৪০. সরল পিসির কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি

সাধন সরল পিসির কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে নি, তবু সবই প্রকাশ হয়ে পড়ল। প্রকাশ হয়ে পড়ল সদুর দীনতা, আর তার ভাইপোদের মিথ্যা কথা।

কাঁচা পাকা চুল, বেঁটে খাটো শক্ত সমর্থ চেহারার যে ভদ্রলোকটির বাসা খুঁজে খুঁজে সেদিন পিসির দেওয়া চিঠিখানা পেশ করে এসেছিল ওরা, সেই ভদ্রলোক তার পরের রবিবারের সকালে এদের এখানে এসে হাজির হলেন।

এ হেন সম্ভাবনার কথা স্বপ্নেও মনে আসে নি ওদের। অবশ্য সেদিন এস্ত শঙ্কিত পলায়নপর ছেলে দুটোকে প্রায় জোর করে দাঁড় করিয়ে তাদের নাম কি, দেশ কোথায়, কলকাতায় বাসা কোন রাস্তায়, ইত্যাদি পক্ষানুপুঙ্খ জেনে নিয়েছিলেন ভদ্রলোক, তথাপি সেটাকে নিছক কৌতূহল ছাড়া কিছু ভাবে নি ওরা দুই ভাই।

সন্দেহমাত্র করে নি, দু-দিন না যেতেই কৈ গো খোকারা বলে এসে হানা দেবেন।

এ যেন বিনা মেঘে বজ্রাঘাত।

ভয়ে প্রাণ উড়ে গেল ওদের।

সভয়ে পরস্পর মুখ-চাওয়াচাওয়ি করল দু ভাই, তারপর সরল নিঃশব্দে দুটো হাত উল্টে এমন একটা বেপরোয়া ভঙ্গী করল, যার অর্থ দাঁড়ায়–তা আমাদের কি দোষ? আমরা তো ওনাকে আসতে বলি নি, পিসি বারণ করে দিয়েছিল তাই না

কিন্তু

এটাও বিনা শব্দে শুধু চোখের ইশারায় উচ্চারিত হল, কিন্তু আমরা সেদিন মিছে কথা বলেছি। মা যখন বলল, ইস্কুল থেকে ফিরতে দেরি কেন, তখন বলেছি ইস্কুলে বল খেলা ছিল।

কিন্তু এত সব ভাববিনিময় মুহূর্তেই ঘটল, কারণ ইত্যবসরেই ভদ্রলোক বাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে বাজখাঁই গলায় পুনঃপ্রশ্ন করেছেন, খোকারা বাড়ি নেই নাকি? এবং সত্যবতী মাথার কাপড় টেনে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এসে স্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করেছে, তুড়ু, দেখ তো কে? জিজ্ঞেস কর কাকে চান?

তুড়ুকে আর কষ্ট করে জিজ্ঞেস করতে হল না, যার কানে যাবার স্বচ্ছন্দেই গেল। আর তিনি সহাস্যে এগিয়ে এসে উত্তর দিলেন, ননদাই গো ননদাই, আপনি হচ্ছেন শ্যালাজ ঠাকুরুন?

শুনে সত্যবতী হাঁ।

এইমাত্র নবকুমার বাজারে গেল, আর এখন এই ঝামেলা! কে জানে লোকটা কে! কোন বদবুদ্ধি লোক না বাসা ভুল করে–সেই কথাটাই বলে সত্যবতী, ছেলেদের মাধ্যমে মাত্র করে, তুড়ু বল, আপনি বোধ হয় বাসা ভুল করেছেন–

বাসা ভুল!

ভদ্রলোক হেসে উঠলেন, মুকুন্দ মুখুয্যে এত কাঁচা ছেলে নয় যে উচিতমত তল্লাস না করে কারুর অন্দরে ঢুকে পড়বে। দস্তুরমত পাড়ার লোককে শুধিয়ে সঠিক জেনে তবে ঢুকেছি। বলি তুমি বারুইপুরের নীলাম্বর বাঁড়ুয্যের ব্যাটা নবকুমার বাঁড়ুয্যের পরিবার নয়? অস্বীকার কর?

বলে আপন রসিকতায় হেঁ হেঁ করে টেনে টেনে হাসতে থাকেন।

কথার ভাষা এবং ভঙ্গিমা এমনি অমার্জিত যে, রাগে আপাদমস্তক জ্বলে যায় সত্যবতীর। নিঃসন্দেহে যে কোন বদলোক, নামটা পরিচয়টা সংগ্রহ করে বাড়ি ঢুকে ভয় দেখাতে চায়।

চাক। সত্য বামনীকে চেনে না।

দৃঢ় আর বিরক্ত স্বরে বলে ওঠে সত্যবতী, তুডু বল, পাড়া-পড়শীকে শুধিয়ে কারুর নাম পরিচয় জানা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। আমরা ও নামে কাউকে চিনি না, উনি যেতে পারেন।

কিন্তু মুকুন্দ মুখুয্যে এত সহজে অপমানিত হন না। হাস্যকণ্ঠ বজায় রেখেই বলেন, চেনো না তা সত্যি! জানার সুযোগ আর ঘটল কই? তোমার ননদ ঠাকরুণ তো আমাকে ত্যাগ দিয়ে নিশ্চিন্দি আছেন। তা এতদিন পরে বিস্মরণ রাজার স্মরণ হল কেন, সেই কথা শুধোতেই আসা। কিন্তু খোকারা, তোমরা একেবারে চুপটি মেরে মুখটি সেলাই করে বসে আছ যে? সেদিন অত আলাপ পরিচয় হল, চিঠি পৌঁছে দিলে, আর আজ যেন চিনতেই পারছ না! মাকে বুঝি বল নি? তাই উনি ‘সোবে’ করছেন লোকটা গুণ্ডা বদমাশ!

এতক্ষণ তাই-ই ভাবছিল বটে সত্যবতী, কিন্তু ভদ্রলোকের শেষ কথাটায় যেন অকূল সমুদ্রে পড়ে।

এসব কি কথা!

বিন্দুবিসর্গও তো বুঝতে পারছে না সত্যবতী। নিজের ছেলেদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল। সেখানে স্পষ্ট অপরাধীর ছাপ। কী এ?

লোকটা কি বারুইপুরের কেউ?

তুড়ু খোকা যখন দেশে গিয়েছিল তখন দেখেছে এখন চিনতে পারছে না? কিন্তু চিঠি কিসের? ভগবান জানেন বাবা! একেই তো শ্বশুরবাড়িতে সত্যর নাম জাঁহাবাজ বৌ, আবার এককাঠি বাড়ল বোধ হয় সে বদনাম। ছেলে দুটো যেভাবে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে সন্দেহ নেই ঘটেছে কিছু।

কিন্তু তথাপি মুখে হারে না সত্য। দৃঢ় হলেও একটু নরম সুরে বলে, খোকা বল, বাড়ির পুরুষজন এখন বাড়ি নেই, আপনি একটু ঘুরে আসুন। যা বলবার তাঁকেই বলবেন।

মুকুন্দ মুখুয্যে এবার একটু গম্ভীর হন। বলেন, বলবার আমার কিছুই ছিল না। তবে আপনার ননদ ঠাকরুণ শ্রীমতী সৌদামিনী দেবী হঠাৎ তার ত্যাগ দেওয়া স্বামীকে একখানা পত্তর কেন দিলেন, তারই তল্লাস করতে

ঠাকুরঝি পত্র দিয়েছেন। আপনাকে! মানে আপনি

যাক এতক্ষণে চিনলে? বাবাঃ, কোথায় ভেবেছিলাম শালার বাড়িতে এসে একটু জামাই-আদর পাব, তা নয়–

কিন্তু ঠাকুরঝি চিঠি লিখেছেন! সত্য আরক্ত মুখে বলে, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না–অসম্ভব।

মুকুন্দ মুখুয্যে কথাটার অন্য অর্থ ধরেন। বলেন, আহা, নিজে হাতে কি আর লিখেছে? কাউকে ধরে লিখিয়েছে নিশ্চয়। এই তো তোমার এই খোকারাই দিয়ে এল পরশুদিনকে

আমার খোকারা? পরশুদিনকে?

সত্যবতীও বিচলিত হয়।

বিচলিত স্বরে বলে, তুড়ু! খোকা!

তুড়ু-খোকার নত বদন, যে বদনে অপরাধের কালিমা।

সত্য যেন একটু অসহায়তা অনুভব করে, আর এই প্রথম বোধ কবি নবকুমারের অনুপস্থিতিতে কাতরতা বোধ করে। মুকুন্দ মুখুয্যের চোখে সত্যর এই বিচলিত ভাবটা ধরা পড়তে দেরি হয় না। এবং ব্যাপারটা অনুধাবন করতেও দেরি হয় না। ছেলেমানুষদের যা হোক বুঝিয়ে চিঠিটা সৌদামিনী চুপিচুপিই পাঠিয়েছে। আগে এটা বুঝলে মুকুন্দ মুখুয্যে অন্যভাবে নিজেকে উপস্থাপিত করতেন। ছেলে দুটো থতমত খেয়ে যাচ্ছে, যাবেই তো, মা জননীটি যে খাণ্ডারনী তা তো বোঝাই যাচ্ছে। বাবাঃ, যেন পুলিসের ধমক!

কিন্তু মুকুন্দও পুলিসের বাবা।

আটঘাটটি বেঁধে তবে এসেছেন। চিঠিটা সঙ্গে এনেছেন। তবে ভদ্রলোকের ধারণায় একটু ভুল ছিল। ভেবেছিলেন সৌদামিনী নিশ্চয় কলকাতায় ভাইয়ের বাসায় এসেছে, আর ভাইপোদের সেটুকু চেপে যেতে বলেছে। নইলে সাতজন্মে যে কখনো কোন বার্তা দিল না, সে কেন হঠাৎ…, কিন্তু ধারণাটা ভুল তা তো বোঝাই যাচ্ছে। সৌদামিনী এখানে নেই!

সত্যি তবে কেন হঠাৎ?

সে চিন্তা যাক। ফতুয়ার পকেট থেকে সৌদামিনীর সেই গোপনতম দুর্বলতার ইতিহাসটুকু বার করে মেলে ধরেন মুকুন্দ মুখুয্যে দাওয়ার ধারে মেজেয়। আর দেখে এক মুহূর্তেই চিনে ফেলে সত্য– হাতের লেখাটা তারই বড় ছেলের। অর্থাৎ তুড়ুকে দিয়েই লিখিয়েছে সৌদামিনী।

সমস্ত ঘটনাটা স্পষ্ট হয়ে যেতে দেরি হয় না আর। দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধু নিজের ছেলেদের এই দুর্বোধ্য আচরণটা অন্ধকারেই থেকে যায়। সত্যবতীকে বিন্দুবিসর্গ না জানিয়ে এত কাণ্ড করবার সাহস কি করে হল ওদের?

পড়ে থাকা চিঠিখানিতে চোখ ফেলা মাত্রই পাঠোদ্ধার হয়ে গেছে, কারণ অক্ষরের ছাঁদ আর তার প্রতিটি টান, প্রতিটি বাঁক তো সত্যবতীর মুখস্থ।

না, প্রেমপত্র নয়, ভাইপোকে দিয়ে লেখানোর আপত্তির কিছুই নেই। সৌদামিনী লিখেছে– পরম পূজনীয় শ্রীচরণকমলেষু–

বহুকালাবধি আপনার কোনো সংবাদাদি জানি না, আপনিও সংবাদ নেন না অধীনা জীবিত
কি মৃত। আমার কথা থাক, আপনার সংবাদ পাইতে ইচ্ছা হয়। আমার ভ্রাতা নবকুমার
কলিকাতায় বাসা করিয়া আছে, তাহার সহিত সাক্ষাৎ হইলে জানিতে পারি। ইহারা নবকুমার
ভাইজীবনের পুত্র সাধনকুমার ও সরলকুমার। পত্রদানের ধৃষ্টতা মার্জনা করিবেন।
        অধিক কি লিখিব! ভগবানের নিকট নিয়ত আপনার কুশল প্রার্থনা করি।
         শতকোটি প্রণামান্তে
         চরণের দাসী
         শ্ৰীমতী সৌদামিনী দেবী।

পাঠোদ্ধার করে যেন স্তব্ধ হয়ে যায় সত্য। এই সৌদামিনী দেবী কোন সৌদামিনী? সেই তাদের সদুদি? সেই সদুদি নিয়ত ভগবানের কাছে সেই লোকটার কুশল প্রার্থনা করে? এই বেঁটে-খাটো খাটমুগুরে গড়নের আধবুড়ো লোকটার?

এও কি সম্ভব?

সৌদামিনী বিধবা নয় এইটুকু মাত্র জানা যেত ভাত খেতে বসার সময়। হেঁসেলের ভাতটা নিয়ে বসত সে মামীর সঙ্গে, ভাই-বৌয়ের সঙ্গে, মাছের ভাগটা নিয়ে। এই যা।

তা ছাড়া আর কখনো কোনদিন কোন সময় টের পাওয়া যেত না সদুর স্বামী আছে। আশ্চর্য! আশ্চর্য! মানুষ কী অদ্ভুত জীব গো! শুধু মনে থাকাই নয়, স্বামীর সংবাদের জন্য উতলা হয় সে! এতই হয় যে মান-মর্যাদা জলাঞ্জলি দিয়ে চরণ্যের দাসী সাক্ষরিত চিঠি পাঠায়।

এ কী দীনতা!

এ কী দুর্বলতা!

বয়সকালে চিরদিন স্থির থেকে এখন এই ভাঁটা-পড়া বয়সে এমনই অস্থির হল যে মান-অপমান জ্ঞান হারাল?

সৌদামিনীর এই পদস্খলন যেন সত্যবতীর মাথাটা লুটিয়ে দিল।

পদস্খলন!

হ্যাঁ, পদস্খলনই মনে হল সত্যবতীর। আর অকস্মাৎ তার বড় একটা যা না হয় তাই হল, দুই চোখ জলে ভরে উঠল।

তবু কষ্টে নিজেকে সামলে মাথার কাপড়টা আর একটু বাড়িয়ে সত্য বড় ননদাইয়ের পায়ের ধুলো নিয়ে শান্তস্বরে বলে, মনে কিছু করবেন না, চেনা-জানা তো নেই কখনো। দাওয়ায় উঠে বসুন। তিনি বাজারে গেছেন, এসে পড়বেন এখনই।

গুরুজনদের সামনে “উনি” বলাটা অশোভন, তাই “তিনি” বলে সত্যবতী।

অবশ্য তাতে বুঝতে অসুবিধে হয় না, সংসার করে ঝানু হয়ে যাওয়া মুকুন্দ মুখুয্যের। এতক্ষণে তিনি শালাবৌয়ের আচরণে প্রীত হন এবং প্রণতাকে থাক থাক্‌ করে সৌজন্য দেখিয়ে গর্বিত ভঙ্গীতে উঠে গিয়ে দাওয়ায় পাতা জলচৌকিতে আঁকিয়ে বসেন।

সত্যবতীর চোখের ইশারায় ছেলেরাও তাদের নবলব্ধ পিসেমশাইকে প্রণাম করে এবং চোখের ইশারাতেই তামাক সেজে আনতে যায় সরল। যদিও নবকুমার তামাক খায় না, তবুও তামাকের পাটটা বাড়িতে রেখেছে সত্যবতী অতিথি-অভ্যাগতদের জন্য।

আপ্যায়ন করতে হবে বৈকি!

পিতৃঋণ মাতৃঋণ দেবঋণ গুরুঋণ! তা অলক্ষ্য জগতের, আর তার শোধের কথা তো কথার কথা। আসলে কুটুম্ব-ঋণের তুল্য ঋণ নেই, আর তার শোধটা নিতান্তই প্রত্যক্ষ বাস্তব। দুর্লজ্জ নীতিকে লঙ্ন করবে সত্য, লোকটা কুটুম্ব নামের অযোগ্য বলে?

তা পারে না?

এখন আর পারে না।

এ সেদিনের সেই কিশোরী সত্যবতী নয়, একদা যে শ্বশুরকে অপবিত্র জ্ঞান করে তার পূজোর গোছ করে দিতে অস্বীকৃত হয়েছিল। এ সত্যবতীর অনেক বাস্তববুদ্ধি হয়েছে। এখনকার সত্য জানে কতকগুলো ব্যাপারকে মনের সঙ্গে রফা করতে না পারলেও, বাইরে খানিকটা রফা করে নিতে হয়। নইলে অসামাজিকতা অভদ্রতা ইত্যাদির দায়ে পড়তে হয়। সংসার যখন করতে বসেছে, সামাজিকতার দায় পোহাতে হবে বৈকি।

তাই একটা নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘরে ঢুকে উনুনে চাপানো হাঁড়িটা নামিয়ে রাখে। তারপর বড়ছেলেকে হাতের ইশারায় ঘরে ডেকে তার হাতে রসগোল্লা আনবার পয়সা দিয়ে ঘরের দরজার কাছে এসে বসে। সেখান থেকে সরাসরি না হলেও ননদাইকে অবলোকন করা যায়।

নবকুমার যতক্ষণ না ফিরছে, ততক্ষণ এই বন্ধন-যন্ত্রণা সইতেই হবে তাকে।

হুঁকোয় একটি সুখটান দিয়ে মুকুন্দ মুখুয্যে রাশভারী গলায় প্রশ্ন করেন, কতদিন হল বাসা করে থাকা হয়েছে?

সত্য মৃদুস্বরে বলে, অনেক দিন। সাত-আট বছর।

বল কি? তখন তো তুমি প্রায় কাঁচা যুবতী গো! তা বুড়ো-বুড়ী যে মত দিল? নাকি মরেছে তারা?

সত্যর ইচ্ছে হয় মুখের সামনে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকে গুম হয়ে। কিন্তু করে। সংক্ষেপে বলে, আছেন। মত না দিলে চলবে কেন? ছেলেদের লেখাপড়া।

হুঁ, তা বটে। একালে তো আর পাঠশালে পড়া বিদ্যেয় চলবে না। তা মাত্তর ওই দুইটি নাকি? কুচোকাঁচা দেখছি নে তো!

২৬৪

এ কথার আর উত্তর কি দেবে সত্য, চুপ করেই থাকে। আর হয় নি এটা বলতেও বুঝি কোথায় কাঁটার মত একটু বাধে। অদৃশ্য সেই কাটাটা বুঝি আস্তে আস্তে অবয়ব নিচ্ছে এক নিভৃত অন্ধকারে।

মুকুন্দ কিন্তু নাছোড়, ফের বলেন, বাপের সঙ্গে বেরিয়েছে বুঝি?

এ প্রশ্নের উত্তরটা সরলই দিয়ে ফেলে, আমরা শুধু দুই ভাই।

মুকুন্দ যে এর মধ্যে নিরে কী “ভাল” আবিষ্কার করেন কে জানে, সস্মিত মুখে বলেন, তা ভাল! আপদের শান্তি! এ দিব্যি ঝাড়া-হাত-পা-হয়ে যাওয়া। এখন তীর্থ কর ধর্ম কর, দস্যিবিত্তি করে সংসার কর, কোনো বালাই নেই। বাবাঃ, আমার ঘরের এণ্ডিগেণ্ডিগুলো দেখলে আমার মাথা কেমন করে! মানুষের ছাঁ তো নয়, যেন হাঁস-মুরগীর পাল?

এবার বোধ করি সত্য বিরক্ত হতেও ভুলে যায়, চমৎকৃত হয়েই তাকিয়ে থাকে। বেটাছেলেতে যে এমন ধরনের কথা কইতে পারে এ তার জানা ছিল না। তার বাপের বাড়ির দেশে অনেককে দেখেছ সে, মেয়েলী বেটাছেলেও দেখেছে, দেখেছে নীলাম্বরকে, নবকুমারকে, সত্যর আদর্শ অনুযায়ী ‘পুরুষ বেটাছেলের’ রূপ কোথাও দেখে নি সত্য, কিন্তু এ কী!

গ্রামের গাইয়ামির মধ্যেও এক ধরনের শোভন-সভ্যতা আছে, এই শহুরে গেঁয়োটাও এক কথায় বিশ্রী কুৎসিত!

অথচ দেখলে বোঝা যায় লোকটা এককালে ‘সুপুরুষ’ বলেই গণ্য হত। একটু বেঁটে, তবে রংটি হর্তেলের মত, মুখাকৃতি দিব্য, কাঁচা-পাকা হলেও চুলে কেয়ারি আছে, আর সর্ব অবয়বে তোয়াজের চিহ্নটি পরিস্ফুট।

হাঁস-মুরগীর পালের সংসার হলেও, ভদ্রলোক নিজের তোয়াজটি ভালই বাগিয়ে নেন সন্দেহ নেই। সদুদির সতীনকে মনে মনে একপ্রকার ব্যাঙ্গাত্মক তারিফ করে সত্য।

কিছুক্ষণ নীরবতা।

মুকুন্দ হুঁকো টানছেন, সত্য উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে সদরের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে, আর বেচারা সরল মনে মনে কাঠ হয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে উদ্যত বজ্রের নীচে প্রতীক্ষারতের মত। এই লোকটা চলে যাওয়ার পর যে তাদের বিচার হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নাস্তি।

প্রতীক্ষার মুহূর্ত দীর্ঘ। সত্যর মনে হয় নবকুমার যেন কতকাল বাজারে গেছে। আর তুড়ুটাও কম দেরি করছে না। ময়রার দোকান তো এই কাছেই।

নীরবতা ভঙ্গ করলেন মুকুন্দ।

বলেন, তা তোমার ননদ ঠাকরুণই বোধ হয় মামা-মামীর সেবা করছে?

কণ্ঠে যেন একটু চাপা অসন্তোষ। সত্য আস্তে বলে, উনিই তো কাছে আছেন বরাবর।

তা থাকতেই হবে, বেটা বেটার-বৌ যখন উড়তে শিখেছে। কিন্তু স্বামীর সংসারের প্রতিও তো একটা কর্তব্য আছে? এই তো আমার ঘরে, সংসারটা একটা মানুষ বিহনে ফুটোনৌকার তুল্য। দ্বিতীয় পক্ষটি তো আমার হঘড়ি আঁতুড়ুঘরে ঢুকতে ওস্তাদ, বাচ্ছা-কাচ্ছাগুলোর হাড়ির হাল। এখন বড় গিন্নী এসে থাকলে সবদিকই রক্ষা হয়, আর তারও

বোধ করি নিতান্তই অসহ্য বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে সত্য এতগুলো কথা বলবার অবকাশ দিয়েছিল লোকটাকে, কিন্তু স্তব্ধতার ঘোর কাটল। আর লোকটা যে সদ্য আগন্তুক এবং হিসেবমত গুরুজন, সে কথা বিস্মৃত হয়ে মৃদু হলেও তীব্রস্বরে বলে উঠল, আপনার অবিশ্যি সবদিক রক্ষে হয়, বিনি মাইনের রাঁধুনী-চাকরানী-ঘরুনী সব পেয়ে যান, কিন্তু তার কী উপকারটা হবে শুনি?

মুকুন্দ মুখুয্যে ক্ষণকালের জন্য থতমত খেয়ে যান, কারণ এ হেন তীব্রতার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে এ কল্পনা নিশ্চয় ছিল না তার, তবে আত্মস্থ হতেও দেরি লাগে না। সেই আত্মস্থ ভঙ্গীতে মৃদু হাস্যের প্রলেপ লাগিয়ে বলেন, শালাবাবুর আমার পরিবার-ভাগ্যিটি তো দেখছি বেশ ভালই। একে রূপসী তায় বিদুষী, নাটক নভেল পড়ার অভ্যেস আছে বোধ হয়! তা জিজ্ঞেসই যদি করলে তো বলি, উপকারের কিছু না হোক পরকালের কাজটাও তো হবে? মামার ঘরে দাস্যবিত্তি করার চাইতে স্বামীর ঘরে দাস্যবিত্তি কিছু আর অপমান্যির নয়?

সত্য উঠে দাঁড়ায়, ধীর স্বরে চেষ্টা করে বলে, মেয়েমানুষের কোনটা মান্যের আর কোনটা অমান্যের সে জ্ঞান থাকলে আর এ কথা বলতে পারতেন না। তবে ঠাকুরঝি যে আপনাকে ত্যাগ দেয় নি, আপনিই ত্যাগ দিয়েছেন তাকে, জানা আছে আমার সে কথা। এখন সংসারে ঝিয়ের দরকার হয়েছে বলে তার পরকালের চিন্তা নিয়ে মাথা ঘামাতে এসেছেন–

যতই ধীরভাবে বলতে চেষ্টা করুক, তবু উত্তেজনায় মুখটা লাল হয়ে ওঠে সত্যর। আর এ উত্তেজনা শুধু ওই চোখের চামড়াহীন বর্বরটার নিলর্জতাতেই নয়, সদুর নির্লজ্জতাতেও। এই হতচ্ছাড়া লোকটাকে এসব কথা বলার সুযোগটাও তো সদুই দিয়েছে।

মুকুন্দ মুখুয্যে এর উত্তরে কী বলতেন অথবা সত্য কিভাবে কথা শেষ করত কে জানে, বাধা পড়লে পিতা-পুত্রের আগমনে। সাধন এসেছে রসগোল্লা নিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে নবকুমারও। পথে বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় সমাচারটা জানিয়ে দিয়ে অবহিত করিয়ে এনেছে সাধন। বাবার দেখা পেয়ে যেন আপাতত বেঁচেছে বেচারা, সরাসরি মার মুখোমুখি দাঁড়াতে অন্তত কিছুটা বিলম্ব হবে।

নবকুমার অবশ্য গুরুজন এবং দুর্লভ কুটুম্বর সম্মান জানে। শশব্যস্তে হাতের জিনিস নামিয়ে হেট হয়ে পায়ের ধুলো নিয়ে সস্মিত বচনে বলে, কী ভাগ্য আমার, পায়ের ধুলো পড়ল এতদিন পরে! কতক্ষণ এসেছেন?

সত্য ততক্ষণে রসগোল্লার ভাঁড় নিয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। মুকুন্দ অন্তরালবর্তিনীর কর্ণগোচর হতে পারে এমন উদাত্ত স্বরে উত্তর দেন, তা এসেছি অনেকক্ষণ! এতক্ষণ হাঁ হয়ে বসে তোমার বিদুষী পরিবারের লেকচার শুনছিলাম। কলকেতারই মেয়ে বুঝি? মেমের কাছে লেখাপড়া শেখা?

লজ্জায় মাথাটা হেঁট হয়ে যায় নবকুমারের, মুখটা টকটকে হয়ে ওঠে। আর সত্যর প্রতি অপরিসীম ক্রোধে যেন হতবাক হয়ে যায়।

আস্পদ্দার কী একটা সীমা নেই? কথা বলতে জানে বলে যাকে যা ইচ্ছে বলবে? অতবড় বুড়ো ননদাই, তাও আবার চিরদিনের অদেখা, তার সঙ্গে তো কথা কইবারই কথা নয়, ঘোমটা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়বার কথা, তা নয়, এমন কথা শুনিয়েছেন বসে বসে যে এই উপহাসের জুতোটি খেতে হল নবকুমারকে।

ছি ছি!

কিন্তু এখন হচ্ছে মনের রাগ মনে চাপা, কিল খেয়ে কিল চুরি। জুতোটাকে বোনাইয়ের রসিকতা বলে ধরে নিয়ে হেঁ হেঁ করে হাসা।

সেই হাসিই হাসতে থাকে নবকুমার এবং সত্য নিঃশব্দে রসগোল্লার রেকাবি আর জলের গ্লাসটা নামিয়ে বাজারের ধামাটা তুলে নিয়ে ঘরে চলে গেলে বোনাই নিজেই যখন রেকাবিটি হাতে উঠিয়ে ব্যঙ্গ হাস্যে বলেন, জুতো মেরে গরুদান? তা মন্দ নয়। যাক, বামুন মুচি-বাড়িতেও লুচি খেতে ছোটে- তখনও নবকুমার সেই হেঁ হেঁ হাসি হাসতে থাকে। বরং মাত্রাটা আরো বাড়িয়ে দেয়।

অতঃপর সত্য আর বেরোয় না।

ছেলে দুটো গুটি গুটি ঘরে ঢুকে বই নিয়ে পড়তে বসে।

নবকুমারের সঙ্গেই অনেকক্ষণ কথা চালান মুকুন্দ।

সুহাসিনী বাড়িতে নেই, রবিবার সকালে সে পাশেরই এক বড়লোকের বৌয়ের কাছে লেস বোনা শিখতে যায়। বৌটির ছেলেমেয়ে নেই, বাড়িতে প্রচুর চাকরদাসী, স্বামীটি রবিবার হলেই সক্কাল থেকে তাসের আড্ডায় চলে যায়, অতএব রবিবার সকালে তো বটেই, এমনিতেও বৌটির অফুরন্ত অবকাশ।

সুহাসিনীর স্কুলে যাবার পথে জানলা দিয়ে ডেকে নিজেই আলাপ করেছিল বৌটি।

ওই লোকটা থাকতে থাকতে সুহাস না ফিরলেই বাঁচি, রান্না করতে করতে ভাবল সত্য। ফিরলে তো ওরই চোখের সামনে দিয়ে ফিরবে? অতি বদ প্রকৃতির লোক। দেখলে নিশ্চয় ওই সুহাসের কথায় সাতশ কৈফিয়ত চাইবে।

মানুষ যে কেন এমন অসভ্য হয়!

আস্তে আস্তে অন্য ভাবনায় চলে যায় সত্য, শুধু কি অসভ্যই হয়? হ্যাংলাও হয় না কি? নইলে সদু ওই বদ লোকটাকে এখনো স্বামীজ্ঞান করে বসে থাকে? শুনেছে নবকুমারের কাছে ইতিহাস। নির্যাতনের জ্বালায় চলে গিয়েছিল সদু, তারপর এই নির্যাতক স্বামীর ঘরে সতীন-কাটা পুঁতেছে, সে খবরও জানা। তবে? এত সত্ত্বেও কি চিরদিন মনে মনে ওর চরণের দাসী হয়ে থেকেছে সৌদামিনী? না ওটা একটা নিয়মরক্ষের পাঠ মাত্র?

হয়তো এদিকে মামীর নির্যাতনে সাময়িকভাবে কোনদিন ধৈয্যচ্যুত হয়েই এ কাজটা করে বসেছে।

কিন্তু তাই কি?

এ তো মনে হচ্ছে বেশ পরিকল্পনার ব্যাপার। রাগের মাথায় কিছু করে ফেলা নয়। পাড়ার কোনো ছেলেপুলেকে দিয়ে লেখালে লোক-জানাজানি হবার ভয়েই হয়তো এতদিন পারে নি। এখন নিজের ভাইপোদের দিয়ে

সন্দেহ নেই কথাটা প্রকাশ করতে বারণ করেছে ছেলেদের। সদুর ওপর এজন্যেও রাগ হয় সত্যর। পিসি হয়ে লুকোচুরি করার বিদ্যেটায় হাতেখড়ি দিলে তুমি!

এখন সত্য কি করে ওদের তিরস্কার করবে?

সেটা কি ঠিক হবে?

পিসিও তো গুরুজন। তার কাছে যখন কথা দিয়েছে। “সত্যরক্ষা” যে মানুষের জীবনের সারধর্ম, এ কথা সত্যই শিখিয়েছে ছেলেদের।

কিন্তু যতই যা শেখাও, তুড়ুটা ঠিক তার বাপের ধাচে যাচ্ছে। মেরুদণ্ডহীন অসার। তবে নবকুমারের আবার তার ওপর মুখে তড়পানি আছে, এর সেটা নেই এই যা! মৃদু ভালমানুষ ছেলেটা। কিন্তু ভালমানুষই কি প্রার্থনীয়? ওই ভাল’টা বাদ দিয়ে যেটা হয়, সেটাই যে চায় সত্য।

সরলটা হয়তো একটু অন্যরকম হবে।

কিন্তু সে কোন্ রকম?

সত্যবতীর মনের মধ্যে মানুষের যে ছাঁচ গঠিত আছে, তার ধারে-কাছে পৌঁছবে?

নাঃ, সে আশা নেই সত্যর। লেখাপড়া শিখবে, রোজগারপত্র করবে, পাঁচজনে “ভাল” বলবে এই পর্যন্ত। তার বেশী নয়, বুঝে নিয়েছে সত্য। যদি তার বেশী হত, এতদিনে ধরা পড়ত সে দীপ্তি, সে ঔজ্জ্বল্য।

বরং সুহাসিনীর মধ্যে বস্তু দেখতে পায় সত্য, দেখতে পায় দীপ্তির চমক। যে সুহাসিনীর কৈশোরকাল পর্যন্ত কেটেছে এক কুশ্রী পরিস্থিতির মধ্যে। জীবনের বনেদে যার শুধুই শূন্যতা।

হয়তো সেই জন্যেই।

আলো আর অন্ধকারের পার্থক্যটা ওর কাছে তীব্র হয়ে ধরা পড়েছে। এদের কাছে সে তীব্রতা নেই। এরা তাই ঝাঁপসা-ঝাঁপসা। চোদ্দ-পনেরো বছর বয়স হল, এখনো বোঝা যাচ্ছে না ওরা নিজেদের নিয়ে কিছু ভাবে কিনা, ভাবতে শিখেছে কিনা। কোনটা ভালো কোটা মন্দ সেটা চিন্তা করে কিনা।

আশ্চর্য!

সত্যবতীর মনের মধ্যে যে ছাঁচ, সত্যবতীর গর্ভের উঁচ তার নাগাল পেল না।

ঈশ্বর জানেন এই সুদীর্ঘকাল পরে সত্যবতীর সত্তার মধ্যে আবার কোন্ ছাঁচ গঠিত হচ্ছে। প্রথমটা ভারী একটা বিপন্নতা বোধ করেছিল সত্য, বিপদ বলে মনে হয়েছিল ঘটনাটাকে, ক্রমশ মনটা কোমল হয়ে আসছে। এমন কি মাঝে মাঝে ভাবতেও ইচ্ছে করছে, পালা বদল হলে মন্দ হয় না, একটি মেয়ে হলে বেশ হয়।

আজ হঠাৎ মনে হল সত্যবতীর, যদি তা-ই হয়, কে বলতে পারে সে মেয়ে তার পিতামহীর আকৃতি আর প্রকৃতি নিয়ে অবতীর্ণ হবে কিনা!

হয়তো তাই হবে।

সত্যবতীর একাগ্র ইচ্ছার নিরন্তর তপস্যা কোনো কাজেই লাগবে না। মেয়ে মানুষের এ এক অদ্ভুত নিরুপায়তা। নিজের রক্ত মাংস মন বুদ্ধি আত্মা সব কিছু দিয়ে যাকে গড়ছি, জানি না সে কী হবে!

নিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, শুনেছি শাস্তরে আছে নরাণাং মাতুলক্রমঃ! কিন্তু মাতুল না থাকলে? দাদামশাইয়ের আত্মজই তো মাতুল? তবে? দাদামশাইয়ের কথা শাস্ত্রে লেখে নি।

চিন্তায় ছেদ পড়ল।

বাইরে সেই বাজখাই গলা বেজে উঠল, কই গো বাড়ির গিন্নী, অত লেকচার-টেকচার শুনিয়ে হঠাৎ একেবারে ডুব যে! অধম তাহলে এখন বিদায় নিচ্ছে। মাঝে মাঝে আসতে অনুমতি হবে তো?

সত্য বাইরে বেরিয়ে এসে হেঁট হয়ে নমস্কার করে শান্ত গলায় বলে, আসবেন বৈকি।

.

কিন্তু এতে, ওই শান্ত বচনেতে কোন কাজ হল না।

মুকুন্দ বিদায় নিতে নবকুমার রে রে করে পড়ল।

বলি তোমার ব্যাপারটা কী? কী সব যাচ্ছেতাই কথা বলছ মুখুয্যে মশাইকে?

সত্য বিরক্তভাবে বলে, যাচ্ছেতাই আবার কী বলতে যাব?

তা যাচ্ছেতাই ছাড়া আবার কী? উনি কিছু যেচে আসেন নি? দিদি তল্লাস করেছিল তাই

কথা থামিয়ে দিয়ে সত্য বলে ওঠে, সেই ঘেন্নাতেই গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল আমার।

তার মানে?

মানে ভেবো খেয়ে দেয়ে নিশ্চিন্দি হয়ে। এখন চান কর গে।

থাম! বলি দোষটা কি করেছে দিদি? স্বামী তো বটে?

তা তো নিশ্চয়।

তবে? নবকুমার সোৎসাহে বলে, মুখুয্যেমশাই যা বললেন, তাতে বুঝলাম ওঁর দুঃখটা। আর যাই হোক লোকটা কপট নয়। বললেন, একসময় দোষ ঘটেছিল ঢের, কুসঙ্গে পড়ে নেশাভাঙ কুকর্ম কিছুই বাকী রাখি নি ভায়া, সতী-সাধ্বীকে লাঞ্ছনাও করেছি। কিন্তু পরে চৈতন্য হয়েছে।

সত্য নিরীহ গলায় বলে, হয়েছে বুঝি!

হয়েছে বৈকি। এখন তো ঐ তামাকটুকু ছাড়া আর কোনো নেশাই নেই। তাই বলছিলেন, কত ইচ্ছে হয়েছে গিয়ে ক্ষমা চাই, মামার পায়ে ধরে চেয়ে আনি কিন্তু লজ্জায় পারি নি। তা তোমার দিদি যেকালে আগু বাড়িয়ে লজ্জাটা ভেঙ্গে দিল, তাতে

তা বেশ তো, সুখের কথা। দিদিকে আনিয়ে নিয়ে আবার নতুন করে গাঁটছড়া বেঁধে পাঠিয়ে দাও। দুই সতীনে সুখে সংসার করুন– বলে একটু তীক্ষ্ণ হেসে সরে যাচ্ছিল সত্য, কিন্তু মুহূর্তে ঘটে গেল এক বিপর্যয়।

নবকুমার বোধ করি কিছু না ভেবেচিন্তেই ক্ষণপূর্বে শোনা একটি কথা যথাযথ উচ্চারণ করে বসল, তা সে সতীন-জ্বালা আর বেশী দিন নয়। শুনলাম নাকি এ পক্ষের সূতিকা ধরেছে। তবে? সে কাঁটা আর কদিন?

মুহূর্তে যেন একটা বোমা ফেটে গেল। সত্যবতী উন্মাদের মত নিজের কপালে একটা থাবড়া মেরে চিৎকার করে উঠল, চুপ করবে তুমি? দয়া করে একটু চুপ করবে? যদি তা না পারো তো যে করে পারো, আমায় জন্মের শোধ কালা করে দাও!

একার সংসারে এতদিন ধরে অরুচি আর অক্ষিদেয় না খেয়ে খেয়ে ভিতরে ভিতরে দুর্বল হয়ে যাওয়া শরীরটা এই উত্তেজনার বার বইতে পারল না। হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল।

ছেলে দুটো হাউমাউ করে জল আর পাখা আনতে ছুটল, নবকুমার ঘর থেকে একটা বালিশ এনে সত্যর লুটিয়ে পড়া মাথার তলায় গুঁজে দিতে বসল, আর এই সময় সুহাসিনী ও-বাড়ি থেকে এসে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আজ ভারী উৎফুল্ল হয়ে আসছিল সুহাস, কারণ তাঁর শিক্ষা-গুরু বৌটি বলেছেন, তুমি যদি ভাই রাজী থাক তো আমার মাস্টারী কর। বড়লোকের বাড়িতে কেবল খেয়ে শুয়ে জীবনে যেন ঘেন্না ধরে গেছে। তোমায় দেখে মনে হয়, যদি তোমার মতন বই-টই পড়তে পারতাম, তা হলেও বা দিনটা কাটত। তা ইস্কুলে যাওয়া তো আর জীবনে হবে না, তবু তোমার কাছে যদি

মাস মাস আটটা করে টাকা দিতে চেয়েছে সে। সুহাস অবশ্য টাকার কথায় আপত্তি করেছিল, বলেছিল, টাকা কেন ভাই! তুমি আমায় একটা বিদ্যে শেখাচ্ছ, আমি না হয় তার বদলে তোমাকে একটা

কিন্তু সে হাতে ধরে কাকুতি-মিনতি করেছে। বলেছে, আমায় শখের জন্যে টাকা খরচ করতে তো আমার বর সর্বদা রাজী! একদিন থিয়েটারে নিয়ে যেতে পচিশ-তিরিশ টাকা খরচ করে, এও তো আমার একটা শখ! গুরুকে দক্ষিণে না দিলে বিদ্যে হয় না।

সুহাস রাজী হয়ে এসেছে।

উফুল্ল হৃদয়ে সত্যর কাছে বলতে আসছিল, দেখ পিসীমা, বড়লোক মাত্রেই খারাপ হয় না। তাদের মধ্যেও মহৎ আছে–, কিন্তু এসেই এই দৃশ্য।

তাড়াতাড়ি সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সেবার ভারটা হাতে তুলে নিল সে। আর সেই প্রথম খবরটা জানল। আত্মগত ভাবেই বলে ফেলল নবকুমার, শরীরটায় পদার্থ নেই দেখছি। বাচ্চা-কাচ্চা হবার আগে মেয়েছেলে মা-ঠাকুমার কাছে যায়, তা সে গুড়ে তো বালি! বারুইপুরেই পাঠিয়ে দিতে হবে দেখছি!

কিছুটা সময় দিশেহারা হয়ে তাকাল সুহাস। তার পর নিজের ওপর ধিক্কারে অবাক হয়ে গেল। ছি ছি, এত বড় বুড়ো মাগী সে, এমনই অবোধ! এক ঘরে একসঙ্গে, কিছু টের পায় নি? তুড়ু খোকার চাইতে তা হলে কোন তফাৎ নেই তার? পিসীমার যে শরীরে এমন অবস্থা হয়েছে, প্রথমে তো তারই বোঝা উচিত ছিল। যত্ন-আত্তিও করা উচিত ছিল।

বুঝতে পারে নি।

সত্যর ছেলে দুটো এত বড় হয়ে গিয়েছে যে, এ ধরনের চিন্তা মাথাতেই আসে নি। তা শুধু লজ্জাই নয়, আজ সত্যর ওই চৈতন্যহীন পাংশু মুখের দিকে তাকিয়ে অজানা একটা ভয়েও বুকটা কেঁপে উঠল সুহাসের।

সুহাসের ভাঙা ভাগ্যে যদি তার এই আশ্রয়ের ভেলা ডুবে যায়? যদি সত্যর কিছু ঘটে?

অনেকদিন পরে ছেলেপুলে হলে তো বিপদ হতে পারে শুনেছে, বুকটা কেঁপে নিথর হয়ে এল সুহাসের। আর বোধ করি এই প্রথম উপলব্ধি করল সত্যকে কতটা ভালবাসে সে। শুধু আশ্রয়ের ভেলা বলেই নয়, মানুষ’টা বলেও প্রাণের আসনে বসিয়ে রেখেছে সুহাস সত্যকে প্রতি মুহূর্তের সংস্পর্শে।

মা-ঠাকুমা নেই বলে যত্ন পাবে না সত্য? সুহাসের কি বয়েস হয় নি সেবা করবার?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *