দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ১২

অধ্যায় বারো

আমি যে ক্যাবটাতে করে গিয়েছিলাম সেটা খুবই পুরোনো ছিল। ক্যাবটার ভেতরে গন্ধ এমন ছিল যে মনে হচ্ছিল ভেতরে কেউ নষ্ট বিস্কুট ফেলে গেছে। গভীর রাতে বেরুলে আমাকে সবসময়ই এমন বাজে প্রকৃতির ক্যাবে উঠতে হতো। তবে এটাই সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার ছিল না। নীরবতা এবং একাকীত্ব পুরো সময়টাকেই আরো বিষণ্ন করে রেখেছিল। যদিও ঐদিন শনিবার রাত ছিল, তারপরও রাস্তায় তেমন কোনো মানুষের আনাগোনা ছিল না। অনেক সময় পর পর মাঝেমধ্যে এক-দুজন লোক চোখে পড়ছিল, মাঝেমধ্যে চোখে পড়ছিল কোমরে হাতগুঁজে রাস্তা পার হওয়া কিছু মেয়ের আর বুড়োগোছের ডেটের সাথে হায়েনার মতো হাসতে হাসতে হেঁটে যাওয়া কিছু ডেটরূপী পতিতার। হায়েনার মতো হাসতে থাকা মেয়েগুলো আসলে অযথাই হাসতো, এমনকি হাস্যকর কিছু না হলেও হাসতো। নিউইয়র্কে গভীর রাতে হাসির শব্দ শোনাটা আসলে খুবই বাজে একটা অভিজ্ঞতা। প্রায় মাইলখানেক ধরে শোনা যেত হাসির শব্দ। এতে নিজেকে আরো বেশি একাকী আর বিষণ্ণ লাগতো। তখন শুধু আমি প্রার্থনা করছিলাম আমি যদি বাসায় ফিরে গিয়ে পিচ্চি ফিবিকে সব কিছু খুলে বলতে পারতাম! যাই হোক, বেশ কিছুক্ষণ ক্যাবে করে চলার পর হঠাৎই কথা বলতে শুরু করলাম ক্যাব ড্রাইভার আর আমি। লোকটার নাম ছিল হরউইটজ। রাতের আগের ড্রাইভারটার তুলনায় লোকটা বেশ ভালো ছিল। যাই হোক, আমি ভেবেছিলাম এই লোকটা হয়তো হাঁসের ব্যাপারে কিছু জানতে পারে।

‘হেই, হরউইটজ,’ বললাম। ‘আপনি কি কখনো সেন্ট্রাল পার্কের লেগুনটার ওদিকে গেছেন? সেন্ট্রাল পার্ক সাউথের রাস্তা ধরে?

‘পার্কের কী?’

‘লেগুন। ছোটো একটা হ্রদ। ঐ যে অনেক হাঁস থাকে?’

‘হ্যাঁ। ওটার ব্যাপারে কী জানতে চান?’

‘আপনি তো নিশ্চয় জানেন হ্রদে হাঁসগুলো সাঁতার কাটে? বসন্তকালে? যাইহোক, আপনি কি কোনোভাবে জানেন শীতের মৌসুমে ঐ হাঁসগুলো কোথায় যায়?’

‘কী কোথায় যায়?’

‘হাঁসগুলো। আপনি কি জানেন এটা কোনোভাবে? মানে কেউ কি লেগুনের ওখানে ট্রাক নিয়ে এসে ওগুলোকে তুলে নিয়ে যায় নাকি ওরা নিজে থেকেই উড়ে দক্ষিণ বা ওরকম কোনো অঞ্চলে চলে যায়?’

কথাটা শুনে মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো লোকটা। লোকটার ধৈর্য শক্তি খুব কম ছিল, তবে আচরণ খুব খারাপ ছিল না। ‘আমি ওটা কীভাবে জানবো?’ লোকটা বলল। ‘আমি কীভাবে এই স্টুপিড হাঁসদের ব্যাপারে জানবো?’

‘আহা, আবেগাক্রান্ত হবেন না,’ বললাম। লোকটা তখন আসলেই প্রশ্নটায় বা কিছুতে বেশ আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল।

‘কে আবেগাক্রান্ত? কেউই আবেগাক্রান্ত না।’

তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। কেউ যদি এতো সেন্সিটিভ হয়ে থাকে তাহলে তার সাথে তো আর কথা বলা যায় না। তবে লোকটা নিজে থেকেই আবার কথা বলা শুরু করল। পুরো ব্যাপারটা নিয়েই অনর্থক কিছু মন্তব্য করে একসময় বলল, ‘মাছেরা কখনো কোনো জায়গায় যায় না। তারা যেখানে আছে সেখানেই থাকে, মানে মাছেরা। ঐ হ্রদেই আছে মাছগুলো।’

‘মাছ? এটা তো ভিন্ন প্রসঙ্গ। মাছ আসলেই ভিন্ন। আমি হাঁস নিয়ে বলছি,’ বললাম।

‘পার্থক্য কী এতে? কোনো পার্থক্যই তো নেই,’ হরউইজ বলল। প্রতিটা কথাতেই বুঝা যাচ্ছিল সে কোনো একটা বিষয়ে বেশ আবেগী বা চিন্তিত ছিল। ‘শীতে হাঁসদের থেকে তো মাছেদের সমস্যাটা আরো বেশি। মাথা খাটান, তাহলেই বুঝতে পারবেন।’

মিনিট খানেকের মতো কিছু বললাম না। তারপর বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে। তারা কী করে তাহলে, মানে মাছেরা? শীতে হ্রদের পানি শক্ত বরফে পরিণত হওয়ার পর মানুষ যখন ওটার ওপর দিয়ে আইস স্কেট করে তখন তারা কী করে?’

হরউইটজ আরো একবার ফিরে তাকালো আমার দিকে। ‘তারা কী করে মানে? কী বুঝাতে চাচ্ছেন আপনি?’ লোকটা প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল আমার দিকে। ‘তারা ঠিক ওখানেই থাকে, ওখান থেকে এক বিন্দুও সরে না।‘

‘তারা তো ঐ বরফটাকে ওভাবেই এড়িয়ে যেতে পারে না। কোনোভাবেই না।’

‘কে এড়াচ্ছে বরফ? কেউই বরফ এড়াচ্ছে না,’ হরউইটজ বলল। বলতে বলতে বেশ উত্তেজিতও হয়ে উঠেছিল সে। আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম উত্তেজিত হয়ে লোকটা না জানি কোনো ল্যাম্পপোস্টে গাড়ি ঠুকে দেয়। ‘তারা ঐ বরফেই বাস করে। এটাই তাদের প্রকৃতি। পুরো শীতেই তারা ঐ বরফে জমা হয়ে থাকে।’

‘তাই? তারা তখন কী খায় তাহলে? মানে তারা যদি জমে শক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তো সাঁতার কেটে খাবারের কোনো খোঁজ করতে পারবে না।’

‘তাদের শরীর… আপনার সমস্যাটা কী আসলে? তাদের শরীরে পুষ্টি সঞ্চিত হয়ে থাকে, ঔ পুষ্টি থাকে জলজ-শৈবালে—যেটা তাদের সাথেই বরফে জমাট হয়ে থাকে। পুরোটা সময়ই তো তাদের শরীরের রন্ধ্র উন্মুক্ত হয়ে থাকে। এটাই তাদের প্রকৃতি। বুঝেছেন ব্যাপারটা?’ বলে আবার ঘুরে আমার দিকে তাকালো।

‘ওহ,’ বলে প্রসঙ্গটা বাদ দিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম এই ক্যাবে চড়ে হয়তো দুর্ঘটনার শিকারও হয়ে পারি। তাছাড়া লোকটা খুবই ইমোশনাল ছিল। তার সাথে কোনো কিছু আলোচনা করাটা খুব আনন্দদায়ক ছিল না। ‘আপনি ড্রিংক করার জন্য কোথাও গাড়ি থামাতে পারবেন? ভাববেন না বিল আমিই দেব,’ বললাম।

লোকটা কোনো জবাব দিলো না যদিও। আমার ধারণা সে প্রস্তাবটা নিয়ে ভাবছিল। তাই আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম। লোকটা আসলে একদিক থেকে বেশ ভালো। বেশ মজাদার প্রকৃতির।

‘আমার এখন মদ খাওয়ার মতো সময় নেই, বন্ধু,’ সে বলল। ‘আর এমনিতেও আপনার বয়সটাই বা কত? বিছানায় শুয়েও ড্রিংক করতে পারবেন আপনি?’

‘আমি শুয়ে পড়ার মতো ক্লান্ত এখনো না।’

যাই হোক, আর্নি’জের সামনে নেমে ভাড়া মেটানোর সময় হরউইটজ আরো একবার মাছের প্রসঙ্গটা তুললো। নিঃসন্দেহেই ব্যাপারটা তার মাথায় শক্তভাবে গেঁথে গিয়েছিল। ‘শুনুন,’ সে বলল, ‘আপনি যদি কোনো মাছ হতেন, তাহলে এই প্রকৃতিই আপনার দেখভাল করত, তাই না? ঠিক বলেছি তো? আপনি নিশ্চয় এটা ভাবেন না যে শীতের সময় সব মাছেরা মরে যায়?’

‘না, তবে…’

‘আপনি ঠিক, আসলেই মাছেরা মরে না,’ বলে ক্যাব নিয়ে জায়গাটা থেকে মুহূর্তের মধ্যেই চলে গেল হরউইটজ। আমার দেখা সবচেয়ে ইমোশনাল মানুষ হরউইটজ। তাকে যেকোনো ব্যাপারে কিছু বললেই আবেগী হয়ে যেত।

অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরও আর্নি’জ তখন কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল। ওখানের বেশির ভাগই ছিল প্রেপ স্কুল এবং কলেজের ফাজিলগুলো। আমি যে স্কুলগুলোতে পড়েছি সেগুলো ছাড়া পৃথিবীর বাদ বাকি সব প্রতিষ্ঠানেই ক্রিসমাসের ছুটি আগেভাগে শুরু হয়ে যেত। জায়গাটায় তখন এতই ভীড় ছিল যে আমি যে আমার কোট খুলে কোথাও রাখবো সেই সুযোগটাও পাচ্ছিলাম না। যদিও জায়গাটা তখন বেশ নীরব ছিল, কারণ আর্নি তখন পিয়ানো বাজাচ্ছিল। পিয়ানো বাজানো শুরুর আগে সুরটা কোনো পবিত্রতার প্রতীক জাতীয় কিছু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কেউই তো আর অতটা ভালো বাদক হতে পারে না। আমার পাশে তখন আরো তিন দম্পতি ছিল, আমরা সবাই টেবিলের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। শুধু তাই না, পিয়ানো বাজানো অবস্থায় আর্নিকে এক পলক দেখার জন্য পিছন থেকে ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কির পরিমাণও কম ছিল না। আর্নি তার পিয়ানোর সামনে বিশাল একটা বড়ো আয়না রেখে দিয়েছিল, আর বড়ো একটা স্পটলাইট ছিল তার ওপর যাতে পিয়ানো বাজানোর সময় প্রত্যেকেই তার মুখটা দেখতে পায়। তবে বাজানোর সময় তার আঙুল দেখার কোনো উপায় ছিল না—শুধু তার মুখটাই দেখা যেত। আমি নিশ্চিত না তখন কোন সুরটা সে বাজাচ্ছিল, তবে সুরটা যেটাই হোক না কেন—সে খুবই বাজেভাবে বাজাচ্ছিল তখন। সে প্রতিটা হাই নোটের লহরীতেই শো-অফ করছিল, সেই সাথে আরো কিছু ট্রিক করছিল। ব্যাপারটা বেশ বিরক্ত লাগছিল আমার। তবে বাজানো শেষ করতেই জনতার ভীড়ের প্রতিক্রিয়া শুনেই বমি করে দেওয়ার ইচ্ছা হলো আমার। তারা প্রত্যেকেই পাগল হয়ে গিয়েছিল সুরে। ঐ জনতাগুলো আসলে ছিল মুভি থিয়েটারে হায়েনার মতো খিলখিল করে হাসা মানুষগুলো যারা মুভি ফানি না হলেও ঠিকই হাসতো। সত্যি বলছি আমি যদি কোনো পিয়ানোবাদক বা মুভি অ্যাক্টর বা এমন কিছু হতাম—তাহলে নিশ্চিত ঐ মূর্খ ফ্যানগুলোকে ঘৃণা করতাম। আমি হয়তো তাদেরকে আমার জন্য তালি বাজাতেই মানা করতাম। মানুষ সবসময়ই ভুল কিছুতে তালি দেয়। যদি আমি কোনো পিয়ানো বাদক হতাম, তাহলে আমি সেটা একদম নির্জনে বাজাতাম। যাইহোক, আর্নি বাজানো শেষ করার পর প্রত্যেকেই তালিতে মুখরিত করে তুলেছিল জায়গাটাকে, আর ঐ আর্নিও তালির শব্দ শুনে তার টোল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মেকি কুর্নিশ জানালো শ্রোতাদের। ব্যাপারটা পুরোপুরিই মেকি ছিল। মানে সে কী পরিমাণের বড়োসড়ো উন্মাসিক প্রকৃতির লোক সেটা ভাবলেই তো এটা সহজে বুঝা যায়। ব্যাপারটা অবশ্য মজারও। বাজানো শেষের পর লোকটার জন্য আমার বেশ দুঃখই লাগছিল। আমার মনে হয় সে নিজেও জানে যে সে কখন সঠিক সুর বাজাচ্ছে আর কখন ভুল বাজাচ্ছে। এটা অবশ্য তার কোনো দোষ না। আমি এর জন্য আংশিকভাবে দোষারোপ করবো তাকে তালি দেওয়া মূর্খগুলোকে। সুযোগ পেলে এই মূর্খগুলো যে কাউকেই নষ্ট করে দিতে পারে। যাই হোক, ব্যাপারটা আমাকে এতো বিষণ্ণ করে তুলেছিল যে আমার তখন ইচ্ছা করছিল কোটটা তুলে নিয়ে আবার হোটেল রুমে ফিরে যাই। তবে রাত তখনো খুব বেশি হয়নি, আর আমারও তখন ফিরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা করছিল না।

শেষমেশ তারা আমাকে একটা পঁচা টেবিল দিয়েছিল। দেওয়ালের সাথের ঐ টেবিলটা ছিল থামের পিছনে। কিছুই দেখার উপায় ছিল না ঐ থামের পিছন থেকে। টেবিলটাও ছিল খুব ছোটো। ওটা আসলে এমন একটা টেবিল ছিল যেটাতে পাশের বড়ো টেবিলের লোকেরা উঠে চলে না যাওয়া পর্যন্ত বসে অপেক্ষা করার মতো। কিন্তু পাশের টেবিলের হারামিগুলো তো আর উঠে যাওয়ার মতো ছিল না। তাই কী আর করা—ওটাতেই বসা লাগলো। বসে একটা স্কচ আর সোডা অর্ডার করলাম। ফ্রোজেন ডাইকুইরিসের পর ওটাই আমার সবচেয়ে পছন্দের ড্রিংক ছিল। আর আর্নি’জে ছয় বছর বয়সের বেশি হলেই ড্রিংক দেওয়ার অনুমতি ছিল। জায়গাটা নিয়মের কোনো তোয়াক্কাই করত না। আর তাছাড়া তারা খেয়ালও করত না কার বয়স কত। এমনকি ওখানে গিয়ে মূর্খের মতো কিছু করলেও কেউ খেয়াল করত না।

আমার আশেপাশের সবগুলোই গণ্ডমূর্খ ছিল। মজা করছি না, আসলেই এরকম ছিল অবস্থা। আমার ঠিক বামেই একটা টেবিল ছিল—সত্যি বলতে টেবিলটা আমার প্রায় কোলের ওপরই ছিল—যেটাতে বসেছিল এক আজব চেহারার লোক আর অদ্ভুত চেহারার মেয়ে। তাদের বয়স আমার সমানই ছিল, সম্ভবত আমার থেকে কিছুটা বেশিই ছিল। ব্যাপারটা বেশ মজার। ড্রিংক খাওয়ার সময় তারা এমন আচরণ করছিল যেন তারা নির্ধারিত সীমার থেকে বেশি খেয়ে না ফেলে। তাদের কথাবার্তা কিছুক্ষণ শুনেছিলাম আমি। আসলে আমার তখন করার মতো কোনো কাজ ছিল না, তাই তাদের কথাই শুনছিলাম। ছেলেটা বিকালে দেখা একটা প্রো-ফুটবল ম্যাচের কথা বলছিল। সে মেয়েটাকে পুরো ম্যাচের বিবরণই বলে দিয়েছিল। মজা করছি না, আসলেই সে পুরো ম্যাচের প্রতি সেকেন্ডের কথাই বলেছিল মেয়েটাকে। আমার শোনা সবচেয়ে বিরক্তিকর ছেলে ছিল ও। আর তাদের দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে মেয়েটার খেলার ব্যাপারে কোনো আগ্রহই ছিল না, তবে মেয়েটা দেখতে ছেলেটার থেকেও বেশি অদ্ভুত ছিল। মনে হয় মেয়েটার আসলে তখন বিবরণ শোনা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কুৎসিত চেহারার মেয়ে হলে যা হয় আর কী। আমার আসলে মাঝেমধ্যে বেশ খারাপই লাগে ওদের জন্য। মাঝেমধ্যে তো আমি তাদের দিকে তাকাতেও পারি না, বিশেষ করে যখন ফালতু চেহারার ছেলেরা তাদেরকে ফুটবল খেলার বিবরণ দেয়। তবে আমার ডান পাশে চলা কথোপকথনটা আরো ফালতু ছিল। ডান পাশে ছিল ধূসর বর্ণের পশমী জ্যাকেট এবং উলের ভেস্ট পরা হোমড়া-চোমড়া ভাব ধরা এক লোক। আইভি লিগের সব হারামজাদাই আসলে দেখতে একরকম। আমার বাবাও চায় আমি যেন ইয়েল বা প্রিন্সটনে যাই, তবে আমার আইভি লিগের কলেজে পড়ার কোনো ইচ্ছাই নেই। যাই হোক, ঐ লোকটার সাথে চমৎকার-চেহারার এক মেয়ে বসেছিল। খোদা, মেয়েটা দেখতে আসলেই খুব সুন্দর ছিল। তবে তাদের কথাবার্তা শুনলে বুঝতে পারতেন। প্রথমত, তারা অনেকটাই মাতাল ছিল তখন। ছেলেটা টেবিলের নিচ দিয়ে মেয়েটাকে ফিল দিচ্ছিল, আর একই সাথে তাদের ডর্মের একজনের এক বোতল অ্যাসপ্রিন খেয়ে সুইসাইড করতে গিয়ে প্রায় মরতে বসা এক ছেলের গল্প ছিল। আর মেয়েটা তখন বলছিল শুধু, ‘ওহ, কী ভয়ঙ্কর… ওহ, ডার্লিং, প্লিজ, এখানে না। প্লিজ।’ একই সাথে কাউকে ফিল দেওয়া এবং সুইসাইড করতে যাওয়া এক ছেলের গল্প বলা পুরোই হাস্যকর ব্যাপার।

ওখানে একা বসে থাকতে থাকতে আমার নিজেকে পুরোপুরি গর্দভ মনে হচ্ছিল। ওখানে আসলে স্মোক আর ড্রিঙ্ক করা ছাড়া কোনো কাজই ছিল না। তারপরও ওয়েটারকে একবার বলেছিলাম সে আর্নিকে গিয়ে আমার সাথে বসে ড্রিংক করার অফারটা দিতে পারবে কি না। সাথে এটাও জানালাম যে আমি ডি.বি.’র ভাই। অবশ্য আমার মনে হয় না সে আমার মেসেজটা আর্নিকে কখনো দিয়েছিল। ঐ হারামজাদা ওয়েটারগুলো কখনোই কাউকে কারো মেসেজ দেয় না।

হঠাৎ করেই একটা মেয়ে আমার কাছে এসে বলে উঠলো, ‘হোল্ডেন কলফিল্ড!’ মেয়েটার নাম লিলিয়ান সিমন্স। আমার ভাই ডি.বি. একসময় মেয়েটার সাথে ডেট করত। মেয়েটার স্তনগুলো ছিল বিশাল বড়ো বড়ো।

‘হাই,’ বলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। এটাই তো সাধারণ ভদ্রতা। তবে ওরকম একটা জায়গায় উঠে দাঁড়ানোটা ছিল বিশাল কঠিন এক কাজ। লিলিয়ানের সাথে এক নেভি অফিসার, অবশ্য লোকটার চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেন কেউ তার পশ্চাতদেশে অনবরত লাথি মারছে।

‘তোমাকে দেখে খুবই ভালো লাগছে,’ বলল লিলিয়ান সিমন্স 1 স্বাভাবিকভাবেই মিথ্যে একটা কথা। ‘তোমার ভাই কেমন আছে?’ হ্যাঁ, সে আসলেই এটা জানতে এসেছিল।

‘সে ভালোই আছে। হলিউডে আছে এখন।

‘হলিউডে! চমৎকার! কী কাজ করে ও?’

‘জানি না ঠিক, সম্ভবত লেখালেখি করে,’ বললাম। আমার আসলে তখন ওসব নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা ছিল না। অবশ্য লিলিয়ানকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে হলিউডে কাজ করাটাকে সে অনেক বড়ো কিছু মনে করে। ডি.বি.র লেখা পড়েনি এমন বেশির ভাগ মানুষই এমন মনে করে। ব্যাপারটা খুব বিরক্ত লাগে আমার।

‘চমৎকার,’ লিলিয়ান বলল। এরপর সে নেভির লোকটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো আমার। লোকটার নাম কমান্ডার ব্লপ না কী যেন ছিল। সে ছিল এমন জাতের লোক যারা মনে করে কারো সাথে হ্যান্ডশেকের সময় আঙুল ভেঙে ফেলার মতো জোরে চাপ না দিলে মানুষ তাদেরকে দুর্বল ভাববে। জিনিসটা খুবই বিরক্তিকর লাগে আমার কাছে। ‘তুমি কি একা?’ লিলিয়ান জিজ্ঞেস করল আমাকে। আমার সাথে কথা বলতে গিয়ে পুরো আইলটাই প্ৰায় আটকে ফেলেছিল ও। অবশ্য তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল সে এভাবে অন্যের রাস্তা আটকে দেওয়াটাকে বেশ পছন্দই করে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা ওয়েটারকে একসময় সরে অন্য পথ দিয়েই যেতে হয়েছিল, তবে লিলিয়ান ঐ লোককে একবার খেয়ালও করেনি। ব্যাপারটা বেশ মজার ছিল। বুঝাই যাচ্ছিল যে ওয়েটার এই ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ করেনি, এমনকি তার সাথে থাকা নেভির লোকটাও লিলিয়ানকে খুব একটা পছন্দ করে না, অবশ্য লোকটা তারপরও ঠিকই ডেট করে যাচ্ছে তার সাথে। আমিও লিলিয়ানকে খুব একটা পছন্দ করি না। সত্যি বলতেই কেউই করে না। একদিক দিয়ে ভাবলে তার জন্য কিছুটা খারাপই লাগে। ‘সাথে কি কোনো ডেট নেই তোমার?’ সে জিজ্ঞেস করল আমাকে। তখন পর্যন্ত আমি দাঁড়িয়েইছিলাম, লিলিয়ান আমাকে একবারও বসতেও বলেনি। সে আসলে এমন ধরনের মানুষ যারা তাদের জন্য অন্যদেরকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করে। ‘ও কি হ্যান্ডসাম না?’ নেভির লোকটাকে বলল ও। ‘হোল্ডেন, তুমি তো দেখি প্ৰতি মিনিটে মিনিটেই হ্যান্ডসাম হচ্ছো।’ নেভির লোকটা তখন তাকে ফিসফিস করে সরে যেতে বলল। বলল যে তারা অন্যদের হেঁটে যাওয়ার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। লিলিয়ানও তখন সায় দিয়ে আমাকে বলল, ‘হোল্ডেন, আমাদের সাথে আসো। ড্রিংক সাথে নিয়েই আসো।’

‘আমি আসলে এখন বেরুতে চাচ্ছিলাম,’ বললাম তাকে। ‘আমার আসলে একজনের সাথে দেখা করতে হবে।’ লিলিয়ানকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে সে আমার সাথে খাতির জমানোর চেষ্টা করছে। কারণটা তো জানাই আছে, সে আমার থেকে ডি.বি.র ব্যাপারে জানতে চাচ্ছে।

‘ওহ, বিদায় তাহলে। ভালো থেকো। আর তোমার ভাইয়ের সাথে দেখা হলে বলো যে আমি তাকে ঘৃণা করি।

বলে লিলিয়ান চলে গেলো ওখান থেকে। এরপর আমি আর নেভির লোকটা একে অন্যের সাথে আবার হাতমিলিয়ে বললাম যে দেখা হয়ে ভালো লাগলো। ব্যাপারটা সবসময় আমাকে বেশ খোঁচায়। আমি সবসময় কারো সাথে দেখা হলে বলি ‘দেখা হয়ে ভালো লাগলো’। সত্যি বলতে আমার আসলে সাক্ষাৎ করে একদমই ভালো লাগে না। তবে এই দুনিয়ায় বাঁচতে হলে এসব বলা ছাড়া কোনো উপায়ও থাকে না।

লিলিয়ানকে কারো সাথে দেখা করার অজুহাত দেওয়ার পর আমার আসলে ওখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায়ই ছিল না। আর্নি কোনোরকমে ভালো কোনো গান বাজায় কি না সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করারও কোনো সুযোগ ছিল না। হ্যাঁ, জানি লিলিয়ান সিমন্স আর ঐ নেভির লোকটার সাথে বসলে আরো কিছুক্ষণ থাকা যাবে ক্লাবটাতে। তবে তাদের সাথে বসে বিরক্ত হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই আমার। তাই বেরিয়ে গেলাম ওখান থেকে। যদিও কোট পরে বেরুনোর সময় আমার বেশ রাগ লাগছিল। কিছু মানুষ সবসময়ই অন্যের মজা নষ্ট করে দেয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *