দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ৮

অধ্যায় আট

তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। রাস্তায় ক্যাব-ট্যাব কিছুই ছিল না। তাই হেঁটেই ট্রেন স্টেশনের দিকে রওনা করলাম। দূরত্ব খুব বেশি ছিল না, তবে আবহাওয়াটা ছিল প্রচুর ঠান্ডা। আর তুষারপাতে হাঁটাও খুব কঠিন হয়ে পড়েছিল। হাঁটার সময় গ্ল্যাডস্টোনের লাগেজগুলোও বারবার আঘাত করছিল পায়ে। তারপরও তরতাজা বাতাসটা বেশ উপভোগ্যই লাগছিল আমার কাছে। সমস্যা শুধু একটাই ছিল, ঠান্ডায় আমার নাক ব্যথা করছিল প্রচুর। বিশেষ করে ওপরের ঠোঁটটায়। স্ট্র্যাডলেটার ঐ জায়গাটাতেই ঘুষিটা মেরেছিল। ঘুষি মেরে ওপরের পাটির দাঁতেও ব্যথা তুলে দিয়েছিল সে। ঠান্ডা বাতাসে ঠোঁটটা যন্ত্রণা দিচ্ছিল বেশ। তবে আমার কানগুলো বেশ শুষ্ক আর উষ্ণই ছিল। আমার হান্টিং টুপিটার সাথে কান ঢাকনিও ছিল। ওগুলো দিয়েই কান ঢেকে রেখেছিলাম। জানি আমাকে দেখতে তখন খুব একটা ভালো দেখাচ্ছিল না, তবে কেমন দেখাচ্ছিল সেটা নিয়ে আমার কোনো ভ্রূক্ষেপও ছিল না। আর তাছাড়া রাস্তায় ঐ সময় মানুষজনও তেমন ছিল না। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল ততক্ষণে।

আমার কপাল ঐদিন বেশ ভালোই ছিল। আমি যাওয়ার দশ মিনিট পরই একটা ট্রেন ছিল। তাই স্টেশনে আমাকে খুব বেশি অপেক্ষাও করতে হয়নি। অপেক্ষা করার সময়টায় হাতে বরফ নিয়ে মুখটা একবার পরিষ্কার করে নিলাম। মুখে তখনও বেশ খানিকটা রক্ত লেগেছিল।

ট্রেনে চড়তে আমার বেশ ভালোই লাগে। বিশেষ করে রাতের বেলায়। রাতের বেলায় ট্রেনের ভেতরে আলো জ্বালানো থাকে, জানালাগুলো থাকে একদম কালো হয়ে। তাছাড়া সবসময়ই দুই পাশের সিটের মধ্যকার করিডোরটা দিয়ে কফি, স্যান্ডউইচ, ম্যাগাজিন বিক্রেতাদের আনাগোনাও থাকে। সাধারণত ট্রেনে উঠলে আমি একটা হ্যাম স্যান্ডউইচ আর চারটার মতো ম্যাগাজিন কিনি। রাতের বেলায় জার্নি করলে বিশ্রি, যুক্তিহীন গল্পে ভরা ম্যাগাজিনও কোনো সমস্যা ছাড়া পড়তে পারি। ওসব গল্পগুলো কেমন হয় তো জানেনই। ডেভিড নামে ধাপ্পাবাজ, সুগঠিত শরীরের কিছু নায়ক থাকে ঐসব গল্পে; লিন্ডা বা মার্সিয়া নামের ন্যাকা কিছু মেয়ে থাকে—যারা সবসময়ই ডেভিডদের জন্য সব কিছু দিয়ে দিতে প্রস্তুত থাকে। রাতের বেলায় ট্রেন জার্নি হলে আমি এসব বাজে গল্পও পড়তে পারি। তবে, ঐবার ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল। আমার আসলে তখন কিছু পড়ার মতো মুড ছিল না। কিছু না করে এমনিতেই সিটে বসেছিলাম শুধু। কাজের মধ্যে কাজ বলতে শুধু হান্টিং টুপিটা মাথা থেকে খুলে পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম।

হঠাতই ট্রেন্টন স্টেশন থেকে এক মহিলা ট্রেনে উঠে বসলো আমার পাশের সিটে। রাত অনেক হয়ে যাওয়ার কারণে ট্রেনের পুরো বগিটাই প্রায় ফাঁকাই ছিল। তবে ঐ মহিলা ফাঁকা সিটগুলোর কোনোটাতে না বসে বসলো আমার ঠিক পাশেই। কারণ মহিলার হাতে অনেক বড়ো একটা ব্যাগ ছিল, আর আমিও বসেছিলাম একদম সামনের সারিতেই। ট্রেনে উঠেই মহিলা ব্যাগটা রাখলো মাঝের আইলটাতে। কন্ডাক্টর বা অন্য কেউ যে ওখান দিয়ে হাঁটতে গিয়ে ব্যাগে হোঁচট খেয়ে পড়তে পারে সেই জ্ঞান বোধহয় মহিলার ছিল না। মহিলার কাছে ছিল বেশ কয়েকটা অর্কিড, খুব সম্ভবত বড়ো কোনো পার্টি বা অনুষ্ঠান থেকে বাসায় ফিরে যাচ্ছিল মানুষটা। মহিলার বয়স খুব সম্ভবত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের মতো, দেখতে খুবই সুন্দর। মহিলারা পাগল করে তুলে আমাকে। আসলেই। আমার কথায় আবার ভেবে বসবেন না যে আমি অতিরিক্ত কামপাগল—যদিও আমি যথেষ্ট কামুকে ছেলে। যাই হোক, আমার কথার অর্থ হচ্ছে আমি তাদেরকে পছন্দ করি, তবে তারা সবসময়ই ট্রেনের মাঝের আইলে তাদের ব্যাগ রেখে দেয়। এই জিনিসটাই আমাকে বেশি পাগল করে তোলে।

যাই হোক, আমরা ওভাবেই বসেছিলাম, এরপর একসময় মহিলা হুট করে আমাকে বলে বসলো, ‘এক্সকিউজ মি, এটা পেন্সি প্রেপের স্টিকার না?’ ওপরের তাকে রাখা আমার স্যুটকেসটার তাকিয়ে আছে মহিলা।

‘হ্যাঁ, পেন্সি প্রেপেরই,’ বললাম। মহিলা ঠিকই ধরেছিল। আমার গ্ল্যাডস্টোনগুলোর একটাতে পেন্সির স্টিকার লাগানো ছিল।

‘ওহ, তুমি কি পেন্সিতে পড়ো?’ মহিলা জিজ্ঞেস করল। মহিলার কণ্ঠটা অনেক সুন্দর। অনেকটাই টেলিফোনে বলা কণ্ঠগুলোর মতো। ঐ মহিলার অবশ্যই টেলিফোন সাথে নিয়ে চলা উচিৎ।

‘হ্যাঁ।’

‘ওহ, ওয়াও! তাহলে তুমি আমার ছেলে আর্নেস্ট মোরোকে চেনো নিশ্চয়? সেও পেন্সিতে পড়ে।’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই চিনি। আমরা এক ক্লাসেই পড়ি।

মহিলার ছেলে কোনো সন্দেহ ছাড়াই পেন্সিতে ভর্তি হওয়া সবচেয়ে বড়ো হারামজাদা ছিল। এমনকি স্কুলের ইতিহাসেও তার থেকে বড়ো কোনো হারামি ছিল না। সে সবসময়ই শাওয়ার শেষে করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় তার ভেজা তোয়ালে দিয়ে করিডোরে থাকা সবার পশ্চাতদেশেই আঘাত করতে করতে যেতো। হ্যাঁ, ঐ হারামজাদা ওরকমই অমানুষ ছিল।

‘তোমার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো,’ মহিলা বলল। মহিলার কণ্ঠে কোনো কৃত্রিমতার ছাপ ছিল না। মহিলা আসলেই খুব ভালো ছিল। ‘আর্নেস্টকে গিয়ে বলবো যে তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে,’ আবার বলল। ‘তোমার নাম কি, বাবা?’

‘রুডলফ শ্মিট,’ বললাম। মহিলাকে আমার পুরো জীবনের কাহিনি শোনানোর কোনো ইচ্ছা তখন ছিল না আমার। আর রুডলফ শ্মিট হলো আমাদের ডর্মের জ্যানিটরের নাম।

‘পেন্সিতে পড়তে ভালো লাগে তোমার?’ মহিলা জিজ্ঞেস করল।

‘পেন্সি? স্কুলটা খারাপ না। অবশ্যই ওটা স্বর্গের মতো বা খুব আনন্দের জায়গা না, তবে অন্যান্য স্কুল থেকে বেশ ভালো এটা। স্কুলের বেশ কয়েকজন ফ্যাকাল্টি আসলেই অনেক ন্যায়নিষ্ঠ।’

‘আর্নেস্ট স্কুলটাকে খুবই পছন্দ করে।’

‘হ্যাঁ, আমি জানি সেটা,’ বললাম। এরপর আমি আরো কিছু গৎবাঁধা বাক্য বলতে শুরু করলাম। ‘সে স্কুলটার সাথে খুবই ভালোভাবে মানিয়ে নিয়েছেন। আসলেই। মানে আমি বলতে চাচ্ছি সে খুব ভালো করেই জানে কোন জিনিসটার সাথে কীভাবে মানিয়ে নিতে হয়।’

‘তোমার তাই মনে হয়?’ মহিলা জিজ্ঞেস করল আমাকে। মহিলাকে তখন যথেষ্ট আগ্রহী শোনাচ্ছিল।

‘আর্নেস্ট? হ্যাঁ, অবশ্যই,’ বললাম। এরপর মহিলাকে তার হাতে গ্লাভস খুলতে দেখলাম। মহিলার হাতের অবস্থাটা একদম বিচ্ছিরি ছিল।

‘ক্যাব থেকে নামার সময় নখটা ভেঙে গেছে,’ মহিলা বলল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি করে হাসলো একবার। হাসিটা খুবই সুন্দর। আসলেই, চমৎকারভাবে হাসতে পারতো মহিলা। বেশির ভাগ মানুষই এভাবে হাসতে পারে না, বা হাসলেও মিথ্যা একটা হাসি ফুঁটিয়ে রাখে শুধু। ‘আর্নেস্টের বাবা আর আমি তাকে নিয়ে মাঝেমধ্যেই অনেক চিন্তায় থাকি,’ মহিলা বলল। ‘আমাদের মাঝেমধ্যেই মনে হয় সে খুব একটা মিশুক ছেলে না।’

‘বুঝলাম না কথাটা?’

‘মানে, সে খুবই সেন্সিটিভ একটা ছেলে। সে কখনোই অন্য ছেলেদের সাথে খুব একটা ভালো করে মিশতে পারে না। সবকিছুই খুব সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলে। তার যে বয়স সেই তুলনায় তার আরো একটু কম সেন্সিটিভ হওয়া উচিৎ।’

সেন্সিটিভ! আসলেই! কথাটা শুনে প্রায় টাশকি খাওয়ার দশা আমার। মোরো সেন্সিটিভ? মোরো ছিল আসলে টয়লেট সিটের মতো সেন্সিটিভ ছেলে।

মহিলার দিকে তাকালাম একবার। দেখে খুব একটা বোকার মনে হচ্ছিল না আমার। দেখেই বুঝা যাচ্ছিল মহিলা খুব ভালো করেই জানেন তার ছেলে কতটা হারামি। অবশ্য নিজের ছেলের ব্যাপারে তো কারো মাকে সবসময়ই সত্যটা বলা যায় না। মায়েরা এমনিতেই একটু পাগলাটে হয়। তবে মোরোর মাকে আমার বেশ ভালো লেগেছিল। মহিলা আসলেই বেশ ভালো ছিল। মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সিগারেট চলবে?’

শুনে মহিলা একবার আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। তারপর বলল, ‘আমার তো মনে হয় না এখানে স্মোকিং অ্যালাউড, রুডলফ।’ হ্যাঁ, মহিলা রুডলফ নামেই ডেকেছিল আমাকে।

‘ওটা সমস্যা না। তারা টের পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা টানতে পারবো, ‘ বললাম। শুনে আমার থেকে একটা সিগারেট আর লাইটারটা নিলো মহিলা।

স্মোক করার সময়ও মহিলাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছিল। ঐ বয়সের মহিলারা সাধারণত সিগারেটে টান দিয়েই ধোঁয়া ছেড়ে দেয়, তবে মোরোর মা ওরকম ছিল না। টান দিয়ে লম্বা সময় ধোঁয়া আটকে রাখতে পারে মোরোর মা। মহিলার সৌন্দর্য্যও ছিল অপরিসীম। তাছাড়া তার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ ‘আকর্ষণ’ও ছিল। আকর্ষণ বলতে কী বুঝিয়েছি তা নিশ্চয় বুঝতেই পেরেছেন আশা করছি।

সিগারেট টানার সময় আমার দিকে একটু অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মহিলা। তারপর হঠাৎই বলে উঠলো, ‘আমার ভুলও হতে পারে, তবে তোমার নাক দিয়ে মনে হয় রক্ত পড়ছে।’

মাথা ঝাঁকালাম। এরপর রুমাল দিয়ে নাক মুছে বললাম, ‘স্নোবল লেগেছিল নাকে। ওটায় আবার শক্ত বরফের টুকরোও ছিল।’ হয়তো মহিলাকে সত্যি ঘটনাটাই বলতাম, তবে ওটা বলতে গেলে অনেক সময় লেগে যেতো। তাছাড়া মহিলাকে আমার বেশ ভালো লেগেছিল। মহিলার কাছে নিজের নাম রুডলফ শ্মিট বলায় একটু একটু খারাপও লাগতে শুরু করেছিল। ‘আর্নি,’ আমি বলতে শুরু করলাম, ‘পেন্সির সবচেয়ে জনপ্রিয় ছেলেদের একজন। আপনি জানেন এটা?’

‘না তো। আমি জানি না। আসলেই?’

আমি তখন মাথা ঝাঁকিয়ে বললাম, ‘এটা ঠিক যে তাকে চিনতে স্কুলের সবারই মোটামুটি কিছুটা সময় লেগেছে। সে যথেষ্ট মজার একটা ছেলে। অনেক দিক দিয়ে সে কিছুটা আলাদাও। তার সাথে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, তখন আমি তাকে অনেক আত্মদেমাগি মনে করেছিলাম। তবে সে আসলে এমন ছিল না। তার ব্যক্তিত্ব একদম খাঁটি। তার সাথে একটু সময় থাকলেই বুঝা যায় এটা।’

মিসেস মোরো কিছু বলল না প্রথমে, তবে তাকে দেখলেই অবস্থাটা বুঝা যাচ্ছিল। ট্রেনের সিটে মহিলাকে একদম আটকে ফেলেছিলাম আমি। সবার মাকে পটানোর উপায় একটাই, তাদের ছেলেকে নিয়ে কয়েকটা ভালো ভালো কথা বললেই গলে যায় তারা।

এরপর আমি সত্যি সত্যিই আরো ভালো করে তেল মারা শুরু করলাম। ‘সে কি আপনাকে ইলেকশনের কথা বলেছে? ক্লাস ইলেকশন?’

মাথা নাড়লো মিসেস মোরো। মহিলাকে আমি অনেকটা মোহগ্রস্ত করে ফেলেছিলাম। আসলেই।

‘আমরা কয়েকজন খুব করেই চাইছিলাম আর্নি যেনো আমাদের ক্লাস প্রেসিডেন্ট হয়। মানে সে-ই ছিল আমাদের সর্বসম্মত পছন্দ। সে-ই ছিল একমাত্র ছেলে যার পক্ষে এই কাজটা করা সম্ভব ছিল,’ বললাম। হা হা, আসলেই তেল মারায় অনেক পটু আমি। ‘তবে ইলেকশনে জিতেছিল আরেকটা ছেলে। হ্যারি ফেন্সার নাম তার। হ্যারি জিতেছিল শুধু একটা কারণে, খুবই সহজ এবং সাধারণ এক কারণে। কারণটা হলো আর্নি আমাদেরকে তাকে নমিনেট করতে দেয়নি। কারণ সে খুবই লাজুক এবং ভদ্র এক ছেলে। সরাসরি মানা করে দিয়েছিল আমাদের। আসলেই সে অনেক লাজুক। আপনার উচিৎ তাকে তার এই অভ্যাসটা থেকে সরিয়ে আনা।’ বলে মহিলার দিকে তাকালাম একবার। ‘সে কি এইসব কথা বলেনি আপনাদের?’

‘না, বলেনি।’

মাথা ঝাঁকালাম। ‘এটাই আর্নি। সে এসব বলার মতো না। তার একমাত্র সমস্যা এটাই—সে খুবই লাজুক এবং ভদ্র। আপনাদের উচিৎ তার সাথে এসব নিয়ে কথা বলা।’

কন্ডাক্টর মিসেস মোরোর টিকেট চেক করতে আসায় গুল মারা থামাতে হয়েছিল আমাকে। অবশ্য আমি এতে বেশ খুশিই হয়েছিলাম। মোরোর মতো একটা ছেলে যে কি না আঘাত দেওয়ার আশায় অন্যদের পশ্চাতে ভেজা তোয়ালে দিয়ে ঝাঁপটা দেয় তাকে নিয়ে আর কতই বা গুল মারা যায়। আর এই ধরনের মানুষ শুধু বাচ্চাকালেই বাদড় থাকে না, সারাজীবন বাদড় হয়ে থাকে এরা। তবে, আমি নিশ্চিত মিসেস মোরো তখন তার ছেলেকে এরকম ভাবছিল না। তার মাথায় তখন চলছিল তার ছেলে খুব লাজুক, ভদ্র এবং বন্ধুর খুশির জন্য নিজেকে প্রেসিডেন্টের জন্য নমিনেটও করতে দেয়নি। খুব সম্ভবত পরবর্তীতেও তাকে মিসেস মোরো এরকমই ভেবেছে নিশ্চয়। মায়েরা এসব ব্যাপারে খুব একটা মাথা খাটায় না।

‘ককটেলের মুড আছে আপনার?’ জানতে চাইলাম। আসলে আমার নিজেরই তখন ককটেলের মুড ছিল। ‘ক্লাব কার দিয়ে ওখানে যেতে পারবো আমরা। যাবেন?’

‘বাছা, তোমার কি ড্রিংক অর্ডার দেওয়ার অনুমতি আছে?’ মিসেস মোরো জিজ্ঞেস করল। বিদ্রুপের স্বর ছিল না কণ্ঠে। মহিলা আসলে এতই লাস্যময়ী ছিল যে তার থেকে বিদ্রুপ আশাও করা যায় না।

‘না, অর্ডার দেওয়ার আইনসম্মত কোনো অনুমতি নেই, তবে আমার উচ্চতার কারণে পার পেয়ে যেতে পারি ঠিকই,’ বললাম। ‘আর আমার চুলগুলোও কিছুটা ধূসর হয়ে গেছে। ওগুলোও সাহায্য করে।’ বলে মাথার পাশে থাকা ধূসর চুলগুলো দেখালাম মহিলাকে। মিসের মোরো এতে বেশ ভালোই চমকে গিয়েছিল। ‘চলুন, তাহলে?’ বললাম। মহিলার সঙ্গ আমার বেশ ভালোই লাগছিল।

‘মনে হয় আমার যাওয়াটা ঠিক হবে না। তবে, হ্যাঁ, আমন্ত্রণের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ,’ মিসেস মোরো বলল। ‘আর তাছাড়া ক্লাব কারগুলো বোধহয় এখন আর পাওয়া যাবে না। রাত তো অনেক হয়ে গেছে।’ মহিলার কথা ঠিকই ছিল। আমিই আসলে সময়ের কথা ভুলে গিয়েছিলাম।

এরপর আমার দিকে তাকিয়ে মিসেস মোরো বলল, ‘আর্নেস্ট আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছিল যে সে বুধবার বাসায় আসবে। ক্রিসমাসের ছুটিটা নাকি বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে।’ মহিলা যে কোনো না কোনোসময় এই কথাটা তুলবে তা আমি জানতাম। পুরো সময়টা জুড়েই এই প্রসঙ্গ আসার ভয়ে ভয়ে ছিলাম। এজন্যই অতিরিক্ত কথা বলছিলাম—কিন্তু শেষমেশ ঠিকই উঠলো প্রসঙ্গটা। ‘তুমি তো দেখি বেশ আগেভাগেই চলে এসেছো। তোমার বাসায় কি কোনো সমস্যা বা কেউ অসুস্থ?’ মিসেস মোরো জিজ্ঞেস করল। মহিলাকে আসলেই বেশ উদ্‌বিগ্ন দেখাচ্ছিল। আমার কয়েকদিন আগেই স্কুল থেকে চলে যাওয়া নিয়ে কোনো সন্দেহের ছাপ ছিল না মহিলার কণ্ঠে

‘না, বাসায় সবাই ঠিকই আছে,’ আমি বললাম। ‘আসলে সমস্যাটা আমারই। আমার একটা অপারেশন হওয়ার কথা।’

‘ওহ, স্যরি, এরকম কিছু মাথায় আসেনি,’ মিসেস মোরো বলল। এই প্রসঙ্গটা তোলায় আসলেই স্যরি ছিলেন মিসেস মোরো। আমিও সাথে সাথেই বলে দিতে চাচ্ছিলাম যে মিথ্যা বলার জন্য আমিও স্যরি, তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

‘না, আসলে অতটা সিরিয়াস কিছু না। ব্রেইনে ছোটো একটা টিউমর হয়েছে আমার। ওটার অপারেশনই।’

‘ওহ, খোদা!’ আঁৎকে ওঠে বলল মিসেস মোরো।

‘আরে না, দুঃশ্চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকই থাকবো। টিউমরটা খুব একটা বড়ো না। আর ঠিক ব্রেইনেও না—হালকা একটু বাইরে। দুই মিনিটের অপারেশন মাত্র,’ বললাম।

এরপর আমি পকেটে থাকা একটা টাইমটেবিল বের করে পড়তে শুরু করলাম। মিথ্যা বলা থামানোর জন্যই পড়ছিলাম ওটা। যদি মুড পেয়ে যাই, তাহলে একবার মিথ্যা বলা শুরু করলে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিথ্যাই বলে যেতে থাকি। মজা করছি না, আসলেই মুড পেয়ে গেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিথ্যা চালিয়ে যেতে পারি আমি।

যাই হোক, এরপর আমরা আর বেশি কথা বলিনি। মহিলাও তার হাতে থাকা ভোগ ম্যাগাজিনের কপি পড়তে শুরু করেছিল, আর বাকিটা সময় আমি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিলাম। নিউইয়র্ক স্টেশনে নেমেছিল মিসেস মোরো। নামার সময় আমার অপারেশনের জন্য শুভকামনা ও প্রার্থনাও জানিয়েছিল। মহিলা তখনও আমাকে রুডলফ বলেই ডাকছিল। আমন্ত্রণ জানিয়েছিল গ্রীষ্মের সময় যেন আর্নির সাথে করে ম্যাসেচুসেটসের গ্লচেস্টারে বেড়াতে যাওয়া জন্য। ঐ বিচটাতেই বাসা তাদের এবং একটা টেনিস কোর্টও আছে। মহিলাকে আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছিলাম যে গ্রীষ্মে আমি আমার দীদার সাথে দক্ষিণ আমেরিকায় ঘুরতে যাবো। ওটা অবশ্য আসলেই অনেক বড়ো একটা মিথ্যা ছিল। কারণ আমার দীদা বাসা থেকেই বের হতো খুবই কম, মাঝেমধ্যে যাও বা বেরুতো সেটাও শুধু ম্যাটিনি শোতে যাওয়ার জন্য বা এমন কোনো কারণে। আর সেই মানুষই কি না দক্ষিণ আমেরিকা ঘুরতে যাবে। অবশ্য, এছাড়া আমার উপায়ও ছিল না। দুনিয়ার সব টাকার বিনিময়েও ঐ হারামজাদা মোরোকে দেখতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *