২. শ্রেষ্ঠত্বের সংস্কৃতি গড়ে তোলা
যখন আপনি চান, একজন স্টার হতে
তখন আপনি কে তাতে কিছু যায় আসে না,
আপনি যা চান তা আপনার হৃদয়ে এসে পৌঁছবেই।
.
চেন্নাইয়ের মাদ্রাজ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়াকালের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আমি আপনাদের সঙ্গে মত বিনিময় করতে চাই।
আমি তখন MIT, চেন্নাই(১৯৫৪-৫৭)-এর এয়ারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আমার ছয়জন সহকর্মীর সাথে লো-লেভেল অ্যাটাক এয়ারক্রাফ্ট প্রোজেক্ট ডিজাইন করার কাজে আমি অংশ নেই। সিস্টেম ডিজাইন করার দায়িত্ব আমাকে দেওয়া হয়। তাছাড়াও প্রোজেক্টের এয়ারোডাইনামিক ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করার দায়িত্বও আমাকে দেওয়া হয়। আমার দলের আর পাঁচজনকে ডিজাইনের পরিচালন, নিয়ন্ত্রণ, নির্দেশ দান ও বর্জন ইত্যাদির কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এয়ারক্রাটের ইনস্ট্রুমেন্টেশন সিস্টেমের দায়িত্বও তাদের উপর ছিল। MIT-এর ডিরেক্টর প্রফেসর শ্রীনিবাসন আমাদের ডিজাইন টিচার এবং গাইড ছিলেন। আমরা প্রোজেক্টে কিছু দিন কাজ করার পর, প্রফেসর শ্রীনিবাসন প্রোজেক্ট পর্যালোচনা করে জানালেন যে, আমার কাজ হতাশাব্যঞ্জক।
বিভিন্ন ডিজাইনারদের থেকে পাওয়া তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে একটা ডাটাবেস তৈরিতে আমাকে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে, সে কথায় তিনি কর্ণপাত করলেন না। আমি বললাম, যে সিস্টেম ডিজাইন তৈরি করতে অপারগ হয়েছি তা আমি সম্পন্ন করব, আমার পাঁচ সহকর্মীর কাজ থেকে ইনপুট পেলেই। আমার কথার জবাবে প্রফেসর শ্রীনিবাসন আমাকে বললেন, ‘দেখ, ইয়ং ম্যান, আজ শুক্রবারের বিকেল, আমি তোমাকে তিন দিন সময় দিতে পারি। যদি সোমবার সকালের মধ্যে তোমার কাছ থেকে কনফিগারেশন ডিজাইন না পাই তবে তোমার স্কলারশিপ বাতিল হবে।
তাঁর কথায় বুঝলাম, আমি ব্যর্থ হলে আমাকে ছিটকে পড়তে হবে। স্কলারশিপ আমার জীবন। যদি আমার স্কলারশিপ বন্ধ হয়ে যায়, তবে আমার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।
ডিজাইনের কাজ সুসম্পন্ন করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আমার টিম এবং আমি উপলব্ধি করলাম আমাদেরকে সারাক্ষণ কাজ করা প্রয়োজন। ওই রাতে আমরা না ঘুমিয়ে কাজ করে গেলাম। শুধুমাত্র ডিনারের জন্য কাজে বিরতি দিলাম।
রবিবার সকালে আমার ল্যাবোরেটরিতে প্রফেসর শ্রীনিবাসনের উপস্থিতি লক্ষ করলাম। তিনি আমার কাজের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তিনি আমার কাজের অগ্রগতি দেখতে পেয়ে আমার পিঠ চাপড়ে আমাকে স্নেহের সঙ্গে আলিঙ্গন করলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘আমি জানি, তোমাকে আমি চাপের মুখে রেখেছিলাম। তুমি সিস্টেম ডিজাইন করার জন্য বড়ো একটা কাজ করেছ।’ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাগুলোর মধ্যে এটা ছিল অন্যতম। আমার ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার মধ্যে সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট, সিস্টেম ইন্ট্রেগেশন, সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমার ক্যারিয়ারের বিভিন্ন স্তরের উন্নতির মূলে ছিল সমন্বিত শিক্ষার অভিজ্ঞতা।
প্রফেসর শ্রীনিবাসনের কাজ পর্যবেক্ষণের পদ্ধতিতে সত্যি সত্যি প্রত্যেক টিম মেম্বরের মধ্যে সময়ের মূল্য সম্বন্ধে উপলব্ধি জন্মে। টিম থেকেই সাফল্য লাভ করা যায়। আমি উপলব্ধি করলাম, মানুষের মন থেকে কাজ করার যোগ্যতা নানাভাবে প্রকাশ পায়। আমার ক্ষেত্রে ওটাই ঘটেছিল। এটাই হচ্ছে ধীশক্তি বিনির্মাণের কৌশল
এখানে মেসেজটা হচ্ছে, সংস্থায় তরুণদের বিশেষত্ব থাকলেও তাদেরকে বহুবিধ ডিসিপ্লিন ও প্রোজেক্টে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হওয়া উচিত। তাহলে তাদেরকে বৃহত্তর সংস্থার দায়িত্ব দিয়ে নতুন পণ্য ও নতুন কিছু তৈরির জন্য প্রস্তুত করা যায়। একজন শিক্ষকের মধ্যে থাকতে হবে প্রফেসর শ্রীনিবাসনের মতো দক্ষ কোচ হওয়ার যোগ্যতা।
২০০৬-এর জানুয়ারিতে ‘নিউ হোরাইজন রকেট’ প্রতি ঘণ্টায় ৩৬,০০০ মাইলের বেশি গতিতে উৎক্ষিপ্ত হলো। ঠিক নয় ঘণ্টায় সেটি চাঁদকে অতিক্রম করে। মহাকাশযানটি ৩ বিলিয়ন মাইল পাড়ি দিয়ে তিন মিনিটের মধ্যে পুটোর ব্যাসকে অতিক্রম করে। অধিকাংশ মহাযানের বোর্ড সিস্টেমের শক্তির উৎস ছিল সৌরশক্তি, আর ‘নিউ হোরাইজন’ রকেটে ব্যবহৃত হয় নিউক্লিয়ার ফুয়েল- পুটিনিয়াম। এতে তাপ হ্রাস পায়। ফুয়েলকে ডিজাইন করা হয় যাতে ২০২০ সাল, এমন কি তারপরও উপযোগী থাকে। প্রোজেক্ট চীফরা হিসাবনিকাশ করলেন যে এতে ১-ইন-১০,০০০ সুযোগ আছে সব ঝামেলা উপেক্ষা করে ‘নিউ হোরাইজনের’ ঠিক ৭,৭৫০ মাইল (১২,৪৭২কিমি) উপরে উঠার। প্লুটোর পাশ দিয়ে পৃথিবীতে প্রয়োজনীয় সব ছবি পাঠাতে ‘নিউ হোরাইজনের’ প্রয়োজন হবে প্রায় ১৬ মাস। স্পেসক্রাফট এর ফলে কুইপার বেল্ট পৌঁছে যাবে। মিশন বামন গ্রহ প্লুটোর পেছন দিয়ে শেষ করার একটা সম্ভাবনা ছিল।
আমি এই গল্পটা বলছি এটা বোঝাতে যে, পুরনো চিন্তাভাবনা থেকে বের হয়ে নতুন ও উদ্দীপক কিছু অর্জন করতে হলে এমনটিই করা উচিত। আমি ডেনিস ওয়েটলের লেখা এম্পায়ারস অব দি মাইন্ড নামের বই পড়েছিলাম। এই বইটিতে বলা হয়, কী ধরনের পৃথিবীর সমস্যা আমরা মোকাবিলা করছি। গতকাল কী ছিল আর আজ কী হচ্ছে? এটা পড়ে আমি লেখকের নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলো পরিবর্তন করি। আমি তৃতীয় পয়েন্ট যোগ করলাম যা নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটি পুস্তকে বলা হয়েছে, ‘গতকালের কাজ আজ করবে না।’
১. গতকাল: প্রাকৃতিক সম্পদই ছিল শক্তি।
আজকাল: জ্ঞানই শক্তি
প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত জ্ঞানের দ্বারা নিজেদের শক্তিশালী করে তোলা।
২. গতকাল: পুরহিতন্ত্র ছিল আদর্শ।
আজকাল: সমন্বিত শক্তিই হচ্ছে আদর্শ।
যে সকল প্রতিষ্ঠান তার বিভিন্ন বিভাগকে শক্তিশালী করে তুলবে তারাই তাদের লক্ষে পৌঁছতে পারবে।
৩. গতকাল: নেতারা আদেশ করতেন এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতেন।
আজকাল: নেতারা ক্ষমতা প্রদান করে শিক্ষা দেয়।
প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্পর্শকাতর হওয়ার দরকার হয় টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনে।
৪. গতকাল: শেয়ারহোল্ডারদের অগ্রধিকার ছিল।
আজকাল: কাস্টমারদের অগ্রধিকার দেওয়া হয়।
প্রতিষ্ঠানগুলোর সকল স্টেকহোল্ডারদের প্রয়োজনের প্রতি সংবেদনশীল হতে হয়।
৫. গতকাল: কর্মচারীরা অর্ডার গ্রহণ করত।
আজকাল: টিম সিদ্ধান্ত নেয়।
প্রতিষ্ঠানগুলোর টিম স্প্রিট বাড়ানোর প্রয়োজন পড়ে।
৬. গতকাল: সিনিয়রিটি দ্বারা মর্যাদা নির্ধারিত হতো।
আজকাল: সৃজনশীলতা দ্বারা মর্যাদা নির্ধারিত হয়।
প্রতিষ্ঠানগুলো বিচার্য হয় কেমনভাবে তারা নতুন কিছু আবিষ্কার ও সৃজনশীল কাজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়।
৭. গতকাল: উৎপাদন নির্ধারন করত লভ্যতা।
আজকাল: প্রতিযোগীতা এখন চাবিকাঠি।
প্রতিষ্ঠানগুলোকে জ্ঞান ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে আরো বেশী বেশী প্রতিযোগীতা প্রবন হতে হবে।
৮. গতকাল: মূল্যবোধ ছিল অতিরিক্ত বিষয়।
আজকাল: মূল্যবোধই হচ্ছে সবকিছু।
প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন মূল্যবোধকে সর্বস্তরে সুপ্রতিষ্ঠিত করা।
৯. গতকাল: প্রত্যেকেই ছিল এক একজন প্রতিযোগী।
আজকাল: প্রত্যেকেই এক একজন গ্রাহক।
প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই ফিডব্যাক পেতে চায় এবং তার উপর ভিত্তি পদক্ষেপ নেয়।
১০. গতকাল: বিশেষ দক্ষতার দ্বারা মুনাফা অর্জিত হতো।
আজকাল: নিষ্ঠার সাথে কাজ করে কৃতকার্য হওয়া।
প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কাজ করতে হয় সাফল্য লাভের জন্য। এ ধরনের কালচারকে তাদের ছাত্রদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশে প্রমোটার হিসাবে কাজ করতে হয়।
আবিষ্কার ও সৃজনশীলতার দ্বারা শ্রেষ্ঠত্বের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। প্রতিযোগিতার দ্বারা একটা জাতির অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটে। জ্ঞানের দ্বারা প্রতিযোগিতা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। প্রযুক্তির দ্বারা জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। আবিষ্কারের দ্বারা প্রযুক্তির বিকাশ ঘটে। সম্পদ ও বিনিয়োগের দ্বারা প্রযুক্তি ও আবিষ্কারের শ্রীবৃদ্ধি হয়। আবিষ্কার জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আমাদের কল্পনাকে দেয় নতুন অবয়ব। কল্পনা প্রত্যেকের জীবনকে আরো অর্থবহ করে তোলে। আবিষ্কার সৃজনশীলতার গভীরতা থেকে ঘটে। জ্ঞানঋদ্ধ সমাজে আমরা অবিরত কোনো কিছু উদ্ভাবন করতে পারি। উদ্ভাবন সৃজনশীলতার মাঝ থেকে ঘটে। সৃজনশীলতা সুন্দর মন থেকে আসে। এটা যে-কোনো স্থানে ও পৃথিবীর যে-কোনো অংশে ঘটতে পারে। এটা একজন জেলের কুঁড়েঘর থেকে বা একজন কৃষকের কুটির থেকে বা একটা ডেইরি ফার্ম, গোমহিষাদি প্রজননকেন্দ্র থেকেও ঘটতে পারে। ক্লাসরুম, ল্যাব বা ইন্ডাস্ট্রি বা আর অ্যান্ড ডি সেন্টার থেকেও আবিষ্কারের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। সৃজনশীলতার বহুমাত্রিক দিকদর্শন আছে। আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মতো বিষয় সৃজনশীলতার মাঝে নিহিত। সৃজনশীলতা মনের কল্পনা শক্তি, যা থেকে নতুন কিছু আবিষ্কার করা যায়। একজন সৃজনশীল ব্যক্তির কোনো কিছু গ্রহণ করার মতো মানসিকতা থাকে।
একজন সৃজনশীল ব্যক্তির নতুন ভাবনা, ইচ্ছা চালিত হয় মনের গভীর থেকে। সম্ভাবনাময় দৃষ্টিভঙ্গির নমনীয়তা ও উপভোগ করার অভ্যাস থেকে সৃজনশীলতার উদ্ভব ঘটে। সৃজনশীলতা হচ্ছে এমন একটা প্রক্রিয়া যার সাহায্যে আমরা অবিরতভাবে আমাদের ধ্যানধারণাকে উন্নত করতে পারি। ধারাবাহিক কর্মের সাহায্যে আমরা সমস্যার চমৎকার সমাধান এবং আমাদের কাজগুলোকে পরিমার্জন করতে পারি। সৃজনশীলতার গুরুত্বপূর্ণ অবয়ব হচ্ছে ভিন্নতা দর্শন এবং উদ্ভাবন। উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা হচ্ছে কালচার অব এক্সেলেন্স বা শ্রেষ্ঠত্বের সংস্কৃতি। চিন্তাভাবনা ও কর্মের শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে কোনো মিশনের ভিত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব বলতে কী বুঝায়? বন্ধুগণ, আপনারা সবাই তরুণ সমাজের এক একজন প্রতিনিধি। এ সমাজকে হতে হবে শ্রেষ্ঠত্বের সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ। হঠাৎ করে শ্রেষ্ঠত্বের সৃষ্টি হয় না। এটা একটা প্রক্রিয়া, যেখানে একজন ব্যক্তি বা সংস্থা বা জাতি অবিরতভাবে প্রতিযোগিতা করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অধিকতর ভালো অবদান রাখে। তারা নিজেরাই
কাজ সম্পন্ন করে, তাদের স্বপ্নগুলোকে পূরণ করার জন্য কাজ করে। তারা প্রস্তুত হয় ঝুঁকি মোকাবিলা করতে। তারা স্বপ্নকে সার্থক করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হওয়ায় তারা অকৃতকার্য হয় না। তারপর তারা স্বপ্নপূরণ করে তাদের মূল টার্গেটে পৌঁছে যায়। তারা কাজ করতে চেষ্টা করে অবর্ণনীয়ভাবে। তারা কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না। এটাই হচ্ছে সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠত্ব। আমি নিশ্চিত আপনাদের প্রত্যেকের সংস্কৃতির মাস্টার হতে হবে।
শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে আমাকে শেয়ার করতে হবে কেমন করে একজন রাস্তার ছেলে নোবেল লরেটি হলেন। মারিও ক্যাপেছি তাঁর মায়ের সঙ্গে ইটালিয়ান আল্পসে বসবাস করতেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হলে, তাঁর মা ও অন্যান্য বোহেমিয়ান লোকগুলোকে দাচাউ কনসেনট্রেশন ক্যামেনা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই বন্দীশিবিরে রাজনৈতিক কয়েদিদেরকেও রাখা হতো। গেস্টাপো বাহিনী দ্বারা গ্রেফতার হওয়ার কথা বুঝতে পেরে তার মা তার সমস্ত সম্পদ বিক্রি করে অর্থকড়ি তার কয়েকজন বন্ধুর কাছে রাখেন, যাতে তাঁর ছেলেকে তাদের কৃষি খামারে রেখে যেতে পারেন।
তাঁর ছেলেকে কৃষিফার্মে গম জন্মাতে হতো; মিলে নিয়ে তা পিষে ময়দা বানিয়ে আনার কাজও তাকেই করতে হতো। এক সময় কিন্তু তার মায়ের দেওয়া অর্থ ফুরিয়ে যায়। তারা ছেলেটিকে তাড়িয়ে দেয়। সে সময় তার বয়স সাড়ে চার বছর। তিনি শহরের রাস্তায় বাস করতেন। মাঝেমধ্যে তিনি গৃহহীন ছেলে- মেয়েদের সঙ্গে থাকতেন। কিছুদিন তিনি এতিমদের সঙ্গেও কাটিয়েছিলেন। সেই দিনগুলোতে তিনি অধিকাংশ সময়ই ক্ষুধার্ত থাকতেন। তিনি এক বছর রেগ্গিওএমেলিয়া সিটিতে বসবাস করেন। এক সময় অপুষ্টির জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। তার মা তাকে এক বছর ধরে খোঁজাখুঁজির পর তার নবম জন্মদিনে তিনি তাকে খুঁজে পান। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ক্যাপেছি ও তার মা আমেরিকায় পাড়ি দেয় ক্যাপেছির চাচা ও চাচির সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।
সেখানে তিনি স্কুলে থার্ড গ্রেডে ভর্তি হন। তিনি খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। তারপর তিনি পলিটিক্যাল সায়েন্স পড়তে যান। কিন্তু তা পড়তে ভালো না লাগায় তিনি তাঁর বিষয় পরিবর্তন করে অংক শাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। ১৯৬১ সালে তিনি গ্রাজুয়েট হন। দুটো মেজর সাবজেক্ট ফিজিকস ও কেমিস্ট্রি বিষয়ও তাঁর পাঠ্যসূচিতে ছিল। তাঁর ফিজিকস পড়তে ভালো লাগত। তবুও জেমস ডি ওয়াটসনের উপদেশে তিনি গ্রাজুয়েট স্কুলে মোলিকুলার বায়োলজিতে পড়াশোনা করেন। তিনি তাকে উপদেশ দেন যে ছোটো বিষয়ের জন্য যেন তিনি বিরক্ত না হন।
ক্যাপেছির উদ্দেশ্য ছিল একটা লক্ষ্যে পৌছানোর। তিনি ১৯৮০ সালে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করে ১৯৮৪ সালে শেষ করেন। ক্যাপেছি সুস্পষ্টভাবে সাফল্য লাভ করেন। তিন বছর পরে ১৯৮৯ সালে তিনি ইঁদুরদের উপর গবেষণার জন্য আবেদন করেন।
ইঁদুরদের উপর তাঁর গবেষণায় অগ্রগতি হয়। ক্যাপেছি সৃষ্ট প্রযুক্তি গবেষকদের দ্বারা স্বীকৃত হয়। একটা ইঁদুরের উপর গবেষণালব্ধ ফলাফলকে তাঁরা ইতিবাচক বলে মনে করেন। মানুষের ব্যাধি নিরাময়ের জন্য তাঁর গবেষণালব্ধ ফলাফলকে কাজে লাগানো হয়। মারিও ক্যাপেছির গবেষণা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য কম চমকপ্রদ ছিল না। ইঁদুরদের উপর তাঁর গবেষণালব্ধ উদ্ভাবন মানুষের আজহেইমার রোগের আরোগ্য লাভের জন্য কার্যকরী হয়। মারিও ক্যাপেছির জেনেটিকস উদ্ভাবনের জন্য ২০০৭ সালে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন।
নোবেল লরেট মারিও ক্যাপেছির জীবনে সত্যি যা প্রমাণিত হয় তা হচ্ছে:
যখন আপনি আশা করেন একজন তারকা হতে, কে আপনি তাতে কিছু যায় আসে না, আপনার হৃদয় যা চায়, তা আপনার কাছে আসবেই।
এটা স্মরণ রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, বিজ্ঞান কঠোরভাবে চেষ্টা করে পৃথিবীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে। আর এটাই ইঞ্জিনিয়ারদের কাছে একুশ শতাব্দীর দাবি।
কিছুদিন আগে আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অ্যাপলাইড সায়েন্সের প্রখ্যাত প্রফেসরদের ল্যাবোরেটরি পরিদর্শন করি। আমার মনে আছে, প্রফেসর হংকুন পার্ক তাঁর ন্যানো নিডলস আমাকে দেখান। ন্যানো নিডলস কীভাবে টারগেটেড সেলে ঢুকিয়ে ওষুধ পুশ করতে হয়, তা তিনি আমাকে দেখান। তিনি এটা আবিষ্কার করে, বায়ো সায়েন্সের ন্যানো পার্টিকেল সায়েন্স উদ্ভাবন করেন। অপরদিকে, প্রফেসর বিনোদ মনোহরণও আমাকে দেখান কীভাবে বায়ো সায়েন্স ও ন্যানো ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স কাজ করে। তিনি সেল্ফ অ্যাসেরিং পার্টিকেল ডিজাইন করার জন্য ডিএনএ ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করেন। অ্যাটোমিক লেভেলে ডিএনএ এর নির্দিষ্ট টাইপ একটা পার্টিকেলের জন্য প্রয়োগ করা হয়।
তিনি তাদের থেকে পূর্বের একটা আচরণ ও স্বয়ংক্রিয় উপস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হন। এটাই হতে পারে আমাদের জবাব যে তিনি তাদের থেকে পূর্বের একটা আচরণ ও স্বয়ংক্রিয় উপস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এটা হতে পারে আমাদের ডিভাইসের সেল্ফ অ্যাসেম্বিলি সম্বন্ধে জিজ্ঞাস্য। ড.কে.এরিক ড্রেক্সলারের কল্পনার মতো মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই গভীর মহাশূন্যে অনেকগুলো কলোনি তৈরি করা সম্ভব হতে পারে। এভাবেই সিঙ্গেল রিসার্চ বিল্ডিং হতে পারে। আমি দেখলাম, কেমনভাবে দুটো ভিন্ন ভিন্ন বিষয় আকৃতি ধারণ করে, একটির সাথে আর একটির মিলন ঘটে প্রযুক্তবিদদের সহায়তা ছাড়াই। এইভাবেই সায়েন্স প্রত্যেকে প্রত্যেকের আকৃতি দিয়ে থাকে। ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আজকের ছাত্রদেরকে উপলব্ধি করার প্রয়োজন আছে।
অনুরূপভাবে, আমি যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করি। আমি সেখানে সিদ্ধার্থন চন্দ্রণের সঙ্গে মিলিত হই। তিনি আমাকে অ্যানি রাউলিং রিজেনারেটিভ নিউরোলোজি ক্লিনিক দেখান। আগে আগেই মানসিক নিউরাল রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তিনি কাজ করেছেন দেখে আমি বিশেষভাবে অভিভূত হই। প্রফেসর চন্দ্রণ তাঁর উদ্ভাবিত আবিষ্কারের সাহায্যে কীভাবে নিউরোনের রোক নির্ণয় করা যায় আমাকে তা দেখান। চোখের ডাক্তাররা তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। অপটিক্যাল স্কানার ডিভাইস ব্যবহার করে তাঁর টিম চোখের ভেতরের দিকটার নকসা করেন, বিশেষ করে রেটিনার। তাঁরা পুনরায় অপটিক্যাল নার্ভ পর্যবেক্ষণ করার টার্গেট করেন। রেটিনার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করেন। তার ভেতরে নিউরন ও ফটো রিসিপটর দেখতে পান। চোখ ব্রেনের সাথে সংযুক্ত। উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করে তাঁরা মিলিমিটারের সাহায্যে অপটিক্যাল নার্ভগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখেন।
আমি সায়েন্স জার্নালে ডিএনএ ন্যানোর সর্বশেষ ডিভাইস সম্বন্ধে একটা আর্টিকেল পড়ি। এই ডিভাইসটি Technische Universitact Muenchen (TUM)-এর সাথে চলমান বাহু বিশিষ্ট একটা রোবটের সঙ্গে সংযুক্ত, যা একটা বই খোলে এবং বন্ধ করে, তাতে একটা সুইজেবল গেয়ারও সংযুক্ত। এই প্রোজেক্টে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকায় ফলাফলে নতুন একটা পথ খুলে দেয় রিকনফিগারিং মোডুলার ৩ডি বিল্ডিং ইউনিটসের সঙ্গে একত্রে পরিপাটি আকৃতিতে যুক্ত হয়। এটা শুধুমাত্র চলমান অংশের প্রাকটিক্যাল ন্যানো মেশিনের জন্য খুলে যায় না, টুলকিটও থাকে, যা সহজতর করে তাদের প্রোগ্রামকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একত্রিত করতে। এটা হচ্ছে একটা নতুন ক্ষেত্র যা ডিএনএ ওরিগামি নামে সমধিক পরিচিত। উদাহরণ হিসাবে ঐতিহ্যবাহী জাপানি কাগজ ভাঁজকৃত শিল্পকলার কথা বলা যায়। প্রোগ্রাম দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে যায় প্রাকটিক্যাল অ্যাপলিকেশনের দিকে। রিসার্চরা ন্যানো পার্টিকেলের যুক্ত হওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। কেমিক্যাল আইওনকে স্ব স্ব টুকরোগুলোয় কেন্দ্রীভূত করে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তারা তাপমাত্রাকে বাগে এনে জয়েনিং প্যাটার্নের সঙ্গে যুক্ত হওয়াকেও নিয়ন্ত্রণ করে। ডিপ স্পেস এপ্লিকেশনে বা মানুষের শরীরের ভেতরের জার্মস ও প্যাথোজেনসের জন্য অনুরূপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রোবটের ব্যবহার উপযোগী হতে পারে। এভাবে ডিএনএ মিথষ্ক্রিয়ায় বায়োসায়েন্সের ব্যবহার করা হয়। টেম্পারেচারের ফিজিকস, আইওন কনস্ট্রাকশনের কেমিস্ট্রির সঙ্গে এটা ব্যবহার করা হয়। তারা উপলব্ধি করে রোবটিক অ্যাসেম্বিলি। এটা স্পেস সায়েন্স কিংবা মেডিক্যাল ফিল্ডে বিশেষ উপযোগী।
বিশ্বজুড়ে একটা নতুন বিষয়কে পরিচিত করানো হচ্ছে। বিষয়টি হলো ইকোলোজি। টেকসই পদ্ধতির উন্নয়নের জন্য ইকোলোজির গুরুত্ব অপরিসীম। এই প্রযুক্তি সবচেয়ে উৎকৃষ্টতম। একুশ শতাব্দীর জ্ঞান ঋদ্ধ সমাজে এটা একটি নতুন দিকদর্শন। এই প্রযুক্তিতে সায়েন্স ও পরিবেশ এগিয়ে চলবে একত্রে। এভাবেই নিউ এইজ মডেল হবে কোর ডাইমেনসনাল ও বায়ো-ন্যানো-ইনফো- ইকো বেসড দিকদর্শন। যখন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি একই মুখী হয় তখন বস্তুতপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয় চিন্তা ও বাস্তবায়ন। যখন সফল বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবে প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়, তখন তাদের সবসময়ের প্রবণতা থাকে আয় উপার্জনের। তাদের চিন্তা করা উচিত, তারা কীভাবে মানুষের জীবনে শুভ পরিবর্তন আনতে পারে।
টেলিফোনের দিকে দৃষ্টিপাত করুন, এটা আপনাকে মনে করিয়ে দেবে আলেকজান্ডার গ্রাহামবেল নামে একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর কথা। তিনি একজন মহান আবিষ্কারক। তিনি ছিলেন সহানুতিভূতিশীল এবং সেবাপরায়ণ। আসলে তাঁর গবেষণার ফলে টেলিফোনের উন্নয়ন ঘটে। তিনি টেলিফোনের চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করে লোকজনকে টেলিফোনের শব্দ শোনাতে সাহায্য করেন। বেলের মা ও স্ত্রী উভয়েই টেলিফোনে আলাপ করে দেখেন। এতে বিজ্ঞানের প্রতি বেলের দৃষ্টিভঙ্গি সুদৃঢ় হয়। তিনি দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ হন টেলিফোনের ডিভাইজ উন্নত করতে। তিনি বোস্টনে একটা বিশেষ স্কুল শুরু করেন। শ্রবণশক্তি ক্ষীণ লোকদেরকে তাঁর তৈরি ডিভাইজের সাহায্যে শব্দ শুনতে সাহায্য করেন। এ থেকেই তিনি টেলিফোন আবিষ্কার করেন। আপনারা কি অনুমান করতে পারেন, আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের বিখ্যাত ছাত্রী কে ছিলেন? তিনি হচ্ছেন হেলেন কিলার। হেলেন কিলার ছিলেন একজন লেখক, সক্রিয়কর্মী এবং কবি। তাঁর শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি ছিল না। হেলেন কিলার তাঁর শিক্ষক সম্বন্ধে একদা বলেছিলেন যে, বেল তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ‘অমানবিক নীরবতা যা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে এবং পর করে দেয়।
পরিশেষে, আমি আপনাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, ‘আপনারা কি স্মরণে রাখতে পছন্দ করেন, আপনি আপনার নিজের জীবনের প্রকাশ ঘটাতে পারেন এবং আপনার জীবনের অবয়ব গড়ে তুলতে পারেন? একখণ্ড কাগজে আপনার স্বপ্নকে লিখে ফেলুন। ওই পাতাটা মানুষের ইতিহাসের বইয়ের পাতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ পাতা হবে। জাতির ইতিহাসে একটা পাতা আপনার স্মরণে থাকবে—সেই পাতাটা হবে আবিষ্কারের পাতা। উদ্ভাবনের পাতা বা আবিষ্কারের পাতা বা সামাজিক পরিবর্তনের পাতা বা দারিদ্র্যতা দূরীকরণের পাতা, বা মানবজাতির জন্য নতুন প্রযুক্তি খোঁজার পাতা।
(আর. ভি. ইনস্টিটিউট অব টেকনোলোজি, বিজনোর ২১ জুলাই ২০১৫ এ বক্তৃতা ও পারস্পরিক আলাপ থেকে।)