১৭. বীরাঙ্গনা অফিস

বীরাঙ্গনা অফিস

‘আপনার কাছে বীরাঙ্গনাদের কোনো ছবি নাই?’ ঢাকার এক প্রাক্তন সমাজকর্মীর ড্রয়িংরুমে বসে সাক্ষাৎকার নিচ্ছিল মুক্তি। সামনের দেয়ালে মাদার তেরেসা, সরোজিনী নাইডু, অরুণা আসফ আলী, মাদাম টিটোসহ নাম-না-জানা বিদেশিনিদের সঙ্গে গৃহকত্রীর স্বাধীনতা-উত্তরকালের কয়েকটি ফ্রেমে বাঁধানো গ্রুপ ছবি, যা একই সঙ্গে তার যৌবনকাল এবং সমাজসেবার মূল্যবান স্মারক। মরিয়ম ফটোগ্রাফে কি রক্তমাংসের শরীরে তখনো ধরা দেয়নি। বীরাঙ্গনা বলতে মুক্তি শুধু দেখেছে কিশোর পারেখের একটি সাদা-কালো আলোকচিত্র। তাতে দুজন অনামা নারীর একজন লম্বা ঘোমটায় মুখ ঢেকে রেখেছে, আরেকজনের মুখের এক পাশ ভোলা। তার আধখানা কপাল ঘিরে ছোট ছোট চুল। মুখটা শীর্ণ। সমাজকর্মী বললেন, ‘মেয়েদের ছবি পাবে কোথায় তুমি। সামনে ক্যামেরা দেখলেই ওরা লজ্জায় না ঘেন্নায় লম্বা ঘোমটার নিচে মুখ লুকাতো।’

ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকোনো সম্ভব হলেও, পেটে তখন টাইমবোমা, বাচ্চারা টিকটিক করে বাড়ছে। যে-কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নতুন দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস। করে দিতে পারে। ‘অথচ’ সমাজকর্মী বলেন, ‘দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। চারদিকে ধ্বংস আর ক্ষয়ক্ষতি। কাজ করার লোক কম। প্রশিক্ষণের অভাব। কারো মাথা ঠিক ছিল না। কোনটা ছেড়ে কোনটা করব। সবই করা দরকার এবং তাড়াতাড়ি।’

’৭২ সালে বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করে মেয়েদের গর্ভপাত করানোর ব্যবস্থা হয়। বিদেশ থেকে অভিজ্ঞ ডাক্তাররা আসেন। যাদের গর্ভধারণের মেয়াদ চার মাস পেরিয়ে গেছে, তাদের সন্তান জন্মাতে দেওয়া হলো। মাদার তেরেসা খুশি হলেন। একটা স্বাধীন জাতি জ্বণহত্যার পাপ থেকে আধাআধি উদ্ধার পেল। তার চ্যারিটি হোমের ছয়জন নার্স ইনকিউবেটর হাতে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে নেমে ঘোষণা দেন, ‘আমরা যুদ্ধশিশুদের বাঁচাতে এসেছি।’ মায়েরা পুনর্বাসনকেন্দ্রের নার্সদের নির্দেশ বা সহযোগিতায় ডেলিভারির আগের রাতে চুল আঁচড়ে টাইট করে বেণি বাঁধে, নিজেরা পরিচ্ছন্ন হয় আর পরিষ্কার জামাকাপড় পরে। তারা একটি নিঘুম রাত কাটায়, যা যুদ্ধের রাতগুলোর চেয়ে আলাদা ও ব্যঞ্জনাময়। পরদিন শারীরিক ক্ষয়ক্ষতি, ভয় আর ভবিষ্যৎ উৎকণ্ঠায় তাদের প্রসবকাল দীর্ঘ আর জটিল হওয়া বিচিত্র নয়। অথচ প্রসবের পর মাথার বিনুনি ঢিলা হওয়ার আগেই তাদের বাচ্চারা দত্তক হিসেবে বিদেশে চলে যায়। পরের দিনের খবরের কাগজে পাঠকরা হয়তো দেখলেন–নার্সদের কোলে শিশু আর উড্ডীয়মান একটি বিমান।

‘তুমি কাজটা যত সহজ ভাবছ, তত সহজ ছিল না।’ মুক্তির দীর্ঘ বয়ান শুনে প্রাক্তন সমাজকর্মী বললেন, ‘মেয়েরা চিল্লাফাল্লা করত। এমনও হয়েছে যে, মাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে চুপিচুপি বাচ্চাটা সরাতে হয়েছে। এসব বাচ্চা দেশে রাখা যাবে না–এরা পাকিস্তানি বাস্টার্ড। যদি কোনো ফরেন কান্ট্রি অফার করে, তাহলে আমরা বাচ্চা দিয়ে দেব ফর অ্যাডপশন। তো বেশিরভাগ বাচ্চা গেছে কানাডায়। স্ক্যান্ডেনেভিয়ায় আমাদের প্রচুর বাচ্চা গেছে।’ সমাজকর্মী কথা বলতে বলতে মুক্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে আসেন, ‘ওই যে মোল্লারা, ওরা তখন টেলিফোন করে বলত, বাইরে বাচ্চা দিতে পারবেন না, সব খ্রিষ্টান হয়ে যাবে। তারা কিন্তু ভালো কোনো কাজে ছিল না। নয় মাস হয়তো রাজাকারিই করেছে–তবু।’

এই সমাজকর্মী যুদ্ধের সময় রাজাকারদের হুঁশিয়ার করে বেনামে উড়া চিঠি দিয়েছেন। লিফলেট বিলি করেছেন। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তার কাছে হাতচিঠি পাঠাত, ‘খাল্লামা, সামনে শীত। আমাদের পঞ্চাশটা পুলওভার পাঠাবেন কালো রঙের।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি গেরিলা যুদ্ধের উপযোগী সোয়েটার বুনতে বসে গেলেন। যুদ্ধের দিন, বাড়িতে কখন মিলিটারি আসে, কাকে ধরে নিয়ে যায়, মেরে ফেলে–তার ভেতর ডজন খানেক সোয়েটার বুনলেনও, যার একটিও পরে কাজে লাগেনি। কারণ শীতের শুরুতেই হঠাৎ করে যুদ্ধটা শেষ হয়ে গিয়েছিল।

এই মুক্তিবাহিনীর ছেলেরাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোথায় কোন বাংকারে, আর্মির প্রমোদখানায়, গুদামঘরে মেয়েরা আটকা পড়ে আছে, সেসব খবর আনতে শুরু করে। মেয়েগুলো রুগ্‌ণ, অসহায়। তাদের তুলে আনার জন্য গাড়ি, রাখার জন্য বাড়ি, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল দরকার। একে একে সবকিছুরই ব্যবস্থা হলো। তবে কে কোনটা করছে, আরেকজন সঠিকভাবে জানছে না। ‘আসলে কাজগুলো তখন হাতে হাতে হচ্ছিল,’ আরেকজন সমাজকর্মী মুক্তিকে বলেন। ‘আমাদের দিয়েই হচ্ছিল। অথচ আমরা জানছি না–কে কোনটা করছি।’ আর তাই যুদ্ধের আটাশ বছর পর, মুক্তি কয়েকজন সমাজকর্মীর সাক্ষাৎকার কাট অ্যান্ড পেস্ট করেও ‘বীরাঙ্গনা অফিস’ নামে। একটি পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় দাঁড় করাতে পারল না। মেয়েদের উদ্ধার করা থেকে শুরু করে পুনর্বাসনের দীর্ঘ প্রক্রিয়াটি কয়েকজন মানুষের সাক্ষাৎকার, পেপার কাটিং আর দু চারটা ছেঁড়া ছেঁড়া ঘটনায় আটকে থাকল।

গর্ভপাতের আগ পর্যন্ত মরিয়ম নিজেকে নিজের হাতে রাখে। এরপর আর সম্ভব হয় না। কারণ বিষয়টা ক্লিনিক্যাল। তত দিনে বিদেশি ডাক্তার, নার্স আর স্বেচ্ছাসেবক দল ঢাকা পৌঁছে কাজ শুরু করে দিয়েছে। ধানমন্ডির তিন নম্বর রোডের একটি সাদা বাড়ি, যা তখন বীরাঙ্গনা অফিস নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে, সেখানে তখন দিনে গড়পড়তা একশ জনের গর্ভপাত, প্রসব করানো আর আনুষঙ্গিক চিকিৎসা চলছে। হাসপাতাল শেষে সুস্থ মেয়েদের গন্তব্য দুটি। হয় তারা নিজেদের আগের ঠিকানায় ফিরে যাবে, না-হয় নিউ ইস্কাটন রোডে আশ্রয় নেবে। সেখানে মুখোমুখি দুটি বাড়ির একটিতে ছিল প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, অন্যটি হোস্টেল। হোস্টেলে সেসব মেয়েই ছিল, যাদের বাড়িঘরের ঠিকানা তখনো পাওয়া যায়নি। বা পেলেও বাবা এসে হয়তো। বললেন, ‘মা পরে এসে নিয়ে যাব। আর দুইডা দিন কষ্ট করে থাক।’ তারপর বাবা ভাই কেউ আর নিতে আসেনি। পরের দিকে হোস্টেলটা শুধু বীরাঙ্গনা নয়, দুস্থ নারী আর এতিম শিশুদেরও আশ্রয়স্থল হয়। ‘যারা খাইতে দিতে পারত না, যাগো অনেক পোলাপাইন হইত, তারা রাইতের আন্ধারে পুনর্বাসনকেন্দ্রে বাচ্চা ফালাই দিয়া যাইত।’ কথাগুলো বলে সে সময়কার পুনর্বাসনকেন্দ্রের বাসিন্দা, বর্তমানে বাংলা ছায়াছবির সাইড একট্রেস বকুল বেগম। সে ’৭২ থেকে ’৭৪-এ দুই বছর আশ্রয়কেন্দ্রে পালাক্রমে এক সপ্তাহ রান্না করেছে, আরেক সপ্তাহ এতিম বাচ্চাদের গোসল দিয়েছে। বকুলের কাহিনি মুক্তি পরে শুনবে। সে এফডিসির সমান পারিশ্রমিকের বিনিময়ে পরপর দু’দিন তার সাক্ষাৎকার দেয়। এই দু’দিনের পারিশ্রমিক ছিল মাত্র পঞ্চাশ পঞ্চাশ একশ টাকা।

মন্টুর নিখোঁজ সংবাদ ছাপা হওয়ার মাস খানেক পর মরিয়ম সংস্থার কর্তৃপক্ষকে যেচে তার ঠিকানা দেয়। পিতা কফিলউদ্দিন আহমেদ, সাং ফুলতলি, ডাকঘর সাহারপার। সেই সঙ্গে বলে যে, এটা তার নয়, মন্টুর বাড়ি ফেরার ঠিকানা। যে মন্টু একাত্তরের এপ্রিল মাস থেকে নিখোঁজ, যার জন্য বাড়িতে বাবা-মা-ছোট দুই বোন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।

মরিয়মের বিলম্বিত কেসহিস্ট্রি সেদিনই প্রথম লেখা হয়। আর কাজটা করে তার সমবয়সি বেবি নামের একটি মেয়ে, যুদ্ধে যে স্বামী হারিয়েছে। মরিয়মের কথা বেবির মনে আছে এজন্য যে, তার বয়ানটা ছিল অভূতপূর্ব। লিখতে লিখতে কয়েকটা ফর্ম নষ্ট করতে হয়েছিল। অথচ প্রতিদিন কমপক্ষে একশ সোয়া শ ফর্ম কাটাকাটি না-করেই ফিলআপ করেছে বেবি। সেসব মেয়ের নাম-ঠিকানা দূরে থাক, চেহারাও আজ মনে নেই। ‘বড় নিষ্ঠুর এক সময়,’ বেবি কাঁচ-ঢাকা টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ার থেকে মুক্তিকে বলে, ‘আয়নায় নিজের মুখ দেখতেও তখন ভয় লাগত।’

এটা তার অফিসকক্ষের নিজস্ব টেবিল। যার কাঁচের ঢাকনায় বেবির পঞ্চাশোর্ধ্ব বলিরেখাময় মুখের প্রতিবিম্ব নড়াচড়া করছে একজন তরুণের পাসপোর্ট সাইজের ফটোর ওপর। ‘ছবিটা কার?’ প্রশ্নটা করেই মুক্তির মনে হয়, সে ভুল করে আগুনে খানিকটা ঘি ঢেলে দিয়েছে। ‘স্মৃতি বড় জ্বালাময়’, বেবি বাংলা গানের কলিটা সুরহীন গাইলেও, তাতে বিষাদের ছোঁয়া থাকে। তার দ্বিতীয় স্বামী কিছুতেই চায় না যে, প্রথমজনের স্মৃতির ছিটেফোঁটা বাড়ির কোথাও থাকুক। তাই প্রাক্তন স্বামী ঠাঁই নিয়েছে। অফিসের কাঁচ-ঢাকা টেবিলে। আমার অনুভূতিগুলি খাঁচাবন্দি পাখি, বেবি পাখির গলায় বলে, ‘তাই এখানে এদের লুকিয়ে রাখতে হয়।’ যতক্ষণ অফিস ততক্ষণ প্রথম স্বামী। ঘরে ঢুকলেই বর্তমান স্বামীর খপ্পরে সে পড়ে যায়। ‘দেশ আর আমার অবস্থা এক। একইভাবে ইতিহাসকে লুকাতে হচ্ছে।’ বলে ছোট্ট করে দম নেয় বেবি। সে পুনর্বাসন সংস্থায় বাহাত্তরে যে চাকরি করতে গিয়েছিল ক্ষতিগ্রস্ত নারী হিসেবে, দেশোদ্ধারের জন্য নয়, কথাটা মুক্তিকে সরাসরি আর অকপটে বয়ান করে। তবে তাকে যখন যা করতে বলা হয়েছে, সে বিনাবাক্যে করেছে। কাজে কখনো গাফিলতি হয়নি।

সে এক এলাহি কাণ্ড। বাচ্চাগুলো বিদেশ চলে যাচ্ছে। আর বিদেশ থেকে আসছে টাকাকড়ি, অদ্ভুত চেহারার মানুষজন আর নানান কিসিমের খাবারদাবার। সেলাই মেশিন, কম্বল, দুধ, পরিজ, কাপড়-চোপড়। স্বামী-পরিত্যক্ত, বাপে-ভাইয়ে খেদানো, ভবিষ্যৎহীন, জরায়ুশূন্য মেয়েগুলো লন্ড্রি, বেকারি চালাবে, কাপড় সেলাই করবে, রুমালে আর বালিশের ওয়াড়ে ফুল তুলবে। এটি গরিব দেশের পুনর্বাসন প্রকল্প। তাই সর্বাগ্রে টাকা রোজগার করে তাদের উদরপূর্তির কথা ভাবা হয়েছিল। নিরুপায় মেয়েরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে। তাদের তৈরি কাগজের ফুলে অতিরিক্ত জৌলুস থাকত। বাচ্চাদের জামাগুলো হতো প্রমাণ সাইজের-রোগা-মোটা সব্বার জন্য মানানসই। তারা সুলভ আর স্বল্পমূল্যের কাঁচামাল, যেমন–বাঁশ আর পাট দিয়ে এমন সব নিত্যব্যবহার্য জিনিস বানাত, যা ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতির সহায়ক। তারা সূচিকর্ম ও সূক্ষ্ম কারুকাজের মাধ্যমে গর্বিত বাঙালি জাতিকে অলংকৃত করতে সচেষ্ট ছিল। প্রথম বিজয় দিবসের প্রদর্শনীতে এসব সামগ্রীর পাশে রাখা ছিল একটি কাঁচের ঢেকি–তাদের কারো কারো হারিয়ে যাওয়া জীবনের একমাত্র স্মারক। তাতে মেয়েরা ধান কুটছে। অদূরে ধানের আঁটি মাথায় কয়েকজন পুরুষ। এ ছাড়া তাদের রান্না করা সুস্বাদু খাবার ঢাকার বিপণিকেন্দ্রের পসার বাড়িয়েছিল। আজকের দিনে শহর এলাকার কনফেকশনারিগুলোতে যে হোমমেড আচার, জেলি, জ্যাম, কেক, বিস্কুট, নকশি-পিঠা, গুঁড়ো মশলাসহ নানান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সুলভে পাওয়া যায়, এর পেছনে আছে বীরাঙ্গনা ও বীরাঙ্গনাদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা মেশানো শ্রম। ‘নিজেদের উজাড় করে দেশকে তারা অনেক দিয়েছে,’ বেবি মুক্তিকে বলে। ‘কিন্তু মানুষ তা মনে রাখে নাই।’

একজন বেতনভুক সমাজসেবীর মুখে এসব কথা শুনে মুক্তি অবাক হয়। মুক্তিযুদ্ধে বীরাঙ্গনাদের যে আত্মত্যাগ আর বিড়ম্বনা লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে, কী নিষ্ঠুর পরিহাস, তা প্রস্ফুটিত হয়েছিল সামান্য ক’টা কাঁচের বয়ামে, প্লাস্টিকের ঠোঙায় আর রঙিন কাগজের ফুলে। শহরের গুণী মহিলারা যে যে-খাবারটা রাঁধতে জানতেন, গাড়ি করে এসে ঝটপট তাদের শিখিয়ে দিয়ে সেই গাড়িতেই বাড়ি ফিরে যেতেন। এভাবে মেয়েরা একেকজন বিনা খরচে ডাকসাইটে রাঁধুনি হয়ে উঠেছিল। তাদের তৈরি খাবার রোজ প্যাকেটে করে এমনকি সচিবালয়েও গেছে আমলাদের লাঞ্চ হিসেবে। বেবির আফসোস, ‘অতি বড় ঘরনি না পায় ঘর, অতি বড় রাঁধুনি না পায় বর।’ তা না হলে, সরকারি-বেসরকারি সব রকম উদ্যোগ-আয়োজন সত্ত্বেও ওদের ভালো ঘরে বিয়ে হলো না কেন?

শুরুতে পত্রিকায় বিয়ের বিজ্ঞাপন দেখে পুরুষের দল চিল-শকুনের মতো হামলে পড়ে। অনেক আবেদনপত্রের ইনভেলপ বেবি নিজের হাতে খুলেছে। সময়টা ’৭২ সালের এপ্রিল মাস। তখনো মেয়েগুলোর পুরুষভীতি প্রবল। বিয়ে তো বিয়ে, কথা বলায়ও চরম অনীহা। তারা আবেগশূন্য আর পাথর হয়ে গিয়েছিল। মেয়েরা নির্বাক, বেবিরাও নির্বাক। সবচেয়ে বড় কথা, তখন কারো মুখে কোনো কথা ছিল না। অগত্যা পাল্টা প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিয়ের আবেদনকারীদের বিরত রাখা হয়।

‘দুঃখী, জনমের দুঃখী এরা। মন্দভাগ্য নিয়া জন্মাইছিল,’ বেবি হাহাকার করে। ‘আমার যত দূর মনে পড়ে, একবার দশ জনকে দশ হাজার টাকা দিয়ে বিয়ে দেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ওয়াইফ সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র, সেলাই মেশিন-টেশিন দিলেন। যারা টাকা নিয়ে বিয়ে করল, তারা খালি টাকা নিল, বউ নেয়নি। যারা বউ নিল, তারা তাদের পদে পদে অপমান করার জন্য নিল।’

আরেকজন সমাজকর্মী, যার নেশা এবং পেশা মেয়েদের স্বাবলম্বী করা, তিনি বললেন, একটা মেয়ের নাম ফুলের নাম দিয়ে, তারে আমরা বিয়ে দিছিলাম। বিয়ের পর সে সুখে আছে। বাহাত্তর থেকে ছিয়াত্তর পর্যন্ত মেয়েদের বিয়ে দেওয়া, চাকরি দেওয়া দুটি কাজই সমান দক্ষতায় তিনি করেছেন। মেয়েরা সমস্যায় পড়লে এখনো ছুটে আসে তার কাছে, খালাম্মা, আপনি আমার বয়স কী দিছিলেন চাকরির সময়? এখনই আমার রিটায়ারের সময় হয়ে গেছে! তখন কী দিয়েছিলেন তাড়াহুড়োয় নিজেরও তার মনে নেই। আসলে দুশ্চিন্তায় দুশ্চিন্তায় মেয়েগুলোকে তখন বয়স্ক দেখাত। ষোলো বছরের মেয়েকে মনে হতো ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের। তিনি স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে বেরিয়েছিলেন, মেয়েরা কে কেমন আছে খোঁজখবর নিতে। একজন বাড়ির গেট থেকেই জানিয়ে দেয়, আপনি এখানে আর আসবেন না। আপনারে দেখলে আমার অনেক কথা মনে পড়ে। আমার কষ্ট আরো বাড়ে। তবে দুটি বাচ্চা নিয়ে সে ভালোই আছে। সেদিন আরেকটা বাড়ি গিয়ে শোনেন, মেয়েটি দশ বছর আগে আত্মহত্যা করেছে। স্বামী দেরিতে জানতে পারে, যুদ্ধের সময় বউ শত্রুর ছাউনিতে ছিল।

‘এমন ঘটনা তো আমারও ঘটতে পারত,’ বেবি মুক্তিকে বলে। আমার বোনের ঘটতে পারত। আমার মায়ের ঘটতে পারত। আমরা বিরাট বাঁচা বাঁইচা গেছি।’ তবে চোখের সামনে যেসব মেয়ের সীমাহীন বিড়ম্বনা দেখতে দেখতে বেবি নিজের অকালবৈধব্যের যন্ত্রণা ভুলেছিল, তাদের প্রতি বরাবরই তার টান। তাদের আড়াল করার ব্যাপারে এখনো সে সচেষ্ট। বেবিরা তখন কেসহিস্ট্রি লিখে ঠিকানার অংশটা কেটে ছিঁড়ে ফেলত, যাতে মেয়েরা নির্বিঘ্নে ঘর-সংসার করতে পারে, ভবিষ্যতে কেউ তাদের নিয়ে টানা-হেঁচড়া করার সুযোগ না-পায়।

এ হলো পঁচাত্তর সাল পর্যন্ত পুনর্বাসনকারীদের চিন্তা ও কাজ। পরে যারা ক্ষমতায় আসে, তারা বান্ডিল বান্ডিল কেসহিস্ট্রি পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু এরকম দামি রেকর্ড, ইতিহাসের উপকরণ আপনাদের কিংবা তাদের এভাবে নষ্ট করা কি ঠিক হয়েছে? এ ব্যাপারে বেবির মতামত, পেট্রোল দিয়ে পোড়ানো উচিত হয়নি, তবে এখন যে ইতিহাসের দোহাই দিয়ে মেয়েদের গরুখোঁজা হচ্ছে, তা-ও ঠিক নয়। ‘তোমরা কী করবে-না-করবে তার জন্য তারা কিন্তু বসে নেই,’ বেবি বলে। কারণ। ‘ওরা নিজেদের ভাগ্য নিজেরা মেনে নিয়েছে, কাজেই সেই জায়গায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার অবকাশ আর থাকছে না।’

তার পরও মুক্তি বেবির কাছে মরিয়মের ঠিকানা চায়! যে ঠিকানা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, বেবি নিজেই অবাক–কেমন করে তা এত বছর পরও মনে রইল! সে মুক্তিকে কড়াল করায়, কঠিন কঠিন শর্ত দেয়। তারপর দুজনে আবদ্ধ হয় এক অলিখিত চুক্তিনামায়।

বে : ঠিকানা গোপন রাখতে হবে।

মু : হ্যাঁ, নামটাও গোপন থাকবে।

বে : ওকে নিয়ে পরিহাস করা চলবে না।

মু : না! কোনো তথ্যবিকৃতিও ঘটবে না।

বে : পত্রিকায় এ নিয়ে চমকপ্রদ ফিচার লেখা চলবে না।

মু : রিপোর্ট বা পত্রিকায় কলাম লেখাও হবে না।

বে : টিভিতে প্যাকেজ নাটক করা যাবে না।

মু : স্বল্প বা পূর্ণদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রও নয়।

বে : ছবি ছাপানো যাবে না।

মু : সাদা-কালো বা রঙিন কোনোটাই নয়।

বে : কাজটা কঠিন কিন্তু।

মু : হ্যাঁ, খুবই কঠিন।

শর্তগুলো ছিল মৌখিক। তাই মরিয়মকে মুখে মুখেই জানাতে হচ্ছিল মুক্তির। সে শোনামাত্র এক ফুঙ্কারে উড়িয়ে দেয়। বলে, তার পক্ষে এমন কেউ শর্তারোপ করতে পারে না, যার সঙ্গে দীর্ঘ আটাশ বছর একবারও দেখা হয়নি, এমনকি যার চেহারাও তার মনে নেই। তবে মরিয়ম বেবির মতোই বলে, ‘তখন এমন এক সময় গেছে, যখন আয়নায় নিজের চেহারা দেখতেও ভয় লাগত।’ এ ছাড়া এই মুখ, এই শরীর আর কারো সঙ্গে বদলে ফেলার তীব্র ইচ্ছা হতো মরিয়মের। কিন্তু কে তাতে রাজি হবে? এমন যে দুস্থ নারী বেবিরা, যুদ্ধে স্বামী হারিয়েছে, তারাও তাতে রাজি হতো না। বিধবার বসন শুধু শুভ্র নয়, দেহটাও নিষ্কলঙ্ক, যা মরিয়মদের নেই। একদিন এক রিকশাঅলা ধানমন্ডির বাড়িটাকে বীরাঙ্গনা অফিস বলাতে সমাজকর্মীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কে কোনদিকে পালাবে তার ঠিক নেই। তারপর তারা নিজেরা যে বীরাঙ্গনা নয়, তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগে যায়। কিন্তু তা প্রমাণ করবে কীভাবে? বীরাঙ্গনাদের তো মেডেল দেওয়া হয়নি যে, অবীরাঙ্গনারা গলার কাপড় সরিয়ে বলবে, এই দেখেন ভাই, আমার গলায় মেডেল নাই, আমি বীরাঙ্গনা না। এদিকে চাকরি বা বিশেষ পদটা ঠিক রাখার জন্য এখানে রোজই তাদের আসতে হচ্ছে। গাড়ি না থাকলে রিকশাই একমাত্র বাহন। বীরাঙ্গনা উপাধিটা যেন বিষাক্ত পোকা কিংবা ছোঁয়াচে রোগ, মরিয়ম ভয়ানক তিক্ততা নিয়ে মুক্তিকে বলে, ‘এর ছোঁয়া লাগলে শরীরে ঘা হবে, হাত-পা পচেগলে খসে পড়বে।’ অথচ তারাই শতমুখে বলত, ‘তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা জাতির গর্ব, তোমরা মহীয়সী নারী!’ বেবিরা মহীয়সী নারী হতে চাইত, জাতির গর্ব তাদের কেউ কেউ তো হয়েইছিল, কিন্তু কোনোভাবে বীরাঙ্গনা নয়। মরিয়মের ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।

সাইড একট্রেস বকুলের কিন্তু মরিয়মের মতো অভিযোগ নেই। বরং তার বিরুদ্ধে মুক্তির কাছে নালিশ জানালেন তখনকার একজন সমাজকর্মী। বর্তমানে তিনি অবসরপ্রাপ্ত। বকুলের ঘটনার পর কান ধরে কসম খেয়েছেন, খোদা যেন ইহজনমে তার হাত দিয়ে অন্যের উপকার না-করায়। কারণ ভদ্রমহিলাকে সে প্রায় পথে বসাচ্ছিল। সংসারটা হয়তো ভেঙেই যেত, যদি তার সহকর্মীরা সময়মতো এগিয়ে না আসতেন। ‘মানুষের উপকার করতে নেই। বিপদ কেটে গেলে উল্টা ছোবল মারে।’ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বৃদ্ধা কথাটা বললেন মুক্তিকে।

কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না বকুলের। পুনর্বাসনকেন্দ্রের সেলাই-ফোঁড়াই- এমব্রয়ডারিতেও মন নেই। একবার ছোট ছেলের জন্মদিনে হাতে হাতে খানিকটা সাহায্য করার জন্য সমাজকর্মী তাকে বাসায় দাওয়াত করে এনেছিলেন। জন্মদিনটা যেন এ বাড়ির ছেলের নয়–ওর। বকুল সেদিন অনেক ফুর্তি আর মজা করল। ‘খালাম্মা এত সোন্দর বাসা আপনের, এইহানে থাকতে মন চায়।’ গৃহকত্রী নিজগৃহের প্রশংসা শুনে হাসলেন, ‘ধুর পাগলি, মন চাইলেই কি সব সম্ভব!’ কিন্তু মনে মনে ভাবলেন অন্য কথা। পুরোনো বাবুর্চির বয়স হয়েছে। চোখে দেখে না। দারচিনি ভেবে মরা আরশোলা তরকারিতে ছেড়ে দেয়। মেয়েটা থেকে গেলে মন্দ হয় না। বকুল থেকে গেল। রান্নাটা সে ভালোই করত। কর্তা তো তেলে-ঝোলে খেয়ে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অফিস ছুটির পর রোজ সাবান, স্নো, পারফিউম এটা-সেটা ব্যাগে নিয়ে ফেরেন। স্ত্রীর রাগী মুখ দেখলে বলেন, ‘আমাদের মেয়ে থাকলে দিতে না এসব? ধরো ও আমাদের মেয়ে।’ তারপর আর কথা থাকে!

বকুল আসলে তাদের মেয়ের মতোই ছিল। বাসায় মেহমান এলে স্বামী-স্ত্রী তাকে নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিতেন। মেয়েটাও তাদের আব্বা-আম্মা বলে পাখির মতো কলকলিয়ে ডাকত। কিন্তু এভাবে এক বছরও ঘুরল না। বকুলের পেটে বাচ্চা চলে এল। ‘তুই আমায় বল, কে তোর এত বড় সর্বনাশ করল। ওর সঙ্গে এখনই আমি তোর বিয়ে দেই।’ তিনি ভেবেছিলেন, বাড়ির ড্রাইভার মতিন না হয় সাদেক। জোরাজুরি করতে বকুল বলে, ‘আব্বা।’ তবু ভালো, পুনর্বাসনকেন্দ্রে ভদ্রমহিলার সহকর্মীদের জেরার মুখে সে সাদেক ড্রাইভারের নাম বলেছিল। পুরোনো ড্রাইভার ছাড়িয়ে নতুন ড্রাইভার পাওয়া গেছে। কিন্তু স্বামীর নামে কলঙ্ক রটে গেলে তিনি কী করতেন? এটা যুদ্ধের চার বছর পরের ঘটনা। বিদেশি ডাক্তাররা অনেক আগে চলে গেছে। বিশেষ অর্ডিন্যান্সের মেয়াদও শেষ। তাই বকুলের গর্ভপাত করাতে তাদের অশেষ বেগ পেতে হয়।

মুক্তি তো অবাক, এত বড় ঘটনা, অথচ বকুল বেগমের তা মনে নেই। সে বলে, ‘পিতা-পুত্রী ছায়াছবির কথা কচ্ছো নাকি তুমি?’ কারণ সেই ছবিতেও তার এরকম একটা পার্ট ছিল। সেখানে গর্ভপাত করানোর পর বিবি সাহেবের বাসা থেকে তাকে তাড়ানোর মধ্য দিয়ে কাহিনি শেষ হয়। বয়সকালে বকুল এই কিসিমের বহু সাইড পার্ট করেছে। আজকাল এসব তার মনেও থাকে না। একটার কথা ভাবলে আরেকটার কাহিনি চলে আসে। তবে সময়টা খুব ভালো যাচ্ছিল তখন। চেহারা ভালো, স্লিম। ফিগার। একবার চিত্রতারকা শাবানার প্রধান সখির পার্ট করার সময় নাচ আর ছোটাছুটির অংশটা একা তার ভাগে পড়েছিল। এমনকি পুরুষের সঙ্গে টেক্কা দিতে ছবিতে সে হিরোইনকে সিগারেট খাওয়া ধরায়, জুডো-কারাতে শেখায়। ছবির শ্রেষ্ঠাংশে বড়মানুষের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলো কার? কার আবার সিগারেটখোর শাবানার, জনমদুখিনি বকুলের নয়। এ নিয়ে তখন তার খুব মনঃকষ্ট গেছে। অভিনয় শেষে রাতে ভালো ঘুম হতো না। কান্নাকাটি করে বালিশ ভিজিয়ে ফেলত। মনে হতো, পৃথিবীর সবচেয়ে অন্যায়ের জায়গা সিনেমা। তবে পেটে দানাপানি থাকলে মানুষ নানান কিছু নিয়ে ভাবে, অযথা দুঃখ করে। তখন বয়স কম ছিল, টাকাও ছিল। এখন কালেভদ্রে ডাক পড়ে। নানি-দাদির পার্ট। সারা দিন স্টুডিওতে বসে বসে পিঠব্যথা, মাজার হাড় কনকন করে। দিন শেষে ম্যানেজার ছোকরা এসে বলে, ‘বকুলি, আজ হলো না রে, কাল আবার আসিস।’ এখন তো রোজ হিসেবে পেমেন্ট। তো খালি হাতে বাড়ি ফেরা। হাত খালি তো পেট খালি।

‘অন্য কাজ খুঁজে নেন না ক্যান?’ মুক্তির কথা শুনে বিরক্ত হয় বকুল। ‘সবাই বলে কাজ খোঁজো, কাজ করো,’ সে মুখ ঝামটা দেয়। ‘করলে কি কাজের অভাব? আমি তো ছিড়া ব্লাউজ-পেটিকোট পইরা রাস্তায় পয়সা তুলতে পারি। আমার অসুবিধা নাই কোনো। কিন্তু ভয়টা ইজ্জতের। বীরাঙ্গনার ইজ্জত না বাঁচলে, দেশের ইজ্জত বাঁচবো?’

‘অহ্, আপনে যে বীরাঙ্গনা, হেইডা কোন ছায়াছবির পার্ট?’

‘জীবন নামের ছায়াছবির,’ হাসিমুখে বকুলের ঝটপট জবাব।

‘এইটা ভোলেন নাই যে বড়?’

‘ভুলতে চাইলে কি ভোলো যায় রে পাগলি? কিছু কিছু জিনিস মনে থেকেই যায়।’

যে দৃশ্যটা কোনো ছায়াছবির নয়, অথচ বকুল বেগম গত উনত্রিশ বছরে এক দিনের জন্যও ভুলতে পারেনি, তা মাত্র ১৫ মিনিটের। তারিখটা আজ মনে নেই। সেদিন ছিল সোমবার। বেলা দশটার দিকে বাড়িতে মিলিটারি আসে। উঠোনে তাদের দেখামাত্র বকুল লম্বা ঘোমটা টেনে দেয়। তারা উর্দুতে ‘কুছ নেহি, ডর নেহি’ বলতে বলতে ঘরের দাওয়ায় উঠে আসে। সঙ্গিন উঁচিয়ে একজন দাঁড়ায় দরজায়। আরেকজন বকুলকে জাপটে ধরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে কাঠের তক্তপোশের ওপর।

‘লোকটা দেখতে কেমন ছিল?’ মুক্তির প্রশ্নটা ধর্ষিত মেয়েকে উকিলের জেরা করার মতো শোনায়। নিজের কানেই তা বেখাপ্পা ঠেকে। তবু সে নিরুপায়। বকুলের মুখে ধর্ষণের বীভৎস বর্ণনা শোনার চেয়ে এ মুহূর্তে প্রশ্ন করাটাই শ্রেয়। মুখ বেঁকিয়ে বকুল বলে, ‘কালো-ছালো, হ্যাংলা!’ আর নিজে সে তখন ছিল হালকা-পাতলা, গায়ের রং শ্যামবর্ণের। ‘এখনো সাজলে তুমি আমারে চিনতে পারবা না।’ বকুল মুক্তিকে গর্ব করে বলে। যা হোক, ১৫ মিনিটে কেয়ামত হয়ে গেল। পাশের ঘরে শাশুড়ি ছোট ছোট দুই নাতনি নিয়ে জায়নামাজে বসা। উঠে আসারও সময় পেলেন না। দরজার সঙ্গিনধারী ঘরে ঢুকে বাক্সের তালা ভেঙে স্বর্ণের মাকড়িজোড়া তুলে নিল। দেয়ালের তাক থেকে সরাল মোরগমার্কা টেবিল ঘড়িটা, যা বড় মেয়ের জন্মের পর ওর নানা নাতনিকে উপহার দিয়েছিল। সেটা পকেটে ঢুকিয়ে পাষণ্ডটা লেদারের সুটকেসটা দু’ভাগ করে রেখে চলে যাওয়ার সময় বকুলের মুখে একদলা থুতু ছিটাল আর কিছু করেনি।

স্বামী বাড়ি ফিরে এটা ভাঙে, ওটা আছাড় মারে। মিলিটারির মতোই তার আচার ব্যবহার। শ্বশুর-শাশুড়ি পুত্রবধূর হাতের রান্না খান না। বকুল পাকের ঘরে বিছানা পেতে চোখের পাতা এক করলে শুধু দেখে, মিলিটারির ভয়ে সে পালাচ্ছে-এই পাড়া থেকে ওই পাড়া, ওই পাড়া থেকে এই পাড়া। কেউ তাকে আশ্রয় দিচ্ছে না। এভাবে কোনোমতে দেশ স্বাধীন হয়। বকুলের দূরসম্পর্কের মামা খবর পেয়ে ছুটে আসেন। দেনদরবার করেও কিছু হয় না। মেয়ে দুটিকে তারা রেখে দেয়। বকুল শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে মাফ চেয়ে জন্মের মতো স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে আসে ঢাকায়। ধানমন্ডির তিন নম্বর বাড়িতে তার এমআর হয়েছিল ’৭২ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে।

মরিয়ম তখনো পুনর্বাসনকেন্দ্রের হাসপাতালে। ছোটখাটো সমস্যা বাদ দিলে সুস্থই আছে। কিন্তু সেলাই-ফোঁড়াই, টাইপিং বা রান্না শেখায় তার মন নেই। সে মুক্তিকে বলে, ‘এসব কাজে মনের স্থিরতা লাগে, গিন্নিবান্নির মতো ধৈর্যের দরকার হয়,’ যার একটিও তখন তার ছিল না। কারণ অতীতটা বিভীষিকা, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত আর মন্টুর অস্তিত্ব শুধু নিখোঁজ সংবাদের পাতায়, এদিকে পত্র পাঠানো সত্ত্বেও কফিলউদ্দিন আহমেদের দেখা নেই। এ কষ্টের ভেতর পূর্বপরিচিত বলতে মিলিটারি ক্যাম্পের সঙ্গী শোভা রানী। সে হানাদার বাহিনীর ছেলের মা হবে। ডেলিভারির আগের রাতে মরিয়ম তার মাথার চুল দু’ভাগ করে দুটি বেণি করে দেয়। বিধবার প্রথম সন্তান। এটা শেষ চান্সও বটে। মরিয়মের বয়স মাত্র বাইশ। যখন তার বিয়ে হবে, বাচ্চা বিয়োনোর সময় আসবে, তখন শোভা রানী পাশে না থাকুক, অন্য কেউ নিশ্চয় চুল আচড়ে বেণি করে দেবে। শোভা রানী উত্তেজিত। বলে, ‘ইশ্‌ মেরিদি, কী গরম!’ তার গলায় আর মুখে মরিয়ম আদর করে পাউডার পাফ বুলিয়ে দেয়। লেবার রুমে ডাক্তারের নির্দেশমতো ঘন ঘন চাপ প্রয়োগ আর কাতরানোর সময় তার ঘাম ও চোখের জলে পাউডার ভিজে কাদা হয়ে গিয়েছিল। প্রসূতি একবার কাঁদে, একবার হাসে। সে একটা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সারা রাত যুদ্ধ করে। ভোররাতে উঁচু পেটটা ধীরে ধীরে নেমে গিয়ে শোভা রানীর দু’পায়ের ফাঁকে বিমল দাসের বংশের প্রদীপ জ্বলে ওঠে।

কফিলউদ্দিন আহমেদ সপরিবারে ঢাকা আসার চার দিন আগে শোভা রানীর শাশুড়ি সুরবালা লোকজনকে জিগ্যেস করে করে বীরাঙ্গনা অফিসে পৌঁছে যান। পুনর্বাসনকেন্দ্রের পত্র পেয়ে নবজাতকের ঠাকুমার আর তর সইছিল না। কাপড়ে চিড়ে-গুড় বেঁধে চলে এসেছিলেন ঢাকায়। শোভা রানী যা ভেবেছে, তা সত্য হয়েছে। কিন্তু অনুরাধা কই? দরজায় গ্রেনেড ফাটার পর থেকেই সে উধাও। হানাদাররা হলরুমে তাকে ফেরত পাঠায়নি। শোভা রানী স্বাধীনতার দিন পর্যন্ত ওখানেই ছিল। কী হলো অনুরাধার? মরিয়মের মতো ক্যান্টনমেন্টের কোনো একটি ঘরে হয়তো আরেকজন আর্মি অফিসার রিপোর্টে ‘বিপজ্জনক’ লিখে তাকে আটকে রেখেছিল। অনুরাধা কি শেষমেশ পাকিস্তান যেতে পেরেছে? মরিয়মের হঠাৎ মেজর ইশতিয়াকের কথা মনে পড়ে। নিজের ওপর তার আস্থার অভাব। পেটে বাচ্চা নিয়ে লাহোরের গুলবাগিচায় যাওয়াটা তাই বেমানান মনে হয়েছিল। পাঞ্জাবি মহিলার গোলাপি লিপস্টিক রঞ্জিত ঠোঁট আর আঁকা ড্রর কাছে সে নির্ঘাত হেরে যেত। সম্মোহনী চোখ, মোহিনী রূপ বাংলামুলুকের নিজস্ব সম্পদ। এখানেই বিকাশ, এখানেই লয়। বাইরে হয়তো তা লক্ষ্যভেদী হয় না। অনুরাধা মাইনাস ফাইভ পরকলায় ঢাকা ঘোলা চোখ নিয়ে ওখানে গিয়ে থাকলে, এখন কী করছে?

পুত্র কোলে শাশুড়ি সুরবালার সঙ্গে শোভা রানীর চলে যাওয়ার পর মরিয়মের নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। জরায়ুর শূন্যতা হঠাৎ তাকে গ্রাস করে। একই দিনে ডাকে ফেলা চিঠির সাড়া দিয়ে সুরবালা এসে নাতি-পুত্রবধূ নিয়ে চলে গেলেন, কফিলউদ্দিন আহমেদের এখনো দেখা নেই। বংশের বাতিই সব, জীবিত মেয়ের কোনো দাম নেই, এত বড় একটা যুদ্ধের পরও? লাখ লাখ মানুষ মারা গেল, সেবাসদন আর অন্যসব জায়গায় বীরাঙ্গনাদের বাচ্চা হয়েছিল কয়টা। তাদের বিদেশ না পাঠালে স্বাধীন দেশটার কী ক্ষতি হতো? তারা পাকিস্তানি জালিমের বাচ্চা শুধু, বাঙালি মেয়ের নয়? খোঁচাখুঁচি করার ফলে জরায়ু আহত হয়েছে তো মরিয়মের একার, মেজর ইশতিয়াক যে শরীর নিয়ে এসেছিল সেই শরীরেই ফিরে গেছে। তার আসা-যাওয়ার পথটাই শুধু বদলে গিয়েছিল। আগমন : পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ। নির্গমন : বাংলাদেশ ভারত-পাকিস্তান। ব্যস, এইটুকুই। মাঝখানে কতশত মানুষ মারা গেল, কতশত মেয়ে নির্যাতিত হলো, কতশত ঘর পুড়ল, কয়েক শ ব্রিজ আর কালভার্ট উড়ে গেল-মরিয়ম বীরাঙ্গনা অফিসে জনে জনে জিগ্যেস করে আর আঙুল গুনে হিসাব করে। সকালের দিকে সংখ্যাটা গণনাযোগ্য মনে হলেও দুপুর নাগাদ সে খেই হারায়। রাতটা পার হয় মরফিনের ঘোরে। পরদিন সংখ্যাগুলো ছোট ছোট সাপের আকৃতি নেয়। তৃতীয় দিনে ডাক্তার রোগ নির্ণয় করলেন–ইপিলেপসি সাইকোসিস। এর উপসর্গ হচ্ছে ঘুম না হওয়া, খেতে না পারা, মূৰ্ছা যাওয়া, ছোটাছুটি করা, অস্থির হয়ে পড়া। চতুর্থ দিনে কফিলউদ্দিন আহমেদ মেয়েকে শনাক্ত করলেন। কর্তৃপক্ষকে বললেন যে, পাগলামিটা তাদের পারিবারিক অসুখ। যুদ্ধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মেরির দাদিরও মাথা গরম ছিল। তার এই নাতনি কোনো কারণ ছাড়াই একবার সিনেমা দেখার নাম। করে বাড়ি থেকে চলে যায়। ২৫ মার্চের আগে শহরের লোকজন যখন যার যার গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছিল, সে তখন ছোট ভাইকে ফুলতলি পাঠিয়ে রায়েরবাজারের বাসায় একা পড়ে থাকে। এসব কি পাগলামির লক্ষণ নয়? কফিলউদ্দিন আহমেদের হাটে হাঁড়ি ভাঙার কারণ আর কিছু নয়, তিনি শুধু মেয়েকে এই কলঙ্কের জায়গা থেকে গোলাম মোস্তফার কথামতো তড়িঘড়ি সরিয়ে নিতে চাচ্ছিলেন। তার পরও ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আরো এক সপ্তাহ বীরাঙ্গনা অফিসে থাকতে হয় মরিয়মকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *