সাতাশ শতাব্দী পর

সাতাশ শতাব্দী পর

ইথাকা নগরীর এক প্রান্তে পথের ধারে বসে আছেন
এক প্রবৃদ্ধ কবি, সামনে কয়েকটি শ্রোতা
অন্ধকার গাঢ় হলে তার কাছে এসে দাঁড়াল
স্থান-কাল-আয়ু নিরপেক্ষ এক সুঠাম পুরুষ
তার সর্বাঙ্গে অন্য কোনো পোশাক নেই, শুধু একটা
কালো চাদর জড়ানো
আকাশ পথে উড়ে গেল কয়েকটি বাদুড় আর তারও ওপরে
কালপুরুষের কোমরবন্ধে একটি তারা
বৈদূর্যমণির মতন উজ্জ্বল
বিশাল ডানা ঝাপটে একটি অ্যালবাট্রস এসে বসল
কাছাকাছি এক সুউচ্চ ম্যাগনোলিয়া গাছে
তাতে ফুটে আছে অজস্র ডিম্বাকার ফুল
সমুদ্র বাতাসে ভেসে আসছে মাল্লাদের অস্পষ্ট গান…
হোমার বললেন, এক দিনার দাও, আর কী শুনতে চাও বলো
প্যারিস ও মিনেলাসের দ্বন্দ্বযুদ্ধ কিংবা হেকটর পতন
কিংবা সেই রমণীর মুখের বর্ণনা, যার জন্য সহস্র রণতরী
ভেসে পড়তে পারে বসফরাসে
কালো চাদর জড়ানো মানুষটি কোনো কথা বলল না
তার নীরবতা অতল জলের স্রোতের মতন বাঙ্ময়
তার দাঁড়াবার ভঙ্গিটি ভবিষ্যকালের ডেভিডের ভাস্কর্যের মতন
অ্যালবাট্রসটি তৃতীয় সপ্তক স্বরে বলে উঠল:
আমার এক পূর্ব পুরুষের নাম ছিল সম্পাতি, আমি
বংশানুক্রমিক কাহিনীতে শুনেছি জনকদুহিতা সীতার কথা
রাম নামে রাজার প্রিয়তমা, যে রাজার আর কোনো মহিষী ছিল না
রাবণ সেই সীতাকে হরণ করার পর সমুদ্রের বুকে সেতু বন্ধন হয়েছিল
মানুষেরা এক রমণীর জন্য হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করতে যায়
প্রায় তো আপনার কাহিনীর মতন একই রকম!
হোমার শুনলেন, কিন্তু বিস্মিত হলেন না
কৌতুক হাস্যে বললেন, জাহাজ বানাতে শেখেনি, তাই সমুদ্র
বেঁধেছে পাথর দিয়ে
তাও মন্দ নয়!

আগন্তুকটিকে তখনো বাক্যহীন দেখে হোমার আবার প্রশ্ন করলেন,
তুমি কি রাজপুরুষ, না যোদ্ধা, না বণিক, না দস্যু?
যদি লুণ্ঠন করতে এসে থাকো, তবে জেনে নাও, আমি
নিতান্তই অকিঞ্চন
যদি আমাকে শাস্তি দিতে চাও, শুনে রাখো, কবিরা অবধ্য!
অর্থাৎ অতি সামান্য কীট-পতঙ্গের মতন বধের অযোগ্য, হা-হা-হা
আমি চোখে ভালো দেখতে পাই না, কে তুমি?
তিনি হাত বাড়িয়ে লোকটির কোমরের অস্ত্র পরীক্ষা করতে গিয়ে
টের পেলেন তার পৌরুষ
আবার সহাস্যে বললেন, তোমার তো ঔৎসুক্য আছে, তা হলে দাও দুদিনার
শোনাব এক নয়, তিন রমণীর কথা
কিংবা জানতে চাও অডিসিউস, আথিনার উপাখ্যান?
আগন্তুকটি তবু নিশ্চুপ
অ্যালবাট্রস বলল, প্রাচ্যে তখনো রণতরী ছিল না বোধহয়
তবে, আমি শুনেছি যুদ্ধ জয়ের পর রাম তাঁর রানিকে নিয়ে
রাজধানীতে ফিরেছিলেন
আকাশ পথে উড়ন্ত রথে!
এবারে শ্রোতাদের মধ্য থেকে এক বামন বলে উঠল, মনোরথ! মনোরথ!
যেমন আমি মাঝে মাঝে
চাঁদের গায়ে হাত রাখি!
আর এক প্রৌঢ় বললেন, প্রাচ্যের মানুষ নানারূপ জাদুবিদ্যা জানে
ওরা মায়ারূপ ধারণ করতে পারে, ওদের সব মন্ত্রই
ঝঙ্কারময় বিশুদ্ধ কাব্য!
হোমার দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, ঝঙ্কারময় হলেই বিশুদ্ধ কাব্য হয় না!
তবু সেই সব কবিদের আমি প্রণতি জানাই!

এই সময় ধীর পায়ে সেখানে এল এক জ্যোৎস্নামাখা রমণী
তার সঙ্গে এক অনিন্দ্যকান্তি দুরন্ত শিশু
সবাই কাব্য ভুলে চেয়ে রইল সেই জীবন্তরূপের দিকে
রমণীটি হোমারকে বলল, বাবা, বাড়ি চলুন, কত রাত হল
আপনার কি ক্ষুধা-তৃষ্ণা নেই?
বালকটি টানাটানি করতে লাগল হোমারের হাত ধরে
কোমরের ব্যথা নিয়ে বৃদ্ধ কবি উঠে দাঁড়ালেন আস্তে আস্তে
আজ তার উপার্জন অকিঞ্চিৎকর
এক শিষ্যকে বললেন, আজ যা যা বলেছি, সব কণ্ঠস্থ করেছ তো বাছা
দেখো, যেন একটি শব্দও বাদ না পড়ে
শিশুটি ছটফটিয়ে বলল, আঃ, চল না
হোমার এক পা বাড়িয়েও কালো চাদর ঢাকা পুরুষটিকে বললেন,
তুমি তো কিছুই জানালে না, জানতে চাইলে না, তুমি কোন দেশের?
সে এবার বিষন্ন স্বরে বলল, আমার ভাষা জ্ঞান নেই
কী ভাবে জানাব জানি না
আমি প্রাচ্যেরও নই, প্রতীচ্যেরও না
আমি এক ব্যর্থ কবির বাল্যসঙ্গী, আমরা একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি
তার সব উচ্চাকাঙ্ক্ষা মিথ্যে হয়ে যায়, তার ব্যর্থতা আমার গায়ে বেঁধে
কখনো সখনো সে শব্দের সন্ধানে মাথা কোটে, তার কপালে থাকে রক্তলেখা
আমার যা কিছু সার্থকতা তাকে দেখে শিহরিত হয়
তার অতৃপ্তি আমাকেও ছুটিয়ে মারে
হে কবিশ্রেষ্ঠ, আপনাকে আমার একটিই প্রশ্ন
মানুষ কেন কবিতা লেখে? কেন এই বৃথা কষ্ট! না লিখলে কী হয়?
এ প্রশ্ন শুনে রমণীটি আধো আঁচলে মুখ ঢেকে কুলকুল করে হেসে উঠল
বৃহৎ ডানার পাখিটি বলল, একেই বলে রসাভাস!
বামনটি বলল, ভুল সময়, ভুল পরিবেশ, ভুল মানুষ!
চঞ্চল বালকটির হাত ধরে একটু দূরে গিয়ে হোমার বললেন,
এ প্রশ্নের উত্তর তুমি কখনো পাবে না
আরও কয়েক পা গিয়ে তিনি আবার বললেন অর্ধ নিমীলিত চোখ ফিরিয়ে
হয়তো এর উত্তর আছে, আমি জানি না
যুগের পর যুগ, এই এক প্রশ্ন, নিরুত্তর
অস্পষ্ট যেন দেখতে পাচ্ছি, আর পঁচিশটা কিংবা সাতাশটা শতাব্দী পার
হয়ে গেলে
আর কোনো মানুষের মনে এ জিজ্ঞাসাই থাকবে না।
আঃ, সে বড় দুর্দিন!