৭. সরকারী হাসপাতালের সিঁড়ি

০৭.

ইস্টনভিলের সরকারী হাসপাতালের সিঁড়ি দিয়ে আড়ষ্ট পায়ে আস্তে আস্তে নেমে এল কেড। সেই ধুলোমাখা শেভ্রলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল রন মিচেল। কেডের বাঁ চোখের নীচটা ফুলে আছে, চোয়ালে প্লাস্টার লাগানো, মুখটা অসম্ভব বিবর্ণ–এছাড়া কেডকে দেখে কেড বুঝবে না সেন্টার মোটর হোটেলের থেকে বেরিয়ে তিন ডেপুটি পুলিশের কাছে কি অমানুষিক মার খেয়েছে কেড।

সারা শরীরে যন্ত্রণা। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে, তবুও মনে একটা গভীর তৃপ্তি নিয়ে কেড হাঁটতে লাগল। মিচেল বলল, মিঃ কেড, গাড়িতে উঠে পড়। প্লেনটা বেরিয়ে যাবে নইলে। এই ক্ষুধে শহরটা দেখার শখ মিটেছে তো তোমার?

হা, কিছুটা। কেড গাড়ীর পেছনের সীটে উঠে পড়ল। অনেক কষ্টে পা দুটো ছড়াতে ছড়াতে কেড ভাবল ফিল্মগুলো নিশ্চয়ই এখন ম্যাথিসনের কাছে যাচ্ছে। দু–এক দিনের মধ্যেই ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন ছবিগুলো পেয়ে যাবে। তারপর এই জানোয়ারগুলো যারা স্মল ও তার বান্ধবীকে মেরে ফেলেছে, তারা উচিৎ সাজা পাবে। তোমার ক্যামেরা পেছনের সীটে আছে কেড। তারপর মুখের কাল দাগের ওপর হাত দিয়ে বলল, খুব বোকা বনেছিলাম। যাক গিয়ে তুমিও ধোলাই খেয়েছ। আমিও খেয়েছি, শোধবোধ। ভবিষ্যতে আর এই শহরে পা মারিও না।

তাই হবে কেড বলল।

ওর ধুলোমাখা প্যান–অ্যাম ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বুক ধড়াস করল একবার কেডের। এরা ক্যামেরাটা খুলে দেখেনি তো। একরোল ফিল্ম নেই ওতে। হয়তো এটা একটা ফাঁদ। কেড ঘামতে লাগল। হয়তো কোথাও নিয়ে গিয়ে ওরা ফিল্মটার কথা জিজ্ঞেস করবে।

কি ভাবছ এত? মিচেল জিগ্যেস করল।

ভাল লাগছে না। পেটে যা লাথি খেয়েছি।

 মিচেল হাসল। কী ভাবতে পারে বলল না।

ওরা কিন্তু এয়ারপোর্টেই পৌঁছাল। মিচেল বলল, যে ফ্রিডম মার্চ নিয়ে তোমার এত উৎসাহ ছিল, তার কথা জানতে চাও না। আমরা পণ্ড করে দিয়েছি ওদের মার্চ। এখন নিগারগুলো আবার গর্তে ঢুকে গেছে।

দেখ তোমার জায়গায় গিয়ে আবার বেশী গল্প, কোরনা। মুখ বন্ধ রেখ।

কেড কোন জবাব না দিয়ে ভারী ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে যন্ত্রণায় বেঁকতে বেঁকতে গাড়ি থেকে নামল। মিচেল বলল বিদায় কেড। এবার তোমার এখানে বেড়ানোটা জমলনা, বড়ই আফশোষের কথা। কেড লবিতে ঢুকে টিকিট দেখাল। কেরাণীটিও প্রায় মুখ ভেঙ্গানোর ভঙ্গীতে হাসল, ভালয় ভালয় পৌঁছল। কেড কোন কিছু বলল না, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে ও পুলিশের আওতার বাইরে চলে যাবে।

হ্যালো, কেড, কেড দেখল ডেপুটি জো স্লাইডার ওর মাংসল নিষ্ঠুর মুখে আধখানা হাসি মেখে ওর দিকে মাস্তানের মতন এগিয়ে এসেছে। কেড ভয় পেল বটে তবে ভাবল আবার যদি শুরু করতে চাস, শুরু কর। কিন্তু তোদর জান আমার হাতের মুঠোয় এখন। তোদর মুখের হাসি ছুটিয়ে দেব আমি।

চললে? স্লাইডার বলল,

সেরকমই তো মনে হচ্ছে, ডেপুটি।

বেশ বেশ। আগে গেলেও তো পারতে। যাবার সময় আর রাগ পুষে রেখ না। কেড চুপ করে রইল।

আরে তোমার রাগ যে পড়ছেই না! আমার ছেলেগুলো আবার ভীষণ উদাসী! কালো পীরিতবাজদের আমরা দেখতে পারি না।

কেড তবু চুপ করে রইল। শোন তোমার জন্য একটা সামান্য উপহার এনেছি।

স্লাইডারের মুখে এবার হাসি ছড়িয়ে পড়ল। চলে যাবে অথচ কোন স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে যাবেনা তাই হয় নাকি?

ও আবার মারবে তাহলে। কেডের যন্ত্রণাকাতর শরীর শক্ত হয়ে গেল। ঠিক আছে এখন আমি মরে যাব। তারপর জিতব আমিই শেষে। এই পচাগলা শহরটা লাটে তুলে দেব।

স্লাইডার কি যেন আলতো করে তুলে দেখাল। দেখে রক্ত হিম হয়ে গেল। ও দেখল ঐ কোডাক ফিমের রোলটা। তুমি তো এই শহরটার কিছুই জানো। এখানে নিগাররাই নিগারদের মাংস খায়। ওই বুড়ো স্যাম নিজে আমায় এই ফিল্মটা এনে দেয়। তুমি নিউইয়র্ক সানে এই ছবিটা পাঠাতে চেয়েছিলে। কিন্তু স্যাম বুঝেছিল এই ফিল্মটার কদর আমি আরো বেশী বুঝব! তাই ও এটা আমায় এনে দেয়।

কেডের অদম্য ইচ্ছে হল ফিল্মটা কেড়ে নেবার। না, কোন আশা নেই।

স্লাইডার বলল, শোন একটা বোঝাপড়ায় আসা যাক। আমরা ফিল্মটা রাখি আর তুমি কার্টিজটা রাখ। ফিল্মটা টেনে বের করে একরাশ তালগোল পাকানো নষ্ট ফিলম ও কেডের– পায়ের কাছে ফেলে দিল। কেড ওর পায়ের কাছে তাকাল। জীবনে সবচাইতে পরাজয়ের মুহূর্ত এটা। আমি শেষ হয়ে গেলাম, ম্যাথিসনকে কিছুই দেখানো গেল না। প্রচণ্ড মার খেলাম, কি ফল হল? জুয়ানা… অ্যাডলফো… এড… ভিকি তারপর এই। কি আর এসে যায়! স্লাইডার হাসতে লাগল, জাহান্নামে যাও। তোমরা নিপাত যাও। তোমাদের এই বেজন্মা শহর নিপাতে যাক। কেড মুখ ফিরিয়ে আস্তে আস্তে রেলিং পেরিয়ে প্লেনের দিকে এগোল। স্লাইডারের অট্টহাসি ওর ওপর আগুনের হকার মতন আছড়ে পড়তে লাগল।

তিনঘণ্টা বাদে প্লেনটা যখন কেনেডি এয়ারপোর্টে পৌঁছাল, কেড পুরোপুরি মাতাল। এয়ারহোস্টেস মেয়েটি কেডকে ধরে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। অন্য যাত্রীরা কেড মজা পাচ্ছিল, কেই বা ঘেন্নায় মুখ কুঁচকে কেডকে পথ ছেড়ে দিল। এয়ারহোস্টেস মেয়েটি অবশ্য খুব মিষ্টি, ভালো। রিসেপশনের কাছে কেডকে পৌঁছিয়ে দিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে বলল, স্যার আপনি সুস্থ বোধ করছেন তো?

দারুণ আছি। হাজার না লক্ষ ধন্যবাদ খুকি।

এই সময় সোফারের পোষাক পরা একটা লম্বা রোগা লোক কেডের দিকে এগিয়ে এল।

মিঃ কেড?

কেড প্রায় টলে পড়ে যাচ্ছিল। কোনমতে লোকটার হাত ধরে নিজেকে সামলাল।

 হ্যাঁ।

আমি গাড়ি এনেছি স্যার। আপনার ব্যাগটা আমায় দিন।

তোমার নিশ্চয় ভুল হয়েছে, সর, কেড লোকটাকে ঠেলে সরিয়ে ট্যাক্সির দিকে এগোতে থাকল হোঁচট খেতে খেতে।

লোকটি ওর পেছন পেছন গেল।

 মাপ করবেন মিঃ কেড।

ব্যাপারটা কি? কেড জড়িয়ে জড়িয়ে প্রশ্ন করল।

 মিঃ ব্র্যাডফ আপনার সাথে দেখা করতে চান, স্যার। আপনার ব্যাগটা আমায় দয়া করে দিন।

এতে যদি তোমরা মজা পাও, তাহলে চল। কিন্তু মিঃ ব্র্যাডফ আবার কে?

এই যে গাড়ি স্যার। একটা হলুদ রঙের রোলস রয়েস দেখিয়ে সোফারটি বলল।

 কেড অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ভুল করলে না তো?

না স্যার। মিঃ ব্র্যাডফ আপনাকেই নিয়ে যেতে বলেছেন।

কেড বুঝল সোফারটি ওকে প্রায় জোর করেই গাড়িতে তুলল। নরম গদির সীটে নিজেকে ডুবিয়ে দিল কেড। তার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে সীটের পেছনে মাথাটা হেলিয়ে দিল, আর তারপরই অজ্ঞান হয়ে গেল।

নিউইয়র্ক শহরের বহুতল বিলডিংয়ের চবিশ তলায় মিঃ ব্র্যাডফের ফ্ল্যাট ছাদের ওপর, চারিদিকে বাগান। কেড একটা গাছের ছায়ায় বসেছিল।

লোকটা লম্বা, রোগা গায়ের রঙ তামাটে খুব স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলে। নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করে আর সূর্যোপাসনা করে। পঁচাত্তর বছর বয়স আন্দাজ, খুবই শক্ত সমর্থ চেহারা। ছোট ছোট চোখদুটি উজ্জ্বল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি।

আমেরিকান ধনীদের মধ্যে পঞ্চম, এই ওর পরিচয়।

হুইসপার নামে কুৎসা-প্রচারকারী সংবাদপত্রের মালিক ব্র্যাডফ। ব্র্যাডফের আরও ব্যবসাপাতি আছে, তবে এই সংবাদ পত্রটিতে এর বিশেষ আগ্রহ। নিষ্ঠুরতা ও নির্দয়তার জীবন্ত প্রতীক এই ব্র্যাডফ। তার পত্রিকা যে কত বিখ্যাত লোককে বিপদে ফেলেছে, তার সংখ্যা নেই। কেডের মুখোমুখি ব্র্যাডফ বসেছিল। কেডের নেশার ঘোর ভাল করে কাটেনি। ব্র্যাডফ সম্বন্ধে কেড আগেই জানত। লোকটা বিপজ্জনক, প্রভাবশালী, অসম্ভব ধনী। ব্র্যাডফ নীচুস্বরে বলল, কেড মনে হচ্ছে তোমার খেলা এখন শেষ।

হ্যাঁ, কেড বুঝেছে সে খুবই বিপদে পড়েছে, ব্র্যাডফের গুহায় এসে পৌঁছেছে। কিন্তু ব্র্যাডফের মতন একটা জঘন্য লোক ওর পিঠ চাপড়িয়ে কথা বলবে কেডের সহ্য হল না। বলল, তাতে তোমার কি এসে যায়?

আমি তোমার সব গতিবিধি জানি কেড। তারপর নিজের হাতের সোনার ওমেগা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ব্যস্ত মানুষ। আমি একটা কাজের কথা তোমায় বলতে চাই।

কেড মদের গ্লাস নামিয়ে রাখল। তার কোন আগ্রহই নেই। আমি কয়েকটা বিশেষ ধরনের ছবি চাই। তুমি তার জন্য দশ হাজার ডলার পাবে।

তারপর কেড়ের দিকে তাকিয়ে ব্র্যাডফ বলল, অন্যান্য কাগজে সেইসব ছবি ছাপাবার অধিকার তোমার থাকবে। তা থেকেও তুমি পয়সা পেতে পার।

আমায় কেন? আরো তো অনেক ফটোগ্রাফার আছে? আমি একটা অপদার্থ মাতাল দেখতেই তো পাই।

তুমি কে আমি ভালোভাবেই জানি এবং তোমাকেই আমার দরকার। তারপর পায়ের ওপর পা তুলে ব্র্যাডফ বলল, মদ খেলে মানুষের নৈতিক চরিত্র বলে কিছু আর থাকেনা। তার ওপরে তোমার খুব পয়সারও প্রয়োজন। আমার অনেক টাকা আছে। অতএব আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি।

জাপানী পরিচারকটি একটা ছায়ার মতন এসে কেডের গ্লাসে আরো হুইস্কি ঢেলে দিয়ে চলে গেল। কেড বলল, আমার এখনো নিউইয়র্ক সান-এর সঙ্গে কনট্র্যাক্ট আছে।

ব্র্যাডফ ঘাড় নেড়ে বলল, না আমি তোমার কনট্র্যাক্ট কিনে নিয়েছি। ম্যাথিসন কনট্র্যাক্টটা ঝেড়ে ফেলে যেন বাঁচল।

কেড মদের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে রইল। হেনরিকে দোষ দেওয়া যায় না। আমি আর কত নীচে নামব? সে নিজে নিজেকে প্রশ্ন করল। হুইসপারের মতন একটা নোংরা কাগজে যদি আমি কাজ করি তাহলে সেটা হবে আমার অধঃপতনের শেষ ধাপ।

ব্র্যাডফ বলল, তুমি ম্যাথিসনের সঙ্গে তোমার কনট্রাক্টটা খুঁটিয়ে কখনো পড়নি। ওই কনট্রাক্টে ছিল তুমি যদি উল্টো পালটা কাজ কর তাহলে ম্যাথিসন তোমার নামে মামলা ঠুকতে পারে। ম্যাথিসনের দয়ামায়া আছে, আমার কিন্তু নেই। তুমি যদি আমার কাজ আমার নির্দেশ মাফিক না কর তাহলে তোমার নামে এমন মামলা ঠুকে দেব যে জীবনে আর এক ডলারও কামাতে পারবে না, সে যে জাতের ছবিই তোল না কেন।

কেড ব্র্যাডফের দিকে তাকাল। ওর চোখ ঝাপসা, যেন কিছুই ভাল করে দেখতে পারছে। না। আমায় কি করতে হবে?

ব্র্যাডফ বলল, অ্যানিটা স্ট্রেলিকের সম্পূর্ণ জীবনীটা আমি সংগ্রহ করেছি। কয়েকটা ফোটো পেলেই জীবনীটা ছাপানো যায়। তোমার সেই ছবিগুলি তুলতে হবে। অ্যানিটা স্ট্রেলিক একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তাড়কা। ব্রিজিত বার্দো, জীন মোরো, জিনা লোলো ব্রিজিতার সঙ্গে ওর নাম এক নিশ্বাসে উচ্চারণ করা যায়। কেড কেড অ্যানিটাকে আধুনিক যুগের গার্বো বলে। অ্যানিটার জন্য রাশিয়ায়। বয়স সাতাশ বছর, চোখ ও চুল পাংসুটে সাদা। ও ঠিক সুন্দরী নয় সুশ্রী। গত পাঁচবছর ধরে অ্যানিটার নাম সংবাদপত্রে প্রধান সংবাদ বলে পরিবেশিত হচ্ছে। সে এপাশ ওপাশ ফিরলেও সেটা খবর হয়ে যায়। অত্যন্ত আকর্ষণীয় চরিত্র এই অ্যানিটা। কেড এ সবই জানে। মদটা শেষ করে ও কাঁপা কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরাল। অ্যানিটা তোমার কি ক্ষতি করল ব্র্যাডফ। আমি তো বুঝতে পারছি সেই জীবনী কীরকম হবে।

অ্যানিটা আমার কী করেছে সে তোমার জানার দরকার নেই। এটা কখনও ভেবেছে অ্যানিটা কখনও বিয়ে করল না কেন?

স্ট্রেলিক সম্বন্ধে আমার কোন আগ্রহই নেই। ও বিয়ে করল না কেন সে নিয়ে আমার মাথা, ঘামাবার দরকার নেই।

ব্র্যাডফ অন্যদিকে পা মুড়ল। এবার থেকে তোমার মাথা ঘামাতে হবে। চিত্রতারকাদের মধ্যে অ্যানিটা একেবারেই অন্যধরনের। পাঁচ বছর হল ও খুবই নাম করেছে। ওর নামে কোন কে নেই, ওর জীবনে কোন পুরুষের নাম শোনা যায় না। ও সমকামীও নয়। আরে এতো রীতিমত সন্দেহজনক। ও রক্তমাংসের মানুষ তো! আমরা বিশ্বাস করি না অ্যানিটা সাতাশ বছর বয়সেও ভার্জিন রয়ে গেছে। ও যেদিন আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেল সেদিন থেকে আমার লোকজন প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা ওর ওপর কড়া নজর রেখেছে অথচ আশ্চর্য এখনো কোন গোপন প্রণয়ীর সন্ধান পাইনি আমরা।

কেড বলল, তোমার জন্য আমার আফশোষ হচ্ছে। তোমার নোংরা কাগজটার পক্ষে এটা একটা আশাভঙ্গ বুঝতে পারছি ব্র্যাডফ। এর জন্য ভবিষ্যতে আমি তোমাকে সহানুভূতি জানাব।

ব্র্যাডফ মড়ার খুলির মতন ভাবলেশহীন মুখ করে বলল, অথচ আমার এই নোংরা পাকমাখা কাগজটায় তুমি এখন কাজ করছ।

তাতে কি এসে যায়?

শোন কাজের কথা শোন। মে মাসে স্ট্রেলিক সুইজারল্যান্ডে যায়। ওখানে আমার নোক ওকে অনুসরণ করে। লোজানে স্ট্রেলিক হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে যায়। লোকটি ওকে আর খুঁজে পায়নি। আবার সেপ্টেম্বরে স্ট্রেলিক সুইজারল্যান্ডে যায়। আমার লোকটি খুবই চালাক চতুর কিন্তু মরোক্স অব্দি গিয়ে ওর নজর থেকে স্ট্রেলিক হাওয়া হয়ে যায়। ও আমাদের লোকদের ধাপ্পা দিচ্ছে আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু কেন এই সতর্কতা? আমার ধারণা সুইজারল্যান্ডে ওর কোন গোপন প্রণয়ী আছে। আমার জানা দরকার সে কে। আমি ওদের দুজনের একসঙ্গে ছবি চাই। এটাই তোমার কাজ কেড। তুমি আমাকে ছবি দাও, আমি তোমাকে দশ হাজার ডলার দেব। যদি ছবি তুলতে না পার তোমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করব। এমন প্যাঁচে তোমায় ফেলব যে একটি ডলার রোজগার করতে চাইলে আমাকেই সেটা দিতে হবে।

কেড সব শুনছিল। বলল, এখন স্ট্রেলিক কোথায়?

প্যারিসে। কাল সকালে তুমি প্যারিস যাবে। আমার লোক ওর্লি এয়ারপোর্টে থাকবে। সেই সব ব্যবস্থা করে দেবে। আর একটু মদ চাই?

কেড হাসল, মন্দ কি! তুমি যেন কি বলছিলে, মদ খেলে মানুষের নীতিজ্ঞান চলে যায়। হ্যাঁ, আমি আরেকটু মদ খাব।

ওর্লি এয়ারপোর্টের রিসেপশনের বাইরে হুইসপারের প্রতিনিধি কেন শেরম্যান অপেক্ষা করছিল। লোকটা চৌকো বেশ গাট্টাগোট্টা খুব ব্যস্তবাগীশ ধরণের। ওকে দেখে কোন মাঝারি জাতের সেলসম্যান মনে হয়। ওর শার্টটা নোংরা, জুতোটাও ধুলোমাখা। দুজনে চুপচাপ ৩৭। শেরম্যানের সিমকা গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। যে চওড়া রাস্তাটা গিয়ে ওতোরুৎ ডু সদে পড়েছে, সেটা দিয়ে প্যারিসের দিকে যেতে যেতে শেরম্যান বলল, যে কোনো মুহূর্তে স্ট্রেলিক রওনা হতে পারে। হতচ্ছাড়া বৃষ্টি। এবার আমাদের চোখে এখনও স্ট্রেলিক ফাঁকি দিতে পারে নি। ওর গ্যারাজের লোকটাকে আমি হাত করেছি। ওর বাড়ির দারোয়ানটাও আমাদের টাকা খাচ্ছে। ওর হেয়ারড্রেসার খবর দিয়েছে অ্যানিটা বাসপত্র গোছাচ্ছে। যেই না খবর পাব স্ট্রেলিক রওনা দিয়েছে তুমি এরোপ্লেনে জেনিভা চলে যাবে। সেখানে বোম্যান্ তোমার সব বন্দোবস্ত করে দেবে। আমি মোটরেঅ্যানিটার পিছু নেব। ওর গাড়ি হচ্ছে অ্যাস্টন মার্টিন। ও গাড়ি চালায় খ্যাপার মন। তাই আমাকে আবার ভড়কি দিতে পারে। যাইহোক, তুমি আর বোম্যাণ ওর জন্য ভালোরবিতে অপেক্ষা করবে। সেখানে ওকে বর্ডার পেরোতে হবে। লোজান থেকে মরোক্স যাবার পথে দু দুবার ও আমাদের চোখে ধুলো দিয়েছে। লোজান আর ভেডের মাঝপথে দুটো চালাকচতুর ছোকরাকে দুটো তেজী গাড়ি দিয়ে মোতায়েন করে রেখেছি। এবারও যদি ও আমাদের এড়িয়ে যায় তাহলেই গেছি। এস. বি. কাজ পণ্ড হওয়া পছন্দ করেন না।

কেড মুখ খুলল না। একটা ডবল হুইস্কি, খানিকটা বরফ এই শুধু ভাবছিল ও। এখানকার কাজে ওর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। সে ছবি তুলতে রাজী আছে কিন্তু এত কষ্টভোগ করতে সে রাজী নয়।

এরকম মড়ার মন মুখ করে থেক না দোস্ত। আমি তোমার সব খবর রাখি। তুমি জব্বর ছবি তুলতে পার জানি। কিন্তু এখন আমার সঙ্গেই তোমাকে কাজ করতে হবে। ভেবনা সব সাজিয়েগুছিয়ে তোমার কাছে এনে দেব আর তুমি পায়ের ওপর পা তুলে ছবি তুলবে।

কেড বলল, চুলোয় যাও। বলে চোখ বুজল।

শেরম্যান এবার চুপচাপ গাড়ি চালাতে লাগল। সেইননদীর বাঁ দিকে রুদ্য ভোজিরো ছাড়িয়ে একটা তৃতীয় শ্রেণীর হোটলে এসে গাড়ি থামাল।

ব্যাগটা নামাও, কেড। নামটা লেখাও। আমি ততক্ষণ অ্যানিটার দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে আসি। তুমি আসবে?

কেড ব্যাগটা নামাল। তুমি যার সঙ্গে কথা বলতে চাও বল, আমার অন্য কাজ আছে।

কেড হোটেলের ভেতরে ঢুকে গেল। শেরম্যান হতাশ হয়ে কাধ ঝাঁকাল তারপর চলে গেল।

সন্ধ্যাটা কেড বিছানায় শুয়ে কাটাল। হাতের কাছে এক বোতল স্কচ হুইস্কি আর নিউইয়র্ক ট্রিবিউন কাগজটা। রাত নটার কাছাকাছি একটা হোটেল থেকে খেয়ে এল। আগে অনেকবার প্যারিসে এসেছে। কিন্তু আজ তার এ শহরটা ভাল লাগছে। সে একলা থাকতে চায় সঙ্গে শুধু মদ থাকলেই হয়।

রাত সোয়া এগারটা নাগাদ টেলিফোনটা বেজে উঠল। শেরম্যান ফোন করছে। কাল অ্যানিটা বেরিয়ে যাচ্ছে। আমি তোমার জন্য জেনিভার টিকিট কেটেছি। তুমি সকাল নটা চোদ্দ মিনিটের প্লেন ধরবে। আমি তোমাকে সকাল আটটায় হোটেল থেকে তুলে নেব। জেনিভায় বোম্যান্ তোমার সঙ্গে দেখা করবে।

সে–ও হু বলে সম্মতি জানাল। ফোন নামিয়ে ও গম্ভীর হতাশায় কাধ ঝাঁকাল তারপর ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল।

অন্ধকারে জুয়ানার ছবি তার কাছে ভেসে উঠল। বিছানায় শোওয়া কালো চুলের রাশি দিয়ে, ঢাকা জুয়ানার সেই অপূর্ব ভঙ্গিমা। সে নিজেকে গাল দিতে দিতে বিছানায় উঠে বসল। এখন তার চাই নির্জলা অন্ততঃ তিন গ্লাস মদ। এই অভিশাপ থেকে তার মুক্তি নেই।

পরদিন সকালে শেরম্যান কেডকে ওর্লি এয়ারপোর্টে নিয়ে গেল। কেডের ওরকম উদাসীন ভাব দেখে শেরম্যান ক্ষেপেই গেল। এ কাজটা আমার কাছে জীবনমরণের মতন। সারাক্ষণ মদে ডুবে থাকলে তুমি এ কাজটা করতে পারবে কি করে?

যাও যাও, কেড বলল। তার মাথায় খুবই যন্ত্রণা হচ্ছে।

এস বির নিশ্চয় মাথা খারাপ হয়ে গেছে নইলে এরকম একটা পাড় মাতালকে এই কাজের ভার দেয়। এদিকে কাজটা ভণ্ডুল হলে আমারই সব দোষ হবে।

এয়ারপোর্টে পৌঁছে শেরম্যান কেডকে টিকিট দিল, বলল, ওহে বোম্যানকে সামলে চলবে। ও আমার মতন এত নরম নয়।

আর শোন, অত কপচিও না। বোম্যানের মাকে গিয়ে ওর সম্পর্কে গুনগান করো। বোম্যানকে কে পরোয়া করে আর ব্র্যাডফকেই বা কে পরোয়া করে। বলতে বলতে কেড এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেল।

প্লেন যখন জেনিভায় পৌঁছল কেড বেশ মাতাল হয়ে পড়েছে। সুইস কাস্টমসের কর্মচারীরা ওর সঙ্গে খুবই কঠিন ব্যবহার করল। হর্সর্ট বোম্যান্ কাস্টমসের বেড়ার ওপারে অপেক্ষা করছিল। লোকটি সুইস। জুরিখে থাকে। বেঁটে আঁটসাঁট চেহারা। চোখদুটিতে ধূর্তমি ঠাসা। কেডের সম্বন্ধে ও আগেই জানত, তাই কেডকে মাতাল দেখে অবাক হল না। বোম্যারে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস। সে মনে করে সে সবরকম অবস্থা সামাল দিতে পারে। পাঁচবছর হল ও হুইসপার কাগজের সুইস প্রতিনিধি। সুইজারল্যান্ডে কোন ট্যাক্সের ঝামেলা নেই। তাই বহু বড়লোকের ভরসা সুইজারল্যান্ড। এবং এদের গোপন রহস্য টেনে বের করেই হুইসপারের এত নামডাক। এটা প্রমাণিত যে, বোম্যান্ কেচ্ছাসন্ধানীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্ধানী।

ভালোরবিতে পৌঁছতে অ্যানিটার তিন চার ঘন্টা লাগবে। আশাকরি ততক্ষণে তোমার নেশা কেটে যাবে। এখন কেড তুমি মদ ছুঁতেও পারবে না। তোমার সামনে এখন কাজ, আর সেই কাজ না করলে আমি তোমাকে ভালরকম বেগ দেব।

কেড ওর পালোয়ান চেহারার দিকে একবার তাকাল।

তাই বুঝি? নাও, আমার ব্যাগ নাও। তোমার মনিব ভালভাবেই জানে কাজটা আমার দ্বারাই সম্ভব তারজন্যই ও কনট্রাক্ট কিনে নিয়েছে। যাও, বকবকানি থামাও।

বোম্যান্ ব্যাগটা নিল। বেশ ঠাণ্ডা, কনকনে আবহাওয়া। ওরা বোম্যানের জাগুয়ার গাড়ির দিকে এগোল।

ভালোরবির কাস্টমস্ ঘাঁটির কাছে গিয়ে বর্ডারের বিশমিটার দূরের ছোট একটা হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল বোম্যান্। ততক্ষণে কেডের নেশা অনেকটা কেটে গেছে। বোম্যান্ একটা ঘর ঠিক করেই রেখেছিল। ওরা দুজনে সেই ঘরে গেল। বোম্যান্ ওদের ঘরে এক লিটার কালো কফি পাঠিয়ে দিতে বলল। ঘরের জানলা থেকে বর্ডার পোস্ট দেখা যায়। বিছানায় ধপ করে বসে কেড দুহাতে মাথা টিপে ধরল।

একটা ডবল স্কচ আর বরফ। তাড়াতাড়ি। আমার মদ চাই–ই চাই।

বোম্যান্ নিজের ভারী কোটটা খুলে ফেলল। জানালা খুলে দিল। চারিদিক ধোঁয়াশায় ভরতি বোঝাই যায় এখনি বরফ পড়বে। বাতাস এত ঠাণ্ডা যে হাড়ে কাপুনি লেগে যাচ্ছে।

জানলা বন্ধ কর, কেড বলল।

বোম্যান্ কেডের সামনে এসে দাঁড়াল, আমার দিকে তাকাও।

কেড ভুরু কুঁচকে বোম্যানের দিকে তাকাল। জানলা বন্ধ কর শিগগির। কেড বলল।

হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে বোম্যান্ কেডকে গালে চড় মারল। কেড বিছানায় চিত হয়ে পড়ে গেল। উঠবার চেষ্টা করতেই বোম্যান্ আবার চড় মারল। কেড নিশ্চপ। ওর মুখ জ্বালা করছে। নেশার ঘোর পুরো কেটে গেছে। ইস্টনভিলে মিচেলের প্রতি যেমন ঘৃণা হয়েছিল সেরকম অসীম ঘৃণা নিয়ে বোম্যানের দিকেও তাকাল।

বোম্যান্ বলল ঘন্টায় ঘন্টায় আমি মার চালাতে পারি জান। আমি বলছি তুমি মদ ছোঁবে না, ব্যস। বুঝেছ?

কে্ড নিজেকে তৈরী করছিল। হঠাৎ ও বিছানা ছেড়ে নেমে বোম্যানের মুখে এলোপাথাড়ি ঘুষি চালাতে লাগল। অত্যন্ত পেশাদারী দক্ষতার সঙ্গে বোম্যান মাথা সরিয়ে কেডের খুঁষি এড়াল। তারপর সমস্ত শরীরের শক্তি দিয়ে এক জব্বর ঘুষি মারল কেডের হৃৎপিণ্ডের ঠিক নীচে। কেড একটা কোৎ করে শব্দ তুলে বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে। বোম্যান তারপর চুলে হ্যাঁচকা টান মেরে কেডকে উঠিয়ে মুখের ওপর এলোপাথাড়ি এমন চড় মারতে লাগল যে কেড সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়ল। এ সময় ওয়েটার কফি নিয়ে এল। কেড ওর শেষ শক্তি শেষ আত্মসম্মান সংহত করে টলতে টলতে বোম্যানের দিকে এগিয়ে এল। বোম্যান্ খুবই তাচ্ছিল্য সহকারে আবার এক পেল্লায় ঘুষি মারল কেডের মুখে। কেড ধপ্ করে মাটিতে পড়ে গেল। বোম্যান্ বসল, এক প্যাকেট সিগারেট বের করল। একটা ধরাল। কেড কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল, এবার কোনরকমে শরীরটা টেনে তুলে পরম ঘৃণা ভরে বোম্যানের দিকে চাইল।

মনে হচ্ছে তোমার জন্মের ঠিক নেই, কেড বলল।

বোম্যান্ হাসল। যা বলেছে। নাও এখন একটু কফি খাও। উঠে পেয়ালায় কফি ঢালল বোম্যান।

চিনি?

না।

বোম্যান্ কেডকে কফির পেয়ালা দিয়ে আবার বিছানায় বসল। এত ঘুষি চড় থাপ্পড় খেয়ে কেডের সারা শরীরে যন্ত্রণা হচ্ছে। হঠাৎ কেডের মনে হল সে একটা পাঁড়মাতাল, সারা মুখে কালসিটে, জামাকাপড় কুঁচকানো এই তত বোম্যান্ দেখতে পাচ্ছে। ওর সবরকম হার হয়ে গেছে। ওর আত্মসম্মানের শেষ স্ফুলিঙ্গটা আবার জ্বলে উঠল। কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে ও গরম কফি খেল, তারপর আরো কফি ঢালল পেয়ালায়।

সিগারেট? বোম্যান ম্যারোকেইন–এর প্যাকেট বাড়িয়ে দিল।

 ধন্যবাদ।

কেড সিগারেট ধরাল। আরো কফি খেল। তারপর বাথরুমে গিয়ে ভালো করে মুখ ধুল। নিউইয়র্ক ছাড়ার পর এই প্রথম নিজেকে বেশ ঝরঝরে লাগল কেডের। ঘরে এসে ও খোলা জানলা দিয়ে বর্ডার–পোস্টের দিক থেকে বুক ভরে ঠাণ্ডা বাতাস টানতে লাগল।

বোম্যান্ বলল, এখনো তিনঘণ্টা আছে অ্যানিটার এখানে পৌঁছতে। খাবে কিছু?

না।

 আমার ইচ্ছে করছে। যদি খেতে চাও, ঘন্টা বাজিও। ওরা তোমাকে মদ দেবে না, তাই সে চেষ্টা কোর না। পরে দেখা হবে।

বোম্যান্ বেরিয়ে গেল। কেড আর এক কাপ কফি খেল, তারপর ইজি চেয়ারে বসে রইল। একা থাকলে তার মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ পর বিরক্ত হয়ে ও উঠে পড়ল, ঘর থেকে বেরোল লবিতে। ওভারকোট গায়ে দিয়ে ও বুটিকে চলে গেল। বড় বড় স্কচের বোতল সাজানো দেখে কেডের চোখ আটকে গেল। কিন্তু মদ কেনবার ইচ্ছেটা সে জোর করে মন থেকে সরিয়ে ফেলল। এক প্যাকেট মদ ভরা চুইংগাম কিনল কেড। বোম্যাকে হোটেল থেকে বেরোতে দেখে ও এগিয়ে গেল। বোম্যান বলল, তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? বেশ স্টেক বানায় এখানে। তোমার কিছু খাওয়া দরকার।

খেলেই হয়।

কেডের পাজরগুলো এখনো টনটন করছে। কিন্তু ওর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।

লাঞ্চ খাওয়া হলে বোম্যান্ বিল মিটিয়ে দিল। দুজনে অন্ধকারে বেরিয়ে গিয়ে জাগুয়ারে বসল। গাড়ির মুখ বর্ডার ঘাঁটির উল্টোদিকে। বর্ডার–ঘাঁটিতে অ্যানিটা স্ট্রেলিক পৌঁছল সন্ধ্যা পাঁচটা পঞ্চাশে। ততক্ষণে চারিদিকে ঘন অন্ধকার হয়ে গেছে কিন্তু বর্ডারের উজ্জ্বল আলোয় সহজেই অ্যানিটাকে ওরা চিনতে পারল। বোম্যান্ বলল, এসে গেছে। কাস্টমস্ পেরোতে ওর পাঁচ মিনিট লাগবে না। চল আমরা রওনা দিই।

লোজার রোডের দিকে বোম্যান্ গাড়ি চালাল। পেছনের জানলা দিয়ে কেড দেখল একটি লম্বা মেয়ে, স্কি করার প্যান্ট আর সাদা চামড়ার জ্যাকেট পরা সাদা হেলমেটে চুলগুলো ঢাকা, অ্যাস্টন মার্টিনের পাশে দাঁড়িয়ে একদল সীমান্ত রক্ষীর সঙ্গে কথা বলছে। একটুক্ষণ তারপরেই ওকে আর দেখা গেল না।

সহসা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে গেল কেড। অনেক অনেক মাস পরে এমন উত্তেজনার অনুভূতি বোধ করল কেড। বোম্যান্ বলল, আমরা পথ ছেড়ে দেব।

কিছুক্ষণ বাদেই অধীর হর্নের আওয়াজে বোম্যান্ পাশ দিল। ঘণ্টায় একশো কিলোমিটারেরও বেশি স্পীডে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল লাল অ্যাস্টন মার্টিন।

বোম্যান্ অ্যাকসিলেটারে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, এইসব সরু রাস্তায় এমন স্পীডে কেড গাড়ি চালায়। ড্যাশবোর্ডের শর্টওয়েভ রিসিভিং সেটের সুইচ টিপে দিয়ে বোম্যান্ মাইক্রোফোনটা তুলে নিল।

হর্সট ওয়াই আরকে ডাকছে। কাম ইন ওয়াই আর।

 লাউড স্পীকারে একটি পুরুষের গলা ভেসে এল, শুনছি হর্সট।

পার্টি লোজানে যাচ্ছে। তুমি কোথায়?

 গ্ৰপর পাশে।

এখানে আসবে। তোমার গাড়ি সামনে রেখে নজর রাখবে, তবে সাবধান ভীষণ স্পীডে গাড়ি যাচ্ছে।

লোজানের শহরতলীতে পৌঁছবার আগে ওরা অ্যাস্টন মার্টিনটা দেখতে পেল না। এই সব। রাস্তা বোমাত্রে হাতের তালুর মতন চেনা। যখনই সিধে রাস্তা পেয়েছে ও উদ্ধশ্বাসে গাড়ি চালিয়েছে, বাঁকের মুখে সাবধান হয়ে স্পীড কমিয়েছে। লোজানে ঢোকবার মুখে গাড়ির জঙ্গলে অ্যানিটার লাল অ্যাস্টন মার্টিন আবার দেখা গেল। গাড়ির স্রোতের মধ্য দিয়ে ওরা গ্রুপ পেরিয়ে চলল। অ্যাস্টন মার্টিন আবার চোখের আড়ালে। গাড়ির ভীড়ের মধ্যে এঁকেবেঁকে অ্যানিটা দ্রুত গাড়ি চালিয়ে উধাও হয়ে গেছে।

শর্টওয়েভ সেটে আবার কথা শোনা গেল।

ওয়াই আর বলছি। অ্যানিটার গাড়ি ঠিক আমার গাড়ির পেছনে, পাশ কাটাবার চেষ্টা করছে। আমরা এখন কেডের পথে অ্যাভন ডু লিৰ্মতে।

বোম্যান বলল ওকে আটকে রাখ। আমি ধরে ফেলছি।

আচ্ছা। তারপরে একটা গাল দিয়ে ওয়াই আর বলল বেরিয়ে গেল আমায় কেটে। একে বেঁকে আমার পাশ কাটিয়ে একটা ট্রাকের মুখোমুখি ধাক্কা লাগাতে লাগাতে চো করে বেরিয়ে গেল। এদিকে আমি জ্যামে আটকে আছি।

বোম্যান্ মুখ খিঁচিয়ে বলল, তুমি নিজেকে ড্রাইভার বল? বলে গাড়ির স্পীড অসম্ভব বাড়িয়ে বিপজ্জনক ভাবে গাড়ির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ও বেরিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ও একটা গাড়ির পাশ দিয়ে সাঁকরে বেরিয়ে গেল ড্রাইভারকে হাত দেখিয়ে। ড্রাইভারও হাত নাড়ল।

উত্তেজনায় টানটান হয়ে সারাক্ষণ বসে কেড। বোম্যান্ যেরকম দক্ষতার সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছে দেখে প্রশংসা না করে ও পারল না। বোম্যান্ আপন মনে বলল ও যদি মনে করে আমাকে কাটাবে ও ভুল করেছে। মাইক্রোফোনটা তুলে নিল ও। গ্রাডকে ডাকছি। শিগগির গ্রাড। লাউডস্পীকারে আরেকটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, বল হসটু।

আমাদের পার্টি তোমার দিকে এগোচ্ছে। তুমি এখন ঠিক কোন জায়গায় আছ?

ফ্লার আর মরোক্স–এর মাঝামাঝি লেক রোডে।

 নজর রাখ। পার্টি ভীষণ স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছে।

বেশ।

লোজান পেরিয়ে ওরা লেক রোড দিয়ে যেন উড়ে চলল। পথে গাড়ির মেলা। বোম্যান কোনটিকে পাশ কাটিয়ে কোনটা আশ্চর্য দক্ষতায় ওভারটেক করে বেরিয়ে যেতে লাগল। এদিকে লেক থেকে হালকা কুয়াশা উঠে আসছে। সামনের গাড়িগুলোর হেডলাইটে চোখ ধাঁধানো আলো। বোম্যান্ চিন্তায় পড়ল। এই আলোতে ও আমাদের কলা দেখাতে পারে। গ্রাড যদি ওকে ধরে রাখতে পারে।

ভেভে ছাড়িয়ে মর্যোক্সে যাবার সোজা পথে যখন গাড়ি ছুটছে, তখন কেড হঠাৎ বলল, আরে তুমি ওকে ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছ। ওর গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। নিজেকে একটা গালাগাল দিয়ে বোম্যান ব্রেক কষল। ফুটপাথের ধারে গাড়ি দাঁড় করাল।

তুমি ঠিক দেখেছ?

কেড মুখ বাড়িয়ে অন্ধকারে দেখল।

হ্যাঁ, পুলিশের সাথে কথা বলছে। পুলিশ ওকে ফাঁসিয়েছে। মাইক্রোফোন তুলে নিল বোম্যান, এ্যাড, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর জন্য পাটির গাড়ি দাঁড় করিয়েছে পুলিশ। এখনি আসবে। আমার ধারণা এবার ও সমঝে চালাবে।

আচ্ছা।

আমাদের নজর রাখতে হবে। এই জায়গাতেই আমরা আগে ধোঁকা খেয়েছি। কি হচ্ছে বলতো এখানে?

কেড তখনো পেছনে চেয়ে আছে। যা হয়, পুলিশ টিকিট দিচ্ছে। যে কোন মুহূর্তে কিন্তু ও বেরিয়ে যাবে।

বোম্যান্ ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটার স্পীডে গাড়ি ছেড়ে দিল।

আসছে, কেড বলল।

অ্যাস্টন মার্টিনটা ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। ওই গাড়ির পেছনের আলো দুটো দেখে দেখে বোম্যান এখান থেকে মর্যোল্প ভিনোভ ও আজিল অবধি অনুসরণ করল।

বোম্যান্ বলল, ও কি ইটালীর সীমান্তের দিকে যাচ্ছে না কি পাহাড়ের পথে ছুটছে? এই বরফ পড়ল বলে। বোম্যান ওয়াটপারের সুইচ টিপল। বোম্যানদের পেছন থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট জ্বলল নিভল।

বোম্যান বলল গ্রাড। ও মাইক্রোফোন তুলে বলল পাটি ঠিক আমার সামনে। এড, আমায় এবার টেককর, ওর সামনে যাও। খেয়াল রেখ, ইটালী যাবার দু মুখো রাস্তায় ও যেন তোমায় ধোকা না দেয়। ও ভিলারও যেতে পারে।

আচ্ছা।

বিশ মিনিট পরে। গ্রাড অ্যাস্টন মার্টিনটার ক মিটার আগে, বোম্যান্ ক মিটার পেছনে। এই সময়ে অ্যানিটার গাড়ি বাঁ দিকে ঘুরল। বোম্যান্ সঙ্গে সঙ্গে স্পীড বাড়াল। ও ভিলারে যাচ্ছে। পথ এবার খুব খারাপ। বরফও পড়বে।

এক কিলোমিটার যেতে না যেতেই বরফ পড়তে লাগল। অ্যাস্টন মার্টিনের স্পীড বেড়ে গেল। খুবই বিপজ্জনক বাকগুলো খুব নিপুণ হাতে কাটিয়ে কাটিয়ে গাড়িটা জোরে চলতে লাগল। বোম্যান গাড়ির আলো নিভিয়ে অ্যাস্টন মার্টিনটার খুব কাছাকাছি চলে এল। ওর ভয় এই পথে ওকে ফাঁকি মেরে কোথায় না চলে যায় অ্যানিটা। গ্রাড ইটালিয়ান রোডে চলে গিয়েছিল। আবার গাড়ি ঘুরিয়ে ওদের পিছু পিছু আসতে লাগল। একটা ছোট্ট মতন গ্রাম হুমোজের কাছাকাছি সরু রাস্তায় অ্যানিটার গাড়ি হঠাৎ স্পীড কম করল। বোম্যান্ ব্রেক কষল নইলে ধাক্কা খেত।

বলল আমাদের দেখেনি তো, ওই আবার যাচ্ছে। না গাড়ি চালাতে জানে বটে ও। ঝড়ের বেগে খাড়া চড়াই পথে ও সেজিয়ের গ্রামে উঠে এল। চারিদিকে কুয়াশা আর বরফ। নির্জন গ্রাম। অ্যাস্টন মানিটা এখন একশো মিটার আগে। হঠাৎ জাগুয়ারটা পিছলে গেল। মনে হল জাগুয়ারটা ডানদিকে পাক নেবে। বোম্যান সামলে নিল। কেড নিরুৎসাহ গলায় বলল, চলে গেছে।

এতক্ষণ কেড সামনের দিকে ঝুঁকে বসছিল। অ্যানিটার গাড়ির লাল আলোর উপর চোখ বিধিয়ে রেখেছিল। আর আলো দেখা যাচ্ছে না। বোম্যান্ বলল, ভিলারে যাচ্ছে আর কোন যাবার জায়গা নেই এখানে। গাড়ির গতি কমিয়ে ও চড়াই পেরোতে লাগল। সামনে শহর।

কেড বলে উঠল, তোমার ডানদিকে। ওই তো, ভেতরে ঢুকে গেল। দুটো গেট। দুটো লোক এসে গেট বন্ধ করল।

বোম্যান কয়েক মিটার এগিয়ে গিয়ে গাড়ি থামাল। গ্রাডের ল্যানসিয়া গাড়িও এসে দাঁড়াল পাশে। গ্রাড গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাল। ওর সবুজ টুপি আর বর্ষাতি বরফ পড়ে সাদা হয়ে যাচ্ছিল। গ্রাড বোম্যাইে বয়সী। চওড়া কাঁধ, দেখেই বোঝা যায় সুইস।

বোম্যান্ বলল, মনে হয় কারো জমিদারীতে ঢুকল। চিনতে পেরেছিলে তো ওকে?

না, এই বরফে কাউকে চেনা যায় না।

বোম্যান গাড়ি থেকে নেমে বলল, এখানে অপেক্ষা কর। তারপর বরফের ঝাপটা থেকে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে ও পেছনদিকে হেঁটে গেল। গ্রাড সিগারেট ধরিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এল।

তুমিই কেড? আমি তোমার কথা খুব শুনেছি।

কেড নিস্পৃহ গলায় বলল, আমিও শুনেছি। ও গ্রাড–এর কাছ থেকে সরে বসল। সিগারেট খুঁজতে লাগল।

গ্রাড বলল, সত্যিই ছবি তুলতে জান বটে তুমি। আমি তোমার সব ছবির সম্বন্ধে জানি।

আমিও, কেড বলল।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। তারপর গ্রাড বুঝল কেড ওর সঙ্গে কথা বলতে একান্তই অনিচ্ছুক। তাই নিজের গাড়িতে ফিরে গেল। পাঁচ মিনিট বাদে বোম্যান্ ফিরল।

বলল, ওখানেই গেছে। খুব উঁচু পাঁচিল। গাড়ি যাবার রাস্তাটা খুবই লম্বা। বাড়ির চিহ্নও দেখলাম না। গ্রাড তুমি এখানে থাক। গেটের ওপর নজর রেখ। আমরা ডিনারে যাচ্ছি। এ জায়গাটার খোঁজ খবর নিতে হবে।

বোম্যান জাগুয়ারে উঠে বসে ভিলারের দিকে গাড়ি চালিয়ে দিল।

.

০৮.

এখন রাত আটটা। বেলভিস্তার হোটেলের লাউঞ্জ একদম জনশূন্য। যে কজন খেলার মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই চলে এসেছে তারা ডাইনিং রুমে। চুন্নীতে কাঠের আগুন গনগন করছে। নকশা কাটা কাঠের মেঝেতে চকচকে পালিশে লালচে আভা বেরাচ্ছে। বেশ ঘরোয়া, সুন্দর পরিবেশ। ফায়ারপ্লেসের খানিকটা দূরে একটা আরাম কেদারায় চোখ বুজে কেড বসেছিল। খুবই মদ খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু নিজেকে দমন করল ও। ব্র্যাডফের এ কাজটা ওকে খুবই আকৃষ্ট করেছে। নিজের কাছে প্রমাণ করতে চাইল যে ভাল ফটো তোলার ক্ষমতা এখনও ওর আছে।

দরজা ঠেলে বোম্যান ঢুকল, শেরম্যান ওর পেছনে পেছনে। কেড শেরম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কোত্থেকে?

আর বোল না। শেরম্যান শিউরে উঠে বলল, প্যারিস থেকে ওই মেয়েছেলেটার পেছন নিতে গিয়ে মরেছিলাম আর কি। এখনও মাথা ঝিমঝিম করছে।

বোম্যান্ অধৈর্য হয়ে বলল, জান তোকার পাল্লায় পড়েছ।

তারপর কেডের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি খবর নিলাম। অ্যানিটা জেনারেল ফ্রিৎস্ ফল সুডউইগের ফোর্টে গিয়ে লুকিয়েছে। জান তো এই জেনারেল কে? আলিনগ্রাদে উনিশশো তেতাল্লিশ সালে রুশদের কাছে তিনি সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এই বাড়িতে তিনি গত বিশ বছর ধরে বাস করছেন অবসরের পর। কি মনে হয় বল তো এর থেকে? 

কেড কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, কিছু না। তোমার কি মনে হচ্ছে?

শেরম্যান বলল, লোকটা হিটলার বিরোধী প্রচার চালাত। অনিটা তো জন্মসূত্রে রাশিয়ান, তাই না?

বোম্যান্ বলল, তা বটে, তবে আমাদের ধারণা ছিল ও ওর গুপ্তপ্রণয়ীর সঙ্গে দেখা করতে সুইজারল্যান্ড আসে, এক আশি বছরের বুড়ো জার্মান জেনারেলের সঙ্গে দেখা করতে আসে শুনলে ব্র্যাডফ খুবই হতাশ হবে।

বোম্যান বলল, মনে হচ্ছে ভেতরে কোন ব্যাপার আছে। আজ রাতে আমরা বাড়িটা দেখতে যাব।

শেরম্যান বলল, কিন্তু বরফে পায়ের ছাপ পড়বে। তুমি কি অ্যানিটাকে জানাতে চাও আমরা। ওকে অনুসরণ করছি?

বোম্যান বলল, এই রকম বরফ যদি পড়তে থাকে তাহলে কোন চিন্তা নেই। বরফে সব ঢেকে যাবে, দেখবে তুমি। গ্রাডকে গিয়ে বরং ছেড়ে দাও। ও দুঘণ্টারও বেশী আটকে আছে। শেরম্যান গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেল।

বোম্যান্ একটা সিগারেট ধরিয়ে বলল, এস. বির একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। প্রেম-টেমের থেকে এটা আরো জমাটি ব্যাপার হতে পারে। বুড়ো জার্মান জেনারেল, রুশদের প্রতি যার সহানুভূতি আছে এবং তার সঙ্গে গোপনে দেখাসাক্ষাৎ করছে একজন বিখ্যাত চিত্রতারকা। আমি আর তুমি ঠিক সব বের করে ফেলব কেড।

কেড চুপ করেই রইল। বোম্যান বলল, চল কিছু খাওয়া যাক। সামনে কাজ, আবার বেজায় ঠাণ্ডা।

ডিনারের পর দুজনেই নিজের নিজের ঘরে চলে গেল। কেডের জন্য ও একটা স্কি-পোষাক ঠিক করে রেখেছিল। স্কিবুট আর দস্তানা পরে ওরা চাকরের বেরুবার দরজা দিয়ে বেরিয়ে গাড়ি চালিয়ে শেরম্যানের কাছে গেল। বেচারা শেরম্যান ওর সিমকা গাড়িতে বসে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিল। এ সময় কনকনে বাতাস বইতে শুরু করল। ঠাণ্ডায় ওদের হাড়ে কাপুনি ধরে গেল। বোম্যান্ বলল, চল একটু দেখেশুনে আসি।

শেরম্যান বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি যাও। আমার দরকার নেই।

কয়েক মিনিট অনেক কষ্টে হেঁটে কেড আর বোম্যান উঁচু লোহার গেটটার সামনে এসে দাঁড়াল। ওপাশে একটা ছোট বাড়ির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। বোম্যান বলল, চল আমরা ওদিক দিয়ে যাই। পাঁচিল ঘেঁষে ওরা পা টিপে টিপে চলতে লাগল।

চল আমরা পাঁচিল টপকাব।

 খানায় নেমে গেল বোম্যান্। বরফে ওর জুতো ডুবে গেল।

পাঁচিলে হেলান দিয়ে ও দাঁড়াল।

দাঁড়াও, আগে তোমায় তুলে দিই।

বোম্যান দু হাত জোড়া করল। কেড ওর জোড়া হাতের চেটোয় পা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বোম্যান্ ওকে ঠেলে ওপরে তুলে দিল। কেড পাচিলটা আঁকড়ে পাঁচিলের ওপর উঠে পড়ল। পাঁচিলের ওপর বসে ও বোমাত্রে দিকে চাইল। বোম্যান্ এত বেঁটে যে কেডের বাড়ানো হাতই ধরতে পারল না। রেগে গিয়ে একটা গাল দিল।

যাকগে। আমি এখানেই থাকি। তুমি দেখতে বাড়িটা যদি দেখতে পাও।

 কেড নরম গলায় বলল, কি করে ভাবছ তুমি, আমি নিজেই পাঁচিল টপকে যেতে পারব।

এত ভাল লাগছিল তার এই দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার যে বলবার নয়। সে খুবই উত্তেজিত বোধ করছে। কিন্তু বোম্যাকে বুঝতে দিল না।

দাঁড়াও দড়ি আনছি। বেনের গাড়িতে দড়ি আছে। আমার খেয়াল করা উচিৎ ছিল। তুমি এখানে অপেক্ষা কর, আমি দেরী করব না। বোম্যান্ অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

পাঁচিলের ওপর গুটিসুটি মেরে কেড বসেরইল। গায়ে মাথায় সমানে বরফ পড়ছে। পাঁচিলের ওপর থেকে খানিকটা বরফ ফেলে দিল ও। তারপর বরফের মধ্যে লাফিয়ে নামল। নরম তুষারে পড়ল বলে ব্যথা লাগল না কিন্তু আচমকা আঘাত লাগল একটা। পায়ের পাতা জ্বলে যাচ্ছে, হাঁটুটাও যেন মড়মড়িয়ে উঠছে। এই অবস্থাতেই কেড গাছের সারির ভেতর দিয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে এগোতে লাগল। শেষে একটা বড় সমতল বরফে ঢাকা জায়গায় এল। এবার ও বাড়িটা স্পষ্ট দেখতে পেল। কেমন এলোমেলো ছড়ানো বাড়িটা, মাঝে মাঝে বুরুজ আছে। দেখেই বোঝা যায় সুইজারল্যান্ডের বিশেষ ধরনের দুর্গপ্রাসাদ এটা। তেতলা বাড়িটার গায়ে গায়ে ছোট জানলা। কোন কোন ঘরে আলো জ্বলছে। সহসা কেড থমকে গেল। ও বিপদের গন্ধ পাচ্ছে। একটু পিছিয়ে বরফঢাকা একটা দেবদারু গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে ও বাড়িটাকে দেখতে লাগল। নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে ও বাড়িটা লক্ষ্য করতে লাগল। মাথার ওপর সমানে বরফ পড়ছে। খেয়ালই হল না কেডের। ওর মনে হল বাড়িটার খুব কাছে না গিয়ে ও বুদ্ধিমানের কাজ করেছে। হঠাৎ ও দেখল বাড়িটার কাছে কি যেন নড়ছে-চড়ছে। বরফের বৃষ্টির মধ্য দিয়ে কেড দেখল একটা লোক মাথা নিচু করে হেঁটে বেড়াচ্ছে বাইরে। তারপর আরেকজনকে দেখা গেল। আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখ সয়ে গেল কেডের। দেখল দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে একটু একটু ফাঁক রেখে সারি সারি সশস্ত্র সান্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মুখ কেডের দিকে। চেহারাগুলো এমন ভয়ংকর যে কেড সভয়ে পিছিয়ে গেল। আরো বিশ মিনিটও প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। হাত পা এদিকে ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে। যথেষ্ট দেখেছে ও এই মনে করে পাঁচিলের যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকে চলল। পাঁচিলের ওপর বরফ সরিয়ে একটা চিহ্ন রেখেছিল কেড। কিন্তু এখন বরফ পড়াতে সেটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল কেডের।

বোম্যান্। ও আস্তে ডাকল।

এই যে।

পাঁচিলের ওপার থেকে সাড়া এল আর সাপের মত পিছলে একটা দড়ি বেয়ে কেডের পায়ের কাছে পড়ল। দড়ি বেয়ে উঠতে কেডের খুবই কষ্ট হল। পাঁচিলের ওপর উঠে ও ঘড় ঘড় করে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। হৃৎপিণ্ডটা যেন পাঁজরার গায়ে আছড়াতে লাগল। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে কেড বোম্যা েপাশে লাফিয়ে পড়ল। বোম্যান ক্ষেপে গেছে। আমার জন্য অপেক্ষা করনি কেন?

জানি। চল, যাওয়া যাক এখান থেকে।

গাড়ির মধ্যে বসে একটু আরাম পেল কেড। গাড়ির ভেতরটা দিব্যি গরম বাইরের তুলনায়। হোটেলের দিকে গাড়ি চালাতে চালাতে বোম্যান্ বলল, ব্যাপারটা কী?

ব্যাপার আছে একটা। হোটেলে গিয়ে বলছি। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওরা হোটেলে পৌঁছে গেল। হোটেলের লবিতে পৌঁছতেই মোটাসোটা হাসিখুশী ম্যানেজার বোমাত্রে দিকে এগিয়ে এল।

হর্সট, তুমি তোমার বন্ধু আর মিঃ শেরম্যান পুলিশ কার্ড লেখাওনি।

ভুলে গিয়েছিলাম একদম। আমায় দাও আমি নিয়ে যাই ঘরে। তা ওকে কার্ডগুলো দিল। বসার ঘরে গিয়ে বোম্যান্ স্কির পোষাক খুলতে লাগল।

এবার বল। এত রহস্য করার দরকার নেই।

কেড জ্যাকেট খুলে ফায়ারপ্লেসের সামনে গিয়ে হাত পা আগুনে সেঁকতে লাগল।

কেড বলল, প্রায় বারোজন সশস্ত্র লোক বাড়িটার চারিদিকে টহল দিচ্ছে। অন্তত দুজনের কাছে অটোমেটিক রিভলবার আছে।

বোম্যানের মুখ হাঁ হয়ে গেল। ঠিক?

আমি বিশ মিনিট ধরে সব লক্ষ্য করেছি। একদম ঠিক বলছি।

কি ব্যাপার বলতো? কিন্তু পাহারা কেন?

কেড ঘাড় নাড়ল। ঠাণ্ডা কি রকম? ব্যারোমিটার কি বলছে?

বোম্যান্ উঠে টেলিফোনে আবহাওয়ার খবর নিল। তারপর বিরক্তিভরা স্বরে বলল, টেম্পারেচার উঠছে। কাল দিনটা ভাল হবে মনে হয়।

কেড বলল, বাড়িটার মুখোমুখি জঙ্গলের কিনারে একটা বড় অবোলা পাইন গাছ আছে। একমাত্র ওখান থেকেই আমি ছবি তুলতে পারি। তেতলায় একটা ঝুলন্ত বারান্দা আছে। কাল দিন ভালো হলে অ্যানিটা বারান্দায় আসতে পারে। এছাড়া তো ফটো তোলার আর কোন উপায় দেখি না। আমার একটা ছশো মিলিমিটার টেলিয়োকোর লেন্স দরকার। কোথা থেকে পাব?

সশস্ত্র পাহারা আছে বললে যে?

থাকুক। লেনসের কি করবে তাই ভাব।

একটু ভেবে নিয়ে বোম্যান ঘড়ি দেখল। রাত বারোটা বেজে কয়েক মিনিট হয়েছে।

কাল এনে দিতে পারি।

ভাল করে আলো ফোঁটার আগেই আমি ক্যামেরার সাজসরঞ্জাম নিয়ে গাছে উঠে পড়তে। চাই।

বোম্যান্ ভ্রূ কোঁচকাল। তারপর একটা নম্বর ডায়াল করল। একটু অপেক্ষা করে নিচু গলায় কাকে যেন কী বলল, কেড বারান্দার ছবি কী ভাবে তুলবে তার সুবিধে অসুবিধে ভাবতে লাগল। রোদ যদি চড়া হয় আর অ্যানিটা বারান্দায় বেরোয়, রোকোর লেন্স পেলে ও ভাল ক্লোজআপ নিতে পারবে। বোম্যান্ ফোন নামিয়ে বলল, আমি গ্রাডকে পাঠাচ্ছি। মর্যোঙ্গে আমার এক বন্ধুর ফটোর দোকান আছে। তার কাছে লেন্স আছে। গ্রাড তিন ঘন্টার মধ্যে নিয়ে আসতে পারবে।

গ্রাডের শোবার ঘরে গিয়ে ও গ্রাডকে টেনে ওঠাল। এখন মর্যোঙ্গে যেতে হবে বলে প্রচণ্ড গাল দিল গ্রাড। তারপর জামাকাপড় পরে একটু বাদেই ও বেরিয়ে গেল। কেড শোবার ঘর থেকে বসার ঘরে ক্যামেরার যন্ত্রপাতি এনে ওর মিনোটায় ফিম ভরতে লাগল।

দেখ বারো ঘণ্টা চালাতে পারি এই পরিমাণ স্যান্ডউইচ আমার দরকার। তাছাড়া কফি, আধ বোতল ব্র্যান্ডি, খানিকটা সরু দড়ি, তিন মিটার গিট বাঁধা দড়ি, একটা ভালো শিকারের ছুরি আর চড়াইয়ে ওঠার লোহার নাল চাই। গাছে ওঠা অত সহজ হবে না। তবে একবার উঠে পড়তে পারলে আমায় আর কেড দেখতে পাবে না।

বোম্যান্ মাথা নাড়ল। ওর মধ্যে প্রথম খুশির ভাব দেখল কেড।

 আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। আর কিছু চাই?

গাছে ওঠার পর আমার একা থাকাই ভাল। তবে নামবার সময় হুড়মুড় করে নামতে হবে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব কি ভাবে?

আমার একটা রেডিও আছে। তাতে কথা বলা যায়, শোনাও যায়। এটাই যোগাযোগ রাখার একমাত্র উপায়।

চমৎকার। তুমি আমার সঙ্গে পাঁচিল অবধি আসবে। যদি বরফ পড়া থেমে যায় তোমাদের নিজেদের পায়ের ছাপ মুছে ফেলতে হবে। তোমাকে আমার মালপত্র বইতেও সাহায্য করতে হবে। তারপর তুমি হোটেলে চলে আসতে পার।

পরদিন সকাল ছটার একটু বাদে কেড আর বোম্যান্ হোটেল থেকে বেরোল। গ্রাড ইতিমধ্যে রোকোর লেন্স নিয়ে এসেছে। মালপত্র সব একটা রুকস্যাকে ওরা ভরেছে। বরফ পরা এখন বন্ধ। চাঁদের রুপোলীআলোয় ভরে গেছেচারিদিকটা। তুষারকণা ঝরছে। তাপমাত্রা শূন্যের অনেক নীচে। পথ খুবই পিছল। শেরম্যানের সিমকা তখনো পথের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনে শেরম্যানকে সশস্ত্র সান্ত্রীদের পাহারা দেবার কথা বলল। শেরম্যান চমকে গেল, খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে ব্যাপার।

তাই দেখতেই যাচ্ছি। বোম্যান্ বলল, তুমি পাচিলের এপারে থাক। আমি যখন ফিরতে চাইব, তুমি আমায় দড়ি ছুঁড়ে দেবে।

বোম্যান্ পাঁচিলের কাছে গিয়ে কেডকে ঠেলে তুলল। শেরম্যান এবার বোম্যাকে ঠেলে তুলে দিল। দড়ির এক প্রান্তে রুকস্যাক, কেডের ক্যামেরার সরঞ্জাম আর শটওয়েভ রিসিভার সেটটা বেঁধে দিল শেরম্যান। বোম্যান্ সেগুলো টেনে তুলল। দুজনে পাঁচিল বেয়ে নেমে খুব সন্তর্পণে অন্ধকার জঙ্গল দিয়ে চলতে লাগল। কেড যেখানে পা ফেলল ওর পায়ের ছাপের ওপরই বোম্যান্ পা ফেলতে লাগল। শেষ অবধি কেড বলল, এখান থেকে দেখা যাবে।

গাছের ফাঁক দিয়ে বরফ ঢাকা লনটা দেখা গেল। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে লনটা। রাতে যে অরোলা পাইন গাছটা দেখেছিল সেটার কাছে খুব ধীর পায়ে কেড হাঁটতে লাগল। লনের দিকে ইঙ্গিত করে কেড বোম্যাকে বলল, দেখতে পাচ্ছ ওদের? সান্ত্রীদের দেখে বোম্যান জোরে নিঃশ্বাস টানল। কালো কালো নিশ্চল সব মূর্তি, হাতে রাইফেল, চোখ জঙ্গলের দিকে নজর রাখছে। কেড পিছিয়ে অন্ধকারে চলে এল। ও চড়াইয়ে ওঠার জন্য লোহার নাল জুতোয় আঁটতে লাগল। আঙুল একেবারে হিম হয়ে গেছে। বোম্যান্ জিজ্ঞেস করল, কি ছাই ওরা পাহারা দিচ্ছে?

কে বলল, তুমি ভাব গিয়ে। কেড পিঠে বাধা দড়িটা খুলে একটা মুড়ো সবচেয়ে নিচু ভালটায় বেঁধে অন্যমুভোর ফাসটা চেপে ধরে ও গাছের গুঁড়িতে জুতোর নীচে আঁটা লোহার নাল বিধিয়ে দিল। তারপর অনেক কষ্টে ও ওপরে উঠতে লাগল। তলার দিকে একটা ঘন ডালের ওপর উঠে ও মুখ বাড়িয়ে বোমাকে বলল, ঠিক আছে। জিনিসপত্রগুলো আমায় দিয়ে তুমি সরে পড় এখন। আর পায়ের ছাপগুলো মুছে ফেল।

বোম্যান অন্যান্য জিনিসপত্র দড়ির মাথায় বেঁধে দিল। কেড সেগুলো টেনে ওপরে না তোলা পর্যন্ত চেয়ে রইল বোম্যান। তারপর চাপা গলায় গুডলাক বলে অন্ধকারে মিশে গেল। একটা ফার গাছের ডাল ভেঙ্গে সযতে ওদের পায়ের ছাপ মুছে ফেলেছিল ও। কেড খুব সন্তর্পণে ওপরে চড়তে লাগল। অবশেষে গাছের প্রায় মগডালে উঠে ও দেখল, এখন উচ্চতা বড় বারান্দার সমান পৌঁছিয়েছে। এই বড় বারান্দার ঠিক নিচেই ঢাকবার বিশাল দরজা। হালকা তেপায়া টেবিলটার পায়াগুলোও গাছের ডালে বাঁধল। রুকস্যাকটা আরেকটা গাছে বাঁধল। এবার ও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে পারে। আধঘণ্টা চুপচাপ বসে ও শর্টওয়েভ রিসিভারের সুইচ টিপে বোম্যাকে ডাকল। বোম্যান সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিল, শুনছি।

আমি অপেক্ষা করছি। আমি প্রস্তুত। লাইন কেটে দিল কেড। কেড গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে চোখ বুজল। এখন চারঘণ্টা অন্ততপক্ষে কিছু করার নেই। বেলা এগারটা হতে না হতে রোদ এমন চড়ে গেল যে কেড ওর গায়ের ভারী জ্যাকেটটা খুলে ফেলল। এরমধ্যে কয়েকটা স্যান্ডউইচ আর ব্র্যান্ডি মেশানো কফি খেয়ে নিয়েছে ও। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতে সান্ত্রীদের বেশ পরিষ্কার দেখতে পেল কেড। নজন সান্ত্রী। বিশাল জোয়ান চেহারা লোকগুলোর। এদের গায়ে কালো বর্ষাতি পায়ে রবারের বুট, মুখে কালো প্লাস্টিকের মুখোশ।

কেড ওর ছশো মিলিমিটার লেন্স দিয়ে দেখতে দেখতে ভাবল এমন গুণ্ডা চেহারার লোজন ও কখনো দেখেনি। রোদ বাড়তে ওদের ছজন প্রাসাদে ঢুকে গেল। আরো তিনজন টহল দিতেই লাগল। এরা খুবই হুঁশিয়ার আর সতর্ক।

সকাল দশটা নাগাদ বারান্দা ও বাড়ির মাঝের দরজাগুলো খুলে গেল। কানাকা উলের টুপি আর পুরোনো একটা ওভারকোট পরা এক বৃদ্ধ বেরিয়ে এল। ওর হাতে লম্বা হাতল দেওয়া, ঝাড় বারান্দা থেকে বরফ ঝেটিয়ে পরিষ্কার করতে লাগল সে। তারপর বারান্দার ওপর চারটে আরাম কেদারা পেতে দিল আর সামনে একটা কাঠের টেবিল পাতল। এবার কেডের একটু ভরসা হল। একটা চেয়ারের ওপরে ও ওর ক্যামেরার মুখ ঘোরাল। খুবই স্পষ্ট ছবি উঠবে নিশ্চিত হয়ে কেড লেসে ঢাকা পরিয়ে একটা সিগারেট ধরাল। দশটা থেকে এগারটার মধ্যে চারিদিক যখন নিশ্চপ তখনই ওর গাছের নীচে দুজনকে জার্মান ভাষায় কথা বলতে শুনল। ডালপালার ফাঁক দিয়ে নীচে ওদের দেখা অসম্ভব। বেজায় ভয় পেল কেড, কিন্তু ওদের দেখতে পেল না বলে বিরক্তিতে তার মন ভরে গেল। সূর্য যখন মাঝখানে হঠাৎ বারান্দায় খানিকটা প্রাণচাঞ্চল্যও দেখা গেল। দরজা খুলে হঠাৎ বারান্দায় বেরিয়ে এল অ্যানিটা স্ট্রেলিক। টেলিস্কোপিক লেনস দিয়ে ও অ্যানিটা স্ট্রেলিককে খুব মন দিয়ে দেখতে লাগল। অ্যানিটার পরনে আঁটো টুকটুকে লাল প্যান্ট আর সাদা সোয়েটার। ওর ছোট ছোট কোকড়া চুলের রুপোলি গুচ্ছো রোদে ঝলমল করছে। একটু পিছু হেলে হাঁটুর ওপর হাত রেখে কেড অ্যানিটাকে দেখতে লাগল। অ্যানিটা একটা চেয়ারে। বসে এক প্যাকেট সিগারেট আর লাইটার বের করল। যখন ও সিগারেট ধরাচ্ছে তখন একটি লোক বারান্দায় বেরিয়ে ওর কাছে এল। লোকটির পরনে কালো স্কি-প্যান্ট, কালো গোলগলা সোয়েটার। লোকটা মাঝারি রকম লম্বা, ধূসর চুল ছোট ছোট করে কাটা, চৌকো কাঁধ, হাঁটা চলা উদ্দীপ্ত সৈনিক সুলভ। লোকটার দিকে পলকহীন চোখে কেড তাকিয়ে রইল। লোকটা অ্যানিটার কাছে গেল, অ্যানিটা হাত তুলল, হাসল। লোকটা অ্যানিটার হাতের আঙ্গুলে চুমো খেল। কেড নিজের অজান্তেই যেন অন্তর থেকে নির্দেশ পেয়ে শাটার টিপল। এক নম্বর ছবি তোলা হল। লোকটাকে কেড দেখতেই থাকল, দেখতেই থাকল। কোথায় যেন দেখেছে ওকে, অসম্ভব চেনা লাগছে। কোন বিখ্যাত ব্যক্তি সন্দেহ নেই। এবার উত্তেজনায় কেড প্রায় পাগল হয়ে যেতে বসল। কেড চিনতে পেরেছে এই বিখ্যাত ব্যক্তিটিকে। কেড ওর রোদেপোড়া মুখ লেসে ফোকাস করল লেন্স জুড়ে। দুবছর আগের কথা। কেড তখন পূর্ব বার্লিনে। ডেইলি টেলিগ্রাফের সাপ্তাহিকীর জন্য কতগুলো ছবি তুলছে। ওর মনে পড়ল কিভাবে পূর্বজাৰ্মানীর সিক্রেট পুলিশের সর্বময় কর্তা জেনারেল এরিখ হার্ডেনবুর্গের আসবার আশায় ও তিনটি ক্লান্তিকর ঘণ্টা অপেক্ষা করছিল। তারপর জেনারেল যখন এলেন জ্বলন্ত চোখে কেডের দিকে তাকালেন, কিছুতেই ছবি তোলার অনুমতি দিলেন না, ওর মনে আছে। সেই হার্ডেনবুর্গ এখানে! হিটফলারের পরে সবচেয়ে বিপজ্জনক, ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর জামান। টেলিস্কোপিক লেসের মধ্য দিয়ে দেখতে দেখতে ভয়ের একটা তুষার শীতল স্রোত কেডের পিঠের শিরদাঁড়া দিয়ে নামতে লাগল। হার্ডেনবুর্গ! এখানে অ্যানিটা স্ট্রেলিকের সঙ্গে। এমন চমকপ্রদ খবর পৃথিবীতে আর বুঝি হয়নি। ব্র্যাডেফ সত্যিই অসাধারণ। ব্র্যাডেফ ঠিকই বুঝেছিল। সেইজন্যই প্রাসাদ ঘিরে এত সশস্ত্র সান্ত্রী। ওরা হার্ডেনবুর্গের গুপ্ত পুলিশবাহিনীর লোক। সেই বিখ্যাত গুপ্তবাহিনী। কেড সভয়ে ওদের দেখল। কেড বুঝল সারা জীবনে সে এর থেকে বেশী বিপজ্জনক কাজ আর করেনি। ওই লোকগুলি যদি ওকে দেখে তাহলে কুকুরের মতন গুলি করবে। একটি প্রশ্ন করবে না। আবার ও বারান্দার দিকে তাকাল। সেই বৃদ্ধ লোকটি একটা খাবার বোঝাই ট্রে আর রুপোর কফি পট এনে টেবিলে রেখে চলে গেল। অ্যানিটা আর হার্ডেনবুর্গ খুবই নিবিষ্ট মনে কথা বলছে। হার্ডেনবুর্গ উঠে কফি ঢালতে লাগল। কেড একটার পর একটা ছবি তুলতে লাগল। এই উজ্জ্বল রোদে ছবি যে খুব ভাল আসবে ও বুঝতে পারছিল।

হঠাৎ দরজাগুলো সপাটে খুলে গেল। দুটো লোক বেরিয়ে এল বারান্দায়। একটি লম্বা হাড় বের করা শক্ত কঠিন চেহারা। হার্ডেনবুর্গের মতন পরনে স্কি-পোষাক। সে একটি হুইলচেয়ার ঠেলছে তাতে একটি বুড়ো, মোটা লোক বসে আছে।

কেড দেখেই চিনল লম্বা লোকটা হচ্ছে হার্ডেনবুর্গের ডান হাত হাৰ্মান লিয়েভন। কিন্তু বৃদ্ধটির দিকে কেড চেয়েই রইল। লম্বা লেন্সটা দিয়ে দেখতে দেখতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিস্ময় যেন ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। কেড স্থির জানত বোরিস ডুসলওস্কির মত দেখতে আরেকটা লোক এই পৃথিবীতে নেই। সেই স্কুল, মাংসল মুখ, মুখে বর্বর নিষ্ঠুরতা। এখন বুড়ো হয়ে গিয়েছে। তবু মুখের সেই ঔদ্ধত্য ব্যঙ্গ ভাব যায়নি। একসময় ও স্তালিনের পুলিশের সর্বময় কর্তা ছিল। ইহুদীরা ওর ভয়ে কাঁপত। বেসেনের সেই জানোয়ারটার মতনই ওর নাম সারা পৃথিবীতে ঘৃণা ও আতঙ্ক জাগিয়ে তুলেছিল। কেড বুঝল ও একটা ঐতিহাসিক ঘটনা দেখছে। এই নিষ্ঠুর, নির্মম লোকগুলোর সঙ্গে এক বিশ্ববিখ্যাত চিত্রতারকার যোগাযোগ। এ যে পৃথিবী কাঁপানো খবর। পূর্ব বার্লিনের হর্তাকর্তা, রুশ সরকারের তথাকথিত এক মিত্রের সঙ্গে বর্তমান রুশ সরকারের এক প্রধানতম শত্রর গোপন আঁতাত!!! উত্তেজনা আর বিস্ময় যত চরমেই উঠুক কেড ঠিক একটার পর একটা ছবি তুলে যেতে লাগল।

হার্ডেনবুর্গ আর ডুসলওস্কি টেবিলে এসে বসেছে। লিয়েভন ভেতরে চলে গিয়েছিল। এখন ও একটা ব্যাগ বোঝাই কাগজ নিয়ে টেবিলে রাখল। অ্যানিটা উঠে হার্ডেনবুর্গের পেছনে দাঁড়িয়ে অভ্যস্ত সম্পর্কের স্বচ্ছন্দতায় ওর কাঁধে হাত রাখল। হার্ডেনবুর্গ ব্যাগ থেকে একটা ম্যাপ বের করে টেবিলে বিছিয়ে রাখল। কেডের লেনটা এত শক্তিশালী যে ও ম্যাপটার খুঁটিনাটি পর্যন্ত দেখতে পেল। ম্যাপটা পশ্চিম বার্লিনের। হঠাৎ কেড দেখল ও এক রোল ফিল্ম খরচ করে ফেলেছে। আবার ক্যামেরায় ফিল্ম ভরল ও।

দুজনে খুব মনোযোগ দিয়ে ম্যাপটা দেখছে আর কথা বলছে। কেড ক্যামেরার শাটার টিপতেই লাগল। ও বুঝেছিল এক ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে ও দাঁড়িয়ে আছে। যে ছবিগুলো কেড তুলছে পয়সা দিয়ে তার মূল্যায়ণ হয় না। এ ছবি হুইসপারের থেকে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এ ছবি এখনি সেক্রেটারি অফ স্টেটের হাতে পৌঁছান দরকার। তিনি দেখার আগে এ ছবি আর কারও দেখা উচিৎ নয়। এ ছবির জোরে আমেরিকা রাশিয়ার সঙ্গে কিনা করতে পারে। এ বোঝার রাজনৈতিক জ্ঞান কেডের আছে। কেডের দ্বিতীয় রোলটাও ফুরিয়ে গেল। বাহাত্তরটা ছবি তুলেছে কেড, একেকটা বারুদের গোলা। এখন ওর একমাত্র চিন্তা কি করে এখান থেকে পালিয়ে হোটেলে পৌঁছান যায় আর জেনেভায় আমেরিকান রাষ্ট্র প্রতিনিধির হাতে ফটোগুলি তুলে দেওয়া যায়। এবার ও টের পেল ওর হাত কাঁপছে। তাড়াতাড়ি ব্রান্ডির বোতলটা নিয়ে চুমুক দিতেই বিপত্তি। বোতলটা কেডের আড়ষ্ট জমে যাওয়া আঙুল থেকে পিছলে গিয়ে গাছের তলায় বরফের উপর পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে ঠাণ্ডা মেরে গেল কেড। আতঙ্কে তার হৃদপিণ্ডটা লাফালাফি করতে শুরু করল। যদি কোন সান্ত্রী এখান দিয়ে যায়, সব শেষ তাহলে। তাড়াতাড়ি শর্টওয়েভ রিসিভারের সুইশ টিপল ও। বোম্যান্? অস্থির ভাবে কেড বলল, না শেরম্যান বলছি, বল কি ব্যাপার। আমার প্রয়োজনীয় ছবি সব তুলে নিয়েছি। এখন দরকার এখান থেকে সরে পড়া।

অন্ধকার না হলে তুমি বেরোতে পারবে না। একঘণ্টা আগে আমি ওখান থেকে গাড়ি চালিয়ে গিয়েছি। গেটে দাঁড়িয়ে দুটো লোক পাঁচিলের ওপর নজর রেখেছে। অন্ধকার না হওয়া অবধি তোমাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আমার হাতে এখন ডিনামাইট।

কিছু করা যাবে না। তোমাকে সবুর করতেই হবে।

ঠিক আছে, হাল ছেড়ে দিল কেড। বারান্দার দিকে আবার তাকাল। মিটিং শেষ। হার্ডেনবুর্গ ডুসলওস্কির চেয়ার ঠেলে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। পেছন পেছন অ্যানিটা যাচ্ছে। ওর হাতে কাগজভর্তি ব্যাগ। দরজাগুলো বন্ধ হয়ে গেল, এবার বারান্দা খালি। কেড ক্যামেরা খুলে সযত্নে ওর রুকস্যাকে ভরল। তেপায়া টেবিলটা তুলে ভাঁজ করে ব্যাগে রাখল। আমেরিকান রাষ্ট্রপ্রতিনিধি এই ছবিগুলো নিয়ে কি করবেন কেড তা ভাবছে না। এই ছবিগুলো তার কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সম্পর্কে ও নিশ্চিত, ওকে এটা করতেই হবে। গাছের ডালে হেলান দিয়ে ও অন্ধকার হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

সোওয়া পাঁচটার একটু পরে বরফ পড়তে আরম্ভ করল, ঠাণ্ডা সাংঘাতিক বেড়ে গেল। অচিরেই গভীর অন্ধকার নেমে এল চারিদিকে। প্রাসাদটা অন্ধকারের সঙ্গে মিশে গেল শুধু তিন চারটি আলোকিত জানলা অন্ধকারের মধ্যে ফুটে রইল। কেড সান্ত্রীদের দেখতে পাচ্ছিল। ওরা সমানে টহল দিচ্ছে, এ ওর সাথে কথা বলছে। যখন অন্ধকার আরও ঘন হল কেড শর্টওয়েভ রিসিভারের সুইচ টিপল।

বোম্যান?

 আছি। ঠিক আছে আমরা যাচ্ছি। যে জায়গাটা দিয়ে ঢুকেছিলাম খুঁজে পাবে?

চেষ্টা করব। খুবই শক্ত অবশ্য।

 কিছু হল?

দুর্দান্ত সাংঘাতিক ব্যাপার। পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম সংবাদ। যখন এখানে পৌঁছবে হেডলাইট জ্বালিও। তা দেখে আমি পথ চিনে নেব।

বৃহত্তম-সংবাদ মানে?

সময় নষ্ট করছ। আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। কেড সুইচ বন্ধ করল।

কেড সাবধানে নামতে লাগল। সারা শরীরে ব্যথা, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বহু কষ্টে শেষ অবধি ও বরফের ওপর নামল। মালপত্র তুলে নিয়ে কান পাতল। বাতাসে কান্নার মতন আওয়াজ, গাছপালার মর্মর ধ্বনি এ ছাড়া আর কিছু শুনতে পেল না ও। যে পাঁচিল দিয়ে ও নেমেছে সেটা কোথায় আবছা বুঝতে পারছে। সেদিকে সন্তর্পনে এগোতে লাগল ও।

মালের বোঝা দুঃসহ রকমের ভারি লাগছে কেডের। হঠাৎ ওর পা কিসে যেন বাধল। হোঁচট খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে গেল কেড। বরফে ওর নাক মুখ ডুবে গেল, প্রথমে খুবই ভয় পেয়েছিল। এবার হাঁটু আর হাতে ভর দিয়ে কেড উঠে পড়ল। চারিদিকে একটু নরম আলো। এবার পেছন দিকে চাইতেই চুল খাড়া হয়ে গেল কেডের। আতঙ্কে তার হৃদস্পন্দন প্রায় থেমেই গেল। সমস্ত প্রাসাদটায় ঝলমলে আলো জ্বলে উঠল। এক দীর্ঘ নিশ্বাস বন্ধ করা মুহূর্ত। তারপরই ঘোর অন্ধকারে কেডকে ডুবিয়ে দিয়ে সব আলো নিভে গেল। একটা তীক্ষ্ণ, তীব্র ঘণ্টা বাজছে।

কেড বুঝছে ও তারে হোঁচট খেয়েছে এবং তাই অ্যালার্ম বাজছে। সর্বনাশ, এমন আতঙ্ক জীবনেও আর ওর হয়নি। ও যদি কোনরকমে সান্ত্রীরা এখানে আসার আগে পাঁচিলটার কাছে পৌঁছতে পারে। শর্টওয়ভ রিসিভারটা ও ফেলে দিল। তারপর রুকস্যাকটা আঁকড়ে ধরে অন্ধকারে গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে ও অন্ধের মতন ছুটল। হঠাৎ কেড দেখল ওর ডানদিকে পনের মিটার দূরে টর্চ জ্বলল এবং নিভল।

কেড থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে এদিকে কান পাতল। ঝোঁপের মধ্যে খসখসে শব্দ। রুকস্যাকটা ওর হাত পিছলে হরকে গিয়ে পড়ল। বুক ধড়াস ধড়াস করছে। হঠাৎ একটা টর্চের আলো ওর ওপর এসে পড়ল। একটা সান্ত্রী চমকিত বিস্ময়ে অস্ফুট আর্তনাদ করল। তারপরেই কেড ওর পা ধরবে বলে সান্ত্ৰীটার উরুতে গিয়ে ধাক্কা খেল। দুজনেই বরফে পড়ে গেল। ভয়ে দিশেহারার মতন কেড অদৃশ্য মুখটাকে এলোপাথারি ঘুসি ছুঁড়ে আঁচড়াতে লাগল। সান্ত্ৰীটা একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। প্রথমে খানিক চমকে গিয়ে ওর সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে কেডের আনাড়ি হাত সবেগে সরিয়ে কেডকে একেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কেড হাঁচড় পাঁচড় করে উঠবার চেষ্টা করতেই ও কেডের ওপর আবার এসে পড়ল। কেডের শাসনালীতে ওর ইস্পাতের মত আঙ্গুলগুলো চেপে বসেছে। কেড বুঝল ও এখনি মরবে। হঠাৎ ওর কোমরের বেলটে শিকারীদের ছুরির কথা মনে পড়ল। ও কোনরকম হাতড়ে ছুরিটা বার করে সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুরিটা গেঁথে দিল। সাম্ৰীটার জামাকাপড় ভেদ করে শরীরে ঢুকে গেল ছুরিটা, কেডের হাতে কাঁপুনি আর ধাক্কা উঠে এল। হাতটা যেন অসাড় হয়ে গেল। একটু নিশ্বাসের জন্য আকুল কেড গড়িয়ে সরে এল। তার পর উঠে দাঁড়াল। কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে কাছেই। সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল ওর থেকে দশ মিটার দূরে পাঁচিলটার গা দিয়ে আলো ঝলকে উঠল। ছুরিটা আঁকড়ে ধরে পাগলের মতন কেভ সেদিকে ছুটল। ঘড়ঘড় করে নিশ্বাস পড়ছে। হৃদপিণ্ডটা ফেটে যায় আর কি।

কেড? বোম্যানের গলা।

কেডের গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ বেরোল। হঠাৎ ওর পিঠের ওপর সপাৎ করে কি পড়ল। দড়ির মুড়ো। ওদিকে জঙ্গল হড়মুড় করে সব ছুটছে কেড টের পেল। এই ঠাণ্ডায় ও ভয়ে ঘামতে লাগল। পেছন ফিরে দেখল প্রায় বারোটা টর্চ জ্বলছে, চমকাচ্ছে। দড়িটা আঁকড়ে ও ছুরিটা ফেলে দিল তারপর দেয়ালে পা ঠেকিয়ে পাঁচিলের ওপরে উঠল। পাঁচিলের ওপর দিয়ে ক পা হেঁটে বোম্যান্ যেখানে দাঁড়িয়েছিল তার কাছাকাছি বরফের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কেড। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে ও বোমাকে বলল, চল জলদি। ওরা আমাকে তাড়া করেছে। কেড যে ভীষণ ভয় পেয়েছে তা বোঝার মন বুদ্ধি ব্যেম্যাত্রে আছে। ও কেডকে জাপটে ধরে ঠিক করে দাঁড় করিয়ে দিল তারপর অর্ধেক ঠেলে, অর্ধেক টেনে কেডকে ওর জাগুয়ারে তুলল।

গাড়িটা যখন চলছে, ক্লান্ত বিধবস্ত কেড ঘড় ঘড় করে নিশ্বাস টানতে লাগল। বোম্যান্ বলল, কি হয়েছে কি?

কেডের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। সান্ত্ৰীটার শরীরে ওর ছুরিটা গেথে যাচ্ছে এই দৃশ্যটাই চোখের উপর ভাসছিল কেডের। সান্ত্রীটা মরে যায় নি তো?

কেড?

কেড কোনমতে বলল, কথা বল না, চালাও।

 মরিয়া হয়ে গাড়ি চালিয়ে দশ মিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেল বোম্যান।

কেড হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, সদর দরজা দিয়ে আমাকে নিয়ে যেও না! আমার সারা শরীরে রক্ত। উজবুক কোথাকার।

বোম্যান গলা চড়িয়ে বলল, কি হয়েছেটা কি?

আমায় উপরে নিয়ে চল।

বোম্যান্ গাল পাড়ল। তারপর কেডকে শক্ত করে ধরে হোটেলের পেছন দিকে নিয়ে গেল। সার্ভিস লেখা লিফট দিয়ে ওরা তেতালায় উঠল। কেডকে আঁকড়ে ধরে বোম্যান্ বসার ঘরে নিয়ে এল। শেরম্যান অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। গ্রাড বিরক্তিভরা মুখ নিয়ে চেয়ারে বসেছিল। কেডকে দেখে লাফিয়ে উঠে বলল, কেডের গা দিয়ে রক্ত ঝরছে। শেরম্যান হাঁ করে কেডকে দেখছিল। রক্তে মাখামাখি জ্যাকেটটা গা থেকে খুলে ফেলল কেড। রেগে আগুন হয়ে ও বোম্যাকে বলল, জাহান্নামে যাও তুমি। মদ দাও আমাকে। মদ দাও শিগগির।

বোম্যান ঘাবড়ে গিয়ে মদ ঢালল।

 নির্জলা হুইস্কি গলায় ঢেলে কেড বলল, ধ্বস্তাধস্তির সময় একজন সান্ত্রীকে আমায় ছুরি মারতে

ওরা তিনজনে হাঁ করে কেডের দিকে তাকিয়ে রইলো তারপর বোম্যান্ চেঁচিয়ে বলল, হা ভগবান….তুমি ওকে খুন করেছ?

কেড রুমাল দিয়ে ওর রক্তমাখা আঙ্গুল পরিষ্কার করল। তারপর বলল, ওকে ছুরি না মারলে ও মেরে ফেলত আমায়। বোম্যান্ চল, দেরী কোর না। আমেরিকান কনসালের কাছে এ ছবি পৌঁছাতে হবে। এ একেবারে ডিনামাইট চল, আমাদের জেনেভা যেতে হবে এক্ষুনি।

বোম্যান্ চেঁচিয়ে উঠল, আরে উজবুক কি ব্যাপার আমি কিছু এখনো জানিইনা। বল আমাকে।

 দুঃখিত কেড বলল। ব্যাপার বিরাট। বিরাটতম। জেনারেল হার্ডেনবুর্গ আর বোরিস ডুসলওস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎকার হচ্ছিল। আমার কাছে ওদের ছবি আছে। বোম্যান্ অবিশ্বাসী চোখে কেডের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবল কেভ বোধ হয় পাগল হয়ে গিয়েছে।

ডুসলওস্কি? কি বলছ তুমি যা–তা। দশবছর আগে ডুসলওস্কি আত্মহত্যা করেছে।

আমিও তাই জানতম। কিন্তু ও বেঁচে আছে। তাই জন্যই তো ওরা এত সান্ত্রী রেখেছে। ওরা সবাই হার্ডেনবুর্গের লোক।

আরে নেশা হয়ে গেছে নাকি তোমার? কি বলছ তুমি?

টেবিলে ঘুষি মেরে কেড বলল, ডুসলওস্কি বেঁচে আছে। আমার কাছে ওদের ছবি আছে।

বোম্যান্ কেডের সাদা রক্তশূন্য মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ও কেডের চোখ দেখে বুঝল কেড সত্যি কথা বলছে।

তা যদি হয়, আমায় ফিল্মগুলো দাও। আমি এস বিকে পাঠিয়ে দিই।

কেড মাথা নাড়াল।

না এ ছবি এত গুরুত্বপূর্ণ যে ব্র্যাডেফকে দেওয়া যাবে না, এগুলো এক্ষুনি আমেরিকান কনসালের হাতে দিতে হবে।

বোম্যানের মুখ কঠিন হয়ে গেল।

তোমার কনট্রাক্ট এস. বির সঙ্গে। তুমি যে ছবিই তুলে থাক, তা এস. বির সম্পত্তি। আমাকে দাও ছবিগুলো।

কনসাল ছাড়া আর কেড এ ছবি পাবেনা, বোম্যান্।

বোম্যানের মুখ রাগে অন্ধকার হয়ে গেল।

একটা মাতালের সঙ্গে কাজ করতে গেলে এই-ই হয়। ও এবার রাগে ফেটে পড়ল। শেরম্যানকে বলল, তুমি কি ওর সঙ্গে একমত নাকি?

মোটেই না। এসবিকে ফোটো দিতে হবে। ও ফোটো নিয়ে যা করবে ওর ব্যাপার।

সেই কথা। ছবিগুলো আমায় দাও। আমরা তিনজন তুমি একলা। দরকার হলে আমরা জোর খাটাব।

কেড ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল। সত্যি তার যদি আর একটু সাহস থাকত, মদ যদি ওকে এভাবে শেষ না করত। তবুও ভয় পেলেও কোথা থেকে একটা শক্তি পেল কেড। এই ফিলমগুলো এই গুণ্ডাটার হাতে কিছুতেই দেওয়া চলবে না।

কেড কাঁচের ছাইদানীটা তুলে নিল।

 যদি জোর কর জানলা দিয়ে এটা ছুঁড়ব।

বোম্যান অবজ্ঞার হাসি হাসল। দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছে জানলা ভাঙ্গলে তাতে কি এসে যায়। দাও কেড, ফিল্মগুলো আমাকে দাও। তুমি নিশ্চয়ই অতটা মাতাল হওনি। দাও।

শেরম্যান আর গ্রাড কেড়ের দিকে এগোতে লাগল। হঠাৎ দরজায় জোরে ধাক্কা মারল। তিনজনেই থমকে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

বোমাত্রে দুচোখে ভয়, কে?

পুলিশ। দরজা খুলুন। ধমকে কে বলল।

কেড পেছোতেই লাগল, পেছোতেই লাগল। ওর শোবার ঘরের দরজাটা খুলে গেল দুম করে। সুইস পুলিশের ছাইরঙা ইউনিফর্ম পরে একজন দীর্ঘ, বলিস্ট দেহ লোক ঘরে ঢুকল।

যে যেখানে আছে তেমন দাঁড়িয়ে থাক। বন্দুকের বাঁটে হাত দিয়ে ও বলল।

পুলিশটার পেছনে কালো বর্ষাতি আর কালো টুপি পরে একটা বেঁটে জোয়ান লোক ঢুকেছিল। সে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে দিল। আরো দুজন লোক ঘরে ঢুকল। কেড দেখেই চিনল, ওরা হার্ডেনবুর্গের লোক।

বোম্যান্ সুইস পুলিশটিকে তড়পে বলল, এ সবের মানে কী?

আপনাদের পাসপোর্ট? আপনারা এ হোটেলে নাম রেজিস্ট্রি করাননি। সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ।

 স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল বোম্যান্।

ও, দুঃখিত। আমরা ব্যস্ত ছিলাম। এই যে আমার পাসপোর্ট। আমার সঙ্গীদের পাসপোর্ট ওদের কাছে। কেড সবই লক্ষ্য করছিল। সে এই ভাওতায় ভুলল না। হার্ডেনবুর্গের লোক যখন এখানে আছে, তখন ওদের গ্রেপ্তার করে খানাতল্লাসী হবেই।

শেরম্যান আর গ্রাড দুজনেই পাসপোর্ট দেখাল। কেড গলাটা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, আমার শোবার ঘর থেকে পাসপোর্ট নিয়ে আসছি। শোবার ঘরের দিকে ও আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। শরীর ভয়ে আড়ষ্ট, বুক ধড়পড় করছে।

পুলিশটা হঠাৎ চেঁচিয়ে বলল, এই দাঁড়াও। শরীর ভয়ে কুঁকড়ে গেছে তবু কেড এগোতেই লাগলো। পেছনে পায়ের শব্দ, কোনমতে দরজাটার পাল্লা ধরে ও সান্ত্রী দুটোর মুখের ওপর আছড়ে বন্ধ করল। একজন কাধ ঢুকিয়ে দিয়েছিল, কেড ঠেলে সরিয়ে দরজায় চাবি দিয়ে দিল। তারপর একলাফে ঘর টপকে ও ঢাকা বারান্দার দরজাটা খুলল। তারপর দরজার পাল্লা টেনে নিয়ে পেছনে লুকোল। দরজা আর দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় ও দাঁড়িয়ে থাকল। বসার ঘরের দরজা ধড়াস করে খুলে গেল, লোকটা ভাগল। জলদি। কে যেন চেঁচিয়ে উঠল।

দুটো লোক বারান্দায় ছুটে বেরিয়ে এসে লিফটের দিকে ছুটল। কেড স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বাইরের ঘরে পুলিশটা বলছে, তোমাদের গ্রেপ্তার করা হল।

বোম্যান উত্তেজিত হয়ে প্রতিবাদ করল। খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তির আওয়াজ। তারপর বোম্যান্ বলল, ঠিক আছে, আমরা যাচ্ছি।

তারপর পুলিশটা আর দুজন সান্ত্রী বোম্যান্, গ্রাড আর শেরম্যানের সঙ্গে খোলা দরজা পেরিয়ে ঢাকা বারান্দা দিয়ে চলে গেল। দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কেড ওদের জুতোর মচমচ শব্দ শুনল। লিফট নীচে নেমে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করল কেড। তারপর একটা গরম কোট গায়ে গলিয়ে দরজার দিকে ছুটে গেল। দরজা খুলে ঝুল বারান্দায় এসে ও দরজাটা বন্ধ করল।

কম্পাউন্ডে তিনটে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। পাশে দুজন সুইস পুলিশ। কেডেরনীচেই আরেকটা ঝুলবারান্দা। কেড রেলিং টপকে নীচের বারান্দায় লাফিয়ে পড়ল। ঝুলবারান্দা থেকে ঘরে ঢোকার দরজার পেছনে অন্ধকার। দরজা খুলে অন্ধকার ঘরে ও ঢুকে পড়ল। তারপর দরজার পর্দা টেনে হাতড়ে হাতড়ে সুইচ খুঁজে বের করে টিপল ও। আলোতে দেখল সামনেই বিছানা। একটি মেয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করছে। দেখেই রক্ত জমে গেল কেডের। কেড মেয়েটি চেঁচাবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর মুখ চাপা দিল। মেয়েটি ওকে সরাবার চেষ্টা করল। কেড মরিয়া হয়ে ফিসফিস করে বলল, ভয় পেওনা। চেঁচিও না। আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না।

মেয়েটি কেডের অস্বাভাবিক দৃষ্টি দেখে বুঝল কেড খুবই ভয় পেয়েছে। ও আস্তে করে কেডের হাতটা ওর মুখ থেকে সরাল।

কি হয়েছে বলুন তো?

মেয়েটির শান্ত কণ্ঠস্বর কেডকে খানিক আশ্বস্ত করল। মেয়েটি বলল, তুমি আমায় প্রায় পিষে ফেলেছ।

কেড তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল, বলল দুঃখিত।

 মেয়েটি বলল, ভয়ে আমার প্রাণ প্রায় উড়ে গিয়েছিল।

কেড বলল তোমার থেকে আমি অনেক বেশী ভয় পেয়েছিলাম। আচ্ছা তোমার কাছে একটু মদ আছে?

মেয়েটি ওর দিকে তাকিয়েই রইল। তারপর বলল, আচ্ছা, তুমি ভ্যাল কেড, না? আমি নিশ্চিত তুমি কেড।

হ্যাঁ, আমি কেড। কি করে জানলে?

 সম্ভবতঃ আমি তোমার সবচাইতে বড় ভক্ত।

কেড ধপ্ করে ইজিচেয়ারে বসে পড়ল। এত স্নায়ুর চাপ তার সহ্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। ও নিজের হাতের দিকে তাকাল। যেন রক্ত লেগে আছে ওতে। কেড মুখ ঢাকল।

মেয়েটা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছে ততক্ষণে। কেডের হাতে একটা গ্লাস গুঁজে দিয়ে বলল, খেয়ে নাও এটা।

কেড প্রায় অচৈতন্যের ঘোরের মধ্যে ছিল। ইস্কির ঝাজে ওর চেতনা ফিরে এল। চো চো করে এক ঢোকে হুইস্কি শেষ করতেই গ্লাসটা ওর হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল।

মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, এবার বলবে ব্যাপারটা কী?

 মেয়েটির স্থির শান্তভাব দেখে কেড অবাক হয়ে গেল।

 তুমি কে?

মেয়েটি বলল, আমি? আমার নাম জিনেৎ দু প্ৰা। আমি ফরাসী। মর্যোয়ে একটা ট্রাভেস্তাল এজেন্সীতে কাজ করি। ছুটি কাটাতে এখানে এসেছি।

তোমার গাড়ি আছে?

হ্যাঁ, নীচের গ্যারেজে…ভক্সওয়াগন।

 দেখ, আমাকে জেনিভায় যেতেই হবে, কেড মরিয়া হয়ে বলল।

এখনি যেতে হবে?

হা।

কিন্তু আমার তো গাড়ির দরকার হবে। চল আমি তোমায় জেনিভায় নিয়ে যাচ্ছি।

কেড বলল, দেখ তোমাকে আমি এ ব্যাপারে জড়াতে চাই না। আন্তর্জাতিক গুরুত্বের ব্যাপার এটা। তোমার প্রাণ সংশয় হতে পারে।

মেয়েটির চোখ জ্বলে উঠল। তুমি কোন ছবি তুলেছ? তাই এত গোলমাল।

কেড বলল, হ্যাঁ।

তাহলে আমি তোমাকে সাহায্য করবই। আমি এখনই রেডি হয়ে নিচ্ছি। মেয়েটি জামাকাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল।

কেড এখনও ঠিক ধাতস্থ হয়নি। সে গ্লাসে আরও. ইস্কি ঢালল। তারপর এক চুমুকে গ্লাস শেষকরে আলো নিভিয়ে দরজা খুলে ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ওর ঠিকনীচেই একদল লোক। চারজনের পরনে সুইস পুলিশের পোষাক, বাকি দুজন হার্ডেনবুর্গের লোক। একটা পুলিশ মাইক্রোফোনে কথা বলছে। ও পালিয়ে যেতে পারে, আমরা সারা হোটেলে তল্লাসী চালাচ্ছি। শহরের ওপর নীচের সব রাস্তা বন্ধ কর। বেশী দূর পালাতে পারবে না, নজর রাখ, লোকটা বিপজ্জনক।

কেড তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এল। ওর আগেই বোঝা উচিৎ ছিল এত সহজ হবে না। কেড বিভ্রান্তের মতন দাঁড়িয়ে রইল। এখন কী করবে ও? জিনেৎ এই সময় প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে এল।

আমার হয়ে গেছে। শুধু পেছনের জীপটা…

কেড বলল, নীচে পুলিশ। ওরা সব রাস্তা করে দিয়েছে।

পুলিশ।

 এই সময় দরজায় ধাক্কা পড়ল।

.

০৯.

আবার দরজায় ধাক্কা পড়ল। কেভ আর মেয়েটি পরস্পরের দিকে তাকাল। পাগলের মতন কেড একটা লুকোবার জায়গা খুজছিল। ফিলমের রোলদুটো ও প্যান্টের পকেটে আঁকড়ে ধরল।

বাথরুম। মেয়েটি ফিসফিস করে বাথরুমের দিকে আঙ্গুল দেখাল। তারপর গলা তুলে বলল, কে?

পুলিশ

কেড বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

বাথরুম থেকে পালানোর কোন রাস্তাই নেই। বুকের মধ্যে হাতুড়ির আওয়াজ। ও রুদ্ধশ্বাসে দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

ও শুনল জিনেৎ দরজা খুলে দিচ্ছে। একজন লোক বলছে, আমরা একটি লোককে খুজছি..লোকটি মারাত্মক…অপরাধী।

ওঃ, জিনেতের গলায় ভয়। এখানে আমি ছাড়া তো কেড নেই। বেরোব বলে জামাকাপড়  পরছিলাম।

আপনার পাসপোর্ট?

লোকটি ভারী পায়ের আওয়াজ তুলে পোবার ঘরে গেল।

জিনেৎ বলল, এই যে আমার পাসপোর্ট। লোকটা কি করেছে?

খুন

এবার লোকটি হাতল ঘুরিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে চাইল। ভয়ে কুঁকড়ে কেড দেয়ালের গায়ে লেপটে থাকল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কেড নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারল না।

খুন। তবে ও সান্ত্রীটাকে মেরে ফেলেছে। কেডের সারা ইন্দ্রিয় জুড়ে এখন ভয় আর ভয়। জিনেৎ বলল, ঠিক আছে চলে গিয়েছে ওরা। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে কেড শোবার ঘরে এল। জিনেৎ কেডের দিকে তাকাল। ওর চোখে ভয় আর সংশয়।

কি হয়েছে আমাকে বল। ওরা বলছে তোমাকে ওরা খুনের ব্যাপারে খুঁজছে।

আর কোন উপায় নেই। কেড আস্তে আস্তে একটা চেয়ারে বসল। তারপর ক্লান্ত ভাবে একটানা বলে গেল সব। ব্রাডেফ…অ্যানিটা স্ট্রেলিক, প্রাসাদের বারান্দায় ওকী দেখেছে…একে একে সব। জিনেৎ গভীর মনোযোগ দিয়ে সব শুনল।

সান্ত্রীটির সঙ্গে ধস্তাধস্তি, ওর ছুরি মারার কথা বলে চলল। আমি ছুরি না মারলে ও আমাকে মেরে ফেলত। ওরা নিশ্চয় বুঝেছিল আমি ফটো তুলেছি। ওরা নিশ্চয় আমার ক্যামেরা খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দিতে পারি না। এটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার। আমাকে আমেরিকান কনসালের কাছে পৌঁছতেই হবে।

ছবিগুলো কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে কেড বলল, আমার তো তাই মনে হয়। আজকাল গুপ্তচর চারিদিকে। এ খবর যদি এখনো কেড না জানে তাহলে এটার গুরুত্ব আন্তর্জাতিক পর্যায়ে।

আমি তো জেনেভায় যেতে পারি। আমার তো মোটরে যেতে কোন বাধা নেই। মেয়েটি বলল।

কেড মেয়েটির দিকে তাকাল। আপাতদৃষ্টিতে এটা একটা দারুণ সমাধান, কিন্তু ইস্টনভিলের বুড়ো স্যামের বিশ্বাসঘাতকতার কথা ওর মনে পড়ল।

এই মেয়েটি কে? কোন্ বিশ্বাসে ওকে এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার দেবে কে? তাছাড়া গাড়ি থামিয়ে ওকে যদি ওরা তল্লাসী করে? মেয়েটি তাহলে ভীষণ বিপদে পড়বে। না কেডের কোন অধিকার নেই মেয়েটিকে এই বিপদের মুখে ঠেলে দেবার।

কেড বলল, না, কাজটা আমাকে নিজেকেই করতে হবে। তুমি এ জায়গাটা চেন? অন্য কোন পথে জেনিভায় পৌঁছা যায়

মরোক্স পর্যন্ত রেলরাস্তা আছে। জেনিভা যাবার ট্রেন পেতে পার তুমি। তবে আমার মনে হয় ওরা স্টেশনেও নজর রাখবে। একটু ভেবে নিয়ে ও বলল, তুমি স্কি করতে পার?

ভাল পারি না। তবে চালিয়ে নিতে পারি।

স্কি চড়ে আমরা তাহলে যেতে পারি। আমি রাস্তা চিনি। অনেকবার স্কি করে গেছি সাইলে। সেখান থেকে আমরা লেকে যেতে পারি তারপর স্টীমারে জেনেভা?

কেড ভেবে দেখল মেয়েটিকে নিয়ে যাবার জন্য ওর উদ্বেগ হচ্ছে।

আমি আশা করতে পারি না যে তুমি… বলে ও থেমে গেল। তারপর বলল, আমাদের কাছে স্কি নেইও।

আমি স্কি জোগাড় করতে পারি।

কেড বলল, কিন্তু এ কাজে বুঝতেই পারছ খুবই বিপদ আছে। আমি তোমাকে এর মধ্যে  টেনে আনতে চাই না। আমাকে বল কোথায় স্কি জোগাড় করতে হবে…

মেয়েটি বলল, তুমি খুঁজে পাবে না। আমার এক বন্ধুর বাড়ি। চল আমরা নীচে গিয়ে দেখি পুলিশ কী করছে। পুলিশ যদি চলে গিয়ে থাকে তবে আমরা বাগান দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারব। ওরা যদি হোটেলেই থাকে তাহলে আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।

জিনেৎ মনে হয় কোন বাধা শুনবে না। কেড হুইস্কির বোতল খুঁজছিল। খানিকটা নির্জলা হুইস্কি গলায় ঢেলে দিল।

তারপর একটু ধাতস্থ হয়ে একটা সিগারেট ধরাল।

দশ মিনিটের মধ্যে জিনেৎ ফিরে এল। বলল, ওরা হোটেল ছেড়ে চলে গেছে। হোটেলের বাইরে একটা পুলিশ মোতায়েন আছে বটে তবে আমরা পেছন দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারি। ওখানে কেড নেই।

কেড বলল, আমার যে তিনজন বন্ধু গ্রেপ্তার হল তাদের কি হল?

হোটেলের মালিক মিঃ বা বললেন ওদের পুলিশের গাড়িতে নিয়ে গেছে।

কেড মুখ বিকৃত করল। জিনেৎ একটা খাটো উলের কোট গায়ে দিয়ে বলল, চল যাই।

কেড জিনেতের কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখল, কেন তুমি নিজেকে বিপদের মধ্যে জড়াচ্ছ। একটা লোককে আমি খুন করেছি। ধরতে পারলে পুলিশ আমাকে খুন করবে। ভগবান জানে তুমি আমার সঙ্গে থাকলে কি হবে।

জিনেতের নীল চোখ দীপ্ত হয়ে উঠল। ও বলল, কেননা আমি তোমার ভক্ত। আর এর চেয়ে উত্তেজক ঘটনা আমার জীবনে আর ঘটেনি।

বেশ, কেড বলল, চল তাহলে যাওয়া যাক।

কেডের দিকে খানিকক্ষণ বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিনেৎ বলল তোমার মধ্যে কোন রোমান্স নেই, না?

কেড হুইস্কির আধখালি বোতল পকেটে রাখল। জিনেরে পেছন পেছন ঢাকা বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে সিঁড়ি অবধি ওরা হেঁটে গেল। আধাআধি নেমে জিনেৎ হাত তুলল। ও এগিয়ে গিয়ে জনশূন্য বসার ঘরটা দেখে নিয়ে কেডকে ইশারা করতে কে নেমে এল।

জনাকীর্ণ খাবার ঘর, একটা ঢাকা বারান্দা, একটা কাঁচের দরজা ঠেলে ওরা একটা বারান্দায় এল। বাইরে শক্ত বরফের আস্তরণের উপর দিয়ে ওরা হেঁটে গেল। খুব জোর ঠাণ্ডা বাতাস যেন ওদের চোখ মুখে কেটে বসতে লাগল। মেয়েটি ভালই রাস্তা চেনে। ওকে অনুসরণ করতে লাগল কেড। দেবদারু গাছের সারি দিয়ে খানিক চলে একটা পাচিলের কাছে এল। জিনেৎ বলল, ওদিকে আরেকটা পথ আছে। বাড়িটা অবধি চলে গেছে। দস্তানা পরা হাতে কেড জিনেতের পা ধরে পাঁচিলে তুলে দিল। তারপর পাঁচিল টপকে জিননেত নামল। কেড তাড়াতাড়ি পাচিল পেরিয়ে ওর কাছে গেল। একটা অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ওরা হাঁটতে লাগলো। কিন্তু জঙ্গলের বাইরে বিরাট মাঠ চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। কেড মুখ ফিরিয়ে দেখল। বরফের উপর ওদের পায়ের কালো ছাপ। কেডের দুশ্চিন্তা হল। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে মিনিট দশেক হেঁটে ওরা একটা বাড়ির খিড়কি দরজায় পৌঁছল। বাড়িটা কাঠের তৈরী, ছোট দোতলা। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে জিনেতের পেছন পেছন উঠল কেড। সদর দরজার ওপরের ঢালু ছাদে হাতড়ে কি যেন খুজল জিনে। তারপর বলল পেয়েছি, বলে চাবি দিয়ে দরজা খুলল। একসঙ্গে পা ফেলে ওরা একটা ঠাণ্ডা, বড় হলঘরে এসে ঢুকল। কেড দরজা বন্ধ করল। জিনেৎ আলো জ্বালল।

জানলা বন্ধ। কেড দেখতে পাবে না।

কেড উদ্বিগ্নভাবে বলল, আমাদের তাড়াতাড়ি করতে হবে। হার্ডেনবুর্গের লোকরা আমাদের পায়ের ছাপ দেখে এখানে চলে আসবে ঠিক।

আমি স্কি আনছি। তুমি এখানে দাঁড়াও।

কেড বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করি।

জিনেৎ বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি এখানে দাঁড়াও, আমিই আনছি।

কেড অস্থির ভাবে অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর কোটের পকেটে হাত ঢাকাতেই ওর রক্ত হিম হয়ে গেছে। এ পকেট ও পকেট হাতড়াতে লাগল। দুটো পকেটই খালি। ফিমের রোল নেই।

ভয়ে যন্ত্রণায় দীর্ণ হতে হতে কেড স্তম্ভিতের মতন দাঁড়িয়ে রইল। তারপর ধড়াস ধড়াস বুকে সিঁড়ির মাথায় গিয়ে একটা ঢাকা বারান্দার দিকে চোখ রেখে জিনেৎকে খুঁজতে লাগল।

জিনেৎ, কেড আকুতিভরা গলায় ডাকল।

কোত্থেকে যেন জিনেৎ সাড়া দিল, এক মিনিটও লাগবে না। দাঁড়াও…

অন্ধের মতন কেড সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। তারপর ঢাকা বারান্দা পেরিয়ে একটা খালি গ্যারাজে গিয়ে পৌঁছল। একটা ব্র্যাকেটে সারি সারি স্কি ঝুলছে। জিনেৎ কেডকে দেখে চমকে উঠল।

কি হল?

ফিলমের রোল দুটো নেই। হোটেলেও ছিল।

জিনেৎ বলল, তা হতে পারে না। ভাল করে দেখেছ?

 দস্তানা খুলে কেড আবার পাগলের মতন পকেট হাতড়াল। তারপর চরম হতাশায় শূন্যে ঘুষি ড়ল।

যাতে হাত দিই তাই পণ্ড হয়ে যায়, চরম হতাশায় খান খান হয়ে কেড বলল।

দেখ পাঁচিল টপকাতে গিয়ে হয়তো ফেলে দিয়েছ, আমি গিয়ে দেখছি।

কেড বলল, চল আমি তোমার সঙ্গে যাই। কেড ছুটল।

 ভ্যাল। অপেক্ষা কর।

জিনেৎ কেডের পেছনে ছুটে এল। দরজার হাতলে হাত রাখল কেড। কি হল? কেড অধীর হয়ে বলল।

তুমি ওখানে যাবে না, ভ্যাল। ওখানে তোমার বিপদ হতে পারে। ওরা যদি আমায় দেখে আমি বলতে পারি আমি খিড়কির দরজা দিয়ে হোটেলে ফিরছিলাম। তুমি এখানে অপেক্ষা কর। আমার পাঁচ মিনিটও লাগবে না।

না না, আমি তোমার সঙ্গে যাব। রোলদুটো খুবই দরকারী জিনিস। কেড দরজা খুলতে যেতেই জিনত ওর পাশকাটিয়ে এসে দরজা বন্ধ করল।

আমি ওগুলো ঠিক খুঁজে পাব। একটু বুদ্ধি খাটাও। কেন বেকার ঝুঁকি নেবে?

 জিমেতের দিকে ফ্যাকাসে সাদা মুখে প্রেতের মতন হাসল কেড।

হয়তো আমি এখনও শেষ হয়ে যাইনি। হয়তো এখনও আমি অত মাতাল উজবুক নই। হোটলে যখন তুমি আমার খুব ভক্ত বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেয়েছিলে তখনই পকেট থেকে রোজ দুটো সরিয়েছ তুমি। আমি প্রায় মজে যাচ্ছিলাম আর কি।

জিনেৎ আহত মুখ করে বলল, আমি! আমি তোমার ফিল্ম সরিয়েছি? আমি তোমায় এত সাহায্য করলাম আর তুমিই আমাকে দায়ী করছ। ঠিক আছে চল আমরা দুজনেই গিয়ে খুজি। জিনে দরজা খুলে বেরোতে গেল। কেড বিদ্যুৎগতিতে এসে দরজা ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করল। আমায় ফিল্মগুলো দাও, কেডের গলার স্বর মরিয়া, ভয়ঙ্কর। রোলগুলো না দিলে দেখ না তোমার কি হাল করি।

কেডের উন্মত্ত ভয়ংকর চোখের দৃষ্টি দেখে জিনত শিউরে উঠল। জোর করে হাসবার চেষ্টা করে বলল, সত্যি, ভেবেছিলাম বেরিয়ে গেছি প্রায়। এই নাও রোলগুলি। বলে জিনেৎ কোটের পকেটে হাত দিয়ে একটা পয়েন্ট থাটি এইট স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন অটোমেটিক রিভলবার বের করে কেডের বুকের দিকে তাক করল।

নড় না, মিঃ কেড। জিনেতের চোখ ঠাণ্ডা, কঠিন।

কে বলল তুমি কে? আমার বোঝা উচিৎ ছিল তুমি এত সময় মতো সুবিধেমত হাজির হলে কি করে?

পিছিয়ে যাও, ঘরে ঢোক। আরাম করে বসে থাক। আর বীরত্ব দেখাতে যেও না।

গভীর বিতৃষ্ণায় কেড মুখ কোঁচকাল। কোন উপায় নেই। বসবার ঘরে ঢুকেও আলো জ্বালল ঘরের একদিকে বিরাট ফায়ার প্লেস। তাতে বোঝাই করা কাঠ। কেড লাইটার জ্বালিয়ে কাঠ ঘেঁরে আগুন জ্বালল। কাঠের আগুন দপদপ করে জ্বলে উঠল। জিনেৎ সোফার উপর আধখালি হুইস্কি বোতল ছুঁড়ে মারল। বলল, ওটা নিয়ে মজে ঋক। আমাকে টেলিফোন করতে হবে। বলে পেছোতে পেছোতে সাইড বোর্ডের ওপর টেলিফোন তুলে একটা নম্বর ডায়াল করল। কেড হইস্কিতে একটা লম্বা চুমুক দিল। তার সারা শরীর হঠাৎ শিউরে উঠল।

জিনেৎ ফোনে বলল নিকি আছে? দশ মিনিট বাদে আসবে? আমাকে বলবেন ফোন করতে। আমি ওর বাড়িতে আছি। বলবেন খুবই জরুরি দরকার।

কেড গরম কোর্টটা খুলে রাখল। তারপর দুইস্কির বোতলটা নিয়ে সোফায় বসল।

জিনেতের দিকে তাকিয়ে কেড বলল, তুমি কি রাশিয়ানদের হয়ে কাজ করছ?

কেডকে দেখে জিনেৎ একটু হাসল।

হয়তো। আমি একটু পরেই চলে যাচ্ছি। জানি না তোমার কী হবে। হয়তো এখানে থাকাই তোমার পক্ষে নিরাপদ।

সত্যি। আমার জন্য তোমার উদ্বেগ দেখে আমি খুবই নাড়া খেয়েছি। একটা কথা ভাবছি আমি, আমার ফি যখন পেয়ে গেছ তখন এ ব্যাপারে কি করে কলে না বলার কোন কারণ নেই। আমার কৌতূহল হচ্ছে।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে জিনেৎ ঘাড় নাড়ল।

না, খুলেই বলছি। অ্যানিটা স্ট্রেলিক আর আমি অনেকদিন ধরেই একসঙ্গেকাজ করছি। আমরা হার্ডেনবুর্গের বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ হাতাতে চেয়েছি। অ্যানিটা ওর প্রেমে পড়ার ভান করে ওকে মজিয়েছে। অ্যানিটা ওকে বুঝিয়েছে যে আমরা বর্তমান রুশ গভর্নমেন্টের বিরোধী। হার্ডেনবুর্গ অ্যানিটার প্রেমে এতই উন্মত্ত হয়েছে যে ও বিশ্বাস করল যে ও ভুসলওস্কিকে ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা করছে। সমস্ত ব্যাপারটা এমন আষাঢ়ে গল্পের মতো অবাভব মনে হল যে হার্ডেনবুর্গ যে বিশ্বাসঘাতক তা প্রমাণ করবার আমরা তথ্য হাতে চাইলাম। হুইসপারকাগজের মিঃ ব্র্যাডেফকে টোপ ফেলতে কোন অসুবিধে হল না অ্যানিটার। মিঃ ব্রাডে কোন ব্যাপার আছে মনে করে তোমায় পাঠালেন ফটো তুলতে। আমরা নিজেরা ছবি কিছুতেই যোগাড় করতে পারতাম না। হোটেলে তোমার ঘরের ঠিক নীচে একটা ঘরভাড়া করে আমি আশায় আশায় বসে থাকলাম তুমি ছবি তুলেছ, এখন সেগুলি আমার হাতে। অঙ্কটা জলের মতন সহজ, তাই না?

যেভাবে আমি তোমার ঘাড়ের ওপর পড়েছিলাম তুমি কী জানতে?

না না ওটা আমার সৌভাগ্য বলে ঘটে যায়। তুমি যখন ঘরে ঢুকলে আমি তো আমার ভাগ্যকে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।

নিকি কে?

নিকি এই বাড়িটার মালিক। ও তোমার একটা রোল নিয়ে যাবে মোটরে। আমি আর একটা রোল নিয়ে যাব ট্রেনে।

আর আমি বসে বসে আগুনে হাত পা সেঁকব যতক্ষণ না হার্ডেনবুর্গের গুরা এসে আমায় মেরে ফেলে, তাই না? কেড গলায় বিষ ঢেলে বলল।

জিনেৎ নিস্পৃহভাবে কাঁধদুটো ঝাঁকাল।

তোমার জন্য আমার দুঃখ হচ্ছে। একবছর আগে হলে আমি তোমাকে বিপদে ফেলতাম না। কিন্তু তুমি এখন বস্তা পচা মাল। তুমি নিজেকে ফালতু ছাড়া আর কিছু বতে পার?

কেড কিছু বলল না।

জিনেৎ একটু ঝুঁকে বলল, আচ্ছা তুমি তো বিরাট একজন ফটোগ্রাফার। তোমার ছবি আমি দেখেছি। আচ্ছা একথা কি সত্যি যে মেক্সিকোর একটা বেশ্যার জন্য তুমি তোমার জীবন নষ্ট করেছ?

কেড বলল, গুপ্তচর হিসেবে তুমি বেশ মজার স্বীকার করছি। কিন্তু তোমার ওই নোংরা নাক দিয়ে আমার অতীত জীবন শোকা বন্ধ কর দয়া করে।

জিনেৎ লাল হয়ে উঠল।

আমি দুঃখিত। আমি সত্যিই জানতে চাইছি।

বেশ। তোমার এটা বিকৃত কৌতূহল বুঝতে পারছি। আমি জানি আমার সম্বন্ধে লোকে কি ভাবে। আমি এখন জাদুঘরের একটা মরা জিনিস। কিন্তু বলতো আমার মতন মাতালের ওপর তোমাদের এই বিশ্বাস কি করে হল যে আমি ছবিগুলো তুলতে ভণ্ডুল করিনি। তোমরা এত চালাক আর চৌকস হয়েও আমার ওপর বিশ্বাস রাখছ কি করে তাই আমি ভাবছি।

জিনেৎ হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল। ওর চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।

কি বলছ তুমি?

কেড বলল, খুকি তোমার জন্য আমার সত্যিই কষ্ট হচ্ছে। তোমার আশায় আমি জল ঢেলে দিলাম। জেনারেল দ্য গলের ছবি তুলতে আমি কেমন বেরিয়েছিলাম শোন নি?

তুমি কি ভাবছ আমি মদ না খেয়েই গাছে উঠেছিলাম।

 যে ফিল্ম পেয়েছে সেগুলি প্রিন্ট করে তারপর বীরত্ব দেখাও।

ছবিগুলো আমার থেকেও বাজে হবে বাজী রেখে এ কথা আমি বলতে পারি।

জিনেতের মুখ মড়ার মতন সাদা দেখাল। তাড়াতাড়ি ও কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ফিল্মগুলো স্পর্শ করল

কেড বলল, তোমার রাশিয়ান মনিবটিকে আমি জানি না। কিন্তু তিনি যখন জানবেন এরকম জরুরি কাজের জন্য আর সব ফটোগ্রাফার বাদ দিয়ে আমাকে বাছা হয়েছে তিনি মোটেই খুশী হবেন না।

জিনেৎ খানিকক্ষণ নির্বাক হয়ে বসেছিল। তারপর বলল, তুমি কথা বলায় খুব ওস্তাদ, তাই না? আমি বলতে পারি তোমার যতই নেশা হক ফটো তুমি ঠিকই তুলেছ। তুমি হলে কেড, এরকম জরুরি ব্যাপার তুমি বুঝবে না এ হতে পারে না।

কেড জিনেতের দিকে তাকিয়ে হাসল, বেশ প্রিন্ট করেই দেখ। আমার নিজের ওপর তো এত বিশ্বাস নেই।

এ সময় টেলিফোন বেজে উঠতেই দুজনে চমকে উঠল। জিনেৎ কেডের দিকে রিভলবার তাক করে রিসিভার তুলল, এখনি আসবে নিকি? অসম্ভব জরুরি দরকার। যা চেয়েছিলাম তা আমি পেয়ে গেছি। তুমি যত তাড়াতড়ি পার এখানে এস।

কেড আবার বোতল খুলে লম্বা একটা চুমুক দিল। জিনেৎ খেঁকিয়ে বলল, তুমি মদ খাওয়া থামাতে পার না?

কেডের হাত থেকে বোতলটা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। ওর এখন খুব নেশা জমে গেছে।

নিজের কথা ভাব খুকুমণি। বন্ধুর সঙ্গে যখন কথা বলছিলে দোস্তরা তখন এসে গেছে।

দোস্ত? কি বলব তুমি!

বাইরে জুতোর মচমচ শব্দ শোনা যাচ্ছে। কে যেন বারান্দায় হাঁটছে। কেড আর জিনেৎ দুজনেই কান পাতল। বাইরে বাতাস জোরে বইছে। ছাদ থেকে বারান্দায় বরফ খসে পড়ল। জিনেৎ চমকে উঠল।

কেড ইশারা করে জিনেতকে কথা বলতে বারণ করল। তারপর কেড দরজাটা ফাঁক করে খুলে ধরল, জিনেৎ সামনে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করল। হঠাৎ কেড জিনেতের কবজিতে সজোরে মারল। জিনেতের হাত থেকে রিভলবার খসে পড়ল। এত জোরে ধাক্কা মারল কেড ওকে যে ও চরকি খেতে খেতে ঘরের মাঝখানে চলে গেল। বন্দুকটা তুলে কেড হাসল।

তুমি অ্যামেচার মনস্তাত্বিক হওয়া ছাড়। ভেবেছিলে আমার খুব নেশা হয়েছে না? আমি ভান করেছিলাম। আমি ততটা উজবুক নই।

জিনেতের চোখ জ্বলতে লাগল।

 নাও আবার গোড়ায় ফিরে যাওয়া যাক। ফিল্মগুলো আমায় দাও।

জিনেৎ পেছনে হটে গেল কিন্তু কেড বিদ্যুৎগতিতে ছুটে গিয়ে ওর হাতের কবজি মুচড়ে দিল। তারপর ওর দোমড়ানো হাত কাঁধের কাছে নিয়ে গিয়ে আরও মুচড়ে দিল। জিনেৎ যন্ত্রণায় কাতরে উঠল।

 কেড হিংস্রভাবে বলল, দাও ফিল্মগুলো দাও। কেড ওর দোমড়ানো হাত আবার মুচড়াতে গেল তখন জিনেৎ তাড়াতাড়ি পকেট থেকে ফিল্মগুলো বের করে কেডের হাতে দিল। এবার জিনেতকে ধাক্কা দিয়ে সোফার উপর ফেলে দিল কেড। তারপর ফিল্মগুলো নিয়ে কেড ইজিচেয়ারে বসল। হাতের তোল দুটোর দিকে তাকিয়ে কেড বলল, একটা কথা জান। আমি অনেক ভেবেছি। হার্ডেনবুর্গ, ওর বাজে ষড়যন্তু এসব নিয়ে আমি কেন এত উত্তেজিত হয়েছিলাম। মনে হচ্ছে আমার গভর্নমেন্ট-এ নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন? চালাক না হার্ডেনবুর্গ, যত ইচ্ছে চালাক। আগে এরকম পরিস্থিতিতে আমি উত্তেজিত হতাম এখন হইনা।

ইস্টনভিল নামে একটা শহরে আমি দুজন অসহায় নিগ্রো তরুণ তরুণীকে খুন হতে দেখেছিলাম। তাই দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়েছিল মানব সভ্যতা বুঝি শেষ হয়ে গেল। কিন্তু আমি জানি তা ঠিক নয়। আজ আমি জানি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অন্য মানুষের মরা দরকার। নিগ্রো হত্যার ফটোগুলি আমার কাছে ছিল। আমি ভেবেছিলাম আমার ফটোর জোরে আমি পাঁচটা বেজন্মা বিবেকহীন পাষণ্ডকে শাস্তি দেব। কিন্তু আরেকটা পাষণ্ড আমার সেই ফিলমগুলো নষ্ট করে দেয়। ডেপুটি স্লাইডারের তাচ্ছিল্য ভরা হাসি মনে পড়ল কেডের। মনের কোণায় জ্বালা করে উঠল। বলল,

তুমি মনে করছ হার্ডেনবুর্গ যে বেইমান এই কথা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করলে একটা বিরাট ব্যাপার হবে। তোমার বয়েস কম তাই বুঝছ না, পৃথিবী যেমন চলছে তেমনই চলবে। পৃথিবীতে বিশ্বাসঘাতকতাই হচ্ছে আমাদের জীবনে সবচেয়ে স্বাভাবিক একটা ঘটনা। তাই আমি তোমাদের ব্যাপারে থাকব না। ফিল্মগুলো আমার। আমি এ নিয়ে যা খুশী করব।

এবার স্থির অকম্পিত হাতে ডেপুটি স্লাইডার যেমন করে কার্তিজ থেকে ফিল্মগুলো টেনে বার করছিল, কেড সেইভাবেই ফিল্ম টেনে টেনে বার করতে লাগল।

জিনেৎ আর্তনাদ করে বলল, না না এরকম কর না।

কেড পায়ের কাছে ফিমের ফিতের কুণ্ডলীটা দেখে বলল, এই নাও জিনেৎ কার্তিজটা তোমায় উপহার দিচ্ছি। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে দাও এটা। অত দুঃখী দুঃখী মুখ কর না জিনেৎ। তুমি ভুল ঘোড়ার ওপর বাজী রেখেছিলে।

কেড এবার বোতল থেকে একটা লম্বা চুমুক দিল, এটা আমার খুব জরুরী ছিল। তুমি গুপ্তচর হিসেবে খুব চতুর নও জিনেৎ, তোমার দেখা উচিৎ ছিল আধবোতল মদ এখনও রয়েছে। জিনেৎ রাগে দুঃখে চীৎকার করে বলল, তোমার মতন মেরুদণ্ডহীন মাতালের থেকে আমার কিছু আশা করাই ভুল হয়েছিল। যাও, তোমার মেক্সিকোর সেই বেশ্যার কাছেই যাও, দেখ ও যদি তোমায় ঠাই দেয়।

কেড হাসল, বেশ, আমি মেরুদণ্ডহীন। বেশ, সে বেশ্যা। কিন্তু ক্ষণিকের জন্য হলেও আমরা পরস্পর পরস্পরের থেকে এমন কিছু পেয়েছিলাম তুমি তা কখনো পাবে না। স্পষ্ট বুঝতে হবে তোমার মতন মেয়ের সেরকম একটা ভালবাসা দরকার যা কোন পুরুষ আজ পর্যন্ত তোমায় দেয়নি। এই যে জীবন যাপন করছি আমরা এই জটিল জীবন বাঁচার কী কৌশল জান? ভাল মুহূর্তগুলো তারিফ করা আর বাজে মুহূর্তগুলোকে ছেটে ফেলা। আমার সমস্যা এখানেই। খারাপ মুহূর্তগুলো আমাকে হারিয়ে দিল। আমি হেরে গেলাম। শোন, এইসব গুপ্তচর, ষড়যন্ত্র এসব ভাওতা ভুলে যাও। একজন পুরুষকে খুঁজে নাও, তাকে ভালবাস, বিয়ে কর সন্তানের মা হও। মেয়েরা এই জন্যেই সৃষ্টি হয়েছে।

জিনেৎ চেঁচিয়ে বলল, চুপ কর। তোমার মতন মাতালের থেকে আমি পরামর্শ চাই না।

কেড ওর চুলে হাত দিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ। যারা নিজেদের জীবনের হিসেবে ভুল করে ফেলে তাদের উপদেশ দেওয়া বৃথা। আচ্ছা আমি চলি, তোমার বন্ধু না আসা অবধি বসে থাক আরাম করে। ও দরজার কাছে পৌঁছতে জিনেৎ বলল, বোকামি কর না। ওরা বাইরে সব ওৎ পেতে আছে তোমার জন্য।

আমার ভবিষ্যত বলতে কিছু নেই। এখন জীবিকা অর্জনের আর কোন পথই রইল না। যে জীবনে আমার কোন আগ্রহ নেই, তার দাড়ি টানার অধিকার আমার আছে। যত ইচ্ছে এবার নাটুকেপনা করব আমি, আর মনে মনে হাসব।

ঘর থেকে বেরিয়ে গ্যারাজে গেল কেড়। পায়ে স্কি বাঁধতে বাঁধতে জুয়ানার কথা হঠাৎ মনে পড়ল কেডের। জুয়ানা এখন কী করছে? হয়তো এই মুহূর্তে কোন ধনকুবের স্থূলদেহ আমেরিকানের পাশে শুয়ে আছে, জুয়ানার চারপাশে সূর্য তার জ্যোতি ছড়িয়ে রেখেছে। স্কি বাঁধা হল। হঠাৎ চলচ্চিত্রের সিনের মতন পরপর কয়েকটা মুখ ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। স্যাম ওয়ান্ড, এড বার্ডিক, ম্যাথিসন, ভিকি মার্শাল। গভীর দুঃখে আর বিস্ময়ে মাথা নাড়ল কেড। ওরা কেমন যেন ছায়া ছায়া হয়ে গেছে ওর কাছে। যেন অলীক, অবাস্তব সিনেমার ছবির মন। তারপর, গ্যারাজের দরজা খুলতে খুলতে অ্যাডোলফো ক্রিলের মুখ ভেসে উঠল কেডের সামনে। সেই মোটাসোটা মেলিকান, জামায় খাবারের দাগ। ওর কৃতার্থ হাসি, ওর বিনয়, ওর মমতা, ওর বিশ্বস্ততা, সব নিয়ে অসম্ভব বাস্তব হয়ে গেল ওর মুখ। মনে হল এই মুহূর্তে কেডের খুব কাছেই আছে ক্রিল।

জ্যোৎস্নায় মাখামাখি বরফের উপর কেড এসে দাঁড়াল। আইলে যাবার ঢালু পথে ও নামতে শুরু করল, স্কির গতি বেড়ে গেল ওর। আর ঠিক তখনই বাইরে চারিদিকে ওৎ পেতে থাকা হার্ডেনবুর্গের সাত্রীদের মধ্যে একজনের চোখে পড়ে গেল কেড। রাইফেল উঁচু হল, আঙ্গুল ট্রিগারে উঠল, গুলি ছোঁড়ার শব্দ। গুলিটা ছুটে এল মৃত্যুর বার্তা নিয়ে। কেডের স্কি বরফে পাক খেতে খেতে ঘুরে ঘুরে ছিটকে যেতে লাগল আর বরফের ওপর লিখে যেতে লাগল কেডের মৃত্যু সংবাদ।