দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ৫

অধ্যায় পাঁচ

পেন্সিতে প্রতি শনিবার একই মিল দিতো। ব্যাপারটা বেশ বড়ো ছিল, কারণ ঐদিন মিলে মাংসের ফালি বা স্টেক দেওয়া হতো। হাজার টাকা বাজি ধরে বলতে পারি, তারা ঐদিন স্টেক ডিনার দিতো কারণ রবিবারে অনেকের বাবা-মা স্কুলে ছেলেদের দেখতে আসতো। থার্মার খুব সম্ভবত আঁচ করেছিল যে প্রত্যেকের মায়েরাই তাদের প্রাণপ্রিয় ছেলেকে জিজ্ঞেস করে তারা আগের রাতে কী দিয়ে খেয়েছে, আর তারা বলবে, ‘স্টেক।’ বাহ, কী চমৎকার ফন্দি শিক্ষার্থীর বাবা-মায়েদের মুগ্ধ করার। আর স্টেকও তো দিতো—কী আর বলবো। ওগুলো এতো শক্ত আর শুকনো থাকত যে ঠিকমতো কাটাই যেতো না। স্টেক নাইটে সাথে সবসময়ই থাকত আলুভর্তা আর ডেজার্ট হিসেবে থাকত ব্রাউন বেটি। যেটা কেউই কখনো খেতো না। সম্ভবত নিচের ক্লাসের স্কুলগুলোর বাচ্চারাই ঐ ডেজার্টটা খেতো—কারণ তাদের তো আর অত বুঝার মতো বয়সই হয়নি। আর খেতো অ্যাকলি। অবশ্য অ্যাকলি সবই খেতো, কিছুই বাদ দিতো না।

ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময়টা বেশ ভালোই ছিল অবশ্য। মাঠে কম করে হলেও তিন ইঞ্চির মতো বরফের স্তর জমে গিয়েছিল ঐদিন। মুষলধারে বরফ পড়ছিল বলা যায়। দৃশ্যটা দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল। প্রত্যেকেই ঐদিন বরফের বল বানিয়ে এর-ওর দিকে ছুঁড়ে মারছিল, বরফ নিয়ে খেলা করছিল ইচ্ছামতো। অবশ্যই ব্যাপারটা বাচ্চামো ছিল, তবে ঐদিন সবাই-ই প্রচণ্ড মজা করেছে বরফ নিয়ে।

আমার কোনো ডেট বা এমন কিছু ছিল না। তাই আমি আর রেসলিং টিমে থাকা আমার এক বন্ধু মেল ব্রোসার্ড সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা অ্যাগার্সটাউনে যাবো এবং ওখানে গিয়ে হ্যামবার্গার খাবো। পারলে একটা মুভিও দেখে আসবো। আমাদের দুইজনের কেউই ঐদিন সারারাত অযথাই বসে থাকতে চাচ্ছিলাম না। আমি মেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম অ্যাকলি আমাদের সাথে গেলে তার কোনো সমস্যা আছে কি না। আমার জিজ্ঞেস করার কারণ অ্যাকলি শনিবার রাতে তার রুমে শুয়ে বসে এবং ব্রণ চিমটানো ছাড়া কোনো কাজই করে না। মেল বলল যে অ্যাকলি গেলে তার কোনো সমস্যা নেই, তবে অ্যাকলির যাওয়াতে সে খুব একটা আনন্দিতও না। অ্যাকলিকে সে খুব একটা পছন্দ করত না। যাই হোক, আমরা দুইজনেই আমাদের রুমে ফিরে গেলাম তৈরি হওয়ার জন্য। রুমে গিয়ে গালোশ (ওয়াটারপ্রুফ ওভারস্যু) পরার সময় চেঁচিয়ে অ্যাকলিকে বললাম সে কি আমাদের সাথে মুভি দেখতে যেতে চায় কি না। আমি জানি শাওয়ারের পর্দার ফাঁক দিয়ে সে ঠিকই আমার ডাক শুনতে পেয়েছে, তবে সে সাথে সাথেই কোনো জবাব দেয়নি। সে কখনো সাথে সাথেই কোনো ডাক বা প্রশ্নের জবাব দিতো না। বরং সাথে সাথেই সাড়া দেওয়াটাকে সে ঘৃণা করত বলা যায়। কিছুক্ষণ পর পর্দাগুলো সরিয়ে শাওয়ারের তাকে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল আমার সাথে আর কে যাচ্ছে। সে সবসময়ই জানতে চাইতো সাথে আর কে থাকবে। সত্যি বলতে সে আসলে এমন একজন মানুষ যে জাহাজডুবির শিকার হলে তাকে বোটে করে উদ্ধার করতে যাওয়া মানুষটাকেও জিজ্ঞেস করবে এখানে আসার আগে তাদের নৌকার দাঁড় কে টানছিল। যাই হোক, তাকে বললাম যে মেল ব্রোসার্ড যাবে আমার সাথে। সে বলল, ‘ঐ হারামিটা… আচ্ছা। এক সেকেন্ড দাঁড়াও।’ তার কথার ধরন এমন যে সে রাজি হয়ে আমার বড়ো কোনো উপকার করে ফেলেছে।

তার তৈরি হতে প্রায় পাঁচ মিনিট লেগেছিল বলা যায়। সে তৈরি হওয়ার সময়টায় আমি জানালার কাছে গিয়ে, জানালা খুলে খালি হাতেই একটা স্নোবল বানালাম। গোল করার জন্য বরফটা বেশ ভালোই ছিল। অবশ্য বলটা কোথাও ছুঁড়ে মারিনি। যদিও রাস্তার অন্য পাশে দাঁড়ানো একটা গাড়ির দিকে ছুড়ে মারতে যাচ্ছিলাম, তবে শেষমেশ আর মারিনি। কারণ গাড়িটাকে খুব সুন্দর আর সাদা দেখাচ্ছিল। তারপর ওটা ছুঁড়ে মারতে চাইলাম রাস্তার ধারে থাকা পানির কলটার দিকে, তবে ওটাও খুব সুন্দর আর সাদা দেখাচ্ছিল। শেষমেশ আমি ঐ বলটা আর কোথাওই ছুঁড়ে মারিনি। এরপর জানালা বন্ধ করে স্নো বলটা হাতে নিয়েই আবার রুমে ফিরে এলাম। এর কিছুক্ষণ পর ব্রোসার্ড আর অ্যাকলির সাথে বাসে চড়ে বসার সময়ও স্নোবলটা আমার হাতেই ছিল। বাস ড্রাইভার দরজা খুলে বলটা আমাকে ছুড়ে মারতে বাধ্য করেছিল যদিও। আমি তাকে বলেছিলাম আমি বলটা কারো দিকে ছুঁড়ে মারবো না, তবে লোকটা আমাকে বিশ্বাস করেনি। মানুষ কখনোই কাউকে বিশ্বাস করে না।

ব্রোসার্ড আর অ্যাকলি দুইজনই আগে হলে চলতে থাকা মুভিটা দেখেছিল। তাই আমরা শুধু দুইটা করে হ্যামবার্গার খেলাম আর আমি পিনবল মেশিনে খেললাম কিছুক্ষণ। তারপর বাসে চড়ে আবার ফিরে এলাম পেন্সিতে। আমার এমনিতেও কোনো মুভি দেখার কোনো ইচ্ছা ছিল না। মুভিটা ছিল কমেডি, ক্যারি গ্র্যান্টসহ আরো কে কে যেন ছিল। তাছাড়া ব্রোসার্ড আর অ্যাকলি আগেও মুভিটি দেখেছে। তারা দুইজন তো কোনো কিছু মজার না হলেও হায়েনার মতো পাগুলে হাসিতে ফেটে পড়তো। তাদের সাথে বসে মুভি দেখাটা কখনোই আমার জন্য উপভোগ্য কিছু ছিল না।

ডর্মে যখন ফিরে যাই তখন প্রায় পৌনে নয়টার মতো বাজে। ব্রোসাৰ্ড ছিল ব্রিজ খেলার ভক্ত। ডর্মে ফিরেই সে কোথায় কে ব্রিজ খেলছে সেটা খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর অ্যাকলি এসে ঢুকলো আমার রুমে। তবে এবার আর সে স্ট্র্যাডলেটারের চেয়ারের হাতলে বসেনি, রুমে ঢুকেই সে শুয়ে পড়লো আমার বিছানায়। তাও আবার আমার বালিশে মুখ চেপে। এরপর সে শুরু করল একঘেয়ে কণ্ঠে কথা বলা আর তার ব্রণে চিমটানো। কাজগুলো থামানোর জন্য আমি তাকে প্রায় হাজারবারের মতো ইশারা করেছি, কিন্তু কোনোভাবেই তাকে নিবৃত করতে পারিনি। সে শুধু একঘেয়ে কণ্ঠে এক মেয়ের কথাই বলে যাচ্ছিল, যার সাথে আগের গ্রীষ্মে যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিল। আমাকে সে এই গল্পটা এর আগেও আরো একশোবার বলেছে। প্রতিবারই তার গল্পটা বদলে যেতো। একবার বলত সে এটা করেছে তার কাজিন বুইকের ওখানে, আরেকবার বলত সে ওটা করেছে এক ব্রডওয়ের ধারে। নিঃসন্দেহেই পুরোটা ছিল তার বানানো গল্প। সে একটা ভার্জিন, আমি নিশ্চিত এটা। এমনকি আমার সন্দেহ আছে সে কখনো কাউকে কোনোরূপ অনুভূতিও দিতে পেরেছে কি না। যাইহোক, শেষমেশ একসময় আমি তাকে সরাসরিই বলে দিই যে আমাকে স্ট্র্যাডলেটারের জন্য একটা কম্পোজিশন লিখতে হবে এবং এটার জন্য আমার মনোযোগ দরকার, সে যেন তার রুমে চলে যায়। সে গিয়েছিল ঠিকই, তবে বরাবরের মতোই লম্বা সময় নষ্ট করার পর। সে চলে যাওয়ার পর আমি আমার নাইটড্রেস, বাথরোব পরে মাথায় হান্টিং টুপিটা লাগিয়ে কম্পোজিশন লিখতে শুরু করলাম।

সমস্যাটা হলো স্ট্র্যাডলেটার যেমন করে চেয়েছে সেরকমভাবে বর্ণনা করার মতো কোনো রুম বা বাড়ি বা কোনো কিছুই আমার মাথা আসছিল না। সত্যি বলতে আমার আসলে রুম বা বাসা নিয়ে বর্ণনামূলক কিছু লেখার কোনো আগ্রহও ছিল না। তাই আমি আমার ভাই এলির বেসবল গ্লাভস (বেসবল মিট) নিয়ে লেখা শুরু করলাম। এটা খুবই বর্ণনামূলক একটা বিষয় ছিল। আসলেই। আমার ভাই এলির কাছে একটা বাঁ-হাতি ফিল্ডার গ্লাভস ছিল। সে বাঁ-হাতি ছিল। ঐ গ্লাভসটার ব্যাপারে ব্যাখ্যা করার মতো ব্যাপারটা ছিল—সে ঐ গ্লাভসের প্রতিটি আঙুলের ফাঁকে, পকেটে বা যেখানে সুযোগ ছিল সবখানেই কবিতা লিখে রেখেছিল সবুজ কালি দিয়ে। মাঠে থাকলে বা ব্যাটিং করার কেউ না থাকলে সে যেন কিছু পড়তে পারে—তাই সে কবিতাগুলো লিখেছিল। যদিও সে এখন মৃত। ১৯৪৬ সালে ১৮ জুলাই লিউকোমিয়ায় মারা গেছে ও। আমরা তখন মেইনে থাকতাম। ও ভালো লাগার মতো মানুষ ছিল। বয়সে আমার দুই বছরের ছোটো হলেও বুদ্ধির দিক থেকে সে ছিল আমার থেকে পঞ্চাশগুণ বেশি তীক্ষ্ণ। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ছিল। তার শিক্ষকরা সবসময়ই মাকে চিঠি লিখতো। চিঠিতে জানাতো এলির মতো একজনকে তাদের ক্লাসে পাওয়া তাদের জন্য কতটা আনন্দের। কথাগুলো তারা তোষামোদ করে বলেনি, সত্যি সত্যিই তারা কথাগুলো মন থেকে বলেছিল। তবে এলি শুধুই আমাদের পরিবারের সবচেয়ে বুদ্ধিমান সদস্য ছিল না, অনেক দিক থেকে সে ছিল সবচেয়ে ভদ্রও। সে কখনো কারো ওপর রাগ করত না। লালচুলো মানুষরা স্বাভাবিকভাবেই চটজলদি রেগে যায়, তবে এলি কখনো রাগেনি। তারও লাল চুল ছিল। দশ বছর বয়সে আমি প্রথম গলফ খেলা শুরু করেছি। আমার মনে আছে একবার এক গ্রীষ্মে দুপুর বারোটার দিকে আমি টি থেকে বল ছুড়ে মেরেছি এবং হঠাৎ করেই মনে হলো আমি যদি ঘুরে তাকাই তাহলে হয়তো এলিকে দেখতে পাবো। ব্যাপারটা আসলেই তাই ছিল। আমি নিশ্চিত সে ফেন্সের বাইরের বাইকে বসেছিল। (পুরো গলফ কোর্সটার চারপাশেই একটা ফেন্স ছিল) আমার একশো পঞ্চাশ গজ পিছনে বসেছিল ও, আর বসে বসে আমার ক্লাব দিয়ে বল ছুড়ে মারা দেখছিল। হ্যাঁ, এমনই লাল চুল ছিল ওর। খোদা, সে খুবই ভালো একটা বাচ্চা ছিল। আমাকে যখন প্রথম সাইকো-অ্যানালাইজড করা হয় তখন আমার বয়স ছিল মাত্র তেরো। সাইকো-অ্যানালাইজ করার কারণ আমি গ্যারেজের সব জানালা ভেঙে ফেলেছিলাম। অবশ্য এজন্য কাউকে দোষ দিই না আমি এলি যেদিন মারা যায় ঐ রাতে আমি গ্যারেজে ঘুমিয়েছিলাম এবং ঘুষি দিয়ে সব জানালা ভেঙে ফেলেছিলাম। কোনো কারণ ছাড়া এমনিতেই ভেঙেছিলাম। এমনকি আমি আমাদের স্টেশন ওয়াগনের জানালাও ভাঙতে চেয়েছিলাম। তবে ততক্ষণে হাত ভেঙে যাওয়ায় আর কিছু করতে পারিনি। অবশ্য আমি স্বীকার করি যে কাজটা বেশ গর্ধভের মতো ছিল। তবে তখন তো আমার মাথায়ই ছিল না আমি কী করছি, আর এলি কেমন ছিল তা তো আমি জানিই। বৃষ্টি পড়লে আমার হাতগুলো এখনো মাঝেমধ্যে ব্যথা করে। আমি এখনো মুষ্টি পাকাতে পারি না—মানে শক্ত করে মুষ্টি পাকাতে পারি না ঠিক, তবে এটা নিয়ে আমার কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই। আমি তো আর সার্জন, ভায়োলিনিস্ট বা এমন কিছু হবো না।

যাই হোক, স্ট্র্যাডলেটারের কম্পোজিশনটা আমি এলির বেসবল গ্লাভস নিয়েই লিখেছি। গ্লাভসটা আমার কাছেই ছিল তখন, আমার স্যুটকেসে। তাই স্যুটকেস থেকে গ্লাভসটা বের করে ওটাতে লেখা কবিতাগুলো লিখে নিলাম। তবে লেখার সময় এলির নামটা বদলে দিয়েছিলাম যাতে কেউ না বুঝতে পারে লেখাটা আমার ভাইকে নিয়ে এবং লেখাটা স্ট্র্যাডলেটার লিখেনি। অবশ্য ঐ গ্লাভস নিয়ে স্ট্র্যাডলেটারের জন্য লেখায় আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না, কিন্তু আমি এটা ছাড়া বর্ণনা করার মতো অন্য কোনো বিষয় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আর তাছাড়া ওটা নিয়ে লিখতে ভালোই লেগেছে। লিখতে এক ঘণ্টা লেগেছিল। এতো সময় লাগার কারণ আমাকে স্ট্র্যাডলেটারের টাইপরাইটারে লিখতে হয়েছে, আর মেশিনটা একটু পরপরই জ্যাম হয়ে যাচ্ছিল। আর আমার টাপরাইটারটা উইংয়ের আরেকজন ধার নিয়েছিল, তাই স্ট্র্যাডলেটারেরটায় লেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

লেখা শেষের পর দেখি তখন সাড়ে দশটা বাজে। আমার অবশ্য কোনো ক্লান্তি লাগছিল না, তাই জানালা দিয়ে কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে রইলাম। তুষার পড়া থেমে গিয়েছিল তখন। মাঝেমধ্যেই ঠান্ডায় জমে যাওয়া ইঞ্জিন চালু হতে বিকল হওয়া গাড়িগুলোর শব্দ শোনা যাচ্ছিল। শোনা যাচ্ছিল অ্যাকলির নাক ডাকার শব্দও। পর্দা ভেদ করেই তার নাক ডাকার শব্দ ভেসে আসছিল আমার রুমে। তার সাইনাসের সমস্যা ছিল আর ঘুমের সময় সে শ্বাসও ঠিকমতো নিতে পারতো না। ছেলেটার আসলে সব রকমের সমস্যাই ছিল—সাইনাস, ব্রণ, নোংরা দাঁত, দুর্গন্ধময় শ্বাস, এবড়ো-থেবড়ো আঙুলের নখ। হারামিটার জন্য মাঝেমধ্যে বেশ দুঃখই লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *