২.৬ চৈত্রমাসে রাই যমুনার যে পথে

‘চৈত্রমাসে রাই যমুনার যে পথে নাইতে যেতেন, সে পথ জল ঢেলে কানু শীতল করে রাখতেন। দুপুরে পশরা নিয়ে যাবার সময় হাতজোড় করে এসে বলতেন, “এই দুপুরবেলা পথের ধুলো তেতে উঠেছে, তুমি এই কদমগাছের নীচে এসে খানিকটা বিশ্রাম করো, পথে আসতে বড় ব্যথা পেয়েছ!” তারপর রাই বসলে, কৌতুক করে বলতেন, “কত মণিমুক্তা তোমার গায়ে ঝলমল করছে। ব্রজের আহীরেরা দিনদুপুরে ডাকাতি করে, তুমি কোন সাহসে বের হয়েছ? এইখানে আমার কাছে থাকো। তোমার মুখখানি পদ্মের মতো, কী জানি যদি ভ্রমরের দল ফুল ভেবে দংশন করে! তুমি এইখানে আমার কাছে থাকো।”

তারপর, দানী সেজে রাইয়ের ওপর কত কৌতুকের জুলুম করেছেন, ‘দান দাও’ বলে পথ আগলে হাত পেতেছেন, সে সকল দিনের কথা স্মরণ করে রাইয়ের চৈত্রমাস কী করে কাটবে?’

এই তরি পড়ে ফুলমতি আনমনা হল। বহুপুরানা, পোকায় খাওয়া চটি বইখানা বন্ধ করে উদাস চোখে উঠানের কোণে তুলসী মঞ্চটার দিকে তাকিয়ে রইল।

ফুলমতি বসে আছে পুবের ভিটির প্রায় ভেঙেপড়া দরদালানের বারান্দায়। বারান্দা আর দালানের ভিতরকার কামরাগুলি গোবর আর আঁটালমাটির মিশেল দিয়ে যত্ন করে লেপা, পয়পরিষ্কার। দরদালানে পলেস্তারা বলে কিছু নাই, শুধুই বহুকাল আগের ছোট সাইজের খয়েরি রঙের ইট চারদিকে। ছাদ দেওয়ালের কোথাও কোথাও এখনও জেগে আছে দুই এক চাক সুরকি। কখনও কখনও আপনা আপনিই ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে।

দরদালানের এদিক ওদিকে গজিয়েছে বট অশখের চারা। কোনও কোনওটা বড়ও। হয়েছে। চৈত্রদিনের বিকালবেলার হাওয়ায় নিজেদের মধ্যে যেন ফিসফাস করছিল বট অশখের পাতারা। পিছন দিককার কার্নিশে চাক বেঁধেছে মৌমাছি। দিনভর মধু নিয়ে চাকে আনাগোনা তাদের। দিনভর গুনগুন শব্দ।

এখনও শব্দটা পাচ্ছিল ফুলমতি।

বারান্দায় পুরানা ছপ (মাদুর) বিছিয়ে বসেছে সে। দুপুরের পর পর ঠাকরুনবাড়ির বড় পুকুরের পুবপারে কয়েক ঘর বাসিন্দার কোনও কোনও বউঝি আসে ফুলমতির কাছে। কখনও রামায়ণ মহাভারতের গল্প, কখনও পুরাণের গল্পগাথা, কখনও বা কোনও বই থেকে। ধর্ম আর দেবদেবীর কথা তাদেরকে পড়ে শোনায় ফুলমতি। এই সময়টা তার যেমন প্রিয়, যারা তার কাছে আসে তাদেরও তেমন প্রিয়। আর ফুলমতি কথা বলে এত সুন্দর করে, পড়ে এত সুন্দর করে, সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে।

আজ ফুলমতির কাছে এসেছে গণেশ নাপিতের বড়মেয়ে আরতি আর নিমাইয়ের বউ মায়ারানি। মায়ারানির কোলে দুই বছরের মেয়ে পুষ্প। মেয়েটা এতই চুপচাপ ধরনের, শব্দ বলতে গেলে করেই না। মায়ের লগে সেও যেন মুগ্ধ হয়ে শুনছিল চৈত্রদিনে কৃষ্ণের বিরহে। কাতর হওয়া রাধার মনোকষ্টের কাহিনি।

বাড়িতে এখন লোক বলতে ফুলমতির মা বাসনা। দুইদিন ধরে একটু একটু জ্বর তার। লগে খুসখুসা কাশিও আছে। এই নিয়ে সংসার সে একদমই সামলাতে পারছে না। কাঁথা গায়ে ওই তো শুয়ে আছে বারান্দার লগের কামরায়। সংসার দু’দিন ধরে সামলাচ্ছে। ফুলমতি।

বাপ রামদাস পানের কারবার করে। দেশগ্রামের লোকে আস্তে ধীরে তাকে পাউন্না বলতে শুরু করেছে। রামদাস পাউন্না। আজ সকালবেলা উঠে সে চলে গেছে মুনশিগঞ্জের ওদিককার রনছ পারুলপাড়া নামের এক গ্রামে। সেই গ্রাম পানের বরজে ভরা। সেখান থেকে সস্তায় পান এনে শ্রীনগর, দিঘলি আর নয়তো গোয়ালিমান্দ্রার হাটে বিক্রি করবে। এই কারবারে রোজগার তার মন্দ না।

বড়ছেলে নিখিলকে অনেকদিন ধরেই চাইছে এই কারবারে নামাতে। নিখিল গা করছে। না। বাপের মুখের উপর একদিন বলেছে, মইরা গেলেও পাউন্না অমু না।

কিন্তু রামদাসের ছোট দুইছেলে সেন্টু মিন্টু বাপের কারবারটা পছন্দ করছে। চাষবাসের ফাঁকে ফাঁকে পাউন্না হতে কোনও আপত্তি নাই তাদের।

বারান্দায় বসে উদাস হয়ে ফুলমতি কি এখন এসব কথা ভাবছে! নাকি ভাবছে তার নিজের কথা। বাল্যবিধবা জীবনের কথা!

আরতি বলল, কী অইলো? ও দিদি, আর পড়বেন না?

উদাস মুখোন হাসিহাসি করল ফুলমতি। না গো দিদি, আইজ আর পড়ুম না। ভাল্লাগতাছে না।

মায়ারানি বলল, ক্যা, কী অইছে আপনের?

কিছু অয় নাই। মা’র শইলডা ভাল না তো, দুইদিন ধইরা বাড়ির বেবাক কাম করি, শইলডা কেলান্ত লাগে।

আরতি বলল, হ। আপনের মুখ দেইক্কাঐ বুজা যাইতাছে। এত সোন্দর মুখহান হুগাইয়া গেছে।

মায়ারানি বলল, হুগাউক আর যাই করুক, দিদির লাহান সোন্দর মাইয়া এই দেশে আর একজনও নাই। না হিন্দুগো ঘরে না মোসলমানগো ঘরে।

এই ধরনের কথা শুনলে ফুলমতির অস্বস্তি লাগে। ভেতরে ভেতরে কীরকম জড়সড় হয়ে যায় সে। এখনও হল। কিন্তু এই নিয়ে কোনও কথা বলল না।

মায়ারানি বলল, দিদি যুদি মোসলমান ঘরে জন্মাইতো তয় এমুন জীবন দিদির অইতো না। এত সোন্দর মাইয়া, এত গুণে ভরা, যেমন কামকাইজ যেমন লেখাপড়া চালচলন, জামাই মইরা যাওনের পরও বহুত বড়ঘরে দিদির বিয়া অইতো।

আরতি বলল, দিদি যুদি কইলকাত্তায় থাকতো তাও তার আবার বিয়া অইতো। আমি হুনছি ইন্ডিয়াতে আইজ কাইল হিন্দু বিধবাগো বিয়া হয়।

ফুলমতি শান্ত গলায় বলল, চুপ কর। এই হগল প্যাচাইল পারি না। আমার ভাল্লাগে না।

আরতি একটু একরোখা ধরনের মেয়ে। ধমকধামক পাত্তা দেয় না। তবে এখন সে অন্যকথা বলল। ও দিদি, আপনে কোন কেলাস তরি পড়ছেন?

ফুলমতি বলল, কোনও কেলাস না।

তয়?

বাইত্তে বইয়া বইয়া যেডু হিগার হিগছি।

মায়ারানি বলল, আপনের আসলে সবদিক দিয়াঐ পোড়া কপাল। বড়ঘরে জন্মাইলে বহুত বিদ্যান অইতেন আপনি। জজ বালিস্টার (ব্যারিস্টার) অইতেন।

পুষ্পর বোধহয় ক্ষুধা লেগেছে। একহাতে মায়ের বুক খুঁজছিল সে। মায়ারানি হয়তো বুকের দুধ দিতও মেয়েকে কিন্তু তখনই বারবাড়ির দিক থেকে হনহন করে হেঁটে ভিতর বাড়িতে ঢুকল নিখিল। হাতে ঝুলছে দুইখান ডেকরা মোরগ।

নিখিলকে দেখে মেয়েকে আর বুকের দুধ দিল না মায়ারানি। আরতিকে বলল, ল রে আরতি, বাইত যাই। নিখিল দাদায় আইছে, অহন কাম আছে দিদির। ওই যে মোরগ দেকতাছচ অহনঐ মোরগ জব কইরা কষাইয়া দেওন লাগবো দাদারে।

মায়ারানি বা আরতির দিকে তাকাল না ফুলমতি। নিখিলের দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বলল, আইজ আমি আর কিছু পারুম না। আমার খুব কেলান্ত লাগতাছে।

নিখিল হাসিমুখে বলল, উপায় নাই। করন লাগবো। তুই তেল মেশলা বাইর কর, আমি মোরগ জব কইরা, বানাইয়া দিতাছি।

মায়ারানি আর আরতি তখন উঠান পেরিয়ে চলে যাচ্ছে।

ফুলমতি বিরক্ত গলায় বলল, দুই-চাইর দিন পর পর এইকাম আমার ক্যান করন লাগবো? তর অন্য দোস্তগো বাড়ির কেঐ রানতে পারে না?

পারে। তয় তর লাহান না।

এই হগল কথা কইয়া আমারে ভুলান লাগবো না। আইজ আমি পারুমঐ না।

নিখিল অনুনয়ের গলায় বলল, দিদি তো ভাল। আউজকারডা কইরা দে। এরপরে আতাহাররা আবার যেদিন কইবো, আমি কমুনে দিদির শইল ভাল না। দিদি আইজ পারবো না।

রান্নাঘর থেকে বঁটি নিয়ে মোরগ কাটতে বাড়ির উত্তর দিকককার জঙ্গলমুখী চলে গেল নিখিল।

ফুলমতি বুঝেছে, যত ক্লান্ত থাক আর যাই থাক, উপায় নেই। কাজটা তাকে করতেই হবে।

তারপর সে উঠেছে। ঘরে গিয়ে হাতের বই জায়গা মতো রেখেছে, চৌকির দিকে তাকিয়ে দেখেছে মা জেগে আছে না ঘুমিয়ে।

ঘুমিয়েই আছে।

ফুলমতি তারপর রান্নাঘরে এসে ঢুকেছে। মশলা কিছুটা বাটাই থাকে রান্নাঘরে, শুধু চাক চাক করে পিঁয়াজ কাটতে হবে। তারপর তেল মশলা পিঁয়াজ দিয়ে কষাতে হবে মাংস।

ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে ফুলমতি তারপর পিঁয়াজ কুটতে বসেছে। পেঁয়াজ কোটা শেষ হতে না হতেই মোরগ বানিয়ে পুকুরঘাট থেকে ধুয়ে পাকলে একেবারে রেডি করে নিয়ে এসেছে নিখিল। এখন শুধু চড়িয়ে দিলেই হবে।

গুছিয়ে রান্নাটা চড়াল ফুলমতি।

নিখিল একটা সিঁড়ি নিয়ে বসেছে বোনের পাশে। বসে বুক পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ধরাল। উদাস হয়ে টানতে লাগল।

কয়েক পলক ভাইকে দেখল ফুলমতি, হঠাৎ করে বলল, তর দিন কি এমতে যাইবো নিখিল?

আচমকা এরকম একটা প্রশ্ন, নিখিল চমকাল। বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কেমতে?

এই যে দোস্তগো লগে আমোদফুর্তি কইরা, মদ খাইয়া, সংসারের মিহি না চাইয়া।

এইডা ছাড়া কী করুম ক! বাবায় যেই কামের কথা কয় হেই কাম ভাল্লাগে না।

তয় অন্যকাম কর। ঢাকা গিয়া চাকরিবাকরি ল।

একথা শুনে চমকে উঠল নিখিল। আরে না না, গেরাম ছাইড়া যাওন যাইবো না।

ক্যা?

নিখিল সিগ্রেটে টান দিয়ে বলল, এমতে।

একটু থেমে কথা যেন ঘুরাল। ঢাকা গিয়া আমার ভাল্লাগবো না। বেবাকতে দেশে থাকবো আর আমি থাকুম ঢাকা, টিকতে পারুম না দিদি।

ফুলমতি গম্ভীর গলায় বলল, খালি এইডাঐ কারণ?

তয় আর কী কারণ থাকবো, ক? তরা বেবাকতে এহেনে, আমার দোস্তরা এহেনে আর আমি গিয়া থাকুম ঢাকায়, ধুৎ, মইরা গেলেও আমি হেইডা করুম না।

মাংসের হাঁড়িতে হাতা দিয়ে খানিক উলট পালট করে ফুলমতি বলল, আমি কইলাম জানি তুই কীর লেইগা যাইতে চাস না।

কীর লেইগা ক তো?

আমার লেইগা।

কী?

হ। আমার কথা চিন্তা কইরা তুই কোনওহানে যাইতে চাস না। এক রাইত গেরাম ছাইড়া থাকচ না।

বোনের চোখের দিকে তাকিয়ে নিখিল বলল, কে কইছে তরে?

আমি জানি। আমার লেইগাঐ আতাহারগো লগে দুস্তি কইরা চলছ তুই, অরা তরে চাকরের লাহান খাড়ায়, যা তা কইয়া গাইল দেয়, বেবাক তুই মাইন্না লইতাছচ খালি আমার লেইগা। নিজের জীবন তুই নষ্ট করতাছস আমার লেইগা।

নিখিল কথা বলল না। উঠানের দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে সিগ্রেট টানতে লাগল।

হাঁড়ির মাংস আবার উলট পালট করল ফুলমতি। সেই ফাঁকে তেল মশলা লং এলাচের গন্ধ উঠে ছড়িয়ে গেল ঘরে। হাঁড়িতে বলকে ওঠা তেলজলের ঘড়ঘড় একটুখানি শব্দও পাওয়া গেল।

এসবের কোনও কিছুই যেন খেয়াল করল না ফুলমতি। আগের মতোই উদাস গলায় বলল, আমি জানি আতাহারগো লগে থাইক্কা তুই আসলে অগো মন ভুলাইয়া রাখচ, আমারে পাহারা দেচ। এইডা না করলে যহন তহন বিপদ অইবো আমার। আমরা হিন্দু মানুষ। আমগো পক্ষে থাকবো কেডা? রাইত বিরাইত যহন তহন অরা আইয়া….।

সিগ্রেট ছুঁড়ে ফেলে নিখিল রুক্ষ গলায় বলল, চুপ কর। এই হগল চিন্তা তর করন লাগবো না। আমি যা করতাছি, যেমতে চলতাছি এমতে চলনঐ ভাল।

কিন্তু আমার লেইগা তুই তর জীবন নষ্ট করতাছচ ক্যা? আমারে তুই আমার কপালের উপরে ছাইড়া দে। তুই তর পথ দেখ। আমার কপালে যা আছে তাই অইবো। মনে কর আমি তর বইন না, আমি তর ভাই।

নিখিল আর কোনও কথা বলল না, চুপচাপ উঠানের দিকে তাকিয়ে বসে রইল। চৈত্রদিনের বিকালবেলার ছায়াময় রান্নাঘরে বসে থাকা দুটি ভাইবোনকে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হচ্ছিল।

.

কী রে, মালাউনের বাচ্চায় দিহি অহনতরি আহে না!

কথাটা আতাহার কাকে বলল কেউ জানে না, তবে জবাব দিল সুরুজ। মনে অয় মুরগি কষাইন্না অয় নাই।

একথা শুনে খ্যাক করে উঠল আতাহার। চেডের (লিঙ্গের) কথা কইচ না। দুইহান মুরগি কষাইতে কতক্ষুন লাগে?

আলমগীর বলল, ছেমড়ারে মতো দোষ দিচ না। কাম তো খালি মুরগি কষাইন্না না! দুইফরের পর পয়লা গেছে মুরগি বিচড়াইতে। কোন বাইত্তে পাইছে কে জানে! তারবাদে হেই মুরগি লইয়া বাইত্তে গিয়া পয়লা জব করছে, তারবাদে ফইর মইর হালাইয়া মুরগি দুইহান বানাইছে। তারবাদে দিদিরে দিছে কষাইতে। এতডি কাম করতে সময় তো ইট্টু লাগবোঐ।

আলমগীরের কথা শুনে চৌকির পুবকোনায় বসা আলী আমজাদ চোখ তুলে তাকাল। আজ তার পরনে সাদা লুঙ্গি আর লাল সবুজের চেক হাওয়াই শার্ট। কোলের কাছে দুই হাতে ধরা কেরু কোম্পানির বড় বোতলের দুই বোতল মল্টেড হুইস্কি। পাঁচটা কাঁচের গ্লাস রাখা আছে পায়ের কাছে। নীল রঙের প্লাস্টিকের একটা পানি ভরতি জগ আছে। অর্থাৎ মদ খাওয়ার সব ব্যবস্থাই পাকা। শুধু নিখিল এলেই হয়।

কিন্তু নিখিলের জন্যই যে এখনও বোতল ভোলা হয়নি তা না। কষানো মুরগির মাংসের জন্যে অপেক্ষাটা চলছে। আতাহার আর আলী আমজাদ দুইজনেরই স্বভাব হচ্ছে গ্লাসে বড় করে চুমুক দিয়েই ঝাল ঝাল মাংস মুখে দেওয়া, তারপর সিগ্রেটে টান দেওয়া। এই না। হলে মদ খাওয়াটা তাদের জমে না। সুরুজ আলমগীরের অবশ্য এসব সমস্যা নাই, মদের লগে তাদের শুধু সিগ্রেট হলেই হয়। তারপরও মদটা যদি বাংলা হয়, সাধনা নয়তো শক্তি ঔষধালয়ের মৃতসঞ্জীবনী যদি ঠেকায় পড়ে খেতে হয় তখন গ্লাসে চুমুক দেয়ার পর পরই মুখের বদস্বাদ মারার জন্য চানাচুর লাগে। কারণ বাংলা আর মৃতসঞ্জীবনী দুটাই নিকৃষ্ট জিনিস, মুখে দিলে মনে হয় বরকির মুত খাচ্ছি।

তবে কেরু কোম্পানির মালের স্বাদ ভাল। এক্সপোর্ট কোয়ালিটির একটা ড্রাই জিন আছে, সেভেন-আপের লগে লেবু দিয়ে খেলে মন ভরে যায়। খেতে যেমন মজা নেশাও। হয় তেমন। কেরুর হুইস্কির মধ্যে মল্টেডটা অসাধারণ। সহজে পাওয়াই যায় না। এই জিনিসের লগে কেন যে ঝাল ঝাল কষানো গোস্তের দরকার হয় আতাহার আলী আমজাদের, আলমগীর সুরুজ কারও তা মাথায়ই ঢোকে না।

আলমগীর একবার বলতে চাইল, কনটেকদার সাব, বতল খোলেন। ঢালেন গেলাসে। আমরা মারতে থাকি। নিখিলা আহুক অর সুবিদা মতন।

তার আগেই আলী আমজাদ বলল, আলমগীর, তুমি একহান কথা ভুল কইছো।

আলমগীর অবাক হল। কোন কথা?

ওই যে কইলা নিখিলার অনেক কাম। মুরগি জোগাড় কইরা জব কইরা বানাইয়া তারবাদে ফুলমতিরে দিবো কষাইতে।

আলমগীর চোখ ছোট করে বলল, হ, মিছাকথা কইলামনি?

না ঠিকঐ আছে তয় একহান কথা কইছো ভুল।

কোনডা?

মুরগি জব করনের কথা।

আলমগীর কথা বলবার আগে সুরুজ বলল, ক্যা, এইডা ভুল ক্যা?

পকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল আলী আমজাদ। নিজে সিগ্রেট ধরিয়ে খুবই হেলাফেলার সঙ্গে প্যাকেটটা ফেলে রাখল চারজন মানুষের মাঝখানে, ভাবটা এইরকম, যেন সে কাউকে সাধবে না, যার ইচ্ছা খাবে, যার ইচ্ছে নাই সে খাবে না।

সিগ্রেটে বড় করে টান দিয়ে আলী আমজাদ বলল, হিন্দুরা তো কোনও কিছু জব কইরা খায় না। কল্লাডা খালি কাইট্টা হালায়। পুজার সময় হোতনা না পাড়া বলি দেয়। বলি অইলো এক কোবে কলা নামায় দেওন। মুরগিও কইলাম অমতেঐ বলি দেয়!

সুরুজ তার স্বভাব মতো অবাক হল। কন কী?

হ।

আলমগীর বলল, মোসলমান অইয়া আমরা বলি দেওয়া মুরগির কষাইন্না গোস্ত খাই? ওইডা তো হারাম। বিসমিল্লা বইলা জবো না করলে কোনও জিনিস হালাল অয় না!

আলী আমজাদ বলল, হ। একে হিন্দু মাইয়ার হাতের রান্দন, তার উপরে বলি দেওয়া মুরগি, দুইডাঐ আমগো লেইগা হারাম।

সুরুজ সিগ্রেট ধরাল। প্যাকেটটা নিজের মনে করে আলমগীরের দিকে বাড়িয়ে দিল। খাবিনি?

দে।

বলে আলমগীরও সিগ্রেট ধরাল।

আতাহার অনেকক্ষণ ধরে থম ধরে আছে। মুখ দেখে বোঝা যায় নিখিলের উপর রেগেছে। আলী আমজাদ তাকে একটু প্রফুল্ল করতে চাইল। দুই হাতে ধরা মদের বোতল কোলের কাছে রেখে বলল, বোস্তাছি নিখিলার উপরে তুমি খুব চেচ্ছ। চেইত্তো না। আইয়া পড়বো নে। পাঁচজনে মদ খাইতে বইয়া একজনে চেইত্তা থাকলে মজমাড়া জুইতের অয় না।

সিগ্রেটের প্যাকেট দেখিয়ে বলল, নেও সিগ্রেট খাও। আতাহার নাক ফুলিয়ে বলল, আমার কাছে সিগ্রেট আছে।

নিজের বুকপকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল আতাহার, ম্যাচ বের করে সিগ্রেট ধরাল। তার ভঙ্গি দেখে আলী আমজাদ বুঝল, যত কায়দাই করুক আতাহারকে কিছুতেই সুরুজ আলমগীরের কাতারে সে নামাতে পারবে না। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নাই ঠিকই তয় আতাহার তেমন কাক না। সব কিছুর পরও কোনও না কোনওভাবে নিজের মর্যাদা সে রাখে। আলী আমজাদের লগে সবই করে আবার দূরত্বও রাখে। ছোটখাটো নানা রকমের ছলচাতুরি করেও আলী আমজাদ দেখেছে শেষ পর্যন্ত আতাহার আলাদাই থাকে। নিজেকে সস্তা করে ফেলে না। সিগ্রেট নিতে বলে আজও ওরকম একটা পরীক্ষা আতাহারকে সে করল, আতাহার ঠিকই বুঝল ব্যাপারটা, ঠিকই ফসকে গেল। আলী আমজাদের সিগ্রেট ছুঁয়েও দেখল না।

এসব নিয়ে আতাহার আবার কোনও কথা তোলে কি না ভেবে চটপট অন্যদিকে কথা ঘুরাল আলী আমজাদ। হিন্দুগো থিকা কইলাম মোসলমানরা অনেক ভাল।

তার কথা লুফে নিল সুরুজ। কেমুন?

মোসলমান বাইত্তে কইলাম হিন্দুরা সহজে খায় না। আর হিন্দুগো রানঘরে যুদি কোনও মোসলমান হাইন্দা যায় তাইলে কইলাম চুলার বেবাক জিনিস হেরা হালাইয়া দেয়। আবার নতুন কইরা রান্দন চড়ায়। আর আমরা মোসলমানরা কত ভাল, হিন্দুগো হাতের বেক কিছুঐ খাই। এই যেমুন নিখিলার বলি দেওয়া মুরগি, ফুলমতির হাতের রান্ন। জানি যে হারাম খাইতাছি, তাও খাই। জাইন্না হুইনাঐ খাই।

আতাহার বলল, আপনে মিয়া বহুত পঁাচগি মানুষ। কথাবার্তা কোনমিহি ঘুরান বুজা যায় না।

আলী আমজাদ হাসল। আমি বাতাস বুইজ্জা চলি। বাতাস যেই মিহি যায় আমিও হেইমিহিঐ যাই।

এইডা আর আমারে কওন লাগবো না। আমি জানি। আমাগো দলের মইদ্যে আমিঐ আপনেরে সবথিকা ভাল চিনি। হোনেন, বহুত হারাম হালাল তো এতক্ষুণ ধইরা বুজাইলেন, অহন আমার একহান কথার জব দেন তো?

কও।

হিন্দুগো এইডা হারাম, ওইডা হারাম, হিন্দু মাইয়া হারাম না হালাল?

আলমগীর বলল, ধুৎ বেড়া! তুই খালি আকথা কচ।

আলমগীরকে ধমক দিল আতাহার। আকথা কইলে তর কী? তুই চুপ কর।

সুরুজ বলল, আমার হোনতে ভালঐ লাগে। আতাহর, তুই ক।

আলী আমজাদ বলল, তোমরা চুপ করো। জিগাইছে আমারে, জবটাও আমি দেই।

আতাহার বলল, দেন।

হিন্দুগো হাতেরডা খাওন যেমুন হারাম, অগো মাইয়া খাওনও অমুন হারাম।

না, আপনে কিছুই জানেন না। হোনেন আমার কাছে। মোসলমানের লেইগা হিন্দু মাইয়া পুরাপুরি হালাল। আমাগো ধর্মে আছে, যুদ্ধ কইরা বিধর্মীদের সম্পত্তি আর মাইয়াছেইলা দখল করবা। তাদেরকে ভোগ করবা। এইডা জায়েজ। এর লেইগাঐ একাত্তোর সালে পাকিস্তানি মেলেটারিরা খালি হিন্দু মারছে আর হিন্দু মাইয়াগুলিরে ধর্ষণ করছে। ওইডা জায়েজ, মানে হালাল।

আলমগীর তার হাতের সিগ্রেটে শেষ টান দিয়ে ছাপরাঘরের খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে ধীর শান্ত গলায় বলল, ওই আতাহার, তুই তো মুসল্লিঘরের পোলা, ধর্মের কথা অনেক জানচ। তয় একহান কথা ক তো আমারে। আমগো ধর্মে বিধর্মীগো লইয়া যেই হগল কথা আছে, বিধর্মীগো ধর্মেও আমগো লইয়া তাইলে হেই হগল কথাঐ আছে?

হ। তর কথাডা আমি বুজছি। যুদ্ধ জয় করনের পর বিধর্মীগো সহায় সম্পত্তি আর মাইয়াছেইলা ভোগ করন আমগো লেইগা যেমুন জায়েজ, আমগো জাগায় যুদি অরা অয় তাইলে অইবো এইটার উলটা। অর্থাৎ আমগো সহায় সম্পত্তি আর মাইয়াগুলিরে ভোগ করন অগো লেইগা জায়েজ অইয়া যাইবো।

এইবার তাইলে আরেকহান কথার জব দে।

ক।

একাত্তোর সালে পাকিস্তানি মেলেটারিগো মইদ্যে কি হিন্দু সোলজারও আছিলো?

আরে না বেড়া?

তয় আমগো দেশের মোসলমান মাইয়াগুলিরে ধর্ষণ করলো কারা? ওই টাইমে তো তিনলাখ মা বইন ধর্ষিতা অইছে। তার মইদ্যে হিন্দু কয়জন আর মোসলমান কয়জন?

একশোতে নাইলে পঞ্চাশটাঐ ধরা যায় হিন্দু! বাকিডি? তাগো ধর্ষণ করছিল কারা?

সুরুজ বলল, আরে থো এই হগল প্যাচাইল। আইছি মদ খাইতে, শুরু অইছে। পলেটিস।

আলী আমজাদ বলল, তয় আলমগীর যে আওয়ামি লিগ সাপোর্ট করে, এইডা আইজ আবার বুজাইয়া দিলো। এই হগল প্যাঁচ আওয়ামি লিগ ছাড়া আর কেঐর মাথায় খেলবো না। কোনহান থিকা কথাডারে কোনহানে লইয়া গেছে।

আতাহার সিগ্রেটে টান দিয়ে বলল, আমরা এহেকজন এহেক পারটি সাপোর্ট করি, তারবাদেও দোস্ত। একলগে বইয়া মদ খাই।

বোজলাম, কিন্তু নিখিলা তোমগো দোস্ত অইলো কেমতে? তোমরা বেবাকতে বড়ঘরের পোলা, আর নিখিলা অইলো গরিব হিন্দুঘরের। ও তোমগো দোস্ত অইলো কেমতে?

সুরুজ বলল, এই কথার জব আমরা আগেও একদিন দিছি। আমরা চাইরজন কাজির পাগলা ইসকুলে একলগে পড়তাম।

আলমগীর বলল, গরিব অউক আর যাই অউক নিখিলরা বেবাকতে খুব ভাল। মা বাপ ভাই বইন, বেবাকতে।

আলী আমজাদ বলল, তয় আমি আগেও কইছি আইজও আবার কই তোমরা নিখিলারে দোস্ত মনে করো আর যাই মনে করো, ও কইলাম তোমগো তা মনে করে না।

ধুৎ মিয়া, না মনে করলে আমগো লগে দিনরাইত ও আছে ক্যা?

আছে নিজের স্বার্থে। তোমগো লগে আছে দেইক্কাঐ দ্যাশগেরামে এমুন দাপটে অরা থাকতে পারতাছে। তোমগো ডরে অগো কেঐ কিছু কয় না। নাইলে অগো বাড়িঘর জাগা জমিন বেবাক এতদিনে মোসলমানরা দখল কইরা হালাইতো। ফুলমতি আর ফুলমতি থাকতো না। বারাঙ্গনা অইয়া যাইতো।

আতাহার বলল, আমি আপনের লগে একমত। আমার দোস্তরা এইডা বুজুক না বুজুক আমি বুজি। বুজি দেইক্কাঐ নিখিলারে চাকরের লাহান খাড়াই। আর গোপন একহান খায়েশও আছে মনে। হেইডা আপনেগো কেঐরে কমুনা। একদিন ওই খায়েশহানও আমি মিডামু। আমিও আমার বাপের লাহান।

তখনই দরজার সামনে এসে দাঁড়াল নিখিল। তার হাতে চার বাটির পুরানা আমলের টিফিন কেরিয়ার। ছাপরাঘরের চৌকির উপর জ্বলছিল হারিকেন, হারিকেনের আলোয় নিখিলের মুখোন করুণ, বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল।

.

গভীর রাতে ভাত খেতে বসে তছি বলল, নাইতে গিয়া আমার মনডা বহুত খারাপ হইছে মা।

রোয়াইলতলার ঘরে টিমটিম করে জ্বলছে পিতলের কুপি। সেই আলোয় খানিক আগে গোসল করে আসা তছিকে ভিজা ভিজা দেখাচ্ছে। মাথার চুল এখন বেলকাটার মতো লম্বা। হয়েছে। দিনভর কাঁথার তলায় থাকার ফলে, রোদহাওয়া গায়ে না লাগার ফলে শরীরের রং হয়েছে পাকা গাবের ভিতরকার মতো। মুখ ফুলে ঢলঢল হয়েছে। শরীরও মোটার দিকে।

মা বুঝতে পারে, শুয়ে থাকার ফল।

রাত অনেকখানি হয়ে যাওয়ার পর, বাড়ির লোকজন খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর রোজ রাতের মতো আজও কাঁথার তলা থেকে বেরিয়েছে তছি। বেরিয়ে মাথার কাছে রাখা ধোয়া শাড়ি হাতে ঘর থেকে বেরিয়েছে। আজ ম্যাটম্যাটে একটুখানি জ্যোৎস্না আছে, সেই আলোয় পেসাব পায়খানা সেরে উঠানের কোণের চুলা থেকে একখাবলা নাড়ার ছাই তুলে অনেকক্ষণ ধরে দাঁত মেজে গেছে পুকুরঘাটে নাইতে। বদনা ভরে পানি তুলে অনেকক্ষণ ধরে নেয়ে খানিক আগে ঘরে এসে খেতে বসেছে।

হুমহাম করে খেতে খেতেই কথাটা বলল।

আজ ক’দিন হল বারেক ছেলেটি রানাদিয়া গেছে নানার বাড়ি বেড়াতে। গিয়ে দাদিকে ভুলেছে। রাতবিরাত যখন তখন নাতির কথা মনে পড়ে তছির মা’র। একদিকে তছির জন্য জ্বালা, অন্যদিকে নাতির জন্যও বুকটা পোড়ায়।

মানুষের যে কতরকমের অশান্তি!

দিনে ভাত তছি আজকাল আর খায় না। খায় রাতে। একবার সন্ধ্যারাতে, আরেকবার ভোররাতে। সন্ধ্যারাতে খেয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। অন্ধকারে ভূতের মতো সারারাত ঘুরে বেড়ায় বাড়িতে। পেটের ভাত হজম হওয়ার পর ঘরে এসে আরেকবার খায়। মা’কে। ডেকে তুলে আবার ঢুকে যায় কাঁথার তলায়। সে যতক্ষণ জেগে থাকে মা ঘুমায়, আর সে যখন ঘুমায় মা তখন জেগে বসে থাকে শিথানে।

নাতির জন্য ঘুমটা রাতে ক’দিন ধরে ভাল হয় না তছির মা’র। যখন তখন ভাঙে। আজও ভেঙেছে। ভাঙার পর উঠে বসে আছে। মা’কে জাগনা দেখেই কথাটা তছি বলল।

মা বলল, কীর লেইগা মন খারাপ অইছে তর?

তছি ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে চাবাতে চাবাতে বলল, আইজ্জাদার বউর লেইগা?

বানেছার লেইগা?

হ।

কী করছে বানেছা?

ঘাটপার গিয়া হোনলাম বিলাপ কইরা কানতাছে। নাদেরের বাপ গো, ও নাদেরের বাপ, আমগো হালাইয়া কই গেলা গা তুমি! এতডি পোলাপান লইয়া আমি অহন একলা একলা কেমুন করুম? আমার কথা নাইলে তুমি ভুইল্লা গেলা, এতডি পোলাপানের একজনের কথাও তোমার মনে অয় না? কেঐর লেইগা ইট্টু মায়া লাগে না? নাদেরের বাপ গো, ও নাদেরের বাপ, ফিরা আহো তুমি। আল্লা রসুলের দোহাই লাগে, ফিরা আহ।

ভাত খাওয়া শেষ করে ঢকঢক করে একগ্লাস পানি খেল তছি। যে গামলায় খেয়েছে সেই গামলায়ই কচলে কচলে হাত ধুয়ে ফেলল।

তছির দুপুর আর রাতের ভাত একবারেই সন্ধ্যাবেলা নিয়ে আসে তছির মা। প্রথম প্রথম। আবদুলের বউ বিরক্ত হত, বলত, এইডা কোন রঙ্গের পাগলামি? এমুন তো কোনওদিন দেহি নাই যে কোনও পাগলের কাছে দিন গেছে রাইত অইয়া আর রাইত অইছে দিন। যত রঙ্গের কারবার এই বাইত্তে।

কিন্তু করার নেই কিছুই। মেনে নিতে হয়েছে। এই পাগলামির ভিতরে যে কী রহস্য জানে শুধু তছি, তার মা আর ভাই।

হাত ধুয়ে আঁচলে হাত মুখ মুছল তছি। দুঃখী গলায় বলল, এমুন কামডা আইজ্জাদায় কীর লেইগা করলো কও তো মা?

ইচ্ছা কইরা করছেনি? আমার মনে হয় জিনেরা যা কয় কউক, আইজ্জা বাইচ্চা নাই। ডাকাইতেঐ খাইছে অরে।

না ডাকাইতে খায় নাই। হেয় বাইচ্চাঐ আছে।

তুই কেমতে কচ?

আমার মনে কয়। আমি দেকছি আমার মনে যা কয় হেইডা সত্য অয়।

তছির কথা শুনে মা একটু উদগ্রীব হল। খুনের ঘটনার পর তছি অনেক বদলেছে। তার কথাবার্তা চালচলন এখন সুস্থ মানুষের মতো। মনের মধ্যে চেপে বসে থাকা অপরাধের চাপে বুঝি মাথার গন্ডগোল কেটে গেছে তার। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কোনও কোনও পাগলের ভিতর আধ্যাত্মিক শক্তি এসে ভর করে। কামেল ফকির হয়ে যায় তারা। তছির তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি তো?

আল্লাহ, আল্লাহ! যদি তেমন হয়ে থাকে তছি তা হলে বেঁচে গেল। কামেল ফকির ধরনের পাগল মেয়েমানুষ কাউকে খুন করতে পারে এই সন্দেহ দারোগা পুলিশরা কখনও করবে না। জেল ফাঁসি কিছুতেই হবে না তছির।

অতি উৎসাহের গলায় মা বলল, ক তো তয় কী কয় তর মনে?

আমার মনে কয় আইজ্জাদার কিছু অয় নাই। হেয় ভাল মতনঐ বাইচ্চা আছে। দূরের। কোনও দেশগেরামে আছে। ইচ্ছা কইরাঐ বাইত্তে আহে না।

আইবো তর মনে অয়?

হ আইবো। না আইয়া পারবো না।

কীর লেইগা এমুন পলাইয়া রইছে?

মনে অয় আমার লাহান কোনও কাম করছে হেয়।

শুনে চমকে উঠল মা। কী? খুন করছে?

তছি বিরক্ত হল। আরে না, খালি খুন করনঐ খারাপ কাম নি? এইডা ছাড়াও তো কত খারাপ কাম আছে। খুনের থিকাও বড় খারাপ কাম আইজ্জাদায় হের মা’র লগে করছে। বউর ডরে মা’রে ভাত দেয় নাই।

হ এইডা ঠিক কথা।

তারবাদে মাইয়াডারে দিল জঙ্গলে হালাইয়া। খরচের ডরে দাফোন কাফোন করলো না। এই কামড়াও খারাপ।

তছির কথা শুনে অবাক হচ্ছিল মা। একদম ভাল মানুষের মতো কথা। বুঝদার মানুষের মতো কথা। কাঁথার তলায় শুয়ে শুয়ে কোন ফাঁকে পাগল মেয়েটা এভাবে বদলে গেল, ভাল হয়ে গেল! এভাবে কথা বলতে শিখে গেল কখন?

তছি একবার মায়ের দিকে তাকাল, তারপর ফুঁ দিয়ে কুপি নিভিয়ে দিল।

মা অবাক। কুপি নিভালি ক্যা?

বোজ নাই কীর লেইগা নিভাইলাম?

বুজছি। কোনহান থিকা কেঐ য্যান না দেকতে পায় হাজামবাড়ির রোয়াইলতলার ঘরে রাইত দোফরে কুপি আঙতাছে। কেউ য্যান কিছু সন্দ না করে।

হ।

বাইরে মধ্যরাতের ম্যাটম্যাটে জোৎস্না আছে। ঘরের ভাঙাচোরা বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে জ্যোৎস্নার আভাস দেখা যায়।

তছি একবার জ্যোৎস্না দেখল। তারপর বলল, রুস্তম রিশকাআলারে খুন কইরা আমার যেই দশা অইছে, মা’র লগে মাইয়ার লগে খারাপ কামড়ি কইরা আইজ্জাদারও হেই দশাঐ অইছে। আমি পাগল অই আর যাঐ অই মাইয়ামানুষ তো! আমি তো ইচ্ছা করলেঐ কোনও মিহি চইলা যাইতে পারি না। দুইন্নাই ভইরা ঐত্তো খালি রুস্তম রিশকাআলা। যে যেহেনদা পারবো জঙ্গল মিহি টাইন্না নিতে চাইবো। কয়জনরে খুন করুম আমি! কয়জনের হাত থিকা বাঁচুম! এর লেইগা নিজেগো বাইত্তে, নিজেগো ঘরে কেঁতার তলে পলাইয়া থাকি। আইজ্জাদায় তো পুরুষপোলা, এর লেইগা হেয় পলাইছে বাড়ির বাইরে। পুরুষপোলাগো তো কোনও অসুবিদা নাই, যেহেনে রাইত হেহেনে কাইত। তয় আমার মনে কয় ফিরত আইবো আইজ্জাদায়। কয়দিন সংসার থিকা, বউ পোলাপানের কাছ থিকা পলাইয়া থাইক্কা, নিজের দোষের কথা, গুণার কথা যহন ইট্টু কইম্মা আইবো মনে, তহন ফিরত আইবো, দেইক্কোনে।

সত্যঐ কচ তুই?

হ সত্যঐ কই।

আল্লায় য্যান তাই করে গো মা, আল্লায় য্যান তাই করে। নাইলে এতডি পোলাপান লইয়া কী উপায় অইবো বানেছার!

তছি আর কথা বলল না। চুপ করে বসে রইল।

মা বলল, তরে একহান কথা জিগামু মা?

তছি শান্ত গলায় বলল, জিগাও।

তুই কি আসলেই পাগল, নাকি ভাল অইয়া গেছচ?

 মায়ের কথা শুনে তছি অবাক হল। আথকা এই কথা জিগাইলা ক্যা? তুমি জানোনা আমি ছোডকাল থিকা পাগল, জন্ম থিকা পাগল।

হ জানি তো। জানুম না ক্যা? তুই তো আমার পেডেঐ অইছচ। মায় জানবো না মাইয়া কেমুন!

তয় আবার জিগাও ক্যা?

জিগানের কারণ আছে।

কী কারণ?

কয়দিন ধইরা আমার মনে অয় তুই আর পাগল না। তুই ভাল অইয়া গেছচ।

একথা শুনে একটুও অবাক হল না তছি। আগের মতোই ধীর শান্ত গলায় বলল, সত্য তোমার মনে অয় মা?

হ।

তছি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্য কথাঐ মনে অয় তোমার।

মা চমকাল। কী?

হ। আমি অহন আর পাগল না। আমি ভাল অইয়া গেছি। মাথা নাইড়া কইরা যেদিন কেঁতার তলে ঢুকছি হেদিন থিকা ইট্টু ইট্টু কইরা ভাল অইয়া গেছি মা।

একটু থেমে বলল, তয় ভাল অওন মনে অয় ঠিক অয় নাই মা?

ক্যা? ক্যা ঠিক অয় নাই?

আমার খালি ওই বেডার কথা মনে অয়। রুস্তম রিশকাআলা। মরণের সমায় কেমুন দাপড়ানডা দাপড়াইছিলো। বাঁচনের লেইগা কেমুন চেষ্টা করছিলো। কেঁতার তলে হুইয়া হুইয়া আমি খালি বেড়ার ওই চেহারা দেহি মা। ঘুমাইয়া থাকলেও দেহি, জাইগ্না থাকলেও দেহি। আর খালি নিজের মরণের কথা মনে অয়।

শুনে বুকটা কেঁপে উঠল মায়ের। কী, কী মনে অয়?

নিজের মরণের কথা। মরতে তো একদিন অইবোঐ। আমি যেমতে বেডার জান কবচ করছিলাম আজরাইল আইয়া আমার জানডাও তো ওমতেই কবচ করবো। তহন আমিও তো বেডার লাহান দাপড়ামু, বাঁচনের চেষ্টা করুম। আমার খালি এই হগল কথা মনে অয় মা। আর বেড়ার চেহারার বদলে আমি খালি তারবাদে নিজের চেহারা দেহি। গলায় য্যান ফাঁস দিয়া ধরছে আজরাইলে, চকু দুইহান বাইর অইয়া আইতাছে আমার, জিবলাহান বাইর অইয়া আইতাছে। মাগো, আমার তহন বহুত ডর করে মা। বহুত ডর করে।

মেয়ের কথা শুনে বুক তোলপাড় করে মায়ের। চোখ ফেটে নামে কান্না। কথা না বলে অন্ধকার ঘরে মেয়ের মাথাটা বুকে টেনে আনে। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে দুইহাতে মা’কে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে মেয়ে। ফিসফিস করে বলে, তুমি সব সময় আমার শিথানে বইয়া থাইক্কো মা। বইয়া বইয়া আমারে পাহারা দিয়ো। আমার জান কবচ করতে আজরাইল য্যান কেঁতার তলে না ঢুকতে পারে।

মা কোনও কথা বলে না। মা শুধু কাঁদে।

.

ও ফুবু, একখান কথা জিগামু তোমারে?

দুপুরের পর গোলাঘরের চৌকিতে কাত হয়েছে রহিমা। সারাদিনে এই সময়ই কিছুটা আজার পায় সে। সকাল থেকে শেষ দুপুর পর্যন্ত একটানা কাজ করে, বাড়ির লোকজনের খাওয়াদাওয়া যখন শেষ হয় তখন সে গিয়ে সামনের পুকুরে চওড়া তক্তা ফেলে যে ঘাটলা করা হয়েছে সেই ঘাটলায় বসে। ক’দিন হল হাসু আসছে তার কাছে। আসার পর থেকে ফুফুর লগে হাসুও আছে সবকাজে, সবসময়। ফুফুর লগে হাত লাগিয়ে সেও সকাল থেকে একটানা কাজ করে। তারপর ফুফু যখন ঘাটলায় গিয়ে বসে হাসুও যায়। হাতে অ্যালুমিনিয়ামের বদনা। ঘাটলায় বসে বদনা ভরে পানি তুলে গোসল করে দুইজনে। শুকনা কাপড়চোপড় রেখে যায় বাড়ির সামনের নাড়ার পালায়। গোসল শেষ করে নাড়ার পালার আড়ালে দাঁড়িয়ে কাপড় বদলে ভিজা কাপড় হাতে আবার যায় ঘাটলায়। পুকুরের পানিতে কাপড় চুবিয়ে ঘাটলার তক্তায় দুই-তিনবার খুচে, শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিপড়ে আবার এনে মেলে দেয় নাড়ার পালায়।

মান্নান মাওলানার বাড়ির কাজের লোকদের সাবান ব্যবহারের কপাল নাই। মাসে এক দুইবার একটুখানি সোডা পায় রহিমা। ওই দিয়ে ত্যানা ত্যানা দুই-একখানা শাড়ি সিদ্ধ করে। মাস ধরে ধুলামাটি যা জমে শাড়িতে, গরম পানি আর সোডায় সেই ধুলামাটির যতটা না কাটে, বেশি কাটে ঘাটলার তক্তায় ফেলে রহিমা যখন কাপড়গুলি আছড়ায়।

আজ তেমন আছড়া-আছড়ির কাজ ছিল না। দ্রুতই গোসল সারতে পেরেছে ফুফু ভাইঝি। নাড়ার পালার আড়ালে দাঁড়িয়ে যখন কাপড় বদলাচ্ছে দুইজনে, রহিমা না, হাসু দেখে পুবদিককার কচুরি ভরতি পুকুরের ওপারে মুকসেইদ্দা চোরার বাড়ির পিছন দিককার জামগাছতলায় দাঁড়িয়ে একটা লোক বিড়ি টানছে আর আড়চোখে হাসুর কাপড় বদলানো দেখছে।

কথাটা ফুফুকে বলেনি হাসু। মনে মনে হাসছে। ওই বেডা, কী দেহো আমারে? আমার শইল অহন আর মাইয়ামাইনষের শইল না। দেহনের কিছু নাই।

লোকটা কে?

মান্নান মাওলানার বাড়িতে বহুদিন ধরে আসা-যাওয়া হাসুর। এই বাড়ির সব শরিককেই হাসু চিনে। আশপাশের বাড়ির লোকজন বউঝি পোলাপান সবাইকেই কমবেশি দেখেছে, চিনে। মুকসেইদ্দা চোরার বাড়ির লোকজনও তার অপরিচিত না। শুধু যার নামে বাড়ির নাম, ‘মুকুসেইদ্দা চোরার বাড়ি’ সেই মুকসেদ আলীকে কখনও দেখে নাই। যখনই এই বাড়িতে আসে তখনই শোনে চুরির দায়ে মুকসেদ আবার ধরা পড়েছে, আবার গেছে জেলে।

এবার কি ছাড়া পেয়ে বাড়ি ফিরেছে মুকসেদ? ওই লোকটাই কি সে?

এসব ভাবতে ভাবতে ফুফুর বাড়ি ফিরেছে হাসু। বাড়ির লোকজনের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাদের খাওয়ার নিয়ম। মাকুন্দা কাশেমকে জেলে দেওয়ার আগেই হাফিজদ্দি নামে একজন গোমস্তা রেখেছেন মান্নান মাওলানা। বিলে গোরু চরাতে দিয়ে দুপুরশেষে সেও আসে ভাত খেতে। তিনজন মানুষ ক’দিন ধরে একলগে বসে ভাত খাচ্ছে। হাফিজদ্দি ভাত খায় খুবই আয়েশ করে, ধীরে সুস্থে। রহিমারও একই অবস্থা। হাসু খায় হুমহাম করে, দ্রুত। যেন এখনই নাকে মুখে ভাত গুঁজে কোনও জরুরি কাজে ছুটতে হবে। এই দেখে প্রথমদিনই হাফিজদ্দি তাকে বলেছিল, এমুন হরতরাইস্যা (ছটফটে) ক্যান তুমি? যেই খাওনের লেইগা দুইন্নাইদারি হেই খাওনডা জুইত কইরা খাও। লোকমান্ডা ভাল কইরা দেও।

হাসু কথা বলবার আগেই রহিমা বলেছে, কইয়া ফয়দা অইব না। হাসু এমন।

আজও তিনজন মানুষ এক বসে খেয়েছে কথা বলতে গেলে হয়ইনি। খাওয়া শেষ করে মাজায় বান্দা গামছা খুলে মুখ মুছেছে হাফিজদ্দি, রান্নাঘরের কোণ থেকে নারকেলের হুঁকা নিয়ে তামাক সাজাতে বসেছে। এখন অনেকক্ষণ ধরে তামাক টেনে আবার বিলমুখী মেলা দিবে। সন্ধ্যার আগে আগে গাইগোরু নিয়ে বাড়ি ফিরবে।

হাফিজদ্দি তামাক নিয়ে বসার পরই ফুফুর গোলাঘরে এসে ঢুকেছে হাসু।

বাড়িটা এখন একেবারেই নিটাল। চৈত্র মাসের দুপুরশেষের রোদ স্থির হয়ে আছে গাছপালায়, ঘরের চালে আর উঠানে। পশ্চিমের ভিটির বাংলাঘরের ছেমায় চালের ছায়া এসে ওই দিককার উঠানের অনেকখানি জায়গা ছায়াময় করেছে। আর সাচ্চারা (সাতচারা) খেলার খোপ কেটেছে মান্নান মাওলানার বড়ছেলে মোতাহারের তিন ছেলেমেয়ে, শিরিন, নসু আর নৃরি। নূরি এখন তার বিধবা মায়ের বুকের কাছে শুয়ে ঘুমাচ্ছে বড়ঘর গোলাঘরের কোণে, পুব-উত্তরের ভিটির চৌচালা পাটাতন ঘরে। শিরিন আর নসু খেলছে। আট-নয় বছরের শিরিনের পরনে নীলের উপর সাদা বুটিদার পুরানা ছেঁড়া জামা আর হাঁটু তরি লম্বা প্যান্ট। প্যান্টের ইলাস্টিক ঢিলা হয়ে গেছে। এখন তার দান। কোনও একটা ঘরে চারা ছুঁড়ে মারার পর লাফিয়ে লাফিয়ে খেলছে সে। নসু উৎসুক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। লাফাবার তালে তালে প্রায়ই পরনের প্যান্ট কোমর ছাড়িয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে শিরিনের। খেলার ফাঁকেই প্যান্ট টেনে তুলছে সে।

নসুর পরনে খয়েরি রঙের মোটা কাপড়ের হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি। গেঞ্জিটা প্রায় নতুন। কয়েকদিন আগে গোয়ালিমান্দ্রা হাট থেকে কেনা হয়েছে।

কিন্তু ছেলেমেয়ে দুইটা একেবারেই চুপচাপ। খেলছে ঠিকই মুখে শব্দ নাই।

হাসু জানে চুপচাপ তারা হয়ে আছে মান্নান মাওলানার ভয়ে। খেয়েদেয়ে মান্নান মাওলানা এসময় ঘুমান। বাড়িতে হইচই হচ্ছে, তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে এটা কিছুতেই সহ্য করবেন না তিনি। উঠে দিকবিদিক ভুলে হাতের কাছে যা পাবেন তাই দিয়ে পিটাতে শুরু করবেন যে শব্দ করেছে তাকে। তার উপর স্ত্রী তহুরা বেগম বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ। বুক ধড়ফড়ানির ব্যারাম হয়েছে। কখনও কখনও বুকে ব্যথাও হয়। ডাক্তার বলেছেন হার্টের অসুখ। সারাদিন চোখ বুজে শুয়ে থাকেন। সামান্য শব্দেও দিশাহারা মতো চোখ খোলেন, বুক ধড়ফড়ানি শুরু হয় তাঁর।

এইসব কারণে বাড়িতে শব্দ বলে কিছু নাই।

এখন এই দুপুরশেষের নির্জনতায় চৈত্র মাসের হাওয়া বইছে গাছের পাতায়, তার একটা শনশন শব্দ আছে, আর রান্নাঘরের পিছন দিককার ঝকড়া মাথার তেঁতুল গাছে একটানা ডেকে যাচ্ছে একটা কাক। কা কা। মাওলানা সাহেবের যত ক্ষমতাই থাক, প্রকৃতির এইসব শব্দ তো তিনি থামাতে পারবেন না। তাঁর কথায় কি আর হাওয়ার চলাচল বন্ধ হবে, গাছের পাতারা নড়বে না। তাঁর কথায় শাসনে কি আর স্তব্ধ হবে মুক্ত পাখিরা, হাম্বা দিতে ভুলে যাবে গোয়ালের গাই গোরু!

এই নির্জনতায় হাসুর কথাটা যেন জোরেই শুনতে পেল রহিমা। চৌকিতে কাত হওয়ার আগে মুখে একটুখানি পান দিয়েছে। তহুরা বেগমের পান খাওয়ার স্বভাব আছে। তাঁর পান থেকে দুই-একটা টুকরা দীর্ঘদিন ধরেই সরিয়ে রাখে রহিমা, সুপারি খয়ের চুন সরিয়ে রাখে। কোনও কোনওদিন গিটঠ দিয়ে রাখে। আজও রেখেছিল। দুপুরের ভাত খেয়ে গোলাঘরের চৌকিতে কাত হয়ে এই পানটুকু অনেকক্ষণ ধরে চাবানোই রহিমার একমাত্র শৌখিনতা।

হাসুর কথা শুনে মুখের পান গালের একপাশে আনল রহিমা। জড়ানো গলায় বলল, কী কথা জিগাবি?

ধানের গোলার পাশে কাজির পাগলা বাজারের চাউলকল থেকে ভাঙিয়ে আনা তিনবস্তা চাউল একটার উপর আরেকটা করে রাখা। সেই বস্তাগুলিতে ঢেলান দিয়ে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসেছে হাসু। চোয়া হয়ে আসা মাথায় বাচ্চা ঘোড়ার লেজের মতো যা কিছু চুল সেইগুলিতে কোন ফাঁকে চলেছে একখাবলা তেল। ফলে মাথায় লেপটে বসা চুল আরও পাতলা দেখাচ্ছে। মেয়েমানুষ হওয়ার পরও যে তার মাথায় দ্রুত পড়ছে টাক তা এই এতটা দূর থেকেও পরিষ্কার দেখতে পেল রহিমা। এই চুলে আধাবিঘত পরিমাণ কালো ভাঙাচোরা একখান কাকুই মনোযোগ দিয়ে চালাচ্ছে হাসু। ঘচঘচ করে খানিকক্ষণ মাথা আঁচড়েই চোখের সামনে কাকুই তুলে দেখছে কাকুইয়ের দাঁতের ফাঁকে উকুন আটকা পড়েছে কি না। পিছার চিকন দাঁড়ার ছোট্ট এক টুকরা রেখেছে হাতের কাছে। কাঁকুইয়ের ফাঁকে উকুন পেলে ওই দাঁড়া দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করছে। বুড়ো আঙুলের এক নখে উকুন রেখে অন্য নখে পুটুস করে চাপ দিয়ে মারছে। পুরা মনোযোগ উকুনের দিকে। রহিমাকে যে একটা কথা বলেছে, রহিমা যে সে কথার পিঠে আরেকখান কথা বলেছে সেদিকে যেন তার মনই নাই।

খানিক অপেক্ষা করে রহিমা বলল, কী রে, কচ না কী কথা?

হ কই কই।

বলেই কাকুইয়ের দাঁত থেকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একটা লিক বের করল হাসু। কাকুই মাটিতে রেখে লিকটা মেরেই রহিমার দিকে তাকাল। অনেকদিন ধইরা মনে করতাছি কথাডা তোমারে জিগামু। এত আহি যাই এই বাইত্তে, কোনহানদা যে দিন জায়গা, কথাডা আর মনেও থাকে না। ফিরত যাওনের পর আবার মনে অয়।

রহিমা আবার বলল, কী কথা?

ছোডকালে আমি আবছা আবছা হুনছি কানিবগে ঠোকর দিয়া বলে আমার বাপের একখান চকু কানা কইরা দিছে। হের লেইগাঐ বলে আমার বাপ দলিলরে মাইনষে কয় কানা দলিল। আসলে ঘটনাডা কী ফুবু? সত্যঐ বগে ঠোকর দিয়া কানা করছে আমার বাপ রে?

হ সত্যঐ।

কেমতে অইছিল এই কাম? কানিবগে পাইলো কই তারে? কেমতে ঠোকর দিলো?

আর কইচ না। এইডা একখান অবিশ্বাসের ঘটনা। আমরা তহন খুব ছোড। আমি হমু এই বাড়ির নূরির লাহান আর দইল্যাদায় (দলিল দাদায়) নসুর লাহান। আমগো গেরামের নাম তো জানচঐ, ষোলঘর (ষোলোঘর)।

বলেই যেন একটু লজ্জা পেল রহিমা। হায় হায় কেমুন কথা কই আমি! খালি আমগো গেরাম কইলাম ক্যা! তর গেরামও তো! তুইও তো ওই গেরামেরঐ মাইয়া, আমগো বাড়ির মাইয়া।

হাসু উদাস গলায় বলল, না আমি ওই গেরামের মাইয়া না। আমি তোমগো বাড়ির মাইয়া না। আমার কোনও গেরাম নাই, কোনও ঘরবাড়ি নাই, মা-বাপ কিছু নাই।

রহিমা টের পেল হাসুর গলায় গভীর অভিমান। অভিমানের কারণটা সে জানে। দ্বিতীয় বিয়ের পর কানা দলিল তার আগের ঘরের একটা মাত্র সন্তানের দিকে ফিরেও তাকায়নি। সত্মায়ের নানারকম অত্যাচার থেকে মেয়েটাকে রক্ষা করেছিল ফুফু রহিমা। মৌছামান্দ্রার এক বাড়িতে এনে তাকে ঝিয়ের কাজে লাগিয়েছে। আজ কত কত বছর কানা দলিল একবারও খবর নিতে আসেনি মেয়ের। মেয়েকে নিয়ে যায়নি বাড়িতে। একওক্ত ভালমন্দ খাওয়ায়নি। যে বাপ মেয়েকে ভুলে গেছে এইভাবে সেই বাপকে মনে রাখবে কোন মেয়ে!

তবু ভাইঝিকে সান্ত্বনা দিল রহিমা। এমুন কথা কইচ না মা। বাপ যত দূরেই থাউক, বাপ তো! জন্মদাতা। তারে তুই অস্বীকার করতে পারবি না!

হাসু মুখ ঝামটে বলল, হইছে, বুজছি। ভাইয়ের পক্ষ লইয়া কথা কওনের কাম নাই। যা কইতা ছিলা হেইডা কও।

হ কই। ষোলঘরের পশ্চিমে একখান খাল আছে, খালের পাড়ে একখান চিতাখোলা। হেই চিতাখোলার পশ্চিমে অইলো আড়ইল বিল। বচ্ছরভর ধানে মাছে ভরা থাকে বিল। আমার বাপে আছিল গরিব গিরস্ত। বিলে দেড়-দুইকানি জমিন আছিল আমগো। হেই জমিনের ধানেঐ দিন যাইতো। কাতি আগন মাসে ধানকাডা লাগতো। ধান কাটতে গিয়া বিলের পানিতে ম্যালা মাছও পাইতো গিরস্তে। মতো বড় বড় কই, পুরানা কই, বুকখান লাল টকটইক্কা। আড়ইল বিলের শীতকাইল্যা কই হোনলেঐ গিরস্তের মোক দিয়া লোল পড়তো। বাবার আছিলো অন্য একখান শক। পাড়ইন (ডাহুক ধরার এক ধরনের খাঁচা) পাইত্তা ডাউক ধরতো। ধান কাডা অইয়া যাওনের পর চোয়া খেতের কোনায়, এই ধর কাতি আগন মাসে পাড়ইন পাইত্তা রাইক্কাইতো। পাড়ইনের ভিতরে ঝুলাইয়া দিতো একছড়া পাকাধান। হেই ধানের লোভে ডাউক গিয়া হানতে পাড়ইনে। হানের লগে লগেঐ পাড়ইনের দুয়ার বন্ধ। বিল বাঐরে ডাউকের তো আকাল নাই। দুই-চাইর দিন পর পরঐ এউক্কা-দুগ্ন (একটা-দুটো) কইরা ডাউক ধইরা লইয়াইতো বাবায়। উড়ানে পলোতে আটকাইয়া থুইতো। জবো কইরা কইরা হেই ডাউকের গোস্ত খাইতাম আমরা। ছোডকালে হারা বচ্ছর ডাউকের গোস্ত খাইতাম আমরা। কুঁকড়া কোনওদিন খাওন লাগতো না। আর বাবার আছিলো ভাল ভালাই খাওনের লোব। ধান কাডা অইয়া গেলে, হেই ধান পাড়াইয়া পোড়াইয়া গোলায় উড়ানের পর মাস দেড়মাস বাবায় কোনও কাম কাইজ করতো না। খালি খাইতো আর হুইয়া থাকতো। কামের মইদ্যে কাম করতে দুইখান। দুইফইরা ভাত খাইয়া পাড়ইন লইয়া যাইতো বিলে, পাইত্তা থুইয়াইতো। বিয়াইন্না রাইত্রে, আন্ধার থাকতে থাকতে গিয়া পাড়ইন লইয়াইতো বাইত্তে। পাড়ইনে রোজঐ দেকতাম একখান দুইখান ডাউক। পলোতে হেই ডাউক আটকাইয়া থুইতো আর আমি দইল্যাদায়, বাড়ির অন্য শরিকের পোলাপান বেবাকতে মিলা ডাউক দেকতাম। মা’র তহন হারাদিন কাম। ইট্টুও আজাইর নাই। হারাদিন চাচি ফুবুগো লগে ঢেঁকি পাড়াইতাছে। আলা চাউলের বউয়া চিতইপিডা আর মউলকা বাবায় খুব সাদ কইরা খাইতো। ডাউকের গোস্ত দিয়া চিতইপিডা নাইলে চাউলের রুডি, ছিটরুডি কাতি আগন মাসে দুই একদিন পর পরঐ খাইতো বাবায়। হারাদিন চেঁকি বাইন্নাও বাবার লেইগা এই হগল রান্দন রানতে অইতো মা’র।

এসব কথা শুনতে ভাল লাগছিল না হাসুর। বলল, হুনতে চাইলাম এক কথা তুমি আর করলা অন্য প্যাচাইল। এত আগিলা দিনের কথা আমি হুইন্না কী করুম! আমারে খালি বাবার কানা অওনের কথা কও। আমি হুনছি কানিবগের কথা তুমি লাগাইছো ডাউকের প্যাচাইল!

মুখে পানের ছোবা এখনও আছে রহিমার। এক গাল থেকে সেই স্বাদের জিনিস আরেক গালে নিয়ে হাসল সে। হোন। ডাউকের কথা না কইলে বগের কথা বুজবি না। একবার পাড়ইন পাইত্তা একখান কানিবগ ধরলো বাবায়।

একথা শুনে ভুরু কোঁচকাল হাসু। পাড়ইনে বগ ধরবো কেমতে? বগে তো ধান খায় না! কীয়ের লোভে পাড়ইনে হানবো?

হোনঐ। কামডা করছিলো বাবায়ঐ। পাড়ইনে ধানের ছড়া না দিয়া দুই তিনডা থোকল টাকি (এক ধরনের ছোট ছোট লালচে ধরনের টাকিমাছ) ঝুলাইয়া দিয়াইছিলো একদিন। ওই য়োকল টাকির লোবে একখান কানিবগ গিয়া হানছে পাড়ইনে। পরদিন বাবায় হেইডারে ধইরা বাইত্তে লইয়াইছে।

হাসু স্বস্তির শ্বাস ফেলল। হ, এইবার বুজলাম। তার বাদে?

মুখের পানে দুই-তিনটা চাবান দিয়া রহিমা বলল, কানিবগ দেইক্কা বাড়ির পোলাপানে তো ফালাইতে (লাফাতে) লাগলো। এতদিন খালি ডাউক দেকছে আর আইজ দেকতাছে। কানিবগ! বাবায় করলো কী, কানিবগটারেও ডাউকের লাহান পলোর মইদ্যে আটকাইয়া থুইলো৷ থুইয়া হাত-পাও ধুইতে গেছে ঘাডে। অহন সকাইল্লা নাস্তা করবো। এক টুপইর (টোপর) মুড়ি, একদলা খাজুইরা মিডাই লইয়া ঘচর মচর কইরা খাইবো ছনছায় বইয়া। আমরা বেবাকতে দূর থিকা পলোয় আটকাইন্না কানিবগ দেকতাছি। দইল্যাদায় আছিলো কই জানি, কানিবগের কথা হুইন্না হাদাইতে হাদাইতে (হাঁপাতে হাঁপাতে) আইলো। আইয়াঐ করলো কী পলোর উপরের মিহি যেই চুঙ্গাডা (চোঙা) আছে হেইডার মইদ্যে চউকু লাগাইয়া ভিতরের মিহি চাইছে। এইয়া দেইক্কা বগটা কেমুন জানি লইড়া চইড়া উটলো। তারবাদে ঠোঁডদুইহান উপরের মিহি উড়াইয়া দইল্যাদার ডাইন দিককার চোক্কে একখান ঠোকর দিল, দিয়া পানির তল থিকা ঠোকর দিয়া বগে যেমতে ছোড মাছ ধইরা ঠোডে উডায় ঠিক অমুন কইরা চডারে দুই ঠোডে ইট্টু ধইরা রাখল তারবাদে কোঁত কইরা মাছের লাহান গিলা হালাইলো।

হায় হায় কও কী?

হ। আসলে অইছে কী, পলোর উপরে দইল্যাদার চকু দেইক্কা, চক্কর লড়ন চড়ন দেইক্কা বকটায় মনে করছে পানির তলে কোনও চেলামাছ লড়তাছে। ঠোকর এর লেইগাঐ দিছিলো।

তারবাদে?

তারবাদে আর কী! দইল্যাদায় কানা অইয়া গেল। দিনে দিনে নাম অইলো কানা দইল্যা।

হাসু স্তব্ধ। চৌকিতে কাত হওয়া রহিমা নড়েচড়ে উঠল। মুখের পানে ঘচর মচর করে আবার কয়েকটা চাবান দিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আহা রে, কত সুখের দিন আছিলো হেইডি। কত মানুষজন বাইত্তে, কত পোলাপান! দইল্যাদার চক্কু বগে খাইয়া হালাইছে দেইক্কা কী চিকরা চিকরি। কেরাই নাও ভাড়া কইরা দইল্যাদারে বাপ চাচারা ফুবারা লইয়া গেল ছিন্নগর। বাজারের নন্দী ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারে দেইক্কা কইলো চকু তো আর হাতের চাড়ি না যে কেঐ টাইন্না উড়াইয়া হালাইলে আবার হইব! যেই চকু গেছে হেইডা গেছে। তয় পোলার তেমুন ক্ষতি অইবো না, হারাজীবন খালি কানা হইয়া থাকবো। ব্যথা বেদনা যাতে না অয়। হেরলেইগা অষইদ দিতাছি।

তখন চৈত্রের বিকাল প্রসারিত হচ্ছিল। বাড়ির উঠান পালানে ছায়া হচ্ছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। তেঁতুলগাছে একটানা ডাকতে থাকা কাকটা কখন উড়ে গেছে। বাংলাঘরের ছেমায়। তখনও সাচ্চারা খেলছে শিরিন আর নসু। ঘুম ভেঙে নূরিও এসে দাঁড়িয়েছে ভাইবোনের পাশে। হাতে টিনের চলটা ওঠা বাটিতে একমুঠ মুড়ি দিয়েছে মোতাহারের বিধবা বউ পারুল। শালিক পাখির মতো খুঁটে খুঁটে মুড়ি খাচ্ছে নূরি আর ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে ভাইবোনের খেলা দেখছে।

ঘরের আবজানো দরজার ফাঁক দিয়ে নূরির দিকে একবার তাকাল হাসু। বলল, অহন তাইলে আরেকখান কথা জিগাই?

বাইরের বিকাল ঘরের ভিতর তৈরি করেছে পাতলা ছায়া। হঠাৎ করেই যেন এই অবস্থাটা দেখতে পেল রহিমা। দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসল। চৌকি থেকে নামতে নামতে বলল, অহন আর কোনও কথা জিগাইচ না লো মা। কইতে পারুম না। বিয়াল অইয়া গেছে। বহুত কাম অহন। ল বাইর অই, কাম কাইজ সারি। কথা জিগাইতে অইলে রাইত্রে জিগাইচ। হুইয়া হুইয়া কমুনে।

ফুফুকে চৌকি থেকে নামতে দেখে হাসুও উঠে দাঁড়িয়েছে। হাতের কাকুই জায়গা মতো রেখে ঘর থেকে বেরুতে যাবে, রহিমা বলল, তয় তর লগেও আমার কথা আছে। আমারে তুই সব কথা খোলসা কইরা একদিন কবি। কীর লেইগা তুই ওই বাইত্তে থাকতে চাচ না, কোন ব্যাডারা তরে জ্বালায়, বেবাক আমারে কবি। তার বাদে আমি হুজুরের লগে কথা কইয়া দেহুম এই বাইত্তে তরে রাখন যায় কি না!

একটুক্ষণ থম ধরে থেকে কী ভাবল হাসু, তারপর গম্ভীর গলায় বলল, আইচ্ছা, একদিন তোমারে আমি বেবাক কথা কমু।

.

আছরের নামাজ পড়ে মন্তাজের সীমানায় এলেন মান্নান মাওলানা। পরনের সাদা পাঞ্জাবি, পেটের কাছটা যথারীতি টাইট হয়ে আছে। নীল রঙের লুঙ্গি গোড়ালির উপর পর্যন্ত পড়েছে। লুঙ্গি তিনি এভাবেই পরেন যাতে গোড়ালি ছাড়িয়ে নীচে নামতে না পারে। পাঞ্জাবির তলায় পেটের কাছটায় গিঁটটু দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রেখেছেন লুঙ্গি। প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ছে ভূঁড়ি, গিটটু দিয়ে না বাঁধলে হাঁটাচলার সময় ভুড়ির কাঁপনে আলগা করে প্যাঁচ দিয়ে রাখা লুঙ্গির খুলে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

মাথায় মাওলানা সাহেবের জরির কাজ করা গোল টুপি। পায়ে টায়ারের দোয়াল (বেল্ট) দেওয়া পুরানা খড়ম। হাঁটার সময় চটর পটর শব্দ হচ্ছিল। দুপুরের ভাত খেয়ে ঘণ্টা দুয়েকের ঘুম দিয়েছেন। চোখ ফোলা ফোলা। নিজের সীমানা পেরিয়ে তিনি যখন মন্তাজের সীমানায় এলেন, মন্তাজদের বড়ঘরের কেবিনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ফিরোজা তাঁকে দেখল। মন্তাজের মায়ের মাথার কাছে বসে তার চুলে বিলি দিচ্ছিল ফিরোজা। বুড়ির তদারকি সারাদিনই করে মেয়েটি। ভয়ার্ত ধরনের, চুপচাপ স্বভাবের মেয়ে। এক পলক মান্নান মাওলানাকে দেখেই চোখ সরিয়ে নিজের কাজে মন দিল। পরনের শাড়ি গোছগাছ। করে একটু যেন জড়সড় হল।

আড়চোখে ফিরোজার এই ভঙ্গিটা দেখলেন মান্নান মাওলানা। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটল তার। খরালিকাল এসে পড়েছে বলে মোটা ফ্লানেলের পাঞ্জাবি তিনি আর পরছেন না। তার শরীরে শীত যেমন গরমও তেমন। কোনওটাই সহ্য করতে পারেন না। এজন্য খরালি আসতে না আসতেই গরম লাগতে শুরু করেছে তাঁর। পাতলা সুতি পাঞ্জাবি পরতে শুরু করেছেন। ফিরোজাকে কেবিনের জানালায় দেখার পর হঠাৎ করেই শরীরে অন্য রকমের একটুখানি গর্মিভাব দেখা দিল। বুকে ধাক্কা লাগল। মন্তাজদের বড়ঘরের কেবিনের জানালা বরাবর উঠানে দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে সবুজ রঙের চিরুনি বের করে হাসিহাসি মুখ করে জানালার দিকে তাকিয়ে পরিপাটি করে দাড়ি আঁচড়াতে লাগলেন।

মান্নান মাওলানাকে দেখে সেই যে মুখ নিচু করে মন্তাজের মায়ের চুলে বিলি কাটার জোর বাড়িয়েছে ফিরোজা সেই জোর আর কমছেই না। খুবই মন দিয়ে কাজটা সে করছে। উঠানে দাঁড়িয়ে যে মান্নান মাওলানা দাড়ি আঁচড়াতে আঁচড়াতে তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন তা যেন তাকিয়ে দেখার সময় নাই ফিরোজার।

ফিরোজার এই ভঙ্গি দেখে বিরক্ত হওয়ার কথা মান্নান মাওলানার, বিরক্ত তিনি হলেন না। শান্ত ভঙ্গিতে দাড়ি আঁচড়ানো শেষ করলেন, চিরুনি পকেটে রাখলেন তারপর খড়মে চটর পটর শব্দ তুলে মন্তাজদের বড়ঘরে এসে ঢুকলেন। চাচিআম্মা, ও চাচিআম্মা! কেমুন আছেন?

মন্তাজের মা বহুবছর ধরে বিছানায় শোয়া। ওঠার ক্ষমতা নাই। চব্বিশঘণ্টা তদারকিতে আছে ফিরোজা। চোখে এখনও একটু একটু দেখতে পায় মন্তাজের মা, কানে কম শোনে। কথাও বলতে পারে তবে পষ্ট না, জড়িয়ে জড়িয়ে যায়। ফিরোজা ছাড়া তার কথা পরিষ্কার কেউ বুঝতে পারে না।

মান্নান মাওলানার গলা শুনে বুড়ি তার জড়ানো গলায় বলল, ওই ফিরি, কে আইলো? কেডা কথা কয়?

ফিরোজা গলা নিচু করে বলল, আতাহার দাদার বাপে।

ফিরোজার এই ধরনের নিচু গলা শুনতে পেল বুড়ি তবে বুঝতে পারল না। বলল, কেডা?

মান্নান মাওলানা খেয়াল করলেন বুড়ি বেশ জোরে জোরে, অনেকটা চিৎকার করে কথা বলে। বোধহয় কানে কম শোনে বলে তার মনে হয় সে আস্তে বললে তার কথা কেউ শুনতে পাবে না। মানুষ সব সময় নিজের অবস্থা দিয়ে অন্যকে ভাবে, অন্যকে বোঝার চেষ্টা করে।

ঘরে ঢুকে মান্নান মাওলানা তখন মাটির মেঝেতে কেবিনের দরজা বরাবর দাঁড়িয়েছেন। শুনলেন মন্তাজের মা বুড়িকে বেশ শব্দ করেই ফিরোজা বলছে, আতাহার দাদার বাপে আইছে। মাওলানা হুজুরে।

মান্নান মাওলানার কথা শুনে বুড়ির আগ্রহ হল। তড়বড়ে গলায় বলল, কো? আইতে ক, আমার কাছে আইতে ক।

কেবিনের দরজার দিকে তাকিয়ে ফিরোজা বলল, আহেন। বুজি আইতে কয়।

খড়ম জোড়া কেবিনে ওঠার সিঁড়ির সামনে রেখে শক্ত পায়ে সিঁড়ি ভাঙলেন মান্নান মাওলানা, কেবিনে বুড়ির যে পাশে ফিরোজা বসে আছে তার উলটা পাশে বসলেন। তিনি কেবিনে ঢোকার লগে লগে, হাঁটা চলার তালে তালে মটমট করছিল কেবিনের পাটাতন, এখন বসার ফলেও তেমন শব্দ হল। এই শব্দে ফিরোজা একটু ভয় পেল। যেই ওজনদার শইল হুজুরের, কেফিনের পাড়াতন ভাইঙ্গা যাইবো না তো!

তার এই ভাবনা এলোমেলো করে দিল বুড়ি। একটা হাত তুলে কোনওরকমে মান্নান। মাওলানার একটা হাত ধরল সে, তারপর হড়বড় হড়বড় করে কী যেন বলল তার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারলেন না মান্নান মাওলানা। ফিরোজার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী কয় রে? কিছুই তো বুজি না।

মান্নান মাওলানার দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল ফিরোজা। বুকে আঁচল টেনে জড়সড় হল। যা কয় হেইডা হোননের কাম নাই।

ক্যা? হোনলে কী অইবো?

আপনে হোনতে চাইলে আমি কইতে পারি।

ক।

বুজি কইলো গাছির মাইয়ার কথা।

নূরজাহানের কথা বলেছে মন্তাজের বুড়ি মা শুনেই শক্ত হয়ে গেলেন মান্নান মাওলানা। কাঁচাপাকা ঘন চাপদাড়ির আড়ালে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তাঁর, চোখ ধকধক করতে লাগল। তবে এসবই কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরই নিজেকে সামলালেন তিনি। গম্ভীর গলায় বললেন, গাছির মাইয়ার কথা কী কইলো?

ওই যে আপনেরে ছ্যাপ ছিডাইছে হেই কথা।

এই কথা হেয় হোনলো কই? তুই কইছচ?

না।

তয়?

ফিরোজা কথা বলল না, চুপ করে রইল।

বুড়ি তখন আবার হড়বড় হড়বড় করে কী কী বলছে। মুখ ঘুরিয়ে কোনওরকমে মান্নান। মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়েছে, মান্নান মাওলানা আর ফিরেও তাকাচ্ছেন না বুড়ির দিকে। ফিরোজার দিকে তাকিয়ে বললেন, কথা কচ না ক্যা? ক কে কইছে?

ফিরোজা মাথা নিচু করে বলল, আতাহার দাদায়।

আতাহার নাম শুনে যেন সাপের ফণায় মন্ত্র পড়া ধুলা পড়ল এমন ভঙ্গিতে গুটিয়ে গেলেন মান্নান মাওলানা। বললেন, আতাহার, আমার পোলা আতাহার?

হ।

ও আহেনি এই ঘরে?

ফিরোজা আগের মতোই জড়সড় ভঙ্গিতে বলল, আহে। পেরায় পেরায়ঐ আহে।

কীর লেইগা?

আইয়া বুজির লগে প্যাচাইল পোচাইল পাড়ে।

একলাঐ আহে নাকি ইয়ার দোস্তগো লইয়া?

একলাঐ। দুই-তিনদিন খালি নিখিলদাদারে লইয়াইছিল।

চোখ তীক্ষ্ণ করে ফিরোজার দিকে তাকালেন মান্নান মাওলানা। তর লগে কথাবার্তা কয় না?

ফিরোজা ভয়ার্ত গলায় বলল, কয়।

কী কয়?

এসময় বুড়ি আবার তার নিজের মতো করে কী কী বলল, মান্নান মাওলানা বুঝতে পারলেন না, ফিরোজা বুঝল কিন্তু কিছু বলল না। তার বুক এখন ঢিবঢিব করছে। আতাহার দাদায় যে এই ঘরে আসে একথা বলে নিশ্চয় সে বড় রকমের ভেজাল লাগিয়ে দিয়েছে। মাওলানা হুজুর এই নিয়ে নিশ্চয় আতাহার দাদার লগে কথাবার্তা বলবেন। সব শুনে আতাহার দাদা যাবে ফিরোজার উপর বিগড়ে।

ইস কেন যে কথাগুলি বলে ফেলল ফিরোজা! বুজি বলছিলেন বলছিলেন তার বলার দরকার কী! বুজির কথা তো হুজুর আর বুঝতে পারেননি, ফিরোজা চালাকি করে অন্যকথা বলে দিলেও পারত!

মান্নান মাওলানা বললেন, কইলি না আতাহার কী কয়?

ফিরোজা এবার কথা ঘুরাতে লাগল। যা বলবার আগে বলে ফেলেছে সেই কথা তো এখন আর ফিরত নেওয়া যাবে না, চালাকি যা করবার এখন করতে হবে। প্যাচিয়ে খুঁচিয়ে কথা বলে আগের কথা অন্যদিকে ঘুরাতে হবে।

ফিরোজা বলল, বুজির লগে আতাহার দাদার খুব খাতির। হের কথাবার্তাও ভাল বোজে আতাহার দাদায়। হের লগেঐ প্যাচাইল পোচাইল পাড়ে। আমি খালি এককাপ চা বানাইয়া খাওয়াই।

একটুখানি উৎসাহিত গলায় ফিরোজা বলল, আপনেরে এক কাপ চা বানাই দিমু? খাইবেন?

মান্নান মাওলানা অন্যমনস্ক হয়েছিলেন। বললেন, না।

তারপর মনমরা ভাব কাটাবার চেষ্টা করলেন। ফিরোজার দিকে আর ফিরেও তাকালেন, মন্তাজের মায়ের দিকে ঝুঁকে বললেন, আপনে তো গাছির মাইয়ার কথা জিগাইলেন চাচিআম্মা। গেরামের বেবাকতেঐ মনে রাখছে ছেমড়ির কথা। যেই কামডা ও করছে হেই কামের কথা মাইনষের ভোলনের কথা না। তয় আমি কইলাম চাচিআম্মা ভুইল্লা গেছি। নাদান পোলাপান, না বুইজ্জা একখান কাম কইরা হালাইছে, হেইডা মনে রাখন মাইনষের কাম না। আমি আল্লার খাসবান্দা, আমি অরে মাপ কইরা দিছি।

বুড়ি তার মতো করে আবার কী কী বলল, মান্নান মাওলানা বুঝতে পারলেন না, বুঝতে চাইলেনও না। দুইহাতে কেবিনের পাটাতনে ভর দিয়ে মোটা শরীর নিয়ে বেশ কষ্ট করেই। উঠে দাঁড়ালেন। যাইগা অহন। গইন্নাগো ঘরে ইট্টু যামু। এইমিহি আইছিলাম দেইক্কা আপনের লগে দেহা কইরা গেলাম।

কেবিন থেকে নামলেন মান্নান মাওলানা। ফিরোজাও এল তাঁর পিছন পিছন। মান্নান মাওলানার ব্যাপারে এখন যেন সাহস অনেক বেড়ে গেছে তার, এখন যেন তাঁকে আর ভয় পায় না ফিরোজা। এই বাড়িতে আসার পর থেকে যেভাবে তার দিকে চোখ ফেলেছিলেন মান্নান মাওলানা, কোনও না কোনও অছিলায় গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করতেন, আভাসে ইঙ্গিতে ইতর সম্পর্ক তৈরি করতে চাইতেন, আতাহার এই ঘরে আসে। শুনে, ফিরোজা তাকে চা তৈরি করে খাওয়ায় শুনে সেই ভাব উধাও হয়ে গেছে তাঁর। আজ ওই ধরনের কোনও ইঙ্গিত তিনি আর দেননি, ফিরোজার গায়েও হাত দেওয়ার চেষ্টাও করেননি। এইসব কারণেই বোধহয় তার ব্যাপারে আড়ষ্টতা, ডর ভয়ে জড়সড় হয়ে থাকা একেবারেই কেটে গেছে ফিরোজার। মান্নান মাওলানার ব্যাপারে বুকে চাপ ধরে থাকা ভাবটা উধাও হয়েছে। বুকটা এখন পরিষ্কার। স্বচ্ছন্দে শ্বাস নিতে পারছে ফিরোজা।

আর একটা কথা ভেবেও ফিরোজা খুব খুশি। আতাহার দাদার কথা শুনেই যেহেতু নিভে গেছেন মান্নান মাওলানা, ফিরোজার ব্যাপারে আর কোনওদিনও তা হলে জ্বলে উঠবেন না। ছেলে যেখানে যাতায়াত করে সেখানকার ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। ঘামাতে গেলে অস্ত্র তো হাতে একটা পেয়েছেই ফিরোজা, আতাহার দাদার নাম, চট করে বলে দিবে।

এসব ভেবে খুশিতে ফেটে পড়ছিল ফিরোজা।

মান্নান মাওলানা তখন কেবিন থেকে নেমে গম্ভীর মুখে খড়ম পায়ে দিচ্ছেন। ফিরোজা দাঁড়িয়ে আছে কেবিনের দরজায়। খড়ম পরা শেষ করে বললেন, চাচিআম্মার সামনে তো সত্য কথা কইতে পারি নাই, তরে কইয়া যাই। গাছির মাইয়ারে কইলাম মাপ আমি করি নাই। কব্বরে যাওনের আগ তরি অর কথা আমি মনে রাখুম। যেই ছ্যাপ ও আমার মোকে ছিডাইছে হেই ছ্যাপ দিয়া অরে আমি…

কথা শেষ করলেন না মান্নান মাওলানা, খড়মে চটর পটর শব্দ তুলে উঠানে নেমে গেলেন।

কেবিনের দরজায় তখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফিরোজা। ঘরের ভিতর জমতে শুরু করেছে বিকাল শেষের অন্ধকার। বাইরের উঠান থেকে রোদ চলে গেছে দক্ষিণের পুকুর পাড়ে। খানিকপর এই রোদও উধাও হবে।

.

মোতাহার ছিল ঘর গেরস্তি করা লোক।

একটু নরমসরম, দুর্বল ধরনের, পেটরোগা। ভাল ভালাই খেয়ে হজম করতে পারত না। বিয়াশাদির বাড়িতে মেজবানি খেতে গিয়ে স্বাদ করে মোটা চাউলের ভাত আর তেলচর্বিতে গলে গলে যাওয়া গোরুর গোস্ত, লগে আলাম (আস্ত) দুইয়েকখান গোলালু, মাঝারি ধরনের ঘন মুগের ডাল তারপর মেজবানি উপলক্ষে দুইদিন ধরে বাড়িতে পেতে রাখা দই নয়তো খাঁটি দুধের ঘন ফিরনি ভরপেট খেলেই পেট ফুলে ঢোল হয়ে যেত তার। ঘনঘন চুকা ঢেউক (চোয়া ঢেকুর) উঠত, ধরে রাখার চেষ্টা করেও পারত না বলে বাড়ির ময়মুরব্বির সামনে, পোলাপানের সামনে যখন তখন ফুটফাট শব্দে বায়ু ত্যাগ করত। রাতভর বুক গলা জ্বলত, ঘুমাতে পারত না, বিছানায় শুয়ে উসপিস উসপিস করত। কাজির পাগলা বাজারের করিম ডাক্তারকে নিয়মিত দেখাত মোতাহার। ডাক্তার বলেছিলেন রোগটার নাম গ্যাস্ট্রিক। বাছবিচার করে খেতে হবে, নিয়ম করে চলতে হবে। শিশিতে ভরা ঘন দুধের মতন অষুদ দিতেন। খাওয়ার আগে অনেকক্ষণ ধরে ঝাঁকিয়ে চা চামচের দুইচামচ অষুদ আর দুইচামচ পানি মিশিয়ে খেতে হত। লগে সাদা ছোট্ট একখানা ট্যাবলেট। এসব খেয়ে ভালই থাকত মোতাহার। কিন্তু নিয়ম করে অষুদটা সে খেত না। দুই-চারবেলা অষুদ খেয়ে যখনই দেখত পেটের আরাম হচ্ছে তখনই বন্ধ করে দিত। ছয়-সাত বছরের পুরানা বউ পারুল অষুদ খাওয়ার কথা বললেই উদাস হয়ে যেত। কখনও কখনও বিরক্ত হয়ে বলত, পেডে অহন কোনও গোলমাল নাই। খামাখা অষইদ খামু ক্যা?

তবে ভাল ভালাই খাওয়ার ব্যাপারে বেজায় লোভ ছিল মোতাহারের। বিয়ার পর পরই মান্নান মাওলানা তাকে ভিন্ন করে দিয়েছিলেন। পুব-উত্তর কোনার চৌচালা একখান ঘর, ঘরের পশ্চিমে একটুখানি উঠান, মাথার ওপর জঙে খেয়ে ফেলা তিনখান ঢেউটিন ফেলা, তিনদিকে হরমাইলের বেড়া, সামনের দিকটা খোলা এমন রান্নাচালা। রান্নাচালার পুবপাশে ছোট্ট আথাল, দুই-তিনখানে বেশি গোরু বাছুর আঁটবে না, এমন। আথালের মাথার উপর আমগাছ। সেই গাছের তলা দিয়ে চিকন রাস্তা উত্তর দিককার নামায় নেমে গেছে। ভিন্ন করে দেওয়ার পর একটা দুধেল গাই, একটা দামড়ি আর দুইটা কাহিল আবাল বড়ছেলেকে দিয়েছিলেন মান্নান মাওলানা। আথালের লগের রাস্তা দিয়া ভাঙনের দিকে নামলেই বাকাচোরা দুইখান হিজলগাছ, লম্বা খালের মতন সরু একখান ডোবা, ডোবায় তক্তা ফেলে বউ পোলাপানের জন্য ঘাটলা করেছিল মোতাহার। খরালিকালে ডোবার পানি তলায় গিয়ে ঠেকলে এদিককার ঘাটলা আর ব্যবহার করতে পারত না তারা। তখন যেতে হত বাড়ির সামনের দিককার পুকুরে। ওই পুকুরের খাই বেশি।

ডোবার ওপারে আড়াইকানি ধানের জমিন মান্নান মাওলানার। বাঁজা ধরনের জমি। বিলের জমিগুলির মতো পোম (উর্বরা শক্তি) নাই এই জমির। বছরভর খেটে ধান যা পাওয়া যায়, পড়তা পড়ে না গিরস্তের। চাষের জন্য এই জমিটুকুই মোতাহারকে দিয়েছিলেন মান্নান। মাওলানা। চাষবাসের দিনে আবালের কাঁধে লাঙল জোয়াল দিয়া সকাল থেকে দুপুর তরি মাথলা মাথায় জমি চষত মোতাহার, তারপর বাড়িতে এসে গোসল খাওয়া সেরে আবার যেত খেতে। একলা মানুষ বলে যে কাজ দশদিনে হওয়ার কথা, মোতাহারের লেগে যেত পনেরো-কুড়িদিন। তার উপর দুর্বল পেটরোগা লোক, আজ এটা কাল ওটা লেগে আছে। তবু ঘরগেরস্তিটা সে মন দিয়ে করত। খেত চষা শেষ করে ইটামুগুর দিয়া খুটখুট করে চাকা ভাঙত, মই দিত। মাথায় টুপি দিয়ে আগল ভরতি বীজধান নিয়ে খুবই মনোযোগ দিয়ে পাইট (পাট) করা জমিতে ছড়িয়ে দিত। বছরের প্রথম বৃষ্টি পেয়েই অঙ্কুরিত হতো বীজ।

পারুলের মনে আছে, মাথায় টুপি দিয়ে বীজ ছড়ানোর ব্যাপারে মোতাহার তাকে একবার বলেছিল, জমিনে ফসল ফলানো অইলো এবাদত বন্দেগির লাহান কাম, পাক পবিত্র কাম। এই কাম নাইয়া ধুইয়া, অজু কইরা, মাথায় টুপি দিয়া করতে অয়। নাইলে মাড়ি বেজার অয়, ফসল দেয় না।

এসব বিয়ার ছয়-সাত মাস পরের ঘটনা। স্বামী লোকটাকে ততদিনে অনেকখানি বুঝে ফেলছে পারুল। নির্বিরোধ স্বভাবের, অতিশান্ত, কারও সাতেপাচে না থাকা লোক। দুর্বল, পেটরোগা। রাতেরবেলা স্বামী-স্ত্রীর ভাব ভালবাসায় পারুল যখন মাত্র উত্তপ্ত হয় তখনই ফুরিয়ে যায় মোতাহার, মরার মতন ঘুমায়া পড়ে। আর পারুলের রাত কাটে ছটফট করে, শরীরের যন্ত্রণায়। কারণ পারুল স্বাস্থ্যবতী, একহারা সুন্দর গড়নের। শরীরে টগবগ করে ফুটছে যৌবন। এই ধরনের মানুষ সহজে বুড়া হয় না, শরীর ছেড়ে যৌবন তাদের সহজে যায় না।

পারুরও যায়নি। বেশ কয়েক বছর স্বামীর ঘর করেছে সে, তারপর স্বামী মরেছে আজ চার বছর। তিন ছেলেমেয়ে নিয়া বিধবা জীবন। তবু যেন সেই প্রথম যৌবনের মতনই রয়ে গেছে পারু। সংসারের দুর্বিপাক একটুও কাবু করতে পারেনি তাকে। একটুও ম্লান করতে পারেনি তার সৌন্দর্য। এখনও যখন দিনের কাজ শেষ করে বিকালের মুখে মুখে মাথায় একটু নারকেল তেল দেয়, মাথা সুন্দর করে আঁচড়ায়া মাথাভরতি ঘন কালো পিঠ ছাপানো চুল গ্রীবার কাছে আলগা খোঁপা করে রাখে, চোখে দেয় একটুখানি কাজল, এই সামান্য প্রসাধনেই তাকে সদ্য যৌবন পাওয়া বালিকার মতন মনে হয়। শ্যামলবরণ মুখ শিশুর ত্বকের মতো লাবণ্যময়। পুঁটিমাছ আকৃতির চোখ দুটিতে সরল সুন্দর দৃষ্টি। পেটে জমেনি এক ফোঁটাও মেদ, পারুর বুক এখনও অবিবাহিতা যুবতীর মতো, শক্ত ধরনের, হাঁটাচলায় তেমন দোল খায় না। পিছন দিক কখনও তেমন ভারী নয়, ছিপছিপা শরীরের লগে মানানসই। এখনও হঠাৎ হঠাৎ কেউ কেউ তাকে দেখে অবিবাহিতা মনে করে। এই তো গেল বছরও কী যেন কী কাজের ব্যাপারে কথা বলতে এসে কে একজন তার ছেলের জন্য পারুর বিয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। লোকটা ভেবেছে পারু মান্নান মাওলানার মেয়ে। আচমকাই ভিতর বাড়ির দিকে পারুকে এক পলক দেখেছিল। অবিবাহিতা ভেবে বিয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। এই নিয়ে বাড়িতে কী হাসাহাসি! পারুকে কথাটা বলেছিল রহিমা। অবশ্য আতাহারও বলেছিল। বলেছিল খুবই গম্ভীর গলায়। তার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলেছিল পারু।

কথায় কথায় প্রাণ খুলে খিলখিল করে হাসার স্বভাব আছে তার। যে-কোনও বিষয়ে ঠাট্টা মশকরা করার, মজা করার স্বভাব আছে। আতাহারের মুখে বিয়ার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলেছিল, আব্বায় কইলেঐ পারত, হ আমি তার ছোড মাইয়া। অহনও বিয়া অয় নাই। বিয়া দিয়া দিলেঐ পারত আমারে!

শুনে আতাহার বলেছিল, মনে হয় বিয়া বহনের খুব শক।

দুইহাতে আতাহারের গলা জড়িয়ে ধরে পারু বলেছিল, হ, খুব শক। খুব।

একবার বিয়া বইয়া সাদ মিটে নাই?

না গো, না। যেই বিয়া আমার অইছিলো হেইডা কোনও বিয়ার জাতঐ না। তোমার ভাইয়েও জামাইয়ের কোনও জাত আছিলো না।

ভাইয়ে যুদি জামাইয়ের জাত না অয় তাইলে তিনডা পোলাপান তোমার অইলো কেমতে?

একথা শুনে অপলক চোখে আতাহারের মুখের দিকে তাকিয়েছিল পারু। তুমি জানো না ছোডমিয়া, পোলাপান তিনডা কেমতে অইছে!

সেই রাতটাও ছিল আজকের মতোই রাত দুপুর, আজকের মতোই ঘুটঘুইটা আন্ধাইরা রাত। ছেলেমেয়েদেরকে আজকের মতোই কেবিনে ঘুম পাড়িয়েছে পারু। গভীর ঘুমে যখন ছেলেমেয়ে তিনটা পুকুরতলার থিকথিকা কাদা তখন কেবিন থেকে পা টিপে টিপে বের হয়ে আসছে পারু। কেবিনের দরজার বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছে। হারিকেন নিবুনিবু করে পাটাতনের এক কোণে রেখে নিজে চুপচাপ বসে থেকেছে কেবিনের বাইরে, পুবদিককার জানালার লগে রাখা শক্ত ধরনের পালঙ্কে। সুগন্ধি দিয়ে সাজিয়েছিল দুইখান পান, নিজে একটা মুখে দিয়া আর একটা রেখে দিয়েছিল তার গভীর রাতে চুপি চুপি আসা শরীর ও মন মানুষটির জন্য। মুখে সারাদিন ধরে জমে থাকে তার সিগ্রেটের বদগন্ধ, কোনও কোনওরাতে মদ খেয়ে আসে। মদের গন্ধটা তেমন খারাপ লাগে না, লাগে সিগ্রেটেরটা। যে রাতেই পারুর কাছে আসে সে পারু তার জন্য পান সাজিয়ে বসে থাকে। নিজের মুখের সুগন্ধি পান, দয়িতের মুখের সুগন্ধি পানের সুবাসে শরীরের মিলন অন্যরকম এক আনন্দময়তা বয়ে আনে।

কিন্তু আজ এত দেরি করছে কেন সে? কোথায় বসে চাটামি (আচ্ছা অর্থে) করছে ইয়ার দোস্তদের লগে! নিশ্চয় আলী আমজাদের ছাপরা ঘরে! নিখিলদের বাড়িতেও যেতে পারে। কিছুদিন ধরে ঘনঘন যাচ্ছে নিখিলদের বাড়িতে। ফুলমতির দিকে নজর পড়েনি তো! এই বাড়িতেও তো মন্তাজদের ঘরে প্রায়ই যাচ্ছে আজকাল। মন্তাজের বুড়িমার দেখাশোনা করে যে ডাঙ্গর ছেমড়ি ফিরোজা, বাপে পোয়ে দু’জনেই কি নজর দিয়েছে ছেমড়ির দিকে! মাজায় কত জোর তার, এতদিন ধরে পারুরই লগে থেকেও কি তার শরীরের ঝাজ (তাপ) মিটছে না! পারু কি তাকে খুশি রাখতে পারছে না! কই এমন কথা তো সে কখনও বলে না! মিলিত হওয়ার সময় সেই শুরু থেকেই তো প্রতিবার কোনও না কোনওভাবে বলে, তুমি খুব ভাল! তোমার লগে থাইক্কা বহুত আরাম পাই। দুই-চাইরদিন পর পরঐ তোমার লগে না থাকলে শইল ফাইট্টা যাইতে চায়। দেহ না তোমার হায়েজের (মাসিক) সময়ও মানতে চাই না আমি।

আজ রাতে পালঙ্কে বসে নিবুনিবু হারিকেনের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবছে পারু। যদি সত্যি সত্যি এমন হয় তা হলে অন্য মেয়েছেলের কাছে কেন যাবে সে! পারুই বা তা সহ্য করবে কেন!

আজ কি এসব নিয়ে তার কথা বলবে পারু!

এখনও সে আসছে না কেন? মুখের পান যে ফুরিয়ে যেতে বসল পারুর! তার জন্য অপেক্ষা করতে করতে বুঝি মুখের সুগন্ধও মিলিয়ে যাবে।

আথালের পিছনকার আমগাছে বুঝি আজ আশ্রয় নিয়েছে কোনও কাক। এক-দুইবার ডানা ঝাঁপটাল সেই পাখি। সন্ধ্যার আগ থেকেই কামারবাড়ির ওদিকে ডাকছে একটা। কোকিল। রাতদুপুরে কোকিলের এরকম ডাকে বুকের ভিতর কেমন করে মন মানুষের জন্য অপেক্ষা করা মানুষের। পারুরও করছিল। এই ভাব আচমকাই উধাও হল গণি মিয়ার সীমানায় তাদের কালোপানা নেড়িকুত্তাটা যখন ঘেউ ঘেউ করে উঠল। তা হলে কি ওদিককার সীমানা দিয়ে বাড়িতে এসে উঠেছে সে! রাতদুপুরে নিজেদের সীমানায় মানুষ দেখে ঘেউ দিচ্ছে প্রভুভক্ত কুকুর! তারপর সেই মানুষের গায়ে চেনাগন্ধ দেখে নিরস্ত হয়েছে!

তার পরও অপেক্ষার পালা শেষ হয় না পারুর। সময় বয়ে যায়, তার মানুষটা আসে না।

আতাহারের জন্য এই অপেক্ষা পারুর তৈরি হয়েছিল বিয়ার কিছুদিন পর থেকেই। বয়সে তারা দুইজন কাছাকাছি। পারু হয়তো বছরখানেকের বড় হতে পারে। আত্মীয়ের মধ্যে সমন্দ হয়েছিল, মান্নান মাওলানার সম্মায়ের দিককার মামাতো ভাইয়ের মেজোমেয়ে পারু, ছোটবেলা থেকেই দুই পরিবারের মধ্যে আসাযাওয়া ছিল। পারুর বাপের বাড়ি বহুদূরের দিঘিরপারের ওদিককার গ্রাম বেসনাল আর আতাহারদের বাড়ি মেদিনীমণ্ডল, তবু দুই-চার বছরে বিয়াশাদির অনুষ্ঠানে আসাযাওয়াটা ছিল। লতায় পাতায় হলেও ভাইবোনের। সম্পর্কটা তাদের ছিল। এই কারণেই বাড়ির বউ হয়ে আসার পরও বউ আসলে হতে পারেনি পারু, আত্মীয়ের মেয়ে হয়েই ছিল। এই বাড়িতে এসেই সমবয়সি আতাহারের লগে। খুনসুটির সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বাড়ির কেউ কিছু মনে করত না। মোতাহারও না। কারণ এরকম খুনসুটির সম্পর্ক যে অন্যদিকে গড়াতে পারে এমন ভাবনা ভাবার মতন মন তার ছিলই না। সে ছিল তার রোগা পেট নিয়া ব্যস্ত। পেট একটু ভুটভাট করলেও বউকে কিছু না বলে মা-ন্যাওটা শিশুর মতো তহুরা বেগমের কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করত। ও মা, কাইল। রাইত থিকা আমার পেটটা জানি কেমুন ফাঁইপপা (ফেঁপে) রইছে। পায়খানাডাও ঠিক মতন অয় নাই। গলাডা জ্বলতাছে, চুমা ঢেউক (এক প্রকারের ঢেকুর) উটতাছে।

পেটরোগা ছেলেটির জন্য অন্যরকমের একখান টান বড় হয়ে যাওয়ায় পরও, বিয়াশাদি করে আলাদা সংসারের মালিক হয়ে যাওয়ার পরও তহুরা বেগমের রয়ে গিয়েছিল। ছেলে যখনই গিয়া মায়ের কাছে ঘ্যানঘ্যান করত, মা তাকে নিয়া ব্যতিব্যস্ত হতেন। রান্নাবান্নায় ব্যস্ত থাকলেও সেসব ফেলে উঠে আসতেন। অমুকটা কর বাজান, তমুকটা কর বলে ছেলেকে সান্ত্বনা দিতেন। পেটে পিঠে, গলায় বুকে হাত বুলিয়ে দিতেন। যেন মোতাহার সংসারী ছেলে নয়, যেন এখনও সে ছোট্ট শিশুটি। মা হাত বুলিয়ে দিলেই যেন পেটের যন্ত্রণা মিটে যাবে, আরাম পাবে সে। কখনও কখনও পেটের যন্ত্রণায় শিশুর মতো মায়ের পাশে গিয়ে শুয়েও থাকত সে। মা তার পেটে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন।

সংসারের বড়ছেলে মোতাহার, তার আগে দুইটা মেয়ে, হাজেরা আর মদিনা, মোতাহারের পর আয়শা, তারপর আতাহার, আতাহারের পর আরেক মেয়ে ফাতেমা, সবার ছোট আজাহার। চার মেয়েরই বিয়াশাদি হয়ে গেছে অনেক আগে। গ্রামে থাকে শুধু মাজারো মেয়ে মদিনা। সাতঘরিয়ায় শ্বশুরবাড়ি। হাজেরা থাকে নারানগঞ্জে, আয়শা আর ফাতেমা ঢাকায়। আয়শা গোপীবাগে আর ফাতেমার বাসা গেন্ডারিয়ায়। আজাহার অনেক বছর ধরে জাপানে। তার টাকায়ই চলছে মান্নান মাওলানার সংসার। অবশ্য জায়গাজমিন আছে ম্যালা। বিলের জমিতে যে পরিমাণ ধান হয়, আর আট-দশটা গোরুর দুধ বেচে যে। নগদ টাকা সব মিলিয়ে মান্নান মাওলানা বেশ অবস্থাপন্ন। চিন্তার মধ্যে চিন্তা তাঁর এখন একটাই, মাজারো পোলা আতাহার। বয়স হয়ে যাওয়ার পরও বিয়াশাদি করছে না ছেলে, সংসারী হচ্ছে না। বাদাইরা (বাউন্ডুলে, বেহিসেবি অর্থে) হয়ে গেছে।

আতাহারের বিয়াশাদি না করার কারণটা অবশ্য বাড়ির সবাই জানে, আত্মীয়স্বজনরাও জানে কিছু কিছু, গ্রামের লোকেও জানে। ভাইর বউর লগে ভাব। ভাইর বউ পারুই নাকি বিয়া করতে দেয় না আতাহারকে।

ওদিকে আজাহার ফিরে আসি আসি করছে জাপান থেকে। জাপান সরকারও নাকি বাংলাদেশিদের আর থাকতে দেবে না তাদের দেশে। অবশ্য টাকাপয়সা যা জমেছে আজাহারের দেশে ফিরে ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটে দোকান দিতে পারবে সে। ওই মার্কেটে দোকান নিয়ে বসতে পারলে সারাজীবনের জন্য নিশ্চিন্ত।

বিয়ার বয়স আজাহারেরও হয়ে গেছে অনেক আগে। মাঝেমাঝেই চিঠিতে সে আতাহারের বিয়ার কথা লেখে। সব জেনেশুনেও লিখছে কেন সে বিয়া করছে না। বুঝাতে চাইছে, আতাহার বিয়া না করলে দেশে এসে বড়ভাইকে রেখে ছোটভাই বিয়া করে কী করে? আর এই সমস্যা না মিটলে তাদের সংসারের দুর্নামও তো ঘুচছে না! যতদিন আতাহার বিয়া না করবে ততদিনই লোকে বিশ্বাস করবে ঠিকই বড়ভাইর বউর লগে তার সম্পর্ক। একবার তো সরাসরি তহুরা বেগমকে আজাহার লিখেছিল ভাবির লগে আতাহারের বিয়াশাদির ব্যাপারে কথা বলতে। তহুরা বেগম বলেও ছিলেন। শুনে পারু সরল গলায় বলেছিল, আমি তারে বিয়া করতে না করছিনি? হেয় করে না ক্যা?

শাশুড়িকে অবশ্য সত্য কথাটা বলেনি পারু। সে-ই আসলে আটকে রেখেছে আতাহারের বিয়া। আতাহারকে বলেছে, যতদিন আমি তোমারে খুশি রাকতে পারুম হেতদিন তুমি বিয়া করবা ক্যা? আমি ফুরাইয়া গেলে করবা। যহন আমার শইল ঠান্ডা অইয়া যাইবো, তহন আমি তোমারে কিছু কমু না।

শুনে আতাহার হেসেছে। মোকে কইবা না, তয় অন্তরে তো জ্বলবা।

না জ্বলুম না।

যহন আমি তোমার চোক্কের সামনে বউ লইয়া ঘরে দুয়ার দিমু তহন তোমার কেমুন লাগবো? তহন তুমি জ্বলবা না?

হ জ্বলুম। তয় তহন একখান সান্ত্বনাও আমার থাকবো যে আমি ফুরাইয়া গেছি। আমার তো তোমারে দেওনের লাহান আর কিছু নাই। পুরুষপোলাগো আগে মাইয়ামানুষরা ফুরাইয়া যায়। আমি ফুরামু, তুমি ফুরাইবা না। তোমার শইল চাইবোঐ আরেকজনের শইল।

আতাহারের লগে কবে শুরু হয়েছিল শরীরের খেলা! কতকাল আগে!

দিনটির কথা স্পষ্ট মনে আছে পারুর। সেটা ছিল বসন্তকালের এক মনোরম বিকাল। বসন্তকালের বিকালে ফুরফুর করে বয় চমৎকার এক হাওয়া। গাছের পাতায় আর আকাশে কী যেন এক পরিবর্তন! সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া যেন এসে লেগেছিল পারুর শরীরে আর মনে। বিকালবেলা সেদিন আকাশ রঙের শাড়ি পরেছিল সে। বিয়ার মাস সাতেক পরের ঘটনা।

সেই ঘটনার কথা মাত্র মনে পড়েছে পারুর ঠিক তখনই পাটাতন ঘরের উত্তর দিককার দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল টর্চের আলো। দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল পারু, অদ্ভুত এক রোমাঞ্চে শরীরের প্রতিটি রোমকূপ যেন আলোড়িত হল। ওই তার মানুষটি আসছে। রাতদুপুরে পারুর লগে মিলিত হতে এসে কখনও সে দরজায় শব্দ করে না, কখনও ফিসফিস করেও নাম ধরে ডাকে না পারুকে। রাতবিরাত চলাফেরা করার স্বভাব বলে টর্চ তার হাতে থাকেই। টর্চের আলো দরজার পায়ের কাছে একবার মাত্র ফেলে। পাটাতনের ফাঁক দিয়ে আলোটা একবার মাত্র ঝিলিক দিয়ে যায় অন্ধকারে। তাতেই পারু বুঝে যায়, মানুষটা তার আসছে। আজ বহুবছর ধরে চলছে এই কায়দা।

তবে প্রতিরাতেই তো আর পারুর কাছে আসছে না সে। সপ্তাহ দশদিনে একবার। মোতাহার মারা যাওয়ার পর অতিকষ্টে চল্লিশটা দিন কাটিয়েছিল তারা। একজনের ভাই। আর আরেকজনের স্বামী মারা গেছে, শরীরের কষ্ট যতই হোক চল্লিশটা দিন অন্তত অপেক্ষা করতে হয়। তারা তা করেছিল। তারপর কয়েকদিন বেশ ঘনঘন দেখা হল। দুই-একদিন পর পরই। তারপর কমে এল। এখন সপ্তাহ দশদিনে একবার আসে আতাহার। যেদিন আসবে সেদিন অদ্ভুত এক কায়দায় সে কথা জানিয়ে দেয় পারুকে। দিনের কোনও না কোনও এক সময় দূর থেকে হোক বা পারুর ঘরের কাছে এসে হোক, সরাসরি পারুর চোখের দিকে তাকাবে। শব্দ না করে ঠোঁট নেড়ে বলবে, আইজ রাইতে আমু।

আতাহারের এই ঠোঁট নাড়া দেখলেও রোমাঞ্চে আলোড়িত হয় পারুর রোমকূপ। ঠোঁট টিপে সামান্য হেসে সেও ঠিক একই কায়দায় বলবে, আইচ্ছা।

মাসিকের সময় কোনও কোনওদিন না করে সে। আবার শরীরের চাহিদা অনুযায়ী ওই অবস্থায়ও কখনও কখনও রাজি হয়ে যায়। এ এক আশ্চর্য শরীরী তৃষ্ণা দুইজন মানুষের।

এই তৃষ্ণায় ছটফট করতে করতেই দরজা খুলল পারু। যেমন নিঃশব্দে দরজা খুলল ঠিক সেই ভঙ্গিতেই ঘরে ঢুকল আতাহার। পায়ের চাপে পাটাতনের তক্তায় মৃদু কাঁপন লাগল। উত্তর দিককার জোড়া হিজলগাছের পাশের পায়েচলা পথে চক থেকে আজ উঠে আসছে সে। ওদিক দিয়ে আসছে বলেই ঘরের পিছন দিককার দরজায় আলো ফেলেছে। অন্যকোনও সীমানা দিয়ে উঠলে সামনের দরজায় আলো ফেলত।

ঘরে ঢুকেই ক্লান্তির শ্বাস ফেলল আতাহার। পরনে সাদার উপর নীল ডোরাকাটা লুঙ্গি আর খয়েরি রঙের ফুলহাতা শার্ট। শার্টের হাতা বগল তরি গুটানো। বুকপকেটে ক্যাপস্টান সিগ্রেটের প্যাকেট, ম্যাচ। পায়ে বাটা কোম্পানির স্যান্ডেল। পারু যখন নিঃশব্দে দরজার ডাসা লাগাচ্ছে তখন স্যান্ডেল খুলে পালঙ্কে চিত হয়ে শুয়ে পড়েছে আতাহার। মাথার কাছে বালিশের পাশে রেখেছে টর্চ।

পারু এসে তার পাশে বসল। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে আতাহার এলে তার গলার স্বর এমন একটা স্তরে নামে, না একেবারেই ফিসফিসা না তেমন কোনও শব্দ, শুধু দুইজন শুনতে পায় দুইজনার কথা। এমনকী এই ঘরের বাইরে বেড়ার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বা বেড়ায় কান লাগালেও কেউ শুনতে পাবে না তাদের কথা। অদূরে কেবিনে শুয়ে থাকা কোনও শিশুর যদি কোনওক্রমে ঘুম ভেঙে যায় সেও শুনতে পাবে না কিছু, বুঝতে পারবে না। মা’কে হাতের কাছে শুয়ে থাকতে না দেখে ভাববে নিশ্চয় বাইরে (প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাওয়া অর্থে) গেছে মা।

আজ রাতে আতাহারের পাশে বসেই শার্টের উপর দিয়ে তার বুকে ডানহাতটা রাখল পারু। রঙ্গিনী গলায় বলল, এত রাইত করলা ক্যা?

আতাহার ক্লান্ত গলায় বলল, কাম আছিল।

কী কাম?

যেই হগল কাম করি রোজ, ঐহগলঐ।

করো তো খালি চাডামি।

আর কী করুম কও। দোস্তগো লগে চাডামি আর তোমার লগে বদামি এই দুইডা ছাড়া আমার কোনও কামঐ নাই।

সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল আতাহার, ম্যাচ জ্বেলে সিগ্রেট ধরাল।

পারু আহ্লাদী গলায় বলল, অহন আবার সিকরেট ধরাইলা?

হ ধরাইলাম।

তয় আমি যে তোমার লেইগা পান সাজাইয়া রাকছি!

দেও, পানও খাই।

শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখা পান বের করল পারু। দেখে পানের জন্য হাত বাড়িয়েছে আতাহার, হাতটা সরিয়ে দিল। ক্যা আমি খাওয়াইয়া দিতে পারি না?

সিগ্রেটের ধোয়া ছেড়ে হাসল আতাহার। পারবা না ক্যা? দেও খাওয়াঐ দেও।

আতাহার হাঁ করল, তার মুখে পান গুঁজে দিল পারু। ঘচর মচর করে সেই পান মুখের আয়ত্তে এনে আতাহার বলল, আসলে আমার মিজাজটা বহুত খারাপ।

ক্যা গো?

এইসব সময়ে অনেক সময়েই গো কথাটা বলে পারু। আতাহারের খুব ভাল লাগে কথাটা। এখনও লাগল। মন ভাল করা গলায় পান চাবাতে চাবাতে, সিগ্রেটে টান দিতে দিতে বলল, খালি আইজঐ খারাপ না, অনেকদিন ধইরাঐ খারাপ।

কবে থিকা, আমি জানি।

কও তো কবে থিকা?

ওই যে নূরজাহানি যেদিন আব্বার মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিছে।

হ। হেদিন থিকা শইলডা জ্বইল্যা যাইতাছে। মনে অইতাছে চুতমারানির ঝিরে ধইরা…।

আতাহারের কথা শেষ হওয়ার আগেই গম্ভীর গলায় পারু বলল, আমার সামনে আকথা কুকথা কইবা না।

আতাহার থমকাল। না আকথা আমি তোমার সামনে কোনওদিনও কই না। আমি জানি ওই হগল কথা তুমি বহুত ঘিন্না করো।

হ। তোমার লগে আমার সব পদের সম্বন্ধঐ আছে, কিন্তু আমার মোকে আইজ তরি তুমি কোনওদিন কোনও অসইভ্য কথা হোনো নাই।

হ, আমার মোকেও তুমি হোনো নাই।

পয়লা পয়লা দুই চাইরবার হুনছি। তারবাদে আমি যহন কইছি অসইভ্য কথা হোনতে আমার ঘিন্না লাগে তহন তুমি ওই হগল কথা কওন বন্ধ করছে।

সিগ্রেটে শেষ টান দিয়ে পালঙ্কের মাথার দিকে ডলে ডলে নিভাল আতাহার, তারপর। ছুঁড়ে ফেলে ঘচর মচর করে মুখের পানে কয়েকটি চাবান দিয়া বলল, তোমার এই সবাবখান আমার বহুত ভাল লাগে। তোমার সব কিছুর মইদ্যে ভারী একখান সইনদর্য আছে। তয় আমি কইলাম নূরজাহানিরে লইয়া বদকথা কইতে চাই নাই। তুমি আগে চেইত্তা গেলা।

আতাহারের কথা শুনে গম্ভীর ভাব কেটে গেল পারুর। বলল, বাদ দেও অন্য মাইনষের কথা। আহো নিজেগো কথা কই।

আতাহারের শার্টের বোতাম খুলতে লাগল পারু। যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমন গলায় বলল, আমার জিনিসটা আনছো?

আতাহার হাসল। না আনলে উপায় আছে?

আছে।

কী উপায়?

তুমি আবার বাপ অইবা!

সব্বনাশ। হেইডা আর অইবো না। দাদায় বাঁইচ্চা থাকতে তিনবার বাপ অইছি, বুজছি খালি তুমি আর আমি। মাইনষে বোজে নাই। মাইনষে মনে করছে দাদারঐ পোলাপান। অহন কিছু অইলে আর উপায় নাই।

লুঙ্গির কোঁচড় থেকে বড়ির প্যাকেট বের করে পারুর হাতে দিল আতাহার। অতিযত্নে জিনিসটা আঁচলে গিঁট দিয়া বাইন্দা রাখল পারু।

পারুর হাতে বোতাম খোেলা শার্ট শরীর আলগা করে পুরাপুরি খুলে ফেলল আতাহার। মুখ থেকে চিড়িক করে পানের পিক আর ছোবড়া ফেলল পালঙ্কের মাঝবরাবর পাটাতনের উপর। ধুৎ পান চাবাইতে আর ভাল্লাগে না।

পারু হাসল। আর না চাইলেও অসুবিদা নাই। আমার কাম অইয়া গেছে।

হ অহন আর মাকে গন্ধ নাই।

আতাহারের বুকের কাছে মুখ রেখে শুয়ে পড়ল পারু। দু’হাতে আতাহার তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।

পারু বলল, কাজির পাগলা বাজারে গেছিলা?

আতাহার চমকাল। না তো!

তাইলে জিনিস কিনলা কই থিকা?

আমি কিনি নাই।

পারু অবাক হল। তয়?

কিনছে নিখিলা।

কও কী?

হ। অরে পাডাই ছিলাম মাওয়ার বাজারে।

তোমরা কি আইজ কনটেকদার সাবের ঘরে আছিলা?

হ।

কে কে?

আমি, কনটেকদার সাবে, আলম সুরুজ। নিখিলারে বাজারে পাইছিলাম বতল আনতে, লগে তোমার জিনিসখানও আনতে। বতল পায় নাই আইজ। কুটুমিয়া ডাক্তারের ফারমেসি থিকা তোমার জিনিসটা কিন্না আনছে।

তোমার দোস্তরা দেহে নাই?

পারুর পিঠের দিকটায় হাত বুলাতে বুলাতে আতাহার বলল, আরে না। দোস্ত অইলেও নিখিলা আমার খাসলোক। খালি ওঐ তোমার-আমার সমন্দের কথা জানে। অরে দিয়া অনেকদিন ধইরা এই হগল জিনিস কিনাই আমি। আমার নিজের কিনতে শরম করে।

আতাহারের খোলা বুকে ছোট্ট করে একটা কামড় দিয়ে পারু বলল, আমার লগে যহন থাক তহন শরম করে না?

পারুর ব্লাউজের বোতাম খুলতে খুলতে আতাহার বলল, হ করে। এর লেইগাঐত্তো তহন চক্কু বুইজ্জা থাকি। তোমার মিহি চাই না।

পারুর শরীর জুড়ে ভয়ংকর উষ্ণতা মাথা চাড়া দিচ্ছে। গোঙানোর মতন বলল, আইজ সকাল থিকাঐ মাথা বেদনা শুরু অইছে। ডাইন মিহির হাত পাওয়ে ঝিমঝিমাইন্না বেদনা। বোজতাছিলাম আইজ তোমার লগে দেহা না অইলে রাইত্রে ঘুমাইতে পারুম না। মাথা বেদনায় মইরা যামু। বিয়ানে এর লেইগাঐ বাংলাঘরের মিহি চাইয়া দুয়ারে খাড়ই রইছিলাম। তুমি আহনের ইশারা না করলে আমিঐ করতাম। আমি আর টিকতে পারতাছিলাম না।

আতাহারের শরীরেও তখন একই ধরনের উষ্ণতা। পারুর মতো জড়ানো গলায় বলল, দূর থিকা তোমার মিহি চাইয়াঐ এইডা বুজছিলাম। আমারও বহুত ইচ্ছা করছিল।

এই যে তুমি আইলা, অহন আবার কয়দিন ভাল থাকুম।

বাইরের অন্ধকার রাত গম্ভীর হচ্ছে। ঝিঁঝি ডাক প্রবল হয়েছে। কামারবাড়ির ওদিককার গাছে বসে গলা ছেড়ে ডেকে যাচ্ছিল এক কোকিল।। কুহু কুহু।

.

মোতাহারের পেট ফুলে ভোজকোমড় (অতিকায় মিষ্টি কুমড়া) হয়ে গেছে।

কোথায় কোন বাড়িতে মেজবানি খেতে গিয়েছিল। গোরুর গোস্ত, মুগের ডাল আর দই খেয়েছে পেট ভরে। তারপরই পেট ফুলে ভোজকোমড়। সেই ফোলা পেটে শুকনা মুখে তহুরা বেগমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ও মা, দেহ আমার পেটটা কেমুন ফুইল্লা গেছে। বুকটা কেমন করতাছে, গলাডা জ্বলে। খালি চুমা ঢেউক উটতাছে।

তহুরা বেগম যেন শুয়ে আছেন বড়ঘরের পালঙ্কে। পায়ের কাছে বসে যেন রহিমা তার পা টিপে দিচ্ছে। এই অবস্থায় ছেলের কথা শুনে যেন দিশাহারা হলেন। বুকের ধড়ফড়ানি যেন বাড়ল। উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, আয় বাজান, আমার কাছে আয়। আমার বুকের কাছে। আইয়া হো। আমি তর পেট দোয়াইয়া দেই, বুক গলা দোয়াইয়া দেই। দেকবি আরাম লাগবো। ফাপা পেট ভাল অইয়া যাইবো।

তারপর যেন রহিমার দিকে তাকিয়েছেন তহুরা বেগম। ওই রহি, তুই অহন যা। আমার পোলায় হুইবো আমার কাছে।

রহিমা বেরিয়ে যাওয়ার লগে লগে যেন তহুরা বেগমের বুকের কাছে শিশুর মতো শুয়ে পড়েছে মোতাহার। আর নিজের অজান্তেই যেন ছেলের পেটে বুকে গলার কাছটায় হাত বুলাতে শুরু করেছেন তহুরা বেগম। আধো আধো গলায় ছেলেকে বলছেন, দেহিচনে বাজান অহনঐ পেট ফাঁপা কইম্যা যাইবো। আরাম লাগব।

একটুক্ষণ চুপ থেকে মোতাহার যেন বলছে, হ মা, আমার অহন বহুত আরাম লাগতাছে। পেটফুলা কইম্যা গেছে, বুকখানও ভাল, গলাডা আর জ্বলে না।

তারপর মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে যেন মুখটা গুঁজে দিয়েছে তহুরা বেগমের বুকে, একহাতে জড়িয়ে ধরেছে মায়ের গলা। আমি তোমার কাছে থাকুম মা। তোমার লগে থাকুম। তুমি যে আমারে ভিন্ন কইরা দিছো, আমি যে একলা একলা অহন অন্য একখান ঘরে হুইয়া থাকি, মা, ওমা আমার কথা তোমার মনে অয় না? আমার লেইগা তোমার মায়া লাগে না মা? মনডা কান্দে না? আমারে ছাইড়া তুমি কেমতে থাকো?

ছেলের কথা শুনে তহুরা বেগমও যেন তার মাথাটা গভীর আবেগে জড়িয়ে ধরেছেন। বুকে। ছেলের মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলছেন, হ বাজান, তর লেইগা আমার বহুত মায়া লাগে, মনডা বহুত কান্দে। তরে আমি আর একলা ঘরে হালাইয়া রাখুম না। আমিও আইয়া থাকুম তর লগে। কয়ডা দিন সবুর কর বাজান।

ফজরের আজানের আগে আগে এই স্বপ্নটা দেখলেন তহুরা বেগম। তারপরই ঘুম ভাঙল। ঘুম ভাঙার পর বুকটা একটু ধড়ফড় করে তার, অস্থির অস্থির লাগে। আজ আর তেমন হল না। আজ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতোই লাগছে। তয় মনটা কেমন হয়ে আছে। জেগে ওঠার পরও যেন মোতাহারকে বুকের কাছে শুয়ে থাকতে দেখছেন। ছেলের শরীরের স্পর্শ যেন পাচ্ছেন। আর কেমন যেন ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। সত্যি তো ছেলেটি তার কোথাকার কোন একলা ঘরে গিয়ে শুয়ে আছে! কবর তো আসলে এক প্রকারের ঘরই! সেই ঘরে আজ চার বছর কেমন আছে তার বুকের মানিক! কবরের অন্ধকারে চার বছরে মানুষের শরীর কি আর শরীর থাকে! শরীর থেকে আস্তে ধীরে খসে যায় ছাল চামড়া মাংস, গলে গলে মাটির শরীর মাটিতে মিশে। চোখ গলতে থাকে পানির তলায় দিনের পর দিন পড়ে থেকে যেমন করে গলে রোয়াইল ফল। থাকে শুধু শরীরের খাঁচা, হাড়, দাঁত নখ চুল। দিনে দিনে এসবও মিশে মাটিতে।

চার বছরে কি শরীরের হাড়ও মাটিতে মিশে গেছে মোতাহারের! দাঁত নখ চুল সব মিশে গেছে! দুনিয়াতে এসে কিছুদিন কাটাল একজন মানুষ, তারপর চলে গেল কবরে। চোখ থেকে চোখের আড়ালে। তারপর কবরের ভিতর থেকেও সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল একদিন, উধাও হয়ে গেল! এই তো মানুষ, এই তো মানুষের জীবন।

মাটির শরীর মাটিতে মিশে যাওয়ার পরও সেই মানুষটি থেকে যায় প্রিয় মানুষের মনে, চোখের ভিতরে, স্মৃতিতে, স্বপ্নে। ঘুরে ফিরে সেই মানুষটির মুখ কারণে অকারণে দেখতে পায় মানুষ। তহুরা বেগম যেমন গত চার বছর ধরে যখন তখনই দেখছেন তার ছেলেটির মুখ। দুপুরবেলা নিরিবিলি ঘরে শুয়ে আছেন, হঠাৎ করেই তার মনে হয়, মোতাহার যেন এসে দাঁড়িয়েছে দুয়ারের সামনে। মা মাগো বলে যেন তাকে একবার ডাকল। হয়তো তখন তন্দ্রামতন এসেছিল চোখে, সেই ডাকে ধড়ফড় করে ওঠেন তিনি। তারপর আর ঘুম হয় না। শুধুই মোতাহারের মুখটা ভেসে থাকে চোখের সামনে। বিকালের দিকে উঠান পালানে, বারবাড়ির সামনের নাড়ার পালাটির ওদিকে কখনও কখনও পায়চারি করেন তিনি। হঠাৎ হঠাৎ দেখতে পান বিলের দিক থেকে যেন ফিরে আসছে তাঁর ছেলে। আস্তে ধীরে হেঁটে এসেও যেন খুবই ক্লান্ত হয়েছে। তবু বাড়ি ঢোকার মুখে বারবাড়ির কাছে মা’কে দেখে যেন তার মুখে ফুটে উঠেছে মোহময় এক হাসি।

দুপুরে খেতে বসেও ছেলের কথা মনে পড়ে তহুরা বেগমের। সকালের নাস্তা খাওয়ার সময় মনে পড়ে, রাতের খাবার সময় মনে পড়ে। রাতেরবেলা দুধভাত খাওয়ার অভ্যাস। তহুরা বেগমের। আধ থাল ভাতের লগে থালভরতি দুধ আর একটুখানি খাজুরিমিঠাই বা। একখানা কবরিকলা অতিযত্নে মাখিয়ে মাখিয়ে অনেকক্ষণ ধরে খান তিনি। বিয়ার পর, পোলাপানের বাপ হয়ে যাওয়ার পরও, সেই ছেলেবেলার মতো করেই যখন তখন মায়ের রাতের খাবারের সময় মোতাহার এসে সামনে বসত কোনও কোনও রাতে। নিজের ভিন্ন। সংসার হয়েছে, সেই সংসারে রাতের খাবার সে হয়তো সেরেও নিয়েছে, তবু মায়ের দুধভাত খাওয়া দেখে তার সামনে বসে শিশুর মতো হাঁ করেছে। আমারে এক লোকমা দেও মা।

ওই সময় তহুরা বেগম দেখেছেন তার বড় হয়ে যাওয়া, ভিন্ন সংসারের মালিক হয়ে যাওয়া ছেলেটি তার সামনে বসা নাই, আছে বহুকাল আগের ন্যাওটা একটা শিশু। দুই মেয়ের পর সংসারে আসছে যে, মায়ের নয়নের মণি যে। শিশুকে ভাত খাওয়াবার ভঙ্গিতে হাত উঠে গেছে তার। শিশুদেরকে খাওয়াবার সময় কোনও কোনও মায়ের মুখে যেমন ঠোঁটের বিশেষ একটা ভঙ্গি ফুটে ওঠে, তেমন হয়েছে। একবার খেয়েই হয়তো মুখ সরিয়ে নিয়েছে মোতাহার, তহুরা বেগম আরেক লোকমা তুলে বলেছেন, একবার খাওন ভাল না বাজান। একবার খাইলে পাইনতে পইড়া মরে!

এই সংসারে মৃত্যুর থাবা প্রথমে এসে পড়ল মোতাহারের উপরই। এত লোকজন সংসারে, এত পোলাপান সবাই সবার মতো ঠিক থাকল, আজরাইল এসে শুধু জান কবচ করল মোতাহারের। এইভাবেও মৃত্যু হয় ওই বয়সি ছেলের! কত বয়স হয়েছিল তার, তিরিশ-বত্রিশ। এই বয়সে ছেলেরা তো বিয়াশাদিও করে না আজকাল!

কপাল, সব কপালের দোষ। নিজেরা পছন্দ করে তহুরা বেগম আর মান্নান মাওলানা আত্মীয়ের মেয়ে আনলেন ছেলের জন্য। নরম শান্ত লাজুক স্বভাবের মিষ্টি মেয়ে পারুল। শ্বশুরবাড়িতে এসে স্বামী রেখে স্বামীর ভাইর লগে সম্পর্ক করল। তার ওপর মান্নান মাওলানা দিলেন ভিন্ন করে। দুই-আড়াই কানি বাজা জমি, ম্যারা ম্যারা দুই-তিনখান গাই গোরু, সবমিলে বছরের ভাত জোগাড় করা মুশকিল। একদিকে বউ আর ছোট ভাইয়ের ঘটনা টের পেয়ে গেল মোতাহার, বউর গর্ভে ভাইয়ের সন্তান আসছে দেড়-দুই বছর পর পর, বাড়ির লোকে ভালই টের পাচ্ছে সব, পারু-আতাহারকে রাতবিরাতে দেখেছে কেউ কেউ, বাড়ির ঝি-চাকরদের কান থেকে গেছে অন্যবাড়ির ঝি-চাকরদের কানে, ছড়িয়েছে ঘটনা। হয়তো মান্নান মাওলানার ভয়ে মুখ খোলেনি কেউ, তয় জানে তো সবাই। একদিকে এই লজ্জায় নিজের ভিতর গুটিয়ে থাকত মোতাহার, অন্যদিকে ভাতকাপড়ের ভয়। নিজের বাপকে ভালই চিনত সে। মোতাহারকে দেখতেই পারতেন না তিনি। শরীরস্বাস্থ্য খারাপ, নরম সরম দুর্বল স্বভাবের পেটরোগা ছেলেটার লগে সব সময়ই পিসপিস করতেন, কাজির পাগলা স্কুলে দুই-তিনবার ফেল করে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ওঠার পর মোতাহারকে আর তিনি পড়ালেনই না। গিরস্তি কাজে লাগিয়ে দিলেন। বিয়া করে ভিন্ন করে দিয়া বললেন, নিজেরডা নিজে কইরা খাবি। আমি আর দুই পয়সাও দিমু না, একসের চাউলও দিমু না।

মোতাহার জানত বাবায় যা বলেন তাই করেন। এই কারণে ওই রোগা শরীরে পরিশ্রম তাকে ম্যালাই করতে হত। একদিকে পেটের আহার জোটাতে হিমশিম, অন্যদিকে বউ ভাইয়ের গোপন সম্পর্ক, এসব নিয়া কখন কে কোন কথা বলে ফেলে, মানসম্মান থাকে না যায়, সবমিলে গ্যাস্ট্রিক রোগটা হল। এই রোগীর বউদের স্বামীর খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে নজরদারি করতে হয়। ডাক্তার কী কী খেতে মানা করেছেন সেসব খাবার চোখের সামনে নাআনাই ভাল। তয় পারু বোধহয় সেসব মনে রাখত না। এক রাতে সেচিশাক আর ছোট ছোট তিতপুঁটি চচ্চড়ি করছে। গ্যাস্ট্রিক রোগীদের শাক খাওয়া নিষেধ। পারু মানাও করেছিল স্বামীকে, বলেছিল, আপনে দুধ দা ভাত খান। শাকশোক খাইয়েন না। আমি আর পোলাপানে খামু নে।

মোতাহার শোনেনি। একটু শাকপাতা, একটু ঝালঝোল তরকারির প্রতি লোভ ছিল। আয়েশ করে সেচিশাক আর পুঁটিমাছের চচ্চড়ি খেল, তারপর দুধভাতও খেল কবরিকলা দিয়ে। রাত দুপুরে পেট ফুলতে লাগল। উসপিস উসপিস শুরু করল। দুধের মতো অষুদটা খেল, ট্যাবলেট খেল তয় কোনও কাজই হল না। মনে হচ্ছে পেট যেন বেলুন, ভিতর থেকে ফুঁ দিয়া দিয়া কেউ যেন তা শুধু ফুলিয়েই যাচ্ছে।

এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে গেল মোতাহার। পারুর কান্নাকাটি চিৎকারে বাড়ির লোকজন। জেগে উঠল। আতাহার আর মাকুন্দা কাশেম গিয়া করিম ডাক্তাররে নিয়া আসলো। ডাক্তার। এসে নাড়ি দেখলেন, বন্ধচোখ খুলে দেখলেন, পেট টিপে দেখলেন। তারপর হতাশ মুখে মাথা নাড়লেন। মোতাহার নাই। পেটে প্রচণ্ড গ্যাস হয়েছিল, গ্যাস থেকে হার্টঅ্যাটাক, অনেক আগেই চলে গেছে সে।

স্বপ্নে মোতাহারকে দেখার পর, ঘুম ভাঙার পর উঠানে খলফার ওপর শোয়া কাফন পরা ছেলেটিকে যেন দেখতে পেলেন তহুরা বেগম। পেট তখনও ভোজকোমড় হয়ে আছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন তিনি। তার কান্নার শব্দেই ঘুম ভাঙল মান্নান মাওলানার।

এসময় অবশ্য রোজই ঘুম ভাঙে তার। বহুদিনের অভ্যাস। ঘুম ভাঙার পর উঠানের কোণে বসে অজু করেন, আজান দেন, বড়ঘরে এসে স্বামী-স্ত্রী দুইজনেই নামাজ পড়েন।

কিন্তু তহুরা বেগম আজ এসময় এভাবে কাঁদছেন কেন! শরীর কি বেশি খারাপ করল!

যদিও স্ত্রীকে নিয়া আগ্রহ নাই মান্নান মওলানার। তবু বিছানায় উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞাসা করলেন, কী অইছে? কান্দো ক্যা?

তহুরা বেগম কথা বললেন না। আঁচলে চোখ মুছলেন, নাক ঝাড়লেন। তয় কান্না থামল না। মান্নান মাওলানা বিরক্ত হলেন। বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, উইট্টা নমজ কালাম পড়ো তারবাদে যতো ইচ্ছা কাইন্দো। আগে আল্লার নাম তারবাদে কান্দন।

দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন তিনি।

অজু সেরে আজান দিয়ে ঘরে ফিরে মান্নান মাওলানা দেখেন তহুরা বেগম তখনও। আগের মতোই শুয়ে আছেন, আগের মতোই কাঁদছেন। দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মান্নান মাওলানার। খেকুরে গলায় বললেন, কী অইলো, অহনতরি উড়ো নাই? নমজের সময় তো যাইতাছে গা!

আবার আঁচলে নাক ঝাড়লেন তহুরা বেগম। যাউক গা। নমজ পড়ুম না।

মান্নান মাওলানা থতমত খেলেন। তহুরা বেগমের মুখে এই ধরনের কথা কখনও শোনেননি তিনি। বহুকাল হল মানুষটি তার সংসারে। অতি নিরীহ, নরম নির্বিরোধ ধরনের মানুষ। স্বামীকে প্রচণ্ড ভয় পান। স্বামীর কত রকমের অনাচার চোখে দেখেও ভয়ে স্বামীর মুখামুখি হন নাই, ওই নিয়া কথা বলেন নাই। স্বামী যা বলেছেন বুঝিয়েছেন সারাটা জীবন মুখ বুজে তাই বুঝে গেছেন, তাই মেনে নিয়েছেন। কখনও স্বামীর মুখের উপর কথা বলেননি, মুখ ঝামটাননি। সাত-সাত সন্তান জন্ম দিয়েছেন তবু যেন স্বামীর মন পাননি। স্বামীর কাছ থেকে আদায় করতে পারেননি স্ত্রীর মর্যাদা, সম্মান। মান্নান মাওলানা চিরকালই বাড়ির ঝিয়ের মতো আচরণ করেছেন। এক অর্থে রহিমা আর তহুরা বেগমের মধ্যে তেমন কোনও ব্যবধান নাই। সেই মানুষ কিনা আজ স্বামীর মুখের উপর বলছেন নামাজ পড়বেন না!

কী ব্যাপার? কী হয়েছে?

মান্নান মাওলানার যা স্বভাব, তিনি কখনও না শুনে অভ্যস্ত নন। যাকে যা বলবেন তা তাকে শুনতে হবে। না শুনলে জাতসাপের মতো ফুঁসে উঠবেন, ফণা তুলবেন। কোনও না কোনওভাবে দংশাবেন তাকে। মাকুন্দা কাশেমকে যেমন ভাবে দংশে ছিলেন। দংশাবেন নূরজাহানকেও। কীভাবে দংশাবেন সেই চিন্তা মনের ভিতর সেদিনের পর থেকে ঘুরপাক খাচ্ছে। সময় নিচ্ছেন দংশাবার পথ বের করবার জন্য। উপরে উপরে সবাইকে বোঝাচ্ছেন, নূরজাহান পোলাপান মানুষ, নাদান মাইয়া, না বুইজ্জা কামডা করছে, আমি আল্লার ন্যাকবান্দা, এর লেইগা অরে আমি মাপ কইরা দিছি। আসলে তো মনের ভিতর চব্বিশ ঘণ্টা জ্বলছে প্রতিশোধের আগুন।

কিন্তু তহুরা বেগমের আজ কী হয়েছে! এতদিনকার চিনা মানুষটা আজ ভোররাতে হঠাৎ করে এমন বদলে গেছেন কেন! কাঁদছেনই বা কেন!

মান্নান মওলানা বুঝে গেলেন শান্ত মানুষরা রাগলে দিকপাশ ভুলে যায়। তহুরা বেগমও আজ ভুলতে পারেন। এজন্য তার লগে এখন রাগারাগি করা ঠিক হবে না। নরম সুরে কথা বলে বুঝে নিতে হবে ব্যাপারটা কী! হঠাৎ এমন অচেনা আচরণ তিনি কেন করছেন!

ধীর শান্ত নরম গলায়, হাসিহাসিমুখে মান্নান মাওলানা তারপর বললেন, আমি বুজছি কোনও কারণে তোমার মিজাজ বিগড়াইছে। এর লেইগা বিয়াইন্না রাইত্রে উইট্টা কানতাছো। কী অইছে হেইডা আমি পরে হুনুমনে। অহন ওডো, অজু কইরা নমজ পড়ো। তাইলে মনডাও শান্ত অইবো।

বাইরে ভাতের পাতলা ফ্যানের মতো ট্যালট্যালে আলো ফুটেছে। কাক শালিকরা ডাকতে শুরু করেছে। গোয়ালের ওদিকে থেকে থেকে ডাকছে দোয়েল পাখি। ঘরের আনাচ কানাচ থেকে উধাও হবে রাতভর ঘাপটি মেরে থাকা অন্ধকার। আলো অন্ধকারের খেলা চলছে আল্লাহতালার দুনিয়ায়।

কী ভেবে তহুরা বেগম তারপর উঠে বসলেন। স্বামীর চোখের দিকে তাকালেন। তয় ঘরের আলো অন্ধকারের মিশেলে চোখ পরিষ্কার দেখতে পেলেন না তার। তবু অপলক চোখে খানিক তাকিয়ে থেকে জীবনে এই প্রথমবারের মতো দৃঢ় গলায় বললেন, নমজ আমি নিজের গরজেই পড়ুম অহন। আপনের কথায় না। আউজকার পর যতদিন বাইচ্চা থাকুম আপনের কোনও কথা আমি আর হুনুম না। আর আপনের সংসারে আহনের পর থিকা। হারাডা জীবন মনের মইদ্যে আমার যেই হগল দুঃখ ব্যাদনা জমছে, রাগ ঘিন্না জমছে বেবাক আপনেরে আমি হুনাইয়া যামু। আপনে মনে করছেন আপনের কিরতি কলাপের অনেক কিছুই আমি বুজি নাই, বুজছি, হগলই আমি বুজছি। কোনওদিন মোক ফুইট্টা কিছু কই নাই। মরণের আগে বেবাক কইয়া যামু। আইজ আমি আমার পোলাডারে আবার সপনে দেকছি। ও আইয়া আমারে ডাক পাড়ছে। পোলার ডাকে আমি বুজছি আমার মরণ ঘনাইছে। মরণের ডরে কইলাম আমি কান্দি নাই। আমি কানছি আমার পোলাডার লেইগা। আমার পোলাডা মরছে আপনের লেইগা। কেমতে অরে আপনে মারছেন হেই হগল আপনেরে আমি কইয়া যামু।

বিছানা থেকে নামলেন তহুরা বেগম। পালঙ্কের তলায় রাখা স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরলেন। হার্টের অসুখ দেখা দেওয়ার পর থেকে চলাচল ধীর হয়েছে তার। আজ সকালে হঠাৎ করেই যেন সেই ধীর চলাচল উধাও হয়ে গেল। প্রথম জীবনে এই সংসারে এসেই যেমন চটপটা ভঙ্গিতে চলাফেরা করতেন, আজ তার চলাচল হল তেমন।

স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে এই জীবনে প্রথম তহুরা বেগমকে খুবই তেজি ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে দেখলেন মান্নান মওলানা। দেখে বুকটা একটু কাঁপল তাঁর।

.

সন্ধ্যার দিকে নাড়ার পালায় শুকাতে দেওয়া কাপড় তুলতে এসেছে হাসু। তার আর রহিমার কাপড় তুলছে। হঠাৎ করে ডানদিককার কাঁধে কে হাত দিল। আচমকা সাপের লেজে পাড়া দিলে যেমন করে লাফিয়ে উঠে ফণা তোলে বিষাক্ত সাপ ঠিক তেমন করে লাফিয়ে উঠল হাসু। রাগ ক্রোধে ফেটে পড়া চোখে যে তার কাঁধে হাত দিয়েছে সেই মানুষটার মুখ দেখার জন্য ঘুরে দাঁড়াল। লগে লগে রাগী মুখ মোলায়েম হল, দৃষ্টি নরম হল। হাসিহাসি মুখ করে হাসু বলল, ও আতাহার দাদায়! আমি ডরাই গেছিলাম।

নীল লুঙ্গির উপর সাদা হাফহাতা গেঞ্জি পরা আতাহার। পায়ে স্যান্ডেল নাই হাতে সিগ্রেট আছে। অর্ধেক শেষ হওয়া সিগ্রেট। সেই সিগ্রেটে বড় করে টান দিল সে। তুই কী মনে করছ? কে হাত দিছে তর কান্দে?

হেইডা বুজি নাই।

আমি বুজছি।

কী, কন তো?

তুই মনে করছচ পিছ থিকা আইয়া আমার বাপে তর কান্দে হাত দিছে।

হাসু বেশ একখান ঢং করল। আউ ছি। হেয় মুরব্বি মানুষ, পরহেজগার লোক, হেয়। ক্যান আমার কান্দে হাত দিবো?

আতাহার আবার সিগ্রেটে টান দিল। এই হগল আল্লাইদ্যা প্যাচাইল পারি না। আমার বাপে কী জিনিস হেইডা বেবাকতে জানে। তুই আমগো বাইত্তে আহচ ম্যালা দিন ধইরা, তুইও জানচ। যুদি না জাইন্না থাকচ তয় তর ফুধু রহিরে জিগাইচ। রহি খুব ভাল কইরাঐ জানে আমার বাপে জিনিসহান কী?

আবার সিগ্রেটে টান দিল আতাহার। হাসল। আমিও কইলাম হেই বাপের পোলা। আতাহারকে হাসতে দেখে হাসুও হাসল। রহিমার শাড়িটা টেনে নামাল নাড়ার পালা। থেকে। শাড়ি ভাঁজ করতে করতে বলল, আপনের খবর আমার কাছে আছে।

কী খবর ক তো!

কমু?

হ ক।

হুইন্না আবার চেইত্তা যাইবেন না তো?

না চেতুম না।

সত্য?

হ সত্য।

আল্লার কিরা?

এত কিরামিরা কাডন যাইবো না। তুই ক, আমি চেতুম না।

একপলক আতাহারের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল হাসু। আপনে বহুত মাইয়াছেইলা ঘেঁষা মানুষ। মাইয়াছেইলা ছাড়া থাকতে পারেন না।

আতাহার আবার সিগ্রেটে টান দিল। সন্ধ্যাবেলার হাওয়ায় সিগ্রেটের ধুমা উড়ায়া বলল, এই কথা হুইন্না আমি চেতুম ক্যা রে? এইডাঐত্তো আসল কথা। হ আমি বহুত মাইয়াছেইলা ঘেঁষা মানুষ। মাইয়াছেইলা ছাড়া থাকতে পারি না।

থাকতে যহন পারেন না তয় বিয়া কইরা লন না ক্যা?

বিয়া করলে অসুবিদা আছে।

কীয়ের অসুবিদা?

তহন খালি বউর লগেঐ থাকন লাগবো। বারো মিহি যাওন যাইবো না।

বারো মিহি যাওনের কাম কী?

কাম আছে। তুই বুজবি না।

বুজাইয়া কন আমারে, হুনি।

একজন মাইয়াছেইলার লগে রোজ রোজ আমি থাকতে পারি না। আমার ভাল্লাগে না। মনে হয় এক তরকারি দিয়া রোজ ভাত খাইতাছি।

একথা শুনে আবার একটু ঢঙি হল হাসু। খিলখিল করে হাসল। এখন বারবাড়ির দিকে কেউ আসবে না। মান্নান মাওলানা আর তহুরা বেগম নামাজ পড়ছেন বড়ঘরে বসে। হাফিজদ্দি আছে গোয়ালে, ধূপ দিচ্ছে। রহিমা পাকেরঘরে রাতের ভাত চড়িয়েছে। বারবাড়ির দিকটা একেবারেই নিটাল। এই অবস্থায়, এই সময়ে হাসু কল্পনাই করেনি আতাহার বাড়ি ফিরতে পারে, তার কাছে এসে দাঁড়াতে পারে। প্রথমে সে ভয় পেয়েছে, তারপর বহুদিনের অভ্যাসের ফলে কোন পুরুষকে কীভাবে ফিরাতে হবে জানে বলে ঢঙি ভাব ধরছে। যেসব কথা বললে আতাহারের মতো পুরুষরা খুশি হয় সেই লাইনেই কথা বলতে শুরু করছে।

সিগ্রেটে শেষ টান দিয়ে দুই আঙুলের টোকায় ছুঁড়ে ফেলল আতাহার। সাবধানি চোখে একবার বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আস্তে হাস ছেমড়ি, মাইনষে হোনবো।

কথা বলার ফাঁকে তার আর ফুফুর শাড়ি ভাজ করে বুকের কাছে সাবধানি ভঙ্গিতে ধরেছে। হাসু। এমনভাবে আড়াল করেছে বুক যেন একটুখানি অন্যমনস্কতার সুযোগেও আচমকা বুকে হাত দিতে না পারে আতাহার। আতাহারের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে হাসু। তয় মুখের কথায় আর আচরণে এমন ঢঙিভাব ফুটিয়েছে যেন আতাহার তার হাত ধরে টানলেই এই নাড়ার পালার পিছনে গিয়ে আতাহারের সঙ্গে সে শুয়ে পড়বে।

আতাহারের সাবধানি ভাব দেখে হাসু বলল, কেঐ হোনবো না। বাড়ির মাইনষে যে যার কামে আছে। এইমিহি কেঐ আইবো না।

না আইলেও একজন আবার সবমিহি কান রাখে, সবমিহি হের চোখ। হেইডা খালি আমার লেইগাঐ। চব্বিশঘণ্টা হেয় আমারে চোক্কে চোক্তে রাখে।

যেন কিছুই জানে না এমন মুখ করে হাসু বলল, হেইডা আবার কেডা? কে আপনেরে চোকে চোক্তে রাখে?

তুই জানচ না?

না।

এই ছেমড়ি, ফাইজলামি করিচ না আমার লগে।

না দাদা, আমি ফাইজলামি করতাছি না। আমি সত্যঐ জানি না।

চোখ সরু করে হাসুর মুখের দিকে তাকাল আতাহার। ভাবিছাবের কথা জান না?

হাসু সরল মুখ করে বলল, না তো! ভাবিছাবে আবার কী করছে?

হের লগে আমার ইটিস পিটিস (প্রেমপিরিতি অর্থে) তুই জান না?

এইডা তো জানি। বাড়ির বেবাকতেঐ জানে।

তয়?

তয় আবার কী?

আরে ছেমড়ি ভাবিছাবেঐত্তো আমারে চোক্কে চোক্কে রাখে। আমি বাইত্তে আইলেঐ হের চকু দুইখান আমার মিহি, কান দুইডা আমার মিহি। হের লেইগা ফিরির কাছে আমি যাইতে পারি না।

একথা শুনে হাসু অবাক হল। ফিরির লগেও কাম অইছে নি আপনের?

না, অহনতরি পুরাপুরি অয় নাই। ইট্ট ইট্ট কথাবার্তা অয়। ভাবিছাবরে ফাঁকি দিয়া অগো ঘরে আমি কয়দিন ধইরা যাই। ফিরির ভাব চক্করে মনে অইতাছে দুই-চাইর দিনের মইদ্যেঐ অইয়া যাইবো।

আপনের।

কেমুন?

যারে চান তারেঐ পান। ভাবিছাবের লাহান একজনরে পাইছেন, অহন চেষ্টা করতাছেন ফিরিরে।

আরেকজনরেও চেষ্টা করতাছি।

কারে?

ফুলমতি।

ও নিখিলাদাদার রাঢ়ি বইন।

হ।

নিখিলাদাদায় না আপনের দোস্ত?

দোস্ত অইছে কী অইছে?

দোস্তের বইনের লগে এই কাম করবেন?

দোস্তের বইনের লগে তো করন যায়। আমার বাপে যে পোলার জিনিসের লগেও করতে চায়। অনেকদিন ধইরা ফিরির মিহি হের নজর। আমার মনেঅয় গাছির মাইয়ার মিহিও নজর দিছে চুতমারানির পোয়। নাইলে দারোগা পুলিশ আর গেরামের বেবাক মাইনষের সামনে ছেমড়ি হের মোকে ছ্যাপ ছিড়াইয়া দিল, হেয় কিছু কইলো না। এমুন নুলাম জিনিস তো আমার বাপে না। ছনুবুড়ির জানাজায় যাওনের লেইগা মাকুন্দারে চোর সাজাইয়া জেলে দিল যেই মানুষ হেয় এতবড় অপমান সইজ্জ করলো ক্যা হেইডা কেঐ না বোজলেও আমি বুজি। নূরজাহানির ব্যাপারে হের অন্যকোনও মতলব আছে।

হাসু বলল, যা ইচ্ছা থাউক। ময়মুরব্বিগো লইয়া কথা কইয়েন না।

আতাহার হাসল, তয় আয় তরে লইয়া কই।

কইতাছেনঐত্তো। আরও কন, হুনি।

তুই আমার লগে এমুন করচ ক্যা, ক তো?

কী করি?

বোজচ না কী করতাছ?

না।

আইজ সাত-আষ্ট বচ্ছর ধইরা দুই-চাইর মাস পর পরঐ আমগো বাইত্তে আহচ তুই। এতদিন ধইরা তর মিহি আমার নজর। বহুত কায়দামায়দা তর লেইগা আমি করছি, তুই আমারে দেচ না ক্যা?

কথাটা যেন বুঝতে পারল না হাসু। সরল গলায় বলল, কী দিমু?

বোজচ না?

না।

আতাহার থতমত খেল। এরচেয়ে সোজাসুজি আর কীভাবে বলা যায় জানে না সে। আমতা গলায় বলল, শইল্যে মইল্যে হাত দিতে দেচ না, যা কই হোনচ না। আইজ সাত আষ্ট বচ্ছর ধইরা কইতাছি, টেকাপয়সা লাগলেও দিমু। কত রাইত তর লেইগা জাইগ্না বইয়া রইছি, তরে কইছি তর ফুবু ঘুমাইয়া যাওনের পর তুই চুপ্পে চুপ্লে উইট্টা বাংলাঘরে আইয়া পড়িচ, তুই কোনওদিন আহচ নাই। আমি বিচনায় হুইয়া তর লেইগা খালি উসপিস উসপিস করছি।

এসব কথা শুনে শরীর শক্ত হয়ে গেল হাসুর। গলা শুকিয়ে এল। তয় আতাহারকে কিছুই বুঝতে দিল না সে। মুখটা হাসিহাসি করে ঢঙি গলায় বলল, আমার লাহান মাইয়ার লেইগা এইরকম আপনের হওন উচিত না।

ক্যা, কী অইছে তর?

আপনে আমার মোকের মিহি কোনওদিন চাইছেন, শইল্লের মিহি চাইছেন?

চামু না ক্যা?

আমার মনে অয় চান নাই। চাইলে আমার লেইগা খায়েশ আপনের অইতো না। চান, আমার মিহি চান, চাইয়া দেহেন আমারে মাইয়াছেইলা মনে অয়নি?

আতাহর হাসিমুখে হাসুর দিকে তাকাল। ততক্ষণে ভর সন্ধ্যা। অন্ধকার হয়ে গেছে। চারদিক। খুব কাছে দাঁড়িয়েও পরিষ্কার দেখা যায় না মানুষের মুখ। হাসুর মুখও পরিষ্কার দেখতে পেল না আতাহার, শরীর দেখতে পেল না। বলল, শইলমইল ঠিকঐ আছে তর, খালি গলার আওয়াজখান বেড়াগো লাহান অইয়া গেছে। এমুন অইছে ক্যা? আগে তো এমুন আছিলো না!

বিরক্ত হল আতাহার। বাদ দে এই হগল। ম্যালা প্যাচাইল তর লগে এতুন পাড়ছি, আর প্যাচাইলের কাম নাই। ল অহনঐ কাম সারি। নাড়ার পালার পিছে যাই।

হাসুর একটা হাত ধরল আতাহার। লগে লগে হাসু যেন আর হাসু রইল না, হাসু যেন এক জোয়ানমর্দ পুরুষ হয়ে গেল। এমন ঝাড়া (ঝটকা) মারল, আতাহার ছিটকে পড়তে যাচ্ছিল, কোনওরকমে নিজেকে রক্ষা করল। তারপর হতভম্ব হয়ে গেল। কী রে, সত্যঐত্তো তরে আর মাইয়াছেইলা মনে অইলো না। হাতখান লোহার লাহান শক্ত, এক্কেরে বেড়াগো হাত। এমুন অইছে ক্যা তর? তর লগে হুইলে তো মনে অইবো বেড়ার লগে হুইছি। কাম নাই তর লগে হোওনের।

লুঙ্গির কোচড় থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট আর ম্যাচ বের করে সিগ্রেট ধরাল আতাহার। দুই ঠোঁটে সিগ্রেট কায়দা করে আটকে প্যাকেট ম্যাচ আবার রাখল কেঁচড়ে, বাড়ির দিকে। উঠতে গেল, হাসু হাসতে হাসতে বলল, খায়েশ মিট্টা গেছে?

আতাহার সিগ্রেটে টান দিয়া বলল, হ। যেই হাত তর আমি ধরছিলাম, ওই হাত যুদি কোনও ছেমড়ির অইয়া থাকে তাইলে ঐডা আর ছেমড়ি নাই, ওইডা বেডা অইয়া গেছে। বেডা অইয়া বেডাগ লগে আকাম কুকামের অব্বাস আমার নাই। আইজ থিকা তুই বাদ, তর মিহি জিন্দেগিতেও আর চাইয়া দেহুম না আমি। আমি ফিরির কাছে যাই।

বসে যাওয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে সিগ্রেট টানতে টানতে আতাহার তারপর উঠানের দিকে উঠে যায়। পিছনে নাড়ার পালার সামনে তখনও দাঁড়িয়ে আছে হাসু। বুক জুড়ে তার গভীর স্বস্তি। অনেক বছর ধরে পুরুষমানুষ ফিরাতে ফিরাতে, নিজেকে রক্ষা করতে করতে সে যেন সত্যি আর মেয়েমানুষ নাই, সে যেন পুরুষমানুষ হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *