1 of 2

২৪. পড়ন্ত বেলার ঝাঁটি জঙ্গলে

পড়ন্ত বেলার ঝাঁটি জঙ্গলের তিতিরের মত তিত্বর-কিত-কিত্ব-তিতর করে ফোনটা বাজছিল। বাড়িতে এখন রুষা আর কাজের লোকজনেরা ছাড়া অন্য কেউই নেই। পৃথু ভোরবেলা উঠেই বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে, আদৌ ফিরবে কি না, তাও সেইই জানে। সকলকেই রুষার বলা আছে, একটার মধ্যে না ফিরলে ধরে নিতে হবে যে, পৃথু খাবে না। তা সে কোথাও খেয়েই আসুক আর না-খেয়েই আসুক। কোনও একজন অবুঝ ইনকনসিডারেট মানুষের জন্যে ওর সংসারে বিশৃঙ্খলা-আনতে রাজি নয় ও আদৌ।

পৃথুর কথা ভাবলেও বিরক্ত বোধ করে রুষা আজকাল। না ভাবাই ভাল। বড়ই ক্লান্ত, একঘেয়ে হয়ে গেছে এই জীবন। দায়িত্বজ্ঞানহীন, প্রায় বিকৃতমস্তিষ্ক স্বামীর এবং নাবালক অবুঝ ছেলেমেয়েদের বোঝা কাঁধে ন্যুজ হয়ে গেছে রুষা। টাকা দিলেই কি সব হয়ে যায়? পৃথুর মতো মানুষ যে কেন বিয়ে করে, কেন তার ছেলেমেয়ে হয়; তা ভাবনারও বাইরে।

ঘড়ির দিকে তাকাল একবার ও। তারপর বাজতে থাকা ফোনটার দিকে।

ভিনোদ!

নিশ্চয়ই ভিনোদের ফোন।

লঘু পায়ে এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলল!

কী ভাল যে লাগে! বাগানে একজোড়া বুলবুলি রঙ্গনের ডালে রঙ্গভরে ঝাপটা ঝাপটি করছিল শিষ দিতে দিতে। হেমন্তর হিম-হিম শিশু-দুপুর চমকে উঠছিল তাদের রঙে-ঢঙে।

কী ভালই যে লাগে!

ভিনোদের একটু গলার স্বর কানে এলেও যেন খুশিতে ভরে যায় মন। কে জানে? কী থাকে, কী আছে; এক-একজনের গলার স্বরে! কেন যে এমন বিপজ্জনকভাবে ভাল লেগে যায় এক একজন পুরুষকে এ জীবনে! আর তেমন করে ভাল লেগে গেলে, কোনও নিয়ম, কোনও বাঁধন, কোনও শাসনই আর মানতে চায় না মন।

কী করছ?

ভিনোদের সুন্দর, পুরুষালি গলা ভেসে এল ওপাশ থেকে। ইংরিজিতেই বলছিল ও। ভিনোদের সঙ্গে সাধারণত রুষাও ইংরিজিতেই কথা বলে। হিন্দি; ভিনোদ ইদুরকার-এর কাছে প্রাকৃত ভাষা বাংলা যেমন রুষার কাছে।

আবারও বলল ভিনোদ, কী হল? কী করছ তুমি? কথা বলছ না যে!

বিশেষ কী আর করব! কাজ করছিলাম।

এত কী কাজ করো? সব সময়?

এই! একটু ধরো না প্লিজ!

আবার কী হল?

এক সেকেন্ড আসছি।

চা-টা, ড্রয়িংরুমেই এনে দিতে বলে এল কিচেনে গিয়ে। মেরীকে। তারপর চেয়ার টেনে নিয়ে বসল ফোনের সামনে রুষা, আরাম করে। পেছনে একটি কুশান দিয়ে।

বলো।

তুমি বলো! কত্বদিন তোমার গলা শুনি না।

আহা!

কত্বদিন পরে ফিরলাম হাটচান্দ্রাতে কিন্তু তোমার গলায় তো তেমন খুশি দেখছি না। কী হল? যত পুরনো হচ্ছি ততই কি সস্তা হয়ে যাচ্ছি তোমার কাছে? কী ভাল যে লাগে না, তোমার সঙ্গে এই একটু সময় কথা বলতে। কী বলব! আজ আসবে আমার বাড়িতে রুষা? চলে এসো। পাঠাব গাড়ি? তোমার জন্যে রায়পুরের হোসা সিল্কের শাড়ি এনেছি একটা। তুমি এসে নিয়ে যাবে নিজে? এস, এস; প্লীজ।

পাগল নাকি? নাঃ। যত্বই বলো না কেন, আমি যাব না। পাগলামি তোমাকে মানায়; আমাকে মানায় না। ব্যাচেলরের একা বাড়িতে বার বার যাওয়া…।

কেন, না? না কেন? শাড়িটা নিতেও আসতে পারো না?

এমন করে বলছ, যেন আমার নিজের দামের চেয়ে একটা সিল্কের শাড়ির দামই বেশি হল? সত্যি! তুমি না!

আসলে, এমনিই। আমার ভাল লাগে না।

কী ভাল লাগে না?

তোমার কাছে যেতে।

মিথ্যে কথা।

সত্যি! তোমার সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে, দেখা হলে ভাল লাগে। অন্য কিছু ভাল লাগে। ভাল নয়, ওসব। তোমরা পুরুষরা বড় জংলি। শুধু ওইসবই বোঝে। তোমরা যখন ভিখিরি হও তখন তোমাদের আত্মসম্মানজ্ঞান একেবারেই লোপ পেয়ে যায়।

ভিনোদ হাসল।

বলল, আত্মসম্মানজ্ঞান আর ভিক্ষা চাওয়া এই ব্যাপার দুটো একসঙ্গে যায় না। তাছাড়া, শরীরের মধ্যে কি আনন্দ নেই? শরীর কি নোংরা?

আছে হয়তো। কিন্তু তার চেয়ে মনের আনন্দ অনেক বেশি গভীর।

বাজে কথা। মনটা তো শরীরের মধ্যেই থাকে। শরীর না থাকলে মন থাকত কোথায়?

জানি না। শরীর, বড় নোংরাই লাগে আমার কাছে। শরীর কি চিরদিন থাকে ভিনোদ? মনই চিরদিনের।

ছাড়ো তো। ফিসফাইজিং। চিরদিন যেন আমরা নিজেরাই থাকব! অত্ব সব জানি না। যাকে ভালবাসি, তাকে শারীরিকভাবে কোনওদিনও না পেলে মনে হয় যে, সে বুঝি ভালই বাসে না। আমাকে। এটাও একরকমের স্বীকৃতি। তোমার যে অদেয় কিছুই নেই আমাকে, এ কথাটাই শরীরের ভালবাসার মধ্যে দিয়ে নতুন করে কখনও জানতে পেলে আমার পুরুষের ইগো স্যাটিসফাইড হবে। অন্য পুরুষদের কথা জানি না। আমি এরকমই।

তুমি বোকা, তাই-ই, জিনিসের দাম বোঝে না।

জানি তো। আমি তো বোকাই। তবু…

শরীর তো যাকে তাকে হেলাফেলায়ই দেওয়া যায়। মানে, যাকে মনই দিতে পারলাম, তাকে আর শরীরটা দিতে বাধা কোথায়?

অনেকই বাধা। সবসময়ই বাধা। তোমাকে দেখে তো তাই-ই মনে হয়। তুমি একটি চাইনীজ ওয়াল।

ভিনোদ অভিমানের গলায় বলল।

আমাকে তুমি একটুও বোঝ না তাই-ই। আসলে, যা দামি, তোমরা, পুরুষরা, তাকে দাম না। দিয়ে, যা সস্তা তাকেই মহামূল্য মনে করে। মেয়েদের শরীর সম্বন্ধে তোমাদের এই বোকা-বোকা দুর্বলতার কোনওই মানে নেই। তোমার মত বুদ্ধিমান পুরুষও যে কী করে…

কী জানি! আমাদের যা দুর্বলতা; সেটাই হয়তো তোমাদের বল। ভগবান পুরুষদের যে কেন এত দুর্বল করে গড়লেন তা তিনিই জানেন। শুধুই মানুষদের। জন্তু জানোয়ারদের মধ্যে বোধহয় এমন দুর্বলতা দেখা যায় না।

হেসে বলল ভিনোদ।

হাসল রুষাও।

ভারী সুন্দর কথা বলে ইদুরকার। ও আসলে জানে না, হয়তো জানবেও না কোনওদিনই যে রুষা ভিনোদের সুন্দর চেহারা, সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ব, ওর অঢেল টাকা কোনও কিছু দেখেই ভালবাসেনি ওকে। ভালবেসেছে, শুধু ওর কথারই জন্যে। “শুধু কথায় চিড়ে ভেজে না” এমন একটি প্রবাদ ওর জানা আছে। কিন্তু প্রবাদটি বোধহয় সত্যি নয়। রুষার মধ্যে যে এক রোম্যান্টিক সত্তা আছে সেই সত্তা ভিনোদের কথাতে পুটিলেখা ফুলেরই মতো ফুটে উঠতে থাকে জড়াজড়িকাসবুজপাতা ছড়াতে থাকে চতুর্দিকে, ফুলকুঁড়িতে পরিবেশ ভরে দিয়ে। ভীরু বৃষ্টির মতো ফিসফিস করে তার নারীসত্তার শার্সিতে সেই কথা চুমু খেতে থাকে অবিরত। তখন আগল খুলতে কোনও বাধাই দেখে

আর। রুষা অন্তত দেখে না। যদিও শরীর দেয়নি ভিনোদকে সে কখনও। যা উপচে চলকে পড়ে, সেটুকুই দিয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কখনও সখনও। তার বেশি নয়।

কী হল? কথা বলছ না যে!

ভাবছি।

কী এত ভাবো?

ভিনোদ হালকা গলায় বলল।

তারপর বলল, বেশি ভাবলে, মানুষ অস্থির হয়ে যায়। পাগল হয়ে যায়। পিরথু-দাদার মতো যার মধ্যে যতখানি ভাবনা আঁটে, তার বেশি আঁটাতে গেলেই মরণ। কার মনে যে কতটুকু আঁটে, সেটা সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত প্রত্যেকেরই। না থাকলেই বিপদ।

তোমার সঙ্গে কথায় পারব না।

জানই যদি, তাহলে আমার কথা কাটো কেন?

কাটব না? কথা? মানুষের এই-ই তো এক বিশেষ আনন্দ। কথার কাটাকাটি খেলা, মানুষ খেলতে জানে, বলো?

তা ঠিক। তুমি কখনও কি পতঙ্গ উড়িয়েছ? ছেলেবেলায়? রুষা?

পতঙ্গ! না। মেয়েরা কি পতঙ্গ ওড়ায় নাকি? সত্যি পতঙ্গ ওড়াইনি কখনও, তবে মনে মনে। উড়িয়েছি কথার পতঙ্গ, স্বপ্নের পতঙ্গ। সবসময়ই ওড়াই। আমি নিজেই তো একটি কাটি-পতঙ্গ। জীবনের আকাশে।

পির্‌থু দাদার কী খবর?

কথা ঘুরিয়ে ভিনোদ বলল।

ভিনোদ জানে, রুষার মতো মেয়ের সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিলেই এরা বেশি সেন্টিমেন্টাল হয়ে ওঠে।

রুষা বলল, কে জানে? তার কথা সেই-ই জানে। কোন ঘোরে যে থাকে! এতদিন ছিল কবিতা নিয়ে, এখন শখ হয়েছে প্রোজ লিখবে। মণি চাকলাদারের মতো উপন্যাস! নভেল লিখছে। খুব নামের মোহ হয়েছে আসলে। ফেমাস লোক হতে চায়। আসলে, ও একটি কনফিউজড় লোক। যোগ্যতা ছাড়াই যারা ফেমাস হতে চায় এবং অনেকসময় হয়ও; তাদের পদদলিত হতেও বেশি সময় লাগে না। অথচ এটা ও বুঝতেই চায় না। আসলে, কী যে ও চায়, আজ অবধি সেটাই স্পষ্ট করে বুঝে উঠল না।

ফেমাস আর নোটোরিয়াসে তফাৎ আছে। জানে তো তা, পির্‌থুদাদা?

চাপা হাসি হেসে বলল ভিনোদ।

জানা তো উচিত। আই ডোন্নো।

রুষাও হেসে বলল।

পির্‌থুদাদা গেছে কোথায়? কতদূরে?

কে জানে? সে তো কাছে থেকেও সবসময়ই দূরে। আজ হয়তো অনেক দূরের কোনও পাহাড়ে-জঙ্গলে গেছে। কিংবা কে জানে, হয়তো এই মুহূর্তে সাবীর মিঞার জুতার দোকানে গিয়েই বসে আছে, কি ভুচু মিস্ত্রির গ্যারাজে। পান খেয়ে খেয়ে ঠোঁটে শ্বেতির মতো দাগ হয়ে গেছে, জানো? কোনওদিন ক্যান্স্যার হলেও আশ্চর্য হব না। ও যখন পানের পিক ফেলে, কেন যেন আমার মনে হয়; প্রতিবারই আমার সমস্ত সৌন্দর্যবোধ, সমস্ত শখ, সুরুচি সবকিছুকেই বিদ্রুপ করে আমার প্রতি ওর জমে-ওঠা ঘৃণাটাই যেন উগরে দেয়। ওর মধ্যে একরকমের চাপা নিষ্ঠুরতা আছে, এক অন্ধ পাশবিক নীরব ক্রোধ। আর জেদও। সেটা আমার ক্ষতি যত না করে; তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে ওর নিজেরই। মানুষটা জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে পুরোপুরি জংলিই হয়ে গেছে। শহরে সমাজে ও একেবারেই বেমানান। এমনিতেই ওর মধ্যে অনেকই জংলামো আছে। অনেকরকম। রক্তেই বয়ে এনেছে সঙ্গে করে; মনে হয়। ইট রানস ইন হিজ ব্লাড।

যাই-ই বলো, তুমি কিন্তু পিরথুদাকে ভালবাসো এখনও। ওকেও বাসো; আমাকেও বাসো। কী করে পারো বলো তো? দুজনকে কি একসঙ্গে ভালবাসা যায়?

তুমি কী বুঝবে? বললে? আমার ভালবাসা কী এতই সীমিত যে, একজনকে দিয়েই আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো? মনে হয়, আমি তেমন মেয়ে নই। না গো, আমি তেমন নই। একই সঙ্গে একাধিক মানুষকে ভালবাসার ক্ষমতা আমার আছে। হয়তো অনেকেরই আছে। আমরা কি নিজেদেরই জানি? সম্পূর্ণ করে?

কী জানি? এ কেমন ভালবাসা তোমাদের। আসলে আমার মধ্যের মালিকানা বোধ এসব ভাগাভাগিতে বিশ্বাস করতে চায় না। জরু আর গরু ভাগাভাগির নয়।

ভিনোদ বলল। তুমিই বলো যে, পিরথু-দার সঙ্গে তোমার মনের কোনও মিলই নেই, শারীরিক সম্পর্কও নেই কোনও; অথচ তবু বলো যে, এখনও তাকে ভালবাসো। আশ্চর্য তুমি। সত্যি!

হাসল রুষা।

চাপা হাসি।

বলল, কী জানি। নিজেই বুঝতে পারি না নিজেকে।

মেরী চা এনে রাখল গোলাপী মাৰ্বল পাথরের টেবলটার উপর। যার উপরে ফোনটা থাকে। হাসছ যে! ভিনোদ অবাক-হওয়া গলায় শুধোল।

হাসছি, তোমার কথা শুনে। তুমি তো বিয়ে করনি, তোমার তো ছেলেমেয়ে হয়নি, তুমি এই ভালবাসার স্বরূপটা ঠিক বুঝবে না। বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রীর ভালবাসাটা এমনই। একটা অভ্যেস। ছেলেমেয়েরা এসে যাওয়ার পর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা একটা অন্য ডাইমেনশান পায়। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, আলগা হয়ে যায় হয়তো। আবার গভীরও হয়; ছেলেমেয়েদের জন্যেই। মনে করো, কী বলব; ধরো, ছিড়ে-যাওয়া পুরনো বাথরুম স্লিপারেরই মতো। ছিঁড়ে গেলেও ছেড়ে যাওয়া; ফেলে দেওয়া বড়ই কঠিন।

একটু চুপ করে থেকে রুমা বলল, উপমাটা কি খুবই খারাপ হল?

উত্তর না দিয়েই ভিনোদ বলল, আমাকে বিয়ে করলেও কি সেই নতুন সম্পর্কটাও বাথরুম-স্লিপারের মতোই হয়ে যাবে? হলে, হোক! তবুও বিয়ে আমি করতেই চাই। তুমিই তো কথা শোনো না আমার। কী না করতে পারি আমি তোমার জন্যে! বিয়েটা আমার পক্ষে একটা মিনিমাল করা। আমার সব কিছুই তো তোমার। তুমি তো জান রুষা।

ভিনোদ আবেগ-ভরা গলায় বলল। অন্তত তাই-ই মনে হল, রুষার।

আবারও বিয়ের কথা ভাবি না। একবারই যথেষ্ট, ভিনোদ। তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হলেই তোমার আর আমার এমন সুন্দর সম্পর্কটাও হয়তো একটা মেনে-নেওয়া অভ্যেস হয়ে যাবে। ছেলে-মেয়ের ভাল-মন্দ, তাদের ভবিষ্যৎ, দৈনন্দিনতার একঘেয়েমি, আমাদের দুজনের সব নিজস্বতা, সব আনন্দ ছাপিয়ে সে সব অনেকই বড় হয়ে উঠবে। আমরা মানে, আমি আর পৃথু তো এখন আর নিজেদের জন্যে বাঁচি না। ছেলেমেয়েদের জন্যেই বাঁচি এখন। এত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, অজানা ভবিষ্যত-এর জল্পনা কল্পনার থকথকে দুর্গন্ধ-কাদার মধ্যে বিবাহিত ভালবাসা একসময় হারিয়েই যায়। তার সব বীজ শিকড়, ফুল, পাতা সংসারের ভারে চাপা পড়ে যায়। কাদায় তো পদ্মও ফোটে। কিন্তু এই মানডেন, প্রোথিত ভালবাসা খুব কমই ফুল হয়ে ফুটে ওঠে। বিয়ে; আর নয়। একবারেই অনেক হয়েছে। এনাফ, ইজ এনাফ। ও ভুল আর নয়।

তোমার বাড়িতে এখন কে কে আছে, রুষা?

হঠাৎই শুধোল ভিনোদ।

মানে?

মানে, এখন তুমি কি একাই আছ বাড়িতে?

না। কিন্তু কেন?

বলই না।

মেরী আছে। কুক লছমার সিং, দুখী, মালি, ড্রাইভার অজাইব সিং সবাই-ই আছে। কিন্তু কেন? হঠাৎ এই প্রশ্ন?

ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমার কাছে যেতে।

কেন? হঠাৎ? এই ভরদুপুরে?

তোমাকে আদর করব। ইচ্ছা করছে ভীষণ।

কী! বলো কী? না, না! পাগল না কি? উ্য হ্যাভ গান ক্রেইজী!

আতঙ্কিত গলায় রুষা বলল।

না, এসো না। একদ্দম না। বাড়ি ভর্তি লোক। ছিঃ। তারা কী ভাববে? তাছাড়া, পৃথু জানতে পেলে? এমনিতে ও উদার। বলব, যথেষ্টই উদার। সেদিন রাতের ব্যাপারটা ও বুঝতে পেরেছে মনে হয়। তবু, কিছু বলেনি আমাকে। তাতেই বুঝেছি যে, ও অন্তত অন্য দশজন পুরুষের মতো মীন নয়।

একে তুমি ঔদার্য বলছ?

বিদ্রুপের গলায় ভিনোদ বলল। যদি আমার স্ত্রী অন্য কারো প্রতি আসক্ত হত, তবে আমি তো নিজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই দেখতাম। সেলফ-ক্রিটিসিজম করতাম; নিজেকে। চাবকাতাম, বুঝতে চাইতাম, কোথায় আমার অপূর্ণতা, ঘাটতি, কেন সে আমাকে নিয়েই খুশি না থেকে অন্যের দিকে হাত বাড়াল!

তুমি মহৎ!

বিদ্রুপের গলায় রুষা বলল।

তারপর বলল, অত সোজা নয় ভিনোদ। অত সোজা নয়। একজন ব্যাচেলর-এর পক্ষে এ ব্যাপারটা বোঝা তো সোজা নয়ই।

কি, সোজা নয়? এত কঠিনই বা কিসে?

কোথায় যে লাগে, তা বিবাহিত মানুষের পক্ষেই একমাত্র বোঝা সম্ভব। আমার সঙ্গে পৃথুর সম্পর্কটা প্রায় মরে যাবারই মতো হয়েছে। নেই-ই বলতে গেলে। তবুও ও যদি অন্য কোনও মেয়ের জন্যে কাঙালপনা করে, এবং তা আমি জানতে পাই; আমার ভীষণই লাগবে। নিজেকে ছোট লাগবে ভীষণ; বঞ্চিত লাগবে। নিজের সম্মানে প্রচণ্ড লাগবে। তোমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না ভিনোদ। কিছু কিছু কথা থাকে, যা নিজে বোঝা যায়। কিন্তু অন্যকে বোেঝানো যায় না। ঠিকভাবে। এ কথাটাও বোধহয় সেই রকমই।

আমি তোমার অত বড় বড় সব কথা বুঝি না।

তোমাকে বোঝাবার কোনও গরজও নেই আমার। বললামই তো! সব কথা সবার বোঝার নয়।

তুমি চান করেছ?

এই-ই প্রথমবার কষার মনে হল, ভিনোদের কথা যেন কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন তো কচি-দুপুর। এখনই। ছিঃ! পৃথুও দিনের বেলায় কখনও এমন নেশাগ্রস্ত হয় না। নেশা করেছে! তাই-ই…এলোমেলো কথা বলছে…

রুষা অন্যমনস্ক গলায় বলল, হ্যাঁ। চান তো সকালেই করেছি। কিন্তু কেন? হঠাৎ চান করার

কথা!

কী পরে আছ? তুমি?

মানে?

কী শাড়ি? খুব সেজেছ কি?

রুষা হাসল।

মুখে বলল, হঠাৎ সাজব কোন সুখে? বুড়ি হতে চললাম, এত সাজাসাজির কী? দিন দুপুরে?

তবু। বলো না। তোমাকে তাহলে আমার কল্পনার চোখে ঠিকঠাক দেখতে পাব।

সত্যিই পাগল তুমি। থাক। আর ঠিকঠাক দেখে কাজ নেই। বেঠিকই ভাল।

না। প্লীজ বলো।

তবুও রুষার উত্তর না পেয়ে বলল, কি? পরেছ কী শাড়ি?

মাহেশ্বরী!

সে আবার কী? শাড়ির তুমি কী বোঝো! ইন্দোরের কাছের মাহেশ্বরী। ভোপালের লঘু নিগম-এর “মৃগনয়নী” থেকে কিনেছিলাম, যখন গেছিলাম গতবছর। কালো, সাদা ছোট্ট ছোট্ট চেক। সস্তা; তাঁতের। কিন্তু দারুণ সুন্দর সুরুচিসম্পন্ন শাড়ি।

আশ্চর্য! জীবনের কোনও ক্ষেত্রেই দামের সঙ্গে মূল্যর পরম্পরা প্রায়ই থাকে না। কেন অমন হয় বলো তো?

জানি না। ভাবিনি কখনও এ নিয়ে।

“মৃগনয়নী”? ভোপালের কোন পাড়ায়? এতবার ভোপালে যাই, কই? চোখে পড়েনি তো!

আরে! টি টি নগরের নিউ মার্কেটের একেবারে লাগোয়াই বলতে গেলে।

ও কে। এবার গেলে যাব। তোমার জন্যে চান্দেরি বা সিল্ক আনব, “মৃগনয়নী” থেকে?

একদম না। কিছু চাই না আমি। যা পাই, তাই-ই তো অনেক। জিনিস চাই না কোনও।

ব্লাউজ? কী ব্লাউজ পরে আছ?

তুমি দেখছি জ্বালালে আমাকে। বড় মেয়েলি তুমি। এমন পুরুষ অসহ্য লাগে আমার।

ওক্কে। ফাইন। মেনে নিলাম আমি অসহ্য। কিন্তু বলো। প্লীজ।

সাদা ব্লাউজ।

ঈসস। দারুণ দেখাচ্ছে তাহলে বলল।

টিপ পরেছো? পরোনি?

উঃ! বোকা বোকা কোরো না।

আহাঃ, বলোই না।

না। আমি কি প্যারাম্বুলেটরে বসে বেড়াতে যাব এখন? হঠাৎ টিপ পরতে যাব কোন দুঃখে? সিলী!

তাহলে চোখে? কাজল? কী? দিয়েছ চোখে? সুর্মা?

হ্যাঁ। দিয়েছি। চোখে কাজল। হল। সো হোয়াট?

গলায় কী পরেছ?

উঃ! কালো পুঁতির মালা। অ্যানোডাইজড তারে বাঁধা।

আর পারফ্যুম?

তোমারই দেওয়া; টোপাজ।

চুল বেঁধেছ?

সত্যি। তুম্মি না! না বাঁধিনি। রোদে চুল ছড়িয়ে বই পড়ছিলাম বারান্দায় বসে। শুকিয়ে গেছে অনেকক্ষণই।

কী বই? মাই! মাই! এডওয়ার্ড লীয়র। আমার বড় প্রিয়। ছোটবেলার বই। কখনও তবু পুরনো হয় না।

আমিও হব না পুরনো। দেখো তুমি।

সামান্যক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, কী তেল মেখেছ? চুলে?

তেল তো আমি মাখি না।

হ্যাঁ।

ঈসস! কী সুন্দর গন্ধ তোমার নরম চুলে। আমি এখান থেকেও পাচ্ছি। শোনো রু-রু…ষা। আমি কিছু জানি না। আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। তুমি তোমার বাড়ি-ভর্তি খিদমদগারদের কাকে কোথায় পাঠাবে কোন ছুতোয়, কাকে মেরে ফেলে পুঁতে দেবে বাগানে; সেসব তোমারই ব্যাপার। আমার। এক্ষুনি একবার ভীষণ আদর করতে ইচ্ছে করছে তোমাকে। আই মাস্ট হ্যাভ ট্য। রাইট ন্যাউ!

তুমি পাগল! ভয়ার্ত গলায় রুষা বলল, না না। মাথা খারাপ। যে-কোনও মুহূর্তে পৃথু চলে আসবে। আমি রাখলাম ফোন।

আমি, না গিয়ে পারছি না। তোমাকে ভাল না-বেসে যে পারি না রুষা! আমাকে ক্ষমা কর, প্লীজ। দশ মিনিটে পৌঁছচ্ছি।

ও প্রান্তে রিসিভার নামিয়ে রাখার কটাক আওয়াজ শুনল, আতঙ্কিত রুষা। ভয়ে ওর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে এল।

শুধু কি ভয়েই?

এক ধরনের অপ্রকাশ্য নিষিদ্ধ আতঙ্ক-মেশা আনন্দও সেই ভয়ের সঙ্গে মিশে ছিল। সেসব অনুভূতির নাম জানে না রুষা। নতুন অনুভূতি।

কাঁপা-হাতে ফোনটা নামিয়ে রেখেই, তাড়াতাড়ি চায়ের কাপটা ট্রে-সুদ্ধ তুলে নিয়ে গেল নিজেই প্যানট্রিতে।

গলা তুলে ডাকল, মেরী, মেরী! নিজের কানেই গলাটা কাঁপা কাঁপা শোনাল।

ওর বুক উথাল-পাথাল করছিল। কানের লতি গরম হয়ে উঠেছিল। প্রায় কাছে এসে-যাওয়া এক নিষিদ্ধ অথচ তীব্র আনন্দর ভয়ার্ত আভাসে ওর জ্বর জ্বর লাগছিল। আশ্চর্য! এখনও এমন হয়? কী করে হয়? পৃথুর ছোঁয়াতে যে-শরীর শব-এর মতো শীতল, নিথর থাকে; সেই শরীরই ভিনোদের আসার কথাতেই আইসক্রীমের মতো গলে যাচ্ছে। উপমাটা বোধহয় ঠিক হল না। আইসক্রীম নয়; হিমবাহ। আইসবার্গ। ভয় হয়, ওর সমস্ত শরীরটাই হিমবাহর মতো গলে গিয়ে নিঃশব্দে ভিনোদের সমুদ্রে একদিন হারিয়েই না যায়! এই মরচে ধরা, বাতিল করা, ফিউজ-হওয়া। শরীরে এত হ্যালোজেন, মাকারী-ভেপার, এত লাল-নীল-হলুদ-সবুজ টুনি বা কী করে যে জ্বলে ওঠে! এ এক বিস্ময়!

–মেরী!

আবারও ডাকল রুষা।

এবার গলায় বিরক্তি ঝরিয়ে। এখন সময় নেই একটুও নষ্ট করবার। বিরক্তিটা ঠিক কার প্রতি তা নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারল না। মেরীরই প্রতি? ওর নিজেরই প্রতি কি? ভিনোদ-এর প্রতি?

দুখী এসে বলল, মেরী কাপড়চোপড় কাচতে নিয়ে গেছে কুয়োতলায়। আজ তো মশারি বেডকভার কাচার দিন। একেবারে চান করেই আসবে।

কতক্ষণ গেছে?

এই তো গেল। খু

ব তাড়াতাড়ি মনে মনে সময়ের একটা হিসাব করল রুষা। ক্যালকুলেটরের চেয়েও তাড়াতাড়ি। সময়ের অকুলান না হলে, বোধহয় সময় কখনও দামি হয় না। মেরী এখন কমপক্ষে আধঘন্টা ওখানে আটকে থাকবে।

মালিটা কোথায়?

রুষা শুধোল, দুখীকে।

ডালিয়ার বাগানে গোবর সার দিচ্ছে।

দুখী বলল, তার ঘড়ি-ধরা মেমসাহেবের এই অসময়ের তৎপরতাতে আশ্চর্য হয়ে।

ওকে বলবি, যেন একদম ফাঁকি না দেয়। যত্ব সময় লাগে, লাগুক। এবারে জবলপুরের ক্যান্টনমেন্টের ফ্লাওয়ার-শোতে প্রাইজ পাওয়া চাই-ই। বলে দিবি। নইলে, ওকে ছাড়িয়ে অন্য মালি রাখব।

কুক কোথায়? লছমার সিং?

বাঃ। আপনাকে বলেই তো গেল। রান্নাবান্না সেরেই গেছে। ওর কে রিস্তেদার এসেছে চিলপি থেকে। তার সঙ্গেই দেখা করতে গেছে না কারখানায়! লাঞ্চ-এর আগেই ফিরে এসে টেবল লাগিয়ে খাবার দেবে তাই-ই তো বলে গেল।

ওঃ।

রুষা বলল।

মনে মনে হিসেব করল দ্রুত। লাঞ্চ-এর দেরি আছে। দেড়টা-দুটো হবে খেতে।

তুই কী করছিস? তুই? ফাঁকি মেরে বেড়াচ্ছিস?

বাঃ রে! আপনার ঘর ডাস্টিং করছিলাম।

আমার ঘর?

চমকে উঠল রুষা।

সর্বনাশ! রুষারই বেডরুম? ভিনোদ যদি অবুঝপনা করে। যদি ফেরাতে না পারে তাকে?

পারলে যে কী হবে, তা ভাববার মতো যথেষ্ট জোরও যেন নেই রুষার বুকে।

এতক্ষণে আমার ঘর ডাস্টিং করছিস। আশ্চর্য! না, না এখন ছাড়!

শিগগির একবার বাজারে যা তো। অজাইব সিং বাইরেই আছে। ওকেই বল, গাড়ি করে নিয়ে যাবে।

দুখী অবাক হল। খুবই। কোনওদিনও বাজারে যায় না ও। ভাল করে চেনে না পর্যন্ত কোথায় সেটা। মেমসাহেবের ঘড়িও ভুলও হয় না কখনওই। আজ সবই যেন গোলমাল হয়ে গেছে মনে হচ্ছে।

কী আনব? এখন? ফ্রিজ তো ভর্তিই আছে। কালই তো মেমসাব আপনি নিজে বাজারে গেলেন। তাহলে…

চুপ কর। মাছ আনবি।

আমি মাছ চিনি না। আমার দেশে শুধু পাহাড় আর টাঁড় আছে, তালাওটালাও নেই। নদী আছে, তাও একটাই…মাছ-টাছ কোনওদিনও…। আমি তো জীবনে কখনও…

জীবনে অনেক কিছুই মানুষ আগে করে না, একদিন না একদিন তা শুরু করে। “জীবনে করিনি” “জীবনে করিনি” করবি না। যাঃ। টাকা এনে দিচ্ছি।

রুষা বেডরুম থেকে টাকা এনে দুখীর হাতে দিতেই দুখী আবার বলল, মাছ তো অজাইব সিংই আনে…আমি…চিনি না যে…

কথা কম। মাছ আনবি। তুই-ই আনবি, বড় কাৎলা। না, কাৎলার মাথা। মুগের ডাল হবে। মাথা দিয়ে।

কাৎলা কী মেমসাব?

উঃ! কাৎলাও চিনিস না? খাস তো খুব! কালো, মুখ-ভ্যাটকানো ইডিয়ট-এর মতো দেখতে মাছ। একরকম।

দুখী বেশি কথা না বলাই ভাল ভেবে বলল, ক্যাঁটলা না পেলে?

না পেলে, যা পাবি; তাই-ই আনবি। পাড়হেন, সাঁওয়ার, ঘেঁওড়া বা মুঙ্গরী। বললাম না, যাই-ই পাবি। বাজারে না পেলে নদীর ঘাটে যাবি। সব কটা ঘাট দেখতে বলবি অজাইব সিংকে। সময় যত লাগে লাগুক। কালার মাথা চাই-ই।

দুখীর মুখ দেখে মনে হল, রুষা কালার মাথা না চেয়ে দুখীর নিজের মাথা চাইলেও যেন বেঁচে যেত ও।

আর শোন। মাছ কিনে একবার পদ্ম স্টোর্স-এ যেতে বলবি। কাস্টার্ড আনবি। জানে, দোকানি। তারপর মুদির দোকানে। গরম মশলা আনবি একশো। সোনামুগের ডাল দু কেজি! রাজমা; কাশ্মীরী; এক কেজি। যাঃ দেরি করিস না।

দুখী বেজার মুখে চলে গেল। ভাবল, মেমসাহেবের মাথাটা নির্ঘাত খারাপ হয়েছে। এতদিন সাহেব এক পাগল ছিল। এবার মেমসাহেবও হল। চাকরি ছেড়ে দিয়ে প্রাণ নিয়ে পালাবার সময় হয়েছে এখন।

অত্যন্ত উত্তেজিত মস্তিষ্কে রুষা সময়ের হিসেব করতে লাগল। অতি-দ্রুত। ক্যালকুলেটরের মতো ওরা একবার বেরলে কম করে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের আগে ফিরতে পারবে না। যথেষ্টই সময়। যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভিনোদকে ফেরৎ পাঠাতে পারে তাহলেও যথেষ্ট সময়। না পারলেও। পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময়, বাঁচা অথবা মরা; দুইয়ের পক্ষেই যথেষ্ট সময়।

দুখী অনেকই দেরি করে ফিরল ভিতর থেকে থলি হাতে করে। রুষার ভয় হচ্ছিল, ওরা বেরোবার আগেই ভিনোদ না এসে পড়ে। সময় অতি দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।

ধমক দিয়ে দুখীকে বলল, কী রে! এতক্ষণ কী করছিলি? এত দেরি করলি?

আমার পেট গড়বড় হয়েছে মেমসাব।

রাগ হল ভীষণই। পেট গড়বড় করার আর সময় পেলে না বাছা?

মনে মনে বলল। মানুষের পেট থাকলেই মাঝে মাঝে গড়বড় সড়বড় হয়। সামান্য পেট নিয়ে যারা ভাবে, তারা…। নাঃ। যাঃ, তোকে দু টাকা বকশিশ দিলাম। মাছ কিনে যা ফিরবে, তা থেকে নিয়ে নিস। জিলিপি খাস।

পেট গড়বড় হওয়ার সঙ্গে বকশিস পাওয়া বা জিলিপি খাওয়ার সম্পর্কটা কী তা বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল দুখী রুষার মুখের দিকে।

বলল, কেন মেমসাব?

আঃ। এমনিই দিলাম। যাঃ। আর দেরি করিস না।

একটু পর, রুষা ড্রয়িংরুমের জানালা দিয়ে দেখল, অজাইব সিং দুখীকে সামনের সীটে তার পাশে বসিয়ে আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে গেটের দিকে যাচ্ছে। এবং ঠিক সেই সময়ই, অ্যাজ ব্যাড লাক উড হ্যাভ ইট, যে ভয়টা করছিল; ঠিক তাই-ই হল। লাল ধুলো উড়িয়ে ভিনোদের গাড়ি এসে জোরে ব্রেক কষে গেটে ঢুকল। অজাইব সিং গাড়ি একেবারে বাঁয়ে কাটিয়ে ভিনোদকে ঢোকার জায়গা করে দিল।

ভীষণই রাগ হল দুখীর উপর, রুষার। ফাজিল ছোঁড়া। খালি বকোয়াস। দু মিনিট আগে বেরোলেও এমন হত না। বাজারের রাস্তা আর ভিনোদের আসার রাস্তা আলাদাই ছিল। পাঁচ সেকেণ্ড আগে বেরোলেও…দুখী এবং অজাইব সিং দুজনেই দেখে গেল ভিনোদকে। এই অজাইব সিংটা মহা ধূর্ত লোক। পৃথুকে কিছু বলে না দেয়! দিন-দুপুরে। কোনও মানে হয়? ভিনোদের এত ডেসপারেট হবার? ওর আর কী? ঝুঁকি যা, তা তো সব রুষারই।

দুখীর কাছে বিস্তারিত সব শুনল অজাইব সিং। অসময়ের বাজারের ফিরিস্তি। শুনতে শুনতে তার গোঁফের ফাঁকে একটু হাসি ফুটে উঠল। বড় রাস্তাতে পড়েই, গাড়ির ক্যাসেট-প্লেয়ারে ক্যাসেটটা ঢুকিয়ে দিল দু আঙুল দিয়ে আলতো করে ঠেলে। বাঁ হাতে।

গান বেজে উঠল :—“ব্যারিলিকি বাজারমে ঝুমকা গীড়া রে। ওঃ ঝুমকা গীড়া রে।”

ক্যাসেটটা অজাইব সিং-এর নিজেরই। ডিউটি সেরে বাড়ি যাবার সময় প্রতি রাতে গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রেখে যায়। মেমসাহেব ও বাবাদেরও অনেক ক্যাসেট আছে, গাড়িতেই রাখা। বেশিই ইংরিজি গানের। সেগুলোতে হাত দেয় না ও। যা কিছু ওর নিজের নয়, তাতে হাত দেওয়া ও নিজেই পছন্দ করে না। তাই-ই ইদুরকার সাহেবের তাদের মেমসাহেবের সঙ্গে এই রহস্যজনক আচরণ তার চোখে মোটেই ভাল ঠেকে না।

কিছুক্ষণ বাঁ হাতে স্টীয়ারিং ধরে গানের সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের আঙুল দিয়ে গাড়ির ছাদে তাল দিল অজাইব সিং। তারপর হঠাৎই প্লেয়ার বন্ধ করে দিয়ে দুখীর দিকে ফিরে বলল : আববে, এ দুখীয়া, অব জিলাইবী খাইবি? ঔর মালাই ভি পীবী? চল।

দুখী অন্যমনস্ক ছিল।

চমকে উঠে বলল, জিলাইবী? মালাই? কাহে? নহী, নহী…। হামারা পেট গড়বড়াগিয়া। চলো, তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে আমরা বাড়ি ফিরে যাব। সত্যিই আমার শরীর ভাল নেই। ঘরমে ১৭০

বহতই কাম হ্যায়।

-–টেন্স গলায় বলল দুখী।

কাম? ছেঃ! কাম ক্যা রে ওড়া-পুত্তা? কাম-ফাম কুচ্ছো নহী। গাদ্ধা কাঁহাঁকা! চল চল গরমাগরম জিলাইবী ঔর মালাই খানেসে গড়বড়-সরবড় ঠিক হো জায়গা বিলকুল।

অবাক গলায় দুখী বলল, এখন জিলাইবী খাবে কী তুমি? আগে মাছ। মাছের খোঁজে চলো সিং সাহাব। ক্যাঁটলা মাছ।

ছাড় তোর ক্যাঁটলা মাছ।

তাচ্ছিল্যের গলায় বলল অজাইব সিং।

সে কী? গরম মশলা, মাছ; কাস্টার্ড, এসব কিনতে হবে না?

গুল্লি মার বে ওড়াপুত্তান। অ্যাইসেহি কাফি গরম হ্যায়। গরম মশলাকা কওন জরুরৎ?

গাড়ির ক্যাসেটে আবার গান বেজে উঠল :

“ব্যারিলিকি বাজারমে ঝুমকা গীড়া রে…

অজাইব সিং ভাবছিল যে, তাদের সাহব মানুষটা একটা বড় বে-আক্কেল, গাণ্ডু। পাগলা-ঘোষষা। সংসারে জরু আর গরু যে শক্ত হাতে সামলে রাখতে হয়, এ কথাটাই সে জানে না। দিন-দুপুরে নিজের ঘরে মুরগি-মারা চলছে, আর সেই ভোলে-ভালা মানুষটার কোনও খেয়ালই নেই। সাবীর মিঞার জুতোর দোকানে বসে হয়তো বেকামকা বাত করে চলেছে এখন। পান থুকছে। মজাক ওড়াচ্ছে। অজীব আদমী। সামুচই অজীব আদমী। খ্যায়ের। বড়া আদমীদের বাতই আলাদা! উনলোঁগোঁকো বেকুবীভি অজীবই হোতা হ্যায়।

ঝড়ের মুখের উক্যালিপটাসের মতো শরীরে মনে আন্দোলিত হতে লাগল রুষা। সত্যিই ঝড়েরই মতো ঢুকেছিল ভিনোদ গাড়িটা পার্টিকোতে রেখে। ওর চোখ মুখ উদভ্রান্ত। ড্রয়িংরুমের দরজা খোলা রেখে রুষা দরজার পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ঢুকেই, ভিনোদ ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। তার রুক্ষ, উষ্ণ ঠোঁট দিয়ে শুষে নিতে লাগল রুষার নরম ঠোঁটের সমস্ত স্নিগ্ধ সিক্ততা। রুষার মনে হল যেন দীর্ঘ তপ্ত গ্রীষ্মের পর প্রথম বৃষ্টি নামল। ভাল লাগায়, ভরন্ত কলসের মতো ভরে উঠতে লাগল ও। দ্রুত।

কিন্তু মুখে বলল, আঃ কী করছ কী! লাগে…লাগে…ভাল্লাগে না…অসভ্য।

তখন অজাইব সিং-এর গাড়ির ক্যাসেটে গান বাজছিল উঁচুগ্রামে : ব্যারিলিকি বাজার মে ঝুমকা গীড়া রে,…

“ঝুমকা গীড়া রে।

ওঃ।

ঝুমকা গীড়া রে। ঝুমকা। ঝুমকা গীড়া রে।
ব্যারিলিকা বাজার মে ঝুমকা গীড়া রে…
সাঁইয়া আয়ে নয়ন ঝুঁকায়ে ঘরমে চোরি চোরি/ বোলে, ঝুমকা ম্যায় পেনাদু, আযা বাঁকি ছোরি
ম্যায় বোলি না :ন ন্না না বাবা! না কর জোরাজোরি…
ওঃ ঝুমকা গীড়া রে…
ব্যারিলিকি বাজার মে ঝুমকা গীড়া রে…।”

দুখী অবাক হয়ে গান শুনতে লাগল। পরের জন্মে ও সিং সাহাবের মতো ড্রাইভার হবে। এতক্ষণ ওর পেট গড়গড় ছিল। এখন মনে হচ্ছে মাথাও গড়বড় সড়বর হয়ে যাবে।

অজাইব সিং বলল, ঘাটে যেতে হবে না। কোথাওই যেতে হবে না। চল বাজার থেকে জিলাইবী আর মালাই খেয়ে বাড়ি ফিরে যাই। তুই কি দুধ পীবী? বাড়ি ফিরলে তুই বলবি যে, পথে টায়ার-পাংচার হয়ে গেছিল, স্টেপনীতেও হাওয়া ছিল না। দেরি হয়ে গেল বলে ফিরে এলাম। দেখিস, মেমসাহেব কিছুই বলবেন না।

ছেলেমানুষ দুখী রেগে বলল, ওয়াহ। অজীব বাঁতে কর হে হে আপ। রাতে মেহেমান আসবে যে! খাওয়া-দাওয়া হবে বললেন না মেমসাব। মাছ না আনলে…

তুই চুপ কর তো উঁওড়াপুতা। ভদ্রলোকেরা দু ঠ্যাঙের চিকনি-লোম-এর নরম মুরগি খেতেই ভালবাসে। পাড়হেন, ঘেঁওড়া, মুজরী এসব মাছ ছোটলোকেরাই খায়।

গান বাজতে লাগল আবার…

“হাম দোনোকো ঘাবড়ার মে ঝুমকা গীড়া রে…”

রুষার সমস্ত শরীর, ওর দু হাঁটু, থরথর করে কাঁপতে লাগল। কান দুটি ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। ওর শরীরের ঝাঁটি-জঙ্গলে এত তাপ জমে ছিল যে, তা জানা ছিল না ওর নিজেরও। হিমবাহ গলে যেতে লাগল দ্রুত তীব্র-জ্বালার উষ্ণ লুতে।

ওকে জড়িয়ে ধরেই বেডরুমে এল ভিনোদ, পা দিয়ে ড্রয়িংরুমের দরজা লাথি মেরে বন্ধ করে।

অনেকই কথা বলার ছিল তাকে রুষার। বুঝিয়ে-সুজিয়ে, দাম্পত্য সম্পর্কর পবিত্রতা, সৌন্দর্য, অনাবিলতা, এসব বিষয়ে স্নিগ্ধ জ্ঞান দেবার ছিল। ও ভেবেছিল বলবে যে, বিনু, তুমিই আমার জীবনের একমাত্র আনন্দ, এই একঘেয়েমির, ক্লান্তির বিষণ্ণতার দমবন্ধ ঘরের লাগোয়া একফালি আলো-হাওয়ার বারান্দা তুমি। শরীরকে এর মধ্যে টেনে এনে এমন সুন্দর সম্পর্কটিকেও নষ্ট করে দিও না। ভেবেছিল, বলবে; শরীরের মধ্যে কিছু নেই ভিনোদ। সত্যিই কিছু নেই।

কিন্তু…

অসুন্দর শরীর কিন্তু কখনও কখনও বড় চকিতে কাজ করে। সুন্দর মন সময় সময় তার নাগালও পায় না হাত বাড়িয়েও। সেই ছুটন্ত ফেরারি শরীরই হয়তো পরক্ষণে অনুতাপে ক্লিষ্ট হয়ে মনের পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদে ফুলে ফুলে। এমনই ঘটে। এই সবই ঘটনা। আমরা কেউই ভগবান নই। মানুষ। বড় সাধারণ, ভঙ্গুর, বড় অসহায়, মানুষ-মানুষী আমরা এই দ্রুতগতি জীবনের সঙ্গে বাঁধা-থাকা ইচ্ছাহীন, মনহীন, শরীরহীন সব গাধা-বোটগুলি।

রুষা ভাবছিল নীরবে।

এতসব, আসলে, তখন ভাবার সময় পায়নি রুষা। শরীর যখন শরীরের উপর দখল নেয় তখন ভয়-পাওয়া কাঠবিড়ালির মতো মন তার মনের পাতার গভীরে লুকিয়ে পড়ে একটু পরেই, স্বমহিমায় প্রকাশিত হবে বলে।

বেডরুম-এর দরজার গডরেজের লকটাকে কট শব্দ করে বন্ধ করল ভিনোদ। রুষার বুকের মধ্যে ভয়-মিশ্রিত-উত্তেজনা-জনিত এক ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। ওর জীবনের একটি কুঠুরি, বড় সুন্দর, বড় স্বপ্নের কুঠুরিটি থেকে কে যেন তাকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কট শব্দ করে সেই নিভৃত কুঠুরিই দরজা বন্ধ করে দিল।

কে?

নিয়তি?

না মেনে উপায় নেই। রুষা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ কত বছরের কত কষ্ট দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। হেরে গেল আজ। রুষা হেরে গেল।

পৃথুর ঘরে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বই আছে একটি। কবিতা-টবিতা পড়ে না রুষা। বইটির নামটিই শুধু চোখে পড়েছে বারবার। ‘প্রভু, নষ্ট হয়ে যাই’।

নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রুষা।

নষ্ট। রুষা কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? রুষা শুধোল। নিরুচ্চারে। রুষাকে।

বাগানে জল তুলছিল মেরী, লাটাখাম্বার ক্যাঁচোর-কোঁচোর বিষণ্ণ নিচু, মন্থর একঘেয়ে শব্দ ভেসে। আসছিল। এস ডি ও সাহেবের সাদা অ্যালসেশিয়ানটা হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঁচুগ্রামে ডাকছিল। চামারটোলিতে মাদল বাজছিল ধ্রাম। ধ্রাধাম! ধ্রাধাম! ধ্রাধাম। ধিড়কু ধরাক। ধুনক ধুনক।

কেউ মরেছে বোধহয় চামারটোলিতে। কে মারা গেল? কোনও নারী কি? কোনও নারী কি নষ্ট হয়ে গেল?

মাদল বাজছিল ব্রাধাম ব্রাধাম। ধ্রাম।

মৃতদেহ নিয়ে আসছে ওরা শোভাযাত্রা করে। দূর থেকে তার শব্দ ভেসে আসছে। মরে যাচ্ছে রুষাও। কত্বরকম মরণই আছে এ সংসারে। রুষার স্বপ্নের সুগন্ধি বীজগুলিকে নিয়ে তুলো পিজছে ভিনোদ। শরীরের গোপন স্নিগ্ধ সুগন্ধি প্রান্তরের নিভৃত কুঁড়িগুলিকে ছিড়ছে কুচি কুচি করে। মাদল বাজছে, মাথার মধ্যে। ধিড়ক ধড়াক। ধনুক ধনুক। ধিড়কু ধড়াক। ধ্রাম। ধ্রামাধাম। ধ্রাধ্রাম।

হঠাৎই রুষা তার বুক থেকে ভিনোদের হাত সরিয়ে দিল। ধাক্কা দিয়ে।

অস্ফুটে বলল, এই! হাত দিও না। প্লীজ!

কেন? রুষা! তুমি তো আমারই! তুমি কি আমার নও? তোমার সমস্ত তুমি?

কথা বোলো না। দিও না হাত।

মনে মনে বলল, আমার সমস্ত আমিকে কেউই পাবে না। আমরা টুকরো টুকরো। প্রত্যেক মানুষই ভেঙে গেছে ভিনোদ। এক টুকরো দিয়েই এক টুকরো পাই। যে-আমি পৃথুর, যে-আমি আমার ছেলে-মেয়ে মিলি-টুসুর; তাকে তুমি কোনওদিনও পাবে না। তা আমার দেওয়ার ক্ষমতারও বাইরে। এছাড়াও আরও অনেক ‘আমি’র টুকরো আছে আমার মধ্যে। সেসবই পাবে না। যতটুকু দিতে পারি ততটুকুই নাও। আর কিছু চেও না।

ভিনোদের কথাটা কেমন জড়ানো মনে হল রুষার। এ কি আনন্দেরই ঘোর? মনে হল, খুবই নেশাগ্রস্ত ও। আবিল হয়ে রয়েছে ভিনোদ। পুরুষরা অনাবিলভাবে, সুস্থতার সঙ্গে কোনও সুন্দর কিছুই কি পেতে শেখেনি জীবনে?

ভিনোদের নেশা হয়েছিল। আধঘন্টার মধ্যে টকাটক চারটে পিংক-জিন খেয়ে এসেছিল সে। সোয়াবিন এক্সট্রাকশন প্ল্যান্টটার প্রজেক্ট রিপোর্ট অ্যাকসেপটেড হয়েছে। ব্যাঙ্কের বড় সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছে। ভিনোদ সেলিব্রেট করতে চেয়েছিল এই অকেশনে। পুরুষের সেলিব্রেশানে নারী-শরীর এক অপরিহার্য অঙ্গ। চম্বলের অনেক ডাকাতই নিপুণ সফল ডাকাতির পরই নিষিদ্ধ পল্লীতে গিয়ে জোটে ভারতের সর্বত্র। চোর, ডাকাত, গুণ্ডা, অত্যাচারী, ঘুষখোর, দালাল সব পুরুষই নারী-শরীরে অবৈধভাবে গিয়ে তার পৌরুষের আদিমতম, কদর্য, ঔদ্ধত্যকে নতুন করে অনুভব করতে চায় শিরায় শিরায়। তাদের নিজের নিজের গোপন পাপবোধ থেকেও বোধহয় মুক্ত হতে চায়।

ভিনোদও কি তাই-ই চাইছে?

রুষার ভীরু, সাদা পায়রার মতো বুকের দিকে চেয়ে ভিনোদ বিড়বিড় করে শায়ের আওড়াল। পিংক-জিন-এর এবং রুষারও নেশার দারুণ ঘোরে।

“নীগাহ যায়ে কাঁহা সীনেসে উঠকর?
গা তো হুসনকি দওলত গড়ী হ্যায়।”

শাপগ্রস্তা, প্রস্তরীভূতা দেবীর মতো দেখাচ্ছিল তখন, আনন্দে এবং পাপবোধে নিথর রুষাকে। তবুও ওর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।

কিন্তু আধ ফোটা হাসিকে ফুটতে না-দিয়ে ও বলল : অসভ্য।

ভিনোদ রুষার স্তনসন্ধিতে মুখ রেখে ভাবছিল, মেয়েদের মুখের ‘অসভ্য’ কথাটার মতো এত বড় কমপ্লিমেন্ট আর হয় না।

রুষা ভাবছিল, খুব সুন্দর শায়েরটি কিন্তু। চোখ, নারীর বুক ছেড়ে আর কোথায়ই বা যাবে? সুন্দরীদের সব সৌন্দর্য তো বিধাতা ওইখানেই গড়ে রেখেছেন।

আজ আর কী সৌন্দর্য বাকি আছে! মেঘে মেঘে বেলা যে অনেকই হল। রুষারও একটি শায়ের মনে এল। “খণ্ডেহার বাতাতি হ্যায় ইমারত বুলন্দ থা।” প্রাসাদ যে একদিন অনুপমই ছিল, আজকের এই ধ্বংসাবশেষই তার প্রমাণ।

মনে এল। কিন্তু বলল না। সবকিছুই ব্যক্ত করতে ওর রুচিতে বাধে।

সীলিং-এর নিশ্চল ফ্যানের দিকে চেয়েছিল ও। এ-ঘরে এয়ারকণ্ডিশনারও আছে। তবে এসব কোনও কিছুই সেপ্টেম্বরের পর থেকে আর দরকার হয় না। বাঁ দিকের দেওয়ালের মাথার দিকে হালকা ঝুল পড়েছে। ঝাড়তে বলবে দুখীকে। একটা সাদা, সুন্দরী কৌতূহলী টিকটিকি চেয়ে আছে ওদের দিকে। কী ভাবছে, কে জানে?

হাই তুলল রুষা একটা। যত অসময়েই কেন যে ওর হাই ওঠে! বোঝে না।

বাগানের পেঁপে গাছে কাক ডাকছে। অসভ্য, কুৎসিত-দর্শন দাঁড়কাক একটা। রুষার এই মুহূর্তের খুশিতে দাঁড়কাককেই মনে হচ্ছে স্বর্গের পাখি। হেমন্তর কচি-দুপুরের রোদের গন্ধ, ধুলোর শালীন গন্ধ, রোদ ঝলমল গাছপাতার ক্লোরোফিলের গন্ধ, স্বচ্ছ উষ্ণতার ভাপ-এর সঙ্গে ভেসে আসছে ওর নাকে। সবুজের এই শান্ত স্নিগ্ধ সমারোহের মধ্যে, এই বিচিত্র হরজাই শব্দমঞ্জরীর ও গন্ধপুঞ্জর ঝুমঝুমির মধ্যেই রুষার দু চোখের মণি আস্তে আস্তে তরমুজ-এর বুকের রক্তের মতো লাল হয়ে এল। শরীরের সব রক্তই যেন হঠাৎ দৌড়ে এল দু চোখে চোখকে রাঙাজবা করে তুলবে। বলে। দৌড়ে এসে, আনন্দই যেন বলল; পৌঁছে গেছি! এই যে, পৌঁছে গেছি!

ভিনোদ জামাকাপড় পরে বেডরুম থেকে বেরিয়ে যেতেই রুষা ঘর লক করে বালিশের উপর এলিয়ে দিল নিজেকে। ইনোসেন্টলি। ওর মধ্যে এক তীব্র আনন্দ এবং হঠাৎ আসা তীব্রতর অপরাধবোধ মিলেমিশে গিয়ে ওর লাল-হওয়া চোখ ফেটে নীল জল গড়িয়ে গেল গাল বেয়ে। একেবারে হঠাৎই। বালিশ ভিজে যেতে লাগল। বড় ঘুম পেল ওর।

কিছু কিছু শ্রান্তি আছে, কুসুমগন্ধী ক্লান্তি আছে; যা পরম প্রার্থনার। এমন শ্রান্ত ও ক্লান্ত হতে ইচ্ছে করে রোজই…। কিন্তু…।

রুষ ভাবল, আজ তার স্বামী, তার ছেলেমেয়ে, তার প্রেমিক, তার সংসার সকলের, সবকিছুর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে ভীষণ ভীষণ ভীষণই ঘুমোবে। ওর তিরিশটি বছরের জীবন থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হয়ে ও বিযুক্তির ঘুম ঘুমোবে। জাগবে, যখন ওর নিজের খুশি।

ঘুমিয়ে পড়েছিল।

অনেকক্ষণ ঘুমঘোরের মধ্যেই শুনতে পেল, চামারটোলির শব্যাত্রীরা ওদের বাংলোর প্রায় সামনেই এসে পৌঁছে গেছে। এখন মাদলের শব্দে কান ফাটার উপক্রম। বাইরে অপরিচিতা এক নারীর শব চলেছে জীবন্ত হয়ে কাঁধে-তোলা চৌপায়ের উপর আলতো হয়ে নাচতে নাচতে আর ঘরের ভিতরে অন্য এক শবেরই মতো নিথর হয়ে পড়ে আছে রুষা। আরেক নারী। জীবন্ত, অথচ মৃতর চেয়েও মৃততর।

জানালার পর্দার উপরের ফাঁক দিয়ে শীত-দুপুরের রোদ এসে পড়েছিল এক চিলতে। হঠাৎই রুষার চোখ পড়ল দেওয়ালে, যেখানে পৃথুর ফোটোখানি বাঁধানো অবস্থায় ঝুলছিল। বিয়ের পরে পরেই তোলা। পরমা সুন্দরী রুষার সুন্দর ছবি, তার অসুন্দর স্বামীর সঙ্গে। পৃথুর চোখের দিকে চোখ পড়তেই, কী যেন হয়ে গেল। ও বালিশে মুখ দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। হঠাৎ। শব্দ করে। বালিশের মধ্যে কান্নাটাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার চেষ্টা করল প্রাণপণে। একটু পরই বাইরে গাড়ির হর্ন বাজল। অজাইব সিংরা ফিরল বোধহয়। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বেডরুমের দরজা খুলে দিল। বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে এল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিক করল। নতুন করে লিপস্টিক লাগাল। শাড়ি জামা ঠিকঠাক করে নিল।

ভিনোদ ফোনে তার সঙ্গে কত কাব্যিই না করল। তার শাড়ি, জামা, কাজল, পারফ্যুম নিয়ে। কিন্তু কাছে যখন এল, ঝড়ের মতো; তখন তাকেও একটা জন্তু বলেই মনে হল। সব পুরুষের কাব্যিই বোধহয় ছল; ছুতো। এমনই। এসব নিতান্তই সস্তা শৃঙ্গার। পুরুষের আদিম অসভ্য বন্যতা, তার ক্ষুধার্ত বুনো কুকুরের সত্তাকে আশ-মিটিয়ে পেটপুরে খাওয়ানোরই উপক্রমণিকা মাত্র। ছিঃ ছিঃ। চলে যাওয়ার সময় একটা চুমু পর্যন্ত খেয়ে গেল না ভালবেসে! শার্ট-এর বোম আটতে আঁটতে দৌড়ে পালিয়ে গেল ভীত কুকুরের মতো। আশ্চর্য!

সমারসেট মম ঠিকই লিখেছিলেন। “ওল মেন আর পিগস।”

রুষা ভাবল।

রিয়্যালী, ওল মেন আর পিগস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *