দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ১০

অধ্যায় দশ

রাত তখনো খুব বেশি হয়নি। আমি জানতাম তখন ঠিক কয়টা বাজে, তবে খুব বেশি রাত হয়নি তখনো। আমারো খুব বেশি ক্লান্তি লাগছিল না। তাই শুয়ে পড়তেও ইচ্ছা করছিল না। ক্লান্তি না লাগলে বিছানায় শোয়াটা আমি খুব অপছন্দ করি। তাই স্যুটকেস খুলে একটা পরিষ্কার শার্ট বের করলাম। এরপর বাথরুমে গিয়ে শরীর ধুয়ে শার্টটা পাল্টে নিলাম। ভাবছিলাম নিচে নেমে ল্যাভেন্ডার রুমে গিয়ে দেখবো সেখানে কী চলছে। ল্যাভেন্ডার রুম ঐ হোটেলের নাইট ক্লাব।

শার্ট পাল্টানোর সময় ছোটো বোনকে প্রায় ফোনই দিয়ে বসেছিলাম। নিশ্চিতভাবেই আমার তখন ফিবির মতো বুদ্ধিমান কারো সাথে কথা বলতে প্রচণ্ড ইচ্ছা করছিল। তবে ফোন করার সাহস পাচ্ছিলাম না। একে তো সে একটা ছোটো বাচ্চা মাত্র, তাছাড়া ঐ সময়ে সে ঘুমিয়েও পড়েছে। ফোন দিলে সে-ই ধরবে কি না সেটাও একটা ঝুঁকি ছিল। যদিও ভাবছিলাম বাবা-মা কেউ একজন ফোন ধরলে ফোনটা কেটে দেবো। তবে ওটাও কাজে লাগার মতো ছিল না। তারা ঠিকই বুঝে যেতো। আমার মা সবসময়ই কেমন করে যেন বুঝে যায়। আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে মায়ের। তবে তখন ফিবির সাথে কথা বলার প্রচণ্ড ইচ্ছা করছিল আমার।

ফিবির ব্যাপারে তো আগে বলিনি। আমার সারাজীবনে তার মতো সুন্দর এবং বুদ্ধিমতি কোনো বাচ্চা আমি দেখিনি। সে খুবই চৌকস ছিল। স্কুল শুরু করার পর থেকে সে প্রতিবারই পরীক্ষায় ‘এ’ পেয়ে এসেছে। সত্যি বলতে, আমার পরিবারে আমিই একমাত্র গর্দভ। আমার ভাই ডি.বি. লেখক। আরেক ভাই এলি—যার কথা আগেই বলেছি আমি… মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে আসলে জাদুকরের মতো ছিল। একমাত্র আমিই শুধু গর্দভ। তবে ফিবি ছিল অন্যরকম। তার চুলগুলো লালচে, অনেকটা এলির মতো। গরমের সময় চুলগুলো ছোটো করে রাখে। গ্রীষ্মের সময় সে তার চুলগুলোকে কানের পিছে আটকে রাখে। তার কানগুলোও খুব সুন্দর। আর শীতের সময় তার চুলগুলো থাকে লম্বা। মাঝেমধ্যে আমার মা তার চুল বেঁধে দেয়, আর মাঝেমধ্যে সে চুল খোলাই রাখে। সে খুবই ভালো। তার বয়স মাত্র দশ। আমার মতোই শুকনো গড়নের ও, তবে ভালো শুকনো। তাকে সবাই পছন্দ করে। মানে কেউ যদি ফিবিকে কিছু বলে, তাহলে সে তড়িৎমুহূর্তেই বুঝে যায় যে তার সাথে কী নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। তাকে নিয়ে যেকোনো জায়গাতেও যাওয়া যায়। তাকে যদি ফালতু কোনো মুভি দেখাতে নিয়ে গেলে, তাহলে সে বুঝে যে ওটা ফালতু মুভি। ভালো মুভি দেখাতে নিয়ে গেলে বুঝে যে ওটা ভালো মুভি। ডি.বি. আর আমি মিলে তাকে একবার রাইমু অভিনীত ফরাসি মুভি ‘দ্য বেকার’স ওয়াইফ’ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। মুভিটা খুবই ভালো লেগেছিল তার। অবশ্য তার পছন্দের মুভি রবার্ট ডোনাটের ‘দ্য থার্টিনাইন স্টেপস’। পুরো মুভিটাই তার মুখস্থ করা। আমি নিজেই তাকে দশবার এই মুভি দেখাতে নিয়ে গেছি। মুভির প্রতিটা সংলাপও তার মুখস্থ, কোন দৃশ্যের পর কোন দৃশ্য সেটাও শুধু শব্দ শুনলেই বলে দিতে পারে। খুবই ভালো একটা বাচ্চা ও। তবে তার একটা সমস্যা হলো সে মাঝেমধ্যে মায়াবী হয়ে পড়ে। বাচ্চা হলেও সে খুবই আবেগী। আসলেই। এছাড়া সে সবসময়ই বই লেখে। তবে লেখাগুলো কখনো শেষ করে না। তার সবগুলোই বই-ই হ্যাজেল ওয়েদারফিল্ড নামের এক বাচ্চাকে নিয়ে লেখা। যদিও ফিবি ওটার বানান লিখে ‘হাজেল’। ঐ হ্যাজেল ওয়েদারফিল্ড আসলে একজন মেয়ে গোয়েন্দা। ধরে নেওয়া হয় যে মেয়েটা অনাথ, তবে তার বাবা মাঝেমধ্যেই তার সাথে দেখা করতে আসে। আর তার বাবা থাকে সবসময়ই ‘এক লম্বা আকর্ষণীয় ২০ বছর বয়সের পুরুষ’। এটা প্রতিবারই হাসায় আমাকে। আহ, ফিবি। তাকে আসলে কেউ অপছন্দ করতে পারবে না। ছোটোবেলায়ও ফিবি খুবই বুদ্ধিমতি ছিল। ছোটোবেলায় আমি আর এলি তাকে নিয়ে পার্কে যেতাম, বিশেষ করে রবিবারগুলোতে। এলির একটা সেইলবোঁ ছিল, রবিবারগুলোতে সে ওটা নিয়ে খেলতে পছন্দ করত। তাই খেলতে যাওয়ার সময় পিচ্চি ফিবিকে সাথে নিয়ে যেতাম আমরা। ছোটো ছোটো সাদা গ্লাভস লাগিয়ে আমাদের দু’জনের মাঝখান দিয়ে হাঁটতো ও। হাঁটার ভঙ্গিও ছিল একদম পরিণত মহিলাদের মতো। আর যখন আমি আর এলি অন্যান্য সাধারণ বিষয়ে আলাপ শুরু করতাম, তখন ফিবি চুপ করে শুধু কথাগুলো শুনতো। মাঝমধ্যে আমরা ভুলেও যেতাম যে সে আমাদের সাথে আছে। তবে সে-ই মনে করিয়ে দিতো ভুলে গেলে। আমাদের কথায় বাঁধা দিতো। কোনো কোনো সময় আমাকে বা এলিকে ধাক্কা দিতো, আর বলত, ‘কে? কে বলেছে এটা? ববি না ঐ মহিলা?’ আর আমরা যখন তাকে বলতাম কে বলেছে, তখন সে ‘ওহ’ বলে আবার চুপ করে শোনায় ব্যস্ত হয়ে যেতো। এলিকে খুব পছন্দ করত ফিবি। এলিও ফিবিকে খুব আদর করত। ঐ ফিবির বয়স এখন দশ। এখন আর সেই ছোটো বাচ্চাটি নেই সে। তবে সে এখনো সবার আদর ঠিকই আদায় করে নিতে পারে। কার থেকে কীভাবে আদর নেওয়া লাগে সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে।

যাইহোক, ফিবি এমন একজন মানুষ যার সাথে মনখুলে ফোনে কথা বলা যায়। তবে আমি খুব ভয়ে ছিলাম আমার বাবা-মা ফোন ধরে ফেলে কি না তা নিয়ে। তারা ফোন ধরলে তো জেনে যেতো যে আমি নিউইয়র্কে ছিলাম এবং আমাকে পেন্সি থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। তাই আর ফোন করিনি তখন। শার্ট পরা শেষে ভালোভাবে তৈরি হয়ে এলিভেটরে করে লবিতে নেমে গেলাম সেখানের কী অবস্থা দেখার জন্য।

কয়েকজন দালালের মতো দেখতে পুরুষ আর পতিতার মতো দেখতে কিছু স্বর্ণকেশী মেয়ে ছাড়া লবিতে তেমন কেউই ছিল না। তবে ল্যাভেন্ডার রুম থেকে ব্যান্ডের মিউজিকের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তাই সেখানেই গেলাম। ওখানেও তেমন ভীড় ছিল। ওখানে তারা আমাকে পিছনের দিকের একটা ফালতু টেবিল দিয়েছিল বসার জন্য। আমার আসলে উচিৎ ছিল হেড-ওয়েটারের নাকের সামনে কয়েকটা টাকা ধরা, তাহলেই ভালো টেবিল পাওয়া যেতো। মজা করছি না—নিউ ইয়র্কে টাকাই সব কথা বলে।

ব্যান্ডটা খুবই ফালতু ছিল। বাড়ি সিঙ্গারও ছিল। প্রত্যেকেই পিঙ্গল বর্ণের পোশাকে ছিল, তবে ভালো পিঙ্গল ছিল না—ওটাও ফালতুই ছিল। জায়গাটাতে আমার সমবয়সী মানুষ খুব কমই। সত্যি বলতে আমার বয়সী কেউ ছিলই না ওখানে। ওখানের বেশির ভাগ মানুষই ছিল বুড়ো, লোক-দেখানো ধনী। সবাই সাথে করে ডেট নিয়ে এসেছিল আবার। অবশ্য আমার পাশের টেবিলের চিত্র অন্যরকম ছিল। আমার পাশের টেবিলে ছিল তিনজন মেয়ে, প্রত্যেকের বয়সই ত্রিশের কাছাকাছি। তারা তিনজনই দেখতে খুব কুৎসিত, আর এমন ধরনের টুপি পরেছিল যেটা দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে তারা নিউইয়র্কের বাসিন্দা না। তবে তাদের মধ্যে থাকা স্বর্ণকেশী মেয়েটা অতটা খারাপ ছিল না। মেয়েটা যথেষ্ট কিউট ছিল। তাই আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে ইশারা করতে শুরু করলাম। ঠিক তখনই ওয়েটার চলে এলো অর্ডার নেওয়ার জন্য। স্কচ আর সোডা অর্ডার করলাম, আর তাকে বলে দিলাম যেন দুটো পানীয় একসাথে না মেশায়। কথাগুলো বেশ দ্রুত বলতে হয়েছিল আমাকে। এসব ক্ষেত্রে একটু তড়িঘড়ি করেই কথা বলা লাগে। আমতা আমতা করলেই তারা বুঝে যায় যে অর্ডারকারীর বয়স একুশ না এবং তাদের কাছে কোনো নেশাদায়ক পানীয়ও বিক্রি করে না। তবে তাতেও কোনো লাভ হয়নি। ঝামেলায় ঠিকই পড়তে হয়েছিল আমাকে। ‘স্যরি, স্যার,’ ওয়েটার বলল, ‘আপনার বয়স ভেরিফাই করার কোনো মাধ্যম আছে কী? আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্স?’

শুনে খুব শীতল দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকালাম, ভাবটা এমন ছিল যেন সে আমাকে অনেক বড়ো অপমান করে ফেলেছে। ‘আমাকে দেখে কি বয়স একুশের কম মনে হয়?

‘স্যরি, স্যার, তবে আমাদের…’

‘আচ্ছা, আচ্ছা,’ বললাম। বুঝে গিয়েছিলাম যে কিছুতেই কোনো কাজ হবে না। ‘কোক নিয়ে আসুন তাহলে।’ অর্ডার নিয়ে যাওয়া শুরু করেছিল লোকটা, তখন আমি আবার পিছন থেকে ডেকে বললাম, ‘আপনি কি ওটাতে হালকা একটু রাম মিশিয়ে দিতে পারবেন?’ খুবই ভদ্রভাবে বলেছিলাম। ‘এরকম একটা জায়গায় তো একদম ড্রাংক না হয়ে বসে থাকা সম্ভব না। আপনি কি হালকা রাম দিতে পারবেন?’

‘স্যরি, স্যার…’ বলে চলে গেল লোকটা। আমিও আর কোনো তর্ক করলাম না। মাইনর বা কমবয়স্ক কাউকে নেশাদায়ক কিছু বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়লে তাদের চাকরি চলে যায়। খোদা, আমি মাইনর ছিলাম।

এরপর আবারো পাশের টেবিলে থাকা তিন ডাইনির দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা দেওয়া শুরু করলাম। মানে ব্লন্ড মেয়েটাকে আর কী। অন্য দুজনের দিকে দৃষ্টিটা শুধু কামাতুরই ছিল না। তবে অতটা অসভ্য দৃষ্টিও ছিল না। শুধু শান্তভাবে তাকিয়ে চোখের ইশারা করছিলাম। আর তারা এটা দেখে কী করেছিল জানেন? মূর্খ-গবেটদের মতো খিলখিল করে হেসে উঠেছিল ডাইনিগুলো। সম্ভবত তারা আমাকে ওসব কিছুর জন্য বেশি কমবয়স্ক মনে করছিল। প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছিলাম তাদের ওপর। তাদের ভাব এমন ছিল যেন আমি তাদেরকে বিয়ে করতে চাইছি। ওভাবে হাসার পর আমার তাদের দিকে শীতল দৃষ্টিতে তাকানো উচিৎ ছিল, তবে সমস্যাটা হলো আমার তখন নাচতে ইচ্ছা করছিল খুব। মাঝেমধ্যেই আমার নাচতে বেশ ভালো লাগে, আর ঐ সময়টা ওরকমই একটা সময় ছিল। তাই হুট করে একটু ঝুঁকে বললাম, ‘তোমাদের মধ্যে কারো কি নাচার ইচ্ছা আছে আমার মতো?’ কোনো অসভ্য বা অশোভন ভঙ্গিতে কথাটা বলিনি। সত্যি বলতে খুব ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তবে তারা ওটাকেও একটা কৌতুক ভেবেছিল। আরো জোরে জোরে হাসতে শুরু করেছিল ডাইনিগুলো। আসলেই গবেট ছিল ঐ মেয়েগুলো। ‘কাম’অন,’ বললাম। ‘আমি একবার একবার করে তিনজনের সাথেই নাচবো, ওকে? কাম’অন!’ আমার আসলেই তখন ড্যান্সিংয়ের মুড ছিল।

শেষমেশ স্বর্ণকেশি মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো আমার সাথে নাচার জন্য। কারণ আমি আসলে তার দিকে তাকিয়েই কথা বলছিলাম। তাকে নিয়ে ড্যান্স ফ্লোরে গেলাম। আর অন্য দুই ডাইনি তখন ঐ দৃশ্য দেখে হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল।

তবে অপমানিত হলেও আমার সময়টা অপচয় হয়নি। স্বর্ণকেশি মেয়েটা বেশ ভালো ড্যান্সার ছিল। আমি যাদের সাথে নেচেছি তাদের মধ্যে সবচেয়ে সেরা ও। মজা করছি না, গবেট টাইপের মেয়েগুলোর মধ্যে কয়েকজন মাঝেমধ্যে ড্যান্সফ্লোরে অবাক করে দিতে পারে। বুদ্ধিমতি কারো সাথে নাচতে গেলে সে হয় অর্ধেকটা সময়ই কাটাবে কীভাবে নাচতে হবে সেটার ইন্সট্রাকশন দিয়ে নয়তো হবে খুবই বাজে ড্যান্সার। তাদের সাথে ক্লাবে গেলে নাচার বদলে টেবিলে বসে শুধু ড্রিংক করাই ভালো।

‘তুমি আসলেই অনেক ভালো নাচো,’ বললাম মেয়েটাকে। ‘তোমার প্রফেশনাল ড্যান্সার হওয়া উচিৎ। আসলেই। আমি আগেও একবার প্রফেশনালের সাথে নেচেছি, তবে তুমি তার থেকে কয়েকগুণ ভালো। কখনো কি মার্কো আর মিরান্ডার নাম শুনেছো?’

‘কী?’ মেয়েটা বলল। সে আসলে আমার কথা শুনছিলই না। পুরো ক্লাব জুড়েই তার চোখ ঘুরঘুর করছিল।

‘আমি বলেছিল কখনো মার্কো আর মিরান্ডার নাম শুনেছো কি না।’

‘জানি না। না। জানি না ঠিক।’

‘ড্যান্সার। সেই ড্যান্সার। যদিও সে খুব একটা হট না। যা যা করা দরকার সবই করে সে, তবে সে খুব একটা হট না। তুমি কি জানো একটা মেয়ে ঠিক কখন চমৎকার ড্যান্সার হয়?’

‘কী?’ বলল মেয়েটা। সে আসলে আমার কোনো কথাই শুনছিল না। তার মন ঘুরছিল পুরো জায়গাটার ওপর।

‘আমি বলেছি তুমি কি জানো একটা মেয়ে ঠিক কখন চমৎকার ড্যান্সার হয়?’

‘না।’

‘দেখো আমার হাতটা এখন তোমার পিঠে। যদি আমি ভাবতে পারি আমার হাতের নিচে কিছু নেই… মানে পায়ের পাতা, পা বা কিছুই নেই…তখনই মেয়েটা চমৎকার ড্যান্সারে পরিণত হয়।’

যদিও মেয়েটা আমার কোনো কথাই শুনছিল না। তাই একটা সময় পর্যন্ত আমিও আর কোনো কথা বললাম না। শুধু ড্যান্স করছিলাম আমরা। আহ, মেয়েটা আসলেই খুব ভালো নাচতে পারতো। বাড়ি সিঙ্গার আর তার ফালতু ব্যান্ডটা তখন ‘জাস্ট ওয়ান অব দোজ থিংস’ বাজাচ্ছিল। তবে তারাও ওই গানটাকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি। গানটা বেশ ভালোই। নাচার সময় কোনো ট্রিক খেলারও চেষ্টা করিনি। নাচার সময় যারা প্রচুর ট্রিক দেখানোর চেষ্টা করে তাদেরকে অপছন্দ করি আমি। তবে ট্রিক না খাটালেও মেয়েটাকে অনেক ঘুরাচ্ছিলাম, আর মেয়েটাও আমার ঘুরানোর সাথে তাল দিচ্ছিল। মজার ব্যাপার হলো, আমি ভাবছিলাম মেয়েটাও আমার স্টাইল উপভোগ করছিল, তারপর হুট করেই মেয়েটা বোকার মতো বলে বসলো, ‘আমি আর আমার বান্ধবীরা কাল রাতে পিটার লরিকে দেখেছি। মুভি অ্যাক্টর পিটার লরি। সেটাও স্বশরীরে। লোকটা তখন নিউজপেপার কিনছিল। খুবই কিউট লোকটা।’

‘তোমার ভাগ্য বেশ ভালো,’ বললাম। ‘আসলেই তোমার ভাগ্য অনেক ভালো। তুমি জানো এটা?’ মেয়েটা আসলেই গবেট ছিল। তবে নাচতো খুবই ভালো। এমনকি নাচার একসময় আমি তার কপালে চুমু দেওয়া থেকে নিজেকে আটকে রাখতে পারিনি। কোন সময়টার কথা বলছি সেটা নিশ্চয় জানেনই আপনার। তবে চুমু দিতেই ক্ষেপে গেল মেয়েটা।

‘হেই! করতে চাচ্ছো কী তুমি?’

‘কিছু না। কিছুই করতে চাচ্ছি না। তুমি আসলেই ভালো নাচো,’ বললাম। ‘আমার একটা ছোটো বোন আছে, ফোর্থ গ্রেডে পড়ে ও। তুমি ঠিক ওর মতোই ভালো। আমার মতে আমার বোনই সবচেয়ে সেরা ড্যান্সার।

‘মুখ সামলে কথা বলো, যদি পারো।’

কী মেয়েরে বাবা! নিজেকে রাণী ভাবে!

‘তোমরা বান্ধবীরা কোন জায়গা থেকে এসেছো?’ জিজ্ঞেস করলাম।

যদিও মেয়েটা কোনো উত্তর দেয়নি আমাকে। মনে হয়, এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবারো পিটার লরির দেখা পাওয়ার আশার ব্যস্ত ছিল ও।

তাই আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা বান্ধবীরা কোথা থেকে এসেছো?’

‘কী?’ সে বলল।

‘তোমরা বান্ধবীরা কোথা থেকে এসেছো? বলার ইচ্ছা না থাকলে উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। তোমাকে বিরক্ত করার কোনো ইচ্ছা নেই আমার।’

‘সিয়াটল, ওয়াশিংটন,’ বলল মেয়েটা। ভাবটা এমন ছিল যেন উত্তর দিয়ে আমার বড়ো উপকার করে ফেলেছে।

‘তুমি খুবই ভালো কনভার্সেশনালিস্ট,’ আমি বললাম। ‘তুমি জানো এটা?’

‘কী?’

কথাটা আর দ্বিতীয়বার বললাম না। বললে সে বুঝতোও না। তাই বললাম, ‘হেই, তারা যদি ফাস্ট কোনো গান বাজায়, তাহলে কি তুমি আমার সাথে জিটারবাগ করতে পারবে? বাজেভাবে মানে লাফানো বা এমন জিটারবাগ না—সাধারণ ও সহজ জিটারবাগ? ফাস্ট গান বাজালে বুড়ো আর মোটকা লোকগুলো ছাড়া সবাইই বসে পড়বে, অনেক জায়গা পাবো আমরা। ওকে?’

‘এটা আমার জন্য অতটা গুরুত্বপূর্ণ না,’ মেয়েটা বলল। ‘আর তোমার বয়স কত আসলে?’

প্রশ্নটায় কেন যেন বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। ‘ওহ, খোদা। এই প্রশ্ন করে মজাটা নষ্ট করে দিয়ো না,’ বললাম। ‘আমার বয়স বারো। বয়সের তুলনায় আমার শরীর বেশি বাড়ন্ত।’

‘শুনো, এটা নিয়ে আগেও একবার বলেছি আমি। তোমার কথাবার্তার ধরণ আমার পছন্দ না,’ মেয়েটা বলল, ‘আর তুমি যদি তারপরও ঐভাবেই কথা বলো, তাহলে তুমি আমার বান্ধবীদের সাথে গিয়ে বসে থাকো।’

সাথে সাথেই কয়েকবার করে স্যরি বললাম। কারণ ব্যান্ড ফাস্ট গান বাজানো শুরু করে দিয়েছিল ততক্ষণে। মেয়েটা আমার সাথে জিটারবাগ করতে শুরু করল। বাজেভাবে না, বরং খুব সুন্দর এবং সুশ্রীভাবে। মেয়েটা আসলেই ভালো ছিল। আমার কাজ ছিল শুধু তাকে স্পর্শ করা। আর যখন সে ঘুরে আমার দিকে ফিরে তার পশ্চাৎভাগটা কাঁপালো… মেয়েটা আমাকে নক-আউট করে দিয়েছিল। আসলেই। নাচ শেষে টেবিলে ফিরে আসতে আসতে আমি প্রায় তার প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলাম। মেয়েরা আসলে এমনই। যখন তারা ভালো কিছু করে—এমনকি মেয়েটা যদি দেখতে খুব ভালো নাও হয় বা তারা যদি স্টুপিডও হয়—তখনই তাদের প্রেমে পড়ে যাওয়া লাগে। এমনকি এরপর আমার অবস্থানটা সেটা নিজেও বুঝতে পারি না। খোদা, মেয়েজাতি। তারা যে কাউকেই পাগল করে দিতে পারে। আসলেই।

অবশ্য মেয়েগুলো আমাকে তাদের টেবিলে বসতে বলার কোনো ভদ্রতা দেখায়নি। সম্ভবত তারা খুব বেশি মুর্খ ছিল বলেই দেখায়নি। যাই হোক আমি নিজে থেকেই তাদের টেবিলে বসলাম। স্বর্ণকেশী যে মেয়েটার সাথে আমি নেচেছিলাম তার নাম বার্নিস ক্র্যাবস না ক্রেবস কী যেন ছিল। আর কুৎসিত দুজনের নাম ছিল মার্টি আর ল্যাভার্ন। আমি তাদেরকে আমার নাম বলেছিলাম জিম স্টিল। মিথ্যা বলার কোনো কারণ ছিল না, তবে আমার মিথ্যা নাম বলতেই ইচ্ছা করছিল তখন। এরপর আমি তাদের সাথে কিছুক্ষণ বুদ্ধিদীপ্ত কোনো বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করলাম, তবে ব্যাপারটা একদম অসম্ভব ছিল। তাদের কারোরই আমার কথার দিকে মনোযোগ ছিল না, মনোযোগ ফেরানোর জন্য বারবার তাদের হাতে টোকা দিতে হচ্ছিল। তাদের তিনজনের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশি স্টুপিড ছিল সেটা বলা খুব কঠিন। তাদের তিনজনের নজরই ছিল ফালতু রুমটার পুরোটা জুড়ে। ভাবটা এমন ছিল যেন তারা আশা করছিল তারা তাকিয়ে থাকলেই একঝাঁক মুভি অ্যাক্টর এসে হাজির হবে রুমে। সম্ভবত তাদের ধারণা ছিল মুভি অ্যাক্টররা নিউইয়র্কে আসলে স্টর্ক ক্লাব বা এল মরোক্কোতে না গিয়ে সবসময় ল্যাভেন্ডার রুমেই সময় কাটাতে আসে। যাই হোক, সিয়াটলে তারা তিনজন কী কাজ করে সেটা জানতে প্রায় আধঘণ্টার মতো লাগলো আমার। তারা তিনজনই একই ইনস্যুরেন্স অফিসে কাজ করে। আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা তাদের কাজকে পছন্দ করে কি না, কিন্তু তিন গর্দভের থেকে কি আর ভালো কোনো উত্তর পাওয়া সম্ভব? আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, কুৎসিত দুইজন মানে মার্টি আর ল্যাভার্ন মনে হয় আসলে বোন, তবে তাদের এটা জিজ্ঞেস করতেই বিরাট অপমানিত হলো তারা। তাদের দুইজনের কারোরই অন্যজনের মতো হওয়ার ইচ্ছা ছিল না, অবশ্য এজন্য তাদের দোষও দেওয়া যায় না। তবে ব্যাপারটা বেশ মজার ছিল।

ঐ রাতে তিনজনের সাথেই নেচেছিলাম আমি। তিনজনের সাথেই আলাদা আলাদা করে। ল্যাভার্ন নামের মেয়েটা খুব একটা খারাপ ড্যান্সার ছিল না। তবে মার্টি, কী আর বলবো ওর কথা। ওর সাথে নাচতে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল যেন ড্যান্স ফ্লোরের ওপর দিয়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি টানছি। এতে আমি আনন্দ পেলাম যদি তাকে এভাবে ফ্লোর ধরে টেনে-হেঁচড়ে নেওয়াটায় বিন্দুমাত্র কোনো মজা থাকত। তাই আমি তাকে বলেছিলাম যে মুভি স্টার গ্যারি কুপার রয়েছে ফ্লোরের ঠিক অন্য পাশেই।

‘কোথায়?’ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো মার্টি। ‘কোথায়?’

‘অহ, একটুর জন্য মিস করেছো। মাত্রই বেরিয়ে গেছে। আমি যখন বললাম তখনই তাকালে না কেন?’

কথাটা শুনেই মার্টি নাচ থামিয়ে রুমের এদিক-ওদিকে তাকানো শুরু করল লোকটাকে দেখার আশায়। ‘ধুর!’ বলল ও। আমি বলতে গেলে তার হৃদয় ভেঙে দিয়েছিলাম ঐদিন। আসলেই দিয়েছিলাম। ওভাবে তার সাথে মজার করার জন্য বেশ খারাপই লাগছিল। কিছু মানুষের সাথে কখনোই ঠাট্টা করা উচিৎ নয়, এমনকি ঐ মানুষটা ঠাট্টার যোগ্য হলেও না।

তবে মজার ব্যাপারটা ঘটেছিল আরেকটু পরে। টেবিলে ফিরে গিয়ে মার্টি অপর দুজনকে বলল যে গ্যারি কুপার কিছুক্ষণ আগেই ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেছে। খোদা, কথাটা শুনে ল্যাভার্ন আর বার্নিসের তো প্রায় লাফিয়ে ওঠার অবস্থা হয়েছিল। প্রচণ্ড উত্তেজিত তারা মার্টির কাছে জানতে চাইলো সে লোকটাকে দেখতে পেয়েছিল কি না। জবাবে মার্টি জানালো সে একঝলক দেখেছে; কথাটা শুনে হাসিতে পেট ফেটে আসছিল আমার তখন।

রাতের জন্য বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল তখন। তাই বার পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি করে আমি তাদের প্রত্যেকের জন্য দুই রাউন্ড ড্রিংক্স এবং আমার জন্য আরো দুটো কোক নিয়ে নিলাম। পুরো টেবিলটাই মদের গ্লাসে ভরেছিল তখন। কুৎসিৎ ল্যাভার্ন তখনো আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করে যাচ্ছিল কারণ আমি কোক খাচ্ছিলাম। বেশ ভালো সেন্স অব হিউমার ছিল তার। সে আর মার্টি শুধু টম কলিন্স ড্রিঙ্ক করছিল। ভাবা যায় এটা? মধ্য ডিসেম্বরে কেউ টম কলিন্স ড্রিংক করে? স্বর্ণকেশি বার্নিস অবশ্য বারবর্ন আর পানি খাচ্ছিল। আসলে লাস্ট রাউন্ড সে ঠিক খাচ্ছিলও না বলা যায়। পুরোটা সময় তারা তিনজনই অনেক চুপচাপ হয়েছিল, এমনকি নিজেদের সাথেও কথা বলছিল না। তাদের মধ্যে মার্টিই একটু বেশি কথা বলছিল। তবে তার কথাবার্তার বিষয়গুলো একদম বস্তাপচা আর বিরক্তিকর ছিল। টয়লেটকে সে বলছিল ‘লিটল গার্লস রুম’ এবং বাড়ি সিঙ্গারের সানাই বাদককে নিয়ে দাঁড়ানো দেখতে খুবই মারাত্মক লাগছিল তার কাছে। সে ঐ লোকের সানাইকে ডাকছিল ‘যষ্টিমধুর কাঠি’ বলে। কুৎসিত অন্যজন, অর্থাৎ ল্যাভার্ন নিজেকে অনেক রসিক ভাবতো। সে বারবারই আমাকে বলছিল আমার বাবাকে যেন ফোন করে জিজ্ঞেস করি বাবা ঐ রাতে কী করছে। বারবারই জিজ্ঞেস করছিল, আমার বাবার কি ঐ রাতে কোনো ডেট ছিল কি না। চারবার আমাকে এটা জিজ্ঞেস করেছিল—আসলেই খুব রসিক ছিল ও। আর স্বর্ণকেশী বার্নিস আসলে তেমন কোনো কথাই বলছিল না। বরং আমি যতবারই তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছি, ততবারই সে উত্তরে বলেছে, ‘কী?’ বারবার এরকম করলে একটা সময় মাথা গরম হওয়াটাই স্বাভাবিক।

হঠাৎ করেই ড্রিংক শেষ করে তিনজনই একসাথে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমাকে বলল তাদের ঘুমানো প্রয়োজন। পরদিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডিও সিটি মিউজিক হলের ফার্স্ট শো ধরতে হবে তাদেরকে। আমি তাদেরকে আরো কিছুটা সময় থাকতে বলেছিলাম, তবে তারা রাজি হয়নি। তাই একসময় বাধ্য হয়েই বিদায় জানাতে হলো তাদের। বিদায়ের সময় তাদেরকে বলেছিলাম যে আমি যদি কখনো সিয়াটলে যাই, তাহলে তাদের সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো। তবে আমার সন্দেহ গেলে কখনো কাজটা করবো কি না। মানে তাদের সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো কি না।

একটা সিগারেট জ্বালিয়ে চেকের জন্য বললাম ওয়েইটারকে। তেরো ডলারের মতো বিল হয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম মেয়েগুলো হয়তো ভদ্রতার খাতিরে আমি আসার আগে তাদের নেওয়া ড্রিঙ্কগুলোর বিল পরিশোধ করার কথাটা অন্তত বলবে। স্বাভাবিকভাবেই আমি তাদেরকে মানা করতাম। তবে তারা কোনো ভদ্রতাই দেখায়নি। এটুক অন্তত দেখানো উচিৎ ছিল। যাই হোক, ব্যাপারটা খুব একটা পাত্তা দেইনি। মেয়েগুলো খুবই উদ্ধত ছিল, আর তাদের মাথায় ছিল আজব ধরনের ফালতু টুপি। আর সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডিও সিটি মিউজিক হলে যাওয়ার কথাটা শুনে খুব হতাশ হয়েছিলাম। আপনারাই ভাবুন, একটা মেয়ে সিয়াটল, ওয়াশিংটন থেকে ফালতু একটা টুপি পরে নিউইয়র্কে এসেছে সকাল সকাল ঘুম থেকে রেডিও সিটি মিউজিক হলের ফার্স্ট শো দেখতে? ব্যাপারটায় খুব হতাশ ছিলাম আমি, এখনো ওটা মানতে পারি না। তারা যদি আমাকে ঐ কথাটা না বলত, তাহলে তাদেরকে একশো ড্রিঙ্ক কিনে দিতেও দ্বিধা করতাম না।

তারা চলে যাওয়ার পরপর আমিও ল্যাভেন্ডার রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। আসলে রুমটারও বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিল তখন। ব্যান্ড চলে গিয়েছিল অনেক আগে। জায়গাটা এমনিতেও খুবই বাজে। যদি সাথে নাচার মতো কেউ থাকে, অথবা ওয়েইটার যদি কোকের বদলে সত্যিকারের ড্রিংক্স দেয়—তাহলে জায়গাটাকে খুব একটা খারাপ লাগবে না। পৃথিবীর কোনো নাইট ক্লাবেই ড্রিংক্স খেয়ে মাতাল না হলে খুব একটা বেশি সময় থাকতে দেয় না। নাহলে বেশি সময় থাকতে চাইলে সাথে অবশ্যই প্রচণ্ড সুন্দরী ও আকর্ষণীয়া মেয়ে বা ডেট থাকা লাগবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *