নসু দৌড়ায়া আইসা বলল, মা ওমা, আতাহার কাকায় আইছে। আতাহার কাকায়।
দুইদিন ধইরা নূরির জ্বর। সকালের দিকে জ্বরটা থাকে না, দুপুরের পর থেকে আসে। আজও তাই হইছে। পারু আর শিরি তার মাথায় পানি দিচ্ছে। দুপুরে শিংমাছের ঝোল দিয়া অল্প একটু ভাত খাইছিল নূরি। তাও খাইতে চায় না। ঘ্যানঘ্যান করে। জ্বউরা (জ্বরের) মুখে খাইতে ভাল্লাগছিল না মাইয়াটার। দুই-তিনবার উটকি পারছে। উকাল কইরা ফালায় কিনা এই ডরে তারে আর ভাত খাওয়ানের চেষ্টা করে নাই পারু।
মান্নান মাওলানার বাড়ি থেকে চইলা আসার পর থেকে শিরি যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, পারুর লগে লগে থাকে। শিরি আর নসুরে স্বর্ণগ্রাম হাইস্কুলে ভরতি করে দেওয়া হইছে। একজন ক্লাস ফোরে আরেকজন ক্লাস টুতে। স্কুল যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ছাড়া বাকি সময় পারুর লগে লগেই আছে শিরি। নূরি আছে বাড়ির পোলাপানের লগে।
পারু বাপের বাড়িতে আসছিল পয়সা থেকে তার মাজারো বইন নাহাররে নিয়া। নাহারের জামাইবাড়িতে ছিল পাঁচদিন। সেই পাঁচদিনে বিবাহিত জীবনের সব কথাই বোনকে সে খুইলা বলছিল। নাহার তো কিছুটা জানতই, যা না জানত পারু তা সবই বলছে। শেষ তরি শাশুড়িরে মুখ ফুইটা বলা, আতাহারের লগে বিয়ার কথাবার্তা, মান্নান মাওলানা আর আতাহারের বেইমানি, শাশুড়ির মৃত্যু, তারপর সবকথা কীভাবে তার কানে আসল সব নাহারকে সে বলল। পোলাপান লইয়া না খাইয়া মইরা গেলেও আর কোনওদিন ওই বাড়িতে ফিরত যাইবো না তাও সাফ সাফ বলল।
নাহাররে নিয়া বাপের বাড়িতে আসার পরও ওই একই কথা বাপ-মা’রে বলছে পারু। ভাই রফু কামরুল একদম ছোট মিজু বাড়িতে ছিল, তাদেরও বলছে। খবর পাইয়া ছোটবোন গোলাপি তার জামাই নিয়া আসছে নূরপুর থেকে। নাহারের লগে আসছিল নাহারের জামাই। হাকিম আর তাদের দুই পোলা মাইয়া। রাজা আর বইচি।
পারু এই বাড়ির সাইজ্জা মাইয়া। আদরের মাইয়া। খুবই নরম কোমল মাইয়া। ভাল মনের মাইয়া। সে আইসা যখন বেবাক কথা বলল, শুইনা বাড়ির লোকে বলল কঠিন দুঃখ না পাইলে এইভাবে মাইয়া চইলা আসে নাই। জামাই মইরা যাওনের পরও যেই মাইয়া বাপের বাড়িতে আসার কথা ভাবে নাই, সে কোন দুঃখে এতদিন পর আসছে, আর ফিরত যাবে না বলছে, সেই ব্যাপারটা সবাই বুঝছে। এই নিয়া কেউ কোনও কথা প্রথম কয়েকদিন বলে নাই। তারপর একদিন বলছে। বলছে পারুর বাপ আফাজউদ্দিন। ঠিক আছে। পারুর আর ফিরত যাওনের কাম নাই। সে এই বাড়িতেই থাকবো। পোলাপান মানুষ করার দায়িত্ব পারুর বাপ যতদিন আছে ততদিন তার, তিনি মারা যাওয়ার পর দায়িত্ব নিবে ভাইরা। বোনরা যে যতটা পারে সাহায্য করবে।
পারুর মাজারো ভাই কামরুল অবশ্য জাগাসম্পত্তির কথা তুলছিল। শিরি নসুরা তার বাপের সম্পত্তি থেকে কেন বঞ্চিত হবে? পারু ওই বাড়িতে আর যাউক না যাউক দরকার হইলে আমরা যাই। মান্নান মাওলানার লগে কথাবার্তি কইয়া টেকাপয়সা কিছু আদায় করি।
পারু কঠিন গলায় বলেছে, না, ওই পাপের সম্পিত্তি আমি আমার পোলাপানরে খাইতে দিমু না। ওই বাড়ির লগে যে আমগো কোনও সম্পর্ক আছে ওইডাই আমি আর স্বীকার করুম না।
পারুর বাপ মা ভাই বইনরা, সবাই পারুর মনোভাবটা বুঝতে পারছিল। শেষ তরি তারা বেবাকতে একসময় বলছে, না ঠিক আছে। অর মন যখন এমতে উইঠা গেছে ঐ বাড়ির উপরে থিকা তয় অরে আর জোর করনের কাম নাই। ও এই বাড়িতেই থাকবো।
উঠানের উত্তর দিকে মাঝারি সাইজের একটা পাটাতন ঘর। সেই ঘরটা খালিই পইড়া থাকে। পারুকে সেই ঘর দেওয়া হল। তিন পোলাপান নিয়া সেই ঘরে থাকে সে। রান্নাবান্না বাড়ির কাজ মায়ের লগে সবই করে। শিরি নসুরে স্কুলেও ভরতি করা হইছে। এর মধ্যে আতাহারের বিয়ার খবরও পাইছে। দাওয়াত দিতে মদিনার জামাইরে এই বাড়িতে পাঠাইছিলেন মান্নান মাওলানা। আত্মীয় মানুষ। সমাদর যেটুকু করার তাকে করা হইছে, তবে বিয়াতে কেউ যায় নাই।
যেই বাড়িতে একদিন জন্মাইছিল পারু, বড় হইছিল, বিয়ার পর যেই বাড়ি ছাইড়া একদিন চইলা গেছিল, সেই বাড়িতে ফিরা আইসা আবার নতুন কইরা জীবন শুরু করল। আগে ছিল একা, এখন তার লগে আছে তিনটা পোলাপান। মাঝখানকার জীবনটা আনন্দময়ই ছিল। শেষ তরি সেই জীবন হইয়া গেল দুঃখের জীবন। বেদনা আর কষ্টের জীবন। নিজের ওপর আর দুইজন মানুষের ওপর ঘৃণার জীবন।
তবু বাপের বাড়িতে জীবনটা নিজের মতন কইরা গুছাইতে শুরু করছে পারু। এই সময় এক বিকালে আসল দুইজন ঘৃণিত মানুষের একজন। আতাহার। দুই গুয়ের পোকের একটা।
নসুর মুখে আতাহারের কথা শুইনা মেয়ের মাথায় বদনার নল দিয়া পানি ঢালতে থাকা হাত থাইমা গেল পারুর। সে বালতি থেকে বদনা ভইরা পানি তুইলা নল দিয়া ঢালতাছিল আর শিরি বোনের মাথার তালুতে হাত বুলায়া পানিটা যাতে চুলের গোড়ায় গোড়ায় লাগে সেই চেষ্টা করছিল। আতাহারের কথা শুইনা পারুর মতন তার হাতও থাইমা গেল। জ্বরের ঘোরে চোখ বুইজা আছে নূরি। সে চোখ খুলল। কে আইছে মা?
পারু গম্ভীর গলায় বলল, কেঐ না। তুই চুপ কইরা থাক।
নসুরে বলল, কলিমরে গিয়া ক, আর বাবায় বাইত্তে আছে তারে গিয়া করা যাওনের সময় দুয়ার টাইন্না দিয়া যা। আমরা যে এই ঘরে আছি এইডা য্যান হেয় না জানে।
পারুর ব্যবহারে নসুর উত্তেজনা একদম পানি হইয়া গেছে। ঠান্ডা গলায় সে বলল, আইচ্ছা।
তারপর ঘর থেকে বাইর হইয়া, দুয়ারের কপাট টাইনা দিয়া নানা নানির ঘরের দিকে যাবে, পারু বলল, নসু, খাড়া।
নসু দাঁড়াল। তর নানিরে এই ঘরে আইতে ক। সে ছাড়া আর য্যান কেঐ এই ঘরে না ঢোকে। আর তুই এমুন ভাবে চলাফিরা করবি সে য্যান তরে না দেহে, তুই য্যান তারে না দেহচ।
নসু আবার বলল, আইচ্ছা।
কিছুক্ষণ পর পারুর মা রাবেয়া খাতুন আইসা ঢুকলেন এই ঘরে। নূরির মাথায় পানি দেওয়া শেষ কইরা গামছা দিয়া তার মাথা ভাল মতন মুছাইয়া দিছে পারু। জ্বর এখনও আছে নূরির। দিঘিরপার বাজারের গোবিন্দ ডাক্তার গতকাইল আইসা দেইখা গেছে। একটা মাত্র ট্যাবলেট দিছে। তিনবেলা সেই ট্যাবলেট আর কুনসুম কুনসুম গরম পানিতে তোয়াইলা ভিজাইয়া শরীর মোছায়া দিতে বলছে, মাথায় পানি দিতে বলছে। খাওয়াদাওয়ার কোনও বাছবিচার নাই, যা খাইতে চায় মাইয়ায় তাই খাইতে পারব। এই জ্বর তিনদিন থাকবো। সেই হিসাবে কাইল জ্বর আর আসব না। পরশু থেকে আল্লার রহমতে সুস্থ হয়ে যাবে মাইয়া।
এই ঘরে পুরানা আমলের খাট। সেই খাটে নূরির মাথার কাছে বইসা আছে পারু। তার একপাশে শিরি। দুইজনের মুখই গম্ভীর। পারুর মা আইসা ঘরে ঢোকার পর পারু বলল, মা, তোমারে সোজা দুই একখান কথা কই। ও ক্যান এই বাইত্তে আইছে আমি বুজছি। আইছে আমার লগে কথা কইতে। আমি অর লগে কথা কমু না, আমার মুখও ওরে দেহামু না। তোমরা যা করনের এইডা মনে কইরা করবা। তোমগো উচিত অরে অহনঐ বাইত থিকা বাইর কইরা দেওয়া। তয় সেইটা পারবা না। অরা তোমগো আত্মীয়। ঠিক আছে আত্মীয়র লগে যা ব্যবহার করনের করবা, খালি আমার কথা মনে রাখবা। আমি যা কইলাম আমার ব্যাপারে ওইটাই হইবো। আমি অর লগে কথা কমু না, অর মুখ দেখুম না।
মা বললেন, এতদূর থিকা কষ্ট কইরা আইছে। কী মনে কইরা আইছে হেইডা হোন। কথা কইতে দোষ কী!
পারু কঠিন চোখে মায়ের মুখের দিকে তাকাল। সব জাইনা শুইনাও তুমি আমারে কও অর লগে কথা কইতে, অর মুখ দেখতে? তোমগো ঘিন্নাপিত্তি কিছু নাই, নাকি! ও তো মানুষ না। ও তো একহান গুয়ের পোক। ও এক পোক অর বাপে আরেক পোক। তোমগো তো উচিত অরে অহনঐ পিছা দিয়া পিডাইয়া বাড়িত থিকা বাইর কইরা দেওন। আমি জানি। সেইটা সম্ভব না। তোমরা পারবা না। তয় আমি যেইডা কইলাম, ওইডা মনে রাইখো। আমি দুয়ার আটকাইয়া এই ঘরে বইয়া রইলাম।
শিরির দিকে তাকাল পারু। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই শিরি বলল, আমিও তোমার লগে এই ঘরে দুয়ার বন্দ কইরা বইয়া থাকুম। আমিও চাই না সে আমারে দেখুক, আমার লগে কথা কউক।
মেয়ের কথা শুইনা পারু অবাক। কচ কী?
ঠিকঐ কই। যে আমার মা’র লগে বেইমানি করছে, অমুন শয়তান বদমাইশের মুখ আমি দেহি না। তুমি নসুরে না করলা আর আমারে কিছু কইলা না দেইখা আমিঐ আমার কথা কইলাম।
মেয়ের কথায় মনটা ভাল লাগল পারুর।
নানির দিকে তাকাল শিরি। তুমি যাও নানি। আমি দুয়ার লাগামু।
পারুর মা চিন্তিত মুখে দরজার দিকে আগায়া গেলেন।
এখন বাড়িতে লোকজন কম। আফাজউদ্দিন আছেন। তাঁর বয়স হয়েছে। এখন আর ছেলেদের সঙ্গে কায়কারবার করেন না। ছেলেরাও বরিশাল পটুয়াখালির ওই নৌকায় কইরা হাটে হাটে গিয়া কাটা কাপড় বিক্রির কাজ করে না। ঢাকার সদরঘাটে থান কাপড়ের দোকান দিছে রফু আর কামরুল, কামু। দুই ভাইয়ের আলাদা দোকান। তারা ঢাকায়ই বাসাবাড়ি নিয়া থাকে। দুইজনই বিয়াশাদি করছে। ছোট মিজু সাত বছর ছিল সৌদি আরবে। ফিরা আইসা সেও ভাইদের লগে নতুন একটা থান কাপড়ের দোকান করছে। ঢাকায় তিনভাই এক বাসায় থাকে। পারুর খবর পাইয়া সবাই বাড়িতে আসছিল। দুই চাইরদিন থাইকা, সবাই মিলা পারুর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়া যে যার মতন ফিরা গেছে। তবে পারুর দায়িত্ব যে সব ভাইবোনের, পারুর ছেলেমেয়েদের দায়িত্বও যে তারা নিজেদের পোলাপানের মতনই পালন করব, মাসে মাসে কোন ভাই কত টাকা দিবে পারুরে, বড়বোন মোরশেদা দিব কত সব ঠিকঠাক কইরা, পারুরে অনেক সাহস ভরসা দিয়া গেছে তারা। ভরসা মতন মাসকাবারি টাকাপয়সা সব ঠিকঠাক মতনই দিচ্ছে। টাকাপয়সা পারুর হাতে পুরাটাই জমছে। তার তো আসলে কোনও খরচা নাই। খাওয়াদাওয়া সবই তো বাবার সংসারে। আছে সে ভালই।
এই ভাল অবস্থায় ও গুয়ের পোকটা আইসা ক্যান হাজির হইল?
শিরি ততক্ষণে দুয়ার আটকাইয়া দিছে। মাথায় পানি দেওয়ার ফলে নূরি একটু আরাম পাইছে। জ্বরের তাপ কমের দিকে। দুপুরে খাওয়ার পর ট্যাবলেট খাইছে। এখন চোখ বুজে পইড়া আছে মেয়েটা। মা বোন দুইজন দুইপাশে বইসা আছে।
ঘরের দরজা জানালা বন্ধের ফলে আবছা অন্ধকারে ভরে আছে ঘর। পারু আর শিরি গম্ভীর মুখে খাটে পা ঝুলাইয়া বইসা রইল।
.
আতাহারকে বাংলাঘরে বসানো হয়েছে। বাড়ির পুরানা কাজের লোক কলিম তারে বসাইছে। নসু সেই যে দৌড়াইয়া আইসা পারুরে খবরটা দিছিল তারপর সে জানি কোনদিকে উধাও হইয়া গেছে। মনে হয় হাওলাদার বাড়ির পোলাপানের লগে মাঠে খেলতে চইলা গেছে। আতাহাররে দেইখা যতটা উত্তেজিত হইছিল, পারুর কথাবার্তা শুইনা আতাহারের ব্যাপারে আর কোনও উৎসাহ দেখায় নাই। নিজের কাজে চইলা গেছে।
আতাহারের চেহারা উদভ্রান্তের মতন। জিনস টি-শার্ট কেডস পরা, কাঁধে কালো রঙের ব্যাগ। হালকা হলুদ রঙের টি-শার্ট আর জিন্স কেডস ধুলায় ভরে আছে। মুখে কয়েকদিনের দাড়িমোচ। বাংলাঘরে ঢুইকা কাঁধের ব্যাগ খাটের ওপর রাখল, তারপর একটা চেয়ারে বসে ক্লান্তির শ্বাস ফেলল।
কলিম বলল, ব্যাগে লুঙ্গিমুঙ্গি আছে, নাকি দিমু?
না না আছে।
তয় জামাকাপড় ছাড়েন। ছাইড়া চাপকলতলায় গিয়া ভাল কইরা হাতমুখ ধোন।
ধুইতাছি, ধুইতাছি। ইট্টু জিরাইয়া লই।
আইলেন কই থিকা? ঢাকা থিকানি?
আরে না, মেদিনমণ্ডল থিকা।
এতদূর থিকা কেমতে আইলেন?
বিক্রমপুরের ভিতরে ভিতরে দিয়া ম্যালা রাস্তা হইছে। কোনও কোনও রাস্তায় রিকশা পাওয়া যায়। কোনও কোনও রাস্তায় হাঁটতে হয়। আমি কোনাকুনি আইছি, চক পাড়ি দিয়া।
তয় তো হাঁটতে হইছে ম্যালা?
হ। হাঁইটাই আইছি বেশির ভাগ রাস্তা।
তারপর আফাজউদ্দিন সাহেব আসলেন বাংলাঘরে। তার পরনে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদার ওপর হালকা সবুজ ডোরাকাটা পরিষ্কার লুঙ্গি। মুখের দাড়ি সবই পাকা। মাথায় টুপি আছে।
গম্ভীর গলায় বললেন, কী সংবাদ আতাহার? হঠাৎ আমগো বাড়িতে?
আতাহার বিনীত ভঙ্গিতে তাঁর পায়ে হাত দিয়া কদমবুসি করল। আসলাম ইকটু দরকারে। আপনেরা ভাল আছেন তালুইসাব?
হ আছি। ভালই আছি। তয় তুমি জামাকাপড় বদলাও, এই ফাঁকে আমিও আছরের নামাজটা পড়ি তারবাদে কথা কমু নে।
জি আইচ্ছা।
আধাঘণ্টাখানিক পর আফাজউদ্দিন আর পারুর মা রাবেয়া খাতুন আইসা বাংলাঘরে ঢুকলেন। ততক্ষণে জামাকাপড় বদলাইয়া হাতমুখ ধুইয়া, নাস্তাপানি খাওয়া শেষ করছে আতাহার। এই ফাঁকে তাকে খাঁটি গাওয়া ঘি দিয়া পরোটা আর সুজির হালুয়া বানাইয়া দিছে কাজের ঝি মরিয়ম। এককাপ চা বানাইয়া দিছে। আফাজউদ্দিন আর রাবেয়া আইসা যখন ঢুকলেন আতাহার তখন চা প্রায় শেষ করেছে। এখন সিগ্রেট ধরাবার তালে ছিল। তালুই মাএঁকে দেইখা সিগ্রেটের আশা বাদ দিল। চায়ের কাপ নামাইয়া বিনয়ী ভঙ্গিতে মাথা নিচা করল।
এই ঘরে একটা খাট আছে। খাটে সব সময়ই তোশকের ওপর সুন্দর চাদর বিছানো। জোড়া বালিশ আছে সুন্দর গিলাপ দেওয়া। টিনের বেড়ায় সুতার কাজ করা সুন্দর সুন্দর ছবি। একটা হরিণের ছবির তলায় সুতার বেঁকা বেঁকা হরফে লেখা ‘সোনার হরিণ কোন বনেতে থাকো। একটা টেবিল আছে ঘরে। গোটা চারেক চেয়ার আছে। একটা চেয়ারে বইসা টেবিলের ওপর খাবার রাইখা খাইতেছিল আতাহার। খালি চায়ের কাপ সেই টেবিলেই রাখল।
আফাজউদ্দিন বললেন, এইবার বলো দেখি কী মনে কইরা আইছো?
আতাহার মাথা নিচা কইরা বলল, ভাবিরে লইয়া যাইতে আইছি।
কই?
আমগো বাড়িতে।
রাবেয়া গম্ভীর গলায় বললেন, কীর লেইগা?
সে আমার বড়ভাইর বউ। আমার ভাবি। পোলাপান তিনটা আমার ভাইস্তা ভাস্তি। আমগো জাগাসম্পত্তির অংশীদার অরাও। ভাই মইরা গেছে, অগো ভরণপোষণের দায়িত্ব তো আমগো। এর লেইগা আমি…
আফাজউদ্দিন বললেন, অর্থহীন কথা।
আতাহার তার দিকে তাকালো। জে?
পারু এই বাড়িতে আইছে শাওন মাসে। তারবাদে অনেক ঘটনা ঘইটা গেছে তোমগো বাড়িতে। তোমার বিয়াশাদি…। যাউকগা, এত কথা আমি তোমারে বলতে চাই না। তোমার বিয়ার সময় মদিনার জামাই আইছিল দাওয়াত দিতে, তারে আমরা পরিষ্কার বইলা দিছি, পারু নিজেও বলছে সে আর কোনওদিন তোমগো বাড়িতে ফিরত যাইবো না। ওই জাগাসম্পত্তি অর পোলাপান কোনওদিন দাবি করবো না। পারুর জীবনে মেদিনমণ্ডল গ্রামের কোনও কিছু আর নাই।
রাবেয়া বললেন, এই যে এতগুলি দিন গেল, তুমি কোনওদিন আইলা না ক্যা? আইয়া কইলা না ক্যা পারুরে তুমি লইয়া যাইতে চাও? আর ঘটনা তো তোমারে কওনের কিছু নাই। বেবাক ঘটনা তো আসলে তোমারে লইয়াঐ। আমার মাইয়ার লগে এই বেইমানিডা তুমি ক্যান করছো? এতকিছু কইরা কোন মুখে তুমি আইজ আমগো বাড়িতে আইছো? কোন মুখে এই হগল কথা কইতাছো? সব শেষ কইরা আইজ এতদিন বাদে পুরানা ঘায়ে নুন ছিডাইতে আইছো? আমার মাইয়া কোনওদিন তোমগো বাড়িতে যাইবো না। তোমগো পরিচয়ও কোনওদিন দিবো না। ওই দিককার সবকিছু সে শেষ কইরা দিছে। সে এখন নতুন কইরা পোলাপান লইয়া সংসার গুছাইছে। আমার ছেলেমেয়েরা তাগো বইনরে দেখবো। এমুন কথাও পারুর ভাইবইনরা পারুরে কইছে, দরকার হইলে তাগো যার যার ভাগের সম্পত্তি সব তারা পারুরে, পারুর পোলাপানরে দিয়া দিবো। পারুর কোনও অভাব থাকবো না। পোলাপান তিনডারে লেখাপড়া শিখাইয়া মানুষ করুম আমরা। অগো লইয়া তোমগো আর চিন্তা করনের কাম নাই।
আতাহার মাথা নিচা কইরা রইল।
আফাজউদ্দিন বললেন, তোমারে কি তোমার বাপে পাঠাইছে না তুমি নিজে থিকাই আইছো?
আমি নিজে থিকাই আইছি। বাবায় জানে না যে আমি বেসনাল আইছি।
আর তোমার বউ?
সেও জানে না।
এই আসনডা তোমার ঠিক হয় নাই।
রাবেয়া বললেন, পারুর দিক ছাড়াও তোমরা আমগো দূর সম্পর্কের আত্মীয়। আত্মীয় বাড়িতে আত্মীয় আইতেই পারে। আইছো যহন থাকো আইজকার রাইত। খাওয়াদাওয়া করো। কাইল চইলা যাইয়ো।
আতাহার মাথা নিচা কইরাই বলল, আমি ইকটু পারুর লগে দেখা করতে চাই। কথা কইতে চাই।
পারু তোমার লগে দেখা করবো না, কথা কইবো না।
আতাহার ছেলেমানুষের মতন গোঁয়ার গলায় বলল, আমি তার লগে দেখা না কইরা, কথা না কইয়া এই বাড়ি থিকা যামু না।
আফাজউদ্দিন বললেন, এইসব কইয়ো না। পারু বহুত নরম মাইয়া। তয় একবার যুদি কোনও জিদ ধরে ওই জিদ কেউ ভাঙতে পারবো না। তুমি যত চেষ্টাই করো, পারু তোমার লগে দেখা করবো না, কথা কইবো না।
তয় আমি এই বাড়ি থিকা যামুও না। তার লগে আমার দেখা করতেই হইব, কথা কইতেই হইব।
রাবেয়া আফাজউদ্দিনের দিকে তাকালেন। এইডা কেমুন কথা? একজন মানুষ তোমার লগে দেখা করবো না, কথা বলবো না, তাও তুমি জোর করতাছো? এইডা তো কোনও কথা হইল না।
আতাহার হঠাৎ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, তারপর নিচা হয়ে বইসা দুই হাতে আফাজউদ্দিনের পা প্যাচাইয়া ধরল। আমি আপনের পায়ে ধরি। পারুর লগে আমি খালি ইকটু দেখা করুম, দুই-চাইরটা কথা তার লগে কমু। তারপর আর এক মিনিট এই বাড়িতে
আমি থাকুম না। লগে লগে চইলা যামু।
আফাজউদ্দিনের পা ছাইড়া রাবেয়ার পা প্যাচাইয়া ধরল আতাহার। আপনেরা আমারে দয়া করেন। আমার বহুত বড় ভুল হইয়া গেছে। আমি সেই ভুলের ক্ষমা চাইতে আইছি পারুর কাছে। আমি তার কাছে মাপ চাইয়াঐ চইলা যামু। আর কিছু না। আপনেরা আমার মা-বাপের মতন। আমারে দয়া করেন। আল্লারস্তে দয়া করেন।
কথা বলতে বলতে গলা ভাইঙা আসল আতাহারের।
আফাজউদ্দিন আর রাবেয়া তখন দুইজন দুইজনের দিকে তাকায়া আছেন। কী করবেন না করবেন বুঝতে পারছেন না।
.
পারু কঠিন গলায় বলল, না।
রাত তেমন হয় নাই। নূরিকে রাতের খাবার আর অষুদ খাওয়াইয়া ঘুম পাড়ায়া দিছে শিরি। আতাহার এই বাড়িতে আসার পর থেকে পারুর চেহারা অন্যরকম। নরম কোমল মায়াবী মুখটা পাথর হয়ে আছে। নূরির দিকে ফিরাও তাকায় নাই। মেয়ের জ্বর কমল না বাড়ল কিছুই সে খেয়াল করল না। বোনকে সামাল দিল শিরি। নূরি যখন গভীর ঘুমে আফাজউদ্দিন আর রাবেয়া আইসা ঢুকলেন এই ঘরে। শিরি নসু বই নিয়া বসছে। রাতের খাওয়াদাওয়া এখনও কারও হয় নাই। বাড়ির পরিবেশটাই বদলাইয়া গেছে।
আফাজউদ্দিন আর রাবেয়া এই ঘরে আসার আগে পারু নসুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তরে সে দেখছে? তুই অর সামনে গেছিলি?
না মা। তারে দূর থিকা দেইখাই আমি দৌড়াইয়া আইয়া তোমারে কইছি। তারবাদে খেলতে গেছি গা। সন্ধ্যার সময় আইসা এই ঘরে ঢুকছি। সেও আমারে দেহে নাই আমিও তারে দেহি নাই। আর তুমি না আমারে না করলা!
হ। আমি চাই সে য্যান তগো কেরে না দেখে। তরা কেঐ য্যান তারে না দেখছ।
আইচ্ছা।
নসুও বোধহয় শিরির মতন ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারে আতাহার কাকার ওপর বিরাট রাগ মা’র। মা’র কথার বাইরে তারা যাইব না।
আফাজউদ্দিন আর রাবেয়া আইসা ঢোকার পর হারিকেনের আলোয় প্রথমে তারা ঘুমন্ত নূরিকে দেখল তারপর শিরি নসুকে বলল, মরিয়মরে গিয়া ক, তগো ভাত দিতে।
ওরা দুইজন বের হবে, পারু বলল, সাবধান, কইছি ওইভাবে চলবি।
দুই ছেলেমেয়ে একলগে বলল, আইচ্ছা মা।
রাবেয়া মেয়ের মন জানেন। বললেন, না, আতাহারের লগে অগো দেখা হইবো না। ও আছে বাংলাঘরে। রান্নঘর থিকা বাংলাঘর অনেকখানি দূরে। আর ওইদিকে কলিম আছে। ভিতর বাড়ির দিকে সে আসতে চাইলে কলিম আইসা খবর দিবো।
কেমতে বুজলা?
তর বাপে আর আমি তারে কইছি আমগো না বইলা, কলিমরে দিয়া খবর না দিয়া সে য্যান ভিতর বাড়ির দিকে না আসে।
পারু কথা বলল না।
আফাজউদ্দিন বললেন, তরে দুই-চাইরড়া কথা কইতে আইলাম মা।
হেইডা তোমগো দুইজনরে দেইখাই আমি বুজছি। তয় এমুন কোনও কথা কইবা না। যেইডা আমি হুনুম না।
রাবেয়া বললেন, আগে তর বাপের কথা হোন মা।
তারপর স্বামীর দিকে তাকালেন তিনি। কন, আপনে যা কইতে চান কন।
আতাহার কীভাবে তাঁদের পা প্যাচাইয়া ধরল, কী বলল সবই পারুকে বললেন তিনি। শুইনা পারু ওই কথাটা বলল, না।
তয় শয়তানডা তো বহুত জ্বালাইবো। যুদি বাইত্তে বইয়া থাকে অরে খেদামু কেমতে? ও তো বিরাট গোঁয়ার।
কাইল বিয়ানে মুইড়া পিছা দিয়া পিডাইয়া খেদাইয়া দেও। কুত্তা যেমতে খেদায় অমতে খেদাও।
এইডা কি আমগো মতন মাইনষে পারে মা? মাইনষে কইবো কী? ও যেই পদের পোলা দেহা গেলো গেরামের মাইনষেগো ডাইকা ডাইকা তর নামে আকথা কুকথা কইয়া গেল।
পারু একটু চমকাল। হ এইডা ও কইতে পারে। ও আর অর বাপে পারে না এমুন কাম দুনিয়াতে নাই।
রাবেয়া বললেন, তয় বুদ্ধি কইরা অরে খেদানঐ ভাল। নাইলে মান ইজ্জত মাইরা দিয়া যাইতে পারে শয়তানডায়।
কিন্তু আমি অরে আমার মুখ দেহামু না। অর সামনে আমি যাইতে পারুম না। অর মুখের মিহি চাইলে ওই যে অগো গেরামের নূরজাহান অর বাপের মুখে যেমতে ছ্যাপ দিছিল হেইডা অর মুখে আমি দিমু। স্যান্ডেল সোন্ডেল দিয়া বাড়িও দিতে পারি।
রাবেয়া আফাজউদ্দিনের দিকে তাকালেন। কী করবেন এই অবস্থায়। বিরাট ভেজালে পড়ছেন তো?
আফাজউদ্দিন গম্ভীর প্রকৃতির, চিন্তাশীল মানুষ। বললেন, অন্য কোনও ভাবে অর লগে কথা কইয়া অরে বিদায় করতে পারছনি মা?
কোনভাবে?
হেইডা আমি বুজতাছি না। আমার মাথায় এই হগল আহে না।
পারু কাতর গলায় বলল, বাবা, অর লগে কেমতে কথা কমু আমি কও তো! মানুষের লগে মানুষে কথা কয়, গুয়ের পোকের লগে মানুষে কথা কয় কেমতে?
একটু আমগো মুখের মিহি চা মা। এই ঝামেলার হাত থিকা বাঁচা। মান ইজ্জত লইয়া তো গেরামে থাকন লাগবো না কি?
পারু ভাল রকম চিন্তায় পইড়া গেল। মেদিনমণ্ডল গ্রামের অনেকে তার আর আতাহারের সম্পর্কের কথা জানে। পোলাপানের কথা জানে, বিয়াশাদি হওয়ার কথা ছিল তাও জানে। বেসনালের কেউ ওইসব জানে না। আতাহার যুদি ওইসব কথা গ্রামের লোকজনরে বইলা যায় তয় মান ইজ্জত সত্যই যাইব। পারুর থেকে ক্ষতি বেশি হইব পোলাপান তিনটার। শিরি নসু স্কুলে পড়ে। গ্রামের পোলাপানরা একটু বেশি পাকনা হয়। স্কুলে ওইসব নিয়া কথা বললে শিরি নসু শরমে স্কুলে যাইতে পারব না। মেদিনমণ্ডলে তো মান্নান মাওলানা আর আতাহারের ডরে কেঐ মুখ খোলে নাই। এই গ্রামে তো আর মান্নান মাওলানা নাই, আতাহার নাই।
শেষ তরি একটা বুদ্ধি বাইর করল পারু। একটা কাম করন যায় বাবা।
আফাজউদ্দিন উৎসাহী হলেন। কী কাম মা?
আমি অর লগে কথা কমু। তয় এই ঘরের দুয়ার জানালা বেবাক ভিতর থিকা বন্ধ থাকবো। পোলাপান তিনডারে পাডাইয়া দিবা তোমগো ঘরে। ওই ঘরে য্যান সে যাইতে না পারে, উক্কি (উঁকি) দিতে না পারে। দরকার হইলে দুয়ার বাইরে থিকা তালা দিয়া রাখবা। আমার পোলাপানের মুখ ও য্যান দেখতে না পারে, আমার পোলাপানে য্যান দেখতে না পারে অর মুখ।
ঠিক আছে। ওই ব্যবস্থা করুম নে। তয় তুই কথা কবি কেমতে?
আমি এই ঘরের দরজা জানালা বেবাক ভিতরে থিকা বন্ধ কইরা রাখুম। এই ঘরের ছাইছের মিহি যেই জানালাডা আছে, কলিমরে কইবা বিয়ানবেলা তারে ছাইছের জানালার সামনে আইন্না খাড়া করাইবো। কলিম যাইবো গা। সে জানালার বাইরে থিকা কথা কইবো, ঘরের ভিতরে বন্ধ জানালার সামনে খাড়াইয়া আমি কথা কমু। তারবাদে তোমগো আর চিন্তা নাই। ও যাইবো গা। আর কোনওদিন এইমিহি আইবো না।
রাবেয়া বললেন, ঠিক আছে মা। আমরা ওইভাবেই ব্যবস্থা করুম।
.
কেমুন আছো, পারু?
বন্ধ জানালার দিকে পিঠ দিয়া দাঁড়ায়া আছে পারু। যেন জানালার ফাঁকফোকর দিয়া, ছিদরি মিদরি (ছিদ্রটিদ্র) দিয়াও পারুর মুখ আতাহার দেখতে না পায়। তবে আতাহারের গলা শুইনা ভিতরে ভিতরে কাইপা উঠল পারু। আতাহারের হাতে সিগ্রেট জ্বলছে, সিগ্রেটের গন্ধটাও পাইল পারু। একদিকে আতাহারের গলা, অন্যদিকে তার সিগ্রেটের গন্ধ। ফেলে আসা দিনের একটা রোমাঞ্চ, একটা দোলা পলকের জন্য মনে আর শরীরে লাগল পারুর। তবে পলকেই ভাবটা পারু কাটায়া ফেলল।
তার কথা মতনই মা বাপে কলিমরে দিয়া এই ব্যবস্থা করছে। সকালবেলার নাস্তাপানি খাওয়াইয়া আতাহাররে এই ঘরের ছাইছে, জানালার লগে আইনা খাড়া করাইয়া দিছে কলিম। দিয়া নিজে চইলা গেছে উঠানের দিকে। পারুর তিন পোলাপান নানা নানির লগে আছে বড় ঘরে। কলিম এমনভাবে চোখ রাখছে চারদিকে, তার চোখ ফাঁকি দিয়া এই বাড়ির কেউর লগে আতাহার দেখা করতে পারব না।
তবে পারুর লগে কথা বলার ব্যবস্থা হইছে তাতেই সে খুশি। অন্য কোনওদিকে তার খেয়াল নাই।
আতাহার বলল, তুমি আমার কথা শোনতাছো, পারু?
গলায় নরম, অনুনয়ের সুর। আতাহারের এই সুর কোনওদিন শোনে নাই পারু। তার মধ্যে ছিল গোঁয়ারতুমি, বদরাগী ভাব, উগ্রতা। মায়া মমতা, নম্রতা কোমলতা তার চরিত্রে নাই। প্রেম করার সময়ও সে রুক্ষই থাকত। জীবনে আজ প্রথম তার গলায় নরম সুর শুনছে পারু। পারু টের পাইল তার মন একটু যেন নরম হইতে চায়। মনরে কঠিনভাবে শাসন করল সে। পাটাপুতার মতন কঠিন, ভারী গলায় বলল, কী কইবা কও।
পারু বুঝল তার গলা শুইনা অস্থির হইছে আতাহার। ফুক ফুক কইরা দুইবার সিগ্রেটে টান দিল, সেই আওয়াজ পাইল পারু। ধুমার গন্ধও পাইল।
আতাহার আগের মতনই নরম গলায় বলল, কইতে চাই অনেক কিছু। অনেক কথা।
কেঐর আজাইরা প্যাচাইল শোননের সময় নাই আমার।
আজাইরা প্যাচাইল না। কামের প্যাচাইল।
দেরি করলে কোনও কথাই আমি হুনুম না। যা কওনের তাড়াতাড়ি কও।
আমি তোমার লেইগা বহুত কষ্ট পাইতাছি।
কও কী?
হ।
কষ্ট কারে কয় তোমার মতন মাইনষে হেইডা বোজে?
আগে বুজি নাই। অহন বুজি। অহন সত্যই বুজি।
হুইনা আমি হাসুম না কান্দুম বুজতাছি না।
ক্যা?
কষ্ট তো মানুষ মানুষের লেইগা পায়। তুমি মানুষনি?
তয় আমি কী?
হোনবা কী?
হ হুনুম।
তুমি অইলা পোক। তাও ভাল পোক না। গুয়ের পোক। গুয়ের পোকের লগে মানুষের কথা সাজে না। তোমার ভাগ্যি আমি একটা গুয়ের পেপাকের লগে কথা কইতাছি।
তোমার যা ইচ্ছা কও, তাও আমার কথা হোনো।
আমার কান পরিষ্কার আছে।
পয়লা কথা হইল, আমি তোমার কাছে মাপ চাই।
কীর লেইগা?
আমার ভুলের লেইগা।
কোন ভুল?
বেক জাইন্না বুইজ্জাও ক্যান তুমি প্রশ্ন করতাছো?
না আমি কিছুই বুজি নাই। কীয়ের ভুল?
আমার জীবনের বড় ভুল।
হেইডা কোনডা?
তোমার লগে বেইমানি।
কীয়ের বেইমানি?
পারু, আমি আর কীভাবে কমু?
না না আমি তোমার কথা বুজতাছি না। তুমি একবার কইলা ভুল, আরেকবার কইলা বেইমানি। ভুল করে মানুষে। বেইমানি করে যার ইমান থাকে। আমি তো আগেঐ কইলাম, তুমি তো মানুষই না। যে মানুষঐ না, তার আবার ভুল কী? বেইমানি কী? আজাইরা প্যাচাইল বাদ দেও।
আতাহার কাতর গলায় বলল, বাবার আর আমার বেইমানির লেইগা মা’য় মরছে, তোমারে আমি হারায়া ফালাইছি।
তোমার বাপে তো হইল তোমার থিকাও বড় গুয়ের পোক। আমি ভদ্রলোকের মাইয়া দেইখা আর কিছু কইলাম না। যুদি বকা জানতাম তয় তোমার বাপরে কইতাম শুয়োর। যেই শুয়োর গু খায়, গুয়ের মইদ্যে পইড়া থাকে। আর তুমি হইলা তার পোলা। আমারে দিয়া খারাপ কথা আর কওয়াইয়ো না। তাড়াতাড়ি কথা শেষ কইরা বিদায় হও। তোমার কারণে আমগো বাড়ির পরিবেশ নষ্ট হইয়া গেছে। বাতাসে গুয়ের গন্ধ। বন্ধ ঘরে থাইকাও হেই গন্ধ আমি পাইতাছি।
পারু আমারে তুমি দয়া করো। আমারে তুমি মাপ করো।
তারপর?
আমি তোমারে ফিরায়া নিতে চাই।
কই?
আমগো বাড়িতে?
কীর লেইগা?
আমি তোমারে ভালবাসি। তোমারে বিয়া করুম। আমার পোলাপান তিনডারে বাপের আসল পরিচয় দিমু!
আইচ্ছা!
তারপর আর নিজেরে ধইরা রাখতে পারল না পারু। দাঁতে দাঁত চাইপা বলল, ওই শুয়োরের পো, ভালবাসা কারে কয় তুই জানছ? আর কারে বিয়া করতে চাছ তুই? আমি। হইলাম মানুষ তুই হইলি গুয়ের পোক। গুয়ের পোকের লগে মানুষের বিয়া অয় কেমতে? আর তর পোলাপান তিনডার অর্থ কী? পোলাপান তিনডা তো মানুষের! আমার পোলাপান কোনও শুয়োরের পোর না। এই তুই যা এহেন থিকা যা। আমগো বাড়ি থিকা বাইর অ। নাইলে, আমি দুয়ার খুইল্লা বাইর অমু। মুইড়া পিছা দিয়া পিডাইয়া তরে বাইর করুম।
আতাহার আগের মতোই কাতর গলায় বলল, তাও তুমি বাইর অও। মুইড়া পিছা দিয়া যত ইচ্ছা পিড়াও আমারে। তাও তোমার মুখটা আমি ইট্ট দেহি। তোমারে দেহনের লেইগা। কইলজাড়া আমার ফাইট্টা যাইতাছে।
পারু আগের চেয়েও বেশি শ্লেষের গলায় বলল, তর আবার কইলজাও আছে নি? কচ কী?
পারু!
আমি আর কোনও কথা শুনতে চাই না। তুই যা, বাইর অ আমগো বাড়ি থিকা। এইডা ভদ্রলোকের বাড়ি। তর লেইগা বাড়ি নষ্ট অইতাছে। তুই যতক্ষণ থাকবি এই বাড়ির মানুষ দম নিতে পারবো না। বেবাকতে অস্থির অইয়া গেছে।
এবার আতাহারের গলা ভাইঙা আসল। পারু, পারু আমি তোমার পায়ে ধরি। আমি তোমার কোনও কথার প্রতিবাদ করতাছি না। তুমি আমারে বাঁচাও পারু। আমি তোমার লেইগা মইরা যাইতাছি।
এই খবরদার। তর কথায় আমার গা ঘিনঘিন করতাছে। তুই আমার পায়ে ধরতে চাস হুইনা আমার মনে অইতাছে একটা গুয়ের পোক পায়খানা থিকা আমার পায়ের মিহি আইতাছে। তুই আর কথা কইচ না, তুই যা।
আতাহার কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, আমি বাঁচতে চাই পারু। আমি তোমারে লইয়া, পোলাপান তিনডারে লইয়া বাঁচতে চাই। এক ট্যারিরে আমি বিয়া করছি, ও আমারে কিছুই দিতে পারে না। অর লগে সহবাস কইরা আমি আরাম পাই না। ওর মুখের মিহি চাইলে আমার মিজাজ খারাপ হয়। অর কথা হোনলে গাও জ্বলে। ও আমারে ভাত আইন্না দিলে, চা-নাস্তা দিলে আমার ঘিন্না লাগে। অর শইল্লের গন্ধে অর লগে আমি শুইতে পারি না।
ও এইবার বুজছি! আমার সব্বনাশ কইরা তুই অহন আরেকটা মাইয়ার সব্বনাশ করতে নামছস। টেকাপয়সা সোনাদানা আর নতুন মাইয়া মাইনষের শইল্লের লোভে তুই একটা মাইয়ারে নিজে দেইক্কা পছন্দ কইরা বিয়া করছস। অহন সব পাইয়া তারে আর ভাল্লাগে না। ওই, তরে আমি কী কমু রে? গুয়ের পোক কইলাম, শুয়োরের পো কইলাম, আর কী কওন যায় রে তরে? তরে কওনের মতন খারাপ শব্দঐত্তো বিচড়াইয়া পাইতাছি না আমি। আমি কি বাইর অইয়া তরে মুইড়া পিছাড়াদা পিডামু? না হেইডা করতেও আমার ঘিন্না। লাগবো। তুই যা, তাড়াতাড়ি যা, তাড়াতাড়ি। নইলে কোন শনি তর কপালে ঘটবো আমি বুজতাছি না। তরে আমি বডি (বঁটি) দিয়া কোপ দিয়া কল্লা নামায়া দিতে পারি।
এবার শিশুর ভঙ্গিতে কাঁদতে আরম্ভ করল আতাহার। করো, হেইডা করো। বডি দিয়া কোপ দিয়া আমার কল্লা নামায়া দেও। আমার আর বাঁইচ্চা থাকতে ভাল্লাগে না। তোমারে ছাড়া আমি টিকতে পারতাছি না। বিয়ার আগে এই বুজি নাই। বাসররাইত থিকা বুজছি। তারপর থিকা আমার পাগল পাগল লাগে। কিছু ভাল্লাগে না। আমি মইরা যামু পারু, আমি মইরা যামু। তুমি আমারে বাঁচাও। আল্লারস্তে তুমি আমারে বাঁচাও।
পারু তবু একটুও নরম হল না, একটুও কোমল হল না। আগের মতোই কঠিন গলায় বলল, তোর মুখে আল্লার নাম শোভা পায় না। তুই এই বাড়িতে মরিছ না। তর মতন। গুয়ের পোক বাঁচলেও যা, মরলেও তা। তুই তগো বাইত্তে গিয়া মর। বড় গুয়ের পোকরে প্যাচাইয়া ধইরা মর। পারলে ওইডারে লইয়া মর। তয় আল্লাহপাকের দুনিয়া একটু পাকসাফ হইবো।
তারপরও শেষ চেষ্টা করল আতাহার। পারু, আমি ওই ট্যারিরে তালাক দিমু। তুমি যেমতে যা কইবা তাই করুম। তোমার পায়ে ধরি পারু। আল্লারস্তে আমার কথা শোনো। আমারে মাপ কইরা দেও। লও আবার আমরা দুইজনে আগের লাহান জীবন কাডাই। ওই ট্যারিগো বাড়ির জিনিসপত্র টেকা পয়সা বেবাক আমি ফিরত দিয়া দিমু।
পারু বলল, তর লগে আমার আর কোনও কথা নাই। শেষ কথা হইল তুই অহনঐ এই বাড়ি থিকা বাইর হইয়া যাবি। আর একমিনিটও এই বাড়িতে থাকবি না। আমার মা-বাপে কইছে দেইখা আমি তর লগে কথা কইছি। এরপর তুই এহেনে খাড়াইয়া কানতে কানতে মইরা গেলেও আমার গলা আর হুনবি না।
পারুর ঘরের ছাইছের দিককার বন্ধ জানালায় মাথা ঠেকায়া আতাহার তখন শিশুর মতন কাঁদছে।
.
পরের বছর চৈত্রমাসের মাঝামাঝি একদিন রব্বান উধাও হয়ে গেল।
কিছুদিন ধইরা সেই প্রথম দিককার মতন বাবরি চুল রাখতে শুরু করছিল সে, দাড়িমোচ কামানো ছাইড়া দিছিল। কীরকম উড়নচণ্ডী উড়নচণ্ডী ভাব। ঠিকঠাক মতন চায়ের দোকানটাও চালায় না। সকালবেলা যখন ইচ্ছা গিয়া দোকান খোলে। দুপুরে বিকালে যখন ইচ্ছা দোকান বন্ধ কইরা বাজারের দিকে চইলা যায় আড্ডা চাডামি মারতে। কখনও কখনও বাড়িতে আইসা শুইয়া থাকে। রাবির পোলা বাদলারে রাখছে কর্মচারী। মাসে বেতন দুইশো টাকা আর তিনবেলার খাওয়া। বাদলা চটপট পোলা। বিয়ানবেলা রব্বানের কোনওদিন দোকান খুলতে দেরি হইলে নিজে দৌড়াইয়া আসে গাছির বাড়িতে। রব্বানরে ডাইকা নিয়া যায়। দোকানে গিয়া চা আর বনরুটি নাইলে টোস্ট বিস্কুট দিয়া নাস্তা করে। দুপুরে প্রথমে সে গাছির বাড়িতে আইসা ভাত খাইয়া যায় তারপর আসে রব্বান। গোসল টোসল কইরা ভাত খাইয়া একটুখানি জিরাইয়া তারবাদে আবার যায় দোকানে। সেই ফাঁকে। দোকান চালায় বাদলা। চা ভালই বানাইতে শিখছে। টাকাপয়সার হিসাবও বোঝে। চুরি চামারির অভ্যাস নাই। একটা পয়সাও এদিক ওদিক করে না। সন্ধ্যার দিকে আইয়া রাতের ভাত খাইয়া আবার যায় দোকানে। তারপর যতক্ষণ দোকান খোলা থাকে দোকানে থাকে বাদলা। রব্বানের লগে দোকান বন্ধ কইরা বাড়ি যায়।
এখন এই দিকটায় দিনরাইত বইলা কোনও কথা নাই। রাইতদোফরে মানুষজন থাকে। রাস্তার কাজ ফেরিঘাট তরি চইলা গেছে। মাটি ফালানো শেষ। এখন ইট বিছানের কাজ চলছে একদিকে, আরেক দিকে রোলার চলছে, কার্পেটিং চলছে। রাত আটটা নয়টার দিকে বাদলা গান গাইতে গাইতে বাড়িতে যায়।
আমায় এত রাইতে ক্যানে ডাক দিলি
প্রাণ কোকিলারে!
দেলোয়ারা ভাবছিলেন বাদলারে লেখাপড়া শিখাবেন। প্রথমে খাইগোবাড়ির স্কুলে তারপর কাজির পাগলা হাইস্কুলে ভরতি করাইয়া দিবেন। পড়ায় বাদলার মনই নাই। রব্বান চায়ের দোকান দেওয়ার পর রাবি একদিন নূরজাহানের কাছে আইসা হাজির। আমার পোলাডারে দোকানের কামে লইয়া লইতে ক তর জামাইরে। একটা ছেমড়া তো লাগে দোকানে।
নূরজাহান বলার লগে লগেঐ রব্বান বাদলারে দোকানে রাখছে। দোকান ভাল রকম চালু হইছে। পাঁচ-ছয়শো টাকা বিক্রি রোজ। চায়ের দোকানে লাভ অনেক। ছয়শো টাকা বিক্রি হইলে সব বাদ দিয়া দুই-আড়াইশো টাকা টিকে। মাসে ছয়-সাত হাজার টাকা। দেশগ্রামে ছয়-সাত হাজার অনেক টাকা। রব্বান আর নূরজাহানের জীবন সুখে আনন্দেই কাটছিল। বাদলাও মহা উৎসাহে দোকান চালায়। কোনও কোনওদিন দবিরও গিয়া দোকানে বসে। রব্বান যদি গোয়ালিমান্দ্রার হাটে যায়, দিঘলি বাজারে যায়, ওইসব দিকে গেলে দিন পার হইয়া যায়, তখন দবির গিয়া বসে দোকানে। সে চা বানাইতে পারে না। চা বানায় বাদলা। অন্যান্য জিনিসপত্র বেচে সে। টাকাপয়সা গুইনা রাখে ক্যাশ বাক্সে। দোকানের আয় উন্নতি দেইখা, মাইয়ার সুখ শান্তি আনন্দ দেইখা ভাবছে দরকার হইলে অর্ধেকখানি জমিন বেইচা বড় কইরা আরেকখান দোকান দিব রাস্তার ধারে। দুইখান দোকান যুদি হয়, তয় টেকা পয়সার আকাল থাকবো না সংসারে। নূরহাজানের পোলাপান হইলে খরচ বাড়বো না!
তয় বছর পার হইয়া আইলো পোলাপান হওনের নাম নাই নূরজাহানের। একদিন এইসব লইয়া হামিদার লগে কথা কইছিল দবির। হামিদা বলছে, আইজকাইলকার পোলাপানে সহাজে পোলাপান হওয়াইতে চায় না। অগো যহন ইচ্ছা অরা হওয়াইবো!
তুমি নূরজাহানরে এই হগল লইয়া কিছু জিগাও নাই।
একদিন জিগাইছিলাম।
কী কয়!
কয় জামাই এত তাড়াতাড়ি পোলাপান চায় না।
তয় ঠিক আছে। আর নূরজাহান কী কয়? জামাই পাইয়া খুশি?
হ খুশি।
খুশি যে হেইডা আমিও বুজি। মাইয়ার মুখ দেখলেই বুজা যায়, জামাইর মুখ দেখলেই বুজা যায়।
ঘরের ওটায় বসে তামাক টানতে টানতে নূরজাহানের সুখী জীবনের কথা ভাইবা বহুত আনন্দে ছিল দবির। হামিদাও ছিল তার মতন আনন্দে। একটা বছর চোখের পলকে যেন কাইটা গেল। চায়ের দোকান দিয়া বেশ গুছাইয়া গাছাইয়া দোকান আর সংসার করছিল রব্বান। এই অবস্থায় হঠাৎ একদিন নাই। নাই তো নাইই। কই যে গেল!
কিছুদিন ধইরা বাবরি চুল রাখছিল, মুখের দাড়িমোচ কামাইতেছিল না। দোকানের দিকে তেমুন মন নাই, নূরজাহানের দিকে তেমুন মন নাই, কেমন জানি উদাস উদাস ভাব। নূরজাহান এক রাইতে তারে ধরল। কী অইছে তোমার?
দোকান বন্ধ কইরা বাড়িতে আসছে রব্বান। নূরজাহানের লগে নিজের ঘরে বইসা রাইতের ভাত খাইছে। বিয়ার পর প্রথম প্রথম রব্বানকে একা একা ভাত খাইতে দিত নূরজাহান। নিজে সামনে বইসা এইটা ওইটা আগায়া দিত, ভাতটা সালুনটা পাতে তুইলা দিত। রব্বান আরাম কইরাই খাইত। তারপর একদিন বলল, আমার একলা একলা ভাত খাইতে ভাল্লাগে না।
নূরজাহান হাইসা বলল, তয় দোকলা পাইবা কই?
রব্বান একটা হাত বাড়াইয়া নূরজাহানের গাল ছুঁইয়া দিল। এই যে আমার দোকলা।
হ আমি তো তোমার দোকলাই।
তয় তুমি আমার লগে বইয়া খাও না ক্যা?
নূরজাহান কীরকম লজ্জা পাইলো। যাহ।
ক্যা অসুবিদা কী?
মাইয়ারা স্বামীর লগে বইয়া খায় না। তাগো সামনে বহাইয়া খাওয়ায়। আমার মায় অহন তরি বাবারে সামনে বহাইয়া খাওয়ায়।
আরে ওইদিন কি আর আছেনি? আইজকাইল বউজামাই একলগে বইয়া খায়। কাইল থিকা তুমি আমার লগে বইয়া খাইবা।
না আমার শরম করবো।
আমার কাছে তোমার কীয়ের শরম?
আমার বেবাক শরমঐত্তো তোমার কাছে। মাইয়ারা সবচাইতে বেশি শরমায় জামাইরে।
আবার সবচাইতে বেশি ভালবাসে জামাইরে।
হেইডা বাসেঐ।
ভালবাসা শব্দটা শোনার লগে লগে সেই মানুষটার কথা পলকের জন্য মনে পড়েছিল নূরজাহানের। মজনু। বিয়ার পর মরনি আম্মার লগে একবার আইছিল নূরজাহানরে দেখতে। রব্বানও সেদিন বাড়িতে। বিকালবেলা। পরনে প্রিন্টের সুন্দর একটা হাওয়াই শার্ট, শ্যাওলার মতন রং এমন প্যান্ট আর পায়ে স্যান্ডেল। দেখতে আরও সুন্দর হইছে। মজনু। সরাসরি মজনুর দিকে তাকাতে কেমন জানি লাগছিল নূরজাহানের। আড়চোখে চাইছিল। আর বুকের ভিতর কেমন করছিল। এই মানুষটার জন্য গোপন এই মন কেমন করা ভাবটা বোধহয় সারাজীবন থাইকা যাইব নূরজাহানের। কত স্বপ্ন তারে নিয়া সে দেখছিল। মরনি আম্মার সংসার হইবো তার সংসার, মরনি আম্মার পোলা হইব তার জামাই। কী স্বপ্ন দেখল আর কী হইল!
মজনুরও মুখে কীরকম বিষাদের গোপন ছায়া ছিল সেদিন। সেও যেন সরাসরি তাকাতে পারছিল না নূরজাহানের দিকে। রব্বানের লগে পরিচয় করাইয়া দিল মরনি। মজনু, এই যে দেখো বাজান নূরজাহানের জামাই। বহুত ভাল পোলা।
মজনু কথা বলে নাই। মৃদু হাসছে। তারপর চা মুড়ি খাইয়া চইলা গেছে। চইলা যাওয়ার সময় নূরজাহান দাঁড়ায়া ছিল বাড়ির নামার দিকে। এমন চোখে একবার নূরজাহানের দিকে তাকাইল মজনু, সেই চাউনিতে যে কী ছিল, নূরজাহানের কলিজাটা পুইড়া গেল। ক্যান যে চোখ ফাইটা আসতে চাইল অব্যক্ত কষ্টের এক কান্না। সেই কান্না সামাল দিয়া বাঁশঝাড়তলার দিকে চইলা গেল সে। লগে দৌড়াইতে দৌড়াইতে গেল ভাদাইম্মা। রব্বান তার আগেই চইলা গেছে দোকানে।
রব্বানের সেই দিনকার সেই কথার পর সকালের নাস্তা দুপুরের ভাত রাতের ভাত, তিনবেলার খাবারই রব্বানের লগে বইসা খায় নূরজাহান। যতই মন জুইড়া থাউক মজনু, রব্বানের জন্যও একটা মায়া মমতা ভাল লাগা নূরজাহানের তৈরি হইছে। এইটা ভালবাসা কিনা কে জানে! তবে মায়াটা রব্বানের জন্য লাগে। দুপুরবেলা দেরি কইরা বাড়িতে আসলে অপেক্ষার একটা কষ্ট হয়। রাতেরবেলা দেরি কইরা আসলে মনের ভিতর তৈরি হয় অদ্ভুত এক ছটফটানি। সব মিলায়া সম্পর্কটা মায়া মমতার, ভাললাগার, হয়তো বা এও এক রকমের ভালবাসা। মজনুর জন্য যেমন তেমন না, অন্যরকম।
তবে রব্বান মানুষটা খারাপ না। মায়া মমতা তারও আছে। একটু উদাস টাইপের। মাঝে মাঝে কী জানি চিন্তা করে। আনমনা হইয়া থাকে। কোনও কোনও রাত্রে অনেকটা রাত হয়ে যায় ঘুম আসে না। বিছানায় শুইয়া নিয়াস ছাড়ে, এইপাশ ওইপাশ করে। ওইরকম এক রাতে নূরজাহান তার বুকে হাত বুলাইয়া জিজ্ঞাসা করছে, কী হইছে তোমার? ঘুমাইতাছে না ক্যা?
জী জানি। ঘুম আহে না। মনডা কেমুন জানি লাগে?
ক্যান গো?
হেইডা কইতে পারি না।
নূরজাহান ঠাট্টা কইরা বলছে, কেঐরে কোনওহানে রাইখা আইছোনি? তার লেইগা মন কান্দে? ঘুম আহে না?
রব্বানও ঠাট্টা করছে। হ একখান বউ রাইক্কাইছি। মাত্র জন্মাইছে এমুন একহান মাইয়া রাইক্কাইছি। তাগো লেইগা পরান কান্দে। রাইত্রে ঘুম আহে না। খাইতে ইচ্ছা করে না। খালি একহান কাম করতে ইচ্ছা করে।
কী কাম?
তোমারে আদর সোহাগ করতে। তোমার লগে সহবাস করতে।
নূরজাহান লাজুক ভঙ্গিতে রব্বানের বুকে ছোট্ট কইরা একটা কিল মারছে।
এক জ্যোৎস্না রাইতে অদ্ভুত এক কাম করল রব্বান। রাইত দোফরে নূরজাহানরে বলল, লও বাইরে যাই।
নূরজাহান অবাক। ক্যা, এত রাইতে বাইরে যাইবা ক্যা?
এমুন সোন্দর জ্যোৎস্না রাইত। লও বাঁশঝাড়তলার ওইমিহি দিয়া ইট্টু হাঁইট্টা হুইটা (হেঁটে টেটে) আহি। ওই দিককার চকে দেইখো কী সোন্দর জ্যোত্মা। জ্যোত্সা দেখলে মাথা খারাপ হইয়া যাইবো। লও।
অনেকটা জোর কইরাঐ নূরজাহানরে লইয়া ঘর থেকে বাইর হইল। নূরজাহান বলল, রাইত দোফরে বাঁশঝাড়তলার মিহি যাইতে আমার ডর করে।
কীয়ের ডর? ভূতের? আরে ধুরো। আমি আছি না! কীয়ের ভূত।
বাঁশঝাড়তলায় আইসা চকের দিকে চাইয়া সত্যঐ মাথা খারাপ হইয়া গেল নূরজাহানের। কী সুন্দর জ্যোত্সা। কী সুন্দর লাগতাছে আল্লাহপাকের দুনিয়া। দক্ষিণ দিকে পদ্মা নদী। সেই নদী থেকে আসছে হু হু করা হাওয়া। পদ্মার ঠিক উপরেই ফুইটা আছে চাঁদ। বৈশাখ মাস। দিনেরবেলা জানমারা গরম। সেই রাইত দোফরে কী সুন্দর হাওয়া। কীসের গরম! ভারী আরামদায়ক হাওয়া।
রব্বান বলল, কী অহন ডর করতাছে না ভাল লাগতাছে?
রব্বানের হাত ধরল নূরজাহান। ভাল্লাগতাছে, বহুত ভাল্লাগতাছে। মনে হইতাছে তোমার হাত ধইরা ওই চক দিয়া একখান দৌড় দেই। দৌড় দিয়া পদ্মার পারে চইলা যায়। গাঙ্গের পানিতে নাইম্মা ডুবাডুবি করি। তোমার বুকে মাথা দিয়া গাঙপারের বালিতে শুইয়া থাকি।
ল যাই।
আরে না। কেঐ দেকলে কী কইবো?
কে দেখবো?
দেখতে পারে। সড়কের কামে দেশগেরামে অহন ম্যালা মানুষ। দেশগেরামে অহন আর দিন রাইত নাই।
বাঁশঝাড়তলায় একটা নাড়ার পালা দিয়া রাখছে দবির। বেশি বড় পালা না। সেই পালায় ঢেলান দিয়া রব্বানের হাত ধইরা চকের দিকে চাইয়া দাঁড়ায়া রইল নূরজাহান। মনের মধ্যে সত্যঐ দারুণ এক আনন্দ। জীবনে যেন এত আনন্দের রাইত আর আসে নাই।
এই সময় ঘটল সেই কাণ্ড।
রব্বান ধীরে ধীরে আদর করতে লাগল নূরজাহানরে। পিঠের কাছে গলার কাছে মুখ ঘষতে লাগল, গালে ঠোঁটে ছোট ছোট কামড়, চুমা, ব্লাউজের তলা দিয়া বুকে হাত, পটাপট একসময় ব্লাউজের টিপ বোতাম খুলল, নূরজাহানের বুকে মুখ দিল। নূরজাহান ছটফট করতে করতে বলল, ঘরে লও।
রব্বান কোনও কথা বলল না। সে যেন পাগল হয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত অবস্থা এমন হল, নাড়ার পালার সঙ্গে ঢেলান দেওয়া অবস্থাতেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই নূরজাহানের লগে মিলিত হইল সে। সেইটা অদ্ভুত রকমের এক পাগলামি, অদ্ভুত রকমের এক আনন্দ। ব্যাপারটা শেষ হওয়ার পর নূরজাহান টের পাইল এইরকম আনন্দ বিয়ার পর, এতবার স্বামীর লগে মিলিত হওয়ার পর একদিনও পায় নাই নূরজাহান। সে তখন আঁচলে মুখ গলা গাল মুচছে আর হাঁপাচ্ছে।
রব্বানের অবস্থাও তেমন। নূরজাহানের আঁচল টাইনা সেও মুখ মুছল। বলল, কী, কেমুন লাগলো?
নূরজাহান কথা বলল না। লাজুক ভঙ্গিতে রব্বানের পিঠে একটা কিল দিল। মিষ্টি কইরা একখান গাইল দিল। শয়তান।
রব্বান বলল, আমার অহন কী ইচ্ছা করতাছে জানো?
কী?
জ্যাটিঙ্গা পাখি হইয়া যাইতে।
জ্যাটিঙ্গা পাখি আবার কোনডা?
হেই পাখি আমগো দেশে থাকে না। থাকে আসামের জঙ্গলে।
তোমার আথকা হেই পাখি হইয়া যাইতে ইচ্ছা করতাছে ক্যা?
এই জ্যোৎস্না রাইত দেইখা, পূর্ণিমা রাইত দেইখা। আর ওই যে ইট্টু আগে যেই আনন্দটা পাইলাম সেই আনন্দে আমার জ্যাটিঙ্গা পাখি হইয়া যাইতে ইচ্ছা করতাছে। তোমারে কইলাম না জ্যাটিঙ্গা পাখিরা থাকে আসামের গভীর জঙ্গলে। ভরা পূর্ণিমা রাইতে চান্দের আলো দেইখা, জ্যোৎস্না দেইখা হেই পাখির মাথা খারাপ হইয়া যায়। জঙ্গল থিকা দলে দলে বাইর হয় পাখিড়ি। বাইর অইয়া কী করে জানো?
কী?
আত্মহত্যা?
কী?
হ আত্মহত্যা করে। দলে দলে আত্মহত্যা করে।
একটু থামল রব্বান। তারপর গম্ভীর গলায় বলল, আমার অহন আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করতাছে।
নূরজাহান তাকে একটা ধাক্কা দিল। কী অলইক্ষা কথা কও।
অলইক্ষা কথা না। সত্যঐ। সত্যঐ আমার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করতাছে। এই আনন্দ আমি সইজ্য করতে পারতাছি না। লও দুইজনে মিল্লা আত্মহত্যা করি। তোমার। শাড়ি দিয়া গলায় দড়ি দেই। আর নাইলে আমগো ঘরে তোমার বাপে ইরিখেতের মাজরা পোক মারনের লেইগা এনডিরিন (এনড্রিন) না কী জানি একটা কীটনাশক আইন্না রাখছে, লও ওই কীটনাশক খাইয়া দুইজনে আত্মহত্যা করি।
নূরজাহান তারপর ভয় পাইয়া গেল। এইরকম জ্যোত্সা রাইতে বাঁশঝাড়তলায় দাঁড়ায়া ওই কাজ করছে তারা, বদ হাওয়া লাগলোনি শইল্লে, জিনে ভূতে ধরলনি রব্বানরে? নাইলে। এই হগল কী কয়!
রব্বানের হাত ধইরা টানতে টানতে তারে ঘরে নিয়া আসল নূরজাহান। লও ঘরে লও। এহেনে আর থাকনের কাম নাই। বহুত থাকছো, যা করনের করছো, অহন ঘরে লও।
বিয়ার পরের একটা বছরে কত ছোট ছোট সুখ আহ্লাদের ঘটনা, কত আনন্দের দিন, সুখ স্বপ্নের রাত, তার কিছুই আইজ মনে পড়ল না নূরজাহানের। মনে পড়ল শুধু সেই জ্যোৎস্না। রাতটার কথা। প্রথমে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার মতন জ্যোত্সা, নূরজাহানের পদ্মা তীরে দৌড়াইয়া যাওয়ার ইচ্ছা, গাঙ্গের পানিতে ডুবাডুবি করার ইচ্ছা, তীরের বালিতে রব্বানের গলা। প্যাচাইয়া শুইয়া থাকার ইচ্ছা। তারপর ঘটল সেই ঘটনা। ঘটনার পর জ্যাটিঙ্গা পাখির কথা তুইলা আত্মহত্যা করতে চাইল রব্বান! নূরজাহান ভাবল বাঁশঝাড়তলার ওদিককার বদ হাওয়া লাগছে। স্বামীর গায়ে, শরীরে আছর করছে বদ কিছু। তাড়াতাড়ি তারে নিয়া ঘরে চইলা আসছে।
আইজ এইসবই মনে পড়ছে নূরজাহানের।
বিয়ানবেলা ঘুম থেকে উইঠা সে দেখে রব্বান ঘরে নাই। ঘরের দুয়ার আবজানো। মাথার সামনের জানালা খোলা। চৈত্রমাসের গরমে জানালা দিয়া মিঠেল হাওয়া আসে। রাতদুপুরে। সেই হাওয়ায় আরামছে ঘুমান যায়। উঠানের দিককার জানালাটা বন্ধই রাখে নূরজাহান। কারণ ওই জানালা দিয়া তাকালেই বড়ঘর দেখা যায়, দবির-হামিদাকে দেখা যায়। কীরকম শরম করে নূরজাহানের।
ঘুম ভাঙার পর রব্বানরে চকিতে না দেইখা নূরজাহান ভাবছে পায়খানায় গেছে। হাতমুখ ধুইয়া ঘরে আইসাই দোকান খুলতে চইলা যাইব। সে ঘর থেকে বাইর হইছে। হইয়া দেখে না রব্বান ওই দিকটায় নাই। চাপকল একহাতে চাইপা অন্যহাতে মুখ ধুইতাছে দবির। রান্নাচালায় হামিদা আটার রুটি ভাজতাছে।
নূরজাহান রান্নাচালায় আসল। হেয় কো মা? তোমগো জামাই?
তাওয়ার রুটি খুন্তি দিয়া উলটাইয়া দিয়া হামিদা বলল, দেহি নাই তো! ক্যা, ঘরে নাই?
না।
দোকানে গেছেগা নি?
দোকানে গেলে আমারে কইয়া যাইবো না? বেশি বেলাও তো অয় নাই। হেয় আর আমি তো একলগেই ঘুম থিকা উডি। আইজ সে কুনসুম উটছে আমি উদিসই পাই নাই।
হামিদা একটু চিন্তিত হল। তয় কই গেল এত বিয়ানে?
কাঁধের গামছায় মুখ মুছতে মুছতে কলতলা থেকে আসল দবির। কী অইছে?
হামিদা বলল, জামাই বিয়ানে উইট্টা কই জানি গেছে গা।
কই গেছে গা?
হেইডাঐত্তো নূরজাহান বুজতাছে না। এত বিয়ানে তো হেয় ওড়ে না।
দোকান মিহি গেলনি?
নূরজাহান বলল, কেরে কিছু না কইয়া, আমারে ডাক না দিয়া তো কোনওদিন যায় না।
এই সময় বাদলা আসল। রব্বানরে সে ডাকে দুলাভাই। বাড়ির উঠানে খাড়ইয়া ছটফটা গলায় বলল, দুলাভাই কো? বেইল অইয়া গেল, দোকান খুলবো না?
নূরজাহান চমকাল। হেয় দোকানে যায় নাই?
না। দোকান বন্ধ। এর লেইগাইঐত্তো আমি বাইত্তে আইলাম। দোকানের এইমিহি ওইমিহি গাহেকরা খাড়ইয়া রইছে। এক বেডা আমারে জিগাইলো, কী রে বাদলা, দোকান খুলবি না? আমগো তো চা খাওন লাগবো। আমি তারবাদেও ইট্টু খাড়ইয়া রইলাম। তারবাদে দৌড়াইয়া আইলাম।
এবার দবির-হামিদাও চিন্তিত।
দবির বলল, কই গেল এত বিয়ানে?
হামিদা বলল, নূরজাহান, দেখ তো দোকানের চাবি ঘরে আছেনি?
নূরজাহান দৌড় দিয়া ঘরে ঢুকল। দোকানের চাবি থাকে বিছানার নীচে, সেই জায়গাটায় হাত দিল। না, চাবি তো আছে। চাবি নিয়া সে বাইর হয় নাই।
চাবি হাতে নিয়া নূরজাহান খুবই চিন্তিত হল। ঘরের এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। বিয়ার পর রব্বান নিজেই নন্দ মিস্তিরিরে ডাইকা একটা অল্পদামি আলমারি বানাইছিল। নিজের দুই-একখান ভাল জামা কাপড়, নূরজাহানের শাড়ি ছায়া ব্লাউজ আর যেইটুক গয়না আছে সেইটুক যাতে রাখন যায়। আলমারিটা তালা দেওয়া। আলমারির মাথার উপরে থাকে রব্বান যে কালো ব্যাগটা লইয়া এই বাড়িতে আসছিল সেই ব্যাগ। নূরজাহানের চোখে পড়ল, ব্যাগটা নাই। তবে আলমারি আগের মতনই তালা মারা।
নূরজাহান ফ্যালফ্যাল কইরা আলমারিটার দিকে তাকায়া রইল। আলমারির চাবিও থাকে বিছানার তলায়। আলমারিতে রব্বান আর নূরজাহানের অতি গোপন কিছু জিনিসও থাকে। কী মনে কইরা ধীর পায়ে গিয়া আলমারিটা খুলল নুরজাহান। খুইলা দেখে জিনিসপত্র সব ঠিক আছে। তার চেনটা কানের দুলটা, শাড়ি ছায়া ব্লাউজ, দোকানের টাকা পয়সা আর বিয়ার সময় রব্বানরে যে সিল্কের পাঞ্জাবি, পায়জামা শার্ট প্যান্ট ঘড়ি আংটি দেওয়া হইছিল সবই আছে। শুধু তার পুরানো শার্ট প্যান্ট দুইটা নাই। দুই-তিনটা শার্ট আর দুইটা প্যান্ট, পুরানা দুইটা লুঙ্গি রব্বান ব্যাগে কইরা নিয়া আসছিল। এক বছরে সেইগুলি আরও পুরান হইছে, লুঙ্গি ছিড়া গেছে, দুইটা লুঙ্গি সে কিনছিল, দুইটা কোরাগেঞ্জি কিনছিল সেই সবই আছে। শার্ট প্যান্ট পুরানাগুলিই চালাচ্ছিল। মাসেকখানি ধইরা বাবরি চুল আর দাড়িমোচের লগে লগে কাপড় চোপড়ের ব্যাপারেও উদাসীন হইয়া গেছিল রব্বান। নিজের পুরানা শার্ট প্যান্ট পরত, নতুন কিনা লুঙ্গি গেঞ্জি পরত, সেইগুলি সবই আলমারিতে আছে, আলনায় আছে, নাই শুধু ব্যাগটা, পুরানা শার্ট প্যান্ট।
নূরজাহানের হাত পা ভাইঙা আসল। মুখটা মরা পাতার মতন শুকাইয়া গেল। চোখে। যেন পলক পড়তে চায় না। যেন এখনই মইরা যাইব এমন ভঙ্গিতে ঘর থেকে বাইর হইল সে। রান্নাচালার সামনে আইসা দাঁড়াইল।
সেখানে রুটি ভাজা শেষ কইরা বইসা আছে হামিদা। দবির আর বাদলা দাঁড়ায়া আছে। উঠানে। নূরজাহান কোনওরকমে বলল, বাবা, হের ব্যাগটা ঘরে নাই।
দবির বড় রকমের একটা ধাক্কা খাইল। কী?
হ।
আমি আলমারি খুলছিলাম। আলমারিতে আমার জিনিস তার জিনিস বেবাকঐ আছে। খালি তার পুরানা শাট পেন লুঙ্গি গামছা গেঞ্জি এই হগল আলমারিতেও নাই, আলনায়ও নাই।
হামিদা দৌড়াইয়া বাইর হইল রান্নাচালা থেকে। কচ কী তুই?
হ মা। আমি বেক কিছু দেইক্কাঐ তোমগো আইয়া কইলাম।
বাদলা বলল, তয় দুলাভাই ব্যাগবোগ লইয়া কই গেল গা? দোকানের চাবি কো?
নূরজাহান হাতের মুঠি খুইলা চাবি দেখাইল। চারজন মানুষই তখন হতভম্ব। এইটা কী হইল? এইভাবে ব্যাগ আর পুরানা কাপড়চোপড় লইয়া কই গেল গা রব্বান? টাকা পয়সাও তো নেয় নাই। হিসাবের টাকা সব আলমারিতে। যেদিন দোকানে যা বিক্রি হয়, রাইতেরবেলা বাড়িতে আইসা গইনা গইনা টাকা পয়সা আলমারিতে রাখে রব্বান। সবকিছু ফালাইয়া এইভাবে কই গেল গা সে? এই বাড়ির কেঐ তো তার লগে কোনও খারাপ ব্যবহার করে নাই। দবির হামিদা তার মা-বাপের মতন। নূরজাহানের লগেও সম্পর্ক খুব ভাল। গত এক বছরে একদিনের লেইগাও মনোমালিন্য হয় নাই। দেখলেই বুঝা যাইতো ভালরকম আমোদ ফুর্তিতে তারা আছে। বিয়ার পর দুইজনেরই চেহারা সুরত ভাল হইছে, শরীর স্বাস্থ্য ভাল হইছে। বিয়ার আগে যেমন ছিল রব্বান বিয়ার পর আর তেমন ছিল না। শরীর স্বাস্থ্যে আমোদ ফুর্তিতে বেশ ভাল ছিল। আর নূরজাহান, মুখ দেখলেই বুঝা যাইত মাইয়াটা সুখে আছে। শরীর স্বাস্থ্যের লগে চেহারাও বদলাইছে, সুন্দর হইছে।
এই অবস্থায় কোথায় চইলা গেল রব্বান!
দোকানের চাবি বাদলার হাতে দিল দবির। তুই গিয়া দোকান খোল বাদলা। চা বানাইয়া বেচাবিক্রি কর। আমি জামাইরে বিচড়াইয়া দোকানে আইতাছি। যা। আর রব্বানের কথা কেঐরে কইছ না। কেঐ জিগাইলে কবি, তার শইল খারাপ। মনে হয় জ্বর আইছে। বাইত্তে হুইয়া রইছে।
আইচ্ছা মামা।
বাদলা চাবি নিয়া চক পাথালে দৌড় দিল।
নূরজাহান তখন ভাঙাচোরা হতাশ মানুষের মতন রান্নাচালার মাটিতে বইসা পড়ছে।
দবির বলল, তুই এত ভাইঙ্গা পরিচ না মা। আমি দেকতাছি কই গেল হেয়, কী বিত্তান্ত।
হামিদা বলল, এইডা কেমুন কারবার জামাইর? কথা নাই বার্তি নাই বিয়ানবেলা উইট্টা ব্যাগ লইয়া কই গেল গা? কোনওহানে যাইতে অইলে আমগো কইয়া যাইবো না? আমরা তারে যাইতে না করতাম!
সেই যে গেল রব্বান, গেল তো গেলই। আর কোনও হদিসই নাই। প্রথম প্রথম দুই তিনদিন রব্বানের উধাও হয়ে যাওয়ার কথা চাইপা থাকল দবির হামিদা বাদলা। বাদলা চায়ের দোকানটা খোলে, দোকানটা তার মতন কইরা চালায়, বন্ধ করে। কত বেচা বিক্রি হয় না হয় কেউ খবরও রাখে না। রাতেরবেলা দোকানের চাবি আর বেচা বিক্রির টাকা দবিরের হাতে আইনা বুঝাইয়া দিয়া যায়। বাদলা মুখ দিয়া যা বলে তাই, টাকা পয়সা দবির গইনাও দেখে না।
যেদিন রব্বান উধাও হয়ে গেল সেদিন অনেকটা রাত তরি উঠানে বইসা ছিল তিনজন মানুষ। দবির হামিদা আর নূরজাহান। ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করেছে, এই বুঝি ব্যাগ হাতে, ব্যাগ কান্ধে ফিরা আসল রব্বান। আইসা তার মধুমাখা হাসিখান দিয়া বলল, আপনেগো ডর দেহানের লেইগা গেছিলাম গা একমিহি, দেকতে চাইলাম আমার লেইগা আপনেগো কেমুন মায়া। তয় আপনেগো ছাইড়া একটা দিনও থাকতে পারলাম না। ফিরত আইলাম। নূরজাহান ভাত দেও আমারে খিদা লাগছে।
বেশি রাত্রে চাঁদ উঠল। দবির বলল, নূরজাহান, মাগো, আর বইয়া থাইক্কা লাব নাই। আইলে এতক্ষুনে আইয়া পড়তো। আমগো এইমিহি হেয় নাই। আমি তো দিনডা ভর। বেবাক মিহি বিচড়াইলাম, কেঐরে তো আর জিগাইতে পারি না যে আমার জামাইরে আপনেরা দেকছেননি? তয় আর দুই-একটা দিন দেইক্কা তারবাদে জিগামু। তুই তর ঘরে গিয়া তর বালিশটা লইয়া আয়। একলা ঘরে থাকনের কাম নাই। আমগো ঘরে থাক।
নূরজাহান মরার মতন উঠল। সারাদিন বলতে গেলে কিছু খায় নাই। সন্ধ্যার দিকে জোর কইরা তারে একটু ভাত খাওয়াইছে হামিদা। বিয়ার পর এমনিতেই একটু ভার ভারিক্কি হইয়া উঠছে নুরজাহান। আগের সেই চঞ্চল ছটফটা দৌড়াদৌড়ি করা মাইয়াটা আর নাই। ধীর স্থির, একটু গম্ভীর, সবকিছু মিলাইয়া এক নতুন নূরজাহান।
দবিরের কথা শুইনা নিজের ঘরে গিয়া ঢুকল সে। ঘরে ঢুইকা নিজের বালিশটা ধরতে গিয়া রব্বানের বালিশটা ধরল, ধরার লগে লগে কইলজাটা য্যান ফাইটা গেল তার, বুকটা ফাইটা গেল, উঠানে বসা মা-বাপে য্যান শুনতে না পায় এমন কইরা চাইপা চাইপা কাঁদতে লাগল। মনে মনে বলল, কই গেলাগা তুমি? আমারে থুইয়া কই গেলা গা? অহন তোমারে ছাইড়া আমার রাইত কাটবো কেমতে? দিন কাটবো কেমতে?
শেষ তরি নিজের বালিশটা বুকে চাইপা, ঘরে তালা দিয়া নূরজাহান যখন চাঁদের আলোয় তাদের ছোট্ট উঠান পার হইয়া নিজের ঘর থেকে বড়ঘরের দিকে পা বাড়াল, নূরজাহানের ক্যান যে মনে হইল জামাইবাড়ি থিকা চিরদিনের জন্য বাপের বাড়িতে চইলা যাইতাছে সে। এই জামাইবাড়িতে য্যান, জামাইর ঘরে য্যান এই জীবনে তার আর কোনওদিন ফিরা হইব না।
.
কয়েকদিনের মধ্যেই দেশগ্রামের সবাই জাইনা গেল রব্বান নাই, রব্বান নূরজাহানরে ফালাইয়া উধাও হইয়া গেছে। তার চায়ের দোকান প্রথম প্রথম কয়েকদিন বাদলা চালাইছে। দুই একদিন দবির নিজে গিয়াও চালানের চেষ্টা করছে। সে চা বানাইতে পারে না, বাদলার হাতের চাও তেমন সুবিধার না। গাহেক কমতে শুরু করল। তারা আসত রব্বানের হাতের চা খাইতে। এখন রব্বান নাই, বাদলার হাতের চা পয়সা দিয়া কিন্না কে খাইব!
শেষ তরি দোকানে তালা মাইরা দিল দবির।
ততদিনে রাস্তার কাজ পুরাপুরি শেষ। উদ্বোধন হইয়া গেছে। রাস্তার ধারে লাগানো। বাবলাগাছগুলি বড় হইতে শুরু করছে। বাস ট্রাক মিনিবাস বেবিট্যাক্সি টেম্পো রিকশা, গাড়ি মোটরসাইকেল দিনরাইত চব্বিশ ঘণ্টা চলাচল করছে। পুরা এলাকা এখন টাউন। এলাকার পুরানা মানুষজনরাও যেন নতুন হইয়া গেছে। বিজলি বাতি আইসা পড়ছে। ঘরে ঘরে টেলিভিশন চলে, ফ্রিজ চলে। মাওয়ার বাজারে ভিসিআরে ইন্ডিয়ান সিনামা দেখায় জামাল। বিরাট রোজগার তার। এক সিনামা বিশটাকা। মদ গাঁজার ব্যাবসাও শুরু হইছে। কত দোকানপাট, কত নতুন নতুন মানুষ। রিকশাআলারা বেশির ভাগই চরের। ওইপার থেকে পদ্মা পাড়ি দিয়া এইপারে আইসা রিকশাআলা হইছে। দেশগেরামের গিরস্তবাড়িতে ঘরদুয়ার এখন ঢাকার টাউনের মতন ভাড়াও দেওয়া যায়। মাসে একশো-দুইশো টাকা। ভাড়া। নূরজাহান-রব্বানের ঘরটা ভাড়া নিতে আসছিল চরের এক রিকশাআলা মমরেজ। দেশশো টাকা ভাড়া কইছিল। দবির কোনও কথা বলে নাই, নূরজাহান সরাসরি না কইরা দিছে। তার তখনও আশা, রব্বান ফিরা আসব। একদিন না একদিন ফিরা আসব। নূরজাহানরে ছাইড়া সে থাকতে পারব না।
নূরজাহানের মুখের দিকে এখন আর তাকানো যায় না। প্রথম জীবনের সেই চঞ্চল মেয়েটা তো নাইই, বিয়ার পর ভরভরন্ত সুন্দর শরীর চেহারার মেয়েটাও নাই। মুখটা শুকনা, চোখ দুইটা গর্তে, চালচলন ধীর, যেন বাইচা থাকতে হইতাছে বইলা বাইচা আছে। তার নাইতে ইচ্ছা করে না, খাইতে ইচ্ছা করে না। একটু সাজগোজ, মাথায় তেল পানি খোঁপা বেণি, না কিচ্ছু ইচ্ছা করে না নূরজাহানের। আর মুখটা এত দুঃখী, এত অসহায়। মেয়ের মুখের দিকে তাকালে বুক ফাইটা যায় দবিরের। মেয়ের জন্য দবির-হামিদা দুইজনই গোপনে কান্দে। আর আল্লারে বলে, আল্লাহ আমার মাইয়ার জীবন তুমি এমুন করলা ক্যা? কোন গুণা আমার মাইয়ায় করছে? কোন গুণা আমরা করছি আল্লাহ, যেই গুনার শাস্তি এমতে তুমি আমগো দিতাছো? আমার মাইয়ারে দিতাছো?
আর নূরজাহান!
বড়ঘরে বিয়ার আগে যেভাবে সে থাকত আবার সে ফিরা গেছে সেই জীবনে। জানালার ওইদিকটায় মুখ মাথা আঁচলে ঢাইকা দুপুরবেলা শুইয়া থাকে, রাতেরবেলা শুইয়া থাকে। ঘুম তার আসেই না। শুধু রব্বানের কথা, শুধু রব্বানের স্মৃতি মনে আসে। রাইত কাইটা যায় কানতে কানতে, বালিশ ভিজে চোখের পানিতে। দিনেরবেলা কখনও কখনও নিজের ঘরটায় গিয়া বইসা থাকে। রব্বানের বালিশটা হাতায়, বিছানাটা হাতায়। এখনও যেন ওই ঘরে আসলে রব্বানের গায়ের গন্ধটা পায়, ঘরের চারদিকে রব্বানের কত স্মৃতি। বাঁশঝাড় তলার ওদিকটায় বিকালের দিকে কোনও কোনওদিন গিয়া নাড়ার পালায় ঢেলান দিয়া দাঁড়ায়া থাকে। মনে পড়ে সেই জ্যোৎস্না রাইতটার কথা, সেই গভীর আনন্দের কথা আর আসামের জঙ্গলের সেই জ্যাটিঙ্গা পাখির কথা। কেন আত্মহত্যার কথা বলেছিল রব্বান? তাইলে কি সে এই বাড়ি থিকা দূরে কোনখানে গিয়া সেই কামটাই করছে? আত্মহত্যা? বাইচা নাই সে? ক্যান এইটা সে করবো? নূরজাহান কি তারে সুখী করতে পারে নাই? সে যেভাবে যা চাইছে, রমিজ ঘটক যেভাবে যা বলছিল দবির তো সেইভাবেই সব কইরা দিছিল। রব্বানরে। মতের কোনও অমিল ওইসব ক্ষেত্রে হয় নাই। দবির-হামিদা তারে জানটা দিয়া আদর করছে। নূরজাহানের মনের মধ্যে গোপনে রইয়া গেছে মজনু। সেই গোপন কথা নূরজাহান ছাড়া দুনিয়ার কেউ জানে না। সেই মানুষটার কথা চাইপা মনের মধ্যে রাইখাই তো রব্বানরে স্বামী হিসাবে মাইনা নিছে নূরজাহান। তারে বুঝতে দেয় নাই কিছুই। শরীর মন সব দিয়া মানুষটারে সে ভালবাসছে! তারপরও এইভাবে তারে সে ছাইড়া গেল?
চোখের পানিতে ভাসতে ভাসতে নূরজাহানের কোনও কোনও দিন মনে হয়, আল্লায় কি মজনুর লেইগাই এই শাস্তি তারে দিল? ভাল একজন মানুষ স্বামী হিসাবে দিয়া তারে ফিরায়া নিল মজনুর কারণে! নূরজাহানের মনের মধ্যে একটুখানি হইলেও রইয়া গেছে মজনু। এইটা তো গুনা। স্বামী ছাড়া অন্য কেউ মুসলমান মাইয়াগো মনে থাকতে পারে না। এই গুনার জন্যই কি রব্বানরে আল্লায় নূরজাহানের জীবন থিকা সরায়া দিল!
নূরজাহান মনে মনে আল্লাহকে ডাকে। আল্লাহ, আল্লাহ তুমি আমারে মাফ কইরা দেও। আমি আমার মন থিকা মজনুরে মুইছা ফালামু। তুমি তো জানোই সব। মজনুর লগে আমার কোনওদিনও কিছু হয় নাই। সে আমারে ভালবাসে আমি তারে ভালবাসি এমুন কথাও কোনওদিন হয় নাই। তার মনের খবরও পুরাপুরি আমি জানি না। আমি জানি আমার মনের খবর। হ, তারে আমার ভাল লাগত। আমি চাইছি, মনে মনে চাইছি তার লগে আমার বিয়া হউক। হয় নাই। মাইনষের হায়াত মউত রিজিক দৌলত বিয়া সবঐত্তো তোমার হাতে। তোমার ইশারায়ঐ রব্বনের লগে আমার বিয়া হইছে। বিয়ার পর মজনুরে আমি একদিন দেখছি, সে দেখছে আমারে। তার মনে কী হইছে আমারে দেখনের পর হেইডা আমি জানি না, আমি জানি আমার মন। আমার মনডা তার লেইগা ইট্ট খারাপ হইছিল, সেইটাই আমার গুনা। আল্লাহ আমার ওই গুনা মাফ কইরা তুমি আমার স্বামীরে ফিরত আইন্না দেও আল্লাহ। জিন্দেগিতে আমি আর কোনওদিন মজনুর কথা ভাবুম না। কোনও পরপুরুষের কথা ভাবুম না। তুমি আমারে মাফ। করো আল্লাহ, মাফ করো। এত সুখের জীবন দিয়া সেই সুখ তুমি ফিরাইয়া নিয়ো না।
বিয়ার পর রব্বানরে নিয়া হাজামবাড়ি বেড়াইতে গেছে নূরজাহান, গাওয়ালবাড়ি, মেন্দাবাড়ি গেছে। যারা রব্বানরে দেখে নাই তাগো জামাই দেখাইয়া আনছে। রব্বানরে বেবাকতে পছন্দ করছে। কইছে বড় ভাল জামাই পাইছে নূরজাহান।
মিয়াবাড়িতে নিয়া গেছিল কুট্টিরে দেখাইতে। আলফু তো বিয়ার মধ্যে ছিলই। কুট্টি আসতে পারে নাই, মাত্র কয়দিন আগে তার আহুজ পড়ছে। পোলা হইছে। রব্বানরে নিয়া এক বিকালে মিয়াবাড়ি গেছিল নূরজাহান। কুট্টি-আলফুর ঘটনা রব্বানরে সে আগেই সব বলছিল। কুট্টি কেমুন পাগল হইয়া গেছিল আলফুর লেইগা, সব বলছিল। শুইনা রব্বান বলছিল, আমি কোনওখানে চইলা গেলে, দশদিনের কথা কইয়া গিয়া যুদি দেড়মাস বাদে ফিরা আহি তয় কি তোমার অবস্থাও হইব কুট্টির মতন?
রব্বানের চোখের দিকে তাকায়া নূরজাহান বলছিল, আমার অবস্থা কুট্টির থিকাও খারাপ হইব। তোমারে ছাইড়া একটা দিনও আমি থাকতে পারুম না।
রব্বানরে দেইখা কুট্টিও খুশি। কুট্টির কোলে তার পোলা। সেই পোলা দেইখা পঞ্চাশটা টাকা দিছিল রব্বান। কুট্টি ও আলফু দুইজনেই খুশি। বড়বুজান তখন বাড়িতে নাই। তার শরীর বেশি খারাপ দেইখা রাজা মিয়া নিজে হাসপাতালের গাড়ি নিয়া আইসা ঢাকায় নিয়া গেছে। ঢাকা থেকে সে আর ফিরে নাই। কয়েকদিন বাদে হাসপাতালেই মারা গেছে। তারপর বাড়িতে আইসা রাজা মিয়ার মা’য় কুট্টি আর আলফুরে সংসার বুঝাইয়া দিয়া গেছে। এখন বাড়ির মালিক বলতে গেলে কুট্টি আর আলফুই। কুট্টি তার পোলার নাম রাখছে। নয়ন। রব্বানের দেওয়া পঞ্চাশ টাকা হাতে নিয়া বলছিল, পোলাডা যহন হাঁটতে শিখবো। তহন এই টেকা থিকাঐ মাজার ঝুনঝুনি কিন্না দিমু। সোনার ঝুনঝুনি তো এই টেকায় অইবো না। এই টেকার লগে আর কিছু টেকা ভইরা রুপার ঝুনঝুনি বানাইয়া দিমু।
নূরজাহান তারপর থেকে আশায় আশায় থাকে, প্রতিদিন অপেক্ষা করে, এই বুঝি কালো ব্যাগটা কান্ধে নিয়া রব্বান আইসা তার নাম ধইরা ডাকে। নূরজাহান, ও নূরজাহান। এই যে দেখো আমি আইসা পড়ছি।
আলফু যেভাবে কুট্টির কাছে ফিরছিল, নূরজাহানের মনে হয় ঠিক সেইভাবেই একদিন তার কাছে ফিরা আসব রব্বান।
.
তুমি কি এইভাবে বইয়া থাকবা না কিছু করবা? মাইয়াডার মুখের মিহি তো আমি চাইতে পারি না।
দুপুরের ভাত খাইয়া তামাক নিয়া বড়ঘরের ছনছায় বসছে দবির। নূরজাহান শুইয়া আছে। বড়ঘরের পুব দিককার জানালার ওই দিকটায়। আঁচলে মুখ ঢাকা। তবে ঘুমায় নাই।
হামিদার কথা শুইনা দবির কাতর গলায় বলল, কী করুম কও? কোনও পথ তো। দেখতাছি না। আইজ দেড় মাসের উপরে অইয়া গেল। কোনওহানে তো আর বিচড়ান বাকি রাখলাম না। মানুষ হারায়া গেলে তারে কি আর বিচড়াইয়া বাইর করন যায়!
রমিজ ঘটকের কাছে গেছালা?
তিনবার গেলাম। কয় আমি কী করুম কও? ভাল পোলা দেইক্কা, বেবাক খোঁজ খবর লইয়া তোমার মাইয়ার বিয়ার ববস্তা করলাম, এক বছরের বেশি পার করল যেই পোলা, এত সোন্দর কইরা সংসার করলো, দোকান চালাইলো, হেই পোলা এইভাবে নিরুদ্দিশ হইয়া যাইবো এইডা কেঐ চিন্তা করছে, কও? আমি ঘটকারে কইলাম, অহন। তাইলে কী করুম? ঘটকায় কইলো, আমিও তো কইতে পারি না কী করবা? পরের বার কইলাম, তুমি যে মালখানগরে গেছিলা, যেই খোঁজখবর লইয়া আইছিলা, বেবাক খবর ঠিক আনছিলা তো? ঘটকায় আমার উপরে চেইত্তা গেল। তয় মিছা খবর আনছিলামনি? আমার কথায় সন্দ হইলে মাইয়া বিয়া দিছিলা ক্যা? নিজে গিয়া খোঁজখবর লও নাই ক্যা?
হামিদা বলল, আসলে আমগো নিজেগোঐ খোঁজখবর লওন উচিত আছিল। ঘটকারা হইল বাটপার, মিথ্যুক। হাছাকথা কয় কম।
তারপর আরেকদিন যহন দেহা অইলো, মাওয়ার বাজারেঐ দেহা হইল, আমারে জিগাইলো জামাইর সমবাত পাইছোনি গাছি? কইলাম, না ঘটকায় হায়আপশোস করল। পোলাডারে এত ভাল দেকলাম, হেই পোলায় এমুন কারবার করবো এইডা কে চিন্তা করছে? তোমার মাইয়ার কপালডাঐ খারাপ। মন্নাইন্না শালার পো শালায় এমুন কুফরি কালাম মাইরা রাখছে, তোমার মাইয়ার জীবনে সুখশান্তি শালায় হইতে দিবো না। আর ওই দিকে দেহো গা শালার সংসারে খালি উন্নতি হইতাছে। বিরাট টেকা পয়সা সোনাদানা লইয়া আতাহাররে বিয়া করাইছে। ভাবির লগে সমন্দ আছিল, তিনহান পোলাপান ভাবির ঘরে অর নিজের, তারবাদেও এত টেকাপয়সাআলা বড়লোকের মাইয়া বিয়া করল। মাইয়াডা। ট্যারা। পয়লা পয়লা বউডারে একদম দেকতে পারতো না। তারবাদে বিরাট খাতির হইয়া গেল বউর লগে। বাপের বাড়ি থিকা ভাইগো কাছ থিকা আরও টেকা আইন্না দিল বউয়ে। বউয়ের টেকায় ঢাকা-মাওয়া লাইনে বাস নামাইছে আতাহারে। বউয়ের নামে বাসের নাম দিছে। কমলা একপেরেছ (এক্সপ্রেস)। অহন বাসের কারবার কইরা লাক লাক টেকা কামাইতাছে আতাহারে।
হামিদা বিরক্ত হল। ওই শুয়োরের পোগো কথা আমি শুনতে চাই না। তুমি অহন কী করবা? আমার মাইয়া কি মইরা যাইবোনি? খাওন দাওন ছাইড়া দিছে, নাওন ধোওন ছাইড়া দিছে। রাইতে ঘুমায় না। খালি কান্দে।
তামাক টানা রাইখা একটা নিয়াস ছাড়ল দবির। কী করি কও তো?
হামিদা আচমকা বলল, তুমি একবার মালখানগর যাইবা?
দবির অবাক হইয়া হামিদার মুখের দিকে তাকাল। মালখানগর?
হ।
মালখানগর গিয়া কী করুম?
খোঁজখবর লইলা?
মালখানগরে কী খোঁজখবর লমু কও? ওই গেরামে তো অর যাওনের কথা না। জানের ডর আছে না?
হেইডা তো ও কইছিল!
ঘটকায়ও তো খোঁজখবর লইয়া ওই এককথাই কইছিল।
অহন ক্যান জানি ঘটকার কথা আমার বিশ্বাস অয় না। মনে অয় তার কথায় ভেজাল আছে। আমার কয়দিন ধইরা মনে অয় রব্বান আর ঘটকায় দুইজনেই আমগো কাছে বেবাক হাছাকথা কয় নাই।
দবির আবার তামাক টানতে লাগল। অনেক্ষণ টাইনা নাকমুখ দিয়া ধুমা ছাড়তে ছাড়তে বলল, মালখানগর গিয়া আবার উলটা কোন বিপদে পড়ি?
কীয়ের বিপদ?
শিকদাররা যুদি বোজে যে আমি রব্বানের হৌর, তারে বিচড়াইতে গেছি…।
দবিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই হামিদা বলল, ভোদাইয়ের (বোকা) লাহান কথা কইয়ো না। রব্বানের হৌর পরিচয় দিয়া তুমি যাইবা ক্যা? তুমি মালখানগর গিয়া মাইনষের কাছ থিকা রব্বানের খোঁজখবর লইবা। জাননের চেষ্টা করবা সে আর ঘটকায় যা যা কইছে বেবাক ঠিক আছে কি না?
ঠিক থাকলে লাবটা কী হইবো, ঠিক না থাকলেই বা লাবটা কী হইবো? রব্বানরে যুদি ফিরাই না পাই তয় লাবটা কী?
কথা ঠিক। তয় আমার ক্যান জানি মনে অয় তুমি নিজে মালখানগর গেলে কোনও না কোনও খবর বাইর করতে পারবা। রব্বানের কি স্বভাবই এই রকমনি যে কিছুদিন পর পর কোনও জাগা ছাইড়া পালায়? মালখানগর ছাইড়া আগেও কোনওহানে পলাইছিলোনি? আগেও কোনহানে গিয়া বিয়াশাদি কইরা তারবাদে এমুন নিরুদ্দিশ অইয়া গেছেনি?
মা-বাবার কথা সবই শুনছিল নূরজাহান। শেষ দিককার কথা শুইনা তার মনটা হাহাকার কইরা উঠল। না না, হেয় মনে অয় ওইপদের মানুষ না। নরম মায়াভরা মনের মানুষ। তয় মনের মইদ্যে ইকটু পাগলামি ভাব আছে। ওই যে জ্যোৎস্না রাইতে করল, তারবাদে জ্যাটিঙ্গা পাখির কথা কইলো, ওইডা হইল পাগলামি। হেদিন মনে অয় তার উপরে কিছুতে আছর করছিল। বদ হাওয়া লাগছিল গায়।
তারপরই আরেকখান কথা মনে হইল নূরজাহানের। আক্কাস ফকিররে দিয়া একবার জিন ডাক দেওয়াইয়া দেহন যায় না জিনেরা কী কয়? আমিন মুনশি সাহেবও কইতে পারে অনেক কিছু। মাওয়ার হিন্দু পাড়ায় এক গণক ঠাকুর আছে। হেয় গইনা কইয়া দিতে পারে বেবাক কথা। সীতারামপুরের মোসলেম কারিগরও কইতে পারে। আমার মা-বাপে এই হগল চিন্তা করতাছে না ক্যা? তাগো কাছে যায় না ক্যা? জিন ডাক দেয় না ক্যা?
নূরজাহান ঘর থেকে বাইর হইল। মা-বাপের সামনে আইসা খাড়ইল। বাবা, একবার জিন ডাক দিয়া দেহো। আমিন মুনশি সাবরে ধরো। গণক ঠাকুরের কাছে যাও। মোসলেম
কারিগরের কাছে যাও। দেহো তারা কে কী কয়?
হামিদা আর দবির দুইজন একলগে চাইল নূরজাহানের দিকে। এতদিনে এই প্রথম নূরজাহান নিজ থেকে কিছু কইল এই বিষয়ে। শুইনা দবির হামিদা দুইজনেঐ মাইয়ারে বুঝ দিল। দবির বলল, আইচ্ছা মা আইচ্ছা, আমি ববস্তা করতাছি। দুই-একদিনের মদ্যেই জিন ডাক দেওনের বন্দবস্ত করতাছি। কাইলঐ আমিন মুনশি সাবের কাছে যামু, গণক ঠাকুর আর মোসলেম কারিগর তিনজনরেই কাইল ধরতাছি আমি।
হামিদা বলল, তয় কাইল রাইত্রেঐ জিন ডাক দেওনের বন্দবস্ত করো।
দেহি পারলে কাইলঐ করুম।
তারপরের দুই-তিনদিনের মধ্যে সবই করা হইল। গণক ঠাকুর বালি মাটিতে কাঠি দিয়া ঘর কইরা কী কী অঙ্ক করল। কইরা বলল, রব্বান বাইচা আছে। ভাল আছে। ফিরত আসা যাওয়ার মইধ্যে একটু ঝামেলা দেখা যাইতাছে। মোসলেম কারিগর এক রাইত ধ্যানে বসল। নিজের বাড়িতে, পরদিন বলল, আছে ভাল। তয় দুইদিন আগে পরে ফিরত রব্বান আসবো। আক্কাসের জিনরা দুইপদের শিকড় বাকড় দিয়া গেছে। কালো গোরুর দুধের লগে রাত্রে শোয়ার। আগে এগারো দিন ভিজাইয়া ভিজাইয়া খাইতে হইব। খাইলে কন্যার মনের আশা পূরণ হইব। জামাই ফিরত আসতে বাইধ্য। আমিন মুনশি সাহেব একটা তাবিজ দিলেন কাইতান দিয়া ডাইনহাতে বাইন্ধা রাখার জন্য। টাকা পয়সা এইসব কাজে ভালই খরচা হইল দবিরের।
যে যা বলছে সেইভাবেই সব করতে লাগল নূরজাহান। কালো গোরুর দুধ দিয়া জিনদের। দেওয়া শিকড় বাকড় ভিজাইয়া ভিজাইয়া খাইল এগারো দিন, মুইশি সাবের তাবিজ বানল ডাইন হাতে।
দিন যায়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। রব্বানের কোনও হদিসই নাই।
জষ্ঠিমাসের শেষদিকে ত্যাক্ত বিরক্ত হইয়া হামিদা আবার দবিরকে ধরল। বেবাক চেষ্টাই তো করা হইল, কাম তো হইল না কিছুই। বাদ দেও এই হগল। তুমি আমার কথা হোনো। মালখানগর যাও। আমি আবারও কইতাছি ওই গেরামে গেলে কিছু খবর তুমি পাইবা। জামাইরেও পাইয়া যাইতে পারো।
ততদিনে নূরজাহান শুকাইয়া কাঠ হইয়া গেছে। কথাবার্তা তেমন বলেই না। বাড়ি থেকে বাইর হওয়া ছাইড়াই দিছে। এই মুখ কেরে দেখাইতে ইচ্ছা করে না। দেশগেরামে বইটা গেছে জামাই নূরজাহানরে হালাইয়া থুইয়া পলাইছে। মান্নান মাওলানার মতন পরহেজগার লোকের মুখে ছ্যাপ দিছিল, এইডা বিরাট গুনার কাম। আল্লায় হেই গুনার শাস্তি অরে দিতাছে। তারপরও গুনা মাপ হইয়া যাইত যুদি মান্নান মাওলানার পোয়রাসতাবে রাজি হইয়া যাইত। মান্নান মাওলানা বিয়া করতে চাইছিল নূরজাহানরে। তার লগে বিয়া হইলে গুনা মাপ তো হইতোঐ, সুখেও থাকত। টেকাপয়সা ঘরবাড়ি গয়নাগাটি, কোনও কিছুর অভাব থাকত না।
এইসব কথা দবির-হামিদার কানে তো আসেই, নূরজাহানের কানেও আসে। ভিতরে ভিতরে শরমে য্যান মইরা আছে নূরজাহান। দেশগেরামে যেই মাইয়ারে জামাইয়ে হালাইয়া পলায় হেই মাইয়ার বদলামের সীমা থাকে না। নূরজাহান এখন মেদিনীমণ্ডল গ্রামের সবচাইতে বদলামি মাইয়া। এই শরমের মুখ নূরজাহান কারে দেখাইব?
শেষ তরি একদিন বিয়াইনা রাইতে মালখানগর মেলা দিল দবির।
.
মালখানগর বড় মাঠটার উত্তর দিকে রাস্তার ধারে কয়েকটা চায়ের দোকান। জষ্টিমাসের দুপুরবেলা সেই মাঠের ধারে আসল দবির। দুপুর হইয়া গেছে। খিদা লাগছে ভালই। ভাত খাইতে পারলে ভাল। না হইলে কোনও মিষ্টির দোকানে বইসা চাপাটি রুটি আর নাইলে পরোটা মিষ্টি, নাইলে দই মিষ্টি খাইয়া পেটটা এখন ভরাইতে হইব। তারপর এককাপ গরমা গরম চা খাইয়া, টাইট হইয়া শিকদার বাড়ির খোঁজখবর লইব। বাড়িঘর আর লোকজনের খবরাখবর লওনের জন্য দেশগ্রামের চায়ের দোকানগুলি হইতাছে আসল জায়গা।
দবির একটা চায়ের দোকানের সামনে আইসা দাঁড়াইল। দুপুরবেলা দোকানটায় ভাত তরকারিও বিক্রি হয়। কয়েকজন দীন দরিদ্র মানুষ নলা মাছের লাল টকটকা ঝোল দিয়া। ভাত খাইতাছিল। দবির সেই দোকানে ঢুকল। নলা মাছের তরকারি দিয়া পেট ভইরা ভাত খাইল তারপর চায়ের অর্ডার দিয়া জেব থেকে কেঁচি সিগ্রেটের প্যাকেট বাইর কইরা একটা সিগ্রেট ধরাইল। ক্যাশে বসা দোকানের মালিক দবিরের বয়সিই হবে। মুখে কাঁচাপাকা দাড়িমোচ, মাথায় টুপি। পরনে সাদা পাঞ্জাবি। মুসল্লি টাইপের মানুষ। দবিরকে খুবই খেয়াল কইরা দেখছিল লোকটা। ভাত খাওয়া শেষ কইরা দবির সিগ্রেট ধরাইছে দেইখা জিজ্ঞাসা করল, মিয়াভাই, কোন গেরামের মানুষ আপনে? এইমিহি আগে কোনওদিন দেহি নাই তো, এর লেইগা জিগাইলাম। কিছু মনে কইরেন না।
দবির সিগ্রেটে টান দিয়া বলল, না কী মনে করুম? আপনের আন্তাজ ঠিকঐ আছে মিয়াভাই। আমি এইদিককার মানুষ না।
তয় কোন গেরাম আপনেগো?
বহুত দূরের গেরাম মিয়াভাই। মাওয়ার পাশে। গেরামের নাম মেদিনমণ্ডল।
ও। তয় মালখানগর আইছেন কোন বাইত্তে? নাকি এহেন থিকা অন্যকোনও মিহি যাইবেন?
না গো দাদা, এই গেরামেঐ আইছি।
কোন বাইত্তে যাইবেন?
শিকদারবাড়ি। তয় শিকদার বাড়িডা চিনি না। কোন মিহি কইতে পারেন? হুনছিলাম বোসের বাড়ির উত্তর দিককার দিঘির পারে।
ঠিকঐ হোনছেন। বোসের বাড়ির উত্তর দিককার দিঘির পুব পাশেই শিকদারবাড়ি। শিকদারবাড়ির কার কাছে যাইবেন? কোন শিকদারের কাছে যাইবেন?
রব্বান নামটা প্রায় মুখে আইসা পড়ছিল দবিরের। বুদ্ধি কইরা চাইপা রাখল। বলল, রব্বানের মৃত বাবার নাম। আশ্রাবউল্লাহ শিকদার সাবের কাছে যামু।
ও আইচ্ছা।
দবির থতমত খাইল। মরা মানুষটার নাম শুইনা ভাত চায়ের দোকানদার ‘ও আইচ্ছা’ বলল ক্যান? ঘটনা কী? দবির বলবে নাকি, মিয়াভাই, আশ্রাবউলাহ শিকদার মইরা গেছে। তার কাছে যামু শুইনা আপনে দিহি কইলেন না, কেমতে যাইবেন? হেয় তো মইরা গেছে।
এইসব কথা বলতে গেলেই একটা পেচিঘুচি (প্যাঁচঘোচ) লাইগ্না যাইব। কোন কথায় কোন কথা বাইর হইব, কোন ভেজাল লাইয়া যাইব ভাইবা দবির আর কথাই বলল না। ভাত আর চায়ের দাম দিয়া দোকান থেকে বাইর হইল। সিগ্রেট টানতে টানতে বোসের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। গোড়ালির বেশ খানিকটা উপরে তুইলা পরছে লুঙ্গি, হাফহাতা ঝুলপকেটঅলা নীল শার্টের ওপর মাজায় বান্দা গামছা। খালি পা ধুলায় মাখামাখি হইয়া আছে।
শিকদারবাড়ির সামনে আইসা মরা মানুষ জেতা হইয়া ফিরত আসতে দেখলে মানুষ যেমন চমকায় দবির ঠিক তেমন কইরা চমকাইল। বাইর বাড়ির সামনে চৌদ্দ-পোনরো মাসের একটা বাচ্চা মাইয়া কোলে লইয়া পায়চারি করতাছে রব্বান। এত আদর করতাছে মাইয়াটারে, একবার চুমা দেয়, একবার মাথায় পিঠে হাত বুলায়, একবার এক কোল থেকে আরেক কোলে আনে। আদরে আহ্লাদে মাইয়া খলখল কইরা হাসে, তার লগে লগে হাসে রব্বান।
বাড়ির নামায় দাঁড়ায়া খানিকক্ষণ এই দৃশ্য দেখল দবির। প্রথম ধাক্কাটা সামলাইল। তারপর ধীর শান্ত পায়ে রব্বানের সামনে আইসা খাড়াইল!
দবিরকে দেখে যতটা অবাক হওয়ার কথা রব্বানের ততটা সে হইল না। হাসিমুখে বলল, আহেন কাকা, আহেন। আমি মনে করছিলাম আরও আগেঐ আইবেন। বহুত দেরি কইরা আইলেন। আছেন কেমুন? কাকি ভাল আছে? আর নূরজাহান? নূরজাহান কেমুন আছে? আমি তো আপনেগো কেঐরে কিছু না কইয়া পলাইয়া আইয়া পড়লাম। তয় নিজের জিনিসপত্র ছাড়া কইলাম কিছু আনি নাই। খালি আমার ব্যাগটা আনছি আর পুরানা কাপড় চোপড়ডি। টেকাপয়সাও আনি নাই।
ভিতর বাড়ির দিকে তাকায়া শেফালি শেফালি বইলা দুইটা ডাক দিল রব্বান। শেফালি নামের মেয়েটা প্রায় লগে লগে দৌড়াইয়া আসল। নূরজাহানের চেয়ে বয়সে পাঁচ-সাত বছরের বড় হবে। পরনে গিরস্তবাড়ির বউঝিদের সস্তা শাড়ি। রোগা পাতলা মাইয়া। গায়ের রং শ্যামলা। তবে হাসিখুশি আছে। রব্বানের ডাকে দৌড়াইয়া আইসা বলল, কী হইল, ডাক পারো ক্যা?
এই দেহো কেডা আইছে? এইডা হইল নূরজাহানের বাপ। গাছিকাকা। সেলাম করো, সেলাম করো। বহুত ভাল মানুষ। সেও ভাল, কাকিও ভাল। বহুত আদর করছে আমারে। আর নূরজাহানের কথা তো তোমারে কইছি। ভাল মাইনষের মাইয়া তো, সেও মানুষ ভাল। আমার খাতির যত্নের কোনও আকাল রাখে নাই।
শেফালি পায়ে হাত দিয়া খুবই বিনয়ী ভঙ্গিতে সালাম করল দবিরকে। ঘটনার কিছুই বুঝতে পারছে না দবির। শেফালি কে, রব্বানের কোলে বাচ্চাটিই বা কার! সে ফ্যালফ্যাল কইরা একবার রব্বানরে দেখে, বাচ্চাটা আর শেফালিরে দেখে। বাচ্চার চেহারা শেফালির মতন।
রব্বান বলল, কাকারে একখান জলচকি দেও বইতে। আর চা মুড়ি দেও। কাকা, দোফরে ভাত খাইছেননি? নাকি ভাত দিবো? দুফইরা ভাত আছে। তরকারিও আছে। দরকার হইলে দুইডা মুরগির আন্ডা ভাইজ্জা দিবো নে। খাইবেন?
দবির স্নান গলায় বলল, না বাজান, আমি ভাত খাইছি। চা মুড়িও খামু না। তোমার লগে কথা কমু।
শেফালি ততক্ষণে দুইটা জলচৌকি নিয়া আসছে। বাইর বাড়ির সামনে চৌকি দুইটা রাইখা বলল, এহেনে বইয়া কথা কইবা নাকি ঘরে গিয়া বইবা? মেজবান লইয়া বাইর বাইত্তে কেঐ বহেনি? কাকা, ঘরে লন। ঘরে গিয়া বইয়া কথা কন।
রব্বান বলল, তার আগে তুমি তোমার মাইয়ারে ধরো।
শেফালি মেয়ে কোলে নিল। মেয়ে রব্বানের কোল থেকে যেতে চায় না, শেফালি জোর কইরাই নিল।
রব্বান দবিরের দিকে তাকাল। জষ্টিমাসের সাই গরম পড়ছে কাকা। বিয়ালবেলা এইদিকটায় ভাল বাতাস লাগে। বোসের বাড়ির দিঘি থিকা ঠান্ডা বাতাস আহে। এর লেইগাঐ মাইয়া লইয়া এহেনে খাড়ইয়া রইছিলাম। শেফালি যে কইলো এহেনে বইবেন না ঘরে গিয়া বইবেন, অহন করবেন কোনডা? এহেনেঐ বইবেন না ঘরে যাইবেন?
দবিরের মুখ শুকনা, গলা দিয়া আওয়াজ বাইর হইতে চায় না। কোনওরকমে বলল, তার আগে তোমারে দুই একখান কথা জিগাইতে চাই বাজান?
রব্বান হাসল, কী জিগাইবেন আমি জানি কাকা। আমার কুলের মাইয়াডা কার? শেফালি কে? মাইয়াডা কাকা আমার। অর নাম হইল বকুল। ফুলের নামে নাম। অর মা’র নাম শেফালি দেইখা মাইয়ার নাম হইছে বকুল। নামডা আমি রাখি নাই। রাখছে আমার চাচায়। চাচা আবার শ্বশুরও। তার নামঐ আশ্রাব আলী শিকদার। তার তিনপোলা এক মাইয়া। আমার তো মা-বাপ ছোড কালেই মরছে। চাচায় আমারে মানুষ করছে। মানুষ কইরা এই বাইঐে রাইক্কা দিছে। একমাত্র মাইয়া শেফালিরে আমার কাছে বিয়া দিছে।
রব্বানের কথা শুইনা দবিরের মনে হইল মাথা ঘুরাইয়া এখনই সে মাটিতে পইড়া যাইব। মাথাটা এমুন একখান ঘুরান দিল। কোনওরকমে একটা জলচকিতে সে বসল।
তার অবস্থা খেয়াল করল রব্বান। মুখের হাসিটা আছেই। সেও বসল দবিরের মুখামুখি। আপনে মনে কষ্ট লইয়েন না কাকা। আমি আপনেগো গেরামে গিয়া বানাইয়া বানাইয়া বহুত কথা কইছি। যা কইছি ঘটনা তার উলটা। চাচায় আমারে আপনা পোলাগো মতনঐ আদর করে। কোনও কোনও সময় মনে অয় আপনা পোলাগো থিকাও বেশি আদর করে। আমার ভাগের জাগাসম্পিত্তি বেবাকতো আমারে দিছে, শেফালির ভাগেরটাও ভাগ কইরা দিয়া দিছে। এই যে এতবড় বাড়িডা দেখতাছেন, তিন পোলারে বাড়ির সীমানা আর যার যার ঘর ভাগ কইরা দিছে। জাগাসম্পিত্তি ভাগ কইরা দিছে। যে যার মতন আছে তারা। কেঐর লগে কেঐর শতরুতা নাই। বাড়ির বেবাক পোলাপানরে মনে হইব এক মা বাপের পোলাপান। চাচায় বুড়া থুরথুইরা হইয়া গেছে, তাও অহনতরি হেয় যা কয় বাড়িতে তাই হয়। যার যার সীমানা উঠান পালান ভিন্ন ভিন্ন। বাড়ির এই দিকটা হইল আমার। বিয়ালবেলা দেইক্কা বাইত্তে আপনে কোনও পোলাপান দেখতাছেন না। বেবাকতে গেছে মালখানগর মাঠে খেলতে। আমার মাইয়াডা ছোড দেইক্কা অরে কুলে লইয়া আমি বাইর বাইত্তে বাতাস খাওনের লেইগা খাড়ইয়া রইছি।
দবির কোনওরকমে বলল, এত কিছুর পর তুমি আমগো লগে এমুন করলা ক্যা? তোমার বউ মাইয়া আছে, শিকদারবাড়ির এমুন পোলা তুমি, তারবাদে ক্যান মেদিনমণ্ডল গিয়া কামলাগিরি করলা, ক্যান আমার মাইয়াডারে এমতে বিয়া করলা? একটা বছর থাকলা? আর ঘটকায়…
রমিজ ঘটকরে কাকা আমি টেকা খাওয়াইয়া মেনেজ করছিলাম। ফালতু লোক, ফালতু। টেকার লেইগা সব করতে পারে। আমার কাকা তহন মাথা খারাপ আছিল। তয় তার আগে আপনেরে আমি একহান কথা কই, হ, মিছাকথা কইয়া, আপনের মাইয়ারে আমি বিয়া করছিলাম, বহুত আদর যত্ন আপনেগো কাছ থিকা আমি পাইছি। বেবাক ঠিক আছে। তয় আইজ আপনের লগে আমি একহানও মিছাকথা কমু না। আমার ওই মাইয়াডার কিরা। আমার মাথা খারাপ অইছিল ক্যান জানেন? মাইয়াডার লেইগা, ওই বকুলের লেইগা। মাইয়া আমি দুই চোক্ষে দেখতে পারি না। বিয়ার পর থিকা আশা করছি পোলা হইব। হইল একটা মাইয়া। মাইয়া হইছে দেইক্কা আমার মাথা গেল খারাপ হইয়া। আমার খালি মনে হইল যেই বউ মাইয়া জন্ম দেয় হেই বউর লগে আমি থাকুম না, মাইয়ার মুখ আমি দেখুম না। বেবাক হালাইয়া আমি পলাইয়া গেলাম গা। আমার মাথাডা তহন সত্যঐ খারাপ। মালখানগর মিহি আমি আর কোনওদিন আমু না এইডাঐ চিন্তা। গেলাম আপনেগো ওই মিহি। গিয়া তো আপনের লগে পরিচয়। বিয়াশাদি কইরা থাইকা গেলাম।
বাচ্চা কোলে শেফালি আসল। রব্বানরে বলল, কাকারে লইয়া বাংলাঘরে গিয়া বহো। বারেকের মায় সেঐ (সেমাই) রানছে। লগে মুড়ি দিছে। সেঐ মুড়ি খাও। তারবাদে চা দিবো নে। আমি বারেকের মা’রে কইছি একটা মোরগ জব করতে, পোলাও রানতে। কাকারে রাইত্রে পোলাও মোরগ খাওয়ামু। আহো।
রব্বান বলল, লন কাকা, বাংলাঘরে লন। আমার বাড়ি দেহেন, সংসার দেহেন।
এই অবস্থায় কেমন কইরা কথা বলে মানুষ! কেমন কইরা লড়াচড়া করে! দবিরের তখন শুধু মনে হচ্ছে তার শরীরে জোরবল নাই। বুকের ভিতরে কইলজাটা ফাইটা গেছে। রক্ত চলাচল বন্ধ। হাত পা চলতাছে না। উইঠা যে দাঁড়াইব, বাংলাঘর তরি হাইটা যাইব সেই শক্তি নাই। শুকনা গলায় শেফালিকে না, রব্বানকে বলল, না আমি ঘরে যামু না। এহেনেঐ ইট্টু বহি। রাইত্রে আমি থাকুম না, মোরগ পোলাও আমার গলা দিয়া নামবো না। রানতে না করো।
আরে আমি না করলেই শেফালি হোনববানি? অরে আপনে চিনেন না। বহুত ভাল মাইয়া। নাইলে ফিরত আইসা আমি যখন পুরা ঘটনা বললাম, বিয়াশাদি করছিলাম, একবছর এক মাস নতুন বউর লগে ঘরজামাই থাকছি, ভাল মাইয়া না হইলে এই হগল কেঐ মাইন্না। লয়? মুইড়া পিছাদা পিডাইয়া আমারে বাইত থিকা বাইর কইরা দিতো না? আমার চাচায় আর সমন্দিরা বহুত চেতা চেতছিল। আমারে বাইত্তে উটতেঐ দিত না। তাগো সামলাইলো। শেফালি। কইলো আমার স্বামীর ভুল যুদি আমি মাইন্না লইতে পারি তয় তোমগো অসুবিদা। কী? হেয় যা করছে, কইরা হালাইছে, আমি তারে মাপ কইরা দিছি। সে আমার মাইয়ার বাপ। আমি তার লগেঐ সংসার করুম। মাইয়া যুদি ওই কথা কয় তয় বাপে কী কইবো, ভাইরা কী কইবো? লন কাকা, বাংলাঘরে লন। সে মুড়ি খান। রাগ কইরেন না। আমি তো আপনের পোলার মতন। পোলায় কোনও ভুল কইরা হালাইলে তারে কোনও বাপে মাপ না কইরা পারে!
দবিরের হাত ধরল রব্বান। লন কাকা, লন।
দবির না, দবিরের লাশ যেন উইঠা দাঁড়াইল। বাংলাঘরের দিকে আসতে আসতে নিজের অজান্তেই যেন শিকদার বাড়ির রব্বানের অংশটা দেখল দবির। সুন্দর ছিমছাম লেপাপোছা একখান উঠান। উঠানের পুবপাশে বড়ঘর, পশ্চিম পাশে বাংলাঘর। উত্তর দিকে অনেকখানি কইরা ফাঁকা জায়গা তারপর বড় বড় ঘর। বোঝা যায় শেফালির তিন ভাইয়ের ঘর দুয়ার ওইদিকে। শেফালির বড়ঘরের পাশেই রান্নাঘর, রান্নাঘরের পাশে আমগাছতলায় চাপকল। স্বচ্ছল গিরস্তবাড়ি। বড় বাড়ি বলে লোকজনের সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কম।
বাংলাঘরে ঢুইকা দবির দেখে চৌকিতে দস্তরখান বিছানো। তার উপর চিনামাটির গামলায় দুধ সেমাই, আরেক গামলায় মুড়ি আর দুইখান রেকাবি। পানির জগখান কাঁচের, দুইখান পরিষ্কার কাঁচের গেলাস।
রব্বান বলল, হাতমুখ ধুইবেন নি কাকা?
দবির মরার মতন বলল, আমার কিছুই করতে ইচ্ছা করছে না। আমার মনে হইতাছে আমি বাঁইচা নাই, আমি মইরা গেছি।
রব্বান তার হাত ধরল। এত ভাইঙ্গা পইড়েন না কাকা। মাইনষের জীবনে কতকিছু ঘটে। ঘটনা তো খালি আপনের জীবনে, কাকি আর নূরজাহানের জীবনে ঘটে নাই, আমার জীবনেও তো ঘটছে। সবঐ আমগো কপালের দোষ। আর আমি তো ফিরা আইলাম কাকা আপনের লেইগা।
দবির অবাক। আমার লেইগা?
হ।
কেমুন?
নূরজাহান বিয়ার লাইক (লায়েক) মাইয়া। তাও অতবড় মাইডারে আপনে নাননা বাচ্চার মতন কুলে বহাইয়া আদর করতেন। বিয়ার দিন দেখলাম, তার পরও দুয়েকদিন দেখছি যে মাইয়ার লেইগা বাপের কী টান। মাইয়ারও কী টান বাপের লেইগা। যহনঐ আপনে নূরজাহানরে কুলে বহাইয়া আদর করতেন, আমি আনমনা হইয়া যাইতাম। আমার খালি মনে পড়ত আমার মাইয়াডার কথা। বকুলের কথা। অর তো কোনও দোষ নাই? অরে তো জন্ম দিছি আমি? মাইয়াডার অপরাধ কী? অরে হালাইয়া আমি ক্যান চইলা আইলাম? কোন ভূতে আমারে ধরল যে আমি আরেকখান বিয়া করলাম, আরেকখান মাইয়ার জীবন নষ্ট করলাম, নিজের জীবনও নষ্ট করলাম! এই দিকে নষ্ট করলাম শেফালির জীবন, আমার ছোট্ট মাইয়ার জীবন। আমার মাথাডা আবার খারাপ হইয়া গেল কাকা। আমি আপনের বাড়ি থিকা পলাইলাম। ফিরত আইসা আমি বেবাক স্বীকার করলাম শেফালির কাছে, আমার মাইয়াডারে ওই পয়লা কুলে লইলাম। কুলে লইয়া কইলজাড়া ফাইট্টা গেল আমার। হায় হায় নিজের মাইয়া হালাইয়া এমতে পলাইয়া গেছিলাম গা আমি? এইডা আমি কী করছি? শেফালি বহুত কানলো। আমিও বহুত কানলাম। তারবাদে শেফালি আমারে মাপ কইরা দিলো। কাকা, পুরুষ পোলাগো তুলনায় মানুষ হিসাবে মাইয়ারা অনেক ভাল। শেফালি যুদি আমারে মাপ না করতো তয় অর ভাইরা আমারে পিডাইয়া মাইরা হালাইতো। আপনে আইয়া আমারে দেখতেন কবরে।
একটা পিতলের চিলমচি দেওয়া আছে একপাশে। দবিরের ডাইন হাত টেনে রব্বান জগের পানি দিয়া তার হাত ধোয়াইয়া দিল। হাত ধোন কাকা, হাত ধোন। মনে কষ্ট নিয়েন না। কী করুম কন? আমরা কহেকজন মানুষ কপালের ফ্যারে পইড়া গেছিলাম। তয় আপনের কাছ থিকা আমি একহান জিনিস হিগছি কাকা, মাইয়ারে আদর করতে হয়। কেমতে? আপনের কইলজা যেমুন নূরজাহান, অহন আমার কইলজা হইল আমার বকুল। হাত ধুইয়া এই লন গামছা, হাত পুঁইচ্ছা (মুছে) সেঐ মুড়ি খান। মনে করেন আমি আপনের পোলা। পোলায় একহান বিরাট অন্নাই কইরা হালাইছে। অহন কি তারে আপনে মাইরা হালাইবেন? আর মারতে চাইলে এই যে আমার সেনটেল (স্যান্ডেল), সেনটেল দিয়া আমারে বাইড়ান। আমার গাল মুখ ফাডাইয়া হালান মাইরা।
দবিরের ভিতরে তখন রাগ ক্রোধ বইলা কিছু নাই। অসহায় এক কষ্টে বুক ঠেইলা উঠতে চাইছে গভীর কষ্টের কান্না। চক্ষু দুইটা ফাইটা যাইতে চাইতাছে। এই অবস্থায় কেমন কইরা সেঐ মুড়ি খাইব সে? এইটা কি সম্ভব?
রব্বান তার রেকাবিতে সেমাই তুইলা দিছে। মুড়ি দিছে। রেকাবি তার দিকে আগায়া দিয়া বলল, খান কাকা খান। ইট্ট হইলেও মুকে দেন। আমি বুজতাছি এই অবস্থায় মাইনষে কিছু খাইতে পারে না। তাও ইট্টু খান। নাইলে আমার থিকা শেফালি বেশি মনে কষ্ট পাইবো। সেও তো আপনের নূরজাহানের লাহান। নূরজাহানের মনে আপনে কি কষ্ট দিতে পারেন, কন কাকা?
দবির অন্যদিকে মুখ ফিরায়া গামছায় চোখ মুছল। তারপর দুধ সেমাইর লগে মুড়ি মিশাইয়া একটুখানি মুখে দিল।
এই সময় দুইটা বড় কাপে কইরা চা নিয়া আসল শেফালি। পিরিচ দিয়া কাপ ঢাকা যাতে চা ঠান্ডা হইয়া না যায়। দস্তরখানের একপাশে চায়ের কাপ রাইখা বসল।
রব্বান বলল, মাইয়া কো? মাইয়া কার কাছে রাইখা আইলা?
বারেকের মা’র কুলে।
চোখের পানি নিয়াই দুই-তিন লোকমা সেঐ মুড়ি খাইল দবির। তারপর রেকাবি সরাইয়া রাখল। আর পারি না। আমার গলা গিয়া খাওন নামে না।
রব্বান বলল, নামনের কথাও না। কী করুম কাকা কন? আমি আল্লার কসম খাইয়া কইতাছি, আমি ইচ্ছা কইরা এমুন কাম করি নাই। আপনেগো মনে দুঃখ দেই নাই, নূরজাহানের জীবনডা ছেঁড়াভেড়া করি নাই। আমার মাথাডার ঠিক আছিল না কাকা। কেমতে যে কী অইয়া গেল কিছুই বুজতে পারলাম না। আপনে আমারে মাপ কইরা দিয়েন কাকা। কাকিরে কইয়েন মাপ কইরা দিতে। নূরজাহানরে কইয়েন।
শেফালি বলল, কাকা, আমিও মনে করেন আপনের আরেক মাইয়া। আরেক নূরজাহান। আপনের এক মাইয়ার লেইগা আরেক মাইয়ার সংসার ভাঙছে। আমার স্বামীর অন্নাইয়ের লেইগা আমিও আপনের কাছে মাপ চাই কাকা। আপনের পায়ে ধরি, আমার স্বামীরে আপনে মাপ কইরা দিয়েন।
দুইহাত বাড়ায়া আসাম (আসনপিড়ি) কইরা বইসা থাকা দবিরের পা দুইটা প্যাচাইয়া ধরল শেফালি। দোষ কাকা তারও না, দোষ কাকা আমার কপালের। মাইয়া না অইয়া আমার যুদি একটা পোলা হইত তয় হেয় বাড়ি ছাইড়া যাইতো না। এই ঘটনাও ঘটতো না। আপনে আপনের এই মাইয়াডারে মাপ করেন কাকা।
শেফালি ঝরঝর কইরা কাঁইদা ফেলল।
রব্বানের চোখেও তখন পানি। এখন তার মুখে আর দাড়িমোচ নাই, মাথায় বাবরি চুল নাই। পরিষ্কার সুখী মুখ। পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর নীল লুঙ্গি। দুই হাতে চোখ মুছল সে।
দবির কাঁদতে কাঁদতে বলল, এই অবস্থায় কারে আমি কী কমু? কারে বকুম, কারে মারুম? নিজের কপালরে পিছাদা পিডাইতে ইচ্ছা করতাছে। কপাল, কপাল রে! ক্যান এমুন কপাল আমার হইল? ক্যান এমুন কপাল হইল আমার মাইয়ার!
অন্যদিকে তাকায়া চোখের পানিতে ভাসতে লাগল দবির।
তিনজন মানুষ চুপচাপ কিছুক্ষণ কাঁদল। রব্বান তারপর চোখ মুইছা বলল, কাকা, আমি আর আপনের এই মাইয়া শেফালি আপনের কাছে মাপ চাইলাম, আপনের পায়ে ধরলাম। এরবাদেও আমি আমার একদিকে চাচা একদিকে শ্বশুর আর তিন সমন্দি তাগো বেবাকতেরে দিয়া আপনের পায়ে ধরাইতে চাই। শিকদার বংশের পোলা হইয়া আমি যেই কামডা করছি, এর থিকা বড় অন্নাই কাকা হইতে পারে না। আমি আপনের মাইয়ার জীবন লইয়া ছিনিমিনি খেলছি, আপনেগো হালাইছি বিরাট বিপাকে, এই বিপাক থিকা আপনেরে উদ্ধারের কোনও পথ আমগো নাই। আমরা আপনের কাছে খালি মাপ চাই। আল্লারস্তে আমারে মাপ কইরা দেন!
দবির ভিতরে ভিতরে নিজেরে সামাল দিছে। নিয়াস ছাইড়া বলল, না, আর কেঐরে ডাকনের কাম নাই। আমি অহন চইলা যামু।
দবিরের কথা শুইনা শেফালি হায় হায় কইরা উঠল। না না কাকা, হেইডা আপনে পারবেন না। আমি আপনের লেইগা মোরগ জব করছি, পোলাও রানতাছি। আপনে রাইতে পোলাও মোরগ খাইবেন। এই মাইয়ার বাইত্তে থাকবেন, বিয়ানে উইট্টা চা নাস্তা খাইয়া মেলা দিবেন।
রব্বান বলল, বিয়াল অইয়া গেছে। মালখানগর থিকা মেদিনমণ্ডল বিরাট দূর। অহন মেলা দিলে রাইত দোফর অইয়া যাইবো যাইতে। আকাশে ম্যাগও দেখতাছি। যেই গরম ছাড়ছে, তুফান আইবো। রাস্তায় বিপদে পড়বেন আপনে। আপনে তো আম পছন্দ করেন। আমগো বাড়ির আম বহুত মিঠা। রাইত্রে পোলাও মোরগের পর আম খাইবেন আপনে। দেইখেন নে কী মিঠা আম।
দবির বলল, না। আমি যামু গা। আমি থাকতে পারুম না। বাইত্তে বেবাকতে চিন্তায় আছে। তুমি যেইভাবে যা কইছিলা…
হ হ ওই কথা মনে থাকলে তো চিন্তার কথাঐ। তয় কাকা বেইল থাকতে থাকতে আপনে মেলা দেন। শেফালি, আমগো আলমাইত্তে (আলমারিতে) দেহো পলিথিনের কাগজ দিয়া আর সুতা দিয়া কয়হান কাগজ বান্দা আছে। ওই কাগজটি লইয়াহো।
আইচ্ছা।
শেফালি চইলা যাওয়ার পর রব্বান বলল, কাম আমি বেবাকঐ সাইরা রাকছি কাকা। আপনেগো বাড়ি থিকা পলাইয়া আইলাম এই বাইত্তে। তহনও জানি না কপালে কী আছে। বউ আমারে বাইত্তে উটতে দিবো কি না, সমন্দিরা মাইর ধইর দিবো কিনা। হৌর কী কইবো? হরি নাই। মইরা গেছে বহুত আগে। যুদি তারা আমারে বাইত্তে উটতে না দিতো, মাইয়ার মুখ দেখতে না দিতো তয় আমি আবার আপনেগো বাইত্তে ফিরত যাইতাম। শেফালি যহন বেবাক হুইন্না মাপ কইরা দিল, মাইয়াডারে দিল আমার কুলে তহন আমি আর রব্বান রইলাম না কাকা, আমি আপনে অইয়া গেলাম, দবির গাছি অইয়া গেলাম। মাইয়ার বাপ। তার কয়দিন বাদে দিঘলি গিয়া তালাকনামাডা তইয়ার তৈরি করছি। যত্ন কইরা বেবাক কাগজপত্র পলিথিনে বাইন্ধা রাকছি। আরও কয়ডা দিন দেকতাম। যুদি আপনেরা কেউ না আইতেন তয় পোস্টাপিসে গিয়া আপনেগো বাড়ির ঠিকানায় পাডাইয়া দিতাম।
পলিথিনে প্যাঁচানো তালাকনামা আইনা রব্বানের হাতে দিল শেফালি। রব্বান দিল দবিরের হাতে। লন কাকা। তালাকনামা ঠিক আছে। আপনে অহন অন্য জাগায় নূরজাহানরে বিয়া দিতে পারবেন। কোনও ঝামেলা নাই।
পলকের জন্য যেন মাথাটা খারাপ হইয়া গেল দবিরের। ঠাস কইরা রব্বানের গালে একটা থাবড় মারল সে। তারপর পলিথিনে প্যাচানো তালাকনামা হাতে চকি থেকে নামল। হনহন কইরা হাইটা রব্বানদের বাড়ি থেকে বাইর হইল। তখনও সন্ধ্যা হয় নাই। তবে চাইর দিক আন্ধার হইয়া আসছে। আকাশে কালো মেঘ। বাতাস নাই। সবকিছু কেমন থম ধইরা আছে। ঝড় বৃষ্টির লক্ষণ। যখন তখন চারদিক থেকে আসবে দমকা হাওয়া, আকাশ। ভাইঙা নামব বৃষ্টি।
রব্বানদের বাড়ি থেকে নাইমা চক পাথালে হাঁটতে লাগল দবির। হাতে ধরা পলিথিনে প্যাচানো তালাকনামা। মেয়ের তালাকনামা হাতে এক দুঃখী পিতা কলিজাফাটা কষ্ট নিয়া হাঁটে। চোখের পানিতে তার গাল ভাসছে, গলা বুক ভাসছে। খানিকপর চকমাঠ দেশগ্রাম উথাল পাথাল কইরা আসে প্রবল তুফান, আকাশ ভাইঙা নামে টেটার নালের মতন বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি চারদিক থেকে গাঁথতে থাকে দবিরকে।
.
ফজরের আজানের পর পর বাড়ি ফিরল দবির।
একেবারেই ভাঙাচোরা বিপর্যস্ত অবস্থা। মালখানগর শিকদারবাড়ি থেকে বাইর হইয়া সেই যে চক পাথালে হাঁটা দিছিল, তারপর তুফান আর বৃষ্টি, হাতে পলিথিনে প্যাচানো মেয়ের তালাকনামা, বুক ফাইটা যাওয়া কষ্ট আর চোখের পানি নিয়া ইরিধানের চকের আতাইল (আলপথ) দিয়া, কোনও কোনও সময় হালট, বড় সড়ক, সারাটা রাইত হাঁটছে। দবির। ম্যাগ তুফানের পর চাঁদ উঠছিল আকাশে। ম্যাট ম্যাইটা জ্যোৎস্নায় পথ চিনছে আর না চিনছে, হাঁটছে। মালখানগর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে মাওয়া মেদিনীমণ্ডল। সেই মুখীই হাঁটছে দবির। পরনের শার্ট লুঙ্গি গামছা ভিজ্জা চুপাচুপা। কখন হাঁটার তালে আর শরীরের তাপে সেই শার্ট লুঙ্গি শরীরেই শুকাইছে উদিস পায় নাই দবির। মাজার গামছা খুইলা যে চিপড়াইব, মুখোন মুছব সেই কথা একবারও মনে হয় নাই তার। হাঁটছে, শুধু হাঁটছে। দবির। ফজরে আজানের পর যখন বাড়ির উঠানে আইসা খাড়ইছে, তখন উদিস পাইল। মাথাটা ফাইটা যাইতে চাইতাছে ব্যথায়, পায়ের গিড়া (গিড়) ভাইঙ্গা আসতে চাইতাছে। শরীরের ছাল চামড়া ফাটাইয়া বাইর হইতাছে তাপ। দবির বুইঝা গেল জ্বর আসতাছে।
এতকিছুর মধ্যেও হাতে ধরা পলিথিনে প্যাচানো নূরজাহানের তালাকনামা।
হামিদা নূরজাহান কেউ তখনও ওঠে নাই। ঘরের দুয়ার বন্ধ। চকেমাঠে একটু একটু কইরা ফুটছে সকালবেলার আলো। কোনওরকমে বড়ঘরের কপাটে দুই-তিনটা ধাক্কা দিল দবির। ভাঙাচোরা গলায় ডাকলো, নূরজাহানের মা, ও নূরজাহানের মা। দুয়ার খোলো!
লগে লগেই দুয়ার খুলল হামিদা। মনে হয় সারারাতই জাইগা ছিল স্বামীর জন্য। নূরজাহানও জাইগা ছিল বাপের জন্য। হামিদা দুয়ার খুলল ঠিকই, নূরজাহানও চকি থেকে নামছে। টলতে টলতে ঘরে ঢুকল দবির। পলিথিনে প্যাচানো মেয়ের তালাকনামা চকিতে ফালাইয়া বলল, জ্বরে শইল পুইড়া যাইতাছে। খাড়ইতে পারতাছি না। যেই ম্যাগবিষ্টি ওইমিহি…
নূরজাহান আর হামিদা দুইজনেই ধরল দবিররে, চকিতে বসাইল। বাপের গালে কপালে হাত দিয়া আথকাইয়া উঠল নূরজাহান। অনেক জ্বর তো!
দবির কোনওরকমে মাজায় বান্ধা গামছাটা খুলল। সেইটা তখনও ভিজা। গামছা খুইলা কাইত হইয়া চকিতে শুইয়া পড়ল।
হামিদা চিন্তিত গলায় বলল, এমন জ্বর আইলো ক্যা? মালখানগরে অন্যপদের কোনও ঘটনা ঘটছে নি? জামাইর চাচতো ভাইরা…।
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দবির বলল, ওইসব কিছুই না। ঘটনা অন্য। আমি অহন। কথা কইতে পারতাছি না। হারারাইত ম্যাগবিষ্টিতে হাঁটছি, এর লেইগাঐ জ্বর আইছে। আমারে একটা কেঁতা দেও। শীতে শইল কাপতাছে। জ্বর মনে অয় আরও বাড়বো!
হামিদা মোটা একখান কাঁথা বাইর কইরা দবিরের গায়ে দিয়া দিল। দবির ঠকঠক কইরা কাঁপতাছে। পায়ে পাককেদা লাইগ্না রইছে। নূরজাহান দৌড়াইয়া গিয়া চাপকল চাবাইয়া। (চেপে) এক বালতি পানি নিয়া আসল। বাপের গামছা বালতির পানিতে ভিজাইয়া বাপের পা পুঁইচ্ছা পরিষ্কার করল। দবির ততক্ষণে জ্বরে বেহুঁশ। কোনও হুঁশই নাই তার।
দুপুরের দিকে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকতে লাগল দবির। রব্বানের বউটা বহুত ভাল। আমারে পোলাও মোরগ খাওয়াইতে চাইছে। মাইয়াডা এই এতডু। দিছি শুয়োরের পোরে এক থাবড়। আমার মাথায় পানি দেও। আমার মাথার রগ ছিড়া যাইতাছে। মাথায় পানি দেও।
মাথায় পানি তখন চলছিল। দবির প্রলাপ শুরু করার আগ থেকেই তার মাথায় পানি দিচ্ছে নূরজাহান, পাশে চিন্তিত মুখে বইসা আছে হামিদা। ঘটনা কিছুই কেউ বুঝতে পারছে না। কী হইছে মালখানগরে? রব্বানের আবার বউ মাইয়া আইলো কই থিকা? দবিরের প্রলাপ শুইনা হামিদা তাকায় নূরজাহানের দিকে, নূরজাহান তাকায় হামিদার দিকে।
রব্বান কি তাইলে মালখানগরেই আছে? নাকি বেবাকঐ দবিরের জ্বরের প্রলাপ! পেটে অষুদ বিষুদ কিছু পড়ন দরকার। জ্বর না কমলে কিছুই জানন যাইব না দবিরের কাছ থিকা। সকাল থিকা কিছু মুখেও দেয় নাই দবির। জ্বর খালি বাড়ছে, খালি বাড়ছে।
হামিদা চিন্তিত গলায় বলল, জ্বরের অষইদ লাগবো! কেঐরে যুদি মাওয়ার বাজারের বাদশা মিয়া ডাক্তরের কাছে পাড়ান যাইতো!
নূরজাহান বলল, কারে পাডাইবা?
হেইডাঐ চিন্তা করতাছি।
তুমি নিজে যাইবা?
আমি যামু?
তয় কী করবা? বাদলারে ডাইক্কা আনবা? অরে পাডাইবা?
হ হেইডা করতে পারি।
তয় তুমি মেন্দাবাড়ি যাও। বাদলারে ডাইক্কা লইয়াহো। আমি বাবার কাছে আছি। একবারে টেকা লইয়া যাও। বাদলা য্যান ওইদিক দিয়াঐ ডাক্তারের কাছে যায় গা। একবারেই য্যান অষইদ লইয়াহে।
এই টাইমে ডাক্তারসাবে থাকবো না। থাকবো কমপাউন্ডার মাধব।
জ্বরের অষইদ মাধব কাকায়ও দিতে পারবো।
আইচ্ছা তয় আমি যাই।
পঞ্চাশ টাকার একটা নোট আঁচলে বাইন্ধা বাড়ি থেকে বাইর হইল হামিদা। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে অমুদ নিয়া হাজির বাদলা। অষুদ মানে দুইপাতা ট্যাবলেট। একলগে দুইটা কইরা দিনে তিনবার খাওন লাগব। তয় খাওন লাগব ভরা পেটে। খালি পেটে খাইলে বায়ু হইব পেটে। খাওনের আধাঘণ্টার মধ্যে ঘাম দিয়া জ্বর ছাড়ব। আর খাইতে পারব সবই। কোনও অসুবিধা নাই। তিনদিনের মধ্যে জ্বর ছাইড়া যাইব।
মাধব বহুত পুরানা কম্পাউন্ডার। তার কথা মতনই কাজ হইল। তিনদিনের পর আর জ্বর আসল না দবিরের। এই তিনদিন জ্বরের ফাঁকে ফাঁকে রব্বানের কথা সবই হামিদা আর নূরজাহানরে সে বলছে। কিছু বাদ দেয় নাই। শুইনা মা-মাইয়া দুইজনেই গেছে পাথর হইয়া। কেউ কোনও কথা বলতে পারে নাই। নূরজাহানের শুধু মনে হইছে, এমুন মধুমাখা মুখের মানুষটার অন্তরে আছিল এই! সে বিবাহিত, মাইয়ার বাপ, মাইয়া হইছে। দেইখা বউ মাইয়া হালাইয়া আরেক জাগায় আইসা বিয়া করল! একটা মাইয়ার জীবন ধ্বংস কইরা দিয়া চইলা গেল? একটা সংসার ধ্বংস কইরা দিয়া চইলা গেল? একবারও ভাবল না কী অন্যায় আছিল মাইয়াটার? কী অন্যায় আছিল মাইয়ার মা-বাপের? আর এইটা কেমুন পাগলামি, কেমুন মাথা খারাপের কাম রব্বানের? হেয় তো আসলে বদ্ধ পাগল! তছি পাগলনির মতন! আহা রে, এমুন এক পাগলের পাল্লায় পড়ল নূরজাহান! নূরজাহানের লগে পড়ল দবির আর হামিদা!
হাঁটতে হাঁটতে মরার মতন নিজের ঘরটায় গেল নূরজাহান। তালা খুইল্লা ঘরে ঢুকল। ঢোকার পর বুকটা ফাইটা গেল তার। চৌকিতে এখনও আগের মতন পাতা আছে বিছানা। নূরজাহানের বিয়াতে লেপ তোশক আর দুইখান বালিশ বানাইয়া উপহার দিছিল আবদুল। নিজের বালিশটা বড়ঘরে নিয়া গেছে নূরজাহান। মনে মনে রব্বানকে বলল, বিয়ার পর কোনওদিন যুদি তুমি আমারে বেবাক কথা খুইল্লা কইতা, তোমার বউ আছে, মাইয়া আছে, হুইনা আমি বহুত কষ্ট পাইতাম, কানতাম, দুই-চাইরদিন তোমার লগে কথা কইতাম না। আমার মা-বাপে তোমার লগে বহুত রাগারাগি করতো, বকাবাজি করতো তোমারে। তয় আমি কইলাম তাগো হাত থিকা তোমারে বাঁচাইতাম। তোমার শেফালি বউ যেমতে তার বাপ-ভাইগো হাত থিকা তোমারে বাঁচাইছে আমিও অমতে তোমারে বাঁচাইতাম। কইতাম, তুমি বচ্ছরে কহেকমাস মালখানগর গিয়া শেফালি বউর লগে থাকো, মাইয়ার লগে থাকো, আর কহেকমাস মেদিনমণ্ডল আইয়া আমার লগে থাকো। আমার কপাল খারাপ দেইখা একলা আমি তোমারে পাইলাম না। আরেকজনের লগে স্বামী ভাগ করতে হইতাছে আমার। সতিন তো কত মাইয়ারঐ থাকে! আমি তোমারে মাইন্না লইতাম। হেইডা না কইরা তুমি আমারে তালাক দিলা? এমুন নিষ্ঠুর কেমতে হইলা তুমি? আর বাসর রাইতে পোলাপান না। হওয়ান লইয়া তুমি যা কইছিলা আইজ আমি বুঝি ক্যান তুমি ওই কথা কইছো! আহা রে, এমুন চালাকি তুমি আমার লগে করলা?
অনেকক্ষণ কাঁদার পর রব্বানের বালিশসহ তোশকটা প্যাঁচাইয়া চকির দক্ষিণ দিককার বেড়ার লগে রাইখা দিল নূরজাহান। এখন চকিটা খা খা শূন্য। চকির কাঠ য্যান ফ্যালফ্যাল কইরা চাইয়া রইল নূরজাহানের দিকে। নূরজাহান মনে মনে বলল আমার জীবন আমি গুটাইয়া ফালাইলাম। যেই জীবন আমার আছিল সেই জীবন এখন আর আমার না।
.
শীতকালের শুরুর দিকে রাবি মতলা আর বাদলা একদিন দবির গাছির বাড়িতে আইসা হাজির।
দুপুরের ভাতপানি খাইয়া দবির তার স্বভাব মতন ছনছায় বইসা তামাক টানছে। হামিদা উদাস ভঙ্গিতে বইসা আছে দুয়ারে। নূরজাহান আঁচলে মুখ ঢাইকা বড়ঘরের চকিতে জানালার পাশে শুইয়া আছে। এই বাড়ির মানুষজন কেউ আর আগের মানুষ নাই। রব্বান চইলা যাওয়ার পর অনেকদিন কাইটা গেছে। তার কথা এখন আর সেইভাবে কেউ মনে করে না। মনের ভিতর রয়ে গেছে সবারই। তবে তারে নিয়া কেউ আর কোনও কথা বলে না। নূরজাহানই তার মা-বাবারে বলছে, তার কথা আর উঠাইয়ো না তোমরা। যে গেছে সে গেছে।
তারপর থেকে যে সংসার একদিন হামিদা সামলাইত সেই সংসার সামলায় নূরজাহান। দিন রাত যখন সংসারের যা কাজ, রান বাড়ন, কাপড়চোপড় থালবাসন ধোওন সব করে সে। হামিদারে হাত লাগাইতে দেয় না, দবিররে হাত লাগাইতে দেয় না। ইচ্ছা কইরাই সংসারের কামে ডুইবা থাইকা সব ভুইলা থাকে। ওই যে নতুন ঘরের বিছানা পাচাইয়া রাখছিল বেড়ার লগে, চকি শূন্য, ঠিক ওইভাবে নিজের জীবনটাও শূন্য কইরা ফালাইছে সে। রব্বানরে য্যান তার বিছানার মতন গুটাইয়া জীবনের, মনের একপাশে রাইখা দিছে। সেই বিছানা খুইলা সুখের কোনও দিন রাতের কথা আর ভাবে না। আর বাড়ি থেকে বাইর হওয়া একদম ছাইড়া দিছে সে। গ্রামের কেউ গাছির বাড়িতে না আসলে নূরজাহানের চেহারা দেখে না। তাও কেউ আসলে নূরজাহান মাথায় ঘোমটা দিয়া এমনভাবে চলাফিরা করে, আর নাইলে ঘরে ঢুইকা এমনভাবে বইসা থাকে তার মুখটা যেন কেউ দেখতে না পায়। এই মুখ মানুষরে দেখাইতে বড় লজ্জা তার।
মেয়ে পুরা সংসার সামলায় দেইখা হামিদা গেছে অলস হইয়া। বেশির ভাগ সময় উদাস হইয়া বড়ঘরের দুয়ারে বইসা থাকে। কোনও কোনও সময় শুইয়া থাকে। রসের দিনে গাছি আর আগের মতন গাছ ঝোড়ে না। নতুন কোনও বাড়িতে যায় না গাছের খোঁজে। পুরানা কয়েকটা বাড়ি আছে, কয়েকটা গাছ আছে ওই ঝোড়ে। রস বিক্রি কইরা আগের মতন টাকাপয়সা কামাই করার ইচ্ছাটাই মইরা গেছে। কী হইব আর এতকিছু কইরা। আগে যা করনের মাইয়ার লেইগা করছে। সেই মাইয়ার জীবন হইল এইরকম। এখন সংসার চললেই হইল। বাড়তি কোনও কিছুর দরকার নাই। রসের দিনে রস বেইচা যা দুই-চাইর টাকা পাওয়া যায়, বাড়তি রস যেইটুকু থাকে, নূরজাহান তোয়াক মিঠাই বানাইয়া রাখে, বছরের মিঠাই হইয়া যায়। ইরি জমিনটা আগে বর্গা দেওয়া ছিল, এখন দবির নিজে চোয়। নিজেই নালা কাইট্টা পানি আনে খেতে, ফাস ফোঁস (সার টার) দেয়। কীটনাশক কিন্না রাখে ঘরে। খেতে পোক থাকলে আলফুর কাছ থিকা এসপেরে মিশিন (স্প্রে মেশিন) আইন্না, মুখে গামছা বাইন্দা নিজেই ছিটায় ইরিখেতে। ধান উঠলে ধান সিদ্ধ করা, শুকালে, চেঁকিতে পাডাইয়া পাডাইয়া চাউল করন, বেবাক কাম একলা করে নূরজাহান। রান্নাচালার পাশে একখান চেঁকি বসাইয়া দিছে দবির। নূরজাহান একলা একলা সব করে। হামিদা হাত লাগাইতে চাইলে ঠান্ডা গলায় বলে, তোমার কিছু করন লাগবো না মা। আমি একলাঐ পারুম। আমার কাম আমারে করতে দেও।
দবির হামিদা দুইজনে মিল্লা একদিন ধরছিল নূরজাহানরে। তুই একলা ক্যান এত কষ্ট করতাছস মা? আমগো দুইজনরে তো কোনও কামঐ করতে দেয় না!
নূরজাহান বলছে, আমার জন্মের পর থিকাই তো তোমরা আমার লেইগা বেবাক কিছু করছো। জানডা দিয়া দিছো আমার লেইগা। কত অপমান অইছো আমার লেইগা, কত কষ্ট করছো, চিন্তা করছে। আমি তোমগো লেইগা কিছু করি নাই। আমারে তোমরা খাওয়াইছো পরাইছো, এত আদর মহব্বত করছো, এত কষ্ট কইরা পাই পাই কইরা পয়সা জমাইয়া আমারে বিয়া দিছো, আমার কপালে বিয়া সয় নাই, আল্লায় কপালে রাখে নাই দেইখা এই হগল লইয়া অহন আর কোনও হায়আপশোস করি না আমি। আল্লায় আমার কপালে যা রাখছে তাই হইছে। এর লেইগা আমি মনে মনে চিন্তা করছি, যতদিন বাঁইচ্চা আছি তোমগো দুইজনরে ঘরবাড়ির কাম আর কিছু করতে দিমু না। বেবাক আমি করুম। শেষ জীবনডা তোমরা দুইজন ইকটু আরামে কাটাও। একদিন আমার লেইগা করছো, অহন আমি তোমগো লেইগা করতে চাই। মাইয়া না অইয়া আমি যুদি তোমগো পোলা হইতাম, তয় রুজি রোজগার কইরা, গিরস্তি কইরা তোমগো খাওয়াইতাম। হেইডা তো আর অয় নাই। আল্লায় তো আর আমারে পোলা বানায় নাই, বানাইছে মাইয়া। এর লেইগা ঘরবাড়ির কাম কইরা তোমগো আমি ইকটু আরামে রাখতে চাই। আর কিছু না।
নূরজাহানের কথা শুইনা দবির হামিদা দুইজনেই বুঝছে, ঘরবাড়ির কামে, সংসারের কামে ডুইবা থাইকা নিজের জীবনের সবকিছু ভুলতে চায় নূরজাহান। কোনও কিছু মনে করতে চায় না। তবে কোনও কোনও বিকালে, যখন ঘরবাড়ির কোনও কাজ থাকে না, একদম আজাইর নূরজাহান, তখন সে মনমরা ভঙ্গিতে বাঁশঝাড়তলার ওই দিকটায় যায়। নাড়ার পালাটায় ঢেলান দিয়া উদাস চোখে সামনের চকের দিকে তাকায়া থাকে, ভাদাইম্মা কুত্তাটা গিয়া দাঁড়ায়া থাকে তার লগে, এই দৃশ্য দেইখা দবির হামিদা নিয়াস ছাড়ে। আহা জীবনটা কেমুন ছেঁড়াভেড়া হইয়া গেল মাইয়াটার! কত আশা, কত স্বপ্ন নিয়া রব্বানের লগে বিয়া দিছিল, পয়লা পয়লা মনে হইল কত ভাল পোলা রব্বান, তারপর…! তুরখুলা (মাটির গর্তে থাকা বড় পোকা) মনে কইরা গরম পানি ঢালা হইল উঠানের গর্তে, বাইর হইল জাইতসাপ। আহা রে, আহা!
মালখানগর থেকে ফিরা আসার পর, জ্বর সাইরা ওঠার পর দবির ভাবছিল রমিজ ঘটকরে ধরব। রব্বানরে যেমন একখান থাবড় মারছে ঠিক তেমন একখান থাবড় মারব শালার গালে। কয়ডা টেকার লেইগা তুই আমার মাইয়ার জীবন নষ্ট করলি খানকি মাগির পোলা!
হামিদা তারে থামাইয়া রাখছে। কোনও লাভ নাই এই হগল কইরা। আমগো পাশে খাড়নের কেঐ নাই। রমিজ ঘটকের পোলাপান আছে, আততিয় স্বজন আছে। তাগো লগে শতরুতা কইরা তুমি পারবা না। উলটা বিপদ হইব!
দবির রমিজরে কিছু বলতে পারে নাই। মাওয়ার বাজারে দুই একদিন দেখা হইছে, রমিজ আগাইয়া আইসা কথা বলতে চাইছে, দবির উলটা দিকে মুখ ঘুরাইয়া চইলা গেছে। রমিজের লগে কথা কইতে ঘিন্না লাগছে। হামিদার কথা একদিকে ঠিক, শতরুতা বাড়াইয়া লাভ কী? নূরজাহানের জীবনে যা ঘইটা গেছে ওইটা কি আর ফিরত পাওয়া যাইব!
তবে রব্বানের উপরে যেমন ঘিন্না, রমিজের উপরেও তেমন ঘিন্নাই দবিরের। এই ঘিন্না। সারাজীবন থাকব। এই ঘিন্না কোনওদিন যাইব না।
আজ বিয়ানে রসের কাজ সাইরা বাড়িতে আসছে দবির। নাওন ধোওন খাওন দাওন সাইরা বসছে তামাক নিয়া। রাবি মতলা আর বাদলা আইসা হাজির। বাদলা এখন কেমুন পুরুষপোলা পুরুষপোলা হইয়া উটছে। লুঙ্গির উপরে হাতাআলা পুরানা খয়েরি রঙের ছিড়াভিড়া সোয়েটার পরা। মুখে দাড়িমমাচের ভাব দেখা দিছে। ইকটু অল্প বয়েসেই ছেমড়াটা য্যান বেশি পাইকা গেছে। দবিরের সামনে তিনজন মানুষ দাঁড়াইল ঠিকই, মা বাপরে কথা শুরু করতে না দিয়া শুরু করল বাদলাই। গাছিমামা, বিরাট একখান আরজি লইয়া আপনের কাছে আইছি। আরজিডা আপনে হালাইতে পারবেন না। রাখতেই হইব। এর লেইগা তিনজনে মিল্লা আপনের কাছে আইছি।
দবির তামাক টানা রাইখা বলল, আগে বয় তরা। তারবাদে হুনি দিহি কী আরজি লইয়া তুই আইছস? নূরজাহানের মা, যোগলাডা উড়ানেই পাইতা দেও, অরা বহুক।
হামিদা হোগলা নিয়া আসল।
রাবি বলল, নূরজাহান কো?
হামিদা ছনছায় হোগলা পাইতা দিয়া বলল, ঘুমাইতাছে।
আমি ঘরে ঢুকুম। অরে ডাক দিমু?
দবির বলল, না থাউক। হারাদিন ম্যালা কামকাইজ করছে। অহন ইকটু ঘুমাউক।
আইচ্ছা আইচ্ছা।
রাবি মতলা হোগলায় বসল, বাদলা বসল না। সে একটু মাতবরি চালে উঠানে খাড়ইয়া রইল।
দবির বলল, ক রে বাদলা, তর আরজিডা ক। হুনি।
বাদলা রাবির দিকে তাকাল। মা, অহন তুমি কও।
মতলা বলল, আমি কই?
রাবি কঠিন চোখে স্বামীর দিকে তাকাইল। না তুমি না, আমি কই।
দবিরের দিকে তাকাল রাবি। গাছিদাদা, আমরা আইছিলাম আপনের দোকানডার বিষয়ে। কথা কইতে। দোকানডা তো পইড়া রইছে।
হামিদা দাঁড়ায়া আছে দুয়ারে। রাবি একবার তার দিকেও তাকাইল। ভাবিছাবেও হোনেন। নূরজাহানের জামাইর লগে বাদলা চা’র দোকানডা চালাইছে। হেয় চইলা যাওনের পরও কয়দিন চালাইছে। চা’র দোকান কেমতে চালাইতে হয় ও জানে। চাও মন্দ বানায় না। দোকানডা আপনেরা আমগো দিয়া দেন।
মতলা বলল, হ। দোকানডা আমরা চালাই। বাদলার খুব শক চা’র দোকানদার হইব।
বাদলা বলল, এইডা আপনে না করতে পারবেন না গাছিমামা। দোকানডা তো পইড়াঐ রইছে। আমরা খুইল্লা চালাই। চালানপত্র বেবাক আমগো। আপনেরে মাসে মাসে কিছু ভাড়া দিমুনে। আমার বাপের তো শইলডা কোনও সমায়ঐ ভাল থাকে না, কাম কাইজ করতে পারে না, হেয় আমার লগে দোকানে বইয়া থাকবো। আমি বাইত্তে ভাত খাইতে গেলে হেয় দোকান পইড় দিবো। চা বানানডাও হিগাইয়া হালামুনে তারে। ঠেকাবাজায় (ঠেকা বেঠেকায়) দুই-চাইর কাপ চা বানাইয়া গাহেকরে দিতে পারবো!
দবির একবার হামিদার দিকে তাকাল। হোনছো অগো কথা?
হামিদা বলল, হুনছি।
কী কও?
আমার কওনের কিছু নাই।
মাইয়ারে জিগাইবা?
ইচ্ছা করলে জিগাইতে পারো।
ডাক দিবা অরে?
তার আগে বাদলারা ভাড়া কত কইরা দিবো হেইডা ঠিক করবা না?
নূরজাহান বলল, যা ইচ্ছা দেউক। দোকান দিয়া দেও বাদলারে!
নূরজাহান কখন উঠল, কখন আইসা খাড়ইল হামিদার পিছনে, অন্যরা তো বোঝেই নাই, হামিদা নিজেও বোঝে নাই। এইবার তার কথায় সবাই মুখ ঘুরাইয়া তার দিকে চাইল। রাবি হাসিমুখে বলল, কেমুন আছস নূরজাহান?
নূরজাহান ম্লান গলায় বলল, আছি ভালই।
অনেকদিন বাদে তরে দেকলাম।
হ। আমিও তোমগো দেকলাম অনেকদিন বাদে।
কয়েক পলকে তারপর নূরজাহানের অনেক কিছুই যেন দেইখা ফালাইল রাবি। নূরজাহান আর সেই নূরজাহান নাই। নূরজাহান এখন ভারভারিক্কি, দেশগেরামের বউঝিগো মতন। কামকাইজ করা, সংসার করা শক্তপোক্ত মাইয়া। বয়স য্যান আথকা বেশ কয়েক বছর বাইড়া গেছে। বয়সের থেকে অনেক বড় লাগে নূরজাহানরে।
রাবি মনে মনে বলল, বিয়ার পানি পেডে গেলে এমুনঐ হয়!
মাসে দুইশো টাকা দোকান ভাড়া সাব্যস্ত কইরা রাবি মতলা আর বাদলা দোকানের চাবি লইয়া চইলা গেল।
এই ঘটনার দেড়-পোনে (পৌনে) দুই বচ্ছর পর আবার বিয়া হইল নূরজাহানের।
.
জাহিদ খাঁ-র বাড়ির পুব-দক্ষিণ কোনায় মতলিব মিয়ার বাড়ি। বাড়ি তেমন বড় না। বড়ঘরটা পাটাতন করা। বাংলাঘরটা বাইর বাড়ির দিকে, মাঝারি সাইজের। ওই মাপের আরেকটা ঘর আছে পুবের ভিটায়, সেই ঘরের দক্ষিণ কোনায় রান্ধনঘর আর চাপকল। পায়খানা ঘরটা পুবদিককার আমগাছ দুইটা ছাড়ায়া, ভাঙনের দিকে। বাড়িতে ঢোকার রাস্তা জাহিদ খাঁ-র বাড়ি আর মতিনদের বাড়ির মাঝখান দিয়া।
মতলিবের অবস্থা মোটামুটি ভালই। মাওয়ার বাজারে বহুত পুরানা মুদিদোকান তার। নিজের বাড়ির অন্য কোনও ওয়ারিশ নাই। তিন বইন, দুই ভাই তারা। বইনদের বিয়াশাদির পর যে যার ভাগের সম্পত্তি মতলিবের কাছে বেইচা টাকাপয়সা নিয়া গেছে। ছোটভাই বিয়া করছে গাজিপুরে। গাজিপুর সাবরেজিস্ট্রি অফিসে কাজ করত। সেখানে বিয়াশাদি করছে, ছোট একখান বাড়িও করছে। সেও তার বাপের সম্পত্তি ভাইয়ের কাছে বেইচা গেছে, গাজিপুরের বাড়িতে দালান তোলার জন্য। এখন সব মিলাইয়া কামারবাড়ির আর তালুকদার বাড়ির মাঝখানকার চকে মতলিবের আড়াইকানি ধানের জমিন আর এই বাড়ি।
তবে সংসারে সুখ নাই মতলিবের। তার ঘাড়ে সংসার আর তিন বইন এক ভাই ফালাইয়া প্রথমে বাপ মরল, তারপর মা। মতলিব মুদিদোকানদারি কইরা তিন বইনের বিয়া দিল, ভাইর নাম আবু তালিব, তারে বিএ পাশ করাইল। এই করতে করতে দিন গেছে অনেক। মতলিব বিয়া করল একটু বেশি বয়সে। শ্বশুরবাড়ি গাদিঘাট। বউর নাম করিমুন্নেসা, ডাকনাম কিরনী। তার আগেই ছোটভাই তালিব বিয়াশাদি কইরা গাজিপুরে স্থায়ী হইয়া গেছে। মতলিবের সংসারে সুখ নাই কিরনীর কারণে। সে অসুইক্কা (অসুখে)। হাঁপানি আছে, বাত আছে। আরও নানান পদের মেয়েলি সমস্যা। বিয়ার পর বছর ছয় মাসের মাথায় পয়লা বাচ্চা নষ্ট হইল। তার দুই বচ্ছর পর নষ্ট হইল পাঁচ মাসের মাথায়। তারপর আর বাচ্চাই হয় না, হয় না অবস্থা। সাত বচ্ছর পর একটা মাইয়া হইল। তারপর পর পর আরও দুইটা, মোট তিনটা মাইয়া হইল। ততদিনে কিরনী বিছনা নিয়া নিছে, সংসার সামলায় মতলিবের দূর সম্পর্কের স্বামী সন্তান ভাইবইন ছাড়া এক ফুবু। প্রায় বুড়া বয়সি মহিলা। শরীরও তেমন না। তাও জানটা। দিয়া মতলিবের সংসার সামলাইত, মাইয়া তিনটা আর কিরনীরে সামলাইত। মতলিবের তো। দিন কাটে বাজারেই। দুপুইরা ভাত টিবিনকারিতে (টিফিন কেরিয়ার) কইরা বাজারে নিয়া যায়, ওখানে বইসাই খায়। সকালের নাস্তা আর রাতের ভাত খায় বাড়িতে। বাড়িতে কয়েকটা হাঁস মুরগি আছে, ওইগুলিরও দেখাশুনা করতে হয়। গোরু বরকি নাই। কে পালব?
মতলিবের বড় মাইয়ার নাম রওশন, মাজারো মাইয়া আয়শা আর ছোটটা খোদেজা। রওশনের বয়স হইছে আট বচ্ছর, আয়শার ছয় আর খোদেজার তিন। কোনওটার কোনও লেখাপড়া নাই, কামকাইজ নাই। মতলিবের ফুরু হয় তাগো দাদি। দাদি দাদি কইরা দিন রাইত ত্যক্ত করে মহিলারে। কাইজ্জাকিত্তন, মারামারি করে তিন মাইয়ায়। বড়ঘরের পালঙ্কে শুইয়া হাঁপাতে হাঁপাতে মাইয়া তিনটারে শাসন করার চেষ্টা করে কিরনী, মাইয়ারা কিরনীরে পাত্তা দেয় না। জানে মায় উইঠা আইসা কিল থাবড় দিতে পারব না। লাঠি দিয়া বাইড়াইতে পারব না।
তবে মতলিব বাড়িতে থাকলে মাইয়ারা একটু শান্ত থাকে। মতলিব ভাঙাচোরা শরীরের মানুষ। কথাবার্তা কম বলে। কাউরে তেমন কিছু বলে না, তাও মাইয়া তিনডা মতলিবরে ভালই ডরায়। দিনভর তাদের দুষ্টামি চলে। দুষ্টামির মাত্রা বাইড়া গেলে মতলিবের ফুবু তাদেরকে মতলিবের কথা বইলা ডর দেখায়। আইজ আহুক মতলিব। কমু নে তরা এই এই করছস। আমার কথা হোনচ নাই। মা’র কথা হোনচ নাই। অসুইক্কা মা’র মিহি চাইয়াও দেহচ নাই।
মাইয়া তিনটা মতলিবের নাম শুনলেই থামে। এমনকী ক্যাতরা (ছোট) মাইয়াটাও। তয় মতলিবের মাইয়া তিনটা দেখতে ভাল না। দুইন্নার কালা এহেকটা। কিরনীর গায়ের রং কালা না। মাইয়ারা পাইছে বাপের রং। মতলিব ভালই কালা। কালা আর কাহিল। মুদিদোকানদারি করে বইলা স্বভাবে বিরাট কিরপিন। ওই যে কথায় আছে না, মুদিদোকানদাররা পিঁপড়ার পাছায় চিমটি দিয়া মিঠাই রাইখা দেয়, মতলিব পিপড়ার পাছায় চিমটি দিয়া মিঠাই রাইখা দেওয়া জিনিস।
এই স্বভাবের জন্যই কিরনীর ভাল চিকিৎসা কোনওদিন সে করাই নাই। হাঁপানি আর বাত বেশি বাইড়া গেলে, কিরনী যখন যায় যায় তখন সে কাজির পাগলার করিম ডাক্তারের কাছে গিয়া অমুদ নিয়া আসে। হাঁপানির একটা ফুছফুছ যন্ত্র (ইনহেলার) আছে কিরনীর। বহুত পুরানা। বেশির ভাগ সময়ই যন্ত্রর ভিতরকার অষুদটা থাকে না। কিরনীর যায় যায় অবস্থা হইলে ওই অষুদ খুবই মন খারাপ কইরা কিনা আনে মতলিব। ইস, এমুন বউর লেইগা নগদ এতডি টেকা খরচা? কিরনীর অষুদ কিনার কষ্টে রাইত কাটে মতলিবের অরঘুমা। মেজাজ থাকে বিগড়াইয়া। মনে মনে খালি কয়, মাগি মরে না ক্যা?
হাঁপানি রোগীরা কেন যে সহজে মরে না!
যার মরণের সে না মইরা মরল মতলিবের ফুবুটা। সংসারটা যে চালাইত, সে। হায় হায়! অহন!
মাথায় আশমান ভাইঙ্গা পড়ল মতলিবের। অহন কী হইব? সংসার চলব কেমতে? মাইয়ারা ডাঙ্গর হইতাছে, তাগো দেখব কে? আট বছরের বড় মাইয়ায় কি সংসার সামলাইতে পারব! রান্ধন বাড়ন, খাওন দাওন! হায় হায়! বাড়িতে যে কামের লেইগা চউরানি (চরের মহিলা) রাখব, একলা ওইরকম চউরানি পাওয়া যাইব না! রাবির মতন পাওয়া যাইব, জামাই পোলাপানসহ। তাগো নাইলে থাকনের লেইগা পুবের ভিটির ঘরটা দিল। তয় তিন চাইরজনের সংসার যুদি হয়! পুরুষটা হয়তো কামলা দিব এদিক ওদিক, রিকশা মিকশা চালাইব। টাকা কামাইব ঠিক, তয় খাইতে চাইব মতলিবেরটা।
কী করন যায়?
কিরনী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, তুমি একখান বিয়া করো। বিয়া করলে এক কামে দুইকাম হইব তোমার। সংসার আর পোলাপান সামলানের মানুষও পাইলা, রাইত্রে শোওনের। মানুষও পাইলা! আমি আর কয়দিন? আমার দিন ফুরাইয়া আইতাছে। ফুবুর লাহান যে কোনওদিন দেখবা, মইরা সিদা অইয়া রইছি।
শরীরের চাহিদা মতলিবের তেমন নাই। নিজেই সে ভাঙাচোরা মানুষ। তার দরকার সংসার আর মাইয়া তিনডা সামলানের মানুষ! কিরনীর কথাটা তার খারাপ লাগে না।
একদিন কিরনীরে বলল, গাদিঘাটে খবর দিবানি?
কিরনী অবাক। কীয়ের খবর?
অর্থাৎ আমারে তুমি বিয়া করাইতে চাও এইডা তোমার ভাইবেরাদারগো জানাইবা না? বইন, বইন জামাইগো তো জানান উচিত। তোমার বাপ-মা বাইচা থাকলে কইতাম তাগো জানাইতে!
ক্যা?
এইডা নিয়ম। এক বউ থাকতে আরেক বউ, শালা সমন্দিরা, শালি শালির জামাইরা এই হগল লইয়া কথা তুলবো না?
কিরনী শ্বাস টানতে টানতে বলল, মদিদোকানদাররা চালাক চতুর হয়। তয় তুমি হইলা ভোদাই। আরে তোমার বউডা যেহেনে তোমারে বিয়া করতে কইতাছে হেহেনে বউর ভাইবইন, বইনজামাই ভাবিগো কওনের কী আছে? আর তারা বেবাকতে তো আমার শইল্লের খবর জানে। ফুবুর মরণের খবরও পাইছে। কামের বেডিবুডি রাখনের থিকা বিয়া করলে লাভ তোমার বেশি। তয় একখান ডর খালি আমার আছে, মাগি আইয়া না আমার মাইয়াছির লগে খারাপ ব্যবহার করে! অগো মারে ধরে। আমারেও যুদি অইত্যাচার করে, আমি অসুইক্কা মানুষ, আমি কিছু করতে পারুম না। মাগির লগে শইল্লের জোরেও পারুম না।
মতলিব বিড়ি খাওয়া লোক। অতি সস্তা পাতার বিড়ি খায় সে। বিড়ি টানতে টানতে বলল, না অমুন বিয়া করুম ক্যা? বিয়া করতে অইলে এই হগল দেইক্কাঐ করুম। খাড়ে দজ্জাল বিয়া করুম না। নরম সরম মাইয়া বিয়া করুম। আগে বিয়াশাদি হইছে, জামাই ছাইড়া দিছে আর নাইলে মইরা গেছে, বিধবা। এমুন পাইলে করুম। তয় করন উচিত তাড়াতাড়ি। সংসার তো অচল হইয়া গেল!
হ। তয় আথকা এমুন মাইয়া তুমি পাইবা কই?
ঘটক লাগামুনি?
লাগাইতে পারো। তয় ঘটকায় টেকা খাইবো ম্যালা।
হ হেইডা ঠিক।
তয় তুমি একখান কাম করতে পারো। আমিন মুনশি সাবের লগে তো তোমার ভাল খাতির। তার লগে কথা কও। হেয় গেরামে গেরামে ঘোরে। মুনশি মানুষ হইলেও আধা পাগলা। এই বাড়ি যায়, ওই বাড়ি যায়। হেয় অমুন কোনও মাইয়ার খবর তোমারে দিতে পারেনি দেহো। আমার মনে হয় পিরবো।
নূরজাহানের কথা আমিন মুনশিই বলল। শুইনা মতলিব গেল ডরাইয়া। হায় হায় কন কী মুনশিসাব? নূরজাহান তো সাই পাজি মাইয়া। মান্নান মাওলানার মুখে ছ্যাপ দিছিল।
আমিন মুনশি দাড়ি হাতাতে হাতাতে বলল, হেই নূরজাহান আর নাই। বিয়ার পর, তালাক হইয়া যাওয়ার পর মাইয়াটা গেছে অন্যরকম হইয়া। কথাবার্তা মাইনষের লগে কয়ঐ না। বাইত থিকা বাইর হয় না। সংসারের বেবাক কাম একলা করে। তুমি নূরজাহানরে বিয়া করলে তোমার সংসার বাঁইচ্চা যাইবো এইটা আমি গেরানটি (গ্রান্টি) দিতে পারি।
মতলিব চিন্তিত গলায় বলল, আপনে কইতাছেন?
আরে হ মিয়া। আমি কইতাছি। আর আমি যে মিছাকথা কই না এইডা তুমি ভাল কইরাঐ জানো।
হ হেইডা জানি। খালি আমি না, দেশগেরামের বেবাকতেই জানে।
তয়?
তয় গাছির লগে কথা কইবো কে? তারা রাজি হইলো কিনা হেইডা বুঝতে অইবো না?
হ হইবো? তুমি কইলে আমি কথা কইয়া দেখতে পারি।
আমি কইলাম। আপনে কথা কন। দেহেন গাছি কী কয়? গাছির বউ কী কয়? নূরজাহান যুদি কিছু কইতে চায় হেইডাও হোনেন!
চকের এককানি জমিন নূরজাহানের নামে রেসটারি (রেজিস্ট্রি) কইরা দিয়া তারে কিরনীর সতিন কইরা বাড়িতে নিয়া আসলে মতলিব। কোনও উৎসব আয়োজন নাই, খরচাপাতির মধ্যে নূরজাহানরে দুইটা নতুন শাড়ি দিতে হইল, ছায়া ব্লাউজ স্যান্ডেল দিতে হইল। আর জমি রেসটারি করতে যা খরচা। আমিন মুনশি সাহেব বিয়া পড়াইলেন দুপুরবেলা। দবির গাছির বাড়িতে দুপুরের ভাতপানি আর দই মিষ্টি খাইয়া বউ লইয়া রিকশায় কইরা নিজের বাড়িতে চইলা আসল মতলিব। মাইয়া তিনটার দেখভালের জন্য এককানি জমিন গেল, এই দুঃখটা তার মনের মধ্যে রইয়া গেল। আর জমিন এককানি নূরজাহানকে দেওয়ার প্রস্তাব দবির দিয়েছিল মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভাইবা। আল্লাহ না করুক, মতলিব যদি আথকা মইরা যায়, তার তো কোনও ছেলে সন্তান নাই, এই বয়সে হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। তখন মতলিবের ভাই আসব বেরাদারি হক নিতে, বইন, বইনজামাইরা আসবো। কিরনী বাঁইচা থাকলে সেও ঠেকাইতে পারব না কেঐরে, নূরজাহানও পারব না। আইন অনুযায়ী মতলিবের ভাইবোনরা তার সম্পত্তির ভাগ একটা পাবেই। এই ফাঁকে মতলিব অবশ্য আরেকটা কাজ সাইরা রাখল। তার অবর্তমানে তার যাবতীয় স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক কইরা দিল তিন মাইয়ারে। তারা সাবালিকা না হওয়া তরি দেখভালের দায়িত্ব তার দুই বউর।
মতলিব তার জাগাসম্পত্তি বাড়িঘর মাইয়াগো দিয়া দিছে শুইনা দবিরও তাই করল। তার মাইয়াটা এমনিতেই দুঃখী। মতলিব ভাঙাচোরা শরীরের প্রায় বুড়া মানুষ। পোলাপান ইহ জিন্দেগিতে নূরজাহানের হইব বইলা মনে হয় না। সে আর হামিদা মইরা গেলে, ওইদিকে মতলিব কিরনী মইরা গেলে, মতলিবের তিন মাইয়ার বিয়াশাদি হইয়া গেলে কোন বিপাকে নূরজাহান পড়ব, আল্লাই জানে। এমতেই মাইয়াটার কপালে ম্যালা ফ্যার। শেষ জীবন কেমতে কাটব কে জানে! যদিও দবিরের কোনও ওয়ারিস নাই। তারপরও কে কোনখান দিয়া বাড়িঘর আর ওই জমিনটুকু দখলের চেষ্টা করব কে জানে! মহাসড়ক হইয়া গেছে, জাগাজমিনের দাম গেছে বাইড়া। কেউ শত্রুতা করলে নূরজাহান ঠেকাইব কেমতে!
দিঘলি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে গিয়া দলিলপত্র সব পরীক্ষা করাইয়া, মতলিব যারে দিয়া তার জাগাসম্পত্তি এককানি লেইখা দিছে নূরজাহানরে, বাকিগুলির মালিক কইরা দিছে মাইয়াগো ঠিক সেই কায়দায় নিজের বাড়িঘর আর জমিনটুকু নূরজাহানের নামে কইরা দিছে। দবির-হামিদা মইরা যাওয়ার পর মালিক হইব নূরজাহান।
নূরজাহানের অবশ্য এইসব নিয়া কোনও কথা ছিল না। মতলিবের লগে বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আমিন মুনশি সাবে আসার পর দবির হামিদা দুইদিন চিন্তা করছে, এককানি জমির বুদ্ধিটা দিছে হামিদা। তারপর নূরজাহানের লগে দুইজনেই কথা বলছে। নূরজাহান তো আইজকাইল কথাই বলে না। মা-বাপ দশ কথা বললে সে বলে একখান। সব শুইনা বলল, তোমরা যা ভাল মনে করো, তাই। তোমরা রাজি থাকলেঐ হইব।
এককানি জমিনের প্রস্তাবে মতলিব এত তাড়াতাড়ি রাজি হইব এইটা অবশ্য চিন্তা করে নাই দবির। মুনশি সাব তিনদিন সময় নিলেন। তারপর আইসা বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। মতলিব রাজি। অর সংসার বাঁচানডা বেশি দরকার।
দ্বিতীয় বিয়া হোক আর যাই হোক, বিয়া তো। লোকজন দুই-চারজন আসল। সাক্ষী উকিল বাপ এইসব তো লাগে। এইবারও রব্বানের লগে বিয়ার মতনই, আজিজ গাওয়াল। উকিল বাপ, আবদুল আর আলফু এই পক্ষের সাক্ষী। মতলিবের পক্ষ থেকে জাহিদ খা-র বাড়ির এনায়েত আর হজরতদের বাড়ির আকবর সাক্ষী। চুপচাপ বিয়া হইয়া গেল নূরজাহানের। গ্রামের কেউ যেন তার মুখ দেখতে না পায়, বিয়ার শাড়ি পইরা, থুতনি তরি ঘোমটা দিয়া নতুন স্বামী মতলিবের লগে রিকশায় বইসা তার বাড়িতে আইসা উঠল নূরজাহান। কিরনী আর তার মেয়েরা তাকায়া তাকায়া দেখল। নুরজাহানরে নিয়া বাসররাত করল মতলিব। পুবের ঘরে। হারিকেনের কাঁটা ঘুরাইয়া মতলিব যখন ঘর আন্ধার করছে, আজও কেন যে প্রথম বাসররাতের মতন নূরজাহান মনে মনে বলল, মজনু মজনু।