দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ৯

অধ্যায় নয়

পেন স্টেশনে নেমে প্রথমেই ফোন বুথে ঢুকলাম। কারো সাথে কথা বলার খুব ইচ্ছা করছিল তখন। ব্যাগগুলো বুথের পাশে রেখে ভেতরে ঢুকতেই কাকে ফোন করবো সেটা আর ভেবে পেলাম না। আমার ভাই ডি.বি. ছিল হলিউডে। ছোটো বোন ফিবি রাত নয়টার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ে। অবশ্য ফোন দিয়ে তাকে ডেকে তুললে সে কিছু মনে করবে না। তবে সমস্যাটা ছিল, তাকে ফোন দিলে যে সে-ই ধরবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। বাবা-মায়ের কারোর ধরার সম্ভাবনাই বেশি। তাই তাকে ফোন দেওয়ার আইডিয়াটা বাদ। এরপর মনে হলো জেন গ্যালাহারের মায়ের কথা। তার মাকে ফোন করে জেনের ছুটি কবে থেকে শুরু হবে সেটা জিজ্ঞেস করা যায়। তবে মিসেস গ্যালাহারকে ফোন দেওয়ার তেমন একটা ইচ্ছা আমার ছিল না। এরপর মাথায় এলো স্যালি হায়েসের কথা। মেয়েটার সাথে মাঝেমধ্যেই ডেটে যেতাম। তাছাড়া জানতাম যে তার ক্রিসমাসের ছুটিও শুরু হয়ে গেছে। ছুটি শুরু হতেই সে আমাকে একটা চিঠি লিখে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আমি যেন ক্রিসমাস ইভে তাদের ওখানে গিয়ে ক্রিসমাস সাজাতে তাকে সাহায্য করি। তবে ভয় ছিল ফোনটা সে ধরবে কি না তা নিয়ে। তার মাও ধরতে পারে। তার মা আমার মা’কে চিনে। মাথায় তখন কল্পনাই করতে পারছিলাম যে ফোন পেয়ে তার মা দৌড়ে গিয়ে আমার মাকে ফোন করে জানাচ্ছে আমি নিউইয়র্কে আছি। তাছাড়া মিসেস হায়েসের সাথে কথা বলার তেমন ইচ্ছাও আমার ছিল না। মহিলা স্যালিকে আমার ব্যাপারে বলেছিল আমি নাকি উন্মাদ টাইপের। বলেছিল আমি নাকি অনেক পাগলাটে আর জীবন নিয়ে নাকি আমার কোনো চিন্তাভাবনা নেই। এরপর মনে পড়লো হুটন স্কুলের আমার এক প্রাক্তন সহপাঠি কার্ল লুইসের কথা। ছেলেটাকে তেমন একটা পছন্দ করতাম না। তাই শেষ পর্যন্ত আর কাউকেই ফোন দেওয়া হয়নি। বিশ মিনিট অযথাই বুথের ভেতর দাঁড়িয়েছিলাম। এরপর বুথ থেকে বেরিয়ে ব্যাগগুলো হাতে নিয়ে টানেল দিয়ে ক্যাবগুলোর দিকে পা বাড়ালাম। কপাল ভালোই ছিল, ক্যাব পেতে খুব একটা দেরি হয়নি।

আমি তখন এতটাই অন্যমনস্ক ছিলাম যে ক্যাবে ওঠে অভ্যাসবশত আমার বাসার ঠিকানাই দিয়ে ফেলেছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম যে ছুটি শুরু না হওয়া পর্যন্ত আমি কয়েকদিন হোটেলে থেকে পরে বাসায় যাবো। এমনকি পার্কের অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার আগ অবধি আমার মাথায়ও আসেনি এটা। মাথায় আসতেই ড্রাইভারকে বললাম, ‘হেই, আপনি কি গাড়িটা ঘুরাতে পারবেন? আমি আপনাকে ভুল ঠিকানা দিয়েছিলাম। ডাউনটাউনেই ফিরিয়ে নিয়ে যান আমাকে।’

ড্রাইভার মোটামুটি কিছুটা বুদ্ধিমান ছিল। ‘এখানে তো গাড়ি ঘুরানো যাবে না। এটা ওয়ানওয়ে রাস্তা। এখন ঘুরাতে হলে আমাকে নাইনটিথ স্ট্রিটে যাওয়া লাগবে।’

আমার তখন তর্ক করার মুড ছিল না। তাই ড্রাইভারের কথাতেই সায় জানালাম। এরপর হঠাৎই অন্য একটা কথা মনে পড়ে গেল। ‘আচ্ছা, আপনি সেন্ট্রাল পার্ক সাউথের লেগুনটা চিনেন? ঐ যে ছোটো হ্রদটা? অনেক হাস সাঁতার কাটতো? কোনোভাবে আপনি কি জানেন হ্রদের পানি জমে গেলে ঐ হাঁসগুলো কই যায়?’ বলার পরই বুঝতে পারলাম ড্রাইভারের ওই ব্যাপারে জানার সম্ভাবনা খুবই কম।

প্রশ্নটা শুনে ড্রাইভার আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়েছিল যেন আমি কোনো বদ্ধ উন্মাদ। ‘আপনি আসলে কী বুঝাতে চাচ্ছেন?’ বলল লোকটা। ‘মজা করছেন?’

‘না। আমার আসলে ওটা জানার আগ্রহ ছিল খুব। এছাড়া কিছু না।’

এরপর আর লোকটা কিছু বলল না, তাই আমিও কিছুই বললাম না। নাইনটিথ স্ট্রিটের পার্ক অতিক্রম না করা পর্যন্ত নীরবতাই ছিল গাড়িজুড়ে। পার্ক পেরিয়েই ড্রাইভার লোকটা বলল, ‘আচ্ছা, এখন গাড়ি ঘুরানো যাবে। কোথায় যাবো?’

‘আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি ইস্ট সাইডের কোনো হোটেলে থাকতে চাই না। এখানে থাকলে আমার পরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি আসলে গোপনভাবে ঘুরতে বেড়িয়েছি,’ বললাম। যদিও ‘গোপনভাবে ঘুরতে বেড়িয়েছি’ জাতীয় সেকেলে কথাবার্তা আমার পছন্দ ছিল না। কিন্তু ড্রাইভার লোকটা যেমন, তাতে এভাবে বলা ছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না। ‘আপনি কি জানেন ট্যাফট বা নিউ ইয়র্ককে এখন কোন ব্যান্ড আছে?’

‘কোনো ধারণাই নেই এই ব্যাপারে।’

‘আচ্ছা, তাহলে এডমন্ট নিয়ে চলেন,’ বললাম। ‘ককটেলের মুড আছে কি আপনার? যাওয়ার সময় থেমে আমার সাথে জয়েন করতে পারবেন অল্প সময়ের জন্য? সমস্যা নেই, খরচ আমারই।’

‘দুঃখিত, বন্ধু, সম্ভব না।’ লোকটা আসলেই খুব ভালো সঙ্গী ছিল। কী চমৎকার ব্যক্তিত্ব!

এরপর এডমন্ট হোটেলে গিয়ে চেকইন করলাম। গাড়িতে থাকার সময় আমি আমার লাল টুপিটা মাথাতেই দিয়ে রেখেছিলাম। তবে হোটেলে ঢোকার আগে ওটা আবার মাথা থেকে নামিয়ে ফেলেছিলাম। হোটেলে গিয়ে নিজেকে গবেট হিসেবে উপস্থাপন করার ইচ্ছা ছিল না। তবে ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারলাম, হ্যাঁ মাথায় রাখলেও কোনো সমস্যা ছিল না। পুরো হোটেলই ভরেছিল গন্ডমুর্খ, গবেট আর পাভার্টে।

তারা আমাকে ফালতু একটা রুম দিয়েছিল। ওটার জানালা দিয়ে হোটেলের অন্যপাশ দেখা ছাড়া আর কিছুই দেখা যেতো না। তবে ওটা নিয়ে অত মাথা ঘামাইনি আমি। এতটাই মনমরা হয়েছিলাম যে জানালা দিয়ে ভালো ভিউ পাচ্ছি নাকি পাচ্ছি না তা নিয়ে কোনো ভাবনা ছিল না। আমার সাথে রুমে যে বেয়ারাটা এসেছিল তার বয়স ছিল পঁয়ষট্টি। লোকটার অবস্থা রুম থেকেও বেশি করুণ ছিল। মাথা আধটেকো ছিল লোকটার। তবে কানের পাশে থাকা চুলগুলোকে টেনে এমনভাবে আঁচড়ে রেখেছিল যেন টাক দেখা না যায়। আমি বুঝি না, টাক পড়লে এমনভাবে চুল আঁচড়ানোর কী আছে। ঐ ফালতুভাবে আচড়ানোর বদলে টাক উন্মুক্ত রাখাই তো ভালো। যাই হোক, পঁয়ষট্টি বছরের একটা লোকের জন্য হোটেলের বেয়ারা হওয়া কত মোহনীয় একটা চাকরি! মানুষের স্যুটকেস বহন করে রুমে নিয়ে যাওয়া আর কয়েকটা বখশিসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা। আমার ধারণা লোকটা খুব একটা বুদ্ধিমান বা শিক্ষিত ছিল না। ভাবতে গেলে যেটা আসলেই একটা খারাপ ব্যাপার।

লোকটা চলে যাওয়ার পর কোট-ফোট পরেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ। এছাড়া আমার করার মতো কোনো কাজও ছিল না তখন। তবে জানালা দিয়ে হোটেলের অন্যপাশে কী চলছিল তা দেখে প্রায় চমকে যাওয়ার অবস্থা। মানুষগুলো আসলে নিজেদের নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে তারা জানালার পর্দাও নামায়নি। একলোককে দেখতে পেলাম শুধু শর্টস পরে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার চুলগুলো ধূসর, চেহারাও বেশ মার্জিত। তবে লোকটা কী করছিল সেটা আসলে বলে বিশ্বাস করানোর মতো না। দেখলাম লোকটায় বিছানায় রাখা তার স্যুটকেস থেকে মেয়েদের পোশাক বের করে গায়ে পরছে। সত্যিকারের মেয়েলি পোশাক, যেমন সিল্ক স্টকিং, হাই-হিল জুতো, ব্রেসিয়ার, এবং এমনকি নিচ দিয়ে ফালির মতো করে ঝুলে থাকা করসেটও ছিল। অবশ্য লোকটা তখন পরেছিল কালো রঙের একটা আটোসাটো সান্ধ্যকালীন পোশাক। পোশাক পরা শেষে বিছানা থেকে উঠে রুমজুড়ে হাঁটা শুরু করল মানুষটা। একদম মহিলাদের মতো করে ছোটো ছোটো কদমে হাঁটছিল। এরপর হাঁটতে হাঁটতে একটা সিগারেট ধরিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো একটা আয়নার সামনে। সম্ভবত ঐ লোকটাও একদম একাকী ছিল। অবশ্য বাথরুমে কেউ ছিল কি না তা জানি না—ওটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। ঐ জানালার ঠিক ওপরের জানালাটা দিয়েই দেখতে পেলাম পুরুষ আর মহিলা তাদের মুখ থেকে পানির মতো কিছু ছুড়ে মারছে অন্যজনের দিকে। অতদূর থেকে তাদের গ্লাসে কী ছিল তা দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে নিশ্চিতভাবেই তাদের গ্লাসে পানি ছিল না। হাইবল জাতীয় কোনো ককটেল ছিল সম্ভবত। যাইহোক, দেখছিলাম প্রথমে লোকটা গ্লাস থেকে চুমুক দিয়ে ওটা পিচকিরির মতো ছুড়ে দিচ্ছে মহিলার গায়ে, তারপর মহিলাও একই কাজ করছে। ওহ্, খোদা! ওটা দেখলে বুঝতেন দৃশ্যটা কেমন ছিল। তারা দুইজন পুরোটা সময় এমন আচরণ করছিল যেন মুখ থেকে পিচকিরি ছুড়ে মারাটাই পৃথিবীর সবচেয়ে হাস্যকর কাজ। মজা করছি না, পুরো হোটেলটাই এরকম বিকৃত কামলালসাপূর্ণ মানুষে ভরা ছিল। সম্ভবত ঐ হোটেলে আমিই একমাত্র স্বাভাবিক মানুষ ছিলাম। সত্যি বলতে, হোটেলের অবস্থা এমন ছিল যে আরেকটু হলেই স্ট্র্যাডলেটারকে টেলিগ্রাম করতে চেয়েছিলাম যেন সে পরের ট্রেনে করেই নিউইয়র্কে চলে আসে। ঐ হোটেলের রাজা হওয়ার যোগ্যতা ছিল তার।

তবে ব্যাপারটা হলো, ঐ ধরনের দৃশ্য দেখতে না চাইলেও দেখতে কিন্তু বেশ ভালোই লাগে। এই যেমন ধরুন—যে মেয়েটা মুখ দিয়ে পানি ছুড়ে মারছিল বা যার মুখে লোকটা পানি ছুড়ে মারছিল, সেই মেয়েটা কিন্তু দেখতে যথেষ্ট সুন্দর ছিল। আমার আসলে বড়ো সমস্যা ছিল ওটাই। মনে মনে সবসময়ই ভাবি যে আমি অনেক বড়ো সেক্স ম্যানিয়াক। মাঝেমধ্যে আমি ভাবি যদি আমার ঐ মেয়েটার সাথে ওরকম কিছু করার সুযোগ থাকে, তাহলে কিন্তু আমি মানা করবো না। একদিক দিয়ে দেখলে কিন্তু ঐ কাজটায় বেশ মজা ছিল। আর দুইজনই মানুষই যদি মাতাল হয়ে একে-অন্যের মুখে এভাবে পানি ছুড়ে মারে—তাহলে সেটা দেখতে একটু অন্যরকম হলেও, মজা কিন্তু নিখুঁতই ছিল। অবশ্য আমার ঐ পানি ছুড়ে মারা আইডিয়াটা অতটা ভালো লাগেনি। একটু ভেঙে চিন্তা করলেই ওটার খারাপ দিকগুলো বের করা সম্ভব। আমার মতে যদি কোনো মেয়েকে ভালো না লাগে, তাহলে তার সাথে কোনো প্রকার বাজে খেলা করা উচিৎ না। আর যদি কোনো মেয়েকে ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই ঐ মেয়ের মুখকেও ভালো লাগা উচিৎ; আর মুখ ভালো লাগলে অবশ্যই ঐ মেয়েটার মুখে আজেবাজে কিছু ছুড়ে দেওয়ার আগে (এই যেমন পানিজাতীয় কিছু) সতর্ক থাকা উচিৎ। এই ব্যাপারটা আসলেই খারাপ যে দেখতে খুবই বাজে কাজগুলো করে অনেক বেশি আনন্দ পাওয়া যায়। আর মেয়েরাও তাদের সাথে এসব আজেবাজে, রুচিহীন কিছু না করলে বা তাদেরকে দৈহিকভাবে আনন্দ দিতে না পারলে খুব একটা পাত্তা দেয় না। কয়েকবছর আগে একটা মেয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল, মেয়েটা আমার থেকেও বেশি ম্যানিয়াক ছিল। একটা সময় পর্যন্ত অনেক মজা করেছি আমরা, অবশ্যই কুৎসিত ধরনের মজা। সেক্স আসলে এমন একটা ব্যাপার যেটা আমি কখনো বুঝতে পারি না। আমি সবসময়ই আমার জন্য আলাদা সেক্সরুল তৈরি করেছি, আর তৈরি করার সাথে সাথেই ভেঙে ফেলেছি ঐগুলো। গতবছরই একটা নিয়ম করেছিলাম যে আমি মেয়েদের সাথে উল্টাপাল্টা মজা করা থ ামিয়ে দেবো; পরবর্তীতে ঐটাই আমার গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছিল। যদিও নিয়মটা অমান্য করেছিলাম। যে সপ্তাহে নিয়মটা বানিয়েছিলাম, ঐ সপ্তাহেই ভেঙে ফেলেছিলাম—আসলে সত্যি বলতে ঐ রাতেই ভেঙেছিলাম। ঐরাতের পুরোটাই আমি কাটিয়েছিলাম অ্যান লুইজ শারমানের সাথে। সেক্স আসলে এমন কিছু যা আমি কখনোই বুঝতে পারি না। আসলেই বুঝতে পারি না।

ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ই জেনের সাথে কথা বলার আইডিয়া এলো মাথায়। ভাবনা এলো যে তার বাসায় তার মায়ের কাছে ফোন করার বদলে তো আমি বি.এম.-এও ফোন করতে পারি। ঐ স্কুলেই পড়তো ও। যদিও এত রাতে কোনো স্টুডেন্টকে ফোন করার অনুমতি ছিল না, তবে একটা উপায় ছিল। আমি ফোন করে বলবো যে আমি জেনের আঙ্কেল। আর তার আন্টি কিছুক্ষণ আগেই একটা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। সেজন্যই জেনের সাথে দ্রুত কথা বলা দরকার আমার। এটা আসলে কাজেও লাগতো। তবে ফোন আর করিনি আমি। কারণ আমি তখন ওরকম মুডে ছিলাম না। আর মুডে না থাকলে ওরকম মিথ্যাগুলো গুছিয়ে বলা যায় না।

আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একটা চেয়ারে সিগারেট টানতে শুরু করলাম। টানা সিগারেট টেনে যাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে দৃশ্যগুলো দেখে প্রচণ্ড হর্নি হয়েছিলাম তখন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। সিগারেট টানতে টানতে হঠাৎই একটা আইডিয়া এলো মাথায়। গত গ্রীষ্মে একটা পার্টিতে প্রিন্সটনের একটা ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার। সে আমাকে একটা কার্ড দিয়েছিল। ওয়ালেট বের করে কার্ডটা খুঁজতে শুরু করলাম। পেতে খুব দেরি লাগলো না। ওয়ালেটে থেকে কার্ডটার রঙ একদম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বলা যায়, তবে কার্ডের লেখাগুলো পড়া যাচ্ছিল ঠিকই। কার্ডে ফেইথ ক্যাভেন্ডিশ নামের একটা মেয়ের ঠিকানা ছিল। মেয়েটা আসলে ঠিক পতিতা বা এমন কিছু ছিল না, তবে মাঝেমধ্যে এসব কাজ করতে মেয়েটার কোনো আপত্তি ছিল না। প্রিন্সটনের ছেলেটা আমাকে এই কথাই বলেছিল। প্রিন্সটনের একটা নাচেও মেয়েটাকে নিয়ে গিয়েছিল ও, এবং মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রিন্সটন থেকে তাকে বেরও করে দিতে চেয়েছিল কর্তৃপক্ষ। মেয়েটা একসময় কোনো এক ক্লাবে স্ট্রিপারের কাজ করত। যাই হোক, ফোনের কাছে গিয়ে ফেইথকে কল করলাম। সে সিক্সটি-ফিফথ অ্যান্ড ব্রডওয়ের স্ট্যানফোর্ড আর্মস হোটেলে থাকত।

ফোন করার আগে আমি আসলে ভাবিনি যে মেয়েটা বাসায় আছে নাকি নেই। কেউই ফোনে কোনো জবাব দিচ্ছিল না। কয়েকবার কল করার পর অবশেষে একজন ফোনটা ধরেছিল।

‘হ্যালো?’ বললাম। মেয়েটা যাতে আমার বয়স নিয়ে কোনো সন্দেহ না করে সেজন্য গলার স্বরটা একটু ভরাট ও গম্ভীর করে নিয়েছিলাম। এমনিতেও আমার কণ্ঠস্বর যথেষ্ট গভীর।

‘হ্যালো,’ ঐ পাশ থেকে মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। খুব একটা বন্ধুবৎসল শোনাচ্ছিল না কণ্ঠটাকে।

‘মিস ফেইথ ক্যাভেন্ডিশ?’

‘কে আপনি?’ ঐ পাশ থেকে বলল। ‘এত রাতে আমাকে ফোন করছে কে?’

ঐ কণ্ঠস্বর শুনে আমি কিছুটা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ‘হ্যাঁ, আমি জানি এখন অনেক রাত,’ পরিপক্কদের গম্ভীর গলায় জবাব দিলাম। ‘আশা করছি এজন্য আমাকে ক্ষমা করবেন, তবে আপনার সাথে যোগাযোগ করা খুব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল আমার জন্য,’ যতটা সম্ভব পূর্ণ বয়স্কদের মতো টান রেখে বললাম।

‘কে বলছেন প্লিজ?’ মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।

‘আসলে আপনি আমাকে চিনেন না। আমি এডি বার্ডসেলের বন্ধু। সেই আমাকে বলেছিল, শহরে আসলে যেন আপনাকে আমি ককটেলের জন্য আমন্ত্রণ জানাই।’

‘কে? আপনি কার বন্ধু?’ খোদা, মেয়েটা প্রায় খেঁকিয়ে বলছিল ফোনে। সত্যিকারের বাঘের গর্জনের মতোই লাগছিল ঐ খেঁকানোগুলো।

‘এডমুন্ড বার্ডসেল। এডি বার্ডসেল,’ বললাম। আসলে নাম ঠিক মনে আসছিল না তখন। এডমুন্ড বা এডওয়ার্ড কী যেন নাম ছিল ছেলেটার। এক পার্টিতে ছাড়া তার সাথে আর কখনোই দেখা হয়নি আমার।

‘ঐ নামের কাউকে আমি চিনি না, জ্যাক। আর আপনি যদি এই রাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলে মজা করার কথা ভেবে থাকেন…’

‘এডি বার্ডসেল? প্রিন্সটনের?’ আমি বললাম।

বুঝাই যাচ্ছিল যে ফোনের ওপাশের মেয়েটা তখন নামটা মনে করার চেষ্টা করছিল।

‘বার্ডসেল, বার্ডসেল… প্রিন্সটনের… প্রিন্সটন কলেজের?’

‘হ্যাঁ, প্রিন্সটন কলেজের,’ আমি বললাম।

‘আপনি প্রিন্সটন কলেজের?’

‘হ্যাঁ, বলা যায় তা।’

‘ওহ… এডি কেমন আছে?’ জিজ্ঞেস করল ফেইথ। ‘যদিও কাউকে ফোন করার জন্য এটা খুবই অদ্ভুত একটা সময়।’

‘সে ভালোই আছে। সে-ই আপনাকে স্মরণ করার কথা বলেছে আমাকে।’

‘ওহ, ধন্যবাদ। তাকেও আমার শুভেচ্ছা জানাবেন,’ বলল ফেইথ। ‘সে খুবই বড়ো মনের মানুষ। এখন কী করে ও?’ হঠাৎ করেই প্রচণ্ড ফ্রেন্ডলি হয়ে গেল মেয়েটা।

‘ঐ আগের কাজই। জানেনই তো আপনি,’ আমি বললাম। আমি কী করে জানবো যে এডি তখন কী করে? আমি তো ছেলেটাকে চিনিই না ভালো করে। এটাও জানি না ছেলেটা তখনো প্রিন্সটনে আছে নাকি নেই। ‘আচ্ছা, যাই হোক, আমার সাথে কোথাও ককটেল ড্রিংক করতে যাওয়ার ইচ্ছা আছে আপনার?’

‘আপনি কি জানেন এখন কয়টা বাজে?’ ফেইথ বলল। ‘যাই হোক, আপনার নামটা জানতে পারি কি?’ হঠাৎ করেই ইংরেজ টানে বলতে শুরু করল ফেইথ। ‘আপনার কণ্ঠ শুনে কিছুটা কম বয়স্ক মনে হচ্ছে। ‘

শুনে হাসলাম। ‘ধন্যবাদ কমপ্লিমেন্টের জন্য। আমার নাম হোল্ডেন কলফিল্ড।’ মেয়েটাকে আসলে মিথ্যা নাম বলা উচিৎ ছিল, তবে ঐ মুহূর্তে কেন যেন এটা মাথা আসেনি।

‘যাই হোক, মি. কফল। আমার আসলে এতো রাতে আলাপচারিতা করার তেমন অভ্যাস নেই। তাছাড়া ঘুম থেকে উঠে আমাকে কাজেও যেতে হয়।

‘কালকে তো রবিবার,’ বললাম।

‘তাহলে, আমাকে আমার সৌন্দর্য্যের জন্য হলেও ঘুমাতে হবে। বুঝেনই তো আপনি, তাই না। ‘

‘আমি তো আমার সাথে শুধু একটা ককটেল নেওয়ার কথাই বলছি। খুব বেশি তো রাত হয়নি এখনো।’

‘আপনি অনেক সুইট,’ ফেইথ বলল। ‘কোথা থেকে ফোন করেছেন? আছেনই বা কোথায় এখন?’

‘আমি? আমি এখন ফোন বুথে আছি।’

‘ওহ,’ বলে এরপর লম্বা একটা সময় চুপ করে রইলো ফেইথ। ‘আচ্ছা, আপনার সাথে কোনো একসময় দেখা করার ইচ্ছা আছে আমার, মি. কফল। আপনার কণ্ঠ বেশ আকর্ষণীয়। শুনে মনে হচ্ছে আপনি মানুষটাও দেখতে আকর্ষণীয় হবেন। তবে এখন অনেক রাত হয়ে গেছে।’

‘আমি তো আপনার ওখানেও আসতে পারি।’

‘হ্যাঁ, এটা হলে ভালোই হতো। ককটেল নিয়ে আপনি আমার এখানে আসলে আমার ভালোই লাগবে। তবে আমার রুমমেট একটু অসুস্থ। সারারাতে এক পলকও ঘুমাতে পারেনি ও। এই মাত্রই একটু চোখ লাগিয়েছে। সেজন্যই আর কী…’

‘ওহ, তাহলে তো খুব খারাপ।’

‘আপনি থাকছেন কোথায়? ককটেলের জন্য কাল রাতেও দেখা করতে পারি আমরা।’

‘কাল তো পারবো না আমি,’ বললাম। ‘আসলে আমার হাতে আজকের রাতেই সময় ছিল।’ বিশাল বড়ো একটা মিথ্যা। আমার আসলে এটা বলা উচিৎ হয়নি।

‘ওহ, তাহলে খুবই দুঃখিত আমি।’

‘সমস্যা নেই। এডিকে আপনার পক্ষ থেকে হ্যালো জানাবো আমি।’

‘জানাবেন আপনি? ধন্যবাদ। আশা করছি নিউইয়র্কে আপনার সময়টা ভালো কাটবে। খুবই ভালো একটা জায়গা এটা।’

‘আমি জানি। ধন্যবাদ। শুভরাত্রি,’ বলে ফোন রেখে দিলাম।

খোদা, আমি আসলেই তালগোল পাকিয়ে ফেলেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *