৫. জীবনযাত্রা পরিচালন
এগুলোই আপনাদের জীবনের সর্বোৎকৃষ্ট দিন যখন আপনাদের
পাখা বাড়ছে এবং আপনারা উড়তে শিখছেন।
.
বন্ধুগণ, দশকের পর দশক যাবৎ বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তির পরিমণ্ডলের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হচ্ছে ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণী। ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণীর ক্ষেত্রে পৃথিবীব্যাপী জোরালো গবেষণা করা একান্ত প্রয়োজন। আইসল্যান্ডে আমি একটা মডেল দেখেছি—প্রায় ১,০০০ বর্গকিমি এলাকায় একটা গ্রহণযোগ্য অগ্রগতি দেখতে পাই। একটা ডাটাবেস অনুসরণ করে এটা করা সম্ভব হয়েছিল। পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, কীভাবে কম্পন একটা দোলনের আকারে ক্রমেক্রমে তৈরি হওয়া কঠিন চাপ ভূমিকম্পের কয়েক দিন এবং কয়েক ঘণ্টা আগে ঘটে থাকে। ভূমিকম্পের এই মডেল তৈরি করা হয়েছিল প্রায় তিন দশকের ডাটাবেসের উপর ভিত্তি করে। জিওলজিস্ট, ম্যাটিরিয়াল সায়েন্টিস্ট, ফিজিস্ট এবং রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট এক্সপার্ট, রক ফরমেশন এক্সপার্ট ও ওয়েল এক্সপ্লোরেশন এক্সপার্টদের ভারতের জন্য প্রয়োজন। চল্লিশ বছরের নীচে বয়সী তরুণ সদস্যদের একটা টিম প্রয়োজন। পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ঘটতে যাওয়া ভূমিকম্পকে এই টিম অগ্রিম বলে দেবে এটাই হচ্ছে একটা মিশন। ভবিষ্যদ্বাণীর জানালা ধীরে ধীরে খুলে দেওয়া হবে দুদিন আগে, সাতদিন আগে, চার সপ্তাহ আগে, যেটা সম্ভব। তরুণদের জন্য এটা হবে দশ বছরের মিশন। ভবিষ্যদ্বাণীর উপর গবেষণা বয়ে আনবে বড়োসড়ো উদ্ভাবন যা থেকে ভারত ভূমিকম্পের বিধ্বংসী ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে। ভূমিকম্পের ভবিষ্যদ্বাণীর এই চ্যালেঞ্জ আমার ব্লগ 3billion ডট org এ বিশেষভাবে সাড়া পাই। আপনারা গবেষণায় প্রবৃত্ত হওয়ার আগে আপনাদের ‘জীবনযাত্রা পরিচালনাত বিষয়ে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে, আমি আমার অভিজ্ঞতার আলোকে জীবনের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা আপনাদের বলব। জ্ঞানার্জন করা, কষ্টের সময়ও স্বপ্নকে সার্থক করতে কঠিন পরিশ্রম করা এবং ব্যর্থতা ও সফলতাকে পরিচালনা করা।
প্রত্যেকটা সফলতা ও প্রত্যেকটা অনুপ্রেরণামূলক পেশার পেছনে আপনারা দেখতে পারবেন অবিচল লক্ষ্য যা জীবনের প্রথম থেকেই প্রায়ই গড়ে ওঠে। জীবনের লক্ষ্য প্রত্যেক কাজের উদ্দেশ্য আর ফলাফলের দিকে চালিত হয়। আপনি আপনার পেশাগত জীবনে প্রবেশ করার আগেই, আপনি আপনার জীবনের লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য উজ্জীবিত হবেন। আর তার ফলেই, আপনি বাকি জীবনে লক্ষ্যে পৌছাতে পারবেন। ফলে, সদাসর্বদা এটি আপনাকে আপনার গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহস জোগাবে।
সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত আপনার জীবনের লক্ষ্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। সঠিক জ্ঞানার্জন করা প্রয়োজন লক্ষ্যে পৌছানের উদ্দেশে। পিতামাতা ও স্কুল কলেজ থেকে অর্জিত জ্ঞানের সর্বোত্তম ব্যবহার করা আপনার দায়িত্ব। জ্ঞান আপনাকে মহত্ত্ব দান করবে এবং কষ্টকর মিশনকে সহজতর করতে সহায়তা দান করবে।
আমি আপনাদের সঙ্গে আমার শিক্ষক প্রফেসর সতীশ ধাওয়ানের গল্প শেয়ার করব। আমি এখন দিল্লির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করছিলাম। ১৯৫৮ সনে আমি ব্যাঙ্গালোরের এয়ারোনটিক্যাল ডিভেলপমেন্ট এস্টাবলিসমেন্টের ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনে (ডিআরডিও) যোগদান করি। সেখানে ডিরেক্টরের উপদেশে আমি একটা হোভারক্রাফ্ট উন্নতকরণের দায়িত্ব নেই। এ কাজের জন্য ডাকটেড কন্ট্রা-রোটোটিং প্রোপেলারের ডিজাইন করার প্রয়োজন হয়। কীভাবে ডাকটেড কন্ট্রা-রোটোটিং করতে হয় তা আমি জানতাম না। আমি জানতাম কীভাবে একটা কনভেনশনাল প্রোপেলার ডিজাইন করতে হয়। আমার কয়েকজন বন্ধু আমাকে বলল যে, ডাকটেড কন্ট্রা-রোটোটিং ডিজাইনের জন্য এয়ারোনটিক্যাল রিসার্চে বিশেষভাবে দক্ষ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের প্রফেসর সতীশ ধাওয়ানের স্মরণাপন্ন হতে পার।
আমি তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য আমার ডিরেক্টর ড. মেদিরাত্তার অনুমতি নিলাম। তারপর আমি প্রফেসর ধাওয়ানের ওখানে গেলাম। তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের একটা ছোট্ট রুমে বসেছিলেন। তাঁর চারপাশে প্রচুর বইপত্র। দেওয়ালে একটা ব্লাকবোর্ড। আমি আমার প্রোজেক্টের কাজ সম্বন্ধে আমার সমস্যার কথা বললাম। তিনি আমার কথা শুনে বললেন যে, এটা সত্যি একটা চ্যালেজিং কাজ। আমি যদি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে পরবর্তী ছয় সপ্তাহের প্রতি শনিবারে ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তাঁর ক্লাসে উপস্থিত থাকি তবে তিনি আমাকে ডিজাইন শিখাতে পারেন।
আমি তাঁর ক্লাস করতে শুরু করলাম। আমি দেখতে পেলাম, তিনি একজন কল্পনাপ্রবণ শিক্ষক। তিনি পুরো কোর্সের জন্য সিডিউল প্রস্তুত করে তা ব্ল্যাকবোর্ডে লিখলেন যাতে তাঁর শেখানো বিষয়গুলো আমরা লিখে নিতে পারি। তিনি আমাকে রেফারেন্স ম্যাটিরিয়াল ও বইপত্র দিলেন, যাতে আমি ওইগুলো পড়ে কোর্সে উপস্থিত থাকতে পারি। আমি এটাকে আমার পক্ষে বড়ো ধরনের সুযোগ মনে করে তাঁর সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে লাগলাম। প্রত্যেক ক্লাস শুরুর আগে তিনি আমাকে শক্ত শক্ত প্রশ্ন করে বিষয় সম্বন্ধে আমার বোধগম্যতা যাচাই করতেন। এ থেকে প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম, কীভাবে একজন ভালো শিক্ষক নির্ভুলভাবে পরিকল্পনা করে নিজেকে প্রস্তুত করেন এবং জ্ঞানার্জনের জন্য ছাত্রদেরকে প্রস্তুত করেন। এই ক্লাস পরবর্তী ছয় মাসেও চলল। আমি মূল সত্য বুঝতে পারলাম। পরিশেষে, আমি ডাকটেড কন্ট্রা-রোটোটিং প্রোপেলার ডিজাইন করার সামর্থ্য অর্জন করলাম। প্রোফেসর ধাওয়ান আমাকে বললেন যে আমি প্রোপেলার উন্নয়নের উদ্দেশে একটা হোভারক্রাফ্ট কনফিগারেশনের জন্য প্রস্তুত। তখন আমি উপলব্ধি করলাম যে প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান শুধুমাত্র একজন শিক্ষক নন, তিনি এয়ারোনটিক্যাল সিস্টেমের উন্নয়নের অসাধারণ ডিভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার।
পরবর্তীকালে প্রফেসর ধাওয়ান আমার সঙ্গে উপস্থিত থেকে ডাকটেড কন্ট্রা- রোটোটিং প্রোপেলার সিস্টেমের সংকটপূর্ণ অংশের পরীক্ষা করে সমস্যার সমাধান করে দিলেন। অবিরত ৫০ ঘণ্টা প্রোপেলার পরীক্ষা করার পর সফলতা পাওয়া গেল। প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান নিজে উপস্থিত থেকে এই পরীক্ষা দেখলেন এবং আমাকে তিনি ধন্যবাদ দিলেন। ওই দিনটি ছিল আমার জন্য বিশেষভাবে স্মরণীয় কারণ, আমি ওই দিনটাতেই দেখতে পেলাম হোভারক্রাফটের সব কিছু আমার টিমের ডিজাইন করা। যাইহোক, ওই সময় বুঝতে পারিনি যে একদিন প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান ISRO’র চেয়ারম্যান হবেন এবং আমি কক্ষপথে রোহিনী উপগ্রহ মহাশূন্য পাঠানোর জন্য ডিভেলপমেন্ট অব স্যাটেলাইট লঞ্চ ভিইয়েকল এসএলভি-৩-এর প্রোজেক্ট ডিরেক্টর হিসাবে তাঁর সঙ্গে কাজ করতে পারব।
আমার পেশায় ওইটাই ছিল প্রথম ডিজাইন করা। ভবিষ্যতে অনেক জটিল এয়ারোস্পেস সিস্টেমে কাজ করার আত্মবিশ্বাস অর্জন করলাম। দুজন যাত্রী বহন করে হোভারক্রাফট জমিনের উপর দিয়ে উড়তে পারল। আমি হোভারক্রাফটের প্রথম পাইলট ছিলাম। আমি যানটিকে যে-কোনো ডিরেকশনে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলাম। মোটের উপর আমি জানলাম যে একটা প্রোজেক্টে সদাসর্বদাই সমস্যা দেখা দিতে পারে। আমাদেরকে সমস্যা মোকাবিলা করে তা দূর করা প্রয়োজন, আর তারপরই সফলতা আসবে। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য বড়োসড়ো লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করে যেতে হবে। অবিরত চেষ্টায় সঠিক জ্ঞানের সাহায্যে আমরা সমস্যাগুলো দূর করতে পারি।
আমি সৌভাগ্যবান এ জন্য যে আমার তিনজন গুরু প্রফেসর বিক্রম ভাই সারাভাই, ড. ব্রহ্ম প্রকাশ এবং প্রোফেসর সতীশ ধাওয়ানের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়। ১৯৭৩ সালে আমি প্রধান জাতীয় প্রোজেক্টের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভিইয়েকল এসএলভি-৩-এর উন্নয়ন করার দায়িত্ব পাই। আমি একটা টিম নিয়ে সাত বছরে এই প্রোজেক্টে সাফল্য অর্জন করতে সমর্থ হই। আমরা কেউই এসএলভি-৩ বা এর সাবসিস্টেমকে সম্পূর্ণভাবে জানতাম না। আমরা শিখলাম, স্বপ্ন দেখলাম, পরীক্ষানিরীক্ষা করলাম, ব্যর্থ হলাম, পুনরুদ্ধার করলাম এবং পরিশেষে সফল হলাম। প্রত্যেকেই উদ্ভাবক, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের প্রশ্নকারী। প্রত্যেকেই অন্যদের সাফল্যে আনন্দিত। আমার টিমের সদস্যরা সবাই ভালো ছিল, ছিল তাঁরা উদ্যমশীল। তাঁরা ইসরোতে প্রধান প্রধান দায়িত্ব পালন করেন।
যখন আপনারা কষ্টকর মিশনে থাকবেন, তখন আপনাদেরকে কষ্টকর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। ফলে সাময়িক পশ্চাৎপদতা দেখা দিতে পারে। ব্যর্থতাকে মেনে নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয় যে পর্যন্ত না সফলতা আসে। ব্যর্থতাকে মেনে নেওয়া একটা গুণ, যা থেকে নেতৃত্বের ক্ষমতা অর্জিত হয়। আমার পেশাগত জীবনে এ বিষয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতার কথা আপনাদেরকে বলতে চাই।
প্রফেসর সতীশ ধাওয়ানের কথা মনে পড়লে বহু ঘটনার কথা মনে পড়ে। আমি সেই সব ঘটনা শেয়ার করতে চাই। একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা বলব, যা তরুণ প্রজন্মের কাছে মূল্যবান শিক্ষা হিসাবে বিবেচিত হবে। ১৯৭৯-এর ১০ আগস্ট তারিখে SLV-3-এর প্রথম পরীক্ষামূলক উত্তোলনের আমি প্রোজেক্ট ডিরেক্টর ছিলাম। ভিইয়েকলটি T-o থেকে সুন্দরভাবে উপরে ওঠে এবং প্রথম ধাপে আশানুরূপভাবে কাজ করে। এরপর দ্বিতীয় ধাপের কাজ শুরু হয়, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লক্ষ করলাম ভিইয়েকল প্রচণ্ড গতিতে কাঁপছে এবং ফ্লাইটটি বঙ্গোপসাগরে নিপতিত হলো। সময়টা ছিল সকাল ৮টা। পুরো টিমটি কয়েক দিনরাত কাজ করা সত্ত্বেও তথ্য সংগ্রহ ও ফ্লাইট ব্যর্থ হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলো। ইতিমধ্যে প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান আমাকে একটা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করতে বললেন। প্রেস কনফারেন্সের আগে তিনি আমাকে বললেন যে, তিনি বর্তমান অবস্থাটা মোকাবিলা করতে যাচ্ছেন। আমাকে অনেক সিনিয়র বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের সাথে নিয়ে সেখানে উপস্থিত থাকতে বললেন। প্রেস কনফারেন্স রুম গণমাধ্যমের ব্যক্তিদের দ্বারা পরিপূর্ণ। রুমটাতে হতাশা বিরাজ করছিল। অনেক প্রশ্ন উত্থাপিত হলো। কিছু জোরালো আর সমালোচনামূলক প্রশ্ন তো তার মধ্যে ছিলই। প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান ঘোষণা করলেন, ‘বন্ধুরা, আজ রোহিনী স্যাটেলাইট কক্ষপথে পাঠানোর জন্য আমাদের SLV-3 এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন ছিল। আংশিকভাবে এটা সফল হয়েছে। বহুমাত্রিক প্রযুক্তির সাহয্যে এটা ছিল আমাদের একটা ভিইয়েকলের প্রথম উড্ডয়ন। আমরা এই উড্ডয়নের সাহায্যে অনেক রকমের প্রযুক্তির প্রমাণ করতে পেরেছি। আমাদেরকে আরো অনেক কিছু প্রমাণ করতে হবে। আমরা কাঁপতে থাকলেও ভেঙে পড়িনি। মোটের উপর, আমি উপলব্ধি করলাম আমার টিম সদস্যদেরকে সফলতার জন্য সমস্ত প্রকারের প্রযুক্তিগত সাপোর্ট দিতে হবে।
পরবর্তীতে একটি ব্যর্থতা নিরূপণ বোর্ড ব্যার্থতার কারণ উদ্ঘাটন করুন এবং আমরা দ্বিতীয় উৎক্ষেপণের জন্য তৈরি হলাম।
SLV-3 এর দ্বিতীয় মিশন ১৯৮০ সালের ১৮ জুলাই ঘটানো হলো। সকাল সাড়ে ছয়টা। সারাজাতির মনোযোগ নিবদ্ধ শ্রীকোটা SHAR লঞ্চ কমপ্লেক্সের উপর। এখন ওটার নামকরণ করা হয়েছে সতীশ ধাওয়ানের নামে তাঁকে সম্মান জানানোর উদ্দেশে।
কাউন্ডডাউনের সময় মিশন টিম ব্যস্ত ছিল এবং সতর্কতার সঙ্গে উড্ডয়ন পর্যবেক্ষণ করছিল। T-0 ভিইয়েকল উড্ডয়ন কালে আমরা লক্ষ করছিলাম উড্ডয়নের প্রায় ৬০০ সেকেন্ডের মধ্যে আমি উপলব্ধি করলাম প্রত্যেক ধাপে প্রয়োজনীয় ভেলোসিটিতে চতুর্থ স্টেজে পৌছাল। আমাকে দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হলো, ‘মিশন ডিরেক্টর সমস্ত স্টেশনকে কলিং করছে। SLV-3 সঠিক গতিতে সঠিক উচ্চতায় পৌঁছেছে রোহিনী উপগ্রহকে কক্ষপথে স্থাপন করতে। আমাদের ডাউন রেঞ্জ স্টেশন ও গ্লোবাল স্টেশনগুলো উপগ্রহটিকে এক ঘণ্টার মধ্যে কক্ষপথে স্থাপন করবে।’ আমার ঘোষণা শুনে সমস্ত স্টেশন ও গ্যালারি থেকে বজ্রনিনাদে করতালি শোনা গেল।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ঘটল তারপরই। প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান টিম লিডারদের নিয়ে একটা প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করতে বললেন আমাকে। আমি এখানে দুটো মেসেজের কথা জানাব। প্রথমটি ছিল ব্যর্থতার পর আমাদের মাঝে আত্মবিশ্বাস ও সাহস বেড়ে যাওয়া। আর দ্বিতীয়টি ছিল ব্যর্থতাকে মোকাবিলা করে একজন নেতার ভূমিকায় ছিলেন প্রফেসর সতীশ ধাওয়ান। নেতা সফলতার সুনাম টিম সদস্যদের জ্ঞাপন করলেন। ব্যর্থতার দায় নেতা নিজেদের কাঁধে নিয়ে ব্যর্থতা ও টিম মেম্বারদেরকে রক্ষা করলেন। আমি ওই সময় ব্যর্থতাকে মোকাবিলা করার উপায় কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টেক্সটবুক বা পড়াশোনায় জানিনি।
মিশাইল প্রযুক্তিতে আমার পেশাগত কাজ করার সময়ে একটা স্মরণীয় ঘটনার কথা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই। এটা ছিল পলিও আক্রান্ত শিশুদের জন্য FRO (ফ্লোর রিঅ্যাকশন অর্থোসিস) ক্যালিপার তৈরিতে আমার অভিজ্ঞতা। NEMS এর ওই সময়ের অর্থোপেডিক বিভাগের প্রধান প্রফেসর প্রসাদের অনুরোধে হায়দ্রাবাদের একটি হাসপাতালে আমার সফরকালে আমি দেখতে পেলাম ৪ কেজি ওজনের কৃত্রিম একটা অঙ্গের সাহায্যে অনেক ছেলে-মেয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। আমি অগ্নি মিসাইলের বন্ধুদের বললাম যে পলিও আক্রান্ত রোগীদের জন্য অগ্নিতে ব্যবহৃত FRO এর হিট শিল্ড কম্পোজিট ম্যাটারিয়াল আমরা কেন ব্যবহার করতে পারি না। তারা তাৎক্ষণিকভাবে বলল এটা করা সম্ভব। আমরা এই প্রোজেক্টে কাজ করলাম কয়েকদিন ধরে। FRO এর সাহায্যে শিশুদের জন্য ৪ কেজি ওজনের স্থলে ৪০০ গ্রাম ওজনের বহনযোগ্য কৃত্রিম অঙ্গ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। ডাক্তাররা আমাদেরকে নতুন হালকা FRO শিশুদের শরীরে স্থাপন করতে সাহায্য করলেন। হালকা ওজনের এই কৃত্রিম অঙ্গে ছেলে-মেয়েরা সহজে হাঁটাচলা ও দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল। তাদের শরীরে নতুন ক্যালিপার স্থাপনের সময় ছেলে-মেয়েদের পিতামাতা উপস্থিত ছিলেন। ছেলে-মেয়েদের ব্যথা দূর হওয়ায় এক সময় তারা বাই সাইকেলে চড়তেও লাগল। আমার জীবনে আগে আমি কখনো এমন অভিজ্ঞতা লাভ করিনি।
আমার বিশ্বাস আমার তরুণ বন্ধুরা, আমাদের দেশের এক মিলিয়ন আলোকিত যুবকদের প্রত্যেকেই ভালো কাজ করতে পারে।
এ জন্য, আপনারা যেখানেই থাকেন না কেন, আপনাদের মনে উদ্ভাবন, নতুন নতুন জিনিস আবিষ্কার কিংবা অনাবিষ্কৃত জিনিস আবিষ্কার করার ইচ্ছে থাকতে হবে।
সবসময়ই মনে রাখবে যে আপনার জীবনে এখনকার দিনগুলোই সর্বোত্তম। ডানা গজানোর কথা আপনারা যখন শিখছেন তখন আপনারা উড়াও শিখতে পারবেন। আপনারা আপনাদের জীবনের মূল্যবান দিনগুলো বৃথা নষ্ট করবেন না।
আপনারা যে ক্ষেত্রেই কাজ করেন না কেন বিশেষজ্ঞ হন। আপনারা বড়ো ধরনের চিন্তা করেন, কঠিন পরিশ্রম করে চলেন এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশে কাজ করতে বোঝার চেষ্টা করে যান। বড়োসড়ো বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত এবং পরদুঃখকাতর মন, ভালো শিক্ষক, ভালো বই আর অভ্যন্তরীণ পরিবেশ প্রয়োজন হয় জীবনের উন্নতি সাধন করার উদ্দেশে।
আপনাদের প্রত্যেককে অবশ্য দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে যে, কোনো সমস্যাই আপনাকে পরাজিত করতে পারবেন না। আপনাদেরকে বলতে হবে, আমি সমস্যা সমাধানের ক্যাপ্টেন হবোই, সমস্যাকে পরাজিত করে সাফল্য লাভ করতেই হবে।
আমাদের সবার কাজ করার প্রয়োজন। সমস্যাগুলোকে দূর করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাহয্যে এই গ্রহের পানি, শক্তি, বাসস্থান, আবর্জনা ও পরিবেশের উন্নয়ন করতে হবে।
আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে তরুণ হিসাবে আমাদেরকে বিশ্বাসী হতে হবে, আর বয়স্কদের মতো সন্দেহও থাকতে হবে। তরুণ হিসাবে আপনাকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে এবং বয়স্কদের মতো ভয়ও থাকতে হবে। আমরা আমাদের বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস ও আশা ভরসাকে উন্নত করবই।
(৬ মে ২০১৫ এ কোচিন কলেজ অব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও ভাষণ থেকে।)