দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ১৭

অধ্যায় সতেরো

বেশ আগেভাগেই চলে এসেছিলাম আমি। শো শুরু হতে তখনো অনেক দেরি ছিল। তাই লবিতে ঘড়ির নিকটে থাকা একটা চামড়ার সিটে বসে স্যালির অপেক্ষা করছিলাম আর মেয়ে দেখছিলাম। ক্রিসমাসের সময় বলে বেশির ভাগ স্কুলেই ছুটি শুরু হয়ে গিয়েছিল, তাই প্রচুর পরিমাণ মেয়ে ছিল জায়গাটায়। বেশির ভাগই বসে বা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল তাদের ডেটের। মেয়েদের অনেকেই বসেছিল পা ভাঁজ করে, আবার অনেকেই পা সোজা রেখেই বসেছিল, কারো পা আবার ছিল খুবই চমৎকার, কারো পা ছিল খুবই ফালতু, কিছু মেয়ে দেখতে প্রচণ্ড রকম কিউট, আবার কিছু মেয়েকে দেখতেই ডাইনির মতো লাগছিল। যাইহোক, আশেপাশের দৃশ্যটা ভালোই ছিল। তারপরও একদিক থেকে আমার কিছুটা খারাপও লাগছিল মেয়েগুলোর সাথে পরবর্তীতে কী হবে সেটা ভেবে। মানে তারা স্কুল-কলেজ থেকে পাশ করে বের হওয়ার পর কী হবে তা নিয়ে ভাবছিলাম। ধারণাই করা যায় যে বেশির ভাগ মেয়েই বিয়ে করবে গর্দভটাইপ কিছু ছেলেকে। ঐসব ছেলে যাদের বেশি আগ্রহ তাদের গাড়ি এক গ্যালন তেলে কত মাইল চলতে পারে, ঐসব ছেলে যারা গলফে বা এমনকি পিংপং-এ হারলে বাচ্চাদের মতো মন খারাপ করে পড়ে থাকে। ঐসব ছেলে যাদের আচরণ খুবই খারাপ, বা ঐসব ছেলে যারা কখনো বই পড়ে না, বা যারা খুবই বিরক্তিকর। তবে আমার মনে হয় এই ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকা উচিৎ। মানে কাউকে বিরক্তিকর বলাটা। বিরক্তিকর লোকদেরকে আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারি না। আসলেই বুঝতে পারি না। এল্কটন হিলসে পড়ার সময় হ্যারিস ম্যাকিম নামের একটা ছেলে দুই মাসের জন্য আমার রুমমেট ছিল। ছেলেটা বেশ বুদ্ধিমান, তবে আমার দেখা সবচেয়ে বিরক্তিকর মানুষও ছিল ও। ওর কণ্ঠ ছিল প্রচুর কর্কশ, আর সে কখনোই চুপ করে থাকত না। আসলেই, সবসময়ই বকবক করত। আর সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটা হলো তাকে কোনো কিছুর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সে কখনোই এক কথায় সেটা জবাব দিতো না। তবে সে একটা কাজ করতে পারতো। ঐ হারামজাদাটা ভালো শিস বাজাতে পারতো। আমি কাউকে তার থেকে ভালো শিস বাজাতে শুনিনি। বিছানা গোছানোর সময় বা ক্লজেটে কিছু রাখার সময়—হারামিটা সবসময়ই ক্লজেট ভরে রাখতো, ব্যাপারটায় প্রচুর বিরক্ত লাগতো আমার—হয় কর্কশ গলায় বকবক করত নয়তো শিস বাজাতো। ক্ল্যাসিক্যাল গানগুলোর শিস ও বাজাতে পারতো ও। তবে বেশির ভাগ সময়ই জ্যাজ গানের শিস বাজাতো, এমনকি ‘টিন রুফ ব্লুজ’-এর মতো কঠিন জ্যাজ গানও ভালোভাবেই বাজাতে পারতো। আমি তাকে কখনোই বলিনি যে সে খুব ভালো শিস বাজাতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই। নিশ্চয়ই কাউকে ডেকে এটা বলা যায় না যে, ‘হেই, তুমি খুব ভালো শিস বাজাতে পারো।’ যদিও তার আচরণে বিরক্ত হয়ে আমার প্রায় আধপাগল হওয়ার দশা হয়েছিল, তারপরও তার সাথে আমি দুই মাস এক রুমে থেকেছিলাম শুধুমাত্র তার ভালো শিস বাজানোর ক্ষমতার কারণে। সেজন্যই আমি আসলে বিরক্তির ব্যাপারে তেমন একটা নিশ্চিত না। হয়তো কোনো ভালো মেয়ে এমন কাউকে বিয়ে করলে সেটা অতটা দুঃখ করার কিছু নেই। এদের বেশির ভাগই কারো মনে আঘাত করে না, আর হয়তো গোপনে তারা খুব ভালো শিসবাদক বা কোনো কিছুতে খুব দক্ষও হতে পারে। কে জানে? নিশ্চিতভাবেই আমি জানি না তা।

অবশেষে এসে পৌঁছালো স্যালি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল। আমিও তাকে দেখে নামা শুরু করলাম সিঁড়ি দিয়ে। তাকে দেখতে প্রচণ্ড সুন্দর দেখাচ্ছিল। আসলেই। একটা কালো কোট পরে রেখেছিল, আর মাথায় ছিল একটা কালো ব্যারে (গোলাকার টুপি)। সে খুব একটা বেশি টুপি পরে না, তবে ব্যারেতে চমৎকার সুন্দর দেখাচ্ছিল তাকে। মজার ব্যাপারটা হলো, তাকে ওইসময় দেখে মনে হচ্ছিল আমি তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। আমি আসলেই একটা পাগল। আমি স্যালিকে অতটা পছন্দ করতাম না, তারপরও মুহূর্তে মনে হচ্ছিল যে আমি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। মেনে নিচ্ছি, আমি আসলেই একটা পাগল।

‘হোল্ডেন!’ স্যালি বলল। ‘খুবই ভালো লাগছে তোমাকে দেখে। অনেকদিন পর দেখা হলো তোমার সাথে।’ তার কণ্ঠটা ছিল খুবই জোরালো আর বাজে। তাকে সাথে নিয়ে কারো সাথে দেখা হলে তার এই কণ্ঠের জন্য বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। তবে সে দেখতে খুবই সুন্দর হওয়ায় কণ্ঠের দিকে অতটা লক্ষ্য করে না কেউ। তবে তার কণ্ঠস্বরটা খুবই যন্ত্রণা দেয় আমাকে।

‘তোমাকে দেখেও খুব ভালো লাগছে,’ বললাম। মন থেকেই বলেছিলাম। ‘কেমন আছো তুমি?’

‘খুবই ভালো। আমি কি দেরি করে ফেলেছি?’

তাকে না বললেও, সে আসলে মিনিট দশেক দেরি করেই এসেছিল। অবশ্য ওটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যাও ছিল না। শনিবার সন্ধ্যার পোস্ট-এ প্রায়ই কার্টুনে দেখা যায় যে গার্লফ্রেন্ডরা দেরি করে আসছে দেখে ছেলেরা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ফালতু কার্টুন কতগুলো। মেয়েটা যদি খুবই লাস্যময়ী সুন্দরী হয়ে থাকে, তাহলে সে দেরি করে আসছে কি না তা নিয়ে মাথা ঘামাবে কে? কেউই না। ‘আমাদের জলদি পা চালানো উচিৎ,’ বললাম। ‘শো দুইটা চল্লিশে শুরু হবে।’ বলে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ট্যাক্সিগুলোর দিকে পা বাড়ালাম।

‘কোন শো দেখছি আমরা?’ স্যালি বলল।

‘ঠিক জানি না। লান্টসদের শো। এটার টিকিটই যোগাড় করতে পেরেছি।’

‘লান্টস! কী চমৎকার!’ আগেই বলেছিলাম লান্টসদের নাম শুনলেই খুশিতে পাগল হয়ে যাবে ও।

থিয়েটারে যাওয়ার পথে ক্যাবের ভেতরে কিছুক্ষণ মেক-আউট করে নিলাম আমরা। স্যালি যদিও প্রথমে কিস করতে চাচ্ছিল না, কারণ সে লিপস্টিক দিয়ে এসেছে—কিস করলে লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে, কিন্তু আমি এতই সম্মোহনী চাহুনি দিয়ে তাকাচ্ছিলাম যে, তার আর শেষে কিস না করেও কোনো উপায় ছিল না। এরপর তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম আমি তাকে ভালোবাসি আমি কতটা পাগলাটে প্রকৃতির ছিলাম তা তো এ থেকেই বুঝা যায়। অবশ্যই কথাটা মিথ্যা ছিল, তবে এটা ঠিক যে বলার সময় আমি ওটা মন থেকেই বলেছিলাম। খোদার কসম, আমি আসলেই অনেক পাগলাটে।

‘ওহ, ডার্লিং, আই লাভ ইউ টু,’ স্যালি বলল। এরপর সাথে সাথেই ঐ একই নিঃশ্বাসে আবার বলে উঠলো, ‘আমাকে আগে বলো যে তুমি তোমার চুলগুলো লম্বা করবে। এই আর্মি ছাঁটা আর দেখতে ভালো লাগে না, আর তোমার চুলগুলো কিন্তু খুবই সুন্দর।’

সুন্দর না ছাই!

আমার দেখা অন্য শোগুলোর মতো অতটা বাজে ছিল না ওটা। তবে ওটার বিষয়বস্তুটা যদিও খুব একটা ভালো ছিল না। শো’টা ছিল পাঁচশো হাজার বছর পুরোনো এক বৃদ্ধ দম্পতিকে নিয়ে। শোটা শুরু হয় তাদের তরুণ সময় থেকে। মেয়েটার বাবা-মা মেয়েটাকে ছেলেটার সাথে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল না, কিন্তু মেয়েটা ঠিকই বিয়ে করে ছেলেটাকে। এরপর তাদের বয়স বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে। মেয়েটার স্বামী একসময় যুদ্ধে যায়, তার এক মাতাল ভাইও ছিল। খুব একটা আগ্রহ পাইনি আমি এতে। মানে কোনো পরিবারের কারো মারা যাওয়া বা তেমন কিছুতে খুব একটা আগ্রহ পাই না। আর তারা তো ছিল শুধু একদল অভিনেতা মাত্র। স্বামী-স্ত্রীর যুগলটা আসলে বেশ ভালোই ছিল, বেশ বুদ্ধিমান ছিল তারা। তবে তারপরও তাদেরকে খুব একটা ভালো লাগেনি আমার। এর একটা কারণ হলো, তারা পুরো নাটকটা জুড়ে চা বা পানীয় খেয়ে যাচ্ছিল শুধু। যতবারই তারা মঞ্চে এসেছে, ততবারই খানসামা তাদেরকে চা দিয়ে গেছে, নয়তো স্ত্রী লোকটা নিজেই কারো জন্য কাপে চা ঢালছে। আর পুরোটা সময় জুড়েই অভিনেতারা শুধু মঞ্চে উঠেছে আর নেমেছে। টানা অনেকক্ষণ এতগুলো মানুষকে উঠা-নামা করতে দেখে প্রায় মাথা ধরে গিয়েছিল আমার। আলফ্রেড লান্ট আর লিন ফন্ট্যান ছিল নাটকে বৃদ্ধ দম্পতি এবং তাদের অভিনয়ও খুব ভালো ছিল, তারপরও আমি তাদেরকে অতটা পছন্দ করতে পারিনি। এটুকু মানতেই হবে যে অভিনেতা হিসেবে তারা অনেক ভিন্ন। মানে তাদের অভিনয়টা ঠিক সাধারণ মানুষের মতো নয় আবার অভিনেতাদের মতোও নয়। এটা আসলে ব্যাখ্যা করা একটু কঠিন। তাদেরকে অভিনয়টায় এমন একটা ভাব ফুঁটে ছিল যে তারা জানতো তারা ভালো অভিনেতা। মানে তারা অভিনেতা হিসেবে ভালো, তবে একটু বেশিই ভালো। তারা দুইজন মঞ্চে থাকা অবস্থায় যখন একজন কোনো কথা বলার সাথে সাথেই বা বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথে সাথেই অন্যজন প্রত্যুত্তর দিয়ে উঠতো। মানে সাধারণ মানুষজন কথা বলার সময় যেভাবে আচরণ করে বা একজনের কথায় আরেকজন বাগড়া দেয় আরকী। সমস্যাটা হলো, এটার একটু বেশিই আধিক্য ছিল তাদের অভিনয়টায়। অনেকটা ভিলেজে পিয়ানো বাজানো আর্নির মতোই। কেউ যদি কোনো কিছুতে দক্ষতা অর্জন করে ফেলে, তাহলে একটা সময় থেকে তারা শো-অফ করা শুরু করে। আর তখন তাদেরকে আর আগের মতো ভালোও মনে হয় না। যাই হোক, আমার দেখা শোগুলোর মধ্যে ঐ একটা শো দেখেই একটু মানসম্মত মনে হয়েছিল। মানে লান্টসদের শো’টা। একথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে।

প্রথম অ্যাক্টের পর অন্য সব স্টুপিডের সাথে আমরা সিগারেট খেতে বেরিয়েছিলাম। নিয়মটা এমনই ছিল। জীবনে একসাথে এতো ধাপ্পাবাজ কখনো দেখা যায় না। প্রত্যেকেই মুখ ভরে ভরে ধোঁয়া ছাড়ছিল আর নাঁক নিয়ে আলাপ করছিল। যাতে সবাই শুনে বুঝতে পারে তারা নাটকের বিষয়ে কত জ্ঞানী সেজন্য খুব জোরে জোরে কথা বলছিল। এক মুভি অ্যাক্টরও আমাদের সাথে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। লোকটার নাম আমি জানি না। তবে লোকটা যুদ্ধের একটা মুভিতে অভিনয় করেছিল। মুভিটা খুব ভালো ছিল না, তবে একটু ভালো শুরু করতেই মুভিটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। লোকটার সাথে এক স্বর্ণকেশি মেয়েও ছিল। আর তারা দুইজন এমনভাবে নিজেদের সাথে কথা বলছিল যেন সে জানেই না যে পাশে দাঁড়ানো মানুষজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবটা এমন যেন ভদ্রতায় নিজেকে অদৃশ্য করে রেখেছে। আমার সাথে থাকা স্যালি অবশ্য তেমন কিছু বলছিল না, সে শুধু লান্টসদের প্রশংসা করছিল। অবশ্য তার কথা না বলার কারণ সে নিজের সাজগোজ নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল। তারপর হঠাৎ এক সময় লবির অন্যপাশে থাকা এক স্টুপিড ছেলের দিকে নজর গেল ওর। ছেলেটা খুবই গাঢ় ধূসর বর্ণের ফ্ল্যানেল স্যুট আর চেক-চেক ভেস্ট পরে রেখেছিল। নিঃসন্দেহেই আইভি লিগের ছেলে। ছেলেটা একটা দেওয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেত টানছিল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন প্রচুর বিরক্ত হয়ে আছে ছেলেটা। স্যালি ছেলেটাকে দেখে শুধু বলে যাচ্ছিল, ‘আমি ঐ ছেলেটাকে আগেও কোথাও দেখেছিলাম।’ স্যালিকে কোথাও নিয়ে গেলে সে সবসময়ই কাউকে না কাউকে চিনবেই, অথবা সে ভাববেই যে ছেলেদের কাউকে সে চেনে। আমি বিরক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত সে বারবার ঐ কথাটাই বলে যাচ্ছিল। তাই বিরক্ত হয়ে এক সময় বললাম, ‘তোমার যদি চেনাজানা কেউই হয়ে থাকে, তাহলে গিয়ে তার সাথে কথা বলছো না কেন? সে তো এতে খুশিই হবে।’ আমি এটা বলায় স্যালি একটু মন খারাপ করেছিল। তবে শেষমেশ স্টুপিড ছেলেটা তাকে লক্ষ্য করেছিল। এগিয়ে এসে এমনভাবে হ্যালো বলেছিল যেন তাদের একজনের সাথে আরেকজনের প্রায় বিশ বছর পর দেখা হচ্ছে। এমন আচরণ করছিল যেন তারা ছোটোবেলায় একই বাথটাবে গোসল করত বা এমনকিছু। ব্যাপারটা বিরক্তিকর ছিল। তবে মজার ব্যাপারটা হলো, তাদের পরিচয়টা সম্ভবত হয়েছিল কোনো একটা বিরক্তিকর পার্টিতে। একবারের বেশি হয়তো তাদের আর কখনো দেখাও হয়নি। নিজেদের মধ্যে কুশলাদি জিজ্ঞেস করার পর স্যালি আমার সাথে ছেলেটার পরিচয় করিয়ে দিলো। ছেলেটার নাম জর্জ কী যেন ছিল, ঠিক মনে পড়ছে না। ছেলেটা পড়তো অ্যান্ডোভারে। ঐ তো বলেছিলাম না আইভি লিগের ছেলে। স্যালি তার কাছে জানতে চাইলো যে নাটকটা কেমন লাগছে তার কাছে। দৃশ্যটা দেখার মতো ছিল। ছেলেটা এমন প্রকৃতির ছিল যারা উত্তর দেওয়ার সময় যত প্রকার সম্ভব তোষামোদ করতে পারে। তাই সে উত্তর দিলো যে নাটকটা মাস্টারপিস না, তবে লান্টসরা নাকি সাক্ষাৎ দেবদূত! স্যালির লান্টস প্রেমের ব্যাপারটা হয়তো জানতো ছেলেটা। তাই বলে দেবদূত, খোদা! ব্যাপারটা প্রচুর বিরক্তিকর ছিল। এরপর সে আর স্যালি কথা বলতে শুরু করে তাদের দুইজনেরই পরিচিত হাজার হাজার মানুষ নিয়ে। আমার শোনা সবচেয়ে ফালতু কথোপকথন ছিল ওটা। তারা দুইজনই যত দ্রুত পারে একটা একটা করে জায়গার নাম বলছিল আর সেখানে তাদের পরিচিত কে থাকে তাদের নিয়ে কথা বলছিল। আমি তো তাদের বকবক শুনে আরেকটু হলেই মরতে বসেছিলাম। ভাগ্যিস সেকেন্ড অ্যাক্টের জন্য বসার সময় হয়ে গিয়েছিল। তবে তাতেও কোনো লাভ হয়নি। সেকেন্ড অ্যাক্ট শেষ হওয়ার পর তারা আবারও তাদের বিরক্তিকর বকবক করা শুরু করে। তারা আরো জায়গার নাম বলছিল, আর ওসব জায়গায় তাদের পরিচিত কে কে থাকে তাদের কথা তুলছিল শুধু। সবচেয়ে খারাপ দিকটা হলো, ছেলেটার কণ্ঠস্বর ছিল খুবই বাজে, ক্লান্ত, ফ্যাসফ্যাসে প্রকৃতির। আইভি লিগের ছেলেদের কণ্ঠ যেমন থাকে আর কী। তার গলার সুরটা ঠিক মেয়েদের মতো শোনাচ্ছিল। হারামজাদা ছেলেটার আমার ডেট নষ্ট করা নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপই ছিল না। এমনকি আমার তো একটা সময় মনে হচ্ছিল যে হারামিটা হয়তো শো শেষে আমাদের সাথে ক্যাবেও চড়ে বসবে। আমাদের সাথে হেঁটে প্রায় দুই ব্লক চলেও এসেছিল সে, তবে শেষমেশ বলল যে তার নাকি বারে বসে কয়েকজন বন্ধুর সাথে ককটেল খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার কথা রয়েছে। আমি কল্পনা করছিল চেক-চেক ভেস্ট পরে হারামজাদারা বারের এক কোণায় বসে ড্রিঙ্ক করছে আর তাদের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বিভিন্ন শো, বই ও মেয়েদের নিয়ে সমালোচনা। উফফ, বিরক্তিকর প্রাণী যত্তসব! ওদেরকে একদমই সহ্য করতে পারি না আমি।

অ্যান্ডোভারের ছেলেটার বকবক শুনে মেজাজ এতটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে ক্যাবে উঠে স্যালির সাথেও কথা বলার মুড পাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসব। আসলেই। তবে তাকে এটা বলতে যাবো, তখন সে হুট করে বলে উঠলো, ‘আমার না একটা চমৎকার আইডিয়া এসেছে মাথায়।’

তার মাথায় সবসময়ই কোনো না কোনো চমৎকার আইডিয়া এসে থাকে। ‘শুনো, ডিনারের জন্য তোমাকে কয়টার মধ্যে বাসায় যাওয়া লাগবে? মানে তোমার কি কোনো তাড়া আছে কি না বাসায় যাওয়ার? মানে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে কি বাসায় ফেরা লাগবে তোমার?’

‘আমার? না। কোনো ধরাবাঁধা সময় নেই,’ জানালাম। সত্যটা আসলে কখনোই বলা হয় না। ‘কেন?’

‘তাহলে চলো রেডিও সিটিতে আইস-স্কেটিং করতে যাই।’

তার মাথা থেকে সবসময় এই ধরনের আইডিয়া বেরোয়।

‘রেডিও সিটিতে আইস-স্কেটিং? এখন?’

‘ঘণ্টাখানেকের মতো স্কেট করবো শুধু। তুমি কি যেতে চাও না? তোমার যদি যাওয়ার ইচ্ছা না থাকে—’

‘আমি বলিনি যে আমার যাওয়ার ইচ্ছা নেই,’ বললাম। ‘তোমার যদি যেতে ইচ্ছা করে তাহলে অবশ্যই যাব।’

‘আসলেই? আমাকে খুশি করার জন্য বলোনি তো? তোমার যেতে ইচ্ছা না করলে যাওয়া লাগবে না। আমার কোনো সমস্যা নেই এতে।’

আসলেই, তার কোনো সমস্যা ছিল না।

‘ওখানে গেলে সুন্দর সুন্দর ছোটো স্কেটিং স্কার্টগুলোর একটা ভাড়া করবো, ‘ স্যালি বলল। ‘গত সপ্তাহে জেনেট কাল্টজও ভাড়া করেছিল।’

ও আচ্ছা, তার ওখানে যাওয়ার এটাই ছিল মূল কারণ। সে আসলে পশ্চাৎকে হাইলাইট করা ছোটো স্কার্টটাতে নিজেকে দেখতে চাচ্ছিল।

তাই রেডিও সিটিতে গেলাম আমরা। আমাদেরকে স্কার্টগুলো দেওয়ার পর তারা স্যালিকে ঐ ছোটো স্কার্টগুলোর একটা দিলো। স্কার্টটাতে স্যালিকে আসলেই খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমাকে এটা স্বীকার করতেই হবে। এমন না যে স্যালি সেটা জানতো না। সে নিজেই ইচ্ছা করে আমার সামনে সামনে এগুচ্ছিল যেন আমি ছোটো স্কার্টে তার পিছনের দিকটা দেখতে পাই। তাকে আসলেই খুব কিউট দেখাচ্ছিল। এটা আমাকে মানতেই হবে।

অবশ্য মজার ব্যাপারটা হলো, ঐ স্কেটিং রিং-এ আমরাই ছিলাম সবচেয়ে বাজে স্কেটার। মানে সবচেয়ে বাজে। এমনকি ওখানে ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা কিছু মানুষও ছিল। স্যালির পা শুধু একটু পরপরই বেঁকে যাচ্ছিল। বারবারই বরফে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। তার পড়ে যাওয়াটা শুধু স্টুপিডই ছিল না, পড়ে যাওয়ার পর নিঃসন্দেহেই প্রচণ্ড ব্যথা করছিল তার পাগুলো। আমি জানি আমার পা কেমন ব্যথা করছিল। মনে হচ্ছিল যেন পায়ের ব্যথাতেই মরে যাবো। আমাদেরকে দেখতে নিশ্চয় খুব সুন্দর লাগছিল, আর সবচেয়ে খারাপ দিকটা হলো প্রায় শত শত চোখ তাকিয়েছিল আমাদের দিকে। কিছু মানুষ আছে যাদের স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে অন্যদের হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়া দেখা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজ নেই।

‘ভেতরে গিয়ে বসে কিছু ড্রিংক করবে?’ অনেকক্ষণ ধরে হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে শেষমেশ স্যালিকে বললাম।

‘সারাদিনে তোমার বলা সবচেয়ে সেরা আইডিয়া এটা,’ সে বলল। সে আসলে আমার থেকেও বেশিবার হুমড়ে পড়েছে বরফে। নিঃসন্দেহেই পায়ে ভয়ঙ্কর ব্যথা করছিল তার। তার জন্য আমার আসলেই খারাপই লাগছিল তখন।

স্কেটগুলো খুলে একটা বারের ভেতর গেলাম আমরা। ওখানে বসে স্কেটিং রিংয়ের দৃশ্যটা দেখতে পাওয়া যায়। ভেতরে গিয়ে টেবিলে বসেই গ্লাভসগুলো খুলে ফেললো স্যালি। তাকে সিগারেট সাধলাম। তবে তাকে খুব একটা খুশি দেখাচ্ছিল না। ওয়েটারকে ডেকে তার জন্য কোক অর্ডার করলাম—স্যালি ড্রিংক করে না—আর নিজের জন্য একটা স্কচ আর সোডা অর্ডার করলাম। তবে হারামজাদা ওয়েটার আমাকে স্কচ দিতে রাজি ছিল না, তাই শেষমেশ আমিও কোকই অর্ডার করলাম শুধু। এরপর ম্যাচের কাঠি জ্বালাচ্ছিলাম শুধু। মাঝেমধ্যেই এই কাজটা করি। কাঠি পুরোটা না পোড়া পর্যন্ত ওটাকে ওভাবেই ধরে রাখি, আর যখন আঙুলে আগুনের তাপ লাগতে শুরু করে তখন ওটাকে ফেলে দিই অ্যাস্ট্রেতে। নার্ভাস থাকলে এই কাজটা করি।

তারপর হুট করেই স্যালি বলে উঠলো, ‘শুনো, আমার একটা ব্যাপার জানতেই হবে। তুমি ক্রিসমাস ইভে গাছ ছাঁটাইয়ের জন্য আমাকে সাহায্য করতে আসবে নাকি আসবে না? আমার এটা জানতে হবে।’ স্কেট করে পায়ে ব্যথা পাওয়ায় তার গলার সুরটা কিছুটা রুক্ষ হয়েছিল তখন।

‘আমি তো তোমাকে চিঠিতেই জানিয়েছি যে আমি আসব। তুমি তো এবার নিয়ে প্রায় বিশবার জিজ্ঞেস করলে আমাকে। অবশ্যই আসব আমি।’

‘আমাকে এটা জানাই লাগবে, সেজন্যই বলছি,’ সে বলল। বলে এরপর হঠাৎ চোখ ঘুরিয়ে রুম দেখা শুরু করল।

হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম যে আমি ম্যাচের কাঠি জ্বালানো বন্ধ করে টেবিলে কনুই রেখে স্যালির দিকে আরো ঝুঁকে গেছি। আমার মনে তখন আসলে বেশ কিছু ব্যাপার ঘুরপাক খাচ্ছিল। ‘হেই, স্যালি,’ বললাম।

‘কী?’ স্যালি বলল। সে তখন রুমের অন্য দিকের টেবিলে বসে থাকা একটা মেয়ের দিকে তাকিয়েছিল।

‘তোমার কি কখনো হতাশ লাগে?’ আমি বললাম। ‘মানে তোমার কি কখনো এমন লাগে যে যদি তুমি কিছু না করো তাহলে সবকিছুর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাবে? মানে স্কুলের কথাই ধরো, তোমার কী স্কুল ভালো লাগে?’

‘স্কুল খুবই বিরক্তিকর।’

‘মানে আমি বলতে চাচ্ছি স্কুলকে তোমার ঘৃণা লাগে? আমি জানি এটা খুবই বিরক্তিকর একটা জায়গা, তবে তুমি কি এটাকে ঘৃণা করো? এটাই বলতে চাচ্ছি।’

‘উম, নাহ, আমি স্কুলকে আসলে ঘৃণা করি না। তুমি আসলে সবসময়ই—

‘আমি ঘৃণা করি স্কুল। খোদা, আসলেই স্কুল প্রচণ্ড ঘৃনা করি,’ বললাম। ‘তবে শুধু এটাই না। সবকিছুই ঘৃণা করি। নিউইয়র্ক, ট্যাক্সিক্যাব, ম্যাডিসন এভিনিউয়ের বাস—যেগুলোর ড্রাইভার সবসময়ই পিছনের দরজা দিয়ে বেরোনোর জন্য চেঁচায়, লান্টসকে ফেরেশতার সাথে তুলনা করা ছেলেদের, এমনকি বাইরে বেরুনোর জন্য এলিভেটরে করে উঠা-নামা করা, ব্রুকলিনে সবসময় পকেটের টাকা খসানো লোকগুলো—সব অসহ্য লাগে আমার। আর মানুষ সবসময়—’

‘চেঁচিয়ো না, প্লিজ,’ স্যালি বলল। ব্যাপারটা বেশ মজার কারণ আমি তখন চেঁচাচ্ছিলাম না, চেঁচানো তো দূরের কথা জোরেও বলছিলাম না।

‘গাড়ির কথাই ধরো,’ এবার আরো শান্ত গলায় বললাম। ‘বেশির ভাগ লোকই তাদের গাড়ির ব্যাপারে একদম পাগল। তাদের গাড়িতে কোনো আঁচড় পড়েছে কি না সেটা নিয়ে তারা সবসময় দুঃশ্চিন্তা করে, তারা সবসময়ই বকবক করে এক গ্যালন তেলে তাদের গাড়ি কত মাইল চলতে পারে। আর তারা একদম ঝকঝকে নতুন কোনো গাড়ি কিনেও ওটার বদলে আরো নতুন গাড়ি নেওয়ার চিন্তা করে। আমার পুরোনো গাড়িগুলোও ভালো লাগে না। মানে ওগুলোর প্রতি আমার কোনো আগ্রহও নেই। ওগুলোর বদলে আমি পারলে ঘোড়া বেছে নেব। একটা ঘোড়ার অন্তত একটা মানবিক জীবন আছে। একটা ঘোড়া অন্ততপক্ষে— ‘

‘আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী নিয়ে কথা বলছো,’ স্যালি বলল। ‘একেকবার একেকটা নিয়ে কথা বলছো তুমি –

‘একটা ব্যাপার কী জানো?’ বললাম। ‘তুমিই হয়তো একমাত্র কারণ যার জন্য আমি এখনো নিউইয়র্কে আছি। যদি তুমি না থাকতে তাহলে আমি হয়তো কোনো জঙ্গল-টঙ্গলেই চলে যেতাম। তুমি একমাত্র কারণ আমার এখনো এখানে টিকে থাকার।’

‘তুমি খুব সুইট,’ স্যালি বলল। তবে তার কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝা যাচ্ছিল সে আর এই বিষয়ে কোনো কিছু শুনতে চাচ্ছে না।

‘তোমার একবার ছেলেদের স্কুলে যাওয়া উচিৎ। চেষ্টা করো মাঝেমধ্যে ছেলেদের স্কুলে যাওয়ার,’ বললাম। ‘পুরো জায়গাটাই ধাপ্পাবাজে ভরা। ওগুলোতে পড়ালেখা শেখানোই হয় শুধু পাশ করে বের হয়ে কোনো একদিন ঐসব ফালতু ক্যাডিলাক গাড়ি কেনার মতো যোগ্য হওয়ার জন্য। আর ওখানে সবসময় এমন একটা ভাব করে থাকা লাগে যেন ফুটবল টিম হারলে সব শেষ। সেখানে সবসময় কথা বলা লাগে শুধু মেয়ে, ড্রিংকস আর সেক্স নিয়ে। আর জায়গাটাতে সবাইকেই একটা ছোটো ছোটো করে চক্র হয়ে থাকা লাগে। মানে বাস্কেটবলের খেলোয়াড়েরা সবসময় একইসাথে থাকে। ক্যাথলিকরা চলে শুধু ক্যাথলিকদের সাথে, ব্রিজ খেলোয়াড়রা ব্রিজ খেলোয়াড়দের সাথে। এমনকি বুক-অব-দ্য-মান্থ ক্লাবের ছেলেরাও তাদের নিজেদের একটা চক্রের মধ্যেই থাকে। যদি কেউ তাদের সাথে কোনো মাথা খাটানোর ব্যাপারে—’

‘আহা,’ স্যালি বলে উঠলো। ‘অনেক ছেলেরাই স্কুল থেকে এরচেয়েও বেশি কিছু অর্জন করে।’

‘হ্যাঁ, আমিও মানি সেটা। আমি মানি যে কেউ কেউ আসলেই এরচেয়েও বেশি কিছু পায়। তবে আমি শুধু এটাই জানতে পেরেছি স্কুল থেকে। বুঝতে পারছো? আমি আসলে এটাই বুঝাতে চাচ্ছিলাম, আমি আসলে কোনো কিছু থেকেই এখন কিছু পাই না। আমার অবস্থা খুবই খারাপ এখন। খুবই বাজে একটা অবস্থায় আছি আমি।’

‘তুমি আসলেই বাজে একটা দশায় আছো।’

তখন হুট করেই একটা আইডিয়া এলো মাথায়।

‘এই শুনো,’ বললাম, ‘একটা আইডিয়া এসেছে আমার মাথায়। তোমার কি এই ফালতু গত্বাঁধা জীবনযাপন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে? আমার আইডিয়াটা শোনো আগে। গ্রিনউইচ ভিলেজের একটা ছেলেকে চিনি আমি। ওর থেকে কয়েক সপ্তাহের জন্য তার গাড়িটা ধার নেওয়া যাবে। সে আমার সাথে একই স্কুলে পড়তো। তার কাছে আমি এখনো দশ ডলার ধার পাই। কাল সকালে কিন্তু আমরা চাইলে ওর থেকে গাড়ি নিয়ে ম্যাসেচুসেটস বা ভারমন্টের দিকে যেতে পারি। ঐ জায়গাটা খুবই সুন্দর, মোহনীয়। আসলেই,’ ওগুলো নিয়ে যত ভাবছিলাম ততই উত্তেজনায় বাড়ছিল আমার। উত্তেজনায় একসময় স্যালির হাত খাবলে ধরলাম। ওহ, কত বোকা ছিলাম আমি ঐসময়। ‘মজা করছি না,’ বললাম। ‘ব্যাংকে আমার অ্যাকাউন্টে প্রায় একশো আশি ডলারের মতো আছে। সকাল হলেই আমি ব্যাংক থেকে ওগুলো তুলবো। আর তারপর ঐ ছেলের গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করবো। মজা করছি না। ওখানে গিয়ে কেবিন ক্যাম্পগুলোতে থাকতে পারবো আমরা। টাকা ফুরিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্তও ওখানেই থাকতে পারবো। তারপর যখন টাকা শেষ হয়ে যাবে, তখন আমি ওখানে কোথাও কোনো চাকরি-টাকরি নেব। তখন হয়তো কোনো নদীর ধারে প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে পারবো আমরা। এরপর হয়তো সময় হলে আমরা বিয়ে করবো। শীতের সময় আমি নিজেই আগুন জ্বালানোর কাঠ কেটে আনবো। সত্যি বলছি, খুবই চমৎকার সময় কাঁটাতে পারবো আমরা। কী বলো তুমি? তুমি যাবে আমার সাথে? প্লিজ!’

‘তুমি চাইলেই তো এরকম কিছু করতে পারবে না,’ স্যালি বলল। তার কণ্ঠস্বর প্রচণ্ড আহত শোনাচ্ছিল তখন।

‘কেন পারবো না আমি?’

‘আমার দিকে চেঁচাবে না, প্লিজ,’ সে বলল। ব্যাপারটা খুবই বিরক্তিকর ছিল, কারণ আমি তখন তার সাথে জোর গলায়ও কিছু বলছিলাম না।

‘কেন পারবো না বলো?’

‘কারণ তুমি পারবে না, এটাই বড়ো কথা। প্রথমত দেখো, আমরা এখনো বলতে গেলে বাচ্চাই। আর তুমি কি কখনো এটা ভেবেছো টাকা শেষ হওয়ার পর তুমি কোনো চাকরি বা কাজ না পেলে কী হবে? না খেয়ে মরতে হবে আমাদের তখন। পুরোটা ব্যাপারই একটা দিবাস্বপ্ন, এটা তো এমনকি—’

‘না এটা দিবাস্বপ্ন না। আমি চাকরি পাবোই। ওটা নিয়ে ভেবো না। ওটা নিয়ে তোমাকে কোনো দুঃশ্চিন্তাও করা লাগবে না। সমস্যাটা কী? তুমি কি আমার সাথে যেতে চাও না? তোমার ইচ্ছা না থাকলে বলো আমাকে।

‘ওরকম কিছু না। আসলে ব্যাপারটা শুধু ওটাই না,’ স্যালি বলল। ঐসময়টায় আমি তাকে কিছুটা ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। ‘ওসব কিছু করার জন্য আমাদের হাতে এখনো প্রচুর সময় আছে। মানে তোমার কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ হওয়ার এবং যদি আমাদের বিয়ে হয়—এরপরও প্রচুর সময় পাবো আমরা ওসব করার। আমাদের যাওয়ার মতোও প্রচুর গন্তব্য থাকবে তখন। তোমাকে শুধু—’

‘না, কোনো সময় থাকবে না পরে। তখন যাওয়ার মতো প্রচুর জায়গাও থাকবে না। পুরো ব্যাপারটাই বদলে যাবে তখন,’ আমি বললাম। আমার তখন আবারো প্রচুর হতাশা লাগতে শুরু করেছিল।

‘কী?’ স্যালি বলল। ‘আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি না। একসময় তুমি চেঁচিয়ে কথা বলো, আর আরেকবার বলো ফিসফিস করে—’

‘আমি বলেছি, না, আমি কলেজ থেকে বের হওয়ার পর যাওয়ার মতো কোনো সুন্দর জায়গা থাকবে না। কান খোলা রাখো তোমার। ব্যাপারটা তখন পুরোই বদলে যাবে। আমাদেরকে তখন এলিভেটরে করে স্যুটকেস নিয়ে উঠা- নামা করা লাগবে। আমাদেরকে তখন ফোন করে সবাইকে বিদায় বলতে হবে, হোটেল থেকে তাদের জন্য পোস্টকার্ড পাঠাতে হবে। আমাকে তখন কাজ করা লাগবে কোনো অফিসে, প্রচুর টাকা আয় করতে হবে, ক্যাবে বা ম্যাডিসন অ্যাভিনিউয়ের বাসে চড়ে পত্রিকা পড়তে হবে বা ব্রিজ খেলা লাগবে। আমাদেরকে যেতে হবে প্রচুর মুভি বা ফালতু অনুষ্ঠান, নিউজরিল বা সার্কাস দেখতে। ওহ খোদা, সার্কাস। ওগুলোতে সবসময়ই একটা গর্দভ ঘোড়া থাকে যেটা উলটে পড়বেই বা কোনো শিম্পাঞ্জিকে দেখা যাবে প্যান্ট পরে বাইসাইকেল চালাচ্ছে। নাহ, ব্যাপারটা তখন এক থাকবে না। তুমি আসলে আমার কথার মানেই বুঝতে পারছো না।’

‘হয়তো। হয়তো বা তুমিই বুঝতে পারছো না,’ স্যালি বলল। ঐসময়টায় আমরা দুইজনই দুইজনকে ঘৃণা করছিলাম না। আসলে তখন তার সাথে ভালো করে কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করার অবস্থাই ছিল না। ঐ বিষয়টা নিয়ে কথা বলা শুরু করেছিলাম ভেবে নিজেরই তখন নিজের ওপর দুঃখ লাগছিল।

‘চলো, এখান থেকে বেরোনো যাক, আমি বললাম। ‘যদি সত্যটা জানতে চাও, তোমার মতো উঁটকো ঝামেলার সাথে সময় কাঁটানোটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল।’

খোদা! বলেই বুঝেছি যে আমার ওটা বলা উচিৎ হয়নি। কথাটা শুনে স্যালি প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়েছিল ঐদিন। অন্য সময় হলে ঐ কথাটা বলতামও না, কিন্তু সে আমাকে প্রচণ্ড হতাশ করে তুলেছিল। আমি সাধারণত কোনো মেয়েকেই কখনো অতটা রুক্ষ কিছু বলি না। এরপর পাগলের মতো অনেকবার ক্ষমা চাইলাম তার কাছে, কিন্তু স্যালি আমার কোনো কথাই শুনছিল না। সে এমনকি কাঁদতেও শুরু করেছিল। ওটাতে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কারণ আমার ভয় লাগছিল সে হয়তো বাসায় তার বাবাকে বলে দেবে যে আমি তাকে ‘উঁটকো ঝামেলা’ বলেছি। তার বাবা খুবই বড়োসড়ো হারামজাদাদের একজন। লোকটা আমাকে খুব একটা পছন্দও করে না। লোকটা একবার স্যালিকে বলেছিল আমি নাকি অনেক বাঁচাল।

‘সত্যিই আমি স্যরি,’ বারবার করে বলছিলাম তাকে।

‘তুমি স্যরি! স্যরি না? ভেরি ফানি,’ স্যালি বলল। সে তখন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। আর তখন হঠাৎই মনে হলো যে তাকে বলা কথাটা নিয়ে আমি আসলে আর দুঃখিত না।

‘চলো, তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি। মজা করছি না।’

‘আমি নিজেই বাসায় যেতে পারবো, থ্যাংক ইউ। যদি তুমি ভেবে থাকো তোমাকে আমি সাথে নিয়ে বাসায় যাবো, তাহলে তুমি একটা পাগল। আমার পুরো জীবনে কোনো ছেলেই আমাকে এই ধরনের কথা বলেনি।’

একদিক থেকে ভাবলে কিন্তু ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর ছিল। এটা ভাবতে গিয়ে তখন আমি এমন একটা কাজ করে বসলাম যেটা আমার করা উচিৎ হয়নি। হেসে উঠেছিলাম আমি। আর হাসিটা ছিল খুবই জোরালো আর স্টুপিড। মানে আমি যদি পিছনে বসে কোনো হলে গিয়ে মুভি দেখি, তাহলে আমিও সামনে ঝুঁকে আমাকে চুপ করে থাকতে বলবো। আমি হেসে উঠায় স্যালি আরো বেশি ক্ষেপে গিয়েছিল।

আরো কিছুক্ষণ ওখানে বসেছিলাম আমি। বারবার ক্ষমা চাইছিলাম স্যালির কাছে। কিন্তু স্যালি আমাকে ক্ষমা করছিল না। বারবার বলছিল তাকে ওখানে একা রেখে চলে যেতে। শেষমেশ ওটাই করেছিলাম। তাকে ওখানে রেখেই ভেতর থেকে জুতাগুলো নিয়ে এসে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। আমার আসলে ওটা করা উচিৎ হয়নি, কিন্তু তখন আমার নিজেরই হতাশা এসে গিয়েছিল নিজের ওপর।

যদি সত্য বলি, আমি নিজেও জানি না কেন তার সাথে ওসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছিলাম। মানে ম্যাসেচুসেটস আর ভারমন্টে যাওয়ার ব্যাপারটা। সে যেতে রাজি হলেও হয়তো আমি তাকে নিয়ে যেতাম না। তার আসলে কারো সাথেই ওখানে যাওয়া উচিৎ না। তবে বাজে ব্যাপারটা হলো, আমি তখন তাকে ওসব বলেছিলাম তখন আসলে মন থেকেই বলেছিলাম। এটাই হলো সবচেয়ে খারাপ দিক। সত্যি বলছি, আমি আসলেই একটা পাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *