1 of 2

৩৭. রাতে খেতে বলব ভাবছি

কিছু লোককে আগামী শুক্রবার রাতে খেতে বলব ভাবছি। বুঝেছ?

রুষা বলল।

গেস্ট-লিস্টটাও ফাইন্যাল করছি। সব সুষ্ঠু তিরিশজন মতো হবে। চোদ্দটি কাপলস। একজন ব্যাচেলর, একজন স্পিনটার।।

পৃথুর মনটা ভাল ছিল না। অন্যমনস্ক ভাবে বলল, শুক্রবার? শুক্রবার কি? আমাদের বিয়ের তারিখ নাকি?

পৃথু প্রশ্ন করল।

পৃথুর ঘরে লেখার টেবিলে, সামনে প্যাড রেখে বসেছিল রুষা। ভুরু তুলে, পেনসিলটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে, তির্যক চোখে পৃথুর দিকে চেয়ে বলল, না। আমাদের ইমপসিবল বিয়েটা, পসিবলি হয়েছিল মার্চ মাসের চার তারিখে।

মার্চ মাসে? তো গতবছর করলে না অ্যানিভার্সারী?

অ্যাকসিডেন্টের অ্যানিভার্সারী করে না কেউই।

তা ঠিক। পৃথু বলল।

আমাদের তো বিয়ে হয়নি।

বলো কী?

বিয়ে যাকে বলে তা হয়নি। বিয়ে ব্যাপারটা একটা টোটাল ইভভমেন্ট-এর ব্যাপার। গভীর ব্যাপার। তোমার বোঝাবুঝির বাইরে।

পৃথু বলল, বুঝব না কেন? বিয়ে মানে একটা টাই-আপ। ইডিয়টিক বন্ধন, ঝুড়ি বোঝাই মিথ্যে কথা। তোমার জীবন আমার হোক আমার জীবন তোমার হোক, আমাদের মিলিত জীবন ঈশ্বরের হোক। অর্থাৎ, বুলশীট। বিয়ে মানে, কতগুলো মস্তিষ্কহীন, মেকানিকাল, মানডেন, বেজ, নেইভ, অন্ধ মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আমেরিকা-রাশিয়ার ডিস-আর্মামেন্ট সামিট-এরই মতো ভণ্ডামির পরাকাষ্ঠা।।

পরাকাষ্ঠা মানে কী? এত কঠিন কঠিন বাংলা আমি বুঝি না।

যে বাঙালি নিজের মাতৃভাষা জানে না ভাল করে, তাকে ধিক।

কী করব? খেতে বলব তো? বলো?

হঠাৎ? আমাকে এ প্রশ্ন? আমি কে? কখনও তো আগে…

তোমার কোন বন্ধুবান্ধবকে বলবে না?

আমার যারা বন্ধু তারা কী তোমার বন্ধুদের সঙ্গে একাসনে বসার যোগ্য?

তা ঠিক, তবে সবাইকে বোলো না। জুতোর দোকানি-ফোকানিকে তো আর বলা যায় না, মোটর মেকানিককেও বলা যায় না, ক্রীম অফ দ্যা টাউনকে বলছি আমি; তার চেয়ে শুধু গিরিশদাকেই বলে দাও। মার্জিনালী প্রেজেন্টবল। যদিও ভীষণ বোকা বোকা।

না। বললে সকলকেই বলব, নইলে কাউকেই। কবে আর বলেছি কাকে? ওদের বাদই দাও।

কাকে কাকে বলতে চাও তুমি?

রুষা বলল। বললে, লাড়ু, ভুচু, ঠুঠা বাইগা, সাবীর মিঞা, শামীম মিঞা, দিগা পাঁড়ে। দিগার সঙ্গে আবার এক তান্ত্রিক জুটেছে এসে। বাঙালি। জয়নগর মজিলপুরের। সকলকেই বলতে হয়।

তান্ত্রিক? মাগো। ওরা তো আবার সম্মোহন-টম্মোহন জানে।

জানেই তো। তা ছাড়া সেদিন যোনিতন্ত্রম-এর দ্বিতীয় পটল থেকে একখানি যা শ্লোক ঝেড়েছিল তা শুনে তো আমারই পটল তোলার জোগাড়।

যোনিতন্ত্ৰম? সেটা কী? না না ওসব নোরা, ভালগার লোককে কোনও রেসপেকটেবল লোকের বাড়িতে ডাকা যায়? তান্ত্রিকদের দেখলেই আমার গা গোলায়।

খুব ইন্টারেস্টিং মানুষ কিন্তু। মনের দরজাটা সব সময় বন্ধ করে রাখলে তাতে আলো-হাওয়া ঢুকবে কী করে? মিশতে হয় সকলের সঙ্গেই।

তোমার মত নিয়ে তুমি থাকো। নাও আমার লিস্ট হয়ে গেছে।

আমি কী করব নিয়ে? কাউকেই বলব না আমি।

সেদিন বাড়িতে থাকবে তো অন্তত?

এত আগে তাও বলতে পারি না। যা ভাল না-লাগে, তা আমি করি না। সেদিন ভাল লাগবে বা লাগবে এত আগে থেকে কী করে বলব? সম্ভব নয় বলা। কিন্তু তোমার পার্টির অকেশনটা কী?

ইদুরের বার্থডে।

ইদুরদেরও বার্থডে হয় বুঝি? ভাবল, পৃথু।।

সকলকেই বলতে পারো তুমি, এক কুর্চি ছাড়া। আই হেইট দ্যাট কমোনার অ্যাম্বিশাস স্টুপিড গার্ল।

রুষা বলল।

অ্যাম্বিশান সব মানুষেরই থাকতে পারে। সেটা দোষের নয়। থাকেও।

কেন? তোমার তো নেই? তোমার জীবনে কী আছে? বড় হবার ইচ্ছা? ফুঃ। না একটা বাড়ি করলে, না করলে পার্সোনাল গাড়ি, কী করলে কী তুমি জীবনে? না বানিয়ে দিলে আমাকে ভাল কোনও গয়না। মেয়েটার বিয়ের সময় যে কী করব। তুমি তো টোটালী অ্যাম্বিশানলেস। বড় হবার কোনও ইচ্ছেই নেই তোমার।

না। তা না। আমারও আছে অ্যাম্বিশন। তবে সেটা টাকা, বাড়ি, গাড়ি নয়; গয়না নয়, বউ-মেয়ের। তাছাড়া তোমরা যাকে বড় হওয়া বল, সেই বড় হওয়ার আর আমার বড় হওয়াতে তফাৎ আছে।

বাজে কথা রাখো। সংসারে অচল, অপদার্থ তুমি। তুমি একটি ভূতনাথ। বাউন্ডুলে।

বলেই রুষ উঠল।

বলল, আসছি এখুনি ঘুরে। অনেক ন্যাকামি হয়েছে। কুর্চিরা ছাড়া আর কাদের বলতে চাও তার লিস্ট করে ফেলল। ইদুরের বার্থডের কথা তো আর বলছি না কাউকে। ডাকছি, এই-ই…। মণি চাকলাদারকেও বলছি। স্পার্কলিং কনভার্সেসানালিস্ট।

রুষা চলে গেল ঘর থেকে।

কী বলে গেল রুষা? ভূতনাথ? বাঃ। ও না জেনে ঠিকই বলেছে। একেবারে পারফেক্ট অ্যানালিসিস।

“তুমি কী করছ ভূতনাথ? লিখছ টিখছ?
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, সত্যিই শুভাশিস, আমি গাড়ি কিনতে পারিনি, না করেছি বাড়ি
জননেতা কোন দুর, জনতার দৈত্যের হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছি।
কলকাতা থেকে কিছু দূরে আধা পাড়াগাঁয়ে, রাত ভোর হলে কলাগাছের পাতায় শিশির ঝরা
দেখি, ওতেই শিহরণ খেলে যায়।
সেই কবে এক রুগণ কবিতার নারীর সঙ্গে বিয়ে হয়ে অবধি খরচের আর শেষ নেই, রাত্রে গিয়ে
ঠায় বসে থাকি তারার বাগানে।

গুড়গুড় করে মেঘ ডেকে উঠলে বুকের মধ্যে হই হই করে শুনি ভাস্কোদাগামার পালতোলা জাহাজের কামানগর্জন। বিদ্যুৎ চমকালে দেখি শেক্সপীয়রের নাটকের বীভৎস বুড়ি ডাইনিদের চুল হেঁছেড়ি। লম্বা লম্বা নখের বাহার। ঘরে বসে জানি না আকাশকে কেন দেখি ভূমধ্যসাগর। এক একদিন মাঘী পূর্ণিমায় দেখি সাদা ফেনায়িত প্রকাণ্ড আকাশব্যাপী রাজহাঁস। ফেলে যায় নিটোল টলটলে সোনার ডিম।

শুভাশিস, গাড়ি কিনতে পারনি, করতে পারিনি বাড়ি,জননেতা হওয়া অসম্ভব। শুধু ছোট ছোট কল্পনার লাল ইট গাঁথি।

আর চুরমার করি, কিছুই হওয়া হয়নি। ট্রেনে করে আসি আর যাই।

রুগণ কবিতার-নারীর চিকিৎসায় আমি ফতুর হয়ে গেলাম। হয়তো জীবনই চলে যাবে…

তোমরা বেশ আছ! শুভাশিস, সুনন্দ, আশুতোষ… আমি এই।”

আমি এই। সুনীল বসুর কবিতা। এই কবিকে কখনও দেখেনি পৃথু। এদিকেও আসেননি কখনও। ছবিও দেখেনি কোথাওই। পৃথুর মনে হয়, ইনি একজন বড় মাপের কবি। জাতকবি।

ডিসেম্বরের শেষ এসে গেল। কুর্চির সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া হল না। কখন বসন্ত গেল, এবার হল না গান। পরশু বড়দিন। ভুচু নেমন্তন্ন করেছে কাল সকলকে তার বাড়িতে বড়দিনের খানায়। রাতে।

কুর্চির বাড়িতে ওকে ওই রহস্যজনক একাকিত্বর মধ্যে ফেলে রেখে আসার পর নিজে যেতে পারেনি নানা ঝামেলায়। কিন্তু ঠুঠাকে পাঠিয়েছিল। ঠুঠা এসে যা বলেছে তাতে মন ভেঙে গেছে পৃথুর। রায়নার বাজারের সকলেই নাকি জানে যে গাঁজা ও আফিং-এর চোরাচালানের ব্যবসাতে জড়িয়ে পড়েছিল ভাঁটু কয়েক মাস হল। নিজের একটি দলও গড়ে তুলেছিল।

যেদিন পৃথু গিয়ে হাজির হয় কুর্চির বাড়িতে না জেনে শুনে, তার দুদিন আগে ভাঁটুকে অ্যারেস্ট করে পুলিশ রায়পুরে নিয়ে গেছিল জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে। কেউ বলছে, রায়পুরে, কেউ বলছে। জবলপুরে, কেউ বা বলছে ভোপালে। দাঈ চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছিল তার পরদিন কোনও ব্যক্তিগত কারণে।

কুর্চি সেদিন মিথ্যা কথা বলেছিল পৃথুকে।

কুর্চি নিজেও বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে ঠুঠা যেদিন গেছিল তার আগের দিনই। লোকে বলছে, শুধু ছোট্ট একটি স্যুটকেস এবং কম্বল দিয়ে জড়ানো একটি বালিশ সঙ্গে নিয়ে তাকে বাসে উঠতে দেখেছে অনেকেই। মালাঞ্জখণ্ড-এর বাসে। পৃথু যেদিন রায়নাতে গেছিল সেদিনের আগের দিন কুর্চি নাকি নিজে হেঁটে বাজারে এসে খাবারের দোকান থেকে খাবার কিনে দোকানে বসেই খেয়েছে। হাতরুটি আর আলুর তরকারি। ছোট্ট জায়গা। বাঙালিবাবুর বউরা এরকম বে-আব্রু হয়ে বাজারের দোকানে রুটি তরকারি খেতে আসে না কখনও। এ নিয়ে কথা চালাচালি এবং হাসাহাসিও হয়েছে। মুনাব্বর বলে একটি পানের দোকানদার নাকি কুর্চিকে কী সব খারাপ কথাও বলেছে। ঠুঠা বাইগা নিজেও নিজের কানে মুনাব্বরের দোকানে বসা ইয়ারদের কাছ থেকে শুনে এসেছে তা। মুনাব্বর নাকি কুর্চিকে বলেছিল : রোজ রুটি তরকারি খাওয়াবে, বদলে কুর্চি যদি কুর্চিকে খেতে দেয়। মুনাব্বরকে।

ঠুঠা বলেছিল, তক্ষুনি আমি ওর দাঁত উপড়ে নিয়ে আসতাম জাননা, কিন্তু মেয়েছেলের ঈজ্জৎ হচ্ছে খুব ভাল জাতের আমেরই মতো নাজুক। বড় সাবধানে নাড়তে চাড়তে হয়। জোর করে তা বাঁচাতে গেলে তাতে দাগই ধরে যায়। কলঙ্ক তাতে বাড়েই। আঙুলের সামান্য বেকায়দার ছোঁওয়াতেই কালশিরা পড়ে যায় ইজ্জতে। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে ঠুঠা ওখানেই হামলা না করে ফিরে এসেছে। পৃথুকে বলেছে কী শেখাতে হবে বলে? শিখিয়ে আসছি।

মালাঞ্জখণ্ড-এ গেলে, কোথায় যেতে পারে কুর্চি? ভাবছিল পৃথু। তার অবস্থাপন্ন, সুখী বিবাহিত বন্ধুর বাড়ি নিশ্চয়ই গিয়ে উঠবে না। তাকে বলবেও না যে, তার স্বামী স্মাগলার অথবা সে এখন পুলিসের হেপাজতে। কুর্চিকে যতটুকু জানে পৃথু, তাতে মনে হয় যে, ও কিছুতেই সেখানে যাবে না।

কিন্তু যাবেই বা কোথায় তাহলে? কী করে খুঁজে পাবে পৃথু তার কুর্চিকে? কুর্চি কি হারিয়েই গেল জীবনেরই মতো? তাহলে, কী নিয়ে আর বাঁচবে পৃথু? জীবনে আনন্দ, সত্যিকারের গভীর আনন্দ বলতে তো কুর্চি ছাড়া আর কেউই নেই; কিছুই নেই।

অনেক ভেবেটেবে শেষে বুদ্ধি খাটিয়ে কুর্চির বন্ধু রিমার স্বামী মহেন্দ্রর কাছে একজন লোকও পাঠিয়েছিল মালাঞ্জখণ্ড-এ পৃথু। কারখানার তার এক শিফট ইনচার্জকে একদিনের ছুটি দিয়ে এই ব্যক্তিগত কাজের জন্যে পাঠিয়েছিল। জানত কাজটা অন্যায়। কিন্তু নিরুপায় হয়েই পাঠিয়েছিল। ন্যায় করতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু কমই করা হয়ে ওঠে। মহেন্দ্রর নামে একটি চিঠি দিয়েছিল শুধু এই কথা জানতে চেয়ে যে, ভাঁটু আর কুর্চি জবলপুর, ভোপাল, ভীমবৈঠকা ইত্যাদি জায়গায় ইতিমধ্যেই চলে গেছে কি না! মিথ্যে কথা লিখেছিল, লিখেছিল যে, পৃথু ভোপালে এসেছে কাজে তাই-ই খবরটা জানতে পারলে, ভোপালেই দু-একদিন বেশি থেকে যাবে। কুর্চিরা কোথায় উঠবে তা ওরা পৃথুকে আগেই জানিয়েছিল।

উত্তরে মহেন্দ্র সংক্ষিপ্ত চিঠি দিয়েছিল। শিফট-ইনচার্জ-এর হাতে। ডিয়ার পিরথুদা,

উই হ্যাভ নো ইনফরমেশান অ্যাবাউট দেম। হ্যাভনট সীন দেম সিন্স এইজেস। তারপর লিখেছিল,

ইটস স্ট্রিক্টলী ফর ইওর কনফিডেন্স : আ স্ট্রং রিউমার ইজ আফুট হিয়ার দ্যাট ভাঁটু অ্যান্ড হিজ অ্যামপ্লিসেস হ্যাভ বীন অ্যারেস্টেড ফর স্মাগলিং। সাম ওয়্যার অ্যারেস্টেড ফ্রম হিয়ার অ্যাজ ওয়েল। ইটস আ শেম। অ্যান্ড সো ফার রিমা অ্যান্ড মাইসেলফ আর কনসার্নড়, উই নোলঙ্গার কনসিডার দ্যা কাপল অ্যাজ ফ্রেন্ডস। আফটার ওল, উই আর রেসপেকটেবল পীপল। রিমা ইজ ভেরী স্যাড ফর কুর্চি, নো ডাউট, বাট সার্টেন ডিসিসানস হ্যাভ টু বী টেকন ইন লাইফ, হুইচ আর আন-অ্যাভয়েডেবল হাওয়েভার সরী ওয়ান মে ফীল টু টেক দ্যাট। উই কুডনট কেয়ার লেস।

রিগার্ডস।

সী য়ু সামটাইম। ডোন্ট ফরগেট টু লুক আস আপ ইফ য়ু আর ইন দিস পার্ট অফ দ্যা ওয়ার্লড।

টুলী ইয়োরস, মহেন্দ্র সিং।

“আফটার ওল উই আর রেসেপেক্টেবেল পীপল”। কথাটা বার বারই কানে বাজছে পৃথুর সেই থেকে।

আর উই রিয়্যালী? বার বার এই প্রশ্নটা করেছে পৃথু নিজেকে।

রেসপেকটেবলিটি একটা মীথ। ফাঁকা আওয়াজ। ভাঁটুও তো রেসপেকটেবলই ছিল, যতদিন ধরা পড়েনি। ধরা না পড়লে, তার অবস্থা দিনে দিনে রমরমে হয়ে উঠলে এই সমাজই তাকে সম্ভ্রান্ততার কনফার্মড় শিরোপা দিত। ইদুরকারের মতো ইমম্যাটেরিয়াল ম্যানেজার শর্মার মতো; পৃথুরও মততা। পৃথু যে বাজারের বাইজীর কাছে গেছিল, রাত কাটিয়েছিল; এ কথা জানলে এই সমাজ তাকে একঘরে করে বলবে ছিঃ ছিঃ ক্যারাকটারলেস। বলবে হী ইজ নট রেসপেকটেবল। “ক্যারেকটার” কথাটার মানে জানে কজন মানুষ?

পৃথু ভাবে, বরং রেসপেকটেবল হচ্ছে ভুচু, দিগা পাড়ে, ঠুঠা বাইগা, রেসপেকটেবল তার কারখানার শ্রমিক গুগ্‌গা আর তার বউ ইতোয়ারিন। রেসপেকটেবল তাদের কারখানার সামনে গত কুড়ি বছর ধরে দিনে রাতে বারো ঘণ্টা পিঠ নুইয়ে বসে কাজ করে কোনওরকমে বেঁচে থাকা অতি-সজ্জন মুচি মহেন্দ্রর। দারিদ্র্য তার অসীম, কিন্তু সে আত্মসম্মানজ্ঞানী লোক। প্রকৃতই সমানের যোগ্য। সম্মানের রঙচঙে জামা চাদর চড়া হারে ভাড়া করে নিয়ে নিজেকে সাজিয়ে সম্মানিত হয়নি এসব মানুষ। রেসপেকটিবিলিটি মিথ্যে অহং। এ জাতের, এ দেশের আত্মসম্মানজ্ঞানই যদি থাকত তবে তার এমন অবস্থা হয়?

কুর্চিকে খুঁজে বার করতেই হবে। এবার থেকে ঠুঠা বাইগার সঙ্গে আর কোনও তফাৎ বোধহয় থাকবে না পৃথুর। যা হারিয়ে গেছে নিশ্চিহ্ন হয়ে, সেই মূলকে, সেই গভীরকে সত্তার সেই গাঢ় অস্তিত্বকে বুনো শুয়োরের মতোই পৃথিবীর সব মাটি উপড়ে ছিটকে ছুঁড়ে-খুঁড়ে খুঁজে বেড়াতে হবে বাকি জীবন। ঠুঠা খুঁজছে তার অতীতকে, পৃথু খুঁজবে তার ভবিষ্যৎকে। এইটুকুই তফাৎ।

কী যে করবে পৃথু। হতভাগা কী যে করবে।

যখন ওর মনের অবস্থা এমন ঠিক সেই সময়েই অন্য আরেক বিপত্তি। কাল লালসাহেব ফোনে খবর দিয়েছেন যে, মগনলাল তার দল নিয়ে হাটচান্দ্রার কাছাকাছিই ফিরে এসেছে। রেড এলার্ট, মীজা গালীব। এলার্ট। চেষ্টা করতে হবে, মগনলালের দলকে এইবারে একেবারে ওয়াইপ আউট করে দিতে। প্রেসিডেন্টস মেডালস অপেক্ষা করবে আপনাদের জন্যে। প্রথম সিভিলিয়ানস হবেন আপনারা যারা মধ্যপ্রদেশের ডাকাতির ইতিহাসে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবেন।

ভুচু সকালে এসেছিল। সব খবর দিয়ে গেল। ও বলছিল যে, মৌলভী গিয়াসুদ্দিন ক্রীসমাস ইভ-এর জন্যে চারটে বড় মোরগা কাল মেরে দেবেন ভুচুকে। অগ্রিম বলে গেছেন, এখানে তো টার্কি পাওয়া যায় না। সাহেবরা থাকতে ক্রীসমাসের আগে জবলপুর থেকে একজন মুসলমান। পাখি-ওয়ালা নিয়ে আসত। আজকাল বড়দিনে টার্কি খাওয়ার লোকও কমে গেছে। মৌলভী বিকেল চারটে নাগাদ বেরিয়ে মোরগা মেরে মোরগা মুসল্লম বানিয়ে নিয়ে আসবেন রাত নটার মধ্যে। বুনো মোরগ মারার পর হয় বানিয়ে রাখতে হয় নয় সেদ্ধ করে নিতে হয় রান্নার আগে। ঝকমারি। আছে।

ভুচুর মেকানিক এবং প্রয়োজনে তবলা বাদক হুদা সাতসকালে গিয়ে নর্মদা থেকে ছাইরঙা রাজহাঁস মেরে নিয়ে এসেছিল একটা। আজই। কাল তার বারবী-কিউ হবে। লোক কম বলেনি ভুচু। পৃথু ছাড়াও, সাবীর সাহেব, গিরিশদা, মৌলভী গিয়াসুদ্দিন, লাড্ডু আর ঠুঠা বাইগা। পামেলা এবং পামেলার মাও আসবেন। তবে ওঁরা তাড়াতাড়ি চলে যাবেন। গীর্জেতে মাস আছে। পৃথু বলেছে, পৌঁছে দিয়ে আসবে ওঁদের জীপে করে। ভুচু আজ আসলে রুষাকে নেমন্তন্ন করতেই এসেছিল। রুষা বলেছিল তোমার দাদাই যাবে। আমার বাড়িতে ছেলে মেয়েদের বন্ধুদের বলেছি। ওরা সব আসবে মজা করবে। আমাকে বাদ দিয়ে দিন। ক্রীসমাস ট্রী সাজাতে হবে। ফাদার ক্রিসমাস। প্রেজেন্টস সব প্যাক করতে হবে। বাড়িতে মেরী আছে। ওরও তো ক্রীসমাস।

ভুচু আর কিছু বলেনি।

রুষা ফিরে এল। বসল, পৃথুর লেখার চেয়ার টেনে। পৃথু খাটে বসেছিল, বালিশে হেলান দিয়ে।

পামেলা আর তার মাকে যখন নিয়ে যাব ওদের চার্চে তখন মেরীকেও নিয়ে যাব।

পৃথু বলল। মেরী খুব খুশি হবে। রুষা বলল, নিয়ে যাবে তো যেও কিন্তু ফেরার সময় তো অতখানি পথ একা আসবে মেরীকে নিয়ে। দেখো, ওর সঙ্গে ইল-বিহেভ কোরো না আবার যেন! লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। তোমাকে নিয়ে কী যে চিন্তা আমার!

পৃথু কিছু না বলে তাকিয়ে ছিল রুষার দিকে। ভাবছিল, কী ভাবে রুষা ওকে? রুষার রুচি এত খারাপ হয়ে গেছে! অবশ্য, দোষও দেয় না রুষাকে, পৃথুর পক্ষে নিজেকে পাহারা দেওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন কাজ।

তোমার উপর যে ভরসা নেই একটুও।

তা ঠিক। পৃথু বলল, আমার নিজেরই নেই নিজের উপর ভরসা। আমার মধ্যে কতগুলো যে মানুষ বাস করে রুষা তা আমি নিজেই জানি না। কোন মানুষটা যে কোন সময় দখল নেবে আমার উপরে, সে সম্বন্ধেও কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই আমার। আমার কোনও টোটাল সত্তা নেই। এই-ই আমার জীবনের অনেক অভিশাপের এক অভিশাপ। আমাকে গুড, ফেয়ার বা ব্যাড কিছুই বলা যায় না কারণ আমি ব্যাডও বটে, ফেয়ারও বটে, গুড়ও বটে। শুধু কোন সময়ে যে কী সেটাই জানা নেই। অনেকগুলো আলাদা আলাদা ঘরে আমার বাস। নতুন ঘরের আলো জ্বলে উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে আগের পুরনো ঘরের আলো নিবে যায়। ওয়াটার-টাইট এয়ার-টাইট সব কম্পার্টমেন্টস। এক ঘরের আমি অন্য ঘরের আমিকে চিনি না পর্যন্ত। আমি এক নই গো রুষা, আমি যে অনেক। আমার উপর ভরসা ভুলেও কোরো না। আমি নিজেই করি না, আর তুমি! সব সময় চোখে চোখে রেখো আমায়, কখন যে কী করে বসি।

কোনওদিনই করিনি। তোমার উপর ভরসা করে মরি আর কী। এ আর নতুন কথা কী! তোমার মত স্বামী নিয়ে এই আমি রুই ঘর করে গেলাম। নেহাৎ সেন্স অফ রেসপেক্ট আছে বলে, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতকে রেসপেকটেবিলিটি দেবার জেদ আছে বলে, কত যে দাম দিলাম, নিজের জীবনটাকে কীভাবে যে নষ্ট করলাম তা…

এটা কিন্তু ভুল। পৃথু বলল। আমার জন্যে নিজেকে নষ্ট কোরো না। করা উচিত নয়। ছেলেমেয়ের জন্যেও নষ্ট কোরো না। “রেসপেকটিবিলিটি” কোনও বাবা-মাই তাদের ছেলেমেয়েকে দিয়ে যেতে পারে না। রেসপেকটেবিলিটি পারিবারিক দোকানের সাইনবোর্ড নয়, সম্পত্তি নয়; ব্যাঙ্ক বালান্স নয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার নয় এ। ভিক্ষার ধনও নয়। প্রত্যেককেই নিজেকে নিজের যোগ্যতায়, ব্যবহারে একে অর্জন করতে হয়। যাতে তা পারে তোমার ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে এই ধন অর্জন করতে, এমন শিক্ষাই দিয়ো ওদের। বাবা মা ছেলেমেয়েদের এর চেয়ে দামি সম্পত্তি আর কীই-ই বা দিতে পারেন?

আমি? আমি কেন? সবকিছুই আমি করব? ওরা কী খাবে, কী পরবে, ছুটির দিনে কী হবে ওদের রিক্রিয়েশন, ওদের ভবিষ্যৎ কী হবে সবই যদি আমি একাই করব তাহলে তুমি ওদের জন্ম দিলে কেন? হোয়াট ইজ ইওর কনট্রিশান?

আমি একটা অপদার্থ। আমি একটা বাজে লোক। আমার কথা ছাড়ো। আমাকে ছেড়ে দাও।

এখন বলছ ছেড়ে দাও। এত বছর পরে। তাহলে ছেলেমেয়েদের জন্ম দিলে কেন?

আমি? আমি দিলাম কোথায়? তাও তো তুমিই দিলে। আমি তো উপলক্ষমাত্র। স্বপ্ন নিয়ে খেলতে চেয়েছিলাম শুধু। স্বপ্নর সুন্দর বীজ থেকে যে ওঁয়া-ওঁয়াকরা ইদুরের বাচ্চার মতো দেখতে আনরোম্যানটিক, মিনিটে মিনিটে শুশুকরা কোনও বিচ্ছিরি গন্ধ প্রাণী এসে হাজির হবে আমি কি তা ভেবেছিলাম।

ইঁদুরের বাচ্চা মানে? হোয়াট ড়ু উ্য মীন?

তুমি কানে কম শুনছ আজকাল। ইঁদুরের বাচ্চা বলেছি, ইদুরের নয়।

নাস্টি। গ্রস। তুমি একটি…

রক্ত, মাংস, প্রাণ, মৈথুন এসব ব্যাপারগুলোই আটারলী গ্রস। আমার এসব ভাল লাগে না। মেয়েরা হল বিধাতার সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি! মেয়েদের ভালবাসতে ভাল লাগে, আদর করতে, অনাবৃত করে দেখতে, পায়ের নখ থেকে কপালের সিঁথি অবধি চুমু খেতে, তাদের চোখের অতল গভীরে চেয়ে সাঁতার না জানা ড়ুবুরির মতো ড়ুবে যেতে। তার সঙ্গে এসবের কী? বাচ্চা, কান্না, কাঁথা। হাইলী আনরোম্যানটিক বিচ্ছিরি সব ব্যাপার। আমার এসব আসে না।

কত যে পাপ করেছিলাম গত জন্মে? তাই-ই ভাবি।

রুষা বলল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

এ জন্মেও কম করছ না।

মানে?

এমন বাজে স্বামীর সঙ্গে ঘর করছ। পাপ না এটা?

এমন স্বামী যেন শত্রুরও না হয়।

কুর্চি কি তোমার শত্রুদের মধ্যে পড়ে? আমি যদি কুর্চির স্বামী হতাম, সুখী হতে তুমি?

কুর্চি? মাই! মাই! শত্রু হতে গেলেও অন্য পক্ষের কাছাকাছি আসতে হয়। কুর্চি, ওই ইমবেসাইল, আন-এড়ুকেটেড, লোয়ার মিডল-ক্লাস, সিম্পলটন রাস্টিক কুর্চির সঙ্গে আমার তুলনা কোরো না, প্লীজ।

ঠিক আছে।

পৃথু বলল।

তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করছই বা কেন রুষা? কিসের তোমার পিছুটান, বন্ধন? আমি তো তোমাকে বেঁধে রাখিনি। আমার সমস্ত খারাপত্ব আমি স্বীকার করি কিন্তু এ কথা বলতে পারো না যে, আমি স্বার্থপর। সব সময় জেনো, তুমি সম্পূর্ণই মুক্ত। একটাই জীবন রুষা। কে কী বলল, কে কী মনে করল, ক্লাবের লাল-নীল হাওয়াইন-শার্ট পরা, কুপমণ্ডুক, বউ আর চাকরিসর্বস্ব বুড়ো বালখিল্যরা কী বলবে অথবা তাদের পিয়ানো বাজানো, নেকু-পুষু-মুনু ইনসিপিড স্ত্রীরাই বা কী বলবে সেই ভয়ে তুমি তোমার জীবন নষ্ট করবে? ওরা কারা এই ফাঁকা মানুষগুলো? তোমার জীবনটা কি তোমার কাছে দামি নয়? নিজেকে এমন করে ঠকিও না।

কী বলতে চাইছ তুমি?

বলতে চাইছি যে, ভিনোদকে বিয়ে করো তুমি। ও তো খুশি হবেই; তুমিও সত্যিই খুশি হবে। জীবনের যা কিছু গেছে তা গেছেই; বাকিটুকুকে এখনও সালভেজ করো। নাথিং ইজ টু-উ-উ লেট। ইটস্ বেটার লেট দ্যান নেভার। ইদুর তোমারই টাইপ। তোমরা সত্যিই মেড ফর ইচ আদার।

রুষা দৌড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।

বলল, আস্তে। উ্য হ্যাভ গান আউট অফ ইওর মাইন্ড।

পৃথু বলল, বাট হাউ বাউট উ্য? উ্য আর গোয়িং আউট অফ ইওর লাইফ। জীবনটা বাঁচবার জন্যে, প্রতি মুহূর্ত পস্তাবার জন্যে নয়। তোমার জন্যে জীবনে করার মতো কিছুই তো করলাম না। একটা ভাল কাজ করতে দাও আমাকে। আমার বিয়ের এই তেতো বাঁধন থেকে তোমাকে মুক্তি দিয়ে চিরদিনের মিষ্টি প্রীতির বাঁধনে বাঁধা পড়তে দাও তোমার সঙ্গে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার সঙ্গে ভিনোদের বিয়ে দেব। দেখো তুমি।

পৃথু আমার মন ভাল নেই, ভাল থাকে না, এমন করে আমার সঙ্গে কথা বোলা না। একদিন কারখানা থেকে বাড়ি ফিরে দেখবে যে, আমি নেই। টুসু মিলিও নেই। শুন্য বাড়ি পড়ে আছে। তোমার চাকর বাকর, আয়া ড্রাইভার, গাড়ি।

জানো রুষা তোমাকে যা বললাম, তা কিছু আমি বানিয়ে বলিনি। এ সবই আমার মনের কথা। আমার তোমাকে দেওয়া যে কষ্ট, সে কষ্ট আমি চোখে দেখতে পারি না। অথচ এই অদ্ভুত বাজে লোকটার এমন স্বভাব যে নিজেকে বদলাতেও পারলাম না। অথচ, সত্যি…, করো না গো ভিনোদকে বিয়ে। ছেলেটা তোমাকে খুবই ভালবাসে।

রুষা চোখ তুলে, চোখ দুটি স্থির করে রাখল পৃথুর দু চোখে। অনেকক্ষণ চোখের ল্যাসার বীম দিয়ে, পৃথু কতটুকু জানে, না জানে, তা বুঝতে চেষ্টা করতে লাগল। বলল, তুমি কী মীন করছ?

তুমি কী বলতে চাইছ পৃথু…?

আমি কিছুই বলতে চাইছি না। তোমাদের মধ্যে ফীজিক্যাল কিছু ঘটেছে কি না জানি না আমি। যদি ঘটে থাকে, বলেই, হাতটা রুষার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, কনগ্রাচুলেশানস।

রুমা রেগে চেয়ার ছেড়ে উঠে চেঁচিয়ে বলল, হাউ ডেয়ার উ্য! উ্য ডার্টি, ডার্টি…। তুমি এমন বলতে পারলে আমাকে? ছিঃ ছিঃ। সকলেই তোমার মতো নয়, তোমার মতো গ্রস শরীর-সর্বস্ব নই আমি। ওরকম শরীর আমার নয় যে…।

শরীর নিয়ে ঠাট্টা কোরো না রুষা। বাইরে অন্ধকার হয়ে গেছে। শরীরও সাপেরই মতো। অন্ধকার হয়ে গেলে যেমন জঙ্গল পাহাড়ের গ্রামের লোকে সাপের নাম মুখে উচ্চারণ করে না তেমন শরীরের নামও অন্ধকার নেমে এলে উচ্চারণ কোরো না। সাপের লেখা যেমন : শরীরেরও তাই। কখন যে কামড়ায় কাকে তা বলা পর্যন্ত যায় না। দংশনকারী আর দংশিত দুজনেই সমান অসহায়। “একই অস্ত্রে হত হল মৃগী ও নিষাদ।” যুবনাশ্ব। মণীশ ঘটক।

তোমার কথাই বুঝি না। তুমি বড় কমপ্লিকেটেড।

রুষা বলল।

একদিন তুমি ভিনোদের চুল আচড়ে দিচ্ছিলে শেষ বিকেলে, বসার ঘরে বসে। মনে আছে? শরতের মেঘে মেঘে রঙের খেলা চলছিল, বাইরে শিউলির গন্ধ, আমলকি গাছের পাতারা হাওয়ার সওয়ার হয়ে ছুটে চলেছে দিগ্বিজয়ে, তার মধ্যে একজন চিরন্তন প্রেমিক আর চিরন্তন প্রেমিকা। সত্যি! ছবিটা আমার চোখে লেগে আছে গো। লাভ অফ দ্য পিওরেস্ট, আন্-অ্যাডালটারেটেড ফর্ম। প্রায় কৈশোরের নির্মল প্রেমেরই মতো! শরীরটা ইনসিডেন্টাল, প্রেমের অনেক দাবির মধ্যে একটা ছোট্ট দাবি মাত্র। আসল ভালবাসা তো একেই বলে। তোমার আর ভিনোদের ভালবাসা যেরকম। আহা! আমাকে যদি কেউ অমন করে কাছে বসিয়ে আদরে চুল আঁচড়ে দিত তো সারাজীবন তার বাঁদী হয়েই থাকতাম।

বুঝেছি, যা বোঝার। কাঁপা গলায় বলল, হতবাক হয়ে পৃথুর চোখে চেয়ে বলল।

কি?

আসলে, তুমি আমাকে ডিভোের্স করে কুর্চিকে বিয়ে করতে চাও। তোমাকে আমি চিনিনি? তুমি ঘোরো ডালে ডালে, আমি ঘুরি পাতায় পাতায়! যা ভাবছ, তা হচ্ছে না। আমি মরে গেলেও ফিরে এসে কুর্চির ঘাড় ভেঙে রক্ত খেয়ে যাব। ভ্যামপায়ারের মতো।

ঈসস-স-স…। বোলো না, বোলো না। পৃথু দু হাতের পাতায় চোখ ঢেকে বলল।

ওর চোখে কুর্চির নরম মরালী গ্রীবাটি ভেসে উঠল। শিরদাঁড়ার হাড়টি উঠে আছে একটু। একটুও বাড়তি মেদ নেই কোথাওই। ছিঃ ছিঃ। ওই সুন্দর ঘাড় ভেঙে কেউ রক্ত খাওয়ার কথা ভাবতে পারে?

তুমি আমাকে চেনোনি রুষা। কেই-ই বা কাকে চেনে বলো? এই ছোট্ট জীবনে! চিনি চিনি বলে মনে হয়; সত্যিই চেনা কী যায়? আমরা নিজেরাই কি চিনি নিজেদের?

তুমি তো একটি মেগালোম্যানিয়াক। সবসময় নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত আছ। আমি-ময় জগৎ তোমার। সব সময়, আমি। আমি। আর আমি।

রুষা বলল ঘৃণা এবং হতাশার গলায়।

পৃথু হাসল। বলল, সকলেই তাই। আমিত্বর প্রকাশটা একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম। কিছুই তো হল না জীবনে। করবার কিছুই করতে পারলাম না। যদি কবি বা লেখক হতে পারতাম তাহলে আমার এই দামি আমিময়তা আমার কলমে তৈরি সব চরিত্রের মধ্যে দুর্মূল্য জাফরান-এর মতো একটু একটু করে মিশিয়ে দিতাম। তারা সব অমর হয়ে থাকত আমার লেখার মধ্যে। লেখক তো থাকেন না। থাকেন না কবিও; তবে তাঁরা যদি লেখার মতো কিছু লিখে যেতে পারেন, তাহলে তাঁরা অমর হয়ে থাকেন তাঁদের ধূলিমলিন প্রাত্যহিক গ্লানির জীবনের নোংরা হাতের কলম দিয়ে গড়া বিভিন্ন সব চরিত্রে। লেখক চলে যান। তাঁর চরিত্ররা থেকে যায়। আমি তো কিছুই হতে পারলাম না। আমিময়তার কথা বলছ, তুমি কি জানো না মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্যর রাবণের চরিত্রের মধ্যে মাইকেল নিজে রয়ে গেছেন।

কে মাইকেল? আমাদের ক্লাবের চাইনীজ রুম-এর স্টুয়ার্ড?

ছিঃ! কী বলছ তুমি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত, দ্যা গ্রেট বেঙ্গলী…

আই অ্যাম নট দ্যা লীস্ট ইন্টারেস্টেড ইন প্রি-হিস্টরিক, ইনসিপিড বেঙ্গলী লিটারেচার।

তাহলে বলি, মাদাম বোভারীর মধ্যে ফ্লবেয়ারের, লেডি চ্যাটালীজ লাভারের মধ্যে লরেন্সের, রাসকানিকভ-এর মধ্যে ডস্টভয়স্কির, ডন-জুয়ানের মধ্যে বায়রনের নিজের ছায়া কি নেই? শেক্সপীয়ারও কি উপস্থিত নন হ্যামলেট-এ? আবার উল্টোটাও হতে পারে। কবি, সাহিত্যিক শিল্পী হলে আমিও তেমন করতে পারতাম, যেমন ভ্যান গখ করেছিলেন। তাঁর ব্যক্তি জীবনের সব অন্ধকার বিষাদকে তাঁর তুলির মাধ্যমে উজ্জ্বলতম রঙের ঋজু, দীপ্ত রেখায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন। যাঁরা শিল্পী, তাঁরা লেখার মধ্যে দিয়ে, ছবির মধ্যে দিয়ে নিরুচ্চারে প্রচণ্ড চিৎকৃতবিপ্লব বিদ্রোহের কথা সহজেই বলতে পারেন। নিজের নিজের ব্যক্তি জীবনকে সমাজের অসংখ্য মানুষের ব্যক্তি জীবনের উপর সুপারইমপোজ করে নিপুণতম ফোটোগ্রাফার এবং এডিটরেরই মতো দারুণ দারুণ সব কম্পোজিশান তৈরি করতে পারেন। তাই নয়? বলো তুমি? জীবন, আমার জীবন, তোমার জীবন, আমাদের সকলের জীবনই তো একটি ফ্রেমের মধ্যের একটি মাত্র কম্পোজিশান। কারও ফোটো সুন্দর, কারও অসুন্দর, কারওটা বা আউট-অফ-ফোকাস হয়ে গেছে, কারও ফোটোর ফ্রেমিংটা ভাল নয়…

আমরা সকলেই তো…….কিন্তু তুমি? পারলে তুমি? তোমার ফ্রেমের মধ্যে থাকতে? একটাই যদি ফ্রেমড-জীবন হত; তাহলে তোমাকে নিয়ে আমার এত অশান্তি হত না।

রুষা বলল, উম্মার সঙ্গে।

পৃথু হেসে ফেলল। বলল, আমি, এই পৃথু ঘোষ যে মেনী-ডাইমেনশনাল! স্টীল-ফোটো হয়ে যারা বাঁচে বাঁচুক। আমি তো একটামাত্র মানুষ নই; আমি যে অনেকগুলো মানুষ। পুরো আমাকে কেউ ধরতে পারলে তো? পারবেই না।

কুর্চি? কুর্চিও পারবে না?

রুষা বলল, তীক্ষ্ম চোখে পৃথুর দিকে চেয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *