৭. আপনি অদ্বিতীয় হোন
ইতিহাস প্রমাণ করেছে যারা অসম্ভব কল্পনা করতে সাহস
করে তারা মানুষের সকল সীমাবদ্ধতাকে ভাঙতে পারে।
.
আমার প্রিয় তরুণ বন্ধুদের কতজনের এই আত্মবিশ্বাস আছে যে, আপনারা এক এক জন অদ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন হবেন আপনাদের পছন্দের ক্ষেত্রে? বলা হয়ে থাকে, ইতিহাস প্রমাণ করেছে যারা অসম্ভব কল্পনা করতে সাহস করে তারা মানুষের সকল সীমাবদ্ধতাকে ভাঙতে পারে। মানুষের উদ্যমের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তা বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, খেলাধুলা, শিল্পকলা বা প্রযুক্তি যাই হোক না কেন মানুষ অসম্ভব বলে কল্পনা করলেও এক সময় অসম্ভব কল্পনাকে সম্ভব করে ইতিহাসে গভীরভাবে ছাপ রেখেছে। তারা কল্পনার জগৎকে ভেঙে পৃথিবীর পরিবর্তন সাধন করেছেন। আসুন, আমরা কয়েকটি সৃজনশীল মানুষকে পর্যালোচনা করি যারা তাদের অদম্য উদ্যমের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। মানুষের লড়াইয়ের গল্প মানুষের মনের সৃজনশীল গল্প ছাড়া অন্য কিছু নয়। কয়েকজন সংগ্রামী মানুষের অর্জন চমৎকার। দ্য রয়েল সোসাইট, লন্ডন এর প্রেসিডেন্ট বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন ১৮৯৫ এ বলেন, ‘বাতাসের চেয়ে অধিকতর ভারী কোনো জিনিস উড়তে পারে না এবং উড়াতে পারবেও না।’ মাত্র এক দশকের মধ্যে ১৯০৩ এ রাইটভ্রাতৃদ্বয় প্রমাণ করেন যে মানুষ উড়তে পারে।
ভোন ব্রাউন নামের একজন বিখ্যাত রকেট ইঞ্জিনিয়ার মহাশূন্যচারীদের স্যাটান ভি ক্যাপসুলে মহাশূন্যে পাঠানোর জন্য তৈরি করেন। চাঁদে হাঁটার বাস্তবতা সম্পর্কে ১৯৭৫ এ তিনি বলেন, যদি আমাকে ক্ষমতা দেওয়া হয় তবে আমি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি।’
প্রাচীন দিনগুলোতে, প্রোলেমাইক অ্যাস্ট্রোনোমি তারকা ও গ্রহগুলোর গণনার কাজে ব্যবহৃত হতো। তখন অনুমান করা হয় পৃথিবী সমতল। বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রমাণ করেন যে পৃথিবী গোলাকার এবং কক্ষপথ সূর্য। তিনজন জ্যোতির্বিদ কোপারনিকাস, গ্যালিলিও ও কেপলার পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানে নতুন দিকদর্শন প্রদান করেন। আজ সর্বজনস্বীকৃত পৃথিবী একটা গ্লোব। কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে ঘোরে, আর সূর্য আছে মিল্কি ওয়েতে। সমস্ত রকমের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে নিকটতর শতাব্দীগুলোতে। অবিরতভাবে মানুষ সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করে অসম্ভবকে পেছনে ফেলে সাফল্য লাভ করেছে।
এই সমস্ত অর্জন থেকে আমরা কী শিক্ষালাভ করতে পারি? এ্যায়ারোডানামিকস বামব্লেবি ল অনুসারে কখনোই উড়ার সামর্থ্য অর্জন করার নয়। কারণ আকার, ওজন ও তার শরীরের আকৃতির সঙ্গে পাখনার আকারের জন্য বামরেবিএর উড়া বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব। কিন্তু বৈজ্ঞানিক থিওরি মতে বামরেবি অবহেলিত হলেও যে-কোনোভাবে উড়ার জন্য এগিয়ে যায় কারণ সে উড়তে চায়। এখানে সমবেত তরুণদেরকে এই উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা উচিত সব কিছুকে সম্ভব করার লক্ষ্যে, কারণ তরুণরা অদ্বিতীয়।
২০০৬-এর ২৮ আগস্টে আমি ভারতের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আমি ইন্ডিয়া ২০২০ মুভমেন্ট-এর পক্ষে একদল ট্রাইব স্টুডেন্টদের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম। আমি তাদেরকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলাম: ‘তোমরা কে কী হতে চাও?’ অনেকের মধ্যে ক্লাস নাইনের একজন ছাত্র জবাব দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল। তার নাম শ্রীকান্থ। সে আমাকে বলল, ‘আমি সরাসরি ভারতের প্রেসিডেন্টকে প্রথম চ্যালেঞ্জ করব।’ আমি ছেলেটির ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার কথা শুনে খুবই খুশি হই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে জীবনের ছোট্ট লক্ষ্য স্থির করা একটা অপরাধ। আমি তাকে অভিনন্দন জানালাম। আমি তার মঙ্গল কামনা করে তাকে বললাম এ জন্য কঠিন পরিশ্রম করবে। সে কঠিন পরিশ্রম করে ক্লাস টেনে শতকরা ৯০ নম্বর এবং উচ্চ মাধ্যমিকে শতকরা ৯৬ নম্বর পেল। সে ইউএস এর বোস্টনে অবস্থিত এমআইটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনার লক্ষ্য স্থির করে। ছেলেটির নিরন্তর কঠিন পরিশ্রম করে শুধুমাত্র সেখানে একটি সিটই পায় না, প্রতিষ্ঠানটি থেকে সে একটি স্কলারশিপও লাভ করেন। শ্রীকান্থের অর্জন অনেককেই অনুপ্রাণিত করে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যে পৌছানের জন্য। লিড ইন্ডিয়া ২০২০-এর প্রেরণায় সে নিজেকে তার ইচ্ছা পূরণ করতে প্রস্তুত করে। লিড ইন্ডিয়া মুভমেন্ট ও জিইর স্বেচ্ছাসেবকরা ইউএসএ ভ্রমণের জন্য শ্রীকান্তকে অর্থ প্রদান করে। তার গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর জিই তাকে একটি চাকরি অফার করে। সে তাদেরকে বলে যে, সে নিশ্চয়ই জিই তে ফিরে আসবে, যদি সে ভারতের প্রেসিডেন্ট হতে পারে। জীবনের সমস্যাবলি ও চ্যালেঞ্জগুলোর ভেতরেও ছেলেটির কেমন আস্থা ছিল!
সম্প্রতি, শ্রীকান্থর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে। তার শিক্ষক, তামিলনাড়ু সরকার এবং লিড ইন্ডিয়া ২০২০, কৌম্বাটোর দ্বারা আয়োজিত ছাত্রদের মতবিনিময় সভায় তাকে নিয়ে আসে। সে তখন বি.এস. কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের আন্ডারগ্রাজুয়েট কোর্সের ফোর্থ ইয়ারে পড়ছিল। এই চার বছরের মধ্যে সে একটা কোম্পানি দাঁড় করায়। বায়ো-ডিগ্রেডেবল ম্যাট্রিলিয়ালস ব্যবহার করে কনজুইমার প্যাকেজিং আইটেম তার কোম্পানিতে তৈরি করে। সে তরুণদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কাজ শুরু করে। সে চ্যালেঞ্জসমূহ কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেই প্রসঙ্গে সমাবেশে উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা প্রদান করে।
আমার তরুণ বন্ধুদের কাছে মেসেজটি হচ্ছে, আপনারা কে, তা কোনো বিষয় নয়। যদি আপনাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য ইচ্ছা ও দৃঢ় সংকল্প থাকে তবে আপনারা অবশ্যই সফল হবেন।
এখানে আর একটা সুন্দর মনের উদাহরণ দেব যে মনে সৃজনশীল ও অদম্য স্পৃহা আছে।
এটা সংগঠিত হয় মহরাষ্ট্রের কোলহাপুর জেলায় হারালি গ্রামে। সেখানে আমি বিভিন্ন স্কুলের ২০০০ ছাত্রের সঙ্গে মিলিত হই। আমার বক্তৃতা শেষ করে আমি মঞ্চ থেকে প্রায় নামতে যাচ্ছি, এমন সময় বছর আঠারো মতো বয়সের একটি তরুণ ছেলে তার মায়ের হাত ধরে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য চিৎকার করে ওঠে। আমি তাদের দুজনকেই মঞ্চের উপরে আসতে বললাম। পোলিও আক্রান্ত ছেলেটির হাঁটতে কষ্ট হলেও তার মনোবল ছিল অটুট। সে আমাকে বলল, ‘আমার নাম শৈলেষ’ আমি এই গ্রাম হারালির ছেলে। আপনি আমাদেরকে স্বপ্ন দেখতে বলেছেন, আমি এখানে আমার স্বপ্নের কথা আপনাকে বলতে এসেছি। আমি একজন দাবা খেলোয়াড়। আমি কঠিন পরিশ্রম করব এবং আমি একদিন গ্রান্ডমাস্টার হবোই।’ আমি শৈলেষকে শুভকামনা জানিয়ে বললাম, তুমি সফল হবেই। বিশেষ করে ঈশ্বর তোমার সঙ্গে আছেন।’ এটাই হচ্ছে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। প্রত্যেক তরুণদের প্রতি আমার মেসেজ যে আপনাদের শক্তি আপনাদের যে-কোনো সমস্যাকে পরাজিত করতে পারবে।
শুধুমাত্র এটা ছাত্রদের উদ্দেশ্যে আমার মেসেজ নয়, এটা শিক্ষকদের প্রতিও আমার মেসেজ। শিক্ষকরা তাঁদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী শক্তি, চিন্তাচেতনা তরুণ মনে দান করে তাদেরকে সারাজীবনব্যাপী নতুন চিন্তাচেতনায় উজ্জীবিত করবেন। এ বিষয়ে মাচুরানা নামে একজন চিলিবাসী জীববিজ্ঞানীর ‘ছাত্রের প্রার্থনা ‘ শীর্ষক একটা কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ছে।
ছাত্রের প্রার্থনা
আমাকে পথ দেখাও যাতে আমি তোমদের কাঁধে দাঁড়াতে পারি
তোমরা নিজেদের প্রকাশ করো যাতে আমি ভিন্ন কিছু হতে পারি
তা আমার উপর চাপিও না তোমরা যা জানো
আমি অজানাকে উদ্ঘাটন করতে চাই।
আর আমিই আমার নিজের আবিষ্কারের উৎস হতে চাই।
যা জানা তা হবে আমার মুক্তি, আমার দাসত্ব নয়।।
(২৯ এপ্রিল ২০১৫ শেমফোর্ড স্কুল, দেরাদুনের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও ভাষণ থেকে)