১৮. হৃদয়ের সুস্থতা
মন-শরীর ও ওষুধের মধ্যে এটা
একটি সমন্বিত কাজ।
.
চিকিৎসা পেশায় বহু দিকদর্শন আছে। চোয়াকিই নিইমা রিনপোচে কাঠমুণ্ডুর প্রধান ভিক্ষু ও চিকিৎসা বিষয়ক গবেষক। তার সম্বন্ধে আমি আপনাদেরকে বলব। এক কিলোমিটার হাঁটার পর আমি হোয়াইট কুম্বা পৌছালাম। প্রধান ভিক্ষু ও তাঁর শিষ্যরা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রিনপোচ আমাকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘আসুন আমরা স্টাডিতে যাই।’ আমি তাকে অনুসরণ করলাম। তিনি একজন তরুণের মতো হেঁটে প্রথম ফ্লোর, দ্বিতীয় ফ্লোর, তুতীয় ফ্লোর পেরিয়ে ফোর্থ ফ্লোরে উঠলেন। সম্ভবত তাঁর স্বাস্থ্যবান জীবনে শরীর ও মনে সুস্থতা ইতিবাচক। সবার সঙ্গে আমি তাকে অনুসরণ করে তাঁর চেম্বারে পৌঁছালাম। আমি দেখতে পেলাম, তাঁর চেম্বারটি আধ্যাত্মিক পরিবেশে স্থাপিত একটি ল্যাবোরেটরি। ওখান থেকে হিমালয়কে দেখা যায়। আমি বিস্মিত হলাম, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে তাঁর গবেষক ছাত্ররা ওখানে এসেছে দেখে। ডেভিড আর শলিম, এমডি. চোয়াকিই নিইমা রিনপোচে এর সহযোগী লেখক। তিনি ডেভিড আর শলিম এর সঙ্গে ‘মেডিসিন অ্যান্ড কমপ্যাসন’ নামে একটি বই লিখেছেন। চোয়াকিই নিইমা রিনপোচে ও আমি আমাদের কয়েকটি বই পরস্পরের সঙ্গে বিনিময় করলাম। আমি কাঠমুণ্ড থেকে দিল্লি আসার পথে তাঁর একটি বই পড়ে ফেললাম। এই বইটিতে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ পুণ্যের কথা বলা হয়েছে, যা থেকে একজন মেডিক্যাল প্রাকটিশনার তাঁর রোগীদের চিকিৎসা করতে পারবেন:
- উদারতা
- খাঁটি ন্যাপরায়ণতা
- সহনশীলতা
- অধ্যবসায়
- বিশুদ্ধ মনোসংযোগ পরিচর্যা
- বুদ্ধিমান হওয়া
এই সদগুণগুলো মানুষের হৃদয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমি নিশ্চিত, যাঁরা চিকিৎসক হতে চান কিংবা ইতিমধ্যেই ডাক্তার হওয়ার জন্য পড়াশোনা করছেন তাঁরা এই গুণাবলিগুলোকে রপ্ত করুন। তারপর অভ্যাসে পরিণত করে রোগীদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার করবেন। এটাই হচ্ছে শরীর-মন এবং ওষুধের মাঝের সুসম্পর্কের উদাহরণ।
পরিবেশের বিরূপতা, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং নগরায়ণের ফলে পৃথিবীতে নানা ধরনের নতুন নতুন রোগ ব্যাধির উদ্ভব ঘটছে। গত দুই দশকে কমপক্ষে ৪৫ প্রকার রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব ঘটেছে মানুষ ও জীবজন্তুর মধ্যে। নিবেদিত গবেষণা দ্বারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা চলছে, চলবেই, যা কখনোই শেষ হবে না। একটি উত্তম বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান অবশ্যই নতুন নতুন দিগন্তকে উন্মোচন করবে।
স্বাস্থ্যসেবক পেশাজীবীরা ‘আমি কী দিতে পারি’ এই দর্শনে পেশাগত কাজ করে থাকে। আমি প্রার্থনা করি, আপনারা নতুন নতুন ভাবনার অধিকারী হোন, আপনারা কাজে উৎসাহী ও নিবেদিত হোন। ‘আমার মস্তিষ্ক ব্যাথা অন্যের দূর করে দিক এবং যাদের প্রয়োজন তাদের সেবায় যেন আমি নিবেদিত হতে পারি।’ এটা অবশ্যই আমাদের স্লোগান হোক।
দুটো DRDO-র সাথে অংশীদারিত্বে মাউন্ট আবুতে অবস্থিত গ্লোবাল হসপিটলে কার্ডিয়াটিক রোগীদের শরীর-মন-আত্মা সুস্থতার জন্য কয়েক বছর কাজ করেছিল। বৈজ্ঞানিকভাবে তারা প্রতিষ্ঠিত করেছিল তিনটি আঁশযুক্ত শাকসব্জি সমৃদ্ধ খাবার, প্রতিদিন অ্যারোবেটিক শরীরচর্চা ও ধ্যানের অনুশীলন।
কয়েক বছর আগে, আমার একজন বৈজ্ঞানিক বন্ধু আমাকে ড. ব্রুস লিপটনের লেখা ‘বায়োগ্রাফি বিলিফস’ নামের একখানা বই পাঠান। বইখানার লেখক একজন বড়ো মাপের বিজ্ঞানী। বায়ো-সায়েন্সের উপর কুড়ি বছর গবেষণা করে তিনি বলেছেন, আমাদের স্বাভাবিক অন্তর্নিহিত ভাবনা আমাদের বায়ো সেলের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে রোগ নিরাময় করে। একটি নতুন অনুষঙ্গের উপর আলোকপাত করা হয় বইটিতে। লেখক প্লেসবো এফেক্টের উপর আলোকপাত করেন। তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা পাওয়ার অব বিলিফ’কে শ্রদ্ধা করেন না। তাঁরা কেমিকেল পাওয়ারের উপরই বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকেন। তাঁরা শরীর ও তার
অংশগুলোকে হেলাফেলা করে থাকেন।
মহাত্মা গান্ধীর লেখায় উঠে এসেছে কেমন করে চিন্তাভাবনা গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। তিনি বলেন:
‘তোমার বিশ্বাসগুলো থেকে চিন্তার উদ্ভব
তোমার ভাবনা থেকে তোমার কথাগুলোর উদ্ভব
তোমার কথাগুলো থেকে তোমার কাজগুলোর উদ্ভব
তোমার কাজগুলো থেকে তোমার অভ্যাসের উদ্ভব
তোমার অভ্যাসগুলো থেকে তোমার মূল্যবোধের উদ্ভব
তোমার মূল্যবোধগুলো থেকে তোমার গন্তব্যে পৌঁছানো।’
আসুন, আমরা নতুন চিকিৎসা সংক্রান্ত আবিষ্কারের বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে মত বিনিময় করি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক্সপার্ট ও ইঞ্জিনিয়ারগণ একটি বইয়ের পাতা খুলে মাংসপেশী বিশিষ্ট একটি কৃত্রিম হাতের ছবি দেখায়। নতুন প্রযুক্তিতে নমনীয় ও হালকা ওজনের রোবটের হাতগুলো দেখায়, যা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কাজে অসাধারণ কৌশল প্রদর্শন করে। মাসেল ফাইবার বিন্যাস ঘটায় আলট্রাফাইন নিকেল— টাইটেনিয়াম অ্যাল্লোয় তারের বান্ডিলগুলোকে, যা সমর্থ হয় টানটান করে প্রসারিত ও নমনীয় করতে।
আমি চীনে থাকাকালে রোবোটিকস দেখার জন্য পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্ৰ পরিদর্শন করি। সেখানে প্রফেসর লি মাইকেল লিউ এর অধীনে কাজ করতে থাকা একদল এক্সপার্ট আমাকে দেখালেন তাঁদের একটি এডাপটিভ প্রোসথেটিক লিম্ব ডিজাইন। প্রফেসর আমাকে বললেন যে এরূপ সিস্টেম তৈরি করতে আমাকে বৈদ্যুতিক প্রকৌশলী, মেডিক্যাল বিশেষজ্ঞ, বিহ্যাব বিশেষজ্ঞ, ডিজাইনারদের একটি দলের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এ ধরনের সমন্বিত সিস্টেম কাজ করে তাদের জ্ঞানের উপর নির্ভর করে।
একুশ শতাব্দীর চাহিদাকে মিটানোর জন্য প্রকৌশলীরা বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধশালী করেছে। যদি আমরা একটি উন্নত কিংবা শিল্পোন্নত দেশের মানুষ হতাম, তবে সাধারণ ইস্যুতে বক্তব্য দিতে হতো, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা সম্বন্ধে নিম্নরূপ বক্তব্য আসত:
১. গুণগতমানের সঙ্গে কোনো প্রকার আপোস ছাড়াই স্বাস্থ্যসেবার সাধ্যমত খরচ।
২. পরিবেশের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা, জীবনধারণের কৌশল ও সংরক্ষণ ভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার প্রতিধেষক ব্যবস্থা।
৩. বিশ্বায়িত বিশ্বে শুধু মাত্র দেশগুলোর নির্দিষ্ট এলাকা কিংবা গ্রুপগুলোতে উত্তম স্বাস্থ্যসেবা দেয়াই যথেষ্ট হতে পারে না।
৪. বিশুদ্ধ পানি ও জ্বালানির অভাব ঘটাতে পারে মারাত্মক স্বাস্থ্যসেবা সমস্যা।
৫. চিকিৎসা ও সামাজিক সেবা পৃথিবীর এক অংশ থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৬. গবেষণা ও শিক্ষণ হচ্ছে চূড়ান্ত সাহায্য চিকিৎসামূলক অনুশীলন ও বিপরীতক্রমী ধারায়। স্বাস্থ্যসেবা ইস্যুতে সঠিক সময়ে ও কম খরচে সমাধানের জন্য বিশ্বব্যাপী জ্ঞানের মঞ্চ তৈরি করা প্রয়োজন।
সম্প্রতি, রোগী, ডাক্তার ও কিছু সমাজ কর্মীদের একটি সম্মেলন হয়েছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোচনা হয়েছিল। রোগী ও ডাক্তারের সম্পর্ক বিস্তৃত হয়েছিল রোগীদের পরিবারের স্বাস্থ্যসেবায়। কেমন করে রোগ প্রতিরোধ করতে হয় এক পরিবার থেকে আর এক পরিবারে ফলপ্রসূ বার্তা প্রেরিত করা হয়, সময়োযুক্ত পরীক্ষা, পথ্যের অভ্যাস এবং উত্তম স্বাস্থ্যের জন্য ব্যায়ামসহ জীবনধারণের কৌশল পরিবর্তনের প্রয়োজন। ডাক্তার ও রোগীর সুসম্পর্ককে শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কের সাথে তুলনা করা চলে। যদি আপনারা একজন ডাক্তার হন, তবে একজন শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে প্রত্যেক পরিবারকে রোগ প্রতিরোধ ও গুণসম্পন্ন স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার উপদেশও দিতে আমি আপনাদের প্রত্যেককে অনুরোধ করব। আমি আশা করি আপনারা সবাই এই মহান পেশায় নিবেদিত হবেন।
(৩১ মার্চ ২০১৫ এ মহিসুর মেডিক্যাল কলেজ ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটে দেওয়া ভাষণ থেকে। )
= সমাপ্ত =