1 of 2

২৩. শীতটা এবার বেশ জাঁকিয়ে পড়বে

শীতটা এবার বেশ জাঁকিয়ে পড়বে মনে হচ্ছে।

কার্তিকের শেষ। আজ লীটি খেয়েছিল ঠা রাতে। বেগুনভাত্তা দিয়ে। পালামৌ থেকে দারোয়ান মুনাব্বর সিং-এর রিস্তেদার এসেছে। সে জাতে ছত্তিশগড়িয়া হলে কী হয়, পালামৌতে এক বাঁশের ঠিকাদারের কাছে কাজ করেছে বহুদিন হল। তাই ছাতুর লীট্টি, মাখনী ইত্যাদি নানারকম বিহারী খাবার রাঁধতে শিখে এসেছে। ছাতুর লীট্টির মধ্যে আবার গরম গাওয়া ঘি ঢেলে দিতে হয়। জবজব করে।

খেয়েছে তো জমিয়েই, কিন্তু ছোকরাদের পেট আর ঠুঠার পেট! পেট একেবারে পাথরের মত ভারী হয়ে রয়েছে।

আজ ওর অফডে, রাতে ডিউটি নেই। থাকলে, তাও হাঁটাহাঁটি করে হজম করার সুবিধে হত।

খাওয়াদাওয়ার পর একটা চুট্টা টেনে কোয়ার্টারে এসে শুয়েছিল। ওর কোয়াটারে ও একাই থাকে। ঘরটা বেশ বড়ই। কুয়োতলাও কাছেই। মস্ত আমগাছ আছে একটা প্রায় মাথার উপরে, ছাতা ধরে। ঝাঁকড়া গাছ, যদিও আমের স্বাদটা একেবারেই ভাল নয়। গরমের সময় দুঃসাহসী ভাল্লুক কম্পাউন্ডের পেছনদিকের কাঁটাতারের বেড়া টপকে আম খেতে চলেও আসে কখনও কখনও। কর্তৃপক্ষ, ভালুকের চেয়ে মানুষকে বেশি ভয় পান বলেই মানুষ যেদিক দিয়ে ঢুকতে পারে সেদিকটাতে উঁচু দেওয়াল দেওয়া আছে। জঙ্গলের দিকে শুধুই কাঁটাতারের বেড়া। গরমের রাতে খুব সাবধানে ডিউটি করতে হয়। ভাল্লুকের সঙ্গে কুস্তি লড়তে কোনও লোকই চায় না। ভাল্লুক, জঙ্গলের লোকের সবচেয়ে বড় অমঙ্গল। বিনা কারণে, খামোখা যার তার সঙ্গে কুস্তি-লড়তে-চাওয়া এমন জানোয়ার জঙ্গল-পাহাড়ে নেই-ই বলা চলে। গরমের দিনে, আরও থাকে সাপ।

ঠুঠা বাইগা, পৃথুর পেয়ারের লোক বলে, প্রত্যেক দারোয়ান, ঝাড়দার, নাইট ওয়াচম্যান ড্রাইভার সবাই-ই ওকে একটু সমীহ করে চলে। ঠুঠাকে সমীহ করা, পৃথুকে ভয় পাওয়ার কারণে নয়। পৃথুকে কেউই ভয় পায় না। সংসারে যে মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা নেই তাকে কেউই ভয় করে না আজকাল। ক্ষতি করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যে মানুষ ক্ষতি করে না কারও, তাকে “মানুষ” বলেই পাত্তা দেয় না কেউ। পৃথু বা “পাগলা ঘোষাকে” কেউই ভারী অফসর বলে মনেই করে না। ও বরং ওদেরই একজন কেউ। ভয়-ভক্তি করে না, কিন্তু একরকমের ভালবাসা বাসে, সে ভালবাসার রকমটা ঠিক কী, তা ব্যাখ্যা করা যায় না। আপন এবং পরকে ভালবাসার মাঝামাঝি এক রকম অনুভূতি সেটা। প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসা খারাপবাসার মাঝামাঝি কোনও বাসা।

গেটের কম্পাউন্ডের চারদিকের মাকরী ভেপার ল্যাম্পগুলো জ্বলছিল নীল স্বপ্নের মতো, শীতের রাতে ঘন সবুজ জঙ্গল আর নীল কুয়াশার কাঁথা জড়িয়ে নিয়ে গায়ে। আলো এসে পড়েছিল ঠুঠার আলো-নেবানো ঘরের একটিমাত্র কপাট-খোলা জানালা দিয়ে। হাঁপানির মতো এক উপসর্গ দেখা দেয় ওর শীতকালে। প্রতি বছরই। এসব ছিল না যতদিন খামারে-জঙ্গলে থাকত। কিন্তু এই কারখানায় থাকতে থাকতেই আরম্ভ হয়েছে এ সব। পৌষ এবং মাঘেই শুধু সব জানালা বনধ করে ঘুমোয় ঠুঠা। অঘ্রান মাস অবধি এই একটি জানালা খোলাই থাকে, সারা রাত। না-থাকলে, দমবন্ধ লাগে। বুকে হাঁপ ধরে।

অফ-ডিউটির রাত ছাড়া অবশ্য ঘুমোবার সুযোগই পায় না ও বিশেষ। রাতে জেগে থাকে, দিনে ঘুমোয়। পুবে আলো ফুটলেই ওর কাজ শেষ। শীতে, গ্রীষ্মে, বর্ষায়, কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে লাটাখাম্বা নামিয়ে দিয়ে বড় বাল্টি করে জল তুলে ঝপাং ঝপাং করে চান করে। নিজে হাতে দুটি রুটি আর তরকারি বানিয়ে খায়। চা কোনওদিন খায়, কোনওদিন বা খায় না। তারপর শীতকাল হলে আমগাছের ছায়ার বৃত্তের বাইরের রোদে চৌপাই টেনে এনে শোয়।

রোদের দিকে বন্ধ চোখে তাকালে রামধনু দেখে, ছোটবেলায় নর্মদার উপরে যেমন দেখত বর্ষার দিনে। টিকেরিয়া আর মালার মধ্যের নর্মদাতে। গরমকালে, পুরনো আমের ছায়ার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে চৌপাইটি লাগিয়ে শুয়ে পড়ে ভোরের মিষ্টি হাওয়ায়। গরমের ভোরের হাওয়াকে খুব ভালবাসে ঠুঠা। তখন বার্জার-এর তীরের গভীর জঙ্গলের মধ্যে বান্‌জারী”র কথা মনে পড়ে যায় ওর।

জীবনটা একেবারেই অন্যরকম হয়ে গেল। ভাল লাগে না। আবারও কয়েকদিনের জন্যে হঠাৎ ভেগে পড়ার সময় হয়েছে। কেটে পড়ার। মুক্তিতে দেখা হওয়ার পর দেবী সিং বলেছিল, আসবে হাটচান্দ্রাতে। কিন্তু আসেনি। আসবে কী করে? ও সাজানা সাহেবের ডেরায় থাকে এখন। আর, মুৰ্জীটোলি বস্তিতে ওর পরিবার থাকে। ছেলের এবং মেয়ের ঘরের নাতি-পুতিসমেত মস্ত সংসার তার। জলকাদাতে লেপ্টে, থেবড়েসা বেদের মতোই অবস্থা ওর। ঠুঠার মতো স্বাধীন, ওর জানাশোনা মানুষদের মধ্যে একজনও আর নেই। ওর নানারকম কষ্টের মধ্যেও ও যে স্বাধীন এ কথাটা মনে করে ওর খুব আনন্দ হয়। দুঃখের মধ্যে একমাত্র দুঃখ “বান্‌জারী” হারাবার দুঃখ। গ্রামটাকেই যদি খুঁজে বের করতে না পারে, যদি আবার না গিয়ে দাঁড়াতে পারে ওর জন্মভূমিতে, ওর ছেলেবেলায় খেলার দিনের ছায়া-রোন্দুরে, তবে বেঁচে থেকে লাভ কি? মরার আগে তার শিকড়কেই শুধু খুঁজে বের করবে না ঠুঠা, শিকড় উপড়ে ফেলবে বুনো শুয়োরের মতো দাঁত দিয়ে, নরম সুগন্ধি মাটি ফালাফালা করবে, তার জন্মস্থানের গন্ধ নেবে নাক ভরে। জন্ম দেবে নিজেকে নিজেই; নতুন করে। রামখিলাওন দুবের মতো ও-ও দ্বিজ হবে।

তারপর মরলেও সুখ!

যার শেকড় নেই; তার কিছুই নেই। শীতে-ফোটা গন্ধা ফুলেরও শেকড় থাকে। যদিও তারা বহতা বানজারা নদীর পাথর-ভরা চিল-ছিপা জায়গাগুলোর মধ্যে মধ্যে মৃদুস্রোতা অথবা প্রায়-থির জলেই ফুটে থাকে। গন্ধালারদেরও শেকড় আছে, এমনই হল যে তারই শুধু নেই। তা হবে না। খুঁজে সে বের করবেই।

পেট, প্রচণ্ডই গরম হয়েছে। ছাতুর লীট্টি খেয়ে আঁই-ঢাঁই করছে শরীর। লীট্টি খাওয়ার আগে ভাঙও খেয়েছিল। ভাঙ-এর সরবৎ

হাটচান্দ্রার ওরা তো খায়ই, বিহার উত্তরপ্রদেশের মানুষরাও খুবই খায়। এই কারখানাতে এসেই, এসব দোষ হয়েছে ওর। নিজে নিজের মতো না থাকতে পারলে থাকার কোনও মানেই নেই। সে থাকা না থাকা সমান। পাঁচরকম মানুষের সঙ্গে মিশতে নেই; ঠুঠার ঠুঠাত্ব একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল জঙ্গল ছেড়ে এসে। জঙ্গল, জঙ্গলই; জংলি মাত্রই জানে। তার কোনও বিকল্প নেই। জংলির আসল জায়গা জঙ্গলেই।

ঘুম আসছে না কিছুতেই।

নানা কথা, ছোটবেলার কথা, নানা গন্ধ, বাঘের গায়ের গন্ধ, নানা শব্দ, অমাবস্যার রাতের হুতোম পেঁচার ডাকের শব্দ ঘন বনের গভীর রাতের দূরের শটগানের চকিত গম্ভীর শব্দেরই মতো তার চেতনাতে ফিরে ফিরে আসছে। অবচেতনও, বর্ষাকালের কানহার জঙ্গলের গভীর শালবনের নীচে নীচে ফোটা অজস্র কুকুরমুত্তা ব্যাঙের ছাতার মতোই ভরে যাচ্ছে, মাথার এক এক কুঠুরীতে দশটি দশটি করে, শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে, লক্ষে লক্ষে। সাদা, কালো, লালচে, খয়েরী। কত রঙ তাদের। আকাশে কালো, শালবনে কালচে সবুজ আর শালবনের পায়ের কাছে রঙ রঙিনা গরম আলোর কুকুরমুত্তা।

পুরনো সাজা গাছের নীচে দেব-দেবীরা কথা কন ঠুঠার স্বপ্নে, কখনও মেঘগর্জনের মতো গুড়-গুড় স্বরে; কখনও বা বাঁশপাতি পাখির গলার স্বরেরই মতো, মিষ্টি মিহি দূরের সুরে।

ঠুঠা বাইগা আসলে, নামেই বাইগা। তার ছোট্টবেলায় বান্‌জারী’ হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে সে গোঁন্দদের বস্তিরই পাশে পৃথুর বাবার জঙ্গল-খামারে মানুষ হয়েছে। তার শেষ কৈশোরের পর থেকেই আজ অবধি গোঁন্দদের সঙ্গে তার মেলা-মেশা, ওঠা বসা। আসলে ও গোঁন্দই হয়ে গেছে। ‘বান্‌জারী’র অন্য আর একটিও মানুষকে সে খুঁজে পায়নি। কোনও পরিবারের কোনও একজনকেও না।

কী হল? কে জানে? সবাই-ই কি একই সঙ্গে মরে গেল? সবাইইকে একই সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে গেছে বিস্মৃতির ধুলোর মধ্যে? নিজের সমাজ ও পরিবারের মধ্যে ঘনসন্নিবিষ্ট হয়ে যে থাকল; সে থাকল না। যদি না সেইভাবে থাকল, এবং বিয়েও যদি না করল তাহলে সব মানুষই ভেসে যায় কচুরিপানার মতো। ঠুঠা ভাবে, চৌপাইয়ে এ পাশ ও পাশ করতে করতে। আশ্চর্য। এমনকি গান্ধালা ফুলদেরও শেকড় থাকে। অমন মানুষেরা তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই চিরদিনের মতো হারিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায়। এতসব ভাবে বোঝে, তবু ইদানীং মাঝে মাঝেই ঠুঠার বড় কষ্ট হয়। নিজের জন্যে। বিশেষ করে, যখন শরীর টরীর খারাপ হয়। বিয়ে করলে ও একটা ঝুপড়ি আমগাছেরই মতো ডালপালা ছড়িয়ে, পাতার ছায়ার আর চামরের নীচে ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে বাঁচতে পারত। পা-ছড়িয়ে, ঘরের দাওয়ায় বসে চুট্টা খেতে পারত, মহুয়া খেত; দিল খুশ করে। একটা নাতি পা টিপত, অন্য নাতির নাত বউ মাথা চুলকে দিত। বিয়ে না করাটা, সময় মতো ভুলই বোধ হয় হয়ে গেল?

ঠুঠার বয়স এখন পঞ্চাশ হয়েছে, কিন্তু শরীরের বাঁধন তিরিশের মতো। বোঝার উপায়ই নেই। ও বুঝতে পারে যে, কোনও মানুষের জীবনেরই টাঁড়ে, বুদ্ধি বা জ্ঞান অর্জুন গাছের মতো যুগযুগ ধরে একপায়ে একই জায়গায় সটান দাঁড়িয়ে থাকে না। জংলি পলাশেরই মতো তারা চারা ছড়াতে ছড়াতে প্রতি বছরই সরে যেতে থাকে। নিজের পুরনো নিজস্বতাকে রোদের মধ্যে, বৃষ্টির মধ্যে ঠায় একা-একা দাঁড় করিয়ে রেখে চারিদিকে চারিয়ে-যাওয়া সবুজ সতেজ চারাদের মধ্যে নিজেকে চোরাচালান করে করে, নড়ে নড়ে, সরে সরে আসতে থাকে ক্রমান্বয়ে। নিজে সরাও যা, নিজের সত্তাকে সরিয়ে নেওয়াও তাই-ই।

এত্বসব বুঝত না হঠা, যখন বয়স কম ছিল। তখন বোঝেনি বলে, দুঃখ কিন্তু নেই তেমন। আজ অবশ্য বোঝে যে, এই-ই তো ঢের! যা হয়েছে, যা বুঝেছে; তাই-ই অনেক। বোঝাবুঝি যার শেষ হয়ে গেছে, যে স্থবির, অনড় বয়স গুনতে-ভোলা মেহগনি গাছ হয়ে অনন্তকাল ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে শুধু বড় থেকে বড়, তার থেকে আরও বড় হতে, হতে, হতে এত বেশি জীবন্ত স্পষ্ট ও চোখ-ধাঁধানো এক সময়-প্রহরী হয়ে যায় যে, সময় তাকে দীমক পোকার মতো কাটতে শুরু করে তার অজানিতেই। কিন্তু সময় দিয়ে সময়কে গুণ করলে, অথবা যোগ করলে, অথবা বিয়োগ করলে যে হাতে অনড় অচল সময়ই শুধু থাকে; একথা মানী মেহগিনিকে বোঝাবে কে? তাই-ই মান চায় না ঠুঠা, দাঁড়িয়ে থাকতে চায় না একই জায়গায়। নড়ে-চড়ে, সরে-সরে, নতুন সবুজ চারাদেরই মতো চারিদিকে চারিয়ে যেতে চায় সবুজ-সোনার মতো। জীবনে। এ জীবন থেকে অন্য জীবনে। অন্য জীবন থেকে, অনন্ত জীবনে।

অনেকই দেখেছে ঠুঠা। মৃতা হরিণীর উষ্ণ যোনির গোপন গন্ধ নিয়েছে নাকে। অতর্কিতে গুলি-খাওয়া মৃত্যু পথযাত্রী বাঘের ভয়হীন বুকের, বুক-ফাটা চকিত কান্নাও শুনেছে। মৃত্যুকে মৃতকে ও বারেবার নানাভাবে শীতলতর, মৃততর করেছে। সদ্যমৃত পুরুষ শিঙাল শম্বরের শুক্রকীটের ডাক শুনেছে। তার হাত ধরে তারা ডাইনির মতো ডেকেছে, বলেছে, আয়! আয়! আয়! সে ডাক শুধু নিজেই শোনা যায়, অন্যকে শোনানো যায় না; জীবনের অনেক গভীর গা-শিউরানো ডাকেরই মতো। ও জেনেছে যে, সৃষ্টি রক্ষা করতে পাহাড়-প্রমাণ শৌর্যের প্রয়োজন নেই, যা প্রয়োজন, তা সামান্য একটু দৃশ্যমান নৈকট্যর। সৃষ্টির শিকড়ের কাজটা একেবারে বড় নিঃশব্দেই ঘটে। শিকড়মাত্রই নিঃশব্দ পদসঞ্চারী। যখন প্রোথিত হয় তখন এবং যখন উৎপাটিত হয়; তখনও।

এত্ব সব কথা, ঠুঠা এইরকম ভাষায় স্বভাবতই ভাবে না। ওর ভাষাটা কাঠ-খোট্টা। মানুষটারই মতো। ভাষা, শিক্ষিত, শহুরে মানুষের। শিক্ষিত মানুষ মাত্রই যে অনেক ঘোরা-পথে চলে, ঘোরা-পথে ভাবে। ঠুঠার মুখের ভাষা অন্য, আর এ ভাষা শুধুই স্বপ্ন দেখার জন্য।

ঠুঠা অনেকক্ষণ তার তপ্ত জঠরের মধ্যের লীট্টি আর বায়গনভাত্তার সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছিল। জানালা দিয়ে সবুজে-নীল মাকরিী ভেপার ল্যাম্প-এর আলো তার কাঁচাপাকা খোঁচা-খোঁচা দাড়িময় রুক্ষ কিন্তু কুটিলতাহীন পবিত্র মুখে এসে পড়েছিল।

ঘুমের মধ্যে ঠুঠা বাইগা, দেবতা নাঙ্গা বাইগার সঙ্গে দেয়ালি করল একবার। নাঙ্গা বাইগীন দেখা দিল না।

তারপরই সে বিড় বিড় করে উঠল, ঘুমের মধ্যে। পুরনো দিনের মত গোপন মন্ত্র পড়ছিল ও।

“নাঙ্গা বাইগীন, নাঙ্গা বায়গা ধরতি ঠাকুর দেও, ঘামসান বাওয়া সওয়া লাখ বনস্পতি যো ম্যায় কাম করুত তো ওকর ডাহার মত যাবে।

র্ত তরফ না, ওকর, সে ঝেঁচ যাবে, মায়লে হুচ্ছো ঝেঁচ যাবে যো যো দাওয়ারিন বুচেলে কান পাকাড়ই হিচ্ছো লানবে, মোর সে আনবে, ওরসে ঝেঁচ যাবে।

মাইলে হুচ্ছো মোর ছোয়াবে তো তয় ম্যায় খানা পেঁহু, সিন্দুর, কাজর, একঠেড়নারিহার তোর চডহাবো আর মোরে সে গাড়া করাই দেবে, আর শের মাররাই দেবে, তায় এঠে লাল কুক্‌রা, এক ক্ষয়রা কুকরা, এক ক্ষয়েরী পিলে তোয় সেঁহু সঙ্করপাঠ হোবে তো সাহী গাড়া করবে।”

হঠাৎই ধড়মড় করে ঘুম ভেঙে উঠে বসল ঠুঠা তার চৌপাইতে।

ঈসস সর্বনাশ হয়ে গেছে!

শোনেনি তো কেউ? শুনে ফেলেনি তো একজনও? এ যে বোদেকে গাড়া করাবার, মানে, মোষকে বাঘকে দিয়ে মড়ি করাবার মন্ত্র! কুমারীর গোপনাঙ্গর মতোই অসুর্যম্পশ্যা, পবিত্র যে এ। জংলি শিকারীর অন্তরের অন্তরতম স্থানে থাকা গোপনতা। এ মন্ত্র, সে কী করে বলে ফেলল? জোরেই বলেছে কি? শোনেনি তো আর কেউই? হে বড়াদেব! হে নাঙ্গা বায়গা।

একটা চুট্টা ধরাল ঠুঠা, চৌপাইতে বসেই; শজারু-মাকা দেশলাই ঠুকে, ফসফস করে। চুট্টাটা ধরানোর পরই ওর রাগ হল খুবই ছাতুর লীট্টির উপর। গাল পাড়ল একটা। তারপর নিঃশব্দে অনেক গাল পাড়ল নিজেকেও। গালাগালের পাহাড় জমে গেল দেখতে দেখতে।

এসব গালাগাল কারখানার গালাগাল। ভারী অসভ্য, অশ্লীল, ভিনদেশি! দিগা শুনলে, তার বন্ধু পানকা ইতোয়ার শুনলে; লজ্জায় ঘেন্নায় মরে যায়! এই দেশে কলকারখানা না-হওয়াই বোধহয় ভাল ছিল। বায়গা, গোল, কুই, মারিয়া, ভূমিহার, ছত্তিশগাড়িয়ারা বনপাহাড়ের দেবশিশু সব।

ছিল অন্তত।

শহরের মানুষের যত্ব লোভ-দেখানো ব্যাপার আছে, জিগলিং-ঝিং-চ্যাক শাড়ি পড়ার লোক, ক্যাঁটকাটে রঙের নাইলনের বুক বাঁধুনি আর জাঙ্গি পরার লোভ, ট্রানজিস্টারের গোঙানির জন্য এই নির্লজ্জ কাঙালপনা ঠুঠাদের নিজস্ব সবকিছুকেই নষ্ট করে দিল।

সবই।

মরবে। সব মরবে। শালারা। সারা পৃথিবী মরবে। “বড়াদেব” সব দেখছেন, “মরাই” দেখছেন, ধারয়া, সাইআম, হয়াম, উইকে, কুসুরে সব দেব-দেবীই দেখছেন। কানা নন তাঁরা কেউই। নিস্তার নেই কারও। জঙ্গলের ছেলেমেয়ে সব নষ্ট হয়ে গেল হো!

চুট্টাটা ফেলে দিয়েই হাসি এল ঠুঠার মুখে। ওর মনে হল, হাসি দিয়ে পাকানো একটা নতুন চুট্টাই ধরিয়েছে ও। হাসির আগুন, হাসির ধুয়ো, চারিদিকে হাসির গন্ধ। কত পুরনো সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল ওর। স্বপ্নটা ওর স্মৃতির ঝুঁটি বড় জোরের সঙ্গে নেড়ে দিয়ে গেল। কত সব জঙ্গলের বন্ধুবান্ধব। পুরুষ-পুরুষ গন্ধ ভরা সময় ছিল; শব্দ ছিল। পুরনো। জান দিয়ে দেবে, কিন্তু দোস্তি দেবে না; এমন সব জিগরি দোস্ত। হীরা সিং বায়গা, লি বায়গা। হারামজাদা, কিন্তু জবরদস্ত শিকারি দেবী সিং। ঘঁা, দুশমন হো তো, অ্যায়সা!

ভাল লাগল খুবই ঠুঠার, সকলের কথা এমন হঠাৎ মনে পড়ে।

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল।

বিরক্ত মুখে ও বন্ধ দরজাটার দিকে তাকাল।

কে, তা জানে ঠুঠা!

উধম সিং সাহেবের বুড়ো-ড্রাইভারের ছুকরী বউ পুনিয়া বাঈ। রাতে ঠুঠা ঘরে থাকলেই, আসবে একবার। একই প্রশ্ন করবে। একই উত্তর শুনবে ঠুঠা বাইগার কাছ থেকে। শুনে, চলে যাবে। তবুও, আবার যেদিন ঠুঠার অফ-ডে থাকবে, কিংবা একা থাকবে ও রাতে ঘরে, সেদিন আসবেই। মেয়েটার জন্য কষ্টও হয়। ব্রাহ্মণের বউ। রামখিলাওন দুবে ড্রাইভার, করে না, হাটচান্দ্রাতে এমন নেশা নেই। ওর মধ্যের পুরুষ মানুষটা নিশ্চয়ই কুচো পাড়হেন মাছের মতো কুণ্ডলি পাকিয়ে সব সময় শুয়েই থাকে। বড়ই শীতকাতুরে, গরমকাতুরে, জলকাতুরে সে মাছ। পাখি ডাকলেও ওঠে বাঘিনী ডাকলেও না।

রাত আটটার পর দুবে মরেই যায় বলতে গেলে, নেশার ঝোঁকে। ওর আগের দু বউ ভেগে গেছে মাইহার থেকেই। মাইহারে বাড়ি দুবের। ছেলেমেয়ে নেই একটাও। এইবারে, এই তৃতীয় পক্ষ পুনিয়াবাঈ-এরও ভাগবার সময় হয়েছে বোধহয়।

ঠুঠা দরজা খুলল।

পুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে। শীতের মধ্যে। একটা শেয়াল-রঙা আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে। উঠা জানে যে, পুনিয়ার ঘোর লালরঙা শাড়ির নীচে আর কিছুই নেই। অনেকদিন ভেবেছে যে, দরজাটি বন্ধ করে, ওকে টেনে এনে খাটিয়াতে ফেলে পুনিয়া যা চায় তা ওকে কোঁচড় ভরে একদিন দিয়েই দেবে। কিন্তু ধর্মে বাধে। রামলিখাওন-এর সঙ্গে তার যে বড় ভাব। যখন নেশা না করে থাকে, তখন লোকটার মতো লোকই হয় না। অধর্ম, ঠুঠা করেনি কোনওদিনও। জেনে শুনে। ও নিজে যেটাকে ধর্ম বলে জানে, সেটাই তো ধর্ম তার কাছে। এতগুলো পাহাড়-উপত্যকার রোদ-চাঁদ-জল-ঝড়ের বছর নিজেকে এমন এমন অনেক পরীক্ষাতেই পাস করিয়ে এনেছে।

পুনিয়া বলল, থোরিসী দুধ হোগী? বড়হি জরুরৎ থী।

নহীলা! ম্যায় দুধকি কারবারী নহী…। ম্যায় আহীর থোরী হুঁ!

পুনিয়া এখুনি চলে যাবে। প্রতি রাতেরই মতো। মেয়েটার ধৈর্য অসীম। কিন্তু ঠুঠার ধৈর্যও কম নয়।

ঠুঠাকে দিগা পাঁড়ে শিখিয়ে দিয়েছে, “কো জগ কাম নাচার ন জেহী?” পরন্তু, “করত মনোরথ জস্ জিআ জাকে।” মানে জগতে কাম যাকে নাচায়নি এমন কে আছে? কিন্তু যার হৃদয় যেমন, তার ইচ্ছাও সেইরকমই হয়। লোকে লোকে তফাৎ থাকে।

পুনিয়া তখনও দাঁড়িয়েছিল। আবারও বলল, থোরীসি হোগী? দুধ…

ঠুঠা আবার বলল, এ! দেখ পুনিয়া ভাবী! হিয়া শেরকা দুধ মিল্ক। গাইয়া-বোদেকে নহী! চল। হঠ! বড়ী রাঅ ভইল।

পুনিয়া চলে গেল। রোজ একই রকম মুখ করে আসে, একই রকম মুখ করে যায়।

দিগা পাঁড়ে বলে, “জানি না জাই নারী গতি ভাই।” নারীর গতিপ্রকৃতি কিছুই জানা যায় না ভাই।

সত্যিই জানা যায় না। কোনওই সন্দেহ নেই।

পুনিয়া চলে যেতেই, ঘুম-ঘুম পেতে লাগল ঠুঠার। এতক্ষণে ছাতুর লীট্টির ভূত তাকে ছেড়েছে। বহু দিন আগে বাস্তারের অবুঝমার পাহাড়ের মারিয়াদের কাছ থেকে কম্বলটা কিনেছিল। দরজা বন্ধ করে, জড়িয়ে, শুয়ে পড়ে পাশ ফিরল। কম্বলের সঙ্গেও এক রকমের প্রেম হয়। সব শীতের রাতের পাখিরাই তা জানে।

ঠুঠা ভাবল।

মনে মনে বলল, সত্যি! অনেকই দিন হয়ে গেল, বাঘের দুধ খায়নি। খেয়েছিল, অবশ্য মাত্র একবারই। কানহাতে। বাজারের তীরে। কিন্তু এখন থাক সে গল্প। গল্প শোনাবার আছেটাই বা কে?

সেইসব বাঘের দুধের মতো খাঁটি দিনগুলোই সব চলে গেছে। ভেসে গেছে গন্ধা ফুলের গন্ধেরই মতো, প্রস্তরময় বাজারের ঝরঝরানি স্রোতে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *