দ্য ক্যাচার ইন দ্য রাই – ১১

অধ্যায় এগারো

লবিতে ফেরার সময় হুট করে আবারও জেন গ্যালাহারের কথা মনে পড়লো আমার। এমনভাবে মনে পড়েছিল যে কোনোভাবেই তাকে মাথা থেকে নামাতে পারছিলাম না। তাই লবিতে একটা বিশ্রি ধরনের চেয়ারে বসে তার কথা ভেবে নিলাম কিছুক্ষণ। ভাবছিলাম এড ব্যাঙ্কির গাড়িতে স্ট্র্যাডলেটারের সাথে তার ডেটটার কথা। আমি নিশ্চিত ঐদিন স্ট্র্যাডলেটার জেনকে তার সেরা সময়টা দিতে পারেনি। জেনকে আমি হাতের উল্টোপৃষ্ঠের মতো চিনি। তবে কোনোভাবেই ব্যাপারটা মাথা থেকে সরাতে পারছিলাম না। হ্যাঁ, আসলেই আমি জেনকে হাতের উল্টোপৃষ্ঠের মতো চিনি। চেকার্স ছাড়াও সে অ্যাথলেটিক খেলাগুলো খুব পছন্দ করত। তার সাথে পরিচয় হওয়ার পর তার সাথে ঐ গ্রীষ্মের প্রতি সকালেই টেনিস এবং প্রতি বিকালেই গলফ খেলেছি। বেশ অন্তরঙ্গতাও ছিল। এটা বলে আসলে কোনো দৈহিক বা শারীরিক কিছু বুঝাচ্ছি না, তার সাথে আমার ওরকম সম্পর্ক ছিলও না। তবে সবসময়ই একে-অন্যের সাথে দেখা করতাম আমরা। মাঝেমাঝে প্রেম না করেও কোনো মেয়ের সম্পর্কে ভালোভাবে সব জানা যায়। জেনের সাথে আমার সম্পর্কটা ওরকমই ছিল।

আমার সাথে ওর পরিচয় হয়েছিল তার ডোবারম্যান পিনশারের মাধ্যমে। তার ঐ কুকুরটা প্রায়ই আমাদের লনে এসে মলমূত্র ত্যাগ করে যেতো। আর আমার মা এই ব্যাপারটায় খুবই বিরক্ত হতো। এরকম কিছুদিন চলার পর মা জেনের মাকে ডেকে এনে এটা নিয়ে বিশাল ঝগড়া করেছিল। আমার মা এসব ব্যাপারে খুব বড়ো ধরনের ঝগড়া করতে পারে। যাই হোক, এই ঘটনার কয়েকদিন পর একদিন ক্লাবে গিয়ে দেখি জেন সুইমিংপুলের পাশে শুয়ে আছে। তাকে দেখে এগিয়ে ‘হ্যালো’ বললাম। হ্যাঁ, সে আমাদের পাশের বাসাতেই থাকত, তবে ঐদিনের আগে তার সাথে কখনো কোনো কথা হয়নি আমার। অবশ্য আমি হ্যালো বলার পর জেন একদম জমে গিয়েছিল প্রথমে। তাকে শান্ত করার জন্য আমাকে অনেক সময় ধরে বুঝাতে হয়েছিল তার কুকুর কোথায় কী করছে সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র কোনো ভাবনা নেই আমার। এমনকি লিভিংরুমে করলেও সেটা নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। যাই হোক, আলাপচারিতার পর ঐদিন থেকেই জেনের সাথে বন্ধুত্ব শুরু হয়। ঐদিন বিকালেই গলফ খেলেছিলাম আমরা। আমার মনে আছে সে ঐদিন আটটা বল হারিয়েছিল। হ্যাঁ, আটটা বল। প্রতিবারই বল মারার সময় চোখ বন্ধ করে ফেলতো। তার ঐ অভ্যাস দূর করতে যথেষ্ট সময় লেগেছিল আমার। তবে বেশ দ্রুতই খেলাটায় পটু হয়ে উঠেছিল জেন। আমি খুবই ভালো একজন গলফার। আসলেই। আমার জীবনে কী কী ঘটেছে, সেগুলো বলে হয়তো কাউকে বিশ্বাস করানো কঠিন। একবার আমি একটা শর্ট মুভিতে অভিনয়ের জন্য সিলেক্ট হয়েছিলাম, তবে শেষমুহূর্তে না করে দিয়েছিলাম যদিও। মুভি জিনিসটাকে এতো ঘৃণা করার পরও যদি কোনো শর্ট মুভিতে অভিনয় করি, তাহলে তো আমার আর মুভির ধাপ্পাবাজদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এই ভাবনাতেই মানা করে দিয়েছিলাম।

যাই হোক জেন খুবই মজার মেয়ে ছিল। তাকে ঠিক অত্যন্ত সুন্দরী মেয়ে বলবো না। তবে তারপরও তাকে দেখলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। সে কিছুটা বাঁচাল প্রকৃতির ছিল। কোনো কিছু নিয়ে কথা বলার সময় যদি সে উত্তেজিত হয়ে যেত তখন তার মুখ, ঠোঁটগুলো শুধু অনবরত নড়তেই থাকত। ঐ ব্যাপারটাই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো আমার। আর সে কখনো মুখটা পুরোপুরি বন্ধও রাখতো না, সবসময়ই হালকা হাঁ হয়ে থাকত মুখটা—বিশেষ করে গলফ খেলার সময় বা বই পড়ার সময়। সে সবসময়ই বই পড়তো এবং ভালো বইগুলোই পড়তো। প্রচুর কবিতা পড়তো। আমার পরিবারের বাইরে একমাত্র তাকেই আমি এলির বেসবল গ্লাভসে লেখা থাকা কবিতাগুলো দেখিয়েছিলাম। এলিকে জেন কখনো দেখেনি। কারণ মেইনে ওটাই ছিল তার প্রথম গ্রীষ্মকাল—এর আগে সে ছিল ক্যাপ কডে। তবে তাকে এলির ব্যাপারে অনেক কিছু বলেছি আমি। সেও এই ব্যাপারটায় বেশ আগ্রহী ছিল।

তবে আমার মা জেনকে খুব একটা পছন্দ করত না। জেন আর জেনের মায়ের সাথে প্রায়ই গ্রামে দেখা হতো মায়ের। তার মায়ের সাথে গ্রামের বাজারটায় প্রায়ই যেত জেন। আমার মা মনে করত তারা তাকে এড়িয়ে চলছে, কারণ মাঝেমধ্যে তারা মাকে দেখলে হ্যালো-ট্যালো কিছু বলত না। এমনকি আমার মা তো জেনকে সুন্দরও মনে করত না। যদিও আমি মনে করতাম। জেনের চাহুনিটা খুবই পছন্দ করতাম আমি।

এক বিকালের কথা মনে আছে আমার। ঐ একবারই জেন আর আমি প্রায় একজন-আরেকজনকে চুমু খাওয়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিলাম। দিনটা ছিল শনিবার, বৃষ্টি পড়ছিল প্রচণ্ড। আমি তাদের বাসার বারান্দায় বসে জেনের সাথে চেকার্স খেলছিলাম। তাদের বাসার বারান্দাটা বেশ বড়ো ছিল। যাই হোক, চেকার্সে জেন কখনোই তার রাজাগুলোকে পিছনের সারি থেকে সরাতো না। এটা নিয়ে প্রায়ই মজা করতাম আমি তার সাথে। তবে তাকে নিয়ে কোনো ঠাট্টা করতাম না। জেনকে নিয়ে কখনোই বেশি পরিমাণ ঠাট্টা করা উচিৎ না। আমি মনে করি একটা মেয়ের সাথে তখনই ঠাট্টা করা উচিৎ যখন ওরকম সুযোগটা আসে, তবে এই ব্যাপারটা কিন্তু বেশ মজার। আমি যেসব মেয়েকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, তাদের নিয়ে কখনো ঠাট্টা করার মুড পাই না। মাঝেমধ্যেই ভাবি ঠাট্টা করলে তারা হয়তো এটা পছন্দই করবে—সত্যি বলতে আমি জানি তারা পছন্দ করবে, কিন্তু লম্বা সময় ধরে চেনা পরিচিত এবং যাদের সাথে আগে কখনোই ঠাট্টা করিইনি—তাদের সাথে এমন কিছু শুরু করাই বেশ কঠিন যাই হোক, ঐ বিকালের ব্যাপারটা বলছিলাম। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল ঐদিন, আর আমরা বারান্দায় বসেছিলাম। হঠাৎই জেনের মায়ের বিয়ে করা মাতাল লোকটা বারান্দায় এসে জেনকে জিজ্ঞেস করল বাসায় কোনো সিগারেট আছে কি না। আমি লোকটাকে খুব একটা ভালোভাবে চিনতাম না, তবে লোকটাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল যে সে এমন প্রকৃতির মানুষ যে নিজের প্রয়োজন না হলে কারো সাথে কথা বলবে না। যাই হোক, জেন ঐ মাতাল লোকের প্রশ্নের কোনো জবাব দেয়নি। এমনকি গেমের ওপর থেকেও চোখ সরায়নি। এরপর একসময় লোকটা কোনো উত্তর না পেয়ে বাসার ভেতরে চলে গেল। লোকটা চলে যেতেই আমি জেনকে জিজ্ঞেস করলাম যে বাসায় কোনো সমস্যা চলছে কি না। জেন আসলে আমাকেও তখন কোনো জবাব দেয়নি। সে এমন ভাব করছিল যেন মনে হচ্ছিল তার সমস্ত মনোযোগ তখন গেমের নেক্সট মুভ নিয়ে। তারপর হঠাৎ করেই তার চোখ থেকে অশ্রুর ফোঁটা পড়লো চেকারবোর্ডের ওপর। লাল একটা সৈন্যের ওপর পড়েছিল ফোঁটা। আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম অশ্রু কণা। জেন কিছু না বলে আঙুলের মাথা দিয়ে অশ্রুটা মুছে নিলো বোর্ডের ওপর থেকে। জানি না কেন, তবে ব্যাপারটা আমাকে বেশ বিরক্ত করছিল। তাই তখন উঠে গিয়ে নিজেই তার মুভটা স্থাপন করলাম বোর্ডে, তারপর বসলাম তার পাশে। সত্যি বলতে প্রায় তার কোলেই বসে পড়েছিলাম। আমি বসতেই ধীরে ধীরে কাঁদতে শুরু করল জেন, আর এরপর আমার যেটা মনে আছে আমি তার মুখের পুরোটা জুড়েই শুধু চুমু খাচ্ছিলাম। তার চোখ, নাক, কপাল, চোখের ভ্রু, কানের লতি— ঠোঁট বাদে মুখের পুরোটা জুড়েই। সে-ই আসলে কেন যেন তার ঠোঁটে চুমু লাগাতে দিচ্ছিল না। যাই হোক, তাকে চুমু খাওয়ার সর্বোচ্চ কাছাকাছি আমি ঐবারই পৌঁছেছিলাম। এর বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়িয়ে তার লাল-সাদা সোয়েটারটা পরে আমাকে বলল আমি তার সাথে কোনো মুভি-টুভি দেখতে যেতে পারবো কি না। মানা করিনি। মুভিতে যাওয়ার পথে তাকে জিজ্ঞেস করলাম মি. কাধি—ঐ মাতালের নাম এটাই ছিল—কি কখনো তার সাথে বাজে কিছু করার চেষ্টা করেছে কি না। জেনের যদিও বয়স কম ছিল, তবে তার শরীরটা প্রচণ্ড আকর্ষণীয়। আর তাছাড়া কাধি লোকটা খুবই হারামজাদা প্রকৃতির। যাই হোক, উত্তরে জেন তখন না বলেছিল আমাকে। আরো কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও তার থেকে কিছু জানতে পারিনি। কিছু কিছু মেয়েদের থেকে আসলে কোনোভাবেই কোনো কিছু বের করা সম্ভব হয় না।

আমি আসলে এটা বুঝাতে চাচ্ছি না যে জেন খুবই জেদী মেয়ে বা তার সাথে আমি খুব একটা প্রেমময় সম্পর্কে জড়াইনি বলে সে কিছু বলছে না। জেন আসলে এমন মেয়েই ছিল না। যেমন—আমি প্রায় সময়ই তার হাতে হাত ধরে থাকতাম। আমি জানি এটাকে আসলে খুব একটা বেশি কিছু মনে হচ্ছে না, তবে তার হাতগুলো ছিল ধরার জন্য একদম পারফেক্ট। বেশির ভাগ মেয়েই হাতে হাত ধরলে মনে হয় যে তাদের হাতের আকর্ষণ কমে গেছে অথবা তারা ভাবে হাতে হাত ধরা অবস্থায় পুরোটা সময় তাদের হাত নাড়ানো লাগবে যেন তারা ভয় পাচ্ছে তারা আমাকে বিরক্ত করছে বা এমন কিছু। কিন্তু জেন অন্যরকম ছিল। আমরা প্রায়ই মুভি বা এমন কিছুতে যেতাম এবং তখন যদি আমরা হাত ধরতাম তাহলে মুভি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত হাত ছাড়তেই পারতাম না। এমনকি পুরোটা সময় আমার হাতের অবস্থানও পরিবর্তন করি না বা ওটাকে খুব বড়ো কিছু ভাবি না। জেনের সাথে থাকলে কখনো উদ্বেগ ব্যাপারটা কোনো সমস্যা করে না, এমনকি হাত ঘেমে থাকলেও না। পুরোটা সময়ই মনে হয় যে আমি সুখে আছি। আসলেই সুখের একটা অনুভূতি হতো শুধু তখন

আরেকটা ব্যাপার আমার মাত্র মনে পড়েছে। একবার একটা মুভি দেখার সময় জেন এমন একটা কাজ করেছিল যাতে আমি পুরোই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম প্রায়। নিউজরিলটা তখন অন ছিল এবং হঠাৎই তখন ঘাড়ে একটা হাতের ছোঁয়া অনুভব করলাম। হাতটা ছিল জেনের। ব্যাপারটা বেশ হাস্যকর ছিল। মানে তার তখন বয়স বেশ কম, আর যেসব মেয়ে তাদের হাত অন্য কারো ঘাড়ে জড়িয়ে রাখে তাদের বেশির ভাগের বয়সই থাকে পঁচিশ বা ত্রিশের মতো, অথবা তাদের স্বামীকে ধরে রাখে বা তাদের বাচ্চাকে। আমিও আমার ছোটো বোন ফিবিকে এভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখি। কিন্তু কম বয়স্কা একটা মেয়ে যদি এই কাজটা করে, তখন সেটা খুবই ভালো একটা অনুভূতি দেয়, প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ায়।

যাই হোক, বাজে চেহারার চেয়ারটায় বসার সময় এটাই ভাবছিলাম। জেনকে নিয়ে ভাবছিলাম। যতবারই এড ব্যাঙ্কির গাড়িতে স্ট্র্যাডলেটারের সাথে তার ডেটের ব্যাপারটা মাথায় আসছিল, ততবারই মাথা নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল আমার। আমি জানতাম জেন স্ট্র্যাডলেটারকে চুমু খেতে দেবে না, তবুও ব্যাপারটাকে আমাকে খুব অস্বস্তি দিচ্ছিল। যদি সত্যি বলি, আমার আসলে এখন এটা নিয়ে কথা বলতেও খুব একটা স্বস্তি লাগছে না।

লবিতে তখন খুব একটা মানুষজন ছিল না। এমনকি পতিতাদের মতো দেখতে স্বর্ণকেশী মেয়েগুলোকেও আর দেখা যাচ্ছিল না। ঠিক তখন হঠাৎই মনে পড়লো যে আমার ঐ জায়গাটা থেকে চলে যাওয়া উচিৎ। জায়গাটা খুবই বিষণ্ন প্রকৃতির। আর তখন আমি খুব একটা ক্লান্তও ছিলাম না। তাই রুমে ফিরে গিয়ে কোটটা পরে নিলাম। সেই সাথে জানালা দিয়েও একবার তাকিয়ে দেখলাম আগের সেই কাজকারবারগুলো এখনো চলছে কি না। ঐ রুমের লাইট বন্ধ ছিল তখন। এলিভেটর দিয়ে নেমে একটা ক্যাব ডেকে ড্রাইভারকে বললাম আমাকে আর্নি’জে নিয়ে যেতে। আর্নি’জ গ্রিনউইচ ভিলেজের একটা নাইট ক্লাব। হলিউডে গিয়ে পতিতা হওয়ার আগে আমার ভাই ডি.বি. প্রায়ই যেত সেখানে। মাঝেমধ্যে সে আমাকেও নিয়ে যেত। আর্নি নামের মোটাসোটা লোক পিয়ানো বাজাতো। লোকটা মারাত্মক রকমের উন্মাসিক প্রকৃতির ছিল। সেলেব্রেটি বা হোমড়া-চোমড়া শ্রেণির কেউ না হলে লোকটা কারো সাথে কোনো কথা বলত না। তবে পিয়ানো খুবই ভালো বাজাতো। সত্যিই বলছি, আসলেই ভালো পিয়ানো বাজাতে পারতো। আমার মনেহয় এটার কারণ যখন লোকটা পিয়ানো বাজাতো তখন তার সুর শুনেই বুঝা যেতো যে লোকটা এমন একজন যে হোমড়া-চোমড়া ছাড়া কারো সাথেই কোনো কথা বলে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *