1 of 2

১৪. পারিহার সাহেব সুফকরের বাংলো

পারিহার সাহেব সুফকরের বাংলোর বারান্দায় বসেছিলেন একা। এখন রাত। ভাবছিলেন, অনেক কথাই।

কানহা টাইগার প্রজেক্ট-এর কোর-এরিয়ার মধ্যে অনেকগুলোই ফরেস্ট রেঞ্জ আছে। কাহা, কিসলি, মুক্তি, ভাইসেনঘাট এবং সুফকর। কোর-এরিয়ার পাশে পাশে আছে বাফার-জোন। সাতপুরা আর মাইকাল হিলস এবং তাদের গায়ের এবং উপত্যকার গভীর জঙ্গলে মোড়া এই

কোর-এরিয়া।

প্রশাসনিক ভাগে ভাগ করলে, এই পুরো অঞ্চল বালাঘাট আর মান্দলা ডিস্ট্রিক্ট-এ পড়ে। সীওনী পড়ে, বালাঘাটেই। সীওনীর কাছে পেঞ্চ ন্যাশনাল পার্ক আছে। পারিহার সাহেবের ওখানেই বদলি হয়ে চলে যাবার কথা হচ্ছে।

এই কোর-এরিয়া স্বভাবতই একদিনের বা একজনের চেষ্টাতে গড়ে ওঠেনি। অনেক মানুষের সম্মিলিত শ্রম, শুভ প্রচেষ্টা আছে এর পেছনে। সাতপুরা আর বিন্ধ্য পর্বতের মধ্যে মাইকাল পাহাড়শ্রেণী মিলন ঘটিয়েছে। আর এই বৃত্তরই মধ্যে বয়ে চলেছে বানজার একপাশে, অন্য পাশে হলো। এই দুই নদীর মধ্যের উপত্যকাতে কান ন্যাশনাল পার্ক। পর্বতময় এই জংগলের উচ্চতা সতেরোশ’ ফিট থেকে ঊনত্রিশশ’ ফিট। বিভিন্ন জায়গায়, উচ্চতা বিভিন্ন। জংগলের গভীরে অনেকই গ্রাম ছিল একসময়, ভারতের সমস্ত জংগলেই যেমন থাকে। কিছু গ্রাম যুগ-যুগান্ত ধরে নিশ্চিহ্ন হয়ে এসেছে, ঠুঠার গ্রামেরই মতো; নানারকম মহামারীতে। প্লেগ, কালাজ্বর, ম্যালেরিয়া এবং টাইফয়েড ইত্যাদিতে। মহামারী রাইন্ডারপেস্ট-এ উজোড় হয়ে গেছে বহু গ্রামের গবাদি পশু। আবার জলের অভাবেও অনেক গ্রাম পরিত্যক্ত হয়েছে। সে কারণেই এই বনের গভীরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মাঝে মাঝেই গা-ছমছম করে তাঁর। কোনও শ্মশান বা কারখানায় গেলে বা পরিত্যক্ত রক-শেলটার বা গুহায় গেলে যেমন মনে হয়, তেমনই অনুভূতি হয় অনেকটা। টাইগার প্রজেক্টের কোর-এরিয়ার পত্তন করা হয়েছিল মাত্র উনিশশো চুয়াত্তর সালে কিন্তু এই কানহা পার্ক-এর পত্তন হয়েছিল উনিশশো তেত্রিশে; ইংরেজ আমলে। এখন বাফার-জোন শুঙ্কু কানহা-টাইগার প্রজেক্ট-এর আয়তন দাঁড়িয়েছে বারোশো মতে বর্গ কি মি। তার মধ্যে কোর-এরিয়াই হচ্ছে নশো মতো কি.মি.।

পুব দিক দিয়ে বয়ে গেছে ভারী সুন্দরী কালোলা মেয়ের মতো নদী, হাঁলো। আর পশ্চিমদিক দিয়ে মেমসাহেবের মতো ফসা বার্জার। হাঁলো আর বানজার-এর মধ্যবর্তী ঘন জঙ্গলাবৃত পাহাড়ি এলাকাতেই এই টাইগার প্রজেক্ট।

পারিহার সাহেব-এর হেড কোয়াটাস মান্দলাতে। মান্দলা, নর্মদার উপরে। বার্জার-এর সঙ্গে নর্মদার মিলনও হয়েছে এখানেই। নদী বা নদ যখন কোনও শহরে ঢোকে, তখন তাদের নিরাবরণ নিরাভরণ রূপটি পারিহার সাহেবকে ব্যথা দেয় বড়। কোনও সুন্দরীকেই কখনও সম্পূর্ণ অনাবৃত নিরাভরণ অবস্থায় সুন্দর দেখায় না। আর্টের গোড়ার কথাও বোধহয় তাই-ই। রহস্য, কিছু না থাকলে, সৌন্দর্য জমি পায় না পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবার। মান্দলাতে পারিহার সাহেবের অফিসের পরই, একটু গিয়েই নদী। কজওয়ের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। ধোপারা কাপড় কাচছে, নারী পুরুষ চান করছে। মালার নর্মদা বাজারকে দেখে টিকেরিয়া আর মান্দলার মধ্যবর্তী নর্মদা অথবা মুক্তির কাছের বা কানহার জংগলের গভীরের বানজার-এর সৌন্দর্যের কোনও ধারণাই করা যায় না।

পারিহার সাহেব কাল রাতে মান্দলা থেকে এসেছেন সুফকর। সুফকর কথাটার মানে হচ্ছে সুনসান জায়গা। সান্নাটা। অবশ্য তিনদিন আগে বেরিয়েছিলেন। চিরাইডোংরি, ইন্দ্রা হয়ে; কিসলি। তারপর মুক্তি। তারপর সুফকর-এ এসেছেন আওরাই; সোন্ধর হয়ে।

এদিকের কিছু গ্রামকে এবং কোর-এরিয়ার অনেক গ্রামকেই অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কোর-এরিয়ার নিভৃতি, নিশ্চিন্ত করতে। কিছু গ্রামকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে লামটা রোড-এর দিকে। আদিবাসীরা খুশি হয়নি। কেই-ই বা আর খুশি হয়! কিন্তু ভারত একটি স্বরাট, বিরাট একীভূত রাষ্ট্র। এখানে দশের স্বার্থের জন্যে একের স্বার্থ মাঝে মাঝে বিসর্জন দিতে হবেই, নইলে দেশের ভাল হওয়া সম্ভব নয়। অন্য অনেক সমস্যাও আছেই। এবং আছে চোরা শিকার, চোরা কাঠ চালানের সমস্যা। আদিবাসী এলাকাতে এবং জঙ্গল-পাহাড় ঘেরা জায়গাতে শিকার চিরদিনই ছিল। ছিল কিছু গরিব লোকের পুরুষালি, সাহসিক আনন্দ হয়ে। এদের প্রোটিনের একমাত্র উৎসও ছিল শিকার করা মাংস। কিছু অবস্থাপন্ন শহুরে মানুষের কাছেও এ ছিল দারুণ এক স্পাের্ট। অনেকদিন পর্যন্ত একইরকম সবই চলে আসছিল। শিকার তো মানুষের আদিমতম সময় থেকেই চলে আসছে। আমাদের দেশের ভীমবৈঠকার, মোদীর, গোয়ালিয়রের, রাইসনের, খাড়োওয়াইর, নরসিংগড়ের, কুটীবাতারারের, স্পেনের আলটামিরাতে এবং পৃথিবীর আরও বহু জায়গায় মানুষ তার প্রস্তরাশ্রয় এবং গুহাতেই প্রথমে শিকারের ছবি এঁকেই আর্টের গোড়াপত্তন করেছিল। শিকার, আদিবাসী এবং ভারতীয় পাহাড়-জংগলের মানুষদের জীবন থেকে রাতারাতি ছিনিয়ে নেওয়া, খুব কঠিন কাজ।

সুখের কথা, শিক্ষিতদের মধ্যে; পশুপাখি কমে যাওয়ায় স্বভাবতই সংরক্ষণের দিকে মন গেছে। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আদিবাসীরা ছাড়াও, যাদের ধর্ম অথবা সামাজিক জীবনের সঙ্গে শিকার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে; যাদের মধ্যে বংশপরম্পরায় আইন ভাঙার ও দুঃসাহসী কাজ করার একটা জন্মগত প্রবণতা প্রায়শই দেখা যায়; তারাও রয়ে গেছে।

আরও রয়ে গেছে এক ধরনের মানুষ, যারা মারতেই ভালবাসে, জানোয়ারের রক্ত মাংসের উপর যাদের নারী-মাংসের থেকেও বেশি লোভ; এই তীব্র আদিম প্রবণতার মূল্য হিসাবে নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত যারা দিতে রাজি।

এটা দুঃখজনক, মনে হয়; পারিহার সাহেবের। যতই এ নিয়ে ভাবেন উনি, ততই বুঝতে পারেন যে শুধুমাত্র বনবিভাগের সমস্যাই নয় এ। এই সমস্যা, সমাজের, পরিবেশের এবং অর্থনীতিরও গভীর সমস্যা। বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের সমস্যা সত্যিই আজকের ভারতের মস্ত বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আর্থিকলাভের জন্যেও কিছু লোক শিকার করে। আফ্রিকাতে তো বড় বড় চক্রই গড়ে উঠেছে। সারা পৃথিবীব্যাপী তাদের জাল ছড়ানো। গণ্ডারের খগ, হাতির দাঁত, জেব্রার চামড়া, কুড়র চামড়া ইত্যাদির চোরাচালানের জন্যে বড় বড় বিজনেস টাইকুনরা আড়াল থেকে মদত দিচ্ছে এদের। কোটি কোটি টাকা খাটছে এইসব ব্যবসাতে। শিক্ষাহীনতা, দেশাত্মবোধের অভাব, ধর্মসম্বন্ধীয় এবং সংস্কারগত বিশ্বাস যেসব দেশে যত বেশি; সেই সব দেশে এই সমস্ত সমস্যার গভীরতাও তত বেশি।

পারিহার সাহেব খবর পেয়েছিলেন যে, কে বা কারা একটি বিরাট বারাশিঙা মেরেছে বন্দুক দিয়ে হাঁলোর পাশে। মাংস কেটে নিয়ে গেছে। ঘটনাটা ঘটেছে একজন সাধুর কুঁড়ের সামনে। সেই সাধুর ব্যাকগ্রাউন্ড সম্বন্ধেও নানারকম কথা কানে এসেছে তাঁর। পাওয়ার সাহেব অনেক কষ্ট করে ওঁর অঞ্চলে বারাশিঙা বাড়িয়ে গেছিলেন। বারাশিঙা কানহার এক বিশেষ আকর্ষণ। শম্বরের চেয়েও বোকা মনে হয়, পারিহার সাহেবের; এই জন্তুজানোনায়ারদের। এই পোচিং-এর ব্যাপারটা তাঁকে খুব আপসেট করেছে। তিনি নিজে ক’দিন এই অঞ্চলে থেকে এ ব্যাপারের তদন্ত শেষ করে যেতে চান। ভোপাল থেকে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। ফরেস্ট সেক্রেটারি নিজে খুঁটিনাটি সব জানতে চেয়েছেন। এসেমব্লীতে কোশ্চেনও উঠেছিল। ঘনঘন ফোন আসছে মান্দলাতে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী ভোপাল থেকে। ব্যাপারটা খুবই একটা সীরিয়াস টার্ন নিয়েছে। ভোপালে বসে, এত বড় এলাকার পার্ককে সামলানোর অসুবিধার কথা উপরমহলের খুব কম মানুষই বোঝেন।

মনে হয়, হাটচান্দ্রার কিছু লোক এর পেছনে আছে। বালাঘাট এবং মান্দলার এস. পি-দের সঙ্গেও কথা বলেছেন তিনি। ওঁরা সব ডি. এস. পি এবং এস. ডি. পিওদের, সার্কল ইনসপেকটরদের খবর দিয়েছেন। হাটচান্দ্রার পোলিস স্টেশান থেকেও একটা রিপোের্ট চাইবেন তিনি, এস. পিকে বলে।

পারিহার সাহেব, সমস্ত সরকারী কর্মচারীদেরই মতো, নিশ্চয়ই রিটায়ার করবেন। একদিন না একদিন সব চাকুরেকেই রিটায়ার করতে হয়। বাগচী সাহেব, পাওয়ার সাহেব, ইত্যাদি সকলেই করবেন। কিন্তু জে. জে. দত্ত সাহেবের মতো পূর্বসূরীরা, যে দৃষ্টান্ত মধ্যপ্রদেশের ফরেস্ট সার্ভিসে রেখে গেছেন, তারই অনুসরণ করতে চান তিনি। যাতে, রিটায়ার করার অনেক বছর পরে, কানহার কোর-এরিয়াতে আবারও এসে কোনওদিন মনে করতে পারেন যে, তাঁর সরকারী কাজের মধ্যে দিয়ে একটা বড় কোনও, সুন্দর কোনও আদর্শকে রূপায়িত করতে বিবেকবান হয়ে সমস্ত আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

মানুষ তো রেখে যায় না অন্য কিছুই! টাকা পয়সা, সম্পত্তি বাড়ি গাড়ি এ সবের কোনও কিছুই থাকে না। এসব রেখে যাওয়ার পেছনে কোনও গভীর বা মহৎ বোধও কাজ করে না। বড়লোকে টাকা রাখলে তার ছেলেমেয়েরা উড়িয়ে দেয় অচিরে, ঘেয়োকুকুরের মতো অর্থ-সম্পত্তি নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে; যদি তারা মানুষই না হয়। আর তারা যদি মানুষ হয়ই, তাহলে টাকা-পয়সার প্রকৃত তাৎপর্য তারা নিশ্চয়ই বোঝে। সুনামের চেয়ে, যোগ্যতাতে অর্জিত যশ-এর চেয়ে, জীবনের উদ্দেশ্যের চেয়েও টাকা যে বড় নয়, প্রায়-অবিশ্বাস্য এই কথাটাতেও কিছু মানুষ আজও বিশ্বাসও করেন।

এই কানহা-কিসলি, এই মুক্তি, সুফকর, ভাইসেনঘাটকে বড়ই ভালবেসে ফেলেছেন পারিহারসাহেব। ট্রানসফার হয়ে বা প্রোমোশনে অন্যত্র গেলেও এখানে বারে বারেই ফিরে আসবেন।

কানহা রেঞ্জ-এই নানা জানোয়ারের কনসেনট্রেশান হয়েছে। এখন চিতলই হয়ে গেছে প্রায় বারো-তেরো হাজার, শম্বর প্রায় সাতশো-সাড়ে সাতশো। গাউর বা ইন্ডিয়ান বাইসন দেড়শোর মতো। বারাশিঙা চারশো পঁচিশ-টচিশ হবে। জংলি শুয়োর হবে এখন পৌনে দু হাজার। কথায়ই বলে, শুয়োরের মত বংশবৃদ্ধি! এই সব জানোয়ার ছাড়া, কানহা কোর-এরিয়া ও বাফার-জোন-এ আছে আরও অনেকই জানোয়ার। কুটরা, কৃষ্ণসার, চৌশিঙা, নীলগাই, ভাল্লুক, বনবেড়াল, বাঁদর, শেয়াল, শজারু, এবং বেজি। বাঘ ও চিতা তো আছেই।

মাউস-ডিয়ার প্রায় দেখাই যায় না এখানে। কথা হচ্ছে, ওড়িষ্যা থেকে এনে এখানে কীরকম বাড়ে, তা দেখা হবে। ওড়িষ্যাতেও মাউস-ডিয়ার মেরে শেষ করে দিয়েছে প্রায়। ওড়িষ্যাতে মাউস ডিয়ারকে বলে, গুরান্টি। সব জায়গাতেই এই একই সমস্যা।

হায়েনা এই অঞ্চলে, কেন জানা নেই, প্রায় দেখাই যায় না। শজারুদের সঙ্গে দেখা হয় শুধু রাতেরই বেলা। পাইথন দেখা যায় না বটে, কিন্তু পথের ধুলোয় তাদের চলার দাগ প্রায়ই দেখা যায়। পাখির মধ্যে ময়ূর, বনমোরগ, ধনেশ ও আরও অসংখ্য পাখি আছে। খরগোশও প্রচুর আছে।

কানহার গর্ব হচ্ছে তার বাঘ আর চিতা। বান্ধবগড়েরই মতো। কোর-এরিয়া এবং বাফার জোন মিলিয়ে এখন বড় বাঘ প্রায় নব্বই মতো হবে। বেশিও হতে পারে। চিতাও হবে ষাট-টাট।

ওরিজম-এর বাগচী সাহেবের অধস্তন কর্মচারীদের সঙ্গে মাঝে মাঝেই মান-অভিমান হয় টাইগার প্রজেক্টের পারিহার সাহেবের এবং ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অন্যান্য অফিসারদের। টুরিজম-এর বড় সাহেব, স্বাভাবিক কারণেই চান, টাওরিস্টরা অনেক বেশি সংখ্যায় এসে, কানহার বাঘ এবং অন্যান্য জানোয়ার দেখুন। তাদের থাকার মতো, খাওয়া-দাওয়ার মতো, তাদের দেখানোর মতো, অনেক বেশি জায়গার ও সুযোগসুবিধার বন্দোবস্ত হোক। এখন যা আছে, তাও কম নয়। তবে, আরও বেশি থাকলে, অনেকই বেশি লোক আসতে পারতেন।

তাতে টাইগার প্রজেক্ট-এর কোনওই আপত্তি নেই। কিন্তু প্রজেক্টের কাজ তো এখনও শেষ হয়নি। বেশি টুরিস্ট এক্ষুনি এলে, এবং কোর-এরিয়ার মধ্যে অনেকগুলি বড় বড় টাওরিস্ট লজ হলে বাঘের বংশবৃদ্ধিতে বিঘ্ন ঘটবে। ফরেস্ট ও প্রজেক্ট টাইগারের লোকেদের তাই-ই ধারণা। কানহার মধ্যে যে মূল লজটি ছিল সেটি এই কারণেই সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জানোয়ারদের অসুবিধে হত খুবই। এখন শুধু কিসলি এবং মুক্তিতেই আছে লজ।

বাগচী সাহেবের টুরিজম ডিপার্টমেন্ট-এর ইন্টারেস্ট বজায় রাখার স্বপক্ষেও কিছু জোরালো যুক্তি, কলকাতার এক ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক, সেদিন এসেছিলেন মুক্তিতে। ভদ্রলোকের নাম মনে নেই। পদবি মনে আছে, খুব সম্ভব সেন। উনি মুক্তি লজ-এই উঠেছিলেন। এককালে শিকার করতেন। ভারতবর্ষের অনেক জংগল তো বটেই, আফ্রিকার জংগলেও গেছেন। অনেকক্ষণ, নানাবিষয়েই সেদিন কথা হল ওঁর সঙ্গে। মুক্তিতে সেদিন বাগচী সাহেব এবং পারিহার সাহেবও ছিলেন। সেই বাঙালি ভদ্রলোক মিঃ সেন, অবশ্য কানহার খুবই সুখ্যাতি করলেন। বললেন যে উত্তরপ্রদেশের করবেট পার্ক, এবং রাজস্থানের র্যাথামবোর ছাড়া মধ্যপ্রদেশেরই কানহা আর বান্ধবগড়েই একমাত্র নিশ্চিত বাঘ দেখা যায়। অল্প সময়ের মধ্যে বাঘ দেখার সুযোগের কথা বিবেচনা করলে বলতে হয়, বিহারের পালামৌ, পশ্চিমবঙ্গর সুন্দরবন ও ওড়িশার সিমলিপাল আদৌ ভাল নয়। পালামৌ, রোম্যান্টিক; সুন্দরবন ভয়াবহ; সিমলিপাল-এর মতো ভাল পার্ক পৃথিবীতে কমই আছে; কিন্তু আজকালকার ট্যুরিস্টরা কম সময়ে এসে যদি বনের বাঘকে বনের পরিবেশে নাই-ই দেখতে পেল, তবে লাভ কী? উনি বলছিলেন যে, তানজানিয়া এবং কেনিয়াতে গেম-পার্ক-এর মধ্যে মধ্যেই দারুণ দারুণ সব থ্র-স্টার হোটেল হয়েছে। দু-একটি ফাইভ স্টারও আছে। রেফ্রিজারেটেড ভ্যানে করে পৃথিবীর সেরা সব খাদ্য-পানীয় সরবরাহ হচ্ছে, জেনারেটরে আলো, পাম্প, এয়ার কন্ডিশনার, হিটার, গীর্জার সব কিছু চলছে। কোটি কোটি টাকা রোজগার। ফরেন এক্সচেঞ্জ।

এখানেও হবে। পারিহার সাহেব বলেছিলেন হেসে, বাগচী সাহেবকে। এখানেও হবে। আমাদের শুধু আরও দশটা বছর সময় দিন বাগচী সাহেব। জন্তু-জানোয়ারদের পপুলেশান বাড়ুক। টওরিজম ডিপার্টমেন্টের দুঃখ আমরা ঘুচিয়ে দেব।

কলকাতার এক ভদ্রলোক কিন্তু একটা দামি কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন যে, ন্যাশনাল পার্ক-এ এবং কোর-এরিয়াতে সব টুরিস্টকে ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়। কিছু টাওরিস্ট সব দেশেই থাকে, যারা পাগলা-গারদে গিয়ে পাগল হওয়া মানুষ-মানুষী বা কোর-এরিয়াতে ঢুকে ইনসট্যান্টবাঘ দেখতে চান, এই দ্রুতগতি, তরলমতি মানুষদেরও বনে ঢোকার কোনওই অধিকার নেই। তাদের বনে ঢুকতে দেওয়া উচিতও নয়। সময় না দিলে বন, মন খোলে না; কারও কাছেই।

যারা বীয়র খেতে, আর তাস খেলতে আর ট্রানজিস্টার শুনতে অথবা ভাড়া করা মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতে বেরিয়ে পড়েন, তাদের জায়গা আর যেখানেই থোক, জংগলে নয়। ডিসক্রিমিনেট করতে হবে। যাঁদের নিজেদের নানাবিধ কথা উচ্চস্বরে বলার প্রবণতার চেয়ে, জংগলের কী বলার আছে তা শোনার প্রবণতা বেশি, জংগল যাদের সত্যিই টানে, কী করে একটি দিনের জন্ম হয় এবং তার মৃত্যু, তা নীরবে দেখার এবং অনুভব করার মতো সময় ও মন যাঁদের আছে, তাঁদেরই শুধু জংগলের গভীরে আসতে দেওয়া উচিত। শুধু তাঁরাই বাঘ দেখতে পাবেন।

ভদ্রলোকের কথার মধ্যে পাগলামি ছিল কিছুটা; কিন্তু কথাগুলি একেবারে ফেলেও দেবার নয়।

চৌকিদার এসে বলল, খনা লগা দিয়া সাব।

পারিহার সাহেব হুইস্কি খাচ্ছিলেন। এই সুফকরের বাংলোটা চমৎকার। খড়ের চালের বাংলো। চওড়া, মস্ত বারান্দা। একেবারে সুনসান্নাটা। আউট-অফ-দ্যা ওয়ার্ড প্লেস একেবারে! বাইরে কুটরা ডাকছে একটা ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে। ভয় পেয়ে। বোধহয়, বাঘ কি চিতা দেখে থাকবে।

চৌকিদারকে বললেন। পাঁচ মিনিট বাদ।

বলে, আর একটা হুইস্কি ঢাললেন। একা বসে, চুপ করে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলতে বলতে হুইস্কি খাওয়ার আনন্দ একমাত্র জংগলে যাঁরা এসেছেন, থেকেছেন, তাঁরাই জানেন। আনন্দ মাত্রই, নারীরই মতো! তাকে সময় দিতে হয়, ইস্পট্যান্স দিতে হয়; তবেই তাকে পুরোপুরি পাওয়া যায়।

বাইরে অঘ্রাণের অন্ধকার রাত। অম্বর ঈত্বরের মতো একটা ভারী গন্ধ ঝুলে আছে স্নিগ্ধ সুফকরের সবুজ সুগন্ধি অন্ধকারে। ভারী ভাল লাগছিল।

জিম করবেটকে ইংরেজ সরকার, “ফ্রীডম অফ দ্যা ফরেস্ট” উপাধি দিয়েছিলেন। শিকারি বলে নয়, জংগল-প্রেমিক বলে। এই উপাধির অর্থ হল, জংগলের যে-কোনও জায়গায় যেতে তাঁর কারওই অনুমতির দরকার ছিল না। জংগলের যে-কোনও বাংলোতেই তিনি থাকতে চাইলে অন্য সকলের আগে তাঁকে অগ্রাধিকার দেওয়া হত। উইদাউট রিজার্ভেশন। এবং তাঁর কাছ থেকে খুব সম্ভবত থাকার জন্যে কোনও পয়সাও নেওয়া হত না। স্থানীয় বনবিভাগের সমস্ত কর্মচারীরা তাঁকে সবরকম সহযোগিতাও নিশ্চয়ই দিতেন।

পারিহার সাহেবের হাতে ক্ষমতা থাকলে, অন্তত মধ্যপ্রদেশের সমস্ত জংগলের জন্যে “ফ্রীডম অফ দ্যা ফরেস্ট” উপাধি দিতেন কলকাতার সেই পাগলাটে মানুষটির মতো দু একজন মানুষকে।

আরেকটা হুইস্কি ঢাললেন পারিহার সাহেব। এবার আর কিছু ভাববেনও না। হুইস্কির নেশাটা, এই রাতের গায়ের গন্ধর সঙ্গে মিশে গিয়ে আস্তে, আস্তে আস্তে, তাঁকে এক গভীরতর নেশার কেন্দ্রবিন্দুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বনের নেশা যাকে একবার পেয়েছে, হুইস্কির নেশা তার কাছে নেশাই নয়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *