১৫. মেধা ও সহমর্মিতা

১৬. শিশু থেকে নেতা

একজন নেতা বলেন,
‘আমি আপনার জন্য কী করতে পারি?’

.

আজ আমি কথা বলতে চাই একজন শিক্ষকের ভূমিকা সম্বন্ধে। আমি সারা বিশ্বের ২০ মিলিয়ন স্কুল ছাত্রছাত্রী ও কয়েক মিলিয়ন শিক্ষকের সঙ্গে মত বিনিময় করেছি। আমি যেখানেই গেছি, তা ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য বা পৃথিবীর যে-কোনো অংশেই হোক না কেন, সব জায়গারই তরুণদের কণ্ঠ অদ্বিতীয়। তাদের ভিশন, স্বপ্ন এবং কাজ করার ইচ্ছে একই। প্রত্যেকেই একটি সমৃদ্ধশালী, সুখী, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ দেশের স্বপ্ন দেখে। সমৃদ্ধি, সুখ ও শান্তি সব সময়ই একত্রে আসে। যখন এই তিনটির একত্র সমাবেশ ঘটে তখনই একটি দেশ সত্যি সত্যি একটি উন্নত দেশে পরিণত হয়।

ছেলে-মেয়েরা বারো বছর ২৫,০০০ ঘণ্টা প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাটায়। শিক্ষকদের মহানুভবতা আর অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থীদের কাছে রোল মডেল হিসাবে কাজ করে। স্কুলে ছাত্রছাত্রীদেরকে গড়ে তোলার বিষয়ে আমি আলোচনা করব।

আমরা সবাই শৈশব থেকে পেশাগত কাজে নিয়োজিত হওয়া পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। অনুগ্রহ করে একটি দৃশ্য দেখার চেষ্টা করি একটি শিশু, একটি বয়ঃসন্ধিক্ষণের ছেলে বা মেয়ে, একজন বয়স্ক মানুষ ও একজন নেতার প্রতি দৃষ্টিপাত করা যাক। কীভাবে তাদের প্রত্যেকে নির্দিষ্ট অবস্থান থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে? শিশুটি বলে, ‘আমি আমার জন্য কী করতে পারি?’

বয়ঃসন্ধিক্ষণের ছেলে বা মেয়ে বলে, ‘আমি একা থাকতে চাই।’ তরুণ ব্যক্তি ঘোষণা করে, ‘আসুন আমরা একত্রে কাজ করি।’ নেতা জানায়, ‘আপনাদের জন্য আমি কি কাজ করতে পারি?’

একজন মানুষকে শিশু থেকে নেতাতে পরিণত করার দায়দায়িত্ব শিক্ষকদের উপর বর্তায়। তাদের পরিবর্তিত করার দায়দায়িত্ব শিক্ষকদের। একজন শিক্ষকের হতে হবে কল্পনাপ্রবণ এবং অনুপ্রেরণা দাতা। শিশুদেরকে সর্বোত্তম করে গড়ে তোলা নির্ভর করে শিক্ষকদের সমন্বিত কাজের উপর।

দক্ষিণ ভারতের সেন্ট জোসেফ কলেজের তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটি দৃশ্য দেখার সুযোগ আমার ঘটেছিল। একটি চমৎকার, স্বর্গীয় দর্শন ব্যক্তিত্ব কলেজ চত্বরে হাঁটাহাঁটি করতেন।। প্রত্যেকদিন সকালে বি.এসসি (অনার্স) ও এম.এ. (গণিত) এর ছাত্রছাত্রীদের তিনি শিক্ষাদান করতেন। তরুণ শিক্ষার্থীরা তাঁকে তাকিয়ে দেখত শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে। সকলের দৃষ্টিতে তিনি একজন মহান ব্যক্তিত্বের প্রতীক ছিলেন। তিনি যখন হাঁটতেন তখন চারপাশে জ্ঞান বিকিরণ করতেন। এই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন মহান শিক্ষক প্রফেসর থোথাত্রি আয়ার। ওই সময় ক্যালকুলাস শ্রীনিবাসন ছিলেন আমার অংকের শিক্ষক। ক্যালকুলাস শ্রীনিবাসন প্রফেসর থোথাত্রি আয়ারের সঙ্গে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে কথা বলতেন। ওই সমস্ত দিনগুলোতে তিনি ও প্রফেসর আয়ার সমন্বয় করে ক্লাস নিতেন। প্রফেসর আয়ার বি.এসসি (অনার্স) ও বি.এসসি (পদার্থবিজ্ঞান) ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস নিতেন। তাঁর ক্লাসগুলোতে উপস্থিত থাকার সুযোগ আমার হয়েছিল। বিশেষ করে মডার্ন এলজেব্রা, স্ট্যাটিসটিকস আমি তাঁর ক্লাস থেকে শিখেছিলাম। যখন আমরা বি.এসসি ফার্স্ট ইয়ারে, তখন সেন্ট জোসেফের ম্যাথেমেটিকস ক্লাবের জন্য ক্যালকুলাস শ্রীনিবাসন দশজন ছাত্রকে নির্বাচন করেন। সেখানে প্রফেসর আয়ার লেকচার সিরিজে বক্তব্য রাখতেন। ১৯৫২ সালের একদিনের কথা আমার এখনো মনে আছে, তিনি এক ঘণ্টা ধরে ভারতের তিনজন প্রাচীন গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীর পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরেন। তার সেই লেকচার এখনো আমার কানে বাজে।

দেশের গর্বকে আমি উপস্থাপন করলাম: জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতে আর্যভট্ট, ভাস্কর ও রামানুজম পৃথিবীকে দান করেছিলেন জিরো, পৃথিবী সূর্যের চারদিকের কক্ষপথে ঘোরার সময় গণনা করেন ও সংখ্যাতত্ত্বের নানা ধরনের আবিষ্কার করেন। এই সমস্ত ঘটনাবলি ও জ্ঞান আমার শিক্ষা, আশা ও মূল্যবোধ পদ্ধতি শিক্ষণের ভিত্তি ছিল। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা আমাকে কয়েক দশক সামনে এগিয়ে দেয়। আমি আত্মবিশ্বাসী যে আজকের দিনেও এ ধরনের শিক্ষক পেশায় আছেন। শিক্ষার পরিবেশে শিক্ষকদের জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন, কী ধরনের মানুষ আমাদের জন্য জরুরি? কী ধরনের সামর্থ্য আমাদের আছে যা আমরা শিশুদের দিতে পারি? আমরা আমাদের শিশুদের শিক্ষা দিতে চাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দেশ গঠনে অবদান রাখার জন্য সামর্থ্য যোগাতে। কেমন করে এটা অর্জিত হবে? যুগপৎ ঘটমান উন্নয়নের জন্য পাঁচটি ক্ষেত্র আছে: আর্থিক বিনিয়োগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সংকটপূর্ণ প্রযুক্তিতে আত্মনির্ভরতা।

উপরের মিশনকে অর্জন করতে হলে স্কুল ও ছাত্রছাত্রীদের নিম্নবর্ণিত যোগ্যতা প্রয়োজন।

  • গবেষণা ও অনুসন্ধানের সামর্থ্য
  • সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের সামর্থ্য, বিশেষ করে জ্ঞানের সৃজনশীলতার স্থান পরিবর্তন
  • উচ্চপ্রযুক্তি ব্যবহারের সামর্থ্য
  • ব্যবসায়ে উৎসাহী নেতৃত্ব অর্জনের সামর্থ্য
  • নৈতিক নেতৃত্বের সামর্থ্য

যতদূর আমরা দেখেছি তাতে পৃথিবীতে দুটো দিকদর্শন আছে। প্রথমটি হচ্ছে মানবজাতি বিষয়ক ক্রমবিকাশ। অন্যটি হচ্ছে মানুষের দ্বারা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা। প্রাকৃতিক দৃশ্যমান চিত্রপটের বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, ভূমিকম্পের কথা। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবিলা করতে হয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি রিসার্চ-এডুকেশন-রিসার্চের অনুষঙ্গকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদেরকে সময় ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হয়। সামাজিক উন্নয়নের জন্য রিসার্চ ওয়ার্কের উপরও জোর দিতে হয়। আমাদের দেশে অনেক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আছে। আমরা জানি সেই কলেজগুলোতে সিট খালি থাকে। আমরা আরো শুনেছি যে ছাত্রছাত্রীরা কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়ে চাকরি পায় না। চাকরিদাতা সংস্থাগুলো বারবারই বলে থাকে যে, তারা যে শিক্ষালাভ করেছে তা চাকরির যোগ্যতা হিসাবে যথেষ্ট নয়। দক্ষতার উন্নয়ন দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। আমরা শুনে থাকি। আমরা শুনতে পাই গ্রাম ও শহরে যথোপযুক্ত দক্ষ লোক আমরা পাচ্ছি না। সুতরাং এটা একটি বাস্তব অবস্থা। যখন দেশে বিপুল সংখ্যক দক্ষ প্রকৌশলী প্রয়োজন, তখন বাস্তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে আসা প্রকৌশলীরা অনেকক্ষেত্রে চাকরিদাতাদের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। পৃথিবীর মধ্যে ভারতের আছে বৃহত্তম তারুণ্যের শক্তি। অপরপক্ষে, ভারতের প্রয়োজন বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত জনশক্তি। আমাদের কাজ করার মতো দুটো দিক আছে। একটি হচ্ছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষ মানুষ। আমাদের পর্যালোচনা করা প্রয়োজন কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে কী কী ধরনের দক্ষতার দরকার। এ বিষয়ে পেশাজীবীরা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। গ্লোবাল লেভেলে ছাত্রদেরকে কোন্ কোন্ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে তা নিরূপণ করা। আমাদের আলোকপাতও করার প্রয়োজন তরুণদেরকে ব্যবসা উদ্যোগী হওয়ার জন্য যাতে তারা চাকরি খোঁজার পরিবর্তে নিজেদেরকে চাকরি দাতা হিসাবে গড়ে তুলতে পারে। সংক্ষেপে বলতে হয়, শিক্ষার কৌশল হতে হবে সমাজ সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দক্ষতা শিক্ষাদান। বর্তমানে প্রযুক্তির অগ্রগতি, গবেষণায় শ্রীবৃদ্ধি ও দক্ষতা সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি ও কম্যুনিকেশন স্কিল মজবুত করা। যদি প্রিন্সিপাল, শিক্ষক, পিতামাতা একজন ছাত্র বা ছাত্রীকে সমস্ত রকমের অর্জনের সঙ্গে যুক্ত করা যায় তবে সেই ছেলে বা মেয়ের মধ্যে জলজ্যান্ত একটি আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠবে। সে অন্যদের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে। সত্যিকারের একজন শিক্ষার্থী শুধুই ক্লাসরুম থেকে শিক্ষা গ্ৰহণ করে না, পরিবেশ থেকেও শিক্ষা নেয়। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে শিক্ষকদের মিশন সঠিকভাবে সত্যিকারে শিক্ষার্থীদেরকে চালিত করে থাকে।

কী ধরনের স্কুল সত্যিকারের শিক্ষার্থীদের সৃষ্টি করতে পারে?

তথ্য অর্জন করার সর্বশেষ প্রযুক্তি অনুসন্ধান বা গবেষণার মাধ্যমে শিক্ষণ, যা গুরুত্বপূর্ণ।

স্কুলগুলোতে ছাত্ররা নিজেরা শিক্ষালাভ করবে এবং অন্যান্য ছাত্রদেরকে শেখাবে। এভাবেই সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটানো উচিত হবে। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার দ্বারা উপলব্ধি করা যায় আমাদের শিক্ষা কতটা অন্যদের উপকারে আসছে। আমি কেমন অবদান রাখতে পারি আমার নিজের উন্নয়নের জন্য। একই সঙ্গে অন্যের ও দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে নৈতিক উন্নয়ন, দলগত কাজের মূল্যায়ন, সহযোগিতা, কঠিন পরিশ্রম ইত্যাদির উপর জোর দেওয়া উচিত।

বন্ধুগণ, আমিও একজন শিক্ষক। আমি শিক্ষক ও ছাত্রদের সঙ্গে কাজ করি। মহান শিক্ষকদের উপর ভিত্তি করে আমি শিক্ষকদের মিশনের উপরে কিছু চিন্তাভাবনা শেয়ার করতে পছন্দ করি। শিক্ষকের কাজ হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদেরকে সৃজনশীল ও শ্রেষ্ঠত্বে পরিবর্তিত করা। শিক্ষকদের শ্রেণিতে গড়পড়তা ছাত্রছাত্রী বলে কেউ নেই। প্রত্যেক ছাত্রই শীর্ষে পৌছাতে পারে। শিক্ষকের মহান জীবনই ছাত্রছাত্রীদের কাছে একটি বার্তা।

(৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ এ বাহরাইনের ইন্ডিয়ান স্কুলে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় ও ভাষণ থেকে।)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *