৩.১ ভরা বর্ষার পানি

তৃতীয় পর্ব

ভরা বর্ষার পানি ভেঙে ওপারের জঙ্গলে যায় বিশাল এক দাঁড়াশ সাপ।

জঙ্গলের দিকে এখনও জেগে আছে কিছুটা শুকনা জমি। পুরাপুরি ডোবে নাই। সেই জমিতে ইঁদুর ব্যাঙের কমতি নাই। একবার গিয়া উঠতে পারলে ছোবলে ছোবলে ব্যাং ধরবে দাঁড়াশ, ইঁদুর ধরবে।

হিজল ডুমুরের ঝোপে বাসা বেঁধেছে কানিবক। এই এতদূর থেকেও দেখা যায় দুইটা ছাইবর্ণের বকপাখি পালা করে ছানাদের জন্য খাবার নিয়া আসে। একটা পাখি যায়, একটা আসে। ইঁদুর ব্যাং না পেলে দাঁড়াশ সাপ হিজল ডুমুরের ডালপালা বেয়ে নিঃশব্দে চলে যাবে। বকের বাসার কাছাকাছি। ছোবলে ছোবলে গিলবে বকের তুলতুলে ছানা। জগতের আলো দেখবার আগেই অন্ধকার এক জগতে চলে যাবে ছানাগুলি। সেই জগৎ থেকে ফিরে আসার কোনও পথ নাই।

এসব ভেবে নূরজাহানের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। দুপুরের পর থেকেই বড়ঘরের চৌকিতে বসে আছে সে। জানালা দিয়া বাইরে তাকিয়ে আছে। জানালাটা পুবমুখী। এদিক দিয়া তাকালে ওপারের ওই জঙ্গুলে জায়গাটা পরিষ্কার দেখা যায়। বর্ষার টলটলা পানি বাড়ির নাম থেকেই শুরু হয়েছে। এই পানিতে কোনদিক থেকে এল সাপটা! নূরজাহানদের বাঁশঝাড়তলাতেই ছিল! ইঁদুর ব্যাং কিছু না পেয়ে জঙ্গলের দিকে রওনা দিয়েছে!

নূরজাহান তারপর বাঁশঝাড়টার দিকে তাকাল।

বাঁশঝাড়ের এদিক ওদিক ছড়ানো তিনটা আমগাছ। দক্ষিণ দিককার নামার দিকে একটা কদমগাছ, একটা বউন্না (বরুণ) আর গলা জড়াজড়ি করা দুইটা হিজলগাছ। বৃষ্টিতে ধুয়ে চকচকা হয়ে আছে আমের গাঢ় সবুজপাতা আর গোটায় গোটায় ভরে গেছে হিজল বউন্নার গাছ। বউন্নার গোটাগুলি রাজহাঁসের ডিমের মতন। হিজলগোটা সবুজ, ছোট ছোট। সেই। গোটা টুপটাপ ঝরছে বর্ষার পানিতে, স্রোতের টানে চলে যাচ্ছে এদিক ওদিক। পচে গলে পানিতে মিশছে।

কদমগাছটা ভরে গেছে ফুলে ফুলে। হাওয়ায় কদমফুলের মৃদু গন্ধ। বাঁশঝাড়ের উপর শ্রাবণ মাসের আকাশ পোড়ামাটির মতন। সাদা কালো মেঘ একাকার হয়ে আছে। মেঘের ছায়ায় আকাশের তলায় পড়ে থাকা দুনিয়া বিষণ্ণ হয়েছে। সেই আলোয় জঙ্গলের আড়াল থেকে বের হয়ে এল একটা কোষানাও। নাওয়ের মাঝখানে সবুজ লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্জাবি পরা যে মানুষটা বসে আছে তাকে কেমন চেনা চেনা লাগে। রোদবৃষ্টি নাই তবু মাথার উপর ছাতি ধরে রেখেছে। নাও বাইছে কামলা ধরনের একজন লোক। তার কালো রঙের শরীর রোগাপটকা, মুখ অন্ধকার হয়ে আছে দাড়িমোচে। কোষানাও যত আগায় লোকটার বইঠার শব্দ তত স্পষ্ট হয়।

কোষানাওটা কি এই বাড়ির দিকেই আসছে!

নৌকা যত আগায় লোকটা তত স্পষ্ট হয়। পাঞ্জাবি পরা লোকটাকে তারপর চিনতে পারল নূরজাহান। কাজির পাগলার ল্যাংড়া বসির, বসির ঘটক!

সে কেন এই বাড়ির দিকে আসছে!

বুকটা ধক করে উঠল নূরজাহানের। তা হলে কি তার বিয়ার সমন্দ নিয়া আসছে বসির? এই বয়সেই কি বিয়া হয়ে যাবে নূরজাহানের! কার লগে হবে? জামাই কেমন হবে? কোন গ্রামের পোলা?

পলকের জন্য মজনুর কথা মনে পড়ল নূরজাহানের। মজনুর সরল সুন্দর মুখোন ভেসে উঠল চোখের সামনে। কতদিন সেইমুখ দেখে না নূরজাহান। সেই যে মান্নান মাওলানার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিল, সেই যে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ হল, তারপর কতদিন কেটে গেছে। শীতকাল খরালিকাল গিয়া বর্ষাকাল এল, এই এতদিনে নিশ্চয় কয়েকবার বাড়ি আসছে মজনু, নূরজাহানের লগে দেখা হয় নাই।

মজনুর কথা ভেবে আশ্চর্য এক অভিমানও হল নূরজাহানের। সে নিশ্চয় শুনেছে নূরজাহানের কথা। মরনি আম্মা কি আর না বলছে! সব শুনেও সে একবার এই বাড়িতে এল না! নূরজাহানের একটু খবর নিল না! নূরজাহান কেমন আছে জানার চেষ্টা করল না! কী হত একবার এলে!

ঠিক আছে, না আইছে না আহুক। আমিই বা ক্যান ভাবুম তার কথা। সে আমার কে!

মজনুর কথা মন থেকে মুছে ফেলতে চাইল নূরজাহান, চোখ থেকে মুছে ফেলতে চাইল তার মুখখানি।

ল্যাংড়া বসিরের কোষানাও তখন সত্যি সত্যি নূরজাহানদের বাড়ির দিকে আগাচ্ছে।

.

খাওয়াদাওয়ার পর নিজের তামাকটা আজ নিজেই সাজিয়েছে দবির।

হামিদাকে যে বলবে, ও নূরজাহানের মা, আমার তামুকটা হাজাইয়া দেও, বলতে পারে নাই। বৃষ্টিবাদলার দিনে সংসারের ম্যালা কাজ আগেভাগেই সেরে রাখতে হয়। কখন বৃষ্টি নামবে, কখন আটকে যাবে হাতের কাজ, এই এক ভয়।

এই ভয়েই হামিদা ব্যস্ত হয়ে গেছে তার কাজে। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর কিছুটা সময় অলস কাটে তিনজন মানুষের। দবির বসে থাকে দাওয়ায়, হামিদা আর নয়তো নূরজাহান সাজিয়ে দেয় তার তামাক। আরও কিছুক্ষণ পর নূরজাহান একটু ঘুমায়, হামিদা জুঠা থালবাসন নিয়া যায় পুকুরঘাটে আর দবির বসে বসে অনেকক্ষণ ধরে তামাক খায়।

আজ ব্যাপারটা গেছে উলটাপালটা হয়ে।

সকাল থেকে এই আসে বৃষ্টি, এই যায়। রান্নাচালায় বসে অতিকষ্টে দুপুরের রান্না করেছে। হামিদা। চারদিক খোলা চালার এদিক দিয়া বৃষ্টির হেচলা (ছাট) আসে, ওদিক দিয়া আসে। চুলার আগুন এই নিভে, ওই নিভে। ভাত তরকারির হাঁড়ি থেকে সরা উঠাবার জো নাই। সরা উঠালেই হেচলায় হেলায় বৃষ্টির পানি এসে পড়বে হাঁড়িতে। ওদিকে লাকড়িখড়ি ভিজে একসা। যে রান্না ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা সেই রান্না শেষ হতে লেগে যায় দুইঘণ্টার উপর। ততক্ষণে হামিদার মেজাজ দাঁড়াশ সাপের মতন তিরিক্ষি। বৃষ্টির হাত থেকে রান্না সামলায় আর খ্যাচর খ্যাচর করে। এমুন মাইনষের লগে সংসার কইরা গেলাম, একখান। ভাল রানঘরও বানাইয়া দিতে পারলো না। জিন্দেগিডা গরবাদ (বরবাদ) অইয়া গেল!

হামিদার এসব কথায় দবিরের মনও যে খারাপ না হয় তা না। হয়, খারাপ হয়। কী করার আছে। গরিব মানুষের ঘরে জন্মেছিল। বাপের আমলের জায়গা সম্পত্তি বলতে এইটুকু ভিটা আর ওইটুকু জমিন। তাও আল্লায় রহম করছে, আর কোনও ভাই নাই দবিরের। দুইটা বোন ছিল। দুইজনই দবিরের বড়। অল্পবয়সেই দুইজনকে বিয়া দিয়া দিছিল বাবা। একজনের স্বামী ছিল খলিফা (দরজি)। বিক্রমপুরেরই লোক। বাড়ি ছিল নওপাড়া। খলিফাগিরি করত লালমণির হাটে। বিয়ার পর বউ নিয়া লালমণির হাটে চলে যায়। সেখানেই ঘরবাড়ি করে, সেখানেই থেকে যায়। মা-বাবা বেঁচে থাকতে বোনটা দু’-চার বছরে এক-আধবার আসত। হামিদাকে বিয়া করে দবির যখন নিজের সংসার সাজিয়েছে তারপর আর কোনওদিন আসে নাই। বেঁচে আছে না মরে গেছে সেই খবরও জানে না দবির।

মেজোবোনটার বিয়া হইছিল ভাঙ্গা থানার ওদিককার এক গ্রামে। বিয়ার পরের বছরই বাচ্চা হওয়ার সময় মারা যায়। দবিরের এইটুকু সম্পত্তির সামান্য ওয়ারিশ বোনরাও। তবে কেউ কখনও সেই দাবি নিয়া আসে নাই। মেজোবোনটা তো মারাই গেল। বাচ্চাকাচ্চা রেখে যায় নাই। বোনের মৃত্যুর মাস তিনেক পর বোনজামাই আবার বিয়া করল। সেই বোনের পক্ষ থেকে কে আসবে জায়গাসম্পত্তির দাবি নিয়া! বড়বোন অবশ্য একবার চাড়ি (হুজুগ) তুলছিল। বাবার মৃত্যুর পর একবারই আসছিল সে। বলছিল, কী রে দউবরা, আমার ভাগের সম্পত্তি আমারে দিবি না?

বড়বোনের সাত ছেলে। মেয়ে নাই। সেই ছেলেরা জোয়ান তাগড়া হয়ে কেউ বাপের মতন খলিফা হয়েছে, কেউ হয়েছে মিল কারখানার শ্রমিক। কেউ দিয়েছে মুদিদোকান। সব মিলে বোনের অবস্থা মন্দ না।

বোনের কথা শুনে দবির অসহায় গলায় বলেছিল, তোমার অবস্থা আল্লার রহমতে ভালই বুজি। পোলারা বড় অইছে, ভাল রুজি রোজগার করে। আমার কাছ থিকা এডু (এতটুকু) সম্পত্তি নিয়া তুমি কী করবা? আমার তো আর কিছু নাই। দশ গন্ডা জমিন আর তিন চাইর গন্ডা ভিডা। গাছির কাম না হিগলে না খাইয়া মরতাম। এডু সম্পত্তির দাবি তুমি আর কইরো না বুজি। ছাইড়া দেও।

দবিরের কথা শুনে ভালমন্দ কিছু বলে নাই বোন। তবে দাবি নিয়া আর আসেও নাই কোনওদিন। তারপর কত কত বছর কেটে গেছে, বোনের আর কোনও খবর নেওয়া হয়। নাই। এতদিনে বোন নিশ্চয় বেঁচে নাই।

তবে বোনদের কথা মাঝে মাঝে মনে হয় দবিরের।

আজ দুপুরেও মনে হয়েছিল। ওই যে হামিদা যখন আপন মনে গজর গজর করছিল, দবির তখন ছনের ঘরটার দিকে। এই ঘরটা বাঁশঝাড়ের ওদিকটায়। উপরে গোটা ছয়েক জংধরা পুরানা ঢেউটিন দিয়া চালা করা, চারদিকে খড়নাড়ার বেড়া। বাঁশের একটা ঝাঁপ আছে। ওই ঝপ সরিয়ে ভিতরে ঢুকতে হয়। ঘর খড়নাড়ার তয় বলা হয় ছনের ঘর।

বিক্রমপুর এলাকায় এরকমই বলে।

ছন জিনিসটা তেমন হয় না বিক্রমপুরে। নদীতীরে কাশ হয় বিস্তর। কাঁশ দিয়া কুঁড়েঘরের বেড়া দেয় গরিব গিরস্তলোক, পাটখড়ি দিয়া দেয়। আর খড়নাড়া, বাঁশকঞ্চির বেড়া তো আছেই। তবু ওই সমস্ত ঘর ছনের ঘর। লোকমুখে বহু বহু বছর ধরে চলছে।

দবিরের ছনের ঘরে লাকড়িখড়ি ছাড়া আর কিছু নাই। আজ সকাল থেকে সেই ঘরে লাকড়িখড়ি গুছগাছ করছিল দবির। একটুখানি রোদের মুখ দেখা গিয়েছিল সকালবেলা। ওই দেখে দবির ভেবেছিল লাকড়িখড়ি একটু রোদে দিলে হামিদার রান্নাবান্নার সুবিধা হবে। নূরজাহানকে নিয়া হাত লাগিয়েছিল। বাপমেয়ে মিলে রোদে মেলে দিয়েছে লাকড়িখড়ি, আধঘণ্টাও হয় নাই, বাঁশঝাড়ের মাথার ওপর ভেসে এল কালিবাউস মাছের মতন এক টুকরা মেঘ। সূর্যের আলো ঢাকা পড়ে গেল। বড় বড় ফোঁটায় হঠাৎ করেই ঝমঝমায়া এল বৃষ্টি। বাপ মেয়ে হচড়পাঁচড় করে লাকড়িখড়ি টেনে নিয়েছে ঘরে। নিতে নিতে লাকড়িখড়ি তো ভিজলই, বাপমেয়েও ভিজে চুবচুবা।

ওদিকে হামিদা রান্না সামলাতে পাগল হচ্ছে রান্নাচালায়।

খরালিকালে এইসব ঝামেলা নাই। লাকড়িখড়ির দিকে মনোযোগ দিতেই হয় না। উঠান পালানের যেখানে ইচ্ছা পড়ে থাকে। রোদে শুকিয়ে শুকিয়ে এমন অবস্থা হয়, চুলায় দেওয়ার লগে লগেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠে। রান্না করতে বিরাট আরাম।

ছনের ঘরের পুবপাশে ছোট্ট একটা নাড়ার পালা। দবির অতিছোট গিরস্ত। দশ গন্ডা জমিতে ইরি ফলায়। ইরি হচ্ছে একফসলি। ধান যা হয় কষ্টেসৃষ্টে তিনজন মানুষের বছর। চলে। শীতের দিনে আছে রসের কারবার। সব মিলিয়ে দিন চলে যায় আর কী!

তবে ওই দশ গন্ডা জমির ধানের লগে ভঁটি নাড়াটাও অতিযত্নে বাড়িতে নিয়া আসে দবির। ছোট্ট করে একটা পালা দেয় ছনের ঘরটার পাশে। লম্বা একটা বাঁশ পুঁতে তার চারপাশে উঁটি নাড়া সাজিয়ে সাজিয়ে উঁচু করে পালা। বছর ভর এই পালার উঁটি আর নাড়া পোড়ে রান্নাচালায়। কখনও বউন্নার ডাল, হিজলের ডাল আর বাড়ির নামার দিককার ঝোঁপঝাড় কেটে এনে উঠান পালানে শুকিয়ে লাকড়িখড়ি করে দবির। শীতকালে খাজুরের ডালপালা বহন করে আনে বাড়িতে। সব মিলিয়ে এই হচ্ছে দবির গাছির সংসার জীবন।

এখন তামাক টানতে টানতে শ্রাবণ মাসের বৃষ্টি ভিজা দুপুরের পর নিজের এই সংসারটা চোখের উপর দেখছিল দবির।

ওই যে বাপের লগে লাকড়িখড়ি তুলতে গিয়ে ভিজে একসা হল নূরজাহান, তারপর সংসারের আর কোনও কাজই করে নাই সে। ভিজা কাপড়েই বাড়ির সামনের দিকটায় নেমে গেছে। সেখানে বর্ষার টলটলা পানিতে টুপুর টাপুর পড়ছিল বৃষ্টি। বৃষ্টি আর বর্ষার পানি দাপড়ায়া অনেকক্ষণ ধরে গোসল করেছে মেয়ে। ঘরে গিয়া শুকনা শাড়ি পরে ভিজা শাড়ি রেখে দিয়েছে চৌকাঠে। চিৎকার করে হামিদাকে বলছে, এই বিষ্টিতে আমি আর বাইর অইতে পারুম না মা। আমার কাপড় ধুইয়া দিয়ো।

একদিকে রান্না সামলানোর ঝামেলা আরেকদিকে মেয়ের ওই কথা, হামিদা যে কী চেতাটা চেতলো! তুবড়ির মতন মুখ ছুটল তার। ওই বান্দরনির ঘরের বান্দরনি, আমি তর চাকর? কীর লেইগা আমি তর কাপড় ধুইয়া দিমু? নিজের কাপড় নিজে ধুইতে পার না? ঠোকনা দিয়া চোপা ভাইঙ্গা হালামু!

এইসব গালাগাল নূরজাহানের গায়ে লাগে না। সে জানে যত গালাগাল আর চেতাচেতিই করুক ঠিকই তার কাজটা মা করে দিবে। তার বলা সে বলেছে, মা’র গালাগাল মা করছে, তারপরও কাজটা ঠিকই হবে। ওই নিয়া সে আর মাথাই ঘামায় নাই। পরিপাটি হয়ে চৌকিতে উঠে বসেছে।

তারপর ধীরে ধীরে একটার পর একটা কাজ শেষ হয়েছে সংসারের। ভাত তরকারি ঘরে এনে গোসল করতে গেছে হামিদা। যাওয়ার সময় ঠিকই হাতে করে নিয়া গেছে চৌকাঠে রাখা মেয়ের ডুরেশাড়ি। গোসল সেরে নিজের শাড়ির লগে কোনওরকমে মেলে দিয়েছে ঘরের ভিতর। লগে স্বামীর লুঙ্গি গামছাটাও ছিল।

দবিরের লুঙ্গি গামছা দবির অবশ্য নিজেই ধুয়ে এনেছিল।

তিনজন মানুষ তারপর চট করেই তাদের খাওয়াদাওয়া শেষ করেছে। খাওয়াদাওয়া শেষ হওয়ার পর জুঠা থালবাসন নিয়া পুকুরঘাটে রওনা দিয়েছে হামিদা। এই কাজটা সে ধীরেসুস্থে করে। আজ বৃষ্টির যা ভাবগতিক, ধীরেসুস্থে করার জো নাই। কখন ঝমঝমায়া আসবে, দেখা গেল সন্ধ্যা হয়ে গেছে তাও থামছে না, তখন কাজটা আটকে যাবে। জুঠা থালবাসন ঘরে পড়ে আছে, কল্পনাই করতে পারে না হামিদা।

থালবাসন নিয়া পুকুরঘাটে যেতে যেতে দবিরকে হামিদা বলেছিল, নিজের তামুকখান আইজ নিজেই হাজাইয়া লইয়ো। আর নাইলে মাইয়ারে কও, মাইয়ায় হাজাইয়া দিবো।

নূরজাহান বলল, আমি পারুম না। আমার ঘুম আইতাছে। মুখ খিঁচিয়ে মাত্র মেয়েকে কিছু বলতে যাবে হামিদা, তার আগেই দবির বলল, না না কেঐর লাগবো না। আমিই হাজাইয়া লইতাছি।

হামিদার লগেই ঘর থেকে বের হল দবির। দরজার পাশে খাড়া করে রাখা থাকে হুঁকাটা। তামাক টিকার মালশা আছে হুঁকার লগে। জিনিসগুলি নিয়া রান্নাচালায় এল। মনোযোগ দিয়া তামাক সাজাতে লাগল।

তখন বৃষ্টি নাই তবে আকাশ থম ধরে আছে। থম ধরা আকাশের তলায়, নিজের ছোট্ট আঙিনার রান্নাচালায় বসে দবির তারপর থেকে আয়েশ করে তামাক টানছে। চোখে উদাস দৃষ্টি। তামাক টানছে আর দেখছে বাড়ির সামনের দিককার বর্ষাভাসা চকমাঠ। এই চকমাঠ ভেঙে, জঙ্গুলে শুকনা জমিটার আড়াল থেকে এসময় বের হয়ে এল ল্যাংড়া বসিরের কোষানাও। নিজের বাড়ির দিকে সেই কোষানাও আগাতে দেখে দবির খুবই অবাক। এত যে প্রিয় তামাক, সেই তামাক টানতে ভুলে গেল। নিজের মনে নিজেকে প্রশ্ন করলো, বছির ঘটক আমার বাইত মিহি (বাড়ির দিকে) আহে ক্যা? ঘটনা কী?

.

পুকুরঘাট বলতে এখন আর কিছু নাই।

বর্ষার পানিতে পুকুর ডোবা সব ভেসে গেছে। এখন চারদিকেই পুকুর, চারদিকেই ডোবা। যেদিকে চোখ যায় শুধুই পানি।

বাড়ির পশ্চিম দিককার ছোট্ট পুকুরটার ওপার তরি দবিরের অংশ। তারপর কাদির মাঝির বাড়ি। পুকুরের তিনদিকটাই জংলা। ছিটকি টোসখোলা আর বেত বউন্নার ঝোপে দিনরাত অন্ধকার হয়ে থাকে। কাদির মাঝির বাড়ি বরাবর সীমানায়, পুকুরের ওপারে আছে। চার-পাঁচটা হিজলগাছ, দুইটা বউন্নাগাছ, একটা ঝাঁপড়ানো ডালপালার ডুমুরগাছ। হিজল বউন্নার গাছ বুনতে হয় না, ডুমুরের গাছও বুনতে হয় না। পানিকাদায় একটুখানি জায়গা পেলেই দেদারছে জন্মায়। প্রথম প্রথম চোখেই পড়ে না। তারপর একদিন যেন হঠাৎ করেই ডালপালা ছড়িয়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

ওই গাছগুলিরও এই অবস্থাই হয়েছে। কবে জন্মাল, কবে বড় হয়ে উঠল উদিস পায় নাই কেউ। একদিন যেন হঠাৎ করেই চোখে পড়ল। আরে, এত ডাঙ্গর ডাঙ্গর গাছ হইলো কবে?

এপারে বাড়ির লাগোয়া দবিরের ঘাটলা।

এপারটা বেশ পরিষ্কার করে রেখেছে দবির। ঝোঁপজঙ্গল গজাতে দেয় নাই। দূর্বাঘাস, সেচি আর দুই-চারটা হাগরা (ঘাঘরা) গজায় কখনও কখনও। আগাছার স্বভাবই তো এমন, ফাঁক পেলেই গজায়। হাগড়া আগাছাটা খুবই বদস্বভাবের। পায়ে লাগলে ভালরকম খাউজায় (চুলকায়)। পাতায় পাতায় জন্মায় ছ্যাঙ্গা। হাগড়া পাতা খাওয়া শেষ করে সেই পোকা একসময় মেলা দেয় ঘরবাড়ির দিকে। সে এক ভালরকম যন্ত্রণা। এজন্য দূর্বা সেচি নিয়া মাথা ঘামায় না দবির, হাগড়া দেখলেই টানে টানে উপড়ায়। পায়ের খাউজানির চেয়ে বড় ভয় ছ্যাঙ্গার।

হামিদা নিজেও চোখের সামনে হাগড়া চারা গজাতে দেখলে থাবায় থাবায় উপড়ে ফেলে।

আজ দুপুরের পর ঘাটলায় এসে কেন যে এইসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় মনে আসছে হামিদার, কে জানে! কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেন যে তিনপারের ঝোঁপজঙ্গল দেখছে, এপারের পয়পরিষ্কার ভিটামাটি দেখছে, কারণ কিছুই জানে না সে।

ঘাটলা বলতে পুরানা ভারী ধরনের বড়সড় একখানা তক্তা আড়াআড়ি করে ফেলা। বর্ষার পানিতে সেই তক্তা এখন ডুবা ডুবা। একটুখানি বাতাস বইলে, বর্ষার পানিতে একটুখানি টেউ উঠলে পানি গড়িয়ে যায় তক্তার উপর দিয়া। তবু সেই তক্তায় বসে ঘাটলায় বসার আনন্দটা পায় হামিদা। গুড়গুড়ার (গোড়ালি) উপর শাড়ি তুলে ধধায়া পাকলার কাজ করতে কীরকম যেন একটা ভাল লাগা টের পায়।

এখনও সেই ভাল লাগাটা সে টের পাচ্ছিল।

খরালিকালে ঘাটলার লগের পানিতে কিছু এলাইচ (হেলেঞ্চা) লতা ফেলেছিল দবির। কত বছর আগের কথা আজ আর তা মনে নাই। সেই লতা দিনে দিনে এত বাড়া বাড়ল, ঘাটলার তিনপাশের পাঁচ-সাত হাত জায়গা দখল করে ফেলল। ধোয়া পাকলা আর গোসলের জায়গাটাও ছাড়তে চায় না। ঘাটপার পুরাপুরি ছেয়ে ফেলে দেখে দবির একদিন। পানিতে নেমে তিন-চার হাত জায়গা পরিষ্কার করেছিল। সেই জায়গার টলটলে পানিতেই ধোয়া পাকলা আর নাওয়ার কাজটা করে তিনজন মানুষ। তবে খরালিকালে। বর্ষাকালে বাড়ির যেদিকটায় ইচ্ছা নামলেই হল। পানি তো চারদিকেই।

বর্ষার পানিতে এলাইচ শাক বেদম বাড়া বাড়ে। একদিকে পানি বাড়ে আরেকদিকে পালা দিয়া বাড়ে এলাইচ। দুই-চার-পাঁচদিনেই দখল করতে চায় হামিদার ধোয়া পাকলার জায়গাটুকু, ছিনিয়ে নিতে চায় গোসলের জায়গাটুকু। বর্ষার মুখে মুখে দবির তাই আরেকবার পরিষ্কার করেছে এলাইচ। কিছু রেখে কিছু উপড়ে ফেলেছে। সেই উপড়ানো এলাইচ শাক দুই-তিনদিন ধরে তরকারি করে খাওয়া হয়েছে। এখনও ঠেকা বেঠাকায় এলাইচ শাকটা যখন তখন তুলতে পারে হামিদা। ঘরে অন্য কোনও তরকারি নাই, ঘোপায় হয়তো জিয়ানো ছিল দুইটা টাকিমাছ, কোন ফাঁকে ঘোপার ভিতর মরে সিধা হয়ে গেছে উদিস পায় নাই কেউ। কোটার জন্য বের করতে গিয়া দেখে পচে গন্ধ ছুটছে। গরিবের সংসার, এই মাছই বা ফেলবে কেন? হামিদা ছুটে গেল ঘাটলায়। কয়েকমুঠ এলাইচ শাক তুলে আনল। তারপর কুইয়া (পচা) টাকিমাছের লগে এলাইচ শাকের মিশেল দিয়া এমন একটা চচ্চড়ি করল, খেয়ে দবির আর নূরজাহান তো মুগ্ধই, হামিদা নিজেও মুগ্ধ। একটু তিতা তিতা, তবে স্বাদ খুব।

তিনজন মানুষের থালবাসন ধুতে সামান্যই সময় আজ লাগল হামিদার। হাঁড়ি পাতিল তো আর ধুতে হচ্ছে না। বৃষ্টি বাদলার দিনে একবেলাতেই দুইবেলার রান্না করে রাখে দেশগ্রামের মানুষ। বিকাল সন্ধ্যায় রাতের রান্না এইদিনে করে না কেউ। বাড়িতে হঠাৎ করে কুটুম এলে অন্য কথা। তখন বাধ্য হয়েই করতে হয়। এমনিতে দুপুরবেলার লগে রাতের রান্না করে রাখে গিরস্ত বউরা। হামিদাও তাই করে। ফলে ভাতের হাঁড়িতে রাতের ভাতটা থেকে যায়, তরকারির পাতিলে থেকে যায় রাতের তরকারি। রাতের খাওয়া দাওয়ার পরও ভাত তরকারি কিছু থেকে গেলে ভাতের হাঁড়িতে পানি দিয়ে রাখলে সেটাই হয়ে গেল পান্তা। পরের দিন সকালে বাসি তরকারি দিয়া পান্তা খাওয়া চলে। আর হাঁড়ি পাতিল ধধায়াও হয় তখনই। এজন্য বর্ষাকালের দুপুরবেলায় খাওয়াদাওয়ার পর গিরস্তবউদের ধোয়া পাকলার কাজ কম। শুধুই থালবাসন আর দুয়েকটা গেলাস বাটি ধুতে হয়, হাতা খুন্তি ধুতে হয়।

ওইটুকু কাজ নিয়াই হামিদা আজ যেন একটু বেশিই অস্থির ছিল। স্বামীর তামাক তরি সাজায়া দিতে পারে নাই।

কাজ শেষ হওয়ার পর বেশ একটা স্বস্তি হামিদার। যাউক, অহন একদোম কাইল বিয়ান তরি আজাইর। আর কোনও কাম নাই।

বেশ একটা ফুর্তির ভাব নিয়া হামিদা তারপর উঠানের দিকে আসছে। থালবাসন আলগা করে ধরা বুকের কাছে। ঘরে মাত্র ঢুকতে যাবে, দেখে বাড়ির বিশ-তিরিশ কদমের মধ্যে। এসে পড়েছে একটা কোষানাও। সেই নাওয়ে ছাতি মাথায় দিয়া বসে আছে ল্যাংড়া বসির। যে লোকটা নৌকা বাইছে তার চেহারায় দুনিয়ার বিরক্তি। যেন নৌকা বাওয়ার চেয়ে খারাপ কাজ আল্লাহর দুনিয়াতে আর নাই।

কিন্তু ল্যাংড়া বসির এই বাড়িতে আসছে কেন?

এখনও বাড়ির ঘাটে ভিড়েনি বসিরের কোষানাও, তবু দুই হাতে ধরা থালবাসনের আড়াল থেকে একটা হাত মুক্ত করল হামিদা। গ্রামের বউঝিদের চিরকালীন রীতি অনুযায়ী নিজের অজান্তেই যেন শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় ঘোমটা দিল।

.

কোষানাওখান একটু যেন জোরেই ঠেকল দবির গাছির বাড়ির ঘাটে।

ভালরকম ধাক্কা লাগল নাওয়ে। সেই ধাক্কায় ল্যাংড়া বসির বসা অবস্থাতেও প্রায় টলে পড়ছিল। ছাতি ধরা হাত থেকে ছিটকে পড়তে চাইল ছাতি। বসির হচ্ছে ঘটক মানুষ। রাগ কাকে বলে জানে না। এই পেশায় রাগ থাকতে নাই। বিয়ার সমন্দ নিয়া গেলে কোনও কোনও বাড়ির গিরস্তে এত বিরক্ত হয়, জাতপাত না বলে, বংশগরিমায় আঘাত লাগলে শালা শুয়োরের বাচ্চা বলে গালাগাল দিয়া বিদায় করে। কেউ চুতমারানির পো পর্যন্ত বলে। চড় মারার জন্য হাত তোলে কেউ, জুতা মারার জন্য পা থেকে জুতা খোলে। দুই-চারবার। ঘেটিতে ধাক্কাও খেয়েছে বসির। ল্যাংড়া পায়ে ধাক্কা সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে। পড়েছে গিরস্তবাড়ির উঠানে। তারপরও উঠে জামাকাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে হাসিমুখে পথ ধরেছে।

এই পেশায় মুখে হাসিটা থাকতেই হয়। হাসিমুখের জোরেই মেয়েপক্ষ ছেলেপক্ষের খাতির তোয়াজও বেদম পাওয়া যায়। পছন্দ মতন সমন্দ একটা করে দিতে পারলে দুইপক্ষের মানুষ পারলে কোলে তুলে রাখে। ঘটকসাব ছাড়া কথা বলে না। রাস্তাঘাটে দেখা হলে বিড়ি সিগ্রেট খাওয়ায়, হাটবাজারে দেখা হলে টেনে নিয়া যায় চা-মিষ্টির দোকানে। দুইডা রসোগোল্লা খান ঘটকসাব, এককাপ চা খান। এই নেন কুড়িডা টেকা দিয়া রাখলাম, বড় মাইয়াডারে যেমুন ভাল একখান পোলার লগে বিয়া দিছেন, মাজারোডারেও ওইরকম একখান পোলার লগে বিয়ার বন্দবস্ত করেন।

কেউ কেউ বলে, আমার বড়ভাইর পোলাডারে যেমুন লক্ষ্মী একখান বউ আইন্না দিছেন, হৌরের অবস্থাও ভাল। ওইরকম টেকাপয়সাআলা ঘরের ভাল একখান মাইয়া আমার পোলার লেইগাও আইন্না দেন। হৌরবাড়ি থিকা পোলায় যেন নগদ টেকাপয়সা কিছু পায়।

ঘটকালির কাজে খাতির তোয়াজটাই বেশি। অখাতিরের কাজ, জুতার বাড়ি খাওয়ার মতন পরিস্থিতিও হয় কখনও কখনও। এইটাই দুনিয়ার নিয়ম। যে-কোনও কাজেরই ভালমন্দ দুইটা দিক থাকবে।

একবার কান্দিপাড়ায় খানবাড়িতে গেছে সেই বাড়ির মেয়ে শেফালির বিয়ার সমন্দ নিয়া। ছেলে হচ্ছে দবিরের পড়শি ওই কাদের মাঝির চাচাতো ভাই। বিএ পাশ করে সেই ছেলে ঢাকার এজিবি অফিসে কেরানির চাকরি করে। লম্বাচওড়া স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ ধরনের ছেলে। চাকরিতে উপরি আয়ও আছে। হাতে দামি ঘড়ি, চোখে দামি ফ্রেমের চশমা, পায়ে চকচকা কালো জুতা আর কালো প্যান্ট সাদা ফুলহাতা শার্ট পরে চলাফেরা করে ছেলে। শিক্ষাদীক্ষা টাকা পয়সা সবই হয়েছে। এখন ভাল বংশের মেয়ে বিয়া করে মাঝিবাড়ির ছেলে জাতে উঠতে চায়। বসিরকে ধরেছে। ভাল বংশের মেয়ে এনে দিতে পারলে ডবল পয়সা দিবে ঘটকালির। বসির মহা উৎসাহে কাজে লেগেছে। শীতকালের দুপুরের ভাত খেয়ে কাজির পাগলা থেকে মেলা দিয়েছে কান্দিপাড়া। সীতারামপুর মেদিনীমণ্ডল হয়ে বিলপাথালে পথ ধরেছে। ল্যাংড়া পায়ে হাঁটা তেমন জোরে হয় না। তবু বিকালের মুখে মুখে গিয়া পৌঁছাইছে কান্দিপাড়া খানবাড়ি। সেই বাড়ির বিয়ার উপযুক্ত মেয়ে শেফালির জন্য ছেলে দেখতে বলেছিলেন মেয়ের মেজোচাচা রশিদ খাঁ। রশিদ খাঁ-র লগে বসিরের দেখা হয়েছিল গোয়ালিমান্দ্রার হাটে। কথায় কথায় বসিরকে বলেছিলেন, আমার বড়ভাইর মাইয়াডার লেইগা পোলা দেইখো তো বসির। ভাল পোলা পাইলে বিয়া দিমু। আমার ভাস্তি দেখতে মন্দ না। খাবাড়ির মাইয়া। বোঝোই তো, আদব লেহাজ জানে। কেলাস নাইন তরি পড়ছে। পাঁচওক্ত নমজ পড়ে, কোরআন শরিফ পড়ে।

মেয়ের গুণকীর্তন শুনে ল্যাংড়া বসির মুগ্ধ। আইচ্ছা দেখুম নে খাঁ-সাব। আপনেগো বাড়ির মাইয়ার লেইগা পোলা পাওয়া কোনও ব্যাপারই না। দেইখেন নে কীরকম পোলা জোগাড় করি।

তারপর হাতে এল মাঝিবাড়ির পোলা। পোলার নাম রফিক মাঝি। সম্বন্ধ নিয়া কান্দিপাড়া খানবাড়িতে গিয়া হাজির বসির। রশিদ খাঁ বাড়িতেই ছিলেন। বসিরকে দেখে খুবই আদর করে উঠানে জলচৌকি পেতে দিয়েছেন বসতে। নিজে বসেছেন বসিরের মুখামুখি হাতলআলা চেয়ারে। পরনে লুঙ্গি আর কোরাগেঞ্জি। মাথায় গোল সাদা টুপি, এক কাঁধে গেরুয়া রঙের পুরানা একখান আলোয়ান। পোলা পাইছো বসির?

বসির গদগদ গলায় বলল, হ পাইছি খাঁ-সাব।

কও কী? সত্যই পাইছো?

ওই দেখো খা-সাবে কয় কী? আরে পোলা না পাইলে এতদূর হাঁইট্টা আপনেগ বাড়িতে আমি আইনি?

হ কথা সত্য। তয় কোন গেরামের পোলা?

মেদিনমণ্ডলের।

পোলায় করে কী?

চাকরি করে।

কী চাকরি? কেরানি, এজিবি অফিসের কেরানি। থাকে ঢাকায়। সেগুন বাগিচায় অফিস। পোলায় থাকে মেসে। মেস অইলো কাকরাইলে। কাকরাইল থিকা সেগুন বাগিচা অইলো হাঁটাপথ। মেস থিকা অফিসে যাইতে তিন-চাইর মিনিট লাগে।

ভাল, ভাল। পোলার লেখাপড়া?

বিএ পাশ।

কোন কলেজ থিকা?

কায়দে আজম কলেজ। ওই কলেজটা অইলো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে। স্বাধীনতার পর নাম বদলাইছে কলেজের। নতুন নামডা আমি জানি না।

কোন ডিভিশনে পাশ করছে?

বসির একটু দমল। আমি খাঁ-সাব আপনের লগে মিছাকথা কমু না। আমি ঘটকালি করি ঠিকঐ, তয় ভাল বংশের পোলা। অবস্থাও মন্দ না আমগো। মিছাকথা কইয়া ঘটকালি অনেকেই করে, আমি করি না। হাছা কথাই আপনেরে কই। ছেলের ডিভিশনটা ভাল আছিলো না।

রশিদ খাঁ চোখ তুলে বসিরের দিকে তাকালেন। তার অর্থ অইতাছে থাজ্জিবিশন? (থার্ড ডিভিশন)।

হ থাড্ডিবিশন। তয় চাকরি করে ভাল। পোলা দেখতে ভাল, রুজি রোজগার ভাল। চাকরিতে উপরি আছে ম্যালা।

না না এই হগলে কোনও অসুবিধা নাই। বিএ পাশ অইলেই অইল। বিএ পাশের নীচে খানবাড়ির মাইয়াগো বিয়া অয় না।

বসির হে হে করে হাসল। হেইডা তো আমি জানিই। বিএ পাশের নীচের পোলা অইলে সম্বন্ধ লইয়া আমি আপনের বাড়িতে আইতামই না। হে হে।

কথা বলতে বলতে আড়চোখে বড়ঘরের দিকে তাকাচ্ছিল বসির। বড়ঘরের কপাটের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে শেফালি। বাড়িতে ঘটক আসছে শুনেই কপাটের আড়ালে এসে দাঁড়িয়েছে। এখান থেকে মাইজ্জাকাকা আর ঘটকের বেবাক কথাই কানে যাচ্ছে তার। শেফালির মা-চাচিরা ঘটকের জন্য চা-নাস্তা বানাতে গেছে রান্নঘরে।

রশিদ খাঁ-র সামনে তখন পিতলের নলঅলা হুঁকা রেখে গেছে বাড়ির পুরনো গোমস্তা কালু। হুঁকার নলে টান দিয়ে তিনি বললেন, বেবাক কথাই কইলা, পোলার নাম কইলা না বসির। নাম কী পোলার?

বসির আবার সেই হে হে করা হাসিটা হাসল। পোলার নাম খাঁ-সাব রফিক।

পদবি?

পদবি অইতাছে খাঁ-সাব মাঝি।

মাঝি শব্দটা শুনে হুঁকার নল হাত থেকে পড়ে যেতে চাইল রশিদ খাঁ-র। কী কইলা? মাঝি?

হ খাঁ-সাব। মাঝি।

মেদিনীমণ্ডলের মাঝিবাড়ির পোলা?

হ।

হুঁকার নল ফেলে লাফ দিয়া উঠলেন রশিদ খাঁ। শালার পো শালা, এত বড় সাহস তর? খানবাড়ির মাইয়ার লেইগা মাঝিবাড়ির পোলার সমন্দ আনছস? ওই শেফালি, মুইরা পিছাড়া (ভাঙা ঝাড়) আন তো। চুতমারানির পো’রে পিছাদা পিডাই।

বসির তারপর আর একদণ্ড বসে নাই খানবাড়ির উঠানে পেতে দেওয়া জলচৌকিতে। ল্যাংড়া পা টেনে কোনওরকমে একটা দৌড় দিয়েছে। একদৌড়ে চকে।

রাগে তখন বসিরের গা জ্বলছিল। আইজকাইলকার পোলাগো আবার জাত-বেজাত কী? লেখাপড়া আর টেকাপয়সা থাকলেই তো অয়। খাঁ-বাড়ির মাইয়া অইছে তো কী অইছে? মাঝিবাড়ির পোলার শিক্ষাদীক্ষা আছে, ভাল চাকরি আর টেকাপয়সা আছে এই জোরে হেই পোলা তো খাঁ-বাড়ির ক্যান, চদরি (চৌধুরী) বাড়ির মাইয়াও বিয়া করতে পারে। আইজকাইল তো জাতে জাতে বিয়া অয় না, বিয়া অয় টেকায় টেকায়। কোনও গিরস্তে টেকা দিয়া জামাই কিনে, আবার কোনও গিরস্তে টেকা দিয়া কিনে বউ। আইজকাইল কি আর বংশগরিমা কোনও কামে লাগে!

চকে নেমে মনে মনে রশিদ খাঁ-কে বেদম গালাগাল করেছে বসির। এত গরিমা দেহাইচ না চুতমারানির পো? মাঝিবাড়ির পোলায় যে তর ওইরকম পেতনির লাহান ভাস্তিরে বিয়া করতে চাইছে হেইডাঐ তর সাত কপালের ভাগ্যি। ওই ভাস্তি তো তুই বিয়া দিতে পারবি ্না। ওই ভাস্তি দিয়া তর ঘরের খাম দেওন লাগবো হালা খাডাসের পো।

তবে ওই রাগ গালাগাল মনে মনেই। তারপর বাজার হাটে, গ্রামের রাস্তায় রশিদ খাঁর লগে দেখা দু’-চার বার হয়েছে বসিরের। বসির হাসিমুখে তাকে সালাম দিয়েছে। ভালমন্দ জিজ্ঞাসা করেছে। অপমানটা যে মনে আছে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেয় নাই সে-কথা। মুখে রাগের ছায়া পড়তে দেয় নাই।

মাস ছয়েক পর এক সকালে রশিদ খাঁ এসে হাজির বসিরের বাড়িতে।

লুঙ্গির ওপর হাফহাতা সাদা শার্টটা পরে মাত্র ঘর থেকে বের হবে বসির, চপচপ করে তেল দেওয়া চুল কাঁকুই দিয়া আঁচড়াচ্ছিল, উঠানে এসে দাঁড়ালেন রশিদ খাঁ। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরা, পায়ে পামশু। বৈশাখ না জষ্ঠিমাসের ঘটনা। বেজায় গরম। সকালবেলাই। রোদের তেজে জান বের হয়ে যায়। রশিদ খাঁ-র মাথার উপর ছাতি ধরা ছিল। বসিরদের বাড়িতে ঢোকার আগে ছাতা বন্ধ করেছেন।

রশিদ খাঁ-কে দেখে হতভম্ব বসির। খাঁ-সাব আপনে আমগো বাড়িতে? কী মনে কইরা?

তোমার লগে কথার কাম আছে বছির।

গলার স্বর খুবই নরম কোমল। গোপনে একটা তোয়াজের ভাবও যেন টের পাওয়া যাচ্ছে গলায়। একটু যেন সমীহের ছোঁয়া।

বসির তার স্বভাবসুলভ হাসিটা হাসল। হে হে, কইয়া ফালান খাঁ-সাব, কইয়া ফালান।

তার আগে কও আমার উপরে তোমার রাগটা কমছে?

বসির যেন আকাশ থেকে পড়ল। কীয়ের রাগ?

ওই যে আমগো বাইত্তে তোমারে….

আরে ধুরো! কী যে কন খাঁ-সাব? ওই হগল আমি মনে রাখছি নি? ক্যা তারপর আপনের লগে আমার দেহা অইছে না? দেহা অওনের পর আমি আপনেরে সেলামালায়কুম দেই নাই? কথাবার্তা কই নাই?

মিছাকথা কমু না। কইছো।

তয়?

এই আর কী! মনে অইলো আর কী?

না না ওই হগল লইয়া আপনে চিন্তা কইরেন না। বাইত্তে বইবেন? চা দিতে কমু এককাপ? নাকি একগেলাস পানি খাইবেন? এতদূর হাঁইট্টা আইছেন, আদাইয়া (হাঁপিয়ে) গেছেন না?

না বাজান, কিছু অয় নাই। খামু না কিছুই। তোমার লগে কথাডা সারি।

তয় লন বাজারমিহি যাই। যাইতে যাইতে আপনের কথা আপনে কন, আমার হোনন আমি হুনি।

খালি হোনলে অইবো না, কামডা কইরা দেওন লাগবো।

অইলো। আগে আপনে কন।

রশিদ খাঁ-কে নিয়া বাড়ির উঠান থেকে নেমে বসিরও মাথার ওপর মেলেছে ছাতা। খালপারের পথ ধরে দুইজন মানুষ মেলা দিয়েছে কাজির পাগলা বাজারের দিকে। কাজির পাগলা স্কুলের বিশাল মাঠ তখন সকালবেলার রোদে ঝিমঝিম করছে। কয়েকটা গোরু বরকি আর কোন গিরস্তের যেন একটা ভেড়া অলস ভঙ্গিতে চরছে।

হাঁটতে হাঁটতে রশিদ খাঁ বললেন, বছির তুমি আমার ছেইলার বয়সি। যেই কামে তোমার কাছে আইছি, কামডা তোমার করনই লাগবো।

বসির বুঝতেই পারছিল না, এত তোয়াজের কী আছে। রশিদ খাঁ এতটা পথ ভেঙে, রোদ ভেঙে তার কাছে আসছে তো একটাই কাজে। ঘটকালির কাজ। বসিরের পেশা ঘটকালি। টাকাপয়সা ঠিকঠাক মতন পেলে কাজ করতে তার অসুবিধা কী? এই নিয়া এত প্যাচালের কী আছে?

আসল কথাটা শোনার জন্য একটু যেন অধৈর্যই হচ্ছিল বসির। তবু স্বভাব অনুযায়ী অধৈর্য ভাব দেখাল না। হাসিমুখে ঠান্ডা গলায় বলল, এত কথার কাম নাই। আসল কথাডা আপনে আমারে কন। আপনের ভাস্তি শেফালির লেইগা সমন্দ দেখতে কইতাছেন তো? মাইয়ার বস (বয়স) অইয়া গেছে, অহন বিয়াশাদি না অইলে দিনে দিনে মাইয়ার চেহারা সুরত যাইবো বিগড়াইয়া। তখন পোলাই পাওয়া যাইবো না, এই হগলই তো কইতে চান, না কি?

রশিদ খাঁ ডানহাত থেকে বাঁহাতে আনলেন ছাতি। দোনেমোনে গলায় বললেন, তোমার অনুমান ঠিকই আছে, তয় ঘটনা একটু অন্যপদের।

হে হে, পদটা কইয়া ফালান।

লও বাজারে গিয়া কই। গান্ধির দোকানে বইয়া দুইখান রসোগোল্লা খাও, এককাপ চা খাও, বিড়ি সিগ্রেটের অব্বাস থাকলে খাও। খাইতে খাইতে কথা হোনো।

বসিরের বুকপকেটে সব সময় থাকে রমনা সিগ্রেটের প্যাকেট। এখনও আছে। আর ওই জিনিস চোখে না পড়ার কথা না। রশিদ খাঁ-র চোখেও পড়েছে। তা ছাড়া রাস্তাঘাটে বাজারহাটে বসিরের হাতে সিগ্রেট তিনি দেখেছেন। ফুক ফুক করে টানতেও দেখেছেন। তবু ময়মুরব্বির ভঙ্গিতে কথাটা বললেন।

বসির তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না রশিদ খাঁ-র আসল মতলবটা কী? ভালরকম একটা ধন্দের মধ্যে সে পড়ে রইল।

গান্ধিঘোষের দোকানে একজনও কাস্টমার নাই। কাঁচের আলমারিতে থরে থরে সাজানো গামলা ভরা রসোগোল্লা লালমোহন ছানার আমিরতি (অমৃতি)। বড় বড় কাঁসার থালায় সাজানো চমচম বালুসাই আর আমিরতি। দোকানের পিছনদিকে বিশাল সাইজের কয়েকটা কড়াই অ্যালুমিনিয়ামের ঢাকনা দিয়া কোনওটা পুরো ঢাকা, কোনওটা একটুখানি। দু’ চারটা বল্লা মৌমাছি আর বিস্তর নীল কালো ভোমা মাছি ভ্যানভ্যান করছে কড়াইগুলির সামনে। কাঁচের আলমারির পাশে আলগা চুলায় চায়ের পানি ফুটছে। টিনের বড় একটা থালায় কাপ পিরিচ আর চামচ সাজানো। চিনির বয়ামটা রাখা দোকানের কর্মচারী গৌরার হাতের কাছে। দোকানে কাস্টমার নাই দেখে একটা হাতপাখায় মাছি তাড়াবার নামে নিজেকে বাতাস করছে গৌরা। খালি গায়ের কালো কুচকুচা গৌরার পেট একেবারে ঝুলে পড়েছে। কোরা রঙের ধুতি লুঙ্গির কায়দায় পরা।

রশিদ খাঁ-কে গৌরা চিনে না, দূর গ্রামের লোক, চিনে বসিরকে। তবে বসিরের লগে রশিদ খাঁ-কে দেখে তার খবর হয়ে গেল, চা মিষ্টি এখন দুই-চারখান বিক্রি হবে। বসির ঘটকের কাছে নিশ্চয় পোলা মাইয়ার বিয়ার ব্যাপারে আসছে দেশগ্রামের কোনও গিরস্ত। চা-মিষ্টি খেতে খেতে এখন সেকথাই হবে। চা-মিষ্টির দাম গিরস্ত লোকটাই দিবে। ঘটকরা। কখনও খাওয়ায় না, তারা শুধু খায়।

দোকানে ঢুকেই মুখামুখি বসল দুইজন। রশিদ খাঁ আদেশের গলায় বললেন, দুইডা কইরা রসোগোল্লা দেও। তারবাদে চা দিয়ো।

চিনামাটির পিরিচে করে রসগোল্লা নিয়া এল গৌরা। লম্বা টেবিলটার ওপর রাখতে রাখতে বলল, কত্তা কোন গেরামের?

রশিদ খ না, জবাব দিল বসির। কচ কী রে গৌওরা, খাঁ-সাবরে তুই চিনচ না? আরে সেয় (সে কিংবা তিনি) অইলো কান্দিপাড়ার রশিদ খাঁ।

গৌরা চিনল কি চিনল না বোঝা গেল না। হাসিমুখে বলল, বুজছি বুজছি।

তারপর চা বানাতে চলে গেল।

রশিদ খাঁ তখন চামচে করে একটু একটু করে রসগোল্লা কাটছেন, একটু একটু করে মুখে দিচ্ছেন।

বসির বলল, এইবার কন খাঁ-সাব। ভাস্তির লেইগা আবার সমন্দ দেহুম?

রশিদ খ বসিরের দিকে চোখ তুলে তাকালেন। না।

তয়?

সমন্দ তো তুমি দেইখাই রাখছো।

জে?

হ। মাঝিবাড়ির একটা পোলা তুমি দেখছিলা না?

লগে লগে সেই দুঃখের স্মৃতি বসিরের মনে পড়ল। মুইড়া পিছার বাড়ি খেতে খেতে বেঁচে গিয়েছিল। ল্যাংড়া পা নিয়া দৌড় দিয়া চকে না নামলে কপালে কী ছিল আল্লাই জানে। এখন সেসব কথা ভেবে বসির টের পেল তার মুখের ভিতরটা তিতা তিতা লাগছে। তিতাভাব কাটাবার জন্যই যেন রসগোল্লার প্রায় অর্ধেকটা চামচে কেটে মুখে পুরে দিল। চাবাতে চাবাতে বলল, আরে হ। রফিক মাঝি। বিএ পাশ। এজি অফিসের কেরানি। চাকরিতে উপরি আছে ম্যালা।

আমি খবর লইছি হেই পোলায় অহনও বিয়া করে নাই।

হ। আমিঐত্তো তার লেইগা মাইয়া দেখতাছি। কাদির মাঝি পেরায় পেরায়ই আমার কাছে আহে। আমার ভাইয়ের বিয়ার কী করলা ঘটক? ভাল জাতের একখান মাইয়া দেও।

মিষ্টি খাওয়া শেষ করে আথকা বসিরের একটা হাত চেপে ধরলেন রশিদ খাঁ। এই সমড়া তুমি কইরা দেও বসির। শেফালির লেইগা পোলাড়া তুমি আইন্না দেও।

বসির ঘাঘুলোক। এতক্ষণের কথাবার্তায় ঘটনা কিছুটা আঁচ করেছিল। পুরাটা বোঝে নাই। এখন সব বুঝেও একেবারেই বলদা (বোকা) একখান মুখ করে ফেলল। কন কী খাঁ-সাব? আপনেগো বাড়ির মাইয়া বিয়া দিবেন মাঝিবাড়ির পোলার কাছে? জাইত যাইবো না?

আইজকাইল আবার জাইত কীয়ের? শিক্ষিত টেকাআলা পোলা, ভাল চাকরি করে, ভাল উপরি পায়, দেখতে শোনতেও ভাল। আমার ভাস্তি তো অত সোন্দর না। মাঝিরা যে আমগো লগে সমন্দ করতে চাইছে, এইটাই বিরাট ঘটনা। আমরা খা-বংশের লোক, তয় অহন পড়তি। টেকাপয়সা আগের লাহান নাই। জাগাসম্পত্তিও কইম্মা গেছে। আরেকদিকে ভাস্তি যাইতাছে বুড়া অইয়া…।

ময়মুরব্বির সামনে পকেটে রমনা সিগ্রেটের প্যাকেট নিয়া ঘুরলেও সিগ্রেটটা বসির ধরায় না। ধরায় আড়ালে আবডালে গিয়া। আজ আর সেটা করল না। চায়ে ফুরুক করে চুমুক দিয়া পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে ধরাল। ভাবটা এইরকম যেন সেই এখন রশিদ খাঁ-র মুরব্বি।

আসলে ব্যাপারটা বসির ইচ্ছা করেই করল। সেদিনকার সেই অপমানের এটা হল প্রথম প্রতিশোধ। পরের প্রতিশোধগুলি সে ধীরে ধীরে নিবে।

সিগ্রেটে টান দিয়া রশিদ খাঁ-র মুখ বরাবর ধুমা ছেড়ে পরিষ্কার গলায় বসির বলল, ঘটনাডা অইলো খাঁ-সাব হেই ডাকের কথার লাহান।

হাততে কাডল খায় না
মোথা লইয়া টান পারে।
(সাধতে কাঁঠাল খায় না, পরে মোথা নিয়ে টানাটানি করে)

তারপর দ্বিতীয় প্রতিশোধটা নিল বসির। আপনে কইছিলেন দেইখাই আপনের ভাস্তির লেইগা ছেইলা দেকছিলাম আমি। ভাল ছেইলা পাইছি, গেছি সল্লমন্দ লইয়া আপনের কাছে, আর আপনে আইলেন আমারে মুইড়া পিছা লইয়া। আপনে যেই কথাডা ইকটু আগে কইলেন এইডা তো আমি বহুত আগে থিকাই জানি। আপনেরা অইলেন অহন পড়তি খা বংশ। আগের বংশগরিমা টেকাপয়সা আর কিছুই নাই আপনেগো। আপনেগো থিকা অহন মাঝিরা অনেক উপরে। মাঝিবাড়ির পোলায় যে আপনের ওই পেতনির লাহান ভাস্তিরে বিয়া করতে চাইছে এইডাই তো বেশি। আর আপনে কী করলেন? আপনে গেলেন ঘটকরে মুইড়া পিছা লইয়া পিডাইতে।

বসিরের কথার খোঁচায় রশিদ খাঁ তখন কাটা কচুপাতার মতন নুইয়ে পড়েছেন। মাথা নিচু করে ফুরুক ফুরুক করে চা খাচ্ছেন। কথা বলতে যেন ভুলে গেছেন। অন্যদিকে বসিরের মনে বেদম ফুর্তি। মনে মনে বলছে, কী রে হালার পো হালা, অহন কেমুন লাগে?

তারপরই বাণিজ্যের কথাটা তুলল বসির। আপনে মুরব্বি মানুষ, ভুল কইরা অপমান করছিলেন আমারে, ঠিক আছে আমি ওইটা মনে রাখলাম না। মাঝিবাড়ির পোলার লগে ধইরা নেন আপনের ভাস্তির বিয়া অইয়া গেছে। যেই মাসে চাইবেন ওই মাসেই বিয়া। তয় টেকা আমারে দেওন লাগবো আষ্ট হাজার।

রশিদ খাঁ-র পায়ে যেন মান্দার কাটা বিনধা গেছে এমন করে চমকালেন তিনি। আষ্ট হাজার?

হ। দশ হাজারই চাইতাম। আপনে মুরব্বি মানুষ দেইখা দুই হাজার কমাইছি।

টাকাপয়সার ব্যাপারে রশিদ খাঁ খুবই খাইষ্ঠা (কৃপণ অর্থে) লোক। শুরু করল তিন হাজার থেকে। শেষ তরি পাঁচ হাজারে সাব্যস্ত হল। দেড়মাসের মাথায় রফিক মাঝির বউ হয়ে খানবাড়ির শেফালি চলে গেল ঢাকার টাউনে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল জুড়ে ওঁয়া ওঁয়া।

তবে রশিদ খাঁ হচ্ছেন বসিরের ঘটক জীবনের বড় রকমের অভিজ্ঞতা। সময় সময় ঘটনাটা বসিরের মনে পড়ে। আর ওই যে বাড়ি থেকে ডাইকা নিয়া গান্ধির দোকানে চা মিষ্টি খাওয়াতে খাওয়াতে যেভাবে শেফালির বিয়ার কথা তিনি তুলেছিলেন, সেই ঘটনার বছর দেড়েক পর আজ ঠিক তার উলটা কায়দায় নূরজাহানের বিয়ার কথা বসির তুলবে। সেই জন্যই দবির গাছির বাড়িতে আসছে।

তবে ওই হারামজাদা ফইজু দিল বাড়ির ঘাটে কোষা লাগাতে গিয়া বিরাট এক ধাক্কা। ইচ্ছা করলেই ধাক্কাটা ফইজু বাঁচাতে পারত। দূর থেকে বইঠার চাড়িটা একটু কমায়া আনলেই পারত। আর নয়তো চাড়ি না দিলেই হত, নৌকাটা আপছে এসে লাগত বাড়ির ঘাটলায়। উদিসই পাওয়া যেত না যে নৌকা ঘাটে লাগছে।

তবু ফইজুর উপর রাগল না বসির। ছাতি বন্ধ করতে করতে বলল, তর অইছে কী রে ফইজ্জা? খ্যাল করচ না কিছু? নাকি নাও বাওয়ায় মন নাই?

ফইজু নিরস মুখে বলল, পরিবারের (বউ অর্থে) লগে কাইজ্জা অইছে। দোফরে ভাত দেয় নাই।

কচ কী?

হ।

তয় আগে কবি না! বাইত থিকা তরে ভাত খাওয়াইয়া আনতাম।

অহন থিকা হেইডাই কইরেন। বাইষ্যাকালে যতদিন আপনের নাও বামু, টেকাপয়সা যা দেওনের দিয়েন, তিনওক্ত খাওনডাও দিয়েন। সংসার আমার রুজিতে চলে না, চলে পোলাগো রুজিতে। এর লেইগা পরিবার অহন আর আমারে দুইচোক্ষের নিলায় (দৃষ্টিতে) দেখতে পারে না। ভাত চাইলে চক্ষু গোড়াইয়া (চোখ রাঙিয়ে) চায়। পাতিলায় ভাত। থাকনের পরও একমুঠ ভাত বেশি চাইলে কয়, ভাত নাই। আর আপনের পেডে কি রাক্কস। হানছে নি (রাক্ষস ঢুকেছে নাকি? এত ভাত ভাত করেন ক্যা?

ছাতি বন্ধ করে বসির তখন পাঞ্জাবির পকেট থেকে গোলাপি রঙের কাকুই বের করে তেলেভিজা মাথা পরিপাটি করে আঁচড়াচ্ছে। ফইজুর কথা তার কানেই গেল না। সে আছে এখন রশিদ খাঁ-র উলটা তরিকায়।

.

ল্যাংড়া বসিরের কোষানাও সত্যি সত্যি তার বাড়ির ঘাটে এসে লাগছে দেখেই তামাক টানা থামিয়েছে দবির। কলকিতে তামাক টিকা দুইটাই বেশ আগে পুড়ে ছাই হয়েছে। তবু টানে টানে ধুমা একটু আসছিল। সেই ধুমায় তামাক বলতে কিছু ছিল না, শুধু তামাকের একটুখানি গন্ধ। নেশাখোর মানুষের কাছে ওইটুকু গন্ধই বা কম কীসে।

দবিরের খুব ইচ্ছা করছিল আরেক ছুলুম (ছিলিম) তামাক সাজাবে। হুঁকা তো হাতে আছেই, তামাক টিকার মালসাও আছে হাতের কাছে। চুলার তলার দিকে এখনও রয়ে গেছে নাড়ার আগুনের ধিকিধিকি। ছাইদাঁড়া (চুলার ভিতর যে দণ্ডটা দিয়ে খুঁচিয়ে ছাই ওলট পালট করা হয়) দিয়ে খানিক খোঁচাখুঁচি করে ওই জিনিস কিছুটা তুলে কলকিতে দিলেই হল। তারপর টানতে শুরু করলে টানে টানে তামাক পুড়বে, গলগল করে ধুমা বের হবে। নেশায় ভরতে থাকবে বুক আর মাথা। টিকা পোড়াবার দরকারই হবে না।

কাজটা করা হল না। দ্বিতীয়বার তামাকের নেশা বুকে মাথায় ঢুকাতে পারল না দবির। বসিরের কোষানাও এসে বাড়ির ঘাটে লাগছে দেখে হুঁকা রেখে উঠে দাঁড়াল। রান্নাচালা থেকে বের হয়ে ধীরপায়ে এল কোষানাওয়ের কাছে।

ততক্ষণে মাথা আঁচড়ে পাঞ্জাবির জেবে (পকেটে) কাকুই ভরেছে বসির। ছাতি বুজিয়ে রেখেছে বাঁশের চটি দিয়া তৈরি কোষানাওয়ের পাটাতনে। দবিরকে আগায়া আসতে দেখে ল্যাংড়া পা টেনে নৌকা থেকে নামল। হে হে গাছিদাদা, আছেন কেমুন? হে হে। শইলডা ভাল? হে হে।

দবির তীক্ষ্ণচোখে বসিরের দিকে তাকাল। আছি তো ভালই রে দাদা। তোমার খবর কী? কী মনে কইরা এই বাইত্তে?

আইলাম আপনের লগে ইট্ট দেহা করতে। হে হে। ইট্ট কথার কাম আছে। হে হে।

লও ঘরে লও। ঘরে গিয়া বহি। নাকি উডানেই বইবা? ফিরি (পিড়ি) আইন্না দিমু?

না ফিরিফুরির কাম নাই। হে হে। নাওয়ে ম্যালা টাইম ধইরা বইয়া আছিলাম। মাজামোজা বেদনা অইয়া গেছে। অহন ইট্টু মাজা টানা দিয়া খাড়ই। হে হে। খাড়ই থাকলে আরাম লাগবো। হে হে।

এইডা কোনও কথা অইলোনি মিয়া? বাইত্তে আইছো, ইট্টু বইবা না? পান তামুক খাইবা না?

আরে খামু নে। পান তামুক খাওনের বহুত টাইম পইড়া রইছে।

তয় কও দিহি (দেখি) কী কইবা? বইতে যহন চাও না, খাড়ই খাড়ইয়াই কও।

হামিদা তখন মাথায় ঘোমটা দিয়া বড়ঘরের কপাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পুরানা কাঠের কপাটের দুইখানের একখান পুরাপুরি আবজানো (ভিড়িয়ে রাখা), আরেকখানের অর্ধেকটা খুলে বাকি অর্ধেকটার আড়ালে দাঁড়িয়েছে সে। দবির আড়চোখে একবার হামিদাকে দেখল। তার চোখ অনুসরণ করল বসিরের চোখ। তবে সে যাকে দেখতে চাইল তাকে দেখতে পেল না। বাড়িতে ঘটক এলে বাড়ির বিয়ার উপযুক্ত মেয়ে কান্দিপাড়ার শেফালির কায়দায় ঘরের দরজায় শরীর অর্ধেক লুকিয়ে দাঁড়ায়। কোনও কোনও বাড়িতে মা-চাচিরাও দাঁড়ায় আর তাদের আড়ালে দাঁড়ায় মেয়ে।

এই বাড়িতে মেয়ের মা দাঁড়িয়েছে, মেয়ে দাঁড়ায়নি। কোথায় সে? বাড়িতে নাই নাকি?

বসির ঘটকের খুবই ইচ্ছা হল নূরজাহানকে একটু দেখে। মেয়েটাকে দুয়েকবার দেখেছে তয় চেহারা মনে নাই। তার কীর্তিকাহিনি সবই শুনেছে সে। দেশগ্রামের শয়ে শয়ে মানুষের সামনে মেয়ে মান্নান মাওলানার মুখে থুতু ছিটিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে মেয়েটাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না দবির আর তার পরিবার। গ্রামের ময়মুরব্বির হাতেপায়ে ধরে মান্নান মাওলানাকে ঠান্ডা করেছে, তার হাত থেকে বাঁচিয়েছে মেয়েকে।

এই বাঁচানোর কথাটা মনে করে ভিতরে ভিতরে খুব একচোট হাসল বসির। মান্নান মাওলানার হাত থিকা বাঁচবো নূরজাহান, কয় কী! মান্নান মাওলানা অইলো জাইত সাপের জাত। জাইত সাপরে দুক্কু (ব্যথা দেয়া অর্থে) দিলে, বেশি মানুষজনের আওয়াজ পাইলে জাইত সাপ তহনকার লাহান ফণা তোলা মাথা নামাইয়া কোনওমিহি যায় গা। যে তারে দুক্কু দিছে তার বাড়ি চিন্না রাখে, ঘর চিন্না রাখে। রাইত্রে আইসা ঢোকে হেই বাড়িতে। যে তারে দুকু দিছে তারে বিচড়াইয়া বাইর করে। তারবাদে ফোঁস কইরা মাথা তুইল্লা খালি একহান ঠোকর দেয়। ওই এক ঠোকরে কারবার শেষ। বিয়ানবেলা বাড়ির মাইনষে উইট্টা দেহে তাগো বাড়ির একজন মানুষ বিচনার মইদ্যে মইরা সিদা অইয়া রইছে। শইলখান সাপের বিষে কালীবন্ন। কী সাপে দংশিল লখাই রে…

নূরজাহানকেও জাত সাপের কায়দায়ই দংশাবে মান্নান মাওলানা। সেই পথ তৈরির জন্যই ধরেছে ল্যাংড়া বসিরকে। বসির ঘটক মানুষ। কোন সাপে কোন ব্যাং খেল ওই নিয়া তার কোনও মাথাব্যথা নাই। তার একমাত্র মাথাব্যথা ঘটকালি। কাজ সারতে পারলেই টাকা। এই কাজ সারতে পারলে দশ দশটি হাজার টাকা দিবেন মান্নান মাওলানা। একত্রে তিনটা কাজ দিয়েছিলেন। দুই ছেলে আর তার নিজের বিয়া। এক ছেলের বিয়া আটকে গেছে। ওই যে আজাহার, জাপানে থাকে। সে এখন বিয়া করবে না। তার অসুবিধা আছে। কী অসুবিধা সেটাও পরে একদিন বসিরকে হুজুর ডেকে বলেছেন। এখন কাজ হল দুইখান। আতাহারের বিয়া, হুজুরের বিয়া। দুইখান বিয়াই ভেজাইলা। আতাহারের লগে ভাবভালবাসা তার ভাবির। তিনখান পোলাপান সেই ভাবির। দেশগ্রামের বেবাক মাইনষেই জানে পোলাপান তিনডা আতাহারের। মোতাহার বাঁইচা থাকতেই ভাবির লগে কারবারখান আতাহার শুরু করছিল। ভাই জানত সবই। নিজের পুরুষত্ব নাই, বউর দেহ আগুনের লাহান। সেই আগুনের তাপ সামলাইতো আতাহার। এই দুঃখেই গ্যাসটিকের (গ্যাসট্রিক) অসুখ অইলো। পেট ফুইল্লা মইরা গেল।

তয় জুয়ান পোলাপানগো এই হগল কারবার থাকেই। কেউ বাড়ির বাইরে করে, কেউ করে বাড়ির ভিতরে। আতাহার নাইলে বাড়ির ভিতরেই করছে। এই হগলে বিয়া আটকাইবো না। মাইয়া একখান প্রায় ঠিক করে ফেলেছে বসির। বেলতলির মাইয়া। বিয়াটা মনে অয়। অইয়া যাইবো আতাহারের। সমস্যা দেখা দিব হুজুররে লইয়া। নূরজাহানের লগে তার বিয়াটা, কামটা একটু য্যান কঠিনই লাগে বসিরের। তারপরও চেষ্টা সে করবে। তার স্বভাব হচ্ছে কাউদ্ভার (কচ্ছপ) মতন। একবার কামড় দিয়া কোনও কিছু ধরলে সহজে ছাড়তে চায় না। নূরজাহানের ব্যাপারে কামড়টা সে আজ দিতে আসছে। দেখা যাক কী হয়!

বসির আবার তার হে হে হাসিটা হাসল। হারাদিন বাইত্তে বইয়া বইয়া করেন কী গাছিদাদা? হে হে। বাড়িত থিকা বাইর বুইর অন না?

তেমুন অই না। কাম কাইজ কিছু নাই। পশশুদিন ইট্টু মাওয়ার বাজারে গেছিলাম। কও বছির, কামের কথা কও।

এহেনে কইতে চাই না দাদা।

তয় কই কইবা?

লন বাজারমিহি যাই। সেন্টুর দোকানে বইয়া চা খাইতে খাইতে কমু নে।

বাজারে যাওনের কাম কী? তোমার ভাবিছাবে চা বানাইয়া দেউক, বাইত্তে বইয়াই। খাও।

আরে না, এই অবেলায় ভাবিছাবরে কষ্ট দিয়া লাভ নাই। আর বাইত্তে বানাইন্না চা খাইতে আমার ভালও লাগে না। বাজারে গিয়া আরাম কইরা বহি, চা’র লগে দুইডা কইরা রসোগোল্লাও খাইলাম। তারবাদে চা সিকরেট খাইতে খাইতে…

দবির চিন্তিত গলায় বলল, তয় আমি আবার বাজার থিকা আমুনে কেমতে? আমার কোষানাও লইয়া লমু?

ওই দেহো দাদায় কয় কী? আরে আপনেরে লইয়া যাইতাছি আমি, আপনেরে ফিরত দিয়া যাওনের দায়িত্বও আমার। আপনে খালি লন।

দবিরের মনে তখন শুধু একটাই ভাবনা। কী এমুন কথা কইতে চায় বছির যেই কথা চা মিষ্টি খাইতে খাইতে কওন লাগে? ভাল খবরের লগে মিষ্টির একখান সমন্দ আছে। ঘটকের মুখে ভাল খবর অইলো বাড়িতে ডাঙ্গর পোলা থাকলে হেই পোলার লেইগা পছন্দসই মাইয়া, আর ডাঙ্গর মাইয়া থাকলে তার লেইগা পছন্দসই পোলা। তয় কি নূরজাহানের লেইগা কোনও পছন্দসই পোলা পাইছে বছির? হেই কথা কওনের লেইগাই তারে বাজারে লইয়া যাইতে চাইতাছে, চা-মিষ্টি খাওয়াতে চাইতাছে?

ভিতরে ভিতরে ভাল রকমের একটা অস্থিরতা শুরু হল দবিরের, ভাল রকমের একটা ছটফটানি। নূরজাহানের লেইগা কোন গ্রামের পোলার সমন্দ লইয়াইছে বছির? পোলার জাতবংশ কী? করে কী পোলা? চাকরিবাকরি না কায়কারবার? নাকি গিরস্তি করে?

একমনে এইসব কথা, আরেক মনে দবিরের মনে হয়, হায় হায় মাইয়াডা তো ডাঙ্গর অইয়া গেছে? মাইয়াডার তো বিয়ার বস (বয়স) অইয়া গেছে। বিয়া অইয়া গেলে মাইয়াডা জামাইবাড়ি যাইবো গা। বাড়িডা খালি অইয়া যাইবো। বাড়িতে তহন আমরা দুইজন। আমি আর নূরজাহানের মা’য়। হায় হায়, নূরজাহান যেই বাইত্তে নাই হেই বাইত্তে আমি থাকুম কেমতে? খেতখোলার কাম কইরা, বাজারহাট কইরা বাইত্তে আইয়া যে মাইয়াডারে ডাক দেই, কো রে, নূরজাহান? কই মা? এই ডাকহান তহন আমি কারে দিমু? শীতের দিনে পয়লা যেদিন রস পড়ে হেই রস আমি বেচি না। বাইত্তে লইয়াহি। পয়লা গেলাস রস মাইয়াডারে খাওয়াই। বিয়া অইয়া গেলে, জামাইবাড়ি চইলা গেলে আর বছরের শীতের দিনে পয়লা রস আমি কারে খাওয়ামু?

এসব কথা ভেবে আনমনা হয়েছে দবির, ব্যাপারটা খেয়াল করল বসির। হে হে, কী চিন্তা করেন গাছিদাদা?

দবির যেন বাস্তবে ফিরল। না না কিছু চিন্তা করি না।

তয় লন যাই।

হ হ লও। তুমি নাওয়ে গিয়া বহো আমি পিরনডা গায়দা (গায়ে দিয়ে) আহি।

আইচ্ছা আইচ্ছা।

পা টেনে টেনে বসির গেল কোষানাওয়ের দিকে আর দবির এসে ঢুকল ঘরে।

কপাটের আড়ালে দাঁড়ানো হামিদার তখন আর তর সইছে না। হরতরাইস্যা (অতিঅস্থির) গলায় বলল, ঘটকায় আইছে ক্যা? সমবাদ (খবর) কী?

দবির আড়চোখে চৌকির দিকে তাকাল। জানালার ধারে কখন শুয়ে পড়েছে নূরজাহান কে জানে। শাড়ির আঁচলে মুখ এমন করে ঢেকে রেখেছে, দেখে বোঝার উপায় নাই জেগে আছে না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে থাকলে ঠিক আছে, জেগে থাকলে ঠিক নেই। যত নিচা গলায়ই কথা বলুক, দবির-হামিদার সব কথাই তার কানে যাবে। মেয়ের বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আসছে ঘটক, কী বিষয় কী বিত্তান্ত কিছুই পরিষ্কার জানে না দবির, আন্দাজ অনুমানে বুঝতে পারছে। সেই আন্দাজ অনুমানটা সে বলতে চায় না। আগে বসির ঘটক সব খুলে বলুক, সব শুনুক দবির তারপর হামিদাকে বলবে।

ঘরের কোণে দড়িতে ঝুলছে দবিরের নীল ঝুলপকেটআলা শার্টটা। সেই শার্ট টেনে গায়ে দিতে দিতে বলল, ঘটকায় যে কীর লেইগা আইছে কিছুই বুজতাছি না। কইলো কথার কাম আছে। বাইত্তে বইয়া কথা কইতে চায় না। কয় লন দাদা, আমার লগে বাজারে লন। চা-মিষ্টি খাইতে খাইতে কমু নে। যাই, হুইন্নাহি (শুনে আসি) কী কয়। বাইত্তে আইয়া তোমারে কমু নে।

মনে লয়…

হামিদার কথা শেষ করতে দিল না দবির। চোখ ইশারায় নূরজাহানকে দেখাল। অহন প্যাচাইল পাইড়ো না। আগে ঘটকার কথা হুইন্নাহি।

দবিরের ইশারা বুঝল হামিদা। বলল, আইচ্ছা যাও যাও। আমগো নাও লইয়া যাইতাছো না?

না। বছিরের নাওয়েই যাইতাছি। ও ঐ আবার বাইত্তে দিয়া যাইবো।

আইচ্ছা আইচ্ছা।

ঘর থেকে বের হয়ে দবির যখন ল্যাংড়া বসিরের কোষানাওয়ে চড়ছে তখন হঠাৎ করেই অদ্ভুত একটুখানি রোদ উঠেছে। বিকাল হয়ে আসা রোদের রংটা আশ্চর্য সুন্দর। ভরা বর্ষার পানিতে পড়েছে সেই রোদ, গাছপালা আর গিরস্ত বাড়ির উঠান পালানে। পড়েছে। শ্রাবণ মাসের মেঘলা আকাশের তলায় মন খারাপ করে পড়ে থাকা মেদিনীমণ্ডল গ্রামখানি যেন হঠাৎ করেই হেসে উঠেছে। এই আলোয় দবিরের মনে হল নূরজাহানের জন্য নিশ্চয় পছন্দসই কোনও সমন্দ নিয়া আসছে বসির। তার মন অচেনা এক আনন্দে ভরে গেল।

.

নূরজাহান জেগেই ছিল।

শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়েছিল ঠিকই, ঘুমায় নাই। অন্যান্য দিন এভাবে শুয়ে পড়ার পর ঘুমে কাদা হয়ে যেতে সময় লাগে না। আজ সেই সাধের ঘুম এলই না। বসির ঘটকের কোষানাও নিজেদের বাড়ির দিকে আসতে দেখেই মনের ভিতরটা এলোমেলো হয়ে গেছে। যে বাড়িতে ডাঙ্গর মেয়ে আছে সেই বাড়িতে মতলব নিয়াই আসে ঘটক। কথায় কথায় মেয়ের খোঁজখবর নেওয়া। বয়স কত হল, এখনই বিয়াশাদির চিন্তা ভাবনা আছে কি না গিরস্তের, সমন্দ আনলে কীরকম আনতে হবে, ময়মুরব্বির লগে এসব আলোচনাই করে বাড়ির উঠানে বসে। পান তামাক খায় আর আড়চোখে এদিক ওদিক চায়, মেয়েটাকে যদি একপলক দেখা যায়। মেয়ে কালো না ফরসা, নাকি শ্যামবর্ণ! উঁচা লাম্বা কেমুন? বেশি উঁচা। লাম্বা অইলে জামাইও তো লাগবো ওই পদের!

এসব ভেবে অদ্ভুত এক লজ্জায় কুঁকড়ে গেল নূরজাহান। যেন নিজের মুখের দিকে তাকাতে পারবে না সে। নিজের হাত পা শরীরের দিকে তাকাতে পারবে না। চোখ তুলে অন্য মানুষের দিকে তাকানো তো দূরের কথা আপনা মা-বাপের মুখের দিকেই তাকাতে পারবে না। এই অবস্থায় বসির ঘটককে যদি ঘরে এনে বসায় বাবায়, তা হলে? বাড়িতে তো বসার মতন ঘর একটাই!

নূরজাহান তারপর আর কিছুই ভাবে নাই। যেখানে বসে ছিল সেখানেই শুয়ে পড়েছে। শুয়ে এমনভাবে ঢেকেছে মুখ, কিছুতেই বোঝার উপায় নাই জেগে আছে না ঘুমিয়ে গেছে।

এই অবস্থায় দবির হামিদার টুকটাক কথাবার্তা সে শুনেছে। শুনে বুঝতে পারে নাই কিছুই। মায়ের অস্থিরতা আর বাবার কথা চেপে যাওয়ার কায়দাটা সে ধরে ফেলেছে। তারপর প্রায় দমবন্ধ করে পড়েছিল। কানখাড়া করে রেখেছিল কখন ঘর থেকে বের হয়। বাবা, কখন গিয়া ওঠে বসির ঘটকের নৌকায় আর কখন বর্ষার পানিতে পড়ে বইঠার চাব (চাড়ি, বইঠা বাওয়া), কখন বাড়ির ঘাট থেকে নৌকা মেলা দেয় চকপাথালে।

সব মিলিয়ে অতি সামান্য সময়। তবু নূরজাহানের মনে হল সময়টা যেন শেষই হচ্ছে। দড়ি থেকে নীল পিরান টেনে নিয়া গায়ে দিতেই যেন অনেকটা সময় নিচ্ছে বাবা। মা’র কথা যেন শেষই হচ্ছে না। পিরান গায়ে দিয়া ঘর থেকে বের হয়ে ওইটুকু উঠান পার হয়ে বসির ঘটকের নাওয়ে গিয়া চড়তে যেন এক-দেড়ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে বাবার। নৌকা ছাড়তেই বা এত দেরি করছে কেন ওই ম্যাড়া (রোগা, দুর্বল) কামলাটা!

বইঠার শব্দ যখন দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, মুখ থেকে শাড়ির আঁচল সরাল নূরজাহান। উঠে বসল।

এই এতক্ষণে একটু সুস্থির হয়ে বসেছে হামিদা। দরজার সামনে আমকাঠের পুরানা পিড়ি পেতে কপাটে ঢেলান (হেলান) দিয়া বসছে। মুখে কোন ফাঁকে দিয়েছে এক টুকরা পান। এখন পান চাবাতে চাবাতে বাইরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে গেছে।

মা’কে কয়েক পলক দেখল নূরজাহান। আচমকা বলল, কে আইছিল মা?

মেয়ের কথায় পলক চমকাল হামিদা। চিন্তিতভাব কেটে গেল। তুই দেহচ নাই কে আইছিলো?

নূরজাহান অবাক হওয়ার ভান করল। আমি কেমতে দেহুম? আমি না ঘুমাইতাছিলাম!

হামিদা ভুরু কুঁচকাল। তয় বুজলি কেমতে বাইত্তে কেঐ আইছিলো?

শুরুতেই কি চালাকিটা ধরা পড়ে যাবে নূরজাহানের?

এত্ত সোজা না!

মুখের অতিসরল একখান ভঙ্গিমা করল নূরজাহান। বাড়ির ঘাডে মনে অইলোনাওয়ের আওজ (শব্দ) পাইলাম। বাবার লগে কে জানি কথা কইলো? তোমার গলার আওজও পাইলাম।

ঘুমে থাকলে এই হগল আওজ পাইলি কেমতে?

ঘুমের মইদ্যেই পাইছি। তুমি জানো না আমার ঘুম পাতলা?

না তর ঘুম পাতলা না। একবার ঘুমাইয়া পড়লে লাডিদা (লাঠি দিয়ে) পিডাইলেও তুই উটতে চাচ না।

কে কইছে তোমারে?

কে আবার কইবো? আমিই কইতাছি। আমার পেডের মাইয়া আমি চিনি না?

নূরজাহান সরল মুখ করে হাসল। না মা। আমার ঘুম সত্যই পাতলা। আমি নাওয়ের আওজ পাইছি, কোন এক বেডার গলার আওজ পাইলাম। তুমি আর বাবায় কথা কইতাছিলা…

নূরজাহানের কথা শেষ হওয়ার আগেই হামিদা বলল, তুই হুইছস কুনসুম (শুয়েছিস কখন)?

নূরজাহান বুঝে গেল অন্যদিক দিয়া মা তাকে আটকাবার চেষ্টা করছে। সেই দিকটাও বন্ধ করল সে। ওইত্তো, তুমি যহন থালবাসন ধুইতে গেলা। বাবায় গেল তামুক খাইতে।

এবার হামিদার সন্দেহ কিছুটা কমল। হ্যাচাঐ?

তয় মিছানি? ঘুম লইয়া মিছাকথা কমু ক্যা?

হামিদা আবার একটু চিন্তিত হল। দরজা দিয়া তাকালে চোখ প্রথমেই যায় বাঁশঝাড়টার ওদিকে। বাঁশঝাড়ের মাথার উপর এসে পড়েছে বিকালের একটুখানি রোদ। সেই রোদে ঝিরঝির করছে বাঁশপাতা। মুখের পান এতক্ষণে একেবারে ছোবড়া হয়ে গেছে। সেই ছোবড়া একগাল থেকে আরেক গালে আনল হামিদা। ঘটকায় আইছিল।

কোন ঘটকায়?

ওইত্তো, ওই ল্যাংড়া। বছির।

ক্যা, সেয় আইছে ক্যা?

হেইডা আমি কেমতে কমু?

তুমি না বাবার লগে কথা কইলা?

হ কইছি। তয় ঘটকার কথা তর বাপে কিছু কয় নাই। ঘটকায়ও মনে অয় তারে কিছু কয় নাই।

কিছু না কইলে বাবায় তার লগে গেলো ক্যা?

হামিদা আবার ভুরু কুঁচকাল। তর বাপে যে তার লগে গেছে হেইডা বুঝলি কেমতে?

ইস মা! তুমি এত বলদা? কইলাম না তোমার আর বাবার বেক (বেবাক) কথা আমি হুনছি।

তয় তো তুই আগে থিকাই জানচ বাইত্তে কে আইছিলো। তর বাপে আমার লগে ঘটকার প্যাচাইলঐত্তো পারতাছিলো!

এবার নূরজাহান হাসল। না না, তুমি বলদা না। তুমি বহুত চালাক। আমার চালাকি ঠিকঐ বুইঝা হালাইছো। বাইত্তে যে বছির ঘটকায় আইছিলো এইডা আমি তোমগো আগে। থিকাঐ জানি।

এবার হামিদা যেন বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল। আমগো আগে থিকা জানচ?

হ।

কেমতে? ঘটকায় কি তরে জানাইয়াঐ এই বাইত্তে আইছেনি?

বলদার লাহান কথা কইয়ো না। হেয় আমারে কেমতে জানাইবো? আমি কি বাইত থনে বাইর অইনি?

তয়?

আরে হোওনের আগে কইফফার ছাড়ার (কফিলউদ্দিন নামের একলোকের ছেড়ে যাওয়া বাড়ি) ওইমিহি থিকা ঘটকার নাও আমি আমগো বাড়ি মিহি আইতে দেকছি। ওইডা দেইক্কাঐ মুখ ঢাইক্কা হুইয়া পড়ছি। ঘুম আমার আহেই নাই। তোমার আর বাবার বেক কথাই আমি হুনছি।

নূরজাহান আবার হাসল।

তার হাসি দেখে রেগে গেল হামিদা। ওই মাগি, ভেটকাবি (হাসি) না। তোর ভেটকান দেকলে আমার শইল জ্বলে। তুই বহুত টেটনি অইছস। বহুত পাকা পাকছস তুই। ঘটকায় বাইত আইছে হেই লইয়া এতপদের প্যাচাইল পাড়লি।

মায়ের এইসব বকা গায়ে লাগে না নূরজাহানের। সে আগের মতোই হাসিমুখে বলল, তোমার লগে বারোপদের প্যাচাইল পাড়তে আমার বহুত আমোদ লাগে।

ঠোকনা দিয়া আমোদ ছুড়াইয়া দিমু। এই হগল আমোদ করিচ জামাইবাইত্তে গিয়া।

নূরজাহান গম্ভীর হল। ঘটকায় কি বিয়ার সমন্দ লইয়া আইছিলো?

তুই বলে বেক কথা হোনছস? তয় জানচ না সমন্দ লইয়া আইছে না কী লইয়া আইছে?

বাবায় তো তোমার লগে সমন্দর প্যাচাইল পাড়ে নাই।

হ পারে নাইঐত্তো।

তয় আমি বুজুম কেমতে?

তর বোজনের কাম নাই।

ক্যা কাম থাকবো না? আমার সমন্দের কথা আমি বুজুম না?

চৌকি থেকে নামল নূরজাহান। হামিদার সামনে এসে দাঁড়াল। তোমারে একখান কথা জিগাই মা?

মেয়ের মুখের দিকে তাকাল না হামিদা। উঠানের দিকে তাকিয়ে বলল, কী?

ঘটকায় যুদি আমার লেইগা কোনও সমন্দ আনে তয় তোমরা কী করবা?

কী করুম আবার?

বিয়া দিয়া হালাইবা আমারে?

সমন্দ যুদি ভাল অয় তয় দিমু।

এত ছোড বসে বিয়া দিবা আমারে?

কীয়ের ছোড বস? বিয়ার বস অইয়া গেছে তর। আগিলা দিনে তর থিকা কত ছোড মাইয়ার বিয়া অইতো।

তোমার বিয়া অইছিল কোন বস্‌সে?

তর সমান বসেই। দুয়েক বচ্ছরের ছোডও অইতে পারি।

মিছাকথা কইয়ো না।

কীয়ের মিছাকথা?

অহন বস কত তোমার?

তিরিশ-পঁইতিরিশ অইবো।

বিয়ার কয় বচ্ছর বাদে আমি অইছি?

বিয়ার পরের বচ্ছরঐ।

তয়?

তয় কী?

তয় তুমি আমার থিকা ছোড আছিলা কেমতে? আমার অহন চৌদ্দ-পোনরো বচ্ছর বস। তোমার যুদি পঁইতিরিশ অয়, তয় তোমার বিয়া অইছে উনিশ-কুড়ি বচ্ছরে। একইশ নাইলে বাইশ বচ্ছর বসে আমি অইছি। যহন আমি হইছি তহন তুমি আমার এই বসূসের থিকা সাত-আষ্ট বচ্ছরের বড়।

হামিদা ততক্ষণে মোলায়েম হয়ে গেছে। মেয়ের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, কী জানি! অইতে পারে।

তয় নিজে বিয়া বইছো আসল বসে আর মাইয়াডারে এমুন পোলাপাইন্না বসে বিয়া দিতে চাইতাছো ক্যা?

এবার গলা একেবারে কোমল হয়ে গেল হামিদার। অপলক চোখে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। হাসিমাখা মায়াবী গলায় বলল, আমি তরে বিয়া দিতে চাইতাছি এইডা তরে কে কইলো?

কেঐ কয় নাই।

তয়?

তোমার কথার ভাবে বোজলাম।

এবার হাসল হামিদা। তরে যত তাড়াতাড়ি বিয়া দিতে পারি তত তাড়াতাড়ি আমরা জানে বাঁচি।

নূরজাহান মুখ ঝামটাল। ক্যা, আমি তোমগো কোন পাকা ধানে মই দিছি?

পাকা ধানে নাই দেচ মই, তয় যেইডা করছস ওইডা পাকা ধানে মই দেওনের থিকা বহুত বেশি।

কোনডার কথা কও?

ভুইল্লা গেছস?

নূরজাহান গম্ভীর হল। বুজছি তো, ঐ একখান কথাই কইবা। হুজুরের মোকে ছ্যাপ দিছিলাম।

হ ওই একখান ঐত্তো দশখানের সমান। দশখান কীয়ের, একশোখানের সমান। তরে যে আজরাইলডার হাত থিকা বাঁচাইয়া আনতে পারছি এইডা আমগো সাত কপালের ভাগ্যি। তুই তো গেছিলি। আজরাইলডায় তো তরে খাইয়া হালাইতো।

ঘটনাটা মনে হলে এখনও নূরজাহানের বুক কাপে। কেমন করে ওরকম একখানা কাজ করতে পেরেছিল সে? কোথা থেকে আসছিল তার ওই সাহস? কাজটা করবার আগে একবারও ভয়ে কেন বুক কাঁপে নাই তার? একবারও কেন ভাবে নাই তারপর কী হতে পারে? ইস মরনি আম্মায় যে কী বাঁচানটা বাঁচায়াছিল তারে!

.

চকের দিক থেকে বিশাল উঁচু দেখায় সড়ক।

একপাশ থেকে অন্যপাশের বাড়িঘর উঠান পালান কিছু দেখা যায় না। বাড়ির উঁচু গাছপালার মাথার দিকটা দেখা যায়। বিকালবেলার ওই একটুখানি রোদ কোনও কোনও গিরস্তবাড়ির গাছপালার মাথায় লেগে চকচক করছে।

বইঠা ছেড়ে অনেক আগেই লগি ধরেছে ফইজু। চকে ধান নাই। এখন তো দেশগ্রামে ইরি ছাড়া আর কিছু চাষ হয় না। ইরি উঠে যায় বর্ষার আগে আগে। ফলে চকমাঠ থাকার কথা ফকফকা, তয় ফকফকা চক এদিকটায় নাই। গিরস্তলোক বাড়ির লগের জমিতে ধইনচা (ধনচে) বুইনা দিছে। কেউ কেউ দিছে কাইশশা (কাঁশ) বুইনা। ধইনচা কাইশশার ফাঁকফোকর দিয়া বইঠা বাওয়া যায় না। এজন্যই লগি নিয়েছে ফইজু। মুখোন তার সেই আগের মতনই নিরস আর অন্ধকার। মেদিনীমণ্ডলের বিশাল চকে খেলা করছে দিনশেষের রোদ। সেই রোদে মুখের অন্ধকার কাটে নাই ফইজুর। দুপুরের ভাত না খাওয়া পেটে দমকা হাওয়ায় বর্ষাচকের পানি যেমন উথাল পাথাল করে ফইজুর পেটের ভিতরটা এখন তেমন করছে। তবু নাওখান সে বাইয়া যায়। লগির ঠেলায় ঠেলায় মালেক দরবেশের বাড়ির দিকে আগায়।

নীল পিরান পরা দবির বসে আছে আগার দিককার চারোটে (নৌকার মাথার দিককার পাদানি কিংবা বসার জায়গা)। তার মুখামুখি ল্যাংড়া পা ভাজ করে বসেছে বসির। মাথার উপর মেলা আছে ছাতি। ঘটকালির কাজে আদব লেহাজের আকাল নাই বসিরের। নৌকায়। উঠে প্রথমেই ছাতিটা মেলে ধরেছিল দবিরের মাথায়। দবির হাত তুলে না করেছে। আমার ছাতি লাগবো না। বিয়ালের রইদ শইল্লে মাথায় লাগে না।

বসির হে হে করে হেসেছে। আমার লাগে গাছিদাদা। ঘটকালির কামে মাথাডা রাখতে অয় গাঙ্গের পানির লাহান ঠান্ডা। এর লেইগা মুলাম (মোলায়েম) রইদ্রেও ছাতিডা আমি মাথায় দেই। মাথার চুল অইলো আমার আগন (অগ্রহায়ণ) মাসের দুবলার (দূর্বাঘাস) লাহান। চপচপা তেল দিয়াও কাকই চালাইতে পারি না।

দবির একপলক বসিরের মাথার দিকে তাকিয়েছিল। হ তোমার চুল বিরাট ঘন। এইরকম ঘনচুলের মাথা গরম অয় বেশি।

হে হে, এর লেইগাইত্তো আমি মাথায় দুইবেলা সউষ্যার তেল দেই। মুলাম রইদ্রেও ছাতি মাথায় দেই। হে হে।

ততক্ষণে নিজের মাথার উপর ছাতি মেলে বেশ একখান ভাব ধরে ফেলেছে বসির। ফইজু বইঠা রেখে লগি হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে। বইঠাটা বসে বসে বাওয়া যায়, লগি বাইতে হয় দাঁড়িয়ে। ছোট লগি হলে কেউ কেউ বসে বসেও বায়। এদিককার চকে পানি বেশি। ছোট লগি ঠাই (তল) পায় না। ছোট লগিতে কাজ হয় না। বসে বাওয়াও যায় না।

দবির একবার ফইজুর দিকে তাকিয়েছিল। লোকটার ব্যাজার মুখ তার ভাল লাগে নাই। অন্যদিকে মনের ভিতর দবিরের ভারী একখান ছটফটানি। ঘটকা বছির কুনসুম (কখন)। কইবো তার মতলবের কথা? নূরজাহানের লেইগা কোন গেরামের পোলা দেখছে সে?

আগ বাড়িয়ে কথাটা দবির জিজ্ঞাসাও করতে পারে না। করলে বসির তাকে আদেখলা (অতিউৎসাহী) লোক ভাববে। হয়তো অন্য রকমের একটা সুযোগ নেওয়ারও চেষ্টা করবে। ঘটকারা অইতাছে মদি দোকানদারগো লাহান। পিঁপড়ার পাছায় চিমটি দিয়া মিঠাই রাইখা দেয়। দবিরের আদেখলামি দেইখা মনে করতে পারে, পাইছি শালারে। অহন মাইয়ার বিয়ার কথা লইয়া দুই-চাইরশো খাওন যাইবো। সেন্টুর দোকানের চা-মিষ্টির দামটা হয়তো দবিরের ঘাড়ের ওপর দিয়াই পার করবে।

না দবির ওই রাস্তায় যাবে না। মনের ভাব মনে চেপে কোষানাওয়ের চারোটে বসে রইল। এদিক দেখে, ওদিক দেখে আর ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করে এই বুঝি কথাটা ঘটকায় তোলে। বসির ওসবের ধার দিয়েই যায় না। সে কথা বলে তার মাথা নিয়া, ছাতি আর মাথার চুল নিয়া। গরম মাথা ঠান্ডা করবার জন্য সউষ্যার তেল দুইবেলা দেয় মাথায়, ওই নিয়া। সড়ক বাঁহাতে রেখে নৌকা আগাচ্ছে দেখে হঠাই বলল, বুজলেন গাছিদাদা, বিক্রমপুরের লেইগা কামের কামডা করলো খানসাবেঐ। আর কেঐ তেমুন কিছু করে নাই।

দবির আনমনা ছিল। বলল, কোন খানসাবে?

বসির যেন এইমাত্র বর্ষার পানিতে একটা চুব খেয়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ওই দেখো। গাছিদাদায় কয় কী? খানসাব কওনের পরও বোজেন নাই? আরে আমিনুল ইসলাম খানসাবের কথা কই।

এবার বুঝদারের মতন হাসল দবির। বুজছি, বুজছি।

ইসলাম সাব না অইলে বিক্রমপুরের উপরে দিয়া এই ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক অইতো না। আর এই সড়ক না অইলে বিক্রমপুরের কোনও উন্নতিও অইতো না।

হ এইডা সত্যকথা।

বিক্রমপুরে তো লিডার কম আছিলো না। শামজ্জেম সাব (শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন), কুরবান আলী সাব (কোরবান আলী)। তারও আগে আছিলো বি চদরী (বি চৌধুরী। বদরুদ্দোজা চৌধুরী) সাবের বাপ কফিলউদ্দিন চদরী। বি চদরী সাব নিজেও বিরাট লিডার। তয় বিক্রমপুরের লেইগা কামের কাম কেঐ করে নাই। করল খালি ইসলাম সাবে। এরশাদ সাবরে কইয়া সড়কটা সে মাওয়ার এইদিক দিয়া আনছে।

এই সড়ক অন্যদিকদা নেওনের কথা আছিলো নি?

না এই দিক দিয়াই নেওনের কথা আছিলো।

তয়?

তয় তো ঘটনা আপনেরে আগে থিকা কইতে হয় গাছিদাদা।

কও তো, হুনি। আমি তো হগল কথা জানি না। খালি দেখতাছি রাস্তা অয়, দেইখাই আমোদ পাই।

বসির হাসল। হে হে। আমোদ তো পাইবেনই। এইডা তো বিরাট আমোদের কথা। যেই দেশের মানুষ নাওদোন ছাড়া আর কিছু চোকে দেখে না, তারা অহন দেখবো বাস টেরাক আর পরাইভেট কার, রিশকা দেখবো, বেবিটেকি দেখবো। দিনে চাইরবার ফুরুত কইরা ঢাকা যাইবো, ফুরুত কইরা আইবো। তাগো লেইগা সড়কখান তো বিরাট আমোদের জিনিস। আরে এই সড়ক তো বহুত আগেঐ অওনের কথা আছিলো। সড়কের প্যালেন করছিলো শেকসাবে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। পাছাইততইর (পঁচাত্তর) সালে তারে মাইরা ফালানের পর জিয়াসাব (শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান) আইলো ক্ষমতায়। ক্ষমতায় আইসা সে কইলাম শেকসাবের প্যালেনটা বাতিল করলো না। রাইখা দিল। কামকাইজও মনে অয় তার আমলে একবার শুরু অইছিলো। জিয়াসাব একবার হেলিকাপটার লইয়া মেদিনমণ্ডল গেরামে আইছিলো না? আপনের মনে নাই হেই কথা?

দবির মাথা নাড়ল। আছে, আছে। খাইগোবাড়ির মাঠে মিটিং করছিলো জিয়াসাবে।

হ এইত্তো আপনের মনে আছে। তারপর তো তারেও মাইরা হালাইলো। তয় তার আগে আরেকখান কারবার অইছিলো। এই সড়কখান তখন বি চদরী সাবগো গেরাম দয়হাটা না মজিদপুর, ওইমিহি দিয়া নেওনের কথা অইছিলো। ওইমিহি দিয়া লৌহজং যাইবো।

কও কী?

আরে হ। হোনেন না ঘটনা। জিয়াসাবে শহিদ অইয়া যাওনের পর সড়কের কাম গেল থাইম্মা। তারবাদে ক্ষমতায় আইলো এরশাদ সাব। সেয় আইসা আবার শুরু করাইলো কাম। এরশাদ সাবের মিনিস্টার অইলো আমিনুল ইসলাম খানসাব। সেয় সড়কখান লইয়াইলো মাওয়া মিহি। বাপের বেড়া একখান। বিক্রমপুরের সব থিকা বড় কামডা কইরা দিছে।

হ অহন সড়কখান ভালয় ভালয় শেষ অইলেই অয়।

বসির অবাক। ওই দেখো গাছিদাদায় কয় কী? আরে ভালয় ভালয় শেষ অইবো কী? শেষ তো পেরায় অইয়াঐ গেছে।

কোনহানদা (কোনখান দিয়ে) হইয়া গেছে অহন দেহি কামকাইজ বন্ধ। মাওয়া তরি মাডি হালানের কামঐত্তো পুরাপুরি শেষ অয় নাই। কুমারবুগের পর থিকা রাস্তা নিচা। আরও বহুত মাডি হালান লাগবো।

আরে হেইডা তো লাগবোঐ। বইষ্যাকালে মাডিকাডার কাম করবো কেমতে? বইষ্যাকালডা শেষ অইতে খালি দেন না, দেইখেন নে মাডিকাডার কাম কারে কয়। পোনরো দিনের মইদ্যে মাওয়া ফেরিঘাট তরি রাস্তা এইরকম উঁচা হইয়া যাইবো।

তারপরও ম্যালা কাম বাকি থাকবো?

হ ওইডা থাকবো। পাকা করনের কাম বাকি থাকবো। এই বইষ্যাকালেও কলম (কইলাম, বললাম) হেই কাম পইড়া নাই। বুড়িগঙ্গার এই পাড় থিকা রাস্তা পাকা করনের কাম আরম্ব অইয়া গেছে।

আরে মিয়া ওইডা জানি। ছিন্নগর তরি আউগ্নাইয়াই গেছে রাস্তা। খরালিকালে আমগো এই মিহি রিশকামিশকাও আহে।

হে হে বইষ্যাকালেও আহে গাছিদাদা। কোলাপাড়ার ওইমিহি কয়দিন আগেও রিশকা দেখছি আমি। গেল শীতে ছিন্নগরের ওইমিহি এক রিশকাঅলার লাশ পাওয়া গেছিলো না? কারা জানি গলায় ফাঁস দিয়া মারছে বেডারে। মাইরা খালপারে হালায় দিছে।

হ ওই ঘটনা হুনছি। তয় কারা মারছে বেড়ারে হেইডা জানতে পারে নাই দারোগা পুলিশে?

না দাদা, পারে নাই।

কথার ফাঁকে কখন যে বুকপকেট থেকে রমনা সিগ্রেট বের করে ধরিয়েছে বসির, দবির খেয়াল করে নাই। এখন হঠাৎই যেন খেয়াল করল বসির ফুকফুক করে সিগ্রেটে টান দিচ্ছে, নাকমুখ দিয়া গলগল করে বের হচ্ছে ধুমা। সেই ধুমা মিশে যাচ্ছে শ্রাবণ মাসের বিকালবেলার হাওয়ায়।

তবে বসির একলা একলা সিগ্রেট টানছে দেখে মনের খুব ভিতরে একটা খটকা লাগল দবিরের। এত খাতির করে যে বসির তাকে বাড়ি থেকে নিয়া আসলো, সেন্টুর দোকানে বসে চা-মিষ্টি খেতে খেতে কাজের কথাটা বলবে, নৌকা ঘুরিয়ে দবিরকে আবার বাড়িও পৌঁছে দিয়া যাবে, সেই মানুষটা সিগ্রেট ধরাবার আগে তাকে একবার বলল না, খাইবেন নি গাছিদাদা একশলা?

দবিরের মনের কথাটা যেন শুনতে পেল বসির। খুবই লাজুক মুখ করে দবিরের দিকে তাকাল। একখান ভুল কইরা হালাইছি দাদা। হে হে।

দবির তাকিয়েছিল মালেক দরবেশের বাড়ির ওদিককার গাছপালার দিকে। বসিরের কথায় তার দিকে চোখ ফিরাল। কীয়ের ভুল?

আপনে বোজেন নাই?

না রে দাদা, বুজি নাই।

আপনে মানুষটা বহুত সোজাপদের। আরে আমি যে একলাঐ সিকরেট ধরাইলাম, আপনেরে যে হাদলাম না, এইডা আপনে খ্যাল করেন নাই?

দবির সরল মুখ করে হাসল। আগে করি নাই। তুমি কথা হপায় (মাত্র) কইছো, তার ইট্টু আগে করছি।

আমি আসলে কথার তালে আছিলাম, এর লেইগা ভুলডা অইছে। লন, অহন একশলা খান। না খাইলে বুজুম আপনে আমার উপরে রাগ করছেন।

আরে না রে দাদা, আমি ওইপদের মানুষ না। রাগারাগি ফাডাফাডি আমি কেঐর লগে করি না।

বুকপকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগ্রেট দবিরের দিকে বাড়িয়ে দিল বসির। নেন গাছিদাদা, নেন।

ইট্টু পরে খাইলেও অসুবিদা নাই। অহন খাইলে চা খাওনের পরও তো আরেকখান খাওন লাগবো।

ওই দেখো গাছিদাদায় কয় কী? আরে সিকরেটের কি আকাল পড়ছেনি? চা খাওনের পর একহান ক্যা, লাগলে তিনহান খাইবেন। লন লন, ধরান।

সিগ্রেটের লগে ম্যাচও বাড়িয়ে দিল বসির।

দবির সিগ্রেট নিয়া হাওয়া বাঁচিয়ে ধরাল। তারপর বড় করে টান দেওয়ার পর উদিস পেল খানিক আগের তুলনায় মনটা তার অনেক ভাল। বেশ একটা আমুদে ভাব খেলা করছে মনে। নূরজাহানের লেইগা সমন্দটা মনে অয় ভালই আনছে বছির।

সিগ্রেট অর্ধেকও খাওয়া হয় নাই দবিরের, মালেক দরবেশের বাড়ির লগের একচিলতা মাঠটার উত্তর পারে কোষানাওখান ভিড়াল ফইজু। আইয়া পড়ছি। নামেন।

দুইজন মানুষ নৌকা থেকে নামল।

বৃষ্টি কাদায় প্যাঁচপ্যাচা হয়ে আছে মাঠ। খানে খানে দুবলাঘাস লেপটা লেপটি হয়ে আছে গেরুয়া রঙের কাদায়। মাঠের পশ্চিমে অনেকখানি নেমে গেছে সূর্য। রোদের শেষ আভাটুকু লেগে আছে চারদিককার চকেমাঠে, ঘরবাড়িতে। এই আলোয় ছাতা মাথায় দেয় আহাম্মকে। বসির এতটা আহাম্মক না। নৌকা থেকে নামার আগেই ছাতি বুজিয়ে ডানদিককার আকাতলির (বগলের) নীচে নিয়েছে। এখন ল্যাংড়া পা টেনে টেনে, ওই তো, ওই যে সড়কপারে দেখা যায় মাওয়ার বাজারের দোকানপাট, ওইদিকটায় দবির গাছির পাশাপাশি হাঁটা দিয়েছে।

.

বাঁশঝাড় তলার ওদিকটায় দুইটা শালিক পাখি চরছে।

একটার পিছন পিছন ছুটছে আরেকটা। ওই শালিকটা চিনতে পারল নূরজাহান। আষাঢ় মাসের দিকে হঠাৎ করেই বড় আমগাছটার খোড়ল থেকে লাফিয়ে পড়েছিল নীচে। শালিক পাখি বাসা বেঁধেছিল খোড়লে। ছানা ফুটেছে ওই একটাই। মাটিতে পড়ে একটুখানি উড়ে যায় শালিকছানা, আবার নামে মাটিতে। ওড়ার চেয়ে লাফায় বেশি। আর পাখা দুইখান। ছড়ায়া দিয়া অবিরাম কাঁপায়, হলুদ ঠোঁটের ভিতর গোলাপি রঙের ঠোঁট ফাঁক করে মায়ের মুখের কাছে চি চি করে। খাওন দেও মা, খাওন দেও।

সেই ছানাটা কবে এত বড় হয়ে গেছে। এখন কোনটা মা কোনটা ছানা বোঝাই যায় না। দুটিতেই দিনের আলো নিভে আসার লগে লগে রাতের খাদ্য জোগাড়ে ব্যস্ত। একটা দইকুলি (দোয়েল) লাফাচ্ছিল অদূরে। নূরজাহানকে দেখে ফুরুৎ করে উড়ে গেল পুকুরের ওপারকার ডুমুর ঝোপে। একটা কাক অনেকক্ষণ ধরে কা কা করছে ছনের ঘরের চালে বসে। দিনের আলো একটু একটু করে ফুরাচ্ছে। এতক্ষুনে মনে অয় মাওয়ার বাজারে বইয়া চা-সিকরেট খাইতে খাইতে বাবার কাছে ঘটকায় আমার সমন্দের কথা কইয়া হালাইছে।

নূরজাহানের লেইগা কার লগে সমন্দ দেখতাছে ঘটকায়? কোন গেরামের পোলায় পছন্দ করলো নূরজাহানরে? এতডু মাইয়ারে পছন্দ করলো কোন পদের পোলায়?

বিয়ার কথা যতবার ভাবছে ততবারই গোপন এক লজ্জায় মুখ নিচা হয়ে যাচ্ছে। নূরজাহানের। যতক্ষণ ঘরে ছিল ততক্ষণ তাকাতে পারে নাই মায়ের দিকে, এখন যেন তাকাতে পারছে না শালিক পাখি আর গাছপালার দিকে। মা এখনও বসে আছে বড়ঘরের দুয়ারে। সেদিকটায় তাকাতেই পারছে না নূরজাহান। এইডা কেমুন কথা? বিয়ার সমন্দ আইছে না নাআইছে, খালি ঘটকায় আইছে বাইত্তে হেতেই দেহি শরমে মরতাছি আমি! যেদিন সত্যঐ বিয়া অইবো হেদিন কী করুম? বাসরঘরে জামাই যহন…

নূরজাহান যখন এসব ভাবছে বাঁশঝাড়ের ওদিককার ধইনচা খেতে তখন কীরকম টাবুর টুবুর একটা শব্দ। প্রথমে শব্দটা খেয়াল করে নাই সে, যখন আস্তে ধীরে বাড়ছে শব্দ, বাড়ির দিকে আসছে তখনই যেন খেয়াল করল। এমুন আওজ করে কীয়ে? গুইসাপে নি? না গুইসাপে তো এত জোরে আওজ করে না! ঘটনা কী?

বাঁশঝাড়ের দক্ষিণ দিকটায় গেছে নূরজাহান, দেখে ধইনচা খেতের ভিতর থেকে একটা কুকুর সাঁতরে আসছে। দেশগ্রামের কুকুর পরিষ্কার পানিতে সাঁতরালে এমন শব্দ হয় না। খেতখোলার ভিতর দিয়া সাঁতরে এলে শব্দটা হয়। ঘন ধইনচা খেতের ফাঁকফোকর দিয়া সাঁতরাবার সময় ধইনচার ডালপালা আর শিকড়বাকড়ে শরীর মাথা আর চার পা আটকে যাচ্ছিল বলেই টাবুর টুবুর শব্দ হচ্ছিল। নূরজাহান যখন ওদিকটায় গেছে ততক্ষণে ডাঙায় উঠে গেছে কুকুরটা। এখন পর পর দুইটা ঝাড়া দিয়া শরীর থেকে পানির শেষবিন্দু তরি খসায়া দিল। ধইনচা খেত আর গাছপালার আড়াল থেকে দিনশেষের এক টুকরা আলো এসে পড়েছে কুকুরটার গায়, তাতে খুব সুন্দর লাগছে। জীবটাকে। পাকা খাজুরের মতন রং গায়ের, চোখ দুইটা যেন গাঢ় কাজল টানা। মুখের কাছটা সাদা কালোয় মিশানো। লেজটা হলুদ সাদা। তলপেটটাও সাদা হলুদে মিশানেনা। কুকুরদা মরদা (মর্দা, পুরুষ)।

এই কুত্তা আমগো বাইত্তে আইলো কই থিকা?

কোন বাড়ির কুত্তা?

কুকুরটা যেন নূরজাহানের মনে মনে বলা কথা শুনতে পেল। তার পায়ের কাছে এসে লেজ নাড়াতে নাড়াতে দুইবার খেউ খেউ করল। বেশ একটা আদরের ভাব আছে চেহারায়। দেশগেরামের নেড়িকুত্তা। তয় একটু যেন ভাল জাতের, একটু যেন পরিষ্কার। দেখলে ঘিন্না লাগে না।

কুকুরটাকে কয়েক পলক দেখে উঠানের দিকে দৌড় দিল নূরজাহান। মা ওমা, তাড়াতাড়ি আহো। তাড়াতাড়ি।

দুয়ারে অলস ভঙ্গিতে বসে থাকা হামিদা মেয়ের ডাকে চমকাল। নিজের অজান্তেই যেন ঘর থেকে বের হয়ে এল। কী অইছে রে?

তারপরই কুকুরটাকে দেখতে পেল। নূরজাহানকে দৌড় দিতে দেখে কুকুরটাও দৌড় দিয়েছে তার পিছন পিছন। যেন কতদিনের পালা কুকুর। বাড়ির মানুষ যেদিকে যায় সেও যায় সেদিকে।

হায় হায় কুত্তা আইলো কই থিকা?

হেইডা তো আমিও কইতে পারি না। ধইনচা খেতের ভিতর দিয়া হাতড়াইয়া আইলো।

কোন বাড়ির কুত্তা?

আমি কেমতে কমু? কুত্তা আইছে দেইক্কাই তো তোমারে ডাক দিলাম।

কুকুরটা তখন দুইজন মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বেশ একটা ফুর্তির ভাব ধরে লেজ নাড়ছে। একবার নূরজাহানের পা শোকে, একবার শোকে হামিদার পা। ভাবটা এরকম যেন এই বাড়িতে সে নতুন না, যেন সে এই বাড়ির বহু পুরানা বাসিন্দা।

কুকুরটার ভাব দেখে মা-মেয়ে দুইজনেই অবাক। হামিদা ভুরু কুঁচকে নূরজাহানের দিকে তাকাল। কুত্তাডার কারবার দেখতাছস? দেইক্কা মনে অয় আমগো বাড়িরই কুত্তা। আমরাই য্যান পালি।

হ। এক্কেরে আপনা মাইনষের লাহান ভাব।

খেদায় দে, খেদায় দে। কুত্তা বিলাই পালনের ঝামেলা অনেক।

আমি পারুম না। তুমি খেদাও।

ক্যা, পারবি না ক্যা?

যুদি কামড় দেয়?

এই কুত্তায় কামড় দিবো না।

রান্নাচালার ওদিক থেকে একটা চলা (লাকড়ি) নিল হামিদা। চলা হাতে তেড়ে গেল কুকুরটার দিকে। এই যা যা। হুর হুর। হুরো। যা যা।

কুকুরটা প্রথমে বুঝতে পারে নাই, আচমকা তাড়া খেয়ে ভড়কে গেল। লেজ নামিয়ে বড়ঘরের চাইছের (পিছন) দিকে দৌড় দিল। হামিদাও কিছুদূর দৌড়ে গেল কুকুরটার লগে। একদিক দিয়া গিয়া অন্যদিক দিয়া ঘুইরা আবার উঠানে চলে এল কুকুরটা।

এরকম দুই-তিনবার। হামিদার তাড়া খেয়ে বড়ঘরের পশ্চিম দিক দিয়া ঘরের ছাইছে চলে যায় কুকুরটা, হামিদাও যায় পিছন পিছন। কুকুর পুবদিক দিয়া বের হয়ে আসে। হামিদা আবার আগের কায়দায় দৌড়ে যায়, কুকুর পশ্চিম দিক দিয়া ঢুকে পুবদিক দিয়া বের হয়ে আসে। ভাল রকমের একটা চরকিবাজি।

কুকুরের লগে মায়ের এই চরকিবাজি দেখে উঠানে দাঁড়িয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল নূরজাহান। মহা বিরক্ত হয়ে নূরজাহানকে একটা ধমক দিল হামিদা। ওই মাগি, ভ্যাটকাবি (হাসবি) না।

তারপরই হাতের চলা কুকুরটার দিকে ছুঁড়ে মারল। কুকুরের গায়ে সেটা লাগল না। ঘরের ছাইছে রাখা ভাঙাচোরা হাঁস মুরগির খোয়াড়টার তলার দিকে চলে গেল।

নূরজাহান হাসতে হাসতে বলল, অইছে মা। থোও তো। কুত্তাডা যহন যাইতে চায় না, থাউক আমগো বাইত্তে। বাইত্তে কুত্তা থাকলে হিয়াল খাডাস আহে না। তুমি ইচ্ছা করলে আবার হাঁস মুরগি পালতে পারবা।

নূরজাহানের কথা শুনে হামিদা ভুরু কুঁচকাল। কথা বলল না।

কুকুরটা তখন ছনের ঘরের ওদিকটায় গিয়া এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে, যেন হামিদা তাড়া করলেই ছুট দেবে। বড়ঘরের চারপাশে যেভাবে ঘুরপাক খেয়েছে ওই একই কায়দায় ছনের ঘরের চারদিকেও ঘুরপাক খাবে। হামিদার হাতে চলা নাই দেখে ভয়টা যেন একটু কমেছে তার। কাজলমাখা চোখ স্থির করে তাকিয়ে আছে মা-মেয়ের দিকে।

নূরজাহান বলল, ভাল জাতের কুত্তা মনে অইতাছে। মরদা কুত্তা। মাইগ্না (মাদি) অইলে বিয়ান বুয়ানের (বাচ্চা দেয়া অর্থে) ঝামেলা আছিলো। মরদা কুত্তার ঝামেলা নাই। এমুন দৌড়ানি দেওনের পরও যহন যাইতে চাইতাছে না, থাউক বাইত্তে।

হামিদা তখনও ভুরু দুইখানা আগের মতন কুঁচকে রেখেছে। এটা হচ্ছে তার কোনও কথা মনে ধরার লক্ষণ। ব্যাপারটা জানে নূরজাহান। সুতরাং মায়ের অবস্থা দেখে সে বুঝে গেল কুকুরটা বাড়িতে থাকলে তার এখন আর কোনও আপত্তি নাই।

ঠোঁটে চুকচুক শব্দ করে কুকুরটাকে তারপর ডাকল নূরজাহান। আয় তু তু তু। আয়, আয়।

এই ডাকের অর্থ বুঝল কুকুরটা। খানিক আগের ভয়ডর ভুলে বেশ একটা আমুদে ভঙ্গিতে নূরজাহানের দিকে আগায়া আসলো। লেজটা পুরপুর করে নড়ছে।

.

দুইন্নাইতে এত ভাল ভাল জিনিস দিয়ে আল্লায়, মাইনষের প্যাডে খিদাডা দিছে ক্যা? খিদার থিকা বদজিনিস আর কিছু নাই। এই জিনিসটা কীরলেইগা (কী জন্য) হান্দাইয়া দিছে প্যাডের ভিতরে? দুইন্নাইর কায়কারবার বেক চলতাছে খিদার লেইগা। চুরি ধারামি, শয়তানি বানরামি (বাঁদরামি) খুন ডাকাতি বেক কিছুর পিছে ওই হালার খিদা। আমি গরিব মানুষ ঠিকঐ, তয় জিন্দেগিতে চুরি ধাওরামি করি নাই। খিদার চোডে আমার দিহি অহন। চুরি করতে ইচ্ছা করতাছে! ওই যে মালেক দরবেশের বাড়ির শোসার (শসার) ঝকাডা দেহা যাইতাছে, আঁকার ফাঁক দিয়া ঝোলতাছে কইচ্চা কউচ্চা (সবুজ সবুজ) শোসা, খিদার চোডে আমার দিহি ইচ্ছা করতাছে ওইমিহি যাইতে! গিয়া দুই-তিনহান শোসা ছিড়া লইয়ামুনি? ওইপদের দুই-তিনহান শোসা খাইলে খিদার কারবার খতম। রাইত্রে ভাত পাই না পাই, অসুবিদা নাই। যামুনি ঝাঁকা মিহি?

কোষানাওয়ের আগার চারোটে বসে শসা ঝকার দিকে তাকিয়ে আছে ফইজু। বাড়ির পশ্চিম দিককার ভাঙনে বিশাল আঁকা। এতটা দূর থেকেও দেখা যায় কঁকার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে বিঘত পরিমাণ কচি কচি শসা। আঁকার তলায় স্থির হয়ে আছে বর্ষার পানি। শেষ বিকালের রোদ উঠে গেছে গিরস্তবাড়ির ঘরদুয়ারের চালে আর গাছপালার মাথার দিকে। আবছা মতন একটা ছায়া জমতে শুরু করেছে শসা আঁকার তলায়। বর্ষার পানি সেই ছায়ায়ই কালো হয়েছে।

তবে আকাশ বেশ পরিষ্কার।

মেঘের চিহ্নমাত্র নাই। প্রকৃতি একেবারেই ধোয়া পাকলা। গিরস্তবাড়ির লেপাপোছা উঠানের মতন তকতকা চারদিক। এই প্রকৃতি অবশ্য বদলে যেতে পারে পলকে। শ্রাবণ দিনের বিশ্বাস নাই। কোন ফাঁকে কোথা দিয়া আকাশের এককোণ থেকে আরেক কোণে উড়ে আসবে কাউয়ার (কাক) মতো মেঘ। হাসতে থাকা প্রকৃতি হঠাৎ করেই ম্লান করবে মুখ। তারপর কথা নাই বার্তা নাই, কুত্তা বিলাইয়ের মতন বৃষ্টি। চোখের পলকে কাদায় পানিতে প্যাঁচপ্যাচা পায়ের তলার মাটি। শেষ বিকালেই রাত্র হয়ে যাবে।

শসা ঝকার উপর দিয়া ফইজু একবার আকাশের দিকে তাকাল। এই একখান জিনিসের লাহান জিনিস দিছে আল্লায়। আশমান। কী সোন্দর জিনিসখান। দুইন্নাইয়ের মাথার উপরে নীল আর সাদা রঙ্গের চাল। কোনও বেড়াবোড়া নাই, খালি চাল। আর একখান ভাল জিনিস অইলো হাওয়া বাতাস। এই যে শাওন মাসের বিয়ালে পদ্মার ওইমিহি থিকা ঝিরঝির কইরা আইতাছে খল্লামাছের মাথার লাহান মুলাম একহান বাতাস, বাতাসটার কোনও তুলনা দুইন্নাইতে আছে! রইদ কী সোন্দর, চান্দের আলো কী সোন্দর! গাছের পাতা, ফুল পাখি, দুবলা ভরা কউচ্চা রঙ্গের মাঠ আর পাকাধানে ভরা সোনার বরণ চক, আহা কত সোন্দর জিনিস। বাইষ্যাকালের বিষ্টিও তো কত সোন্দর, শীতের দিনের বিয়ালে যহন চাইর মিহি থিকা দেশগেরামের দিকে আস্তে আস্তে আহে খুয়া (কুয়াশা)–আহা, হেইডাও তো কত সোন্দর। খরালিকালের চাঁদনি রাইতে তারায় তারায় ভরা আকাশখান, হেই আকাশের কি কোনও তুলনা আছে? বাড়ির উডানে বইয়া রাইত দোফরে আকাশ মিহি চাইলে একহান। কথাই খালি মনে অয়, এত সোন্দর দুইন্নাই ছাইড়া একদিন চইলা যাওন লাগবো। হায় হায় এতকিছুর মইদ্যে ওই বদজিনিসখান, খিদাঁড়া ক্যান দিছে আল্লায়! যদি খিদা না থাকতো তয় তো কামকাইজ কিছু করন লাগতো না। খিদার আগুনে পোড়া পেড লইয়া কাজির পাগলা থিকা নাও বাইয়া ফইজুর পয়লা আহন লাগতো না মেদিনমণ্ডল। দবির গাছির বাড়িত থিকা আহন লাগতো না মাওয়ার বাজারে। শাওন মাসের এত সোন্দর বিয়ালডা বাড়ির উডানে বইয়া আশমানের মিহি চাইয়া কাটাইয়া দেওন যাইতো।

এতকিছু ভেবেও পেটের খিদাটা সামাল দিতে পারছে না ফইজু। পেটের ভিতর কোন অদৃশ্য শত্রু যেন কায়দা করে ছাইড়া দিছে পুরাপুরি জবাই না করা একখান ড্যাকরা মোরগ। সেই মোরগ মরণযন্ত্রণায় দাপড়া দাপড়ি করছে পেটে। কখন মরবে, কখন মরে। শান্ত হবে, কে জানে!

এরকমই তো হওয়ার কথা।

সেই কোন সকালে একমুঠ মুড়ি খেয়েছিল ফইজু। লগে ছোট সাইজের দুইখান মিষ্টি আলুসিদ্ধ। ওইটুকু খাবার কতক্ষণ থাকে এই বয়সি মানুষের পেটে?

বাড়িতে অবশ্য খাওনদাওনের আকাল নাই। জের ভরা মুড়ি, ছালা ভরা মিষ্টি আলু। চাউল ডাইল তরিতরকারিরও কমতি নাই। তিন পোলাই জুয়ান মর্দ অইছে। কামাই রুজি করে তিনজনেই। বড়জনের নাম বদু। বদু অইলো কেরায়া নাওয়ের মাঝি। নিজের নাও নিজে বায়। দেশগ্রামের পয়সাআলা মানুষজন লইয়া, গিরস্তবাড়ির বউঝি লইয়া এই গ্রামে ওই গ্রামে যায় নাও বাইয়া। দিনে একদেশশো টেকা রুজি। গেল বচ্ছর বিয়া করছে। বউর নাম আশুরা। কবুতরখোলার মাইয়া। সাত মাইসা পেট লইয়া আশুরা অহন ফইজুর বাড়ির উঠানে হাঁটাচলা করে। শইল্লের তুলনায় মাইয়াটার পেট অইয়া গেছে বেশি বড়। মুখ মিহি চাইলে মায়া লাগে। মনে অয় বিরাট আজাবের মইদ্যে আছে। দুই-চাইর দিনের মইদ্যে আহুজ পড়লে এই আজাব থিকা রেহাই পাইবো।

পেটের ভারে সংসারের কামকাইজ তেমুন করতে পারে না আশুরা। তারপরও দুই চাইরখান কামে হাত লাগাতে যায়। আর ওইটা দেখলেই বদুর মায় যায় চেইত্তা। হায় হায় বউ, এইডা তুমি কী করতাছো? তোমার কাম করনের কাম কী? আমি আছি না? আমিঐ করুম নে? তুমি থোও। যাও ঘরে গিয়া বইয়া থাকো গা। কিছু করন লাগবো না! এই শইল লইয়া কাম করন বহুত কষ্টের। পাঁচহান মাইয়া আর চাইরহান পোলা হইছে আমার। আমি জানি পোলাপান অওয়ান কত কষ্টের! এত কষ্ট করনের পরও চাইরটা পোলাপান বাঁচাইতে পারি নাই। আহুজ ঘরে মরলো একহান পোলা। তিনহান মাইয়া মরলো কোনও ছয় মাসে, কোনও এক দেড় বচ্ছরে। পোলাপান অওয়ানের যেমুন কষ্ট, মইরা গেলে কষ্ট তার থিকা হাজার গুণ। যাও, ঘরে যাও।

বদুর মায়ের নাম খাতুন।

উঠানের কোণে বসে তামাক টানতে টানতে খাতুনের এইসব কথা শোনে ফইজু আর অবাক হয়। খুবঐ খাড়েদজ্জাল (অতিদজ্জাল) মানুষ অইতাছে খাতুন। বিয়ার পর থিকা জানডা ফইজুর তেজপাতা কইরা ছাড়ছে। ফইজু যেমন তারে হাড়ে ডরায়, পোলা তিনটাও ডরায় যমের লাহান। মাইয়া দুইডার নাম ভানু আর আলতা। জামাই বাড়িত থাকে বচ্ছরের পর বচ্ছর। বচ্ছরে একবার বাপের বাড়িতে নাইওর আইলে মা’র ডরে কুঁকড়াইয়া থাকে, দুই-চাইরদিনের বেশি থাকতে চায় না। নাতি নাতকুড়ডিরে বেদম আদর করে খাতুন। তাও থাকতে চায় না তারা।

ফইজুর মাজারো পোলার নাম কুতুব। সেইটা একটু পাজি পাজরা। কথায় কথায় ঘাড় ত্যাড়া করে। বাপ রে আর বড়ভাই রে মানেই না। মাছের কারবার করে। বিয়ান্নারাইতে উইঠা দিঘলি বাজারে যায় কোনওদিন, মাওয়ার বাজারে যায় কোনওদিন। তিন-চাইর হাজার টেকা পুঞ্জি (পুঁজি)। ওই টেকা দিয়া আড়ত থিকা মাছ কিনে। কিনে পাইকারি বেচে, খুচরা বেচে। ঘণ্টা-দুই ঘণ্টার কারবার। কোনও-কোনওদিন তিন-চাইরশো টেকাও রুজি করে। আবার কোনও কোনওদিন এক-দুইশো টেকা লোসখানও দেয়। লোসখান মোসখান পাত্তা দেয় না কুতুব। একদিন লোসখান অইছে কী অইছে, লোসখানের ডবল লাব করুম নে কাইল। মাছের কারবার এমুন। আইজ লোসখান কাইল লাব।

দুইন্নাইর কেঐরে ডরায় না কুতুব। ডরায় খালি খাতুনরে। মা’র সামনে চোখ তুইলা চায় না। মা’র গলার আওজে মেকুর (বিড়াল) অইয়া যায়।

আর ছোট পোলাডা, মাবুদ, মাবুদ আগে কাম করতো ভানুর জামাইর লগে। ভানুর জামাই কাটা কাপড়ের (রেডিমেড গার্মেন্টস) কারবার করে। ঢাকা থিকা মাল আইন্না দেশগ্রামের হাটবাজারে বিক্রি করে। মাবুদ থাকতো তার লগে লগে। মাস শেষে কয়েকটা টেকা তারে ধরাইয়া দিতো ভানুর জামাই। জামাইর নাম জামাল। খুবঐ কিরপিন (কৃপণ) পদের মানুষ। মাবুদ ত্যাক্ত হইয়া দুলাভাইর সঙ্গ ছাড়ছে। অহন কুতুবের লগে থাইকা মাছের কারবার ধরনের ফিকির করতাছে।

মাবুদ অইতাছে খাতুনের নাড়িঝাড়া পোলা। অতি আদরের। সেও মা’রে ডরায় যমের লাহান। সংসারের একটা মানুষরে ছাইড়া কথা কয় না খাতুন। আর সে যেইটা কইবো ওইটাঐ হোনন লাগবো। না হোনলে খবর আছে। হাতের সামনে যা পাইবো ওইডা দিয়াই পিডাইবো। পোলা মাইয়ারা যে কত পিডান খাইছে তার হাতে। স্বামী হইয়া ফইজুও খাইছে দুই-চাইরবার। তয় বউর হাতে মাইর খাওনের কথা কেঐরে কইতে পারে নাই। বিরাট শরমের কথা! এই কথা কেঐরে কওন যায়নি? হোনলে মাইনষে হাসবো না?

সংসারের প্রতিটা মানুষকে কঠিন শাসনে রাখে খাতুন। ফইজুর লগে সংসার করতে আসার পর থেকেই এই অবস্থা তার। তখন ফইজু গিরস্তালি করে। দেড়কানির মতন জমিন ছিল। আমন আউশ চাষ করে কোনওরকমে চলত দিন। বর্ষাকালে মাঝির কাজটাও করত। বছর বছর পোলাপান হত, সংসার চালাত অতিকষ্টে। তবু দিনে দিনে চেহারা ঘুরল সংসারের। মরে বেঁচে ছেলেমেয়ে যে কয়জন রইল, প্রত্যেকেরই কোনও না কোনও গতি হল। ওই যে কথায় আছে না, মুখ দিছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি। তিনি আহার দিছেন। মেয়ে দুইটার বিয়া হল মোটামুটি ভাল ঘরেই। ছেলেগুলি দাঁড়িয়ে গেল। বদলাল সবই, শুধু খাতুন বদলাল না। স্বভাব চরিত্র আগের মতনই। বুড়া হতে চলল, তবু ত্যাজ সেই আগের মতনই। দজ্জালি কমে নাই। স্নেহ মায়া বলতে কিছু যে তার মধ্যে আছে। বোঝাই যায় না।

আশুরা বউ হয়ে আসার পর একটু একটু বোঝা গেল।

দেশগ্রামে বউ-শাশুড়ির মিলমিশ বলতে গেলে দেখাই যায় না। দেখা গেল শাশুড়িরা দিনরাত বকাবাজি করছে বউকে। পান থেকে চুন খসলে চৌদ্দগুষ্ঠির খবর নিয়া নিচ্ছে। পয়লা পয়লা মুখ বুজে কিছুদিন হয়তো এসব সহ্য করল বউ। তারপর সেও হয়ে উঠল দজ্জাল। শাশুড়ি একটা বললে সে বলে তিনটা।

বদুর বিয়ার আগে এই নিয়া খুবই চিন্তিত ছিল ফইজু। হায় হায় রে, খাতুনের যা স্বভাব, বউটা বাড়িতে টিকতে পারবো কিনা আল্লাই জানে! খাতুনের অত্যাচারে বাইধ্য অইয়া বউ লইয়া না ভিন্ন অইয়া যায় বদু।

আল্লার রহমত। হল তার উলটা। একমাত্র আশুরার লগেই খাতুনের সম্পর্ক হল প্রকৃত অর্থেই স্নেহমমতার। চরিত্রের লগে বেমানান আচরণ ছেলের বউর লগে পয়লা দিন থেকেই। শুরু করল খাতুন। পারলে আশুরাকে কোলে নিয়া বইসা থাকে। স্বামী আর তিন পুত্র কারও দিকে ফিরে তাকায় না, জামাইবাড়িতে মেয়েরা খেয়ে আছে না না-খেয়ে, নাতিনাতকুড়দের অসুখবিসুখ হল কি না, কে ভাবে ওসব কথা! চোখ সব সময় শুধু বউর দিকে। চিন্তা সব সময় শুধু বউ নিয়া।

আজব কারবার!

আজ দুপুরে কারবার যেটা হল সেটা অতি লজ্জার। সংসার স্বচ্ছল হওয়ার পর ফইজু গেছে বাড়তি মানুষ হয়ে। ছেলেরা তাকে তেমন পাত্তা দেয় না, খাতুন তো দেয়ই না। আগে যা-ও দুয়েকটা কথা বলার ক্ষমতা সংসারে ফইজুর ছিল, এখন সেটা একদমই নাই। আগে রুজি রোজগার করত বলে দাম একটু ছিল সংসারে। এখন রুজি রোজগার নাই, বয়স হয়েছে, খাতুন তাকে কেন পাত্তা দিবে। বর্ষার শুরু থেকেই ফইজু ভাবছিল, না, এইভাবে বাড়ির উঠানে বসে দিনগুলি পার করে দেওয়ার অর্থ নাই। কাজকাম কিছু একটা জোটাতে পারলে ভাল। কাজে টাকাপয়সা না পাওয়া যাক, পেটেভাতেও যদি কোনও বাড়িতে কাজ জোটে, মন্দ কী! সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকা হল, তিনবেলার খাবারও জুটল। খাতুনের দজ্জাল চেহারা দেখতে হল না।

এই ভেবে এদিক ওদিক কাজের চেষ্টা ফইজু করেছে। জোটেনি কোথাও। কাল হঠাৎ করেই কাজির পাগলা বাজারে ল্যাংড়া বসিরের লগে দেখা। কথায় কথায় সে বলল তার কোষানাওয়ের একজন মাঝি দরকার। না না, নৌকা তেমন বাইতে হবে না। দিনে একবার দুইবার এদিক ওদিক যাওয়াআসা। কাজ তেমন ভারী না। তিনবেলা খাওয়াদাওয়ার লগে দুই-চারটা টাকাও বসির দিবে। তবে কত দিবে সেটার ঠিক নাই।

ফইজু রাজি। সে তো শুধু পেটেভাতের কাজ পেলেই রাজি।

আজ দুপুরের পর যাওয়ার কথা বসিরের বাড়ি। দুপুরের পর বাড়ি থেকে বের হবে সে। পুরাপুরি কাজে লাগতে হবে পরদিন থেকে। আজকের দিনটা ফাও। বাড়ি থেকেই দুপুরের ভাত খেয়ে যেতে হবে।

ফইজু ওই নিয়া ভাবে নাই। একটা দিন ফাও হলে অসুবিধা কী? একটা দিন বাড়ির ভাত খেয়ে কাজে গেলে অসুবিধা কী? খাতুনকে কাজের কথা বলেছে, সে পাত্তা দেয় নাই।

দুপুরের দিকে ফইজু একটু তাড়াহুড়াই করছিল।

ভাত তরকারি রান্না হয়ে গেছে। এখন খাতুন শুধু বেড়ে দিলেই খেয়ে ল্যাংড়া বসিরের বাড়ির দিকে মেলা দিতে পারে। খানিক আগে বাড়ির ঘাটে ডুব দিয়া আসছে। গামছায়। শরীর মাথা মুছতে মুছতে খাতুনকে বলল, দেও বদুর মা, ভাত দেও। খাইয়া মেলা দেই। রান্নাঘরের সামনে জলচৌকি নিয়া বসে আছে আশুরা। সেদিকে ফিরেও তাকাল না খাতুন। এমন একটা মুখ খিচানি দিল! লগে যা তা ভাষায় গালাগাল। ওই গোলামের পো গোলাম, আমি তর বান্দি যে যা কবি ওইডাঐ লগে লগে করন লাগবো? যা ভাত পাবি না। ভাত দিমু না তরে। যা কইলাম, যা। নাইলে ফিরি দা (পিঁড়ি দিয়ে) পিডাইয়া হাড্ডিগুড়ি ভাইঙ্গা হালামু!

এত নিরীহ ভঙ্গিতে ভাত চাওয়ার পর এভাবে তেড়ে উঠতে পারে এতকালের পুরনো স্ত্রী, তাও ছেলের বউর সামনে, এতটা ফইজু ভাবে নাই। সে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল। বউ সামনে থাকায় লজ্জাও পেল খুব। দুয়েকটা কথা যে খাতুনকে বলবে, বলার সাহস হল না। একটা বললে পাঁচটা বলবে খাতুন। সত্যি সত্যি পিঁড়ি দিয়া পিটাতে শুরু করতে পারে। তখন বউর সামনে ইজ্জত আর থাকবেই না। তারচেয়ে চুপ করে যাওয়া ভাল। না খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়া ভাল।

রান্নাঘর থেকে মাথা নিচু করে বের হয়ে আসার সময় ফইজু টের পেল তার খুব কান্না পাচ্ছে। শাশুড়ির কারবারটা দেখতে পেয়েছিল আশুরা, কথাবার্তা তো শুনেছেই। শ্বশুর লোকটার জন্য হয়তো মায়া হয়েছে তার। মায়াবী একটা মুখ করে ফইজুর দিকে তাকিয়ে। ছিল সে। ফইজু তাকাতে পারে নাই তার দিকে। গামছা কাঁধে ফেলে যত দ্রুত সম্ভব আশুরার চোখের সামনে থেকে সরে যেতে চেয়েছিল।

এখন এই শেষ বিকালে কোষানাওয়ের আগার চারোটে বসে মালেক দরবেশের বাড়ির শসা ঝকার দিকে তাকিয়ে নিজ সংসারের এই চেহারা দেখে খিদার কষ্ট ভুলতে চাইছিল ফইজু। পেটের ভিতর খিদা রয়ে গেছে খিদার মতোই। সেই অর্ধেক জবাই করা মোরগ সমানে দাপড়াচ্ছে। এই আজাবের হাত থেকে বাঁচার জন্য যাবে নাকি ফইজু দুই-তিনটা শসা চুরি করতে! ওদিকটায় লোকজনের চিহ্নমাত্র নাই। কোষানাওখান নিঃশব্দে আঁকার তলায় ঢুকিয়ে দুই-তিনটা কেন, পুরা ঝাঁকা খালি করে দিলেও কেউ উদিস পাবে না।

যাবে নাকি ফইজ?

না, আর যাই করুক চুরিটা ফইজু করবে না। খিদার কষ্টে মরে গেলে মরে যাবে, তাও চুরি করবে না। এত লম্বা জীবনে কখনও যা করে নাই, মরণ ঘনিয়ে আসা দিনে কেন করবে সেই কাজ। কেউ দেখুক না দেখুক, ওই যে মাথার উপর বসে আছেন একজন, দিনদুনিয়ার মালিক, তিনি তো দেখবেন। আর ফইজুর মনের ভিতরে বসে আছে বিবেক নামের যে আরেকজন সে তো কথায় কথায় খোটা দিবে ফইজুকে। ওই ফইজু, তুই তো চোর। গিরস্তবাড়ির আঁকা থিকা শোসা চুরি কইরা খাইছিলি না? ছি ছি, তুই চোর? চোরা ফইজু?

না না, বিবেকের এই অপবাদ ফইজু নিবে না। ঘা

ড় থেকে গামছা নামিয়ে পেটে টাইট করে একটা বাঁধ দিল ফইজু। এভাবে বাধলে খিদা টের পাওয়া যায় না।

.

খান গাছিদাদা, খান।

সেন্টুর চা-মিষ্টির দোকানঘরটা পাটাতন করা। ভাঙনের দিককার ঘর, পাটাতন ছাড়া উপায় কী! ঘরের বয়স হয়েছে অনেক। রোদবৃষ্টিতে চাল বেড়ার দশা তেমন কাহিল করতে পারে নাই, ভিতরকার দশা ভালরকম কাহিল। মানুষের পাড়ায় পাড়ায় আলগা হয়েছে পাটাতনের কাঠ। চায়ের পানি পড়ে, মিষ্টির সিরা পড়ে পচনও ধরেছে কাঠে। হাঁটাচলায় মচর মচর শব্দ হয়। সেন্টু চেষ্টা করে শব্দ বাঁচিয়ে হাঁটতে। কাস্টমারদের জাত হয় বারোপদের। এইটুকু শব্দেও বিরক্ত হয় কেউ কেউ। জাতপাতের হিসাব না রেখেই হয়তো সেন্টুকে একটা ধমক দিল। কাজটা ভজা করলে ভজাকেই দিল ধমকটা। ওই মিয়া, এমুন আওজ করো ক্যা? আস্তে হাঁটতে পারো না!

ভজা বেখেয়ালি টাইপের মানুষ। ধমক ধমক খেয়েও অনেক কথাই মনে রাখে না। সেন্টুর খেয়াল সবদিকে। সে খেয়াল রাখে।

আজ খেয়ালটা সেন্টুর নাই। পায়ে মচর মচর শব্দ তুলে পিরিচে দুইখান করে বড় সাইজের রসগোল্লা এইমাত্র দবির আর ল্যাংড়া বসিরের টেবিলে এনে রাখল সে। সেন্ট খুবই হাসিখুশি ধরনের মানুষ। হাসিহাসিমুখে কাস্টমারদের লগে গল্পগুজব করতে ভালবাসে। আজ মুখে হাসি নাই। মাঝবয়সি মুখোন ব্যাজার।

সেন্টুর ব্যাজার মুখ খেয়াল করল বসির। দবিরকে মিষ্টি খাওয়ার কথা বলেই নিজের মিষ্টিতে চামচ চালাল। বড় এক টুকরা মিষ্টি কেটে মুখে দিল। কেসটা কী সেন্টুদাদা?

মিষ্টির আলমারির পাশে সেন্টুর বসার ব্যবস্থা। ততক্ষণে সে গিয়া বসেও পড়ছে। ব্যাজার মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। মাওয়ার বাজারের চারপাশে তখন পদ্মার ঘোলা পানির মতন দিনশেষের আলো।

বসিরের কথা শুনে তার দিকে তাকাল সেন্টু। ব্যাজার মুখ হাসিহাসি করার চেষ্টা করল। কীয়ের কেস?

বসির রসগোল্লা চাবাতে চাবাতে বলল, আপনের? ইহ জিন্দেগিতে তো আপনের এমুন। ব্যাজার মুখ দেহি নাই। আইজ মুখ ব্যাজার ক্যা?

দবির এসবের কিছুই খেয়াল করে নাই। সে আছে তার নিজের উত্তেজনায়। বাড়ি থেকে এতদূর নিয়া আসলো বসির তয় কাজের কথাটা বলছেই না। মেদিনীমণ্ডলের চক পাড়ি দিয়া, এতটাক্ষণ ধরে এতটা পথ এল, আবোল তাবোল কত কথা, আসল কথার খবর। নাই। তখন নাহয় ফইজু ছিল নাওয়ে, এজন্য নাহয় বলে নাই। মালেক দরবেশের বাড়ির ওইদিকে কোষানাও নিয়া বইসা রইল ফইজু, সে আর বসির হেঁটে এল এতটা পথ, তাও কিছু বলল না। মাওয়ার বাজারে এসে ঢুকল সেন্টুর দোকানে, রসগোল্লার অর্ডার দিল। দবিরকে খাওয়ার কথা বলে নিজে খেতে খেতে এখন দেখি কথা বলছে সেন্টুর লগে! সেন্টুর হাসিমুখ, ব্যাজার মুখ নিয়া চিন্তিত। শালার পো শালায় শুরু করল কী? আসল কথা কয় না ক্যা?

ল্যাংড়া বসিরের কায়দায় চামচে মিষ্টি কেটে মুখে দিল দবির। বসিরের লগে ভাও (ভাব) দিয়েই চলতে হবে তাকে। ভিতরের উত্তেজনা কিছুতেই প্রকাশ করা যাবে না। এতদূর। বসির যখন তাকে নিয়াই আসছে, জেবের পয়সা খরচা করে সিগ্রেট মিষ্টি খাওয়াচ্ছে, খানিকপর খাওয়াবে চা, আসল কথা সে বলবেই। না বললে দবিরের লোকসান কিছু নাই, বসিরের পুরাটাই লোকসান। এইজন্য দবিরও বসিরের পথটাই ধরল। সেন্টুর মুখের দিকে তাকাল। বসিরের লগে গলা মিলায়া বলল, হ, ঘটনা কী রে দাদা? মুখহান এমুন ব্যাজার। ক্যা?

সেন্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আর কইয়েন না। আমগো লাহান হিন্দুরা এই দেশে থাকতেই পারবো না।

দবির কথা বলবার আগেই বসির বলল, এইডা কেমুন কথা কইলেন সেন্টুদাদা? আমগো বিক্রমপুরে তো হিন্দু মোসলমানে গলা প্যাঁচাইয়া থাকে। বিরাট খাতির দুই জাতে। কেঐর লগে কেঐর শৌতরামি (শত্রুতা) নাই।

উপরে উপরে নাই, ভিতরে ভিতরে আছ।

কন কী?

হ। ওইডা বাইরে থিকা দেহা যায় না। আপনেরা কেঐ বাইরে থিকা বুজতেও পারবেন না। বুজি খালি আমরা, হিন্দুরা।

দবির বলল, বুজাইয়া ইকটু কও তো দাদা।

বসিরও গলা মিলাল। হ হ কন সেন্টুদাদা। না কইলে বুজুম কেমতে!

সেন্টু আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না থাউক। কইয়া লাব কী?

বসির বলল, লাব আছে দাদা। দুই পদের লাব আছে। একটা লাব অইলো, মনের মইদ্যে কথা চাইল্পা রাখলে কষ্ট বাড়ে। কইয়া হালাইলে হেই কষ্ট কমে। আরেকখান লাব অইলো, ঘটনা জানা থাকলে এই হগল লইয়া বড় জাগায় কথা কওন যায়।

কেমুন বড় জাগা?

এই ধরেন নেতাগো লগে। ঘটকালি করনের সুবিদা বিরাট। বেক মাইনষেই আমারে খাতিল (খাতির) করে। বিক্রমপুরের বেক নেতাঐ আমারে চিনে। দরকার অইলে আপনেগো লইয়া নেতাগো লগে আমি কথা কমু। এইডা হিন্দু-মোসলমান বেকতেরঐ দেশ। আমার যেমুন এই দেশ, আপনেরও তেমুন এই দেশ।

দবির বলল, লেইজ্য কথা। কও দাদা, কইয়া ফালাও। আর আমগো উপরে তুমি বিশ্বাস রাখতে পারো। আমগো পেট থিকা কোনওদিনও কথা বাইর অইবো না। তোমার কোনও ক্ষতি অইবো না।

তার বাদেও ভর করে দাদা।

বসির বলল, কোনও ডর নাই। গ্যারান্টি দিলাম।

দোনোমোনো করে সেন্টু। না থাউক।

এবার বসির মুখ গোমড়া করল। তয় আর কী! আপনে যদি না কইতে চান কইয়েন না। আপনের কষ্ট লইয়া আপনে থাকেন। আমগো কী?

বসিরের পক্ষ নিয়া দবির বলল, কইতে পারতা সেন্টু। কইলে তোমার উপকার ছাড়া অপকার অইতো না। বসির খুবঐ ভাল মানুষ। আমিও মানুষ খারাপ না। দেশগেরামের কেঐ আমগো নামে বদলাম কইতে পারবো না।

সেন্টু একটু নড়েচড়ে বসল। হেইডা জানি।

তয় কও।

আসলে এসব জানার কোনও আগ্রহই দবিরের নাই। সে কারও সাতেপাঁচে থাকা মানুষ। কে হিন্দু কে মুসলমান, কার লগে কার কী সম্পর্ক, কে কার লগে শত্রুতা মারামারি করছে এসব সে ভাবে না। দেশগ্রামের সবাই তার কাছে ভাল, সবাই তার আপন। সবার কথাই সে জানে, সবার ভালমন্দই জানে। কূটনামির স্বভাব দবিরের নাই। কারও কথা। কারও কাছে লাগায় না। কেউ বললে তার কথা মন দিয়া শোনে, না বললে আগ্রহ দেখায় না।

এখন দেখাচ্ছে বসিরের জন্য। যত তাড়াতাড়ি সেন্টুর পেটের কথা বের করতে পারবে বসির, তত তাড়াতাড়ি তার পেটের কথাটাও বের হয়ে আসবে। কোন মতলবে, কোন কথা বলবার জন্য এতদূর তাকে নিয়া আসছে বসির, জানা যাবে। উত্তেজনা লাঘব হবে দবিরের।

সেন্টু তখন হাফ সাইজের দুইখান কাঁচের গেলাসে দুইচামচ করে চিনি ফেলছে, গেলাসের মাজা তরি গোরুর দুধ ঢালছে। এখন কেটলির নল কাত করে খয়েরি রঙের লিকার ঢালল গেলাসে। তারপর ফটাফট শব্দে চামচ নাড়তে লাগল।

দবির আর বসির দু’জনেরই রসগোল্লা খাওয়া শেষ। হাতের কাছে গেলাসে ভরে পানি দিয়েছিল সেন্টু। পুরা পানিটাই ঢক ঢক করে খেয়েছে দু’জনে। এখন বেশ একটা পরিতৃপ্তির ছাপ পড়েছে চেহারায়। চা এলেই চায়ে চুমুক দিয়া সিগ্রেট ধরাবে দুইজনে। সেই ফাঁকে সেন্টুর ঘটনা জানা হয়ে যাবে। তারপরই আসল কথাটা বলবে বসির। দবির সেই আশায় আছে।

চায়ের গেলাস দবির আর বসিরের টেবিলে এনে রাখছে সেন্টু, বসির বলল, আপনে একলা একলা দোকান চালাইতাছেন ক্যা সেন্ট্রদাদা? আপনের ওই ছেমড়াডা কো? কী জানি নাম? ও ও মনে অইছে, ভজন। ভজা ভজা। ভজা কো?

সেন্টু তার জায়গায় গিয়া বসল। আর কইয়েন না। ওই শালার পো শালারে লইয়াঐ। তো ঘটনা।

বসির ফুরুক করে চায়ে চুমুক দিল। কী করছে?

যেইডা করছে হেইডা অর দোষ না। ও কী করবো কন? পেডে কামড় (আমাশা) কি ওয় (সে) ইচ্ছা কইরা হওয়াইছে!

পকেট থেকে সিগ্রেট বের করে নিজের অজান্তেই যেন ধরাল বসির। দবিরকে দিল। দিয়া ম্যাচ জ্বেলে ধরিয়ে দিল। ভজার পেডে কামড় অইছে নি?

হ। তয় ভজা খাচ্চর না। কাম সাইরা সাপন দিয়া হাত ধোয়।

দবির সিগ্রেটে টান দিয়া বলল, ওইডা ধুইতেই অইবো। তোমার দাদা চা-মিষ্টির কারবার। তোমার দোকানের কর্মচারী যুদি বারে বারে পায়খানায় যায় আর যুদি সাপান দিয়া হাত না ধোয় তয় তুমি ওইডা লইয়া বদলামের মইধ্যে পড়বা। মাইনষে কইবো সেন্টুর দোকানের কর্মচারী হুইচ্চা (শৌচকর্ম) সাপন দিয়া হাত ধোয় না। গুয়ের হাত দিয়া চা-মিষ্টি বানায়। এই বদলাম একবার রইট্টা (রটে) গেলে তোমার দোকানে গাহেক আইবো না। তোমার কারবার ফিনিশ অইয়া যাইবো।

সেন্টু ব্যাজার মুখে বলল, এই বদলামডা রটানের চেষ্টাঐ ত্তো করতাছে আকবইরা। বাজারের দুইহান মিষ্টির দোকানের একহান আমার একহান আকবইরার। খালি বিক্রমপুরে না, পুরা বাংলাদেশেই হিন্দুগো হাতের মিষ্টির নাম বেশি। মোসলমানরা ভাল মিষ্টি বানাইতে পারে না। কেমতে পারবো কন? তার তো বেশিদিন ধইরা মিষ্টি বানায় না। এক-দুই পুরুষ ধইরা বানায়। আর আমরা বানাই চৌদ্দ পুরুষ ধইরা…

সেন্টুর কথা শেষ হওয়ার আগেই বসির বলল, হ এইডা ঠিক। মাওয়ার বাজারের মিষ্টির কথা হোনলেই মাইনষে বোজে সেন্টুর দোকানের মিষ্টি। আকবরের দোকানের মিষ্টি মাইনষে পছন্দ করে না।

তয় আকবইরা যে মিষ্টি খারাপ বানায় এইডা আমার মুখে কেঐ কোনওদিন হোনে নাই। অর বদলাম আমি কোনওদিন কই না। তয় ওই শালার পো শালায় আমার গোঁয়ার (পশ্চাৎদেশ) পিছে লাইগ্যা রইছে। আমার কোনও দোষ ধরতে পারে না দেইক্কা ভজারে লইয়া পড়ছে।

বসির আবার বলল, কী করছে?

আইজ বিয়ান থিকা তিন-চাইরবার পায়খানায় গেছে ভজা। বাজারে পায়খানা নাই। যাইতে অয় গাঙপারের কাইশ্যাবনে (কাশবনে)। ওহেনে পানি উইট্টা গেছে। যারা হাগতে মোততে যায় কাম সাইরা তারা বেবাকতেই বাইষ্যার (বর্ষার) পানি খরচা করে। ভজা। ওইভাবে কাম সারে না। একহাতে বদনা লয় আরেক হাতে লয় সাপানের টুকরা। কাম। সাইরা সাপন দিয়া কচলাইয়া হাত ধুইয়া আহে। ভজা বারে বারে পায়খানায় যায় এইডা বিয়ান থিকাই দেখছে আকবইরা। তারপর থিকাই কারবার শুরু করছে।

বসির বড় করে সিগ্রেটে টান দিল। কী কারবার?

দবির ভিতরে ভিতরে তখন খুবই বিরক্ত। দুই শালার পো শালায় কী শুরু করলো? হাগামুতা পেডে কামড় এই হগল লইয়া এত প্যাচাইল পারতাছে ক্যা? সেউন্টা নমোরপুতের তো আক্কেল বুদ্দি কিছু নাই। চা মিষ্টি খাইছে যেই কাস্টমাররা তাগো সামনে এই প্যাচাইল কেমতে পারে?

দবিরের মনের কথা কেউ টের পায় না। না সেন্টু না বসির। তারা ওই একই বিষয় সমানে চালিয়ে যায়।

সেন্টু বলল, কারবারডা অইলো, যারে পায় তারে কয়, সেউন্টার দোকানের ভজা গুয়ের হাত দিয়া মিষ্টি বানায়, চা বানায়। ওই যে দেহো মিয়ারা, বদনা হাতে বারে বারে কাইশ্যাবনে যায়! কাম সাইরা হাত পোয় না। ওই হাত দিয়াঐ গাহেকরে চা মিষ্টি দেয়।

বসির চিন্তিত গলায় বলল, এইডা আকবর আপনেরে ফাপড়ে হালানের লেইগা কইতাছে সেন্টুদাদা। তয় ভজারে রাখন আপনের ঠিক অইবো না। একবার এই বদলাম রইট্টা গেলে আপনের দোকানে আর গাহেক আইবো না। চা মিষ্টির দোকান পাকছাপ (পরিষ্কার অর্থে) না থাকলে ওই দোকান চলবো না।

মনের বিরক্তি মনে চেপে বসিরের লগে গলা মিলাল দবির। হ, কথা ঠিক। ভজারে রাখলে তোমার কারবারের ক্ষতি অইবো দাদা।

সেন্টু বলল, হেইডা আমি বুঝি। বুজি দেইক্কাঐ ভজারে খেদাইছি।

শুনে খুবই উৎসাহী হলো বসির। ফুক ফুক করে দুইবার সিগ্রেটে টান দিল। খেদাইছেন?

হ দোফরেঐ খেদাইয়া দিছি।

ভাল করছেন, বহুত ভাল করছেন।

তয় দোকান চালামু কেমতে হেই চিন্তায় অহন আর বাঁচতাছি না।

ক্যা? অন্য কর্মচারী রাখবেন?

হেইডা তো রাকতেই অইবো। তয় ভজার মতন কর্মচারী পামু কই? ভজা বহুত ভাল চা। বানাইতো, আমার থিকাও ভাল মিষ্টি বানাইতো। আমি নিজহাতে অরে কাম হিগাইছিলাম। আকবইরা হালায় গোঁয়ার পিছে না লাগলে ভজারে আমার খেদান লাগতো না।

চা শেষ করে সিগ্রেটে টান দিল বসির। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই দবির বলল, আল্লায় যা করে ভালর লেইগাই করে। মনে কষ্ট লইয়ো না দাদা। কর্মচারী বিচড়াও (খোজো), দেখবা ভজার থিকাও ভাল কর্মচারী পাইয়া গেছ। বদলাম কইরা আকবর তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারে নাই। উপকারই করছে। এই যে আকবর কথা রটানের লগে লগে ভজারে তুমি খেদাইছো, এইডাই তোমার উপকার। বাজারের মাইনষে আর গাহেকরা মনে করবো খাচ্চর কর্মচারী তুমি দোকানে রাখো নাই। খেদাইয়া দিছো।

বসির বলল, একদোম খাঁটি কথা। সেন্টুদাদা, আইজথিকা দেকবেন আপনের দোকানের আরও নাম অইবো। বেচাকিনা আরও বাড়বে।

বোজলাম, তয় ভজা ছেমড়াডার লেইগা মায়া লাগতাছে দাদা। এতদিন রইছে আমার লগে! কানতে কানতে বাইর অইলো দোকান থিকা। ভজার লেইগা মনডা আমার খারাপ।

দোকানের নাম বাড়লে, বেচাকিনা বাড়লে খারাপ মন ভাল অইতে টাইম লাগবো না।

ভগবানে করুক, হেইডাই য্যান অয়। আপনেগো মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।

এসময় খাইগোবাড়ির (খানবাড়ির) আপেল মেম্বার এসে দাঁড়াল সেন্টুর দোকানের সামনে। লগে মেদিনীমণ্ডলের ইদ্রিস জুয়েল আর নয়ন। দবির আর ল্যাংড়া বসিরের দিকে ফিরাও তাকাল না আপেল। পরনে টেটরনের কালো প্যান্ট আর সাদার উপর নীল চেকের হাফহাতা শার্ট। পায়ে রাবারের পামশু। হাতে সিগ্রেট জ্বলছে। সিগ্রেটে টান দিয়া সেন্টুকে বলল, দুই কুড়ি বড় সাইজের রসোগোল্লা বাইন্দা রাখো সেন্টু। ঘুইরা আইতাছি। যাওনের সময় লইয়া যামু।

লগের ছেলে তিনটা নিয়া কালিরখিলের ওদিকে চলে গেল আপেল। সেন্টু ব্যস্ত হয়ে গেল মিষ্টি গুছাতে। দবিরের মনে তখন বিরাট স্বস্তি। এবার নিশ্চয় কথাটা তুলবে বসির। গভীর আগ্রহ নিয়া বসিরের দিকে তাকাল সে।

বসিরও তাকাল দবিরের দিকে। তয় এইবার কথাডা কই গাছিদাদা।

ভিতরের উত্তেজনা প্রকাশ করল না দবির। খুবই সরল সাধারণ গলায় বলল, কও।

আপনের মাইয়াডার বস কত অইলো গাছিদাদা? হে হে।

অনেকক্ষণ পর বসিরের হে হে হাসিটা শুনল দবির। শুনে আনমনা হল। কার কথা কও? নূরজাহানের?

তয় আর কার কথা কমু? নূরজাহান ছাড়া আপনের আর কোনও মাইয়া আছেনি? হে হে।

না হেইডা নাই। আমার ঐ একখানঐ মাইয়া।

কন দিহি বস কত অইলো মাইয়ার?

এই ধরো চৌদ্দ-পোনরো বচ্ছর।

ধরতে পারুম না। চৌদ্দ না পোনরো হেইডা কন।

মুখ হাসিহাসি করল দবির। আমগো লাহান মাইনষে পোলাপানের আসল বসের খবর। রাখে না। কোন বচ্ছর কোনদিন জন্মে পোলাপান হেইডা পুরাপুরি মনে রাখে না।

হ কথা ঠিক।

তয় নূরজাহানের চৌদ্দ নাইলে পোনরো বচ্ছর বস অইবো। এইরকম বাইষ্যাকাল। আষাঢ় না শাওন মাস জানি। বিয়াইন্না রাইত্রে আহুজ পড়লো তোমার ভাবীছাবের। ধরনী অইলো আলার মা’য়। ইস, আগের দিন বিয়াল থিকা যে কী মেঘবিষ্টি। নূরজাহানের মা’র বেদনা উটলো হাজেরবেলা। মেগে ভিজতে ভিজতে কোষানাও লইয়া আমি গেলাম আলাগো বাইত্তে। আলার মা’রে লইয়াইলাম। বাইত্তে আর কেঐ আছিলো না। ঘরে নিজেঐ কুপি আঙ্গাইয়া রাইক্কা গেছি। নিঝুম বিষ্টি নামছে। আশমান খালি গুরুম গুরুম করে। খাড়াজিলিকের পর খাড়াজিলিক (বিদ্যুৎ চমক)। হাজেরবেলাই ঘুটঘুইট্টা আন্দার। একহান কইরা খাড়াজিলিক দেয়, চাইরমিহি ফকফক কইরা ওডে, হেই আলোয় পথ দেইক্কা নাও বাই আমি। ওইরকম মেগবিষ্টির রাইত্রে আলার মা কইলাম একবারও না করলো না। কওনের লগে লগে পুরানা একহান ছাতি মাথায় দিয়া আমার নাওয়ে উটলো। অমুন। বিষ্টি ছাতিতে মানে না। ভিজ্জা একসার (একসা) অইলো। ভিজা কাপড় লইয়াঐ বইয়া রইলো হারারাইত। আমি ভাত হাদলাম, খাইলো না। নূরজাহানের মায় তহন বেদনার চোড়ে মরোমরো। আমার একহান মাত্র ঘর। ওই ঘরেঐ বউর আহুজ পড়বো। বাইরে মেগবিষ্টি আরও বাড়ছে। আশমান য্যান ছিদ্রি অইয়া গেছে। ঘরে বইয়া থাকতে আমার শরম করতাছিল। ভিজতে ভিজতে রান্নঘরে গেলাম না। লুঙ্গি কাছা দিয়া হারারাইত বইয়া রইলাম রান্নঘরে। বিষ্টি বাঁচাইয়া বাঁচাইয়া টিক্কা আঙ্গাই আর খালি কুরুক কুরুক কইরা তামুক খাই। কান রইছে ঘর মিহি। বুকের ভিতরে নলামাছের লাহান ফালাফালি করে কইলজা। এই নি হুনুম আহুজ পইড়া গেছে তোমার ভাবিছাবের। ওয় ওয়া কইরা কানতাছে আমার পোলা নাইলে মাইয়া।

একটু থামল দবির। তারপর বলল, হ আওজ এক সময় হুনলাম। তহন বিয়ান অইয়া গেছে। আমার নূরজাহানও অইলো, মেগবিষ্টিও থাইমা গেল। ঘণ্টাহানি পর ডালিম ফুলের লাহান রইদ উটলো। মাইয়ার মুখহান দেইক্কা এমুন আমোদ লাগলো। তোমার ভাবিছাবের বুকের কাছে কেঁতাকাপড়ের মইদ্যে এই এতডু একহান মুখ, এই গিনি গিনি চকু ছোড ছোড হাত পাও। মাথা ভরা কালা কালা চুল মাইয়াডার।

দবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দেখতে দেখতে কতদিন গেল গা। মাইয়া ডাঙ্গর অইয়া গেল। আইজ তোমার লাহান নামকরা ঘটকে আমার মাইয়ার খবর লইতাছে। দিন কেমনে চইলা যায়?

যে কথা শোনার জন্য বুকের ভিতর এত উত্তেজনা, এত অপেক্ষা সেই কথা শোনার আগে কেন যে এতসব কথা বসিরকে দবির বলল, কে জানে।

দবিরের কথা মন দিয়াই শুনছিল বসির। দবির থামার পর তার সেই হাসিটা হাসল। হে হে গাছিদাদা, দেহেন তো, কেমুন মানুষ আপনে? মাইয়ার জন্মের রাইতটা পুরাপুরি মনে। রাখছেন আর আসল কথাই মনে রাখেন নাই। সন তারিখ। সন তারিখ জানা থাকলে মাইয়ার আসল বসটা জানন যাইতো। তয় আমার মনে অয় চৌদ্দ-পোনরো বছর বস অইবো না নূরজাহানের।

দবির অবাক। তয় কত অইবো?

বেশি অইবো। ষোলো-সতেরো।

আরে না রে দাদা, এত অইবো না।

অইবো। মাইয়ার শইল চেহারা দেখলে বুজা যায়। আর ঘটকরা অইলো ঘাঘুমাল। আবিয়াতো পোলা মাইয়ার শইল মুখ দেখতে দেখতে চকু পাইক্কা যায় ঘটকগো। একপলক একজনরে দেইক্কাঐ কইয়া দিতে পারে বস কত অইবো।

তুমি এর মইদ্যে নূরজাহানরে দেখছো নি?

এবার একটু ফাঁপরে পড়ল বসির। আমতা গলায় বলল, না এর মইদ্যে দেহি নাই। তয় আরবচ্ছর দেখছিলাম। তহনঐ মাইয়ার বস পোনরো-ষোলো মনে অইছে আমার। এই এক বচ্ছরে আরও ডাঙ্গর অইছে না? হে হে।

সেন্টুর দোকানে দবির আর বসির ছাড়া কোনও গাহেক নাই। বিকালবেলা বাজারের দিকে তেমন লোকজন হয় না। মেঘবৃষ্টি না থাকলে, রোদ আর খটখটা শুকনা থাকলে দুই চারজন আড্ডাবাজ মানুষ বাজারের দিকে আসে। সেন্টুর দোকানে বসে মিষ্টি না খেলেও চা দুই-চারকাপ খায়। আজ সকাল থেকে এই বৃষ্টি এই একটুখানি রোদ, আকাশ এই পরিষ্কার এই মেঘলা। কখন হঠাই নামবে বৃষ্টি, হঠাই অন্ধকার হবে চারদিক কে জানে। এজন্য আড্ডাবাজ গিরস্তলোক বাড়ি থেকে বের হয় নাই। আপেল মেম্বারের বাড়িতে হয়তো কুটুম আসছে। এজন্য বাধ্য হয়ে মিষ্টি নিতে আসছে বাজারে। তবে দুইকুড়ি বড়সাইজের রসগোল্লা বেচে বিশ-পঁচিশ কাপ চায়ের লাভ তুলে ফেলবে সেন্টু। কারবারের দিক দিয়া খুবই সরস সে। ভজাকে নিয়া নানা প্রকারের শোকতাপ প্রকাশ করার পর, হিন্দু হয়ে দুইজন মুসলমানের সামনে আরেকজন মুসলমান মিষ্টির দোকানদার আকবরকে ‘শালার পো শালা’ বলে সমানে গালাগাল করে গেল। মুসলমান দুইজন চেতে যায় কি না ভাবলই, আকবরের উপর ঝাল যা ঝাড়ার ঝেড়ে যেই আপেল মেম্বারের দুইকুড়ি বড়সাইজের রসগোল্লার অর্ডার পেল লগে লগে ভুলে গেল দোকানে দুইজন গাহেক আছে। তারা দুইজন কথাবার্তা বলছে নিজেদের মধ্যে। কী বলছে না বলছে এত কাছে থেকেও সেকথা শুনছে না সেন্টু। নিজের ব্যাবসায় ডুবে গেছে। দোকানের পিছন দিককার বড় বড় কড়াইগুলির একটি থেকে লোহার হাতায় করে রসগোল্লা তুলে নতুন মাটির হাঁড়িতে গুনে গুনে রাখছে। হাতার চ্যাপটা মাথায় ছোট ছোট ছিদ্র। দুইটা-তিনটা করে রসগোল্লা তুলে লগে লগেই হাঁড়িতে রাখছে না সেন্টু, হাতার ছিদ্র দিয়া সিরা ঝরে পড়ার জন্য একটু সময় নিচ্ছে। বাইরে দিনের আলো একেবারেই ফুরাবার মুখে। সেন্টুর চা মিষ্টির দোকানে খাটাসের মতন ঘাপটি মেরে ঢুকতে চাচ্ছে শ্রাবণ সন্ধ্যার অন্ধকার।

বসির আচমকা বলল, তয় আপনের কী মনে অয় গাছিদাদা, আপনের মাইয়ার কি বিয়ার বস হয় নাই? চৌদ্দ-পোনরো আর নাইলে ষোলো-সতেরো, বস যেইডাঐ অউক, বিয়ার বস অইছে কি না হেইডা কন।

দবিরের বুকে আবার সেই আগের উত্তেজনা ফিরে এল। তয় মাইয়ার বিয়ার সম-ঐ আনছে ঘটকায়? এইডা আমি আগেঐ বুজছিলাম। সমন্দ না আনলে আতকা এমতে আমার বাইত্তে আইবো ক্যা? নিজের নাওয়ে কইরা বাজারে আইন্না আমারে চা মিষ্টি খাওয়াইবো ক্যা? সিকরেট খাওয়াইবো ক্যা? এত খাতিরের গোমড় কী?

মনের এসব কথা একদম প্রকাশ করল না দবির। হাসিমুখে বলল, হ বিয়ার বস মাইয়ার অইছে। আগিলা দিনে তো আরও কম বসেই মাইয়াগো বিয়াশাদি অইতো। অহন দিন বদলাইছে, মাইয়া ডাঙ্গর কইরা বিয়া দেয় গিরস্তে। নূরজাহান ডাঙ্গর অইছে। অরে বিয়া দেওন যায়।

বুকপকেট থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট বের করল বসির। প্রথমে নিজে নিল না, প্যাকেট থেকে একটা সিগ্রেট খানিকটা টেনে বের করে দবিরের দিকে আগায়া দিল। নেন গাছিদাদা, ধরান এক শলা।

দবির সিগ্রেট নিয়া বলল, তুমি ধরাইবা না?

হ, এইত্তো ধরাইতাছি।

দবিরের সিগ্রেট আগে ধরায়া দিয়া নিজেরটা ধরাল বসির। বুকভরতি ধুমা টেনে বলল, আপনে বোজছেন গাছিদাদা কীর লেইগা এত প্যাচাইল আমি পাড়তাছি?

কথার লগে নাকমুখ দিয়া গলগল করে ধুমা বের হল বসিরের।

দবিরও সিগ্রেটে টান দিল। বসিরের কায়দায় নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, বুজুম না ক্যা? বুজছি। নূরজাহানের লেইগা সমন্দ আনছো।

হ ঠিকঐ বুজছেন। হে হে।

বুকের উত্তেজনা এখন আরও গম্ভীর হয়েছে দবিরের। তবুও সেই আগের তরিকায়ই আছে সে। বসিরকে কিছুতেই বুঝতে দিবে না তার মনের অবস্থা। যেন ব্যাপারটাতে তার কোনও আগ্রহই নাই। মেয়ের বিয়ার সমন্দ আনা না-আনা যেন কোনও ব্যাপারই না এমন নির্বিকার গলায় বলল, কোন গেরামের পোলা?

মুখটা ডিঙ্গিনৌকার মতন করে হাসল বসির। সেই হাসিতে শব্দও হল না, দাঁতও বের হল না। বলল, ধরেন আমগো আশেপাশের গেরামের পোলা।

বুজলাম। গেরামের নাম কইতে অসুবিদা আছে?

না কীয়ের অসুবিদা?

তয় কও।

ধরেন মেদিনমণ্ডলেরঐ পোেলা।

দবির একটু বিরক্ত হল তয় বিরক্তটা প্রকাশ করল না। সিগ্রেটে টান দিয়া বলল, ধরনের কী আছে? মেদিনমণ্ডলের পোলা অইলে কও, হ মেদিনমণ্ডলের পোলা।

হ মেদিনমোণ্ডলের পোলা।

কোন বাড়ির পোলা? বাপের নাম কী?

ওইডা পরে কই। আগে পোলার বিবরণ হোনেন।

কও, কও।

আরেক গেলাস চা খাইবেন নি?

অহন আর খামু না।

ক্যা?

আমি চা বেশি খাই না। চা খাইলে রাইত্রে ঘুম আহে না।

আইজ আইবো। হে হে।

কেমতে বুজলা?

যেই পোলার লেইগা আপনের মাইয়ার সমন্দ আনছি, হেই পোলার কথা হোনলে এক গেলাস ক্যা, দশ-বিশ গেলাস চা খাইলেও ঘুম আপনের অইবোই। কারণ হোনবেন? হে হে।

কও।

কারণডা অইলো বেক মা-বাপেঐ চায় তার মাইয়াডার ভাল ঘরে বিয়া অউক। টেকা পয়সা আছে, জাগাসম্পত্তি বাড়িঘর আছে, পোলার রুজিরোজগার ভাল। ওই পদের জামাইর কাছে মাইয়া সুখে শান্তিতে থাকবো। আপনের অইলো একহান মাত্র মাইয়া। ওই মাইয়াডার যুদি ভাল ঘরে, ধনী জামাইর লগে বিয়া অয় তয় তো আপনের ইহজিন্দেগিতে আর কোনও চিন্তা নাই। আপনে খালি খাইবেন আর ঘুমাইবেন। হে হে। দশবিশ গেলাস চা খাইলেও ঘুম নষ্ট অইবো না।

দবির মনে মনে বলল, ঐডাই য্যান অয় আল্লাহ, ঐডাই য্যান অয়।

সিগ্রেটে টান দিয়া বসির বলল, খাইবেননি আরেক গেলাস? দিতে কমু?

না রে দাদা। অহন না। খাইলে পরে খামু নে। তুমি খাও। তোমার তো চা’র নিশা।

না, তয় আমিও খামু না। ঘটক মানুষ, ঘনঘন চা খাই। কয়দিন ধইরা খুব বায়ু অয়। হে হে। রাইত্রে ঠাস ঠাস কইরা বায়ু ছাড়ি। আপনেগো বউ বকাবাজি করে। হে হে।

হাতের সিগ্রেট শেষ হয়ে আসছে। নূরজাহানের সমন্দের উত্তেজনায় সিগ্রেট একটু ঘনঘনই টান দিয়েছে দবির। তারটা প্রায় শেষ, বসিরেরটা এখনও দুইটান খাওয়া যাবে।

সিগ্রেটে শেষ টান দিল দবির। সেন্টুর দোকানের সামনে একটুখানি প্যাককাদা জমে আছে। সেই প্যাককাদার দিকে টোকা মেরে সিগ্রেটের পিছনটা ফেলে দিল। অতি আপনজনের কায়দায় বসিরকে বলল, চা কম খাওয়ার চেষ্টা কইরো। রসগোল্লা চা এই। হগল জিনিস যত খাইবা পেডের দশা তত খারাপ অইবো। বায়ু খুবই খারাপ রোগ। একবার অইলে রক্ষা নাই। হুজুরের পোলা মোতাহাররে দেখলা না, কেমতে মইরা গেল!

বসির হে হে করে হাসল। কথা মান্নান মাওলানার দিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে আমোদ। পেয়েছে।

সেন্টু ততক্ষণে হাতের কাজ শেষ করেছে। দুইকুড়ি বড়সাইজের রসগোল্লা হাঁড়িতে ভরে। হাঁড়ির মুখ বেঁধেছে পুরনা পেপার (খবরের কাগজ) দিয়া। ডাবল করে সুতলি দিয়েছে যেন শক্ত করে হাতে ঝুলানো যায়। কাজে এতটাই মগ্ন ছিল, এই এতক্ষণে একবারও তাকায় নাই বসির দবিরের দিকে। এত কাছাকাছি থেকেও শুনতে পায় নাই দুইজন মানুষ কী এত কথা বলছে।

এখন হাতের কাজ শেষ হয়েছে দেখে মানুষ দুইজনের দিকে পলকের জন্য তাকাল। তারপরই আরেক কাজে ব্যস্ত হল। দোকানের পিছন দিক থেকে পুরনো হ্যাঁজাক বাতিটা এনে প্রথমে খুবই সাবধানে, খুবই যত্নে বাতির কাঁচ ত্যানা দিয়া মুছল। ম্যান্টেলের একটা কোনা খুলে ঝুলছে, সাবধান না হলে পুরাটা খুলে যাবে। তা হলেই কয়েকটা টাকা গচ্চা। নতুন ম্যান্টেল কিনে লাগাতে হবে। তারচেয়ে পুরনাটা দিয়া যে কয়দিন কাজ চালানো যায়। কোনা ঝুললে কী হবে, আলো তো হয় ফকফকা।

কাচ মোছা শেষ করে আগের মতনই সাবধানি ভঙ্গিতে হ্যাঁজাক পাম্প করল সেন্টু। জোরে পাম্প করলেও খুলে পড়তে পারে ম্যান্টেল। বেশ খানিকটা সময় ধরেই কাজটা সে করল। তারপর ম্যাচ জ্বেলে হ্যাঁজাক ধরাল। হ্যাঁজাকের সোঁ সোঁ শব্দ আর সাদা আলোয় ভরে গেল দোকান।

তখনও কাজ শেষ হয় নাই। অতি সাবধানে হ্যাঁজাকটা তারপর তুলে ধরল সেন্টু। দোকানঘরের বাতার লগে কুকিচ বিস্কুটের মতন (এই বিস্কুটটা ইংরেজি ‘এস’ অক্ষরের মতো দেখতে ছিল। গ্রাম অঞ্চলে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এখন আর পাওয়া যায় না) বড়সাইজের লোহার একটা আংটা ঝুলছে, সেই আংটার লগে হ্যাঁজাক ঝুলিয়ে দিল সেন্টু। তারপর আনন্দের একটা শব্দ করল। অর্থাৎ কাজটা ভালভাবে শেষ করতে পেরেছে।

নিজের সিগ্রেট শেষ করে বসিরও তখন দবিরের কায়দায় ছুঁড়ে ফেলেছে দোকানের সামনে। ছ্যাত করে সামান্য একটা শব্দ করে নিভেছে সিগ্রেটের আগুন।

আপেল মেম্বারের মিষ্টির হাঁড়ি নিয়া দোকানের বাইরে পা দিয়েছে সেন্টু। দবির বসির দুইজনকেই বলল, আপনেরা ইট্টু বইয়েন।

বসির বলল, আপনে যাইতাছেন কই সেন্টুদাদা?

মেম্বরের মিষ্টি দিয়াহি।

কই দিয়াইবেন?

কালিরখিলের মাডে বইয়া মেম্বরে অহন চাডামি (আ) মারতাছে। ওহেনে গিয়া মিষ্টির পাতিল দিয়াইলে খুশি অইবো।

হেয় না কইলো দোকানে আইয়া লইয়া যাইবো?

হ কইছে। তার কওন হেয় কইছে, আমার কাম আমি করলে বহুত খুশি অইবো। বোজেন না, আমরা হিন্দুমানুষ। কত কিছু হিসাব কইরা চলতে অয়।

দুইজন মানুষের এসব কথার একটাও ভাল লাগছিল না দবিরের। সে আছে তার। উত্তেজনায়। এখনও পুরা কথা শোনা হয় নাই। আধাবিধি হয়ে আছে কথা। মেদিনমণ্ডলের কোন বাড়ির পোলার লেইগা সমন্দ আনছে ঘটকায়? জাগাসম্পত্তি বাড়িঘর আর রুজি রোজগারের কথা যেই হগল কইলো, ওইরকম পোলা কোন বাড়ির?

মনে মনে মেদিনমণ্ডলের প্রত্যেকটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল দবির।

সেন্টু চলে যাওয়াতে বসির খুব খুশি। হে হে করা হাসিটা হেসে বলল, আমি অহন বহুত খুশি।

দবির তাকিয়ে ছিল বাইরের দিকে। চোখ ফিরিয়ে বসিরের দিকে তাকাল। ক্যা, খুশি ক্যা?

মালাউনের বাচ্চায় নাই দেইক্কা।

দবির অবাক। এতক্ষণ ধরে সেন্টুদাদা সেন্টুদাদা করল যে লোকটা, মাত্র চোখের আড়াল হয়েছে সেন্টু লড়ে লড়েই সে মালাউনের বাচ্চা হয়ে গেল? আজব কারবার!

তয় এইসব নিয়া কথা বলল না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আসল কথার বারোআনি এখনও শোনা হয় নাই দবিরের। আর দেরি করা যাবে না। এখন পুরা কথা শুনতেই হবে।

এই প্রথম বসিরকে একটু তাড়া দিল দবির। কও রে দাদা, কও। কোন বাড়ির পোলা? পোলার নাম কী? বাপদাদার নাম কী?

বসিরের মুখে আবার সেই হে হে। কইতাছি। এইডাইত্তো কওনের আসল টাইম। মালাউনের বাচ্চায় গেছে দেইক্কা এর লেইগাইত্তো খুশি অইলাম। হোনেন গাছিদাদা, আগেঐ কইছি পোলার অবস্থা বিরাট। বিলে ষোলো-সতেরো কানি জমিন আছে। বাইত্তে চৌচালা চাইর-পাঁচহান ঘর। আথালে গাই আছে দশ-বারোডা। বচ্ছরে ধান যা পায়, চাইর ভাগের একভাগেরও কম লাগে বাইত্তে। বাকি ধান বেইচ্চা টেকা পায় লাখ লাখ।

দবির চিন্তিত। এমুন পোলা মেদিনমণ্ডলের কোন বাড়ির? আমি তো বিচড়াইয়া পাইতাছি না।

পাইবেন, পাইবেন। আমি কইলেঐ পাইবেন।

তয় কও না ক্যা?

আপনের লগে ইট্টু রহস্য করতাছি। হে হে।

রাইত অইয়া যাইতাছে দাদা। বাইত যাওন লাগবো। অহন আর রহস্য কইরো না।

বসির তবু তার জায়গা থেকে নড়ল না। আগের মতনই রহস্যের গলায় বলল, বিদেশ থিকাও টেকা আহে পোলার। মাসে মাসে একলাখ-দেড়লাখ টেকা।

কও কী?

হ।

কোন দেশ থিকা?

জাপান জাপান। জাপানি টেকা।

দবির ভ্রু কুঁচকাল। পোলার ভাই বেরাদর কেঐ জাপান থাকে?

এইডা কইলেঐত্তো আপনে চিন্না হালাইবেন। হে হে।

দবিরের মনের ভিতর বড়সাইজের একটা ডাইয়া (ভেঁয়ো পিঁপড়ে) যেন হাঁটাচলা করছিল এতক্ষণ। এইমাত্র সেই বজ্জাত ভালরকম কামড় দিয়া ধরছে। নিজের অজান্তেই দবির যেন বলল, তুমি কি হুজুরের পোলার কথা কইতাছো? আতাহারের কথা কইতাছো? অর ছোডো ভাই থাকে জাপানে। অগোঐত্তো বিলে ষোলো-সতেরো কানি জমিন। বাইত্তে চাইর-পাঁচহান চৌচালা টিনের ঘর। আথালে দশ-বারোহান গাই! না, না। আতাহার পোলা ভাল না। মদপানি খায়। মোতাহারের বউর লগে বহুতদিনের খাতির। পোলাপান তিনডার বাপ মোতাহার না, বাপ অইলো আতাহার। এইডা তুমি কেমুন সমন্দ আনছো আমার মাইয়ার লেইগা?

দবিরের দিশাহারা মুখ দেখে একটুও বিচলিত হল না বসির। আগের মতনই হাসল। হে হে। আতাহারের যত দোষঐ থাকুক, অর মতন পোলায় আপনের লাহান গাছির মাইয়া বিয়া করবো না। ভাবির লগে ইটিস পিটিস করুক আর যাই করুক, তিনহানের জাগায় দশহান পোলাপান পয়দা করুক ভাইর বউর পেড়ে, তারবাদেও আতাহারের লাহান পোলার ম্যালা দাম। ওইরকম পোলা আপনের মাইয়ারে বিয়া করবো না। অর বিয়া আমি বিরাট ঘরে ঠিক করতাছি।

খুবই অপমানকর কথা, দবিরকে খুবই ছোট করা। তবু মন খারাপ করল না দবির, খুশিই হল। যাক আতাহারের মতন বজ্জাতের জন্য যে নূরজাহানের সমন্দ আনে নাই বসির!

তাইলে ওইরকম অবস্থার পাত্রহান কে মেদিনমণ্ডল গেরামে? আতাহার ছাড়া আর কাগো এইরকম অবস্থা?

সন্ধান পায় না দবির। ভিতরে গভীর এক অসহায়ত্ব।

কাতর অনুনয়ের গলায় দবির বলল, দোফরের পর থিকা তোমার লগে আছি দাদা। আমার বাইত্তে তোমারে দেইক্কাঐ বুজছিলাম নূরজাহানের সমন্দ লইয়া তুমি আইছো। এতাহানি সমায় কাইট্টা গেছে তাও কও নাই পোলাডা কে! খালি রহস্য করতাছো। আর রহস্য কইরো না দাদা। আমার অস্থির লাগতাছে। সমর কথা কও, হুইন্না বাইত যাই। তোমার ভাবিছাবের লগে কথাবার্তা কই। বুজলা না?

বসির তবু আগের মতনই। বুজছি গাছিদাদা, বুজছি। হে হে। তয় একহান শেষকথা আপনেরে আমি কই, যুদি ওই পোলার কাছে মাইয়া বিয়া দেন তয় মাইয়া তো আপনের রানির হালে থাকবোঐ, মাইয়ার লগে লগে আপনেও থাকবেন রাজার হালে। গরিব গাছি। দেইখা দেশগেরামের মাইনষে আপনেরে গনায় ধরবো না, মানুষঐ মনে করবো না, আপনের চলাফেরা করন লাগবো বিলাইয়ের লাহান হেইডা আর অইবো না। আপনে তহন। ছিনা টান কইরা হাঁটবেন। গাছিগিরি করনঐ লাগবো না। আপনের সংসার চলবো জামাইর টেকায়। মাইয়া আপনের গয়নার ভারে হাঁটতে পারবো না। হে হে।

দবির মনে মনে আবার বলল, হেইডাঐ য্যান অয় আল্লাহ। হেইডাঐ য্যান অয়। জামাই বাইত্তে গিয়া আমার নূরজাহান য্যান বিরাট সুখে শান্তিতে থাকে। বাপের সংসারে যা না। পাইছে জামাইর সংসারে গিয়া য্যান তাই পায়।

বসির বলল, আপনের রাজি অইয়া যাওন উচিত গাছিদাদা।

দবির অস্থির গলায় বলল, পোলার নামডাইত্তো কইতাছো না? নাম না জাইন্না রাজি অই কেমতে?

একথার ধার দিয়াও গেল না বসির। বলল, চাইলে বিলের এক-দেড় কানি জমিন আপনেরে লেইক্কা দিবো জামাই। বাইত্তে দরকার অইলে আরেকহান চৌচালা ঘর উড়াইয়া দিবো। বাইত্তে আরেকহান ঘর না থাকলে মাইয়া জামাই যহন নাইওর আইবো, থাকবো কোন ঘরে? একঘরে হৌর হরির লগে জামাই মাইয়া থাকবো কেমতে? আপনে রাজি অইয়া যান দাদা।

দবির ততক্ষণে সহ্যের একেবারে শেষ সীমায়। গলা চড়ল তার। এত প্যাচাইল না পাইরা পোলাডা কে হেইডা আগে কও। তুমি খালি আবল তাবল প্যাচাইল পাড়তাছো। আসল কথা কইতাছো না। এই হগল কথা পরে। আগে পোলার কথা কও।

অপলক চোখে দবিরের চোখের দিকে তাকাল বসির। শীতল গম্ভীর গলায় বলল, পোলা না, সে অইলো পোলার বাপ। নাম আব্দুল মান্নান মাওলানা।

লগে লগে যেন সাত আশমানের উপর থেকে দশদিক কাঁপিয়ে ভয়াবহ শব্দে ঠাঠা (বজ্রপাত) পড়ল। সেন্টুর দোকানের চাল ফুটা করে সেই ঠাঠা সরাসরি পড়ল দবিরের মাথায়। মুখোন হাঁ করা, চোখ দুইটা অপলক। দবিরের মনে হল সেন্টুর দোকানের বেঞ্চে বসে, হাত দুইখান রাখা আছে কনুইয়ের উপর, এই অবস্থায় মরে গেছে দবির। সে এখন জীবিত না, সে এখন মৃত। সে এখন লাশ।

.

আরে ও গাছিদাদা, খাড়ন খাড়ন।

ল্যাংড়া বসিরের দিকে আর ফিরাও তাকাল না দবির। সেন্টুর দোকান থেকে বের হয়ে হনহন করে হাঁটতে লাগল। মান্নান মাওলানার জন্য নূরজাহানের বিয়ার প্রস্তাব আনছে বসির এটা শোনার পর সে আর একটা কথাও বলে নাই বসিরের লগে। ঠাঠায় মরে যাওয়া। মানুষের মতন অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল বসিরের দিকে। চোখে পলক পড়ে নাই, চোখের মণি নড়ে নাই একটুও। দমও বুঝি বন্ধ ছিল।

তারপর একসময় নিজের মধ্যে ফিরল দবির। চোখে পলক ফেলল, বড় করে দম ফেলল। আর কোনও দিকে তাকাল না, হঠাত্র উঠে দাঁড়াল। দুই-তিনখান বড় কাইক (পা ফেলা অর্থে) ফেলে প্রথমে দোকান থেকে বের হল, বের হয়ে দিকপাশ দেখল না, বাজারের পুবমুখী বড় সড়কের দিকে একই ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগল।

সেন্টু তখনও আপেল মেম্বারের রসগোল্লা পৌঁছে দিয়া ফেরে নাই। দোকানে সাঁ সাঁ করে জ্বলছে ম্যান্টেল ঝুলে পড়া হ্যাঁজাকবাতি। হ্যাঁজাকবাতির চারপাশে বিনবিন করে উড়ছে অজস্র পোকা, বাতির তাপ উত্তাপে পুড়ে মরছেও সমানে। বাতার লগে ঝুলতে থাকা হ্যাঁজাকবাতির ঠিক নীচে, পাটাতনের ওপর ধীরে ধীরে জমছে মরাপোকা।

দবিরকে এভাবে বের হয়ে যেতে দেখেই তাকে ডাকল বসির। দবির ডাক শুনল না, ফিরাও তাকাল না তার দিকে, এটা বসিরের জন্য নতুন কোনও ঘটনা না। ঘটকালির কাজে এই ধরনের অভিজ্ঞতা তার আছে। চিন্তার বাইরের পাত্র পাওয়া গেছে বা তার জন্য সমন্দ। আনছে বসির, আচমকা সেই পাত্রের কথা শুনে এরকম নির্বাক হয়ে যায় অনেক মা-বাপই। সেই ধাক্কা সামলাতে একটু সময়ও লাগে।

তা লাগুক। তাতে বসিরের কোনও অসুবিধা নাই। সে হচ্ছে কাউট্টা (কচ্ছপ)। একবার কামড় দিয়া ধরলে ছাড়াছাড়ির নাম নাই। শেষ তরি দেখে নিবে। আর নূরজাহানের লগে হুজুরের বিয়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়ার কিছু নাই। আগে আতাহারের বিয়াটা হবে তার দুই চার-ছয় মাস পর হুজুর একটা ভেক ধরবেন। আমার শইল ম্যাজম্যাজ করে, অজুর পানি আউন্নাইয়া দেওনের লেইগা একজন মানুষ লাগে, জায়নামাজ আউন্নাইয়া দেওনের লেইগা একজন মানুষ লাগে। রাইত্রে পায়ে ইট্টু তেল দিয়া দিব, বস তো আমার তেমন বেশি অয় নাই। এই বসে বউ একহান লাগে, বউ ছাড়া থাকন যায় না। নূরজাহানরে আমার পছন্দ অইছে। হ, ও আমারে অপমান করছে। শয়ে শয়ে মাইনষের সামনে আমার মোখে ছ্যাপ দিছে। ওই হগল আমি মনে রাখি নাই। অল্প বসি নাদান মাইয়া। আমার সংসারে আইলে ঠিক অইয়া যাইবো…

বাড়ির সবাই হুজুরের আসল উদ্দেশ্য বুঝবে। গ্রামের লোকেও বুঝবে। ওইসব বোঝাবুঝিতে হুজুরের কিছু যায় আসে না। তিনি তাঁর কাজটা করবেন। যেমন করে পারেন নূরজাহানকে বিয়া কইরা আনবেন। তারপর যে মুখে নূরজাহান তাঁকে থুতু দিয়েছিল সেই মুখ দিয়া যা যা করানো যায় সবই করাবেন। হুজুরের সেই প্রতিশোধ নূরজাহান ছাড়া দুনিয়ার কেউ বুঝতে পারবে না। বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। যাহ, এইরকম কাম কোনও মাইনষে করতে পারেনি?

হুজুর যে মানুষ না, হুজুর যে জানোয়ার এটা জেনে বুঝেও অনেকে বিশ্বাস করবে না।

বসির এসব বোঝে। বুঝেই কাজটা সে হাতে নিয়েছে। প্রথমদিন হুজুর যখন আতাহারের বিয়াশাদির কথা বলার পর নিজের বিয়ার কথাটা বললেন, তখনই কিছুটা অবাক হয়েছিল বসির। এই বয়সে এমন কামেলদার মানুষ আবার বিয়া করতে চাইছেন? যাঁর নাতি নাতকুড় বড় হয়ে গেছে সেই মানুষ চাইছেন আবার বিয়া করতে? তাও নূরজাহানের মতন নাতনির বয়সি একটা মেয়েকে?

বসিরের মতন ঘাঘুলোকের অবশ্য বুঝতে দেরি হয় নাই, কারণটা কী? দেশগ্রামে এত মেয়ে থাকতে নূরজাহানকেই কেন তিনি বিয়া করতে চাইছেন?

সেদিন আর কোনও কথা বলে নাই বসির। দিন কয়েক পর নিজেই গেছে হুজুরের কাছে। কাজটা করতে পারলে কতটাকা দিবেন হুজুর সেসব আলাপ করা দরকার। আর কিছু যদি অ্যাডভান্স দেন। অন্তত হাজার দুয়েক।

দু’হাজার দেন নাই হুজুর, দিছেন পাঁচশো। ওই নিয়াই কাজ শুরু করতে হবে। কাজ যত আগাবে ততই ধীরে ধীরে দুইশো-পাঁচশো করে পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে দশহাজার। তবে এর বাইরেও একটা বাণিজ্য আছে। দবির নূরজাহান আর হামিদা এই তিনজনের পিছনে যদি সমন্ধ বাবদ, অর্থাৎ তাদেরকে পটাপটির কাজে এক্সট্রা কিছু খরচাপাতি হয় সেই। খরচা হুজুর আলাদা দিয়া দিবেন। আজ এই যে দবিরের পিছনে রসগোল্লা চা আর সিগ্রেট খরচা করল বসির, এই পয়সা বসিরের পকেটের না, এই পয়সা হুজুরের। দুয়েকদিনের মধ্যেই হুজুরের বাড়িতে গিয়া, ঘটনা কতদূর আগাল, প্রস্তাব শুনে দবিরের কী অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি বয়ান করার লগে খরচের টাকাটাও নিয়া নিবে বসির। লগে কিছু ফাউও নিবে। দিনরোজে ফইজুকে নিয়েছে নাওয়ের মাঝি হিসাবে, তার একটা মজুরি ধরবে। সেই মজুরির পুরোটাই দেবে না ফইজুকে। ফইজুর নামে চল্লিশ টাকা পেলে দিবে বিশটাকা। বাকি বিশ নিজের পকেটে।

এই ধরনের কাজের মজাটাই এখানে। বিয়াশাদির কাজে যত ভেজাইল্লা কাজ হাতে আসে পয়সাও আসে তত। যত ভেজাল তত পয়সা।

এইসব হিসাব করেই হুজুরের কাজটা নিয়া নামছে বসির। দুপুরের পর থেকে দিনের পুরা সময়টা ব্যয় করে খানিক আগে আসল কথাটা দবিরকে বলতে পেরেছে। বলার পর দবিরের অবস্থা যে এরকমই হবে সেটা বসির আগেই অনুমান করেছিল। তবে ওই নিয়ে কোনও কথা না বলে, বোবা মানুষের কায়দায় হঠাই হাঁটা দিবে দবির এতটা বোঝে নাই। দবিরকে হাঁটা দিতে দেখে এজন্যই অস্থির হল। ডাকাডাকি শুরু করল। কই মেলা দিলেন গাছিদাদা? আরে খাড়ন খাড়ন। আমি আপনেরে বাইত্তে দিয়ামু নে।

দবির ফিরাও তাকাল না। আগের মতনই বড় বড় কাইকে হাঁটতে লাগল।

বসির তার ল্যাংড়া পা টেনে যত দ্রুত সম্ভব সেন্টুর দোকান থেকে বের হল। আগের মতনই ডাকতে লাগল দবিরকে। আরে অইলো কী আপনের? বাইত যাইবেন কেমনে? খাড়ন আমি আইতাছি। আমিই বাইত্তে দিয়ামু নে?

না দবির আর দাঁড়াল না, দবির আর ফিরাও তাকাল না। পুবমুখী হাঁটছে তো হাঁটছেই। আকাশে চারভাগের একভাগ চাঁদ উঠেছে। চাঁদের তলা দিয়া ভেসে যাচ্ছে শ্রাবণ সন্ধ্যার মেঘ। কখনও একটুখানি ফুটছে জ্যোত্সা আবার আবছা অন্ধকারে ভরে যাচ্ছে চারদিক। আলোছায়ার এই খেলার ভিতর দিয়া বড় সড়কের দিকে উধাও হয়ে গেল দবির গাছি। অনেক ডাকাডাকি করেও তাকে ফিরাতে পারল না বসির। শেষমেশ আশা ছেড়ে দিল। খুবই বিরক্ত হয়ে একটা গাল দিল দবিরকে। যা শালার পো শালা, গোয়া মারা গিয়া। একদিকে হুজুরে লাগছে তর মাইয়ার পিছে আরেক দিকে লাগছি আমি। আমগো তো চিনছ না? বাপ ডাকাইয়া ছাড়ম নে। পায়ে ধইরা কাইন্দা কূল পাবি না নে! হুজুরের কাছেঐ মাইয়া বিয়া দেওনের লেইগা পাগল অইয়া যাবি নে! এই হগল কাম কেমতে করতে অয়। হেই বেয়ত (কায়দা) আমার জানা আছে।

এসময় কালিরখিলের দিক থেকে হেঁটে এল সেন্টু। দোকানে ঢুকতে গিয়া দেখে বসির দাঁড়িয়ে আছে বাইরে আর দবির গাছি নাই। তেমন অবাক সে হল না। হাসিমুখে বলল, কী অইছে ঘটক? বাইরে খাড়াইয়া রইছো ক্যা? গাছি কো?

হেয় গেছে গা। আমি খাড়ই রইছি তোমার টেকা দেওনের লেইগা। চা রসোগোল্লার দাম নিবা না?

ওইডা তো নিমুই। না নিলে খামু কী?

বসির পকেটে হাত দিল। তয় কও দেহি, কয় টেকা অইছে?

টাকার কথা বলার আগে সেন্টুর ইচ্ছা হল বসিরকে একটু ঘাঁটিয়ে দেখে গাছিকে এত খাতির করে চা মিষ্টি সিগ্রেট খাওয়াবার অর্থ কী? গাছির মেয়ে নূরজাহান ডাঙ্গর হয়েছে। নূরজাহানের বিয়ার সমন্ধ আনছেনি বসির? আইন্না থাকলে পোলাড়া কে? বাড়ি কোন গেরামে? মাইয়া দেখতে গাছির বাইত্তে কবে আইবো তারা?

কথাগুলি বলল না সেন্টু। অতি উৎসাহ খারাপ জিনিস। খারাপ জিনিস মনে চাইপা রাখাই ভাল।

সেন্টু হাসিমুখে বলল, দুই টেকা কইরা চাইরহান রসোগোল্লা অইলো আট টেকা আর দুই কাপ চা দুই টেকা। বেশি না ঘটক, বিল অইছে দশ টেকা।

সেন্টুর হাতে দশ টাকার একটা নোট দিল ল্যাংড়া বসির।

.

মাওয়ার বাজার থেকে পুবদিকে হেঁটে এলে, কুমারভোগের মুখে একটা কবরস্থান।

কবরস্থানের ওখান থেকে সোজা উত্তরে চলে গেছে সড়ক। এদিকটায় এখনও শেষ হয় নাই মাটি ফেলার কাজ। বেশ অনেকটা জায়গা ভাঙন। সেখানে থইথই করছে বর্ষার পানি। এইমাত্র একেবারেই পরিষ্কার হয়েছে আকাশ। চাঁদের তলা দিয়া কবুতরের মতন উড়াউড়ি করছিল শ্রাবণের মেঘ। সাদা আর ছাই বর্ণের মিশেল দেওয়া মেঘ। ঘোরকালো মেঘ হলে চাঁদ একেবারেই ঢাকা পড়ত। অন্ধকারে ডুবে যেত ত্রিভুবন। সাদা আর ছাই বর্ণের মিশেল দেওয়া মেঘ অতটা কাবু করতে পারে নাই চাঁদের আলো। এই ফুটফুট করে জ্যোৎস্না, এই একটুখানি অন্ধকার। চাঁদ আর মেঘের সেই খেলাটা শেষ হয়েছে। এখন আকাশ গিরস্তবাড়ির হোরা (ঝাড় দেওয়া) উঠানের মতন সাফসুতরা। গন্ধরাজ ফুলের মতন জ্যোত্সা চারদিকে। ভাঙনের দিককার পানিতে জ্যোৎস্না পড়ে ঝিলমিল ঝিলমিল করছে। দক্ষিণের পদ্মা থেকে হু হু করে আসছে মায়া মমতার মতন হাওয়া।

সেন্টুর দোকান থেকে বের হয়ে সোজা এদিকটায় হেঁটে আসছে দবির। পিছনে ল্যাংড়া বসির আবালের মতন ডাকাডাকি করছিল, দবির ফিরাও তাকায় নাই। যে সমন্ধ নূরজাহানের জন্য বসির আনছে, ওইকথা শোনার পর সেই মানুষের ডাক আর শোনা যায় না, সেই মানুষের দিকে আর ফিরা তাকানো যায় না।

এরকম সমন্ধ বসির আনল কী করে? মান্নান মাওলানা হবে নূরজাহানের জামাই? কয় কী? নূরজাহানের বাপ দবিরের বাপের বয়সি লোক মান্নান মাওলানা। আর নূরজাহান অইলো চৌদ্দ-পোনরো বচ্ছরের মাইয়া! ঘটকার পোয় এইডা কইলো কী?

বসিরের মুখে বারোপদের কথা শুনতে শুনতে দবির যখন অস্থির, শেষমেশ বসির যখন মান্নান মাওলানার কথা বলল, দবিরের মাথায় সেন্টুর দোকানের চাল ঘেঁদা কইরা ঠাঠা পড়ল। ঠাঠায় দবির কিছুক্ষণের জন্য মারাও গেল। মাথা অচল অইলো দবিরের, চিন্তা ভাবনা অচল অইলো। ভোন্দার মতন (হতভম্বের মতো) অনেকক্ষণ চাইয়া রইল ঘটকার মিহি। তারবাদে আথকাই বাইর অইলো সেন্টুর দোকান থিকা। বড় বড় কাইক দেওনের পর এই ভাঙ্গনমিহি আইয়া, আশমানের চান আর গাঙ্গের হাওয়া, দবির ধীরে ধীরে নিজের মধ্যে ফিরল। মাথা পরিষ্কার হল তার, চিন্তা চেতনা আগের জায়গায় ফিরা আসলো।

তয় দবির এখন বাড়ি যাবে কী করে? এই এতটা পথ, নৌকা ছাড়া উপায় কী?

বসির ডাকাডাকি করছিল পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ওরকমই কথা ছিল। যে পাত্রের জন্য নূরজাহানের সমন্ধ আনছে শালার পো শালায়, মইরা গেলেও অর নাওয়ে আমি উড়ুম না। অর মুখ আমি আর দেহুম না। দরকার অইলে পানি ভাইঙ্গা বাইত্তে যামু, হাতরাইয়া যামু, তাও বইচ্ছা শুয়োরের পো’র লগে যামু না।

শার্ট খুলে পাগড়ির মতন মাথায় বাঁধল দবির। বেশ শক্ত করে বাঁধল। লুঙ্গি খুলে নতুন করে বাঁধল মাজায়, তারপর যতটা শক্ত করে কাছা দেওয়া যায়, দিল। দিকপাশ আর তাকাল না, খলবল খলবল করে ভাঙনের পানিতে নামল।

এটা ঘুরপথ। ঘুরপথেই যাবে দবির। মালেক দরবেশের বাড়ির ওদিক দিয়া গেলে পথ অনেকটা কমত। না ওদিকে যাবে না সে। ওদিকটায় ঘটকার কোষানাও লইয়া বইয়া রইছে। ফইজু। ফইজুর সামনে কোষায় না উইঠা পাইনতে নামছে দবির, হাতাইয়া বাইত যাইবো, ফইজু মনে করবো কী? ওয় তো আর ঘটনা জানে না। দবিররে পাইনতে নামতে দেখলেঐ চিল্লাচিল্লি শুরু করবো। করতাছেন কী গাছিদাদা? ওডেন, নায়ে ওডেন। ঘটকে না কইলো আপনেরে আমরা বাইত্তে দিয়ামু!

বর্ষার পানিতে দবিরের তখন হাঁটু ডুবছে, মাজা ডুবছে। মাজা ছাড়িয়ে বুক, বুক ছাড়িয়ে গলা। পায়ের তলা থেকে সরে যাচ্ছে মাটি। পানি, শরীরের তিনদিকে শুধু পানি। মাথার উপরকার পরিষ্কার আকাশ যেন তাকিয়ে আছে দবিরের দিকে, চাঁদ যেন টর্চলাইটের মতন জ্যোৎস্নাটুকু ফেলেছে শুধুই দবিরের উপর।

দবির আস্তে ধীরে সাঁতরাতে লাগল। অনেকটা দূরপথ, আস্তে ধীরে না সাঁতরালে শরীর ক্লান্ত হবে, অচল হবে। বাড়ি তরি যাইতে জান বাইর অইয়া যাইবো।

দিনভর তেমন রোদ ছিল না বলে, এই খানিক কোদাইল্লা বৃষ্টি, এই একটুখানি রোদ, আবার আকাশের মুখ গোমড়া, আকাশ আর মেঘের এইসব কায়কারবারে বর্ষার পানি গরম হওয়ার সুযোগ পায় নাই। শীতকালের দুপুরবেলার মতন কোমল মোলায়েম পানি। এই পানিতে শার্ট প্যাচানো মাথাটা শুধু জাগিয়ে দবির ধীরে ধীরে সাঁতার কাটছে। সড়কের পার ঘেঁষে অনেকটা জায়গা পরিষ্কার। এই জায়গা থেকে মাটি কেটে তোলা হয়েছে। সরকারের একোয়ার করা জমি। খাইও (গভীরও বেশি। এই জায়গা দিয়া সাঁতরে যাওয়ার সুবিধা হল ঘাস বিচালি বলতে কিছু নাই জায়গাটায়। ধইনচা কাইশ্যা কিছু নাই। আরামছে সারানো যাচ্ছে। চকের ভিতর দিয়ে সাতরাতে হলে কখনও পড়ত ধইনচা খেত, কখনও কাইশ্যা। আর নয়তো অন্যান্য ঘাস কচুরি। কচুরি অবশ্য দুই-চারটা এদিকটায়ও আছে। তাতে কোনও অসুবিধা নাই। ওইটুকু কচুরিতে সাঁতার কাটতে কষ্ট নাই।

পানির কোমলতায়, পরিষ্কার আকাশ, চাঁদের আলো আর নদী থেকে উড়ে আসা হাওয়ায় সাঁতরাতে সাঁতরাতে দবির এখন নূরজাহানের কথা ভাবছে। মান্নান মাওলানা আর ল্যাংড়া বসিরের কথা ভাবছে। নূরজাহানের জন্য বসির মান্নান মাওলানার সমন্দ আনছে শোনার পর মনে হয়েছিল দোষটা বসিরের। এইরকম সমন্দ ঘটকা শালার পো শালায় আনতে পারে না। আমি গাছি মানুষ। গরিব। তয় না খাইয়া তো থাকি না। খালি একহান মাইয়া আমার। মাইয়া ডাঙ্গর অইতাছে, অর বিয়াশাদির চিন্তা আমার আছে। টেকাপয়সা কিছু মাইয়ার লেইগা জমাইছি। মাইয়ার বিয়া ঠিক অইলে দেশগেরামের মাইনষেও তো কিছু সাহাইয্য করবো! দেলরা বুজির বইনপো আছে এনামুল, সেয় দিবো কিছু। খাইগোবাড়ির মাইনষে দিব। বিয়া ভালয় ভালয় অইয়া যাইবো। আইটকা গেলে দশগন্ডা জমিনের অর্ধেক বেইচ্চা হালামু, দরকার অইলে বেবাকহানি বেইচ্চা হালামু। মাইয়াডা ছাড়া আমার আর আছে কে। অর বিয়াশাদি অইয়া গেলে সংসারে খালি আমি আর নূরজাহানের মায়। দুইজন মাইনষের দিন কাইট্টা যাইবো। এই অবস্তায় ঘটকা শালার পো শালায় এইডা কেমুন সমন্দ আনলো?

ল্যাংড়া বসিরকে নিয়া এরকম একটা ঘোরের মধ্যে পড়েছিল দবির। এই ঘোর এখন চট করেই কেটে গেল। না, এইডা ঘটকার দোষ না! অরে পাডাইছে হুজুরে! নূরজাহান তার মোখে ছ্যাপ দিছিলো, দেলরা বুজিরে ধইরা, এনামুলসাবরে ধইরা ওই ঘটনা মিটমাট করছে দবির। হুজুরে কইয়া দিছে, নাদান মাইয়া, ভুল কইরা হালাইছে, আমি অরে মাপ কইরা দিলাম। হায় হায় ওইডা তো শালার পো শালায় উপরে উপরে করছে! ভিতরে ভিতরে অর ক্ষার (রাগ) নূরজাহানের উপরে রইয়া গেছে! হেই ক্ষার মিটানের লেইগা শুয়োরের পোয় এই পথ ধরছে! বিয়া কইরা একবার যুদি নূরজাহানরে অর বাইত্তে নিতে পারে, জিন্দেগিভর মাইয়াডার ছ্যাপ দেওনের শোধ লইবো! আমার মাইয়ার জানডা কুত্তার পো কুত্তায় খাইয়া হালাইবো! হায় হায় এই আজরাইলের হাত থিকা মাইয়াডারে অহন কেমতে বাঁচামু আমি? হায় হায়! নূরজাহান আর নূরজাহানের মা’য় তো এই কথা হোনলে ডরে মইরা যাইবো! একবার হুজুরের হাত থিকা নূরজাহানরে আমরা বাঁচাইছি, এইবার বাঁচামু কেমতে? হায় হায়!

ভয়ে আতঙ্কে হাত-পা অচল হয়ে আসতে চায় দবিরের, শরীর নড়তে চায় না। পানিতে ডুবে মরে যাওয়া মানুষের লাশের মতন ভেসে থাকে সে। বাড়ি এখনও অনেক দূর। এতটা পথ যেতে পারবে তো দবির! নাকি তার আগেই পানিতে ডুবে মরে যাবে! রাতেরবেলা কেউ কিছু টের পাবে না, সকালবেলা মেদিনীমণ্ডল আর কুমারভোগের মাঝখানকার চকে ভাসতে দেখা যাবে তার লাশ। মাথায় বাধা নীল শার্টটা তখনও হয়তো বাধাই আছে। পানিতে ভিজে প্যাঁচটা আরও শক্ত হয়েছে।

ভয় আতঙ্ক কেটে দবিরের তারপর অদ্ভুত এক কষ্ট শুরু হয়। আমি তো কোনওদিন কেঐর কোনও ক্ষতি করি নাই। জাইন্না শুইন্না কেঐর মনে কষ্ট দেই নাই, কোনও গুনার কাম করি নাই। তয় আমার মাইয়ার জীবনডা এমুন অইলো ক্যা? মা-বাপের গুনা পোলাপানের উপরে পড়ে। আমি আর নূরজাহানের মা’য় কী এমুন গুনা করছি যেই গুনা পড়লো আমার নূরজাহানের উপরে? যেই গুনায় নূরজাহানের জীবনে একটার পর একটা ফাড়া (বিপদ) আইতাছে? এক ফাড়াথিকা অরে আল্লায় বাঁচাই দিছে, উপরে আল্লাহতালা নীচে মানুষের অছিলা, বড় একহান ফাড়া কাটছে নূরজাহানের। হায় হায়, বছর ঘুরতে না ঘুরতে আবার কোন ফাড়া আইলো মাইয়াডার? এই ফাড়াত থন অরে আমি অহন কেমতে বাঁচামু? এইবার আমি কার কাছে যামু? নূরজাহানের মা’য় এই কথা হোনলে পাগল অইয়া যাইবো, নূরজাহান। ডরে মরবো? হায় হায়, আমি অহন কী করুম আল্লাহ, আমি অহন কী করুম?

চাঁদের আলো তখন আরও প্রখর হয়েছে, নদী থেকে ভেসে আসা হাওয়া হয়েছে আরও জোরালো। বর্ষার খোলা চকমাঠ আর মাথার উপরকার শ্রাবণ রাতের আকাশ যেন গভীর আনন্দে ভরে গেছে। প্রকৃতির এই মনোরম আনন্দে এক অসহায় দুঃখী মানুষ টেটার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে কোনওরকমে বেঁচে থাকা শোলমাছের মতন ভাসতে ভাসতে যায় তার ঘরগিরস্তির দিকে। সেই মানুষের চোখের পানি মিলেমিশে যায় বর্ষার পানির লগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *