দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ২

অধ্যায় দুই

তাদের দুইজনেরই আলাদা আলাদা রুম আছে। দুইজনের বয়সই সত্তরের মতো, আরো বেশিও হতে পারে। অনেক কিছুই উপভোগ করেছেন তাদের জীবনে, যদিও অবশ্যই খুব একটা ভালো করে তা করতে পারেননি। কথাটা শুনতে খারাপ মনে হলেও আমি আসলে খারাপ কিছু বুঝাইনি। শুধু বলছি যে আমি এই বৃদ্ধ স্পেন্সারকে অনেকটা সময় ভেবেছি, আর লোকটাকে নিয়ে যদি কেউ অতিরিক্ত ভেবে থাকে—তাহলে মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগবে, লোকটা এখনো বেঁচে আছে কিসের জন্য। মানে বলতে চাচ্ছি, লোকটা কুঁজো হয়ে গেছে, শিরদাঁড়ার অবস্থা খুবই খারাপ। ক্লাসে বোর্ডে লেখার সময় হাত থেকে চক পড়ে গেলেও সেটা তুলতে পারেন না তিনি। সবসময়ই সামনের সারিতে থাকা কারো উঠে চকটা তাঁর হাতে তুলে দিতে হয়। আমার মতে এরকম জীবন তো খুবই জঘন্য জীবন। তবে লোকটাকে নিয়ে যদি কেউ অতিরিক্ত না ভেবে যথেষ্ট পরিমাণ ভাবে, তাহলে বুঝতে পারবে লোকটার জীবন আসলে খুব একটা খারাপ নয়। উদাহরণস্বরূপ, এক রবিবার আমি আর স্কুলের কয়েকজন মিলে উনার বাসায় হট চকলেট খেতে গিয়েছিলাম। ঐদিন মি. স্পেন্সার আমাদেরকে একটা পুরোনো ছেঁড়া নাভাজো কম্বল দেখিয়ে বলেছিলেন, কম্বলটা নাকি তিনি আর মিসেস স্পেন্সার মিলে ইয়েলোস্টোন পার্কের এক ইন্ডিয়ানের থেকে কিনেছেন। কথাগুলো বলার সময় তাঁর চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে তিনি এই কম্বলটা কিনে খুবই তৃপ্ত হয়েছেন। হ্যাঁ, আমি এটাই বুঝাতে চাচ্ছি। কাউকে দেখে হয়তো মি. স্পেন্সারের মতো অনেক বয়স্ক মনে হতে পারে কিংবা মনে হতে পারে লোকটা এখনো বেঁচে আছে কিসের আশায়, সেই মানুষগুলোর আশাও কিন্তু আসলে খুব অল্পই থাকে, একটা ছেঁড়াফাটা কম্বল পাওয়াতেই সে পরিতৃপ্ত হয়ে যেতে পারে।

মি. স্পেন্সারের দরজাটা খোলাই ছিল, তারপরও ভদ্রতার খাতিরে দরজায় টোকা দিলাম। দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম যে তিনি একটা বড়ো চামড়ার চেয়ারে বসে আছেন। শরীর মুড়িয়ে রেখেছেন একটু আগেই বলা ঐ কম্বলটা দিয়ে। টোকার শব্দ শুনে বসা অবস্থাতেই চোখ তুলে তাকালেন দরজার দিকে। ‘কে ওখানে?’ চেঁচিয়ে বললেন। ‘ওহ, কলফিল্ড? আসো, আসো, ভেতরে আসো।’ তিনি আসলে সবসময়ই চেঁচিয়ে কথা বলেন। ক্লাসেও, ক্লাসের বাইরেও। চেঁচানোটা অনেকটা ভড়কেও দেয় তাঁর শ্রোতাদেরকে।

রুমের ভেতরে ঢুকেই মনে হলো আমার ওখানে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। ঢুকতেই প্রচণ্ড খারাপ লাগা শুরু করল আমার। অসুস্থ মানুষের প্রতি আমার কোনো সমস্যা ছিল না। তবে রুমের অবস্থাটা ছিল খুবই খারাপ। মি. স্পেন্সার চেয়ারে বসে আলান্টিক মান্থলির একটা কপি পড়ছিলেন। ওষুধ-বড়ি ছড়িয়ে ছিল পুরো রুমে জুড়ে, বাতাসে ভাসছিল শুধু নাকের ড্রপের গন্ধ। খুবই বিষণ্নকর এক অবস্থা। মি. স্পেন্সারের পরনে ছিল খুবই পুরোনো, মলিন একটা বাথরোব। কে জানে জন্মের পর তাঁকে ঐ বাথরোবেই মোড়ানো হয়েছিল কী না। বয়স্ক লোকদেরকে রোবে দেখতে আমার অতটা ভালো লাগে না। রোবে তাদের জীর্ণশীর্ণ বুক আর পা সবসময়ই উন্মুক্ত হয়ে থাকে। বিচে এবং অন্যান্য কিছু জায়গায় দেখেছি, বৃদ্ধ লোকদের পা খুব বেশি ফ্যাঁকাশে আর অ-লোমশ হয়। দেখতে খুবই বিশ্রি লাগে।

‘হ্যালো, স্যার,’ বললাম। ‘আপনার নোটটা পেয়েছি। ধন্যবাদ, স্যার।’ তিনি আমাকে একটা নোটে লিখে জানিয়েছিলেন আমি যেন ছুটি শুরুর আগে উনার সাথে একবার দেখা করে যাই। ‘আপনার নোট পাঠানোর দরকার ছিল না। আমি নিজেই এসে আপনার সাথে দেখা করে যেতাম।’

‘বসো ওখানে,’ বললেন মি. স্পেন্সার। ওখানে বলতে তিনি বিছানাকে বুঝিয়েছেন।

বিছানায় বসলাম। পাথরের মতো শক্ত। ‘আপনার অসুখের কী অবস্থা, স্যার?’

‘মাইবয়, আমার যদি আরেকটু বেশি ভালো লাগে, তাহলে হয়তো আমি ডাক্তারের জন্য ডাক পাঠাবো,’ বলে পাগলের মতো খুক খুক কর হাসতে শুরু করলেন বৃদ্ধ স্পেন্সার। অসুখে আসলে তাঁর মানসিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ হাসার পর নিজেকে আবার স্বাভাবিক করে নিয়ে বললেন, ‘তুমি খেলার মাঠে নেই কেন? আমি তো জানতাম আজকে বড়ো খেলাটা হওয়ার কথা।’

‘হ্যাঁ, স্যার খেলাটা আজই হচ্ছে। আমিও ওখানেই ছিলাম। মাত্রই পেন্সিং টিম সাথে করে নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসেছি,’ বললাম।

‘তো, তুমি আমাদেরকে ছেড়ে চলে যাচ্ছো, না?’ সিরিয়াস কণ্ঠে বললেন মি. স্পেন্সার। আমি জানতাম যে তিনি সিরিয়াস হবেনই একসময়।

‘হ্যাঁ, স্যার। তাই তো মনে হয়।’

শুনে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলেন তিনি। আমি আমার জীবনে কাউকে কখনো এতো বেশি মাথা ঝাঁকাতে দেখিনি। দেখে বুঝার উপায় নেই যে তিনি কি মাথা ঝাঁকিয়ে কোনো কিছু ভাবছেন, নাকি তিনি মাথা ঝাঁকানো থামাতে ভুলে গেছেন।

‘ড. থার্মার তোমাকে কী বলেছে? যতদূর জানি তোমার সাথে তাঁর কথে পিকথন হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, স্যার। আসলেই আমাদের কথা হয়েছে। প্রায় দুই ঘণ্টার মতো উনার অফিসে ছিলাম আমি।’

‘কী বলেছে তোমাকে লোকটা?’

‘তেমন কিছু না… বলেছে জীবন আসলে একটা খেলার মতো। আর এই খেলাটা খেলতে হয় সব নিয়মকানুন অনুসরণ করে। খুব ভালোভাবেই কথা বলেছেন তিনি। মানে তিনি আসলে উত্তেজিত হয়ে বা রাগান্বিত গলায় কিছু বলেননি। তিনি শুধু ‘জীবন একটা খেলা’ এটা নিয়েই বলে গেছেন।

‘জীবন আসলেই একটা খেলার মতো, বাছা। আর এই খেলাটা খেলতে হয় সব নিয়ম মেনেই।’

‘হ্যাঁ, স্যার। আমি জানি এটা, আমি জানি।’

ধুর, খেলা না ছাই। তামাশার খেলা আমার। যদি গুরুত্বপূর্ণ-নামিদামী মানুষদের দলে কেউ থাকে, তাহলে এটা আসলেই একটা খেলা—আমি মানি সেটা। তবে কেউ যদি অন্য দলটাতে থাকে, যেটাতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ- নামিদামী মানুষরা না থাকে, তাহলে এখানে খেলার আছেটাই বা কী? কিছুই না। কোনো খেলাও না।

‘ড. থার্মার কি তোমার বাবা-মাকে ব্যাপারটা জানিয়ে চিঠি দিয়েছে কোনো? বৃদ্ধ স্পেন্সার জিজ্ঞেস করলেন।

‘তিনি বলেছেন সোমবার চিঠি পাঠাবেন।

‘তুমি কি তাদের সাথে যোগাযোগ করেছো?’

‘না, স্যার। করিনি। বুধবার বাসায় গেলে তো এমনিই দেখা হবে, তাই আর যোগাযোগ করিনি।’

‘তোমার কি মনে হয়। তারা খবরটা কীভাবে নেবে?’

‘উমম… তারা এটা নিয়ে কিছুটা বিরক্ত হবে,’ বললাম। ‘তারা আসলেই বিরক্ত হবে অনেক। এই নিয়ে আমি এখন পর্যন্ত মোট চারটা স্কুলে ভর্তি হয়েছি।’ বলে একটু মাথা নাড়লাম। আসলে একটু না, অনেকক্ষণই মাথা নাড়লাম। ‘খোদা!’ আমি বললাম। ‘খোদা!’ শব্দটা আসলে আমি একটু বেশিই বলি। এর পিছনে একটা কারণ আমার শব্দভান্ডার অনেক দুর্বল, আর আরেকটা কারণ হচ্ছে আমি প্রায়ই আমার নিজের বয়সের থেকে একটু কম বয়সের মানুষের মতো আচরণ করি। গত ডিসেম্বরে আমার বয়স ছিল ষোলো, আর এখন সতেরো, কিন্তু মাঝেমধ্যে আমি তেরো বছর বয়সী বাচ্চার মতো আচরণ করে বসি। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর, কারণ আমার উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট আড়াই ইঞ্চির মতো আর চুলগুলো ধূসর মানে পাকা। আসলেই আমার চুল পেকে গেছে। মাথার একপাশে মানে ডানে পাশে প্রায় মিলিয়ন খানেকের মতো পাকা চুল রয়েছে। সেই বাচ্চাকাল থেকেই আমার ডানপাশের চুলগুলো ধূসর। তারপরও আমি মাঝেমধ্যে বারো বছরের বাচ্চাদের মতো আচরণ করে বসি। সবাই এই কথা বলে, সবচেয়ে বেশি বলে আমার বাবা। কথাটা অবশ্য সত্য, তবে পুরোপুরি সত্য না। মানুষের সবসময়ই কিছু কিছু ব্যাপার পুরোপুরিই সত্য থাকে। তবে তারা কী ভাবে তা নিয়ে আমি খুব একটা কেয়ার করি না। মাঝেমধ্যে মানুষ যখন আমাকে বলে বাচ্চামো ছেড়ে নিজের বয়সের মতো আচরণ করতে, তখন খুবই বিরক্ত লাগে। কিছু কিছু সময় আমি আমার বয়স থেকে অনেক বেশি বয়সীদের মতোও কথা বলি, কিন্তু ওটা কখনো খেয়ালই করে না কেউ। মানুষ আসলে কখনো খেয়াল করে না।

বৃদ্ধ স্পেন্সার আবারো মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলেন। সেই সাথে নাকও খোঁচাতে শুরু করেছেন। দেখে মনে হচ্ছে তিনি হয়তো নাক চুলকাচ্ছেন, কিন্তু আসলে তিনি তাঁর বুড়ো আঙুল নাকের ভেতর ঠেসে দিয়ে বসে আছেন। হয়তো রুমে আমি ছাড়া আর কেউ নেই বলেই তিনি এই কাজটা করতে কোনো দ্বিধা করছেন না। আমারও এটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, তবে কাউকে নাক খোঁচাতে দেখাটা খুবই বিরক্তিকর একটা ব্যাপার।

কিছুক্ষণ নাক খোঁচানোর পর তিনি বললেন, ‘কয়েক সপ্তাহ আগে ড. থার্মারের সাথে দেখা করতে আসার সময় তোমার মা-বাবার সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তারা খুবই বড়ো মনের মানুষ।’

‘হ্যাঁ, স্যার। তারা খুবই ভালো মানুষ।’

বড়ো মন! এই শব্দটা আমি খুবই ঘৃণা করি। শুনলেই মেকি মেকি মনে হয়। শব্দটা শুনলেই আমার ইচ্ছা করে গড়গড় করে বমি করে দেই।

এরপর হঠাৎ করেই মি. স্পেন্সারকে দেখে মনে হলো তিনি আমাকে খুবই ভালো বা বুদ্ধিদীপ্ত কোনো উপদেশ দিতে যাচ্ছেন। চেয়ারে তিনি আরো কিছুটা সোজা হয়ে উঠে বসেছেন, শরীরও ঘুরিয়েছেন আমার দিকে। তবে কিছু বললেন না। সোজা হয়ে তিনি শুধু আটলান্টিক মান্থলি’র কপিটা হাতে তুলে নিয়ে ছুড়ে দিলেন বিছানার ওপর। তাঁর চেয়ার থেকে বিছানার দূরত্ব মাত্র দুই ইঞ্চির মতো হবে, এরপরও তিনি মিস করলেন। বিছানার ধারে লেগে নিচে পড়ে গেছে কপিটা। আমিই উবু হয়ে কপিটা তুলে রাখলাম বিছানার ওপর। ঠিক তখন হঠাৎ করেই আমার মনে হলো আমার এই রুমটা থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিৎ। আমাকে বিশাল একটা লেকচার শুনতে হবে। লেকচার শোনায় আমার সমস্যা নেই, কিন্তু নাকের ড্রপের ঘ্রাণে ভরা রুমে বাথরোব পরা বৃদ্ধ স্পেন্সারের থেকে লেকচার শোনা কোনোভাবেই সম্ভব না আমার পক্ষে। এতোগুলো জিনিস একবারে মাথায় নেওয়া মহা-অসম্ভব ব্যাপার।

তবে লেকচারটা শুরু হয়ে গেলো ঠিকই। ‘তোমার সমস্যাটা কী, বাছা? মি. স্পেন্সার বললেন। ব্যাপারটা আসলে তাঁর জন্যও একটু কঠিন। ‘এই টার্মে কয়টা সাবজেক্ট ছিল তোমার?’

‘পাঁচটা, স্যার।’

‘পাঁচটা। আর কতগুলোতে ফেইল করেছো?

‘চারটা।’ বিছানায় একটু সরে বসলাম। আমার বসা সবচেয়ে শক্ত বিছানা এটা। ‘ইংরেজিতে ভালোভাবেই পাস করেছি,’ বললাম। ‘ইংরেজিতে আমার কোর্সে বেউলজ আর লর্ড র‍্যান্ডাল মাই সন ছিল, এগুলো আমি হুটন স্কুলেই পড়ে এসেছি। মানে ইংরেজিতে আর কী আমাকে খুব একটা সমস্যা হয়নি, মাঝেমধ্যে কয়েকটা কম্পোজিশন লিখতে হয়েছে শুধু।’

মি. স্পেন্সারের আমার কথায় কোনো মনোযোগই ছিল না। আসলে লোকটার কারো কথার ওপরই মনোযোগ থাকে না।

‘আমি ইতিহাসে ফেইল করিয়েছি কারণ তুমি ইতিহাসের কিছুই জানো না।

‘জি, স্যার, জানি সেটা। এখানে আপনার সাহায্য করার কিছু ছিলও না।’

‘কিছুই জানো না,’ তিনি আবার বললেন। ব্যাপারটা বিরক্তিকর। একই কথা দুইবার বলা আমার ভালো লাগে না। বিশেষ করে প্রথমবার কথাটায় সায় দিয়ে স্বীকার করে নেওয়ার পরও ঐ কথাটা আরেকবার বললে খুবই বিরক্ত লাগে। বিরক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি আরো একবার বললেন কথাটা। ‘একেবারেই কিছু জানো না। পুরো টার্মে তুমি তোমার বই খুলে দেখেছিলে কী না তাতেও আমার সন্দেহ আছে। খুলে দেখেছিলে? সত্যি করে বলো তো।’

‘আসলে, স্যার, বেশ কয়েকবার বইটার পাতা উলটেপালটে দেখেছিলাম, ‘ বললাম। আমি আসলে লোকটার মনে কোনো আঘাত করতে চাইনি। ইতিহাস নিয়ে পুরো পাগল ছিল লোকটা।

‘পাতা উলটে দেখেছিলে, হু?’ বিদ্রুপাত্মক স্বরে বললেন। ‘তোমার পরীক্ষার খাতাটা আমার টেবিলের ওপরেই আছে। স্তুপের একদম ওপরেই আছে। ওটা একটু নিয়ে আসো তো।’

এটা খুবই খারাপ একটা ট্রিক, তবে কোনো তর্ক না করে উঠে গিয়ে খাতাটা এনে দিলাম মি. স্পেন্সারকে। এটা ছাড়া আমার আসলে অন্য কিছু করারও ছিল না। খাতাটা উনার হাতে দিয়ে আবারো বসলাম সিমেন্টের খাটটার ওপর। খোদা, কাউকে বলে বুঝাতে পারবো না যে উনাকে বিদায় জানাতে গিয়ে ওরকম অবস্থায় পড়ে আমার কেমন লাগছিল।

তিনি আমার খাতাটা তুলে নিয়ে এমন চোখে তাকালেন যেন এটা খুবই জঘন্য কিছু। ‘মিশর নিয়ে নভেম্বরের ৪ তারিখ থেকে ডিসেম্বরের ২ তারিখ পর্যন্ত ক্লাসে পড়ানো হয়েছে,’ তিনি বললেন। ‘আর তুমি ঐ পরীক্ষায় ঐচ্ছিক রচনার প্রশ্নটার উত্তর করেছো। ওখানে তুমি কী লিখেছো সেটা শোনার কি কোনো ইচ্ছা আছে তোমার?’

‘না, স্যার। খুব একটা ইচ্ছা নেই,’ বললাম।

উনি তারপরও ঠিকই পড়তে শুরু করলেন। আসলে কোনো শিক্ষক যখন কিছু করার জন্য মনস্থির করে বসে, তখন তাঁকে থামানোর কোনো উপায় থাকে না। তাঁরা কাজটা করবেই।

মিশরীয়রা ককেশিয়ানদের খুবই পুরোনো একটি জাতি যারা থাকে আফ্রিকার উত্তরের একটা অংশে। আফ্রিকা হচ্ছে পূর্ব গোলার্ধ্বের সবচেয়ে বড়ো মহাদেশ। শক্ত বিছানায় বসে এসব আজগুবি কথা শোনা ছাড়া আমার আসলে কিছুই করার ছিল না। খুবই বাজে একটা ফাঁদে আঁটকে গেছি।

বিভিন্ন কারণে আমাদের কাছে খুবই রহস্যময় এক জাতি হয়ে আছে। আধুনিক বিজ্ঞান অনেক বছর ধরেই জানতে চাচ্ছে, মিশরীয়রা লাশ মমি করার সময় সেগুলো শত শত বছর ধরে পঁচে না গিয়ে অক্ষত থাকার জন্য কোন গোপন উপকরণটা ব্যবহার করত? মমি করার গোপন পদ্ধতিটা এই বিংশ শতাব্দীর আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে এখনো একটি ধাঁধাঁ হয়ে আছে।

এরপর পড়া থামিয়ে খাতাটা নিচে নামিয়ে আনলেন মি. স্পেন্সার। লোকটার প্রতি কিছুটা ঘৃণা লাগা শুরু করেছিল আমার। ‘তোমার রচনা আসলে এখানেই শেষ বলা যায়,’ বিদ্রুপাত্মক স্বরে বললেন তিনি। উনার মতো বয়সের কেউ যে বিদ্রুপ করে কিছু বলবে তা হয়তো কেউ ভাবতে পারে না, কিন্তু এতে তিনি বেশ পটু ছিলেন বলা যায়। ‘যাই হোক, রচনার শেষে পৃষ্ঠার নিচে তুমি আমার জন্য একটা নোটও লিখেছিলে আবার।’

‘হ্যাঁ, স্যার, আমার সেটা মনে আছে,’ চটজলদি বলে উঠলাম। চাচ্ছিলাম তিনি যেন ঐ নোটটা জোর গলায় পড়তে শুরু না করেন। কিন্তু তাঁকে থামাতে আর পারলাম না। উত্তেজনায় কোনো কথাই তাঁর কানে যাচ্ছে না।

প্রিয় মি. স্পেন্সার,

মিশর নিয়ে আমি এটুকুই জানি। আপনার ক্লাসগুলো খুব ভালো হলেও, আমি আসলে এই বিষয়ে খুব একটা আগ্রহ পাইনি। আপনি যদি আমাকে ফেইল করান তাতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আসলে ইংরেজি ছাড়া আমি সব সাবজেক্টেই ফাঁকি দিয়েছি, সবগুলোতেই ফেইল করবো আমি।

আপনার স্নেহের,

হোল্ডেন কলফিল্ড।

এরপর তিনি খাতাটা নামিয়ে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন তিনি এইমাত্র আমাকে পিংপং বা এমন কোনো খেলায় পরাজিত করেছেন। মনে হয় না খাতার লেখাগুলো পড়ে আমাকে ঐভাবে অপমান করার জন্য তাঁকে কখনো ক্ষমা করবো আমি। খাতার লেখাগুলো যদি তিনি লিখতেন তাহলে আমি কখনো জোরে উচ্চারণ করে পড়তাম না। আসলেই পড়তাম না। তারচেয়েও বড়ো কথা, আমি ঐ নোটটা লিখেছিলাম যাতে আমি ফেইল করায় তিনি কোনো দুঃখ না পান।

‘তুমি কি ফেইল করার জন্য আমাকে দোষারোপ করছো, বাছা?’ বললেন তিনি।

‘না, স্যার! আমি নিশ্চিতভাবেই আপনাকে কোনো দোষ দিচ্ছি না,’ বললাম। ঐ সময়টায় সত্যিই প্রার্থনা করছিলাম তিনি যেন আমাকে আর ‘বাছা’ বলে সম্বোধন না করে না।

এরপর তিনি খাতাটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন, তবে এবারও ব্যর্থ হয়েছেন কাজটাতে। তাই আবারও আমি উঁবু হয়ে খাতাটা তুলে আটলান্টিক মান্থলির কপিটার ওপর রাখলাম। প্রতি দুই মিনিট পরপর এভাবে নিচ থেকে জিনিস তোলাটা খুব বিরক্তিকর।

অবশ্য, এটা সত্য যে আমার ফেইল করায় উনি বেশ বিমর্ষ হয়ে আছেন। তাই উনার হয়ে আমিই নিজেকে গালাগাল করলাম কিছুক্ষণ। বললাম যে আমি আসলেই একটা গর্ধব, রামছাগল, এসব সেসব আরো অনেক কিছু। এটাও বললাম যে, উনার জায়গায় আমি থাকলে আমিও এই কাজটাই করতাম। বললাম যে শিক্ষকতার কাজটা খুবই কঠিন, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই এটা বুঝতে চায় না, শিক্ষকদের অর্জিত সম্মানটাও দেয় না। সেই সাথে হেনতেন, হাবিজাবি আরো অনেক কিছু। তেল মারা যাকে বলে আর কী!

যদিও মজার ব্যাপার হলো, উনাকে ঐ কথাগুলো বলার সময় আমি আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। আমি ভাবছিলাম নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্ক সাউথের সেন্ট্রাল পার্কের উপহ্রদটার কথা। ভাবছিলাম এই ঠান্ডায় সেন্ট্রাল পার্কের হ্রদটা বরফে জমে গেছে কী না, বাসায় গিয়ে আমি সেটা দেখতে পারবো কী না। আর যদি পানি জমেই যায়, তাহলে হ্রদের পানিতে সাঁতার কাটা হাঁসগুলোর কী অবস্থা! আমার ধারণা, এরকম কিছু হয়ে থাকলে কেউ হয়তো ট্রাক নিয়ে এসে হাঁসগুলোকে কোনো চিড়িয়াখানায় চলে নিয়ে গেছে। অথবা, হাঁসগুলোও হয়তো উড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে।

আমার কপাল ভালো ছিল। মানে আমি একই সাথে বৃদ্ধ স্পেন্সারকে তেল মারা আর হাঁসগুলোকে নিয়ে ভাবার কাজটা ঠিকমতোই করতে পারছিলাম। ব্যাপার বেশ মজার। শিক্ষকের সাথে কথা বলার সময় আসলে খুব একটা মাথা খাটিয়ে ভাবা লাগে না। তখন হঠাৎই মনে পড়লো যে আমি কথা বলার সময় তিনি আমাকে একবার থামাতে চেয়েছিলেন। মি. স্পেন্সার আসলে সবসময়ই সবার কথায় বাঁধা দেন।

এসব নিয়ে তোমার কেমন লাগে, বাছা? তোমার ভাবনা জানতে আগ্রহী আমি। খুবই আগ্রহী।’

‘পেন্সি থেকে সাসপেন্ড হওয়ার ব্যাপারটা বুঝাচ্ছেন?’ বললাম। সাথে আশা করছিলাম তিনি যেন তাঁর বুকটা একটু ঢাকেন। দৃশ্যটা খুব একটা মোহনীয় ছিল না।

‘আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, আমার জানামতে হুটন স্কুল আর এল্কটন হিলসেও তোমাকে সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছিল।’ তিনি কথাটা শুধু বিদ্রুপাত্মক স্বরেই বলেননি, এর সাথে ঘৃণার ছাপও মিশেছিল।

‘এল্কটন হিলসে আমাকে খুব একটা সমস্যায় পড়তে হয়নি,’ জানালাম। ‘আমি আসলে কখনো ফেইল-টেইল করি না। আমি শুধু স্কুল ছেড়ে আসি।’

‘ছাড়ার কারণটা কি জানতে পারি?’

‘কারণ? আসলে, স্যার, গল্পটা অনেক লম্বা। মানে খুবই প্যাঁচালো।’ সত্য বলতে ওসব নিয়ে মি. স্পেন্সারের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। বললেও তিনি সেসব কারণ কখনো বুঝতেন না। ওসব আসলে তাঁর বুঝার কথাও না। আমার এল্কটন হিলস ছাড়ার বড়ো একটা কারণ হচ্ছে সেখানে আমার আশেপাশে ধোঁকাবাজের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। হ্যাঁ, এটাই বড়ো কারণ। প্রতিদিন তাদের ধোঁকাবাজির পরিমাণ বাড়ছিল। ওখানে হেডমাস্টার মি. হাস ছিল আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বড়ো ধোঁকাবাজ। থার্মারের থেকেও দশগুণ বেশি খারাপ ছিল লোকটা। উদাহরণস্বরূপ, প্রতি রবিবার লোকটা স্কুলে ড্রাইভ করে আসা প্রত্যেক অভিভাবকের সাথে হাত মেলাতো কথা বলতো। ভাবটা এমন ছিল যেন সে খুব মহিমান্বিত কোনো কাজ করছে। অবশ্য যেসব অভিভাবকেরা দেখতে একটু উদ্ভট তাদের সাথে তার আচরণ ছিল বেশি বিরক্তিকর। আমার ওখানকার রুমমেটরা লোকটা কী করেছিল তা দেখলেই বুঝতে পারতো। মানে ব্যাপারটা হলো যদি কারো মা একটু মোটা বা দেখতে ক্লাউনের মতো হয় আর বাবা যদি ঢোলাঢালা স্যুট আর ক্লাউনের মতো সাদা কালো জুতো পরে আসতো, তাহলে বুড়ো হাস তাদের সামনে গিয়ে ধাপ্পাবাজের মতো হাসতো, হাত মেলাতো, কথা বলতে শুরু করত, কখনো কখনো প্ৰায় আধঘণ্টা জুড়েই কথা বলত। ভাবতে পারেন ব্যাপারটা, কোনো বাচ্চার বাবা- মায়ের সাথে এতক্ষণ কথা কি কেউ বলে? আমার ওসব ভালো লাগতো না। পাগল করে তুলতো ব্যাপারগুলো। এল্কটন হিলসকে প্রচণ্ড ঘৃণা করি আমি।

তখন বৃদ্ধ স্পেন্সার আমাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করেছিল, কিন্তু আমি তা শুনতে পাইনি। তখন আমি হারামি হাসকে নিয়ে ভাবছিলাম। ‘জি, স্যার?’ ক্ষমা চেয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

‘পেন্সি ছাড়ার পিছনে কি তোমার কোনো সুনির্দিষ্ট সংশয় আছে?’

‘মানে, আমার আসলে বেশ কয়েকটা বিষয় নিয়ে সংশয় আছে… তবে খুব একটা বেশি নেই। এখনো দ্বিধা জাগেনি আর কী! আমার ধারণা ব্যাপারগুলো এখনো ঐভাবে আমার চোখে ধরা পড়েনি। আমার চোখে পড়ার জন্য আসলে বেশ কিছুটা সময় লাগে। এই মুহূর্তে আমি আসলে বুধবার বাসায় যাওয়া নিয়েই ভাবছি। আমি একটা গাধা, স্যার।’

‘ভবিষ্যৎ নিয়ে কি তোমার কোনো ভাবনা আছে, বাছা?’

‘ওহ, হ্যাঁ, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কিছু ভাবনা অবশ্যই আছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে।’ বলে এক মুহূর্তের জন্য ভেবে নিলাম। ‘তবে খুব বেশি ভাবনা নেই, আমার মনে হয়। এখনো খুব বেশি কিছু ভাবিনি।’

‘ভাববে একসময়,’ স্পেন্সার প্রত্যুত্তরে বললেন। ‘একসময় তুমি ঠিকই ভাববে, বাছা। সেই সময় ভাববে যখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।’

মি. স্পেন্সারের কথাটা শুনে আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। কথা শুনে নিজেকে মৃত বলে মনে হয়েছিল। অবস্থাটা খুবই বিষণ্নকর ছিল। ‘হয়তো, স্যার,’ বললাম।

‘আমি তোমার ঐ মাথাটায় কিছু উপদেশ ঢুকিয়ে দিতে চাই, বাছা। আমি তোমাকে সাহায্যের চেষ্টা করছি। যদি পারি, আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করবো।’

তিনি আসলেই আমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছিলেন। তার চেহারা দেখেই সেটা বুঝা যাচ্ছিল। তবে ঐ মুহূর্তটায় আমাদের দুইজনের ধারণাই একদম ঠিক বিপরীত, দুইজন দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছিলাম। ‘আমি জানি সেটা, স্যার,’ বললাম। ‘অনেক ধন্যবাদ, স্যার। মজা করছি, আসলেই আমি এটার প্রশংসা করছি।’ বলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। খোদা, জীবন বাঁচানোর জন্য আমার আর দশ মিনিট ঐ বিছানায় বসের থাকার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। ‘তবে ব্যাপারটা হচ্ছে, আমাকে এখন যেতে হবে। জিম থেকে এখনো আমার জিনিসগুলো নেওয়া হয়নি। বাসায় যাওয়ার আগে ওগুলো নিয়ে নিতে হবে। নাহলে আমি ঠিকই বসতাম।’ কথাটা শুনে মি. স্পেন্সার গম্ভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আবার মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলেন। লোকটার জন্য আমার আসলেই তখন অনেক খারাপ লাগছিল। কিন্তু আমি সেখানে আর একটা মুহূর্তও থাকতে পারছিলাম না। একে তো আমরা দুইজন ছিলাম উলটো দুই মেরুতে, তাছাড়া লোকটা যেভাবে বিছানায় এটা-সেটা ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে বারবার মিস করছিল—তাতে বারবার উঁবু হয়ে সেগুলো তোলাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এছাড়াও বাথরোব সরে গিয়ে তাঁর বুক যেভাবে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল আর রুমে যেরকম কড়া নাকের ড্রপের ঘ্রাণ ছিল…মানে বলতে গেলে অবস্থাটা ছিল একদম অসহ্যকর। ‘স্যার, আমাকে নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না,’ বললাম। ‘আমি আসলেই কথাটা মন থেকে বলছি। আমি ঠিকই থাকবো। আসলে এখন একটা বাজে সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সবারই তো বাজে সময় থাকে, তাই না?’

‘আমি তা জানি না, বাছা। আমি জানি না।’

এরকম উত্তরে কারোরই ভালো লাগার কথা না। ‘অবশ্যই, স্যার, অবশ্যই এমন একটা সময় থাকে,’ বললাম। ‘আমি মন থেকেই বলছি। প্লিজ, আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করবেন না।’ বলে কোনো রকমে লোকটার কাঁধে হাত দিলাম।

‘ওকে?’ বললাম আবার।

‘যাওয়ার আগে কি এক কাপ হট চকলেট খেয়ে যাবে না? মিসেস স্পেন্সার মনে হয় এতে…’

‘অবশ্যই খেতাম, স্যার। তবে ব্যাপারটা হলো আমাকে এখন যেতে হবে। এখন সরাসরি জিমে যাবো। ধনবাদ, স্যার। অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

তারপর আমরা হাত মেলালাম, সাথে আরো কিছু ফর্মালিটিজ। এতে যদিও আমার অনেক খারাপ লাগছিল, কিন্তু তখন এটা করা ছাড়া কোনো উপায়ই ছিল না।

‘আমিও আপনাকে একটা উপদেশ দিয়ে যাই, স্যার। এখন আপনার অসুখটার দিকে একটু নজর দেন। নিজের প্রতি একটু খেয়াল রাখবেন, প্লিজ।’

‘বিদায়, বাছা।’

রুমের দরজাটা বন্ধ করে লিভিং রুমের দিকে পা বাড়ালাম। আসার সময় পিছন থেকে মি. স্পেন্সার চেঁচিয়ে কিছু বলেছিলেন আমাকে, যদিও তা ভালোভাবে শুনতে পাইনি। তবে আমার ধারণা তিনি চেঁচিয়ে ‘গুড লাক’ বলেছিলেন।

আমি অবশ্য প্রার্থনা করছি এটা যেন সত্যি না হয়। আমি কখনো কাউকে চেঁচিয়ে ‘গুড লাক’ বলবো না। এটা শুনতে খুবই বিদঘুটে শোনায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *