১২. বই আমাদের পথপ্রদর্শক

১২. বই আমাদের পথপ্রদর্শক

একটি ভালো বইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা এবং তার মালিক হওয়া
প্রকৃত পক্ষে একটি চিরস্থায়ী সম্পদ

.

তরুণদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদের চিন্তাভাবনার সঙ্গে মত বিনিময় করার আমার একটি মিশন ছিল। গত দুই দশকে প্রায় ১৯.৫ মিলিয়ন তরুণের সঙ্গে আমি মিলিত হয়েছি। তরুণদের কাছ থেকে আমি কী শিখেছি? তরুণদের কাছে আমার বার্তাটিই বা কী?

২০১০ এ আমি যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম তা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাই। আমি ইউএস এর লেক্সিংটনের গাটন কলেজ অব বিজিনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস এর ৭২ জন গ্রাজুয়েট ও পোস্ট গ্রাজুয়েটদের এক একটি ক্লাসে কথা বলেছিলাম। আমরা এক একটি ক্লাসে তিরিশ মিনিট সময় নেই।

একদিন, স্টেফানী নামের একটি মেয়ে আমাকে একটি অসাধারণ প্রশ্ন করে বসলেন। স্টেফানী এই কোর্সে যোগদানের আগে স্কুল টিচার ছিলেন। তিনি আমাকে জিজ্ঞসা করলেন, ‘ড. কালাম, রাতে আমি আপনার লেখা বইগুলোর একটি পড়েছি। আপনি বহু কাজ করেছেন। আমাকে বলুন কোন্ কাজটি করে আপনি পরম সুখ লাভ করেছেন?’

আমার উত্তর আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব। আমরা ১৯৮০ এ প্রথম দেশীয় স্যাটেলাইট লঞ্চ ভিইয়েকল এসএলভি-৩ উড্ডন করি। এতে আমি যারপর নাই খুশি হই। ১৯৮৯ এ অগ্নি ২০০০ কিলোমিটার এর গন্তব্যে যখন পৌছাল তখন আমাকে অন্য ধরনের সুখ দিল। ১৯৯৮ এ আমাদের টিম সাফল্যের সঙ্গে ৫২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের পোখরান মরুভূমিতে একটি নিউক্লিয়ার অস্ত্রের পরীক্ষা সম্পন্ন করলে, আমি বড়োই আনন্দ পেলাম। যখন আমাদের টিম ভিশন ২০২০ সফল করে ভারতকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশে পরিবর্তিত করার জন্য প্রস্তুত করল তখন আমার মধ্যে সুখের অনুভূতি জেগে উঠল। তারপর স্টেফানী আমাকে প্রশ্ন করল, ‘কিন্তু কোটিতে আপনি পরম সুখ পেয়েছিলেন?

আমি তাকে বললাম, ‘আমি চরম আনন্দ পেয়েছিলাম যখন পোলিও আক্রান্ত শিশুদের জন্য হালকা ওজনের ক্যালিপার তৈরি করতে বিশেষ অবদান রাখি। হালকা ওজনের ক্যালিপার ব্যবহারের ফলে পোলিও আক্রান্ত ছেলে-মেয়েদের ব্যথা দূর হওয়ায় তারা সহজে হাঁটাচলা করতে পারায় আমি পরম সুখ অনুভব করলাম। আমার জীবনের অন্য কোনো অবদানে কখনোই এতটা পরম সুখ অনুভব করিনি।’

আমি পরম সুখ অনুভব করেছি ভালো ভালো বই পাঠে, সেগুলোর পাতা থেকে আসল অর্থ উপলব্ধি করে। এক একটা ভালো বই পাঠ করে জ্ঞানঋদ্ধ হই। বই আমার স্থায়ী সঙ্গী। মাঝেমধ্যে বইগুলোর বিষয় আমার সম্মুখে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। বই আমাদের জীবনযাত্রায় পথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা কার্যকরী থাকে। আমি ১৯৫৩ এ চেন্নাইয়ের মুর মার্কেটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে লাইট ফ্রম মেইনি ল্যাম্প নামে একখানা বই কিনেছিলাম। এই বইখানা আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যায়। এই বইখানা পাঁচ দশক যাবৎ আমার সঙ্গের সাথি ছিল। বইখানা সব সময় পড়ার ফলে বেশ কয়েকবার বাইন্ডিং করা হয়েছিল। আমার মনে বইটি গভীরভাবে রেখাপাত করে। আমার এক বন্ধু ২০০৪ এ নতুন সংস্কারের একই বই আমাকে উপহার দিয়েছিল। সে বলেছিল যে, সর্বোত্তম জিনিস হিসাবে সে আমাকে বইখানা দিচ্ছে।

২০০৯ এর ১১ আগস্টে আমি তামিলনাড়ুর IROD এ ভ্যালেডিক্টোরি ফাংসন উদ্বোধন করতে গিয়েছিলাম। আমি আমার ভাষণে পরামর্শ দিয়েছিলাম যে প্রত্যেককে এক ঘণ্টা করে প্রতিদিন বইমেলায় কাটিয়ে ভালোমানের বই পড়া উচিত। এতে তারা জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে জ্ঞানঋদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারবে। তাদের ছেলে-মেয়েরা একদিন বড়ো মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারবে। আমি সমস্ত পিতামাতাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, প্রত্যেকের বাড়িতে কমপক্ষে ২০টি বই নিয়ে একটা ছোট্ট লাইব্রেরি গড়ে তুলতে। সেই লাইব্রেরিতে থাকবে দশটা শিশুতোষ বই, শিশুরা অল্প বয়সেই বাড়িতে বসে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারবে ও উপলব্ধি করতে পারবে তাদের পিতামাতা মানসম্পন্ন বই পাঠ করেন। এই সমাবেশে অনেক লোক উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা আমার এই ভাবনাটাকে ভালোভাবে উপলব্ধি করে তাঁদের বাড়িতে তাৎক্ষণিকভাবে একটি লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। আমি অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে নীচের শপথটা করিয়ে নিয়েছিলাম।

‘আজ প্রথমেই আমি ২০টি বই নিয়ে আমার বাড়িতে একটি হোম লাইব্রেরি গড়ে তুলব, আর তাতে ১০টি শিশুতোষ বই থাকবে।’

‘আমার ছেলে-মেয়েরা এই হোম লাইব্রেরিটিকে ২০০ বইয়ের একটি বড়ো লাইব্রেরিতে উন্নীত করবে। আমার নাতি নাতনিরা হোম লাইব্রেরিকে ২০০০ বইয়ের একটি লাইব্রেরিতে উন্নীত করবে।’

‘আমি মনে করি আমাদের লাইব্রেরি সারাজীবনের মূল্যবান সম্পদ এবং আমাদের পরিবারের মূল্যবান সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হবে। আমরা আমাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে কমপক্ষে একঘণ্টা প্রতিদিন লাইব্রেরিতে কাটাব পড়াশোনা করে।’

এই বিষয়ে শপথ গ্রহণ করানোর পর অবাক করা ঘটনা ঘটে গেল। এক ঘণ্টার মধ্যে বইমেলার বুকস্টল থেকে সমাবেশে উপস্থিত লোকেরা হাজার হাজার বই কিনে নিল। বইমেলার বুকস্টলের প্রায় বই বিক্রি হয়ে গেল।

অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন, হোম লাইব্রেরি হচ্ছে সর্বোত্তম সম্পদ। হোম লাইব্রেরিতে প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে বই পড়লে ছেলে-মেয়েরা মহান শিক্ষক, বড়ো নেতা, বড়ো বৃদ্ধিজীবী, বড়ো প্রকৌশলী, বড়ো বিজ্ঞানীতে পরিবর্তিত হতে পারবে। আপনারা প্রত্যেকে একটি হোম লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পারেন, যা পুরো পরিবারকে প্রত্যেকদিন ডিনারের সময় সাধারণ বিষয়ে আলোচনা করতে পারবেন। এভাবে পারিবারক জ্ঞান সমৃদ্ধ করে পুরো পরিবারে টেকসই ঐক্য গড়ে তুলতে পারেন।

(২৪ জানুয়ারি ২০১৫ জয়পুর লিটারেচার ফেসটিভ্যালে দেওয়া ভাষণ থেকে)

১০. প্রত্যেকের হাতে একখানা বই

আমরা অবশ্যই ভাষার বাধা, দূরত্ব,
মূল্যের প্রতিকূলতা অতিক্রম করে প্রত্যেকের
হাতে বই পৌঁছে দিতে পারব।

.

প্রিয় বন্ধুগণ, ভারত ২০২২ এর মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন দক্ষ লোকের মিশন সফল করবে। ৫০০ মিলিয়ন মানুষের অধিকাংশই তরুণতরুণী। তাদের বই ও জার্নাল থেকে জ্ঞান আহরণ করে জ্ঞান সমৃদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। দেশে লাইব্রেরির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কীভাবে লাইব্রেরির সান্নিধ্য পেতে পারি?

একটি ভালো ব্যবস্থা ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। ইন্ডিয়াতে প্রায় ৭০০ মিলিয়ন ভ্ৰাম্যমাণ গ্রাহক আছে। আমরা মোবাইলভিত্তিক লাইব্রেরি স্থাপন করতে পারি। সারাদেশে মোবাইলভিত্তিক লাইব্রেরির মাধ্যমে বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। তাছাড়াও মোবাইল ফোনে অনুবাদক কাজ করতে পারবে। মোবাইল অ্যাপলিকেশন ব্যবহার করে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের সুযোগসুবিধা পেতে পারি। এই সমস্ত বইয়ের অডিও সিস্টেমও চালু করতে পারি। অডিও সিস্টেম চালু হলে বই পড়ার পরিবর্তে শোনার মাধ্যমে জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব হবে। আমরা এভাবে সত্যি সত্যি ভাষার বাধা, দূরত্ব ও মূল্যের প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পড়াশোনার সামর্থ্য গড়ে তুলে প্রত্যেক মানুষের কাছে বই পৌঁছে দিতে পারব।

চিকিৎসক থেকে দার্শনিকে পরিবর্তিত হওয়া নোবেল বিজয়ী অ্যালেক্স ক্যারলের বই ম্যান, দি আননোন পাঠ করে আমি জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়েছি। এই বইয়ে আলোকপাত করা হয় মন ও শরীর কীভাবে সমন্বিতরূপে কাজ করে। আপনি একটাকে ব্যবহার, আর একটাকে অবজ্ঞা করতে পারবেন না। বিশেষভাবে যে ছেলে-মেয়েরা ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে তাদের এই বইটি পড়া উচিত। এই বইটি পাঠ করলে তারা শিখতে পারবে যে মানুষের শরীর যান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত নয়। শরীর সবচেয়ে অখণ্ড ও স্পর্শকাতর ফিডব্যাক পদ্ধতির সঙ্গে একটি বড়ো ধরনের বোধ সম্পন্ন সজীব পদার্থ দ্বারা গঠিত। মানুষের নিয়ম শৃঙ্খলা গড়ে উঠেছে মনস্তাত্ত্বিক ও শরীরবৃত্তের সমন্বিত জীবনের মেলবন্ধনে।

আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখি থিরুভাল্লুভারের থিরুক্কুরাল বইটিকে। বইটি জীবনের জন্য একটি চমৎকার কোড অব কন্ডাক্ট। লেখকের ভাবনায় উঠে এসেছে একটি দেশ, ভাষা, ধর্ম, কৃষ্টি এবং মানুষের মনের কথা। থিরুক্কুরাল বইখানা ছয় দশক যাবৎ আমার জীবনে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এই বইয়ে বলা হয়েছে যে নদী, হ্রদ, কিংবা পুকুরের গভীরতা যাই হোক না কেন, পানির অবস্থা যাই হোক না কেন লিলি ফুল সব সময়ই ফোটে। অনুরূপভাবে, যদি লক্ষ্য অর্জনের দৃঢ় সংকল্প থাকে তবে লক্ষ্যে পৌঁছানো অসম্ভব হলেও একজন মানুষ সাফল্য লাভ করবেই।

গ্রামের একটি ছেলের আত্মজীবনী আমি এখন আপনাদের কাছে বলব। ছেলেটির আত্মজীবনী পড়ে আমি লেজার প্রযুক্তির ভাবনায় মুগ্ধ হই।

১৯৬৮ এ আইআইটি, খড়গপুর থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রিধারী পশ্চিম বাংলা থেকে আসা একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী বিখ্যাত এয়ারোস্পেস কন্ডাক্টর নোর্থরোপ করপোরেশন রিসার্চ অ্যান্ড টেকনোলজির টিমে যোগদান করেন। তিনি সেখানে পদার্থবিদ হিসাবে অসাধারণ কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করেন। তিনি কাৰ্বন মনোঅক্সাইড (সিও) লেজার বিভাগে কাজ করছিলেন। তাঁর রিসার্চের উপর ভিত্তি করে ১৯৬৮ এ তার সহকর্মীরা নোর্থরোপ এ সবচেয়ে শক্তিশালী কন্টিনিউয়াস লেজার আধুনিকায়ন করেন। তিনি পদার্থ বিজ্ঞানী হিসাবে সামনের দিকে এগিয়ে যান। এই ভারতীয় বিজ্ঞানী রুম টেম্পারেচারের জন্য লেজার অপারেট তৈরি করতে সক্ষম হন। কিছুদিন আগেও যা তৈরি করার কথা ভাবাও সম্ভব ছিল না।

লসএঞ্জলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সেমিনারে ভারতীয় এই বিজ্ঞানী তাঁর আবিষ্কারের ফলাফল প্রদর্শন করেন। ‘ফাদার অব দি এইচ বোম’ খ্যাত এডওয়ার্ড টেলার ভারতীয় বিজ্ঞানীর উপস্থাপনার সময় চক্রান্ত করে বাথরুম করার অজুহাত দেখিয়ে রুম থেকে বাইরে চলে যান। যাওয়ার আগে বিজ্ঞানীকে তিনি ফিরে না আসা পর্যন্ত তাঁর বক্তব্য পেশ স্থগিত রাখার অনুরোধ জানিয়ে যান। পরবর্তীতে একজন রাশিয়ান বিজ্ঞানী একটি প্রখ্যাত জার্নালে লেখেন, ‘ভৌমিকের সিও লেজারের উপর কাজে লেজার সম্বন্ধে কোনো কিছুই বাদ যায়নি।’ তার আর্টিকেল এই বিজ্ঞানীকে আন্তর্জাতিক সুনাম এনে দেয়। আপনারা কি জানেন ভারতীয় এই বিজ্ঞানীর নাম? এই বিজ্ঞানীর নাম ড. মণিলাল ভৌমিক। তিনি ‘কোড নেম গড’ নামে বিখ্যাত বইয়ের লেখক। তিনি এই বইতে বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সম্পর্কের কথা দেখান। আমি একটানা বইটি পড়ে ফেললাম। আমি প্রত্যেকটি অধ্যায় উপভোগ করি। বইটিতে ড. ভৌমিকের জীবনের ব্যথাবেদনা ও আনন্দ উঠে এসেছে। আমি নিশ্চিত আপনারা সবাই অবশ্যই গভীর আগ্রহভরে এই লেজার বিজ্ঞানীর সম্বন্ধে পড়বেন। লেজারের উপর তার আবিষ্কারের ফলে আই সার্জারির গুরুত্বপূর্ণ LASIK (লাসিক) এর উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়।

এখন আমি দুদশক আগে হনলুলুতে ঘটা একজনের জীবনের সত্য ঘটনা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব। এই ঘটনাটি আমি স্টেভেন আ. কেভের লেখা এভরিডে গ্রেটনেস বই এ পড়েছিলাম।

লিণ্ডি কুনিশিমা ও গেরিয়ের দুই মেয়ের মধ্যে ট্রুডির বয়স তেরো বছর আর ছোটো মেয়ে জেনিফার বয়স নয় বছর এবং স্টেভেন নামের ছেলেটির বয়স আঠারো মাস। গেরি তার ছেলের মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু একটা লক্ষ করল। একজন নিউরোলজিস্টের দ্বারা ব্রেনের ভার্মিস এরিয়ার সিটি স্ক্যান করানোর পর দেখা গেল বডি ম্যাসেলের থেকে ব্রেনে মেসেজ যাওয়া আসা করছে না তা ডেভেলপ না করায়। নিউরোলজিস্ট জানিয়ে দিলেন স্টেভেন কখনোই হাঁটাচলায় বা মানসিক ও শারীরিকভাবে স্বাভাবিক হবে না। এ দুঃসংবাদে গেরির আহার নিদ্রা বন্ধ হয়ে গেল। ট্রুডি কিন্তু ডাক্তারের পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর ডাক্তারের ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ জানাল এই বলে যে তিনি স্টেভেন সম্পর্কে যা বলেছেন তা সে বিশ্বাস করে না। সে জানাল যে, স্টেভেন স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সে নিজেই চেষ্টা চালিয়ে যাবে। তারা প্রত্যেকদিন ডিনার টেবিলে পড়াশোনা করত। তারা স্টেভেনকে একটি প্যাসেজ পড়ে শোনাতে লাগল। ফলে শোনাটা স্টেভেনের অভ্যাসে পরিণত হলো। জেনিফার ও ট্রুডি তাকে প্রশ্ন করে জীবজন্তুর ছবিতে হাত রেখে তাকে প্রশ্ন করতে থাকল। কয়েক সপ্তাহ তারা স্টেভেনের কাছ থেকে কোনো জবাব পেল না।

তিন মাস পরে স্টেভেন তার আসন থেকে মোচড় মেরে শিশুদের বইগুলোর দিকে হাত বাড়াল। স্টেভেন বইয়ের পাতায় টোকা মারতে থাকল যে পর্যন্ত না জীবজন্তুর ছবিগুলো দেখতে পায়। পরের রাতে জেনিফার বই পড়তে প্রস্তুতি নিলে তাদের ভাই হামাগুড়ি দিয়ে জেনিফারের সেই দিকে এসে সেই পাতাগুলো খুলে ফেলল। এ থেকে এটা বোঝা গেল স্টেভেনের স্মরণ শক্তি আছে, আর তা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

স্টেভেনের সামনে জেনিফার ও ট্রুডি পিয়ানো বাজাতে থাকে। একদিন জেনিফার পিয়ানো বাজানো প্রাকটিস করার পর স্টেভেনকে তার আসন থেকে তুলে পিয়ানোর নীচে বসিয়ে দিল। সে সময় সে একটা অজানা নতুন শব্দ উচ্চারণ করল। সে গুনগুন করে সুর করতে থাকল। একই সঙ্গে তাদের পরিবার তার ম্যাসেলে ম্যাসেজ করতে থাকল। গেরি, ট্রুডি ও জেনিফার ছেলেটির ঠোঁটের মাঝে পিনাট বাটার পুরে দিতে শুরু করল। তাতে সে তার জিবে ও দাঁতের পাটিতে এক্সাইজ হতে থাকল। স্টেভেন সাড়ে চার বছর বয়সেও কথা বলতে পারল না, তবে সে মুখ দিয়ে শব্দ করতে পারছিল। তার কিন্তু স্মৃতিশক্তি আছে বলে মনে হলো। তার হাতের কাছে ৩০০ পিস জিগস পাজেল দিলে তা খণ্ড খণ্ড অংশকে নিয়ে ঠিকমতো সাজাতে পারল।

কয়েকটি স্কুল থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর লুইস বোগার্ট তাকে রবার্ট এলেন মোন্তেসরী প্রাক স্কুলে ভর্তি করে নিলেন। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর স্টেভেন নিজেকে উপলব্ধি করার জন্য দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হলো।

একদিন বোগার্ট পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষকদের কাজ দেখছিলেন। তিনি দেখলেন শিক্ষক একজন ছাত্রকে তার সংখ্যা জিজ্ঞাসা করছেন। ‘সংখ্যা কত?’ শিশুটি বলল, ‘কুড়ি!’ স্টেভেন হঠাৎ বলে ফেলল। বোগার্ট অবাক হলেন। স্টেভেন ভালোভাবে কথা বলতে পারে না। কিন্তু স্পষ্টভাবে তো সঠিক নম্বরটা বলতে পেরেছে। বোগার্ট শিক্ষিকার নিকটবর্তী হলে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “স্টেভেন কি এমনটা বলেছে?’

শিক্ষিকাটি বললেন, ‘না। আমরা তাকে এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা বলেছি। কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো সংখ্যা বের হয়নি। ওই ঘটনাটি বোগার্ট স্টেভেনের মাকে বললেন, ‘স্টেভেন যা বলতে যোগ্যতা অর্জন করেছে ঠিক তাই সে বলতে শুরু করেছে।’ তখনো তার ব্রেনের মোটরের দক্ষতা কম ছিল। জেনিফার, গেরি ও ট্রুডি কঠিন পরিশ্রম করতে লাগল তার হাতের লেখা স্পষ্ট করার জন্য। একদিন স্টেভেন জেনিফারকে আশ্বাস দিয়ে বলল, ‘আমি এটা করতে পারব। তোমরা আমাকে সময় দাও।’

তারপর থেকে ধীরে ধীরে স্টেভেনের উন্নতি হতে লাগল। ১৯৯০ এ তাকে সাধারণ ধারার একটি ক্যাথোলিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হলো। সম্মিলিত দৃঢ়সংকল্পের শক্তিতে এভাবে একটি শিশুকে নিরাময় করানো সম্ভব হলো।

(৯ ডিসেম্বর ২০১৪ এ পুডুচেরির ন্যাশনাল অন নলেজ, লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন নেটওয়ার্কিং এর উদ্বোধনী ভাষণ থেকে।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *