এক জীবনের মর্ম

এক জীবনের মর্ম

জীবন প্রবাহের এক পাশে দাঁড়িয়ে যদি কোনওদিন
হঠাৎ প্রশ্ন জাগে
এ জীবনের মর্ম কী?
তখনই আকাশে বিদ্যুৎ ঝলকায়, শোনা যায় রথচক্রের শব্দ
কয়েক মুহূর্তের জন্য পৃথিবী বধির
তবে কি এই প্রশ্ন ভুলে যাবার নামই নিয়তি?
যদি এই শুকনো নদীটি এবারের বর্ষাতেও রূপ ফিরে না পায়
ডাঙায় উল্টে আছে নৌকা, যদি আর না ভাসে
খরখরে কাদায় রয়ে গেছে অনেক পায়ের ছাপ
ঢেউ উঠে এসে আর প্রণাম জানাবে না?
এই নদীর জীবনেরও কোনও মর্ম নেই?

সব নদীই পাহাড়ের সন্তান, যেমন সব মানুষই মাটির
সেই মাটিতেই রক্তপাত ও অশ্রু
এবং চরম ঘুম
মাঝখানের জীবনটাও তো মাটি খেয়েই বেঁচে থাকা
চেটেপুটে খাই নখের ধুলো
মাটিতেই লেখা জীবন চরিত, কপাল ভর্তি মাটি
বৃষ্টি ভেজার পর হাঁটতে হাঁটতে টের পাই
আমি আর আমার মা সহোদর, এমনকী বাবা ও
আমার ভাই
সবাই এই ধরিত্রীর ছেলে মেয়ে
বিশ্বজোড়া একই সংসারে তবু সর্বক্ষণ চলছে গৃহ বিবাদ!

অরণ্য থেকে ঘরে ফিরে আসার দিনেই প্রথম পাপ হয়েছিল
মাটিতে ব্যক্তিগত সীমানার গণ্ডিকাটা
আসলে কী চেয়েছিলাম আমি, নিজস্ব ফসল, না নারী?
নারী কোনওদিনই পুরুষকে তার সর্বস্ব দেয়নি
এমনকী, ভালোবাসার আকিঞ্চনেও না
ভালোবাসা এই আছে, এই নেই, কখনও অলীক
প্রথম শিল্পের মতন অপরূপ কৃত্রিমতা
ভালোবাসা পাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি সত্য
ভালোবাসার জন্য ছটফটানি
এর মাঝখানে থেকে যায় শরীরের অসূক্ষ্ম দাবি, আর
অপত্য-বন্ধন
এত কাছাকাছি তবু অপরিচয়ের দূরত্ব বেড়ে যায় দিন দিন
অদৃশ্য অস্ত্রের ঝনঝনায় মাধুর্য হারিয়ে যায় বারবার
পুরুষ সব সময় নিজেকে জয়ী ভেবে রচনা করে
এক মূর্খের স্বর্গ
আসলে নারীরা চুপি চুপি ঝাজরা করে দেয় তাদের হৃদয়।

মাঠে যে-ই ফসল ফলল, অমনি শেষ হয়ে গেল
সব বন্ধুত্ব
ফসলের জন্য এই নগর সভ্যতা আর তার সমস্ত অভিশাপ
ফসলের জন্য সব রকমের বিশ্বাস ঘাতকতা
সেই আকাশের নীচে রোদে পোড়ে,
ঝড় বাদল মাথায় নেয়
দগ্ধ উদরেও সৃষ্টির গান গায়
সেই আচ্ছাদনের আরামে, সুখ শয্যায় শুয়ে
বঞ্চনার শ্বেতপত্র তৈরি করে
নদী প্রতিবাদ করেছিল, তার গলা কেটে দেওয়া হল
পাখিরা গান না গাইলে তাদের জন্য দেওয়া হল বিষ
ফসলের খেতের পাশে বসে যারা খিদের জ্বালায় কাঁদে
যাদের বাড়িতে উনুন জ্বলে না
তাদের বাড়িতে যখন তখন আগুন ধরিয়ে দিয়ে
পুড়িয়ে মারাটাই তো সোজা
খালি পেট থাকলেও কাঁদতে পারবে না
নগর সংস্কৃতির বিঘ্ন ঘটাবে না
চাঁদের উল্টো পিঠের মতন এটাই সভ্যতার গোপন শর্ত!
মাটি কিন্তু ভোলে না।
সম্রাটকেও তারা টেনে নিয়ে যায় মাটির নীচে
আলেকজান্ডার, চেঙ্গিজ, হলাকু, নেপোলিয়ন, চার্চিল, হিটলাররা
মাটির গণ্ডির লোভ করেছিল, তারা শেষ পর্যন্ত
ভূ-গর্ভে পোকা মাকড়ের খাদ্য সব
অস্ত্র শেষপর্যন্ত ভোঁতা হয়ে যায়
যারা লোভী, তারা মরে উদর পীড়ায়
যারা প্রাসাদ বানিয়েছিল, তারা বটগাছের শিকড়ের জোর জানে না
যারা সবাইকে পদানত করতে চেয়েছিল, তাদের আজ পা নেই
যারা দেশাভিমানী, দেশ তাদের মনে রাখে না
উই ধরা ছবি এক সময় খসে পড়ে ঝনঝন শব্দে
আজ যে দু’হাত ওপরে তুলে আছে, কাল সে অঞ্জলি পেতে করুণা-ভিখিরি!

মানুষ কি তখনই আত্মধ্বংসের দিকে যায়
যখন সে মুছে ফেলে বাল্যকালের ছবি?
মানুষের গলা তখনই কর্কশ হতে শুরু করে
যখন সে ভুলে যায় ভালোবাসার মুহূর্তগুলি
শরীরের মাধুর্য তখনই মিলিয়ে যেতে শুরু করে
যখন মিলনের মধ্যে এসে মেশে গরল
আহা, সেই সব মানুষ কত দুঃখী, যারা গায়ে জ্যোৎস্না মাখে না
উন্মুক্ত দিগন্তের মধ্যে শুধু একটা ঝাঁকড়া গাছ, আর কিছু নেই
তার নীচে একজন ঘুমন্ত মানুষ, তার শিয়রের কাছে
একটা বাঁশি
সে হয়তো কিছু একটা স্বপ্ন দেখছে
আমিও তাকেই স্বপ্নে দেখেছি সারাজীবন!