১. শ্মশানের ধোঁয়া

কেড

০১.

অ্যারোপ্লেনটা ইস্টনভিল পাক দিয়ে ঘুরতেই কেড দেখতে পেল শহরের উত্তর দিকটা যেন শ্মশানের ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে। কে জানত এখানকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ, কিন্তু এতটা ভাবেনি। সারা প্লেনে একটা ভয় তাকে কুরে কুরে খেয়েছে। এখন তার হাত-পা কাঁপতে লাগল, হৃৎপিণ্ড ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। আর একটু মদ তাকে খেতেই হবে।

মাথার ওপর আলোর সঙ্কেত যাত্রীদের বলে দিচ্ছে সীটবেল্ট পরে নিতে। সিগারেট খাওয়া এখন চলবেনা। নাঃ, এয়ারহোস্টেস ওকে এখন আর মদ দেবে না। ইতিমধ্যে কেড আটটা ডাবল হুইস্কি শেষ করেছে। এয়ারহোস্টেসটা বিরক্ত হয়ে উঠেছিল শেষের দিকে। হৃৎপিণ্ড যতই লাফাতে থাক কেড বুঝল প্লেন না থামা পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

প্লেনে সে ছাড়া আর মোটে দুজন যাত্রী আছে। ইস্টনভিলের পরিস্থিতি এখন যেরকম, একান্ত বাধ্য না হলে কেড এখানে আসে না।

কেডের সঙ্গে নিউইয়র্কে যে জনাবিশেক যাত্রী উঠেছিল তারা সব অ্যাটলান্টায় নেমে গেল। এরা দুজন উঠল। লম্বা, পেশীবহুল দেহ লোকদুটোর মুখ টকটকে লাল। মাথায় পানামা টুপি, ধুলিধূসরিত স্যুট। কেডের একসারি সীট পেছনে ওরা বসেছিল। কেড যখন একের পর এক মদের গ্লাস গিলছিল, ওরা নিজেদের মধ্যে নীচুস্বরে কি যেন বলছিল। নামবার আগে প্লেনটা যখন পাক। খাচ্ছে ওদের একজন বলে উঠল, দেখ জ্যাক, কি ধোঁয়া দেখেছ? মজা জমে উঠেছে।

বেজন্মা নিগারগুলো। অন্য লোকটা ঘোৎ ঘোঁৎ করে বলল পুড়ে মরুক ব্যাটারা।

কেড শিউরে উঠল। পাশের সীটে রাখা পুরনো প্যানঅ্যাম ওভারনাইট ব্যাগটার দিকে ও চোরা চাহনিতে চাইল। ওতে ক্যামেরা আর আনুষঙ্গিক সাজসরঞ্জাম আছে। ক্যামেরা না আনাই ঠিক ছিল। ইস্টনভিল এখন আগ্নেয়গিরি হয়ে আছে, বিস্ফোরণ ঘটবেযখন তখন। এরকম অবস্থায় কেড ছবি তুলতে আসছে ব্যাপারটা জানাজানি হলে মারাত্মক হবে।

জ্যাক নামে লোকটা বলল, মিলিটারি এসেছে মনে হচ্ছে।

আর না না, এর সঙ্গী বলল।

ফ্রেডকে চিনি না আমি? নেহাত বাধ্য না হলে ও ওই স্কুলের ছোকরাগুলোকে আমাদের মজা নষ্ট করতে দেবে না।

হয়তো কোন নিগার ভয়ের চোটে খবর পাঠিয়েছে।

না না। ফ্রেড বলেছিল ও প্রতিটি টেলিফোনের কল চেক করবে। নিশ্চয় করছে। বুঝবে ব্রিক! আমরা নিগারগুলোকে উচিতমত শিক্ষা দেব। এবার কাউকে আর বাইরে থেকে এসে বাধা দিতে দিচ্ছি না।

কেড রুমাল বার করে মুখ মুছল। ম্যাথিসন যখন ওকে ডেকে পাঠাল, তখনি ও বুঝেছিল এবার ও ফাঁদে পড়েছে। ম্যাথিসনের ছোট অগোছালো অফিসে ঢুকতেই ও টের পেয়েছিল ম্যাথিসন ওকে এবার মরণ ছোবল দেবে। কেড দোষ দিচ্ছে না তাকে। হেনরি ম্যাথিসনের মত ভাল বার্তা সম্পাদক আর হয় না। দুঃস্বপ্নভরা তিন তিনটে সপ্তাহ সে কেডকে পরপর সুযোগ দিয়েছে।

এড বার্ডিক ম্যাথিসনকে বলেছে সুযোগ দিলে কেড প্রমাণ করে দেবে যে সে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাল ফটোগ্রাফার। কে সে সুযোগ পেয়েছিল কিন্তু কি লাভ হল?

লজ্জায় ঘামতে ঘামতে কেড তার কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলগুলো দিয়ে তার প্যানঅ্যাম ব্যাগটা আঁকড়ে ধরল।

ম্যাথিসন লোকটা কড়া। পাঁচমাস ধরে কেড প্রমাণ করছিল যে বার্ডিক ওর সম্বন্ধে ঠিকই বলেছে। কেড যখন ডেস্কের ওপর ফটোগুলোনামিয়ে রাখত, ম্যাথিসনের চোখে সে খুশীর ছোঁয়া দেখেছে। পাঁচমাস ধরে সব ঠিকই চলছিল, কিন্তু কেড আবার মদ খাওয়া শুরু করল। কারণ ছিল, খুবই সংগত কারণ। কিন্তু ম্যাথিসনকে জুয়ানার কথা বলে কোন লাভ হত না। মেয়েরা তুচ্ছ ম্যাথিসনের কাছে।

তারপর তিন হপ্তায় চারটে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কেড নষ্ট করে ফেলে। তাই ম্যাথিসন যখন তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল, কেড ভেবেছিল এবার ও ওকে সিধে দরজা দেখিয়ে দেবে। তখন কেডের খুবই দুরবস্থা। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারে না। রোজ এক পাঁইট হুইস্কি খেতে হয়। আরো খেতে পারে ও, তবে প্রাণে টিকতে হবে তো। হাতের টাকা ফুরিয়েছে। গাড়ির বাকি টাকা দেওয়ার জন্য চাপ আসছে সমানে। বাড়িভাড়া বাকি পড়েছে। কেডের কাছে দামী জিনিষ বলতে তখন ওই ক্যামেরা আর যন্ত্রপাতিগুলো। ওগুলো হাতছাড়া করলে কেড মরে যাবে।

বস, ভ্যাল। ম্যাথিসন বলল। লোকটা ছোটখাট, কেডের থেকে দশবছরের বড়, সাতচল্লিশ বছর ওর। 

তেমন সুবিধে করতে পারছ না, তাই না?

কেডের হাত কাঁপছে। চেয়ারটায় ভর করে ও দাঁড়িয়েছে। নেশা কেটে গিয়েছে তখন। মুখ গরম হয়ে উঠেছে। মাথা দপদপ করছে, পেটে একটা ব্যথা অনুভব করছে সে।

লেকচার রাখ, কেড বলল, তোমার সঙ্গে পরিচয়ের পর আমি…

বাজে বোক না। চুপ করে থাক, ম্যাথিসন গলার স্বর নামিয়ে বলল। তারপর ডেস্কের দেরাজ থেকে একটা স্কচের বোতল আর দুটো গ্লাস বার করে কেডের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ঢাল।

কেড নিজের সঙ্গে খানিক যুদ্ধ করে সতৃষ্ণভাবে গ্লাসে চুমুক দিল। তারপর ধীরে ধীরে বসে পড়ে মদটা শেষ করল।

একটা কাজের কথা আছে, ভ্যাল। একমাত্র তুমিই পারবে। ম্যাথিসন সহানুভূতির দৃষ্টিতে কেডের দিকে তাকাল। তারপর বোতলটা ঠেলে দিয়ে বলল, নাও, চালাও। মনে হচ্ছে তোমার আরো দরকার।

কেড ভান করল মদটা তুচ্ছ। তারপর বলল, কি কাজ?

এস সিন্ডিকেট একটা দারুণ কাজের খবর এনেছে। ওরা চায় তুমিই ছবিগুলো তোল।

সিন্ডিকেটের কাজ মানেই মোটা টাকা। একাজে ফটোগ্রাফার ছবি তোলে, সিন্ডিকেট সারা বিশ্বে সে ছবি ছাপায়, আধাআধি বখরা হয়।

বিষয়টা কি? কেড ভাবছে যদি কিছুদিন মদ বন্ধ করে সে একাজটা শেষ করতে পারে, তাহলে তার অর্থকষ্ট খানিকটা কমবে। এদিকে ম্যাথিসনের দিকে না তাকিয়ে সে গ্লাস ভরে নিয়েছে। ম্যাথিসন সেদিকে লক্ষ্য না করে বলল, আজ রাতে ইস্টনভিলে একটা সিভিল রাইট অভিযান শুরু হচ্ছে। কাল দুপুরের মধ্যে দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে। সিন্ডিকেট চায় তুমি কাল সকাল নটার প্লেনে ওখানে যাও।

 কেড আস্তে আস্তে বোতল বন্ধ করল। তার মেরুদণ্ড শিরশির করছে।

আজ রাত্রে গেলেও তো হয়, সে প্রায় হতাশ স্বরে বলল।

না অত তাড়াতাড়ি যাবার দরকার নেই। তুমি ঝট করে যাবে আর ঝটপট কাজটা শেষ করে চলে আসবে।

যদি বেরিয়ে না আসতে পারি? কম্পিত স্বরে কেড বলল।

ম্যাথিসন গ্লাসে চুমুক দিয়ে চুপ করে রইল। অনেকক্ষণ দুজনে নীরব থাকল। কেড শেষে মরিয়া হয়ে বলল, সেবার নিউইয়র্কে ঠিক এইরকম ব্যাপারের ছবি তুলতে গিয়ে তিনজন ফটোগ্রাফারকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল, পাঁচটা ক্যামেরা ভাঙ্গে। কেড ছবি তুলতে পারেনি।

সেইজন্যেই এস্ এই ছবিগুলো চায়।

কেড ম্যাথিসনের দিকে তাকিয়ে বলল তুমিও তাই চাও?

হ্যাঁ, চাই! এ–এর বক্তব্য হল ছবিগুলো ভাল হলে লাইফ–এর সঙ্গে কথাবার্তায় আসা যাবে। একটু থেমে ম্যাথিসন বলল, জি, এমের এজেন্ট ফোন করেছিল। জানতে চাইছিল আমরা তোমার গাড়ির টাকা মিটিয়ে দেব কিনা। আমার বলতে হল কনট্রাক্টে তোমার গাড়ির টাকা দেবার কোন কথা নেই। আবার একটু থেমে ম্যাথিসন বলল তুমি ভাবনা চিন্তা করে বল। অ্যালিস তোমার টিকিট জোগাড় করে দেবে। খরচ খরচার জন্য একশো ডলার তোমাকে দিচ্ছি। তুমি চাইলে আরো দেব। কি করবে এখন বল।

মানে কাজটা ঝামেলার, বলতে গিয়ে কেডের মনে হল ভয় যেন তাকে খামচে ধরেছে। আর কে যাচ্ছে?

কেড না। আর কেড জানেই না। যদি কাজটা হাসিল করতে পার, তোমার কপাল ফিরে যাবে।

রুমাল দিয়ে মুখ ঘষতে ঘষতে কেড বলল, আর যদি না পারি? আমার কপালে কি থাকবে?

ম্যাথিসন ওর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল। তারপর একটা নীল পেনসিল তুলে নিয়ে ডেস্কের উপর একটা বিজ্ঞাপনের কপি দাগ দিতে লাগল। এটা ম্যাথিসনের পরিচিত ইঙ্গিত যে কথাবার্তা শেষ হয়ে গিয়েছে।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত কেড চুপ করে রইল। একেই বলে মরণ ছোর্বল। কিন্তু তার আত্মসম্মান এখনো শেষ হয়ে যায়নি। হুইস্কির ঘোরে তা আবার জ্বলে উঠল।

ঠিক আছে। টিকিটের বন্দোবস্ত কর। আমি কাল তৈরী থাকব। পা টললেও অন্তত মাথা উঁচু করে ও অফিস থেকে বেরিয়ে এল।

.

ইস্টনভিলের এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের দিকে যেতে যেতে কেড দেখল দূরে মেঘহীন আকাশে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। এয়ারপোর্টের আলোটাও কেমন ভুতুড়ে, গা ছম ছম করা।

ওর সঙ্গে যে দুজন যাত্রী এসেছে, ওরা সামনে হাঁটছে। ওরা খুব দ্রুত হাঁটছে, ওদের উদ্দেশ্য ওদের জানা। চওড়া হাতগুলো দুলছে উত্তেজনায়।

কেড তাড়াহুড়ো করল না। ভ্যাপসা গরম, তার ওপর ব্যাগটাও ভারী। এয়ারপোর্টের বাইরে পা রাখতে তার ভয় হচ্ছিল। এখন ও হোটেলে যাবে, শহরের অবস্থাটা কি বুঝতে হবে। তাছাড়া ওর এখন একটু মদ চাই।

এয়ারপোর্ট বিল্ডিংয়ের নিস্তেজ লবিতে মিটমিটে আলো জ্বলছে। লবিটা জনশূন্য। শুধু লবির মুখে প্লেনের ওই যাত্রীদুজন কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। লোকটা লম্বা, বলিষ্ঠ দেহ, পরনে খাটো হাতা গলা–খোলা স্পোর্টস শার্ট আর রং–জ্বলা খাকি প্যান্ট।

কেড বাঁদিকের বারের দিকে সরে গেল। বারও খালি। কেবল টেকো, মাঝবয়সী বারম্যান খবরের কাগজ পড়ছিল।

উত্তেজনা যথাসম্ভব চেপে কেড নির্জলা স্কচ চাইল। বারম্যান একবার ওর দিকে কৌতূহলী চোখে চেয়ে তারপর হোয়াইট হর্স লেবেল আটা বোতল থেকে হুইস্কি ঢেলে গ্লাসটা কেডের দিকে ঠেলে দিল।

কেড ওভারনাইট ব্যাগটা মেঝেতে রেখে একটা সিগারেট ধরাল। ওর হাতটা কাঁপছিল। তবে সঙ্গে সঙ্গে মদটা তুলল না। এইটুকু আত্মসংযম দেখাতে গিয়ে ওর শরীরে খুব কষ্ট হতে লাগল। দরদর করে ঘামছিল ও। তবু জোর করে নিজেকে সংযত করে ধীরেসুস্থে সিগারেটে টান দিল কেড। তারপর যেন কিছুই হয়নি এরকম ভাব দেখিয়ে মদের গ্লাসে চুমুক দিল।

এই আসছেন? বারম্যান শুধোল।

কেড ভেতরে কুঁকড়ে গেল যেন। মদটা শেষ করে বলল, হ্যাঁ।

 বারম্যান বলল, আপনাকে দেখে অবাক হয়েছি যাদের বুদ্ধি আছে তারা এই শহরে আসার আগে দুবার ভাববে। বাইরের লোক এই শহরে এখন আসুক কেড চায় না।

কেডের আরেকটু মদ দরকার। কিন্তু বারম্যানটাকে সামলাতে হবে। অত্যন্ত অনিচ্ছায় ও বারের কাউন্টারে পয়সা রেখে ব্যাগটা তুলে বেরোবার জন্য দরজার দিকে হাঁটতে লাগল।

দরজায় সেই স্পোর্টস শার্ট পরা লোকটা যেন ওর জন্যেই দাঁড়িয়ে আছে। কেডের বুক ধড়ফড় করে উঠল।

লোকটা কেডের বয়সীই হবে। মুখটা কঠিন লাল মাংসল। শার্টের বুকপকেটে একটা পাঁচফলা রুপোর তারা।

কেড দরজার কাছে পৌঁছতে লোকটা একটুও পথ দিল না। কেডের মুখের ভেতর শুকিয়ে গেছে।

লোকটা এবার নীচু গলায়, বলল আমি ডেপুটি শেরিফ জো স্লাইডার। তোমার নাম কেড?

 হ্যাঁ। কেড সভয়ে বলে উঠল।

শোন তোমার শ্রেণীর লোকেরা যখন আমার সঙ্গে কথা বলে, আমাকে ডেপুটি বলে। আমি তাই চাই।

কেড নিশ্চুপ থাকল। অথচ একবছর আগে হলে ও অনায়াসে এরকম একটা পরিস্থিতি সামলাতে পারত। কোথায় তলিয়ে যাচ্ছে নিজে, কেড অনুভব করল। এত ভয় পেয়েছে যে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। আত্মগ্লানিতে কেড জর্জরিত হতে লাগল।

ভ্যাল কেড। নিউইয়র্ক সানের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ফটোগ্রাফার ঠিক বলেছি? স্লাইডার ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের সাথে বলল।

ঠিকই আমারই নাম ভ্যাল কেড, ডেপুটি।

ইস্টনভিলে দরকারটা কি তোমার, কর্কশ স্বরে স্লাইডার বলল। 

কেড নিজেকে গালাগালি দিল। কি করবে তোমার ও কেড, নিজেই নিজেকে মনে মনে বলল। ও শুধু তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে। বল বল…

কিন্তু আসলে যা বলল তাতে নিজেই ঘৃণায় স্তম্ভিত হয়ে গেল।

আমায় আসতে বলা হয়েছে, তাই এখানে এসেছি, ডেপুটি। আপনি ভাববেন না। আমি কোন ঝামেলাতে যেতে চাই না… ।

স্লাইডার ঘাড়টা একদিকে ঝাঁকাল। বটে, আমি কিন্তু শুনেছি দি সানঝামেলা পাকাতে চায়।

–হয়তো চায়। কিন্তু আমি ওসবের মধ্যে নেই।

স্লাইডার ওর দিকে চেয়ে রইল। একটা কথা কেড, ওরা তোমার মতন মেরুদণ্ডহীন একটা মাতালকে এখানে পাঠিয়েছে কেন, বলতে পার? বল তো, আমি জানতে চাই।

কেডের মনে হল ওর এখনি আরেকটা হুইস্কি দরকার। এখনই।

বল কেড… স্লাইডার একটু ঝুঁকে কেডের বুকে মৃদু ধাক্কা মারল। কেড ছিটকে দুপা পিছিয়ে গেল। তারপর শুকনো ঠোঁট দুটো একটু মুছে বলল, আমি কোন ছবি তুলব না, ডেপুটি। আপনি দেখবেন।

স্লাইডার ওর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। আমি কি ভাবছি তা তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি কোথায় উঠছ?

হোটেল সেনট্রাল মোটর।

যাচ্ছ কখন?

পরের প্লেনে…কাল সকাল এগারটায়।

স্লাইডার বেশ কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, তাহলে আমরা দেরী করছি কেন? চল কেড, তোমার থাকার বন্দোবস্ত দেখি।

লবিতে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ স্লাইডার জিজ্ঞেস করল ব্যাগে কি আছে কেড?

আমার জিনিষ।

 ক্যামেরা আছে কি?

কেড থমকে দাঁড়াল। স্লাইডারের দিকে চাইল, ওর চোখের দৃষ্টি কেমন উন্মত্তর মতন। তা দেখে স্লাইডার এত চমকে গেল যে তাড়াতাড়ি পিছিয়ে গেল।

আমার ক্যামেরায় হাত দিয়ে দেখ। দেখ একবার? হিস্টিরিয়াগ্রস্ত লোকের মতন কেড বলে, উঠল।

তোমার ক্যামেরায় কে হাত দিচ্ছে? স্লাইডারের হাতটা ততক্ষণ বন্দুকের বাঁটের উপর চলে গেছে। আমি বলিনি। চাচাচ্ছ কেন?

ক্যামেরা ছুঁয়ো না…ব্যস। কেড এবার একটু সংযত স্বরে বলল।

–চল, দেরী করছি কেন আমরা।

কেড, এলোমেলো পায়ে গেটের দিকে চলতে লাগল। বমি পাচ্ছে ওর, মনে হচ্ছে এক্ষুনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। এক মুহূর্তের মধ্যে ও দপ করে জ্বলে উঠেছিল। ভাবলেই ভয় করে।

বাইরেটা ভ্যাপসা গরম, বাতাসে ধোঁয়া। বাইরে ছায়ায় একটা ধুলোমাখা শেভ্রলে দাঁড়িয়ে ছিল। স্লাইডার ইশারা করে গাড়িতে উঠতে বলল। গাড়ির ড্রাইভার ঠিক স্লাইডারের মতন পোশাকপরা। শার্টের পকেটে স্লাইডারের মত রুপোর তারা লাগানো খুব ছটফটে আর সতর্ক। সরু মতন মুখটা রোদে পোড়া, ঘোট ঘোট চোখদুটো ভিজে পাথরের নুড়ির মত ভাবলেশহীন।

রন, এই হচ্ছে কেড। এক সময়কার নামকরা ফটোগ্রাফার, হয়তো তুমি ওর নাম শুনে থাকবে। ও কোন ঝামেলা চাইছে না। ওকে হোটেলে নিয়ে যাও। কাল সকাল এগারটার প্লেনে ও ফেরত যাবে। যতক্ষণ না রওনা হয়, ওর সাথে সাথে থেক।

কেডকে স্লাইডার বলল, এহচ্ছে রন মিচেল। নিগ্রোপ্রেমিকদের ও ঘৃণা করে, ঝামেলাবাজদের ঘৃণা করে, আর সবচেয়ে ঘেন্না করে মাতালদের। স্লাইডার একটু হেসে বলল ওকে চটিও না। চটালে ও রেগে যায়।

মিচেল সামনে ঝুঁকে খোলা জানলা দিয়ে কেডকে একবার ভাবলেশহীন চোখে দেখল। তারপর স্লাইডারের দিকে চেয়ে চোখ গরম করে বলল, তুমি যদি ভেবে থাক আমি সকাল থেকে এই বদমাতালটাকে পাহারা দেব, তোমার মাথা পরীক্ষা করাও।

স্লাইডার হাত নেড়ে বলল আরে না, না, ওকে পাহারা দিতে হবে না। চাও তো ওকে ঘরে বন্ধ করে রাখ। মোটামুটি আমি ঝামেলা চাই না।

গজর গজর করতে করতে মিচেল শেভ্রলের দরজাটা খুলে কেডকে বলল, উঠে পড়। আর ঝামেলা করলে দেখিয়ে দেব।

কেড গাড়িতে উঠে হাঁটুর ওপর ব্যাগটা রাখল। নির্জন রাস্তা দিয়ে হাইওয়ের দিকে গাড়ি ছুটে চলল। হাইওয়েতে যখন পৌঁছল তখন গাড়ির স্পীড ঘন্টায় সত্তর মাইল।

কেড জানলা দিয়ে বাইরে দেখছিল। পথে কোন গাড়ি নেই। এ যাবৎ শুধু একটা পুলিশের গাড়ি চোখে পড়েছে। গাড়ি চালাতে চালাতে মিচেল নীচুস্বরে কেডকে গালি দিচ্ছিল।

শহরের বাইরে পৌঁছে মিচেল গাড়ির স্পিড কমাল। ওদের গাড়ি এখন মেন স্ট্রীট দিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দুধারে দোকান–পাট সব বন্ধ। ফুটপাত দিয়ে কেড হাঁটছে না। একটা বড় মোড়ে পৌঁছতেই কেড দেখল পথের ধারে একদল জোয়ান ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা মুগুর দোলাচ্ছে আর ওদের কোমরে বন্দুক।

একটা ছোট রাস্তায় ঢুকে মিচেল হোটেলের সামনে গাড়ি থামাল।

সেন্ট্রাল মোটর হোটেল একটা আধুনিক ধরনের দশতলা বাড়ি। সামনে লন তাতে একটা ফোয়ারা। প্রতিটা ঘরের সামনে বারান্দা। একদম রাস্তার ওপরে।

ওরা দুজন সিঁড়ি দিয়ে হোটেলের দরজার দিকে এগোল। দারোয়ান মিচেলকে দেখে ঘাড় নাড়াল। আর কেডের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল। সুইংডোর ঠেলে ওরা হোটেলের রিসেপশনের দিকে এগোল।

রিসেপশনের কেরানীটি কেডের হাতে একটা রেজিস্ট্রেশন কার্ড আর কলম দিল। কেডের হাত এত কাঁপছে যে সে অতিকষ্টে প্রয়োজনীয় কথাগুলো লিখল।

কেরানীটি বলল, ৪৫৮ নম্বর ঘর বলে চাবি দিল। কেরানীটিকে খুব বিব্রত দেখাল যেন কোন ভিখারীর সাথে তাকে কথা বলতে হচ্ছে।

মিচেলই চাবিটা নিল। তারপর হোটেলের ছোকরা বেয়ারাটাকে আসতে মানা করে স্বয়ংক্রিয় লিফটের দিকে এগোল।

চারতলার লম্বা টানা বারান্দা পেরিয়ে ওরা দুজন ৪৫৮ নম্বর ঘরে এসে পৌঁছল। মিচেল দরজা খুলল। ঘরটা বেশ বড় আর সুসজ্জিত। দরজা খুলে মিচেল ঝুলবারান্দায় গিয়ে রাস্তার দিকে দেখল। বুঝল ওদিক দিয়ে কেড পালাতে পারবে না। তারপর খুশী হয়ে ও ঘরে ফিরে এল।

কেড ব্যাগটা বিছানার উপর রাখল। অসম্ভব ক্লান্ত লাগছে ওর। পা–টাও ব্যথা করছে। কিন্তু মিচেল না যাওয়া পর্যন্ত ও বসতেও পারছে না।

ওকে মিচেল বলল। যাওয়ার সময় পর্যন্ত তুমি এখানেই থাকবে। আমি কাছাকাছিই থাকব। কিছু চাই তোমার?

কেড সামান্য ইতস্ততঃ করল। গত সন্ধ্যা থেকে তার পেটে কিছু পড়েনি। কিন্তু তার ক্ষিধেও তেমন পাচ্ছিল না। কেড খায় খুব কম। সে মিচেলের দিকে না চেয়ে বলল, এক বোতল স্কচ আর বরফ।

–দাম দিতে পারবে?

–হ্যাঁ।

 দরজা টেনে দিয়ে মিচেল চলে গেল। কেড বুঝতে পারল দরজার চাবি যোরাচ্ছে মিচেল। জ্যাকেটটা খুলে ও বড় ইজিচেয়ারে বসল। ওর হাত দুটো এখনও কাঁপছে।

প্রায় দশ মিনিট বাদে একজন ওয়েটার একটা স্কচের বোতল একটা গ্লাস আর বরফ দিয়ে গেল। কেড ওয়েটারের দিকে চাইল না, টিপসও দিল না। মিচেল ওয়েটারের সঙ্গে ঘরে ঢুকেছিল এবার বেরিয়ে দরজায় ফের তালা লাগাল।

কেড কান পেতে শুনল ওরা চলে গেছে কিনা। তারপর গ্লাসে একটা বড় পেগ ঢালল। একটু চুমুক দিয়েই ও টেলিফোনের কাছে গিয়ে রিসিভার তুলল।

একটা মেয়ে উত্তর দিল। কেড নিউইয়র্ক সানের কানেকশানে চাইল। এক মিনিট মেয়েটি বলল।

কেড শুনতে লাগল। মেয়েটি কথা বলছে কিন্তু কি বলছে শোনা যাচ্ছে না। কয়েক মিনিট বাদে মেয়েটি কাটাকাটা গলায় বলল, আজ নিউইয়র্কের কোন কল নেওয়া হচ্ছে না।

 কেড রিসিভার নামিয়ে রাখল। কার্পেটের দিকে খানিক শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল তারপর ওদিকে গিয়ে মদের গ্লাস তুলে নিল।

.

মিস্টার কেড। উঠুন। মিস্টার কেড!

কেডের মনে হল স্বপ্নের মধ্যে ওকে কে ডাকছে। সে প্রায় যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে চোখ মেলল। বারান্দার দিকের খোলা জানালা দিয়ে কড়া রোদ আসছে, তার চোখ যেন পুড়ে যাচ্ছে।

মিস্টার কেড, প্লিজ…আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।

কেড কোনমতে বিছানা ছেড়ে মাটিতে নামল। ঘরটা এখনও আবছা ক্রমে স্পষ্ট হল। যেই বুঝল একটা লোক ওর খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে ও সঙ্গে সঙ্গে চোখ বুজে ফেলল।

মিস্টার কেড, প্লিজ।

কেড এবার চোখ খুলে দেখল একজন নিগ্রো ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর।

মিস্টার কেড। আধঘণ্টার মধ্যে মার্চ শুরু হচ্ছে। আপনার শরীর ভাল আছে তো? নিগ্রোটি জিজ্ঞেস করল। কেড ভালভাবে তাকাল। লম্বা, রোগা তরুণ এক যুবক। পরনে গলা খোলা সাদা শার্ট, ইস্ত্রি করা কালো প্যান্ট। 

এখানে তুমি কি করছ। কেড চাপা কর্কশ স্বরে বলল, কেমন করে ভেতরে এলে?

সরি, মিঃ কেড। আপনাকে ঘাবড়ে দিতে চাইনি। আমি সানি স্মল। আমি সিভিল রাইটস কমিটির সেক্রেটারী।

কেড ওর দিকে তাকিয়েই থাকল। তার মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য।

আমার গার্লফ্রেন্ড এই হোটেলে কাজ করে। ওই বলল আপনি আপনার কাগজের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ওরা দেয়নি। আর আপনাকে বন্ধ করে রেখেছে। শোনামাত্রই আমি এখানে চলে এসেছি। এই আমাকে চাবি দিল। আমরা চাকর সুইপার আসবার লিফটে যেতে পারি। ওদিকে কেড নজর দেয় না।

সাংঘাতিক এক আশঙ্কায় কেডের মন অন্ধকার হয়ে গেল। তার মাথায় কিছুই খেলছিল না। সে একদৃষ্টিতে স্মলের দিকে চেয়ে রইল।

বেশী সময় নেই, মিঃ কেড। নিন আপনার ক্যামেরা আমি ঠিক করেই রেখেছি। ও ক্যামেরাটা কেডের হাতে দিল। কেডের হাত কাঁপতেই লাগল। কিন্তু ক্যামেরার ধাতব স্পর্শটা হাতে লাগতেই ওর স্তম্ভিত ভাবটা কেটে গেল। কেড কর্কশ গলায় বলল, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। ওর চোখ জ্বলতে লাগল। আমাকে একা ছেড়ে দাও। বেরোও।

মিঃ কেড। আপনার কি শরীর ভাল নেই, স্মল হতচকিত ভাবে বলল।

বেরোও। কেডের গলা চড়তে লাগল।

 কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনি তো আমাদের সাহায্য করতেই এসেছেন। আসেননি? আজই আমরা টেলিগ্রাম পেয়েছি যে আপনি আসছেন। কি হয়েছে মিঃ কেড? আমরা সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছি যে। মার্চ তিনটের সময় শুরু হবে।

বেরোও। কেড উঠে দাঁড়াল। ডানহাতে মিনোল্টাটা আঁকড়ে ধরে ও বাঁ হাত দিয়ে দরজা দেখাল।

বেরোও, কখন মার্চ শুরু হবে তাতে আমার কিছু এসে যায় না। বেরোও।

 স্মল যেন আড়ষ্ট হয়ে গেল।

এ নিশ্চয় আপনার মনের কথা নয় মিঃ কেড, আস্তে কোমল গলায় স্মল বলল। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কেডের ভেতর অবধি শিউরে উঠল। দয়া করে আমার কথাটা শুনুন মিঃ কেড। আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফটোগ্রাফার। আমি, আমার বন্ধুরা অনেক বছর ধরে আপনার তোলা ছবি দেখে আসছি। আপনার ছবি আমরা জমাই, মিঃ কেড। সেই রাশিয়ানরা যখন যায় তখনকার হাঙ্গেরীর সেইসব অপূর্ব ছবি, ভারতে দুর্ভিক্ষের ছবি, হংকঙে দুর্ভিক্ষের ছবি, মানুষের দুঃখ কষ্টের অনবদ্য সেইসব দলিল। আপনার মতন অদ্ভুত প্রতিভা আর মানুষের প্রতি দরদী অনুভূতি আর কজনের আছে, মিঃ কেড।

আমরা তিনটের সময় মার্চ শুরু করছি। পাঁচশোর বেশি লোক মুগুর, বন্দুক আর টিয়ার গ্যাস নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পরার জন্য। তা সত্ত্বেও আমরা মার্চ করছি। আজ রাতের মধ্যে আমাদের শরীর দিয়ে রক্ত ঝরবে, কতজন যে হাসপাতালে যাবে। তা সত্ত্বেও আমরা মার্চ করতে চাই কারণ এই শহরে আমরা আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাই। আমাদের মধ্যে অনেকেই মার্চে যেতে ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু যেই শুনল আপনি আমাদের মার্চের ছবি তুলবেন, তাদের ভয় কমে গেল। অদ্ভুত এক উদ্দীপনা দেখা দিল। আমরা জেনে গেছি আজ আমাদের কপালে যাই ঘটুক সারা পৃথিবীতে তার প্রমাণ থেকে যাবে। সারা পৃথিবী বুঝবে আমরা কি চাই। আমাদের একমাত্র আশা পৃথিবীর মানুষকে বোঝানো আমরা কি চাই, আমাদের নৈতিক দাবি তাদের কাছে জানান। আপনি আমাদের হয়ে এই বার্তা পৃথিবীর কাছে পৌঁছে দিতে পারেন।

স্মল একটু থামল, আপনি ভয় পেয়েছেন নিশ্চয়? আমরা সবাই ভয় পেয়েছি। কিন্তু আমি ভাবতেও পারছি না আপনার মতন সৎ, গুণী মানুষ আমাদের মিছিলে আজকে থাকবেন না।

কেড পা টেনে টেনে রাইটিং ডেস্কের দিকে গেল। ক্যামেরাটা টেবিলের উপর রেখে সে গ্লাসে হুইস্কি ঢালল।

ভুল লোককে ওরা হিরো বানিয়েছিল এখন বেরোও নিগার বেরিয়ে যাও, স্মলের দিকে পেছন ফিরে কেড বলল।

ঘরের মধ্যে কয়েক মুহূর্তের নীরবতা নেমে এলো। আবেগঘন, টানটান অনুভূতিতে মন্থর এক দীর্ঘ নীরবতা। তারপর স্মল বলল, আমার দুঃখ হচ্ছে মিঃ কেড আমাদের জন্য নয়, আপনার জন্য।

আস্তে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, চাবি বন্ধ হল। কেড কিছুক্ষণ হাতের গ্লাসটার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ঘৃণায় যেন শিউরে উঠল। সামনের দেয়ালে গ্লাসটা ছুঁড়ে মারল। দেয়াল থেকে ছিটকে আসা হুইস্কিতে তার শার্ট ভিজে গেল। কিছুক্ষণ ও কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইল, মন থেকে সমস্ত চিন্তা প্রাণপণে সরিয়ে দিতে চাইল। হঠাৎ বন্ধ জানালার ওপার থেকে এক তীব্র বুক কাঁপানো নারীকণ্ঠের আর্তনাদ ক্ষীণ হয়ে ভেসে এল। কেড উঠে দাঁড়াল। তার বুক ধকধক করতে লাগল। আবার সেই আর্তনাদ ভেসে আসল।

কাঁপতে কাঁপতে কেড দরজা খুলে ঝুলবারান্দাটায় গিয়ে দাঁড়াল।

ঘরে ছিল শীততাপ–নিয়ন্ত্রিত শীতলতা। এখন রাস্তা থেকে ঝাপসা শ্বাসরোধকারী গরম উঠে এসে যেন তাকে ধাক্কা দিল। কেড বারান্দার রেলিং আঁকড়ে ধরে সামনে ঝুঁকে রাস্তার দিকে চাইল।

সানি স্মল ঠিক রাস্তার মাঝখানটায় দাঁড়িয়ে। তার হাত দুটো উত্তেজনায় টানটান, মুঠো পাকানো। দুপুরের কড়া রোদে ওর আবলুশ কালো শরীরের ওপরে শার্টটা অসম্ভব সাদা দেখাচ্ছে। প্রথমে ডান দিকে চাইল ও, তারপর বাঁ দিকে। কার দিকে হাত নাড়িয়ে স্মল তীক্ষ্ণ, তীব্র গলায় বলল, এস না, টেসা। আমার কাছে এস না। ওর গলার স্বর কেডের কানে বাজল।

কেড রাস্তার ডানদিকে চাইল। তিনজন শ্বেতাঙ্গ উন্মত্তের মতন স্মলের দিকে ছুটে আসছে। বিশাল দেহ, বলিষ্ঠ তিন শ্বেতাঙ্গ ওদের হাতে মুগুর। বাঁ দিকে তাকাতেই কেড দেখল ওদিক দিয়ে দুজন শ্বেতাঙ্গ ধীরে ধীরে স্মলের দিকে এগোচ্ছে। ওদের হাতেও মুগুর। আক্রান্ত আর আক্রমণকারীদের এ ছবি চিরকালের, চিরপরিচিত। স্মলের পালানোর কোন উপায়ই নেই।

বোঁ করে ঘুরে কেড প্রায় হাতড়ে হাতড়ে ঘরে চলে এল। ক্যামেরাটা ঝটিতি তুলে নিল। ঝটপট ৫৮ সি. এম. লেন্সটা খুলে ফেলে, ওভারনাইট ব্যাগটা উপুড় করে বিছানায় ঢালল। তারপর ২০ সি. এম. টেলিফোটো লেন্স নিয়ে প্রায় টলতে টলতে ব্যালকনিতে চলে এল। বহু বছর ধরে ক্যামেরা ব্যবহার করছে কেড, ওর এখন প্রতিটি গতিবিধি এমন নিশ্চিত ও দ্রুত যে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতন। ক্যামেরার লেন্সমাউন্ট খট করে বসে গেল। ১/১২৫–য়ে সাটার আর এফ ১৬–য় অ্যাপারচার দিল কেড। ভিউফাইন্ডার দিয়ে দেখে নিল। নিঃসহায় নিরস্ত্র নিগ্রোটি আর তার চারিদিক থেকে ঘিরে আসা আততায়ীদের চেহারা, এক ভয়ংকর হিংস্রতার ছবি

যেন কোন অলৌকিক উপায়ে কেডের হাতের কাঁপুনি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ও সাটার টিপতে থাকল।

নিচে, পথে একটা লোক ছুটতে ছুটতে বলল, এই কুত্তীর বাচ্চা নিগারটা সেই স্মল! মার ব্যাটাকে তার গলায় পৈশাচিক উল্লাস যেন।

লোকগুলো যখন স্মলকে ঘিরে ফেলল তখন স্মল কুঁকড়ে গিয়ে হাতদুটো আড়াআড়ি করে মাথা ঢাকল। ওর হাতের উপর একটা মুগুরের বাড়ি পড়ল। স্মল হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। রোদে আরেকটা মুগুর ঝলসে উঠল। ছবি তুলতে তুলতে কেড স্পষ্ট শুনতে পেল মুগুরের আঘাতে হার ফেটে যাওয়ার আওয়াজ।

নিগ্রোটি রাস্তায় পড়ে গেল। পাঁচটা লোক ওকে বিজয় উল্লাসে যেন ঘিরে ফেলল। দশটা ধুলোমাখা, ভারি বুটজুতোর ফাঁকে ফাঁকে উজ্জ্বল লাল রক্ত গড়িয়ে রাস্তায় যেন নক্সা কাটতে লাগল।

পাঁজরায় মুগুরের আঘাত পরতেই স্মলের শরীরটা ছটফট করে উঠল। একটা লোক আরেকটা লোককে ঠেলে সরিয়ে নিগ্রোটির কাছে গিয়ে ওর গালের হাড়ের ওপর ধাঁই করে বুট দিয়ে লাথি মারল। ফিনকি দিয়ে রক্ত উঠে লোকটার জুতো আর প্যান্ট ভিজিয়ে দিল।

চারতলা থেকে ক্যামেরার সাটার নির্ভুল ভাবে তার কাজ করে চলল।

এই সময় হোটেল থেকে একটা পাতলা, ছিপছিপে নিগ্রো মেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে এল। মেয়েটি লম্বা, ওর কোকড়া চুলগুলো এলোেমলো, গায়ে একটা সাদা পোষাক, খালি পা। সাংঘাতিক জোরে মেয়েটি ছুটছে।

কেডের ২০ সি. এম. লেসে স্পষ্টভাবে মেয়েটি ধরা পড়ল। ওর মুখের আতঙ্ক, বিস্ফোরিত চোখ সংকল্পে কঠিন ওষ্ঠাধর….সব।

মেয়েটি যখন স্মলের কাছে গিয়ে পৌঁছাল তখন একটা লোক স্মলকে আবার মুখে লাথি মারতে যাচ্ছে। মেয়েটি হিংস্র নখ দিয়ে লোকটার মুখ ছিঁড়ে দিল। তারপর, ও স্মলকে আড়াল করে লোকগুলির মুখোমুখি দাঁড়াল।

লোকগুলি প্রথমে একটু পিছিয়ে গেল। উত্তেজনাভরা সন্ত্রস্ত এক মুহূর্ত মাত্র। তারপরেই যে লোকটার মুখ নখে আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে সে একটা পৈশাচিক চীৎকার করে মুগুর ওঠাল। মেয়েটা মাথা বাঁচাতে হাত তুলল। মুগুরটা হাতের ওপর গিয়ে পড়ল। হাতটা অচল হয়ে গিয়ে পাশে ঝুলে পড়ল। কালো মাংসের ভেতর দিয়ে সাদা দাঁতের মতন সাদা হাড় ভেঙ্গে বেরিয়ে এল।

মার মার কালা কুত্তীটাকে। লোকগুলি চেঁচাল। এরপর অনেকগুলি মুগুর উঠে মেয়েটির মাথার ওপর গিয়ে পড়ল। মেয়েটি স্মলের ওপর পড়ে গেল। ওর সাদা পোষাক কোমর অবধি গুটিয়ে গেল। লম্বা, কালো পাতলা পা দুটো ছড়িয়ে পড়ল।

রাস্তার অন্যপ্রান্ত থেকে এবার পুলিশের গাড়ির তীক্ষ্ণ হুইল শোনা গেল।

পাঁচজন লোক ঝট করে ঘাড় তুলল। দুজন ডেপুটি ওদের দিকে দেখছে। রোদে ঝকঝক করছে বুকের ব্যাজ। মুখের এদিক থেকে ওদিক অবধি হাসি ছড়িয়ে আছে। খুব ধীরে ধীরে ওরা এগোল। যে লোকটার মুখ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে, সে মুগুরটা ধরে বাটটা দিয়ে মেয়েটির ফাঁক করা দুপায়ের মাঝখানে চালিয়ে দিল। ওর একজন সঙ্গী ওকে ধরে টেনে নিয়ে গেল।

ওদিকে ডেপুটিরা ধীর পায়ে প্রায় থেমে থেমে এগোচ্ছিল। পাঁচজন লোক এবার পেছোতে লাগল। অচৈতন্য রক্তাক্ত নিগ্রো দুটির কাছে ডেপুটিরা যখন পৌঁছল, পাঁচজন লোক তখন হাওয়া।

কেড ব্যালকনি থেকে সরে এল, ক্যামেরা নামাল। ওর কাপনি আবার শুরু হয়েছে বটে তবে কেড বুঝল ফ্রিডম মার্চের চেয়ে এ ছবির বক্তব্যে অনেক জোর থাকবে।

এখন তার চাই একটা ড্রিংক।

টলতে টলতে ও ঘরের ভেতর এল, তারপরেই ওর পা দুটো মেঝেতে আটকে গেল। মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা তুষারশীতল স্রোত নামতে লাগল।

খোলা দরজায় মিচেল দাঁড়িয়ে, ওর চোখ দুটো পাথরের মতন। দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইলো। তারপর মিচেল ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজায় চাবি দিল।

ক্যামেরাটা আমায় দে, কুত্তার বাচ্চা। হিংস্র স্বরে মিচেল বলল।

কেড মনে মনে বলল, এও কি সম্ভব? আমি এক বছরে নিজের শরীর মন এত নষ্ট করে ফেলেছি যে এই খেলো গুণ্ডাটাকে দেখে আজ আমি ভয় পাচ্ছি। লোকটার গায়ে খুব জোর। ও ঝট করে আক্রমণ করলে আমি কিছুই করতে পারব না। ও আমায় তুলোধোনা করে ছাড়বে। ক্যামেরাটাও নিয়ে নেবে।

ক্যামেরাটা দে, কি বলছি শুনছিস?

কেড পিছোতে লাগল। ক্যামেরা থেকে কাঁপা হাত দিয়ে সে ২০ সি. এম. লেন্সটা খুলে ফেলল। তারপর বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে দিল লেটা। তারপর পেছোতে পেছোতে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিচেল আস্তে আস্তে এগোল।

আমি ছবি তুলতে দেখেছি তোমাকে। তোমাকে আমি সাবধান করে দিইনি আগে? দাও, ক্যামেরা দাও।

ক্যামেরা নাও, কেড রুদ্ধশাসে বলল, শুধু আমার গায়ে হাত দিও না। ও গলা থেকে ক্যামেরার স্ট্র্যাপ খুলল।

মিচেল একটু দাঁড়াল। মুখে তাচ্ছিল্য আর ঘৃণার হাসি।

কেডের ডান হাতে ক্যামেরার স্ট্র্যাপ। মুখ রক্তশূন্য, ফ্যাকাশে। গলা দিয়ে ঘরঘর করে নিঃশ্বাস বেরোচ্ছে। ওর মুখে তীব্র আতঙ্ক। কেডকে এখন এমন একটা তুচ্ছ ঘৃণ্য পোকার মতন দেখাচ্ছে, যে মিচেল চালে ভুল করে বসল। সে একটু অসতর্ক হয়ে পড়ল। আঙ্গুল মটকাতে মটকাতে ভাবতে লাগল ওর আতঙ্কগ্রস্ত মুখের ওপর ও কখন ঘুষিটা বসাবে।

দাও, ও হাত বাড়াল।

সেই মুহূর্তে কেডের মধ্যে কি যেন একটা ওলোটপালট হয়ে গেল। চিরকাল ও ওর ক্যামেরাটাকে সমস্ত দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়ে এসেছে। কেড ওর ক্যামেরায় আঁচড় বসাতে পারেনি। ওর সমস্ত অনুভূতি এক মুহূর্তে প্রখর হয়ে উঠল। অজান্তেই ডানহাতটা শক্ত করে বাগিয়ে ও বিদ্যুৎবেগে হাতটা দোলাল। স্ট্র্যাপে বাঁধা ক্যামেরাটা গুলতির মতন ছুটে গিয়ে মিচেলের তাচ্ছিল্যমাখা হাসি মুখটার উপর ঠাস করে লাগল। মিচেল মুখ সরাবার একটু সুযোগও পেল না। ভারি ধাতব ক্যামেরার কোনটা ওর কপালের রগে গিয়ে লাগল। চামড়া কেটে গেল। মিচেল হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। চোখ ভাসিয়ে রক্ত পড়ছে। আধো অচৈতন্য হয়ে মিচেল কেডের সামনে বসে পড়ল হাঁটুতে ভর দিয়ে। চোখ দুটো রক্তে প্রায় বুজে গেছে।

কেড স্তব্ধভাবে ভয়ার্ত অবিশ্বাস্য চোখে মিচেলের দিকে তাকিয়ে থাকল। ক্যামেরাটা মিচেলকে আঘাত করে ফিরে এসে কেডের হাঁটুতে সজোরে মারল, কেড টেরই পেল না। ওর

অবশ আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে স্ট্রাপটা পিছলে গেল। ক্যামেরাটা পড়ে গেল মাটিতে।

মিচেল মাথাটা একটু ঝাঁকাল। ব্যথায় কাতরে উঠল। তারপর অতিকষ্টে বাঁ হাতের উপরে শরীরের ভর রাখল। ডানহাতটা কোমরের কাছে নিয়ে এল। ৪৫ রিভলবারের বাঁটটা খুঁজতে লাগল।

কেড ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অজান্তেই ২০ সি. এম. লেন্সটা তুলে নিল। মিচেল যেই পিস্তলটা টেনে বার করতে যাবে, অমনি কেড ওর কাছে গিয়ে লম্বা লেন্সটা দিয়ে প্রাণপণে ওর মাথার ওপর মারল। মিচেলের শরীরটা প্রথমে একটু দুলে উঠল তারপরেই অচল হয়ে কার্পেটের ওপর এলিয়ে পড়ে গেল।

ভীষণ শরীর খারাপ লাগছে কেডের। মনে হচ্ছে নিঃশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে যাবে এক্ষুনি। বুকের ভেতর যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। দু হাতে মাথা টিপে কেড অনেকক্ষণ বিছানার উপর বসে থাকল, জোর করে শরীরের ঝিমঝিম ভাবটা কাটাবার চেষ্টা করল। তারপর প্রায় অমানুষিক শক্তিতে নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াল। ক্যামেরাটা তুলে নিয়ে ফিল্ম গোটাতে লাগল। এত হাত কাঁপছে যে বেশ খানিকক্ষণ সময় গেল। শেষ পর্যন্ত ও ক্যামেরা থেকে ফিমের কাট্রিজটা বের করল।

মিচেল একটু নড়ে উঠল। কেড টলমল পায়ে জ্যাকেট গায়ে গলিয়ে নিল। ডান পকেটে কাট্রিজটা রাখল। ক্যামেরাটা সঙ্গে নেবে ভাবতে গিয়ে ইতস্ততও করল বটে, কিন্তু এও বুঝল যে ইস্টনভিলের রাস্তা দিয়ে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে আনা।

হোটেলের করিডরটা একদম নির্জন। কি করবে ভাবল কেড। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল স্মল বলেছিল চাকর ও সুইপারদের লিফটের ওপর কেড নজর রাখেনা। দ্রুত হেঁটে ও সার্ভিস লেখা দরজাটা ঠেলে একটা লবিতে ঢুকল। ওঃ সে যদি আধখালি হুইস্কির বোতলটা এখন আনত। ফিরে যেতে লোভ হল ওর। নিজেকে প্রাণপণে সংযত করল কেড।

লিফটের বোম টিপল কেড। ঘড় ঘড় করে নিঃশ্বাস পড়ছে তার। যদি এখন একটু মাথা ঠাণ্ডা করে সব গুছিয়ে ভাবতে পারত। কেমন করে সে ইভিল থেকে পালাবে? কাল সকালের আগে প্লেন নেই। সবচেয়ে ভাল হোত যদি ও কোন মোটর ভাড়া করতে পারত। কিন্তু মিচেল পুলিশকে ঠিকই খবর দেবে আর ওরা ওর মোটর আটকাবেই। যদি কেড ট্রেনে করে পালাতে পারত।

লিফটের দরজা খুলে গেল। ঘড়ির দিকে তাকাল কেড। তিনটে বেজে দশ। ফ্রীডম মার্চ শুরু হয়েছে। তাই এই সময়ে কেড একটা পালাবার সুযোগ পেলেও পেতে পারে। পুলিশ আর ডেপুটিরা মিছিল পণ্ড করতেই ভয়ানক ব্যস্ত থাকবে।

লিফট থামল। সামনে একটা প্যাসেজ। তারপর একটা খোলা দরজা। কেড তাড়াতাড়ি প্যাসেজটা পেরিয়ে দরজা দিয়ে একটা সরু গলিতে এসে পড়ল। গলিটা হোটেলের পেছন বরাবর চলে গেছে। একটা লোকও নেই গলিতে।

কেডের পা কাঁপছে। কিন্তু যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে সে হাঁটতে লাগল। বড় রাস্তায় পড়বার আগেই ওরই একটা সমান্তরাল সরু গলিতে ঢুকে পড়ল কেড।

নিয়ন আলোতে লেখা গ্যারাজ লাইনটা চোখে পড়ল হঠাৎ। শ্বাস প্রায় বন্ধ করে রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে কেড গ্যারাজে এসে ঢুকল।

একটা মোটা লোক একটা পন্টিয়াক গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। কেড এগিয়ে আসতেই ও সোজা হয়ে দাঁড়াল।

কেড যথাসম্ভব শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করল, আমি একটা গাড়ি ভাড়া করতে চাই।

বেনসন মোটা লোকটা স্যাঁতসেঁতে হাতটা এগিয়ে দিল। অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও কেড হাতটা ধরে আঁকাল।

গাড়ি ভাড়া করতে চান। কোন ঝামেলা নেই। আমার অনেক গাড়ি আছে। কতক্ষণের জন্যে?

কেডের হঠাৎ মনে পড়ল ম্যাথিসন যে তাকে একশো ডলার দিয়েছে তার থেকে মোটে আশি ডলার আর কয়েকটা সেন্ট পড়ে আছে। এত মদ খেয়েছে বলে তার আফশোষ হল। অথচ ওর এখন মদ দরকার।

কেড গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলল, দু ঘণ্টার জন্য। এই কাছাকাছি ঘুরে আসব। যা গরম।

কুড়ি ডলার। বেনসন চটপট বলল, ডিপোজিট আর ইনসিওরেন্সের জন্য নব্বই ডলার দিতে হবে, তবে ওটা ফেরত পাওয়া যাবে।

এই সময় কেড মারাত্মক ভুল করে বসল। অতিরিক্ত মদ্যপানে তার চিন্তাশক্তি এতই ভোতা হয়ে গিয়েছে যে সে বলে বসল, দেখুন, হার্টজ–য়ে আমার ক্রেডিট কার্ড আছে। আমি বিশ ডলার এখনি দিচ্ছি। তবে ডিপোজিট দিতে পারব না। বলে কার্ডটা বেনসনের হাতে দিল।

যেই লোকটা কার্ডটা দেখতে লাগল, কেড নিজের ভুল বুঝতে পারল। কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে। লোকটা কুৎসিত থমথমে মুখে বলল নিগ্রোপ্রেমীদের আমরা গাড়ি ভাড়া দিই না। যাও, ভাগো। বলে কার্ডটা ফিরিয়ে দিল।

কেড মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে লাগল। ওর ছুটতে ইচ্ছে করল। রাস্তাটার শেষপ্রান্তে এসে বাঁ দিকে ঘুরে ও একটা নোংরা গলির ভেতর ঢুকে পড়ল। গলিটার সামনেই বড় রাস্তা। গলির মাঝামাঝি জ্যাকস বার লেখা একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে। প্রথমে কেড জোর করে এগিয়ে গেল। কিন্তু কয়েক গজ এগিয়েই সে থমকে দাঁড়াল। তার মদ এখন ভীষণ প্রয়োজন। কেড জানে এক মিনিট সময়ও তার নষ্ট করা উচিৎ নয়। কিন্তু তার মদ চাই–ই। নইলে ও আর হাঁটতে পারবে না। তাড়াতাড়ি পিছিয়ে এসে বারের সুইংডোরটা ঠেলে ও ভেতরে ঢুকে পড়ল। একটা ঘিঞ্জী নোংরা বার।

একটা বুড়ো নিগ্রো বারম্যান ছাড়া বারটা একদম ফাঁকা। কেডকে দেখে বারম্যানটা ভয়ে যেন জমে গেল।

আমায় ভয় পাবার দরকার নেই। কেড বলল, হোয়াইট হর্স আর বরফ। এখনই চাই।

বুড়ো নিগ্রোটি একটা বোতল, একটা গ্লাস আর এক বাটি বরফ কেডের সামনে রেখে অপর প্রান্তে চলে গেল।

দ্বিতীয় পেগের পর কে একটু সহজভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারল। গলিটা কি চুপচাপ। ফ্রীডম মার্চের এখন কি হচ্ছে কে জানে।

বলতে পার কেমন করে আমি একটা গাড়ি পেতে পারি। কেড হঠাৎ বেপোয়রায়া হয়ে বলল, আমাকে শহর থেকে পালাতে হবে।

বৃদ্ধ নিগ্রোটি দু কঁধ সঙ্কুচিত করল, যেন কেড তাকে মারতে যাচ্ছে।

সে মুখ না ফিরিয়ে বলল, আমি গাড়ি টাড়ির খবর রাখি না।

সেন্ট্রাল মোটর হোটেলের সামনে তোমাদের দুজন আজকে খুব মার খেয়েছে। সাংঘাতিক আহত। শুনেছ?

বৃদ্ধ নিগ্রোটি বলল এ শহরে কে কি বলে আমি জানি না।

তোমার স্বজাতি সম্পর্কে ওভাবে বোল না। আমি নিউইয়র্কের একজন সাংবাদিক। তোমার সাহায্য চাই।

বৃদ্ধ নিগ্রোটি এবার ঘুরে কেডের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকাল। তারপর সতর্ক গলায় বলল, আপনি বোধহয় মিথ্যে বলছেন।

কেড ওর মানিব্যাগ বার করে প্রেস কার্ডটা রাখল।

 বৃদ্ধ নিগ্রোটি এবার সামনে এগিয়ে এল। তারপর নিকেলের তোবড়ানো চশমা বার করে পরল। একবার কার্ডের দিকে তাকায়, আরেকবার কেডের দিকে চায়। হঠাৎ ও বলে, উঠল আমি আপনার কথা শুনেছি। ওরা ভেবেছিল আপনি ওদের সঙ্গে মার্চ করবেন।

জানি, ওরা আমাকে হোটেলে বন্ধ করে রেখেছিল। অনেক কষ্টে বেরিয়ে এসেছি।

যে দুজনকে ওরা হোটেলের বাইরে মেরেছিল, ওরা মারা গেছে।

কেড নিঃশ্বাস টানল। ঠিক জান?

জানি। আপনার এখান থেকে এখনি চলে যাওয়া উচিৎ। ওরা যদি আপনাকে এখানে দেখে, আমাকেও মেরে ফেলবে।

আমি ছবি তুলেছি। যে পাঁচটা লোক ওদের মেরেছে, ওদের আমি কঁসিকাঠে ঝোলাব। তুমি আমাকে একটা গাড়ি যোগাড় করে দিতে পার।

আমার গাড়ি নেই।

সহসা বাইরে পুলিশের গাড়ির তীক্ষ্ণ ইসলে বাতাস দীর্ণ–বিদীর্ণ হয়ে গেল। দুজনেই চমকে গেল। কেড তাড়াতাড়ি আরেকটা ড্রিংক ঢেলে নিল। এখন তার মাথা খুব পরিষ্কার কাজ করছে। মদটা গলায় ঢেলে ও মানিব্যাগ থেকে পাঁচ ডলারের একটা নোট একটা নামলেখা কার্ড আর ফিলমের কাট্রিজটা বার করে।

ওরা হয়তো আমাকে ধরবে, কেড বলে। কিন্তু এ ছবি ওদের হাতে কিছুতে দেওয়া চলবে না। তোমাকে এগুলো নিউইয়র্কে সানের অফিসে পাঠাতে হবে বুঝেছ? তুমি বুড়ো হয়েছ, তুমি গরীব, তুমি খুবই ভয় পেয়েছে আমি জানি। কিন্তু যে দুজনকে ওরা আজ মেরে ফেলল, তাদের দিকে তাকিয়ে তোমাকে এটুকু করতেই হবে। এই ফিল্ম আর আমার কার্ডটা নিউইয়র্ক সান–এ তোমায় পাঠাতেই হবে।

তাড়াতাড়ি কেড দরজার কাছে চলে যায়, সুইংডোরটা ঠেলে ও গলিতে পা দিল।

আবার পুলিশের হুইল বেজে উঠল। গলিটা এখন জনমানব শূন্য। কেড মোড়ের দিকে হাঁটতে থাকল। বুকের হৃৎপিণ্ডটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাচ্ছে। তবু ওর একটা আশ্চর্য আনন্দ হচ্ছিল। ও বুঝেছে নিগ্রো বৃদ্ধ যেমন করেই হোক ম্যাথিসনকে ছবিগুলো পৌঁছে দেবে। কেডের এখন যাই হোকনা কেন, ওর এসে যায় না। তার সব গ্লানি ধুয়েমুছে গেছে। সে নিজেকে অনেক হাল্কা মনে করছে।

তিনটে লোক রাস্তার কোণ থেকে এসে মুগুর হাতে ওকে ঘিরে ফেলল। কিন্তু কেড. ওর চলার গতি থামাল না।

.

০২.

 ইস্টনভিলে আসার চোদ্দ মাস আগে কেড মেক্সিকোর সমুদ্রতটে শৌখিন রঙ্গভূমি অ্যাকাপুলকোতে স্যানডে টাইমসের রঙিন ক্রোড়পত্রের জন্য ছবি তুলছিল।

তখন কেডের অসাধারণ ফটোগ্রাফার হিসেবে খুব নামডাক। সম্পূর্ণ ফ্রি–লান্স কাজ করে ও, ছবিগুলো এক কথায় অসাধারণ। নিউইয়র্কে ওর এজেন্ট স্যাম ওয়াল্ড সেগুলি নিমেষে বিক্রী করে দেয়। কেডের ব্যাঙ্কের একাউন্টে টাকা জমতেই থাকে।

কেডের জীবনে সে এক মহাসৌভাগ্যের সময়। সে বিখ্যাত, ধনী। সবাই তাকে এক ডাকে চেনে। তার স্বাস্থ্য ভাল। অথচ খ্যাতি ওর চরিত্র নষ্ট করেনি। সাফল্য ওর মাথা ঘোরায়নি। তবুও অনন্য প্রতিভাবানদের মতনই তার চরিত্রে কিছু পরস্পর বিরোধী বৈশিষ্ট্য ছিল। সে ছিল বেহিসেবী, বড্ড বেশী মদ খেত, সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গ কামনা করত। অপরদিকে সে ছিল দয়ালু কোমল প্রকৃতির। নিপীড়িত সর্বহারাদের একরকম সে যেন মুখপাত্র ছিল। স্ত্রী বা সংসার না থাকায় সে নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করত। মানুষটা ছিল সাধাসিধে সাধারণ। ওর প্রতিভাই ছিল অসাধারণ। সারা পৃথিবীটা সে ঘুরে ঘুরে মানবদরদী ফটোগ্রাফার হিসেবে অসহায়দের ওপর অত্যাচার, তাদের দুঃখ দুর্দশার ছবি তুলত। তার সারা সময়টা কাটত ট্রেনে, প্লেনে নয়তো গাড়িতে।

রেডইন্ডিয়ানদের জীবনযাত্রার কয়েকটি সূক্ষ্ম, খুবই অনুভূতি প্রবণ ছবি তুলে ও তখন সবে অ্যাটিটলান হ্রদের তীরে সান্টিয়াগো থেকে ফিরছে। ছবিগুলোতে রেডইন্ডিয়ানদের জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত, ধুলো ময়লার গন্ধও যেন পাওয়া যায়। বোঝা যায় শুধু অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে রেডইন্ডিয়ানরা কি অমানুষিক সংগ্রাম করছে।

এই ছবিগুলোর বিপরীত জীবনের বিষয়বস্তু তখন খুঁজছিল কেড। তাতে রেড ইন্ডিয়ানদের ওপর তোলা ছবিগুলি আরো মর্মস্পর্শী হবে। সাদায়–কালোয় মেশানো বিপরীত একটা এফেক্ট।

তাই ওর অ্যাকাপুলকোয় আসা। যেসব অলস, বিলাসী মোটা মাংসল উচ্ছংখল নরনারী শবদেহের মতো সী বীচে পড়েছিল তাদের ছবি সে তার ২০ সি. এম. টেলিফোটো লেনসে তুলছিল।

কেড তখন হিলটন হোটেলে আছে। ওর ভোলা ছবিগুলো স্যাম ওয়ান্ডের কাছে রওনা হয়ে গেছে। একটা শক্ত কাজ করবার পর ভেতরটা যেমন হালকা হয়ে যায়, সেরকমই হয়েছিল কেডের। সে সুইমিং পুলটার পাশে ক্যাম্বিসের আরামচেয়ারে এক গ্লাস টেকুইলা কলিন্স হাতে নিয়ে বসে তার ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্পর্কে ভাবছিল।

সামনে একেবারে অসভ্য প্রায় নগ্ন কতগুলো আমেরিকান টুরিস্টবর্বরোচিত ভাবে হইচই করতে করতে জলে ঝাপাঝাপি করছিল। কেড ওদের বিতৃষ্ণার সঙ্গে দেখছিল। এই বুড়োদের হাতে এত টাকা? অথচ কত যোগ্য তরুণদের কোন টাকাই নেই, এইভেবে তার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল।

পানীয়টা শেষ করে ব্রীজ পার হয়ে ও সমুদ্রতটের দিকে এগিয়ে গেল।

সেদিন নিয়তি ওর সঙ্গে এক ভয়ংকর খেলা খেলল। ওর জীবন, ওর মৃত্যু সব যেন নির্ধারিত করে দিল সেই সর্বনাশা নিয়তি। সেই রোদজ্বলা মধ্যাহ্নে ও দেখা পেল জুয়ানা রোকাকে। এই জুয়ানা রোকাই কেডকে ধ্বংস করতে করতে সর্বনাশের শেষ কিনারায় নিয়ে এসে দাঁড়। করিয়েছিল। তার ভেতরকার চমৎকার মানুষটাকে শেষ করে দিয়েছিল পুরোপুরি। শোচনীয় পরিণতির শেষ অবস্থায় পৌঁছে একদিন ইস্টনভিলে বর্ণবিদ্বেষী কিছু মানুষের হাতে ওর প্রাণটাই প্রায় চলে গিয়েছিল।

মেক্সিকোর মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়, খুব অল্প সংখ্যক মেয়েরাই শরীরের যত্ন নেয়। যারা নেয় না তারা হয়ে পড়ে মোটা আর কুৎসিত। জুয়ানা রোকা মেক্সিকান, ওর বয়েস এখন সতেরো। গড়পড়তা আমেরিকান মেয়েদের ছাব্বিশ বছর বয়সে শরীরে যে পূর্ণতা আসে জুয়ানার এখনই তা এসে গেছে। রেশমের মতন চুলের ঢল কোমর অবধি নেমেছে। চোখদুটো গভীর কালো, নাকটা ছোট কিন্তু যেন পাথর থেকে কুঁদে তোলা। ঠোঁট দুটোতে যেন মধুর স্বপ্নের প্রতিশ্রুতি। পুরুষকে পাগল করে দেওয়ার মতন তার শরীরে মদির যৌনাকর্ষণ রয়েছে।

বালির উপর চিৎ হয়ে শুয়েছিল জুয়ানা। ওর কোঁকড়া চুল ঘেরা মুখখানা যেন একটা ছবির মতন। চোখদুটো বোজা। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটতে হাঁটতে কেড জুয়ানার কাছে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ওর নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কেড জীবনে যত নারী দেখেছে জুয়ানা নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে সুন্দরতম। যেন রক্তমাংসের মানবী নয় জুয়ানা। যেন একটা শিল্প যা চোখ ভরে দেখা যায়। আর কেড অনুভব করল ওর শরীরের টানও দুর্বার।

কেডের নিস্পন্দ ছায়া জুয়ানার মুখের ওপর পড়েছিল। জুয়ানা চোখ খুলল। তারপর পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এবার হাসল জুয়ানা। তার মুক্তোর মতন দাঁতের সারি দেখে কেডের ভেতরটা কেমন শিরশির করে উঠল।

একেবারে একা? কেড বলল।

কেন, তুমিই তো আছ, মোহিনীর ভঙ্গিতে জুয়ানা বলল।

 আমি তোমাকে কাল রাতেই দেখেছি। তুমি হিলটন হোটেলে আছ না?

 হ্যাঁ।

জুয়ানা উঠে বসল। তার চুলের কালো রাশ গলায় পেঁচিয়ে বলল, তুমি তো কেড। বিশ্ববিখ্যাত ফটোগ্রাফার।

–কেমন করে জানলে? কেড হেসে বলল।

–আমি অনেক কিছুই জানি। সে খুব আন্তরিক সুন্দর চাহনীতে কেডের দিকে তাকাল। কেড তোমার অনেক ছবি আমি দেখেছি। মাঝে মাঝে তুমি খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়, না?

কেড ওঁর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল।

 এ কথা বলছ কেন?

 বল, আমি সত্যি বলিনি?

কেডের অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল জুয়ানা যেন তার ভেতর অবধি দেখতে পাচ্ছে।

আমার কথা থাক। তোমার কথা বল। তোমার নাম কি?

 জুয়ানা রোকা।

তুমি কি ছুটি কাটাতে এসেছ?

সেরকমই।

কোথায় উঠেছ?

৫৭৭ নম্বর ঘর, হিলটন হোটেলে।

মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে গেল কেড। আমি তো ৫৭৯ নম্বর ঘরে আছি।

জানি, আজ সকালেই ঘর বদলেছি।

 জুয়ানাকে শুধু সুন্দর লাগেনি সেই মুহূর্তে ওর শরীরের অমোঘ সর্বনাশা আকর্ষণের কথাই ভেবেছে কেড। বুঝতে পারল সে নিজের বশে আর নেই। রক্ত দ্রুততালে বইছে, বুক ধড়াস ধড়াস করছে।

জুয়ানা নীল প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে দুর্বোধ্য হাসি হাসল। কটা বাজে?

নির্বোধের মতন তাকিয়েছিল কেড। হঠাৎ সম্বিত পেয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, দুটো বেজে কুড়ি।

— ইস্। তাড়াতাড়ি উঠে জুয়ানা ভিজে ভোয়ালে কোমরে জড়িয়ে নিল। আমাকে যেতেই হবে। দেরি করলে ও ভারি রেগে যাবে।

–কে? শোন, যেওনা।

জুয়ানা কিন্তু ততক্ষণে বালি দিয়ে ছুটতে শুরু করেছে। স্বচ্ছল গতিভঙ্গী ওর। মেক্সিকান মেয়েদের গড়ন এত সুন্দর। কেড বালির উপর বসেই রইল। অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে, তাদের মোহিনীমায়ার জাল কেটে বেরিয়েও এসেছে। কিন্তু এ যেন অদ্ভুত এক অভিজ্ঞতা। তার যেমন আনন্দ হচ্ছে, তেমনি যন্ত্রণাও হচ্ছে সমানে। ঘর বদলিয়েছে, জুয়ানা ওর সঙ্গে ঠাট্টা করছিল নাকি।

ক্যামেরা তুলে নিয়ে ও হোটেলে ফিরে এল। ব্রিজের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খড়ের চালার নীচে ওপেনএয়ার রেস্টুরেন্টের দিকে চেয়ে দেখল।

প্রায় প্রতিটা টেবিলই ভর্তি। স্থূলকায় আমেরিকান মহিলারা কিন্তু বড় রকমের ফুলকাটা টুপি আর সুইমিং স্যুট পরে চেয়ার মুড়ে বসে আছে। রোমশ শরীর বুড়োরা সাঁতারের পোষাক পরে বসে আছে। ওদের ভুড়ি হাঁটুর ওপর থলথল করছে।

হঠাৎ ও জুয়ানাকে দেখতে পেল। একটা টেবিলে একজন দীর্ঘকায়, পাতলা চেহারার মেক্সিকানের সঙ্গে বসে আছে। বয়স পঁয়ষট্টি হবে। পাতলা মুখে আভিজাত্যের চিহ, সাদা চুল, নীল চোখের দৃষ্টি কঠোর। চমৎকার নিখুঁত ব্লেজার, সাদা ফ্লানেলের প্যান্ট, সাদা সিল্কের শার্ট আর টাই ওর পরনে। চারিদিকে কুৎসিত প্রায় নগ্ন চেহারার মাঝে লোকটি যেন একটা ব্যতিক্রম। লর দিকে তাকিয়ে কেডের সব উৎসাহ যেন নিভে গেল। টেবিলটার থেকে অনেক দূরত্ব রেখে অনেকটা ঘুরে ও চলে গেল নিজের ঘরে। ঘরে ঢুকে এই প্রথম খেয়াল করল ওর আর পাশের ঘরটার মধ্যে একটা দরজা আছে। ওর দরজাটা খিল দেওয়া। নিশ্চয় দরজাটা ওদিক থেকেও বন্ধ থাকবে।

জুয়ানা বলেছে ও ওই ঘরে এসেছে আজ। তাহলে আজ রাতে যে কোন সময়ে জুয়ানার ইচ্ছে থাকলে ওরা যোগাযোগ করতে পারে। বিছানায় শুয়ে পড়ে কেড। অস্থির এক উত্তেজনায় সে ছটফট করতে লাগল।

জুয়ানার সঙ্গী পুরুষটি কে? ওর বাবা? স্বামী? প্রণয়ী? হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠল। নিউইয়র্ক থেকে স্যাম ওয়াল্ড কথা বলতে চায়। জুয়ানার মুখ ভাসছিল কেডের চোখের সামনে। প্লিজ বলে দেবেন আমি এক সপ্তাহের জন্য বাইরে গেছি কোন ঠিকানা রেখে যাইনি। এইটুকু করবেন দয়া করে?

বিখ্যাত কেড অমন অনুনয় বিনয় করে কথা বলছে যে অপারেটর মেয়েটি গলে গেল।

সেদিন সন্ধ্যায় একটা ভাড়া করা জীপে করে কেড এমোররা উপকূলে লা গামা রেস্টুরেন্টে গেল। অ্যাকাপুলকো নিউজকাগজের সাংবাদিক রিকার্ডো ওরোসিওর সঙ্গে ওর ডিনার খাবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট।

রেস্টুরেন্টে ওরোসিও ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। ওরোসিও মেক্সিকান, ছোটখাট চেহারা, দড়ি পাকানো শরীর। কালো মুখ থেকে ওর হাসি কখনও মেলায় না। পোষাকও খুব কায়দা করে পরে।

খেতে খেতে এটা সেটা বিষয়ে কথা বলতে লাগল ওরা দুজনে। হঠাৎ কেড মনে করল ওরোসিও ওকে সাহায্য করতে পারে।

চামচ দিয়ে কফি নাড়তে নাড়তে কেড বলল, হিলটনে একজন মেক্সিকান আছে। লম্বা, পাতলা চেহারা, বয়স বছর পয়ষট্টি। মাথায় ঘন সাদা চুল, চোখের রঙ নীল। আমি যখন দেখি, ওর পরনে…

আমি জানি উনি কে। ওরোসিওর মুখে কৌতুকের হাসি। ওর কথা জানতে চাও, অ্যামিগো। আরে বলনা ওর তরুণী সঙ্গিনীটিকে তোমার মনে ধরেছে।

কেড হেসে ফেলল। ধরে ফেলেছ দেখছি…যাকগে ভদ্রলোকটি কে?

ওর নাম ম্যানুয়েল ব্যারেডা। ওর জাহাজের ব্যবসা আছে। ব্যবসা কেন্দ্র হচ্ছে ভেরাক্রুজ। ভদ্রলোক বিরাট ধনী। ওর স্ত্রী শয্যাশায়ী, অসুস্থ। তিনটি ছেলে ব্যবসা দেখে। একটি মেয়ে আছে, ব্যাঙ্ক অফ য়ুকাতানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।

কেড বিস্মিত হল। এসব খবর ধীরে ধীরে হজম করতে লাগল।

ওর সঙ্গে…ওর কি মেয়ে? শেষ অবধি প্রশ্নটা করেই ফেলল কেড।

ওর প্রশ্ন শুনে ওরোসিও নিঃশব্দে হেসে গড়িয়ে পড়ল। ওর হাসি আর থামেনা। কেড ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করল।

হাসি থামিয়ে ওরোসিও বলল, মাপ কর ভাই। ও ওর মেয়ে নয়। ওর মেয়ে এক বিশালাকার মহিলা। ওর….

ওর মেয়ের কথা থাক। সঙ্গের মেয়েটি কে?

ইস যতবার এ প্রশ্ন শুনেছি ততবার যদি কেড দশটা করে ডলার আমাকে দিত, আমি সেই মার্সিডিজটা কিনে ফেলতাম। ও আসার পর থেকে প্রত্যেকদিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমাকে এ প্রশ্নটার জবাব দিতে হয়।

এটা কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব হল না।

মেয়েটির নাম জুয়ানা রোকা।

 জানি, ও কে? কি করে?

ও বর্তমানে সিনর ব্যারেডার নমসহচরী সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই। কিন্তু ও যে কে তা বলা কঠিন। শুনেছি ব্যারেডের সঙ্গে দেখা হবার আগে ও মেক্সিকোয় সান ডিয়েগো ক্লাবে নর্তকী ছিল। শোনা যায়, বুলফাইটারদের সঙ্গে ওর বেজায় দোস্তি। কিম্বাবলা যায় বুলফাইটাররাই ওর সঙ্গে দোস্তি করতে ব্যস্ত। তবে ওদের উদ্দেশ্য খুব একটা সফল হয়নি। ওরা ওকে কায়দা করতে পারেনি।

এখন বলতে একজন ব্রিলিয়ান্ট ফটোগ্রাফার যে নাকি জুয়ানা রোকার সম্পর্কে আগ্রহী, তার মনের কথাটা কি?

আরেকটু কফি নেওয়া যাক। কেড বলল, মেক্সিকান কফি সত্যিই চমৎকার।

কিছুক্ষণ চুপ করার পর কেড বলল, সিনর ব্যারেডার মতন ব্যস্ত মানুষ অ্যাকাপুলকোয় কি করছেন?

শুনেছি সম্প্রতি ওর একটা হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এখানে এসেছেন রোদ পোহাতে ডাক্তারের পরামর্শে।

হার্ট অ্যাটাক?

ওয়োসিও কেডের মনের কথা আঁচ করে বলল, তুমি হয়তো ভাবছ হার্টের রুগী এক বৃদ্ধ হিলটন হোটেলে কেমন করে জুয়ানা রোকোর মত একটি প্রাণবন্ত মেয়ের সঙ্গে সহবাস করছেন, তাই না?

বলতে পার। কেড হেসে বলল।

মেয়েরা যখন এত সুন্দরী হয় তাদের সঙ্গে মিশলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে বই কি। সিনর ব্যারেডা আকাপুলকোতে প্রেম করলে কেড অত মাথা ঘামাবে না। সেই জন্যেই ঝুঁকি নিয়ে উনি মাথা ঘামাচ্ছেন না।

হয়তো তাই। কেড নিস্তেজ গলায় বলল।

কেডের মনে হয়েছে জুয়ানা হয়তো স্বেচ্ছায় তার পাশের ঘরে এসেছে। কিন্তু সিনর ব্যারেডা যদি তার জীবন, স্বাস্থ্য জুয়ানার জন্য সবকিছুই পণ রাখতে পারেন, এ ব্যাপারে ওর মাথা গলানো ঠিক হবে না। সে সিনর ব্যারেডার প্রশংসা করছিল মনে মনে।

যাক গিয়ে, সিনর ব্যারেডা আর তার প্রণয়নীর কথা থাক। চল পাহাড়ের দিকে ঘুরে আসা যাক।

ওরোসিও বিল চাইল। বলল অসম্ভব, আমাকে অফিসে ফিরতেই হবে। মিঃ কেড একটা উপদেশ দিই যদিও উপদেশ দেওয়া আমি পছন্দ করি না। আমার কথা হল মেক্সিকোতে তুমি মজা–টজা করার জন্য অনেক মেয়ে পাবে। মেক্সিকোতে একটা কথা প্রচলিত আছে জুয়ানা রোকা পুরুষদের কাছে মৃত্যু স্বরূপ। ও আমাদের আধুনিক কারমেন। ওর জন্য দুজন বুলফাইটার প্রাণ হারিয়েছে। এখন থেকেই সাবধান হও। আগামীকাল বা আগামী পরশু সাবধান হয়ে লাভ নেই। এই কথা কটি বলেই আমি যাব। মনে রেখ মেয়েদের সৌন্দর্য খুব লোভনীয়, কিন্তু সৌন্দর্যটার আড়ালে হয়তো ধারালো ছুরি ঢাকা থাকে। তোমার অসম্ভব ভক্ত আমি, জান তো? কেডের হাত ঝাঁকিয়ে ওরোসিও চলে গেল।

কেড রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল। জীপের পাশে দাঁড়িয়ে ও তারাভরা আকাশটার দিকে তাকাল। নরম কালো ভেলভেটের ওপর তারাগুলো যেন হীরের দ্যুতির মতন জ্বলছে। বাতাস গরম। বালির ওপর ঢেউ আছড়ে পড়ছে ফিরে যাচ্ছে আবার। সমুদ্রের কল্লোল শোনা যাচ্ছে। দুরে দেখা যায় পাহাড়ের গায়ে আলো জ্বলছে। মনে হচ্ছে একটা বৃহৎ সরীসৃপ যেন এলিয়ে শুয়ে আছে। ছুটন্ত গাড়ির আলোগুলো মনে হচ্ছে উড়ন্ত জোনাকির ঝাক।

হোটেলে ফিরে কেড ব্যারের কথাই ভাবতে লাগল। ঠিক করেছে স্যাম ফোন করলে ওর কি কাজের কথা জেনে নেবে। আর কাল সকালেই ও অ্যাকাপুলকো ছেড়ে চলে যাবে। কাজে জড়িয়ে পড়লে ও জুয়ানাকে নিশ্চয়ই ভুলতে পারবে। সিনর ব্যারেডার মধুচন্দ্রিমাকে নষ্ট করবার কোন অধিকার নেই তার। প্রাণান্ত ভাল না বাসলে ব্যারেডা এমন ভাবে জীবনের সঙ্গে জুয়ো খেলতে পারত না।

ওর ঘর থেকে ওয়ান্ডকে ফোন করল ও। তারপর বিছানায় বসে সমুদ্রের বুকে চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখতে লাগল। বিশ মিনিট পরে ও কানেকশান পেল। ওরা বলল যে তুমি এক সপ্তাহের জন্য বাইরে গেছ। ওয়াল্ড গাঁ গাঁ করে চেঁচাচ্ছিল।

কানের পর্দা ফাটাবে নাকি? নাঃ শেষ অবধি মত বদলাল স্যাম। কি কাজের কথা বলছিলে বলতো?

কি ব্যাপার। মেয়েটি রাজী হচ্ছে না নাকি?

বাজে কথা ছাড়। ফোনের বিল চড়ছে। কি কাজ বল?

ষাঁড়ের লড়াই। আগামী মাসে আমাদের কাগজে একটা নতুন ন্যাকামি শুরু হচ্ছে। নাম হল নিজেই দেখুন। পরিকল্পনাটা, নীতিবাগিশ, আদর্শবাদী। ওদের ধারণা তোমার ছাপানো ছবি দিয়ে শুরু করলে ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতন অনৈতিক ব্যাপার বন্ধ করা যায়। আমেরিকার বাইরে যদি ছবিগুলো ভোলা যায়, তাহলে ওরা ক্যাশ তিন হাজার ডলার আর পঁচিশ পার্সেন্ট রয়্যালিটি দেবে। বুঝতেই পারছ ওরা কি চায়। ক্লান্ত বিধ্বস্ত ঘোড়া, ক্ষতবিক্ষত ষাঁড়, কাপুরুষ ফাইটার, টুরিস্টদের পাশব উল্লাস। তোমাকে আর কি বোঝাব? এই রবিবারে একটা জবরদস্ত লড়াই হবে। আমি ক্রিলের সঙ্গে কথা বলেছি। ডিয়াজ লড়ছে। ডিয়াজ এখন দুর্দান্ত জনপ্রিয়। কি, করবে তো?

আজ শুক্রবার। কেডের মনে হল এ ভালোই হল।

বেশ স্যাম। ক্রিলকে বলবে আমার টিকিট করে রাখতে। একেবারে সামনের দু-সারি রাদ দিয়ে টিকিট করবে। আমার দু পাশের সীট দুটো যেন খালি থাকে। আমার জায়গা চাই।

ঠিক আছে।

 ক্রিলকে বোল, লড়াইয়ের আগে ও পরে আমি ডিয়াজের সঙ্গে কথা বলতে চাই।

এতে একটু ঝামেলা হতে পারে। ডিয়াজের এখন খুব নাম। ও রাজী নাও হতে পারে।

সে ক্রিল বুঝবে। ওকে বল আমি এই ব্যবস্থাই চাই।

বেশ। আমি কি তোমার জন্য এল প্রেসিডেন্টে একটা ঘর বুক করে রাখব।

 কেড একটু ইতস্ততঃ করে মাঝের বন্ধ দরজাটার দিকে একবার তাকাল। তারপর বলল না, আমিই বন্দোবস্ত করব। শেষ যে ছবি পাঠিয়েছি, পেয়েছো?

হা। অপূর্ব, অসাধারণ। ভ্যাল তুমি হচ্ছ দুর্দান্ত একটা ট্যালেন্ট, আমি বলছি, জান…।

কেড ওকে থামিয়ে রিসিভার নামিয়ে রাখল। কাজটা বেশ চ্যালেঞ্জের হবে। খুব দ্রুত শার্টার টিপতে হবে। ভাল আলো পাবেনা তাই বড় অ্যাপারচার ব্যবহার করতে হবে। খুব মাথা খাটাতে হবে তাকে। কিন্তু ফটোগ্রাফির এইসব সমস্যা তার ভালই লাগে।

টেলিফোনটা তুলে এবার কেড মেক্সিকোর কোন্ কোন্ শহরে প্লেন যাবে খোঁজ নিল। আগে থেকে যুক্ত করার দরকার নেই। প্লেনের সীটগুলো কখনই ভর্তি থাকে না। তারপর বন্ধ দরজাটার কাছে গিয়ে কান পাতল। না, কোন সাড়া শব্দ নেই। বাইরের বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে দেখেছে পাশের ঘরে আলো জ্বলছে কিনা। দেখেছে জানলা বন্ধ, ঘরে আলো নেই। কেড ঘরে ফিরে এল।

তাহলে সবটাই পরিহাস। জুয়ানা তার সঙ্গে ঠাট্টা করছিল। অর্থহীন, নিষ্ঠুর, ঠাট্টা।

দেয়াল আলমারি থেকে প্যাকিং ব্যাগ নিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল কেড। জুয়ানার নির্মম পরিহাসও হজম করতে পারছে না। কেনই বা রেগে যাচ্ছে কেড। ওতো স্থির করেছিল ওদের ব্যাপার থেকে দূরে থাকবে ও। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ও ভাবল ও একটু মদ খেয়ে নেবে। কিন্তু রাত অনেক হয়ে গো এখন ঘুমিয়ে পড়াই ভাল।

জামাকাপড় ছেড়ে ফেললও। বাথরুমে যাবার আগে শেষবারের মতনবন্ধ দরজাটায় কান পাতল। নিস্তব্ধ, একদম নীরব।

চুলোয় যাক। নিজের মনেই চেঁচিয়ে উঠল ও। শাওয়ারটার নীচে মাথা রেখে ও অনেকক্ষণ স্নান করল। তারপর ঘরে ফিরে বিছানায় এলিয়ে পড়ল। খুব আরাম লাগছে এখন। আর একটুও রাগ নেই।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। কেড ভাবল স্যাম হয়তো কিছু বলতে ভুলে গেছে। ও হালকা করে ফোনটা ধরল। হ্যালো!

দেখলাম তোমার ঘরে আলো জ্বলছে।

জুয়ানার গলা, এ নিশ্চয়ই জুয়ানার গলা। সঙ্গে সঙ্গে কেডের বুকের ওঠানামা দ্রুততর হল, নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল।

–কোনরকমে ও বলল তাই বুঝি?

–হ্যাঁ, বিরক্ত করলাম নাকি?

না, না…

ভালো, আমি বলছিলাম আমার দিকের দরজা খোলাই আছে।

 এই রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার মুহূর্তেও কেড ব্যারেডাকে ভোলেনি।

আমি শুতে যাচ্ছি। আবেগে কেডের গলা থর থর করে উঠল।

আমি শুয়েই আছি।

 রিসিভার নামিয়ে কেড বন্ধ দরজাটার খিল খুলে পাশের ঘরের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াল। মৃদু নীল আলো জ্বলছিল, কেড দেখল কালো চুলের বন্যার মাঝে জুয়ানা শুয়ে আছে। ঠোঁটে সেই মাদকতাময় হাসি। কেড ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।

সোয়া নটার প্লেন ধরবার জন্য ওদের অসম্ভব তাড়াহুড়ো শুরু হয়েছে। সহযাত্রী শুধু আটজন আমেরিকান টুরিস্ট। তাদের হাতে ক্যামেরা।

যথারীতি প্লেন ছাড়তে দেরী হচ্ছে।

কেডের অভিজ্ঞতায় জুয়ানার সাথে প্রেম তার জীবনে এক অনন্য ঘটনা। এরকমটা আর কখনো হয় নি। কিন্তু ভেতরের একটা পাপবোধ সেই অভিজ্ঞতার আনন্দকে অনেক ম্লান করে দিয়েছে।

ভোরের দিকে ওরা যখন প্রেমের বন্যায় তখনো ভাসছিল, জুয়ানা হঠাৎ বলল সে কেডের সঙ্গে মেক্সিকোয় যাচ্ছে।

তোমায় কে বলল আমি মেক্সিকোয় যাচ্ছি? কেড অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

আমি টেলিফোনে ব শুনেছি। তুমি তো বুলফাইটের ছবি তুলতে যাচ্ছ, তাই না?

 কেড বলল, তুমি তা করতে পার না। তুমি ব্যারেড়ার কথা ভুলে যাচ্ছ।

 জুয়ানা তখন তার একটা পা তুলে খুব মন দিয়ে দেখছে।

 আমার পা সত্যিই সুন্দর, তাই না?

কেড উঠে বসল।

 শোন, তোমার এরকম করা ঠিক হবে না। ব্যারেডা তোমাকে সত্যিই ভালবাসে…

জুয়ানা দুম করে পা নামিয়ে দিয়ে বলল, ব্যারেড বুড়ো…ওকে আমার অসহ্য লাগে। আমার জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেছে। নিচের হলে রেখেছি। কাল আমি তোমার সঙ্গে মেক্সিকো যাচ্ছি।

না, আমি তোমায় একাজ করতে দিতে পারিনা। আমার সঙ্গে দেখা হবার আগে তুমি ব্যারের সঙ্গেই তো ছিলে….

আমার ওকে ক্লান্তিকর লাগত। আমার ওর সঙ্গে আসা উচিৎ হয়নি। আমার ভুল হয়েছে। ওর মতন বুড়োর সঙ্গে থেকে কি করব? আমি মেক্সিকো ফিরে যাচ্ছি। তুমি যদি আমায় না নিয়ে যেতে চাও, সোজা বলে দাও। আমি একাই যাব।

ব্যারেডাকে কি বলবে? কেড উদ্বেগে বলে উঠল।

 কিছুই বলব না। ও যতক্ষণে ঘুম থেকে উঠবে, আমি চলে যাব।

শোন এরকম হৃদয়হীন ব্যবহার করা উচিৎ নয়। অন্তত লিখে জানাও।

 লিখে জানাবার দরকার নেই। হলে যে বেয়ারা থাকে ও বলে দেবে আমি চলে গেছি, ব্যস।

এই বলে জুয়ানা কেডকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল। যখন ঘুম ভাঙ্গল ওদের, আটটা বেজে গেছে। জামাকাপড় বদলালো, হোটেলের বিল মেটালো, গাড়িতে মালপত্র ভোলার তাড়াহুড়োতে ব্যারেডার কথা ভুলেই গেল কেড।

মেক্সিকো শহরের অর্ধেকটা পাড়ি দেবার পর কেডের হঠাৎ মনে পড়ল ব্যারেডার কথা। সত্যি ভদ্রলোকের জন্য খারাপ লাগছে খুব। জুয়ানার খুশীতে ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে কেড ভাবল জুয়ানার ভেতরটা কি নির্মম। তার একটু ভয় করতে লাগল।

কেডকে চেয়ে থাকতে দেখে জুয়ানা বলল, আমি একটা চমৎকার বাড়ির খবর জানি। আমরা সেটা ভাড়া করতে পারি। হোটেলে থাকার থেকে অনেক ভালো। আমি খুব ভাল রাঁধতে পারি। আমি বাড়িটার দেখাশোনা করব, রান্না করব, তোমার ভাল লাগছে না ভাবতে।

জুয়ানার পরনে দামী হাতকাটা সাদা পোক। মাথার উপর চুল চুড়ো করে বাঁধা। কানে সোনার দুল, গলায় চওড়া সোনার কলার। এই রকম সুন্দরী, সৌখিন মেয়ে হাত পুড়িয়ে রান্না করছে ভাবতেই হাসি পেল কেডের।

তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? তুমি ভাবছ আমি রাঁধতে পারি না?

কেড বুঝল জুয়ানার আঘাত লেগেছে। তাড়াতাড়ি বলল, আমি জানি তুমি রাঁধতে পার। কিন্তু কজন পরিচারিকা লাগবে তোমার?

দুর, আমরা কোন পরিচারক রাখব না। শুধু তুমি আর আমি থাকব।

বাঃ বেশ হবে। চল বাড়িই ভাড়া করব আমরা।

জুয়ানা ওর হাতের উপর হাত রাখল। মিষ্টি হেসে বলল, আমি সব ব্যবস্থা করব। তোমার কাছে টাকা আছে তো? সব বন্দোবস্ত করতে কিছু টাকা লাগবে কিন্তু। আমার কাছে দুশো পেসো আছে। ম্যানুয়েল বেচারা ভারী কৃপণ।

দাঁড়াও ভাল মনে করেছ। তুমি ওকে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দাও।

জুয়ানা কেডের হাতটা টেনে বলল, তোমার কাছে টাকা আছে কিনা জানতে চাইলাম। তুমি খালি খালি ম্যানুয়েলের কথা বলছ, আমার ভালো লাগছে না।

কেড একটা নিঃশ্বাস ফেলে মানিব্যাগ থেকে ওকে পাঁচ হাজার পেসোর নোট দিল।

মেক্সিকোয় পৌঁছে আমি চেক ভাঙ্গাব। এখন এর চাইতে বেশী টাকা আমার কাছে নেই।

 যথেষ্ট হবে। দেখবে আমি কিরকম গুছিয়ে চালাতে পারি। আমরা খুব সুখী হব দেখো। জুয়ানার উজ্জ্বল চোখদুটি খুশিতে উপছে পড়ছে যেন।

এগারটার পর ওরা মেক্সিকো পৌঁছল। মধ্য আমেরিকায় স্যাম ওয়ান্ডের প্রতিনিধি অ্যাডোলফো ক্রিল এয়ারপোর্টে ছিল। মোটামুটি মানুষটি, মাথায় টাক, জামাকাপড়ের দিকে বিশেষ লক্ষ্য নেই। কিন্তু ব্যবহারটি খুবই মধুর।

কেড যখন জুয়ানার সঙ্গে ওকে আলাপ করিয়ে দিল ক্রিল যেন ধন্য হয়ে গেল। ওর চোখে বিস্ময় আর প্রশংসা।

কেড জিজ্ঞেস করল, টিকিট পেয়েছিলে?

নিশ্চয়ই, আপনি যা যা বলেছিলেন সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।

ডিয়াজের সঙ্গে কখন দেখা করছি?

ক্রিলের মুখ থেকে সৌজন্যমাখা হাসিটা হঠাৎ নিভে গেল। দুঃখিত, এটা একেবারে অসম্ভব ব্যাপার। ডিয়াজ কারো সঙ্গে দেখাই করে না, এমনকি প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও নয়। ডিয়াজ খুব গোঁড়া ধার্মিক। লড়াইয়ের আগে সে শুধু প্রার্থনা করে। ওর সঙ্গে দেখা হওয়া সম্ভবই নয়।

কেড বিরক্ত হয়ে বলল, লড়াইয়ের আগে ওর সঙ্গে কথা বলতেই হবে। আমি ওয়াল্ডকে আগেই তো বলেছিলাম।

ক্রিল পায়ে পা ঘষল, টুপি দিয়ে পা চাপড়াল।

সিনর কেড। সত্যি বলছি আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি।

জুয়ানার চোখ হঠাৎ জ্বলে উঠল রাগে। ও বলে উঠল, ডিয়াজ একটা বোকা, পেট মোটা কোলা ব্যাঙ। তুমি যদি সত্যিই দেখা করতে চাও, আমি ব্যবস্থা করে দেব। মেক্সিকোয় আমি কত কি করতে পারি। এখন আমি যাচ্ছি। বাড়িটার বন্দোবস্ত করতে হবে আমায়। কাল আমরা নতুন বাড়িতে যাব। আজ রাতে হোটেল এ প্রেসিডেন্টে থাকব। আমার জন্য হোটেলে অপেক্ষা কর। বিকেলের দিকে তোমার সঙ্গে দেখা করব।

এক মিনিট শোন জুয়ানা। সত্যি বলছ ডিয়াজের সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে পারবে?

নিশ্চয়। জুয়ানা চলে গেল।

ক্রিলের মুখে একটা মেকি হাসি খেলা করছে। বলল সিনর আপনি ভাগ্যবান। আপনার বান্ধবী শুধু সুন্দরীই নন, তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন।

হা। কেড ব্যাগ তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল।

যেহেতু কেড সরল এবং ভদ্র, জীবনের অভাবিত সাফল্যে সে বিস্মিতই হয় কেবল, ভাগ্যের কাছে সবসময় তার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানায়। এক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ অ্যামেচার ফটোগ্রাফার হিসেবে সে এক হাজার ডলার পুরস্কার পেয়েছিল দশ বছর বয়সেই। সেই তার সৌভাগ্যের শুরু। এক মসৃণ সফলতার পথ দিয়ে তার বাধাহীন চলা। জীবনে কখনও কোন কঠিন অসুখ হয়নি তার। জীবনে এমন একটা সময়ও আসেনি যখন ওর কাছে গাড়ি ছিল না। অনাহারের কষ্ট কি কেড তা জানতেই পারেনি। তেমন কোন আঘাতও জীবনে পায়নি ও। প্রায় সবসময়ই কোন না কোন সুন্দরী মেয়ে ওর সঙ্গিনী হয়ে থেকেছে। তার জীবনে সে এত সফলতার মুখ দেখেছে যে তার জীবনে জুয়ানা রোকোর অকস্মাৎ আবির্ভাবে সে অবাক হয়নি। যদিও জুয়ানার আবির্ভাবকে সে দেবতাদের এক প্রসন্ন বরদান বলেই মনে করেছে।

এল প্রেসিডেন্টে আলোকিত ফোয়ারা আর বিশাল সুইমিং পুলের মুখোমুখি বারে বসে জুয়ানার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ও গত বারো ঘণ্টার কথা ভেবেছে। সামনের টেবিলে গ্লাসে সিনজানো বীয়ার আর বরফ।

জুয়ানা রহস্যময়ী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ও নিজেই বলেছে কেডকে যখন ও হিলটন হোটেলে ঢুকতে দেখে তখনি ওর প্রেমে পড়ে যায়। নিজেই খোঁজ খবর নিয়ে জানে কেড কে, ওর ঘরের নম্বর কত, সব। জুয়ানা সঙ্গে সঙ্গেই কেডের পাশের ঘর বদল করে নিয়েছে। জুয়ানা জানত কেড ওকে চাইবেই। এই বারোঘন্টার মধ্যে পরস্পরকে ভাল করে জানার সুযোগই পায়নি ওরা। কিন্তু জুয়ানার বিষয়ে কেড যত কমই জানুক জুয়ানা কেডের সব খবরই জানে। এতেও কেড আশ্চর্য হয়নি। কেড বিখ্যাত সর্বজনবিদিত একটি নাম।

জুয়ানার সঙ্গে ভালবাসার যা অভিজ্ঞতা হয়েছে এরকমটি আগে কেডের হয়নি। এই অভিজ্ঞতার এমন এক উত্তেজনা ও তৃপ্তি আছে যা কেড কখনও আগে অনুভব করেনি। এক যথার্থ প্রণয়ণীকে কি করে ভালবাসতে হয়, জুয়ানা তা জানে।

জুয়ানার কথা ভাবতে ভাবতে কেড সভয়ে উপলব্ধি করল জুয়ানা ছাড়া সে তার জীবনের কথা ভাবতেই পারছেনা। জুয়ানা ছাড়া সেবাঁচতে পারবেনা। মেয়েদের ব্যাপারে কেড সবসময়ই সতর্ক ছিল। কাউকেই তার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী হতে দেয়নি। কিন্তু জুয়ানার সঙ্গে সংসার পাতার স্বপ্ন তাকে এক আশ্চর্য আনন্দ আর উদ্দীপনায় ভরিয়ে দিচ্ছে। আবার যখনই মনে হচ্ছে ম্যানুয়েল কে কি অনায়াসে ও ছেড়ে এল। এক অজানা আশঙ্কায় তার মন ভরে উঠল। অবশ্য সে তার মনকে বোঝাল, ব্যারেডার বয়স পঁয়ষট্টি, অসুস্থ রুগ্ন এক বৃদ্ধের সাথে জুয়ানার মতন যৌবনোচ্ছল, প্রাণচঞ্চল এক মেয়ে কতক্ষণ থাকতে পারে। কেডের মনেহল জুয়ানা তাকে সত্যিই ভালবাসে, সেও জুয়ানাকে ভালবাসে, এ ভালোবাসা দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য।

জুয়ানার জন্য তার মন খারাপ হতে লাগল। সে জোর করে তার মনকে বুলফাইটের প্রসঙ্গে নিয়ে গেল। ক্রিল বলেছে আজ সন্ধ্যাবেলায় সে ফোন করে জানাবে কি ঠিক হল না হল। ফ্রিল ওর গাড়িটা কেডকে দিয়েছে ব্যবহারের জন্য। বলেছে ও কেডের গাইড আর সোফারের কাজ করবে। কেড ক্রিলকে বলেছে ও তিনটে ক্যামেরা ব্যবহার করবে, ক্রিলকে ওর পাশে বসতে হবে, কেড যখন যে ক্যামেরাটা চায় কেডকে তা হাতে তুলে দিতে হবে যাতে কেড ইচ্ছে মতো লে দিয়ে অনবরত ছবির পর ছবি তুলতে পারে। কেডের ক্রিলকে বেশ পছন্দ হয়েছে। ক্রিলই বলেছে জুয়ানার ঘরে রাখার জন্য কেড়ের একটা বড় কারনেশান ফুলের তোড়া কেনা উচিৎ। ক্রিই সেই ফুলের তোড়া কেনা ও রাখার ব্যবস্থা করছে।

লাঞ্চের পর কেড খানিক ঘুমিয়ে নিল। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বেশ ঝরঝরে লাগছিল কেডের। বাথরুম থেকে স্নান করে বেরোতেই জুয়ানার টেলিফোন এল।

টেলিফোনে অনেক পুরুষ কণ্ঠের কথাবার্তা, গীটারের বাজনা, গানের আওয়াজ আসছিল। কেড সন্ধিগ্ধ স্বরে বলল, তুমি কোত্থেকে কথা বলছ?

একটা কাফে থেকে। এখানে যা হৈ–চৈ আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শোন, ডিয়াজ আগামীকাল আড়াইটার সময় তোমার সঙ্গে কথা বলবে। ও হোটেল ডি টোরায় থাকবে। ঠিক আছে?

–নিশ্চয়। বাঃ চমৎকার। কি করে করলে?

রেনাদো আমার খুব বন্ধু। ও বুলফাইটারের ম্যানেজার। প্রখ্যাত ফটোগ্রাফার কেড ওর একজন ফাইটারের ছবি তুলবে শুনে গলে গেছে। এখন ডিয়াজও খুব খুশী দেখছি পেটমোটা কোলাব্যাঙ একটা।

কেড মনে মনে বলল খুব বন্ধু। একথার মানে কি?

এমনিতে বলল, বাঃ চমৎকার। কিন্তু তুমি কাফেতে কি করছ ডার্লিং? আমার কাছে চলে আসছ না কেন?

রেনাদো এখানে আছে যে। আমি এখনই বেরিয়ে যাচ্ছি তবে রাত দশটার আগে আসছি না।

 কেন?

এখনও কাজ বাকি আছে যে। বাড়িটা পেয়েছি কিন্তু দালালের সঙ্গে দেখা করতে হবে, ওকে টাকা দিতে হবে। লোকটা একটা ডাহা চোর, ওর সঙ্গে দামদস্তুর করতে হবে। আগামীকাল বুলফাইটের পর আমরা আমাদের নতুন বাড়িতে সোজা চলে যেতে পারব। আজ রাতে চল আমরা নেই রেস্টুরেন্টে যাই। ওখানে চমৎকার খাবার পাওয়া যায়। তুমি জান রেস্টুরেন্টটার কথা?

কেড বলছে ও জানে না।

তাহলে তোমার একটা মনে রাখার মতন অভিজ্ঞতা হবে। একটা টেবিল বুক করে নাও না কেন? আমি যাচ্ছি, এখনও অনেক কাজ বাকি আছে। তুমি আমাকে এখনও ভালবাস তো?

সেটা এখানে এলেই বুঝতে পারবে।

 জুয়ানা হেসে উঠল, সে আমার খুব ভাল লাগত। চলি। ফোনটা নামিয়ে রাখল জুয়ানা।

কিছুক্ষণ পর ক্রিল টেলিফোন করল। কেড ওকে ডিয়াজের কথা বলল। শুনে ক্রিল আশ্চর্য হয়ে গেল।

আপনি জানেন না সিনর ডিয়াজের সঙ্গে আপনার দেখা করিয়ে দেবার জন্য আমি কি পরিশ্রমটাই না করেছি। আপনার বান্ধবী যে রেনাদোর কথা ভেবেছে, তা খুব বুদ্ধির কাজ হয়েছে। রেনাদো অত্যন্ত বিশিষ্ট ব্যক্তি এখানকার, তবে খুব কড়া প্রকৃতির। আপনার বান্ধবী রেনালদোকে নিশ্চয়ই খুব ভাল চেনেন। তাই ব্যাপারটা সম্ভব হয়েছে।

একথা শুনে কেডের উদ্বেগ আর ঈর্ষা বেড়েই গেল। রাত দশটার একটু পরে জুয়ানা হুড়মুড় করে কেডের শোবার ঘরে ঢুকল। বলল, চল ডার্লিং আমার বেজায় ক্ষিদে পেয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি জুয়ানা স্নান করে পোক বদলে নিল।

নেগ্রুই রেস্টুরেন্টের খাবার সত্যিই চমৎকার। খেতে খেতে জুয়ানা বকর বকর করেই চলল। সব ব্যবস্থা তৈরী। এখন এক সপ্তাহের ভাড়া দিয়েছি। তবে যতদিন ইচ্ছে ততদিন আমরা ওই বাড়িতে থাকতে পারি। ডিয়াজের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঠিক করে দিয়েছি, খুশী হয়েছ তো? লোকটা একটা নির্বোধ, মোটা। তবে ষাঁড়ের সঙ্গে লড়াইয়ে ডিয়াজ খুব মজবুত। রেনাদো তত বেজায় খুশি। রেনাদো সহজে খুশী হয় না…।

কেড বলল, ক্রিল বলল রেনাদো খুব কঠোর প্রকৃতির, কি করে ওকে রাজী করালে?

জুয়ানা ছুরি দিয়ে একটা ক্রীমভর্তি পেসট্রি কাটছিল। ও চোখ তুলে হাসল।

ভাল, তোমার হিংসে হচ্ছে তো। পুরুষ যখন হিংসে করতে শুরু করে বোঝা যায় সে মেয়েটিকে সত্যিই ভালবাসে।

ওসব কথার কায়দা ছাড়…দয়া করে আমার প্রশ্নের জবাব দাও।

তুমি কি রেগে গেছ, জুয়ানার চোখে কৌতুকের হাসি।

এখনো রাগিনি, তোমার জবাবের অপেক্ষা করছি।

 রাগি পুরুষ আমি খুব পছন্দ করি। রাগ না হলে আবার পুরুষ মানুষ নাকি?

 কেড অসহিষ্ণু গলায় বলল, দয়া করে বলবে কি রেনাদো রাজী হল কেন?

 নিশ্চয়। এতে গোপন করার কিছু নেই। জুয়ানা খুব আরাম করে হেলান দিয়ে বসল। আমার বাবা ছিলেন একজন নামকরা বুলফাইটার, টমাস রোকো। বাবা রেনাদোকে উঠতে অনেক সাহায্য করেছিলেন। রেনাদো আজকে যে এত ক্ষমতাবান আর ধনী তা বাবার জন্যই অনেকটা। তাই আমি কোন সাহায্য চাইলে, রেনাদো না করতে পারে না।

কেড স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। খুশী মনে জুয়ানার হাত ধরল।

 তোমার বাবার কি হল?

বাবা এখন বুড়ো হয়ে গেছেন। তাই ট্যাক্সকোয় একটা রুপো বেচার দোকান করেছেন বাবা। বাবা ভারি কড়া আর খিটখিটে। বাবার ইচ্ছে ছিল ছেলের। কিন্তু তার জন্য বাবা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করবেন তা আমি মানতে পারছি না। মাও ঘ্যানঘ্যানে খিটখিটে। পনের বছর বয়সেই আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাই।

তোমার বয়স কত?

 সতেরো।

দু বছর আগে তুমি নিজের পরিজনকে ছেড়ে চলে গেছ?

নিজের পায়েই দাঁড়ানো ভাল।

কিন্তু কেমন করে রোজগার করেছ?

জুয়ানার চোখে উদ্বেগ আর আশঙ্কা ফুটে উঠল, তোমার কৌতূহল বড় বেশী দেখছি। পুরুষরা এসব সত্যিকথা জানতে চায়না। তারা যা সত্যি তাই বিশ্বাস করে।

কেড দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জুয়ানা কেড়ের হাত ধরে বলল, চল আমরা হোটেলে ফিরে যাই। বিশ্বাস কর আমি তোমায় ভালবাসি। তোমাকে পাওয়া আমার জীবনের একটা বড় লাভ।

আমারও।

জুয়ানার মুখ খুশীতে ঝলমল করে উঠল। হাতে হাত জড়িয়ে ওরা রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এল।