দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ২০

অধ্যায় বিশ

ওখানেই বসে রইলাম অনেকক্ষণ। ড্রিঙ্ক করছিলাম আর মাতাল হচ্ছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম টিনা আর জেনিনের আরেকবার পারফর্ম্যান্স দেখার। তারা ঐদিন আর আসেনি। তাদের বদলে স্টেজে পিয়ানো বাজাতে এলো হোমোর মতো দেখতে এক লোক আর গান গাইতে এলো ভ্যালেন্সিয়া নামের এক নতুন মেয়ে। মেয়েটা গানের গলা তেমন ভালো ছিল না, তবে টিনা-জেনিনের থেকে অন্তত কয়েকগুণ ভালো ছিল। অন্ততপক্ষে মেয়েটা কিছু ভালো গান গাইতে পারতো। বারে আমি যেখানে বসেছিলাম তার ঠিক পাশে বসেই পিয়ানো বাজাচ্ছিল লোকটা। আর ভ্যালেন্সিয়া নামের মেয়েটা বলতে গেলে ঠিক আমার সাথে দাঁড়িয়েই গান গাইছিল। তাই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলাম, তবে মেয়েটা এমন ভাব করল যেন সে আমাকে দেখেইনি। আমি হয়তো এমনিতে অন্য সময় এমনটা করতাম না, তবে তখন প্রচণ্ড মাতাল ছিলাম। গান গাওয়া শেষে মেয়েটা এতো জলদি রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল যে আমি তাকে আমার সাথে ড্রিংক করার আমন্ত্রণটাও জানাতে পারিনি। তাই হেডওয়েইটারকে ডেকে বললাম সে যেন ভ্যালেন্সিয়াকে জিজ্ঞেস করে সে আমার সাথে বসে ড্রিংক করতে রাজি আছে কি না। ওয়েইটার বলল সে মেসেজটা পৌঁছে দেবে, তবে সে সম্ভবত মেয়েটাকে আমার মেসেজটা কখনোই জানায়নি। মানুষ কখনোই কাউকে কারো মেসেজ জানায় না।

রাত প্রায় একটা পর্যন্ত বারেই বসেছিলাম। ততক্ষণ মদ গিলতে গিলতে প্রচণ্ড মাতাল হয়ে পড়েছিলাম। আসলে ঠিকমতো চোখেও দেখতে পারছিলাম না। তবে আমি সতর্কভাবে চলার চেষ্টা করছিলাম, পাগলামি করে কারো নজরে পড়ার ইচ্ছা ছিল না। চাচ্ছিলাম না কেউ আমার আসল বয়সটা জেনে যাক। তাই যতটা সতর্ক ছিলাম। তবে মাতাল হওয়ার পর আবারও কল্পনা করছিলাম আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে আছি। জ্যাকেটের নিচ দিয়ে পেটের ওপর চেপে ধরে রেখেছিলাম যেন বারে কোথাও রক্তের ফোঁটা না পড়ে। কাউকে জানতে দিতে চাচ্ছিলাম না যে আমার পেটে গুলি লেগেছে। এভাবেই পেটের জখমে হাত চেপে ধরে রেখে ইচ্ছা করল জেনকে আরেকবার ফোন দেওয়ার। ছুটিতে সে বাসায় এসে পৌঁছেছে কি না সেটা জানতে ইচ্ছা করছিল। তাই বিল পরিশোধ করে বার থেকে বেরিয়ে টেলিফোনগুলোর কাছে গেলাম। হেঁটে যাওয়ার সময় হাত দিয়ে আমার পেট চেপে ধরে রেখেছিলাম। খোদা, আসলেই অনেক মাতাল হয়ে গিয়েছিলাম ঐদিন।

তবে ফোনবুথে যাওয়ার পর কেন যেন জেনকে ফোন করার কোনো মুড হচ্ছিল না আমার। হয়তো প্রচণ্ড মাতাল হয়েছিলাম বলেই মুড হচ্ছিল না। তাই তাকে কল না করে কল করলাম স্যালি হায়েসকে।

অতিরিক্ত মদ খাওয়ায় ঠিকমতো চোখেই দেখতে পাচ্ছিলাম না। সেজন্য কোনোভাবেই সঠিক নম্বরটা টাইপ করতে পারছিলাম না। শেষমেশ বিশবারের মাথায় সঠিক নম্বরটায় ফোন করতে সফল হলাম।

‘হ্যালো,’ ফোনটা ধরার সাথে সাথেই বলে উঠলাম। বলতে গেলে প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠেছিলাম।

‘কে বলছেন?’ এক মহিলার রুক্ষ কণ্ঠ ভেসে এলো ফোনের ওপাশ থেকে। ‘আমি, হোল্ডেন কলফিল্ড। স্যালিকে ডাকুন প্লিজ।’

‘স্যালি ঘুমাচ্ছে। আমি স্যালির দাদী বলছি। এতো রাতে ফোন করেছো কেন, হোল্ডেন? তুমি কি জানো এখন কয়টা বাজে?’

‘হ্যাঁ। স্যালির সাথে কথা বলা দরকার আমার। খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। তাকে ডাকুন।’

‘স্যালি ঘুমাচ্ছে, বাছা। কাল ফোন করে কথা বলো ওর সাথে। গুড নাইট।’

ডেকে তুলুন তাকে। ডেকে তুলুন, এখনই।

জবাবে তখন ভিন্ন একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ফোনের ওপাশ থেকে। ‘হোল্ডেন, আমি বলছি।’ স্যালির কণ্ঠ ওটা। ‘কী হয়েছে?’

‘স্যালি? তুমি?’

‘হ্যাঁ। চেঁচিয়ো না তো। তুমি কি মাতাল নাকি?’

‘হ্যাঁ। শুনো, শুনো। আমি ক্রিসমাস ইভে আসবো, ঠিক আছে? তোমার গাছ ট্রিম করার জন্য, ওকে? ঠিক আছে, স্যালি?’

‘হ্যাঁ। তুমি তো প্রচণ্ড ড্রাংক। ঘুমাও এখন। আছো কোথায় তুমি? সাথে কে আছে?’

‘স্যালি? আমি এসে তোমার গাছ ট্রিম করতে সাহায্য করবো, ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ। ঘুমাও এখন। কোথায় তুমি? সাথে কে?

‘কেউ না। আমার সাথে আমি আর আমিই আছি।’ খোদা, আসলেই ভয়ংকর রকমের মাতাল হয়েছিলাম তখন। এমনকি তখনো হাত চেপে পেট ধরে রেখেছিলাম। ‘তারা আমাকে ধরে ফেলেছে। রকির গুন্ডা খুঁজে বের করে ফেলেছে আমাকে। তুমি জানো এটা? তুমি জানো এটা, স্যালি?’

‘তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না। এখন ঘুমাতে যাও। আমাকেও ঘুমাতে হবে। কাল ফোন করো।’

‘হেই, স্যালি! তুমি কি চাও আমি গাছ ট্রিম করি? তুমি কি এটাই চাও?’

‘হ্যাঁ। গুড নাইট। এখন বাসায় গিয়ে ঘুমাও।’

বলে ফোন রেখে দিলো স্যালি।

‘গুডনাইট’, গুডনাইট, স্যালি বেবি, স্যালি সুইটহার্ট ডার্লিং,’ বললাম। ভাবতে পারছেন কতটা মাতাল ছিলাম তখন? আমিও ফোন রেখে দিয়েছিলাম। ধরে নিয়েছিলাম সে হয়তো কিছুক্ষণ আগেই ডেট থেকে বাসায় ফিরে এসেছে। কল্পনা করছিলাম সে কোথাও লান্টসের শো দেখছিল আর তার সাথে ছিল অ্যান্ডোভারের সেই হারামজাদাটা। কল্পনা করছিলাম তারা হয়তো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মার্জিত থাকার ভান ধরে মেকি কথাবার্তা বলছিল। খোদা, ঐ দৃশ্যগুলো কল্পনা করতেই মনে হলো যে তাকে ফোন না দিলেই হয়তো ভালো হতো। আসলে আমি মাতাল হলে একদম পাগল হয়ে যাই।

বেশ কিছুক্ষণ ফোনবুথেই ছিলাম। যেন জ্ঞান না হারাই সেজন্য ফোনটা কোনোরকমে হাতে আঁকড়ে রেখেছিলাম। সত্যি বলতে আমার তখন খুব একটা বেশি ভালোও লাগছিল না। শেষমেশ কোনোরকমে ফোন বুথ থেকে মাতালের মতো দুলতে দুলতে বাথরুমে গিয়ে একটা ওয়াশবোল পানিতে ভরে নিলাম ওয়াশবোলটা পানিতে ভরার পর মাথা ডুবিয়ে দিলাম, একদম কান পর্যন্ত। বেশ কিছুক্ষণ মাথা ডুবিয়ে রাখলাম পানিতেই। পানি থেকে মাথা তোলার পর মাথা মুছতেও কোনো ইচ্ছা করছিল না আমার। প্রচুর পানির ফোঁটা পড়ছিল মাথা থেকে আর আমি ফোঁটাগুলো পড়তে দিচ্ছিলাম। এরপর এগিয়ে গিয়ে বসলাম জানালার কাছে থাকা রেডিয়েটরের নিচে। রেডিয়েটর বেশ আরামদায়ক ও উষ্ণ ছিল। আমার বেশ ভালোই লাগছিল, কারণ আমার শরীর তখন প্রচণ্ডরকমভাবে কাঁপছিল। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর, মাতাল অবস্থায় সবসময়ই আমি প্রচণ্ডরকম কাঁপাকাঁপি শুরু করি।

আমার তখন কিছুই করার ছিল না, তাই রেডিয়েটরের নিচে বসে মেঝেতে থাকা বর্গাকার সাদা টাইলগুলো গুনছিলাম। যত সময় গড়াচ্ছিল, ততই ভিজছিলাম। ঘাড় থেকে গ্যালন পরিমাণ পানি ঝরছিল তখন। কলার, টাই, পোশাক সবই ভিজে প্রায় চুপচুপে হয়ে গিয়েছিল। তখন এতই মাতাল ছিলাম যে ভিজে যাওয়াটাকে তেমন পাত্তাই দিচ্ছিলাম না। এরপর তখন হুট করেই ভ্যালেন্সিয়ার জন্য পিয়ানো বাজানো হোমোদের মতো দেখতে লোকটা বাথ রুমে এলো তার সোনালি চুলের গোছাটা আঁচড়ানোর জন্য। চুল আঁচড়ানোর সময় লোকটার সাথে বেশ ভালোই আলাপচারিতায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম, তবে ব্যাপারটা হলো লোকটা অতটা বন্ধুবৎসল ছিল না।

‘হেই, এখান থেকে বারে ফিরে যাওয়ার পর কি ভ্যালেন্সিয়ার সাথে দেখা করবেন আপনি?’ জিজ্ঞেস করলাম।

‘হ্যাঁ, এটার সম্ভাবনাই বেশি,’ লোকটা বলল। বেশ রসিক ছিল লোকটা। আমার সবসময় রসিক লোকদের সাথেই কথা হয়।

‘শুনুন, তাকে আমার প্রশংসা জানাবেন। জিজ্ঞেস করবেন, ওয়েটার তাকে আমার মেসেজটা জানিয়েছিল কি না, ঠিক আছে?’

‘বাসায় যাচ্ছেন না কেন? আর আপনার বয়সই বা কত?’

‘আমার বয়স ছিয়াশি। শুনুন, মেয়েটাকে আমার প্রশংসা জানাবেন, ঠিক আছে?’

‘বাসায় যাচ্ছেন না কেন?’

‘আমার কথা বাদ দেন। আপনি কিন্তু খুবই ভালো পিয়ানো বাজান,’ বললাম। আমি আসলে তখন লোকটাকে তেল মারছিলাম শুধু। সত্য বলতে লোকটার পিয়ানো বাজানো ছিল খুবই বাজে। ‘আপনার রেডিওর জন্য বাজানো উচিৎ,’ বললাম। ‘আপনার মতো সুদর্শন একজনকে কে না লুফে নেবে? সেই সাথে সোনালি চুলের গোছা — ম্যানেজার দরকার আপনার?’

‘বাসায় যান, ভাই। আপনাকে দেখে ভালো পরিবারের ছেলেই মনে হচ্ছে। বাসায় গিয়ে ঘুমান।’

‘যাওয়ার মতো কোনো ঠিকানা নেই আমার। আর মজা করছি না—আপনার কি ম্যানেজার দরকার?’

লোকটা কোনো উত্তর না দিয়েই বেরিয়ে গেল বাথরুম থেকে। আসলে চুল আঁচড়ানো শেষ হওয়ার পর আর এক সেকেন্ডও দাঁড়িয়ে থাকেনি লোকটা। হ্যান্ডসাম লোকেরা আসলে এমনই, স্ট্র্যাডলেটারের মতো। তাদের চুল আঁচড়ানো শেষ হলে তারা কাউকে পাত্তাই দেয় না।

রেডিয়েটর থেকে উঠে শেষমেশ যখন আমি চেক-ইন রুমে এলাম তখন প্রচণ্ড কাঁদছিলাম। জানি না কেন, তবে কাঁদছিলাম। সম্ভবত তখন খুব হতাশ আর একাকীত্ব অনুভব করছিলাম বলেই কাঁদছিলাম। যাই হোক, চেকরুমে গিয়ে টিকেটটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তবে চেকরুমের দায়িত্বে থাকা মেয়েটা খুবই ভালো ছিল। টিকেট ছাড়াই আমার কোটটা দিয়েছিল। ‘লিটল শার্লি বিনস’র রেকর্ডটা তখনো কোটের পকেটেই ছিল। টিকেট ছাড়াই কোট দেওয়ায় আমি মেয়েটাকে কিছু টাকা দিতে চাইলাম, তবে মেয়েটা তা নেয়নি। মেয়েটা আসলেই খুব ভালো ছিল। সে বারবারই আমাকে বলছিল বাসায় ফিরে গিয়ে ঘুমাতে। তারপরও আমি তার সাথে ডেট ফিক্সড করার চেষ্টা করেছিলাম। বলেছিলাম যে কাজ শেষে সে আমার সাথে ড্রিংক করার জন্য যেতে পারবে কি না। তবে মেয়েটা মানা করে দিয়েছিল। বলেছিল, তার বয়স নাকি আমার মায়ের সমান প্রায়। এটা শুনে আমি মেয়েটাকে আমার ধূসর চুল কয়টা দেখিয়ে বললাম যে আমার বয়স বিয়াল্লিশ বছর। আসলে তখন মজা করছিলাম শুধু। তবে মেয়েটা ভালো ছিল—এসবে কিছু মনে করেনি। আমি তাকে আমার লাল হান্টিং টুপিটা ও দেখালাম। সে টুপিটা বেশ পছন্দ করেছিল। বেরিয়ে যাওয়ার আগে সে নিজ হাতে মাথায় টুপি পরিয়েও দিয়েছিল, কারণ আমার মাথা তখনো অনেকটা ভেজা ছিল। মানুষটা আসলেই ভালো ছিল।

বাইরে বেরুতেই আমার আর নিজেকে মাতাল মনে হচ্ছিল না, তবে সময় গড়ানোর সাথে সাথে ঠান্ডা লাগার পরিমাণটাও বাড়ছিল। দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছিল তখন। কোনোভাবেই থামাতে পারছিলাম না কাঁপাকাঁপি। এভাবেই ম্যাডিসন অ্যাভিনিউ পর্যন্ত হেঁটে বাস আসার অপেক্ষা করছিলাম। আমার কাছে তখন তেমন টাকা ছিল না, তাই তখন প্রচুর খরচ করে ক্যাবে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। তবে বাসেও উঠতে একদমই ইচ্ছা করছিল না। তাছাড়া আমি তো জানতামও না যে কোথায় যাবো। তাই ভাবলাম দাঁড়িয়ে না থেকে পার্কের দিকে হাঁটা শুরু করবো, লেকের পাড়ে গিয়ে দেখবো হাঁসগুলো কী করছে, হাঁসগুলো তখনো ওখানে আছে কি না। আমি তখনো জানতাম না যে শীতের সময় হাঁসগুলো কী করে। পার্কটা খুব বেশি দূরে ছিল না আর আমারও যাওয়ার মতো বিশেষ কোনো গন্তব্য ছিল না—আমি এমনকি এটাও জানতাম না যে রাতে কোথায় ঘুমাবো—তাই হাঁটা শুরু করলাম। খুব একটা ক্লান্ত বা অবস্বাদগ্রস্তও ছিলাম না তখন। আমার শুধু তখন প্রচণ্ড মন খারাপ লাগছিল।

পার্কে যাওয়ার পথেই ঘটলো বাজে ব্যাপারটা। হুট করে হাত থেকে ফিবির রেকর্ড পড়ে গিয়েছিল। মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল রেকর্ডটা। ওটা একটা বড়ো খামের ভেতরেই ছিল, তারপরও ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গিয়েছিল। আমার এতো খারাপ লেগেছিল যে প্রায় কেঁদেই দিয়েছিলাম। আমি জানি রেকর্ডটা তখন আর কোনো কাজের ছিল না, তারপরও আমার ওটা ফেলে দিতে ইচ্ছা করছিল না। তাই খাম থেকে টুকরোগুলো বের করে কোটের পকেটে রাখলাম। এরপর গিয়ে পৌঁছুলাম পার্কে। খোদা, প্ৰচণ্ড অন্ধকার গ্রাস করে রেখেছিল তখন পার্কটাকে।

আমি আমার পুরোটা জীবনই কাঁটিয়েছি নিউইয়র্কে। সেন্ট্রাল পার্কটা হাতের উলটো পিঠের মতো ভালোভাবেই চিনি। ছোটোবেলা ঐ পার্কটাতেই রোলার- স্কেট করেছি সবসময়, সাইকেল চালিয়েছি। তবে তারপরও ঐ অন্ধকারে লেকটা খুঁজে পেতে প্রচুর সমস্যা হচ্ছিল আমার। জানতাম লেকটা কোথায়—লেকটা সেন্ট্রাল পার্কের দক্ষিণ দিকে—কিন্তু তারপরও কোনোভাবেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমি হয়তো তখন স্বাভাবিকের থেকেও অনেক বেশি মাতাল ছিলাম। শুধু হাঁটছিলাম আর হেঁটেই যাচ্ছিলাম আর পার্কটাও আরো অন্ধকার ও ভূতুড়ে হচ্ছিল। ঐ সময়টায় আমি পার্কে একটা মানুষকেও দেখিনি। অবশ্য এতে খুশিই ছিলাম। পার্কে তখন কোনো মানুষ থাকলে হয়তো আমি তাদের থেকে মাইলখানেক দূরে থাকতাম। শেষমেশ লেকটা খুঁজে পেলাম। লেকের পানি আংশিক বরফে জমে যাচ্ছিল, আর বাকি অর্ধেকে তখনো পানি টলটল করছিল। তবে তাতে কোনো হাঁস দেখতে পেলাম না। পুরো লেকের পাড় দিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলাম—হাঁটতে গিয়ে একবার পড়েও যেতে নিয়েছিলাম আসলে—তবে একটা হাঁসও দেখতে পেলাম না। ভাবছিলাম তারা যদি এখনো এখানে থেকে থাকে তাহলে হয়তো ঘুমাচ্ছে নয়তো পানির একদম কিনারে ঘাসের ভেতরে লুকিয়ে আছে। তাদেরকে ওভাবে খুঁজতে গিয়েই প্রায় পড়তে বসেছিলাম আমি। তবে তাদেরকে কোথাও খুঁজে পেলাম না।

শেষমেশ কোনো হাঁস খুঁজে না পেয়ে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। খোদা, প্রচণ্ড কাঁপছিলাম তখন। কোনোভাবেই কাঁপুনি বন্ধ করতে পারছিলাম না। যদিও আমি আমার হান্টিং টুপিটা পরে রেখেছিলাম তারপরও আমার মাথার পিছনের দিক চুলগুলো ঠান্ডায় জমে বরফের টুকরো হয়ে গিয়েছিল। দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। ভাবছিলাম আমি হয়তো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবো। কল্পনা করছিলাম হাজার হাজার হারামজাদা আমি মারা যাওয়ার পর ফিউনেরালে এসেছে। ডেট্রোয়েট থেকে আমার দাদা, প্রায় পঞ্চাশজনের মতো আন্টি আর আমার সব হারামি কাজিনদের সবাই ওই ফিউনেরালে এসে ভিড় করে রেখেছে। এলি মারা যাওয়ার পরও তারা সবাই এসেছিল। ডি.বি. আমাকে বলেছিল ফিউনেরালে আমার এক আন্টি—যার মুখ সবসময়ই দুর্গন্ধে ভরা থাকে—বারবারই বলছিল কফিনে নাকি এলি খুব শান্তভাবে শুয়েছিল। আমি ফিউনেরালে ছিলাম না। আমি তখনো হাসপাতালে ছিলাম। হাতে ব্যথা পাওয়ায় আমাকে তখন হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। যাইহোক, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার দুঃশ্চিন্তা করে আমার বাবা-মায়ের জন্য প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল আমার। বিশেষ করে আমার মায়ের জন্য, মা তখনো এলির শোকটা কাঁটিয়ে উঠতে পারেনি। কল্পনা করছিলাম আমি মারা যাওয়ার পর মা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না আমার স্যুট আর অ্যাথলেটিকের সরঞ্জামগুলোর কী করবে। তবে একটা ভালো ব্যাপার হলো মা কখনো ফিবিকে আমার ফিউনেরালে নিয়ে আসবে না, কারণ ফিবি তো বাচ্চা একটা মেয়ে মাত্র। এটাই একমাত্র ভালো দিক। এরপর কল্পনা করলাম আমার আত্মীয়স্বজনের দল পুরোটা মিলে আমাকে কবরে ঢুকিয়ে রেখে ওপরে মাটি ঢালছে, আর কবরের মাথার কাছে আমার নাম লেখা একটা ফলক লাগাচ্ছে। তারপর চলে যাচ্ছে আমাকে ওখানেই অন্যান্য সব মৃতদের সাথে রেখে। খোদা, অন্যান্য মৃতদের সাথে রাখার থেকে আমি আশা করছি তারা যেন আমাকে কোনো নদী বা কোথাও পুঁতে রাখে। অন্তত ওই অভিশপ্ত কবরখানা থেকে তো এটা ভালো। কবরখানায় মানুষজন শুধু রবিবার এসে ফুল রেখে যায়, এছাড়া তারা আর কখনো ওখানে যায়ই না। আর মারা যাওয়ার পর কে ফুল পাওয়া নিয়ে ভাবে? কেউই না।

আবহাওয়া ভালো থাকলে আমার বাবা-মা প্রায়ই কবরস্থানে গিয়ে এলির কবরে ফুল রেখে আসে। আমিও তাদের সাথে কয়েকবার গিয়েছিলাম। তবে পরে আর যায়নি। প্রথমত, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা কবর, কবরের ফলক দেখতে আমার কখনোই তেমন ভালো লাগে না। অবশ্য সূর্য উঠলে অতটা খারাপও লাগতো না, তবে দুইবার আমরা যাওয়ার পর বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছিল। ব্যাপারটা খুবই বাজে ছিল। কবরের ফলকে পড়ছিল বৃষ্টির পানি, মাটিতে পড়ছিল, মাটিতে পড়া পানিগুল চুয়ে চুয়ে পড়ছিল কবরের ভেতর থাকা এলির বুকে। পুরো জায়গাটা জুড়েই বৃষ্টি পড়ছিল। বৃষ্টি শুরু হতেই গোরস্থানে থাকা দর্শনার্থীদের সবাই পাগলের মতো দৌড়ে ছুটে গিয়েছিল তাদের গাড়িতে। এই একটা জিনিসই আমাকে রাগিয়ে তুলেছিল। কবর দেখতে যাওয়া সবাইই বৃষ্টি শুরু হলে তাদের গাড়িতে দৌড়ে এসে রেডিও চালু করে বসতে পারে, তারপর হয়তো কোথাও ডিনার করার জন্যও যেতে পারে—কিন্তু এলিকে পড়ে থাকতে হয় ঐ কবরস্থানেই। আমি এটাই সহ্য করতে পারি না। আমি জানি ওই কবরে শুধু তার শরীরটাই আছে, আর আত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বর্গে—কিন্তু তারপরও আমি এটা সহ্য করতে পারি না। আমি শুধু চাই সে যেন ঐ কবরে না থাকে। এলিকে কেউ চিনে থাকলে সে ঠিকই বুঝবে আমি আসলে কী বুঝাতে চাচ্ছি। আমি জানি সূর্য উঠলে কবরস্থান অতটা খারাপ না, কিন্তু সূর্য তো উঠে তার মর্জি মতো। আর বেশিরভাগ দিনেই সূর্য দেখা দেওয়ার প্রয়োজনও মনে করে না।

বেশ কিছুক্ষণ ওসব নিয়ে ভাবার পর মাথা থেকে নিউমোনিয়ার ভূত তাড়ানোর জন্য পার্কে থাকা ফালতু স্ট্রিট ল্যাম্পের আলোতে টাকা বের করে গোনা শুরু করলাম। আমার কাছে তখন তিনটা সিঙ্গেল, পাঁচ কোয়ার্টার আর একটা নিকেলই ছিল শুধু। খোদা, পেন্সি থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রচুর টাকা খরচ করে ফেলেছিলাম আমি। এরপর বেঞ্চ থেকে উঠে লেকের বরফ জমে যাওয়া অংশটার কাছে গিয়ে কোয়ার্টারগুলো আর নিকেলটা ছুড়ে মারলাম। জানি না কেন ঐ কাজটা করেছিলাম, মনে হয় মাথা থেকে নিউমোনিয়ার ভাবনাটা তাড়ানোর জন্যই। তবে এতেও নিউমোনিয়ার দুঃশ্চিন্তাটা মাথা থেকে সরেনি।

ভাবতে শুরু করলাম আমি নিউমোনিয়ায় ভুগে মারা গেলে ফিবির কেমন লাগবে। জানি ওটা বাচ্চাদের মতো একটা ভাবনা, তারপরও ভাবনাটা মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। যদি এমন কিছু তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার খুব খারাপ লাগবে। সে আমাকে অনেক পছন্দ করে। মানে সে আমার অনেক বড়ো ভক্ত। আসলেই। যাইহোক, যেহেতু ওসব ভাবনা মাথা থেকে দূর করতেই পারছিলাম না, তাই ভাবলাম লুকিয়ে লুকিয়ে বাসায় গিয়ে ফিবিকে একবার দেখে আসবো। বাসার চাবির একটা কপি আমার সাথেই ছিল, তাই ভাবলাম খুব চুপে-চাপে, নিঃশব্দে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে ফিবির সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে আসবো। তবে ফ্রন্টডোরটা নিয়ে আমার দুঃশ্চিন্তা লাগছিল। দরজাটা খোলার সময় প্রচুর ক্যাচক্যাচ শব্দ করে। অ্যাপার্টমেন্টটা বেশ পুরোনো আর আমাদের বিল্ডিং সুপারিন্টেনডেন্টও প্রচুর অলস। বাসার সব কিছু ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে। আমার ভয় লাগছিল লুকিয়ে বাসায় ঢোকার সময় হয়তো দরজার শব্দের কারণে ধরা পড়ে যাব। তবে তারপরও বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

তাই পার্কের বেঞ্চ থেকে উঠে রওনা করলাম বাসার দিকে। পুরোটা রাস্তা হেঁটেই গিয়েছি। বাসাটা বেশি দূরে ছিল না। আমিও তখন আর অতটা মদ্যপ ছিলাম না। বাইরের পরিবেশটা ছিল খুবই ঠান্ডা তখন, তাই রাস্তাটাও খালিই ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *