1 of 2

০৩. হাটচান্দ্রার সীমানা

হাটচান্দ্রার সীমানা ঘিরে ঘুরে ঘুরে বয়ে গেছে সুন্দর বাজার নদী। অন্যদিকে আছে হাঁলো নদী। এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে গড়ে উঠেছে হিন্দুস্তান কপার করপোরেশানের নতুন তামার খনি ও খনি-সংলগ্ন বিরাট আধুনিক কারখানা। মালাঞ্জখণ্ড-এ। সাম্প্রতিক অতীতে চালু হওয়া দূরের মালাঞ্জখণ্ড এবং মোগাঁও গাঁ এই হাটচান্দ্রার শান্ত, নিরুদ্বেগ, গ্রাম-গন্ধী জীবনে হঠাৎ আবর্তর সৃষ্টি করেছে।

চামারটোলির কাছেই ওদের বাড়ি। সেখান থেকে আধমাইলটা দূরে দুটি ছোট ছোট নদী মিশেছে এসে রাত-মোহানায়। একটির নাম শাওন। অন্যটির নাম ভাঁদো। ভাঁদো নদীটি হঠাৎই বাঁক নিয়ে হামলে পড়েছে গিয়ে শাওনের উপর। কে, কবে এদের নাম রেখেছিল জানে না, তবে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। মোহানাটা দারুণ। রাত-মোহানা। বড় বড় শালগাছ আছে। কিছু। আর অন্যান্য হরজাই জঙ্গল। একটি পত্রহীন প্রাচীন বাজ-পড়া শিমুল। সাহেবের মতো তার গায়ের রঙ। বর্ষায় যে আগাছার ঝাড় জন্মেছিল সমতলে, এখন তা ঘন সবুজ ওড়না জড়িয়ে ঘন-সন্নিবিষ্ট নিবিড় হয়ে উঠেছে। বিরাট বিরাট গোলাকৃতি পাথর আছে অনেক। চারধারে ছড়ানো-ছিটানো, চ্যাটালোও আছে কিছু কিছু।

এখন রাত। পৃথু একটি বড় উঁচু পাথরের উপর বসেছিল। মনটা যখন পাগল-পাগল করে, তখনই ও পালিয়ে আসে এখানে। মাঝে মাঝেই রুষার ব্যবহারে ও নিজের সম্বন্ধে এমনই বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে যে, কী করবে ভেবে পায় না। পাগলের মনও মাঝে-মাঝে পাগল-পাগল করে। সেইসব সময় এসে এখানে একা-একা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। মনের মধ্যে টাইট হয়ে গুটিয়ে থাকা স্পিংটা ক্রমশ ঢিলে হতে আরম্ভ করে। আস্তে আস্তে। মন শান্ত হয়ে এলে, একসময়, ঘরমুখখা গোরুর মতো বাড়ির দিকে ফেরে।

কোনও মানুষজনেরই যাতায়াত নেই এদিকে। কচিৎ প্রেমিক-প্রেমিকা ছাড়া কেউই আসে না। তারাও জায়গাটা নির্জন বলে দিনমানেই পালায়। শীত যখন জাঁকিয়ে বসে, তখন অবশ্য অনেকেই আসে দলবেঁধে, চড়া রোদে, চড়ুইভাতি করতে। দিনে, দিনে। রাতে, কেউই নয়।

যখনই ও এমন একা থাকে তখনই পৃথু একটি বড় লেখা লিখবে ভাবে। ওর জীবনের প্রথম ও শেষ উপন্যাস, প্রথম ও শেষ কবিতা গ্রন্থেরই মতো। হয়ে কি উঠবে কখনও? না বোধহয়। কিছুই হবে না। উপন্যাস লেখা বড়ই পরিশ্রমের। অনেকটাই একা-হাতে অট্টালিকা গড়ে তোলার মতো। ও-যে শুধু ভাবতেই জানে। পাতার পর পাতাও তো লেখে রোজই। কিন্তু মনে, মনে। অক্ষর কাটে, শব্দ ছেড়ে, পঙক্তি উধাও করে, প্যারা বানায়; সবই মনে মনে। মনের মধ্যেই কিশলয়, মনের মধ্যেই লাল, হলুদ, খয়েরী-ড়ুরে ঝরা-পাতা, মনের মধ্যেই নিঃশব্দ সব শব্দময়তা, চর-পড়া, পাড়-ভাঙা, বিরহ এবং মিলন সব। ওর এই আত্মস্থ, আত্মজ উপন্যাস কোনওদিনও কালি ও কাগজের সঙ্গে সহাবস্থান করবে না। জানে, পৃথু।

জীবনের হাল ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে অনেকই প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ শক্তি। অন্যচালিত, অন্যবাহিত, অতি সাধারণ, উদ্দেশ্যহীন সম্পূর্ণ এক বস্তুতান্ত্রিক দিগন্তর দিকেই ভেসে চলেছে তীরবেগে এবং যান্ত্রিকভাবে জীবনের জল কেটে, একটি কুৎসিত পানকৌড়ির মতো। থামবার কোনও উপায় নেই, দুপাশে এক মুহূর্তর জন্য তাকাবার অবসর নেই।

কত নবতৃণদল! কত সর্ষে আর সরগুজার হলুদ ফুলে ভরা সবুজ মাঠ দুদিকে! অড়হর লেগেছে, কুখী লেগেছে, বাজরা; নদীপারে সতেজ সবুজ টানটান ধান, শান্তির দূতীর মত সাদা, মসৃণ ডানার বকেদের নিঃশব্দ ওড়াউড়ি। চিকন নদীর পেলব চরের উপর জলের-সহস্র আকুলি-বিকুলি আঙুলে আঁকা কী অসাধারণ স্পন্দন এবং ফুৎকারে উৎসারিত সব সার সার ছবি। গাঙ-শালিকের বাসা, প্রমত্ততায় পাড় ভেঙে-যাওয়া নদীর রৈ রৈ রব, অন্যদিকে অবলীলায় স্তিমিত চর ফেলা। খাড়া, উঁচু পাড়ে উদবেড়ালের উড়াল গর্ত, সোঁদা-সোঁদা মেছো-মেছে গভীর গন্ধ ওড়ে সেইখানে, ঝাঁকি দিয়ে মিশে যায় সে গন্ধ জলবাহী ঘুর্ণি হাওয়ায় চখাচখির কবোষ্ণ আঁশটে গন্ধের সঙ্গে। প্রসন্ন, পরিযায়ী পাখিদের মিশ্র-স্বরের জলজ কাকলি পৃথুর মনকে উড়িয়ে নিয়ে যায় সুদূর, শীতার্ত দূর দিগন্ত থেকে দূরতর দিগন্তে। এই গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।

বড় কষ্ট পৃথুর বুকের ভিতর। বুক থাকলেই বোধহয় কষ্ট হয়। হৃদয়-আক্রান্ত হলেও কি এইরকমই কষ্ট পায় মানুষ? না বোধহয়। সে কষ্ট তো এক চকিত পরিণামের, সে তো তীব্র তাৎক্ষণিক কষ্ট। সে কষ্টর সময় জ্ঞান ভয় পেয়ে চকিতে দৌড়ে পালিয়ে যায় শরীরের বাড়ি ছেড়ে, মুক্তি দেয় মানুষকে সেই তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার নখ থেকে। কিন্তু পৃথুর যে যন্ত্রণা, সেটা ক্যানসারাস। চব্বিশ ঘণ্টাই। ব্যথাটা সবসময়ই গুবরে পোকার মতো ফেরে নিজের মধ্যে, অসভ্য শিশুর মতো অনুক্ষণ একঘেয়ে কাঁদে, কুরে কুরে খায় পৃথুকে। এ ভোঁতা ব্যথা। লেপ্টে থাকে সবসময়। সঙ্গ ছাড়ে না।

আশ্বিন চলে গিয়ে কার্ত্তিক এসেছে। শীতটা জাঁকিয়ে পড়তে পড়তেও কী মনে করে থমকে আছে যেন। সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অষ্টমীর চাঁদ উঠেছে। রুপোর জরি লেগেছে নদীর গেরুয়া-দুধি আঁচলে। বড় সুন্দর দেখাচ্ছে এখন চারপাশ। খুবই ভাল লাগছে পৃথুর। মাঝে মাঝে ওরও ভাল লাগে। ভাল লাগবে বলেই তো আসে।

শাওন আর ভাঁদো নদীতে জল বওয়ার কুলকুলানী শব্দ ভেসে আসছে পৃথুর কানে। কোনও নৌকোর দাঁড় বাইবার ছলাক ছলাক শব্দ শুনতে পেল ও। এসব নদীতে নৌকো বাইবার মতো শান্ত জল বছরের এই সামান্য সময়টাতেই একমাত্র থাকে। মধ্যপ্রদেশের নদীগুলি বিশেষ নাব্য নয়। সুন্দরী, ব্যক্তিত্বসম্পন্না, নর্মদা, এখন কানায় কানায় ভরা। প্রতিটি ছিপছিপে স্বচ্ছতোয়া শাখা নদীতেই সেই সুপুরুষ নদীর নরম আদর লাগে বছরের এই সময়টিতে।

নৌকোটা যেন এদিকেই আসছে মনে হল। বাঁকটা ঘুরল। তারপরই এগিয়ে আসতে লাগল। ছলাক্‌ ছলাক্‌; ছপ্ ছপ্‌।

একটি পুরুষকণ্ঠ বলল হিন্দীতে : পাথরগুলোর কাছেই নোঙর করা যাক। কী বল তোমরা?

লোকটি হাটচান্দ্রার বাসিন্দা নয় বোধহয়। তার কথায় অন্য কোথাকার যেন টান আছে।

সে আবারও বলল, এই রাতের বেলায় মেয়েছেলেদের নিয়ে এখানে নোঙর করবে? কি গো মাঝি? তুই কি বলিস রে, নাসিরুদ্দিন ভাই? তার চেয়ে চল ভাই চলেই যাই। হাটচান্দ্রাতে তো এসেই গেছি। ভয় লাগে হে! অচেনা জায়গা সাপ-কোপ! সঙ্গে মেয়েমানুষ।

একটি চিকন নারীকণ্ঠ সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ধমকের গলায় বলল, ডর ক্যা কহুঁ ম্যায়। ডর কওন্ চিজ কা?

সাঁপ?

জারামে সাঁপ্‌কা ডর থোরী!

গলার স্বর শুনেই পৃথু চমকে উঠল।

নৌকোটা থামল। একজন লম্বা মতো লোক কতগুলো হাঁড়িকুড়ি নিয়ে নামল নৌকো থেকে। ঠোকাঠুকি লেগে ধাতব শব্দ হল। নৈঃশব্দ চমকে গেল। লোকটার-তুলে নেওয়া পায়ের চাপে নৌকোটা ছলাৎ করে দুলে উঠল। ওগুলো নামিয়ে রেখে, লোকটা এদিক-ওদিক কোনও কিছুর খোঁজে হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। বোধহয় উনুন বানাবে, রান্নাবান্না করবে এইখানে। পৃথু ভাবল, এরাও খুব সম্ভব পাগল।

মাঝির সঙ্গে দুজন নারী নৌকো থেকে নামল। রাত-মোহানার হাওয়া তাদের গায়ের ঈত্বরের গন্ধে হঠাৎই ভারী হয়ে উঠল। নাক উঁচু করে ঈত্বরগন্ধী কার্তিকের শিশিরের ঘ্রাণ নিল পৃথু। বোধহয় ফিরদৌস্।

দুই নারীর পরনেই ঘাগরা। একজনের বয়স তিরিশ হবে। আবছা চাঁদের আলোয় ভাল ঠাহর হল না। অন্যজনের বয়স হবে পঁচিশ-টচিশ। ভরা যৌবন। শাঁওন-ভাঁদো নদীরই মতো। ছলবল করছে।

মাঝি পৃথুকে পাথরের উপর হঠাৎ দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠে বলল, ইয়ে সান্নাটা জাগেমে একেলা বৈঠকে আল্ কেয়া কর রহা হ্যায় শেঠ?

কুচ্ছো নেহী! মগর করেঙ্গে কেয়া, এহি ত’ শোর্চ রহা থা।

পৃথু বলল।

ওর কথাতে মেয়ে দুটি হেসে উঠল। অল্পবয়সী মেয়েটির হাসিতে অসংখ্য বেলোয়ারি চুড়ি ভেঙে গিয়ে, কলস ভরার শব্দের সঙ্গে যেন ভেসে গেল রাত-মোহানায়। এমন আশ্চর্য কিন্নরকণ্ঠ কখনও শোনেনি আগে।

সুরেলা কণ্ঠস্বর পৃথুকে চিরদিনই অবশ করেছে। সে নারীরই হোক, কি পাখিরই হোক। পথের উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে কতবার, ফাঁদে পড়া শিঙাল হরিণেরই মতো। জবলপুরের বাঈজীর গজল বা টপ্পার টুকরো-টাকরা চওক-এর চমিলানো চিঝোলানো বারান্দা থেকে উৎসারিত হয়ে তার কানে হঠাৎই বিধে গেছে। অচেনা, অদেখা, শালীন গৃহবধূর হাঁসীর মতো শিষ তোলা যৌন-গন্ধী স্বর, দ্রুত দৌড়ে যাওয়া গোলাপ বালার পায়ের পায়জোরের, চকিত সতীচ্ছদ-এর দুঃখী-সুখী স্বর, নর্ম-নর্তকীর নৃত্যরতা পাখির মতো উড়াল পায়ের নূপুরের আরোহণ অবরোহণের নিকৃণিত শিঞ্জীনি স্বর; সুর আর স্বর পৃথুকে চিরদিনই ঘুরিয়ে মেরেছে। পথ ভুলিয়েছে। কতবার উদাস দুপুরে, চিহরচিরি ঝিলের পাশের ঝটিজঙ্গলে বিরহী কালি-তিতিরের গলার দীর্ঘ, বিষণ্ণ, ছিদ্রিত স্বর শুনে তাকে বুকে তুলে নিয়ে তার কোমল গলায় চুমু খেতে ইচ্ছে করেছে পৃথুর!

পৃথু একসময়ে বাস্তবে ফিরল; যদিও বাস্তবে ওর বাস নয়। তবু, কখনও সখনও সেই অচিন পরবাসেও সে প্রবেশ করে, দ্রুত নিষ্ক্রান্ত হবে বলে। রুষার কাছে থাকলে অবশ্য বাস্তবেই তাকে বাস করতে হয়।

বেশি সময়ই।

পৃথু বলল, তোমরা কারা?

আমরা; আমরা।

ইয়ার্কির গলায় কমবয়সী মেয়েটি বলল।

পৃথুর বাস্তব বুদ্ধিতে ভরকরা স্বল্প আয়ু সুস্থ মস্তিষ্ক বলল, তুমি পৃথু ঘোষ, হচ্ছ গিয়ে হাটচান্দ্রার লাক্ষা কোম্পানীর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। বিদেশের ডিগ্রিধারী। পথের কোনও সহজলভ্যা চটুল নারী তোমার সঙ্গে এভাবে কথা কয়? কোনও বেয়াদবী এ?

পরক্ষণেই সেই হামবড়াই ভাবটা হঠাৎ-আসা অসময়ের কাম-এর মতোই হঠাৎই মরে গেল। মেয়েটি আবার বলল, আমরা নাচেওয়ালী; গানেওয়ালী। লোক মোটেই ভাল নই।

অন্যজন বলল, শেঠকে দেখে মনে হচ্ছে রহিস খানদানের লোক!

রহিস-হিস নই। শেঠও নই। আমি অতি সাধারণ লোক। ভাল তো নই-ই।

বুঝেছি, লোক তুমি খুবই খারাপ। বাড়ি কোথায় তোমার শেঠ?

আমার বাড়ি সবখানে। চমকে উঠল পৃথু। কথাটা, নিজেই বলল তো?

বড়া মমৌজী আমী লাক্ত কলা বহীন।

ছলবলিয়ে অল্পবয়সী মেয়েটি বলল।

লম্বামতো লোকটি ততক্ষণে পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। সে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে, উবু হয়ে বসে, উনুন ধরাবার বন্দোবস্ত করতে লাগল। উনুনটা ধরে উঠতেই, উনুনের গনগনে আগুনে পাশের কালো বড় পাথরে পিকনিক করতে আসা ছেলেমেয়েদের লিখে-যাওয়া জোড়া-জোড়া নামগুলো ফুটে উঠল।

কখনও বাঈজী বা তওয়ায়েফ-এর গান শুনেছেন?

অল্পবয়সী মেয়েটি বলল।

শুনেছি।

আবার বলল পৃথু।

কোথায় শুনেছেন?

জবলপুরে।

হাঁ? জবলপুরমে? বড়ী তাজ্জব কী বাত!

একটু চুপ করে থেকেই আবার বলল, হামলোঁগোনে তো বড়ী ঘুম-ঘামকে হিয়া-আয়ী! কিনা দূর পড়েগী জবলপুর হিয়াসে? সিধী রাস্তে সে? সমঝে না, ইয়ে নদ্দী সে নেসি। রাস্তেসে!

অন্য মেয়েটিই জবাব দিল, পৃথু জবাব দেবার আগেই; জবলপুরসে ইয়ে রাত যিনী দূর, ইয়ে রাত সে জবলপুর স্রি উনাহি দূর পড়েগী।

ছোট মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল। বাঁ হাতের তর্জনী তার ডান গালে ঠেকিয়ে কুর্নিশের ভঙ্গিতে তারিফ জানাল অন্যজনকে। বলল, বহত, খুউব!

ইডিয়ট, পৃথুর শরীর ও বোধ ক্রমশই শক্ত হয়ে আসতে লাগল। সত্যি! এমন গলা ও জীবনে শোনেনি। এমন গলার স্বরও কারও হয়? এমন স্বর তো শুধুমাত্র কুর্চিরই আছে বলে জানত! পৃথুর মাথার মধ্যে কী যেন সব গলে-টলে যেতে লাগল। মেয়েটির চোখ দুটিতে, আর নাক-চিবুকে বুদ্ধি আর রসবোধের দ্যুতিও যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিল। কে এ? কুর্চিই নাকি? কুর্চি ছদ্মবেশে নদী—ভেসে এল কি?

অন্য মেয়েটির দিকে চেয়ে হাসি হাসি মুখে সে-ই বলল, অল্পবয়সী মেয়েটি, কমলা বহি, দিখো

তো সাহি, হামারা নাম ভি হ্যায়? বলেই, আঙুল তুলে দেখাল পাথরগুলোর দিকে।

পৃথু দেখল, লেখা আছে বিজ্‌লী+পওন্।

হাসল ও। বলল, তোমার নাম তাহলে বিজ্‌লী। তা, তোমার নামের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে ও কার নাম? চেনো নাকি?

বিজ্‌লী হাসল। বলল, চিনি না। তবে, চিনতে কতক্ষণ?

কলা একদৃষ্টিতে পৃথুকে দেখছিল। ওর চাউনিতে সাপের চাউনির মতো একধরনের ঠাণ্ডা সম্মোহন ছিল। কাকে তার বয়সের তুলনায় অনেকই বেশি বড় দেখাচ্ছে। মনে হল পৃথুর। কে। জানে? যেমন দেখাচ্ছে, তাই-ই তার বয়সের আসল ছবি কী না? চোখের নিচে কালি। এককালে সেও হয়ত সুন্দরী ছিল বিজ্‌লীরই মতো, চোখের কালিতে অনেক অভিজ্ঞতা মাখামাখি হয়ে, লেপ্টে ছিল।

কম্‌লা বলল, শেঠ-এর নামটা কী?

আমি শেঠ নই।

নামটা কী? বাপ-মায়ে নাম তো একটা দিয়েছিল?

পৃথু!

বিজ্‌লী হেসে উঠল।

বলল, কেয়া বেমতলব কা নাম আপকা? উস্ নাম কি কোই মতলবই নেহি! ঝুট্টো?

তারপরই বলল, বেমতল কা নাম্ কা আদমী ভি সব বোম্বাই হোতা। বোল, কলা বহিন? কিঁউ, খুচ্ছুকা বা ইয়াদ তো হোগী! সাচ্‌মুচই বেকাম্‌কা।

বলেই, ঝুমঝুমির মতো হেসে উঠল।

“বেকাম্‌কা আদ্‌মী” বলতে কী বোঝাল সেই বিদ্যুতের মতো বিজ্‌লী, তা বিজ্‌লীই জানে।

পৃথু প্রতিবাদ করে বলল, না না। বে-মতলবের নয়। আছে। মানে আছে। তার নামেরও মানে আছে।

পৃথু? ফুঃ। হোনেই নহী শেকতা!

বলেই, আবারও হেসে পড়ল বিজ্‌লী, এবার নিজেরই কোলের উপর।

পৃথুর বেশ লাগছিল।

তুমহারা নাম কিনেনে রাখখাতা? উনোনে ভি জরুর বেকামাই হোগা। আবার বলল বিজ্‌লী।

পৃথুর মনে হল, কী করছে কি সে, এই রাত-দুপুরে, সস্তা আতরের গন্ধ-ভরা বাজে বাঈজীদের সঙ্গে? রুষা ঠিকই বলে, “তোমার কোনও সে নেই, ব্যালান্স নেই, তোমাকে কোথাওই একা ছেড়ে দিতে আমার ভরসা হয় না। কোথায় যে গিয়ে আমার নাম ড়ুবিয়ে আসবে। তোমাকে কেউই না চিনতে পারে, হাটচান্দ্রায় আমাকে সকলেই চেনে। আমার একটা প্রেস্টিজ আছে, ইমেজ আছে।

হঠাৎই কলা বলল, তা শেঠ, তোমার চোখ দুটিতে এত দুঃখ কেন?

দুঃখ?

পৃথু চমকে উঠল।

কই? না তো! কাল এক বন্ধুর বাড়ি গেছিলাম, সুমা লাগিয়ে দিয়েছিল সে। বাড়িতে তেওহার ছিল। সুমাই লেগে আছে হয়ত।

ভালই বলেছো শেঠ। সুমা; শুধু খুবসুরতি ধারই দেয়, তাও অতি অল্প সময়েরই জন্যে। দুঃখী মানুষের চোখের চেহারাটা আমি চিনি। তাদের দুঃখটা চোখের তলায় থাকে না। চোখের একেবারে মণির মধ্যেই বাসা বেঁধে থাকে; ঝিনুকের মধ্যের মুক্তোর মতো।

আবারও চমকে উঠল ও।

বিজ্‌লী বলল, কিন্তু দুঃখ যার নেই কলা বহিন, সে তো বিকুল জানোয়ারই হচ্ছে। তাই না? সে কি আদমী? ই কেই তো খুদা দুঃখ দিয়ে পাঠান। দুঃখ না থাকলে যে কিছুই হয় না বহি। নাচ হয় না, গান হয় না, যারা শের লেখে, তাদের শের আসে না। দুঃখ নিয়ে দুঃখ করে তো একমাত্র বোকারই। ইনসানোঁকো লিয়ে দর্দ, খুদাহকি ই বুঝুদি দোয়া।

বিজ্‌লী পৃথুর একেবারে কাছে চলে এসে সামনে বসল। পা দুটি মুড়ে। এমন করে ওর চোখে

তাকাল, যেন জন্ম-জন্মান্ত থেকে পৃথুর সঙ্গেই ওর জানাশোনা ভালবাসা।

কলাভাত চাপিয়েছিল আলু আর ডিম সিদ্ধ দিয়ে। পাথর সাজানো কাঠকুটোর উনুনে। মাঝি বলল, একটু এগিয়ে গিয়ে দেখব নাকি নৌকোটা নিয়ে? মুঠিবাঁকে চেনী মাছ পাওয়া যেত হয়তো। যাব, আর আসব।

বিজ্‌লী তাকে ধমক দিয়ে চুপ করাল। বলল, আঃ। চুপ কর না। আমরা কথা বলছি। খালি খাওয়া, আর খাওয়া! যেন, খেতেই মানুষ আসে এই দুনিয়াতে!

বিজ্‌লী একটু পরেই আবার শুধোল, তুমি কোথায় থাকো শেঠ, বললে না তো!

ওইখানে। বলেই, বাঁ হাত তুলে চন্দ্রালোকিত আবছা অন্ধকারে আঙুল নির্দেশ করে শহরের দিকে দেখাল পৃথু।

ওর মধ্যে থেকে কে যেন বলে উঠল, ওইখানে নয়; ওইখানে নয়; আমি সবখানে থাকি। আজ নয়, আমি অনন্তকাল ধরেই আছি। চিরন্তন পুরুষ আমি।

বাড়িতে কে কে আছে তোমার?

সবাই আছে। মুখ বলল।

মন বলল, সবাই? সবাই কে? তোমার কেউই নেই। তুমি একা। জন্ম-জন্মান্তরের একা।

বিজ্‌লী ফিক করে হেসে উঠেই, গম্ভীর হয়ে গেল।

পৃথু বোকার মতো হাসল।

কম্‌লা বলল, লাও নাসিরুদ্দিন ভাইয়া। বাবুকে লিয়ে গোলি লাও।

নাসিরুদ্দিন নৌকোয় গিয়ে ফিরে এসে একটা প্লাস্টিকের কৌটো দিল কার হাতে। কলা তা থেকে চারটি কালো গুলি নিয়ে বিজ্‌লীকে দিল। বিজ্‌লী দু হাত জড়ো করে, বহত্ এক্‌লাখ্‌ আর তমদ্দুনের সঙ্গে শর ঝুঁকিয়ে পৃথুকে পেশ করল সে-গুলি। গোলাপের লাল-পাপড়ি, পেস্তা, কিসমিস এবং রাংতা-মোড়া গুলি।

বশীকৃতর মতো চিবিয়ে জল খেল ও। কে জানে কী আছে এতে? বিষ নয় তো? হলে হবে।

বিজ্‌লী বলল, তোমার মতো মানুষ দেখেছি আমি।

আমার মতো?

ও নিজেই বলল, না ওর ভেতর থেকে অন্য কেউ বলল, এবারেও বুঝল না। পৃথু বলল, দ্যাখো, অন্য মানুষের মধ্যে, অন্য কোনও মানুষের মধ্যেই কিন্তু আমি নেই। আমি মোটেই টুকরো-টা নই গো মেয়ে। আমি আসলে, আস্ত একটি মানুষ। নিটোল। পরিপূর্ণ একটি মানুষ।

নদীর শব্দ জোর হল। সাহেবের মতো গায়ের রঙের, ন্যাড়া, বাজপড়া, দীর্ঘদেহী শিমুলের ডালের আশ্রয় ছেড়ে হুতোম পেঁচা ভেসে গেল চাঁদের আলোর স্রোতের বিপরীতে, হরজাই গাছেদের গা-ছমছম ছায়ায়। তারও পর রাতের নদীর অস্পষ্ট-ছবি বুকে-ধরা স্নিগ্ধ চাল-ডোরঙা আকাশে।

তোমরা আসছ কোথা থেকে? আসছ না যাচ্ছ?

পৃথু শুধোল।

যাওয়া মানেই তো আসা, আর আসা মানেই যাওয়া। যেমন ভাবে যে দেখে। এখন অবশ্য বলতে পার, যাচ্ছিই। হাটচান্দ্রা বলে কাছেই একটা জায়গায়। রাতটা ইচ্ছে করেই নৌকোয় কাটাব। কাল ভোরে নৌকো ফেলে শহরে যাব। গাড়ি আসবে আমাদের জন্যে। মুজরো আছে। গান গাইব, নাচব। তুমি দেখতে আসবে?

রাত, কথায় কথায় বাড়তে লাগল। ওদের খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে একসময় জিনিসপত্র গোছ-গাছ করে নিয়ে নৌকোর দিকে এগোলো ওরা। নৌকোটা খুলে নিয়ে ভাসিয়ে দিল একসময়। ভাসতই, কারণ, কোনও নৌকোই চিরদিন একই ঘাটে বাঁধা থাকে না; নদীতে, অথবা জীবনে।

পৃথুই শুধু বসে রইল একা পাথরের উপর অবশ হয়ে, সাদা শালে মাথা ঢেকে। ওর উঠতে ইচ্ছে করছিল না। মাথাটা ক্রমশই হাল্কা হয়ে আসছিল। কে জানে কী খাইয়ে গেল খারাপ মেয়েটা।

চমৎকার অনুভূতি একটা। এমন কখনও হয়নি এর আগে। কী খাইয়ে দিয়ে গেল বিজ্‌লী, কে জানে? মেঝের মাটি?

সামনেই বালির উপর পাথর, কালো পোড়া কাঠ আর আগুন জ্বালাবার চিহ্ন পৃথুকে শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে, যা-কিছু ঘটেছিল কিছুক্ষণ আগে তার সবটুকু হলেও, কিছু অন্তত সত্যি!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *