১৭. সৃজনশীল নেতার ক্রমবিকাশ

১৭. সৃজনশীল নেতার ক্রমবিকাশ

একজন নেতাকে নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে সততার
সঙ্গে কৃতকার্য হওয়া উচিত।

.

আমার ইগনাইটেড মাইন্ড বইখানা ২০০১ এ প্রকাশিত হয়। মানুষের অগ্রগতির জন্য আলো জ্বালানো, সৃজনশীল শিক্ষাদান, নৈতিকতাপূর্ণ বৈজ্ঞানিক মন সৃষ্টির লক্ষ্যে আমার ব্যক্তিগত মিশনের প্রেক্ষিতে। আমার পেশাগত দায়দায়িত্ব আমাকে সুযোগ করে দেয় প্রযুক্তি ও মিশনের জন্য বিভিন্ন স্তরে সৃজনশীল ও প্রকাশমান নেতৃত্বের বিশেষ লক্ষণগুলোকে বুঝতে। পৃথিবীর নেতৃবৃন্দ মহান মহান দার্শনিক, নবজাগরণের পথিকৃতদের আত্মজীবনী ও স্পষ্ট বক্তব্য থেকে আমি সব সময়ই অনুপ্রাণিত হয়েছি। যখন ইন্ডিয়ার ভিশন ২০২০ এর ক্রমবিকাশের জন্য আমি জাতীয় দলে অংশ ছিলাম, তখন প্রযুক্তি, সমাজ, ও দেশের নেতৃত্ব সম্বন্ধে উপলব্ধি করি। তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময় কালে উন্নয়ন সম্পর্কে তাদের প্রশ্ন থেকে আমার মনে পুনরায় নেতৃত্ব সম্বন্ধে প্রতিফলন ঘটে। রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ও তার পরবর্তীকালে আমার সুযোগ ঘটে দেশ ও বিদেশের মহান মহান নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করার। আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন যে আনুষ্ঠানিক, সাংগঠনিক, জাতীয় ও বিশ্বায়িতম্ভরে সৃজনশীল নেতৃত্ব মানবজাতির শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য জরুরি।

সুতরাং কেমনভাবে সৃজনশীল নেতৃত্বের প্রকাশ ঘটে? সৃজনশীল নেতৃত্ব শুরু হয় নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য বর্তমান থাকলে:

  • সুস্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত করা
  • মধ্যধারার ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে উপলব্ধি করা
  • দৃঢ়বিশ্বাস ও সহানুভূতির সাহস করা
  • বর্ধিষ্ণু প্রযুক্তির প্রতি প্রত্যাশিত সামাজিক দূরদর্শিতা দেখানো
  • সবুজ বিপ্লবের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক কৃষ্টির জন্য কৃষক ও প্রশাসকদের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক মেধার সমন্বয় সাধন করা
  • বিজ্ঞানে আজীবন মিশন
  • শক্তি সামর্থ্য ও সৎ প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা

জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর কথা দিয়েই আমাকে শুরু করতে দিন। ব্রিটিশের কব্জা থেকে তিনি অহিংস নীতির উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে আমাদের দেশকে স্বাধীন করেন। বেশ কয়েক বছর আগে আমি অসাধারণ অভিজ্ঞতা অর্জন করি যে, একজন মাত্র মানুষ বিপুল জনগোষ্ঠীকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। দিল্লিতে মহাত্মা গান্ধীর নাতনি সুমিত্রা কুলকার্নির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাঁর দেখা ঠাকুরদা মহাত্মা গান্ধী সম্বন্ধে একটি ঘটনার কথা আমাকে বলেন।

প্রত্যেকদিন গান্ধীজী সন্ধ্যায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনায় অংশ গ্রহণ করতেন। প্রার্থনার শেষে তিনি সচরাচর অভাবী লোকদের কল্যাণের জন্য স্বেচ্ছায় দান গ্রহণ করতেন। তাঁর অনুগামীরা যে যাই দিক না কেন তা সংগ্রহ করে হিসাবপত্র করে রাখা হতো।

সংগৃহীত অর্থকড়ির হিসার গান্ধীজীর ডিনারের আগে তাঁকে দেওয়া হতো। পরদিন ব্যাংকের একজন লোক আসতেন সংগৃহীত অর্থ নিতে। একদিন ব্যাংকের লোকটি জানাল যে তাকে দেওয়া টাকার মধ্যে কয়েকটি পয়সার অমিল হয়েছে। গান্ধীজী এ কথা শুনে তাকে বললেন যে এটা হচ্ছে গরিবদের জন্য দান, যার প্রত্যেকটি পয়সার হিসাব আমি রাখি।

প্রিয় বন্ধুগণ, আপনাদের সবাইকে ন্যায়পরায়ণতা অনুশীলন করতে হবে। আপনারা সবাই আগামীকালের ম্যানেজার ও নেতা, আপনাদেরকে অবশ্যই চিন্তাভাবনা ও কাজে ন্যায়পরায়ণার অনুশীলন করতে হবে।

২০০৪ এর ১৬ সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবান পরিচালিত ১৯০০ শতকের ভিনটেজ পরিচালিত একটি ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় আমার ভ্রমণকালে পুনরায় গান্ধীজীর কথা স্মরণ হলো। আমার মনে পড়ল একদিন এই ট্রেনে গান্ধীজী ভ্রমণ করেছিলেন। গান্ধীজী ট্রেনের এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে ভ্রমণ করে জাতিগত বৈষম্য দূর করার জন্য সংগ্রাম করছিলেন। সেই কথা আমার মনে পড়ল। শীতের একরাতে ট্রেন পিটারমার্টিজবার্গে বিরতি দিলে সেখানে দৈত্য আকৃতির একজন অমানুষ গান্ধীজীকে মারধর করে। গান্ধীজীকে ফার্স্ট ক্লাস কামরা থেকে বের করে দেয় গায়ের রঙ কালো হওয়ার কারণে। যখন আমি পিটারমার্টিজবার্গ স্টেশনে নামলাম তখন রেল স্টেশনে একটি ফলক আমার চোখে পড়ল। ফলকের লেখাটি আমি পড়লাম। ফলকে লেখা রয়েছে :

এম. কে. গান্ধীকে এই স্টেশনে
প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে
৭ জুন ১৮৯৩
নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

এই ঘটনা তাঁর জীবনের গতি পরিবর্তন করে দেয়। তিনি সেখানে জাতিগত অবদমনের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। ওই দিন থেকে তিনি অহিংস আন্দোলন শুরু করেন। এটাই ছিল অহিংস নীতির পুনর্জন্ম ৩০০ খৃষ্টপূর্বাব্দে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর। পরবর্তীতে গান্ধীজী অহিংস ধর্মকে আরো উন্নত করে ভারতের স্বাধীনতার জন্য শক্তিশালী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন। তিনি আব্রাহাম লিঙ্কনের গেটিসবার্গের ভাষণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। গান্ধীর শিক্ষা অহিংস আন্দোলনে অনুপ্রেরণা যোগায়। বিশেষ করে ইউএস সিভিল রাইট নেতা মার্টিন লুটার কিং গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন।

আমি পিটারমার্টিজবার্গ স্টেশনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম তা থেকে আমার মনে দুটো দৃশ্যপটের উদয় হলো। একটা দৃশ্য ছিল রোবিন আইল্যান্ডের যেখানে ড. নেলসন ম্যান্ডেলা একটি ছোট্ট সেলে ছাব্বিশ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। আর একটি দৃশ্য ছিল ড. নেলসন ম্যান্ডেলার বাড়ির।

কেপ টাউন তার টেবল মাউন্টেনের জন্য বিখ্যাত। এই মাউন্টেনে টেবল পিক, ডেভিল পিক ও ফেক পিক নামে তিনটি শৃঙ্গ আছে। শৃঙ্গগুলোর মধ্যে সারাদিন ব্যাপী একটি সুন্দর দৃশ্যপট বর্তমান ছিল। মাঝেমধ্যে কালো মেঘ এবং কখনো সাদা মেঘের আনাগোনা শৃঙ্গগুলোকে যেন আলিঙ্গন করে যায়। টেবল মাউন্টেন আটলান্টিক সাগরের খুবই কাছে। আমি হেলিকপ্টারে কেপ টাউন থেকে দশ মিনিটে রোবেন আইল্যান্ডে পৌঁছালাম। যখন আমরা দ্বীপটিতে পৌঁছালাম তখন সাগর শান্ত ছিল। সমস্ত দ্বীপটিতে নীরবতা বিরাজ করছিল। এই স্থানে মানুষের স্বাধীনতাকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার মি. আহমেদ কাথরাদা ড. ম্যান্ডেলার সহকারাবন্দি ছিলেন। তিনি আমাদেরকে স্বাগত জানালেন। তার ছোট্ট রুমটি দেখে আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। সমস্ত মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষাকে যিনি পূর্ণ করেছিলেন তিনি ওই ছোট্ট রুমটিতে ঘুমাতেন। আমার মনে পড়ল, ৬ ফুট লম্বা নেলসন ম্যান্ডেলা ওই রুমে ছাব্বিশ বছর কারারুদ্ধ থেকে নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। তাঁর জীবনের বেশিরভাগ বছর কাটিয়েছিলেন এই শান্ত দ্বীপটিতে। যখন জেলের ওয়ার্ডেনরা ঘুমিয়ে থাকত তখন তিনি জেলে বসে প্রতিদিন ছোটো ছোটো চিঠিতে স্বাধীনতার পাণ্ডুলিপি লিখতেন। সেই পাণ্ডুলিপি থেকেই পরিশেষে তাঁর বিখ্যাত বই এ লঙ ওয়াক টু ফ্রিডম প্রকাশিত হয়।

আমার পক্ষে এটা ছিল একটি বড়ো ধরনের ঘটনা, জোহান্সবার্গে ড. ম্যান্ডেলার সঙ্গে তার বাড়িতে সাক্ষাৎ। সে কী উষ্ণ অভ্যর্থনা! ছিয়াশি বছরের মানুষটির মুখে হাসি লেগে ছিল। বন্ধুগণ, আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে ইচ্ছুক ম্যান্ডেলার মিলিত হওয়ার ঘটনা। ড. ম্যান্ডেলার বাড়িতে প্রবেশ করে তাকে উৎফুল্ল দেখতে পেলাম। আমি ভাবলাম, এই লোকটিই দক্ষিণ আফ্রিকাকে শৃঙ্খল মুক্ত করে দেশটিকে স্বাধীন করেন।

তিনি আমাকে বিদায় জানাতে হাতের লাঠি রেখেই হেঁটে হেঁটে বারান্দায় এলেন। আমি তাকে ধরে হাঁটতে সাহায্য করলাম। হাঁটার সময় আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ড. ম্যান্ডেলা, আপনি কাকে আন্দোলনের অগ্রপথিক মনে করে দক্ষিণ আফ্রিকাতে দমনকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললেন? সেই কথাটি কি আমাকে বলবেন।’ তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বললেন, ‘অবশ্যই দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতা আন্দোলনে একজন অগ্রপথিকের অনুপ্রেরণায় আমি আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হই। সেই অগ্রপথিক হচ্ছেন এম. কে. গান্ধী। ভারত আমাদেরকে মহাত্মা গান্ধীকে দিয়েছিলেন। আমরা আপনাদের কাছে দুই দশক পরে মহাত্মা গান্ধীকে ফিরিয়ে দিয়েছি।’ স্বাধীনতা লাভের পর, ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হন।

ড. ম্যান্ডেলাকে স্থানীয় ভাষায় মাডিবা বলে ডাকা হয়। তিনি মৃত্যুবরণ করলে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সারা বিশ্বের নেতারা হাজির হন। ড. ম্যান্ডেলার জীবন ও সংগ্রাম থেকে আমি ২০০০ বছর আগে থিরুভাল্লুভারের লেখা থিরুক্কুরালস বইটির অনুষঙ্গ দেখতে পাই।

দুইজন রাজনৈতিক নেতা মহাত্মা গান্ধী ও ড. নেলসন ম্যান্ডেলা ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্বাধীনতা দান করেন। তাঁদের এই সংগ্রামের অনুপ্রেরণায় অনেক দেশই স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রামে লিপ্ত হয়।

এখন আমি চীনের আধুনিক শিল্পবিপ্লবের স্থপতি দেং জিয়াওপিং সম্বন্ধে বলব। তাঁর নেতৃত্বে চীনে দ্রুততার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি ও বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্নয়নের বন্ধন গড়ে ওঠে। দেং জিয়াওপিং ডিসেম্বর ১৯৭৮ এ চীনের প্রখ্যাত নেতা হয়ে ওঠেন। চীনে তখনো সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলছিল। কয়েক শত মিলিয়ন চীনা দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হয়। চীন দ্রুততার সঙ্গে অধিকতর শক্তিশালী, ধনী ও আধুনিক রাষ্ট্র হয়ে ওঠে।

আধুনিক করে গড়ে তোলার জন্য ডেং বিশ্বের প্রধান প্রধান দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। ইউরোপ, জাপান, ইউএসএ সহ বিভিন্ন শিল্পোন্নত দেশের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। চীনের উন্নয়নের জন্য দেং জিয়াওপিং অর্থনৈতিক রূপকল্প আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়।

এখন আমি ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির রূপকল্প সম্বন্ধে কিছু কথা আপনাদের কাছে উপস্থাপন করব। প্রফেসর বিক্রম সারাভাই ছিলেন আমার গুরু। খুব কম লোকের ভাগ্যে এত বড়ো মাপের মানুষের সরাসরি সান্নিধ্য জোটে। সাত বছর প্রফেসর বিক্রম সারাভাই এর সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এক পাতার বিবরণ থেকে স্পেস প্রোগ্রামের প্রথম লগ্নের রূপকল্পকে আমি অবলোকন করেছিলাম। সেই এক পাতার বিবরণ নিয়ে অবিরত কাজ করার শিক্ষা ছিল সত্যি সত্যি আমার জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর চাবিকাটি।

১৯৭০ এ দেওয়া প্রফেসর বিক্রম সারাভাই এর বিখ্যাত বিবরণীতে তিনি বর্ণনা করেন, “ভারত তার শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তরুণদের জ্ঞানভাণ্ডারের সাহায্যে তার নিজস্ব রকেট সিস্টেম (স্যাটেলাইট ভিইয়েকল) তৈরি করতে পারবে। তারা ভারতের যোগাযোগ, দূরভাষ, ও মেট্রোলোজিকাল স্পেসক্রাফটের উন্নয়ন করবে। আমি এখনো সেই বিবরণটির ফলাফল দেখে আপ্লুত হয়ে পড়ি। আজ ভারত তার জমিন থেকে যে-কোনো ধরনের স্যাটেলাইট লঞ্চ ভিইয়েকল, যে-কোনো ধরনের স্পেসক্রাফ্ট উৎক্ষেপণের ক্ষমতা অর্জন করেছে। মহাশূন্য প্রযুক্তি ও মহাশূন্য বিজ্ঞানের মাধ্যমে ভারত পৃথিবীর মহাশূন্য প্রকল্পের অংশীদার হতে পেরেছে।

এম.এস. স্বামীনাথন ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক হিসাবে পরিচিত। তাঁর নেতৃত্বে ভারত উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন গম উৎপাদনে সাফল্য লাভ করেন। ১৯৪৩ এ পশ্চিম বাংলায় দুর্ভিক্ষে ৩ মিলিয়ন মানুষ মারা যাওয়ার কারণে স্বামীনাথন কৃষিক্ষেত্রকে গবেষণার বিষয় হিসাবে বেছে নেন।

স্বামীনাথন তার সহকর্মী ও ছাত্রদের সঙ্গে সারা পৃথিবীর সাহচর্যে কাজ করেন। ব্যাপকভাবে এ কাজ করতে গিয়ে চারা জন্মানো, কৃষি গবেষণা ইত্যাদির ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় তাকে পড়তে হয়। ১৯৮৩-তে তিনি কৃষকদের অধিকার এবং ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারটেকিং অন প্লান্ট জেনেটিক রিসোর্সেস (IUPGR) এর উন্নয়নের ধারণা লাভ করেন। তিনি ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব জেনেটিকস এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৭ সালে প্রথম ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ লাভ করেন। স্বামীনাথনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় সচেতনা সৃষ্টি হয় যে, ক্ষুধা প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এটা মানুষের আচরণের দ্বারা সৃষ্ট একটি দুর্যোগ। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যা মানুষের দ্বারাই সমাধান হতে পারে। ভারতের প্রথম সবুজ বিপ্লবে অগ্রদূত ছিলেন স্বামীনাথন। স্বামীনাথনের এই সফলতা আসে রাজনৈতিক রূপকল্পকার ড.সি সুব্রামানিয়ানের নির্দেশনায় ও কৃষকদের সমর্থনে তাঁর টিমের সহযোগিতায়। তাঁরা ভারতকে ক্ষুধার রাজ্য থেকে মুক্ত করেন। ‘সিড টু গ্রেন’ রূপকল্পের আওতায় ভারত খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণের কাছাকাছি পৌছাতে সক্ষম হয়। অবশ্য এটা ঘটাতে কৃষি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাকে কাজ করতে হয়।

চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের বিখ্যাত আবিষ্কার ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞানে চন্দ্রশেখর লিমিট। লিমিট বর্ণনা করে একটি সাদা বামন তারকার সর্বাধিক পিণ্ড (- ১.৪8 সোলার পিণ্ডসমূহ) বা সমতুল্যভাবে, একটি তারকার সর্বনিম্ন পিণ্ড স্বাভাবিকভাবে একটি নিউরোন তারকায় নিথর বা কালগহ্বরে একটি সুপার নোভায় পরিণত হয়। চন্দ্রশেখর লিমিট দ্বারা স্থিরীকৃত হয় নির্দিষ্ট পিণ্ড কত দীর্ঘ সময় একটি তারকায় কিরণ দেয়। ১৯৮৩-তে চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ান তাঁর এই আবিষ্কাররের ফলে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৪৭ এ চন্দ্রশেখরের দু’জন ছাত্র টিসাং-দাও লী এবং চেন নিং ইয়াং পার্টিকেল ফিজিকস রিসার্চ ডক্ট্রাল প্রার্থী ছিলেন। চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ান উইসকোনসিন-এর লেক জেনেভার ইয়ের্কস অজার্ভাটোরিতে অফিস চালালেও তিনি আবহাওয়া খারাপ থাকলেও নিয়মিত চিকাগো পর্যন্ত ১০০ মাইল ড্রাইভ করে যেতেন। এবং ইয়াংকে গাইড ও পড়াশোনা শিখাতে যেতেন। ১৯৫৭ এ তাঁর এই দুই ছাত্র তাদের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। চন্দ্রশেখর নোবেল পুরস্কার লাভের তিন দশক আগে তাঁর ছাত্ররা নোবেল পুরস্কার পান। এটাও প্রকাশ করে বিজ্ঞান ও তাঁর ছাত্রদের প্রতি চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ানের অঙ্গীকার। চন্দ্রশেখরের কাছে বিজ্ঞানই ছিল আজীবনের সাধনা। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তরুণদেরকে বিজ্ঞানের প্রতি আবেগপ্রবণ করে তোলে।

প্রফেসর সারাভাইয়ের কাছ থেকে প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান ISRO-এর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রফেসর সারাভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র ও বিচক্ষণ ব্যবস্থাপক। তিনি ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ ও উন্নয়নের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলেন। তিনি সংস্থা, শিল্পকারখানা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অ্যাপলিকেশন ব্যবহারকারীদের মধ্যে আন্তঃসংযোগ স্থাপনে চেষ্টা করেন। তিনি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কৃষ্টিকালচার সৃষ্টিতে যেন যান্ত্রিক ছিলেন। উন্নয়ন, প্রোজেক্ট, প্রোগ্রামস ও মিশন ব্যবস্থাপনায়ও তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।

পরিশেষে, আমি আপনাদের সঙ্গে নেতৃত্বের সফলতার কথা শেয়ার করব। এ. শ্রীধরন ‘মেট্রো ম্যান অব ইন্ডিয়া’ হিসাবে পরিচিত। তিনি ১৯৯৫-২০১২-তে দিল্লি-মেট্রোর ম্যানেজিং ডিরেক্টর ছিলেন। ১৯৬৪ এর ডিসেম্বরের সাইক্লোনে তামিলনাড়ুর মেইন ল্যান্ডের আমার জন্মস্থান রামেশ্বরমের সঙ্গে সংযুক্ত পামবান ব্রিজের অংশ বিশেষ ভেঙে যায়। রেলওয়ে তিন মাসের মধ্যে ব্রীজটি মেরামত করার লক্ষ্য স্থির করে। শ্রীধরনকে ব্রিজটির মেরামত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি মাত্র ছেচল্লিশ দিনের মধ্যে ব্রিজটিকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনেন।

১৯৭০ এ শ্রীধরনকে ভারতের প্রথম কলকাতা মেট্রোর প্লানিং, ডিজাইন ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯০ এ ভারতের কোনকান রেলওয়ের চেয়ারম্যান পদে শ্রীধরনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এটা ছিল ভারতের প্রথম বোট (বিল্ড-অপারেট-ট্রান্সফার) ভিত্তিক প্রধান প্রকল্প। এই প্রকল্পে নরম জমিনে ৭৬০ কিমি রেলপথ, ১৫০টি ব্রিজ ও ৯৩টি টানেল তৈরি করা হয়। তেমন উল্লেখযোগ্য ব্যয় ছাড়াই সরকারি সেক্টরের এই প্রোজেক্ট যথাসময়ে সম্পন্ন হয় শ্রীধরনের নেতৃত্বে। শ্রীধরন দিল্লি মেট্রোর কাজ নির্দিষ্ট দিনের আগেই তাদের নির্দিষ্ট বাজেটে সম্পন্ন করেন। ২০০৫ এ শ্রীধরনকে ফ্রান্স সরকার চেভালিয়ের দ্য লা লেজিওন ডি’অন্নেউর (নাইট অব দি লেজিওন অব অনার) পুরস্কার প্রদান করে।

সুতরাং আমরা এ থেকে দেখতে পাই :

ক. নেতাকে অনাবিষ্কৃত পথ দিয়ে ভ্রমণ করার সমর্থ অবশ্যই থাকতে হবে।

খ. নেতাকে অবশ্যই জানতে হবে কীভাবে সাফল্য ও ব্যর্থতাকে মোকাবিলা করতে হবে।

গ. নেতার অবশ্যই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস থাকতে হবে।

ঘ. নেতা ব্যবস্থাপনায় ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা উচিত হবে।

ঙ. নেতার প্রত্যেকটি কাজ স্বচ্ছ হওয়া উচিত হবে।

চ. নেতার সততার সঙ্গে কাজ ও সাফল্যলাভ করা উচিত হবে।

আমি সৃজনশীল নেতাদের প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে আলোচনা করেছি দেশের ও দেশের বাইরের ছাত্রছাত্রী ও লোকজনের সঙ্গে। তরুণদের মধ্যে উদ্যমী করে গড়ে তুলতে আমি পারি, আমরা পারি, দেশও পারে। পৃথিবীর আন্তঃসংযোগের মাধ্যমে আমরা পুরো মানবজাতিকে উপকার করতে পারি। আমরা নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্যগুলোকে কেন্দ্রীয়ভূত কবে তরুণদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে তুলতে পারি। নেতৃত্বের গুণাবলি নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর মানুষদেরকে ক্ষমতাশীল করতে পারে।

(৭ নভেম্বর ২০১৪ এর পিকিং ইউনিভার্সিটি, বেজিং এ সাসটেনেবল ডিভেলপমেন্ট সিস্টেম ও সৃজনশীল নেতৃত্বের উপর জীবনধারা প্রসঙ্গে বক্তব্য থেকে।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *