২৮. আরেকটা গণ-আদালত, না হয় মুক্তিযুদ্ধ

আরেকটা গণ-আদালত, না হয় মুক্তিযুদ্ধ

মরিয়মের দ্বিতীয় বিয়ের দশ বছর পর মুক্তি যখন ঠিকানা খুঁজে খুঁজে রায়েরবাজারের বাসায় হাজির হয়, দেবাশিস তখন আর ওখানে নেই। তাকে দরজা খুলে দেয় টুকি। বারান্দায় বেঞ্চিতে বসে মুক্তি অপেক্ষা করে একজন বীরাঙ্গনার, বেবির লেখা কেসহিস্ট্রিতে যার বয়স বাইশ। পুনর্বাসনকেন্দ্রের চিকিৎসার পর বয়সটা আরো কম দেখাত–গর্ব করে তাকে বলেছিল বেবি। যদিও বারবার জিগ্যেস করেও জবাব পায়নি, মেয়েটা একা একা হাসত যখন, তখন চুলের ফাঁক দিয়ে তার গালে টোল পড়তে দেখেছে বেবিরা। তারপর তো মরিয়মের মানসিক রোগ ধরা পড়ে। ভাগ্য ভালো যে, ঠিক সময়ে গার্জিয়ান এসে মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। তা না হলে, বিদেশি ডাক্তাররা চলে যাওয়ার পর তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে চালান দেওয়া হতো। যারা একবার ওখানে গেছে, তারা আর বাইরের আলো দেখেনি। ওখানকার। পাগলেরাই হয়েছিল তাদের আপনজন। সবশেষে বেবি পত্রিকার হারানো বিজ্ঞাপনের ভাষায় মুক্তিকে বলে, মেয়েটির বাম গালে একটা গোলাপি আঁচিল আছে আর মুখাকৃতি চাঁদের মতো গোলাকার। মুক্তিকে পরে নতুনগাঁওয়ের জৈতুন বিবিও মরিয়মের কথা বলতে যেয়ে চাঁদপানা মুখের উল্লেখ করেছিল।

বয়স বাইশ বছর এবং মুখাকৃতি গোলাকার, চেনার এ দুটি লক্ষণ মাথায় নিয়ে মুক্তি বারান্দার নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে থাকে। টুকি সামনে দিয়ে এমনভাবে আসা যাওয়া করে, যেন সে-ই এ বাড়ির ঘরনি। উঠোনের দড়ি থেকে কাপড় তোলে টুকি। পোষা মুরগিগুলোকে কক কক শব্দ করে ডেকে নিয়ে যায় রান্নাঘরের পেছনে। তাকে মুক্তি মরিয়ম ভাবে না, শুধু এ কারণে যে, তার বয়স বাইশ নয়, আর মুখাকৃতিও গোলাকার নয়। তারপর মরিয়ম সামনে এসে দাঁড়ালে সে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যে, সে মরিয়ম বেগমের একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী, অনেকক্ষণ হয় এসেছে, তাড়াতাড়ি ভদ্রমহিলার দেখা পেলে ভালো হয়, কারণ সে থাকে মিরপুর, রাত হয়ে আসছে, তাকে বাসে করে বাসায় ফিরতে হবে। মরিয়ম তার দীর্ঘ বাক্যটি শুনতে শুনতে ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালায়। তার দিকে একটি বেতের চেয়ার এগিয়ে দিয়ে নিজে মোড়া টেনে বসে বলে, ‘আমার নাম মরিয়ম বেগম।’

মুক্তির মুখ থেকে কথা সরে না। মাঝখানে আটাশটা বছর যে পালিয়ে গেছে, তা তার ধীরে ধীরে মনে আসে। তাহলেও ভদ্রমহিলার বয়স মাত্র পঞ্চাশ এখন। একজন বীরাঙ্গনা এত অর্ডিনারি হয় দেখতে! রাধারানী তো এরকম নয়। মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান। সত্ত্বেও ওর জেল্লা আছে চেহারায়। এদিকে মরিয়মের গোলাকার মুখের চন্দ্রিমাভা বয়সের রাহুগ্রাসে হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার চেহারা তো হওয়ার কথা নাটক-সিনেমার সেসব মা-খালাদের মতো, মেকআপ দিয়ে যাদের বয়স বাড়ানো হয়েছে, আসলে তারা বয়স্ক নয়।

নিজের চেহারা অন্য আরেকজনের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা মরিয়মের পছন্দ হয় না। সে কি নতুন বউ যে বাইরের মানুষ এসে তার মুখ দেখবে! মুক্তিকে সে জিগ্যেস করে, বেবি তার সম্পর্কে কী বলেছে। কিন্তু উত্তর শোনায় মনে হলো, তার বিশেষ আগ্রহ বা ধৈর্য নেই, দুম করে বলে বসে, ‘হে তো একটা মাথা পাতলা মহিলা।’ তারপর তার একপ্রস্থ গালাগাল শুনতে শুনতে মুক্তির চোখের সামনে থেকে অর্ডিনারি চেহারাটা অন্তর্হিত হয়ে মরিয়মের গালের গোলাপি আঁচিলটা জ্বলজ্বল করতে থাকে। বীরাঙ্গনার রাগ না-থাকাটাই অস্বাভাবিক। আগে যা ছিল অভিমান, এখন তা হয়তো ক্ষোভ-তবে কার বিরুদ্ধে বোঝা যায় না। সে যা-ই হোক, কথাবার্তা শুরুর আগে ভদ্রমহিলার কঠিন দিল ভিজিয়ে খানিকটা নরম করা দরকার।

‘আপনাদের আত্মত্যাগ ছাড়া তো দেশ স্বাধীন হইত না। আপনারা বিশেষ কিছু… মানে।’ কথার মাঝখানে তোতলাতে থাকে মুক্তি। এদিকে মনে হয় জেঁকের মুখে নুন পড়েছে। মরিয়ম মোড়া ছেড়ে পাশের চেয়ারে গা এলিয়ে বসে। চোখ সিলিংয়ের দিকে। আজ কত বছর পর একজন তার বাড়ি খুঁজে খুঁজে এসেছে। অনুরাধা তাহলে মিথ্যা বলেনি। মানুষের কষ্ট-নির্যাতনেরও দাম আছে। কিন্তু তারা যে। বিশেষ কিছু–সেটা কী? তা কি মাপা যায়-সম্মান, মর্যাদা, ভালোবাসা বা শ্রদ্ধা দিয়ে?

দুটি বিয়ের পর, অল্প দিনের জন্য হলেও মরিয়মের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা বেড়ে গিয়েছিল। এর সঙ্গে যদিও একাত্তরের ধর্ষণের সরাসরি সম্পর্ক নেই। বিশেষত, দ্বিতীয় বিয়ের বহু আগে বীরাঙ্গনার লেবাস মরিয়মের গা থেকে এমনিই খসে পড়েছিল। এটি ছিল অস্বাভাবিক বিয়ে, যার মধ্যস্থতাকারী মহল্লার লোকজন। তাদের অজুহাত ছিল, দুর্নামের হাত থেকে মহল্লার মান-ইজ্জত রক্ষা করা, প্রকারান্তরে একজন বীরাঙ্গনার পায়ে শিকল পরানো, যে তাদের অগোচরে পরপুরুষ সংসর্গ করছে।

বিয়ের দ্বিতীয় দিনে হাজির ছেলে বর-কনেকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। হাজি সাহেবের বিধবা স্ত্রী মরিয়মকে উপহার দেন একটা হাফ সিল্ক জামদানি শাড়ি। দেবাশিসের জন্য কিনে আনেন সিল্কের টুপিসহ তসরের পাঞ্জাবি। আশপাশের বাড়ির ছেলেপেলেরা রাস্তায় দেখা হলে বর-কনেকে সালাম দিত। বিয়ের খবরে টলেননি শুধু মনোয়ারা বেগম। ‘ধুর ধুর, এইডা একটা বিয়া অইলো! ছন্দা তোরও মাথা খারাপ–বইনের বিয়ার কথা শুইন্যা নাচতাছস। তোর বাপও একদিন নাচছিল, হে যখন মমতাজরে শাদি করে।’ তিনি তো ঢাকা এলেনই না, ছন্দাকেও ভিড়তে দেননি এদিকে। পরে যখন স্কুলমাস্টার কলিগের সঙ্গে ছন্দার বিয়ে হয়, তখনো মরিয়ম আর দেবাশিস দাওয়াত পায়নি। মনোয়ারা বেগম ছাড়া মেরির বিয়েতে নাখোশ ছিল আরেকজন–স্বয়ং দেবাশিস। মরিয়মের সঙ্গে তার স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বিয়ের পর নষ্ট হয়ে যায়। কোথাও যাবার জায়গা না থাকায় আরো দুটি বছর সে এ বাড়িতে ছিল। তখন ঘুমাত পাশের ঘরে। নৌকাডুবির দুঃস্বপ্নটা মাঝরাতে মরিয়মের ঘরে তাকে আর ফিরিয়ে আনতে পারেনি। ঠিকা ঝির তো আক্কেলগুড়ুম। স্বামী-স্ত্রী একঘরে থাকে না, এক বিছানায় শোয় না–এ কেমন! দেশের বাড়ি থেকে স্বামী-বশীকরণের তাবিজ আর পানিপড়া এনে মরিয়মকে দিয়েছিল ঠিকা ঝি। সেসব কাজে না দিলে চাকরি ছেড়ে চলে যায় সে।

ঠিকা ঝি তো চাকরি ছেড়ে খালাস। একটা ব্যর্থ বিয়ে দিনে দিনে মরিয়মের মনে ক্রোধের জন্ম দেয়। বয়স তখন তার চল্লিশ। সন্তানের মা হতে কোনো বাধা নেই। পাশের ঘরে স্বামী রয়েছে, অথচ সে তার সঙ্গে শোয় না। পাড়ার লোকেরা তাকে বিয়ে দিয়ে তিলে তিলে যে শাস্তি দিচ্ছে, এর চেয়ে পাথর মারা অনেক ভালো ছিল। একবারেই সব শেষ হয়ে যেত। মরিয়ম মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে উঠে দেবাশিসের ঘরের কড়া নাড়ে। ভেতর থেকে সাড়া আসে না। বারান্দার বেঞ্চিতে বসে তার মনে আকাশসমান ঘৃণা জন্মায় দেবাশিসের প্রতি। সে কি দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে পারে না একবার! মরিয়ম শারীরিক সম্পর্ক চায় না, সন্তান চায় না, দেবাশিস শুধু তার মাথায় হাত রাখুক, সে শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়বে। পরদিন কথাটা শোনার পর দেবাশিস মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে এসেছিল। যে পুরুষটি নির্ভেজাল পুরুষ-আসক্ত, তার ছোঁয়া পাওয়া মাত্র মরিয়মের শরীরের গ্রন্থি আলগা হতে শুরু করে। কোল থেকে মাথা নামিয়ে উঠে পড়ে দেবাশিস। সব জানার পর ভগবান জানেন, মেরি কেন তাকে বিছানায় চায়। সারা রাত কামার্ত বাঘিনির মতো বারান্দার এমাথা-ওমাথা পায়চারি করেছে মরিয়ম। এ তামাশা দেখার লোক ছিল না। হাজির বাড়ির দোতলাটা অন্ধকার। সবাই যার যার বিছানায় ঘুমাচ্ছে। মেরি-দেবাশিস স্বামী-স্ত্রীলোকজন বিয়ে দিয়েই দায়মুক্ত, তাদের রাত কীভাবে কাটে, এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। গলা ফাটিয়ে মরিয়মের চাচাতে ইচ্ছা করে–যে পুরুষ কিছু করতে পারে না, সে মাথায় হাত বোলাতে আসে কেন?

এভাবে বঞ্চিত হওয়া কি ধর্ষণের চেয়ে খারাপ? মরিয়ম অতীতের ধর্ষকদের একে একে স্মরণ করে। বাড়ির উঠোন থেকে গলির শেষ মাথা পর্যন্ত তাদের লম্বা লাইন। সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? আবেদ জাহাঙ্গীর, মেজর ইশতিয়াককেও তার আর মনে ধরে না। এই রাতে দেবাশিসকেই তার চাই–যে তার শরীর চায় না।

‘তুমি অসুস্থ অসুস্থ, আমি বলছি, মেরি,’ দেবাশিস দিনের বেলা চাচায়, ‘তুমি ডাক্তার দেখাও।’ মরিয়ম অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ‘দূর হ হারামজাদা,’ বলে দেবাশিসের গায়ে পায়ের স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারে সে। ভেবেছিল, লজ্জা থাকলে ছেলেটা আর এ মুখো হবে না। দু’দিন পর ঠিকই ফিরে আসে। সঙ্গে আরেকটা কমবয়সি ছেলে। দেবাশিস পরিচয় করিয়ে দেয়, এর নাম অনুপম সিকদার। জগন্নাথ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বাড়িটা যে মরিয়মের, এ নিয়ে দুজনের কারো মাথাব্যথা নেই। তাকে অবশ করে দিয়ে তারা ঘরে ঢুকে দরজার খিল তুলে দেয়। পরিস্থিতি মরিয়মকে বোবা করে দিয়েছে। এবার নিজের বাড়িতেও সে পরবাসী। প্রতিবাদ করতে গেলে ফের যদি একা হয়ে যায়! বাইরের অবস্থাও তখন উত্তপ্ত। এরশাদ পতনের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আজ প্রতিরোধ, কাল হরতাল। একদিন অফিসে গেলে দু’দিন ঘরে থাকতে হয়। ছেলে দুটি সারা দিনে একবারও বাইরে বেরোনোর নাম করে না। ঘরের ভেতর জেঁকে বসেছে। জোরে জোরে রেডিও শোনে। ফাঁকে ফাঁকে উঠে গিয়ে খিচুড়ি পাকায় আর ডিম ভাজা করে নিজেরা খায়, মরিয়মকে খেতে দেয়।

এ ব্যবস্থায় মনোয়ারা বেগম মহা খুশি। তিনি ঢাকা এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। রায়ের বাজারের দিকে না এসে বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি চলে যান মগবাজার, গোলাম মোস্তফার বাসায়। পরদিন আসেন মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে। ‘মরিয়ম তুই খুব ভালো স্বামী পাইছস। ছেলেডা কিউট!’ মেরির গোমড়া মুখ দেখে তিনি চটে যান, ‘কী বেআক্কেলে মাইয়্যা তুই! বুড়া বয়সে বিয়া অইছে। কই স্বামীর সেবাযত্ন করবি, তা না, ঠ্যাংয়ের ওপর ঠ্যাং তুইল্যা খাইতাছস।’

মায়েরা নাকি মেয়ের দুঃখ বোঝে। মা তো উল্টা বুঝলেন। মার কাছে আসল ঘটনা ভেঙে বলতে মরিয়মের ইচ্ছা করে। দুনিয়ায় অন্তত একজন মানুষ জানুক, কী নরকের মধ্যে সে দিন গোজার করে। কিন্তু মনোয়ারা বেগমকে দেখে মনে হচ্ছে, এমন বাজে কাজে নষ্ট করার মতো সময় তার নেই। দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। বাড়িটা আগাছায় ছেয়ে গেছে। হাস্নাহেনার ঝোঁপের আর দরকার কী। জোড়া সাপের বদলে, বাড়ি পাহারা দিতে একজোড়া পুরুষই তো আছে। তিনি দা-কুড়াল হাতে দিয়ে দেবাশিস আর অনুপমকে গাছ কাটায় লাগিয়ে দেন। মহা উদ্যমে তারা গাছ কাটে। মনোয়ারা বেগম দুপুরের কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে তদারক করেন, হাতে হাতে গাছের ডালপালা সরান। মরিয়মের অস্থির লাগে। মা মনে হয় দিন দিন খুকি হচ্ছেন! এ বয়সে এতটা পরিশ্রম সহ্য হবে? হার্টের অবস্থা খারাপ, ডায়াবেটিসেও ধরেছে। মনোয়ারা বেগম মেয়ের কোনো কথাই কানে তোলেন না। বাড়িটাকে ন্যাড়া বানিয়ে, মরিয়মকে হতাশার অতলে ফেলে, সন্ধ্যা নামার আগে আগে ভাইয়ের বাসায় ফিরে যান। তার কোনো পিছুটান নেই। ’৭৪-৭৫ সালে যে মায়ের ধ্যানজ্ঞান ছিল মেয়ে, মেয়ের পুনর্বাসনের জন্য যিনি পাগল হয়ে উঠেছিলেন, নব্বইয়ে তার এ পরিবর্তন!

বছরটাও নানা আলামতের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে। বাবরি মসজিদ আক্রান্তের উড়ো খবরে দাঙ্গা বেধে গেল পুরান ঢাকায়। মরিয়ম ও অনুপম দুজনেই দেবাশিসের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। সরকার সারা দিন হিন্দুর দোকানপাট, ঘরবাড়ি অবাধে লুটপাট, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করতে দিয়ে সন্ধ্যায় কারফিউ জারি করে। অনুপম বাইরে থেকে ঘুরে এসে বলে, ‘এইডা এরশাদশাহির কাণ্ড। সরকারবিরোধী আন্দোলন বিভ্রান্ত করতে শালা দাঙ্গা বাধাই দিছে।’ দেবাশিস কিছু বলে না। সারা দিন ঘরে বসে পায়ে তার ঝি-ঝি ধরে গেছে। সে বাইরে বেরোতে চাইলে অনুপম স্বামীভক্ত পত্নীর মতো তার শার্ট টেনে ধরে। ‘দেবাশিস খাড়াও, এ বিপদের মধ্যে বাইরে যাবা না কইলাম! মরিয়মকে বারান্দায় দেখে দেবাশিস অপ্রস্তুত হাসে, আহ্ ছাড়ো বলছি! আমি দেবাশিস না, আবেদ ইশতিয়াক।’ তাই তো! দেবাশিস যে কলমা-পড়া মুসলমান–মরিয়মের মনেই ছিল না। ‘তুমি আবেদ ইশতিয়াকই হও আর যে হও, অনুপম গোঁ ধরে, এখন বাইরে গেলে আমার লাশের ওপর দিয়ে যাইবা।’

দেবাশিস বাইরে যায় না ঠিকই, কিন্তু অনুপম গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। মরিয়মের দিকে দেবাশিসের নরম চোখে তাকানো, মিষ্টি স্বরে কথা বলা–এসব তার ভালো ঠেকছে না। সে জাতকুল ছাড়ার মতো হোস্টেল ছেড়ে চলে এসেছে। বন্ধুরা বুঝুক না বুঝুক তাকে নিয়ে ঠাট্টা করে। তাদের সন্দেহ মরিয়মকে নিয়ে। মহিলা একাত্তরের বীরাঙ্গনা, বহুগমনে অভ্যস্ত, এক স্বামীতে চলছে না, তাই অনুপমকে ভাড়া খাটাতে স্বামীকে পাঠিয়ে হোস্টেল থেকে তুলে নিয়েছে। দেবাশিসকে তারা মনে করে কাপুরুষ, পুরুষ জাতির কলঙ্ক।

অনুপমের মুখে এসব অভিযোগ শুনতে শুনতে দেবাশিস মরিয়মকে ডাকে, ‘মেরি শুনছ, অনু কী বলে, মজার ব্যাপার শুনে যাও।’ মরিয়ম দরজা পর্যন্ত এসে থমকে দাঁড়ায়। অনুপম মুখ চেপে ধরেছে দেবাশিসের আর ‘ওগো শুনছো ওগো শুনছো’ বলে ভেংচি কাটছে। অর্ধেক বয়সের ছেলে বাড়ি তুলেছে দেবাশিস, দিনে দিনে মজা আরো টের পাবে। দরজা থেকে সরে আসছিল মরিয়ম, মুখ থেকে অনুপমের হাত সরিয়ে দেবাশিস এবার চাচায়, ‘মেরি, জগন্নাথ কলেজের ছাত্ররা আমারে কয়…’

এই মিষ্টি মিষ্টি খুনসুটি বেশি দিন চলে না। দেশ-বিদেশের পরিস্থিতি উত্তপ্ত : ঢাকার রাস্তায় মিছিলের ওপর ট্রাক তুলে দিয়েছে পুলিশ, ইরাক আক্রমণ করতে যাচ্ছে আমেরিকা, লৌহমানবী থেচারের পতন আসন্ন, বেনজির ভুট্টো নির্বাচনে হেরে যাচ্ছেন। বিবিসির খবর না শুনলে দেবাশিসের রাতে ঘুম আসে না। অনুপম ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে খবরের মাঝখানে রেডিওটা একদিন আছাড় মেরে ভেঙে ফেলে। মরিয়ম নিজের ঘরে শুয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিল। ভাঙাভাঙির শব্দে তার ভুরুজোড়া সামান্য কোঁচকায়, পরক্ষণে সে ফিরে যায় চটুল ম্যাগাজিনে। থমথমে মুখে ঘরে ঢোকে। দেবাশিস। কী যেন বলতে এসেছিল, তাকে বইয়ের পাতায় নিমগ্ন দেখে না-বলেই বেরিয়ে যায়।

এরশাদ পদত্যাগ করার পরদিন বিজয় মিছিল থেকে দেবাশিস আর অনুপম ফেরে না। অপেক্ষা করে করে মাঝরাতে তাদের ঘরে ঢুকে বাতি জ্বালায় মরিয়ম। দরজার পাশের আলনাটা খালি। ঘরে জিনিসপত্র কিছু নেই। বিছানায় বালিশচাপা এক টুকরো কাগজ। আত্মহত্যার নোটের মতো কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা। চলে যাচ্ছে দেবাশিস। কারণ মরিয়মকে সহ্য করতে পারছে না অনুপম। সে জেলাস। দুজনের না-বলে যাওয়ার কারণ–দেবাশিস মনে করে, মরিয়ম তাকে যেতে দেবে না। তাদের খোঁজ করাটাও অযথা সময় নষ্ট হবে–জানিয়ে গেছে দেবাশিস।

মহল্লার জনতার উদ্যম, কৌতূহলে ভাটা পড়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মতো ব্যর্থ এ মহিলার জীবন। বারংবার অন্ধকার গর্তে পড়া তার নিয়তি। তার জন্য ভালো কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হয়। তাদেরও তো বয়স বাড়ছে। খোদার লীলাখেলা আর নেতাদের ভণ্ডামি দেখতে দেখতে ক্লান্ত। পাড়ার নতুন প্রজন্ম যারা হাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট ধরেছে, লুকিয়ে-চুরিয়ে সিগারেট ফুঁকছে, না-ওঠা মোচে তা দিচ্ছে, তাদের মায়ের বয়সি মরিয়ম। তবে কারো মা নয় সে, তার না-থাকা সন্তানের বাবারা আজ আছে, কাল নেই। এসব দেখে দেখে তারা হাঁটতে শিখেছে। এখন পাড়ার গলিতে সকাল-বিকাল ফুটবল খেলে। শরীরের জন্মদাগের মতোই প্রশ্নাতীত এ নারী তাদের জীবনে। শুধু তার ব্যবহারটা যদি আরেকটু ভালো হতো, তারা খুশি। থাকত। তাদের ফুটবল ঘরের চালে পড়লে মরিয়ম গলা ফাটিয়ে চিৎকার জুড়ে দেয়। কখনো তার কাছ থেকে বল ফেরত পাওয়া যায় না। সাহস করে দেয়াল টপকে কখনো যদি ছেলেরা বাড়িতে ঢোকে, ‘আন্টি এই শেষ, আর কোনোদিন ঘরের চালে বল পড়বে না’ বলে নাকে খত দিয়ে বেরিয়ে আসতে হয়। বাড়ির ভেতরটা অবশ্য ছেলেদের খুব টানে। কেন, তা তারা জানে না। তাদের কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধটা। সুদূর পলাশী বা পানিপথের যুদ্ধের কাছাকাছি ইতিহাস বইয়ের ঘটনা বৈ কিছু নয়। বাতাসে কিছু কথা ভেসে উঠে হারিয়ে যায়।

বাস্তব জীবনের মতো রাতের দুঃস্বপ্নেও মরিয়ম বারবার অন্ধকার গর্তে পড়ে। তবে অলৌকিকভাবে উদ্ধারও পেয়ে যায়। এক রাতে হয়তো দেখল, একটা উঁচু দালানের ওপর থেকে পড়ে যাচ্ছে, পায়ের তলায় সাপোর্ট নেই, পড়তে পড়তে কার্নিশ ধরে সে ঝুলে রইল। কিংবা আরেক রাতে উঁচু দালান থেকে পড়ার আগে দেখতে পেল, নেমে যাওয়ার একটা ঝুলন্ত সিঁড়ি। অন্য একটা স্বপ্ন যা মরিয়ম প্রায়ই দেখে, সেটা হলো, সে একটা গাঙ পার হচ্ছে কাঠের সাঁকোর ওপর দিয়ে, যার মাঝখানটা নেই। ঘুমের ভেতর যখন সে ভয়ে দিশাহারা, পানিতে পড়ো পড়ো ভাব, তখন অস্পষ্ট কিছু একটা দেখতে পায় ওপারে যাওয়ার। জিনিসটা কী–জেগে ওঠার পর মনে থাকে না। তবে মরিয়ম ওটাকে আলকাতরা মাখানো, নতুন পাল-বৈঠার একটা নৌকাই ভাবে।

জীবনের শেষ কোথায় আর কীভাবে–না জানলেও, দেবাশিস চলে যাওয়ার পর মরিয়ম যে শূন্য গর্তে পড়ে গেছে, একটা নতুন পালতোলা নাও তাকে এতখানি ভরসা দেয় যে, সে নিশ্চিত–আজ হোক কাল হোক এ থেকে উতরাতে পারবে। তাই ১৯৯২-এর ২৬ মার্চ, সকাল এগারোটায় পশ্চিম পার্শ্বের গেট দিয়ে সে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করে। জায়গাটা মানুষে মানুষে সয়লাব। ২১ বছর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণা হবে। মরিয়মের চোখে কালো চশমা, মাথার চুল চূড়ায় তুলে খোঁপা-বাঁধা। তাকে ছদ্মবেশী নায়িকার মতো দেখায়। সে কালো চশমার আড়াল থেকে পুরোনো মানুষদের খুঁজছে। যারা নির্যাতিত হয়েছিল, তারা কি এই বিলম্বিত বিচারসভায় হাজির হবে না? হোক না তা প্রতীকধর্মী। আর কেউ না আসুক, অনুরাধা আসবেই, যদি সে বেঁচে থাকে। মরিয়মের মতো কালো চশমা, উঁচু খোঁপার আরো কয়েকজন ইতস্তত ঘুরছে। তারাও হয়তো একাত্তরের বীরাঙ্গনা। গণ-আদালতের রায় শুনতে এসেছে বা তার মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে নির্যাতন ক্যাম্পের সাথিদের। রোদের তেজ ক্রমশ বাড়ছে। অদূরে বাজছে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-আর যদি একটা গুলি চলে…ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। সেই একই জায়গা–তখনকার রেসকোর্স ময়দান। তখন এত গাছপালা ছিল না। বিরান মাঠ। বিশাল জনসমুদ্র দেখে মন্টু ঘাবড়ে গিয়েছিল, ‘মেরিবু, আমি যদি হারাই যাই, খুঁজিস না, তুই। একটা রিকশা ধরে সটান বাসায় চলে যাইবি।’ কত বছর আগের কথা? বিশ! না একুশ? মরিয়ম চশমা খুলে চোখ মুছে ফের জনসমুদ্রের দিকে তাকায়। শাড়িতে হঠাৎ টান পড়ে। ‘কে, মেরি আফা না?’ পেছন ফিরতেই তার মুখোমুখি টুকি। হাতে টিফিন কেরিয়ার। নতুনগাঁওয়ের সেই কাজের মেয়ে, একই দিনে মিলিটারি তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল। টুকি গণ-আদালত দেখতে আসেনি। উদ্যানটা তার গার্মেন্টসে আসা-যাওয়ার শর্টকাট পথ। আলসারের ব্যথা ওঠায় আজ তার কাজে যেতে দেরি হয়েছে। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসেও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খোলা থাকে? আশ্চর্য তো! মরিয়ম অবাক হয়। টুকি বলে, ‘আপনে কী মনে করেন! বচ্ছরের ৩৬৫ দিনই খোলা। কামাই দিলে বেতন কাইটে নেয়। কিন্তু মরিয়মের সঙ্গে দেখা হওয়াতে টুকি অফিস কামাই দিয়ে সোহরওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে থাকে। কার বিচার, কী বৃত্তান্ত ভিড়ের ঠ্যালায় বোঝার উপায় নেই। কুষ্টিয়া থেকে তিনজন বীরাঙ্গনার সাক্ষী দিতে আসার কথা। মরিয়ম তাদের একনজর দেখতে চায়। যদি পরিচিত কেউ হয়! ‘তাইলে তো আপনেরে গাছের আগায় উঠতে হবে।’ পাশ থেকে একজন পাজামা-পাঞ্জাবি পরা পুরুষ মন্তব্য করে। সত্যি গাছের ডালে ডালে মানুষ। ট্রাকের ওপর থেকে জাহানারা ইমাম যে গণ আদালতের বিচারের রায় ঘোষণা করছেন, নিচের মানুষ তা দেখতে পাচ্ছে না। মাইকও নেই যে, ঘোষণাটা কানে শুনবে। ‘পুলিশ ঢাকা শহরের সব মাইক বাজেয়াপ্ত করেছে।’ তারা প্রশ্ন না করলেও পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটি জবাব দিয়ে যাচ্ছে। ‘লোকটার চরিত্র খারাপ!’ বলে টুকি মরিয়মকে টানতে টানতে উদ্যানের বাইরে নিয়ে আসে।

গোলাম আযমের ফাঁসির রায় কার্যকর না হলেও, সেই স্মরণীয় দিনে মরিয়ম টুকিকে কুড়িয়ে পায়। টুকি আসার পর বাড়িটা আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মনোয়ারা বেগম হাস্নাহেনার ঝোঁপ নিকেশ করে চলে গেছেন। বাঁশঝাড় তো কবেই শেষ। পাকা কুয়ার ধার ক্ষয়ে গেছে। টুকি প্রথম কোদাল দিয়ে কুয়ার পাড়টা সাফ করে। দেয়ালের ধার ঘেঁষে পেঁপে আর কলাগাছ লাগায়। কয়েকটা মোরগ-মুরগি নিয়ে সে গার্মেন্টসের চাকরির বিকল্প একটা প্রকল্প দাঁড় করায়। প্রকল্পের পুঁজি মরিয়মের আর পরিকল্পনা ও শ্রম টুকির। ‘বাসায় ইত্তো ইত্তো খালি জাগা! পশু-পাখি ছাড়া মানুষের জীবন চলে?’ এটা টুকির থিওরি। এদিকে মুরগিগুলোর ঘরের যত্রতত্র পায়খানা করায়, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে বিছানায় ওঠায়, অসময়ে ডাক ছাড়ায় মরিয়ম ত্যক্ত-বিরক্ত। মুখে কিছু বলে না। টুকি থাকলে মুরগি থাকবে, মুরগি না থাকলে টুকি থাকবে না–এ অলিখিত নিয়ম। তা মানতে হবে। না মানলে আবার অন্ধকার গর্তে পড়া অনিবার্য, যা সে যমের মতো ভয় পায়।

বাড়িতে মরিয়ম আর একা নয়। অফিস থেকে সন্ধ্যায় ফিরে এলে হাসিমুখে দরজা খুলে দেওয়ার একজন মানুষ আছে। সারা দিন কোন ক্লায়েন্ট কী করল, বসের ব্যবহার কেমন ছিল, দুপুরে লাঞ্চ করেছে কী দিয়ে–মন খুলে এসব তুচ্ছ কথা বলা যায়। টুকি টুকটুক করে মোরগ-মুরগিদের আধার খাওয়ায়, ‘গার্মেন্টস মালিকের কত বড় সাহস, এত দিন আমারে শোষণ করছে! আমি একজন বীরাঙ্গনা। আয় আয় কক কক। মেরি আফা, সাদা ডুরি মুরগিডার মনে অয় ডিম পাড়ার সময় হয়েলো, সারা দিন টইটই কইরে জাগা বিছরায়।’

দেরিতে হলেও ’৭২ সালের আদলে টুকির পুনর্বাসনের ব্যবস্থা হয়েছে। তখন মিরপুরে পোলট্রি ফার্ম করা হয়েছিল বীরাঙ্গনাদের রোজগারের জন্য। তারা মুরগি পুষবে। ঝকায় আঁকায় ডিম যাবে বাজারে। উৎসাহ জোগাতে শুরুর দিকে পুনর্বাসনের উদ্যোক্তারা ডিম কেনা শুরু করেন। বাড়িতে রান্নার পর গৃহকত্রী জনে জনে জানান দিতেন, ‘ডিম খাচ্ছো-খাও। জিগ্যেস করো না, কাদের মুরগির ডিম খাচ্ছে।’ কারণ বিষয়টা গোপন রাখার কেন্দ্রের নির্দেশ ছিল। মানুষ যদি সত্য কথা জানতে পেরে বাজার থেকে ডিম কেনা বন্ধ করে দেয়! টুকির সেই চিন্তা নেই। সে যে বীরাঙ্গনা, ঢাকা শহরে মরিয়ম ছাড়া কাকপক্ষীও জানে না।

‘কিন্তু মেরি আফা, আমার কী লাভ অইলো?’ রাতে মুরগিগুলো ঘুমিয়ে পড়লে পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে টুকি জানতে চায়। মরিয়ম প্রথম বুঝতে পারে না—‘লাভ অইলো মানে?’

‘এই যে ঢাকার কাকপক্ষীতেও জানতি পারল না, আমি একজন বীরাঙ্গনা!’

অন্ধকারে মরিয়ম নিঃশব্দে হাসে। একটা গণ-আদালত টুকিকে উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিকে ঠেলে দিয়েছে। সে আর সাধারণ থাকতে চাচ্ছে না, নেত্রী হতে চাচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষ কি মানবে, যে এক লাইনও পড়তে জানে না! একটা সংবর্ধনা দিয়ে ছেড়ে দেবে–এবার নিজেরটা নিজে করে খাও। আর সন্তানের বয়সি ছেলেমেয়েরা ক্যামেরায় ছবি তুলে সামনে মাইক ধরে জানতে চাইবে, ‘দিনে কয়বার পাকিস্তান আর্মি আপনেরে ধর্ষণ করছে?’

অন্ধকারে মরিয়মের চিন্তার নাগাল পায় না টুকি। তার মুখের ক্রুর হাসিটাও দেখতে পায় না সে। ‘জীবনে আমি স্বামী পালাম না, বাচ্ছা পালাম না, সংসার পালাম না।’ টুকি না-পাওয়ার তালিকাটা দীর্ঘ। সারা রাত বলেও শেষ করা যাবে না। তবে হাতে এখন তার টাকা আছে। টাকা থাকলে টুকির ডবল বয়সের পুরুষও স্ত্রী পায়, বাচ্চা পায়, সংসার পায়। টুকি হচ্ছে মেয়েলোক। তার জন্য বয়স একটা ফ্যাক্টর। বীরাঙ্গনা হওয়ার দুর্নাম বা সুনাম না-হয় এ বেলায় বাদই দেওয়া গেল। সেই বুঝে টুকির কথাগুলোও অন্ধকারে মোড় নেয়। ‘মেরি আফা, ঘুমাই পড়ছেন? আরেকটা কথা।’ মরিয়ম সাড়া দেয় না। সে ঘুমিয়ে পড়লেও টুকি আরেকটা কথা না-বলে পারবে না। আর সেটি হচ্ছে, কুষ্টিয়ার তিনজন মহিলা গণ-আদালতে সাক্ষী দিয়ে চলে গেল। টুকির মনে খেদ, ‘তারা টাকাও পাইছে শুনলাম! আমরা ঢাকা বইসে কিছু জানতি পারলাম না। বুইঝতে পারলাম না। মেরি আফা, আমাদের মতো বীরাঙ্গনা এ দেশে কয়জনা। এখনো অমাবস্যা-পূর্ণিমা আলি এই পাশ থেইক্যে ওপাশে নড়ে শুতি পারি না। শইলের সব জায়গায় ব্যথা। ভিতুরে ভিতুরে জ্বর বায়।’ অন্ধকারে টুকি দীর্ঘশ্বাস ফেলে । মরিয়ম একজন লেখাপড়া জানা মহিলা। অফিসে চাকরিও করে। তার অগোচরে কোন ফাঁকে একটা গণ-আদালত হয়ে গেল! মরিয়ম আশ্বস্ত করে যে, এবার থেকে সে চোখ-কান খোলা রাখবে। যাতে মঞ্চে উঠে সাক্ষী দেওয়ার সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া না হয় টুকির।

আরেকটা গণ-আদালতের স্বপ্ন নিয়ে টুকি ঘুমিয়ে পড়ে। এবার বিছানায় এপাশ ওপাশ করার পালা মরিয়মের। গণ-আদালত বসলে সে কি সাক্ষী দেবে? কার বিরুদ্ধে? যে পাকিস্তানি সৈন্যরা দিনের পর দিন তাকে ধর্ষণ করেছে, সেসব ধর্ষকের সে নাম জানে না, পদ কী বলতে পারবে না, চেহারাও তাদের অস্পষ্ট। যার কথা যুদ্ধের এত বছর পরও মরিয়মের মনে আছে, সে মেজর ইশতিয়াক। মেজর ইশতিয়াকের সঙ্গের প্রেমের উপ্যাখ্যান সে কোথায় ফেলবে? তা লোকটার পক্ষে, না বিপক্ষে যাবে? আবেদ জাহাঙ্গীর, আবেদ সামির, মমতাজের বিরুদ্ধে মরিয়মের কোনো অভিযোগ নেই? যারা তার জীবনটা ছারখার করে দিয়েছে? মরিয়মের ছোট ভাই মন্টু সম্মুখযুদ্ধে শহিদ। তার মৃত্যুর নাকি বিচার হবে না। কারণ সে সিভিলিয়ান নয়, যোদ্ধা। কিন্তু গোঁফ ওঠার আগেই কেন তাকে যুদ্ধে যেতে হয়েছিল–এর জবাব নেই। গোলাম মোস্তফা মরিয়মের মামা, কোলাবোরেটর ছিলেন পাকিস্তান আর্মির, ১৯৭১ সালে। তিনি স্বয়ং যুদ্ধাপরাধী। মরিয়ম যে বাড়িতে থাকে, সেটি ছিল শত্রুসম্পত্তি, জলের দরে কফিলউদ্দিন আহমেদ হিন্দুর পরিত্যক্ত ভিটাবাড়ি ক্রয় করেছিলেন। তিনি আজ মৃত। মরিয়ম তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। এদিক দিয়ে ইতিহাস কি তাকে ছেড়ে কথা কইবে?

সত্তর-আশি–এই দুই দশক মরিয়ম নিজের সমস্যা নিয়েই ছিল। নব্বইয়ের শুরু হিসাব-নিকাশ আর বোঝাপড়া দিয়ে। তাতে কে হারে, কে জিতে বলা যায় না। কষ্টের নিরিখে যদি বিচার হয়, তবে মরিয়মেরই জিত হবে। কারণ পাকিস্তানিরা তাকে যে অত্যাচার করেছে, এর তুলনায় মেজর ইশতিয়াকের সঙ্গে ভালোবাসাবাসি সমুদ্রে এক ফোঁটা শিশিরবিন্দু। আর গোলাম মোস্তফার রাজাকারি করার পেছনে মরিয়মের কোনো হাত ছিল না। লোকটাকে সে বরাবর অপছন্দই করেছে।

নিজেকে একবার বাদী আরেকবার বিবাদী ভাবতে ভাবতে মরিয়মের রাত কাবার। যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে অনেকের মতো সেও বিভ্রান্ত। এসব ঝামেলা নেই টুকির। সে প্রলেতারিয়েত। ঘুমের ভেতর দিয়ে সুখী-সমৃদ্ধিশালী ভবিষ্যতের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার গন্তব্য আরেকটা গণ-আদালত।

বছরের পর বছর গড়ায়, গণ-আদালত আর বসে না। টুকি জেরা করে, ‘মেরি আফা, খবরের কাগজটা খুটোয় খুটোয় দেখছেন তো? চশমা পরে আরেকটু দ্যাখেন।’ আরেকটা গণ-আদালত বসাতে লোকজনের এত দেরি হচ্ছে–টুকির বিশ্বাস হতে চায় না। হালে মরিয়মেরও চোখে নতুন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আগে চশমা ছাড়া দূরের সবকিছু ঝাপসা লাগত, এখন খবরের কাগজ পড়তে গেলে চোখ থেকে চশমাটা খুলে ফেলতে হয়, নয়তো ঝাপসা লাগে। সে টুকির দিকে চশমা পরে তাকায়, পরক্ষণে খবরের কাগজ পড়ে চশমা খুলে। টুকি তা পছন্দ করে না। মেরি আফার সবকিছুতেই ধরি মাছ না-ছুঁই পানি ভাব। নিজে তো মরে মরে বেঁচে রয়েছে, টুকির জীবনে উন্নতি হোক, সেটিও চায় না। এ কেমন মানুষ!

গণ-আদালতের ভাবনাটা যখন মুছে যাচ্ছিল টুকির মন থেকে, তখন হঠাৎ একদিন খবরের কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে মরিয়মের কুয়াশাময় দৃষ্টিপথে মুক্তিযোদ্ধা। তারামন বিবি ভেসে ওঠে। ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড়ে চরাঞ্চলে তার বাড়ি। পথ দুর্গম। নদী পার হয়ে, চরের উত্তপ্ত বালুর ওপর দিয়ে সাংবাদিকেরা ছুটে যাচ্ছে। তাদের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হওয়ার পর তারামন বিবি সশরীরে আবির্ভূত হন। চোয়াল ভাঙা রোগাক্রান্ত চেহারার এক নারী। পেশা উঞ্ছবৃত্তি। স্বাধীনতার ২৪ বছর পর যক্ষ্মা রোগে ভুগে ভুগে শেষাবস্থায় জাতির সামনে উপস্থিত হয়েছেন। খবরের কাগজ খুললেই তার ছবি, খবর, সাক্ষাৎকার। তারামন পেট ভরে ভাত খেতে চায়। তারামন বাঁচতে চায়। বাঙালি জাতির প্রতি তারামনের আহ্বান, ‘একসময় আমার শরীলে জোর ছিল, এখন কডা হাড্ডি আছে খালি, গায়ে শক্তি নাই, তাই আপনাদের কাছে আমার একটা কথা, এই বাংলাদেশটারে আপনেরা সবায় ধইরা রাইখেন। কারো হাতে ছাইড়া দিয়েন না।’ তারামনের অভিব্যক্তি, ‘মনে অয় য্যান দেশ আবার স্বাধীন হইছে।’ তারামনের মুক্তিযুদ্ধ করার কারণ, ‘পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাগো ভালো ভালো খাদ্যবস্তু, কাপড়লতা সব লইয়া যাইতো। আমরা পাঞ্জা দিয়া ধরছি, যুদ্ধ করছি, যুদ্ধ কইরা দ্যাশ স্বাধীন করছি।’ ঢাকা এসে তারামন বিস্মিত, ‘মানুষ কত ভালো ভালো খাওন খায়, দালানে ঘুমায়। আর আমার কপালে দুই বেলা নুনভাত জুটে না!’ বিবিসির কাছে তারামনের নালিশ, ‘খুনি আসামি যদি অইতাম, তাইলে নিশ্চয় সরকার আমারে বাহির করা হারতো। আমারে হাজতে দিয়া থুইতো। আইজ যুদ্ধ কইরা, শরীলের রক্ত দিয়া যুদ্ধ কইরা আমি ঘরে বইস্যা রইছি। কেহই খোঁজও নেয় না।’

এসব টুকিরও মনের কথা। তবে কথাগুলো স্টেজে উঠে নিজের মুখে বলতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এ সুযোগ একা তারামনের। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লাফালাফি করলেও সাংবাদিকদের ক্যামেরা এখন টুকির দিকে ঘুরবে না। সেসব ব্যস্ত তারামনকে ধরতে–প্রধানমন্ত্রী পদক তুলে দিচ্ছেন তারামন বিবির হাতে, শহিদমিনারে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করছেন তারামন বিবি, সাভার স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করতে গেছেন তারামন বিবি, তারামনকে সামনে দাঁড় করিয়ে শিল্পীরা দেশাত্মবোধক গান গাইছেন, নারী নেত্রীরা মাইক ধরে আছেন তারামনের মুখের ওপর।

মরিয়মের কাছে টুকি শোনে, সরকার পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছে তারামন বিবিকে। ‘ইত্ত টাকা! হে তো বড়লোক হইয়ে যাবে, আফা। কী কাজ করে এত টাকা পাইলো?’

‘অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে তারামন।’

‘যুইদ্ধ করলে টাকা পাওয়া যায়? এ দেশে আর যুইদ্ধ হবে না?’

যুদ্ধাপরাধের বিচারের গণ-আদালত বাদ দিয়ে, আরেকটা যুদ্ধের অপেক্ষা করে টুকি বেগম। যাতে সে অস্ত্র হাতে লড়তে পারে। কিন্তু টাকা আর খ্যাতি তো পাওয়া যায় যক্ষ্মা হওয়ার পর, স্বাধীনতার ২৪ বছর পর। এতগুলো বছর কি তার হাতে আছে? এক ঝাঁক মোরগ-মুরগির মধ্যে মন খারাপ করে বসে থাকে টুকি। সুযোগের অভাবে জীবনে উন্নতি হলো না। মুরগির ডিম বেচে পঞ্চাশ-একশো টাকা দিয়ে কী হয়। তারামন বিবির মতো একমোটে পঁচিশ হাজার, পঞ্চাশ হাজার পেলে না কথা ছিল।

সপ্তাহ খানেক পর মরিয়মের খেয়াল হয়, মুরগির সংখ্যা ধাই ধাই করে কমে যাচ্ছে। টুকিকে জিগ্যেস করলে সে মুখ ঝামটা দেয়, ‘বেজিতে ধইরে নে যাচ্ছে। আমি কী করব?’ বেজি! ঢাকা শহরে বলে বিড়ালই প্রায় নেই, বেজি আসে কোত্থেকে? দু তিন রাত জেরা করার পর বের হয়, ফেরিঅলার কাছে মুরগি বেচে দিচ্ছে টুকি। ক্ষুদ্র ব্যবসায় তার আর মন বসছে না। তাহলে সে কী করবে? মরিয়ম ক্ষুব্ধ-এ বাড়িতে যারাই থাকতে আসে, তাদেরই মাথা বিগড়ে যায়। দোষ বাড়িটার, না মেরির? আবার বোতল পরা এনে চারধারে পুঁতলে কেমন হয়? মরিয়ম তা-ই করবে। তার আগে, টুকির এত অর্থ-প্রতিপত্তির লোভ, সে যে একজন বীরাঙ্গনা, এ খবরটা পত্রিকা অফিসে ফোন করে জানাতে হয়। সাংবাদিকরা হয়তো ক্যামেরা নিয়ে আসবে, কিন্তু টুকির অর্থপ্রাপ্তির তাতে গ্যারান্টি নেই। পেতে পারে, আবার না-ও পারে। তা ছাড়া সাংবাদিকরা হয়তো কথায় কথায় জেনে যাবে, এ বাড়িতে একজন না, দুজন বীরাঙ্গনা। পরের জন শিক্ষিত, চাকরি করে। এযাবৎ যত বীরাঙ্গনার হদিশ পাওয়া গেছে, তারা সবাই গরিব। টাকাপয়সা আর ছেলেমেয়ের চাকরির জন্য একাত্তরের ইজ্জত লুণ্ঠনের কথা বলে সমাজের কাছে আরেকবার বেইজ্জত হয়েছে। শিক্ষিতরা বেনামি, চেহারাহীন। টিভি নাটকে তাদের জায়গায় পেশাদার নায়িকারা অভিনয় করেন। সাংবাদিকরা মরিয়মের সন্ধান পেলে, দেখা যাবে, টুকিকে বাদ দিয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছে।

বীরাঙ্গনা নিয়ে এত পলিটিক্স! দেখে-শুনে সাক্ষাৎকার দেওয়ায় টুকির রুচি হয় না। সে মুরগি পোয় ফের মন দেয়। সন্তানস্নেহে ছানাপোনা লালন-পালন করে। সে একাই এদের বাপ-মা, ভাই-বোন, মামা-খালা। আর অবসর সময় তার কাটে জায়নামাজে বসে তজবি জপে। টুকি তো পরকালের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, মরিয়মের বয়স পঞ্চাশ হতে চলল, কাউকে কিছু না জানিয়ে দুনিয়া থেকে সে বিদায় নেবে?

গোলাম মোস্তফার মৃত্যুতে মরিয়মের বুক থেকে পাষাণ নামে। যুদ্ধাপরাধের শাস্তি না পেয়েই তিনি রোগে ভুগে গত হয়েছেন। আরেকজন যিনি, খবরের কাগজে মেয়ের নির্যাতনের কাহিনি পড়ে ভর্ৎসনা করতে ছুটে আসতেন ঢাকায়, তিনিও পরলোকগত। মনোয়ারা বেগমের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে মরিয়ম গোপন কথা ফাঁস করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ ব্যাপার রত্না-ছন্দাকে জানানোর সে প্রয়োজন মনে করে না। তাদের একজন ফুলতলি, আরেকজন সৌদি আরবে সুখে-শান্তিতে স্বামীর সংসার করছে। বিপদে আপদে কোনোদিন তাদের পাশে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারেও তাই বোনদের দূরে রাখা মরিয়ম শ্রেয় মনে করে। প্রস্তুতির শেষ অবস্থায় মুক্তি যখন দরজায় কড়া নাড়ে, তত দিনে বাংলাদেশের বয়স আটাশ। আর সময়টা হচ্ছে ১৯৯৯ সাল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *