১৫. সারেন্ডার সারেন্ডার, একটি জরুরি ঘোষণা

সারেন্ডার সারেন্ডার, একটি জরুরি ঘোষণা

মেজর ইশতিয়াকের দলটা শত্রুর তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে। পলায়নবৃত্তি কাপুরুষতা, তবে মৃত্যুর চেয়ে ভালো।

ব্যারাক ছাড়ার আগে মেজর ইশতিয়াকরা সাদা আর হলুদ মিত্রদের জন্য অপেক্ষা করে। তারা আকাশের দিকে তাকায়, সাগরের ওপর চোখ রাখে। শূন্যের রং নীল, সাগরেরও তাই। চীনা বা আমেরিকানদের এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। রং শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায়। তাতে অযথা কালক্ষেপণ হয়। অবশেষে মাকড়সার জালে বন্দি মাছির মতো ভনভন করতে করতে রাতের অন্ধকারে একটি নদীর খোঁজে বেরিয়ে পড়ে। উড়োজাহাজ থেকে দেখা রুপোলি সর্পিল জলাধার, তীরে নোঙর করা সারি সারি গানবোট–যেগুলো পদ্মার ওপর দিয়ে কুলচিহ্নহীন মেঘনার মোহনা পর্যন্ত তাদের এগিয়ে দেবে। তারপর সাদা পতাকাবাহী জাহাজে চেপে বিক্ষুব্ধ সাগরের তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যাবে এমন এক নিরাপদ বন্দরে, যার জেটিতে স্ত্রী-সন্তানেরা চোখে জল আর হাতে রুমাল নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু দিনশেষে রাত নামে। শুকনো খাল-বিল ছাড়া কিছু নজরে পড়ে না। নদীগুলো যেন যুদ্ধাক্রান্ত জনগোষ্ঠী, তাদের বুটের আওয়াজে দ্রুত পালাচ্ছে। অগত্যা সমুদ্রপথে পলায়নের পরিকল্পনাটা বাতিল হয়। কিন্তু শত্রু পেছনে রেখে ডাঙায় টিকে থাকা কঠিন, বিশেষ করে এমন এক জনপদে, যেখানে তুমি কারো সাহায্য আশা করতে পারো না। স্থানীয় লোকজন সামনে পেলে শিয়াল-কুকুরের মতো পিটিয়ে মারবে। শত্রু অঞ্চলে একটা বিচ্ছিন্ন দলের বাঁচার উপায় তারা স্টাফ কলেজের প্রশিক্ষণকালে পাতানো যুদ্ধের মাধ্যমে শিখেছিল। কিন্তু বাস্তবটা অন্যরকম। দিনে গা-ঢাকা দেওয়ার যে জনপ্রাণীহীন ল্যান্ডস্কেপ থাকার কথা, সে রকম কিছু কোথাও নেই। রাত কাটে খেতের সবজি চুরি করে, অনিদ্রায়, আতঙ্কে। পাতার খসখস আওয়াজ, ব্যাঙের ডাক, শিয়ালের খকখক হাসি শুনে তারা বন্দুকের ট্রিগার টিপে ধরে। এর মধ্যে এক রাতে সবজি চুরি করার সময় এমন এক অঘটন ঘটে, যা সেই গাঁয়ের লোক গর্ব আর শোকের স্মৃতি হিসেবে যুদ্ধের বহু বছর পরও মনে রাখবে এবং যে-কোনো আগন্তুকের কাছে তারা তা বয়ান করবে। তাতে মর্সিয়ার মাতম সহযোগে কারবালার কাহিনি শোনাবেন এক বৃদ্ধ। যার বয়সের গাছপাথর নেই।

সেদিনের ঘটনার শুরু বর্তমান মুদি দোকানদার ইব্রাহিম বিশ্বাসকে দিয়ে।

ইব্রাহিমের বয়স তখন দশ। অবেলায় খেজুরের রস খেয়ে তার পাতলা পায়খানা হচ্ছিল। ভোররাতের দিকে পেটে মোচড় দিতে সে একাই বাড়ির নামায় গিয়ে বসে। নিজেকে খালাস করে বসাবস্থায় অদূরের সবজির মাঠে আয়েশ করে তাকায়। আমি ছোট্ট এইখানি তো, সামনের একটা ন্যাংটা বাচ্চাকে দেখিয়ে মুক্তিকে বলে ইব্রাহিম, ‘ভাবিলাম মুলো খেতে বুঝি শেয়াল পড়িছে। ঝাঁকে ঝাঁকে শেয়াল। আগে ইব্রাহিমদের গাঁয়ে মানুষ মরলে শিয়াল ডাকত। তখন যুদ্ধের বছর, হরবখত মানুষ মারা যাচ্ছে। রাতের প্রহরে প্রহরে শোনা যায় বজ্জাতগুলির হুঙ্কুতি আর হুক্কা হুয়া হাঁকডাক। খালে বিলে এত মরা থাকতে, ইব্রাহিম অবাক হয়ে ভাবে, ‘সবজি খেতে তেনারা মুলো খাইতে আসিছে কেন।

মুলাখেতের পাশেই লঙ্কার আবাদ। আর ওখানেও শিয়াল। শিয়ালগুলো বড় বড়, সংখ্যায় মনে হয় কয়েক গন্ডা। ইব্রাহিমের ধন্ধ লাগে। এ তো শিয়াল নয়, মানুষ-ছপছপ করে পাতাসুদ্ধ মুলো খাচ্ছে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে। তার আর পুকুরঘাটে যাওয়া হয় না। পরনের হাফপ্যান্ট পতাকার মতো মাথার ওপর নাচাতে নাচাতে সে বাপজানকে গলা ফাটিয়ে ডাকে। যতটা জোরে ডাকলে মানুষের ভয় পালায় ঠিক ততখানি গলা ফাটিয়ে। বাপ বেরিয়ে এলে সে ‘মুলো খেতে শেয়াল পড়িছে’ বলে, বলে না যে মানুষ। কারণ মানুষ বলতে তখনো তার গা ছমছম করছিল। যা হোক যুদ্ধের দিন, লোকজন ঘুমালেও কান দুটি জেগে থাকে। বাপবেটার চিল্লাচিল্লিতে পাড়াপড়শির ঘুম ভেঙে যায়। তারা দলে দলে বেরিয়ে আসে হাতে লাঠিসোটা নিয়ে। ততক্ষণে ভোরের কুয়াশা কেটে গেছে। সকাল হয় হয়। তবু তারা খেতে পাকসেনাদের ছোটাছুটি করতে দেখে শিয়ালই ভাবে, মানুষ ভাবে না। কারণ বাজারের ক্যাম্প ভেঙে দু’দিন হয় পাক আর্মি চলে গেছে। বিহারিরা সপরিবারে গেছে তাদের পেছন পেছন। রাজাকাররাও লাপাত্তা। এ অবস্থায় খেতে শিয়াল নয় তো কী। দেখতে-শুনতে বা আচার-ব্যবহারে ভোরের আলো-আঁধারে এদের শিয়াল বলেই গণ্য হয়। তেনারাও মানুষজন দেখে শেয়ালের মতো লেজ দুলিয়ে নাইচতে লাগিছেন, ইব্রাহিমের কথার মাঝখানে বলে ওঠে ঘটনার আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী ওসমান গনি। অবশ্য বিষয়টা তখন আর ইব্রাহিমের একার থাকে না। প্রাপ্তবয়স্কদের এখতিয়ারে চলে। যায়। তারা হাতের লাঠিসোটা নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ যুদ্ধের যেন শেষ নেই। আর ফসলের খেতগুলোও মনে হয় কারবালার ময়দান। ওসমান গনি কাহিনির এই জায়গায় কথা বন্ধ করতেই একজন বৃদ্ধ নিচু স্বরে কারবালার গীত গেয়ে ওঠেন। এ যেন আগে থেকে রিহার্সেল করা–কথা থামলে গান শুরু হবে। চোখ বুজে বৃদ্ধ গাইছেন–

কারবালারো কথা কইতে যায় গো হৃদয় ফাটিয়া
কান্দে মায়ে বাচ্ছা কোলে লইয়া।
নবীর বংশ ধ্বংস হইল শুধু পানির লাগিয়া
কান্দে মায়ে বাচ্ছা কোলে লইয়া।

জমায়েতটা ইস্পাতের মতো স্থির। বাতাসের কম্পন কখন যেন থেমে গেছে। মুক্তি তাকিয়ে দেখে, বৃদ্ধের ভাঙাচোরা দেহটা দু’হাঁটুর মধ্যিখানে। শোকে তিনি মোহ্যমান। গান শেষে তার স্বল্প কেশের মাথাটা নুয়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সে বৃদ্ধের বয়স জানতে চাইলে গাঁয়ের কেউ সঠিক বলতে পারে না। গাঁয়ের সর্বজ্যেষ্ঠ মুরুব্বি ওসমান গনি জানায়–সত্তরের জলোচ্ছ্বাসের পর সাগর উপকূলের এক গ্রাম থেকে নিঃস্ব অবস্থায় বৃদ্ধ এখানে আসেন। তার পরনে ছিল ছেঁড়া তবন, গায়ে তাপ্লিমারা ফতুয়া আর বগলে খান কয়েক জীর্ণ পুঁথি। এসে বললেন, সংসারে জনমনুষ্যি কেউ বেঁচে নেই। সাগর টেনে নিয়েছে। নোনা পানি বৃদ্ধের হাড়মাস খেয়ে ফেলেছিল। চামড়াও নুন-পোড়া। এসেই ঘড়া ঘড়া পুকুরের পানি একেক টানে যখন খেয়ে নিচ্ছিলেন, তখন তিনি দেখতে আজকের মতোই। শীতের শেষে তার চলে যাওয়ার কথা ছিল। এর মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল। তখন কারবালার কাহিনি শুনিয়ে শুনিয়ে বৃদ্ধ কমলগঞ্জের মানুষদের আসন্ন যুদ্ধের ব্যাপারে প্রস্তুত করেন। জনে জনে তিনি বলেন যে, বিক্ষুব্ধ সাগরের মতোই যুদ্ধ। তা ধ্বংস করে, আপনজনের মৃত্যু ঘটায় আর সয়সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তা অন্ধ-বড়লোক ছোটলোক মানে না, নারীদের উলঙ্গ আর বেইজ্জত করে। যুদ্ধশেষে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ফরসা চেহারার শহুরে বা ভিনদেশি মানুষেরা খাদ্য-খাবার, ক্যামেরা নিয়ে আসে। নিজেরা সঙ্গে আনা বোতলের পানি খায়, সেই পানিতে ভাগ বসাতে দেয় না। খাদ্য কম্বল বিতরণ করে ছবি তুলে চলে যায়।

বৃদ্ধের কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। অকারণে এত মৃত্যু, তা-ও আবার সমুদ্রের আক্রোশে নয়, মানুষের ষড়যন্ত্রের ফলে, এ শোক স্বজনহারা মানুষ সামলাবে। কী করে! তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বৃদ্ধকে তারা যেতে দেয়নি। সেই থেকেই তিনি আছেন। তার গানের বিষয়ও একটা কারবালা। যখনই একাত্তর নিয়ে কথা ওঠে, তিনি তাদের কারবালার কাহিনি শোনান। কাজটা অনিয়মিত। তবু এর বিনিময়ে তাকে তারা দু’বেলা খেতে দেয়। খুব সামান্যই তিনি আহার করেন। দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তরে তাকে খাওয়াতে তাই তাদের অসুবিধা হচ্ছে না। এরপর গ্রামবাসীর বক্তব্য শেষ হলে বৃদ্ধ ‘হায় গো দুলদুল’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যান, যা তাদের রিহার্সেলের অংশ বলে মনে হয় মুক্তির ।

ওসমান গনি জানায়, সেদিন দুপুরের আগেই উভয় পক্ষের চারটা লাশ পড়ে। সৈন্য যদি মরে একজন, গাঁয়ের লোক মারা যায় তিনজন। কারণ সৈন্যদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র । গাঁয়ের লোকজনের সম্বল বলতে লাঠিসোটা আর ঘৃণা। তা-ই দিয়েই তারা লড়ে যাচ্ছিল। দুপুরের দিকে রণকৌশলে কিছুটা রদবদল হয়। যারা খেত-খামারে যুদ্ধ করছিল, তারা পিছিয়ে আসে। কয়েক গাঁয়ের লোক টেটা-বল্লম হাতে সৈন্যদের ঘিরে দাঁড়ায়। বৃত্তটা দ্বিতীয় দিনে ছোট আর আকারে হয় গোল। সৈন্যরা গুলি চালাতে চালাতে বৃত্তের কোনা ভেঙে বেরিয়ে গেলে তাদের সেদিনের গুলিবর্ষণে শহিদ হন ইব্রাহিমের বাবা ইসমাইল।

পাকসেনাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র যতই থাকুক লোকবল তো কম। তারা মোটে বিশ পঁচিশ। এদিকে গ্রামবাসীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় হাজার হাজার। উপায়ান্তর না দেখে পাকসেনারা বাজারের মসজিদে ঢুকে দোর আটকে দেয়। গুলির মুখে গাঁয়ের লোকজনের মসজিদের দরজা ভাঙার সাহস হয় না, তবে তারা সরেও যায় না। জায়গাটা ঘিরে রাখে। ততক্ষণে আশপাশের পাঁচ ছ’ গাঁয়ের নর-নারী, ছেলে-বুড়ো সবাই যুদ্ধে শরিক হয়ে গেছে। তারা গায়ের যোদ্ধাদের জন্য ডালা ভরে খই-চিড়ে আর মাটির মটকায় করে গুড় নিয়ে আসে। তেষ্টা নিবারণ হয় মসজিদসংলগ্ন পুকুরের পানিতে। হায় গো কারবালার যুদ্ধ!’ ভিড়ের মধ্য থেকে বৃদ্ধের কণ্ঠ ফের ভেসে আসে। ফোরাতের পানি রক্তে ভাইস্যে গেল, তবু যুদ্ধ থামল না।’ এটুকু বলে শ্রোতাদের মনোযোগ আকর্ষণের পর পুনরায় পুঁথির ভুবনে ঢুকে পড়েন বৃদ্ধ। তার মাথাটা হাঁটুর বেশ খানিকটা ওপর। ভঙ্গুর দেহটা সাপের মতো দুলছে যেন কোনো। এক অদৃশ্য সাপুরের বাঁশির সুরে সুরে–

এই কথা শুনিয়া রে কাশেম জ্বলিয়া উঠিল
ছাগলের পালে যেমন বাঘ ঝাঁপ দিল।
কলার বাগিচা যেমন হাতিতে লুটায়
দুই হাতে তলোয়ার লইয়া অমনি কাটে ভাই।

মুক্তির মনে হয়, সবাই যেন ইতিহাসের যোদ্ধা–প্রাণপণে শত্রুর মোকাবিলা করছে। আর বৃদ্ধ তাদের গানে গানে বলে যাচ্ছে, তোমরা অনর্থক কালক্ষেপণ করিয়ো না। পুকুরের পানি শুকিয়ে তলায় লেগে গেছে। আচমকাই তার চোখে নামে বিষাদের কালো ছায়া। সেখানে শুধুই শোক, বহু বছর আগেকার এক বালক যোদ্ধা কাশেমের জন্য। ঘরে যার সদ্য বিয়ে করা বালিকা বধূ সখিনা। যোদ্ধা নিজে তিরবিদ্ধ, জলতেষ্টায় কাতর। ভূমিতে পড়ে ছটফট করছে। বৃদ্ধের কণ্ঠে ঝরনার মতো ঝিরঝিরিয়ে বিষাদের সুর নামে।

ইব্রাহিমের মা মদিনা বিবিসহ অন্য বিধবারা শুরু থেকেই পুকুরপাড়ে। মাঠে ময়দানে পড়ে থাকা লাশের কাছে কেউ নেই। মহিলাদের ভাবখানা এমন, মসজিদের শত্রুরা নিহত হলে, তাদের স্বামীরা আপনা হতে জ্যান্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরবে, যেমন করে হাল বাওয়ার পর গোধূলি বেলায় মাঠ থেকে লাঙল-গরু নিয়ে ফিরত। এদিকে মসজিদ ভাঙা ছাড়া শত্রু নিধনের অন্য কোনো উপায় নেই। এ নিয়ে যখন মতভেদ চলছে, তখন স্কুলছাত্র মহিবুলকে দেখা যায় ‘সারেন্ডার সারেন্ডার’ বলে ফসলের মাঠ চিরে দৌড়ে আসতে। সে রেডিওতে জেনারেল মানেকশ’র আত্মসমর্পণের নির্দেশটা শুনে আর দেরি করেনি। মসজিদের কাছাকাছি এসে তোতা পাখির মতো এর পুনরাবৃত্তি করে, ‘ভাইসব তোমরা চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়িছো। আকাশপথ-সমুদ্রপথ বন্ধ। পালানোর উপায় নেই। তোমরা সারেন্ডার করো, নতুবা মৃত্যু। সারেন্ডার করলে জেনেভা কনভেনশন মোতাবেক তোমাদের প্রতি যুদ্ধবন্দির আচরণ করা হইবে।’

মহিবুলের মুখে জেনারেল মানেকশ’র ঘোষণাটি সবাই ধৈর্য সহকারে শোনে। সারেন্ডার যে মাথার ওপর হাত তোলা, এই নয় মাসে তারা তা শিখেছে। ‘কিন্তু জেনেভা কী রে, মহিবুল?’ মসজিদের বেষ্টনী ধরে রেখে ওসমান গনি গলা তুলে জানতে চায়। ‘জেনেভা হলো গে দেশ, একটা স্বাধীন রাষ্ট্র।’ মহিবুল দম নেওয়ার ফাঁকে গভীরভাবে চিন্তা করে আরো বলে, ‘সারেন্ডার করলি পর তেনাদের জেনেভা দেশে চালান করি দিবে।’

খবরটা শুনে সবার মাথায় হাত। ভারতের এ কেমন বিচার! ‘নয় মাস ধরে জ্বালাল-পোড়াল, খুন করল, ইজ্জত নিল–সাজা হবে না? জেনেভা দেশে পাঠাই দিবে!’

‘জে,’ মহিবুল নিজে যেন ভারতীয় সৈন্য, মৃদুস্বরে অপরাধীর গলায় তা স্বীকার করে।

ওসমান গনি বেষ্টনী ছেড়ে এক লাফে পুকুরের উঁচু পাড়ে ওঠে। রাগে-অপমানে মুখটা তার লাকড়ির চুলার মতো গনগনে লাল। ভায়েরা, শেয়াল মারিছ না তোমরা অতীতকালে!’ সে তর্জনী নাচিয়ে নাচিয়ে বক্তৃতা আরম্ভ করে, ‘গর্তের মুখে ধোয়া দিয়ে মোরা এখন শেয়াল ধরিব–চলো।’ যেই কথা সেই কাজ। বস্তা ভরে লঙ্কার গুঁড়ো এল। শুকনো কচুরিপানা, খড়ের বিচালি, পাটখড়ি, কেরোসিন জোগাড় হয়ে গেল হাতে হাতে। একজন মই বেয়ে উঠে গেল মসজিদের গম্বুজের চূড়ায়। হাতুড়ি, বাটাল, শাবল দিয়ে মসজিদের ছাদ ফুটো করে ফেলল। ছিদ্রপথে দাহ্য পদার্থের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হলো লাল লঙ্কার গুঁড়ো। ধোঁয়ার কুণ্ডলী আকাশে উঠতে থাকলে সেদিন সূর্য ঢাকা পড়ে মধ্যাহ্নেই কমলগঞ্জে নেমে আসে রাতের অন্ধকার।

ধোঁয়া-অন্ধকারের আড়ালে মানুষগুলো ওত পাতে মসজিদের দরজায়। একেকজন সৈন্য মাথার ওপর হাত তুলে সারেন্ডার করে বেরোয় তো, মানেকশ’র ঘোষণা অগ্রাহ্য করে তারা শিয়ালের মতো পিটিয়ে মারে। হত্যার বহ্নি উৎসবে কখন ত্রাণকর্তারা ট্যাংক নিয়ে হাজির হয়েছে, তারা তা দেখতে পায়নি।

দেখেছিল এক বিহারি, মজিদ নাম, ঘটনাস্থল থেকে এক মাইল দূরে। লোকটা ছিটগ্রস্ত। আজগুবি চিন্তায় মাথাটা ভরপুর। অন্য সব বিহারি পাকিস্তান আর্মির পেছন পেছন সটকে পড়লে সে শুধু রয়ে যায় তাদের প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাকিস্তানি যোদ্ধারা এইভাবে চোরের মতো পালিয়ে যাবে, চোখের সামনে দেখেও তার বিশ্বাস হয়নি। তাহলে তো আসমানের চান-সুরুজ মিথ্যা হয়ে যায়। তৃতীয় দিনে তার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়। মজিদ বিহারি দেশভাগ দেখেছে। বন্দে মাতরম আর নারায়ে তকবির আল্লাহু আকবর-এর মুখোমুখি সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ আর ছোরার ঝলকানির সে একজন প্রত্যক্ষদর্শী। রাতের আঁধারে বিহারের টিলাটক্কর, কাঁটা ঝোঁপড় আর বাংলামুলুকের একাংশ ডিঙিয়ে এপারে চলে আসার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তার আছে। তারপর নয় মাস যাবৎ এত বড় একটা যুদ্ধ গেল, আশ্চর্য যে সে কোনোদিন ট্যাংক দেখেনি। লোকটা ট্যাংক দেখে ভাবে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী বুঝি শক্তিমান যানে চেপে ড় তুলে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসছে। তাদের আগমন মাটি কাঁপানো ভূমিকম্পের মতন। তাতে তার শরীর আবেগে থরথর করে। সে আর বিলম্ব করে না। ‘রোকো রোকো ভাইয়া, হামলোক বিহারি আদমি, তুমহারা দোস্ত!’ ধ্বনি তুলে মজিদ বিহারি কম্পমান মাটির ওপর দিয়ে নতুন হাঁটতে শেখা শিশুর মতো টলতে টলতে দৌড়ে যায় যন্ত্রদানবের দিকে।

দৃশ্যটা দেখেছিল ট্যাংকের ওপর থেকে ইব্রাহিমের বড় বোন মর্জিনার স্বামী আতা মিয়া। মুক্তির ইশারায় সে বসাবস্থা থেকে সিনা টান করে উঠে দাঁড়ায়, নিজের পরিচয় দেয়, ‘আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ভারত থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।’

সেদিন ‘ট্যাংকের ওপর আপনি কী করছিলেন?’ মুক্তির প্রশ্ন শুনে আতা মিয়া থ। যুদ্ধের এত বছর পর, কেউ এমন প্রশ্ন করতে পারে, তার ধারণা ছিল না। সে মনে বেদম চোট পায়। সত্যি, সেদিন ট্যাংকের কমান্ডার, ক্রু বা চালক এসব গুরুত্বপূর্ণ পদের কেউ ছিল না আতা মিয়া। তার থাকার কথাও নয়। তাদের দল তখন মিত্রবাহিনীর ট্যাংকের পথপ্রদর্শক। শত্রু ঠেঙাতে ঠেঙাতে বীরের বেশে স্বদেশে ফিরছে। কিন্তু চোখে-মুখে, শরীরের ভঙ্গিমায় বীরত্বের ভাবটা কিছুতেই ফুটিয়ে তুলতে পারছিল না। ট্যাংকের ইস্পাতের বডিটা পিচ্ছিল আর সামনের দিকটা ঢালু। ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে শরীর পিছলে পিছলে পড়ে যেতে চায় নাক উঁচু ট্যাংকের কনভেয়ার বেল্টের তলায়। এই অবস্থায় হাতের তালুর ওপর ভর রেখে টাল সামলাতে বেশ নাজেহাল হতে হচ্ছিল পথপ্রদর্শকদের। কিন্তু সেসব তো তখনকার কথা। তারপর আতা মিয়া যখনই নিজের গৌরবময় দিনগুলোর কথা ভাবে, তখন একটা নাক উঁচু ট্যাংক ঘড়ঘড়িয়ে তার স্মৃতিতে ঢুকে পড়ে। তখন সে আর দু’কাঠা ধানি জমির মালিক, পেশায় গার্লস স্কুলের দফতরি, ইব্রাহিমদের বাড়ির ঘরজামাই থাকে না। হয়ে যায় ট্যাংকআরোহী-বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার বীজ বপন করতে করতে যে এগিয়ে আসছে। মুক্তির প্রশ্নটা তাই তার স্মৃতির প্রতি হুমকি। যাচাই-বাছাইয়ের সময় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে কলমের খোঁচায় নাম কাটা যাওয়ার চেয়েও বেদনাদায়ক।

সে সময় যুদ্ধের মতিগতি হঠাৎ পাল্টে গিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তখনো জানে না যে, এবার গেরিলা যুদ্ধ খতম, সামনে আসল যুদ্ধ–একেবারে শত্রুর মুখোমুখি, যার নেতৃত্বে থাকবে মিত্রবাহিনী, আতা মিয়ারা থাকবে পার্শ্ব চরিত্রের ভূমিকায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখা গেল, সামনে হাফ ডজন ট্যাংক। ট্যাংক কমান্ডারের গলায় দুরবিন, মাথায় হেলমেট। ক্রুরা সব ডাংরি পরে ট্যাংকের নিরাপদ গহ্বরে ঢুকে বসে আছে। পথঘাট চেনানোর জন্য দীনহীন বেশের আতা মিয়াদের বসিয়ে দেওয়া হয় অভিজাত ট্যাংকের ওপর। আতা মিয়া ভয়ে তটস্থ। তার মনে হচ্ছিল, তোপের মুখে মিত্রবাহিনী তাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। ভয়ের চেয়েও বিষয়টা অপমানের। কিন্তু খানিক পর উল্টো দিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি আসতে শুরু করলে, আতা মিয়া বলে-মারাঠি ট্যাংক কমান্ডার ‘আপনারা নেমে যান, নেমে যান’ নির্দেশ দিয়ে নিজে ঢাকনার নিচে ঢুকে পড়ে। তারপর ঝাং-গুরুম, ঝাং-গুরুম শব্দে গোলা ছুঁড়ে ছুঁড়ে আসল যুদ্ধটা ট্যাংকবাহিনীই চালিয়ে যায়। আতা মিয়ারা থাকে পেছনে–শোয়া পজিশনে। এই অবস্থায় অর্ডার আসে, পাকিস্তান আর্মি পালিয়েছে, তোমরা এগিয়ে গিয়ে ক্যাম্প দখল করো। দখল আর কী-পোড়া মাটি, ধ্বংসস্তূপ, পরিত্যক্ত বাংকার, অর্ধভুক্ত বিরিয়ানি, থালাবাসন, কয়েকটা তাজা লাশ। কিন্তু ট্যাংকগুলো থামে না। কারণ জাতিসংঘের নিউ ইয়র্ক অফিসে তখন তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে। বিষয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। যুদ্ধবিরতি ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাবের পক্ষে-বিপক্ষে ১০৪-১১টি ভোট পড়ে। বিপক্ষের ভোটাররা ভারত আর সোভিয়েত লবির মাত্র ১১টি দেশ। এদিকে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী জে এ ভুট্টো সাত সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল নিয়ে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেছেন। অবস্থা সঙ্গিন। জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস হওয়ার আগেই ভারতীয় ট্যাংকবাহিনীর দ্রুত ঢাকা পৌঁছাতে হবে। শত্রুকে তাড়া করে তাই তারা এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি মার্চ করছে সহযোগী পদাতিক বাহিনী। আর আতা মিয়ারা তো আছেই সঙ্গে।

এভাবে দিন কয়েক চলার পর, কমলগঞ্জে জনতার সঙ্গে পাকিস্তান সৈন্যের খণ্ডযুদ্ধের খবরটা তাদের কাছে ওয়ারলেস মারফত আসে। কমলগঞ্জ আতা মিয়ার চেনা জায়গা, নিজের গ্রাম থেকে মাত্র দুই ক্রোশ পথ। তাই তাকে সমাদর করে প্রথম দিনের মতো ফের ট্যাংকে তোলা হয়। ট্যাংক-কমান্ডার খুশিতে ডগমগ—’দোস্ত জলদি চলো। মওকা মিল গিয়া।’ মৃত সৈন্য নয়, এখন তাদের দরকার জ্যান্ত যুদ্ধবন্দি। কমান্ডার আতা মিয়ার দিকে তাকালেই সে হাতের ইশারায় সামনের দিকটা দেখিয়ে দেয়। অর্থাৎ-চিন্তার কোনো কারণ নেই-কমলগঞ্জ সামনেই। ঠিক সে সময় মজিদ বিহারির ট্যাংকের সামনে হঠাৎ চলে আসাটা ছিল উটকো ঝামেলা। আতা মিয়া প্রথম বুঝতে পারেনি। সে তখন দ্রুতগামী ট্যাংকের পিঠে নিজেকে ধরে রাখতেই ব্যস্ত। তারপর ‘রোকো রোকো…’ চিৎকারটা যখন শোনে, ততক্ষণে মজিদ বিহারি পদাতিক বাহিনীর গুলি খেয়ে উড়তে উড়তে রাস্তার বাইরে চলে গেছে। দৃশ্যটা তাকে এতই আচ্ছন্ন করে রাখে যে, সামনের মসজিদে ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখেও তার কোনো ভাবান্তর হয় না। তবে হাফ ডজন ট্যাংকের পরোয়া না-করে উন্মত্ত জনতাকে যখন মারদাঙ্গা চালিয়ে যেতে দেখে, তখন সে ট্যাংকের পিঠ থেকে খুশিতে লাফিয়ে পড়ে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয়–জয় বাংলা!

মসজিদের দরজাটা পদাতিক বাহিনীর দখল নিতে নিতে খান পাঁচেক পাক আর্মির লাশ পড়ে যায়। তাতেও লোকগুলোর রাগ কমে না। জেনেভা দেশে হানাদারদের জামাই আদরে থাকাটা যে-করে হোক ঠেকাবেই। এই মানেকশ’র ‘সারেন্ডার সারেন্ডার’ ঘোষণাটি যত অনিষ্টের মূল। গত ন’মাসে তারা রেডিও শুনেছে বিস্তর, কিন্তু কোনো খবরই এভাবে তাদের নাকে-মুখে থুতু ছিটিয়ে দেয়নি। মিত্রবাহিনীর দাবড়ানি খেয়ে ওসমান গনি পুকুরের উঁচু পাড়ে ফের এক লাফে উঠে যায়, ‘ভায়েরা শোনেন, একবারটি মোর কথা শুনি লন। ইব্রাহিমের বাপ ইসমাইলকে নচ্ছাররা যখন গুলি করইলো, মানিক শার চ্যালা-চামুণ্ডারা তখন কনে ছিল! কনে ছিল আফিলুদ্দিন যখন শহিদ হয়–’

ওসমান গনির ফাটা বাঁশের মতো ভাঙা খ্যানখেনে গলা আর আতা মিয়ার মুহূর্মুহূ জয় বাংলা স্লোগান মিত্রবাহিনীর ফাঁকা আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতা ক্রমশ পিছু হটতে শুরু করে। তারা দৌড়ঝাঁপ করতে করতে একসময় পৌঁছে যায় দুদিন আগের পচাগলা লাশের কাছে। সেখানকার বাস্তবতা তখন ভিন্ন…।

যে যে-জায়গায় গুলি খেয়ে পড়েছিল, সেখানেই ফুলে ঢোল হয়ে আছে। আর তাদের নিয়ে চলেছে কাক, শকুন, কুকুরের ত্রিমুখী লড়াই। বাঙালি আর পাকিস্তানি লাশের মধ্যে তরতফাত নেই। গাঁয়ের মহিলারা শত্রু-মিত্র ভুলে সব কটা লাশের জন্য আছাড়ি-পিছাড়ি বিলাপ জুড়ে দেয়। নারীদের অরাজনৈতিক কাণ্ডকারখানায় পুরুষেরা বিরক্ত হয়। তারা পাকসেনার লাশগুলো কোনোরকমে মাটি চাপা দিয়ে, আত্মীয় বা প্রতিবেশীর অর্ধভুক্ত দেহাবশেষ বাঁশের মাচায় তুলে কাঁধে করে বাড়ি ফেরে।

গাঁয়ের বাড়িগুলো যখন শোকে মোহমান, কান্না আর দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারাক্রান্ত, রাতের অন্ধকারে এবার সত্যিকারের শিয়ালের পাল ফসলের মাঠে ঝাকে। আঁকে প্রবেশ করে। পিতৃহারা ইব্রাহিম এই দৃশ্য বাড়ির নামায় বসে দেখে। কিন্তু সে চাঁচায় না। ভয়ও পায় না। কাঁচা লঙ্কা দিয়ে শিয়ালের মুলো খাওয়ার কথাটা মনে পড়তে এত দুঃখের মাঝেও তার মুখে হাসি ফোটে। সে ভাবে, দু’দিন আগেও সে কত ছোট আর বেকুব ছিল। শিয়াল যে আমিষাশী-মাংস খায়, লঙ্কা দিয়ে মুলো খায় না, তা-ও তার জানা ছিল না। বাপ মরে গিয়ে রাতারাতি তাকে সাবালক বানিয়ে দিয়ে গেছে।

মৃত সৈন্যদের নিয়ে শিয়ালের পাল যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন জ্যান্ত যুদ্ধবন্দিরা এক মাইল দূরের সদরের এক খুপরি ঘরে নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। জেনেভা কনভেনশন শীতের রাতে মৌতাতের মতো। তা পেটের দানাপানি না জোগালেও ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করে। সে সময় আতা মিয়া অদূরের খোলা মাঠে পরিত্যক্ত বাংকারের কাঠখড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছিল। তার পাশে গানে গানে কারবালার কাহিনি বয়ান করেন। যে, সেই বৃদ্ধ। তখনো বৃদ্ধের স্বল্প কেশের মাথাটা দু’হাঁটুর মাঝখানে, যা আগুনের রক্তিমাভায় ঝিকমিক করছে। আজ পুঁথির বীরযোদ্ধাদের সশরীরে পেয়ে এলাকার লোকজন বৃদ্ধের কথা ভুলে গেছে। খাওয়ার সময় তাকে ডাকেনি। শোয়ার জায়গাটাও বেহাত হয়ে গেছে। এখন মুক্তিযোদ্ধারা এর-ওর বাড়ির সম্মানীয় অতিথি। মুক্তাঞ্চলের তারা নব্য শাসক। গতকাল পর্যন্ত যেসব দোর তাদের সামনে রুদ্ধ ছিল, সেসব এখন অবাধ, উন্মুক্ত। তাদের আপ্যায়ন করতে সদরের আশপাশ এলাকা আজ উৎসবমুখর। শামিয়ানার নিচে বড় বড় তামার ডেকচিতে গরুর মাংস, খিচুড়ি। পরিবেশনের জন্য এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে আনা হয়েছে চিনামাটির বাসন, কাঁচের গেলাস, কাঁসার চিলমচি। ভূরিভোজের পর বহুদিন পর যোদ্ধারা আজ গরম বিছানায় সুখনিদ্রা যাচ্ছে। আতা মিয়ার চোখে ঘুম নেই।

দিনের বেলা মিত্রবাহিনীর তাড়া খেয়ে ওসমান গনির দল যখন ফসলের মাঠের দিকে দৌড়ে যায়, আতা মিয়া তখন তাদের মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করে। তারপর দলছুট কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে ইব্রাহিমদের উঠোনে হাজির হয়। সেখানে দু-দুটি লাশ। একটা ইসমাইলের, অন্যটা আবদুর রবের। যার সঙ্গে সাত দিন আগে ইসমাইল বিশ্বাসের কন্যা মর্জিনা বিবির শাদি হয়েছিল। আহা রে, ঘুরেফিরে আবার সেই কারবালা। মর্জিনার অবস্থা বিবি সখিনার মতো। বাবা নেই। নতুন বিয়ে। করা স্বামী নেই। একটু পরপর মেয়েটা মূৰ্ছা যাচ্ছিল। মা মদিনার এত শোকের মধ্যেও বাস্তব জ্ঞানটা টনটনে। বাড়ির উঠোনে দু’দুটি লাশ আছে, একজন জীবিত মুক্তিযোদ্ধাও তো আছে। মর্জিনা দশটা জল ঝাঁপটা খেয়ে একবার চোখ খুলে তো, মা তাকে মুক্তিযোদ্ধার জন্য শরবত বানানোর তাড়া দেন। এই করে করে একসময় মেয়ের মাথায় মায়ের নির্দেশটা ঢোকে। কিন্তু শরবতের গ্লাস হাতে মর্জিনা বিবি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হুড়মুড়িয়ে কলাগাছের মতো ভেঙে পড়ে মুক্তিযোদ্ধার পায়ের কাছে। এত বড় সম্মানের জন্য আতা মিয়া মোটেও তৈরি ছিল না। তড়াক করে সে লাফ দেয়, যেন আর একটু হলেই শত্রুর পোঁতা মাইনে পা পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ইসমাইলের বাড়ির সীমানা ছাড়ার পরপরই মনে তার অনুতাপ আসে। যাক, যা হবার হয়ে গেছে। এখন ফেরার পথ নেই। দিন শেষ। নিজের অধিনায়কের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। তা না হলে দলের লোকেরা তাকে ক্যাজুয়ালটির দলে ফেলে। দিতে পারে। সে সদরে যাওয়ার রাস্তায় ওঠার আগে মর্জিনাদের বাড়ির পথটা ভালো করে দেখে নেয়, যাতে দ্বিতীয়বার পথ চিনতে কোনোক্রমেই ভুল না হয়।

এদিকে সদরে তখন আরেক হট্টগোল। ট্যাংকসহ মিত্রবাহিনী এগিয়ে গেছে। পেছনে রেখে গেছে আর্বজনাস্বরূপ যুদ্ধবন্দিদের। তবে কড়া প্রহরায়। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আতা মিয়াকে নিরস্ত্র করে ভারতীয় সান্ত্রিরা মাননীয় মেহমানগণের সঙ্গে সাক্ষাতের ছাড়পত্র দেয়। তখন মনে যদিও আরেক চিন্তা–আতা মিয়া মুক্তিকে বলে, তবু একবার পাকিস্তানি সৈন্যদের চোখের দেখা দেখার জন্য সে বন্দিশিবিরে প্রবেশ করে। আট-দশ জন আধমরা, ক্ষতবিক্ষত হানাদার কোনোরকমে বোর্ড অফিসের খাস কামরার খালি মেঝেতে পড়ে আছে। চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো অসহায়, বিহ্বল চাহনি। এ তাহলে প্রবল পরাক্রান্ত শত্ৰু, যাদের বিরুদ্ধে গত ছয়টা মাস আতা মিয়া খেয়ে না-খেয়ে যুদ্ধ করেছে! এখন উভয় পক্ষ মুখোমুখি অথচ কেউ কাউকে মারছে না। আতা মিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ-করে তাদের দেখে। ভাবে, মর্জিনা বিবি সঙ্গে থাকলে বেশ হতো। কিন্তু কী হতো–সে জানে না। মেয়েটার কথা ভাবতে গেলে, চেহারাছবি কিছু মনে পড়ে না, চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফুলপাতা আঁকা একটা কাঁচের গেলাস। যার মিষ্টি শরবতে কয়েক ফোঁটা কষ্টের নোনা পানি মিশে রয়েছে। তারপর তো সে ওখান থেকে পড়িমরি পালায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আতা মিয়া অস্বস্তিতে ডান পায়ের পাতা দিয়ে বাঁ পা ঘষে। ভঙ্গিটা মিত্রবাহিনীর নিয়োগকৃত সান্ত্রির পছন্দ হয় না। সে পেছন থেকে তাগাদা দেয়, আপকা টাইম ওভার হুয়া।

অন্য সময় হলে আতা মিয়ার মাথায় রক্ত চড়ে যেত। আজ যেন তার কী হয়েছে। ওখান থেকে নড়তেও ইচ্ছে করে না। অথচ দাঁড়িয়ে থাকতে গেলে পা ঘষাঘষি বাদ দিয়ে অন্য কিছু করা দরকার। কী করা যায়-ভাবতে ভাবতে আতা মিয়ার চোখ পড়ে পালের গোদা একজন অফিসারের ওপর। দেখে সেও তার দিকে অপলক চেয়ে আছে। যা মর্জিনাকে বলতে পারত অথচ বলা হয়নি, আতা মিয়ার গলার কাছে সেসব কথা ভিড় করে। সৈন্যটিকে সে জিগ্যেস করে, ‘ভাইসাব, আপ ক্যায়সা হো?’ সম্বোধনের জবাবে লোকটি নিরুত্তর। একটু যেন আবেগে কেঁপে উঠল। প্রশ্নটা নির্দোষ। কিন্তু অদ্ভুত ধরনের। সারা দিন সান্ত্রিটি নানান রকমের গালাগাল দিতে দেখেছে লোকজনদের। কিন্তু এমন প্রশ্ন কেউ করেনি। তাকে গোঁফের তলায় মিটিমিটি হাসতে দেখে আতা মিয়ার কথা বলার আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। সে তার পছন্দের সৈন্যটিকে বলে, ‘আপলোক ভিজা বিড়াল বন গয়া কিউ? আভি ডর লাগতা হ্যায়?’ যুদ্ধবন্দি বেজায় সেয়ানা। তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আড়চোখে সান্ত্রির দিকে তাকায়। যেন বোঝাপড়াটা শুধু পাকিস্তানে আর হিন্দুস্থানে। মাঝখানে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ফাউ। এখনো তাদের প্রজা। আতা মিয়ার হাত নিশপিশ করে। কিন্তু তার মর্জিনাকে বলতে-না-পারা কথাগুলো এখনো শেষ হয়নি। বিনয়ের সঙ্গে সে বলে, ‘আপলোক কভ পাকিস্তান সে আয়া?’ এবার সৈন্যটার শুকনো ঠোঁটজোড়া কেঁপে ওঠে। আতা মিয়া এক পা এক পা করে এগিয়ে যায়, মেরা নাম আতা মিয়া। ফ্রিডম ফাইটার। ভাইসাব আপকা নাম?’

‘মেজর ইশতিয়াক।’

আতা মিয়া এক গাল হেসে মুক্তিকে বলে, ‘আপনে জানতে চাচ্ছেন বলে কচ্ছি।’ তা না হলে যুদ্ধবন্দিদের মাঝখানে পালের গোদা আছে জেনেও সেদিন তার তেমন উত্তেজনা বা আনন্দ হয়নি। বরং তার কথা বলার আগ্রহ তখন বৃদ্ধ লোকটার সঙ্গে, যে। শীতের রাতে ভোলা মাঠে আগুন পোহাচ্ছে।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিম পড়তে শুরু করে। গায়ে তাদের কাপড়চোপড় তেমন নেই। আগুনের উত্তাপে সামনেটা গরম হলেও পেছন দিকটা জমে যাওয়ার উপক্রম। অদূরেই পাকসেনার বাংকারগুলো খালি পড়ে রয়েছে। এতে রাতের মতো ঢুকে পড়লেই চলত। কিন্তু জিন্দা থাকতে গর্তে ঢুকতে নারাজ বৃদ্ধ। আতা মিয়া দৌড়ঝাঁপ করে কাঠখড় জোগাড় করে, বৃদ্ধ এক চুলও নড়ে না। সেই যে আগুনের পাশে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে বসে আছে, পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলেও সোজা হওয়ার তার লক্ষণ নেই। এ কেমন মানুষ? মুক্তিযোদ্ধা আতা মিয়ার তাকে তখন ভয় দেখাতে ইচ্ছে করে। বলে, ‘বুড়া মিয়া, নয় মাস দেশে থাকি কী করিছেন? জানি মুক্তিযুদ্ধ করেননি। রাজাকারি করিছেন?’

‘মুই?’ বৃদ্ধ চমকে উঠে তাকায়। ‘বয়স কই রে বাপ, যে যুদ্ধ করিব, রাজাকারি করিব?’

‘বয়স থাকলে রাজাকারি করতেন?’

বৃদ্ধ চরম গোঁয়ার। আতা মিয়ার মারাত্মক প্রশ্নটার জবাব দেয় না। মাথাটাও ফের গুঁজে দিয়েছে দু’হাঁটুর মধ্যিখানে। বয়সকালে ডাকাত ছিল নাকি লোকটা? ডরভয় বলে কিছু নেই! রাজাকারির শাস্তি এখন মৃত্যুদণ্ড। এ এক দিনে ডজন খানেক রাজাকারের লাশ পড়েছে কমলগঞ্জে। কিন্তু বয়স থাকলে যে রাজাকার হতো তার শাস্তি কী? এখন অবশ্য চাইলেই যা খুশি করা যায়। আইনের বই দেখে তো আর বিচার-সালিশ হচ্ছে না না! সবাই প্রতিহিংসায় পাগল। হাতে পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র। একেকটা অভিযোগ আসে, অনতিবিলম্বে শাস্তি কার্যকর হয়ে যায়। সাক্ষী-সাবুদের দরকার পড়ে না। আতা মিয়া অবশ্য গ করতে চায় না। তার আগ্রহটা অন্য জায়গায়। সে বৃদ্ধের সাপোর্ট চায়। আগামীকাল মিত্রবাহিনীকে অনুসরণ করে সে ঢাকার দিকে অ্যাডভান্স করবে, না কমলগঞ্জে থেকে যাবে, যেখানে বিবি মর্জিনা স্বামীশোকে ঘন ঘন মূর্ছা যাচ্ছে। ‘যুদ্ধ বড়, না মানুষের মিল-মহব্বত বড়–বুড়া মিয়া?’ আতা মিয়ার মুখ ফসকে অযোদ্ধাসুলভ প্রশ্নটা তিরের বেগে বেরিয়ে যায়। আর এর ধাক্কায় বৃদ্ধের মাথাটা হাঁটুর প্যাঁচ ছেড়ে উত্থিত হয়। তিনি পরম তাচ্ছিল্য ভরে বলেন, ‘যুদ্ধ রাজারে প্রজা বানায় না। প্রজারে রাজা বানায় না। সত্য যা, তা কারবালা।’

পরদিন কয়েকটা বাসি ও টাটকা খবর উড়তে উড়তে আসে–

মাটি-ল্যাপা, ডালপাতায় সাজানো কয়েকটা মাইক্রোবাস কারফিউর ভেতর ঢাকার অলিগলি চষে ফেলছে। আলবদর বাহিনী খুব তৎপর। তারা দেশের বাছা বাছা সন্তানদের চোখ বেঁধে মাইক্রোতে তুলে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাচ্ছে।

মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ ভিয়েতনাম ছেড়ে এখন ভারত মহাসাগরে।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণের ফলে গভর্নর হাউসে আগুন ধরে যায়। আক্রমণকারীরা নিশানা ঠিক করেছিল ঢাকার টুরিস্ট গাইড দেখে। তাতে ভয় পেয়ে গভর্নর স্বয়ং ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি বর্তমানে দলবলসহ আন্তর্জাতিক জোন, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছেন।

মিত্রবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে। ভৈরব হয়ে তাদের একদল এখন ডেমরায়। আরেক দল মানিকগঞ্জ রোড ধরে এগিয়ে মিরপুর ব্রিজের কাছাকাছি অবস্থান। নিয়েছে। তাদের সঙ্গে রয়েছে টাঙ্গাইলে অবতরণকারী একদল ছত্রীসেনা। বিদেশি সূত্রমতে ছত্রীর সংখ্যা ৫০০০।

তখন একটি ভূগর্ভস্থ কক্ষের দেয়াল বেয়ে একটা বিষধর কেউটে মানচিত্রে উঠে গেল। তারপর কুণ্ডলী পাকিয়ে ফণা তুলল ঢাকার ওপর। জেনারেল ব্যাঘ্র ভয়ে গর্জন করলেন, কিন্তু তার মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। তার কানের পাশে মাছির মতো ভনভন করে উড়ছে একটি প্রলোভনসারেন্ডার সারেন্ডার, একটি জরুরি ঘোষণা। তিনি মাছিটিকে না তাড়িয়ে উড়তে দিলেন।

ঠিক সেসময় জে এ ভুট্টো জাতিসংঘের বর্ধিত সভায় আমরা যুদ্ধ করব, হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করব’ বলে চেঁচাচ্ছিলেন। তারপর হলিউডি কায়দায় যে কাগজটি না পড়েই তিনি ছিঁড়ে ফেললেন, আশ্চর্য হলেও সত্য যে, তা ছিল যুদ্ধবিরতির সোভিয়েত লবির দেশ পোল্যান্ডের পক্ষ থেকে।

জেনারেল ব্যাঘ্র দেয়াল থেকে মানচিত্র নামানোর আদেশ দিয়ে সাজঘরে ঢুকলেন। সাজটা যুদ্ধের নয়–আত্মসমর্পণের।

.

আতা মিয়া কমান্ডারের কাছে গিয়ে মিথ্যা করে বলে, ‘মনটা জানি কেমুন করতে লাগিছে, ভাইজান। আমারে দুই দিন ছুটি দেন। আমি বাড়ি যাইয়্যাম।’ এরকম একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যে-কোনো সময় ঢাকা থেকে পাকবাহিনীর সারেন্ডারের খবর আসতে পারে, সারা বছর যুদ্ধ করে কে চায় এ দৃশ্য দেখা থেকে বঞ্চিত হতে! প্রস্তাবটা পাগলামির পর্যায়ের হলেও ভাইজান সানন্দে ছুটি মঞ্জুর করেন। রাস্তার চৌমাথায় এসে আতা মিয়া টানাটানিতে পড়ে যায়-তার সামনে চারদিকে চারটা রাস্তা। একটা গেছে মর্জিনাদের বাড়ির দিকে। দিনের আলোয় তার মনে হয়, শোকের বাড়িতে এভাবে যাওয়া ভালো দেখায় না। চার দিনের খতম পড়ানো হয়ে গেলে যাওয়া যাবে বরং। তার পরের রাস্তা গেছে ঢাকা। ঢাকা বহু দূর। তৃতীয়টা ধরলে দুই ক্রোশ পর যদিও তার নিজের বাড়ি, বাড়িতে আছেন বৃদ্ধ বাপজান আর তার পরের সংসারের স্ত্রী-পুত্র পরিজন, বেকার ছেলে যুদ্ধে যাওয়াতে একজনের খোরাকি বেঁচে গিয়েছিল, এখন স্টেনগান কাঁধে আতা মিয়া বাপজানের সামনে খালি হাতে দাঁড়াতে চায় না। চতুর্থ রাস্তায় গেলে পথে পড়ে যে জেলা শহর, সেখানে থাকেন তার মাতৃতুল্য ফুপু, তাকে পুত্রস্নেহে লালন করে যিনি নিজের গর্ভজাত পুত্রসন্তানের অভাব পূরণ করেছিলেন। শহরটা স্বাধীন হয়েছে আজ তিন দিন। আতা মিয়া আর যুদ্ধ করতে চায় না ঠিকই, তবে স্বচক্ষে বিজয় দেখা থেকে বঞ্চিত হবে, সেটাও তার ইচ্ছে নয়। সহিসালামতে শহরটায় পৌঁছাতে পারলে সাপও মারা পড়বে, হাতের লাঠিও ভাঙবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *