১. শান্ত বিকেল

ডাবল ডিল

চব্বিশে মে, রবিবার।

সারা জায়গাটা জুড়ে শান্ত বিকেল নেমে আসছে। নিস্তব্ধতার মধ্যে ভারী মোহময় পরিবেশ। একটা পাওয়ার বোট ব্যাভেরিয়ার লিন্ডাউ বন্দর ছেড়ে এগিয়ে চলেছে। কিছুটা দূরেই দেখা যাচ্ছে কোনট্যানজ লেক। বোটের চালক চার্লস ওয়ার্নার। একভাবে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। প্রচণ্ড সাবধানী। হাওয়া বুঝে সতর্ক হওয়ার ব্যাপারে ওস্তাদ। তাকানো দেখে বোঝা যাবে না মনে কি আছে।

***

এর ঠিক দুদিন পরে। জায়গাটা হচ্ছে লন্ডন। দু’জন ব্যক্তি পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছিল। একজন টুইড, অপরজন মার্টেল। কথা প্রসঙ্গে টুইড মার্টেলকে বলল, বুঝলে খুনটা বেশ নৃশংস। ঝুঁকি নিয়েই করা হয়েছে।

ওয়ার্নার পাওয়ার বোট-এ সাগরের বুক চিরে এগোতে এগোতে সবেমাত্র বন্দর ছাড়িয়েছে। সামনেই ডানদিকে পাথরের একটা সিংহমূর্তি আর বাঁদিকে বিরাট উঁচু লাইট হাউস। মাঝখান দিয়ে স্পীডে এগিয়ে চলেছে,ওয়ার্নার-এর পাওয়ার বোট। হঠাৎ সেই মুহূর্তে কোথা থেকে একটা শব্দ ভেসে এলো।

ওয়ার্নার-এর বয়স চল্লিশ। পাতলা–চেহারা। ছটফুটে, হাসিখুশি স্বভাবের। পরনে একটা জার্মান স্যুট। মাথায় টুপী। সামনেই লেক। দূরে তাকালো ও। না, সন্দেহজনক কিছু নয়।

বিকেলের সোনালী সূর্যের আলোয় মাখামাখি সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল বালিয়াড়িতে। অদূরে ভেসে চলেছিল হাল্কা পালতোলা নৌকো। বেশ কিছু দূরে লিবেনটিন আর সুইজারল্যান্ডের বরফ ঢাকা পাহাড়ের দুটো অসমান চুড়ো। ওয়ার্নার দূরে তাকালো। তার চোখে পড়ল দুটো সাদা রঙের স্টীমার। যেগুলো ছুটে চলেছে জার্মান শহর কোনস্ট্যানজের দিকে।

সমুদ্রের স্বচ্ছ,নীলচে জল। বাতাসের বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ তার ওপরেনানা ধরনের নক্সা তৈরীকরছে। রহস্যময়, ঠিক ঐ জায়গাটায় কিছু মানুষকে দেখা যাচ্ছে। মোট ছ’জন। বাতাস কাটতে কাটতে ওরা এদিকেই এগিয়ে আসছে।

এই তোমরা চলে যাও। ওয়ার্নার একভাবে তাকিয়ে চীৎকার করে ওদের বলল। নিজের ইঞ্জিনটা খানিকটা পিছিয়ে নিল। সবাই সুগঠিত চেহারার যুবক। পরনে স্নানের পোশাক। দু’জনের সোনালী চুল। ওদের নৌকোগুলো ধনুকের মতো। ওয়ার্নার অনুভব করল তার নৌকো তটরেখা থেকে আর আধমাইল। ওরা ছ’জন চক্রাকারে ঘুরপাক খাচ্ছে। ওয়ার্নার নিজের বোটটা থামিয়ে চীৎকার করে বলে উঠল, এই তোমরা চলে যাও এখান থেকে।

চীৎকার করে বললেও, তখনও ওয়ার্নারের মনে কোন রকম বিরক্তির প্রকাশ ছিল না।

কিন্তু ওরা ক্রমশঃ আরো কাছে আসতে লাগল। তখন ওয়ার্নার তাড়া করে খানিকটা এগিয়ে গেল। সোনালী চুলের লম্বা যুবকটি বোটের একেবারে কাছে। তার বাঁহাতে পাল আর ডান হাতে ছুরি। ওয়ার্নার বিপদ বুঝে সাবধান হবার আগেই ওরা ওর বোটটাকে ঘিরে ফেলেছে। যুবকটি লাফিয়ে ওর পাওয়ার বোটে চলে এলো। আর ওকে লক্ষ্য করে মুহূর্তের মধ্যে কোণাকুনি ভাবে ছুরিটা চালালো। ইতিমধ্যে পাঁচখানা নৌকা ওকে মাকড়সার জালের মতো ঘিরে ফেলেছে। দূরে কোথাও জল পুলিশ আছে কিনা সে ব্যাপারে তাদের হৃক্ষেপ ছিল না।

ওদের চক্রব্যুহ ভেদ করে পাওয়ার বোটটা নজরে আসা কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। ততক্ষণে সোনালী চুলের যুবকটি কসাই-এর কাজ সেরে লাফিয়ে নিজের নৌকোয় উঠে গেল। আর সবাই মিলে দ্রুত নৌকাগুলো চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। অদূরে অস্ট্রিয়ার সীমারেখা। দেখা যাচ্ছে শুধু ধূ ধূ তীরভূমি।

***

এতো অনেকবার ছুরি মারা হয়েছে। উন্মাদ না হলে এরকম ভাবে কেউ খুন করে না। শরীরটা একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

কথাগুলো বলছিলেন পুলিশ সার্জেন্ট ডরনার। আর মৃত ব্যক্তিটি হলো চার্লস ওয়ার্নার। পাওয়ার বোটটার ভেতর ওর নিপ্রাণ দেহটা পড়ে ছিল।

সার্জেন্ট ডরনারের জীবনে এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ওর সঙ্গে কমবয়েসী পুলিশটা লাশটার সমস্ত কিছু পরীক্ষা করছিল।

হঠাৎ পায়ের কাছে কিসের একটা স্পর্শে ওর ভুরু কুঁচকে এলো। সঙ্গে সঙ্গে সেটা কুড়িয়ে পকেটে চালান করল। ত্রিকোণাকৃতি অনেকটা ডেলটার মতো একটা ব্যাজ। ভয়ঙ্কর অবস্থায় পড়ে থাকা দেহটার দিকে আর একবার দেখলোঁ। লাশটার পকেট থেকে বার করা ওয়ালেট থেকে ডরনার পাসপোর্টটা বার করলো। তারপর আবার বলে উঠলোলোকটা ইংরেজ। আরে ব্যাগটায় তো অনেক টাকাও আছে দেখছি।

–ওরা ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি…।

অসমাপ্ত বাক্যটা ডরনারের সহকারী বুস বলে উঠলো। ততক্ষণে মৃতদেহের চোখ দুটো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। খানিকক্ষণ পরে ও আবার বলে উঠলো শয়তানগুলোর তো কোন চিহ্নই দেখা যাচ্ছে না। কাজ সেরে তাড়াতাড়ি সরে পড়েছে…।

ডরনার বলল, কিন্তু এই ব্যাগটা ছিনিয়ে নিতে এক সেকেন্ডের বেশী লাগত না।

একটু থেমে বলল, অদ্ভুত রকমের খুন।কথা বলতে বলতে চারিদিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎব্যাগের মধ্যে একটা প্লাস্টিক কার্ড নজরে পড়ল। অনেকটা ক্রেডিট কার্ডের মতো। সবুজ আর লাল ডোরাকাটা। কার্ডটা দেখে ডরনার বুঝলো ওটা ক্রেডিট কার্ড নয়। আর পাঁচ অক্ষরের একটা কোড নম্বর, যেটা লন্ডন শহরকে বোঝায়।

বুস বলে উঠলো, ব্যাপার কি?

ডরনারের মুখ দেখে বুস অনুমান করছিল সমস্যা বেশ জটিল। ডরনার কার্ডটা ওয়ালেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে কি যেন ভাবছিল। খানিক পরে ও আর বুস দু’জনেই পাওয়ার বোটের একেবারে নিচে এসে নীচু স্বরে কথাবার্তা বলতে লাগলো।

ব্যাপার গোপন রাখতে হবে। প্রথমেই আমাদের পুলাকে বি. এন. ডি-তে জানাতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি…।

তার মানে ও…।

–আমি কিছুই মনে করতে চাইছি না। কিন্তু লন্ডনের লোকেরা রাতের আগেই সমস্ত কিছু জানতে চাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠবে, আর সেটাই আমাকে চিন্তায় ফেলেছে।

***

পুলিশ লঞ্চের ওপরের দিকটায় সার্জেন্ট ডরনার দাঁড়িয়েছিল। লিন্ডাউ বন্দরে ওদের লঞ্চটা ক্রমশ এসে পৌঁছেছিল। লাশটা একটা ক্যানভাস দিয়ে ঢাকা। একটা শক্ত দড়ি দিয়ে পাওয়ার বোটটা লঞ্চটার সঙ্গে বাঁধা ছিল। ডরনার চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল।

মৃতদেহের পিছন দিকটা ভয়াবহ আকার ধারণ করায় ডরনার চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। কথাটা বুসকেও জানায়নি সে।

–ঐ ছয়জন অপরাধীকে তীক্ষ্ণভাবে নজর রাখো। ওরা সম্ভবত এখন এই তীরভূমিতেই এসেছে। খুব কাছাকাছি ঘিরে ফেলার চেষ্টা করবে। কিন্তু সাবধান ওরা সবাই সশস্ত্র।

ডরনার তার রেডিও অপারেটরকে সংকেতে কথাগুলো জানালো। ওরা ততক্ষণে লিন্ডাউ-এ দ্বিতীয়বারের সফর আরম্ভ করেছে। এদিকে পুলিশের হেড কোয়ার্টারে তখন সংকেত পাঠানো হচ্ছে।

–আমার মনে হচ্ছে ওর পেছনে কয়েকটা অদ্ভুত চিহ্ন আছে।

ওয়ার্নারের দিকে তাকিয়ে বুস মন্তব্যটা করলো। লঞ্চ ততক্ষণে বন্দরের কাছে এসে গেছে। বুস সাইরেন বাজালো।

–প্রায় অনেকটা, কিছু একটা চিহ্নের মতো। কিন্তু কিসের চিহ্ন কে জানে। জায়গাটায় এত বেশী রক্ত জমেছিল যে…।

তুমি তোমার কাজ করে যাও, বিরক্তির সঙ্গে ডরনার কথাটা বলল।

সূর্য ক্রমশ নিম্নগামী। চমৎকার পরিবেশ। ওরা ছোট্ট বন্দরটায় আস্তে আস্তে পূর্ব দিকের অভিমুখে এগোতে লাগল। ওখানে লঞ্চ দাঁড়ানোর জায়গা। ডরনার সকলের চোখ এড়িয়ে মৃতদেহটাকে কিভাবে হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া যায় তাই ভাবছিল। চার্লস ওয়ার্নারের দেহটা ইতিমধ্যেই পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখে নিয়েছে। সুতরাং উতলা হবারও প্রয়োজন নেই।

***

পুরানো ধাঁচের সিন্ডাই শহরটার বাড়িঘরগুলো মধ্যযুগীয় ধরনের। কোনট্যানজ লেকের শেষপ্রান্তে পূর্বদিকের দ্বীপটায় অনেক সরু সরু রাস্তা আছে। গাড়িতে বা ট্রেনে এ জায়গায় আসার জন্য দুটো আলাদা রাস্তা আছে। সৌখিন হোটেলও আছে।

পাতলা চেহারার তীক্ষ্ণ মুখের এক যুবক দাঁড়িয়েছিল। পরনে জিনসের প্যান্ট আর শার্ট, বয়স কুড়ি বছর। যুবকটি সিনেমার সঙ্গে যুক্ত। আনমনে ভাবতে ভাবতে হাঁটছিল সে। বন্দরের পুলিশ লঞ্চটার দিকে একবার তাকালো। হঠাৎ চোখ পড়ল পেছনের দিকে পাওয়ার বোটটার দিকে আর সঙ্গে সঙ্গে সতর্ক হয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দ্রুত একটা বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল। হাত ঘড়িটা দেখে নিল।

ফোনের বুথের সামনে পৌঁছে সে ঢোকার আগে আর একবার দেখে নিল সামনের অফিসটা থেকে কেউ আসছে কিনা।

নিশ্চিত হয়ে ও একটা নম্বর ডায়াল করল। কোনো একটা অ্যাপার্টমেন্ট থেকে একটা যুবতী কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। ও বলল, আমি এডগার ব্রাউন বলছি।

অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এলো, আমি ক্লারা, হাতে একদম সময় নেই, এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি…।

যুবক হু বলে খানিকক্ষণ থেমে বলল, তোমাকে জানাচ্ছি যে আকাঙিক্ষত ব্যাপারটা অবশেষে পৌঁছে গেছে।

–এত তাড়াতাড়ি?

পাওয়ার বোটের মধ্যে একটা দেহ রয়েছে শুনে ক্লারার কণ্ঠে বিস্ময় প্রকাশ পেল।

–তুমি নিশ্চিত তো, ক্লারা প্রশ্ন করলো।

–নিশ্চিত না হয়ে আমি কিছু বলিনা, তুমি কি সবকিছু জানতে চাও?

না-না। অত তাড়াহুড়োর কি আছে? যাইহোক জানানোর জন্য ধন্যবাদ…। স্বাভাবিক কণ্ঠে। বলল ক্লারা।

–আমার ফি? ব্রাউন গলার স্বরটা একটু চড়িয়ে দিল।

দাঁড়াও, পোষ্টঅফিস থেকে নিতে হবে। দিন দুয়েক সময় লাগবে। মনে রাখবে তোমার কাজ এখনও শেষ হয়নি। কাজটা অত সোজা ভেবোনা।ব্রাউনের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে গেল।

ক্লারা ফোনটা ছেড়ে দিল। ফোনটার দিকে তাকিয়ে কাঁধটা ঝাঁকিয়ে বুথ ছেড়ে রাস্তায় নেমে দাঁড়ালো। ব্রাউন নিজের লক্ষ্য রাখার ব্যাপারটা ভালই জানে। কিন্তু ক্লারার সঙ্গে ওর আলাপই হয়নি। যে সংস্থার হয়ে ও গুপ্তচরের কাজে নেমেছে, তাদের ব্যাপারে ও কিছুই জানেনা। ক্লারার নম্বরটা অবশ্য স্টাটগার্ট-এর।

***

স্টাটগার্টের চমৎকার পেন্টহাউস অ্যাপার্টমেন্ট। সাতাশ বছরের আকর্ষণীয়া ক্লারা ঘরের মধ্যে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের মুখ পরখ করছিল। আগে মডেলিং পেশায় ছিল। শহরের সেরা পার্লারে চুলের পরিচর্যা করে। ওয়ারড্রোবে ওর যা পোষাক আছে তা অন্যের ঈর্ষার বস্তু।

ওর চোখ দুটো গভীর কালো, আবেদনময়ী।

ঠোঁটের সিগারেটটা নিয়ে নিজের সাদা ফোনটা ধরবে কিনা ভাবছিল, তারপর অ্যাপার্টমেন্টের মালিককে ডাকলো। এরপর আধপোড়া সিগারেটটা ফেলে দক্ষিণ ব্যাভেরিয়ার একটা নম্বর ডায়াল করল।

ঠিক তারপরই উত্তর-পূর্ব লিন্ডাউ-এর কয়েক মাইল ভেতরে অনেকটা দূর্গের মতো একটা ফার্মের মধ্যের একটা কক্ষে চামড়ার একটা হাত রিসিভার তুললো। সেই হাতের আঙুলে একটা হীরের আংটি শোভা পাচ্ছে। বাঁদিকের রিস্টে নামকরা কোম্পানীর দামী রিস্টওয়াচ।

–হ্যাঁ, বলছি।

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে একটা গম্ভীর কণ্ঠস্বর ঐ বাক্যটা উচ্চারণ করলো। এ প্রান্ত থেকে ভেসে এলো, ক্লারা বলছি।

-হ্যাঁ। আমি যে লোমের পোষাকটা পাঠিয়েছিলাম পেয়েছেন তো? ভাল। আর কোন খবর? ক্লারা খানিকটা ইতস্ততঃ করে ব্রাউনের খবরটা জানালো।

তুমি বলছো তাহলে, ওটা এসে পৌঁছেছে?

–হ্যাঁ। আমি জানি এবার তুমি খানিকটা পেয়েছ।

কিন্তু ষাট বছরের বৃদ্ধ মানুষটা মনের প্রতিক্রিয়া গোপন করে গেল। ভীষণ সতর্কতার প্রয়োজন। পুলিশ ইতিমধ্যেই দেহটা খুঁজে পেয়েছে।

পরিকল্পনামত একটা ব্যাপারে নিশ্চিত যে, ওটা ওয়ার্নার-এর দেহ এবং ওটা পুলিশের হেফাজতে। সূত্র অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য।

–তুমি নিশ্চিত? খুব তাড়াতাড়ি…।

একটু কাঁপা কণ্ঠস্বরে ক্লারা বলল, আমি তো ওখানে ছিলাম না…। আমি তো তোমাকে বললাম পাঁচ মিনিট আগে আমাদের লোক কি বলল…।

সেই বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর শোনা গেল এবার, যাইহোক, তুমি মনে রেখো যে, আমার সঙ্গে কথা বলছো।

এই কথাটা বলে রিসিভার রেখে সোনার লাইটারে চুরুট ধরালো।

ওদিকে ক্লারা বিরক্তির সঙ্গে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ফোন কেটে গেল। ক্লারার সমস্ত খরচ-খরচা ওই বহন করে। তবুও…।

ক্লারা গম্ভীর মুখে সিগারেট ধরিয়ে খানিক বাদে আয়নায় মুখ দেখতে লাগলো। সমস্যা এখন, সেই মিলিওনিয়ার শিল্পপতি। ও বিজ্ঞ রাজনীতিবিদও বটে। ক্লারা জানে যে সে পশ্চিম জার্মানীর একজন বিপজ্জনক লোকের সঙ্গে যুক্ত।

***

মঙ্গলবার ছাব্বিশে মে :

 টুইড ওর অফিসের দোতলার ঘরে বসেছিল। অদূরেই রিজেন্টপার্ক। মোটা লেন্সের চশমা দিয়ে দেখছিল, চার্লস ওয়ার্নার-এর মৃতদেহটা থেকে লিন্ডাউ জলপুলিশ সবকিছু খুলে নিচ্ছে।

ব্রিটেনের গুপ্তচর সংস্থার কেন্দ্রস্থলটা ওয়াটারলু স্টেশনের একেবারে গায়ে কংক্রীট বিল্ডিং। ভেতরটা অবশ্য জর্জিয়ান বিল্ডিং-এর মত। বেশীরভাগ অংশই পেশাদার ইনটিটিউশনগুলোর এক্তিয়ারে আছে।

কিন্তু জায়গাটার একটা সুবিধে যে এই বিল্ডিং থেকে বাইরে এসে যে কোন দিকে চলে যাওয়া যায়।

কেউ অনুসরণ করছে কিনা সেটা দেখার সবচাইতে ভাল উপায় হল রিজেন্ট পার্ক। রিজেন্ট পার্কে নিজেকে লুকিয়ে রেখে কাউকে অনুসরণ করা একেবারে অসম্ভব।

খানিক এগোলেই রিজেন্ট পার্কের প্রবেশ পথ মাটির নীচে চলে গেছে। কেউ যদি এখানে অনুসরণ করতে চায় তাহলে তাকে লিফটে উঠতে হবে।

টুইড মৃদু স্বরে বলল, মানুষটা সঙ্গে কি বয়ে বেড়াচ্ছিল, সত্যিই মর্মান্তিক।

ও ছাড়াও ঘরে আরও একজন ছিল, নাম কেইথ মাৰ্টেল। ও আপন মনে সিগারেট খাচ্ছিল। টুইড-এর মন্তব্যে ও খানিকটা অবাকই হলো।

ওদের দুজনের মধ্যে বয়সের ফারাকটা অন্ততঃ বছর বিশেকের। মারটেল লম্বা সুগঠিত চেহারার। চোখমুখে একটা দৃঢ়তার ভাব। জেদী স্বভাবের। বয়স ঊনত্রিশ। নাকের গঠন রোমানদের মত।

কালো রঙের হোল্ডারে পরপর সিগারেট খেয়ে যায়। কথা বলে জার্মান ভাষায়। এছাড়া ফরাসী ও স্প্যানিশ ভাষাতেও দক্ষ। হাল্কা বিমান ও হেলিকপ্টার চালানোয় পারদর্শী। সাঁতারও কাটে মাছের মত।

–স্বাভাবিক ভাবেই সবকিছু ঘটে। খারাপ হতেই পারে। এটাকেও ধরতে হবে বৈকি। ও বলে উঠল।

রহস্যময় স্বভাব, ওকে সঠিক আসনে বসিয়েছে। সমস্যা সমাধানে ওর খ্যাতি খুবই। কিন্তু ওর তীব্র আচরণেই ওকে এড়িয়ে নতুন একজনকে সেন্ট্রাল রেজিস্ট্রির প্রধান করা হয়েছে।নতুন সুপ্রীম ফ্রেডারিক অ্যান্টনী হাওয়ার্ড টুইডের সঙ্গে কিছু রহস্যাবৃত আলাপ হয়। তখন বেশ অপছন্দই করেছিল।

–এসব কি করে করলে কেইথ?

 টুইড কাঁধটা ঝাঁকিয়ে ডেস্কের ফাঁকে ওয়ার্নার-এর জিনিষপত্রের দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিলো। মার্টেল কতকগুলো কাগজের টুকরো তুলে নিলো। তার মধ্যে কিছু টিকিটও আছে। সবগুলোই ওয়ার্নারের ওয়ালেটের মধ্যে থেকে পাওয়া গেছে।

ওয়ার্নারের ওয়ালেটে নানারকম অদ্ভুত সব জিনিসপত্র ভর্তি ছিল। সে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত ছিল। মার্টেল জানে ব্যাপারটা মোটেই তুচ্ছ করবার নয়। ওয়ার্নার জানতো, তার যদি কিছু ঘটে বা সে যদি খুন হয়ে যায় তাহলে তার কাছ থেকে কোনরকম ক’ যাতে কেউ না পায় সেরকমই করা উচিত।

–ও জার্মানীতে কি করত? মার্টেল জিজ্ঞেস করল।

–ঋণের ব্যাপারে জড়িয়ে ছিল। আমি এবং এরিখ স্টোলারও রয়েছে। এরিখের কাছে আমি সত্যিই ঋণী। ওর প্রয়োজন ছিল এমন একজন বাইরের লোক যে একজন জার্মানীকে ব্যাভেরিয়ার ডেলটায় ঢুকিয়ে দিতে পারবে। এটা নয়ানাজীদের ব্যাপার।ওরা খুব কৌশলেই নিজেদের আইনের ভেতর রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সেজন্যই ওদের ব্যান করা যায়নি।

বি. এন. ডি.এটা জার্মান নামের আদ্যক্ষর। এটি জার্মান ফেডারেল সিক্রেট সার্ভিস। এদের হেডকোয়ার্টার মিউনিখের কাছাকাছি। টুইড পকেট থেকে কিছু একটা বের করতেই ডেস্কে পড়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হলো। ও সেটার দিকে তাকালো। অনেকটা ডেলটার মত দেখতে ত্রিভুজাকৃতি একটা রূপোর ব্যাজ।

–স্বস্তিকার আধুনিক সংস্করণ? টুইড মন্তব্য করলো। একটু ভেবে তারপর বলল, এই ব্যাজটা ওয়ার্নার-এর দেহ থেকে পাওয়া গেছে। খুনী অবশ্যই এটা না ভেবে-চিন্তে ফেলে দিয়েছিল।

কেমন করে ও খুন হলো?

খুবই নৃশংসভাবে। বলে টুইড নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। তারপর বললো, বি. এন. ডি. প্যাথোলজিস্ট-এর রিপোর্টে বলেছে, ওয়ার্নারকে এক বিশেষ ধরনের ছুরি দিয়ে পঁচিশবার ওর দেহে আঘাত করা হয়েছে। তারপর ওর দেহের পেছনে ওদের ট্রেডমার্ক ডেলটা’ এঁকে দেয়।

–এই ডেলটার ব্যাপারটা আমরা ভাবছি…।

–এটা একজন নিরপেক্ষ সাক্ষী চিহ্নিত করেছে। তার নাম স্টোলার। এখনও আমার কাছে আসেনি ও। লিন্ডাউ-এর বন্দরে একটা উঁচু টেরাসে কিছু জার্মান ট্যুরিস্ট বসেছিল।

মার্টেল বলে উঠল, কিরকম যেন মনে হচ্ছে।

 এরপর ও একটা জার্মান নাম উচ্চারণ করলো।

–হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি তো লিন্ডাউ বলে অদ্ভুত জায়গাট চেন। ম্যাপে জায়গাটা আমি দেখেছি। ওপর থেকে জায়গাটা ভেলার মতো দেখতে। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে দুটো ব্রীজ দিয়ে যুক্ত রয়েছে…।

–একটা রোড ব্রীজ আর একটা রেল চলাচলের রাস্তা আছে। অবশ্য ওখান দিয়ে সাইকেল ট্রাকও যেতে পারে।

বাঃ, তোমার দেখার প্রশংসা করতে হয়। টুইডের বক্রোক্তি মার্টেল খেয়াল করলনা। টুইড তার প্রচণ্ড উদ্বেগ গোপন করার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল।

–যা বলছিলাম…, একজন জার্মান ট্যুরিস্ট, ওয়ার্নার যখন বোট নিয়ে লেকে ঘুরছিল, তখ বাইনোকুলার দিয়ে ওকে লক্ষ্য করছিল। তারপর ও ছ’জন উইন্ড সার্কার’-কে এগিয়ে আসতে দেখল। ওয়ার্নারের কাছে এসে ওর পাওয়ার বোটটা থামালোবাইনোকুলার দিয়ে একভাবে দেখে যাচ্ছিল ও। ওয়ার্নার হুইলের কাছে দাঁড়িয়েছিল। বিপদ বুঝে সতর্ক হয়ে জলপুলিশের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। ওদের লঞ্চ টেরাসের নীচে।

এরপর ও স্টোলারের রিপোর্টটা দেখল। তারপর বলল, ডরনার তখন সমুদ্র দেখছিল…।

বাকিটা অতীত, দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস, তাই না?

–হ্যাঁ তাই। আমি চাই তুমি এবার এগোও।

***

ফ্রেডরিখ অ্যান্টনী হাওয়ার্ড কোনরকম শব্দ না করেই হাওয়ার মতো অফিসে এলো।

ওর সঙ্গে ম্যাসন ছিল। নতুন কাজে লেগেছে। ম্যাসনের চোখদুটো তীক্ষ্ণ আর ক্ষুধার্ত। ও চুপচাপ ওর চীফ-এর পেছনে অনেকটা কমিশনার-এর মতো দাঁড়িয়ে রইলো।

–টুইড আমার মনে হয় তুমি জানো যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভিয়েনাতে কনফারেন্সে যাচ্ছেন সুতরাং ওর নিরাপত্তার জন্যে আমাদের সক্রিয় লোকের প্রয়োজন। তাই তো?

ও বলার সময় সক্রিয় কথাটার ওপর জোর দিল যার অর্থ মাৰ্টেলকে রাখা যায় টুইডকে বাদ দিতে হয়। অসংযত মেজাজের হাওয়ার্ডের মুখটা চওড়া। বয়স পঞ্চাশ হলেও সুগঠিত চেহার ও অত্যন্ত কুশলী। মেয়েদের কাছে শয়তান বলে খ্যাতি আছে।

আসল কথা ওর স্ত্রী সিনথিয়া দেশের একটা ছোট কুঠুরিতে থাকে। ও নাইটব্রীতে পিয়েডএডেরা ভাড়া নিয়েছে। ওটাও খুব একটা সুবিধেজনক নয়। টুইড-এর ব্যক্তিগত মন্তব্য উচ্ছন্নে যাওয়ার ব্যাপারটা বোঝায়।

ঐ জায়গাটায় আমি একসময় ছিলাম। তাও সঙ্গে যখন মেয়ে আছে তখন একটা ঘর…

–এইগুলো কি? হাওয়ার্ড ওয়ালেটটা দেখতে দেখতে বলল। মার্টেল ততক্ষণে কাগজে টুকরোগুলো পকেটে পুরে নিয়েছে। হাওয়ার্ড ঘরে ঢুকে এল।

–হু। টুইড মৃদু হেসে বলল। তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, চার্লস ওয়ার্নার-এর নিজস্ব ব্যাপার-স্যাপার সব। বি. এন. ডি. যদি দয়া করে মিউনিখ থেকে লন্ডনে আসে, তবে আমরা তদন্তের কাজটা তাড়াতাড়ি আরম্ভ করতে পারি।

টুইড চশমাটা খুলে মুখে আবার পরে নিল। হাওয়ার্ড-এর সামনে চশমা ছাড়া ওর অস্বতি হয়।

বুড়ো বয়সে আমরা একটুতেই রেগে যাই, হাওয়ার্ড হালকা মেজাজেই কথা বলল।

 –লোকটা মৃত, টুইড আবার বলল।

–তোমার কাজ আমার পছন্দ হচ্ছে না। যতটা করেছ ততটাই ভাল। হাওয়ার্ড কথাগুলো বে জানলার কাঁচের ভেতর দিয়ে বাইরের দিকে তাকালো।

–আমি জোর দিয়ে বলছি, আর এক সপ্তাহের মধ্যে প্যারিস থেকে ভিয়েনায় যে সমিট এক্সপ্রেস আসবে তাতে সক্রিয় কর্মীরা থাকবে। মঙ্গলবার দোসরা জুন…।

টুইড-এর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, আমার কাছে ক্যালেন্ডার রাখবো।

হাওয়ার্ড প্রথমে টুইডকে ভুরু কুঁচকে তারপর মার্টেলকে দেখল। মার্টেল এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি। চুপচাপ সিগারেট টানছিল। হাওয়ার্ডের উপস্থিতিতে কেউ এরকম অভ্যাস করে এটা হাওয়ার্ডের পছন্দ নয়।

–আচ্ছা। ও জোর দিয়ে বললল।

মার্টেল হাওয়ার্ড-এর দিকে কঠিন দৃষ্টি নিয়ে তাকালো।

–আমি অন্য জায়গায় ব্যস্ত, ও বলে উঠলো। হাওয়ার্ড টুইডের দিকে ফিরল, শীতল দৃষ্টি।

–এটা অত্যন্ত বাজে ব্যাপার। আমি মাৰ্টেলকে আমার নিরাপত্তা বিভাগে নিচ্ছি। ও ভাল জার্মান…।

-কেন ও ব্যাভেরিয়া যাচ্ছিল। টুইড বলল, আমাদের বরাবরই সন্দেহ ছিল পৃথিবীর ঐ অংশে একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে চলেছে। এখন বোঝা যাচ্ছে ওয়ার্নার খুন হল কেন?

হাওয়ার্ড ম্যাসনের দিকে তাকাতে দেখল ও যেন কর্তৃপক্ষকে আক্রমণ করতে উদ্যত কমিশনারের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে।

–আমি কি ব্যাপারটার একটু খোঁজ নিতে পারি?

 বি. এন. ডি. এরিখ স্টোলার আর আমি নিজে। টুইড একটু জোর দিয়েই বলল কথাটা। হাওয়ার্ড’-এর কাছ থেকে এখন যাওয়া প্রয়োজন।

মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। ব্যাভেরিয়ান রহস্যের পুরো ভারটা আমি নিচ্ছি। আমি যেমন বুঝবো স্টাফকে নিয়ে পুরো ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ করাবো। আর একটা ব্যাপার, সামিট এক্সপ্রেস ভিয়েনা থেকে চারজন উঁচু দরের পশ্চিমী নেতাদের নিয়ে আসছে। ব্যাভেরিয়া দিয়ে যাবার সময় ওরা কি সোভিয়েত ফাস্ট সেক্রেটারীর সঙ্গে দেখা করবে?

***

ওরা আবার একা হয়ে গেল। মন্ত্রীদের বিশেষ আলোচনা শোনার জন্যে হাওয়ার্ড অফিস থেকে বেরিয়ে যেতেই ম্যাসনও নীরবে ওকে অনুসরণ করলো।

–আমার ব্যাপার ও মনে রেখেছিল, মার্টেল বলল।

–ঠিক আছে। কে?

 –ঐ যে নতুন ছেলেটা, ম্যাসন। রাস্তা থেকে সে ওকে নিয়ে এসেছিল।

 টুইড বলল, এক্স স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চ। থামলো। আবার বলল, হাওয়ার্ড ওকে রীতিমত ইন্টারভিউ নিয়ে নিয়োগ করছে। আমার ধারণা ও আমাদের সঙ্গে যোগ দেবার জন্যে আগে থেকে ওৎ পেতে ছিল।

–যে সব লোক আবেদন করেছিল তাদের আমরা নিইনি। মার্টেল হিসহিসিয়ে বলে উঠল।

–ওয়ার্নার এর হদিশ তুমি কিভাবে সংগ্রহ করছো? মন দিয়ে স্টোলার-এর লোকের তোলা এই ছবিগুলো দেখো। দুটোতেই ওয়ার্নারের পেছনে ডেলটা পার্টির প্রতীক পরিষ্কারভাবেই দেখা যাচ্ছে।

–ডেলটা অর্থাৎ নয়া নাজী।

মার্টেল ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলল, ডেলটা রেইনহাড় দিয়েত্রি নামে একজন মিলিওয়নার ইলেকট্রনিক্স শিল্পটি চালাচ্ছে। এছাড়াও ব্যাভেরিয়ান স্টেটের ইলেকশান অফিস চালাচ্ছে যা…।

–চৌঠা জুন, বৃহস্পতিবার, সামিট এক্সপ্রেস যেদিন ব্যাভেরিয়া অতিক্রম করেছিল তার আগের দিন।

টুইড বলে উঠলো, একটা কিছু আছে যা দিয়ে হাওয়ার্ড-এর চোখ এড়িয়ে যেতে পারে। তুমি জান কেইথ, আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, তা হলো সমস্ত ব্যাপারটার, পরস্পর সংযুক্তি–এক্সপ্রেস ব্যাভেরিয়া অতিক্রম করা, স্টেট ইলেকশান, আমাদের কাছে পৌঁছবার আগেই ওয়ার্নারের খুন হওয়া। সমস্ত কিছু।

মার্টেল ডেস্কের ওপরে ছবিগুলো রেখে দিল। তারপর পকেট থেকে লুকানো কাগজের টুকরোটা বের করতেই হাওয়ার্ড ঘরে ঢুকল। ও ওটা লুকিয়ে ফেলেছিল।

জুরিখ থেকে আরম্ভ করবো। কি কারণে ওয়ার্নার খুন হলো এটা বের করতে হবে।

জুরিখ কেন? আমি তো তোমাকে দেখয়ে ছিলাম মিউনিখ থেকে জুরিখের একটা প্রথম শ্রেণীর টিকিট আর লিন্ডাউ থেকে মিউনিখ। কিন্তু…।

–হু, এই ছেঁড়া কাগজের টুকরো। চালিয়ে যাও। লক্ষণ ভালই।

টুইড আতস কাঁচ দিয়ে টুকরোটা ভাল করে পরীক্ষা করতে লাগলো। এই টিকিটে প্রিন্ট করা আছে, লিজেন্ড ভি, বি. জেড. জুরি…লিনি। বেগুনীঅংশটায় রেনওয়েগ–আগস্টশব্দগুলো পাঞ্চ করা আছে। দামও লেখা আছে।

–প্রথমবার যখন আমি জুরিখে ছিলাম, আমি নিশ্চিত যে, তোমার কাছে একটা ট্রামের টিকিট ছিল। মার্টেল বলল, ট্রামের রুটটা ছিল বনহফট্র্যাসি থেকে রেনওয়েভা। হু, ওয়ার্নার শহরের ভেতরে কেন ঘোরাঘুরি করছিল? কোথায় যাচ্ছিল? ও তো সময় নষ্ট করার লোক নয়।

টুইড ওর কথায় ঘাড়টা নাড়লো। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা ফাইলের ভেতর থেকে ছোট্ট কালো নোটবুক বের করল। ওর একটা পাতায় আঙুল টিপে ধরে ড্রয়ারের চাবিটা দোলাতে লাগল।

আমার ধারণা তুমি জান যে হাওয়ার্ড, যতক্ষণ না সবাই বাড়ি যায়, বসে থাকে, তারপর ও ভ্রমণে বেরোয়। ভেবেছিল কিছু একটা পাবে যা ওকে বলা হয়নি। ও নিজের স্টাফ-এর পেছনেই : গোয়েন্দাগিরি করতে বেশী সময় দেয়। তারপর অপর পক্ষের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করে। ওর হাত শক্ত রাখতে ব্যাপারটা…।

–তুমি সব চাইতে দামী কাজটা করে ফেলেছ।

মার্টেল বলে উঠলো, অনুমানটা দারুণ। আমি কি তুরুপের তাসটা দেখতে পারি?

ওয়ার্নার-এর ব্যাপারে স্টোলার দ্রুতবেগে আমার কাছে এগিয়ে আসছে। টুইড ছোট নোটবুকটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বলে উঠলো, একমাত্র আমিই জানি ওয়ার্নারের কাছে দুটো নোটবুক থাকত। বুকপকেটের ভেতর যে বড় নোটবুকটা থাকতো ওটা পাওয়া যাচ্ছে না। যে বদমাইশটা ওকে আঘাত করেছিল, সেই ওটা হাপিস করেছে। অর্থহীন সব ব্যাপার। ব্যাটা গোপন পকেটে রেখেছিল। স্টোলার লিভার থেকে যখন আসছিল তখন ও নিজে দেখেছে। এর আগে জলপুলিশের ডরনারের কাছে সব শুনেছিল।

–আমি কি ওটা একটু দেখতে পারি?

–তোমার জিভটা খুবই ধারালো, বলে টুইড নোটবুকটা ওকে দিলো। মার্টেল পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কতগুলো খাপছাড়া টাইপের শব্দ দেখতে পেল। মিউনিক, জুরিখ, ডেলটা, ওয়াশিংটন ডিসি, অপারেশান ক্রোকোডাইল প্রভৃতি।

চার্লস…?

–ওরা সবাই ওয়ার্নারকে চার্লস বলে। মনে হচ্ছে চার্লস মেইন স্টেশনগুলিতে ছিল। হাউপটব্যানহফ…মিউনিক…জুরিখ। কেন? যদি জুরিখের সঙ্গে ডেলটা’র কোনরকম সম্পর্ক থাকে তাহলে অদ্ভুত ব্যাপার কোষ্টা? বলতে পারো?

টুইড বলে উঠল, ডেলটা হচ্ছে অফিসিয়াল নয়া-নাজী পার্টি। এদেরই প্রার্থী ব্যাভেরিয়ান স্টেট ইলেকশানে দাঁড়াচ্ছে।

কিন্তু এরা আন্ডার গ্রাউন্ডেও কাজ করে। একটা গুজব আছে ডেলটা দলগুলো উত্তর-পূর্ব সুইজারল্যান্ডে অপারেশন চালাচ্ছে; সেন্ট গ্যালেন আর অস্ট্রিয়ান বর্ডার-এর ঠিক মাঝখানে ওদের কারবার। সুইস কাউন্টার এসপিয়নেজ দার্দি অ্যান্ড ব্যাপারটায় বেশ চিন্তিত…।

আমাদের সমর্থন করাটাই অনেক? দিচ্ছে? মার্টেল জিজ্ঞেস করলো।

–খুব সতর্কভাবে। সুইস পলিসি তুমি তো জানো? নিরপেক্ষ থাকতে চায়। সেজন্য ওরা খুব সাবধানে…।

ঐখুনেগুলো ওয়ার্নারের কি করলো দেখ। আর এই ক্লিন্ট লুসিসটা কে? ওয়াশিংটন ডি. সি.?

টুইড ঘোরানো চেয়ারটাকে আস্তে আস্তে ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ক্লিন্ট আমার অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু, প্রাক্তন সিয়া। পরে টিম ও’মিয়েরা ওকে বার করে দিয়ে নিজেই এখন সিক্রেট সার্ভিসের প্রধান হয়েছে। সুতরাং মার্কিন প্রেসিডেন্টের সামিট এক্সপ্রেসে ভিয়েনা যাত্রার কোন নিরাপত্তা রইল না।

–হাওয়ার্ড যদি এর বিপক্ষে থাকে তাহলে বি.এন. ডি-র সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে ফান্ডের বেশীরভাগটা কে দেবে?

–বি. এন. ডি-র এরিখ স্টোলার। প্রচুর পয়সাওয়ালা লোক ও। ডেলটা একটা ক্ষতচিহ্ন…।

–তাহলে চার্লস যেরকম গোপন স্বভাবের, সেই রকমই তোমাকে না জানিয়ে মিউনিক থেকে ওয়াশিংটনে দ্রুত…।

ওকে থামিয়ে দিয়ে টুইড সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, হ্যাঁ। আমিও তাই মনে করি, কিন্তু কেন, বুঝতে পারছি না।

–কিন্তু আমরা তো অন্যকিছু বুঝে উঠতে পারছি না। তাই না?

ওয়ার্নারকে যে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে এতে দেখাই যাচ্ছে।

কথাটা বলে নোটবুকটা দেখতে দেখতে বলল, সেন্ট্রালহক৷ ই দেখা যাক্।

চেয়ারে বসা টুইডের দৃষ্টি চশমার মধ্যে নির্লিপ্ত। এর অর্থ মার্টেল জানে যে, এখন ও এমন কিছু বলতে যাচ্ছে যা ও পছন্দ করেনা। একটা সিগারেট ধরিয়ে হোল্ডারটা দাঁত দিয়ে চেপে ধরল।

টুইড স্বাভাবিক ভাবেবলল, তুমি এই ব্যাপারটায় আমাকে কিছু সাহায্য কর কেইথ।ওয়ার্নারকে জীবিত দেখেছে যে সেই শেষ ব্যক্তি হচ্ছে ফার্ডি আর্নল্ড ও আমাদের খুবই সাহায্য করেছে।

–ও অর্থাৎ মহিলা?

–হুঁ, মহিলা। ক্লেয়ার হফার। ও থাকে জুরিখে। মেয়েটার মা ইংরেজ বাবা সুইস। ও সুইস সার্ভিসে যোগ দিয়েছিল। সেন্ট্রালহক ৪৫। সুতরাং রেফারেন্স থেকে অনুমান করা যায়…।

-মনে হচ্ছে ওয়ার্নারের নোটবুক রাখার কারণ হচ্ছে ওর সন্দেহজনক ব্যাপারগুলো…।

তুমি যা সাহায্য পেয়েছ সব কিছুই প্রয়োজনে লাগতে পারে…।

–সমস্ত সাহায্য আমি বিশ্বাস করতে পারি…।

টুইড একটু জোর দিয়েই বলে উঠলো, মেয়েটা একটা প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে।

ব্যাপারটা বোঝ…। মার্টেল বলে উঠলো, ওয়ার্নারকে এমন কেউ খুন করেছিল যাকে ও বিশ্বাস করেছিল এবং সে জানত ও সুইজারল্যান্ড অতিক্রম করছে।

একটু থেমে আবার বলে উঠল, এখন তুমি আমাকে আবার বললো যে, কেউ স্টোলার বাইরের সাহায্য চেয়েছে।

কারণ ওভাবে, বি. এন. ডি ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। যেখানেই তুমি যাও না কেন সব জায়গাতেই একটা সন্দেহের মেঘ। দোসরা জুন, মঙ্গলবার, রাত এগারোটা পঁয়ত্রিশে সামিট এক্সপ্রেস প্যারিস ছাড়ছে। আর সাতদিনে, রহস্য ভেদ হচ্ছে।

***

 বুধবার, সাতাশে মেঃ

জেনেভাগামী মিঃ কেইথ মার্টেলকে অনুরোধ করা হচ্ছে তিনি যেন তাড়াতাড়ি সুইস এয়ার রিসেপশনে ডেস্কে চলে আসেন…।

ট্যানর থেকে খবরটা এলো। মার্টেল হিথরো বিমানবন্দরের লাউঞ্জে ছিল। যাবার সময় হয়ে এসেছে। ঠিক সেই সময় খবরটা শুনে ও আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নামলো। ওখান থেকে সুইস এয়ারের রিসেপশন ডেস্ক দেখা যাচ্ছে। ওখানে আরো দু’জন যাত্রীকে ডাকা হলো। ও উল্টোদিকে যাচ্ছিল।

সুইস এয়ার হোস্টেস তাকে জরুরী ফোন আসার খবরটা জানাতেই ও এগিয়ে গিয়ে রিসিভার ধরতেই মেয়েটা সামনে থেকে চলে গেল।

টুইডের ফোন, কণ্ঠস্বরে সতর্কতা। প্রাথমিক পরিচয়পর্ব সেরে মার্টেল কাজের কথায় এলো।

-কি ব্যাপার? তুমি আমার নাম ব্রডকাস্ট করেছ। এই টার্মিনালের প্রত্যেকটা হারামজাদা আমার নাম জেনে গেল…।

–আমি জেনেভায় যাওয়ার ব্যাপারটা পাল্টেছি। ওখানে কে…।

–অনেক ধন্যবাদ। আর দশমিনিট বাদে আমার ফ্লাইট…।

–আরে গতকাল যখন আমরা কথাবার্তা বলছিলাম তখন আমার অফিসে ছারপোকা ছিল।

 –তুমি কোথা থেকে বলছ?

–বেকার স্ট্রীট স্টেশনের একটা বুথ থেকে। বিল্ডিং থেকে কথা বলার মতো বোকা আমি নই। পরিষ্কার করার মেয়েটা আমাকে জানালো আমার লাইটের বাটা গেছে। আমি ওটা চেক করতে গিয়ে হঠাৎই দেখি তখন শেডের ভেতর ছারপোকা…।

–তাহলে তো আমাদের কথা কেউ শুনেছে।

–টেপ করেও নিয়েছে। এটাও জেনেছে আমি কোথায় যাচ্ছি আর কেন যাচ্ছি।

–আমি ভেবেছি তোমার প্লেন ধরার আগেই এটা জানান উচিৎ–টুইডের গলা দিয়ে একধরনের শব্দ বার হলো আর কণ্ঠস্বরে আবেগ।

ধন্যবাদ, আমি আমার চোখ খোলা রাখব,মার্টেল ছোট্ট জবাব দিল।

–সম্ভবতঃ জুরিখ-এ তোমার সতর্ক থাকা উচিৎ। একটা রিসেপশান কমিটি তোমার জন্যে অপেক্ষা করতে পারে…।

অসংখ্য ধন্যবাদ। এবার আমাকে যেতে হবে…।

***

এগারোটা দশে সুইস এয়ার ফ্লাইট ছাড়ল। লন্ডনে তাপমাত্রা পঞ্চাশ ডিগ্রীফারেনহাইট। মার্টেল জানলার ধারে একটা সীটে বসেছিল। জানলা দিয়ে জারা পর্বতের শৃঙ্গগুলো দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন ওগুলো ছোঁয়া যাবে।

প্লেন প্রথমে ব্যাসলের ওপরে এসে পৌঁছলো তারপর জুরিখের উদ্দেশ্যে পূর্বদিকে উড়ে চললো।

মেসিনের শব্দ হওয়ার সময় জানলার অপর প্রান্তেবরফে ঢাকা আল্পস-এর ওপর সূর্যের আলো পড়ে এক মনোরম দৃশ্য তৈরী করেছে। অবশেষে প্লেন নামলো।

ক্লেটেন এয়ারপোর্ট। জুরিখের দূরত্ব এখান থেকে দশ কিলোমিটার। প্লেন থেকে বেরোতেই উত্তাপের ঝলকানি ওকে গ্রাস করলো। লন্ডনে পঞ্চাশ ডিগ্রী আর জুরিখে পঁচাত্তর ডিগ্রী ফারেনহাইট। এয়ারপোর্ট সুশৃঙ্খল আর শান্ত। কাস্টমস্ আর পাসপোর্ট কন্ট্রোল অতিক্রম করতে ওর রীতিমত সমস্যা দেখা দিলো।

এয়ারপোর্ট থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ওকে হাউণ্ট ব্যানহক-এর দিকে যেতে হবে। যেটা ওয়ার্নার-এর নোটবুকে লেখা দ্বিতীয় জায়গা। ট্রেনের বদলে ও একটা ক্যাব’ এ উঠলো।

সুইজারল্যান্ডের তিনটে বড় হোটেল-এর মধ্যে একটাতে ও উঠলো। ঘরের ভাড়া হাওয়ার্ডকে সন্ন্যাসী বানিয়ে দেবে। কিন্তু হাওয়ার্ড খরচ-খরচা দেয়নি। লন্ডন ছেড়ে যাবার আগে টুইডকে অনেকগুলো জিনিস টেলেক্স করলো। এতে এরিখ স্টোলারও আছে।

জার্মানরাই তোমার খরচ বহন করছে। সুতরাং মেজাজে উপভোগ করেনাও,টুইড বললো। একটু থেমে আবার বলল, সমস্ত ঘটনার ব্যাপারে ওরা সচেতন। ওরা জানে যে, এমন লোককে আমি সাহায্যের জন্যে পাঠিয়েছিলাম, সে আর নেই…।

–সেজন্য আমি পরবর্তী লোক হতে পারি? মার্টেল উত্তর দিলো, যাক ভালোই। ছোট্ট ঘরের থেকে শহরের ভাল জায়গাই পাওয়া যাবে…।

ভাল? উদাসীন ভাবে শব্দটাকে ভাববার চেষ্টা করল ও।

ক্যাব দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে জুরিখের দিকে। ভাবতে লাগল টুইডের অফিসের ছারপোকার কথা, ওর হোটেল পরিবর্তন করা উচিত। বিরোধীরা যদি ওকে বাউর-অ্যাল্যাক’-এ খোঁজার চেষ্টা করে তাহলে ওর কাছে একটা দারুণ সুযোগ আসবে। প্রথমে তো ওদের সঙ্গে দেখা হোক। মাৰ্টেল একটা সিগারেট ধরালো।

জুরিখে ফিরে যাওয়াই ভাল। নীলরঙের ট্রামগুলো শব্দ করতে করতে চলে যাচ্ছে। ড্রাইভার ওকে ব্যানহকপ্লেটজ-এর দিকে নিয়ে চলল। যেতে যেতে লিমাট নদী বয়ে যাচ্ছে দেখতে লাগল মার্টেল। একটা ব্রীজ পড়ল এই নদীর ওপর। ওয়ার্নারের নোটবুকে কেন জায়গাটার নাম লেখা আছে এই ভেবে খুব আশ্চর্য হল আর ভালভাবে জায়গাটা দেখতে লাগলো।

বাঁদিকে সারি সারি গাছ। ইউরোপে এটাই ওর প্রিয় শহর আর এই রাস্তাটা। এখানে বেশ কয়েকটা বড় বড় ব্যাংক আছে, যাদের আন্ডারগ্রাউন্ড ভল্টগুলোতে জমানো সোনার পাহাড়। প্রত্যেকটা ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত কঠিন।

আস্তে আস্তে গাড়ি ট্যালটেলীর রাস্তায় এসে পড়ল। দুরে রাস্তার শেষপ্রান্তে বাউর-আ-ল্যাক’ দেখা যাচ্ছে। সামনে লেক।

ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশ। আবহাওয়াটা গুমোট। শহরটা যেন বিপদে মেখে আছে। ধনুকের মত এক জায়গায় ক্যাবটা এসে থামল। সামনের প্রবেশ পথ দিয়ে ঢুকতেই হেড পোর্টার দরজা খুললো। মার্টেল দেখল একটা রোলস রয়েস আর পাঁচটা মার্সিডিজ পার্ক করা রয়েছে। প্রবেশ পথের ঠিক পেছনে সবুজ লন, ছোট্ট পার্কও বলা যায়।

এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল পর্যন্ত ওকে কেউ অনুসরণ করেনি। এ ব্যাপারে ও নিশ্চিত। হোটেল প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে। হেড পোর্টার ওকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফোনটা তুলে কিছু কথাবার্তা বলে অবশেষে ওকে একটা ডাবল বেডের ঘর দেওয়া হল। ঘরে পৌঁছে বেডরুম এবং বাথরুম ভালভাবে পরীক্ষা করে নিল কোন মাইক্রোফোন লুকনো আছে কিনা। যাইহোক কিছুই পাওয়া গেল না। ও কিছুতেই যেন সন্তুষ্ট হতে পারছিল না।

লিফট এড়িয়ে ও সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। লিফটে না চড়াই ভাল, ওটা একটা ফাঁদ। আবহাওয়া, স্বাভাবিক। খানিকটা এগোতেই দেখল একটা চাদোয়ার তলায় চা আর ড্রিংকস পাওয়া যাচ্ছে। পাশের ফ্রেঞ্চ রেস্টুরেন্টে ও কফির অর্ডার দিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনে এলিটদের আসা যাওয়া একভাবে লক্ষ্য করতে লাগলো। একটা ছায়া ওর সামনে ভেসে উঠলো।

ক্লেয়ার হারের সঙ্গে ঠিক রাত আটটায় ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, ওরই ফ্ল্যাটে। কিন্তু সময়টা এত বিশ্রী যে ও খানিকটা বিরক্তি বোধ করলো। স্বাভাবিক হলে জায়গাটা ও তন্ন তন্ন করে খুঁজে নিতে পারত। কিন্তু এখন তা সম্ভব নয়। টুইডের অফিসের ছারপোকার ওপরে ও নিজের কৌশলে খানিকটা পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ও ভালভাবেই অপেক্ষা করতে লাগল।

অন্যেরা যখন রাতের খাবার খেয়ে নিচ্ছে ও তখন কফি খেল সাড়ে সাতটা নাগাদ। তারপর বিলে নিজের সই আর রুম নাম্বারটা লিখে ধনুকাকৃতি জায়গাটায় এসে দাঁড়ালো। কাউকে দেখতে না পেলেও ওর মনের অস্বস্তি কিছুতেই যাচ্ছে না।

রাস্তা ফাঁকা, জনমানবহীন। ও মেসিনের কাছে গিয়ে ওটাকে থামিয়ে কুড়ি সেন্টিমের একটা মুদ্রা ঢুকিয়ে দিল আর টিকিটটা নিয়ে জুরিখের একটা গোপন লোকের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

ট্রামগুলো ওর চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। টিকিটটা ওকে খানিকটা ঝামেলায় ফেলছিল। ওর বুকপকেটে একটা খামের ভেতর ওয়ার্নারের ওয়ালেটের সবকিছু আছে। ওর সঙ্গেই ট্রামের টিকিট আছে, তাতেও লেখা রেনওয়েগ–আগস্ট। জায়গাটা বেশীদূর নয়। ক্লেয়ার হফারের মুখটা মনে পড়তে সামনে দিয়ে আসা ট্রামটায় উঠে নামবার দরজার দিকে ঠিক পাশের সীটটায় বসে পড়ল।

হোটেল থেকে সেন্ট্রাল হক ৪৫এ আসতে মিনিট পাঁচেক লাগে। এখানেই ক্লেয়ার হফারের ফ্ল্যাট। ট্রামটা একটা স্টপ এগোতেই ওর মনে হলো কেউ যেন অনুসরণ করছে। পরের স্টপটায় উঠে দাঁড়ালো আর ট্রামটা থামলে একটা কালো বোম টিপল, তাতে দরজা দুটো আপনা হতেই খুলে গেল।

দরজা খুললো। নিজের টিকিটটা দেখে নিয়ে ও সামনের দিকে তাকালো। গন্তব্যস্থল সম্পর্কে এখনো ও কিছুটা বিভ্রান্তিতে ভুগছে।

কিছু লোক ট্রাম থেকে নামল। দরজা বন্ধ হতে আরম্ভ হল। ও লাফিয়ে ফুটবোর্ডে পা রাখলো। ও জানে ফুটবোর্ডে কেউ থাকলে দরজা হয় খুলে যাবে নয়তো খোলাই থাকবে।

এবারে পাশে নেমে ও খানিকটা দাঁড়ালো।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে কেউ ওকে অনুসরণ করছে কিনা সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হলো। ট্রামের দরজা আবার আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল এবং ট্রাম নিজস্ব গতিতে চলতে লাগল।

সেন্ট্রালহক জায়গাটা অনেকটা চতুর্ভুজের মত। একদিকে বনহফট্রাসে আর চারদিকে বড় বড় বিল্ডিং। এই চতুর্ভুজের প্রত্যেক দিকের সামনেটা ধনুকের মত। প্রত্যেকটা দিকেই প্রবেশ পথ আছে। একটায় বনহফট্রাসে। ভেতরে বাগান।

মার্টেল দ্রুত রাস্তাটা পার হলো। পোট্রোট্যাসের দিকে এগিয়ে ডান দিকে পাশাপাশি ব্লকের তৃতীয় দিকে এগোতে লাগলো। ধনুকের মতো জায়গাটা হেঁটে যাবার সময় গাছগুলো, গাছের মূলগুলো ভাল করে দেখতে লাগল। ওর আগের কথা মনে পড়ল। সবকিছু একই আছে, পাল্টায়নি কিছুই। ও একটা সীটে গিয়ে বসলো।

সেন্ট্রালহকে এই অ্যাপার্টমেন্টটায় ও আগে কখনও আসেনি। ঢোকার সময় কৌশল নিল। এমনভাবে দাঁড়ালো যাতে বাইরে ওর ছায়াটা দেখা যায়, সেভাবে দাঁড়ালো। তাহলে অনুসরণকারীকে ধরে ফেলা সহজ হয়।

জায়গাটা আলোআঁধারি। কেমন যেন সব অস্পষ্ট। সামনে গাছগুলোতে পাখীদের কিচিরমিচির আর ঝর্নার কুলকুল শব্দ শোনা যাচ্ছিল। এর থেকে শান্ত পরিবেশ আর হয়না। সামনের জানালা, তার পাশের জানলাটার দিকে ও তাকালো। তারের পর্দা দিয়ে জানলাগুলো ঘেরা। হঠাৎ একটা শব্দ হলো।

না। শাস্তির মরূদ্যানে ওকে কেউ অনুসরণ করতে আসেনি। এবারেও উঠে দাঁড়িয়ে ধনুকাকৃতি জায়গাটার দিকে এগোতে লাগল। অ্যাপার্টমেন্টে ঢোকার প্ল্যানটা টুইড ওকে বুঝিয়ে দিয়েছিল।

সামনে দেখল নেমপ্লেট–সি. হফার। বেলটা টিপতেই জার্মান ভাষায় একটা মহিলা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। ভাষাটা সুইস-জার্মান নয় বলে ও ঠিক বুঝতে পারল না।

–কে ওখানে?

 –মাৰ্টেল। কণ্ঠস্বরটা যথাসম্ভব নরম রেখে বলল। চোখদুটো গ্রীলের দিকে।

অপরপ্রান্ত থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল–আমি ক্যাচটা খুলে দিয়েছি। দোতলায় আছি।

দরজা খোলার পর আস্তে আস্তে ভেতরে ঢুকে গেল। পেছনের দরজাটা আপনা হতেই বন্ধ হয়ে গেল। সামনে পুরোন আমলের লিফট। লিফটেনা উঠেও বেশ তাড়াতাড়ি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল।

উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি।

ওজন নয় স্টোন দুই পাউন্ড।

বয়স-পঁচিশ।

চুলের রং কালো।

 চোখের রং–ঘোর নীল।

হফারের বর্ণনা মোটামুটি এইরকম।

টুইড মার্টেলকে লন্ডনে এটা আগে থেকেই দিয়েছিল। ফার্ডি আর্নল্ড-এর দেওয়া তথ্য ওগুলো। ও জানে যে, টুইডের দুটো ব্যাপারে ঘৃণা আছে। একটা কমন মার্কেট আর একটা মেট্রিক সিস্টেম।

মার্টেল দোতলায় পৌঁছল। ওর কাছে কোনো রকম অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। ও আশা করেছিল যে হফার একটা হ্যান্ডগান অন্ততঃ দেবে। ওর সামনে বন্ধ দরজার কাঠের কাজগুলো ভারী অদ্ভুত। মাঝখানে একটা ছোট্ট গর্ত। বোঝা গেল মহিলাটি প্রস্তুত হয়ে রয়েছে।

–জুরিখে স্বাগতম। মিঃ মার্টেল তাড়াতাড়ি ভিতরে এসো।

 তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে গেল। ও ভেতরে ঢুকতেই মহিলাটি ওর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে নিলো। তারপর দরজাটা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দিল।

ধনুকের মত জায়গার নীচে ও অপেক্ষা করতে লাগল। ওর আঙুলের মাঝখানে কালো হোল্ডার ধরা আছে। নির্লিপ্ত ভঙ্গীমায় ও মহিলাটিকে দেখতে লাগল।

মেয়েটার চোখে বড় আকারের বিদেশী কালো চশমা। মহিলার চুলগুলো ঘন কালো। উচ্চতা পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি, ওজন নয় স্টোন। সমস্ত কিছু মিলিয়ে মহিলাটি আকর্ষণীয়া। রঙীন ব্লাউজ আর স্কার্টে দেহটা আবৃত। রুক্ষ স্বরে মহিলাটি বলে উঠলো, সব কিছু ঠিকঠাক আছে তো?

–তুমি আর একটু সতর্ক হতে পারো না? মার্টেল বলল।

ছোট্ট হল ঘরটা থেকে বেরিয়ে ওরা একটা বসার ঘরে পৌঁছল।

–এখান থেকে জানলা দিয়ে সেন্ট্রাল হক’ এর বাগানটা দেখা যায়। কথাটা বলে মার্টেল সিগারেট ধরালো মহিলাটির অনুমতি না নিয়েই।

মহিলাটি গম্ভীর হয়ে বলল, তুমি অবশ্য এখানে সিগারেট খেতে পারো।

–চমৎকার। আসলে এটা না খেলে কোন কিছুতেই আমার মনোযোগ আসে না। এরপরে ও ঘরটার চারিদিকে ভালভাবে তাকাতে লাগল। বেশ কয়েকটা আর্ম চেয়ার আর সোফা রয়েছে। এছাড়া স্বাভাবিক ওজনের সাইনবোর্ডও আছে। এই জার্মান-সুইসের ঘরের আসবাবপত্র দেখে ওর একগুয়ে মেজাজেরই পরিচয় দেয়।

মার্টেল ভাবল, হফার এই মুহূর্তে কি ভাবছে ও জানে। ও ভাবছে হায় এই বদমাসটার সঙ্গে আমাকে কাজ করতে হবে?

-আমি এক্ষুনি একটু কফি নিয়ে আসি। ও বন্ধুত্বপূর্ণ গলাতেই বলে উঠলো।

–তাহলে তো ভালই হয়…।

 মার্টেল জানলার দিকে এগিয়ে গেল। মহিলাটি সুইংডোর দিয়ে জানলার দিকে চলে গেছে।

তাড়াতাড়ি দেখলে মনে হয় বেশ দামী জিনিষে ভর্তি। ও গতি পরিবর্তন করে আস্তে আস্তে দরজার হাতলটা ঘোরাল। দরজা খুলে যেতে ভেতরটায় ও উঁকি মারল।

সামনেই বেডরুম। একটা বড় বেড, একটা ড্রেসিং টেবিল রয়েছে। চারিদিকে পরিচ্ছন্নভাবে কমেটিক সাজানো। একটা বড় আকারের ওয়ারড্রোব। দরজা অর্ধেক খোলা রেখে সরে এলো।

রান্নাঘরের মধ্যে হঠাৎ ও এসে দেখল পারকোলেটারে কিছু একটা করছে। কাউন্টারে কিছু আধ-খাওয়া খাবার পড়ে আছে। পাশে একটা অপরিষ্কার গ্লাস। এছাড়া অপরিষ্কার একটা ছুরি, দুটো কাঁচি, এক টুকরো স্টিকিং প্লাস্টার এসবও রয়েছে। মুখ বন্ধ অবস্থায় ও এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

বাড়িতে এসবও করো, মার্টেল…।

–সব সময়েই, বলে মৃদু হাসল। তারপর হপারের দিকে তাকিয়ে বলল, ওয়ার্নার কি এখানে ঘুমোতো?

কথাটা শুনতেই হপারের পারকোলেটার থেকে জিনিস ছিটকে পড়ল। হপার দেওয়ালের কাপবোর্ডের দিকে এগিয়ে গিয়ে ওটা খুলল।

জীবনের একঘেয়েমি কাটানোর জন্যে আমি অনেককিছু পাল্টাই…। ওখান থেকেই মহিলাটি বলে উঠল। তারপর পরের বোর্ডটা থেকে বড় বড় কটা কফির কাপ বের করল। মার্টেল ক্রীম খাবে না জেনে হফার দুটো কাপে কালো কফি ঢাললো।

তারপর ওগুলো একটা প্লেটে রেখে মার্টেলের দিকে তাকিয়ে বলল–তুমি আমাকে…।

অনুমতি দিচ্ছো…।

এরপর কাপ দুটো তুলে নিয়ে মার্টেল বসার ঘরের দিকে এগোলো। ঘরের মধ্যে মাদুর ঢাকা একটা টেবিল দেখল। হফারকে অনুসরণ করল।

ওরা পরস্পর কথা বলছিল। হফার কালো চশমার ফাঁক দিয়ে শোবার ঘরের দিকে তাকালো। মার্টেল ওর চোখের ভাষা বুঝল না। কিন্তু মুখের বিবর্ণ ক্ষতটা দেখা যাচ্ছিল।

–তুমি বেডরুমে…

 –আমি কারো সঙ্গে থাকাটা…।

–তোমার নার্ভ আছে বলতে হবে।

ওরা দু’জনে বেডরুমের দিকে এগোতে থাকল। মার্টেল হারের হাতটা ধরে শোফায় গিয়ে বসল পাশাপাশি একটা হাতে হারের বাহু আর সেই বড় গ্লাসটা নিলো।

হফার হঠাৎ অন্য হাতে ওর বড় বড় নখ দিয়ে মার্টেলের মুখে আঘাত করল। মার্টেল কব্জি ধরার চেষ্টা করল।

হিসহিস শব্দে হফার বলে উঠল, মার্টেল বুঝছো তো। আমরা যদি পরস্পর কাজ করি তাহলে কিছু ব্যাপারে আমাদের সোজাসুজি হওয়া দরকার…।

–তুমি এখনো আমার প্রশ্নের জবাব দাওনি। ওয়ার্নার আর তোমার ব্যাপারটা।

 কিছুক্ষণ বাদে হফারকে ছেড়ে দিয়ে কফিতে চুমুক দিল। একভাবে হারের দিকে তাকিয়ে রইল। হফারও স্বাভাবিক হয়ে কফিতে চুমুক দিলো।

–শোনো কয়েকটা ব্যাপার আছে। প্রথমতঃ তোমার এক্তিয়ারে ওটা পড়ে না। দ্বিতীয়তঃ আমার উত্তর না’না। আমি যতটুকু ওকে জানি ও আমার কাছে সব সময় থাকতো না। ব্যাপারটা কঠোরভাবেই ব্যবসায়িক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ…।

ব্যাপারটা তোমার কাছে পরিষ্কার। যাইহোক আমার কথা শোন। ওয়ার্নার খুন হবার আগে শেষ কবে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

লিন্ডাউ-এ যাবার দিন তিনেক আগে। ওকে দেখে আমার খুব হতাশ মনে হয়েছিল বলেছিল ওর মনে হচ্ছে সব জায়গায় যাওয়া ওর পক্ষে সম্ভব নয়…।

–ডেলটার সঙ্গে?

ক্লেয়ার হফার খানিকক্ষণ থামলো। মার্টেল ভাবলো ও কি ভাবছে তা যদি হফার বুঝতে পারে তাহলে ও অবাক করে দেবে। টুইডের মন্তব্য ওর মনে পড়ছিল যে, ব্যাপারটা মিথ্যে কখনই নয়। যদি ঘটনা তোমার চিন্তার সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি করে, তাহলে ঘটনাকে সব সময় বিশ্বাস করবে।

টুইড মার্টেলকে এটা বারবার বলেছিল।

হফার-এর উত্তরে মার্টেল সেটাই ভাবলো।

তুমি ওদের নয়া-নাজী পটভূমির কথা বলছো? আমি ডেলটার কথা বলছি যার সঙ্গে ও চলছিল।

মাৰ্টেলকে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে শান্ত কিন্তু ওর নার্ভগুলো ভেতরে প্রচণ্ড উত্তেজিত। প্রাণপণে উত্তেজনা থামাবার চেষ্টা করতে লাগল।

হফার এক নাগাড়ে কফি খেয়ে উঠে দাঁড়ালো। যখন মার্টেলকে অনুসরণ করে ও রান্নাঘরে এসেছিল তখন একটা ব্যাগও সঙ্গে এনেছিল। সেটা জানালার ধারের সোফার পেছনের চেয়ারে ফেলে এসেছে। কথা বলতে বলতে ও সোফার দিকে এগিয়ে এলো।

ও আমার কাছে একটা নোটবুক ফেলে রেখে গিয়েছিল। তাতে তো অনেককিছুই লেখা আছে কিন্তু ডেলটার কথা কিছু ছিল বলে তো মনে পড়ছে না…।

মার্টেল আধখোলা শোবার ঘরের কাছ থেকে অস্পষ্ট, অদ্ভুত ধরনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। হফার ব্যাগটার মুখটা খুলতে খুলতে ওর সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিল।

–পরের দরজার লোকগুলো উৎপাত করছে। ঘরগুলো পরিষ্কার করার আগে এরকম করছে। যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে এরকম চলবে।

মার্টেল বসার জন্যে সোফাটাই বেছে নিয়েছে। কারণ ফায়ার প্লেসের ওপরে একটা আয়না আছে। তার সামনেটায় একটা বড় ফুলদানী। কিন্তু হফারকে এখান থেকে ভালই দেখা যাচ্ছে।

যখন ও সতর্কভাবে ভেবে দেখছিল যে ওকে কেউ অনুসরণ করছে না তখনই ও শোচনীয় একটা ভুল করে বসেছিল। ওর সামনেই বিপদ, পেছনে নয়। অ্যাপার্টমেন্টে ওর পৌঁছনোর জন্যেই শত্রু অপেক্ষা করছে।

তুমি এলে যখন তখন আমি একটু অন্যরকম হয়ে গিয়েছিলাম, এজন্য আমি দুঃখিত। আসলে চার্লির মৃত্যুটা আমাকে ভীষণ আঘাত দিয়েছে…। এরপরে মার্টেল ক্লিক ধরণের একটা শব্দ শুনতে পেয়ে বুঝতে পারলো হফার ওর পেছনে আসছে। আয়নার সামনের ফুলদানীটার কাছে এসে দাঁড়ালো। দু’জনের দূরত্ব বেশী নয়। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে মার্টেল ঘুরে দাঁড়িয়ে হারের কজীটা ডানহাত দিয়ে চেপে ধরলো। ওর হাতে ফেল্ট-টিপ’ ধরনের পেন-এর মতো একটা জিনিস ছিল।

আসলে ক্লিক শব্দটা হতেই ওটার ভেতর থেকে ব্লেডের মত লোহার শিক বের হয়ে এসেছিল। একেবারে গোড়াটা সূঁচের মত পাতলা। হফার ঐ সঁচের মত জায়গাটা ওর ঘাড়ের মাঝখানে চেপে ঢুকিয়ে দিতে চেয়েছিল।

মার্টেল নৃশংসভাবে ওর কজীটা মুচড়ে দিল। হফার আর্তনাদ করে উঠতে ওর হাত থেকে অস্ত্রটা পড়ে গেল। মার্টেল নিজের দেহটা দিয়ে সজোরে ওকে ধাক্কা মারতে সোফার পেছনটায় পড়ে গেল। হারের স্কার্টটা উরুর ওপরে উঠে গেছে। সুন্দর সুডৌল পা-জোড়া দেখা যাচ্ছিল। যৌন উত্তেজনায় অস্থির মার্টেল হফারকে ধরে শোওয়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো।

–বেজন্মা কুত্তা কোথাকার। বলেই সজোরে একটা ঘুষি মারল। একেবারে স্থির হয়ে গেল। মার্টেল ওর মুখের দিকে ঝুঁকে পড়ল। ঠিক তখন হফার চেতনা ফিরে পেয়ে শক্ত দুটো আঙুল ওর চোখে ঢুকিয়ে দিতে চাইল। ক্রোধে মার্টেল ওর গালে সজোরে এক থাপ্পড় কষালোলা।

আমি তোমার ঘাড় একেবারে ভেঙ্গে দেব…।

এবার মার্টেল লক্ষ্য করল ওর চোখে ভয়ের কালো ছায়া। ওকে ওল্টাতে গেলে কোনরকম বাধা দিল না। মার্টেল নিজের বেল্ট খুলে ওর হাতের সঙ্গে পা দুটো বাঁধলো।

হফার যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল।

মার্টেল ভাবল এবার ওর চলে যাওয়া উচিত। ও হারের মুখে রুমালটা ঢুকিয়ে দিয়ে ওকে সোফায় বসিয়ে দিল।

দ্রুত বেডরুমের দিকে এল। ওখান থেকেই সেই শব্দটা ভেসে আসছিল। ওয়ারড্রোব কাপবোর্ডের দরজা দুটো খুলে ফেলে ভালভাবে দেখতে লাগল।

কালো চুলওয়ালা মেয়েটা মেঝেতে পড়ে ছটফট করছিল। মুখে স্টিকিং প্লাসটার আটকানো।

হ্যালো, ক্লেয়ার হফার। ও বলে উঠলো। মৃদু হাসল। আবার বলল, সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। এখন নিশ্চয়ই স্বস্তিবোধ করছে।

***

বুধবার, সাতাশে মে :

হফার প্রথম ধাক্কাটা কিছুটা সামলে নিয়েছে। ওর জিনিষটা কাপবোর্ডের ভেতর দেখে নিল। রান্নাঘরটা পরিষ্কার করলো।

–তুমি কেমন করে জানলে মেয়েটা এরকম করছে? ও জিগ্যেস করলো।

ওদের বন্দীতখন মেঝেতে আচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে আছে। মার্টেল ওর বেল্টটা খুলে ওকে একটা দড়ি দিয়ে বাঁধলো। আগেকার প্লাস্টারটা খুলে নতুন একটা লাগিয়ে দিল।

মার্টেল বলে উঠলো, যদিও ওর চেহারার বর্ণনার সঙ্গে সবকিছু মিলে গিয়েছিল তবুও একটা ব্যাপার যে ওর চোখে কালো চশমা ছিল। এখন আমরা জানি কেন–ওর চোখ দুটো বাদামী।

নিশ্চয়ই, অনেক…

 যখন আমি শোবার ঘরে ঢুকি তখন তোমার কসমেটিকস ড্রেসিং টেবিল একেবারে গোছানো অবস্থায় ছিল। একটা ব্যাপারে, কাঁচের সঙ্গে স্টিকিং প্লাস্টার এটাই আমার কৌতূহল জাগিয়েছে। ওর এমন কোন কাটা ছিল না, যা দেখা যায়।

–কিন্তু অন্য ব্যাপারও ছিল…।

 –যেমন…?

সবচেয়ে বাজে ব্যাপার যেটা তাহলে ও একেবারেই জানত না কাপবোর্ডটায় কফির কাপ থাকে। ও ওয়ার্নারের আসার ব্যাপারটা বেমালুম অস্বীকার করল। ওয়ার্নার ওর মতো আকর্ষণীয়া মহিলাকে একবার চেষ্টা করবেই। সুতরাং ও চার্লিকে ডাকল। সব সময়ই চার্লসকে ও উৎসাহ দিত।

–তুমি দারুণভাবে লক্ষ্য করেছে। এখানে কফি আছে?

–না বসার ঘরে।

একটু থেমে আবার বলল, আমাদের প্রতারককে কয়েকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার আছে। কাপবোর্ডের মধ্যে তোমার শব্দের ব্যাপারটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তুমি ওখানে একটা সুযোগ নিয়েছিলে–

আমি একটা মানুষের শব্দ শুনে বুঝেছিলাম তুমি এসে পড়েছ। ও আমাকে বোকা ভেবেছিল। ও কি তোমাকে খুন করতে চেয়েছিল?

এরপরে ওরা বসার ঘরে ফিরে গেল। ওখানে ওদের সঙ্গী ফায়ার প্লেসের সামনে অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে। যার ফলে মার্টেলের কণ্ঠস্বর ও শুনতে পায়নি। ও কি তোমাকে খুন করতে গেছিল? কথাটা বলে উঁচওয়ালা অস্ত্রটা হাতে নিল।

মনে হয় তাই। আমি যখন ওকে চেপে ধরলাম ও তখন আপ্রাণ চেষ্টা করছিল ওটা আমার ঘাড়ের মাঝখানে ঢুকিয়ে দিতে। একটা বোতাম টিপলেই ওর ভেতর থেকে ফ্লুইড বেরিয়ে আসবে। ঔষধের প্রতিক্রিয়া ওর ওপর দিয়েই দেখা যাক।

ও ভাল করে জিনিষটা ধরল। তারপরে মেয়েটার দিকে ঝুঁকে পড়ে মুখের প্লাস্টারটা মুখ থেকে ছিঁড়ে দিল। মেয়েটা আতঙ্কে চীৎকার করে উঠল। ওর ঠোঁটের ওপর একটা আঙুল রেখে মার্টেল বলল–একটা কথা নয়। আমি যা যা প্রশ্ন করবো ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। তোমার আসল নাম কি?

মুখের মত প্রশ্ন কোরনা…।

–যদি এটা তোমার ঘাড়ে ঢুকিয়ে বোতামটা টিপে দিই কি ঘটবে নিশ্চয়ই জানা আছে তোমার…।

মার্টেল কথাটা বলে অস্ত্রটা হফারের ঘাড়ের দিকে এগোতে লাগল।

ওর বাদামী চোখ করুণ অসহায় হয়ে উঠলো–ঈশ্বরের দোহাই, আমাকে মেরো না।

 মার্টেল ব্যঙ্গ করে বলে উঠলোতোমাকে আমি বাঁচাবো, তুমি আমায় এটাই করতে চেয়েছিলে। ভাল চাও তো বলে ফেল…।

–গিসেলা জোবেল।

-তোমার ঘাঁটিটা কোথায়?

বাভেরিয়া, মিউনিক! দোহাই… পিটির দিব্যি…!

–পিটি?

মার্টেল হারের মুখের দিকে একভাবে চেয়ে রইল। হফারের দৃষ্টিও ওর দিকে।

–কেন না কথাটার মানেও বোঝে না? এই ভাবেও আমাকে পরীক্ষা করেনি।হার অনেকটা মরিয়া হয়ে বলে উঠলো।

খানিকটা শ্বাস ফেলে আবার বললো, তুমি ঠিক করে ফেলেছ…।

ও একটা সিগারেট ধরিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল। মার্টেল সঁচটাকে আরো কাছে এনে একভাবে প্রশ্ন করল, কার জন্যে তুমি কাজ করছে বলতো?

-ও আমাকে মেরে ফেলবে…।

–তুমি যদি ঠিকমতো জবাবনা দাও এই যন্ত্রটা ঠিক তুমি যেভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলে, আমিও সেইভাবে ব্যবহার করে দেখব। আমরা খবর পেয়েছি যে ওয়ার্নারকে গোপন রুটে পাঠানো হয়েছিল। বলল শিগগির…।

রেইনহার্ড দিয়েত্রিচ।

 বলার পরেই আতঙ্কে ওর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। মার্টেল তখন ধীরে ধীরে সূঁচটা হফারের কাঁধ থেকে সরিয়ে নিল।

–আমাকে একটা ছিপি দাও যাতে এই বিচ্ছিরি জিনিষটা ঢাকা দেওয়া যায়।

ওর কথায় হফার রান্নাঘরের দিকে এগোতে থাকলো মার্টেল ভাবতে লাগল, এই অস্ত্রটা দিয়ে গিসেলা জোবেল ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল।

এখন ওর একটা কাউন্টার এসপিয়নেজ কোন ব্যক্তিকে দিয়ে দেওয়া উচিত। ফরেনসিক এটা নিশ্চয়ই পরীক্ষা করে দেখবে।

***

মেয়েটা ওর দিকে তাকিনেন তাপারটা জানা। সামান্য মামার দিকে তাকিয়ে বলল।

রাত দশটা বেজে যেতে মার্টেল ঠিক করলো যে এবারে ওরা নিরাপদেই এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরোতে পারবে। হফার একটা ব্যাগ প্যাক করল। ইতিমধ্যে মার্টেল পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে বাউর-আ-ল্যাকে’ সাদা পোষাকের গোয়েন্দা পাঠাতে বলল। বিলটা জমা দিয়ে ও স্ক্যাটকেলটা নিয়ে নেবে। ব্যাগটা হলঘরে রয়েছে।

–আমরা সেন্ট স্যলন থেকে ট্রেন নেবো। মার্টেল সুইস মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল।

–আমাদের কাজ ওয়ার্নারের ব্যাপারটা জানা। সামান্য মাত্রই এগোন গেছে। মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, একমাত্র ওখানেই ও থামতো। এটাই ওর এখান থেকে ব্যাভিরিয়ার যাবার পথে কাজ…।

যাক, তাহলে আমরা যতটুকু পেয়েছি, সেই ভিত্তিতে কাজ আরম্ভ করা যাক।

সন্ধ্যেবেলাটা নানা কাজে ভর্তি থাকে। হফারও পকেট থেকে ডায়েরী বার করে মার্টেলকে ফোন করলো।যখন ও ওর বস ফার্ডি আর্নল্ড–এর সঙ্গে কথা বলছিল, তখন ও আয়নায় একভাবে দেখে যাচ্ছিল।

টুইডের বর্ণনানুযায়ী একেবারে এক।

মেয়েটা দেখতে সুন্দরী। লম্বা কালো চুল। নরম কণ্ঠস্বর আর ছন্দময় চলাফেরা, ইতিমধ্যেই মার্টেলের ওকে পছন্দ হয়েছে। কিন্তু ও এমন একজনকে খুঁজছিল যে আরও গতিশীল।

সুইস কাউন্টার এসপিয়েনজ-এর প্রধান জুরিখ থেকে নিজের এরোপ্লেনে এসেছে। ছোট-খাটো গম্ভীর মুখের মানুষ ফার্ডি আর্নল্ড। ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়।

–আমরা একটা অ্যাম্বুলেন্সে ওকে নিয়ে যাব বলে গিসেলা জোবেলকে দেখল। ও ততক্ষণে আরামদায়ক চেয়ারে বসে পড়েছে।

–ওকে একটা স্পেশাল হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। ওকে ভাল নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। ওকে সবকিছু জিজ্ঞেস করা যাবে। ও মার্টেলের দিকে তাকালো।

–আজ ঠিক দশটায় এই নাম্বারে আমাকে ফোন কোর। ছোট্ট প্যাডে ফোন নাম্বারটা লিখে ইংলিশম্যানের হাতে দিলো। খানিকক্ষণ তাকালো।

আমার কাছে জুরিখ কোডও আছে। যদি তুমি কাগজটা হারিয়ে ফেল।

 আর্নল্ড মার্টেলের কথা শুনে মৃদু হাসল, বললো–আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করিনা, তা তো। নয়।

কিন্তু একজন ইংরেজ এজেন্ট, ওয়ার্নার চিহ্নিত হয়ে গেছে। এমন কি জার্মানের মত আচরণ করেও–সুতরাং তুমি সমস্ত দিকগুলো দেখছ। আজ সকাল দশটায় তোমায় কেন ফোন করেছিলাম? নিশ্চিত তুমি কেবলমাত্র জোবেলের প্রাত্যহিক জিজ্ঞাসার ব্যাপারটা আরম্ভ করেছ। বিপরীত ভাবে বলতে হয় আমরা কেবলমাত্র শেষ করেছি। যেহেতু এ মহিলাকে সারারাত জিজ্ঞাসা করার আছে।

 মার্টেলকে খুশী মনে হলনা। সত্যি ব্যাপারটা ধরা যাচ্ছেনা। ফার্ডি আর্নল্ড আরও দক্ষ চালক হফার এর সম্পর্কের মধ্যে কিছু একটা আছে। ওর তীক্ষ্ণ অনুমান শক্তি দিয়ে এটা বুঝছে।

–এসো, শোবার ঘরে এসো। গিসেলার দিকে তাকিয়ে বলল।

 এরপর দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

ওখানে আমি কথাগুলো জোবালকেই শোনাতে চেয়েছিলাম। ওরা যদি ওদের ভাগ্যে কি আছে জেনে উদ্বিগ্ন হয় তাহলে আমাদের পরিকল্পনাটা সফল হতে পারে।

মার্টেল বলল, ও স্বীকার করেছে যে ও রেইনহার্ড দিয়াত্রিচের হয়ে কাজ করেছে।

–আচ্ছা।

আর্নল্ড-এর ঐ বিবৃতির ব্যাপারে কোন উৎসাহ দেখা গেল না। মার্টেলের মনে পড়লো লন্ডনে ওকে টুইড বলেছিল সুইসরা নিরপেক্ষতার নীতি নিয়ে চলছে। সুইস পাল্টা গোয়েন্দারা জার্মান নয়া-নাজী মুভমেন্টের ব্যাপারে খোলাখুলি সংঘর্ষ চায়না। ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু এটাকে সাহায্য করা মোটেই যায়না। মার্টেলের অনুমান, আর্নল্ড সতর্ক নজর রেখেছে।

বার্নে, গুজবের ব্যাপারে খুবই বিরক্ত। উত্তর সুইজারল্যান্ডে একটা গোপন সংগঠন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।

–সেন্ট গ্যালন?

–তুমি কি করে ঐ জায়গার কথা জানলে?

মার্টেল স্বাভাবিক উত্তর দিলো, কারণ ঐ জায়গাটা উত্তর-পূর্ব সুইজারল্যান্ডের একটা অন্যতম বড় শহর। আমার কাছে ডেলটা শব্দটা খুব আকর্ষণীয়। রাইন ডেলটা, অষ্ট্রিয়ার কাছে তোমাদের যে সীমানা, ঠিক সেখানেই রয়েছে।

মার্টেল কথা বলতে বলতে আর্নল্ডের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছিল। ওয়ার্নারের নোটবুকে আরো একটা অস্টিয়ান বন্দরের নাম আছে ব্রে গেঞ্জ।

–আমরা অস্টিয়ান পাল্টা গোয়েন্দার সংস্পর্শে এসেছি, আর্নল্ড বলল। বার্নে, এখানকার এই জুরিখের হালফিল অবাঞ্ছিত ছাত্র সংঘর্ষের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর। মনে হয় ওরা গোপন ডেলটা চক্রের মাধ্যমেই সংগটিত।

ও রিস্টওয়াচটা দেখে বলল, আমাকে এখন যেতে হবে।

ও এত দ্রুত বেরিয়ে গেল মেয়েটার দিকে তাকিয়েও দেখল না। মার্টেল শোবার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখল গিসেলা জোবেল নেই। কোন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই হফার ওকে বুঝিয়ে দিল।

–অ্যাম্বুলেন্সের একটা টীম এসে ওকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে গেছে।

–আর্নল্ড খুব একটা সময় নষ্ট করেনি। ও যাবার সময় তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছে? তুমি কি বলেছে যে আমরা সেন্ট গ্যালেন’ যাচ্ছি।

ও অবাক হয়ে বলে উঠলো, না, কেন কোন গণ্ডগোল হয়েছে কি? আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।

মার্টেল ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে জলের মধ্যে পড়ে থাকা ব্যাগদুটো তুলে নিল।

–তুমি তো আমাকে জানো, আমি অনেক প্রশ্ন করি। আমাদের এখন হাউন্টব্যানহফ’-এর ট্রাম ধরতে হবে।

–তাড়াতাড়ি করতে হবে। ট্রাম সোজা স্টেশনের দিকে যায়। নাম্বার আট। এটাই সবথেকে ভাল পথ।

ওয়ার্নারও তাই ভেবেছিল।

***

নির্মম অত্যাচার, উন্মত্ত বলে ওরা অ্যাপার্টমেন্টের দরজা বন্ধ করে দিলো। রাত দশটা। ব্যানহফ ট্রামের খিলানটা ওদের চোখে পড়েছে। কিছু লোকের আনাগোনা। শান্ত পরিবেশ।

 মার্টেলের সেন্ট্রাল হকের অ্যাপার্টমেন্টে আসার পর নতুন একটা জিনিস সংযোজন হয়েছে। তা হলো কোল্ট ৪৫। ওর কাঁধে স্প্রিং-এর হোলস্টার। যেখানে ঐ মহিলাকে বেঁধে রাখা হয়েছিল সেই ওয়ারড্রোবের গোপন জায়গায় এটা ছিল। হফারই দিয়েছে।

মার্টেলের এই রিভালভার থাকাটা বে-আইনি। যাবার পথে সীমান্ত এলাকা পড়বে না, সুতরাং অসুবিধা খুব বেশী নেই।

ও ওকে জিজ্ঞেস করল যে, ওর কাছে যেটা আছে, তা ফার্ডি আর্নল্ড জানতে পারবে না তো? ওকে না বলতে অনুরোধ করল কেন নিজেও বুঝতে পারল না।

–ওখানে টিকিট মেশিন আছে। হফার দুটো কেস নিয়ে ওকে অনুসরণ করলো। আমি যখন ট্রামে উঠব আমার কেসটা আমিই নেব।

ও দেখলো মেয়েটা কয়েকটা পয়সা ঢোকালো। ল্যাম্পের আলোয় মেয়েটাকে সুন্দরী দেখাচ্ছে। মার্টেল বুঝতে পারল না মেয়েটা কেন কাজ করছে। ওকে আরো ভাল করে না জানলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না।

লেকের দিক থেকে ট্রাম আসছে। ট্রামের আওয়াজ ক্রমেই বাড়তে লাগল। ক্রমশ মার্সিডিসটা সামনে এসে ট্যাঙ্কের মতো সজোরে আঘাত করল। টিকিট মেশিনের কাছে যেখানে মেয়েটা দাঁড়িয়েছিল সেখানে এসে আঘাত করে থামলো।

আঘাতটা মার্টেলের কাছে একটা খুঁটির মত। ও দেখল, মার্সিডিস থেকে বেরিয়ে এসে দুজন লোক হফারকে চেপে ধরেছে। আর একজন ওর মুখের ওপরের অংশটায় কাপড় ঢাকা দিচ্ছে। রাস্তার আলোয় ওদের ডিনোমিনেটার দেখা যাচ্ছে। ত্রিভুজাকৃতি ব্যাজ লাগানো। অনেকটা গ্রীক অক্ষর ডেলটার মত।

***

ও এবার ট্রামের ঘণ্টা শুনতে পেল। মার্সিডিসটা আড়াআড়িভাবে লাইনটা ব্লক করে দিয়েছে। এবারে একটা রোলস রয়েস এলো। আগের ড্রাইভার ক্রমাগত বেল বাজাতে লাগল।

মার্টেল ব্যাগগুলো ফেলে হাতে কোল্ট ৪৫ নিয়ে এগোতে লাগল। রোলসটা সামান্য বেঁকে গেল। তারপর হেডলাইটের আলোয় ওর চোখ ধাঁধিয়ে গেল। এক হাতে চোখ ঢাকা দিয়ে আর এক হাতে ট্রিগার টিপল, পরপর দুবার। হেডলাইট নিভে গেল। কেউ একজন হঠাৎ মার্টেলকে লক্ষ্য করে গুলি করতে গেল।

ইংরেজটা শ্যুট করতেই সে মার্সিডিজে এলিয়ে পড়ল, কপালে রক্তের ধারা।

মার্টেল দু’জন লোকের দিকে ছুটে গেল। সঙ্গে হফার। ওর মুখের কাপড়টা সরালো। ক্লোরোফর্মের গন্ধ মার্টেলের নাকে এলো। একটা লোক মাৰ্টেলকে সজোরে লাথি কষালো। আরো কিছু লোক এবারে বেরিয়ে এসে জড়ো হল।

জুরিখের রাস্তায় হানাহানি মার্টেলের দুঃস্বপ্ন মনে হল। আক্রমণকারীদের একজন মার্টেলকে লক্ষ্য করে পিস্তল তুলেছে। অন্য একজন মেয়েটাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু মার্টেলের বুলেট দ্রুত গিয়ে বিধল ওর বুকে আর ডিগবাজী খেয়ে ছিটকে পড়ল।

রোলস থেকে আরও কয়েকজন বেরিয়ে এল। মার্টেলের কোল্ট থেকে আবার গুলি ছুটে একজনের গালে লাগল।

ওদের সম্মিলিত আক্রমণে মাৰ্টেলকে হতবুদ্ধি দেখাচ্ছিল। গুলি আর খরচ না করার জন্যে রিভালভারটা লাঠির মত ব্যবহার করতে লাগল। হঠাৎ মাথার ওপর ভারী আঘাতে চোখে ঝাপসা দেখল। খানিক পরে চোখ মেলতে দেখল হারের মাথাটা মার্সিডিসে ঢোকানো আর পা দুটো একটা নোক মুচড়ে দেবার চেষ্টায় রত। ভয়ঙ্কর দৃশ্য। আতঙ্কে হারের চোখ দুটো বিস্ফারিত।

ওদের মধ্যে একজন স্মোক বোমা ছুঁড়ছে। চারিদিক ধোঁয়ায় একাকার। ট্রামকে লক্ষ্য করে আর একটা বোমা ছুঁড়ল। ওদের মধ্যে ক’জন হফারকে মার্সিডিসে ঢুকিয়ে নিয়েছে। ওকে হফারের কাছে পৌঁছতেই হবে। একজন ওর কাছাকাছি হতেই মার্টেল গুলি করলো।

মার্সিডিসও আরও দুটো গাড়িতে মৃত আর আহতদের তোলা হচ্ছিল। ব্যানহফস ট্রাসের দিকে। দুটোই এগোতে লাগল। সামনে মার্সিডিস। বেশ খানিকটা বাঁদিকে প্যারেজপ্লেজ।

 হঠাৎ একটা ট্রাম নিঃশব্দে ধোঁয়া ভেদ করে এগিয়ে এলো। মার্টেলের দেহ রক্তে ভাসছে। একজন ওর দিকে এগিয়ে গেল, সামনাসামনি আর কেউ ছিল না। ওকে একজন আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিল।

ওর মুখের সামনেই দেহটা পড়ে আছে। মার্টেল দ্রুত গিয়ে নাড়িটা দেখল।

 বুঝল লোকটা আর বেঁচে নেই। ঘাসের মধ্যে নিজের রিভলভারটা রেখে দিল। লোকটার দিকে ঝুঁকে আর বুকের কাছে কোটে রূপোর ব্যাজ আটকানো! মার্টেল ওটা খুলে পকেটে রাখলো।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছুই পাওয়া গেলনা, ব্যাজ ছাড়া পরিচয়ের আর কোন চিহ্নই নেই। মার্টেলকে বেশ হতাশ দেখাল।

 ধোঁয়ায় ঢাকা ট্রামের ছায়াটা স্পষ্ট, ড্রাইভার নেই। ও ক্যাবের মধ্যে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা দুটো কেসের দিকে তাকালো।

যে কোন সময়ে ক্যাব থেকে ড্রাইভার অদৃশ্য হতেই পারে। মার্টেল ওর জুতোটা নাড়াচাড়া করতে খানিকটা রক্ত বেরিয়ে এল। তারপর স্যুটকেশ দুটো নিয়ে আতঙ্কের জায়গাটা ছেড়ে চলল। কোথাও থেকে পেট্রোল কারের সাইরেন ভেসে আসছিল।

হঠাৎ বিস্ফোরণে মাৰ্টেল খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। কোন উপায় না দেখে পুরনো শহরটার দিকে এগোতে লাগল। ভেবেছিল ট্রামে যাবে কিন্তু একজনকে দুটো স্যুটকেশ নিয়ে চলতে দেখলে সন্দেহ করারই কথা।

এই মুহূর্তে মার্টেলের তিনটে কাজ। এক, স্টেশনের লাগেজ লকারে সুটকেস দুটো লুকিয়ে রাখা। দুই, স্টেশনের কাছাকাছি একটা হোটেলের ব্যবস্থা করা। তিন, বার্নেতে আর্নল্ডের হেড কোয়ার্টারে ফোন করা।

***

মার্টেল অনুভব করলো যে, ও একটা ঝড়ের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোনও ভুল টুল হচ্ছে নাতো?

আর্নল্ডের দেওয়া নাম্বার ঘোরাতেই একজন মহিলার কণ্ঠস্বর জিজ্ঞাসা করল–

-তুমি কে বলছো? এখন রাত কটা বাজে জানো?

আমি দুঃখিত। আমি চাইছি…।বলে ও নাম্বারটা একের বেশীবার বলে গেল। আর্নল্ড নামটা বলল।

–এখানে ঐ নামের কেউ থাকে না, সম্ভবতঃ তোমার রং নাম্বার হয়েছে। শুভরাত্রি।

সচওয়েইজারহফ-এর ভাড়া করা অ্যাপার্টমেন্টে ওর ভাড়া করা শোবার ঘরে মার্টেল বসেছিল। কিন্তু ওর মনটা ছিল হাউপ্টব্যানহফের দিকে। হারের লকারের চাবিটা ওর পকেটেই আছে।

ফার্দি আর্নল্ড একটা বাজে নাম্বার কেন দিয়েছিল কে জানে। তাহলে ও প্রকৃত ফার্দি আর্নল্ড নয়। আসল ফাদির সঙ্গে ওর এখনও দেখা হয়নি।

ঐ একই লোক যদি নিষ্ঠুরভাবে আক্রমণ করে থাকে তাহলে হফার নিশ্চয়ই অ্যাপার্টমেন্ট তাড়াতাড়ি ছাড়ার ব্যাপারে ওর কারণ ব্যাখ্যা করেছিল। ও জানতো বাইরে ওদের জন্যে কি অপেক্ষা করছে। কিন্তু মার্টেল যখন হফারের সঙ্গে এসেছিল তখন হফারই বা কেন ওকে আর্নল্ড হিসাবে মেনে নিলো। অনুভূতি দিয়ে বুঝল-এর মধ্যে নিশ্চয়ই কোথাও ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি হয়েছে। কোথায়?

***

মার্টেল ঘর ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো। রাস্তাটা পেরিয়ে সারি সারি টেলিফোনবুথ। একটায় ঢুকে টুইডের দেওয়া নাম্বারে আর্নল্ডকে ফোন করল। টুইডের দেওয়া নাম্বারটা আলাদা।

–কে? কণ্ঠস্বর ধারালো ও তীক্ষ্ণ।

–কোথা থেকে তুমি ফোন করছো?

–এই মুহূর্তে সেটা প্রয়োজনীয় নয়।আমি দুঃখের সঙ্গে তোমাকে জানাচ্ছি যে, হফার, তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্লেয়ার হফারকে ডেলটা’র অপহরণ করে নিয়ে গেছে..।

–জুরিখের ব্যানহফপ্ট-এর হত্যা লীলায় তোমার অংশ ছিল?

 –হত্যালীলা? মার্টেল বলল।

–ডেলটা, যদি ডেলটা হয়ে থাকে। একটা ব্যাংক রেড় হয়েছে। ব্যাঙ্কের মূল দরজায় ছোট মাইন বসানো ছিল। ওটার বিস্ফোরণে ট্রামের কিছু লোক আহত হয়েছিল। ট্রামটা ওখানেই দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এখনও জানতে চাই কোথা থেকে তুমি ফোন করছ?

বাদ দাও। তোমার সুইচবোর্ডের মধ্যে দিয়ে এই কল করছি।

–উন্মাদের মতো কথা বোলনা। ফার্দির কণ্ঠস্বরে উত্তেজনা। আবার বলল ফাদি, আমাদের নিরাপত্তা…। ব্যাঙ্ক রেইডের ব্যাপারে তুমি কিছু বলো।

মার্টেলকে একটু উত্তেজিত দেখাল, বললো, এই কল মাত্র দু’মিনিটের জন্যে, সুতরাং…

আমি তো তোমাকে বললাম, একটা বোমা, বলা যায় টাইম বোমা, ব্যাঙ্কের দরজায় ফিট করা ছিল। ব্যাপার কি ঘটল তা কেউ বোঝেনি। ওটা ছিল স্মোক বোমা আর সেজন্য ট্রামের ড্রাইভার কিছু দেখতে পায়নি।

-রোলস রয়েসের ব্যাপারে কিছু বলল যেটা তুমি জানো।

–আমি ও ব্যাপারে কিছু জানিনা। রাস্তায় আমি রূপোর, অনেকটা ডেলটা আকারের একটা ব্যাজ দেখেছিলাম।

–ক্লেয়ার হারের সতর্কতা সূচক একটা বুলেটিন পাঠাও যাতে সমস্ত পয়েন্ট থাকে।

মার্টেল কলের দৈর্ঘ্যটা দেখে নিল।

–ওর জন্যে আমার দুঃখ হয়…।

–দুঃখ এখন থামাতে পারো। ওর কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যা মার্টেলের পছন্দ হলনা।

আমরা জানি, ওর কি হয়েছে, এটাও গল্পের একটা অংশ।

–এখন খ্রীষ্টের দিব্যি, আমায় বলল এবং তাড়াতাড়ি…মেয়েটা…।

 লিম্মাট’-এ ওর দেহটা ভাসছিল। সেরকম অবস্থাতেই খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আধঘণ্টা আগের ব্যাপার। মেয়েটাকে নৃশংস ভাবে অত্যাচার করা হয়েছে। তারপর নদীতে ফেলে দিয়েছে। আমি চাই তুমি এসো। মার্টেল তুমি বার্নের ঠিকনাতে এসো…।

আর্নল্ডের কথা থামতেই, মার্টেল ফোনটা ছাড়লো।

***