ছাড়লাম না। ওকে ভালোভাবেই চেপে ধরেছিলাম। ‘আমার শক্ত কবল থেকে নিজেই নিজেকে ছুটিয়ে নাও,’ বললাম।

‘ওহ, খোদা!’ বলে রেজারটা নামিয়ে রেখে জোরে হাত ঝাড়া দিলো। সাথে সাথেই আমার কবল থেকে মুক্ত হয়ে গেল। সে আসলে খুবই শক্তিশালী ছিল। আর আমি ছিলাম অনেক দুর্বল। ‘এখন, খেলা বাদ দাও,’ বলল ও। বলে আবারও শেভ করা শুরু করল। সে সবসময়ই দুইবার করে শেভ করত, নিজেকে সুদর্শন দেখানোর জন্য। অবশ্যই তার রেজারই তো ছিল ভোঁতা, মরচি পরা। দুইবার না করলে তো শেভই হতো না ঠিকমতো

‘ফিটজেরাল্ড না হলে তোমার ডেট কে?’ জিজ্ঞেস করলাম। আবারও ফিরে গিয়ে ওয়াশবোলে বসলাম। ‘ফিলিস স্মিথ নাকি?’

‘না। ওই হওয়ার কথা ছিল, তবে প্যাঁচ লেগে গেছে ওটা নিয়ে। এখন ডেটে যাবো বাড থ’র রুমমেটের সাথে… ওহ, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ও তো তোমাকে চেনে। ‘

‘কে চেনে?’ জানতে চাইলাম।

‘আমার ডেট।’

‘তাই?’ আমি বললাম। ‘নাম কি ওর?’ কিছুটা আগ্রহী ছিলাম।

‘একটু ভাবতে দাও… আহ, জেন গ্যালাহার।’

তার থেকে নামটা শুনে প্রায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম আমি।

‘জেন গ্যালাহার,’ আমি বললাম। এমনকি নামটা শুনে আমি ওয়াশবোল উঠে দাঁড়িয়েও পড়েছিলাম। ‘হ্যাঁ, আসলেই আমি তাকে চিনি। বলতে গেলে গত গ্রীষ্মের আগের গ্রীষ্মে আমরা তো প্রতিবেশিই ছিলাম। তার একটা বড়োসড়ো ডোবারম্যান পিনশার ছিল। ওভাবেই তার সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার। তার কুকুরটা প্রায়ই চলে আসতো আমাদের…’

‘ওহ খোদা, হোল্ডেন, তুমি এখন ঠিকঠাক আমার আলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছো,’ স্ট্র্যাডলেটার বলল। ‘তোমাকে কি ওখানেই দাঁড়ানো লাগবে?’

খোদা, বেশি উত্তেজনায় ব্যাপারটা খেয়ালই করিনি। আসলেই অনেক বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম তখন।

‘ও কোথায় এখন?’ জিজ্ঞেস করলাম তাকে। ‘আমার গিয়ে তাকে হাই- হ্যালো কিছু একটা তো বলা উচিৎ। সে কোথায়? অ্যানেক্সে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার কথা কীভাবে উঠলো? সে কি এখন বি.এম.-এ পড়ে? ও বলেছিল তার ওখানে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। শিপলিতে যাওয়ার সম্ভাবনার কথাও বলেছিল। আমি ভেবেছি সে শিপলিতেই গেছে। আমার কথা কী প্রসঙ্গে বলল ও?’ আমি আসলেই উত্তেজনায় অনেক অস্থির হয়েছিলাম তখন।

‘আমি জানি না, হোল্ডেন। খোদা, একটু কি উঠবে তুমি? আমার তোয়ালের ওপর বসে আছো তো,’ স্ট্র্যাডলেটার বলল। আমি তার তোয়ালের ওপর বসেছিলাম।

‘জেন গ্যালাহার,’ আমি বললাম। কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছিলাম না। ‘জিসাস ক্রাইস্ট!’

স্ট্র্যাডলেটার তার চুলে জেল মাখছিল তখন। আমার জেল।

‘ওর নাচ বেশ পছন্দ,’ বললাম। ‘ব্যালে নৃত্যে বেশ ভালো ও। প্রচণ্ড গরমের সময়টায় প্রতিদিন আমার সাথে দুই ঘণ্টা করে প্র্যাক্টিস করত ও। তার দুঃশ্চিন্তা ছিল গরমে নাকি তার পা অনেক খারাপ হয়ে যাবে—মানে ফুলে-টুলে যাবে আর কী। তার সাথে সবসময়ই চেকার্স খেলতাম আমি।’

‘তার সাথে তুমি সবসময় কী খেলতে?’

‘চেকার্স।’

‘চেকার্স, ওহ আচ্ছা।’

‘হ্যাঁ। সে কখনোই তার রাজাদের কোনোটাকেই সরাতো না। কখনো রাজা পেলে সে কখনোই ওটাকে সরাতো না। পিছনের সারিতে ওভাবেই ফেলে রাখতো ওটাকে। কখনোই ওগুলো ব্যবহার করত না। পিছনের সারিতে সাজিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করত ও।’

শুনে স্ট্র্যাডলেটার কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখালো না। আসলে ঐ ধরনের কথাবার্তায় কখনোই মানুষ আগ্রহ পায় না।

‘আমরা যে গলফ ক্লাবের সদস্য ছিলাম তার মা-ও সেই ক্লাবের সদস্য ছিল,’ বললাম। ‘টাকার দরকার হলে আমি মাঝেমধ্যেই সেখানে ক্যাডির কাজ করতাম। তার মায়ের হয়েও কয়েকবার ক্যাডি ছিলাম। নয় হোল শেষে মহিলার স্কোর হতো প্রায় একশো সত্তরের মতো।’

স্ট্র্যাডলেটার আসলে আমার কথা শুনছিলই না। সে তার নিজের চুলগুলোকে আকর্ষণীয় করাতেই বেশি মনোযোগী ছিল।

‘আমার ওখানে ওকে একবার হ্যালো বলে আসা উচিৎ,’ বললাম।

‘যাও, যেতে মানা করেছে কে?’

‘যাবো একটুপর।’

স্ট্র্যাডলেটার ওদিকে আবার তার চুলগুলোকে এলোমেলো করতে শুরু করেছে। চুল আঁচড়াতে তার কমপক্ষে হলেও আধ-ঘণ্টার মতো লাগতো।

‘তার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে। তার মা অবশ্য পরে এক মাতালকে বিয়ে করেছিল আবার,’ বললাম। ‘লোকটা ছিল শুকনো, পাগুলো ছিল লোমশ। লোকটাকে মনে আছে আমার। লোকটা সবসময়ই শর্টস পরে থাকত। জেন বলেছিল লোকটা নাকি নাট্যকার না কী যেন, তবে সবসময়ই লোকটাকে মদ খেতেই দেখেছি। মদ খেতো আর রেডিওতে প্রচার হওয়া সব মিস্ট্রি প্রোগ্রামগুলো শুনতো। আর উলঙ্গ হয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াতো। এমনকি জেন থাকলেও।’

‘তাই?’ স্ট্র্যাডলেটার বলল। শেষ কথাটায় বেশ আগ্রহ পেয়েছিল সে। এক মদখোর উলঙ্গ হয়ে সারাবাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাও আবার জেনের সামনেই। স্ট্র্যাডলেটার প্রচুর সেক্স পাগল ছিল।

‘জেনের শৈশবটা খুবই খারাপ ছিল। মজা করছি না, সত্যিই।’

ঐ কথায় অবশ্য স্ট্র্যাডলেটার খুব একটা আগ্রহ পায়নি। যৌনতা সম্পর্কিত ব্যাপারগুলোতেই তার আগ্রহ বেশি ছিল।

‘খোদা! জেন গ্যালাহার!’ কোনোভাবেই মেয়েটাকে মন থেকে দূর করতে পারছিলাম না আমি। ‘আমার গিয়ে অন্ততপক্ষে তাকে একবার হ্যালো বলে আসা উচিৎ।’

‘তাহলে বাবা থেমে আছো কোন কারণে? বারবার একই কথা না বলে গিয়ে বলেই এসো!’ স্ট্র্যাডলেটার বলল।

হেঁটে জানালা পর্যন্ত গেলাম। তবে জানালা দিয়ে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। টয়লেটের গরমে কাচগুলো ধূমায়িত হয়েছিল। ‘আমার এখন আসলে ওরকম মুড নেই,’ বললাম। আসলেই মুড ছিল না। ওরকম কিছু করার জন্য মুড থাকা খুব জরুরি। ‘আমি ভেবেছিলাম সে শিপলিতে পড়ে। আমি শপথ করেই বলতে পারবো যে সে শিপলিতেই পড়তে গিয়েছিল।’ বলে টয়লেটের ভেতরে পায়চারি দেওয়া শুরু করলাম। পায়চারি করা ছাড়া আমার অন্য কিছু করারও ছিল না। ‘সে কি খেলাটা উপভোগ করেছে?’ জানতে চাইলাম।

‘হ্যাঁ, মনে হয়। ঠিক জানি না।’

‘সে কি তোমাকে বলেছে আগে আমরা সবসময়ই একসাথে চেকার্স খেলতাম বা এমন কিছু?’

‘আরে বাবা, আমি জানি না। তার সাথে তো আমার পরিচয় হয়েছে মাত্র, ‘ বলল স্ট্র্যাডলেটার। চুল গোছানোর কাজ শেষ হয়েছে তার।

‘হেই, তাকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো, ওকে?

‘ওকে,’ স্ট্র্যাডলেটার বলল, তবে আমি জানি সে জানাবে না। স্ট্র্যাডলেটারের মতো লোকেরা আসলে কাউকেই কারো শুভেচ্ছা জানায় না।

নিজেকে সুদর্শন দেখানোর মিশন শেষে আবারো রুমে ফিরে গেল ও। তবে আমি আরো কিছুক্ষণ টয়লেটের ভেতরেই রয়ে গেলাম। জেনের কথা ভাবছিলাম শুধু। তারপর আমিও একসময় রুমে ফিরে গেলাম।

স্ট্র্যাডলেটার তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার টাই বাঁধছিল। সে তার জীবনের অর্ধেকটা আয়নার সামনেই কাঁটিয়েছে। আমি আমার চেয়ারটাতে বসে চুপ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

‘হেই,’ কিছুক্ষণ পর বললাম। ‘তাকে আমার বহিষ্কার হওয়ার কথাটা বলো না।

‘আচ্ছা!’

স্ট্র্যাডলেটারের এই গুণটা বেশ ভালো ছিল। অ্যাকলির মতো তাকে সবকিছুর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া লাগতো না। আমার ধারণা, ওসব ব্যাপারে তার আগ্রহ থাকত না বলেই জানতে চাইতো না কিছু। তবে অ্যাকলি অন্যরকম ছিল। সব ব্যাপারেই নাক গলাতে পছন্দ করত।

ততক্ষণে স্ট্র্যাডলেটার আমার হাউন্ড-টুথ জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে। ‘দয়া করে, জ্যাকেটটা টেনে ঢিল করে ফেলো না,’ বললাম। তখন পর্যন্ত আমি মাত্র দুইবার গায়ে জড়িয়েছিলাম ওটা।

‘ঢিল করবো না। আমার সিগারেটগুলো কই?’

ডেস্কের ওপরে।’ সে কখনোই কোথায় কোন জিনিস রেখেছে সেটা মনে রাখতে পারতো না। ‘তোমার মাফলারের নিচে।’ মাফলারের নিচ থেকে বের করে তার কোটের পকেটে রাখলো সিগারেটগুলো। মানে আমার কোটের পকেটে।

হঠাৎ করেই আমার হ্যাটের ঝুঁটিটা সামনের দিকে টেনে আনতে শুরু করলাম। হঠাৎ করেই প্রচণ্ড নার্ভাস লাগছিল আমার। আমি আসলে একটু নার্ভাস প্রকৃতিরই। ‘আচ্ছা, তার সাথে কোথায় ডেট তোমার, কোথায় যাবে?’ জিজ্ঞেস করলাম। ‘ঠিক করেছো কিছু?’

‘ঠিক জানি না কই যাবো। সময় থাকলে নিউইয়র্কের দিকে যেতে পারি। সে তো মাত্র সাড়ে নয়টা পর্যন্ত থাকবে বলেছে।’

স্ট্র্যাডলেটারের কথার ধরণটা আমার ঠিক ভালো লাগেনি। ‘সে তো আর জানে না তুমি কতটা সুদর্শন, আকর্ষণীয় যুবক। এই জন্যই হয়তো সাড়ে নয়টা পর্যন্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি সে জানতো তাহলে দেখতে সাড়ে নয়টার বদলে পরদিন সকাল পর্যন্তই থাকত।’

‘ঠিকই বলেছো,’ স্ট্র্যাডলেটার বলল। তাকে আসলে খুব সহজে রাগানোও যেতো না। অতিরিক্ত দাম্ভিক ছিল ও। ‘যাই হোক, ওসব বাদ দাও। আমার জন্য কম্পোজিশনটা করে রেখো,’ সে বলল। বেরিয়ে পড়ার জন্য একদম প্রস্তুত ও। ‘ওটা নিয়ে খুব বেশি পরিশ্রম করার দরকার নেই, তবে যত বেশি সম্ভব বর্ণনামূলক করার চেষ্টা করবে? ওকে?’

আমি তাকে কোনো উত্তর দিইনি। অবশ্য উত্তর দেওয়ার মানসিকতাও ছিল না তখন। শুধু বললাম, ‘তাকে জিজ্ঞেস করো তো সে এখনো তার রাজাগুলোকে পিছনের সারিতে সাজিয়ে রাখে কি না।’

‘আচ্ছা,’ স্ট্র্যাডলেটার বলল ঠিকই, তবে আমি জানি সে ওটা কখনোই জেনকে বলবে না। ‘এখন, শান্ত করো নিজেকে।’ বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

সে চলে যাওয়ার পর আরো আধ-ঘণ্টা বসে রইলাম ওভাবে। কোনো কাজ ছাড়াই চেয়ারে বসেছিলাম শুধু। শুধু ভাবছিলাম জেনের কথা, স্ট্র্যাডলেটারের সাথে তার ডেটে যাওয়ার কথাটা। ভাবনাটা আমাকে এতোই নার্ভাস করে তুলেছিল যে প্রায় পাগলই হয়ে যেতে বসেছিলাম। আগেই তো বলেছি স্ট্র্যাডলেটার কতটা সেক্স পাগল।

হঠাৎ করেই আবার রুমে এসে ঢুকলো অ্যাকলি। বরবারের মতোই শাওয়ারের পর্দার ফাঁক দিয়ে এসেছিল। জীবনে ঐ একবারই মনে হয় তাকে দেখে আমি খুশি হয়েছিলাম। সে আমার ভাবনাগুলোকে অন্যদিকে নিয়ে সরিয়ে নিয়েছিল।

প্রায় ডিনারের সময় পর্যন্ত রুমে ছিল ও। তার গালের বড়ো ব্রণ চিমটাতে চিমটাতে বলছিল সে পেন্সিতে যেসব ছেলেদের সাহসিকতাকে ঘৃণা করে তাদের কথা। কোনো রুমাল ছাড়াই ব্রণটা চিমটাচ্ছিল ও। হারামজাদাটার আসলে কোনো রুমাল ছিল কি না তা নিয়েও সন্দেহ আছে আমার। কখনোই তাকে রুমাল ব্যবহার করতে দেখিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *